তপ্ত শয্যায় শব্নমের গায়ে ঈষৎ শিহরণ। অচ্ছেদ সরসী নীরে রমণীর কম্পন?
মোতির মালাটি গলাতেই আছে। আমি সেটি দানা দানায় অল্প অল্প ঘোরাতে ঘোরাতে একটা লকেটে হাত ঠেকল। বললুম, এর ভিতরে কিছু আছে?
চুপ।
আমি মালা ঘোরানো বন্ধ করে তার বুকের উপর হাত রেখে চুপ করে রইলুম।
হঠাৎ লেপ সরিয়ে উঠে পড়ল ঘরের কোণের অতিশয় ক্ষীণ শিখাটির দিকে। আমি দেখতে পেলুম, যেন ঝরে উড়ে গেল একটি গোলাপ ফুল, তার দীর্ঘ ডাঁটাটির চতুর্দিকে আলুলায়িত, হিল্লোলিত অতি সূক্ষ্ম, অতি ফিকে গোলাপী মসলিন। ক্ষীণালোকে তার প্রতিটি অঙ্গ দেখা যাচ্ছে, দেখা যাচ্ছেও না।
আলো জোর করে দিয়েছে। এখন প্রতি অঙ্গ-। আমি চোখ বন্ধ করলুম।
আমার পাশে শুয়ে লকেটটি খুলে আমার হাতে তুলে দিয়ে বললে, এই আমার শেষ গোপন ধন। এবারে আমি নিশ্চিন্ত হব।
খুলে দেখি আমারই একটি ছোট্ট ফটো! অবাক হয়ে শুধালুম, ‘এ তুমি কোথায় পেলে?’
বললে, চোখের জলে নাকের জলে।
‘সে কি?—এতদিনে বুঝলুম, শব্নম কেন কখনও আমার ছবি চায় নি।’
আব্বা ইংরেজী কাগজ নেন—হিন্দুস্থানী। জশ্নের কয়েকদিন পরে তারই একটাতে দেখি পরবের সময় ব্রিটিশ লিগেশনে আর কাবুল টীমে যে ক্রিকেট ম্যাচ হয়েছিল তারই খান দুই তিন ফটো। কান্দাহার থেকে লিখলুম ওই কাগজকে ছবিটার কন্টাকট্ প্রিন্ট পাঠাবার জন্য। মূল্যস্বরূপ পাঠালুম, এ দেশের কয়েকখানা বিরল স্ট্যাম্প-বিদেশে পয়সা পাঠানো যে কী কঠিন সেই জ্ঞান হলো চোখের জলে নাকের জলে! সন্ত্বনা এই, যে লোকটার হাতে চিঠিখানা পড়েছিল সে নিশ্চয়ই স্ট্যাম্প বোঝে। আমাকে অনেক আবোল তাবোল ছবির মাঝখানে ওই ছবিও পাঠালে খান তিনেক। তোমার ছবি তুলে নিয়ে লকেটে পুরে দিলুম। হল?
আমি কি বলব? আমি তার মুক্তামালা রুদ্রাক্ষের শেষ প্রান্তের ইস্টমন্থ!
দিনযামিনী সায়ন্প্রাতে শিশির বসন্তে বক্ষলগ্ন হয়ে এ শুনেছে শব্নমের আকুলতা ব্যাকুলতা প্রতি হৃদয়স্পন্দনে। একে সিক্ত করে রেখেছে শব্নমের অসহ্য বিরহশর্বরীর তপ্ত আঁখিবারি।
আমি কল্পনা করে মনে মনে সে ছবি দেখছি, না শব্নম কথা বলেছে? দুটোর মাঝখানে আজ আর কোনও পার্থক্য নেই। কিংবা তার না-বলা ব্যথা যেন কোন্ মন্ত্রবলে শব্দতরঙ্গ উপেক্ষা করে তার হৃদস্পন্দন থেকে আমার হৃদস্পন্দনে অব্যবহিত সঞ্চারিত হচ্ছে। কান্ঠাশ্লেষে বক্ষালিঙ্গনে চেতনা চেতনায় এই বিজড়ন অন্য রজনীর তৃতীয় যামে আমা দোহাকার জ্যোতির্ময় অভিজ্ঞান, অপূর্বলব্ধ বৈভব।
কত না সোহাগে কত না গান গুনগুন করে শব্নম সে রাত্রে আমাকে কানে কানে শুনিয়েছিল। লায়লী মজনূঁর কাহিনী।
বাঙালী কীর্তনিয়া যে রকম রাধামাধবের কাহিনী নিবেদন করার সময় কখনও চণ্ডীদাস, কখনও জগদানন্দ, কখনও জ্ঞানদাস, কখনও বলরাম দাস, বহু পূষ্প থেকে মধু সঞ্চয় করে অমৃতভাণ্ড পরিপূর্ণ করে, শবনম্ ঠিক তেমনি কখনও নিজামী, কখনও ফিরদৌসী, কখনও জামী, কখনও ফিগানী থেকে বাছাই গান বের করে তাতে হিয়ার সমস্ত সোহাগ ঢেলে দিয়ে আমাকে সেই সুরলোকে উড়িয়ে নিয়ে গেল যেখানে সে আর আমি শুধু দুজনা, যেখানে কপোতী কপোতকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় ঊধ্বর্তর গগনাঙ্গনে।
কপোত-কপোতী দিয়েই সে তার কীর্তন আরম্ভ করেছিল। বয়ঃসন্ধিক্ষণে মুকুলিকা লায়লী পুষেছিল কপোত-কপোতী। যৌবন দেহলিপ্রান্তে সে কপোত-কপোতীকে দেখে আধো আধো বুঝতে শিখলে প্রেমের রহস্য।
দেহ তখন আর লায়লীর সৌন্দর্য ধরে রাখতে পারছে না। ওষ্ঠাধর বিকশিত হয়ে ডেকে এনেছে প্রথম ঊষার নীরব পদক্ষেপে গোলাপী আলোর অবতরণ। তারই দুপাশে শুভ্র শর্করার মত তার বদন ইন্দুর বর্ণচ্ছটা, কিন্তু কপোল দুটির লালিমা হার মানিয়েছে বর্ষা শেষের রক্তাক্ত সূর্যাস্তকে। রক্ত কপোল আর শূভ্র বদনপ্রান্তের মাঝখানে একটি কজ্জলকৃষ্ণ তিল, যেন হাবশী বালক লাল গালের গোলাপ বাগানের প্রান্তদেশে খুলেছে শুভ্র শর্করার হাট। সে বালক তৃষিত। তারই পাশে লায়লীর গালের টোলটি। সে যেন আব্-ই-হায়াৎ, অম্তবারির কূপ-অতল গভীর হতে উৎসারিত হচ্ছে অমৃতসুধা। স্মিত হস্যের সামান্যতম নিপীড়নে উৎসমূলে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তারই সৌন্দর্য প্লাবিত করে দেয় তার গুল-বদন, ফুল্ল বল্লরী। সমুদ্রকুমারীর চোখের জল জমে গিয়ে সমুদ্রগর্ভে আশ্রয় নেয় যে মুক্তা সে-ই এসে আলোর সন্ধান পেয়েছে লায়লীর ওষ্ঠাধরের মাঝখানে। সে ওষ্ঠে আমন্ত্রণ, অধরের প্রত্যাখ্যান-মজনুঁর ওষ্ঠাধর যেদিন এদের সঙ্গে সম্মিলিত হবে সেদিন হবে এ রহস্যের চুড়ান্ত সমাধান।
তরুণ রাজপুত্র কয়েস দূর হতে প্রথম দর্শনেই অভিভূত হয়ে আকুলি-বিকুলি করে কি ভাব প্রকাশ করতে চেয়েছিল সে তার বাল্যসখাও বুঝতে পারে নি। সর্পদষ্টাতুরকে আত্মজন যে রকম স্বগৃহে নিয়ে আসে, সখা সেইরকম কয়েসকে নিয়ে গেল আপন দেশে।
অন্তঃপুরবাসিনী অসূর্যম্পশ্যা লায়লীকে প্রেমের পুকার, হৃদয়ের আহ্বান পাঠাবে কয়েস কি করে?
এখানে এসে শব্নম যে কাহিনী বর্ণনা করল তার সঙ্গে আমাদের নল-দময়ন্তী কাহিনীর প্রচুর সাদৃশ্য আছে। পার্থক্য শুধু এইটুকু যে হৃদয়ের কন্দর্পভর ধারণে অসমর্থ নলরাজ কুসুমায়ুধের অগ্রদূত রূপে পাঠিয়েছিলেন বন্য-হংসকে, আর শব্নমের কাহিনীতে কয়েস লায়লীর নবশ্যামদূর্বাদল-বক্ষতলে পালিত কপোতকে বন্দী করে তার ক্ষীণপদে বিজড়িত করে পাঠিয়েছিল প্রেমের লিখন।
কি উত্তর দিয়েছিল লায়লী? কে জানে? কিন্তু আরব ভূমিতে আজও তাবৎ দরদী-হিয়া, শুষ্ক-হৃদয়, সবাই জানে, সেই দিন থেকে লায়লীর চোখে দেখা দিল এক অদ্ভুত জ্যোতি-ক্ষণে ক্ষণে কারণে অকারণে তার চোখে হিল্লোলিত হতে লাগল এক অদৃষ্ট-পূর্ব বিদ্যুল্লেখা।
রাজপ্রাসাদ থেকে যে দেওদার সারি চলে গেছে মরুভূমির প্রত্যন্ত প্রদেশ পর্যন্ত তারই শেষে ছিল ঝরনা ধারা। এ দেওদার সুদূর হিমালয় থেকে আনিয়েছিলেন লায়লীর এক পূর্বপুরুষ। কিংবদন্তী বলে, শস্যশ্যামল-সজল বনভূমির শিশু দেবদারু একমাত্র তাঁরই সোহাগ মাতৃস্তন্য পেয়েছিল বলে এই অস্থিশুষ্ক থরভূমিতে প্লবঘন বীথিকা নির্মাণ করতে পেরেছিল।
আর সেই ঝরনার জল আনতে যেত নগরীকার কারীগণ।
যুগ যুগ ধরে তরুণ প্রেমিকা দেওদার গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে বেণু রবে, কখনও বা গানে গানে প্রেমের আহ্বান পাঠিয়েছে প্রেমিকাকে।
দেবদারু অন্তরালে মরুভূমির সুদূর প্রান্তে ধীরে ধীরে উঠেছে পূর্ণচন্দ্র। দীর্ঘ দেবদারুর ছায়ায় ছায়ায় যেখানে আলোছায়ার কম্প্রমান বেপথু আলিঙ্গন তারই পাশে গা মিশিয়ে দিয়ে মজনূঁ উদ্বাহু হয়ে ধীরে স্থির কষ্ঠে লায়লীকে আহ্বান জানাচ্ছে অদৃশ্য গীতাঞ্জলি স্তবকে স্তবকে নিবেদন করে।
এ আহ্বান জনগণের সুপরিচিত কিন্তু আজ সন্ধ্যার এ আহ্বান যে রহস্যময় মন্ত্রশক্তি নিয়ে বসন্ত সমীরণের চঞ্চলমুখরতা মৌন করে দিল, দেবদারুপল্লবদল স্তম্ভিত করে দিল সে যেন ইহলোকবাসী মর মানবের ক্ষণমুখর হৃৎপিণ্ড স্পন্দনজাত নয়। গৃহে গৃহে বাতায়ন বন্ধ হল। হর্ম্যশিখর থেকে নাগর নাগরী দ্রুতপদে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করল। বৃদ্ধেরা মক্কার উদ্দেশে মুখ করে আকাশের দিকে দুহাত তুলে প্রার্থনায় রত হলেন।
কার ওই ছায়াময়ী অশরীরী দেহ? কার হৃদয় ছুটে চলেছে দেহের আগে আগে ওইখানে, যেখানে ঊর্ধ্বে উচ্ছ্বসিত উৎসধারা বিগলিত আলিঙ্গনে সিক্ত করে দিচ্ছে দেবদারুদ্রুমকে?
চৈতন্যের পরপারে জরামর অন্তহীন আলিঙ্গন।
বেহেশৎ ত্যাগ করে ফিরিশতাগণ তাঁদের চুম্বনের মাঝখানে এসে আপন চিন্ময়রূপ বিগলিত করে দিলেন।
সংস্কারমুক্ত জনও প্রিয়াসহ তাজমহল দর্শনে যায় না। যমুনা পুলিনের কিংবদন্তী বলে, হংস-মিথুন পর্যন্ত বৃন্দাবন বর্জন করে-তাজমহলের উৎসজল এক সঙ্গে পান করে না। যমুনা বিরহের প্রতীক। অপিচ, বাসরঘর প্রথম মিলনকে চিরজীবী করে রাখতে চায়। সেখানে বিরহগাথার ঠাঁই নেই। শব্নম অতি সংক্ষেপে ক্ষীণ কাকলিতে লায়লী মজনূঁর সে কাহিনী ছুঁয়ে গেল-কনিষ্ঠা যে রকম ভ্রাতৃদ্বিতীয়ার দিনে তার কনিষ্ঠতম ভীক অঙ্গুলি দিয়ে গ্রামভারি সর্বাগ্রজের কপালে তিলক দেয়।
বর্ষাভোরের ঘন মেঘ হঠাৎ কেটে গেলে যে রকম শত শত বিহঙ্গ বনস্পতিকে মুখরিত করে তোলে ঠিক সেই রকম অকস্মাৎ বিচ্ছুরিত হল শব্নমের আনন্দ গান।
মর্ত্যের ধূলার শরীর আর মৃত্যুঞ্জয় প্রেমকে ধরে রাখতে পারল না। দ্বিগলয়প্রান্ত থেকে যে রামধনু উঠেছে মধ্য-গগনের স্বর্গদ্বার প্রান্ত পর্যন্ত তারই উপর দিয়ে হাত ধরাধরি করে লায়লী মজনূঁ চলেছে অমর্ত্যলোকে। কখনও গহন মেঘমায়া, কখনও তরল আলোছায়ার মাঝে মাঝে, কখনও চূর্ণ স্বর্ণরেণু সূর্যরশ্মি কণা আলোড়িত করে, কখনও ইন্দ্রধনুর ইন্দুনিভ বর্ণাবন্যায় প্রবাহমান হয়ে তারা পৌঁছল স্বর্গদ্বারে। জয়ধ্বনি বেজে উঠেছে বেহেশতের আনন্দাঙ্গানে। পরিপূর্ণ প্রণয়-প্রতীক স্বর্গ হতে দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর সেখানে প্রত্যাবর্তন করছে অনিন্দ্য, নবজন্ম নিয়ে, মরজীবনের জীর্ণ বাস ত্যাগ করে, সুরলোকের অসম্পূর্ণতা সর্বশ্রীময় করে দিতে।
সে কী ছবি! চতুর্দিকের স্ত্রী ফিরিশতাগণের চোখে পলক পড়ছে না। দিব্যজ্যোতি ধারণ করে লায়লী মজনূঁ বসে আছেন মুখোমুখি হয়ে। ফিরিশত-প্রবীণ জিব্রাইল তাঁদের সম্মুখে ধরেছেন পানপাত্র-আল্লাহতালা কুরান শরীফে যে শরাবুনতহূরা দেবেন বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে আছেন তাই জিব্রাইলের হাত থেকে তুলে নিয়ে লায়লী এগিয়ে ধরেছেন মজনূঁর সামনে। দিব্যজ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে সে সুধাপাত্র হতে।
চতুর্দিকে মধুর হতে মধুরতর সঙ্গীত :
হে প্রেম, তুমি ধন্য হলে লায়ণী মজনঊঁর বক্ষমাঝে স্থান পেয়ে!
হে প্রেম, তুমি অমরত্ব পেলে লায়লী মজনূঁর মৃত্যুর ভিতর দিয়ে।
খুদাতালার সিংহাসন থেকে ঐশীবাণী উচ্চারিত হল :
হে সুরলোকবাসীগণ! প্রেমের দহন দহন দাহে হয়ে অর্জন করেছ তোমরা সুরলোকের অক্ষয় আসন।
হে মর্ত্যবাসীগণ! সর্বচৈতন্য সর্ব কল্পনার অতীত যে মহান সত্ত্বা তিনি তার বিশ্বরূপ ব্রাহ্মণ্ডস্বরূপের একটি মাত্র রূপ প্রকাশ করেছেন মর্ত্যলোকে-তাঁর প্রেমরূপ।