নবম পাঠ
মোহ নিদ্রায় মায়া ও ভ্রম উৎপাদন
পাত্র মেসমেরিক নিদ্রায় অভিভূত হওয়ার পর, তাহার মনে হিপ্নোটিজমের ন্যায় নানা প্রকার মায়া ও ভ্রম উৎপাদন করিবার প্রয়াস পাইবে। যখন বুঝিতে পারিবে যে, সে মোহ নিদ্রায় তৃতীয় স্তরে উপনীত হইয়াছে, তখন সম্মোহনবিৎ স্বীয় মনের সহিত তাহার মনের ঐক্য বৃদ্ধি করিবার জন্য পাস ও আদেশ দ্বারা তাহার নিদ্রা আরও একটু গভীর করিয়া তাহাকে ঐ অবস্থায় একটু সময় থাকিতে দিবে, পরে তাহাকে চক্ষু খুলিতে বলিয়া অর্ধ সজ্ঞানাবস্থায় আনিবে। এই অবস্থায় তাহাকে স্পর্শ করিলে বা তাহার সহিত কথা-বাৰ্তা কহিলেই সে অর্ধসজ্ঞান হইবে। তখন বাহ দৃষ্টিতে তাহাকে সজাগ বলিয়া বোধ করিলেও সে অর্ধ-মোহ নিদ্রাচ্ছন্ন বলিয়া বুঝিবে। এই অবস্থায়ই কাৰ্যকারক তাহার মনে পঞ্চ-জ্ঞানেন্দ্রিয়ের নানা প্রকার মায়া ও ভ্রম সৃষ্টি করিবে।
ইচ্ছাশক্তি পূর্ণ মানসিক আদেশ দ্বারাই মায়া সৃষ্টি করিবে; কিন্তু যদি আবশ্যক হয়, তবে উহার সহিত খুব অল্প কথায় দুই-একটি মৌখিক আদেশও প্রদান করা যাইতে পারে। যে বস্তু বা বিষয় সম্বন্ধে মায়া জন্মইতে ইচ্ছা করিবে, তাহা অগ্রে খুব একাগ্র মনে চিন্তা করতঃ পাত্রের মনে প্রেরণ করিবে অর্থাৎ উক্ত চিন্তা বা ভাবটি তাহার মনে প্রতিফলিত হউক এরূপ ইচ্ছা করিবে। কাৰ্যকারক সুবিধা মনে করিলে তজ্জন্য হিপ্নোটিজমের প্রণালীও অবলম্বন করিতে পারে। এক টুকরা গোলাকার পিবোর্ড, মোটা কাগজ বা একটা গাছের পাতা লইয়া উহাকে লুচি বলিয়া একটু সময় চিন্তা করিয়া, পরে ইহা পাত্রের হাতে দিয়া বলিবে—“এই দেখ, একখান সুস্বাদু লুচি! এই লুচিখানা খাইয়া ফেল!” কিম্বা তাহার সামনে একখানা লাঠি বা একগাছা দড়ি ফেলিয়া রাখিয়া উহাকে সাপ বলিয়া একটু চিন্তা করার পর বলিবে- এই দেখ, তোমার সম্মুখে মস্ত একটা সাপ পড়িয়া রহিয়াছে।” অথবা তাহার দাতের বেদনা হইয়াছে এরূপ চিন্তা করিয়া নিজের হাত দ্বারা তাহার গালের কোন এক স্থানে টিপিয়া দিয়া বলিবে—“তোমার এই স্থানের দাত গুলিতে বড় বেদনা হয়েছে, তোমার বড় যন্ত্রণা বোধ হচ্চে!” ইত্যাদি। এই রূপ ইচ্ছামাত্র তাহার মনে যে কোন প্রকার মায়া সৃষ্টি করিতে পারা যায়। উৎপাদিত মায়াটি তাহার মন হইতে বিদূরিত করিতে এক গ্রমনে এইরূপ চিন্তা করিবে যে উহা দূরীভূত হউক। আবশ্যক হইলে তৎসঙ্গে “সেরে গেছে—সব সেরে গেছে” বলিয়া মৌখিক আদেশও দেওয়া যায়। তৎপরে তাহার মনে ভ্রম সৃষ্টি করিবে। তজ্জন্য তাহাকে কয়েকটি পাস দ্বারা আরও গভীর নিদ্রায় অভিভূত করণওর এই অবস্থায় কিছুক্ষণ থাকিতে দিবে। ইহাতে তাহার মনের সহিত পাত্রের মনের ঐক্য আরও বৰ্দ্ধিত হইবে এবং তাহার মন সহজেই কাৰ্যকারকের মানসিক আদেশের সাড়া দিবে। এইক্ষণ তাহাকে চক্ষু খুলিতে বলিয়া পূর্বের ন্যায় অর্ধ সজ্ঞানাবস্থায় আনয়ন করিবে। তৎপরে যে ভ্রমটি সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা করিবে, তাহা খুব একাগ্ৰমনে চিন্তা করিয়া পূর্বের ন্যায় তাহার মনে প্রেরণ করিবে। যদি কাৰ্য্যকারক তাহাকে বাদর নাচ দেখাইতে ইচ্ছা করে, তবে সে নিজের মনে ঐরূপ একটি চিত্র কল্পনা করিয়া তাহার মনে উহা প্রেরণ করিবে এবং তৎসঙ্গে তাহাকে নিম্নোক্ত রূপ কিছু জিজ্ঞাসা করিবে—তুমি কি তোমার সামনে যে কয়েকটা বাঁদর নাচিতেছে, তাহা তুমি কি দেখিতে পাইতেছ?” যদি সে সতি-সূচক উত্তর দিতে ইতস্ততঃ করে, তবে তাহার সম্মুখে অঙ্গুলি নির্দেশ পূর্বক বলিবে-এই দেখ বড় বাঁদরটা, এই দেখ বাদরীটা; আর ঐ যে উহাদের বাচ্চাগুলি!” দেখত, উহারা কেমন তালে তালে অঙ্গ ভঙ্গী করিয়া নাচিতেছে?” ইত্যাদি। যদি সে তাহাকে মেঘ গর্জন শুনাইতে ইচ্ছা করে, তবে মেধাবৃত আকাশ ও মেঘ গর্জনের একটি চিত্র স্বীয় মনের মধ্যে আঁকিয়া উহা তাহার মনে প্রেরণ করিবে এবং উক্তরূপ দুই একটি মৌখিক আদেশ দ্বারা ঐ ভাব তাহার মনে সুস্পষ্টরূপে ফুটাইয়া তুলিবে এবং তাহার কৰ্ম্ম প্রবৃত্তি জাগাইবে।
এই অবস্থায় সম্মোহনবিৎ পাত্রের অজ্ঞাতসারে নিজের মুখে মিষ্ট টক, ঝাল, তেঁততা ইত্যাদি কোন রসের আস্বাদন করিলে, কিম্বা নিজের শরীরের কোন স্থানে চিটি কাটিলে বা সূচ বিঁধাইলে পাত্র স্বীয় জিহ্বাতে সেই স্বাদ বা তাহার শরীরের সেই স্থানে উক্ত আঘাত জনিত যন্ত্রণা অনুভব করিতে পারে। এখন তাহার মস্তকের উপর বা উহার পশ্চাতে (তাহাকে না দেখাইয়া) কোন জিনিষ ধরিলেও সে উহার নাম বলিয়া দিতে পারে। পাত্র খুব সংবেদ্য না হইলে এবং গভীর নিদ্রাগত হইয়া সম্মোহনবিদের মনের সহিত তাহার মনের দৃঢ় ঐক্য স্থাপিত না হইলে, এই শ্রেণীর পরীক্ষায় বিশেষ সাফল্য লাভ হয় না।
পাত্রের মনে কয়েকটি ভ্ৰম জন্মাইবার পর, তাহাকে পুনরায় নিদ্রিত করিবে এবং কিছুক্ষণ পরে কয়েকটি উৰ্দ্ধগামী পাস ও কপালের উপর ঠাণ্ডা বাতাস বা ফু দিয়া তাহাকে জাগ্রত করিয়া দিবে।