চতুর্থ পাঠ
মনের দ্বিত্বভাব
(Duality Of Human Mind)
মানব-মনের বিভিন্ন প্রকৃতি বিশিষ্ট দুইটি বিশেষ ‘ভাব’ বা ‘অবস্থা’ আছে। কেহ কেহ উহাদিগকে ‘ভাব’ বা ‘অবস্থা না বলিয়া ‘বৃত্তি বলেন; আবার কেহ কেহ বা উহাদিগকে দুইটি স্বতন্ত্র ‘মন’ বলিয়াই উল্লেখ করেন। আমিও সুবিধার নিমিত্ত মানুষের বিভিন্ন প্রকৃতির বিশিষ্ট দুইটি মন আছে বলিয়াই উল্লেখ করিব।
মানুষের মন দুইটি। ইংরাজীতে উহাদের একটিকে “অব্জেক্টটিভ মাইণ্ড” (Objective Mind)*; আর অপরটিকে “সাবজেক্টটিভ মাইণ্ড” (Subjective Mind)+ বলে। বাঙ্গলায় উহাদিগকে যথাক্রমে “বহির্মন” ও “অন্তর্মন” বলিয়া অভিহিত করা যাইতে পারে। এই মন দুইটিই মানুষকে প্রতিনিয়ত চালনা করিয়া থাকে। জীবন ধারণের জন্য মানুষ যে সকল কাৰ্য্য করে, সেইগুলি সমস্তই এই দুই মনের উত্তেজনায় সম্পন্ন হয়। উহাদের উত্তেজনা ব্যতিরেকে, সে ইচ্ছাপূৰ্ব্বক হউক, আর অনিচ্ছাপূৰ্ব্বক হউক, কোন কাৰ্য্যই করিতে পারে না। সুতরাং মনের দ্বিত্বভাব এই মন দুইটিই সৰ্বময় কর্তা; মানুষ তাহাদের আজ্ঞাবহ ভৃত্য মাত্র। প্রভুর আদেশ ব্যতীত ভৃত্য যেমন কোন কার্য করিতে সমর্থ হয়না, সেইরূপ এই প্রভু দুইটির উত্তেজনা বা প্রবৃত্তি ব্যতিরেকে মানুষ কোন কৰ্ম্মই করিতে পারেনা। সে জাগ্রত বা স্বাভাবিক অবস্থায় (normal condition) যে মনের কর্তৃত্বাধীনে থাকিয়া আপনাকে পরিচালিত করে, অর্থাৎ মানুষের স্বাভাবিক অবস্থায় যে মন কাৰ্য্য করে, উহাকে “বহির্মন” আর নিদ্রিতাবস্থায় বা অজ্ঞাতসারে যে মনের দ্বারা পরিচালিত হয়, অর্থাৎ মানুষের এই অবস্থায় যে মন কাৰ্য্য করে, উহাকে “অন্তর্মন বলে। বহির্মনের সর্ব প্রধান গুণ বা ধৰ্ম্ম বিচার করা, এবং উহার ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি অনুসারে মানুষকে পরিচালিত করা। এই মন ইন্দ্রিয়গণের এবং জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের সাহায্য লইয়া ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিচার করিয়া থাকে। সুতরাং উহাকে যুক্তি বা প্রমাণের বিরুদ্ধে, কোন কিছু স্বীকার, বিশ্বাস অথবা কোন কায করিতে প্রবৃত্ত করা যায় না। যখন আমরা কোন প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে কোন কিছু স্বীকার, বিশ্বাস অথবা কোন কার্য করিতে আদেশ করি, তখন তাহার বহির্মন ইন্দ্রিয়গণের এবং জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের সাহায্য লইয়া, উহা বিচার করিয়া দেখে যে, আমরা যাহা বলিতেছি তাহা সত্য কিনা? অথবা আমাদের আদিষ্ট কাৰ্যটি করা উচিত কি না? যদি সত্য বা উচিত হয়, তাহা হইলে সে উহা করে, আর মিথ্যা বা অনুচিত হইলে করিতে স্বীকৃত হয় না। এই নিমিত্ত আমরা কাহারও দ্বারা কোন মিথ্যা বা অসঙ্গত কথা স্বীকার বা বিশ্বাস করাইতে, অথবা কোন অনুচিত কাৰ্য্য করাইতে পারি না। কারণ তাহার বিচার-বুদ্ধি বিশিষ্ট বহির্মন তাহাকে উহা করিতে দেয়না। মানুষ জাগ্রত বা স্বাভাবিক অবস্থায় জ্ঞানতঃ ও ইচ্ছাপূর্বক যে সকল শারীরিক বা মানসিক কাৰ্য্য সম্পন্ন করে, সে গুলি সমস্তই তাহার বহিমনের।
অন্তর্মন বিচার শক্তিহীন। এজন্য এই মন বহির্মনের ন্যায় ভাল-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় ইত্যাদি বিচার করিতে পারে না। ইহার সর্ব প্রধান গুণ বা ধৰ্ম্ম কোনরূপ আপত্তি না করিয়া আদেশ পালন করা এবং উহার ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি অনুসারে মানুষকে পরিচালিত করা। এই মন বিচার শক্তিহীন বলিয়া ইন্দ্রিগণের দ্বারা প্রত্যক্ষীভূত বা জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেকের দ্বারা প্রমাণিত কোন বস্তু বা বিষয়ের বিরুদ্ধেও উহাকে কোনকিছু স্বীকার বিশ্বাস অথবা কোন কাৰ্য্য করিতে প্রবৃত্ত করা যায়। যদি কোন প্রকৃতিস্থ ব্যক্তিকে একখানা পুস্তক দেখাইয়া, উহাকে বাঘ বলিয়া স্বীকার বা বিশ্বাস করিতে বলা হয়, তবে সে কখনও উহা করিবে না; যেহেতু তাহার বিচারশক্তি বিশিষ্ট বহির্মন উহা করিতে দিবে না। বহির্মনের ধর্ম বিচার করা, সুতরাং এস্থলে এই মন দর্শনেন্দ্রিয়ের সাহায্যে বিচার করিয়া দেখিবে যে, উহা সত্য নহে, অর্থাৎ উহা বাঘ নয়,-একখানা পুস্তক। কিন্তু আবার সেই ব্যক্তিকেই সম্মোহন নিদ্রায় অভিভূত করিয়া ঐ পুস্তকখানাকে বাঘ বলিয়া স্বীকার বা বিশ্বাস করিতে বলিলে, সে তখন তাহাই করিবে। যেহেতু তখন সে তাহার বিচার-শক্তিহীন অন্তর্মন কর্তৃক চালিত হইতেছে। এই মন বিচার-শক্তিহীন ও বিশ্বস্ত ভৃত্যের ন্যায় আজ্ঞা বহ বলিয়া, সে উহা বিশ্বাস করিবে এবং হঠাৎ বাঘ দেখিলে লোক যেরূপ ভীত ও বিচলিত হয়, সে ব্যক্তিও ঐ পুস্তকখানা দেখিয়াই তদ্রুপ ভীত ও পলায়নপর হইবে। মানুষ স্বাভাবিক ও সম্মোহন নিদ্রায় এবং অজ্ঞাতসারে বা অনিচ্ছাপূর্বক যে সকল কাৰ্য্য করে, সে গুলি সমস্তই তাহার অন্তমনের।
বহির্মন মটর নার্ভ (Motor nerve) এবং অন্তর্মন সেনসরি নার্ভ (Sensory nerve) নামক স্নায়ুমণ্ডলীর ভিতর দিয়া যাবতীয় কার্য সম্পন্ন করিয়া থাকে। বহির্মন পঞ্চ জ্ঞান ও কর্মেন্দ্রিয়ের কাৰ্য্য করিতে সমর্থ হইলেও অভ্যন্তরীণ যন্ত্রগুলির উপর কোনরূপ আধিপত্য করিতে পারে না। যেমন আমরা জ্ঞানতঃ ও ইচ্ছাপূর্বক চক্ষুর পাতা উঠাইতে ও নামাইতে পারি, কিন্তু যকৃত, পাকস্থলী, হৃদযন্ত্র ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ যন্ত্রগুলিকে ইচ্ছামত নাড়া-চাড়া করিতে পারি না। আর অন্তর্মন শরীরস্থ প্রত্যেক যন্ত্র ও ইন্দ্রিয়ের উপরই স্বীয় আধিপত্য বিস্তার করিতে পারে। আমরা দেখিতে পাই যে, আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির নানাবিধ সঙ্কোচন-প্রসারণ-কাৰ্য্য অনেক সময়, আমাদের অজ্ঞাতসারে সম্পন্ন হয় এবং ফুসফুস, হৃদ্যন্ত্র, পাকস্থলী, যকৃত ইত্যাদির ক্রিয়াও স্বতঃই সম্পন্ন হইয়া থাকে, সেজন্য আমাদিগকে কোনরূপ ইচ্ছা করিতে হয় না। শরীরস্থ তাবৎ ইন্দ্রিয় ও যন্ত্র গুলির উপর অন্তর্মনের এইরূপ আধিপত্য বিদ্যমান থাকাতে, আমরা উহার সাহায্যে শরীর ও মনের বহু প্রকার রোগ আরোগ্য করিতে সমর্থ হই।
জীবন-যাত্রা নির্বাহের প্রতিপদক্ষেপ মানুষের বহির্মন তাহার বন্ধুর ন্যায় কাৰ্য্য করিয়া থাকে; কারণ এই মন যেমন অনুসন্ধিৎসু ও বিচারক্ষম, তেমনি আবার নিয়ত জাগ্রত ও সতর্ক। বাস্তবিক ইহার সাহায্য ব্যতিরেকে সে কখনও নিরাপদে তাহার বিষয়-কৰ্ম্ম সম্পন্ন করিতে পারে না। যাহার বহির্মন উন্নত নহে, সে পশুর সমান; যেহেতু সে বিচার-শক্তিহীন। বিচার-শক্তিহীন মানুষকে যে প্রতিপদে বশীভুত ও লাঞ্ছিত হইতে হয়, তাহ। শিশুদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে সহজেই বুঝিতে পারা যায়। অন্তর্মন যদিও অধিকাংশ সময়ে নিদ্রিতাবস্থায় অবস্থান করে, তথাপি আমরা কতকগুলি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া বলে, উহার সহায়তা লাভ করিয়া মানুষের শরীর ও মনের উপর, আমাদের ইচ্ছানুরূপ অনেক প্রকার কাৰ্য্য করিতে পারি, তাহাকে বশীভূত করিয়া প্রায় যদৃচ্ছারূপে পরিচালিত করিতে সমর্থ হই। এই মনই শারীরিক-মানসিক-নৈতিক রোগ সকল আরোগ্য করে, মানসিক বৃত্তিনিচয়কে তীক্ষ্ণ ও উন্নত করে, এবং সম্মোহনবিদের আদেশানুসারে মানুষকে পরিচালিত করে। সুতরাং মানুষকে বশীভূত করিতে হইলে আমাদিগকে তাহার এই মনের উপরই কাৰ্য্য করিতে হইবে।
বহির্মন ও অন্তর্মনকে নিম্নোক্ত ভাবে চিত্রিত করিতে পারা যায়। উহারা দুই ভাই; অন্তর্মন বড় আর বহির্মন ছোট। তাহারা দুই ভাইয়ে একটি ব্যবসায় করিতেছে। বড় ভাই কারবারের মালিক ও গুদামের কর্তা; আর ছোট ভাই উহার অংশীদার ও একমাত্র পরিচালকম্যানেজার। বড় ভাই অসতর্ক, সরল বিশ্বাসী ও আজ্ঞাবহ বলিয়া ব্যবসায়-বুদ্ধিহীন। সে তাহার খরিদ্দারদিগকে সহজে বিশ্বাস করে, এবং তাহারা যে দরে মাল-পত্র বিক্রয় করিতে বলে, সে লাভ লোকসানের প্রতি দৃকপাত না করিয়া, সেই দরেই উহা বিক্রয় করিয়া ফেলে; এজন্য তাহাকে সর্বদাই ঠকিতে হয়। এই সব কারণে বড় ভাই অনুপযুক্ত হওয়াতে ছোট ভাইই ব্যবসায়ের পরিচালন ভার স্বহস্তে গ্রহণ করতঃ ক্রয় বিক্রয়াদি সমস্ত কাৰ্য্য স্বয়ং সমাধা করে। ছোট ভাই বুদ্ধিমান, সুচতুর, বিচারক্ষম ও সর্বদা সতর্ক; সুতরাং সে ব্যবসায়ের উপযুক্ত লোক সন্দেহ নাই। সে যেমন তাহার খরিদ্দারদিগের নিকট অধিক লাভ লইয়া মাল-পত্র বিক্রয় করে, তেমনি আবার মাল-পত্ৰ খরিদ করিবার সময় ও ভাল জিনিষ দুই পয়সা কম দরে ক্রয় করিতে চেষ্টা পাইয়া থাকে। বড় ভাই গুদামের কৰ্ত্তা রূপে সর্বদা ঘরের ভিতর বসিয়া থাকে, আর ঘোট ভাই স্বয়ং প্রহরী রূপে দোকানের সম্মুখ দরজায় দণ্ডায়মান থাকিয়া অত্যন্ত সতর্কতায় সহিত ব্যবসায় সংক্রান্ত সমস্ত কার্য সম্পন্ন করে। যখন কোন ক্রেতা বা বিক্রেতা আসিয়া তাহার নির্বোধ বড় ভাইএর সহিত কথা-বাৰ্তা কহিতে চেষ্টা করে, তখনই সে উপস্থিত হইয়া উহাতে বাধা দেয় এবং তাহার সঙ্গে ক্রয় বিক্রয় সম্বন্ধে স্বয়ং আলাপ করতঃ কাৰ্য্য সমাধা করে, এবং কোন ক্রমেই তাহাকে বড় ভাইএর সন্মুখীন হইতে দেয় না।
এইক্ষণ আমরা আরও স্পষ্টরূপে বুঝিতে পারিলাম যে, যতক্ষণ আমরা অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য ছোট ভাইকে কার্যে বিরত করিতে না পারিব, ততক্ষণ তাহাকে এড়াইয়া বড় ভাই এর সঙ্গে, আমাদের অভীষ্ট বিষয়ে আলাপ করিতে সমর্থ হইব না। বড় ভাইএর সঙ্গে কথা-বার্তা কহিয়া তাহাকে আজ্ঞাধীন করাই যখন আমাদের উদ্দেশ্য, তখন আমরা কি উপায়ে ছোট ভাইকে স্থানান্তরিত করিতে পারি, আমাদিগকে এখন তাহাই দেখিতে হইবে। বহির্মনকে আমরা তিনটি বিভিন্ন প্রক্রিয়ার সাহায্য নিশ্চেষ্ট, সুপ্ত বা নিষ্ক্রিয় করিতে পারি। সেই তিনটি প্রক্রিয়া এই—“সম্মোহন আদেশ”, “দৃষ্টিক্ষেপন’ ও ‘হাত-বুলান। এই বিভিন্ন প্রক্রিয়া তিনটি কাহারো উপর নির্দিষ্ট নিয়মে প্রয়োগ করিলে তাহার বহির্মনকে অল্প বা অধিক সময়ের জন্য নিশ্চেষ্ট ও নিস্ক্রিয়াবস্থায় আনয়ন করা যায় এবং তখন তাহার অন্তর্মন আদেশ পালনে বাধ্য হইয়া থাকে।
অন্তর্মনকে আমরা যাহা করিতে আদেশ করি, বিশ্বস্ত ভৃত্যের ন্যায় বিনা আপত্তিতে সে তাহাই করিয়া থাকে। আমাদের আদেশ সঙ্গত কি অসঙ্গত সে বিষয়ে কিছুমাত্র হৃক্ষেপ করে না। যদি তাহাকে এরূপ আদেশ করা যায় যে, সে কুকুর, তাহা হইলে সে তাহাই বিশ্বাস করিবে এবং আপনাকে বাস্তবিক কুকুর বলিয়া মনে করিবে! যদি তখন তাহাকে কুকুরের ডাক ডাকিতে বলা যায়, তবে সে কুকুরের মতই ‘ঘেউ ঘেউ শব্দ করিতে আরম্ভ করিবে। তখন তাহাকে বানর বা ভল্লুক বলিয়া নাচাইতে, এক টুকরা কাগজকে বিস্কুট বলিয়া, কিম্বা কতকগুলি পিয়াজ-রগুনকে সুস্বাদু লিচু বলিয়া খাওয়াইতে পারা যায় ইত্যাদি। উক্তরূপে আদেশ দিয়া যেমন তাহার মনে ইচ্ছামত যে কোন প্রকার মায়া ও ভ্ৰম জন্মাইতে পারা যায়, সেইরূপ তাহার শরীরস্থ অভ্যন্তরীণ যন্ত্র ও মানসিক বৃত্তিগুলিকে ও অল্প বা অধিক পরিমাণে, স্থায়ী বা অস্থায়ীরূপে বশে আনিতে পারা যায়। এক কথায়, আমরা তাহাকে প্রায় যদৃচ্ছাক্রমে পরিচালিত করিতে পারি। কিন্তু যে কাৰ্যের দ্বারা তাহার নৈতিক চরিত্র দূষিত হইবার সম্ভাবনা আছে, অন্তর্মন সেরূপ কোন কাৰ্য্য করিতে স্বীকৃত হয় না।
————–
* Conscious Mind, Voluntary Mind, Objective Faculty, Intellect, etc.
+ Sub Conscious Mind, Invountary Mind, Subjective Faculty Subliminal Self, Sleeping-Mind etc.