একবিংশ পাঠ
মায়া ও ভ্রম উৎপাদনার্থ বিশেষ উপদেশ
মোহিত পাত্রকে পরীক্ষা করণান্তর প্রথম তাহার মনে মায়া ও তৎপরে ভ্রম (illusion and hallucination) জন্মাইবে। এই শব্দদ্বয়ের মধ্যে অর্থগত বিশেষ পার্থক্য আছে। এক বস্তু অন্য পদার্থ বলিয়া বোধ হইলে (অর্থাৎ বিড়াল হাতী বলিয়া, দুর্গন্ধ পদার্থ সুগন্ধি বলিয়া উপলব্ধি হইলে) সেই ভ্রান্ত অনুভূতিকে “মায়া” (illusion) বলে, আর যেখানে কিছুই নাই, সেখানে কোন পদার্থের অস্তিত্ব বোধ করিলে (যেস্থানে কিছুই নাই সেস্থানে বাঘ, নীরব স্থানে বংশীধ্বনি বা টক্ না খাইয়া জিহ্বাতে অম্ন স্বাদ অনুভব করিলে) সেই মিথ্যা অনুভূতিকে “ভ্রম’ (hallucination) বলে।
নিদ্রিত ব্যক্তির মনে প্রথম মায়া ও তৎপরে ভ্ৰম জন্মইবে। এই সম্বন্ধে বিশেষ নিয়ম এই যে, প্রথম রসনেন্দ্রিয়ের, দ্বিতীয় ভ্রাণেন্দ্রিয়ের, তৃতীয় শ্রবণেন্দ্রিয়ের, চতুর্থ ত্বকেন্দ্রিয়ের, পঞ্চম বা সৰ্বশেষে দর্শনেন্দ্রিয়ের মায়া ও ভ্রম জন্মাইবে। অভিজ্ঞ সম্মোহনবিদগণ সর্বদা এই নিয়মের অনুসরণ না করিলেও নবীন কাৰ্যকারককে তাহা করিতে হইবে। তবে যাহাদের সংবেদনা স্বভাবতঃ অধিক এবং যাহারা খুব তাড়াতাড়ি মোহিত হয়, কিম্বা যাহারা ইতঃপূর্বে কয়েকবার মোহিত হইয়াছে, তাহাদের মনে মায়া ও ভ্ৰম জন্মাইতে এই নিয়ম পালনের আবশ্যকতা নাই।
মোহিত ব্যক্তির মনে একবার বিভিন্ন রকমের দুই-তিনটি মায়া ও শ্রম সৃষ্টি করিতে পারিলেই, তখন তাহাকে প্রায় সকল প্রকার মায়া ও শ্রমের অধীন করিতে পারা যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যাইতে পারে যে, যদি রসগোল্লা বলিয়া কতকগুলি পিঁয়াজ বা রশুন তাহাকে খাইতে দেওয়া যায়, তাহা হইলে সে আহলাদের সহিত ঐগুলি খাইয়া ফেলিবে; কি যদি উগ্র গন্ধযুক্ত এক শিশি স্মেলিং সল্ট (Smelling Salt) বা এমোনিয়া (Ammonia) সুগন্ধ আতর বলিয়া তাহার নাকের সম্মুখে ধরা যায়, তবে সে অত্যন্ত তৃপ্তির সহিত উহা পুনঃ পুনঃ অঘ্রাণ করিবে। এইরূপে কেবল আদেশ করিয়াই তাহাকে বানর বা ভল্লুক বলিয়া নাচাইতে, গায়ক বলিয়া গাওয়াইতে, বক্তা বলিয়া বক্তৃতা করাইতে, শিক্ষক বলিয়া পড়াইতে, নাপিত বলিয়া কামাইতে, মুচি বলিয়া জুতা সেলাই করাইতে, পালোয়ান বলিয়া মল্লযুদ্ধ করাইতে পারা যায় ইত্যাদি। এই অবস্থায় তাহাকে অভিভাবক এবং উপস্থিত পিতামাতাকে তাহার ছেলে মেয়ে বলিয়া আদর বা শাসন করিতে বলিলে, সে তাহাই করিবে; কিম্বা তাহাকে মুখ ভ্যাংচাইতে বলিলে, সে তাহাই করিতে বাধ্য হইবে। তাহার কোলের উপর একখানা জুতা রাখিয়া, উহাকে তাহার নব জাত শিশু বলিয়া ঘুম পাড়াইতে আদেশ করিলে, সে সত্য সত্যই তাহার কল্পিত শিশুকে ঘুম পাড়াইতে আরম্ভ করিবে ইত্যাদি। এইরূপে কাৰ্যকারক ইচ্ছা মাত্র তাহার মনে শত সহস্র প্রকার মায়া ও ভ্রম জন্মাইতে পারে। সম্মোহন বিদ্যার এই অংশই সচরাচর ক্রীড়ারূপে রঙ্গমঞ্চে প্রদর্শিত হইয়া থাকে।
মোহিত ব্যক্তির মনে মায়া ও ভ্ৰম জন্মাইবার আদেশ গুলিকে সুস্পষ্ট, বিশ্বাসোদ্দীপক ও প্রভুত্ব ব্যঞ্জক স্বরে প্রদান করিবে। আদেশ দিবার সময় মুখে কথা বাধিয়া গেলে, বা সুস্পষ্ট ও সরল ভাবে উচ্চারিত না হইলে, সেই আদেশ পাত্রের মনে কৰ্ম্ম-প্রবৃত্তি জাগ্রত করিতে পারেনা। পাত্রকে যাহা করিতে বলিবে, সে তাহা করিতে অস্বীকার বা ইতস্ততঃ করিলে, তাহাকে পুনরায় এরূপ দৃঢ়তার সহিত ও বিশ্বাসোদ্দীপক স্বরে আদেশ দিবে, যেন কথা গুলি তাহার মনে দৃঢ়রূপে অঙ্কিত হয়। কাৰ্য্যকারক চতুরতার সহিত আদেশ দিতে পারিলে সে সহজেই পাত্রদিগকে সমস্ত প্রকার মায়া ও ভ্রমের অধীন করিতে সমর্থ হইবে।