ইংরাজী নববর্ষের প্রথম দিন সকালে কিশোর বিমলাকে লইয়া কলিকাতায় ফিরিল।
গাড়িতে সারারাত্রি বসিয়া আসিতে হইয়াছে। হাওড়া স্টেশনেও দারুণ ভিড়; মানুষ ও মোটঘাট ঠেলিয়া বাহিরে আসিতেই দীনবন্ধুবাবুর সহিত দেখা হইয়া গেল। তিনি ট্রেন ধরিবার জন্য লাঠিটা কাঁধে ফেলিয়া দ্রুতপদে ছুটিতেছিলেন, কিশোরকে দেখিতে পাইয়া দূর হইতে চিৎকার করিয়া বলিলেন, কি হে, খবর সব ভাল তো? বর্ধমান যাচ্ছি, আর সময় নেই, টিকিট কিনতে হবে—তোমাদের ওদিকটাতে গোলমাল বেধেছে, সাবধানে থেকো–
কিশোর চেঁচাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কিসের গোলমাল?
কাগজে পড়নি?—দাঙ্গা–সাবধানে থেকো, আমি চললুম, সময় নেই–কাল সকালেই ফিরব বলিতে বলিতে তিনি প্রবহমান জনতার মধ্যে অন্তর্হিত হইয়া গেলেন।
কিশোর ব্যাপারটা ভাল রকম হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিল না, গত কয়েকদিন খবরের কাগজ পড়িবার মত মনের অবস্থা তাহার ছিল না। সে চিন্তিতমুখে ট্যাক্সিতে উঠিল। পথে হ্যারিসন রোডের মোড়ের উপর একখানা বাঙলা দৈনিক কিনিয়া লইয়া তাহার উপর দৃষ্টিপাত করিতে বড় বড় অক্ষরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিবরণ চোখে পড়িল। গত তিন দিন ধরিয়া এই নৃশংস আত্মঘাতী অনুষ্ঠান। চলিতেছে, মেছুয়াবাজার ও আমহার্স্ট স্ট্রীটের চৌমাথাকে কেন্দ্র করিয়া শহরের ঐ প্রান্তটাতেই ইহা। ছড়াইয়া পড়িয়াছে। কেল্লা হইতে মিলিটারি আসিয়া মেশিনগান ইত্যাদির সাহায্যে মোড়ে মোড়ে পাহারা দিতেছে বটে, কিন্তু খুন-জখম তাহাতে কিছুমাত্র কমে নাই। কাগজে উভয় সম্প্রদায়ের হতাহত ব্যক্তির দীর্ঘ তালিকা বাহির হইয়াছে।
বিমলা গলা বাড়াইয়া কাগজখানা দেখিতেছিল, সে শিহরিয়া উঠিয়া বলিল, ঠাকুরপো, এ জিনিস তো বাঙলা দেশে কখনও ছিল না।
কিশোর মাথা নাড়িয়া বলিল, ইংরেজ বাহাদুর স্বায়ত্ত শাসনের যে প্রথম কিস্তি আমাদের দিয়েছেন, এটা তারই অনিবার্য ফল।
বাড়ি পৌঁছিয়া তাহারা দেখিল, পাড়াটা একেবারে নিস্তব্ধ। বেলা প্রায় আটটা বাজে, কিন্তু এখনও রাস্তায় জনমানব নাই। কিশোরের বাসার সম্মুখে কিছুদূরে একটা চায়ের দোকান ছিল—প্রত্যহ সন্ধ্যায় সকালে সেখানে বহুলোকের সমাগম হইত—সেটার দরজায় তালা লাগানো। আশেপাশের বাড়িগুলা যতদূর দেখা গেল, সব দরজা জানালা বন্ধ। একটা আশঙ্কাপূর্ণ থমথমে ভাব যেন চতুর্দিকে। আচ্ছন্ন করিয়া আছে।
ক্রমে বেলা যতই বাড়িতে লাগিল, নিকটে দূরে চারিদিক হইতে একটা সোরগোল ততই স্পষ্টতর হইয়া উঠিতে লাগিল। মাঝে মাঝে এক এক দল উন্মত্তপ্রায় লোক চিৎকার করিতে করিতে লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্র লইয়া রাস্তার একদিক হইতে অন্যদিকে ছুটিয়া গিয়া—বোধ করি গোরার তাড়া খাইয়া যে পথে আসিয়াছিল সেই পথে আবার ফিরিয়া পলাইতেছে। অনতিদূরে ফুটপাথের উপর একটা স্থানে খানিকটা রক্ত জমিয়া শুকাইয়া ছিল; বোধ হয় আগের দিন কোন হতভাগ্য ছুরির আঘাতে। ঐখানে পড়িয়া প্রাণ হারাইয়াছে। জনহীন পথের উপর ঐ দাগটি যেন ধরিত্রীর বুকের উপর একটা দগদগে ক্ষতের মত দেখাইতেছে। কিশোর দোতলার জানালায় স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া বাহিরের দিকে। চাহিয়া রহিল।
বিমলা এক হাতে একখানা আসন ও অন্য হাতে রেকাবিতে করিয়া খানিকটা গরম হালুয়া আনিয়া কিশোরের সম্মুখে রাখিয়া বলিল, তোমাকে আজ যে কী খেতে দেব তা জানি না। ঝিও আসেনি।
কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, ঘরে কি কিছু নেই?
শধু চাল আর ডাল।
ওতেই হবে।–যে রকম কাণ্ড দেখছি, বাজার-হাট কিছুই বসবে না। তা ছাড়া বাড়ি থেকে বার হওয়াও তো অসম্ভব।
না, না, বাড়ি থেকে বার হবে আবার কী। কোন রকমে প্রাণে প্রাণে এসে পৌঁছতে পেরেছি, এই ঢের। খাও—জল আনি।
কিশোর খাইতে বসিল। জলের গেলাস আনিয়া তাহার সম্মুখে রাখিয়া বিমলাও মাটিতে বসিল। আস্তে আস্তে বলিল, ওঁরাও এসেছেন।
কারা?–কিশোর চমকিয়া মুখ তুলিল।
বিমলা আঙুল দিয়া পাশের বাড়ির দিকে দেখাইয়া বলিল, ওপরের ঘরের জানালা একটা ভোলা ছিল, তাই জানতে পারলুম। কিন্তু সাড়াশব্দ কিছু পেলুম না।
কিশোর কোন কথা বলিল না, মুখ খুঁজিয়া আহার করিতে লাগিল। বিমলা একটা নিশ্বাস ফেলিয়া কতকটা নিজমনেই বলিল, কেমন আছে সব কে জানে।
দ্বিপ্রহর নামমাত্র আহার করিয়া কিশোর নিজের ল্যাবরেটরি ঘরটার ধুলা ঝাড়িয়া পরিষ্কার করিবার চেষ্টা করিতেছিল; কিন্তু কাজে তাহার মন বসিতেছিল না, পাশের বাড়িতে উহারা ফিরিয়া আসিয়াছে এই কথাটাই বার বার মনে পড়িয়া তাহাকে উন্মনা করিয়া দিতেছিল। এমন সময় বিমলা প্রবেশ করিয়া বলিল, ঠাকুরপো, বিনয়বাবুর বোধ হয় খুব অসুখ।
কিশোর একবার চকিতের জন্য মুখ ফিরাইয়া আবার ঝাড়ন দিয়া একটি কাচের যন্ত্র ঝাড়িতে ঝাড়িতে বলিল, কী করে জানলে?
নীচের ঘরে সুহাস দারোয়ানটাকে ওষুধ আনতে দিচ্ছিল—শুনতে পেলুম। কিন্তু দারোয়ানটা কিছুতেই যেতে চাচ্ছে না। সব কথা তো ভাল শোনা গেল না, শুধু সুহাস মিনতি করে বলছিল–একবারটি যাও, তোমায় দশ টাকা বকশিশ দেব, ওষুধ না এলে বাবুকে বাঁচানো যাবে না। দারোয়ানটা কেবলই নেহি মাইজী নেহি মাইজী বলছিল–
বাড়িতে কি আর কেউ নেই?
কী জানি, আর তো কারুর গলা পেলুম না।
কিছুক্ষণ কিশোর স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর হঠাৎ হাতের ঝাড়নটা ফেলিয়া দিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইল। উৎকণ্ঠিত বিমলা বলিল, ও কি, কোথায় চললে, ঠাকুরপো?
দেখি যদি কিছু করতে পারি— বলিয়া কিশোর নামিয়া গেল।
সদর-দরজা খুলিয়া বাহির হইতে যাইবে, এমন সময় বিমলা পশ্চাৎ হইতে বলিল, একটু দাঁড়াও ঠাকুরপো, আমিও যাচ্ছি।
সে সময় রাস্তা খালি ছিল, দুজনে বিনয়বাবুর বাড়ির সম্মুখে গিয়া কড়া নাড়িতেই দরজা খুলিয়া গেল। দারোয়ানটার পাশ কাটাইয়া বিমলা আগে প্রবেশ করিল, কিশোর তাহার পশ্চাতে ঢুকিল।
সুহাসিনী কালিমালিপ্ত মুখে নির্জীবের মত ঘরের মধ্যে একাকিনী দাঁড়াইয়া কী ভাবিতেছিল, দুজনকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া যেন ভূত দেখার মত চমকিয়া উঠিল। বিমলা দ্রুতপদে তাহার দিকেই গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কী হয়েছে, সুহাস? বাবার অসুখ করেছে?
বুদ্ধিভ্রষ্টের মত সুহাস নিঃশব্দে ঘাড় নাড়িল।
বিমলা বলিল, কোথায় আছেন তিনি?—ওপরে?
সুহাস হঠাৎ কাঁদিয়া ফেলিয়া নিকটের চেয়ারটার উপর বসিয়া পড়িল। বিমলা তাহার পাশে বসিয়া সান্ত্বনা দিয়া বলিল, কেঁদো না। কী হয়েছে আগে আমাদের ভাল করে বলো।
সুহাস চক্ষু মার্জনা করিয়া ভগ্নকণ্ঠে বলিল, কাল থেকে বাবার হাঁপানির ব্যথা উঠেছে, কিছুতেই কমছে না। ডাক্তারের কাছে খবর পাঠাতে পারছি না। আমি একলা, বাড়িতে দুটো চাকর ছাড়া আর কেউ নেই। যে ওষুধটা খেলে বাবার হাঁপানির ব্যথা কমে, সেটাও কাল রাত্তিরে ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ ডাক্তারখানা থেকে ওষুধ আনতে রাজী হচ্ছে না— সুহসিনী আঁচলে চোখ মুছিল।
কিশোর দরজার কাছেই দাঁড়াইয়া পড়িয়াছিল, নিমেষের জন্য বিমলার সহিত তাহার দৃষ্টি বিনিময় হইল। বিমলা তাড়াতাড়ি সুহাসের দিকে ফিরিয়া বলিল, কিন্তু ওষুধ না আনলেই যখন নয়, তখন দারোয়ান যাবে না কেন? মরণবাঁচনের কথা—আর ডাক্তারখানাও তত বেশী দূর নয়
সুহাসিনী মাথা নাড়িয়া বলিল, ওরা যেতে চাচ্ছে না বলছে বাড়ি থেকে বেরুলেই ওদের ছুরি মারবে।
বিমলা আর কিছু বলিতে পারিল না; নিজে প্রাণ দিয়া পরের প্রাণ বাঁচাইতে যদি কেহ রাজী না হয়, তাহাকে কী বলা যাইতে পারে!
কিশোর এতক্ষণে কথা কহিল, বলিল, ওষুধের নামটা কী?
সুহাসিনী অদূরে টী-পাইয়ের ওপর একটা খালি শিশি দেখাইয়া বিড়বিড় স্বরে কহিল, ওর গায়ে লেখা আছে, পেটেন্ট ওষুধ।
কিশোর শিশিটা তুলিয়া লইয়া বিমলাকে বলিল, বৌদি, তুমি বোসো আমি এখনই আসছি।
বিবর্ণ মুখে বিমলা বলিয়া উঠিল, তুমি কোথায় যাচ্ছ, ঠাকুরপো—
এখনই ফিরব। কাছেই ডিপেন্সারি—কোন ভয় নেই। বলিয়া কিশোর নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেল।
দুজনে চিত্রার্পিতের মত কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিল। তারপর সুহাসিনী জলে মজ্জমান ব্যক্তির মত সজোরে বিমলার একটা হাত চাপিয়া ধরিল। এইভাবে প্রায় রুদ্ধ নিশ্বাসে তাহারা ঘরের মধ্যে বসিয়া রহিল।
বাহির হইতে কখনও অখণ্ড নিস্তব্ধতা, কখনও বা বহুকষ্ঠের দূরাগত চিৎকার আসিতে লাগিল। অসীম উৎকণ্ঠার মধ্যে পনেরো মিনিট কাটিয়া গেল।
একবার সুহাসিনী কম্পিত অধরে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার ভয় করছে না?
বিমলা দাঁতে ঠোঁট চাপিয়া বলিল, আমার ভয় করছে বৈকি, সুহাস। গেলে যে আমারই যাবে, আর তো কারুর যাবে না।
তাহার কণ্ঠস্বর অতিশয় কঠিন শুনাইল। সুহাসিনী নতমুখে বসিয়া রহিল, আর কোন কথা বলিল না।
হঠাৎ বাহিরের দরজার উপর একটা গুরুভার পতনের শব্দে চমকিয়া দুজনে পরস্পরের মুখের দিকে চাহিল; তারপর বিমলা ছুটিয়া গিয়া দরজা খুলিয়া ধরিল, সুহাসিনীও তাহার পশ্চাতে গিয়া দাঁড়াইল।
বদ্ধ দরজায় ঠেস দিয়া কিশোর বসিয়া ছিল, দরজা খুলিতেই ঢলিয়া চৌকাঠের উপর পড়িয়া গেল। জামার বুকে রক্ত, মুখে রক্ত, মাথার চুলে রক্ত মাখামাখি কিশোরকে চক্ষু বুজিয়া পড়িয়া যাইতে দেখিয়া বিমলা কাঁদিয়া উঠিল, আমার এই সর্বনাশ করতেই কি তুমি বেরিয়েছিলে, ঠাকুরপো?
বিমলার কণ্ঠস্বরে কিশোর চোখ মেলিয়া চাহিল, কিছুক্ষণ শুন্য দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া, ওষুধ এনেছি বলিয়া শিশিসুদ্ধ একটা কম্পমান হাত তুলিয়া ধরিল।
দুটি নারী তখন বহুকষ্টে বুকভাঙা শক্তি প্রয়োগ করিয়া তাহার অবসন্ন দেহটা টানিয়া আনিয়া একটা চেয়ারে বসাইয়া দিল। জামা খুলিয়া, মাথা-মুখ ধুইয়া দিবার পর দেখা গেল, মাথায় চোট লাগিয়াছে, ঠিক মূর্ধার উপর প্রায় তিন ইঞ্চি স্থান কাটিয়া হাড় পর্যন্ত দেখা যাইতেছে। হাড়টা ভাঙিয়াছে কিনা বুঝা গেল না, কিন্তু রক্তস্রাব তখনও বন্ধ হয় নাই। বিমলা আঁচল ছিড়িয়া ক্ষতস্থানটা বাঁধিয়া দিবার পর কিশোরের আচ্ছন্ন ভাব একটু কমিয়াছিল, সে সোজা হইয়া বসিবার চেষ্টা করিয়া অস্পষ্টস্বরে বলিল, পেছন থেকে মাথায় লাঠি মারলে যাবার সময় কিছু হয়নি, কিন্তু ফিরে আসবার সময়–ডিসপেন্সারি থেকে বেরুতেই–মারলে। হঠাৎ—পড়ে গেলুম—তারপর এই পথটা ছুটে আসতে হাঁপিয়ে পড়লুম, নইলে লাগেনি বোধ হয় বেশী–
ঘরের এককোণে দেয়ালে কপাল ঠেকাইয়া সুহাসিনী কাঠের মত শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার দেহটা বারবার শিহরিয়া উঠিল। বিমলা চোখ মুছিতে মুছিতে কেবল ভগবানকে মনে মনে ডাকিতে লাগিল,–ঠাকুর, বুক চিরে রক্ত দেব, ভাল করে দাও।
কিশোর ক্লান্তভাবে ঘাড়টা নত করিয়া বলিল, মনে হচ্ছে একটু শুতে পেলে ভাল হত—
সুহাসিনী চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। একবার বুঝি একটু ইতস্তত করিল, তারপর বিমলাকে বলিল, আপনি ওঁকে নিয়ে ওপরে আসুন—দারোয়ান আর বদরী সাহায্য করবে। আমি বিছানা ঠিক করে রাখছি।
সুহাসিনীর ঘরে বিছানার উপর শোয়াইয়া দিতেই একটা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া কিশোর বলিল, আঃ, এখন বেশ স্বস্তি পাচ্ছি। শিয়রের দিকে দৃষ্টি পড়িতেই দেখিল, খাটের বাজু দুহাতে শক্ত করিয়া ধরিয়া সুহাসিনী দাঁড়াইয়া আছে। কিশোর ম্লান হাসিয়া বলিল, আপনাদের কষ্ট আর অসুবিধাই ঘটালুম।
সুহাসিনীর নিমীলিত চক্ষু দিয়া ধারার ন্যায় অশ্রু নামিয়া বুকের কাপড় ভিজাইয়া দিতে লাগিল, কিন্তু কিশোর তাহা দেখিতে পাইল না।
বৌদি।
ভাই! নিজের আঁচল দিয়া কিশোরের কপাল ও ঘাড় হইতে রক্তের দাগ মুছিয়া লইয়া তাহার মুখের উপর ঝুঁকিয়া বিমলা বলিল, কী বলছ, ঠাকুরপো?
মাথার হাড়টা বোধ হয় ফ্রাকচার হয়নি।
ঠাকুর করুন, তাই যেন হয়।
বিনয়বাবুকে ওষুধ দেওয়া হয়েছে? কেমন আছেন তিনি?
ভাল আছেন—এখন ঘুমুচ্ছেন।
আমারও যেন ঘুম পাচ্ছে—
বিমলার বুকের ভিতরটা আবার ছ্যাঁৎ করিয়া উঠিল। আর একদিন স্বামীর মাথা কোলে লইয়া সে এমনই ভাবে মৃত্যুর সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল। সেদিন তিনিও এমনি ধীরে ধীরে ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন। ভগবান! সেই পরীক্ষা কি আবার নূতন করিয়া পাঠাইয়া দিলে?
ব্যাকুলভাবে সুহাসের দিকে চাহিয়া সে বলিল, একটা ডাক্তার—একটা ডাক্তারও কি পাওয়া যায় না, সুহাস?
কিশোর বলিল, ডাক্তারের দরকার নেই, বৌদি। বেশী রক্ত বার হয়েছে বলে একটু অবসন্ন বোধ হচ্ছে, ঘুমুলেই সেটা কেটে যাবে। ডাক্তারের চেয়ে তোমার পায়ের ধুলো একটু মাথায় দাও—ঢের বেশী কাজ হবে–
নিমীলিত নেত্রে কিশোর একটু হাসিল।
সত্যি বলছ ঠাকুরপো, কোন ভয় নেই? পোড়া মেয়েমানুষ—কিছুই যে বুঝতে পারি না, ভাই! কিন্তু তুমি ঠিক বুঝতে পারছ, কোন ভয় নেই?
বুঝতে পারছি—কোন ভয় নেই।
অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া বিমলা তাহার কপালে বুকে হাত বুলাইয়া দিয়া বলিল, আচ্ছা, তবে ঘুমোও। আমরা কাছেই রইলুম।
তোমরা বরং বিনয়বাবুর কাছে যাও—
কিছুক্ষণ পরে কিশোরের নিশ্বাসের শব্দে বিমলা বুঝিল সে ঘুমাইয়াছে, তখন তাহার বুক পর্যন্ত ঢাকা দিয়া আস্তে আস্তে ঘরের বাহিরে বারান্দায় আসিয়া দাঁড়াইল।
শীতের বেলা তখন পড়িয়া আসিতেছে। অস্তমান সুর্যের দিকে তাকাইয়া জোড় করে বিমলা বোধ করি প্রাণের অব্যক্ত আকাঙক্ষাই দিনদেবকে নিবেদন করিতেছিল, হঠাৎ মুখ নামাইয়া দেখিল, সুহাসিনী একেবারে তাহার পায়ের কাছে আসিয়া বসিয়া পর্ডিয়াছে।
সুহাস!
বৌদি! বলিয়া সুহাসিনী তাহার পায়ের উপর মাথা রাখিয়া ফুপাইয়া কাঁদিয়া উঠিল।
ছি ছি সুহাস, ওঠো।
অবরুদ্ধ অশ্রুবিকৃত স্বরে সুহাস বলিল, বৌদি, আমাকে কি তোমরা ক্ষমা করতে পারবে? আমার পাপেই আজ–আর বলিতে পারিল না, তাহার দেহ অদমনীয় বাষ্পেচ্ছ্বাসে ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল।
বিমলা জোর করিয়া তাহাকে তুলিয়া বুকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, সুহাস, দোষ তুমি ওঁর কাছে। অনেক করেছ, তাই বুঝি ভগবান আজ এই শাস্তি পাঠিয়ে দিয়েছেন। দুঃখ তুমি কম পাওনি জানি, কিন্তু ভগবানের চোখে হয়তো এখনও তোমার প্রায়শ্চিত্ত শেষ হয়নি। শুধু তোমার নয়, আমাদের সকলেরই আজ পরীক্ষার দিন। ক্ষমা তোমাকে করব কী সুহাস, শুধু প্রার্থনা করি তোমার ভালবাসার জোরে ওঁকে যেন যমের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারি।
সুহাসের হাত ধরিয়া ঘরের দ্বারের কাছে আসিয়া বলিল, যাও, লজ্জা কোরো না, ওঁর কাছে গিয়ে বোসোগে, ঐখানেই তোমার স্থান। আমি তোমার বাবার কাছে গিয়ে বসছি। বলিয়া তাহাকে আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঠেলিয়া দিল।
এক ঘণ্টা পরে বিমলা বিনয়বাবুর ঘর হইতে ফিরিয়া আসিয়া দেখিল, কিশোর তখনও তেমনিই পড়িয়া ঘুমাইতেছে এবং সুহাস খাটের পাশে হাঁটু গাড়িয়া কিশোরের একটা হাতের মধ্যে নিজের মুখখানা চাপিয়া চুপটি করিয়া বসিয়া আছে।
নিঃশব্দে পা টিপিয়া টিপিয়া বিমলা ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল।
.
পাঁচ বৎসর কাটিয়া গিয়াছে।
বিনয়বাবু মারা গিয়াছেন। সে ধাক্কা সামলাইয়া গেলেও তাঁহার শরীর ভিতরে ভিতরে একেবারে জীর্ণ হইয়া পড়িয়াছিল; সুহাসিনীর বিবাহের মাস কয়েক পরে তিনি কয়েক দিন মাত্র অসুখে ভুগিয়া হঠাৎ পরলোকযাত্রা করিলেন। ইদানীং তাঁহার প্রাণে শান্তি ফিরিয়া আসিয়াছিল, বাঁচিয়া থাকিয়া জীবন উপভোগ করিবার ইচ্ছাও জাগিয়াছিল। কিন্তু যাঁহার অমোঘ আদেশের উপর আপীল চলে না, তিনি একদিন কাহাকেও কোন কৈফিয়ত না দিয়া বিনয়বাবুকে নিজের কাছে টানিয়া লইলেন। কন্যা, জামাতা, বন্ধুবান্ধবের অসীম স্নেহ ও শুশ্রুষা তাঁহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না। প্রাণোপম সুহৃদের বিয়োগে দীনবন্ধুবাবু বড়ই বেদনা পাইলেন।
এই ঘটনার কিছুদিন পরে কিশোর বিমলার টাকায় কাশীপুরের দিকে নুতন বাড়ি কিনিয়া সপরিবারে সেখানে উঠিয়া গেল। অধ্যাপকের চাকরি সে পূর্বেই ছাড়িয়া দিয়াছিল, সেই অবধি বাড়িতে মস্ত বড় ল্যাবরেটরি স্থাপন করিয়া বৈজ্ঞানিক গবেষণায় কাল কাটাইতেছে।
রাত্রি সাড়ে দশটা বাজিয়া গিয়াছিল। মাথার উপর দুটা বড় বড় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালিয়া কিশোর ল্যাবরেটরিতে বসিয়া একমনে কাজ করিতেছিল। সুহাসিনী ঘরময় ইতস্তত ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। এবং এটা-ওটা নাড়াচাড়া করিতেছিল। একবার কয়েকটা কাচের ছিপিযুক্ত শিশি হইতে খানিকটা তরল পদার্থ একটা টেস্ট-টিউবে ঢালিল, তারপর কী ভাবিয়া সেটা রাখিয়া দিল। বুনসেন বানার জ্বালিয়া সেটা খুব কমাইয়া দিয়া আবার ঘরময় বেড়াইতে লাগিল। কিশোরের দিকে তাকাইয়া দেখিল সে গভীর মনঃসংযোগে কী লিখিতেছে।
তখন চুড়িগুলার শব্দ করিয়া, আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটা ঝনাৎ করিয়া টানিয়া আবার সশব্দে পিঠে ঠেলিয়া সে বলিল, আজ করবীর একখানা চিঠি এসেছে।
কিশোর চিন্তা-নিমগ্ন চক্ষু একবার তুলিয়া আবার লেখার উপর নিবদ্ধ করিল। সম্ভবত কথার অর্থ তাহার মস্তিষ্ক পর্যন্ত পেীছিল না। করবীর নামোল্লেখেও তাহার মনের চটকা ভাঙিল না।
সুহাস বলিল, করবী লিখেছে যে, সে বরের সঙ্গে বিলেত চলল—এখন কিছু কাল সেখানেই থাকবে।
এবার অন্যমনস্ক কিশোর চক্ষু তুলিয়া বলিল, ও!
সুহাস জোরে হাসিয়া উঠিল, বলিল, আমার একটা কথাও তোমার কানে যায়নি। কী বললুম বলো তো?
তখন সচেতন হইয়া কিশোরও হাসিয়া বলিল, সত্যিই শুনতে পাইনি। কী বলছিলে?
কিছু না। একটা আরামের নিশ্বাস ফেলিয়া সে আবার ঘরময় পায়চারি করিতে লাগিল।
আজ বহুদিন পরে করবীর পত্র পাইয়া তাহার মনটা অকারণে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, এখন আবার তেমনিই অকারণে তাহা শান্ত হইয়া গেল।
বুনসেন বার্নার উস্কাইয়া দিয়া সে টেস্টটিউবের তরল পদার্থটা গরম করিতে লাগিল, সেটা ফুটিয়া উঠিতেই আলোর সম্মুখে তুলিয়া ধরিয়া বলিল, ওগো দেখ, কী সুন্দর রঙ!
কিশোর কাজ ফেলিয়া তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, হাসিয়া বলিল, এই হচ্ছে বুঝি! নিজেও কাজ করবে না, আমাকেও করতে দেবে না?
সুহাস বলিল, যথেষ্ট কাজ হয়েছে মশায়, রাত এগারোটা বাজে, এবার শুতে চলুন।
কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, আমার অন্য অ্যাসিস্টান্টটি কোথায়?
দিদির আজ একাদশী, তিনি শুয়ে পড়েছেন। সত্যি চল, অনেক রাত হয়ে গেল—
কিন্তু–তুমি বরঞ্চ এগোও,আমি এই কাজটা সেরে নিয়েই—
সেটি হচ্ছে না মশায়। তোমাকে ছেড়ে দিলে তুমি সমস্ত রাতই কাজ করে কাটিয়ে দেবে–বলিয়া সুহাস তাহার হাত ধরিয়া টানিয়া লইয়া চলিল।
ঘরের আলো নিভাইয়া দুজনে উপরে উঠিয়া গেল। শয়নঘরে প্রবেশ করিয়া দেখিল, নাইটল্যাম্প জ্বলিতেছে, কিন্তু খোক বিছানায় নাই।
দুজনের একবার চোখাচোখি হইল, তারপর আবার তাহারা ঘর হইতে বাহির হইল। তেতলায় একটিমাত্র ঘর—সেটিতে বিমলা শয়ন করে। পা টিপিয়া টিপিয়া তাহারা উপরে গিয়া ভেজানো দরজায় কান পাতিয়া শুনিল, অস্পষ্ট কথার গুঞ্জন আসিতেছে। তখন দ্বার ঠেলিয়া দুজনে ঘরে প্রবেশ করিল।
ঘরে কেবল পিলসুজের উপর তেলের প্রদীপ জ্বলিতেছে। তক্তপোশের উপর বিছানা পাতা, তাহাতে দুইটি মাথা অত্যন্ত কাছাকাছি দেখা যাইতেছে।
সুহাস বলিল, বিদ্যুৎ! তোমার চোখে কি ঘুম নেই?
বিদ্যুৎ চকিতে বড়মার গলা জড়াইয়া ধরিল, বলিল, ঐ সুহাস এল, বড়মা। এখুনি আমাকে নিয়ে যাবে।
বিমলা বলিল, সুহাস, ও আজ আমার কাছে শোবে।
সুহাস বলিল, শুলে তো কোন কথা ছিল না দিদি, কিন্তু বকিয়ে বকিয়ে যে তোমায় পাগল করে দিলে! নে বিদ্যুৎ, ওঠ–কাল আবার গল্প শুনিস।
বিদ্যুৎ কাঁদো কাঁদো হইয়া বলিল, বড়মা—
বিমলা বিদ্যুৎকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, না, আজ ও আমার কাছে থাক। তুই যা সুহাস, গল্প শেষ না হলে ছেলে ঘুমুবে না।
না, আজ একাদশী—কিছুতেই আমি তোমাকে বকতে দেব না। আর এগারোটা বাজতে চলল, ঘুমও কি ওর চোখে আসে না? বিদ্যুৎ, আয় শিগগির।
বিদ্যুৎ আরও জোরে বড়মার গলা জড়াইয়া ধরিল। বিমলা বলিল, বড় জ্বালাতন করিস তুই সুহাস, গল্প শেষ হলে যাবে কি করে শুনি? তোরা শুগে যা না বাপু!
তক্তপোশের পাশে বসিয়া কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, কোন গল্প হচ্ছে? সেই যেটাতে খোকাবাবু কালো ঘোড়ায় চড়ে বাঘ শিকার করতে যাবেন—সেইটে?
বিমলার বুকের ভিতর হইতে মাথা তুলিয়া বিদ্যুৎ বলিল, না, সেটা নয়, তোমার বিয়ের গল্প।
কিশোর আঁতকাইয়া উঠিল, অ্যাঁ—সে আবার কী! সুহাসও তক্তপোশের অন্যদিকে বসিয়া সকৌতুকে বলিল, তবে আমিও একটু শুনি।
আর ভয় নাই দেখিয়া বিদ্যুৎ সোৎসাহে বিছানায় উঠিয়া বসিয়া বলিল, আচ্ছা বড়মা, এই বাড়িটা তুমি আমাকে দিয়ে দিয়েছ, না?
বিমলা বলিল, হ্যাঁ—তারপর শোন্—
আর বাবার ঘরে যে ঘড়িটা আছে–টিং—টিং–করে বাজে—সেটাও আমার–না?
হ্যাঁ—সেটাও তোর।
আর সুহাসের ঘরে যে গ্রামোফোন—সেটাও আমার?
সেটাও তোর—সব তোর।
বিদ্যুৎ নিশ্চিন্ত হইয়া শুইয়া বলিল, এবার বলো।
বিমলা তাহার ক্ষুদ্র দেহটি কাছে টানিয়া লইয়া আরম্ভ করিল, তারপর বুঝেছিস বিদ্যুৎ, আমিআর সুহাস তোর বাবাকে ধরাধরি করে নিয়ে এসে চেয়ারে বসিয়ে দিলুম। তোর বাবার গায়ে রক্ত, মাথায় রক্ত,—তাই দেখে তোর মা কাঁদতে লাগল, আমিও খুব কাঁদতে লাগলুম। তারপর তোর মার বিছানায় নিয়ে গিয়ে তোর বাবাকে শুইয়ে দিতেই তোর বাবা ঘুমিয়ে পড়ল। সমস্ত রাত সে ঘুম ভাঙল না, আর তোর মা সমস্ত রাত একলাটি জেগে বসে রইল—
লুকাইয়া চোখের জল মুছিয়া সুহাস আস্তে আস্তে উঠিয়া গিয়া সিঁড়ির মাথার কাছে দাঁড়াইল। খানিকক্ষণ পরে কিশোর তাহার পাশে আসিয়া দাঁড়াইতেই সে সজলনয়নে একবার স্বামীর মুখের দিকে চাহিয়া নিজের মাথাটা তাহার বুকের উপর রাখিল, একটা উচ্ছ্বসিত দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, উঃ, কী দিনই গিয়েছে—ভাবলে যেন জ্ঞান থাকে না।
কিশোর দুই বাহু দিয়া সজোরে তাহাকে একবার বুকে চাপিয়া ধরিল। তারপর দুইজনে হাত ধরাধরি করিয়া নীরবে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া গেল।