পরদিন কলেজ হইতে ফিরিবার পর জলযোগ করিতে বসিয়া কিশোর বলিল, ওরা ব্রেহ্ম নয়—হিন্দু।
বিমলা বলিল, কারা?—ওঃ, পাশের বাড়ির কথা বলছ? তা এরি মধ্যে খবর পেলে কোত্থেকে?
দীনবন্ধুবাবু বললেন বুঝি?
এক টুকরা লুচি মুখে পুরিয়া কিশোর বলিল, হুঁ।
অল্প হাসিয়া বিমলা জিজ্ঞাসা করিল, তা আর কী কী খবর নিলে? শুধু হিন্দু হলে তো চলবে না, কী জাত?
কিশোর লুচি চিবাইতে চিবাইতে কহিল, জাত বামুন–মুখুজ্জে।
বিমলা হাসিয়া বলিল, যাক, তবে তো সবই ভাল। এখন আমি গিয়ে একবার দেখেশুনে এলেই হয়।
সন্দিগ্ধভাবে বিমলার মুখখানা নিরীক্ষণ করিয়া কিশোর বলিল, তার মানে কী হল?
বিমলা বলিল, ঐ দেখো, চোরের মন বোঁচকার দিকে। মানে আবার কী হবে? নতুন প্রতিবেশী এসেছেন—সেদিন অত ভদ্রতা করলেন—ওঁদের বাড়ি গিয়ে ভাব-সাব আলাপ-পরিচয় করতে হবে না? সেই কথাই তো বলছি, একদিন গিয়ে দেখা-শুনা করে আসব।
উঁহু, কৈফিয়ত খুব জোরালো শোনাচ্ছে না। কথার মধ্যে কী একটা ইশারা ছিল, এবার সেটা সামলে নিলে।
কিছু সামলে নিইনি। তোমার মনে সন্দেহ, তাই ওকথা ভাবছ।
আর তোমার মনে সন্দেহের নামগন্ধও নেই?
না, তুমি আমার লক্ষ্মণ দেওর, তোমাকে কি সন্দেহ করতে পারি? বলিয়া সস্নেহ-কৌতুক-তরল দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিল।
কিশোর আহারে মন দিল।
দু-একটা অন্য কথার পর বিমলা জিজ্ঞাসা করিল, তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে, আচ্ছা ঠাকুরপো, মেয়েটি দেখতে কেমন?
এবার কিশোরের পালা, সে বলিল, কোন্ মেয়েটি?
কোন মেয়েটি আবার—পাশের বাড়ির মেয়েটি?
ও, কিশোর বিবেচনা করিয়া বলিল, কালো।
কার মত গায়ের রং হবে—আমার মত?
বললুম না কালো? তুমি কি কালো?
আচ্ছা, তবে আমাদের ঝির মত?
না, অতটা নয়। এই ধরো, আমার ওপর আরও দু পোঁচ।
বিমলা বিচারকের মত মুখ করিয়া বলিল, তাহলে কালো বলা চলে না–শ্যামবর্ণ।
বেশ, তবে শ্যামবর্ণই।
উজ্জ্বল শ্যামবর্ণও হতে পারে।
তা পারে, আশ্চর্য নয়।
আচ্ছা। আর মুখ-চোখ?—গড়ন?
কিশোর যেন চিন্তা করিতে করিতে বলিল, মুখ-চোখ—আছে। আর গড়ন যতদুর মনে পড়ছে—
না ঠাট্টা নয়। সত্যি বলো, মুখ-চোখ ভাল নয়?
কিশোর একটু গম্ভীর হইয়া বলিল, কি জানি বৌদি, আমি অত ভাল করে দেখিনি।
বিমলা বলিল, তুমি বড় লাজুক, ঠাকুরপো; ভাল করে মুখের পানে তাকাতেও পারনি বুঝি?
কিশোর তাড়াতাড়ি বলিল, না না, তাকাব না কেন? দেখতে মন্দ নয়—চলনসই। কিন্তু বৌদি, পারের বাড়ির মেয়ের সম্বন্ধে এসব আলোচনা করা কি উচিত? তোমার সম্বন্ধে যদি কেউ এভাবে। আলোচনা করত, আমার কিন্তু একটুও ভাল লাগত না।
আমরা মুখ মেয়েমানুষ, অমন আলোচনা করে থাকি। তাহলে মেয়েটি চলনসই?
অনিচ্ছাভরে কিশোর বলিল, হ্যাঁ।
বিমলা ফিক্ করিয়া হাসিয়া ফেলিয়া বলিল, ঠাকুরপো, আজ মেয়েটিকে আমি দেখেছি। আমার ঘরের গলির দিকের জানলা দিয়ে ওর শোবার ঘর দেখা যায়।
কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া কিশোর বলিল, তবে আমাকে এত জেরা করলে কেন?
দেখছিলুম, সত্যি কথা বল কিনা।
আশ্চর্য হইয়া কিশোর বলিল, সত্যি কথা বলব না কেন?
কী জানি, যদি লুকোও।
তোমার মনের কথাটা কী বলল তো,বৌদি?
বিমলা বলিল, আমার মনের কথা আবার কী? তোমার মনের কথাই জানতে চেয়েছিলুম।
আমার মনের কথা হচ্ছে এই যে, একটি ভদ্রমহিলার সঙ্গে আলাপ হয়েছে, কিন্তু তার নাক, মুখ, চোখ, রঙ, গড়ন কেমন—এ নিয়ে আমি মনে মনেও কোনরকম আলোচনা করিনি।
মনে মনে হাসিয়া বিমলা বলিল, তা তো দেখতেই পাচ্ছি–নইলে আর চলনসই বলতে না। রঙ ময়লা হোক–কিন্তু মেয়েটি সত্যিই সুন্দরী, ঠাকুরপো। মহাভারত পড়েছ তো? স্বয়ংবরসভা মনে আছে—যে বিন্ধিবে লভিবে সে কৃষ্ণা গুণবতী! ওকে একবার দেখেই মনে হল ও সেই কৃষ্ণা গুণবতী, যার জন্যে আর্যাবর্তের রাজারা সব উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন। সে-ও কালো ছিল, ঠাকুরপো।
কিশোর কোন উত্তর না দিয়া গম্ভীর মুখে উপরে উঠিয়া গেল। ভ্রমণোপযোগী জামা কাপড় পরিয়া, ছড়ি হাতে সে নামিয়া আসিতেই বিমলা বলিল, এই নাও, পান ধরো। আর মুখগোমড়া করে থাকতে হবে না। মেয়েমানুষ মেয়েমানুষের সম্বন্ধে অমন জিজ্ঞেস করে—ওতে দোষ হয় না। নাও, এবার হাসো তো দেখি।
কিশোর হাসিয়া ফেলিল, না বৌদি, এ ভারি অন্যায়—
আচ্ছা, আচ্ছা, অন্যায়। কিন্তু তুমিও এবার থেকে আমার কাছে সত্যি কথা বোলোলুকিও না।বলিয়া হাসিতে হাসিতে কলঘরের দিকে প্রস্থান করিল।