অনুপম ও হেমাঙ্গিনীর লক্ষ্য যদিও এক ও অভিন্ন ছিল, তথাপি মাতা-পুত্রের কার্যপ্রণালীতে বৈষম্য দেখা দিয়াছিল। অনুপম অত সুক্ষ্মভাবে সব দিক বাঁচাইয়া কাজ করিবার অর্থ বুঝিত না। কিশোরের উপর তাহার তীব্র বিদ্বেষ জন্মিয়াছিল, যে কোন উপায়ে তাহাকে অপদস্থ করিয়া নিজের কার্যসিদ্ধি করিতে পারিলে সে আর কিছু চাহে না।
হেমাঙ্গিনী কিন্তু অন্য পথে চলিয়াছেন। কিশোর যে লম্পট দুশ্চরিত্র নহে তিনি তাঁহার পরিণত বয়সের অভিজ্ঞতার দ্বারা মনে মনে বুঝিয়াছিলেন, সুতরাং তাহার চরিত্রের প্রতি আক্রমণ শেষ পর্যন্ত। স্থায়ী ফলপ্রদ হইবে কি না, এ বিষয়ে তাঁহার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। এরূপ একটা অপবাদ মিথ্যা বলিয়া প্রতিপন্ন হইলে অপবাদকারীর প্রতি তাহার ফল যে শুভ হয় না, এ কথাও তাঁহার অজানিত ছিল না। তাই দুই-একটা লোভনীয় অর্ধ-প্রমাণ হাতের কাছে পাইয়াও তিনি তাহার সদ্ব্যবহার করিতে কুণ্ঠিত হইতেছিলেন। কিশোরের সহিত বিমলার সম্বন্ধটা বস্তুত নিদোষ হইলেও সাধারণ পাঁচজনের দৃষ্টিতে যে অত্যন্ত সন্দেহজনক, তাহাতে সংশয় নাই। বাহিরের লোকের কাছে শুদ্ধমাত্র এই একত্র থাকাটা অতিশয় নিন্দনীয় সম্পর্কের দিকে ইঙ্গিত করিতে থাকে, এবং অন্যের সম্বন্ধে মন্দ কথাটা নির্বিবাদে বিশ্বাস করিয়া লওয়ার দিকে মানুষের মনে এমন একটা সহজ প্রবণতা আছে যে বেশী সাক্ষ্যপ্রমাণ না পাইলেও, কেবল মাত্র একটা তুচ্ছ নৈতিক সাবধানতার বিধি লঙ্ঘন করার অপরাধে কাহারও বিরুদ্ধে। অতিবড় ব্যভিচারের অভিযোগও অভ্রান্ত সত্য বলিয়া স্বীকার করিয়া লইতে তিলমাত্র দ্বিধা হয় না।
হেমাঙ্গিনী কিন্তু এই সুতীক্ষ অস্ত্রটি কিশোরের বিরুদ্ধে আপাতত প্রয়োগ করিতে প্রস্তুত ছিলেন না। নিজের বুদ্ধি ও কার্য-নৈপুণ্যের প্রতি তাঁহার অসীম আস্থা ছিল। তাই এক ঢিলে ঢিলে দুই পাখি মারিয়া যাহাতে তিনি সুহাসিনীর দিক হইতে কিশোরের চিত্তকে অন্যদিকে আকৃষ্ট করিয়া লইতে পারেন, সেই চেষ্টাতেই নিজের সুন্দরী ভ্রাতুস্পুত্রীকে আনিয়া রঙ্গস্থলে ছাড়িয়া দিয়াছিলেন ও মনে মনে কামনা করিতেছিলেন—যাহাতে সাপও মরে অথচ লাঠিও না ভাঙে। করবীর স্বামী হিসাবে কিশোরকে কল্পনা করিতে তাঁর আপত্তি ছিল না, বরং ইহাই এ জটিল সমস্যার একমাত্র সু-সমাধান বলিয়া তাঁহার মনে হইয়াছিল।
অনুপম কিন্তু গোঁ-ভরে নিজের পথে চলিয়াছিল। হেমাঙ্গিনীর কুটনীতি তাহার মনঃপূত হইতেছিল না। কিন্তু প্রকাশ্যে মাতার বিরুদ্ধতা করিবার সাহসও তাহার ছিল না, তাই সে গোপনে গোপনে নিজের প্রবৃত্তিমত কাজ করিতে লাগিল। এক জাতীয় লোক আছে, নিজের স্বার্থের ব্যাঘাতকারীকে তাহারা নির্বিচারে দুষ্ট লোক বলিয়া বিশ্বাস করিয়া লয়, নিজের স্বার্থের ন্যায়-অন্যায় বিচার করে না। অনুপম সেই শ্রেণীর লোক। সে নানা প্রকারে নানা দিক দিয়া কিশোরের অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল এবং এই বলিয়া নিজের মনকে প্রবোধ দিল যে, দুষ্টের দমন করিতে গেলে কোন অস্ত্রই পরিত্যাজ্য নয়। যুদ্ধে এবং প্রণয়ে অনুচিত কিছু নাই।
এ দিকে কিশোরের তপোভঙ্গ করিবার ভার যাহার উপর পড়িয়াছিল সেই নির্দোষ বিঘ্নকারিণীটি পরম আনন্দেই দিন কাটাইতেছিল। পিসীমার অভিসন্ধি টের পাইলে করবীর মত সরলমনা মেয়েও বোধ করি লজ্জায় ও ধিক্কারে এই অশোভন কলাকৌশল ও ষড়যন্ত্র হইতে দূরে সরিয়া দাঁড়াইত। এমন কি, সুহাসিনীর প্রতিদ্বন্দ্বিরূপে তাহাকে আসরে দাঁড় করানো হইয়াছে, ইহা ঘুণাক্ষরে সন্দেহ করিলে সে রাগারাগি চেঁচামেচি করিয়া একটা কাণ্ড বাধাইয়া তুলিত এবং হয়তো কিশোরের সম্মুখে সকল ষড়যন্ত্র ফাঁস করিয়া দিতেও দ্বিধা করিত না। কিন্তু সে বেচারী এ-সব কিছুই জানিত না। নিতান্তই অন্ধকারে থাকিয়া সে কিশোরের প্রেমে হাবুড়ুবু খাইতেছিল।
করবীর জীবনে অবশ্য প্রেমে পড়া এই প্রথম নহে, ইতিমধ্যে আরও দুতিনবার হইয়া গিয়াছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কোনটাই দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই।
সেদিন বৈকালে করবী সাজগোজ করিয়া পিসীমার বাড়ি যাইবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময় কিশোর একগুচ্ছ করবীফুল হাতে লইয়া উপস্থিত হইল।
বিবাহের কথাবার্তা স্থির হইয়া যাইবার পর কিশোর একবারমাত্র বিনয়বাবুর বাড়ি গিয়াছিল। কিন্তু তাহাকে দেখিয়া সুহাসিনী যেরূপ লজ্জিতভাবে ঘর হইতে উঠিয়া গেল এবং সে থাকা পর্যন্ত আর ফিরিয়া আসিল না, তাহাতে কিশোর নিজেও বড় কুণ্ঠিত হইয়া পড়িল। বাড়ি আসিয়া সে ভাবিয়া দেখিল যে, তাহাদের সম্বন্ধ এখন এমন হইয়া দাঁড়াইয়াছে যে, বিবাহের পূর্বে সুহাসিনীর সহিত মেলামেশা করা তাহার উচিত হইবে না। বিলাতী কোর্টশিপ ব্যাপারের বিরুদ্ধে তাহার মনে একটা মজ্জাগত বিরূপতা ছিল; এবং সুহাসও যে, যাহার সহিত বিবাহ স্থির হইয়া গিয়াছে, প্রকাশ্যভাবে নিত্য তাহার সাহচর্যকে কুণ্ঠার চোখে দেখে, তাহা বুঝিয়া সে বেশ তৃপ্তি পাইল। সে স্থির করিল আপাতত আর অকারণে বিনয়বাবুর বাড়ি যাইবে না।
কিন্তু প্রত্যহ কারণে অকারণে বিনয়বাবুর বাড়ি গিয়া এমন একটা অভ্যাস হইয়া গিয়াছিল যে, সময় উপস্থিত হইলে মন ছটফট করিতে থাকিত। তাই দুচার দিন বাড়িতে চুপ করিয়া বসিয়া থাকিবার পর সে বৈকালে বেড়ানোর পূর্বতন অভ্যাসটা পুনরুজ্জীবিত করিবার চেষ্টা করিল।
ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা ব্যাপার ঘটিয়া তাহাকে উদ্ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছিল। ইদানীং কলেজের সুমহলে তাহাকে লইয়া বিশেষ একটা আন্দোলন আলোচনা, এমন কি হাসি-মস্করা চলিতেছে, তাহার আভাস সে মাঝে মাঝে পাইতেছিল। একদিন ক্লাশে ঢুকিয়া হঠাৎ তাহার চোখে পড়িল, বোর্ডের উপর খড়ি দিয়া বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে—বিমলা। সেদিন সে ইহার ইঙ্গিতটা ধরিতে পারিল না, কিন্তু দ্বিতীয় দিন যখন ঐ নামটার সঙ্গে হাটে হাঁড়ি এই দুটা শব্দ বোর্ডের উপর আরও বড় বড় অক্ষরে লেখা দেখিল এবং ক্লাশের দিকে চক্ষু ফিরাইতেই দেখিল, দেড় শত ছেলের চোখের অনুসন্ধিৎসা তাহার মুখে অপরাধের চিহ্ন অন্বেষণ করিতেছে, তখন কিছুই তাহার বুঝিতে বাকি রহিল না। নিমেষমধ্যে তাহার মুখখানা ক্রোধে কালো হইয়া উঠিল। কিন্তু সে আত্মসংবরণ করিয়া যথানিয়মে লেকচার দিয়া গেল, কাহাকেও কোন কথা জিজ্ঞাসা করিল না। ঘন্টা শেষ হইলে বিশ্রামঘরে গিয়া সে মাথায় হাত দিয়া ভাবিতে লাগিল, এ কাহার কাজ? তাহার পারিবারিক জীবন লইয়া এমন প্রকাশ্যভাবে কলেজের ছাত্রদের মধ্যে ঘাঁটাঘাঁটি করিতেছে কে?
কিন্তু যে-ই হউক, কেবল ছাত্রমহলে একথা প্রচার করিয়াই যে সে ব্যক্তি নিশ্চিন্ত নাই, তাহার প্রমাণ কিশোর অবিলম্বে পাইল। পরদিন কলেজের প্রিন্সিপ্যাল তাহাকে নিজের ঘরে ডাকিয়া পাঠাইলেন; সে উপস্থিত হইলে নিঃশব্দে দেরাজ হইতে একখানা চিঠি বাহির করিয়া তাহাকে পড়িতে দিলেন; বেনামী চিঠি পড়িতে পড়িতে কিশোরের রগের শিরগুলি ফুলিয়া উঁচু হইয়া উঠিল। সে যে একজন স্রষ্টা স্ত্রীলোকের সহিত প্রকাশ্যে সহবাস করিতেছে, অজ্ঞাত পত্রলেখক এই সংবাদটি প্রিন্সিপ্যাল মহোদয়ের গোচর করিয়াছেন, এবং একজন অধ্যাপকের এইরূপ ব্যভিচারপূর্ণ জীবনযাত্রা ছাত্রদের নৈতিক চরিত্রের পক্ষে কিরূপ হানিকর তদ্বিষয়ে দীর্ঘ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করিয়া পত্ৰ শেষ করিয়াছেন।
চিঠি প্রত্যর্পণ করিয়া কিশোর জিজ্ঞাসা করিল, আপনি এখন কী করতে চান?
প্রিন্সিপ্যাল গম্ভীর-মুখে বলিলেন, বোসো। এ চিঠি কে লিখেছে, তোমার সন্দেহ হয়?
না?
তোমার কেউ শত্রু আছে?
থাকতে পারে—জানি না।
কিন্তু এরকম একটা দুর্নাম কে দিলে, কেনই বা দিলে, তাহার একটা নিরাকরণ হওয়া দরকার।
কিশোর নীরবে বসিয়া রহিল, কিন্তু তাহার চোখ দুটা অসহায় ক্রোধে জ্বলিতে লাগিল।
প্রিন্সিপ্যাল চিঠিখানা তুলিয়া ধরিয়া বলিলেন, এর অভিযোগ সমস্তই মিথ্যা–কী বলো?
কিশোর কঠিন স্বরে বলিল, আপনি কি আমার কৈফিয়ত তলব করছেন?
ধীরভাবে প্রিন্সিপ্যাল বলিলেন, কলেজের কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কৈফিয়ত তলব করলেও সেটা অনুচিত হয় না। কিন্তু আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি মাত্র।
কিশোর আরও কঠিন হইয়া বলিল, আমায় মাপ করবেন, আমি কৈফিয়ত দিতে অক্ষম। দরকার হয়, আমি কর্মে ইস্তফা দিতে প্রস্তুত আছি।
প্রিন্সিপ্যাল প্রবীণ লোক, কলেজের অধ্যক্ষতা করিয়া জীবন কাটাইয়াছেন, যুবক চরিত্রের অন্ধ্ররন্ধ্র তাঁহার সুপরিচিত। বিশেষ, কিশোর তাঁহার কলেজেরই ছাত্র ছিল, তাহাকে তিনি ভাল করিয়া চিনিতেন। শুধু অপরাধীই যে কৈফিয়ত দিতে ভয় পায় তাহা নহে, আত্মমর্যাদাশীল তেজস্বী ব্যক্তিও যে মিথ্যা দোষে অভিযুক্ত হইয়া নিজের সাফাই গাহিতে ঘৃণা বোধ করে, ইহাও তাঁহার অপরিজ্ঞাত ছিল না। তিনি কিশোরের গায়ে হাত রাখিয়া বলিলেন, কিশোর, এ যে মিথ্যা অপবাদ, তা আমি জানি। কিন্তু কলেজের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আমার অনুসন্ধান করা উচিত নয় কি—তুমিই বলো? তা ছাড়া আমি তোমাকেই জিজ্ঞাসা করছি, আর কাউকে তো জিজ্ঞাসা করিনি করবও না। আমি বন্ধুভাবে কেবল জানতে চেয়েছিলাম, কে তোমার এমন অনিষ্ট করতে চায় এবং কতটুকু সত্যকে ফেনিয়ে তুলে সে এই মিথ্যার সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আজ থাক, আজ তোমার মন ভাল নেই। আর একদিন তোমার মাথা ঠাণ্ডা হলে এ বিষয়ে আলোচনা করা যাবে। এই বলিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন। কিশোর এই ভক্তিভাজন গুরুতুল্য লোকের প্রতি অকারণ রূঢ়তা প্রকাশ করার জন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হইয়া ফিরিয়া আসিল।
সেদিন কিশোর সকাল সকাল বাড়ি ফিরিয়া আসিল, কিন্তু তাহার মনের অশান্তি দূর হইল না। এ এমনই কথা যে বৌদিদির কাছে বলিয়াও হৃদয়ভার লাঘব করা যায় না। ঘরে চুপ করিয়া বসিয়া থাকলে ঐ কথাটাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া মনকে উৎপীড়িত করিতে থাকিবে। এইরূপ অবস্থার কী করিয়া এ অন্তদাহের হাত হইতে নিস্তার পাইবে স্থির করিতে না পারিয়া হাঠৎ তাহার স্মরণ হইল করবীর কথা। করবী দুইবার তাহাকে নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করিয়াছে, এতদিন কেবল অবহেলা। করিয়াই নিমন্ত্রণ রক্ষা করা হয় নাই। কিশোর আর দ্বিধা না করিয়া উঠিয়া পড়িল এবং কালোচিত শেভূষা পরিয়া করবীর পিতৃভবনের উদ্দেশ্য যাত্রা করিল।
চৌরঙ্গীর দিকে সাহেব-পল্লীতে করবীদের বাড়ি। ধর্মতলার ট্রাম হইতে নামিয়া পথে হগ সাহেবের বাজারের ভিতর দিয়া যাইতে যাইতে একটা ফুলের দোকানে অনেক লাল ও সাদা করবীফুল দেখিয়া কিশোর একগুচ্ছ তাহাই কিনিয়া লইল।
কিশোরকে দেখিয়া করবী ভারি খুশি হইল, ছুটিয়া আনন্দিত কলকণ্ঠে তাহার অভ্যর্থনা করিল। ভতরে গিয়া বসাইবার পর কিশোর তাহার সাজ-সজ্জার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল, আপনি কোথাও যাচ্ছিলেন, আমি এসে বিঘ্ন করলুম।
করবী বলিল, তা হোক, কোথাও যাওয়ার চেয়ে আপনি এসেছেন, এতেই আমি বেশী খুশি হয়েছি।
কিশোর হাতের ফুলগুলা করবীকে দিয়া বলিল, এই ফুলগুলো আপনার নামে আত্ম-প্রচার করে নজেদের দর বাড়াবার চেষ্টা করছিল, তাই দেখে অপরাধীদের আপনার কাছে ধরে এনেছি।
করবী একবার কিশোরের স্মিতমুখ ও একবার তাজা ফুলগুলি নিরীক্ষণ করিয়া হাসিয়া উঠিল, ওঃ! কিন্তু তা তো নয়। বরং আমিই ওদের নাম জাল করে নিজেকে ওদের নামে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করছি।
কিশোর মাথা নাড়িয়া বলিল, কখনই না। আমি ঠিক জানি ফুলগুলো ঝুটো, আপনি সাচ্চা।
করবী করতালি দিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, আচ্ছা কিশোরবাবু, আপনি এমন সুন্দর সুন্দর কথা তৈরি করে বলেন কী করে? আমি তো একেবারেই পারি না, যা মুখে আসি বলে ফেলি!
কিশোর বলিল, ভগবান আপনাকে অনেক গুণ দিয়েছেন, মনের কথা মুখে প্রকাশ করতে একটুও কষ্ট হয় না। আমি হতভাগ্য—প্রাণের কথাটি বলতে হলে অনেক ভেবেচিন্তে ভাষাকে আয়ত্ত করে তলব বলতে হয়। সেই জন্যই বোধ হয় অমন ছাপার অক্ষরের মত শোনায়।
করবী সপ্রশংস দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, আপনি অদ্ভুত লোক। এই ছুতো করে আবার একটা মপ্লিমেন্ট দিয়ে দিলেন। আপনার মত এমন কমপ্লিমেন্ট দেবার ক্ষমতা আমি কারুর দেখিনি– সাহেবদেরও না।
কিশোর বলিল, যার কোন গুণ নেই, বিনীতভাবে কথা বলবার ক্ষমতাও যদি তার না থাকে, তাহলে সে যে নিতান্তই অপাঙক্তেয় হয়ে পড়বে।
করবী ঘরের চারিকোণে রূপার ফুলদানিতে ফুলগুলি সাজাইয়া রাখিয়া, একটি সবৃন্ত লাল মঞ্জরী হাতে লইয়া কিশোরের সম্মুখে আসিয়া বলিল, উঠুন। এইটে আমার চুলে পরিয়ে দিন তো! বলিয়া কবরীবদ্ধ মাথাটি কিশোরের দিকে ফিরাইয়া দাঁড়াইল।
কিশোর মনে মনে ভারি কৌতুক অনুভব করিল। করবীর ছেলেমানুষের মত অসঙ্কোচ অনেক ময় শালীনতাকে ভ্রুক্ষেপ করে না। যাহার সঙ্গে মাত্র দুদিনের পরিচয়, এরূপ যুবকের দ্বারা নিজের বরী পুষ্পশোভিত করিয়া লইতে তাহার বাধে না, তাহার প্রাণের এই নির্মল নির্মুক্ততা অত্যন্ত মঠাভাবেই কিশোরের হৃদয় স্পর্শ করিল। আজ তাহার প্রাণে অনেকখানি গ্লানি লুকাইয়া ছিল, প্রবীর এই বিশ্বাসপূর্ণ বন্ধুত্ব যেন তাহার মুছিয়া পরিষ্কার করিয়া দিয়া গেল। সে তাহার খোঁপার মধ্যে অপটু হস্তে ফুল খুঁজিয়া দিতে দিতে মেহামনে ভাবিতে লাগিল, আজ যদি তাহার করবীর মত কেটি সহোদরা ভগিনী থাকিত, সেও বোধ করি এমনই অলজ্জিত অকুণ্ঠ অধিকারে দাদার সাহায্যে নজের কুন্তল-শোভা বর্ধিত করিয়া লইত।
দফুল পরানো হইলে করবী চকিতের ন্যায় অদূরের একটা আয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া লইয়া সহাস্যমুখে কিশোরের দিকে ফিরিল; তারপর অঙ্গুলি দিয়া শাড়ির দুপাশের দুই অংশ ধরিয়া পায়ের পিছনে পা দিয়া হাঁটু মুড়িয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল, থ্যাঙ্ক ইউ।
কিশোর অবাক হইয়া বলিল, ও কী হল?
করবী চঞ্চল চোখে চাহিয়া বলিল, ওকে ক্যার্টসি বলে—তাও জানেন না?—এখন চলুন, মার সঙ্গে দেখা করবেন। মা রোগা মানুষ, বেশী চলতে ফিরতে পারেন না, ওপরেই থাকেন। বাবা এখনও অফিস থেকে ফেরেননি, কিন্তু তিনিও এসে পড়লেন বলে। বাবা এলে সবাই মিলে চা খাওয়া যাবে। ওঃ—আপনি বুঝি আবার চা খান না। আচ্ছা, আপনার জন্য অন্য বন্দোবস্ত হবে অখন। ঘোলের সরবতে আপত্তি নেই তো?
তারপর ঘণ্টা দুই কিশোরের ভারি আনন্দে কাটিয়া গেল। করবীর মা রুগ্না স্ত্রীলোক, বেশী নড়াচড়া করা ডাক্তারের নিষেধ। বাড়ি হইতে বাহির হইতে পান না, তাই বাহিরের কেহ দেখা করিতে আসিলে ভারি আহ্লাদিত হন। করবীর বাবা প্রমদাবাবু পুলিস হইলেও বেশ সজ্জন ব্যক্তি, পুলিস জীবনের নানা কৌতুকপ্রদ গল্প বলিয়া আসর জমাইয়া তুলিলেন। পুলিসের লোক যে এত মিশুক ও মজলিশী হইতে পারে, কিশোরের তাহা ধারণাই ছিল না।
রাত্রি প্রায় আটটার সময় ইহাদের অপর্যাপ্ত প্রীতি ও আতিথেয়তা উপভোগ করিয়া পুনরায় আসিবার অঙ্গীকার করিয়া কিশোর যখন বিদায় লইল, তখন সে তাহার চিরাভ্যস্ত প্রফুল্লতা ফিরিয়া পাইয়াছে। সম্পূর্ণ অনাত্মীয় পরিবারের কাছে আত্মীয়ের ন্যায় সমাদর পাইয়া এই কথাই ভাবিতে ভাবিতে সে বাড়ি ফিরিল যে, শত্রু তাহার যত শত্রুতাই করুক, যাঁহারা নিরপেক্ষ তাঁহাদের স্নেহ ও সম্মান আকর্ষণ করিবার মত গুণ তাহার আছে।