অনুপম প্রস্তাব করিবার পর হইতেই সুহাসিনীর বিবাহের কথাটা থাকিয়া থাকিয়া বিনয়বাবুর মনে তীক্ষভাবে খোঁচা দিয়া যাইতেছিল। আর যে বিলম্ব করা উচিত নহে, সুহাসের জন্য একটি সৎপাত্র দেখা দরকার, এই চিন্তা একটা শারীরিক অস্বস্তির মত তাঁহার চেতনার পিছনে লাগিয়া ছিল। অথচ কী করিতে হইবে, কোথায় ভাল পাত্র পাওয়া যায়, এ সকল বিষয়ে তাঁহার জ্ঞান এতই সঙ্কীর্ণ যে কার্যত কিছুই করিয়া উঠিতে পারিতেছিলেন না।
দীনবন্ধুবাবু তাঁহার বহুদিনের পুরাতন বন্ধু, কর্মস্থলে থাকাকালেই তাঁহার সহিত সম্প্রীতি জন্মিয়াছিল। কার্যোপলক্ষে দীনবন্ধুবাবুকে তখন মাঝে মাঝে ও অঞ্চলে যাইতে হইত; তিনি। বিনয়বাবুর গৃহেই আতিথ্য স্বীকার করিতেন। সুহাসিনী সেই সময় ফ্রক পরিয়া বাড়ির উঠানময় ছুটাছুটি করিয়া খেলা করিয়া বেড়াইত। তাহার সুহাস-মায়ী নামটা সেই কালের।
চা-পার্টির রাত্রে দীনবন্ধুকে আড়ালে পাইয়া বিনয়বাবু নিজের সমস্ত দুশ্চিন্তা ও দুভাবনার কথা বন্ধুর কর্ণে ঢালিয়া দিলেন। দীনবন্ধুবাবুর কাছে তিনি কখনও কোন কথা গোপন করিতেন না। অনুপমের প্রস্তাব ও সুহাসিনীর প্রত্যাখ্যানের কথাও প্রকাশ করিয়া বলিলেন।
সমস্ত শুনিয়া দীনবন্ধু বলিলেন, আপনি ঠিকই করেছেন। পাত্র নির্বাচন অবশ্য আমরাই করব। কিন্তু সুহাস-মায়ী এখন বড় হয়েছেন, তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কিছু হতে পারে না। কাজেই তিনি যাকে অপছন্দ করেছেন, অতিবড় সৎপাত্র হলেও তাকে ত্যাগ করতে হবে। সুহাস-মায়ী যে বিবাহের অবস্থা। প্রাপ্ত হয়েছেন, তা আমিও লক্ষ্য করেছি; কিন্তু আমি আশা করেছিলুম খোঁজাখুঁজির দরকার হবে না, ও সমস্যাটার আপনিই সমাধান হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আচ্ছা, আপনার কি মনে হয় না যে, বিশেষ কাউকে মনে মনে পছন্দ করেন বলেই সুহাস-মায়ী সেদিন। অনুপমকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন?
বিনয়বাবু মাথা নাড়িয়া নাড়িয়া বলিলেন, না, আমার তো তা মনে হয় না। সে রকম ছেলে কে-ই বা আছে যাকে সুহাস; তবে আমি অন্যমনস্ক লোক, ভাল করে লক্ষ্য করিনি, তাও হতে পারে।
দীনবন্ধুবাবু অন্যমনস্ক লোক নহেন, তিনি ভাল করিয়াই চারিদিক লক্ষ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু আপাতত কিছু না বলিয়া সব দিক ভাল করিয়া ভাবিয়া দেখিবেন বলিয়া বিনয়বাবুকে আশ্বাস দিলেন। সে রাত্রে কথা এইখানেই স্থগিত রহিল।
পরদিন প্রাতে বিনয়বাবু চিঠি লিখিয়া দীনবন্ধুকে ডাকিয়া আনাইলেন। দীনবন্ধু আসিয়া শুনিলেন, একজন বিখ্যাত মহিলা-ডাক্তার ডাকা হইয়াছে, তিনি উপরের ঘরে সুহাসিনীর স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নিযুক্ত আছেন।
অল্পক্ষণ পরে ডাক্তার মিসেস সরকার নামিয়া আসিলেন। স্ত্রীলোকটির বয়স হইয়াছে—এম. ডি. ডাক্তার; নির্ভীক স্পষ্টবাদিতা সত্ত্বেও সুচিকিৎসার গুণে শহরের সম্রান্ত ও অত্যাধুনিক সমাজে অনেক পুরুষ-ডাক্তার অপেক্ষাও অধিক প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন। বিনয়বাবুর উৎকণ্ঠিত মুখের দিকে চাহিয়া তিনি হাসিয়া বলিলেন, Nothing wrong, আপনি চিন্তিত হবেন না। আপনার মেয়ের স্বাস্থ্য খুব ভাল। এমন clean-limbed healthy girl আমি খুব অল্পই দেখেছি, বিশেষত, আজকালকার এই সব tea-swelling cinema-mad modern মেয়েদের মধ্যে। She is a perfect innocent too! ডাক্তার সরকার সকৌতুকে হাসিলেন, না, ওষুধ-বিষুধ দরকার নেই। কতকগুলো patent medicine গিলিয়ে ওর অমন সুন্দর system নষ্ট করে দিতে চাই না।
বিনয়বাবু বলিলেন, কিন্তু কাল রাত্রে–
ডাঃ সরকার বলিলেন, ও কিছু নয়-momentary excitement, এ বয়সে এমন হয়ে থাকে। Girls will be girls, you know. কোন কারণে মানসিক উত্তেজনা হয়েছিল তাই she felt faint. You need nt wory about that, আচ্ছা, উঠলুম তবে। যন্ত্রপাতির ব্যাগটা লইয়া তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন, আর দেখুন, একটা কথা বলতে চাই, কিছু মনে করবেন না। আপনারা হয়তো মেয়েকে পঁচিশ বছরের করে বিয়ে দেবার পক্ষপাতী। কিন্তু সব দিক দেখেশুনে, দেশের জলহাওয়া বিবেচনা করে আমার মনে হয়—সেটা মেয়েদের স্বাস্থ্যের পক্ষে হানিকর। অনাগত-যৌবনার বিবাহ দেওয়া যেমন ক্ষতিকর, বিগত-যৌবনারও তাই। সব জিনিসেরই দুটো extreme আছে মানেন তো?–আচ্ছা, Good bye! Gratuitous advice দেওয়া আমার একটা অভ্যাস-I hope you dont mind-নমস্কার। বলিয়াই ভিজিট লইয়া সহস্যমুখে তিনি প্রস্থান করিলেন।
বিনয়বাবু হাঁফ ছাড়িয়া বলিলেন, যাক, একটা দুভাবনা দুর হল। দীনবন্ধু বলিলেন, দুর্ভাবনা আপনারই হয়েছিল, আমার কস্মিন কালেও হয়নি। সে যাক, ডাক্তার সরকার বিবাহ সম্বন্ধে যে ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন, সে-ও তো আমাদেরই মনের কথা, কালই এ বিষয়ে আলোচনা হয়ে গেছে। তাহলে ও বিষয়ে আর তর্ক নেই। এখন কথা হচ্ছে, সুহাস-মায়ীর জন্যে একটি ভাল বর দেখা দরকার।
বিনয়বাবু চিন্তিতমুখে বলিলেন, সে তো বুঝেছি, কিন্তু তেমন পাত্র পাওয়া যাচ্ছে কোথায়? তোমার জানাশুনোর মধ্যে এমন কোন–
দীনবন্ধু বলিলেন, সে কথা পরে হবে। তার আগে কী রকম জামাইটি আপনার ঠিক চাই, সেই কথা আমাকে খোলসা করে বলুন তো।
বিনয়বাবু ভাবিতে ভাবিতে বলিলেন, কী রকম? বিদ্বান, সচ্চরিত্র, স্বাস্থ্যবান হবে, এই আর কি! ভদ্রঘরের ছেলে হবে, একেবারে দীন-দরিদ্র না হয়, আর কলকাতার মধ্যে হয়, তা হলেই ভাল,–মাঝে মাঝে মেয়েটাকে দেখতে পাব। বলিয়া তিনি দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিলেন।
দীনবন্ধু হাসিয়া বলিলেন, শেষটাই আপনার আসল কথা, কী বলেন? কিন্তু এসব ছাড়াও আর একটা কথা আছে, সুহাস-মায়ীর পছন্দ হওয়া চাই। ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া হঠাৎ প্রশ্ন করিলেন, আচ্ছা, কিশোরকে আপনার কেমন মনে হয়?
বিনয়বাবু যেন হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, কিশোর? কিশোর?
সহাস্যে দীনবন্ধু কহিলেন, হাঁ কিশোর। চোখের বড় কাছে থাকে বলে নাকটাকে সহজে কেউ দেখতে পায় না। আমার গিন্নী আঁচলে চাবি বেঁধে প্রায়ই বাড়িময় চাবি খুঁজে বেড়ান এবং আমাকে। সন্দেহ করেন। আপনারও তাই হয়েছে, পাশের বাড়ি বলে কিশোরকে লক্ষ্য করেননি।
বস্তুত বিনয়বাবু এ দিক দিয়া কিশোরকে কখনও ভাবিয়া দেখেন নাই। ছেলেটিকে তাঁহার বড় ভাল লাগিয়া গিয়াছিল, যখন তখন তাহাকে ডাকাডাকি করিয়া গল্পগুজবে অথবা জ্ঞানবিষয়ক আলোচনায় সময় কাটাইতেন। সুহাসিনীর সঙ্গে অকুণ্ঠিতভাবে মেলামেশা করিবার সুযোগও কিশোর অন্যান্য পরিচিত বন্ধুদের মত সহজেই পাইয়াছিল। কিন্তু সুহাসিনীর স্বামী হিসাবে তাহার যোগ্যতা-অযোগ্যতার কথা বিনয়বাবু কোন দিন বিচার করিয়া দেখেন নাই। তিনি অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে সোজা হইয়া বসিয়া বলিয়া উঠিলেন, সত্যিই তো! ঠিক তো! হ্যাঁ—এটা অ্যাদ্দিন চোখে পড়েনি! আর ঘরও যে আমাদের পালটি হে! সেদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করেছিলুম, বললে শাণ্ডিল্য পোত্র। চমৎকার ছেলে, দীনবন্ধু, খাসা ছেলে! যেমন স্বাস্থ্য, তেমনই লেখাপড়ায়, আর যার বড় নেই কলকাতার বাসিন্দা। বলিয়া তিনি উত্তেজনার ঝোঁকে হাঁপাইতে লাগিলেন। হঠাৎ এমন মনোমত পাত্র হাতের এত কাছে পাইয়া আনন্দে তিনি কন্যার বিবাহ দিবার মর্মগত অনিচ্ছাও ভুলিয়া গেলেন। সোৎসাহে আবার বলিলেন, হাতের কাছে এমন ছেলে রয়েছে, আর আমরা চারদিকে হাতড়ে বেড়াচ্ছিলুম! ব্যস্, আর দেরি নয়, দীনবন্ধু, তাহলে লাগিয়ে দাও। ছোকরাকে দেখে অবধি আমার যে কী ভাল লেগেছিল, তা আর তোমায় কি বলব। প্রথম থেকেই। বুঝেছিলুম, অমন ছেলে আর হয় না। তাহলে, কি বল দীনবন্ধু, বিবাহের প্রস্তাবটা ওর কাছে—হঠাৎ তাঁহার উৎসাহ বাধাপ্রাপ্ত হইল, থমকিয়া বলিলেন, কিন্তু সুহাস যদি কোন গোলমাল করে। তার যদি মত না হয়।
দীনবন্ধুবাবু সকৌতুকে বিনয়বাবুর এই উত্তেজনা উপভোগ করিতেছিলেন, মৃদুহাস্যে বলিলেন, আমার বিশ্বাস সুহাস-মায়ীর অমত হবে না। আপনি বরং তাকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখুন।
বিনয়বাবু বলিলেন, সেই কথাই ভাল। সুহাসকে এইখানেই ডাকা যাক, কী বল? তার যা লেবার আছে আমাদের দুজনের সামনেই বলুক।
দীনবন্ধু হাসিলেন, দুজনের সামনে বলতে হয়তো সে লজ্জা পাবে, তার চেয়ে আপনি বরং ও-ঘরে–
বিনয়বাবু বলিলেন, আচ্ছা বেশ, আমিই না হয় ওপরে গিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে আসছি। আমার কাছে কিছু লুকোবে না, সেদিন অনুপম সম্বন্ধে তো বেশ পরিষ্কারভাবেই–
দীনবন্ধু বলিলেন, এ সব বিষয়ে না বলা যত সহজ, হ্যাঁ বলা তত সহজ নয়। কিন্তু আমি বলছিলুম আপনি বরং তাকে ডেকে দিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে বসুন, জিজ্ঞাসাবাদ যা করবার, আমিই করছি। আপনি যে রকম অস্থির হয়ে পড়েছেন, কি বলতে কি বলে বসে থাকবেন, তার ঠিকানা নেই।
না, না, তা বলব কেন? তা বলব কেন? এই সময় তোমার বৌদিদি যদি বেঁচে থাকতেন!—তা আচ্ছা, তুমিই ওকে প্রশ্ন করো, একই কথা—ও ঝি। সুহাসকে একবার এই ঘরে ডেকে দাও তো, বলো দীনবন্ধুবাবু ডাকছেন!—আমি তাহলে পাশের ঘরে রইলুম।
কিছুক্ষণ পরে সুহাসিনী ঘরে প্রবেশ করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, কাকাবাবু, আমাকে ডাকছেন?
দীনবন্ধু নতমুখে চিন্তা করিতেছিলেন, বলিলেন, হ্যাঁ, এসো সুহাস-মায়ী, আমার পাশে এসে বোসো, তোমার সঙ্গে দুটো কথা আছে। সুহাসিনী বিস্মিতভাবে তাঁহার পাশে গিয়া বসিল, বাবা কোথায়?
দীনবন্ধু বলিলেন, তিনি ও-ঘরে আছেন–। সুহাস-মায়ী, তুমি যখন খুব ছোট্টটি ছিলে, পাজামা আর ফ্রক পরে একটা সেলুলয়েডের পুতুল বগলে করে বাড়িময় ছুটাছুটি করে বেড়াতে, তখন আমি মাঝে মাঝে তোমাদের বাড়িতে যেতুম। মনে আছে?
সুহাস ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আছে। আপনিই তো আমাকে ঘুড়ি ওড়াতে আর মার্বেল খেলতে শিখিয়েছিলেন। তখন আমি ভারি দুরন্ত ছিলুম–না?
দীনবন্ধু অতীতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, তা আমার মনে নেই। কিন্তু সন্ধ্যার পর আমার কোলের কাছটিতে বসে তুমি যে-সব গোপনীয় মনের কথা আমাকে বলতে, তা বেশ মনে আছে।
সুহাসিনী কৌতূহলী হইয়া বলিল, আমার কিন্তু মনে নেই। কি সব মনের কথা বলতুম কাকাবাবু, বলুন না।
দীনবন্ধু বলিলেন, তোমার কি রকম ছেলে চাই, কটা মেয়ে চাই, কত বড় বাড়ি, কখানা মোটর না হলে একেবারেই চলবে না, এই সব গোপনীয় কথা আমাকে বলতে। বড় হয়ে আমার মত একটা ছেলে যে তোমার নিতান্ত দরকার, একথাও তখন বলেছিলে। সেই জন্যই তো তোমাকে সুহাস-মায়ী ছাড়া আর কিছু বলতে পারলুম না।
ছেলে সম্বন্ধে সে-মত আমার এখনও বদলায় নি, কাকাবাবু বলিয়া সলজ্জহাস্যে সুহাসিনী চোখ নীচু করিল।
দীনবন্ধু বলিলেন, সে আমি জানি। কিন্তু একটা কথা তুমি তখন বলনি, বোধ হয় খেয়াল হয়নি। সেইটে আজ তোমাকে জিজ্ঞাসা করতে চাই।
কী কথা, কাকাবাবু?
দীনবন্ধু গম্ভীরভাবে বলিলেন, আমার মত ছেলে চাও বলেছিলে বটে, কিন্তু ছেলের বাপটি যে কি রকম চাই, তার আভাস দিতে তখন ভুলে গিয়েছিলে। আমারও জেনে নেওয়া হয়নি। কিন্তু এখন যে সেটা জানা দরকার হয়ে পড়েছে, সুহাস-মায়ী।
সুহাসিনীর মাথায় যেন লজ্জার পাহাড় ভাঙিয়া পড়িল। সে আরক্ত নতমুখে বসিয়া ঘামিতে লাগিল।
দীনবন্ধু পূর্ববৎ গম্ভীরভাবে বলিতে লাগিলেন, ক্রটি আমারই, তখনই এই বিষয় আমার সবিশেষ অনুসন্ধান করা উচিত ছিল। কিন্তু ভুল যখন হয়ে গেছে তখন তো আর উপায় নেই। মনে করো, আমরা আবার সেই আগেকার দিনে ফিরে গেছি; আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, আমার বাবাটি কি রকম হলে তোমার পছন্দ হয়? তুমিও সেদিনকার মত মন খুলে সরলভাবে উত্তর দাও দেখি।
সুহাসের চক্ষু বুজিয়া আসিতেছিল, গলাও প্রায় বুজিয়া গিয়াছিল। সে ক্ষীণকণ্ঠে বলিল, আমি ও-সব কিছু জানি না।
দীনবন্ধু বলিলেন, জানো নিশ্চয়, কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছ না। লজ্জা কি মা? তোমার মন না জেনে তত আমরা কিছু করতে পারি না। কিন্তু আর যে জামাই না হলে আমাদেরও চলছে না। নাও, মুখ তুলে আমার পানে চাও দেখি। বলিয়া সস্নেহে তাহার চিবুক ধরিয়া মুখ তুলিতে গেলেন। প্রত্যুত্তরে সুহাস হেঁট হইয়া তাঁহার জানুর মধ্যে মুখ লুকাইয়া অস্ফুটস্বরে কহিল, না, আমি কিছু বলতে পারব না, কাকাবাবু।
পাগল মেয়ে। এত লজ্জা! দীনবন্ধুবাবু মনে মনে খুশিই হইলেন। আস্তে আস্তে তাহার মাথায় হাত বুলাইয়া বলিলেন, আচ্ছা, কী রকম বর চাই, তা তোমাকে বলতে হবে না—আমিই না হয় বলছি–।–একটি ছেলেকে আমার আর তোমার বাবার দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। তুমিও তাকে চেনো—
সভয়ে সপ্রশ্ননেত্রে সুহাসিনী মুখ তুলিল।
কিন্তু তার সম্বন্ধে তোমার মনের কথা কী, তা না জানা পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না। ছেলেটির নাম কিশোর।
বিদ্যুদ্বেগে আবার সুহাস তাঁহার জানুর মধ্যে মুখ লুকাইল।
দীনবন্ধুবাবু ভিতরে ভিতরে সবই বুঝিয়াছিলেন, কিন্তু এই কন্যাপ্রতিম মেয়েটির প্রথম অনুরাগের সলজ্জ মধুটুকু উপভোগ করিবার লোভ সংবরণ করিতে পারিতেছিলেন না। তাই এতক্ষণ নানা ছল চাতুর্যের অবতারণা করিয়া এই নবোন্মোষিত হৃদয়ের সরসোজ্জ্বল মাধুর্যটি নিজের পরিণত বয়সের রসোপলব্ধি দ্বারা সানন্দে আস্বাদন করিতেছিলেন। তিনি জোর করিয়া সুহাসের মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, এবার তো সুহাস-মায়ী, হ্যাঁ না যা-হোক একটা উত্তর দিতে হবে, আর তো চুপ করে থাকা চলবে না। কিশোরের সম্বন্ধে তোমার মনের কথাটি কী, আমাকে চুপি চুপি বলে ফেলো তো দেখি।
সুহাস উত্তর দিল না, চক্ষু মুদিয়া রহিল।
বলবে না? আচ্ছা, চোখ খুলে চাও। তাও না? তবে তো ভারি মুশকিল। কিশোর বেচারার ভাগ্য পরীক্ষা তাহলে হয় কি করে? ভু কুঞ্চিত করিয়া দীনবন্ধুবাবু যেন কী চিন্তা করিলেন, আচ্ছা, এক কাজ করা যাক। ছেলেবেলার সে-খেলা আমি এখনও ভুলিনি, তোমারও নিশ্চয় মনে আছে। এই আমি চোখ বুজে রইলুম, তোমার উত্তর যদি হাঁ হয় তাহলে একটা চুমু খাবে, আর যদি না হয় তাহলে হাতে একটা চিমটি কাটবে—কি–বলো? ব্যস, এইবার আমি চোখ বুজলুম।
দীনবন্ধুবাবু সুহাসিনীকে ছাড়িয়া দিয়া চক্ষু মুদিত করিলেন। কিয়ৎকাল কিছুই হইল না, তারপর সহসা নিজের কপালে ওষ্ঠাধরের মৃদু স্পর্শে তাড়াতাড়ি চোখ খুলিয়া দেখিলেন, সুহাস বিদ্যুতের মত ঘর ছাড়িয়া পলাইয়াছে।
সুহাস—সুহসা-মায়ী—ডাকাডাকিতে কোনই ফল হইল না। সুহাস তখন নিজের ঘরে সশব্দে দরজা বন্ধ করিয়া দিয়াছে।
বিনয়বাবু লাইব্রেরি-ঘর হইতে শঙ্কিতভাবে গলা বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, কী হল?
দীনবন্ধুবাবু পুনশ্চ গাম্ভীর্য অবলম্বন করিয়া বলিলেন, ভয় নেই, আপনি আসুন। আমার যতদূর মনে হল কিশোরকে বিয়ে করতে সুহাস-মায়ীর আপত্তি হবে না।
বিনয়বাবু প্রফুল্ল হইয়া বলিলেন, যাক, এ দিকে তাহলে আর কোন গণ্ডগোল নেই। এখন কিশোরের কাছে কথাটা তুলতে পারলে–
পকেট হইতে ঘড়ি বাহির করিয়া দীনবন্ধুবাবু বলিলেন, সেটা আজ বিকেলবেলা করলেই হবে। আমার কলেজের বেলা হয়ে গেছে, আমি আর বসতে পারব না। উঠলুম। কলেজে অবশ্য তার সঙ্গে দেখা হবে কিন্তু আমি তাকে এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। আপনি মেয়ের বাপ, বলা কওয়া আপনারই দরকার। যাহোক, বিকেলবেলা আমি আবার আসছি, তখন যথা কর্তব্য স্থির করা যাবে। বলিয়া তিনি গাত্রোত্থান করিলেন।