তারপর কিশোরের আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় ন্যূনাধিক ছয় মাস কাটিয়া গিয়াছে।
কিশোর একখানা টেলিগ্রাম পড়িতে পড়িতে রান্নাঘরের সম্মুখে গিয়া ডাকিল, বৌদি, একখানা। তার এল।
জ্বলন্ত উনানের দিক হইতে মুখ ফিরাইয়া উৎকণ্ঠিত দৃষ্টিতে চাহিয়া বিমলা বলিল, কিসের তার, ঠাকুরপো? কোত্থেকে এল?
কিশোর বলিল, বাবা করেছেন। তিনি আজ আসছেন, এই সাড়ে নটার গাড়িতে।
বিমলা দরজার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, কৈ, তাঁর তো আসার কোন কথা ছিল না।
উদ্বিগ্নস্বরে কিশোর বলিল, না। হঠাৎ–। যাই আমি হাওড়ায়, নটাও তো বাজে। বলিয়া জুতা-জামা পরিবার জন্য উপরে উঠিয়া গেল।
বিমলা কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর উনান হইতে কড়াটা নামাইয়া হাত ধুইয়া, কিশোরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ উপরে গেল। কিশোর তখন পাঞ্জাবি পরিয়া হাতে ঘড়ি বাঁধিতেছিল, চৌকাঠের উপর দাঁড়াইয়া বিমলা সঙ্কুচিত স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, আমি যে এখানে আছি, সে কথা তাঁকে লেখা হয়েছিল?
কিশোর একটু কুণ্ঠিত হইয়া বলিল, না, লিখব-লিখব করে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সেজন্যে ভেব না, বৌদি।–বলিয়া তাড়াতাড়ি বাহির হইয়া গেল।
ট্রামে যাইতে যাইতে কিশোর ভাবিতে লাগিল, বাবাকে খবর না দেওয়াটা ভাল হয় নাই। তিনি সেকেলে লোক, হয়তো এটাকে ভাল চোখে দেখিবেন না। উপরন্তু যদি অন্য সূত্রে খবর পাইয়া থাকেন, তাহা হইলে মন্দ ভাবিয়া বসাও বিচিত্র নহে। বিশেষ, সে যখন নিজে কোন খবরই দেয়। নাই, তখন সব দিক দিয়াই ব্যাপারটা অত্যন্ত সন্দেহজনক প্রতীয়মান হয়।
কিশোর জোর করিয়া নিজেকে বুঝাইবার চেষ্টা করিল, সন্দেহজনকই বা কিসে? নিজের বিধবা অনাথা বৌদিদিকে লইয়া এক বাড়িতে থাকা কি এতই নিন্দনীয়? অবশ্য, বিমলা তাহার সত্যিকার বৌদিদি নহে; কিন্তু তাহাতেই বা কী? সে তো বিমলাকে আপনার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতৃবধুর মতই শ্রদ্ধা করে। আর, এটা কীই বা এমন মহামারী ব্যাপার যে দেশসুদ্ধ লোককে সংবাদ না দিলেই নয়?
বাপকে লইয়া ফিরিবার পথে, গাড়িতে কিশোর দুই-একবার কথাটা উত্থাপন করিবার চেষ্টা করিল; কিন্তু কী বলিবে, কেমন করিয়া কথা তুলিবে, ভাবিয়া না পাইয়া কিছুই বলা হইল না। তা ছাড়া, তাহার পিতা পশুপতিবাবু গোড়া হইতেই এমন গম্ভীর হইয়া বসিয়া রহিলেন যে, দুই-একটা সাধারণ কুশল প্রশ্ন ছাড়া ভালমন্দ কোন কথাই সে বলিতে পারিল না।
গাড়ি হইতে নামিয়া বাড়ির ভিতর পা দিবামাত্র বিমলা আসিয়া গলায় আঁচল দিয়া প্রণাম করিল।
পশুপতিবাবু গাম্ভীর্যের সহিত বিস্ময় মিশ্রিত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, এটি কে?
কিশোর দুইবার ঢোক গিলিয়া বলিল, উনি—উনি আমার বৌদি?
পাকা ভ্রূযুগল ঊর্ধ্বে তুলিয়া পশুপতিবাবু বলিলেন, বৌদিদি?
পলকের জন্য বিমলার ভাবলেশহীন মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কিশোর নিজেকে সামলাইয়া লইল। নিজের দুর্বলতাকে মনে মনে ধিক্কার দিয়া সহজ সংযত স্বরে বলিল, হ্যাঁ, বৌদিদি। ওপরে চলুন, সব কথা বলছি।
পুত্রের অনুবর্তী হইয়া পশুপতিবাবু উপরে কিশোরের ঘরে গিয়া বসিলেন। জুতা-জামা ত্যাগ করিবার কোন চেষ্টা না করিয়া জিজ্ঞাসুভাবে পুত্রের মুখের দিকে চাহিলেন, যেন পুরা কৈফিয়ত না শুনিয়া তিনি কোন কাজই করিবেন না।
কিশোর সংক্ষেপে ও সরলভাবে বিমলার আগাগোড়া ইতিহাস বলিয়া গেল।
সমস্ত শুনিয়া পশুপতিবাবু বলিলেন, হুঁ। আমাকে জানাওনি কেন?
জানাব জানাব করে জানানো হয়নি। আমার ভারি অন্যায় হয়ে গেছে।
হুঁ। পশুপতিবাবু কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তারপর হঠাৎ বলিলেন, আমি তোমার বিয়ের সম্বন্ধ করেছি।
কিশোর চমকাইয়া উঠিয়া বলিল, বিয়ের সম্বন্ধ? কিন্তু এখন তো
হাত নাড়িয়া বাধা দিয়া পশুপতিবাবু বলিলেন, কিন্তু তার আগে আজই তুমি ঐ মেয়েমানুষটিকে বিদেয় করে দাও। ওর পয়সাকড়ি থাকে ভালই; না থাকে, নিজের পথ ও নিজে দেখে নেবে।
কিশোর প্রস্তরমূর্তির মত দাঁড়াইয়া রহিল।
পশুপতিবাবু বলিলেন, তোমার নামে নানারকম কুৎসা আমার কানে উঠেছিল, তাই নিজের চোখে দেখতে এলুম। তা দেখছি, কথাটা নেহাত মিথ্যে নয়। কিন্তু এ-সব কানাঘুষো বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। তুমি ছেলেমানুষ, যা করে ফেলেছ তার আর চারা নেই, কিন্তু ঐ স্ত্রীলোকটিকে আর বাড়িতে রাখা চলবে না। আজই ওকে যেতে বলে দাও।
তবু কিশোর ঘাড় গুঁজিয়া নীরব হইয়া রহিল। পশুপতিবাবু একটু নরম হইয়া পুনরায় বলিলেন, আমি তোমাকে দোষ দিচ্ছি না। কলকাতা শহর, তোমার এই উঠতি বয়স, চোখের মোহে অনেকের অমন সর্বনাশ হয়। কিন্তু সময়ে সামলে নেওয়া চাই। তোমার বিয়ের আমি সমস্ত ঠিক করে এসেছি—-মেয়েটি বেশ সুন্দরী
আমি এখন বিয়ে করব না।
আচ্ছা সে না হয় পরে দেখা যাবে। এখন তুমি ঐ মেয়েমানুষটিকে দূর করো তো দেখি। তোমার চোখের নেশা বই তো নয়। দু-দিন পরেই দেখবে—
বার বার বাপের এই কদর্য ইঙ্গিতে লজ্জায়, ক্রোধে, অপমানে কিশোরের নিজের চুল ছিড়িতে ইচ্ছা হইতেছিল। সে অতি কষ্টে আত্মসংবরণ করিয়া ধীরভাবে বলিল, আমি পারব না।
পশুপতিবাবু ধমক দিয়া বলিলেন, পারবে না আবার কী? নিজের মুখে না বলতে পার, আমি বলে দিচ্ছি। এসব বিষয়ে চক্ষুলজ্জা মহাপাপ। না হয় দু-পাঁচ টাকাও যদি লাগে। —
ব্যাকুল হইয়া কিশোর বলিল, বাবা, কি বলছেন আপনি। উনি ভদ্রমহিলা বিধবা, শুদ্ধাচারিণী, ওঁর সম্বন্ধে এসব কথা মনে আনাও পাপ।
পশুপতিবাবু ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, দেখো, আমি তোমার বাপ, একষট্টি বছর বয়স হয়েছে, আমাকে বোকা বোঝাবার চেষ্টা কোরো না।
হতাশ হইয়া কিশোর বলিল, তবে আর কী বলব বলুন! আমার চরিত্রেও কি আপনার বিশ্বাস হয়?
পশুপতিবাবু কহিলেন, বলছি তো, তোমার দোষ কি? পাল্লায় পড়ে অসৎসঙ্গে মিশে অমন কত চরিত্রবান ছেলে নষ্ট হয়ে যায়। সংসার দেখে দেখে আমার চুল পেকে গেল। কিন্তু তোমাকে তো আমি এভাবে অধঃপাতে যেতে দিতে পারি না, শেষ পর্যন্ত বিষয়-আশয় কিছুই যে থাকবে না। ও সব মেয়েমানুষ কালকেউটের জাত, একবার পেয়ে বসলে
কথা শেষ হইবার পূর্বেই কিশোর মাথার একটা প্রবল ঝাঁকানি দিয়া বলিল, ওঁর কথা থাক। আপনি যখন আমাকেও বিশ্বাস করবেন না, তখন আর উপায় কী! কিন্তু আমি ওকে নিরাশ্রয় করে পৃথিবীতে একলা ছেড়ে দিতে পারব না, এই আমার শেষ কথা।
পশুপতিবাবু ক্রোধে অগ্নিবর্ণ হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, পারবে না? বটে! —আচ্ছা তবে আমারও শেষ কথা শুনে রাখো। আজ থেকে তোমার সঙ্গেও আমার কোন সম্পর্ক রইল না। তোমার দুনামের জ্বালায় আমার লোকের কাছে মুখ দেখানো ভার হয়ে উঠেছে, তোমার মত দুশ্চরিত্র কুপুত্রকে আমি ত্যাগ করলুম। আজ থেকে তুমি আমার বাড়িতে মাথা গলিও না। আর তোমাকে মাসোহারাও আমি বন্ধ করে দিলুম। আমার পয়সায় এই সব নির্লজ্জ ব্যভিচার হতে পারবে না।
পশুপতিবাবু কাঁপিতে কাঁপিতে সিঁড়ি দিয়া নীচে নামিয়া চলিলেন। আজ দুই মাস হইতে নিজের কলেজে অধ্যাপকের চাকরি পাইবার পর কিশোর যে আপনা হইতেই মাসোহারা লওয়া বন্ধ করিয়া দিয়াছে রাগের মাথায় সে কথা তিনি স্মরণ করিতে পারিলেন না।
পশুপতিবাবু বাড়ির বাহির হইয়া একেবারে ফুটপাথে গিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, কিশোর ছুটিয়া তাঁহার কাছে গিয়া ব্যগ্র মিনতির কণ্ঠে বলিল, বাবা, আপনার পায়ে পড়ি, এখনই যাবেন না। কাল সমস্ত রাত ট্রেনে এসেছেন–
একখানা খালি ট্যাক্সি যাইতেছিল, পশুপতিবাবু সেটাকে ইঙ্গিতে ডাকিয়া তাহার উপর উঠিয়া বসিলেন।
কিশোর গাড়ির মধ্যে ঝুঁকিয়া তাঁহার পা চাপিয়া ধরিয়া বলিল, বাবা, আপনার পা ছুঁয়ে বলছি—
প্রত্যুত্তরে পশুপতিবাবু কড়া সুরে ট্যাক্সিচালককে বলিলেন, হাঁকো হাওড়া স্টেশন।
ট্যাক্সি বাহির হইয়া গেলে পাংশু-শুষ্কমুখে কিছুক্ষণ ফুটপাথে দাঁড়াইয়া থাকিয়া কিশোর আস্তে আস্তে বাড়ি ঢুকিল। বাপ তো তাহার চরিত্রের উপর একটা জঘন্য সন্দেহ করিয়া সমস্ত সম্বন্ধ ছিন্ন করিয়া দিয়া চলিয়া গেলেন, কিন্তু এদিকে বিমলার কাছে সে মুখ দেখাইবে কি করিয়া? আর এরূপ একটা কুৎসিত ব্যাপারের পর বিমলা যদি আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্য তাহার সংসর্গ ত্যাগ করিতে চায়। এ অপমান যদি সে সহ্য করিতে না পারে!
নিজের ঘরে ফিরিয়া কিশোর দেখিল, মেঝের উপর বাম বাহুতে ভর দিয়া বিমলা হেঁট হইয়া বসিয়া আছে। সে প্রবেশ করিতেই মুখ তুলিয়া জিজ্ঞাসা করিল, রইলেন না? চলে গেলেন?
হ্যাঁ, চলে গেলেন। কিশোর শ্রান্তভাবে একটা চেয়ারে বসিয়া পড়িল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বিমলা বলিল, ঠাকুরপো, আমার জন্য আজ তোমার বাপের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হল। তুমি না হয়ে অন্য আর কেউ হলে আমি এ মনোমালিন্য হতে দিতুম না—নিজে সরে দাঁড়াতুম। কিন্তু তোমাকে তো আমি এ অপমান করতে পারব না। তোমার বাবা বিষয়ী লোক, আমার সম্বন্ধে তিনি যা খুশি ভাবতে পারেন, আমাকে তো তিনি চেনেন না। কিন্তু তোমার মত ছেলেকে বাপ হয়ে তিনি চিনলেন না, মিথ্যে কলঙ্কের বোঝা মাথায় চাপিয়ে দিয়ে গেলেন, এই বড় আশ্চর্য। যাক, তাঁর বিষয়-আশয়ের দিন দিন শ্রীবৃদ্ধি হোক, তোমার মত ছেলে তিনি হারালেন, এই বোধ হয় তাঁর সবচেয়ে বড় লোকসান।
কিশোর দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলিল, বৌদি, বাবা মিথ্যে সন্দেহ করে ছেড়ে গেলেন, তুমিও আমায় ছেড়ে যেও না।
বিমলা উঠিয়া আসিয়া তাহার কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল, না। আমি তোমায় ছেড়ে যাব না। তুমি আর আমি আমরা সাধারণ দুর্বল মানুষ নই, নিজেরা মুখে বললেও এ কথা সত্যি। আমরা দুজনে মিলে দেখাব যে, অপরাধ আমাদের মধ্যে নেই, অপরাধ আছে সমাজের মনে। অন্যান্য সামান্য ছোট মানুষের পক্ষে সতর্কতার যে বিধিনিয়ম আছে, আমাদের বেলায় তা খাটে না। এ কথা সমাজ যদি দেখতে পায় ভালই, না পায় তাতেই বা ক্ষতি কী! আমরা তো জানি, আমরা খাঁটি আছি!–নাও, এখন ওঠো। স্নান করবে চলো, তোমার কলেজের বেলা হয়ে গেছে। বলিয়া বিমলা দ্রুতপদে নীচে নামিয়া গেল।