২০. পরদিন খাওয়া-দাওয়ার পর

পরদিন খাওয়া-দাওয়ার পর বাহির হইতে বেলা বারোটা বাজিয়া গেল।

বিমলা, করবী ও কিশোর এই তিনজনেরই যাওয়া স্থির ছিল, কিন্তু যাত্রা করিবার সময় সুরেন আসিয়া গাড়িতে চাপিয়া বসিল। তাহার বয়স তেরো-চৌদ্দ বছর, এই একদিনেই সে বিমলার বিশেষ অনুগত হইয়া পড়িয়াছে।

করবী তাহাকে ধমক দিয়া বলিল, তুই আবার কোথায় যাবি? তুই তো অনেকবার দেখেছিস।

সুরেন বয়সে এবং অন্তরে ছেলেমানুষ হইলেও কথাবার্তায় বেশ পরিপক, সে তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, দেখলেই বা! আবার বুঝি দেখতে নেই?

করবী অধীর হইয়া বলিল, না না, তুই ব্যাডমিন্টন খেলগে যা না বাপু!

সুরেনও গরম হইয়া বলিল, ব্যাডমিন্টন তুই খেলগে যা, ও তো মেয়েমানুষের খেলা। আমি আজকাল টেনিস খেলি—জানিস?

করবী চোখ পাকাইয়া বলিল, অ্যাঁ—আমাকে তুই বলা! আমি না তোর দিদি! দাঁড়া তো বলিয়া কানের দিকে হাত বাড়াইল।

সুরেন দুই হাতে নিজের কান চাপিয়া ধরিয়া তর্জন করিয়া কহিল, খবরদার করি-দি, কানে হাত দিলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি—দেখুন তো, বৌদি

বিমলা তাহাকে নিজের কাছে টানিয়া লইয়া বলিল, আহা চলুক না ও, আমাদের দেখাতে-শোনাতে পারবে।

সুরেন উৎসাহিত হইয়া বলিল, া আলবত। করি-দি সারনাথের জানে কী? কলা। মিউজিয়মে যে অ্যাস্তবড় হাঁড়ি আছে, দেখেছিস? কত দিনের পুরানো বল দেখি?

তোর আত্তবড় হাঁড়ি আমি দেখতে চাই না।

দুই ভাইবোনে সারাটা পথ ঝগড়া করিতে করিতে চলিল।

সারনাথের ধ্বংসস্তুপে পৌঁছিয়া সকলে মোটর হইতে নামিল। আর একখানা শুন্য ট্যাক্সি মোড়ের উপর দাঁড়াইয়া ছিল; এ সময়ে প্রত্যহই দুই-চারিজন দর্শক মৃগদাবের লুপ্ত গৌরবের চিহ্নগুলি পরিদর্শন করিতে আসিতেন। নিকটেই মিউজিয়ম—তাহাতে খননোদ্ধৃত মূর্তি প্রভৃতি রক্ষিত ছিল। অদূরে একটি বৌদ্ধ মঠ, তাহাতে কতকগুলি মুণ্ডিতশির শ্রমণ বাস করিতেছিলেন। তাঁহারা অধিকাংশই সিংহলী বা ব্রহ্মদেশীয়; বাঙালী বৌদ্ধ সন্ন্যাসীও দুই-একজন ছিলেন।

সম্মুখেই মহাচৈত্যের বিরাট দেহ আকাশে মাথা তুলিয়া আছে। উৎসাহী সুরেনের পশ্চাদ্বর্তী হইয়া সকলে প্রথমে সেই দিকে চলিল। কোথায় চৈনিক পরিব্রাজক পাথরের উপর সোনা বসাইয়া গিয়াছে, হাজার বছরেও তাহাও মুছিয়া যায় নাই; কোনখানটা মেরামত করিতে গিয়া ইংরাজ গভর্নমেন্ট চৈত্যের শিল্প-শোভা কুশ্রী করিয়া তুলিয়াছে; কোন লৌহশৃঙ্খল অবলম্বনে চৈত্যের উপরে উঠিয়া দীপালী সাজাইবার নিয়ম ছিল, এই সমস্ত দেখিতে দেখিতে সকলে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল। দর্শন শেষ হইলে সঙ্ঘারামের খনিত ভূমির উপরে সকলে উপস্থিত হইল। স্থানটা বহু বিস্তৃত, কোথাও প্রকাণ্ড দরদালানের স্তম্ভের পাঠিকাগুলি রহিয়াছে, আর সবই নষ্ট হইয়া গিয়াছে; কোথাও সারি সারি ক্ষুদ্র কুঠুরির ছাদহীন নগ্ন দেওয়ালগুলি সেকালের ছাত্রদের কঠোর কৃসাধনের পরিচয় দিতেছে; কোথাও বা সঙ্কীর্ণ গুপ্ত সুড়ঙ্গ এখনও অটুট অবস্থায় বর্তমান রহিয়াছে। সমস্ত মিলিয়া এমন একটি আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছে যে, দেখিতে দেখিতে অতীতের অসংলগ্ন স্বপ্নে মন তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া যায়।

বিমলা সুরেনের মুখে এই সব স্মৃতি-চিহ্নের সত্য-অসত্য ইতিহাস শুনিতে শুনিতে একেবারে তন্ময় হইয়া গিয়াছিল। কিশোর বুকের মধ্যে কেমন একটা বেদনা অনুভব করিতেছিল; যেন তাহার নিজেরই অতীত জীবনের ইতিহাস এইখানে ছিন্ন হইয়া কালের চরণতলে দলিত পিষ্ট হইয়া পড়িয়া আছে, ইহার মর্মকাহিনী চিরদিন এমনই অনাদৃত অপঠিত রহিয়া যাইবে। করবীও ইহাদের দুজনের দেখাদেখি গম্ভীর হইয়া থাকিবার চেষ্টা করিতেছিল বটে, কিন্তু তাহার মনটা এই সব মৃত অতীতের স্মৃতির সঙ্গে ঠিক সুর মিলাইতে পারিতেছিল না। তাহার সতেরো বছর বয়স, আজ না জানি কি কারণে তাহার বুকের ভিতরটা দুলিয়া দুলিয়া উঠিতেছিল, চোখে যেন কিসের ঘোর লাগিয়াছিল। তাহার সমস্ত দেহটা সুরবাঁধা সেতারের মত বিনা কারণেই রণিয়া রণিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছিল। শুষ্ক নীরস অতীতের কথায় তাহার প্রয়োজন ছিল না। তাহার কি আসে যায় কবে গুপ্ত-সাম্রাজ্যের কোন রানী সঙেঘর জন্য কোন অলিন্দ নির্মাণ করাইয়া দিয়াছিলেন, তাহা জানিয়া?

এইভাবে ঘুরিতে ঘুরিতে করবী ও কিশোর অজ্ঞাতসারে আলাদা হইয়া বিমলা ও সুরেনের নিকট হইতে দূরে পড়িয়া গিয়াছিল, হঠাৎ কিশোর একবার চারিদিকে তাকাইয়া বলিল, বৌদি কোন দিকে গেলেন?

করবী বলিল, সুরেন বোধ হয় কোথাও বসে তাঁকে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে শুরু করে দিয়েছে। চলুন, ঐ স্তম্ভটা দেখে আসি। স্তম্ভের দিকে যাইতে যাইতে করবী আঙুল দেখাইয়া বলিল, দেখুন, আমাদের মত আরও কারা বেড়াতে এসেছে।

কিশোর চাহিয়া দেখিল, একজন পুরুষ ও একটি স্ত্রীলোক দূরে দাঁড়াইয়া একজন ভিক্ষুর সহিত কথা কহিতেছেন। ভিক্ষু অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া তাঁহাদের এটা-ওটা দেখাইয়া কী কথা বলিতেছেন, শুনা গেল না। কিশোর নিরুৎসুকভাবে বলিল, বাঙালী মনে হচ্ছে।

করবী কৌতূহলভরে সেই দিকে তাকাইতে তাকাইতে চলিল।

আধঘণ্টা পরে স্তম্ভ দেখিয়া ফিরিবার সময় হঠাৎ কোন্ দিক দিয়া যেন কী হইয়া গেল। মেয়েমানুষের মনের কথা, যাহা সহজে প্রকাশ হইবার নয়,অচিন্তিতপূর্ব অবস্থার মধ্যে পড়িয়া তাহা দমকা হাওয়ায় বদ্ধ জানালার মত খুলিয়া একেবারে উদঘাটিত হইয়া গেল। কোথাও এতটুকু আড়াল বা আবরণ রহিল না।

প্রাচীন ইষ্টকের দেওয়াল দিয়া ঘেরা চৌবাচ্চার মত একটা স্থানে এক খণ্ড প্রস্তরলিপি দেখিয়া কিশোর সেটা পাঠ করিবার উদ্দেশ্যে নামিয়া পড়িয়াছিল। চারিধারের দেওয়াল হইতে স্থানটা। পাঁচ-ছয় ফুট নীচু, নামিবারও কোন পথ ছিল না, কিশোর উপর হইতে লাফাইয়া পড়িয়াছিল। করবী সেখানে নামিবার কোন সহজ উপায় না দেখিয়া উপরেই দাঁড়াইয়া ছিল।

নিবিষ্টমনে শিলালিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করিতে করিতে কিশোর এক সময় চোখ তুলিয়া দেখিল,করবী হঠাৎ কি মনে করিয়া পাঁচিলের মত দেওয়ালের উপর দিয়া পার হইয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে, কিন্তু কয়েক পদ গিয়া আর যাইতে পারিতেছে না, মাঝখানে দাঁড়াইয়া পড়িয়াছে। তাহার পা দুটা থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। দেওয়ালটা মাত্র হাতখানেক চওড়া, তাহার দুই দিকেই একমানুষ প্রমাণ গর্ত, কিশোর ভীতভাবে চিৎকার করিয়া উঠিল, সাবধান!

কিন্তু সাবধান হইবার মত অবস্থা করবীর ছিল না, সাকাসে তারের উপর খেলা দেখাইতে দেখাইতে মেয়েরা যেমন দুলিতে থাকে, সেও তেমনই একবার এদিক একবার ওদিক দুলিতেছিল। তাহার মুখ কাগজের মত সাদা হইয়া গিয়াছিল। কিশোরের দিকে না চাহিয়াই সে ক্ষীণস্বরে বলিয়া উঠিল, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

করবী যেখানে দাঁড়াইয়াছিল, ছুটিয়া তাহার নীচে গিয়া দাঁড়াইয়া কিশোর বলিল, বসে পড়ো। ঐখানে বসে পড়ো। আমি তোমাকে তুলে আনছি!

কিশোরের কথামত বসিতে গিয়া করবী আর তাল সামলাইতে পারিল না, অস্ফুট চিৎকার করিয়া যেদিকে কিশোর ছিল, সেই দিকে ঢলিয়া পড়িল।

তাহার পতনোম্মুখ দেহ কিশোর অর্ধপথে ধরিয়া ফেলিল বটে, কিন্তু করবীর হাই হীল জুতাসুদ্ধ পা দুটা সজোরে মাটিতে ঠকিয়া গেল। পতনের সঙ্গে সঙ্গে সে প্রাণপণে কিশোরের গলা জড়াইয়া ধরিয়াছিল, মাথাটাও কিশোরের বুকের উপর পড়িয়াছিল। সেই ভাবেই দুইজন ক্ষণকাল দাঁড়াইয়া রহিল। করবীর হৃৎপিণ্ডের দ্রুত স্পন্দন হাতুড়ির মত কিশোরের বুকে আঘাত করিতে লাগিল।

পাঁচ সেকেণ্ড এইভাবে থাকিবার পর কিশোর চমকিয়া করবীকে ছাড়িয়া দিল। কি সর্বনাশ! এই অবস্থায় যদি কেহ তাহাদের দেখিয়া ফেলে।

করবী কিন্তু তাহাকে ছাড়িল না, বাহুবন্ধন হইতে মুক্ত হইবার চেষ্টা করিতেই সে ভীত শিশুর মত। আরও জোরে তাহার গলা আঁকড়াইয়া ধরিল। চক্ষু মুদিতই ছিল, কেবল তাহার বুক হইতে একটি কম্পিত নিশ্বাস বাহির হইল মাত্র।

কিশোর ত্রস্ত ও বিব্রত হইয়া বলিল, কোথাও লাগেনি তো?

করবী সাড়া দিল না। দুশ্চিন্তায় কিশোরের গলা শুকাইয়া গেল—তবে কি করবী মূর্ছা গেল নাকি?

সে ভীতকণ্ঠে ডাকিল, করবী!

করবী একবার চোখ খুলিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া আবার তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করিয়া ফেলিল।

যাক, তবু ভাল, মূর্ছা নহে, কিশোর অস্বস্তিপূর্ণ দেহে কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিয়া শেষে আর কিছু ভাবিয়া না পাইয়া পুনরায় বলিল, তোমার কোথাও লাগেনি তো?

করবী মাথা নাড়িয়া জানাইল, না।

কিশোর সঙ্কুচিত স্বরে বলিল, তাহলে—তাহলে এখান থেকে বেরুবার চেষ্টা করলে হত না?

করবীর মুখে আবার রক্তসঞ্চার হইয়াছিল, সে ঠোঁট টিপিয়া চুপি চুপি বলিল, কেন, আমি তো বেশ আছি। তোমার কি আমাকে বড্ড ভারি বোধ হচ্ছে।

দারুণ শীতেও কিশোরের কপাল ঘামিয়া উঠিল। করবী আঘাত পায় নাই, মূছাও যায় নাই—অথচ তাহার বুকের উপর মাথা রাখিয়া পড়িয়া আছে। অনেক সময় ভয় পাইলে স্ত্রীলোকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শিথিল হইয়া যায়, দাঁড়াইতে পারে না—ইহা সম্ভবপর বটে, কিন্তু তাহার মুখে এ কি রকম কথা! কিশোরের মনে ভীষণ একটা সন্দেহ মাথা তুলিতে লাগিল। তবে কি–

না, না, এ সম্ভব নহে, তাহারই বুঝিবার ভুল। সে তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, কিন্তু কেউ যদি আমাদের এভাবে দেখতে পায়—মনে করবে–

মনে করুক গে—

কিশোর পাথরের মত শক্ত হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। আর সন্দেহ করিবার তিলমাত্র স্থান নাই। করবীর কণ্ঠস্বর, তাহার সিন্দুরবর্ণ মুখ, মুদিত চক্ষু কেবল একটি কথার সাক্ষ্য দিতেছে। কিশোরের মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। এ কী হইল। ইহা সে কখনও ভাবিতে পারে নাই। কিন্তু করবীর এ ভাব তো আকস্মিক নহে, ইহার পশ্চাতে বহুদিনের রুদ্ধ নিগৃহীত আবেগ সঞ্চিত হইয়া আছে। আজ নাড়া পাইয়া ঝরিয়া পড়িয়াছে মাত্র। কিন্তু কেন এমন হইল।

হাওড়া স্টেশনে করবীর সহিত প্রথম চোখাচোখির সময় ইহারই পূর্বাভাস বুঝি সে পাইয়াছিল। কেন, তখন সে সাবধান হয় নাই? কেন করবীর সহিত অসদ্ব্যবহার করিয়া অন্য গাড়িতে গিয়া উঠে নাই? এখন এই অপরিসীম লজ্জার বোঝা লইয়া সে কী করিবে? করবীর এ অনাহুত ভালবাসা কেমন করিয়া প্রত্যাখ্যান করিবে?

কিন্তু–

করবী যদি সত্যই তাহাকে ভালবাসে, তবে কেন সে তাহাকে প্রত্যাখ্যান করিবে? করবীকে ভালবাসিবে না কেন? সে তো মুক্ত, তাহার কোন বন্ধন নাই। সারাজীবন কেন সে উদাসীর মত। কাটাইয়া দিবে? কবীকে বিবাহ করিয়া সে কি সুখী হইতে পারে না? করবীর মত মেয়ে এ সংসারে কয়টা পাওয়া যায়? করবীকে বিবাহ করিয়া তাহার বুকের শূন্য গহ্বর কি ভরিয়া উঠিবে না?

কিশোরের বক্ষ ভেদ করিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল। অন্তর্যামীর কাছে তো ছলনা চলে না। নহিলে, এই যে একটি পূর্ণযৌবনা নারী তাহার বুকের উপর পড়িয়া যথাসাধ্য সরল ভাষায় তাহাকে প্রেম নিবেদন করিতেছে, ইহা তাহার অন্তরে অনুরূপ ভাবের সৃষ্টি করিতে পারিল না কেন? করবী যে পাষাণমূর্তি নয়, বেপমানা স্পন্দমানা নারীমূর্তি,–একথা, তাহার মন তো দূরের কথা, শরীরের তপ্ত রক্তস্রোতেও স্বীকার করিতে পারিল না কেন? না,–করবীকে দিবার মত তাহার কিছু নাই। আর একজন তাহার হৃদয় বলিয়া যাহা কিছু ছিল, তাহা লুটিয়া-পুটিয়া নিঃশেষ করিয়া লইয়া দূরে সরিয়া গিয়াছে। শূন্য হৃদয় লইয়া করবীর প্রেম সে গ্রহণ করিতে পারিবে না। দুদিন পরে এই নিঃস্ব অন্তঃসারশূন্যতা যখন প্রকাশ হইয়া পড়িবে, তখনকার ভয়াবহ জীবনযাত্রার কথা কল্পনা করিয়া সে শিহরিয়া উঠিল। না, করবীকে সে ঠকাইতে পারিবে না।

কিন্তু তবু করবীর প্রতি স্নেহে করুণায় তাহার বুক ভরিয়া উঠিল। তাহার উপরে, কি দুর্বিষহ লজ্জা যে এখনই করবীকে মাটির সহিত মিশাইয়া দিবে তাহা ভাবিয়া সে নিজেও লজ্জায় মরিয়া গেল। কী করিবে, কেমন করিয়া এই দুর্নিবার লজ্জার হাত হইতে করবীকে রক্ষা করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইল না।

কিছুক্ষণ পরে নিজেকে যথাসম্ভব সংযত করিয়া সে করবীর চুলের উপর মৃদু অঙ্গুলিস্পর্শে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিল, করবী, তুমি তো জান–

এই পর্যন্ত বলিয়া কিশোর হঠাৎ থামিয়া গেল। সুর্য পশ্চিমদিকে ঢলিয়া পড়িয়াছিল, ঠিক এই সময় কাহার সুদীর্ঘ ছায়া তাহার পায়ের কাছে আসিয়া পড়িতেই কিশোর চমকিয়া ফিরিয়া চাহিল। করবী চোখ বুজিয়া ছিল বলিয়া কিছু দেখিতে পাইল না। কিন্তু বৈকালী সূর্যের পশ্চাৎপটের সম্মুখে এক অতিপরিচিত নারীমূর্তি দেখিয়া কিশোরের মনে হইল, সে একটা অসম্ভব অবান্তর স্বপ্ন দেখিতেছে। ক্ষণকাল অভিভূতের মত থাকিয়া সে সবলে রূঢ়ভাবে নিজেকে করবীর বাহুমুক্ত করিয়া লইল।

কিন্তু উপর হইতে সেই ক্ষণিক-মূর্তি তখন অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে।

এই সময় দুর হইতে সুরেনের বালককণ্ঠের ডাক আসিল, করি-দিদি! কিশোরবাবু।

কিশোর নীরস নিস্তেজ স্বরে কহিল, চলুন। ওরা আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।

আর কোন কথা হইল না, কেহ কাহারও মুখের দিকে চাহিল না, নিঃশব্দে দুইজনে ফিরিয়া গিয়া বিমলা ও সুরেনের সহিত যোগ দিল।

বিমলা একবার দুইজনের মুখের দিকে চাহিয়াই বুঝিল,—কিছু একটা ঘটিয়াছে। কিন্তু কী ঘটিয়াছে তাহা এই দুটি শুষ্ক পাংশু পীড়িত মুখ দেখিয়া বুঝিতে পারিল না এবং অনুমান করিতে সাহসী হইল না।

অন্তরের দুঃসহ বেদনা চাপিয়া যাহাদের মুখে হাসিতে হয় তাহাদের মত হতভাগ্য অল্পই আছে। কিশোর ও করবী আরও দুই ঘণ্টা, যেন কিছুই ঘটে নাই এমনি অভিনয় করিয়া, সমস্ত দ্রষ্টব্য বস্তু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে দেখিয়া যখন বাড়ি ফিরিবার জন্য মোটরে উঠিল, তখন হৃদয়-ভারাক্রান্ত অবসাদে কিশোরের সর্বশরীর ভাঙিয়া পড়িতেছে এবং করবীর মনে হইতেছে আরও খানিকক্ষণ এইরূপ করিতে হইলে সে আর পারিবে না, তাহার স্নায়ুমণ্ডলী ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া যাইবে। তাই বাড়ি যাইবার পথে এই বৃথাভিনয়ের চেষ্টা আর কাহারও দ্বারা সম্ভব হইল না। সন্ধ্যার অন্ধকারে চলন্ত গাড়ির মধ্যে সকলে স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।

সুরেনের অতিশয় ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল, সেও বাক্যব্যয় করিয়া শক্তিক্ষয় করিতে রাজী হইল না।

বাড়ি আসিয়া নামিবার উপক্রম করিতেই প্রমদাবাবুর ভৃত্য আসিয়া খবর দিল যে, বিনয়বাবু ও সুহাসিনী দেখা করিতে আসিয়াছেন।

করবী তাড়াতাড়ি নামিয়া গেল।

মোটর-ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারেজে তুলিতে নিষেধ করিয়া কিশোর দ্রুতপদে গিয়া প্রমদাবাবুর নিকট উপস্থিত হইল। ভাগ্যক্রমে প্রমদাবাবু একাকী ছিলেন, কিশোর কোন প্রকার ভণিতা না করিয়া বলিল, এখনই আমি বৌদিকে নিয়ে স্টেশনে রওনা হব। শুনেছি, আটটার সময় একটা পশ্চিমের ট্রেন আছে।–কিছু মনে করবেন না আপনারা তো সব জানেন।

তাহার ক্লান্তক্লিষ্ট মুখের দিকে চাহিয়া প্রমদাবাবু কী যেন বলিতে গেলেন, কিন্তু বলিবার পূর্বেই কিশোর নত হইয়া তাঁহার পদধূলি লইয়া বলিল, থাকতে অনুরোধ করে আমার লজ্জা আর বাড়াবেন না। আপনাদের সংসর্গে এলেই আমি অপরাধ করে ফেলি, এই আমার ভাগ্য। দয়া করে একটা  চাকরকে বলে দিন, আমাদের জিনিসপত্রগুলো গাড়িতে তুলে দিক। বৌদি গাড়িতেই বসে আছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *