জন্মাষ্টমীর কয়েকদিন আগে হইতে বিনয়বাবুর শরীর খারাপ যাইতেছিল। তাঁহার সাবেক হাঁপানির ব্যারাম আবার মাথা তুলিয়াছিল। যদিও গুরুতর কিছু নয়, তথাপি দুইদিনের জন্য বৃদ্ধকে বিছানায় পাড়িয়া ফেলিয়াছিল।
এই যন্ত্রণাদায়ক রোগ সারাইবার জন্য তিনি গত পনেরো বৎসর অনেক চিকিৎসা, এমন কি দৈব অবধূত পর্যন্ত করাইয়াছিলেন, কিন্তু কিছুতেই কোন ফল পান নাই। অবশেষে একটা দামী বিলাতী পেটেন্ট ঔষধ সেবন করিলে তখনকার মত উপশম হইত।
জন্মাষ্টমীর পরদিন তিনি অনেকটা ভাল হইয়া উঠিয়াছিলেন। দুপুরবেলা তাঁহাকে বিছানার উপর পিঠে বালিশ দিয়া বসাইয়া হাতে একখানা বই দিয়া সুহাসিনী নিজের ঘরে সেলাই লইয়া বসিয়াছিল। নীচে লাইব্রেরি-ঘরে গিয়া বসিবার জন্য বিনয়বাবু আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন, কিন্তু আজ বৈকালে শরীর ভাল থাকিলে একবারটি নীচে যাইতে দিলেও দিতে পারে, সুহাসিনী এইরূপ আশ্বাস দিয়া রাখিয়াছিল।
আরামকেদারায় হেলান দিয়া বসিয়া সেলাই করিতে করিতে সুহাসিনী অন্যমনস্ক হইয়া পড়িয়াছিল, এমন সময় পশ্চাৎ হইতে কে আসিয়া তাহার চোখ টিপিয়া ধরিল। সুহাসিনী কে রে? বলিয়া চমকাইয়া উঠিল, তারপর আঙুল দিয়া আগন্তুকের হাতে চুড়ি অনুভব করিয়া বলিল, করবী, চোখ ছাড়। কী চমকে দিতেই পারিস মানুষকে।
চোখ ছাড়িয়া গলা জড়াইয়া ধরিয়া করবী বলিল, কি ভাবছিলে ভাই হাসিদি তন্ময় হয়ে?—ঘরে ঢুকলাম—জানতেও পারলে না?
সুহাস বলিল, কিছু নয়। দুপুরবেলা হঠাৎ এলি যে? করবী বিছানার উপর বসিয়া পড়িয়া বলিল, জ্যেঠামশায়ের অসুখ জানতে পারিনি ভাই, আজ সকালে একজনের মুখে শুনতে পেয়ে খবর নিতে এলুম। কেমন আছেন তিনি?
আজ একটু ভাল আছেন। পিসীমা কোথায় রে, তিনি একদিনও বাবাকে দেখতে এলেন না?
পিসীমা তো সাতদিন হল বহরমপুর গেছেন। তাঁর দেওরের সঙ্গে কী মামলা-মোকর্দমা হবে, বাবাকে কাগজপত্র দেখাচ্ছিলেন, তাই জানতে পারলুম। বড়দাও এখানে ছিলেন না, পিসী। বহরমপুর যাবার পর তিনি কোথায় গিয়েছিলেন, আজ সকালে ফিরে এসেছেন।-বড়দার একটা কী হয়েছে, ভাই।
বিস্মিত হইয়া সুহাসিনী বলিল, কী হয়েছে?
তা জানি না, কিন্তু যেন কেমন কেমন লাগল। আজ এসেই আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন, মার সঙ্গেও দেখা করলেন না। আমাকে বললেন, বিকেলে সুহাসদের বাড়ি যাস, ভারি মজা হবে। বলেই। হঠাৎ চলে গেলেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারলুম না। কী মজা হবে ভাই, হাসিদি?
কি জানি। কিছুক্ষণ বিমনা হইয়া বসিয়া থাকিয়া সুহাসিনী বলিল, তাই বুঝি তুই সকাল-সকাল এসে হাজির হয়েছিস মজা দেখবি বলে?
করবী বলিল, দূর! মজা দেখবার জন্যে তো আমার ঘুম হচ্ছিল না। আর বড়দার মজা, সে ভাই। উনিই বোঝেন, আর কেউ বোঝে না। কেবল পরকে অপদস্থ করা, হয়তো ঝগড়া করা। সে ভাই আমার ভাল লাগে না। আমি এলুম নিরিবিলি তোমার সঙ্গে দুটো গল্প করব বলে। বাড়িতে একলা কি মন লাগে?
করবী শয্যায় উপুড় হইয়া দুই উথিত করতলে চিবুক রাখিয়া বলিল, কিন্তু অতদূরে বসে থাকলে কি গল্প হয়? এখানে এসে বোসস না, ভাই।
সুহাসিনী উঠিয়া বলিল, তা বসছি। কিন্তু খালি খালি চুমু খেয়ে যদি বিরক্ত করিস, তাহলে ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। ও সব আদর আমি ভালবাসি না।
করবী বলিল, ইঃ, ভালবাসি না। বল না কেন, আমি চুমু খেলেই ভাল লাগে না, আর কেউ যদি—
চুপ করে পোড়ারমুখী! মেয়েদের স্কুলে পড়ে ভারি ফাজিল হয়েছিস। বলিয়া হাসিতে হাসিতে শাসনচ্ছলে তাহার গাল টিপিয়া দিল।
সুহাস তাহার পাশে আসিয়া বসিলে করবী মুখ গম্ভীর করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, হাসিদি, তোমার সঙ্গে একটা পরামর্শ আছে, ভাই। কিন্তু সে ভারি গোপনীয় কথা, কাউকে বলবে না বলো।
ইতিপূর্বে আরও কয়েকবার করবীর গোপনীয় কথা সুহাসিনী শুনিয়াছে, সুতরাং কথাটা যে কী, তাহা বুঝিতে তাহার বিলম্ব হইল না। সে মুখ টিপিয়া হাসিয়া বলিল, কী কথা শুনি?
করবী গলা ধরিয়া সুহাসের কান নিজের মুখের কাছে টানিয়া আনিয়া ফিসফিস করিয়া গোপনীয় কথা বলিল।)
শুনিয়া সুইস উঠিয়া বলিল, এই কথা! তা এবার নিয়ে কবার হল রে?
কিছুমাত্র লজ্জিত না হইয়া করবী সহাস্যে বলিল, চারবার; কিন্তু এবার ভাই সত্যি-সত্যি, খেলা নয়; একেবারে চিরজীবনের জন্যে—for ever and ever!
সুহাস বলিল, সে তো প্রত্যেকবারেই বলিস। হ্যাঁ রে, তোর দুদিনের জন্যও মতি স্থির থাকে না? সত্যেনবাবু বেচারীর কী দশা হবে?
করবী বিজ্ঞের মত চিন্তা করিয়া বলিল, তোমার কাছে সত্যি কথা বলছি ভাই হাসিদি, সত্যেনবাবু খুব ভাল টেনিস খেলতে পারেন বলে ওঁকে আমার ভারি পছন্দ হত, ভেবেছিলুম সত্যিই বুঝি তাঁকে ভালবাসি। কিন্তু এখন দেখছি সে একেবারেই ছেলেমানুষী।
হাসি চাপিয়া সুহাসিনী বলিল, আর নীতীশবাবু। তিনি কি অপরাধ করলেন?
গলা ফুলাইয়া করবী বলিল, নীতীশবাবু ভাল লোক নয়, ভাই। গলা খাটো করিয়া বলিল, একদিন একলা পেয়ে আমাকে চুমু খাবার চেষ্টা করেছিল। আমি তার গালে এমন একটি চড় কষিয়ে নয়েছিলাম যে, সেই থেকে আর আমার কাছে ঘেঁষে না।
সুহাস খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
করবী বলিল, যাও, তুমি হাসছ—তাহলে বলব না।
না, হাসব না, বল। লোকটি কে?
সন্দিগ্ধ চোখে চাহিয়া করবী বলিল, না, তুমি মুখ টিপে টিপে হাসছ। তোমার গায়ে হাত দিয়ে লেছি ভাই, এবার আর ঠাট্টা নয়, এবার জীবন-মরণের সমস্যা।
তাই তো জানতে চাইছি, জীবন-মরণের সমস্যাটি কে?
করবী একটু মলিন হইয়া বলিল, আমার প্রাণের কথা বুঝতে যদি নিজে কখনো প্রেমে পড়তে। তখন আর হেসে ওড়াতে পারতে না। একটু থামিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিল, আচ্ছা হাসিদি, তুমি কখনো কারু প্রেমে পড়নি?
দূর! আমি কি তোর মত পাগল? বলিয়া সুহাস কোলের উপর হইতে সেলাইটা তুলিয়া লইল।
উৎসাহে উঠিয়া বসিয়া করবী বলিল, বলো না হাসিদি, লক্ষ্মীটি, পায়ে পড়ি।
উৎসাহে দ্রুতবেগে ক্রুশকাঠি চালাইতে চালাইতে সুহাস বলিল, তুই নিজের কথা বল না বাপু, আমার কথা শুনে কী হবে?
সেলাই কাড়িয়া লইয়া করবী বলিল, না বলল। বা রে! আমিই খালি বলব আর তুমি মুখ বুজে থাকবে—সে হবে না।
অল্পকাল চুপ করিয়া থাকিয়া একটু লাল হইয়া সুহাস বলিল, যদি বলি হ্যাঁ, তাহলে কী করিস?
তাহলে গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খাই। তৎক্ষণাৎ সঙ্কল্প কার্যে পরিণত করিয়া আহ্লাদে করবী বলিল, কে ভাই তিনি? নিশ্চয় আমার জানা লোকনয়? আচ্ছা, তিনি তোমাকে ভালবাসেন?
সুহাসিনী উত্তর না দিয়া মৃদু হাসিল। করবী বলিয়া চলিল, নিশ্চয় বাসেন, তোমাকে না ভালবেসে কেউ থাকতে পারে? বিয়ের সব ঠিক হয়ে গেছে, না? আচ্ছা, কি দুষ্টু তুমি, আমাকে একটি কথাও কি বলতে নেই? আমি কিন্তু ব্রাইড-মেড হব, তা এখন থেকে বলে দিচ্ছি। কিন্তু আসল কথাটাই যে বললে না—কে ভাই তিনি যিনি আমার সিদির মনটিকে হরণ করে নিয়েছেন?
বরের বুঝি নাম করতে আছে?
ইস্! এখনো তো বর হয়নি, এরি মধ্যে নাম করতে নেই? তুমি ভাই একদম সেকেলে।
আচ্ছা, কাছে আয়, কানে কানে বলছি!
ইলেকট্রিক বাতির গোলকের মধ্যে হঠাৎ আলো নিভিয়া গেলে চোখের পদার উপর তাহার প্রতিচ্ছবি যেমন ধীরে ধীরে ম্লান হইয়া যায়, নাম শুনিয়া করবীর মুখের হাসিও তেমনি করিয়া মিলাইয়া গেল। তাহার মুখের সমস্ত রক্ত নামিয়া গিয়া মুখখানা ছাইয়ের মত পাংশু হইয়া গেল, কিন্তু পরক্ষণেই আবার এক ঝলক রক্ত ছুটিয়া আসিয়া তাহার চোখের দৃষ্টি পর্যন্ত রক্তাভ করিয়া দিল। দৃষ্টিপথের সম্মুখস্থ কুয়াশার ভিতর দিয়া সে বিহুলের মত চাহিয়া রহিল।
করবীর মুখের দিকে সুহাসের দৃষ্টি ছিল না, থাকিলে বোধকরি সকল কথা প্রকাশ হইয়া দুজনের লজ্জা রাখিবার স্থান থাকিত না। সুহাস নিজমনে হাসিয়া বলিল, দুধ-ভাত খেলেই বরের নাম করার দোষ কেটে যায়। আজ রাত্তিরে দুধ-ভাত খাব।
এইবার করবী যেন ধাক্কা খাইয়া চেতনা ফিরিয়া পাইল। এ মুখের ভাব যে সুহাসকে কিছুতেই দেখাইলে চলিবে না, এ দুঃসহ লজ্জা যেমন করিয়া হউক গোপন করিতে হইবে, এই চিন্তা তাহার মুখখানাকে কাঠের মত শক্ত করিয়া দিল। একটা ফ্যাকাসে হাসি টানিয়া আনিয়া সে বলিল, কিশোরবাবু? এত শিগগির এই কদিনের মধ্যে—তাই কিছু জানতে পারিনি! আমি ভেবেছিলুম–তারপর অনর্গল দশ মিনিট ধরিয়া সে যে কী বলিয়া গেল, তাহার মাথামুণ্ড নিজেই সে বুঝিতে পারিল না। সুহাসের সন্দিগ্ধ দৃষ্টি তাহার উপর নিবদ্ধ দেখিয়া সে থামিয়া গেল, খুব হাসিয়া উঠিয়া বলিল, আবোল-তাবোল বকছি-না? খুব আমোদ হলে আমার ঐ রকম হয়, তখন। আর কথার মানে খুঁজে পাওয়া পাওয়া যায় না।
সুহাস বলিল, এবার তুই বল, তোর তিনিটি কে?
করবী বলিল, সে হবে খন। আগে এই খবরটা ভাল করে হজম করে নি। আচ্ছা হাসিদি, কিশোরবাবু তোমাকে খুব ভালবাসেন?
আমি জানি না। তাঁকে জিগ্যেস কগে যা। জান না বৈকি! না জেনেই বুঝি এত হাবুড়ুবু খাচ্ছ?
হাবুড়ুবু খাচ্ছি কে বললে?
বুক নিংড়াইয়া করবী হাসিল, সে তত দেখতেই পাচ্ছি! আচ্ছা হাসিদি, সত্যি করে বলো না, ওঁকে কি রকম ভালবাস? খুব–খুব অনেক?
তাহার গালে আঙুলের মৃদু টোকা মারিয়া লজ্জিত স্মিতমুখে সুহাস বলিল, অনেক।
ঘড়িতে ঠং ঠং করিয়া তিনটা বাজিল। সুহাস বলিল, তুই বোস, বাবাকে ওষুধ খাইয়ে আসি। বলিয়া উঠিয়া গেল।
সে ফিরিয়া আসিতেই করবী বলিয়া উঠিল, চল, কিশোরবাবুর বাড়ি যাই, ওঁর বৌদিদির সঙ্গে আলাপ করে আসি।
সুহাস সঙ্কুচিত হইয়া বলিল, তুই যা, আমি ভাই যেতে পারব না।
কেন, লজ্জা করবে?
বাবাকে একলা ফেলে যাব, যদি কিছু দরকার হয়? তুই যা না, ঝিকে সঙ্গে দিচ্ছি।
যদি সুহাস পুরাতন প্রশ্নটা আবার করিয়া বসে, এই ভয়ে করবী কোন ছুতায় পলাইবার চেষ্টা করিতেছিল, সে উঠিয়া বলিল, তাই যাই! কথা দিয়েছি, না গেলে অন্যায় হবে।
তা যা না, ওঁরা সব বাড়ি আছেন, জন্মাষ্টমীর ছুটি। দীনবন্ধুকাকাও এসেছেন, তাঁর আজ এখানে নেমন্তন্ন।
ও—তবে থাক। বলিয়া করবী বসিয়া পড়িল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার উঠিয়া বলিল, চল ভাই, জ্যাঠামশায়ের কাছে গিয়ে বসি। তিনি একলা রয়েছেন, রোগা মানুষ, আমরা কাছে বসে গল্প করলে খুশি হবেন। বলিয়া সুহাসের মতামতের প্রতীক্ষা না করিয়া আগেই ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
বেলা চারটা বাজিতে না বাজিতে অনুপমচন্দ্ৰ আসিয়া উপস্থিত হইল। একেবারে বিনয়বাবুর শয়নকক্ষে প্রবেশ করিয়া অযাচিত কৈফিয়ত দিয়া বলিল, কদিন কলকাতায় ছিলাম না, একটা জরুরী কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল, তাই আসতে পারিনি। শরীর খারাপ হয়েছিল? ও কিছু নয়। এখন তো বেশ ভালই আছেন দেখছি, নীচে চলুন না–
বিনয়বাবু বলিলেন, আমারও তো তাই ইচ্ছে, কিন্তু সুহাস–
অধীরভাবে অনুপম বলিল, ওদের আপত্তি শুনতে গেলে কাজ চলে না। কদিন ধরে এ ঘরেই বন্ধ হয়ে আছেন, নীচে গেলে একটা চেঞ্জ হবে। উঠুন। একলা নামতে না পারেন, আমার কাঁধে ভর দিয়ে চলুন। সামান্য অসুখকে বড় করে তুলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়া মেয়েদের একটা স্বভাব।
অনুপমের মুরুব্বিয়ানায় সুহাসিনী মনে মনে বিরক্ত হইল, কিন্তু পিতার আগ্রহ দেখিয়া আর কিছু বলিতে পারিল না। বিনয়বাবু অনুপমের সাহায্যে আস্তে আস্তে নামিয়া নীচে ড্রয়িংরুমে গিয়া বসিলেন।
সকলে উপবিষ্ট হইলে অনুপম কৈফিয়তের জের টানিয়া বলিল, আজকাল অফিসে যে রকম কাজ পড়েছে, নাওয়া-খাওয়ার ফুরসত পাই না। সীনিয়র তো কিছুই করেন না। বুড়ো হয়েছেন, নড়তেও পারেন না, বাইরের যত কাজ আমার ঘাড়ে ফেলে নিশ্চিন্দি। আর, আমি ছাড়া হয়ও না কারু দ্বারা। এই তো একটা ব্রীফ বোঝাতে পুরুলিয়া যেতে হল। যাক, একরকম মন্দ হল না, কাজকে কাজ, সেই সঙ্গে পরের পয়সায় বেড়ানো হল।
কেহ কোন উত্তর করিল না। সুহাসিনী মাথা নীচু করিয়া বুনিতে লাগিল, করবী অন্যমনস্কভাবে জানালার বাহিরে তাকাইয়া রহিল।
অনুপম এবার কাজের কথা পাড়িল। কোন বিষয়েই সে সবুর করিতে পারে না, গলাটা ভাল করিয়া ঝাড়িয়া লইয়া বিনয়বাবুর দিকে ফিরিয়া বলিল, একটা অপ্রীতিকর কাজ বাধ্য হয়ে আজ আমাকে করতে হবে। এতে আমার নিজের কোনও স্বার্থ আছে—আপনারা মনে করবেন না, সুবিনয় অনেক পাজি লোক ভদ্রতার মুখোস পরে ঘুরে বেড়ায়, সকলকে ধরিয়ে দেওয়া আমার জীবনের ব্রত নয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কর্তব্যের অনুরোধে এ কাজ আমাকে করতে হচ্ছে।
সকলের বিস্মিত দৃষ্টি অনুপমের উপর গিয়া পড়িল। সে পকেট হইতে একখানা ভাঁজ করা কাগজ বাহির করিয়া বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলিল, যাদের আমি বন্ধু বলে মনে করি, তাদের সম্বন্ধে আমি উদাসীন থাকতে পারি না, এই আমার স্বভাব। বন্ধুত্বের খাতিরে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয়, এমন কি, সময় সময় এমন কাজও করতে হয় বন্ধুরা যাকে হয়তো অনধিকারচচা বলেও মনে করতে পারেন। কিন্তু ও সব সেন্টিমেন্টকে আমি ডরাই না। যাঁদের ভালবাসি, অনিষ্টের হাত থেকে তাঁদের রক্ষা করতে গিয়ে অপ্রিয় হতে আমার আপত্তি নেই।
অস্থির হইয়া বিনয়বাবু বলিলেন, কথাটা কী? তুমি যে খালি হেঁয়ালির সৃষ্টি করে চলেছ।
অনুপম কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া গাম্ভীর্যের মাত্রা আরও বাড়াইয়া দিয়া বলিতে লাগিল, আপনাদের স্মরণ থাকতে পারে, কিছু দিন পূর্বে কোন একটি লোকের বিরুদ্ধে আমি আপনাদের সতর্ক করে দিয়েছিলুম; প্রথম থেকেই বুঝেছিলুম তিনি কি প্রকৃতির লোক এবং সে কথা প্রকাশ করে বলতেও দ্বিধা করিনি। এই জন্যে অনেক ব্যঙ্গবিদ্রূপ আমাকে সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু কর্তব্যের খাতিরে সে সব আমি গ্রাহ্য করিনি। আপনারা বিশ্বাস করে তাকে অন্তরঙ্গের মধ্যে স্থান দিয়েছেন, এমন কি, বাড়ির মহিলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অবকাশ দিয়েছেন, আমার নিষেধে কর্ণপাত করেননি। কিন্তু এই লোকটা আপনাদের বিশ্বাস ও ঘনিষ্ঠতার কতদূর অযোগ্য, তার অকাট্য প্রমাণ আজ আমি দিতে পারি।
বিনয়বাবু নির্বাক বিহুলের মত বসিয়া রহিলেন। কিন্তু সুহাসিনী কথা কহিল, জ্বলন্ত দুই চক্ষু অনুপমের উপর নিবদ্ধ করিয়া অনুচ্চস্বরে কহিল, কার কথা আপনি বলছেন—কিশোরবাবুর?
বিকৃতমুখে হাসিয়া অনুপম বলিল-হ্যাঁ কিশোরবাবুর। যাঁকে আস্কারা দিয়ে তুমি মাথায় তুলেছ যাঁর মত ব্যক্তি পৃথিবীতে আর নেই। তিনি কী, তা জানো?
তেমনই তীব্র অনুচ্চকণ্ঠে সুহাসিনী বলিল, জানি। কিন্তু আপনি তাঁর কী জানেন জিজ্ঞাসা করি?
বিজ্ঞ হিতৈষীর ছদ্মবেশ ফেলিয়া দিয়া উগ্র কটুকণ্ঠে অনুপম বলিয়া উঠিল, লম্পট, দুশ্চরিত্র, স্কাউনড্রেল! আরও জানতে চাও? সমাজে একঘরে, বাপের ত্যাজ্যপুস্তৃর! কী জানি আমি! কী জানি না? জোচ্চোর বদমায়েস কোথাকার।
জ্যা-মুক্ত ধনুকের মত সোজা দাঁড়াইয়া উঠিয়া সুহাসিনী বলিল, অনুপমবাবু, আপনি সাবধান হয়ে কথা বলবেন। আপনি জানেন না তিনি– বলিতে বলিতে থরথর করিয়া কাঁপিয়া সে আবার বসিয়া পড়িল। তাহার মুখ দিয়া আর কথা বাহির হইল না।
বিনয়বাবু ব্যাকুল হইয়া বলিয়া উঠিলেন, ছি ছি অনুপম, এ সব তুমি কি বলছ? বিদ্বেষে অন্ধ হয়ে–কিশোরের মত ছেলে—তুমি কি পাগল হলে–
পাগল আমি হইনি, আপনারা হয়েছেন। আমার কথা আপনারা বিশ্বাস করবেন না জানি। এর পূর্বে একবার আমি এই কথাই আপনাদের জানাতে চেয়েছিলাম। সেদিন চোখ রাঙিয়ে সে আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল; আপনারা তাতে মত দিয়েছিলেন। আজ তাই আমি প্রমাণ হাতে করে এসেছি—এই দেখুন। বলিয়া অনুপম হাতের কাগজখানা বিনয়বাবুর সম্মুখে তুলিয়া ধরিল।
অভিভূতের ন্যায় বিনয়বাবু বলিলেন, কী এ? কিসের প্রমাণ?
পড়ে দেখুন, বুঝতে পারবেন। সুহাসিনীর দিকে ফিরিয়া বিজয়গর্বিত কণ্ঠে বলিল, কিশোরবাবুর বাপের চিঠি। গুণধর ছেলেকে বাপ কী সার্টিফিকেট দিয়েছেন, একবার পড়ে দেখ।
পশুপতিনাথ চক্রবর্তী যে কিশোরের বাপের নাম, তাহা বিনয়বাবু কিশোরের কাছে জানিয়া লইয়াছিলেন। এ চিঠি তাঁহারই লেখা। পাঠ করিবার পর বিনয়বাবুর অবশ হস্ত হইতে কাগজখানা পড়িয়া গেল। অনুপম সেটা কুড়াইয়া সুহাসিনীকে খোঁচা দিয়া বলিল, তুমি বোধ হয় পড়তে চাও না। বিশ্বাসের জোর কমে যেতে পারে।
সুহাসিনী উত্তর দিতে পারিল না, উত্তর দিল করবী। সে উঠিয়া আসিয়া অবজ্ঞাপূর্ণ স্বরে বলিল, দেখি, কী চিঠি নিয়ে এত গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছ। চিঠিখানা আগাগোড়া পড়িয়া চাপা ক্রোধের কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, বড়দা, মিথ্যে কথা, সমস্ত মিথ্যে কথা। কোত্থেকে এ সব তৈরি করে নিয়ে এলে? আমি বিশ্বাস করি না!
সে চিঠিখানা হাতে মুড়িয়া ফেলিয়া দিতে যাইতেছিল, সুহাসিনী ব্যগ্রভাবে বলিল, দেখি—দেখি করবী।
করবী তাহার হাতে তাল-পাকানো কাগজখানা দিল। কম্পিত হস্তে সেটা সমান করিয়া সুহাসিনী পড়িবার চেষ্টা করিল, প্রথমটা কিছুই পড়িতে পারিল না। তারপর অক্ষরগুলা স্পষ্ট হইয়া উঠিল, পড়িতে পড়িতে তাহার মুখ সাদা হইয়া গেল। যখন পড়া শেষ হইয়া গেল, তখনও সে কাগজখানা দুহাতে শক্ত করিয়া ধরিয়া অন্ধ দৃষ্টিতে তাহার পানে তাকাইয়া রহিল।
চিঠিতে লেখা ছিল—
আমার পুত্র কিশোরচন্দ্র চক্রবর্তীর নামে গত কয়েক মাসে নানা প্রকার কুৎসিৎ জনশ্রুতি শুনিয়া, স্বয়ং পরীক্ষা করিবার জন্য আমি একদিন হঠাৎ কলিকাতায় গিয়া তাহার আমহার্স্ট স্ট্রীটের বাসায় উপস্থিত হই। দেখিলাম, সে এক বিধবা যুবতীকে ভ্রাতৃবধু পরিচয় দিয়া তাহার সহিত ব্যভিচারীর জীবন যাপন করিতেছে। আমি তাহাকে সৎপথে আসিতে বহু অনুরোধ করা সত্ত্বেও সে ঐ কুলটা স্ত্রীলোককে ত্যাগ করিতে সম্মত হইল না।
ধর্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, আমি এই কুলকলঙ্ক পুত্রের সহিত সমস্ত সম্বন্ধ ছিন্ন করিয়াছি; মৃত্যুর পর আমার সত্ত্বার করিবার অধিকার পর্যন্ত তাহার থাকিবে না। এইরূপ পাপাচারী পুত্রের অগ্নি গ্রহণ করিলে পরকালে আমার সদগতি হইবে না।
শ্রীপশুপতিনাথ চক্রবর্তী।
অনেকক্ষণ পরে মড়ার মত দুই চোখ তুলিয়া যখন সুহাসিনী সম্মুখে চাহিল, তখন দেখিল, কিশোর ও দীনবন্ধুবাবু পদা ঠেলিয়া ঘরে প্রবেশ করিতেছেন।