কাব্যশাস্ত্র ও গল্প-উপন্যাসের সরস পৃষ্ঠা হইতে প্রণয়রূপী দেবতাটির পরিচয় আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর জানা আছে। বাস্তব-জগতে এই ধনুর্ধর দেবতা যখন আমাদের পরিচিত কাহারও উপর অত্যাচার উৎপীড়ন আরম্ভ করেন, তখন তাঁহাকে চিনিতে আমাদের তিলার্ধ বিলম্ব হয় না। কিন্তু পরিহাস এই যে, ইনি যখন একদিন সহসা হাস্যমুখে আমাদেরই দ্বারে আসিয়া দাঁড়ান, তখন অনেকেই তাঁহাকে চিনিয়া লইতে পারি না।
পুরুষ—বিশেষ করিয়া যুবাপুরুষ সম্বন্ধে সুহাসিনীর মন এতদিন একপ্রকার উদাসীন নিষ্ক্রিয় হইয়াই ছিল। তাহাদের চালচলন কথাবার্তা মাঝে মাঝে বৈচিত্র্যপূর্ণ ও কৌতুকাবহ মনে হইলেও কোনদিন ইহাদের প্রতি একটা স্থায়ী আকর্ষণ সে অনুভব করে নাই। জগতের অন্যান্য বহু কোটি প্রাণবন্ত জীবের মত এগুলিকেও সে ভগবানের একপ্রকার সৃষ্টি বলিয়া নিরুৎসুক চিত্তে ও বিনা আপত্তিতে স্বীকার করিয়া লইয়াছিল, সম্প্রদায়-হিসাবে ইহাদের প্রতি বিরাগ বা অনুরাগ কিছুই অন্তরে। পোষণ করে নাই। অনুপমকেও সে সহজভাবে সরল চিত্তে এই যুবকজাতির পঙক্তিভুক্ত করিয়া নিশ্চিন্ত হইয়াছিল।
কিন্তু এতদিন পরে কিশোর নামক একটি যুবক আসিয়া তাহার পূর্বধৃত সমস্ত ধারণা ওলট-পালট করিয়া দিল। সর্ববিষয়ে যুবসম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হইয়াও লোকটি যেন নিজের কোন বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে একেবারে শ্ৰেণীমুক্ত হইয়া পৃথকভাবে দেখা দিল। যুবক বটে—তবু যেন সে সাধারণ যুবক নহে। অন্যান্য সকলের সহিত তাহার যেন মস্ত একটা স্বাতন্ত্র্য আছে। সুহাসিনীর কৌমার্যের নির্বিকার যোগনিদ্রা ভাঙিয়া গেল। প্রথমে বিস্ময়, তারপর কৌতূহল এবং সর্বশেষে অদম্য আগ্রহ তাহার দেহ-মনকে অহরহ কিশোরের দিকে দুর্বার শক্তিতে টানিতে লাগিল।
দুইটি মানুষের মধ্যে পরিচয়ের একটা অবস্থা আছে যখন পরস্পর সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য বিষয় ও জানিবার স্পৃহা দুইই নিঃশেষ হইয়া যায়; তখন তাহাদের মধ্যে সত্যকার সম্বন্ধ স্থাপিত হয়—তা সে শত্রুতা, বন্ধুত্ব বা নির্লিপ্ততা যাহাই হউক। কিন্তু যেখানে তাহা হয় না, যেখানে জানিবার তৃষ্ণা জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে আরও বাড়িয়া উঠিতে থাকে, কিছুতেই নিবৃত্ত হইতে চায় না, সেখানে জিজ্ঞাসু ব্যক্তিটির মনোভাব লইয়া সতর্কভাবে অনুসন্ধান করা প্রয়োজন হইয়া পড়ে।
কিন্তু জাহাজের দিগদর্শন যন্ত্রের কাঁটার মত যাহার মন সকল কাজে অকাজে পাশের একখানা বাড়ির পানে স্থির-নিশ্চল হইয়া আছে, আর একজনের কলেজ যাইবার ও সেখান হইতে ফিরিবার সময়টাতে যাহাকে কোন অদৃশ্য শক্তি ঘাড় ধরিয়া আনিয়া শয়নঘরের জানালার পাশে দাঁড় করাইয়া দেয়, একজনের সহসা শ্রুত কণ্ঠস্বর যাহার বুকে মুগুরের মত ঘা মারিয়া নিশ্বাস রোধ করিয়া দিবার। উপক্রম করে এবং প্রভাতে শয্যাত্যাগের পর হইতেই যে উৎকণ্ঠিতা সন্ধ্যার একটি মধুময় প্রহরের জন্য উৎসুক প্রতীক্ষায় উন্মনা হইয়া থাকে, তাহার তত্ত্ব অনুসন্ধান করিতে যাওয়া নিতান্তই একটা অনাবশ্যক বাহুল্য বলিয়া মনে হয়।
মনের এইরূপ অবস্থার কথা সুহাসিনী কিন্তু কিছুই জানিতে পারে নাই। নিজের চিত্ত বিশ্লেষণ করিবার তাহার বয়স নহে, অপরূপ অনুভূতির আনন্দেই সে বিভোর হইয়াছিল। তাই আর কাহারও চক্ষু দিয়া সে যদি আজ নিজের মনটা দেখিতে পাইত, তাহা হইলে বোধ করি লজ্জায় মরিয়া যাইত। বাড়িতে অন্য স্ত্রীলোক বা সমবয়স্কা মেয়ে থাকিলেও হয়তো হাসিঠাট্টার ভিতর দিয়া সে নিজের কাছে ধরা পড়িয়া যাইত। কিন্তু সেরূপ কেহ না থাকায়, জীবনের এত বড় পরিবর্তনটা তাহার কাছে। অজ্ঞাত রহিয়া গেল।
সেদিন দুপুরবেলা আহারাদির পর বিনয়বাবু নিজের ঘরে বিশ্রাম করিতেছিলেন, সুহাসিনী একা এই দীর্ঘ অলস বেলাটা কি করিয়া কাটাইবে ভাবিতে ভাবিতে নিজের ঘরের শয্যার উপরে বুকের তলায় একটা বালিশ দিয়া শুইয়া একখানা বই লইয়া নাড়াচাড়া করিতেছিল, এমন সময় দরজার বাহির হইতে ঝির গলা শুনিতে পাইল, এই যে মা, এ দিকে আসুন। দিদিমণি নিজের ঘরে রয়েছেন।
কে আগন্তুক আসিয়াছে, দেখিবার জন্য সুহাসিনী বই ফেলিয়া উঠিয়া বসিতেই পর্দা সরাইয়া বিমলা প্রবেশ করিল। সাদা থান ও শেমিজ, মাথার চুলগুলা টান করিয়া পিছনদিকে জড়ানো, গলায় কেবল ইষ্টকবচযুক্ত একগাছি সরু সোনার হার,—তাহাকে দেখিয়া সুহাসিনী কিছুক্ষণ মুগ্ধের মত বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল, সম্ভাষণ করিতেও ভুলিয়া গেল। তারপর তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া বলিল, আসুন। আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি, আপনি কিশোরবাবুর বৌদিদি।
কথাটা বলিতে বলিতে পলকের জন্য সুহাসিনীর চোখ দুটি যেভাবে অবনত হইয়া পড়িল, তাহা বিমলার চক্ষু এড়াইল না। সে বলিল, আমার বড় অন্যায় হয়ে গেছে, ঢের আগেই আমার আসা উচিত ছিল। কিন্তু আমার দেওরটি তোমাদের ওপর যে রকম উৎপাত আরম্ভ করেছেন, তার সঙ্গে আমিও যদি আবার যোগ দিই, তাহলে তোমাদের পাড়া ছেড়ে পালাতে হবে, এই ভয়ে এতদিন আসিনি।
হাত ধরিয়া তাহাকে নিজের বিছানায় বসাইয়া সুহাসিনী মৃদুহাস্যে বলিল, এ রকম উৎপাত যদি মাঝে মাঝে করেন তবেই আপনাদের পাড়ায় থাকব, নইলে সত্যিই উঠে যেতে হবে।
বিমলা জিজ্ঞাসা করিল, পাড়ার আর কারুর সঙ্গে আলাপ হয়নি বুঝি?
না। এসে পর্যন্ত একেবারে একলা পড়ে গেছি।
অতঃপর সহজেই আলাপ জমিয়া উঠিল। কারণ, দুইদিকেই ভাব করিবার আগ্রহ সমান। সুহাসিনী লক্ষ্য করিয়া দেখিল, বিমলা শুধু অসামান্য রূপবতী নয়, অতিশয় সুশিক্ষিত এবং কথাবার্তায় বিশেষ রকম পরিমার্জিত। তাহার কথার মধ্যে বুদ্ধির এমন একটি অনাড়ম্বর অথচ সহজ স্বাতন্ত্র আছে যে, সুহাসিনী বিস্মিত না হইয়া পারিল না। ঘণ্টাখানেক গল্পসল্প করিবার পর তাহার দৃঢ় ধারণা জন্মিল যে, এত সুন্দরী, এরূপ বুদ্ধিমতী এমন মধুর প্রকৃতির স্ত্রীলোক সে আর কখনও দেখে নাই।
ইহাদের কথাবার্তা খুব সাধারণ গোছেরই হইল। প্রায় সমবয়স্কা দুটি যুবতী একত্র হইলে যেরূপ আলাপ সাধারণত হইয়া থাকে, এখানেও তাহার ব্যতিক্রম হইল না। লেখাপড়ার কথা, সেলাইয়ের কথা, সংসারের কথা, সুহাসিনীর মাতার মৃত্যুর কথা ইত্যাদি নানা প্রকার বিশ্রম্ভ আলোচনার মধ্য দিয়া দুজনেরই দুজনকে এমন ভাল লাগিয়া গিয়াছিল যে, পাশের ঘরের ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দুটা বাজিতেই বিমলা চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল, আর তো ভাই বসতে পারব না, ঠাকুরপোর আসবার সময় হল।
হ্যাঁ, আজ বিদ্যুত্বর, আজ তো তিনটের সময়–এই পর্যন্ত বলিতেই কে যেন সুহাসিনীর জিভ চাপিয়া ধরিল। বিমলা লক্ষ্যই করে নাই এমনই ভাবে বলিল, হ্যাঁ, আজ ওঁকে শেষের একটা ক্লাস নিতে হয় না, তিনটের মধ্যেই ফেরেন। —আচ্ছা ভাই, আসি তাহলে। আমাদের গল্প শেষ হল না, আর একদিন হবে। এবার কিন্তু তোমায় যেতে হবে। পালটা না দিলে আসব না, তা বলে দিচ্ছি!
কেবলমাত্র একটা আচ্ছা ছাড়া সুহাসিনী আর কিছু বলিতে পারিল না, বেফাঁস কথাটা বলিয়া অবধি তাহার বুক ধড়াস ধড়াস করিতেছিল।
নীচে সদরের বারান্দা পর্যন্ত গিয়া হাসিমুখে ফিরিয়া দাঁড়াইয়া বিমলা বলিল, আচ্ছা চললুম, মনে থাকে যেন, সুহাস।
সুহাসিনী একটু লাল হইয়া, একটু ইতস্তত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আমি আপনাকে কী বলে ডাকব?
তাহার অবনত মুখের পানে চাহিয়া বিমলা বলিল, তুমি আমাকে দিদি বলে ডেকো।
পথে তখন বেশী লোক-চলাচল ছিল না, মাথায় আচঁলটা একটু টানিয়া দিয়া বিমলা ত্বরিতপদে রাস্তাটুকু পার হইয়া নিজের বাড়িতে গিয়া ঢুকিল।
তাহাকে বিদায় দিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিয়া পুনরায় শয্যার উপর বসিবার উপক্রম করিতেই সম্মুখেই বড় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বখানা সুহাসিনীর চোখে পড়িল। সেইদিকে তাকাইয়া নিজের অজ্ঞাতসারে সে একটা নিশ্বাস ফেলিল। তাহার মনে হইল, তাহার মত কুৎসিত কুরূপা পৃথিবীতে বুঝি আর দ্বিতীয় নাই।
সন্ধ্যার পর নিত্য-নৈমিত্তিক বৈঠক বসিয়াছিল। বর্তমান বিজ্ঞানের ধারা লইয়া কিশোর ও বিনয়বাবুতে তর্ক এবং গবেষণা চলিতেছিল, অদূরে একখানা চৌকিতে করতলে চিবুক রাখিয়া সুহাসিনী চুপ করিয়া বসিয়া শুনিতেছিল। কিন্তু যত না শুনিতেছিল, একজন তার্কিকের বলিষ্ঠ দেহ, সুযুক্তিপূর্ণ বাক্য, বহুবিস্তৃত জ্ঞান ও নির্মল অন্তঃকরণের কথা ভাবিতে ভাবিতে বিভোর তন্ময় হইয়া পড়িয়াছিল।
কী একটা তকাধীন কথার কোনরূপ নিষ্পত্তি ও মতের ঐক্য না হওয়ায় কিশোর হঠাৎ তাহার দিকে ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কী বলেন?
চটকা ভাঙিতেই সুহাসিনীর জ্ঞান হইল যে, সে এতক্ষণ আত্মবিস্মৃত হইয়া কিশোরের মুখের পানে তাকাইয়া বসিয়াছিল, একটা কথাও শুনিতে পায় নাই। লজ্জা ঢাকিবার জন্য তাড়াতাড়ি ঘাড়টা অন্যদিকে ফিরাইয়া সে বলিল, আপনাদের কী তর্ক, আমি তাই বুঝতে পারছি না।
কেন বুঝতে পারছেন না? কিশোর চেয়ারের মুখ তাহার দিকে ফিরাইয়া বসিয়া বলিল, এ তো খুব সহজ কথা। উনি বলছেনবলিয়া আলোচ্য বিষয়টা আবার বিশদ করিয়া বিবৃত করিতে যাইবে, এমন সময় দরজার কাছে গাড়ি থামার একটা শব্দ শুনা গেল এবং অনতিকাল পরে অনুপমের মাতা হেমাঙ্গিনী দেবী প্রবেশ করিলেন।
কুঁচাইয়া পরা গরদের সরু পাড় ধুতি, গায়ে অনুরূপ ব্লাউজ এবং পায়ে বনাতের চটিজুতা পরিয়া হেমাঙ্গিনী হিন্দু বিধবার আচার ও আধুনিক শিষ্ট সমাজের সভ্যতা এই দুয়ের মধ্যে একটা রফা করিয়া লইয়াছিলেন। তিনি আসিতেই সকলে সসম্রমে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। সুহাসিনী কাছে আসিয়া প্রণাম করিল, তিনি তাহার গণ্ডে একটি লৌকিক চুম্বন দিয়া বলিলেন, ওঁর নাকি আবার শরীর খারাপ হয়েছে? বলিয়া ইঙ্গিতে বিনয়বাবুকে দেখাইলেন।
সুহাসিনী বিস্মিত হইয়া বলিল, কৈ, না। বাবা তো বেশ ভালই আছেন।
বিনয়বাবু সে কথার সমর্থন করিয়া বলিলেন, এখানে এসে অবধি হাঁপানিটা আর চাগায়নি।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া একটা চেয়ারে বসিয়া হেমাঙ্গিনী বলিলেন, তবু ভাল। কে যেন বললে—তাই শুনে পর্যন্ত মনটা ছটফট করছিল। নানান কাজে আসতে পারিনি। আজ আর থাকতে পারলাম না, ভাবলুম, একবারটি গিয়ে দেখে আসি, কচি মেয়েটা একলা না জানি কত কষ্টই পাচ্ছে। আর তো সুজাতা নেই— বলিয়া তিনি আর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন।
সুজাতা সুহাসিনীর মায়ের নাম।
এই সময় সম্মুখে কিয়দূরে উপবিষ্ট কিশোরের উপর দৃষ্টি পড়ায় তিনি সুহাসিনীকে নিম্নস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, চিনি-চিনি মনে হচ্ছে—ছেলেটি কে বলো তো?
নিজের ত্রুটি এতক্ষণে চোখে পড়ায় বিনয়বাবু তাড়াতাড়ি উঠিয়া দুজনের পরিচয় করাইয়া দিলেন। কিশোর কপালে হাত ঠেকাইয়া নমস্কার করিল। হেমাঙ্গিনী খুব জোরে হাসিয়া উঠিয়া বলিলেন, আপনি কিশোরবাবু? সেদিন রাত্রে মিছিমিছি কী ভয়টাই আমরা পেয়েছিলুম। অনুপমের মুখে আপনার সব কথা শুনেছি। বড় খুশি হলাম।
কিশোর বিনীতভাবে চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু তাহার মনটা হঠাৎ কেমন খারাপ হইয়া গেল। প্রথম-দর্শনেই কাহারও সম্বন্ধে কোন প্রকার ধারণা করিয়া লওয়া অনুচিত, কিন্তু এই স্ত্রীলোকটির গোঁফ কামানো পুরুষের মত মুখ ও উগ্র হসি তাহার আদৌ ভাল লাগিল না। মনমরা হইয়া সে ভাবিতে লাগিল, ইহার সহিত পরিচয়ের সুযোগ না হইলেই বোধ হয় ভাল হইত।
বিনয়বাবু কিন্তু হাঁফ ছাড়িয়া আবার প্রফুল্ল হইয়া উঠিলেন। বস্তুত হেমাঙ্গিনীকে সহসা আবির্ভূত হইতে দেখিয়া তিনি অতিমাত্রায় উৎকণ্ঠিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। সেই যে অনুপম বিবাহের প্রস্তাব করিয়া চলিয়া গিয়াছিল, তারপর আর আসে নাই; বিনয়বাবু চিঠি লিখিয়া তাহাকে সুহাসিনীর অমত জানাইয়া দিয়াছিলেন। তারপরও কয়েক দিন গত হইয়াছে। কিন্তু ওদিক হইতে কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যায় নাই। তাই আজ হেমাঙ্গিনীকে দর্শনমাত্র তাঁহার মনে একটা অনির্দিষ্ট আতঙ্কের সঞ্চার হইয়াছিল। স্বর্গগতা স্ত্রীর এই বান্ধবীটিকে তিনি মনে মনে ভয় করিতেন। কিন্তু যখন দেখিলেন যে, হেমাঙ্গিনী বেশ সহজভাবে হাসিমুখে কথা কহিতেছেন, তখন তাঁহার স্বাভাবিক প্রফুল্লতা আবার ফিরিয়া আসিল।
সাধারণভাবে আবার কথাবার্তা আরম্ভ হইল, শুধু সুহাসিনী তাহাতে যোগ দিতে পারিল না; আস্তে আস্তে সরিয়া গিয়া কোণের একটা চৌকিতে মৌন হইয়া বসিয়া রহিল।
ক্রমশ দেখা গেল যে, বিনয়বাবুও কখন অলক্ষ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য হইতে বাদ পড়িয়া গিয়াছেন, শুধু কিশোর আর হেমাঙ্গিনীতে কথা চলিতেছে; অর্থাৎ হেমাঙ্গিনী ঘুরাইয়া ফিরাইয়া নানা প্রকার প্রশ্ন করিতেছেন এবং কিশোর তাহার উত্তর দিতেছে। হেমাঙ্গিনীর ভাবভঙ্গি দেখিয়া অনুমান হইতে লাগিল যে, এই প্রিয়দর্শন ছেলেটিকে দেখিবামাত্র তাঁহার মাতৃহৃদয়ের বহুকালসঞ্চিত স্নেহ। অকস্মাৎ প্রচণ্ড বেগে উথলিয়া উঠিয়াছে, তাই আজ তাহার নাড়ীনক্ষত্র না জানিয়া তিনি ক্ষান্ত হইবেন না।
মা নেই—আহা মরে যাই। মুখখানিকে নিরতিশয় করুণ ও ব্যথিত করিয়া বলিলেন, যার মা নেই, তার কেউ নেই। মা-মরা ছেলে দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা কেমন করতে থাকে।তা, তোমার বাবা আবার সংসার করেছেন বুঝি?
ঘাড় নাড়িয়া কিশোর জানাইল—হ্যাঁ।
বিজ্ঞভাবে শিরঃসঞ্চালন করিয়া হেমাঙ্গিনী কহিলেন, তাই। ও তো জানা কথা—দোজ-পক্ষে বিয়ে করলে আগের পক্ষের ছেলেমেয়ে পর হয়ে যায়—এ আমি ঢের দেখেছি। এ তো নতুন কিছু নয়, বাবা। তোমার সৎমার আবার ছেলেপুলে হয়েছে তো?
কিশোর বলিল, হ্যাঁ। কিন্তু আমি বাবার পর হয়ে গেছি, একথা আপনি মনে করছেন কেন?
হয় বাবা, অনেক দেখেছি, জানি কিনা। আর তাই যদি না হবে, তুমি এখানে একটি বাসা নিয়ে রয়েছ, তিনি কি তোমার কাছে এসে থাকতে চাইতেন না?
কিশোর কহিল, ও অঞ্চলে আমাদের কিছু জমিদারি আছে, তাই দেখতে শুনতে হয় বলে তিনি এখানে থাকতে পারেন না। তা ছাড়া–
বিস্ময়ে চোখ তুলিয়া হেমাঙ্গিনী বলিলেন, জমিদারি আছে? তবে তোমার চাকরি করবার দরকার?
এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া কঠিন। শুধু টাকার লোভে যে সকল মানুষ কাজ করে না, কর্মের প্রতি নিঃস্বার্থ অনুরাগও যে সম্ভব, একথা ইহাকে বুঝাইবার চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র। উপরন্তু এই নাছোড়বান্দা জেরায় সে পরিশ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছিল, তাই প্রসঙ্গটাকে শেষ করিয়া ফেলিবার উদ্দেশ্যে বলিল, আমার ভাল লাগে, তাই কাজ করি; তা ছাড়া আমি তো একলা থাকি না, আমার বৌদিদি থাকেন— বলিয়া ফেলিয়াই কিশোর ত্রস্ত হইয়া উঠিল। এই নৃতন সুত্র ধরিয়া যে আর এক প্রস্ত জেরা আরম্ভ হইবে, তাহা বুঝিতে পারিয়া সে তাড়াতাড়ি বিনয়বাবুর দিকে ফিরিয়া কী একটা অন্য কথা বলিতে গেল, কিন্তু তাহাকে সে অবসর না দিয়া হেমাঙ্গিনী পুনশ্চ বলিলেন, বৌদিদি? কিন্তু তুমি যে বললে, তোমার বড় ভাই কেউ নেই। তা তোমার দাদাও কি তোমার সঙ্গেই থাকেন?
বিরক্তি চাপিয়া কিশোর বলিল, না, আমার বৌদি বিধবা।
বিধবা-কিছুক্ষণ নির্বাক থাকিয়া যেন কী চিন্তা করিতে করিতে বলিলেন, সেই কথাই তো ভাবছিলাম, তুমি ছেলেমানুষ, একলা থাক, শুধু বামুন-চাকরের ওপর কি নির্ভর করা চলে? একজন। গিন্নীবান্নী মেয়েমানুষ বাড়িতে চাই বৈকি। তাঁর হাতেই বুঝি সংসার? তা—তাঁর ছেলেপুলে নেই বুঝি? কত বয়স হবে?
প্রশ্নগুলা যে নিঃস্বার্থ কৌতূহল-প্রণোদিত নহে এ সন্দেহ কিশোরের অন্তরে উঁকি মারিতেছিল, এবার সে একেবারে অধৈর্য হইয়া পড়িল, বলিল, আমাকে মাপ করবেন, কিন্তু সারাক্ষণ নিজের সম্বন্ধে আলোচনা করতে আমি বড় লজ্জা পাচ্ছি। আপনারাও নিশ্চয় মনে মনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, না বাবা, তোমার কথায় আমি বড় আনন্দ পাচ্ছি।
সে আমার সৌভাগ্য। কিন্তু এঁরা তো ক্লান্তি বোধ করতে পারেন। বলিয়া ঘরের বাকী দুইজন লোককে নির্দেশ করিল।
কিশোরের দিকে একটা মর্মভেদী তীক্ষ দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া হেমাঙ্গিনী আর কিছু বলিলেন না। আজ তিনি এ বাড়ির আবহাওয়া বুঝিতে আসিয়াছিলেন, কিন্তু বিশেষ করিয়া পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী এই যুবকটিকে ভাল করিয়া পরীক্ষা করাই ছিল তাঁহার মুখ্য উদ্দেশ্য।
অনুপম সে রাত্রির ঘটনা প্রথমে মাতার কাছে গোপন করিয়াছিল। কাজটা যে ঠিক হয় নাই, করিয়া ফেলিবার পরই সে বুঝিয়াছিল। তারপর যখন বিনয়বাবুর চিঠি গেল, তখন আর কোন কথাই চাপা রহিল না। অনিচ্ছুক পুত্রের নিকট হইতে খুঁটিনাটি সমস্ত জানিয়া লইয়া হেমাঙ্গিনী বিরক্ত হইয়া বলিলেন, তুই যেমন বোকা, তেমনি বেহায়া। নিজের মুখে মেয়ের বাপের কাছে বিয়ের কথা তুলতে তোর লজ্জা হল না? ভাগ্যে সুজাতা বেঁচে নেই,নইলে আমার আজ মাথা কাটা যেত। এই সব কথা—এই লোকটার ব্যাপার—এতদিন আমাকে বলিসনি কেন?
বয়ঃপ্রাপ্ত পুত্রের সহিত তিনি অন্তরালে এমন ব্যবহার করিতেন, যেন সে পাঁচ বছরের একটা নিবোধ শিশু।
বিনয়বাবুর বেশ টাকাকড়ি আছে, একথা চেনা-পরিচিত সকলেই জানিত; তিনি বৃদ্ধ হইয়াছেন এবং সুহাসিনী তাঁহার একমাত্র সন্তান—এই তিনটি তত্ত্বের যাহা অনিবার্য যোগফল, তাহাও নিতান্ত গণ্ডমূখ ছাড়া কাহারও অবিদিত থাকিবার কথা নহে। সুতরাং রঙের উপর রসানের মত সুহাসিনীর সহিত অনুপমের বিবাহ যে হেমাঙ্গিনীর একান্ত অভিপ্রেত ছিল, তাহা লিখিয়া প্রকাশ না করিলেও কোন ক্ষতি ছিল না।
তিন-চারিদিন ধরিয়া সমস্যাটিকে চতুর্দিক হইতে ভাল করিয়া বিবেচনা করিবার পর তিনি নিজেই অকুস্থল পরিদর্শনের জন্য আসিলেন, কিন্তু অনুপমের প্রস্তাব ও প্রত্যাখ্যান সম্বন্ধে যে ঘুণাক্ষরেও কিছু জানেন, তাহার আভাসমাত্র দিলেন না।
কথায় কথায় আরও কিছুকাল কাটিল। আজিকার সন্ধ্যাটা ব্যর্থ হইল, এইরূপ মনোভাব লইয়া কিশোর প্রস্থান করিবার পর, হেমাঙ্গিনী দ্বারের দিকে চাহিয়া থাকিয়া যেন নিজমনেই বলিলেন, ছেলেটি বেশ, কিন্তু বাপের সঙ্গে বনে না। ভিতরে কিছু কথা আছে।
কিছু কুষ্ঠিতভাবে বিনয়বাবু বলিলেন, বনে না, তেমন কথা তো কিছু বললে না।
হেমাঙ্গিনী বলিলেন, বাইরের লোকের কাছে কি সে কথা বলতে পারে? কিন্তু আমি বলে দিলুম, দেখে নিও, ভিতরে কোন কথা আছে। বলিয়া সুহাসিনীর দিকে চাহিয়া গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়িলেন।
এইরূপে, ভদ্রভাবে কিশোরের যতটা অনিষ্ট করা যাইতে পারে, তাহা করিয়া, পিতার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সুহাসিনীকে খুব সাবধান করিয়া দিয়া এবং শীঘ্রই আবার আসিবেন, এই আশ্বাস প্রদান করিয়া তিনি ছ্যাকড়া গাড়ি চড়িয়া প্রস্থান করিলেন।
সুহাসিনীর মনের অবস্থা যে ঠিক কোথায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে এবং তাহার হৃদয় লইয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিশোর যে কিরূপ গুরুতর প্রতিপক্ষ, তাহা তাঁহার মত শাণিত বুদ্ধিশালিনী রমণীর আন্দাজ করিতে বিলম্ব হয় নাই। তাই গাড়ির মধ্যে খাড়া বসিয়া ভু কুঞ্চিত করিয়া ভাবিতে ভাবিতে তিনি বাড়ি গিয়া পৌঁছিলেন।