শুক্তির অন্তরস্থিত মুক্তার লোভে সমুদ্রে ড়ুব দিয়া যাহারা শুন্য ঝিনুকটা হাতে করিয়া কুলে ফিরিয়া আসে, অনুপমচন্দ্রের অবস্থাটা প্রায় তাহাদের মত হইয়াছিল। কিশোরকে যুদ্ধে পরাস্ত করিয়া বিজিত ভূমি দখল করিতে গিয়া সে দেখিল, দখল করিবার মত কিছুই নাই,—যাহা ছিল, যুদ্ধের অগ্নিকাণ্ডে পুড়িয়া জ্বলিয়া নিঃশেষ হইয়া গিয়াছে।
অনুপম ভাবিয়াছিল, ধাক্কা খাইয়া সুহাসিনীর মন তাহার দিকেই ফিরিয়া আসিবে। কিন্তু তাহা যখন হইল না, বরঞ্চ বিপরীত ফলই দেখা গেল, তাহার প্রতি সুহাসিনীর চিত্তের বিরূপতা আরও গভীর ও অন্তর্মুখী হইয়া অস্থিমজ্জায় আশ্রয় লইল, তখন ব্যর্থ ও ক্রোধান্ধ অনুপমও তাহাকে যেন কোন প্রকারে পাইবার জন্য মনে মনে জিদ ধরিয়া বসিল! যতই মনে হইতে লাগিল, সুহাসিনীর মন সে কোন দিন পাইবে না, পাইবার আকাঙক্ষা ততই তাহার উগ্র ও দুর্নিবার হইয়া উঠিতে লাগিল।
এ দিকে অনুপমের জননী হেমাঙ্গিনী কিন্তু উল্টা সুর ধরিলেন। এতদিন তিনি অনুপমের সঙ্গে সুহাসিনীর বিবাহ ঘটাইবার জন্য উদগ্রীব ছিলেন, সে জন্য চেষ্টার ত্রুটি করেন নাই, কিন্তু যে মেয়ে। আর একজনকে ভালবাসে বলিয়া জানাজানি হইয়া গিয়াছে এবং যাহাকে লইয়া এত বড় একটা প্রকাশ্য সামাজিক কেলেঙ্কারি ঘটিয়া গেল, তাহাকে পুত্রবধুরূপে কোন বর্ষীয়সী রমণীই কামনা করেন না—তা সে অন্য দিক দিয়া যতই লোভনীয় হউক। অন্য পুরুষের হৃদয়হীন বিশ্বাঘাতকতার কথা চিন্তা করিয়া যে কুমারী দিন দিন শীর্ণ হইয়া যাইতেছে, জানিয়া শুনিয়া তাহাকে বধুরূপে ঘরে আনিবার মত উদারতা হেমাঙ্গিনীর ছিল না। তিনি একদিন এই কথাটাই ইঙ্গিতে অনুপমকে বুঝাইবার। চেষ্টা করিলেন। কিন্তু অনুপমচন্দ্র মাতার ইঙ্গিত সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করিয়া নিজের পথে চলিতে লাগিল। তখন হেমাঙ্গিনী তাহাকে স্পষ্ট করিয়া, ধমক দিয়া বুঝাইয়া দিলেন যে পরের পরিত্যক্তা কন্যার পশ্চাতে ধাবমান হওয়ার মত নির্লজ্জ নির্বুদ্ধিতা অতি অল্পই আছে; ভাবিয়া দেখিতে গেলে সুহাসিনীকে পুনর্ভু বলিলেও অন্যায় বলা হয় না এবং এত সত্ত্বেও সে যদি তাহাকে বিবাহ করিতে চায়, তাহা হইলে অন্তত তিনি কখনই এরূপ বধুকে ঘরে স্থান দিতে পারিবেন না, অনুপম যেন অন্য ব্যবস্থা করে।
অনুপম তাহার পুরুষ-স্বভাব মাতাকে অত্যন্ত ভয় করিত, তাই ভিতরে গর্জন করিতে থাকিলেও মুখে কোন কথা না বলিয়া মাতার অনুশাসন একপ্রকার স্বীকার করিয়া লইল।
তারপর বিনয়বাবু কন্যাকে লইয়া কলিকাতা ছাড়িয়া গেলেন, কিছুকাল আর তাঁহাদের কোন উদ্দেশই পাওয়া গেল না।
চারিমাস পরে হঠাৎ একদিন অনুপম সংবাদ পাইল, বিনয়বাবু সকন্যা দেশে ফিরিয়াছেন। সে তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের সঙ্গে দেখা করিতে ছুটিল।
মাত্র আগের দিন বিনয়বাবু আসিয়া পৌঁছিয়াছেন; বাসার আসবাবপত্র তখনও ভাল করিয়া গোছানো হয় নাই। অনুপম ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করিয়া দেখিল, দীনবন্ধুবাবুও রহিয়াছেন।
বিনয়বাবু শীর্ণ অসুস্থ মুখে হাসিবার চেষ্টা করিয়া বলিলেন, এসো, অনুপম।
অদূরে আর একটা চেয়ারে সুহাসিনী বসিয়া ছিল, সে নড়িয়া চড়িয়া বসিল। দীনবন্ধু কটমট করিয়া একবার অনুপমের দিকে চাহিয়া কুঞ্চিত করিয়া অন্য দিকে মুখ ফিরাইয়া লইলেন।
ঘরের আবহাওয়া অনুকূল নহে বুঝিয়া অনুপম যতদূর সম্ভব সপ্রতিভভাবে আসন গ্রহণ করিয়া কুশল-প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। একবার সুহাসিনীকেও বোধ করি স্বাস্থ্য সম্বন্ধে প্রশ্ন করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু সুহাসের দিকে চাহিয়া প্রশ্নটা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইল না। মামুলিভাবে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলিল। ও পক্ষ হইতে বিনয়বাবুই কেবল কথা কহিলেন, ঘরের আর দুইজন মুখ টিপিয়া বসিয়া রহিলেন।
এলোমেলোভাবে প্রায় মিনিট পনেরো আলাপ চলিবার পর বিনয়বাবু ক্লান্ত হইয়া থামিয়া গেলেন। তখন অনুপম একলাই বাক্যালাপের চেষ্টাকে প্রাণপণে ঠেলিয়া লইয়া চলিল, কিন্তু পাঁচজনের সম্মিলিত উদ্যমে যাহা স্বচ্ছন্দে চলে, একাকী তাহাকে টানিয়া লইয়া যাওয়া সহজ নহে। অনিচ্ছুক তিনজন শ্রোতাকে অনুপম তাহার জীবনে গত চারমাসে যাহা ঘটিয়াছে তাহার অধিকাংশই একটানাভাবে বলিয়া গেল। কিন্তু কোন দিক হইতে লেশমাত্র উৎসাহ বা অনুমোদন না পাইয়া শেষ পর্যন্ত দম ফুরাইয়া-যাওয়া কলের ইঞ্জিনের মত তাহাকে চুপ করিতে হইল।
দীনবন্ধু ও সুহাসিনীর যত্নকৃত কঠিন নীরবতা অনুপমকে ভিতরে ভিতরে অস্থির করিয়া তুলিয়াছিল, কিন্তু এমন একটা আলোচনার বিষয়ও সে খুঁজিয়া পাইতেছিল না যাহার মধ্যে এই দুইজনকে আকর্ষণ করিয়া আনা যাইতে পারে। মিনিট দুই-তিন চুপ করিয়া জানালার বাহিরে তাকাইয়া থাকিবার পর হঠাৎ একটা নূতন প্রসঙ্গের সূত্র পাইয়া সে বলিয়া উঠিল, পাশের বাড়ির দরজায় তালা লাগানো দেখছি। মহাপ্রভু গেলেন কোথায়? বাসা ছেড়ে দিয়েছেন না কি?
বলিয়া ফেলিয়াই অনুপমকে অনুতাপ করিতে হইল। এ প্রসঙ্গ এরূপ সময় উত্থাপন করা যে ঘোরতর নির্বুদ্ধিতার কাজ হইয়াছে, কিশোর বা তৎসম্পর্কীয় কোন কথা না বলাই যে সবদিক দিয়া শোভন ও নিরাপদ হইত, তাহা সে অন্তরে অন্তরে অনুভব করিল। কিন্তু অনুভব করিলেও কথাটা। ফিরাইয়া লইবার তখন আর উপায় ছিল না। সুহাসের মুখ ধীরে ধীরে লাল হইয়া উঠিতেছিল। দীনবন্ধুবাবু গভীরতর হুকুটি করিয়া নিজের মোটা লাঠিটার মুঠের দিকে চাহিয়া ছিলেন, বিনয়বাবুর শীর্ণ মুখখানা যেন আরও পীড়িত হইয়া উঠিয়াছিল। তবু অনুপম চুপ করিয়া যাইতে পারিল না, সে মরিয়াভাবে ভূলের পথেই অগ্রসর হইয়া চলিল। পিছু হটিবার স্থান যেখানে সঙ্কীর্ণ, সেখানে একজাতীয় লোক বিপদ জানিয়াও গোঁ-ভরে সম্মুখদিকে চলে, স্থির হইয়া থাকিতে পারে না। অনুপমও কাহারও নিকট হইতে কোন উত্তর না পাইয়া মুখখানাকে হাসি-হাসি করিবার চেষ্টা করিয়া বলিল, পালিয়েছে নাকি? যাক, তবু ভাল, ভদ্রলোকের পাড়ায় যে ওসব চলে না সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু গেল কোথায়?
তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে সুহাস হঠাৎ চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল এবং কোন কথা না বলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
অনুপমের মুখখানা নিজের অজ্ঞাতসারে কালো হইয়া উঠিয়াছিল, সুহাস চলিয়া যাইবার পর কিছুক্ষণ হিংসাপূর্ণ দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকাইয়া থাকিয়া সে দীনবন্ধুবাবুর দিকে ফিরিল, মনের সমস্ত বিষ তাঁহার মাথায় উদগিরণ করিয়া দিয়া বলিল, আপনার সঙ্গে তো ভারি প্রণয় ছিল, রাত নেই দিন নেই যাতায়াত করতেন। আপনি জানেন, ভাজটিকে নিয়ে গেল কোথায়? বস্তি-টস্তিতে গিয়ে উঠেছে না কি?
এবার দীনবন্ধুবাবু একেবারে অগ্নিকাণ্ডের মত জ্বলিয়া উঠলেন, চোপরাও বেয়াদব নচ্ছার কোথাকার! জুতিয়ে মুখ ছিড়ে দেব।–বেরোও—বেরোও তুমি এখনি এ বাড়ি থেকে, নইলে দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধরে বার করে দেব। বলিয়া তিনি হাতের স্কুল যষ্টিটা সজোরে মাটিতে ঠুকিতে লাগিলেন।
অনুপম চেয়ার হইতে ছিটকাইয়া উঠিয়া চিৎকার করিয়া বলিল, কি! আমাকে আপনি বেরিয়ে যেতে বলেন। আপনি কে আর ইউ? এই বাড়ি আপনার নয়, বিনয়বাবুর, সে কথা মনে রাখবেন।
দীনবন্ধু লাঠি ঠুকিতে ঠুকিতে বলিলেন, এ বাড়ি আমার, এখানে আমি যা বলব তাই হবে। তুমি এই দণ্ডে এখান থেকে বেরোও, ছোকরা। ফের যদি কখনও মাথা গলাবার চেষ্টা করেছ, তাহলে তোমাকে চাবকে লাল করে দেব। যাও।
বিনয়বাবু অসহায়ভাবে চেয়ারে হেলান দিয়া পড়িয়াছিলেন, ক্ষীণকণ্ঠে কেবল বলিলেন, দীনবন্ধু! দীনবন্ধু!
দীনবন্ধু ধমক দিয়া বলিলেন, আপনি চুপ করুন। এই শয়তানটাই যত নষ্টের গোড়া। শুরু থেকে ষড়যন্ত্র পাকিয়ে পাকিয়ে আজ আপনাদের এমন অবস্থা করেছে–damned villain। আপনার যদি এতটুকু মনের জোর থাকত অনেক আগেই এটাকে দূর করে দিতেন। কিন্তু তা যখন আপনি পারবেন না, তখন আমাকেই এ কাজ করতে হবে।যাও, বিদেয় হও এখন। বলিয়া অনুপমকে লাঠি দিয়া দরজা নির্দেশ করিয়া দিলেন।
অনুপম তথাপি কী একটা বলিবার উদ্যোগ করিতেছে দেখিয়া তিনি একেবারে হুঙ্কার ছাড়িলেন, যাবে না? ভাল কথার কেউ নয় বটে। দারোয়ান! ইধার আও।
দাঁতে দাঁত ঘষিয়া অনুপম বলিল, আচ্ছা—এ অপমান আমি ভুলব না—আমিও দেখে নেব– বলিতে বলিতে ঝড়ের মত বাহির হইয়া গেল।
দীনবন্ধু বলিলেন, আজ আমার প্রাণটা ঠাণ্ডা হল। সেই দিন থেকে আমি আক্রোশ পুষে রেখেছিলুম—যেদিন ও কতকগুলো মিথ্যে কথা বলে সুহাস-মায়ীর মন ভেঙে দিয়েছিল।
বিনয়বাবু মাথা তুলিয়া বলিলেন, মিথ্যে কথা, দীনবন্ধু? তুমি বলতে চাও মিথ্যে কথা?
হ্যাঁ, মিথ্যে কথা, ওর এক বর্ণ সত্যি নয়। আর মিথ্যে কথা বলে এতখানি অনিষ্ট বোধ হয় আজ পর্যন্ত কেউ করেনি।
কিন্তু তার বাপের চিঠি–
বাপের ছেড়ে তিপন্ন পুরুষের চিঠি যদি থাকত, তবুও কথা মিথ্যে হত। কিন্তু সে ভেবে আর কী হবে বলুন, এখন তো আর কোন উপায় নেই।
বিনয়বাবু একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। ঘরের ভিতরটা অন্ধকার হইয়া আসিতেছিল, কিছুক্ষণ দুজনে মৌন হইয়া রহিলেন।
শেষে আর একটা শ্রান্তিভারাক্রান্ত নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বিনয়বাবু বলিলেন, দেখ দীনবন্ধু, আমি বোধ হয় আর বেশী দিন বাঁচব না। আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে, ভিতরে ভিতরে বুঝতে পারছি। কিন্তু সে জন্য তো ভাবি না, শুধু এই ভয় হয়, মেয়েটার কোন বিধিব্যবস্থা না করেই যদি মরে যাই। তুমি দেখো, দীনবন্ধু। জান তো, তুমি ছাড়া আমার আপনার বলবার কেউ নেই।
মৃদু তিরস্কারের সুরে দীনবন্ধু বলিলেন, এ সব আপনি কী যা তা বলছেন! শরীরটা একটু খারাপ যাচ্ছে, তারপর মানসিক ক্লেশেরও অভাব নেই, তাই যত সব বাজে কথা মনে আসছে। ও চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলুন—এখনও দীর্ঘ জীবন আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে—আমি তো ও-সব ভাবনা এখনও মনে আনতে পারি না, আর আপনি আমার চেয়ে কতই বা বড় হবেন? বড় জোর দু-তিন বছরের! এরি মধ্যে ও-সব দুশ্চিন্তা কেন? শুধু রেলে ঘুরে ঘুরে শরীরটা কাহিল হয়ে পড়েছে বৈ তো নয়, দুদিন পরে আবার দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।
বিনয়বাবু আস্তে আস্তে বলিলেন, তাই হবে বোধ হয়। ঘুরে বেড়ানোও তত কম হয়নি। তার ওপর সুহাসের জন্য মনটা সর্বদাই–
মৃত্যুর কথা ভাবলেই মৃত্যুকে কাছে ডেকে আনা হয়। ও সব কথা যাক। আজ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আজ আর কাজ নেই, কাল থেকে আবার আমাদের পুরনো ঈভনিং ওয়াক আরম্ভ করা যাবে। এখন বরঞ্চ আপনি কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে বিশ্রাম করে নিন গে। বলিয়া দীনবন্ধু সুহাসকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। সুহাস আসিলে বিনয়বাবু তাহার সঙ্গে দোতলায় নিজের শয়নকক্ষে উঠিয়া গেলেন।
দীনবন্ধু আরও কিছুক্ষণ চিন্তিতভাবে অন্ধকার ঘরের মধ্যে বসিয়া রহিলেন, তারপর লাঠিটা তুলিয়া লইয়া উঠিবার উপক্রম করিতেই মৃদু কণ্ঠের কাকাবাবু শুনিয়া চকিতে ফিরিয়া দেখিলেন, সুহাসিনী কখন নিঃশব্দে তাঁহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।
সুহাস-মায়ী! কী মা!
সুহাসিনী তাঁহার চেয়ারের পিঠ ধরিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, অন্ধকারে তাহার মুখ ভাল দেখা গেল না। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সে অতি ক্ষীণকণ্ঠে যেন কথাগুলা গুনিয়া গুনিয়া বলিল, কাকাবাবু, আপনার কি মনে হয় আমি ভুল করেছি?
প্রথমে দীনবন্ধু প্রশ্নটা ঠিক ধরিতে পারিলেন না, তারপর বুঝিতে পারিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, হ্যাঁ মা, ভুল করেছ। বড় ভুল করেছ।
সুহাসের নিকট হইতে অস্ফুট শব্দ আসিল, কিন্তু—
দীনবন্ধু বলিলেন, ওর মধ্যে কিন্তু নেই, সুহাস। ভালবাসা আর বিশ্বাস—এ দুটো জিনিস আলাদা করা যায় না। তুমি আলাদা করবার চেষ্টা করেছিলে, তাই আজ এত কষ্ট পাচ্ছ। ভেবে দেখ, আমরা তো আদালত নই যে সাক্ষীসাবুদ নিয়ে তবে যাকে ভালবাসি তাকে বিশ্বাস করব। আর, ওর বিরুদ্ধে তুমি যে প্রমাণ পেয়েছিলে, আমিও তো তাই পেয়েছিলুম। কিন্তু আমি সে কথা বিশ্বাস করতে পারলুম না কেন?
সুহাসিনী রুদ্ধনিশ্বাসে নীরব হইয়া রহিল।
দীনবন্ধু বলিতে লাগিলেন, আমি জানি, কিশোর কখনও ও কাজ করতে পারে না, তাই হাজার প্রমাণেও আমাকে টলাতে পারেনি। মা, তুমি ছেলেমানুষ, কিন্তু আমার পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে, জীবনের অভিজ্ঞতাও কম সঞ্চয় করিনি। আমি জানি মানুষের চেয়েও তার বিরুদ্ধে প্রমাণকে যারা বিশ্বাস করে, শেষ পর্যন্ত তাদের ঠকতে হয়। কিশোরকে আমি চিনি, তাই যদি তাকে স্বচক্ষে ব্যভিচার করতে দেখি, তবু আমি আমার চোখকেই অবিশ্বাস করব, তাকে অবিশ্বাস করতে পারব না।
কিন্তু কাকা—
দীনবন্ধু উঠিয়া দাঁড়াইলেন, থাক সুহাস, আর নয়। বিশ্বাস কাউকে জোর করে করানো যায় না, আমিও সে চেষ্টা করব না; আমি শুধু নিজের বিশ্বাসের কথা তোমায় বললুম। কিশোরকে আমি ভালবাসি, তাই আমি তাকে বিশ্বাস করি। আর ঐ মেয়েটি—বিমলা, ওকেও আমি ভালবাসতে। শিখেছি। আমি জানি ওদের ভিতরের সম্বন্ধ ভাইবোনের মত পবিত্র। না, তার চেয়েও বেশী, কারণ। ওদের মধ্যে সত্যিকারের কোন সম্বন্ধ নেই। যে যাই বলুক, ওদের বিষয়ে কোন কুৎসাই আমি কোন দিন বিশ্বাস করতে পারব না।
একটু চুপ করিয়া বলিলেন, ওদের ওপর আমার কতখানি আস্থা তা তোমাকে বোঝানো শক্ত। আমার যদি নিজের মেয়ে থাকত, আমি তাকে কিশোরের হাতে দিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে। করতুম। এই বলিয়া তিনি আস্তে আস্তে নিষ্ক্রান্ত হইয়া গেলেন।
দীনবন্ধুবাবুর শেষ কথাগুলির মধ্যে যে কতখানি অভিমান নিহিত ছিল তাহা সুহাসিনী বুঝিল। তাহার বুক ছিড়িয়া একটি দীর্ঘনিশ্বাস বাহির হইল। দুহাতে মুখখানা চাপিয়া ধরিয়া সে দীনবন্ধুবাবুর পরিত্যক্ত চেয়ারে বসিয়া পড়িল।
কাশীতে করবীর সহিত দেখা হইবার পর তাহার নিম্নাভিমুখী মন ধাক্কা খাইয়া ভিন্ন খাতে বহিতে আরম্ভ করিয়াছিল। কিন্তু সন্দেহের বিষ এমনই মারাত্মক বস্তু যে, একবার কোনক্রমে মনকে আশ্রয়। করিলে সেখান হইতে তাহাকে তাড়ানো অতিবড় চিত্তবলশালী লোকের পক্ষেও দুঃসাধ্য হইয়া উঠে। তাই দীনবন্ধুবাবুর কুণ্ঠাহীন বিচারহীন বিশ্বাসের কথা শুনিয়াও তাহার মন শান্তি পাইল না, বরঞ্চ অনিশ্চয়তার যন্ত্রণায় বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিল।