বিংশ পরিচ্ছেদ – শিল্পকলা
১. স্থাপত্যশিল্প
প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যশিল্পের ইতিহাস লেখা অতিশয় কঠিন, কারণ হিন্দু যুগের প্রাসাদ, স্তূপ, মন্দির, বিহার প্রভৃতির কোনো চিহ্ন এক প্রকার নাই বলিলেই চলে। ফাহিয়ান ও হুয়েন সাংয়ের বিবরণ এবং প্রাচীন শিলালিপি ও তাম্রশাসনগুলি আলোচনা করিলে কোনো সন্দেহ থাকে না যে, হিন্দু যুগে বাংলায় বিচিত্র কারুকার্যখচিত বহু হৰ্ম ও মন্দির এবং স্তূপ ও বিহার প্রভৃতি ছিল। কিন্তু এ সমুদয়ই ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। প্রাচীন প্রশস্তিকারেরা উচ্ছ্বসিত ভাষায় যে সমুদয় বিশাল গগনস্পর্শী মন্দির ‘ভূ-ভূষণ’, ‘কুল-পৰ্বত-সদৃশ’ অথবা সূর্যের গতিরোধকারী’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, আজ তাঁহার চিহ্নমাত্রও নাই। দ্বাদশ শতাব্দীতেও সন্ধ্যাকরনন্দী বরেন্দ্রভূমিতে যে সমুদয় ‘প্রাংশু-প্রাসাদ’, মহাবিহার এবং কাঞ্চন-খচিত হৰ্ম্ম ও মন্দির দেখিয়াছিলেন, তাহা সবই কালগর্ভে বিলীন হইয়াছে। বাংলার স্থপতি-শিল্পের কীৰ্ত্তি আছে কিন্তু নিদর্শন নাই।
এদেশে প্রস্তর সুলভ নহে, তাই অধিকাংশ নির্মাণকার্য্যেই ইটের ব্যবহার হইত। আর্দ্র বায়ু, অতিরিক্ত বৃষ্টি, বর্ষা ও নদী প্লাবনের ফলে ইষ্টক শীঘ্রই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। বৈদেশিক আক্রমণকারীর অত্যাচারেও অনেক বিনষ্ট হইয়াছে। প্রকৃতি ও মানুষ উভয়ে মিলিয়া বাংলার প্রাচীন শিল্পসম্পদ ভূপৃষ্ঠ হইতে বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছে।
সামান্য কয়েকটি ভগ্নপ্রায় মন্দির এই বিশ্বগ্রাসী ধ্বংসের হস্ত হইতে কোনো রকমে আত্মরক্ষা করিয়া এখনো দাঁড়াইয়া আছে। জঙ্গল-পরিপূর্ণ মৃৎস্তূপ খনন করিয়া পুরাতত্ত্ব-অনুসন্ধিৎসুগণ কোনো কোনো অতীত কীৰ্ত্তির জীর্ণ ধ্বংসাবশেষ আবার লোকচক্ষুর গোছর করিয়াছেন। ইহারাই বাংলার অতীত শিল্প-সম্পদের শেষ নিদর্শন। ইহাদের উপর নির্ভর করিয়াই বাংলার স্থাপত্যশিল্পের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস রচনা করিতে হইবে। কিন্তু এ ইতিহাস নহে, ইতিহাসের কঙ্কাল মাত্র। বাংলার প্রাচীন শিল্প-সমৃদ্ধি এবং তাঁহার অতুলনীয় কীর্তি ও গৌরবের ক্ষীণ প্রতিধ্বনিও ইহার মধ্য দিয়ে ফুটিয়া উঠিবে কি না সন্দেহ।
.
ক। স্তূপ
বৌদ্ধস্তূপই ভারতের সর্বপ্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন। ভগবান বুদ্ধের অস্থি বা ব্যবহৃত বস্তু রক্ষা করিবার জন্যই প্রথম স্তূপের পরিকল্পনা হয়। পরে বিশেষ বিশেষ ঘটনা চিরস্মরণীয় করিবার জন্য যে যে স্থানে তাহা ঘটিয়াছিল সেখানে স্তূপ নির্ম্মিত হইত। বৌদ্ধদের পূর্ব্বেও হয়তো এই প্রথা ছিল-এবং পরে জৈনরাও স্তূপ নির্মাণ করিত। কিন্তু বৌদ্ধগণের মধ্যেই স্তূপ বিশেষ বিখ্যাত ছিল। বৌদ্ধগণ স্তূপকে পবিত্র মন্দিরের ন্যায় জ্ঞান করিত এবং পরবর্ত্তীকালে তাহারা স্তূপকেও পূজা ও অর্চনা করিত। স্তূপ নির্মাণ ও উৎসর্গ করা অতিশয় পুণ্য কাৰ্য্য বলিয়া বিবেচিত হইত। এই সমুদয় কারণে যেখানেই বৌদ্ধধর্ম্ম প্রসারলাভ করিয়াছে সেইখানেই ক্ষুদ্র ও বৃহৎ অসংখ্য স্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছে। বাংলা দেশেও অনেক স্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছিল।
স্তূপের তিনটি অংশ। সৰ্ব্বপ্রাচীন স্থূপে অনুচ্চ গোলাকৃতি অধোভাগের উপর গম্বুজাকৃতি মধ্যম অথবা প্রধান অংশ এমনভাবে নির্ম্মিত হইত যাহাতে অধোভাগের কতকটা স্থান মুক্ত থাকে এবং ইহার উপর দিয়া গম্বুজের চারিদিকে ঘুরিয়া আসা যায়। এই উন্মুক্ত অংশ ভক্তগণের প্রদক্ষিণপথস্বরূপ ব্যবহৃত হইত। গম্বুজের উপর প্রথমত চতুষ্কোণ হৰ্ম্মিকা ও তাঁহার উপর একটি গোলাকৃতি চাকা থাকিত।
কালক্রমে স্তূপের আকৃতি ক্রমশই দীর্ঘাকার হইতে থাকে। অধোভাগ অনেকটা পিপার আকার ধারণ করে এবং মধ্যভাগের অর্দ্ধবৃত্তাকার গম্বুজও ক্রমশ দীর্ঘ হইতে দীর্ঘতর হয়। উপরের গোলচাকার সংখ্যাও বাড়িয়া যায় এবং পর পর ছোট হইতে হইতে সর্ব্বশেষ চাকাটি প্রায় বিন্দুতে পরিণত হয়। স্তূপের এই তিন অংশের নাম মেধি, অণ্ড ও ছত্রাবলী। ক্রমে এই তিন অংশের নীচে একটি অপোভাগ সংযুক্ত হয়। এই অধোভাগ চতুষ্কোণ, এবং ইহার প্রতি দিকের মধ্যভাগে খানিকটা অংশ সম্মুখে প্রসারিত থাকে। কোনো কোনো স্থলে এই প্রসারিত অংশের খানিকটাও আবার সম্মুখে প্রসারিত হয়। এইরূপ এক বা একাধিক প্রসারের ফলে অধোভাগ ক্রমশ ক্রসের আকার ধারণ করে। ক্রমশ নিচের এই ক্ৰসাকৃতি অধোভাগ ও মেধি এবং উপরের অসংখ্য ছত্রাবলীই প্রাধান্য লাভ করে, এবং এ দুয়ের মধ্যকার অংশ অণ্ড-এককালে যাহা স্তূপের প্রধান অংশ বলিয়া বিবেচিত হইত-আর দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করে না। স্তূপগুলিও প্রায় মন্দির চূড়া বা শিখরের আকার ধারণ করে।
হুয়েন সাং লিখিয়াছেন যে পুণ্ড্রবর্দ্ধন, সমতট ও কর্ণসুবর্ণের যে যে স্থানে গৌতমবুদ্ধ ধর্মোপদেশ করিয়াছিলেন সেই সেই স্থানে মৌৰ্য্যসম্রাট অশোক নির্ম্মিত স্তূপগুলিও তিনি দেখিয়াছিলেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে হুয়েন সাংয়ের সময়ও বাংলার এমন বহু প্রাচীন স্তূপ ছিল যাহা লোকে অশোকের তৈরি বলিয়া বিশ্বাস করিত। কিন্তু বাস্তবিকই গৌতমবুদ্ধ যে ঐ সমুদয় স্থান পরিদর্শন করিয়াছিলেন, এবং ইহার স্মরণার্থ অশোক ঐ সকল স্তূপ নিৰ্মাণ করিয়াছিলেন, অন্য প্রমাণ না পাওয়া পর্য্যন্ত কেবল হুয়েন সাংয়ের উক্তির উপর নির্ভর করিয়া ইহার কোনোটিই বিশ্বাস করা যায় না। অশোকের কথা দূরে থাকুক, হুয়েন সাংয়ের সময়কার কোনো স্তূপের ধ্বংসাবশেষও অদ্যাবধি বাংলায় আবিষ্কৃত হয় নাই।
বাংলায় যে সকল স্তূপ দেখা যায় তাহা সাধারণত ক্ষুদ্রাকৃতি। পুণ্য অর্জনের জন্য দরিদ্র ভক্তগণ এইগুলি নিৰ্মাণ করিত।
ঢাকা জিলার আসরফপুর গ্রামে রাজা দেবখগের তাম্রশাসনের সহিত যে ব্ৰঞ্জ বা অষ্টধাতুনির্ম্মিত একটি স্তূপ পাওয়া গিয়াছে তাহাই সম্ভবত বাংলার সর্বপ্রাচীন স্তূপের নিদর্শন (চিত্র নং ২৬)। ইহার চতুষ্কোণ অধোভাগ ও হৰ্ম্মিকা এবং গোলাকার মেধির চতুর্দিকে নানা দেব-দেবীর মূর্ত্তি উৎকীর্ণ। স্তূপটির মেধি ও অণ্ড একটি ঘণ্টার মতো দেখায়। পাহাড়পুর ও চট্টগ্রামের অন্তর্গত ঝেওয়ারিতে আরও দুইটি ধাতুনির্ম্মিত স্তূপ পাওয়া গিয়াছে।
১০১৫ অব্দে লিখিত একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে বরেন্দ্রের মৃগস্থাপন-স্তূপের একটি চিত্র আছে। চীনদেশীয় পরিব্রাজকগণ সপ্তম শতাব্দীতেও এই স্তূপটি দেখিয়াছিলেন। এই চিত্র হইতে সেকালেরর স্তূপের আকৃতি বেশ বোঝা যায়। এই স্তূপের অধোভাগ ছয়টি স্তরে বিভক্ত এবং প্রতিস্তরটি একটি প্রস্ফুটিত পদ্মের আকার। অণ্ড অংশ ঈষৎ দীর্ঘাকৃতি এবং ইহার চতুর্দিকে চারিটি কুলুঙ্গির অভ্যন্তরে চারিটি বুদ্ধমূর্ত্তি। চতুষ্কোণ হৰ্ম্মিকার উপর বহুসংখ্যক ছত্র।
বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে বাংলার আরও দুই-তিনটি স্থূপের ছবি আছে। ইহার একটি তুলাক্ষেত্রে ‘বর্দ্ধমান স্তূপ’। ইহার অধোভাগ নানা কারুকার্যে শোভিত ও চারিটি স্তরে বিভক্ত, এবং ইহার মেধি উৰ্দ্ধ ও অধোমুখ দুই দল বিকশিত পদ্মের আকৃতি।
পাহাড়পুর ও বহুলাড়ায় (বাঁকুড়া) বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইষ্টকস্থূপের অধোভাগ আবিষ্কৃত হইয়াছে (চিত্র নং ৩১)। এগুলি গোল, চতুষ্কোণ অথবা ক্রসের আকার। বিহারের প্রাচীন স্তূপ ও পূর্ব্বোক্ত বাংলার স্তূপের চিত্রের অধোভাগের সহিত ইহাদের অনেকের নিকট সাদৃশ্য দেখা যায়। সুতরাং এই সমুদয় অধোভাগের উপর যে সমুদয় স্তূপ নির্ম্মিত হইয়াছিল তাহা দেখিতে বিহারের স্তূপ এবং মৃগস্থাপন অথবা বর্দ্ধমান স্তূপের ন্যায় ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
জোগী-গুফা নামক স্থানে পাথরের একটি ছোট স্তূপ পাওয়া গিয়াছে। ইহার মেধি ও অণ্ড অংশের উচ্চতা তাহাদের ব্যাসের তিন গুণ। সুতরাং মেধি অণ্ড ও ছত্রাবলী মিলিয়া ইহা একটি সুদীর্ঘ চূড়ার ন্যায় দেখায়, ইহাকে স্তূপ বলিয়া প্রথমে কিছুতেই মনে হয় না। ইহাকে বাংলার স্তূপের শেষ বিবর্ত্তন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
.
খ। বিহার
সপ্তম শতাব্দীর পূর্ব্বেই যে বাংলায় বৌদ্ধ ভিক্ষুগণের বাসের জন্য অনেক বিহার ছিল এবং ইহার কোনো কোনোটি বেশ বড় ও কারুকার্যখচিত ছিল, চীনদেশীয় পরিব্রাজকগণের বিবরণ হইতে তাহা জানা যায়। স্তূপের ন্যায় এগুলিও ধ্বংস হইয়াছে। কিন্তু রাজসাহীর অন্তর্গত পাহাড়পুর নামক স্থানে একটি বিশাল বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ায় প্রাচীন বাংলার এই শ্রেণীর স্থাপত্যের সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা সম্ভবপর হইয়াছে।
একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, পঞ্চম শতাব্দীতেও এখানে একটি জৈন বিহার ছিল। সম্ভবত কালক্রমে ইহা নষ্ট হইয়া যায়। অষ্টম শতাব্দীতে ধর্ম্মপাল এখানে যে প্রকাণ্ড বিহার নির্মাণ করেন, সোমপুর মহাবিহার নামে তাহা ভারতের সর্বত্র এবং ভারতের বাহিরেও বৌদ্ধজগতে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে। এই প্রকাণ্ড বিহারের চতুষ্কোণ অঙ্গনটি প্রতিদিকে ২০০ গজ দীর্ঘ ছিল। (চিত্র নং ৩০)। অঙ্গনটি উচ্চ প্রাচীরে ঘেরা ছিল এবং অঙ্গনের চারিদিকেই এই প্রাচীরগাত্রে ভিক্ষুগণের বাসের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কক্ষ নির্ম্মিত হইয়াছিল। এই সমুদয় কক্ষের সংখ্যা ১৭৭। প্রতি কক্ষ প্রায় সাড়ে তেরো ফুট দীর্ঘ ছিল। কক্ষগুলির সম্মুখ দিয়ে আট-নয় ফুট চওড়া প্রশস্ত বারান্দা সমস্ত অঙ্গনটি ঘিরিয়া বিস্তৃত ছিল; এবং চারিদিকে চারিটি সিঁড়ি দিয়া বারান্দা হইতে অঙ্গনে নামা যাইত। প্রাচীরের উত্তর দিকে এই বিহারের প্রধান প্রবেশপথ অথবা সিংহদরজা ছিল। ইহার পশ্চাতেই একটি প্রকাণ্ড স্তম্ভযুক্ত প্রশস্ত দালান ছিল। এই দালান হইতে আর একটি ক্ষুদ্রতম স্তম্ভযুক্ত দালানের মধ্য দিয়া পূর্ব্বোক্ত কক্ষ শ্রেণীর সম্মুখস্থ বারান্দায় পৌঁছানো যাইত। দক্ষিণ, পূর্ব্ব ও পশ্চিম বারান্দায় ঠিক মধ্যস্থলে, অঙ্গনে নামিবার সিঁড়ির পশ্চাতেও এইরূপ কয়েকটি অতিরিক্ত কক্ষ ছিল। সমুদয় কক্ষগুলি হইতে জল নিঃসারণের জন্য পয়ঃপ্রণালীর ব্যবস্থা ছিল। বিস্তৃত অঙ্গনের ঠিক মধ্যস্থলে একটি প্রকাণ্ড মন্দির ছিল (চিত্র নং ৩১)। এই মন্দির ও চতুস্পার্শ্বস্থ কক্ষগুলির মধ্যবর্ত্তী বিস্তৃত আঙ্গিনায় ছোট ছোট স্তূপ, মন্দির, কূপ, স্নানাগার, রন্ধনশালা ভোজনালয় প্রভৃতি ছিল। ভারতবর্ষে এ পর্য্যন্ত যত বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে তাঁহার মধ্যে এই সোমপুর বিহারই সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। এই বিহারটি যখন সম্পূর্ণ ছিল তখন ইহার বিশালত্ব ও সৌন্দর্য্য লোকের মনে বিস্ময় উৎপাদন করিত। একখানি সমসাময়িক লিপিতে ইহা “জগতাং নেকৈবিশ্রাম-ভূ” (জগতে নয়নের একমাত্র বিরামস্থল অর্থাৎ দর্শনীয় বস্তু) বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। ইহার মহাবিহার নাম সার্থক ছিল।
সম্প্রতি কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী ময়নামতী নামক অনুচ্চ পর্বতমালায় কয়েকটি বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। উহার খননকার্য এখনো আরম্ভ হয় নাই, কিন্তু প্রাথমিক পরীক্ষার ফলে একজন পুরাতত্ত্ববিৎ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে পাহাড়পুরের বিহার ও মন্দির অপেক্ষাও বৃহত্তর বিহার ও মন্দিরাদি এইখানে ছিল।
এই সমুদয় ধ্বংসাবশেষ হইতেই প্রাচীন বাংলার বিহার সম্বন্ধে কতক ধারণা করা যায়।
.
গ। মন্দির
বাংলার প্রাচীনকালের মন্দির প্রায় সকলই ধ্বংস হইয়াছে এ কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। কিন্তু কোনো কোনো বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথিতে কয়েকটি প্রাচীন মন্দিরের ছবি আছে। কতকগুলি প্রস্তরমূর্ত্তিতেও মন্দির উত্তীর্ণ হইয়াছে। এই সমুদয় প্রতিকৃতির সাহায্যে বাংলার প্রাচীন মন্দিরের গঠনপ্রণালী আলোচনা করিলে ছাদের আকৃতি অনুসারে ইহা নিম্নলিখিত চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়।
১। এই শ্রেণীর মন্দিরের ছাদ উপর্যুপরি কতকগুলি সামন্তরাল চতুষ্কোণ স্ত রের সমষ্টি। প্রতি দুই স্তরের মধ্যবর্ত্তী ভাগ অন্তর্নিবিষ্ট থাকায় এই স্তরগুলি বেশ পৃথক পৃথক দেখা যায়। স্তরগুলি যত ঊর্ধ্বে উঠিতে থাকে ততই ছোট হয়। গুপ্তযুগের ভাস্কর্যে এই শ্রেণীর মন্দির উত্তীর্ণ হইয়াছে। ইহার পরিণতি দেখা যায় উড়িষ্যার মন্দিরের সম্মুখস্থ জগমোহনে। উড়িষ্যার এই প্রকার ছাদযুক্ত মন্দির ভদ্র অথবা নীড় দেউল নামে অভিহিত হইয়াছে।
২। দ্বিতীয় শ্রেণীর মন্দিরের ছাদ উড়িষ্যার মন্দিরের ন্যায় শিখরে ঢাকা। চতুষ্কোণ গর্ভগৃহের প্রাচীরগাত্র হইতে উচ্চ শিখরের চারিটি ধার উঠিয়া ঈষৎ বাঁকা হইতে হইতে অবশেষে প্রায় সংলগ্ন হইয়া যায়। এই সংযোগস্থল একটি গোলাকার প্রস্তরখণ্ডে (আমলক শিলা) আবদ্ধ করা হয় এবং শিখরের গাত্রে কারুকার্যখচিত অনেক লম্বালম্বি পংক্তি থাকে। এই শ্রেণীর মন্দিরের নাম রেখ-দেউল।
৩-৪। প্রথম শ্রেণীর ভদ্র দেউলের সর্বোচ্চ স্তরের উপর একটি স্তূপ বা শিখর স্থাপিত করিয়া এই দুই শ্রেণীর মন্দিরের সৃষ্টি হইয়াছে। কোনো কোনো স্থলে এই স্তূপ বা শিখর কেবল সর্বোচ্চ স্তরের উপরে নহে, প্রতি স্তরের কোণে এবং সম্মুখ ভাগেও দেখা যায়।
বৌদ্ধ পুঁথির চিত্র ও প্রস্তরমূৰ্ত্তি হইতে জানা যায় যে, প্রাচীন বাংলায় এই চারি শ্রেণীর মন্দির ছিল। তবে শেষোক্ত দুই শ্রেণীর কোনো প্রাচীন মন্দির এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু পরবর্ত্তীকালে নির্ম্মিত দিনাজপুরের অন্তর্গত কান্তনগরের মন্দির চতুর্থ শ্রেণীর মন্দিরের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন বলিয়া গণ্য করা যাইতে যারে। ব্রহ্মদেশে এইরূপ মন্দির আছে। বাঁকুড়ার এক্তেশ্বর মন্দিরের অঙ্গনে নন্দীর যে ক্ষুদ্র একটি মন্দির আছে, প্রথম শ্রেণীর মন্দিরের তাহাই একমাত্র নিদর্শন। এতদ্ব্যতীত বাংলায় যে কয়েকটি প্রাচীন মন্দির আছে তাহা সকলই দ্বিতীয় শ্রেণীর। ইহার মধ্যে বর্দ্ধমানের অন্তর্গত বরাকরে একটি, ও বাঁকুড়ার অন্তর্গত দেহারে দুইটি, মোট তিনটি প্রস্তরে গঠিত, অবশিষ্ট ককেটি ইষ্টকনিৰ্মিত। এই মন্দিরগুলির শিখর পূর্ব্বোক্ত বর্ণনানুযায়ী ও উড়িষ্যার মন্দিরের অনুরূপ। হিন্দু যুগে এই শ্রেণীর মন্দির উত্তর ভারতের সর্বত্র দেখা যাইত।
বরাকরের ৪ নং মন্দিরটি (চিত্র নং ৩) ইহাদের মধ্যে সর্বপ্রাচীন। ইহার অপেক্ষাকৃত উচ্চ গর্ভগৃহ, অনুচ্চ শিখরভাগ এবং আমলক শিলার আকৃতি অনেকটা ভুবনেশ্বরের প্রাচীন পরশুরামেশ্বর মন্দিরের ন্যায়, এবং ইহা সম্ভবত ঐ সময় অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দে নির্ম্মিত।
বড় বড় মন্দিরের অনুকরণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দিরও নির্ম্মিত হইত। রাজসাহী জিলার অন্তর্গত নিমদীঘি এবং দিনাজপুরের অন্তর্গত বাণগড়ে এইরূপ প্রস্তরনির্ম্মিত দুইটি এবং চট্টগ্রামের অন্তর্গত ঝেওয়ারিতে ব্ৰঞ্জনির্ম্মিত একটি মন্দির (চিত্র নং ৪) পাওয়া গিয়াছে। এগুলির গঠনপ্রণালী একই রকমের এবং সম্ভবত বরাকর মন্দিরের অনতিকাল পরেই এই সমুদয় নির্ম্মিত হয়। এই যুগের বৃহৎ শিখরযুক্ত মন্দির কিরূপ কারুকার্যখচিত ছিল এই সমুদয় দেখিলে তাহা অনেকটা অনুমান করা যায়। গর্ভগৃহের চতুর্দিকে চারিটি ত্রিভঙ্গিম খিলানযুক্ত কুলুঙ্গি, শিখরগাত্রে অলঙ্কাররূপে চৈত্যগবাক্ষের ব্যবহার, এবং শিখরের উপরিভাগে চারি কোণে সিংহমূৰ্ত্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পরবর্ত্তীকালের মন্দিরগুলিতে খোদিত কারুকাৰ্য্য অনেক বেশি। শিখরের কোণগুলি পালিশ করায় ইহা অধিকতর গোলাকার দেখা যায় এবং শিখরগাত্রে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিখরের প্রতিমূর্ত্তি উত্তীর্ণ করা হয়। মন্দিরের প্রবেশপথের সম্মুখস্থ পুরু দেওয়ালের মধ্যে একটু ছোট নাটমন্দিরের মতো কক্ষ যোগ করাও এগুলির আর একটি বিশেষত্ব। দেউলিয়ার (বর্দ্ধমান) মন্দির, বহুলারার (বাঁকুড়া) সিদ্ধেশ্বর মন্দির (চিত্র নং ২৭ ক), (সুন্দরবনের জটার দেউল) এবং দেহারের (বাঁকুড়া) সরেশ্বর ও সল্লেশ্বরের মন্দির বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথম তিনটি ইষ্টক ও শেষোক্ত দুইটি প্রস্তরে নির্ম্মিত। সিদ্ধেশ্বর মন্দিরের কারুকার্য বাংলার মন্দিরশিল্পের সর্বোৎকৃষ্ট নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
পাহাড়পুরের বিহারের অঙ্গনের ঠিক কেন্দ্রস্থলে একটি বিশাল মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে (চিত্র নং ৩১)। ইহার ঊর্ধ্বভাগ বিলুপ্ত হওয়ায় এই মন্দিরটি কোন শ্রেণীর অন্তর্গত ছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। কিন্তু ইহার নিচের যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাহা ভারতবর্ষের অন্যান্য মন্দির হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।
মন্দিরটি ত্রিতল। ইহার ঠিক কেন্দ্রস্থলে একটি চতুষ্কোণ বর্গাকৃতি অংশ সোজা উপরে উঠিয়া গিয়াছে। ইহার চারিধারের প্রাচীর অতিশয় স্কুল ও দৃঢ় এবং প্রাচীরের অভ্যন্তরস্থ স্থান ফাঁকা হইলেও সেখানে প্রবেশ করিবার কোনো উপায় নাই। ত্রিতলে এই বর্গাকৃতি অংশের প্রতি প্রাচীরের সম্মুখভাগে একটী নাটমন্দির ও মণ্ডপ এমনভাবে নির্ম্মিত হইয়াছে যাহাতে ইহার দুই পার্শ্বে প্রাচীরের খানিক অংশ মুক্ত থাকে। ইহার ফলে এই চারিটি প্রসারিত অংশের মধ্যে বর্গাকৃতি অংশের চারিটি কোণ বাহির হইয়া আছে এবং সমস্তটা একটি ক্রসের আকার ধারণ করিয়াছে। এই ক্রসের সীমারেখা অনুযায়ী একটি প্রদক্ষিণপথ ও তাঁহার আবেষ্টনী মন্দিরের চারিদিকে ঘিরিয়া আছে। দ্বিতলের পরিকল্পনা ত্রিতলেরই অনুরূপ-কিন্তু ইহার প্রতিদিকের সম্মুখভাগ খানিকটা প্রসারিত করিয়া আরও দুইটি কোণের সৃষ্টি করা হইয়াছে। একতল দ্বিতলের অনুরূপ, কেবল ইহার উত্তর দিকের একটু অংশ বাড়াইয়া সিঁড়ির জায়গা করা হইয়াছে। সমগ্র মন্দিরটি উত্তর-দক্ষিণে ৩৫৬ ফুট এবং পূর্ব্ব-পশ্চিমে ৩২৪ ফুট দীর্ঘ। যে অংশ অবশিষ্ট আছে তাঁহার উচ্চতা ৭০ ফুট।
এই বিশাল মন্দিরের উপরিভাগ কিরূপ ছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। কেহ কেহ অনুমান করেন যে বর্গাকৃতি অংশের উপরে মূল মন্দির ছিল। আবার কেহ কেহ বলেন যে সাধারণ মন্দিরের গর্ভগৃহের ন্যায় কোনো কক্ষ এই মন্দিরে ছিল না-কেবল বর্গাকৃতি অংশের সম্মুখস্থ চারিটি নাটমন্দিরে চারিটি দেবমূর্ত্তি ছিল। জৈন চতুর্মুখ মন্দির ও ব্রহ্মদেশের কোনো কোনো মন্দিরে এইরূপ ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়।
সম্ভবত বর্গাকৃতি অংশের উপর এক উচ্চ শিখর ছিল, এবং যাহাতে এই বিশাল শিখরের ভার বহন করিতে পারে সেই জন্যই বর্গাকৃতি অংশ এমন সুদৃঢ়ভাবে একেবারে নীচ হইতে গাঁথিয়া ভোলা হইয়াছিল। যখন এই বিশাল মন্দিরের উপযোগী উচ্চ শিখর বিদ্যমান ছিল তখন ইহা বহুদূর হইতে গিরিচূড়ার ন্যায় দেখা যাইত, এবং ইহার সৌন্দৰ্য্য, বিশালতা ও গাম্ভীর্য লোকের মনে কিরূপ বিস্ময় উৎপাদন করিত, আজ আমরা কেবলমাত্র কল্পনায় তাহা অনুভব করিতে পারি।
মন্দিরটি ইট-কাদার গাঁথুনিতে তৈরী, অথচ সহস্রাধিক বৎসর পরে আজিও এই ইটের দেওয়াল ৭০ ফুট উঁচু পর্য্যন্ত অবশিষ্ট আছে ইহাই আশ্চর্যের বিষয়। দেওয়ালের মাঝে মাঝে কারুকার্যখোদিত ইটের কার্নিশ এবং দেওয়ালের গায়ে আবদ্ধ তিনটি সারিতে সাজানো পোড়ামাটি ও প্রস্তর ভাস্কর্যের ফলকগুলি এখনো ইহার অতীত শিল্পকলার নিদর্শনরূপে বর্ত্তমান। মন্দিরটি অষ্টম শতাব্দে নির্ম্মিত কিন্তু ইহার গাত্রসংলগ্ন কোনো কোনো ভাস্কৰ্য্য গুপ্তযুগের। সম্ভবত কোনো প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ হইতে এগুলি আহৃত হইয়া পরবর্ত্তীকালের মন্দিরগাত্রে সংলগ্ন করা হইয়াছে।
পাহাড়পুরের মন্দিরের পরিকল্পনা ভারতবর্ষে আর কোনো স্থানে দেখা যায় না, কিন্তু যবদ্বীপ ও ব্রহ্মদেশের কোনো কোনো মন্দির অনেকটা এইরূপ এবং ইহারই অনুকরণে নির্ম্মিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয়। পূৰ্বোক্ত বাংলার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর মন্দিরের শিখরও ব্রহ্মদেশে দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং বঙ্গদেশের অধুনা বিলুপ্ত মন্দিরশিল্প সুদূর প্রাচ্যের হিন্দু উপনিবেশগুলিতে বিশেষ প্রভাব বিস্ত রি করিয়াছিল এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ যুক্তিসঙ্গত। বাংলায় প্রাচীন মন্দির খুব বেশি নাই, কিন্তু এই সমুদয় মন্দিরের অংশবিশেষ-স্তম্ভ, চৌকাঠ প্রভৃতি-নানা স্থানে পাওয়া গিয়াছে। দিনাজপুর রাজবাড়ীতে কারুকার্যখচিত একটি প্রস্তরস্তম্ভ আছে। ইহার গাত্রের উত্তীর্ণ লিপি হইতে জানা যায় যে স্তম্ভটি গৌড়াধিপ প্রতিষ্ঠিত একটি শিবমন্দিরের অংশ। এই মন্দিরটি নবম শতাব্দে নির্ম্মিত হইয়াছিল। বীরভূম জিলার অন্তর্গত পাইকোরে দুইটি এবং পাবনা জিলার হাণ্ডিয়াল গ্রামে চারিটি বিচিত্র কারুকার্যে শোভিত প্রস্তরস্তম্ভ পাওয়া গিয়াছে। দিনাজপুরের গরুড় স্তম্ভ ও কৈবৰ্ত্ত স্তম্ভও (চিত্র নং ২৮ ক) এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বিক্রমপুরের নানা স্থানে প্রস্তর ও কাষ্ঠের স্তম্ভ পাওয়া গিয়াছে। কাষ্ঠের স্তম্ভগুলি জীর্ণ হইলেও তাঁহার গাত্রে উত্তীর্ণ বিচিত্র কারুকার্য এখনো দেখিতে পাওয়া যায়, এবং ইহার শিল্পকলা অতিশয় উচ্চশ্রেণীর। এইরূপ কয়েকটি কাষ্ঠের স্তম্ভ, ব্রাকেট প্রভৃতি ঢাকা যাদুঘরে। রক্ষিত আছে, এবং এইগুলি প্রাচীন বাংলার দারুশিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন (চিত্র নং ২৯)। ইহা হইতে আরও প্রমাণিত হয় যে বাংলায় কাষ্ঠনির্ম্মিত অনেক মন্দির ছিল। কালক্রমে সেগুলি ধ্বংস হইয়াছে, কিন্তু তাঁহার যে দুই-একটি ক্ষুদ্র অংশ প্রায় সহস্র বৎসর পরেও টিকিয়া আছে তাহা হইতেই এই মন্দিরগুলির সৌন্দর্য্য সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যাইতে পারে। স্তম্ভগুলি বাস্তবিক বাংলার বিলুপ্ত মন্দিরশিল্পের স্মৃতিস্তম্ভ।
বাণগড়ের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে আবিষ্কৃত একটি বিশাল কারুকার্যখচিত পাথরের চৌকাঠ এখন দিনাজপুর রাজবাড়ীতে আছে। প্রাচীন গৌড়ে ও রাজসাহী জিলায় কয়েকটি পাথরের চৌকাঠের অংশ পাওয়া গিয়াছে। এগুলির কারুকার্য খুবই উচ্চদরের। স্তম্ভের ন্যায় এই সমুদয় চৌকাঠও প্রাচীন মন্দিরশিল্পের স্মৃতি বহন করিতেছে।
.
২. ভাস্কৰ্য্য
ভারতবর্ষে চিরকাল দেবমন্দিরই স্থাপত্য ও ভাস্কৰ্য্যশিল্পের প্রধান কেন্দ্র ছিল। প্রাচীন বাংলায় মন্দির ছিল, সুতরাং ভাস্কর্যের বহু উন্নতি হইয়াছিল। মন্দিরের সঙ্গে সঙ্গে ইহার অধিকাংশই লুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু অনেক স্থলে মন্দির বিনষ্ট হইলেও তন্মধ্যস্থ দেবমূৰ্ত্তি রক্ষিত হইয়াছে। বাংলায় যে বহুসংখ্যক দেব-দেবীর মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে পূর্ব্বেই তাঁহার উল্লেখ করিয়াছি। এই সমুদয় মূর্ত্তি হইতে বাংলার প্রাচীন চারুশিল্পের কতক পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু ইহার অধিকাংশই নবম শতাব্দীর পরবর্ত্তীকালের। ইহার পূর্ব্বে একমাত্র পাহাড়পুর মন্দিরগাত্রেই অনেক ভাস্কর্যের নিদর্শন একত্র পাওয়া যায়। যে সমস্ত ভাস্কর্যের নিদর্শন ইহারও পূৰ্ব্ববর্ত্তীকালে বলিয়া নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যায় তাঁহার সংখ্যা খুবই অল্প।
ক। প্রাচীন যুগ
চন্দ্রবর্ম্মার রাজধানী পুষ্করণা (বাঁকুড়া জিলার পোকৰ্ণা) ও সুপ্রসিদ্ধ প্রাচীন নগরী তাম্রলিপ্তিতে প্রাপ্ত কয়েকখানি উত্তীর্ণ পোড়ামাটি বাংলার সৰ্ব্বপ্রাচীন ভাস্কর্যের নিদর্শন। ইহার একখানিতে একটি যক্ষিনীর মূর্ত্তি আছে। ইহার গঠনপ্রণালী ও বসন-ভূষণ শুঙ্গযুগের মূর্ত্তির অনুরূপ (খৃ. পৃ. প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দী)। মহাস্থানে একটি পোড়ামাটির মূৰ্ত্তি কেহ কেহ মৌর্য যুগের বলিয়া মনে করেন, কিন্তু ইহা এতই অস্পষ্ট যে এ সম্বন্ধে কোনো সঠিক ধারণা করা কঠিন। মহাস্থানের আর একটি পোড়ামাটির মূর্ত্তি সম্ভবত শুঙ্গযুগের।
রাজসাহী জিলার অন্তর্গত কুমারপুর ও নিয়ামপুরে প্রাপ্ত দুইটি সূৰ্য্যমূর্ত্তি এবং মালদহ জিলার হাঁকরাইল গ্রামের বিষ্ণুমূর্ত্তির পোশাক-পরিচ্ছদ ও গঠনপ্রণালী কুষাণযুগের মূর্ত্তির অনুরূপ। বাণগড়ে প্রাপ্ত কয়েকটি পোড়ামাটির মূর্ত্তিতে কুষাণ অথবা তাঁহার অব্যবহিত পরবর্ত্তী যুগের শিল্প-লক্ষণ দেখিতে পাওয়া যায়।
বিহারৈলের বুদ্ধমুর্তি সারনাথের গুপ্তযুগের মূর্ত্তির অবিকল অনুকরণ বলিলেও চলে। কাশীপুরের (সুন্দরবন) ও দেওরার (বগুড়া) সূৰ্য্যমূৰ্ত্তি দুইটিতেও গুপ্তযুগের শেষকালের (ষষ্ঠ শতাব্দী) শিল্প-লক্ষণ বিদ্যমান। ইহাদের মধ্যে কাশীপুরের মূর্ত্তিটি (চিত্র নং ১৫ক) অধিকতর সৌষ্ঠবসম্পন্ন। গুপ্তযুগে পূৰ্ব্ব ভারতীয় মূর্ত্তিগুলিতে যেরূপ সংযম ও গাম্ভীর্য্যের সঙ্গে কমনীয়তা ও ভাবপ্রবণতার অপূৰ্ব্ব সমাবেশ দেখা যায়, এই মূর্ত্তিটিতে তাহা বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে। মহাস্থানের নিকটবর্ত্তী বলাইধাপ ভিটায় সোনার পাতে ঢাকা অষ্টধাতুনির্ম্মিত একটি মঞ্জুশ্রী মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। এই মূর্ত্তিটি প্রাচীন বাংলার ভাস্কর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। ইহার গঠনপ্রণালী গুপ্তযুগের আদর্শের অনুযায়ী। এই মূর্ত্তির কমনীয় অথচ শান্ত-সমাহিতভাবে পরিপূর্ণ মুখশ্রী, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের লাবণ্য ও সুষমা, করাঙ্গুলি, অধর-যুগলের ব্যঞ্জনা ও সমগ্র দেহের ভাবপ্রবণতা দেখিলে, প্রাচীন বাংলায় চারুশিল্পের কত দূর উৎকর্ষ হইয়াছিল, তাঁহার ধারণা করা যায়।
এই সমুদয় মূৰ্ত্তি হইতে প্রমাণিত হয় যে, খৃষ্টাব্দের আরম্ভ বা তাঁহার পূর্ব্ব হইতেই বাংলায় ভাস্কর্যের চর্চ্চা ছিল এবং বাংলার শিল্পী গুপ্তযুগ পৰ্য্যন্ত ভারতের সাধারণ শিল্পধারার সহিত যোগ রক্ষা করিয়াই চলিত। ষষ্ঠ শতাব্দীর পূর্ব্বে বাংলার ভাস্কর্যে কোনো বিশিষ্ট প্রণালী বা পরিকল্পনার পরিচয় পাওয়া যায় না। এই পরিচয় প্রথম পাওয়া যায় দেবখড়ের রাণী প্রভাবতীর লিপিযুক্ত সৰ্ব্বাণী ও তাঁহার সহিত প্রাপ্ত একটি ক্ষুদ্র সূৰ্য্যমূৰ্ত্তিতে। এই দুইটি সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে নির্ম্মিত। গুপ্তশিল্পের প্রভাব থাকিলেও, ইহাতে পরবর্ত্তী পালযুগের শিল্প-বৈশিষ্ট্যের সূচনা দেখিতে পাওয়া যায়। চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত মণিরহাটে প্রাপ্ত একটি শিবমূৰ্ত্তিও এই শ্রেণীর অন্তর্গত। এই তিনটি মূর্ত্তিই ধাতুনির্ম্মিত।
.
খ। পাহাড়পুর
পাহাড়পুরের মন্দিরগাত্রে যে খোদিত প্রস্তর ও পোড়ামাটির ফলক আছে তাহা হইতে সর্বপ্রথমে বাংলার নিজস্ব ভাস্কৰ্য্যশিল্পের বৈশিষ্ট্যের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়। বিষয়বস্তু ও শিল্পকৌশলের দিক দিয়া বিচার করিলে, পাহাড়পুরের ভাস্কৰ্য্য দুই বা তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। প্রথমটি লোকশিল্প এবং দ্বিতীয়টি অভিজাত শিল্প। তৃতীয়টি এ দুয়ের মাঝামাঝি।
প্রস্তরের কয়েকটি ও পোড়া-মাটির সমুদয় ফলকগুলি প্রথম শ্রেণী অথবা লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত। রামায়ণ-মহাভারতের অনেক কাহিনী ইহাতে খোদিত হইয়াছে। কৃষ্ণের জন্মকথা এবং যে সমুদয় লীলা বাঙ্গালীর চিরপ্রিয় এবং বাংলার প্রতি ঘরে পরিচিত, তাঁহার বহু দৃশ্য ইহাতে আছে (চিত্র নং ৭-৮)। পঞ্চতন্ত্র ও বৃহকথার জনপ্রিয় গল্প ইহার হাস্যরসের আধার যোগাইয়াছে। সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ ও জীবনযাত্রার দৈনন্দিন কাহিনী ইহাতে বিশেষভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। মেয়েরা নানা ভঙ্গীতে নৃত্য করিতেছে (চিত্র নং ৬), শিশুকে ক্রোড়ে লইয়া জননী কূপ হইতে জল তুলিতেছে অথবা জলের কলসীসহ গৃহে ফিরিতেছে, কৃষক লাঙ্গল কাঁধে করিয়া মাঠে যাইতেছে, বাজিকর কঠিন কঠিন বাজি দেখাইতেছে, শীর্ণকায় সাধু-সন্ন্যাসী কাঁধের উপর কাষ্ঠখণ্ডের সাহায্যে তৈজসপত্র বহন করিয়া লম্বা দাড়ি ঝুলাইয়া নজদেহে চলিয়াছে, পরচুলাপরা দারোয়ান লাঠি ভর দিয়া দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া ঝিমাইতেছে। (চিত্র নং ৫), প্রেমালাপে মত্ত যুবক-যুবতী, পুরুষ ও স্ত্রী বাদ্যকারগণ এবং তাহাদের বাদ্যযন্ত্র, পূজানিরত ব্রাহ্মণ, অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পুরুষ ও নারী, ধনুর্বাণহস্তে রথারোহী যোদ্ধা, পর্ণমাত্ৰ-পরিহিত শবর স্ত্রী-পুরুষের প্রেমালাপ, ধনুহস্তে শবর, মৃত জন্তু হস্তে লইয়া বীরদর্পে পদক্ষেপকারিণী শবর রমণী,-এইরূপ অসংখ্য দৃশ্য শিল্পী খোদাই করিয়াছে। সুপরিচিত পশুপক্ষী পত্রপুষ্প গাছপালাও শিল্পীর দৃষ্টি এড়ায় নাই। দৃশ্যমান জগতের বাহিরেও শিল্পীর কল্পনা বিস্তার লাভ করিয়াছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, গণেশ, বোধিসত্ত্ব, পদ্মপাণি, মঞ্জুশ্রী, তারা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্ত্তি আছে, কিন্তু ইহাদের সংখ্যা খুব বেশি নহে। দৈত্য, দানব, নাগ, কিন্নর, গন্ধৰ্ব্ব ও বহু কাল্পনিক জীবজন্তু শিল্পীর হস্তে মূর্ত্তি পরিগ্রহণ করিয়াছে।
যে সকল ভাস্কর এই সমুদয় দৃশ্য খোদিত করিয়াছিল, তাহাদের শিক্ষা ও সমাজ খুব উচ্চশ্রেণীর নহে। উত্তীর্ণ পুরুষ ও নারীমূর্ত্তির গঠন অতি সাধারণ, এমনকি কুৎসিত বলাও চলে। তাহাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সৌষ্ঠবহীন এবং অনেক সময় অস্বাভাবিক, পরিধেয় বসন-ভূষণ অতিশয় সংক্ষিপ্ত ও সাধারণ; তাহাদের গতি ও ভঙ্গীর মধ্যে কোনো লাবণ্য বা সুষমা নাই এবং অন্তর্নিহিত কোনো ভাব বা চিন্তা তাহাদের মুখশ্রীতে ফুটিয়া ওঠে নাই। যে সূক্ষ্ম সৌন্দৰ্য্যানুভূতি উচ্চ শিল্পের প্রাণ, এই সমুদয় মূর্ত্তিতে তাঁহার সম্পূর্ণ অভাব। কিন্তু উচ্চাঙ্গের সৌন্দৰ্যবোধ বা প্রকাশের ক্ষমতা না থাকিলেও সংসার ও সমাজের সহিত এই সমুদয় ভাস্করের ঘনিষ্ঠ পরিচয়, নিকট সম্বন্ধ ও নিবিড় সহানুভূতি ছিল, এবং তাহাদের শিক্ষা-দীক্ষা অপরিণত হইলেও পুরুষানুক্রমলব্ধ কৌশল ও স্বাভাবিক নিপুণতার সাহায্যে তাহারা সরল অকৃত্রিমভাবে ইহার পরিচয় দিতে সমর্থ হইয়াছে। সংখ্যায় অগণিত যে সমুদয় সাধারণ শ্রেণীর নর-নারী উচ্চতর শিল্প বা সৌন্দৰ্য্যবোধের দাবি করিত, তাহাদের জন্যই এই সমুদয় শিল্প রচনা। তাহারা যে এই দৈনন্দিন জীবনযাত্রার পরিচিত দৃশ্যাবলী এবং কাল্পনিক ও বাস্তব জগতের চিত্র বিশেষভাবে উপভোগ করিত, তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে। এই হিসেবে পাহাড়পুরের এই দৃশ্যাবলী বাংলার প্রাচীন লোকশিল্পের চমৎকার দৃষ্টান্ত বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
কিন্তু বাংলায় যে উচ্চশ্রেণীর শিল্পীও ছিল পাহাড়পুরের দ্বিতীয় শ্রেণীর পাথরের ফলকে উত্তীর্ণ মূর্ত্তিগুলিই তাঁহার প্রমাণ। এগুলির সংখ্যা খুব বেশী নহে, এবং ইহারা প্রধানত কৃষ্ণ, বলরাম, শিব, যমুনা প্রভৃতি দেব-দেবীর মূর্ত্তি (চিত্র নং ৯)। ইহার মধ্যে একটি পুরুষ ও নারীর প্রণয়চিত্র (চিত্র নং ৮) অনেকেই রাধাকৃষ্ণের যুগলমূৰ্ত্তি বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। মূর্ত্তির মস্তকের পশ্চাতে দিব্যজ্যোতির চিহ্ন আছে, অতএব ইহা সাধারণ মনুষ্যমূৰ্ত্তি নহে। কৃষ্ণের জীবনের অনেক দৃশ্য এই মন্দিরগাত্রে আছে। সুতরাং খুব সম্ভবত ইহা কৃষ্ণ ও তাঁহার প্রেয়সীর মূর্ত্তি। কিন্তু এই প্রেয়সী যে রাধা এরূপ মনে করিবার বিশেষ কোনো কারণ নাই। কৃষ্ণ-রাধার প্রেমের কাহিনী মহাভারত ও প্রাচীন পুরাণাদিতে পাওয়া যায় না এবং ইহা যে এই সময়ে প্রচলিত ছিল, তাঁহারও কোনো সন্তোষজনক প্রমাণ নাই। সুতরাং অনেকে মনে করেন যে, ইহা কৃষ্ণের পার্শ্বে রুক্মিণী অথবা সত্যভামার মূর্ত্তি।
এই মূর্ত্তির সহিত পূর্ব্বোক্ত প্রথম শ্রেণীর অন্তর্গত অনুরূপ কয়েকটি প্রণয়িযুগলের মূৰ্ত্তি তুলনা করিলেই শিল্প হিসাবে এ দুয়ের প্রভেদ বুঝিতে পারা যাইবে। মুখশ্রী, দাঁড়াইবার ভঙ্গি, নারীমূৰ্ত্তির ঈষৎ বক্র লীলায়িত দৃষ্টিভঙ্গী ও সলাজ-হাস্য-ফুরিতাধর, হস্তপদাদির গঠন-সৌষ্ঠব, পরিধেয় বসনের রচনাপ্রণালী, এবং সর্বোপরি নর-নারীর প্রেমের যে একটি মাধুৰ্য্য ও মহিমা এই মূর্ত্তির মধ্য দিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, এই সমুদয় বিষয় বিবেচনা করিলে, ইহার শিল্পীর শিক্ষা দীক্ষা ও সৌন্দৰ্য্যানুভূতি যে পূর্ব্বোক্ত শিল্পীগণের অপেক্ষা অনেক উচ্চস্তরের সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে না। বলরাম ও যমুনার মূর্ত্তির সহিত যম, অগ্নি প্রভৃতির এবং দক্ষিণ প্রাচীরস্থিত শিবমূৰ্ত্তির সহিত অন্যান্য শিবমূর্ত্তির তুলনা করিলেও স্পষ্ট প্রতীয়মান হইবে যে, পাহাড়পুরের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর গুপ্তযুগের গঠন-সৌষ্ঠব, অঙ্গের লাবণ্য ও সুষমা, গতিভঙ্গীর বৈচিত্র্য ও সাবলীল ভাব, অন্তর্নিহিত ভাবের বিকাশে উদ্ভাসিত মুখশ্রী প্রভৃতির স্পষ্ট নিদর্শন দেখা যায়। বাংলার যে সমুদয় শিল্পী এগুলি গড়িয়াছিল গুপ্তযুগের শিল্পই তাহাদের আদর্শ ছিল, এবং স্বাভাবিক প্রতিভা ও কঠোর সাধনা দ্বারা তাহারা তদনুযায়ী শিক্ষা লাভ করিয়াছিল। প্রথম শ্রেণীর শিল্পীদের শিক্ষা ও আদর্শ ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। বাংলার পল্লীতে পল্লীতে প্রাচীনকাল হইতে যে শিল্পধারা সহজ ও স্বাভাবিক বিবর্ত্তনের ফলে গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহারা শিশুকাল হইতেই অভ্যস্ত হইয়া তাহাকে রূপ দিয়াছিল।
পাহাড়পুরে কতকগুলি খোদিত প্রস্তর আছে যাহাতে প্রথম শ্রেণীর অপটুতা ও দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষা ও সৌন্দর্যবোধ উভয়ই আংশিকভাবে বর্ত্তমান। কৃষ্ণের কয়েকটি বাল্যলীলা ও কতকগুলি দেব-দেবী ও দিকপালের মূৰ্ত্তি এই শ্রেণীর অন্ত গত। কৃষ্ণের কেশীবধ (চিত্র নং ৭) ইহার একটি উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। বালকৃষ্ণের মূর্ত্তি এবং ইহার সাবলীল গতিভঙ্গী দ্বিতীয় শ্রেণীর শিল্পীর অনুযায়ী, কিন্তু ইহার মুখ চোখের গঠনে পারিপাট্যের যথেষ্ট অভাব। ইন্দ্রের মূর্ত্তির মধ্যেও যথেষ্ট সৌষ্ঠব ও সৌন্দৰ্য্য আছে, কিন্তু ইহার চোখ ও মুখের গঠন অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এই সমুদয় কারণে এই খোদিত প্রস্তরগুলি একটি পৃথক বা তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা যাইতে পারে। সম্ভবত বাংলার প্রাচীন শিল্প ও গুপ্তযুগের নূতন আদর্শ এই দুয়ের সংমিশ্রণে ইহার উৎপত্তি হইয়াছিল।
প্রথম শ্রেণীর খোদিত পোড়া-মাটি ও পাথরগুলি যে পাহাড়পুর মন্দিরের সমসাময়িক, সে বিষয়ে সকলেই একমত; কিন্তু কেহ কেহ মনে করেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর খোদিত পাথরগুলি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন। সম্ভবত এগুলি কোনো মন্দিরগাত্রে সংলগ্ন ছিল, পরে পাহাড়পুর মন্দিরে ব্যবহার করা হইয়াছে। কিন্তু এই বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্প যে বিভিন্ন যুগের নিদর্শন তাহা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। কারণ একই সময়ে বাংলায় বিভিন্ন আদর্শের শিল্প প্রচলিত ছিল, ইহা অসম্ভব নহে। বাংলায় গুপ্তরাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর হইতেই গুপ্তশিল্পের প্রভাবও যে এদেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল, এরূপ অনুমান করা যায়। তাঁহার ফলে একদল সম্পূর্ণভাবে এই নূতন আদর্শ গ্রহণ করিয়াছিল, আর একদল নূতন আদর্শ কতকাংশে গ্রহণ করিলেও প্রাচীন পন্থা একেবারে ত্যাগ করে নাই। এই দুই দল এবং অবিকৃত প্রাচীনপন্থিগণ একই সময়ে বর্ত্তমান থাকিতে পারে এরূপ কল্পনা একেবারে অযৌক্তিক নহে।
.
গ। পোড়া-মাটির শিল্প
প্রাচীন বাংলায় পোড়ামাটির শিল্প খুবই উন্নতি লাভ করিয়াছিল। পাহাড়পুর ব্যতীত আরও অনেক স্থানে, বিশেষত কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী ময়নামতী ও লালমাই পৰ্ব্বতে, অনেকগুলি পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে কিন্নর (চিত্র নং ১০ ক), বিদ্যাধর (১৩ খ), বিবিধ ভঙ্গীর নারীমূৰ্ত্তি (১০ খ-গ, ১৩ গ-ঘ), অসি ও বর্শ্বহস্তে সৈনিক (১২ ক), ব্যাঘ্ৰ শিকারী (১২ খ), ব্যায়ামকারী (১১ ক), পদ্ম (১১ খ), নানারূপ প্রকৃত ও কাল্পনিক জন্তু ও দেব-দেবীর মূর্ত্তি প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহার অধিকাংশই পাহাড়পুরের প্রথম শ্রেণীর ন্যায় লোকশিল্পের নিদর্শন বলিয়া গ্রহণ করা যায়। কিন্তু কয়েকটি রচনাভঙ্গি অপেক্ষাকৃত উচ্চাঙ্গের শিল্পজ্ঞানের পরিচায়ক (১০ খ-গ)। ইহাছাড়া অনেক খোদিত ইটও পাওয়া গিয়াছে।
প্রাচীন পুণ্ড্রবর্দ্ধন নগরীর ধ্বংসের মধ্যেও বহু পোড়ামাটির ফলক ও মূর্ত্তি এবং কারুকাৰ্য্য-খোদিত ইট পাওয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে গোবিন্দ-ভিটায় প্রাপ্ত একটি গোলাকৃতি ফলক অথবা চক্রকে খোদিত মিথুনমূৰ্ত্তি (১৫ খ) উৎকৃষ্ট শিল্পকলার নিদর্শন।
বাংলায় প্রস্তর খুব সুলভ না হওয়ায় মৃৎশিল্প খুব বেশী জনপ্রিয় ছিল এবং লোকশিল্প হিসেবে পালযুগে, এবং সম্ভবত তাঁহার বহু পূৰ্ব্বেও, বিশেষ উন্নতিলাভ করিয়াছে। মধ্যযুগেও বাংলার এই জাতীয় শিল্পপ্রতিভার কিছু কিছু নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়।
.
ঘ। পালযুগের শিল্প
নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ-এই চারি শতাব্দের শিল্পকে পালযুগের শিল্প নামে অভিহিত করা যাইতে পারে। কারণ যদিও দ্বাদশ শতাব্দে সেনরাজগণ বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল এবং বৰ্ম্ম, চন্দ্র প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজবংশও এই যুগে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিয়াছেন, তথাপি এই চারি শতাব্দের শিল্প মোটামুটি একই লক্ষণাক্রান্ত এবং পালরাজ্যেই ইহার অভ্যুদয় ও বিকাশ ঘটিয়াছিল।
এই যুগের প্রস্তর ও ধাতুশিল্পের যে সমুদয় নিদর্শন এযাবৎ পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার বিষয়বস্তু কেবলমাত্র দেব-দেবীর মূর্ত্তি। বাস্তব সংসার ও সমাজের সহিত ইহার প্রত্যক্ষ কোনো সম্বন্ধ নাই। বিভিন্ন ধর্ম্মগ্রন্থে দেব-দেবীর যে ধ্যান আছে সৰ্ব্বতোভাবে তাঁহার অনুসরণ করিয়া শিল্পীকে এই সমুদয় নিৰ্মাণ করিতে হইত। সুতরাং শাস্ত্রের অনুশাসন নিগড়পাশের ন্যায় শিল্পীর স্বাধীন ইচ্ছা নিয়ন্ত্রিত করিত। শিল্পী বা শিল্পের কোনো অব্যাহত গতি ছিল না। প্রকৃত শিল্প মূর্ত্তির মধ্য দিয়ে তাঁহার কলানৈপুণ্য ও সৌন্দৰ্য্যবোধ প্রকাশ করিতে সমর্থ হইয়াছে ইহাই তাঁহার কৃতিত্ব।
উপকরণ বিষয়েও শিল্পীর খুব স্বাধীনতা ছিল না। অষ্টধাতু ও কালো কষ্টিপাথর, সাধারণত ইহাই ছিল মূর্ত্তি নির্মাণের প্রধান উপাদান। রৌপ্য এবং স্বর্ণও মূর্ত্তি নির্মাণে ব্যবহৃত হইত, কিন্তু এরূপ মূর্ত্তির সংখ্যা খুবই কম। কাষ্ঠনির্ম্মিত মূর্ত্তিও মাত্র কয়েকটি পাওয়া গিয়াছে।
পালযুগের চারিশত বৎসরে শিল্পের অনেক বিবর্ত্তন হইয়াছিল। কিন্তু এই বিবর্ত্তনের ইতিহাস সঠিকরূপে জানিবার উপায় নাই। অধিকাংশ মূৰ্ত্তিরই নির্মাণকাল মোটামুটিভাবেও জানা যায় না। এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত বহু শত মূর্ত্তির মধ্যে মাত্র পাঁচখানিতে সময়বিজ্ঞাপক লিপি উৎকীর্ণ আছে। ইহার মধ্যে একখানি দশ, দুইখানি একাদশ ও দুইখানি দ্বাদশ শতাব্দের। কোনো এক শতাব্দীর মাত্র একখানি বা দুইখানি মূর্ত্তির সাহায্যে সেই শতাব্দীর বিশিষ্ট শিল্প-লক্ষণ স্থির করা দুঃসাধ্য। সুতরাং কেবলমাত্র শিল্পের ক্রমগতির সাধারণ রীতির দিক দিয়া বিচার করা ছাড়া বাংলার এই যুগের শিল্পবিবর্ত্তনের ইতিহাস জানিবার আর কোনো উপায় নাই। কিন্তু এই সাধারণ রীতিগুলি যথাযথভাবে স্থির করা সহজ নহে, এবং অনেক সময়ে শিল্পীর ব্যক্তিত্ব ও অন্য অনেক বিশিষ্ট কারণে সাধারণ রীতির ব্যতিক্রম বা বিপর্যয় ঘটে। সুতরাং কেবলমাত্র এই রীতি অবলম্বনে রচিত বিবর্ত্তনের ইতিহাস সৰ্ব্বথা নির্ভরযোগ্য নহে। বাংলার শিল্প সম্বন্ধে এইরূপ ইতিহাস রচনার চেষ্টা খুব বেশি হয় নাই। যে দুই-একজন করিয়াছেন তাহাদের মতামত খুব স্পষ্ট নহে এবং সর্ব্বসাধারণে গৃহীত হয় নাই।
রচনাবিন্যাস, গঠনপ্রণালী ও সৌন্দৰ্য্য বিকাশের দিক দিয়া বিচার করিলে এই সমুদয় মূর্ত্তির মধ্যে অনেক শ্রেণীভেদ করা যায়। কিন্তু এই সমুদয় প্রভেদ কতটা স্থান বা কালের প্রভাবে এবং কতটা শিল্পীর ব্যক্তিগত রুচি বা অন্য কোনো কারণে ঘটিয়াছে তাহা নির্ণয় করা কঠিন। এই সমুদয় কারণে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত সম্ভব না হইলেও বাংলার এ যুগের ইতিহাস আলোচনা করিতে গিয়া অনেকেই শিল্প বিবর্ত্তনের দুই-একটি মূলসূত্র অবলম্বন করিয়াছেন। বিবর্ত্তনের দিক দিয়া মূল্য খুব বেশী না হইলেও বিশ্লেষণের দিক হইতে এইগুলি ইতিহাস আলোচনায় প্রয়োজনীয় সন্দেহ নাই।
সাধারণত মূৰ্ত্তিগুলি একটি বড় প্রস্তরখণ্ডের মধ্যস্থল হইতে কাটিয়া বাহির করা হয়। মূল মূর্ত্তিটি কেন্দ্রস্থলে এবং পারিপার্শ্বিক মূৰ্ত্তিগুলি ও বিভূষণাদি এবং চালচিত্র ইহার দুই পার্শ্বে ও উপরে থাকে। প্রথমে মূৰ্ত্তিগুলির গভীরতার এক অৰ্দ্ধ মাত্র পাষাণের উপর উত্তীর্ণ হইত, কিন্তু ক্রমেই এই গভীরতার মাত্রা বৃদ্ধি হয়। পরিশেষে মূল মূর্ত্তিটি প্রায় সম্পূর্ণ আকার লাভ করে এবং এই উদ্দেশ্যে ইহার চতুম্পার্শ্বস্থ পাথর কতকটা একেবারে কাটিয়া ফেলিয়া দেওয়া হয়। আবার প্রথম প্রথম মূল মূর্ত্তিটিই শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য থাকে ও দর্শকের প্রায় সমগ্র মনোযোগ আকৃষ্ট করে। ক্রমশ পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তিগুলি ও নানাবিধ কারুকার্যে বিভূষিত চালচিত্র অধিকতর প্রাধান্য লাভ করে এবং সুদক্ষ শিল্পীর হস্তে মূল মূর্ত্তির শোভাবর্দ্ধন করে। কিন্তু সর্বশেষ কোনো কোনো স্থলে এইসব পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তি ও অলঙ্কারের প্ৰাচুৰ্য্য এত বৃদ্ধি পায় যে মূল মূর্ত্তিটিই অপ্রধান হইয়া পড়ে। অনেকেই মনে করেন যে এই দুইটি পরিবর্ত্তনই খুব সম্ভব প্রধানত কালপ্রবাহের ফলে ঘটিয়াছে; অর্থাৎ উত্তীর্ণ মূৰ্ত্তির অতিরিক্ত গভীরতা এবং পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তি ও চালচিত্রে অলঙ্কারের অতিরিক্ত ও অযথা বাহুল্য শিল্পীর অপেক্ষাকৃত অপ্রাচীনতার প্রমাণ। কিন্তু ইহা যে একটি সাধারণ সূত্র হিসেবে গ্রহণ করা যায় না, রাজা গোবিন্দচন্দ্রের নামাঙ্কিত লিপিযুদ্ধ বিষ্ণু ও সূৰ্য্যমূৰ্ত্তির সহিত রাজা তৃতীয় গোপালের চতুর্দ্দশ বৎসরে উত্তীর্ণ সদাশিব-মূৰ্ত্তির তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে।
একজন প্রসিদ্ধ শিল্পসমালোচক বাংলার এই যুগের শিল্প-বিবর্ত্তন সম্বন্ধে আলোচনা করিয়া ভিন্ন ভিন্ন শতাব্দের শিল্পের লক্ষণ বা বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করিয়াছেন। তাঁহার মতে নবম শতাব্দে দেহের কমনীয়তা, সুডৌল গঠন ও শান্ত সমাহিত মুখশ্রী; দশমে শক্তিব্যঞ্জক দৃঢ় বলিষ্ঠ দেহ; একাদশে ক্ষীণ তনু, সুকোমল ভাবপ্রবণতা, মুখমণ্ডলের অপার্থিব দিব্যভাব ও দেহের ঊৰ্দ্ধভাগের লাবণ্য ও সুষমা; এবং দ্বাদশে ভাবব্যঞ্জনাহীন মুখশ্রী, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কৃত্রিম আড়ষ্টতা ও বসন ভূষণের প্রাচুর্য্য;-ইহাই এই চারি যুগের বাংলার শিল্পের প্রধান লক্ষণ। নিছক শিল্পের হিসাবে বাংলার মূর্ত্তিগুলিকে মোটামুটি এইরূপভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা সম্ভবপর, কিন্তু এই চারিটি শ্রেণী যে পর পর চারিটি শব্দের প্রতীক, এই মত গ্রহণ করা কঠিন। পূর্ব্বোক্ত গোবিন্দচন্দ্র ও তৃতীয় গোপালের সময়কার মূর্ত্তির তুলনা করিলেই তাহা বুঝা যাইবে। প্রথম মহীপাল ও গোবিন্দচন্দ্র সমসাময়িক। কিন্তু এই দুই রাজার নামাঙ্কিত লিপিযুক্ত দুইটি বিষ্ণুমূর্ত্তি উপরি-উক্ত শ্রেণীবিভাগে এক পর্যায়ে পড়ে না।
কালানুযায়ী বিশ্লেষণ সম্ভবপর না হইলেও, পালযুগের শিল্প সম্বন্ধে সাধারণভাবে কয়েকটি সিদ্ধান্ত করা যায়। শিল্পীগণ পাথরের বা ধাতুর উপর খোদাই করিতে যে অসাধারণ দক্ষতা লাভ করিয়াছিল, তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। লতা, পাতা, জীব, জন্তু ও নানারূপ নকশার কাজ অনেক মূর্ত্তিতে এমন নিপুণ ও সূক্ষ্মভাবে সম্পাদিত হইয়াছে যে, বহুবর্ষব্যাপী শিক্ষা ও সাধনা এবং পুরুষানুক্রমিক অভ্যাস ব্যতীত ইহা কদাচ সম্ভবপর হইত না। এই যুগের মূৰ্ত্তিগুলি যত্নপূৰ্ব্বক পরীক্ষা করিলে বাংলার লুপ্ত চারুশিল্প সম্বন্ধে একটি স্পষ্ট ধারণা করা যায় এবং বাংলা দেশে যে অন্তত পাঁচ-ছয়শত বৎসর একটি জীবন্ত ও উচ্চাঙ্গের শিল্পধারা অব্যাহতভাবে প্রবাহিত ছিল, ইহাতে কোনো সন্দেহ থাকে না।
মনুষ্যমূর্ত্তিগঠনই ভাস্কৰ্য্যশিল্পের উৎকর্ষের সর্বশ্রেষ্ট পরিচয় ও প্রমাণ। বাংলার শিল্পী এ বিষয়ে কতটা সফলতা লাভ করিয়াছিল, তাঁহার বিচার করিতে হইলে বাংলার দেব-দেবীমূৰ্ত্তিই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। ধর্ম্মপ্রাণ ব্যক্তির নিকট দেব-দেবীর মূৰ্ত্তি মাত্রেই সুন্দর। রাধাকৃষ্ণের নামসম্বলিত কবিতা ও সংগীত মাত্রেই যেমন একশ্রেণীর লোককে মুগ্ধ করে, দেব-দেবীর যেকোনো চিত্র বা মূৰ্ত্তিই তেমনি অনেকের নিকট অপূর্ব্ব সৌন্দর্য্যের আকর বলিয়া প্রতীয়মান হয়; এমনকি কালীঘাটের পটের ছবিও কেহ কেহ উচ্ছ্বসিত ভাষায় বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু ইহা ভক্তের দৃষ্টি, শিল্পের অনুভূতি নহে। শিল্পের প্রকৃত বিচার করিতে হইলে, তাহা কেবল ভাব ও সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তির দিক দিয়াই করিতে হইবে। দেব-দেবীর মূর্ত্তিই যে আমাদের অতীত ভাস্কৰ্য্যশিল্পের একমাত্র নিদর্শন, ইহা এই শিল্পের প্রকৃত ইতিহাস জানিবার একটি অন্তরায়। কিন্তু এই অন্তরায় অগ্রাহ্য বা অস্বীকার না করিয়া ইহার সাহায্যেই যত দূর সম্ভব শিল্পের পরিচয় দিতে হইবে। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও দেব-দেবীর মূর্ত্তির মধ্য দিয়েই শিল্পের বিকাশ হইয়াছে। প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপীয় শিল্পীগণও দেব-দেবীর মূৰ্ত্তির মধ্য দিয়াই অনবদ্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করিয়া জগতে অমরত্ব লাভ করিয়াছেন। প্রাচীনযুগের ‘ভেনাস ডি মিলো এবং মধ্যযুগের র্যাফেল ও টিসিয়ান অঙ্কিত ম্যাডোনা ও ভেনাসের মূর্ত্তি দেবীরূপে কল্পিত হইলেও, ভাব ও সৌন্দর্য্যের অভিব্যক্তির জন্যই ইহা শিল্পজগতে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করিয়াছে।
সারনাথে গুপ্তযুগের যে সমুদয় মূর্ত্তি আছে, পালযুগের শিল্পে তাঁহার প্রভাব দেখা যায়। কিন্তু এ দুয়ের মধ্যে অনেক গুরুতর প্রভেদ আছে। প্রথমত, গুপ্তযুগের সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভঙ্গীর পরিবর্তে বাংলার মূর্ত্তিগুলির কতকটা আড়ষ্টভাব ও জড়তা বিশেষভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। দ্বিতীয়ত, গুপ্তযুগের মূর্ত্তিতে একটি আত্মনিহিত অতীন্দ্রিয় ভাবের অভিব্যক্তিই শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য, দেহের সুষমা ও লাবণ্য অপ্রধান ও এই ভাবেরই দ্যোতক মাত্র। বাংলার মূর্ত্তিগুলিতে এই আধ্যাত্মিক ভাব অপেক্ষা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য আনন্দ ও ভোগের ছবিই যেন বেশী করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে। একের আদর্শ শান্ত-সমাহিত অন্তদৃষ্টি, অন্যের আদর্শ কান্ত ও কমনীয় বাহ্য রূপ। বাংলার মূর্ত্তিতে যে আধ্যাত্মিক ভাবের বিকাশ নাই তাহা নহে, কিন্তু তাঁহার প্রকাশভঙ্গীতে সাধারণত অন্তরের সংযম অপেক্ষা ভাবপ্রবণতার উচ্ছ্বাসই বেশী বলিয়া মনে হয়। তবে পালযুগের শ্রেষ্ঠ মূর্ত্তিগুলিতে এই দুই আদর্শের সমন্বয় দেখিতে পাওয়া যায়। এই মূর্ত্তিগুলি “কোমল অথচ সংযত, ভাবপ্রবণ অথচ ধ্যানস্থ, লীলায়িত অথচ দৃঢ়প্রতিষ্ঠ।” বাংলার শিল্প গুপ্তযুগের শিল্পের অপেক্ষা নিকৃষ্ট হইলেও, সমসাময়িক পশ্চিম, মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের শিল্প অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কারণ এই সমুদয় শিল্পে সাধারণত গুপ্তযুগের আধ্যাত্মিক ভাব এবং পালযুগের সৌন্দর্য্য ও লাবণ্য উভয়েরই অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে মধ্যযুগের এই মূর্ত্তিগুলি প্রাণহীন ও অসুন্দর, এবং ধর্ম্মমত ও ধৰ্ম্মানুষ্ঠানের পাষাণময় রূপ ব্যতীত শিল্প হিসাবে ইহার বিশেষ কোনো সার্থকতা নাই। অবশ্য কদাচিৎ এই সমুদয় অঞ্চলেও সুন্দর মূর্ত্তি দেখা যায়,-দৃষ্টান্ত স্বরূপ এলিফান্টা দ্বীপের মূর্ত্তিগুলির উল্লেখ করা যাইতে পারে। কিন্তু সাধারণত এই সমুদয় দেশে মধ্যযুগের মূর্ত্তিগুলি শ্রীহীন। কেবল বিহারে ও উড়িষ্যায় বাংলার ন্যায় সৌন্দর্য্যের আদর্শ শিল্পে বর্ত্তমান দেখা যায়। বাংলার পালযুগের শিল্পের প্রভাব এই দুই প্রদেশে এমনকি যবদ্বীপ ও পূৰ্ব্ব ও ভারতীয় অন্যান্য দ্বীপপুঞ্জে বিস্তৃত হইয়াছিল।
এ পর্য্যন্ত যে সমুদয় আলোচনা করা হইয়াছে তাহা এই যুগের শিল্প সম্বন্ধে সাধারণভাবে প্রযোজ্য। কোনো কোনো মূর্ত্তিতে যে ইহার ব্যতিক্রম দেখা যাইবে তাহা বলাই বাহুল্য, কারণ কোনো দেশের অথবা কোনো যুগের শিল্পই কয়েকটি সাধারণ নিয়মের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। পালযুগের শিল্প সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করিতে হইলে এই যুগের মূর্ত্তির সহিত ঘনিষ্ঠ পরিচয় আবশ্যক। বর্ত্তমান গ্রন্থে মূর্ত্তিগুলির বিস্তৃত বিবরণ বা আলোচনা সম্ভবপর নহে বলিয়াই আমরা সংক্ষেপে এই যুগের শিল্পের গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সাধারণ মন্তব্য করিয়াছি। এই সকল মন্তব্য বিশদ ও পরিস্ফুট করিবার জন্য কয়েকটি মূর্ত্তির উল্লেখ করিতেছি।
শিল্পের দিক দিয়া দেখিতে গেলে বিষ্ণু ও তাঁহার পারিপার্শ্বিক দেব-দেবীর মূৰ্ত্তিগুলিই প্রাধান্য লাভ করে। শিয়ালদির বিষ্ণুমূর্ত্তির মুখে শিল্পী বেশ একটু নূতনত্ব ও বৈশিষ্ট্য ফুটাইয়াছেন। বিষ্ণুর উপরের দুই হস্তের অঙ্গুলির বক্রভাব কোমলতা ও কমনীয়তার সূচক, যদিও চক্র ও গদা এই দুই সংহারকারী অস্ত্র ধরিবার সহিত তাঁহার সামঞ্জস্য নাই। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, দুই স্তম্ভের ন্যায় সমান্তরাল পদযুগলের উপর দণ্ডায়মান সরল রেখার ন্যায় দেহগঠন শিল্পীর কৌশলের অভাব নহে, কঠোর নিয়মানুবর্তিতাই সূচিত করে। পার্শ্বচারিণী দুইজনের বঙ্কিম দেহভঙ্গী হইতেও ইহা প্রমাণিত হয়। এই দুই পার্শ্বচারিণীর মূৰ্ত্তি লাবণ্য ও সুষমার সহিত গাম্ভীৰ্য্য ও ভক্তির সংমিশ্রণে অপরূপ শোভা ধারণ করিয়াছে। বজ্রযোগিনীর মৎস্যাবতার মূর্ত্তিতে (চিত্র নং ২০) বিষ্ণুর মুখের কমনীয় কান্তি, অধর-যুগলের হাসিরেখা ও দেহের সুডৌল গঠন এমন কৌশলে সম্পাদিত হইয়াছে যে, বিষ্ণুর অধোভাগ মৎস্যের আকার হইলেও এই অসঙ্গতি শিল্পের সৌন্দর্য্যের হানি করে নাই। বাঘাউরার প্রস্তরনির্ম্মিত (চিত্র নং ১৮) এবং সাগরদীঘি, রঙ্গপুর ও বগুড়ার ধাতুনির্ম্মিত বিষ্ণুমূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২১ ঘ, ১৯) উচ্চশ্রেণীর শিল্পকলার নিদর্শন। মূর্ত্তিগুলির কৃত্রিম দাঁড়াইবার ভঙ্গীর সহিত পার্শ্বচারিণীগণের সহজ সাবলীল ভাব বিশেষভাবে তুলনীয়। দেওরা ও বাণগড়ের বিষ্ণুমূর্ত্তিও উচ্চাঙ্গের শিল্পকলার নিদর্শন। মুর্শিবাবাদ জিলার অন্তর্গত ঝিল্লির বরাহ অবতারের মূৰ্ত্তিও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মূৰ্ত্তির মুখ বরাহের হইলেও, মনুষ্যাকৃতি অধোভাগে শিল্পী অনবদ্য সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিয়াছেন। বিক্রমপুর ও বীরভূমের অন্তর্গত পাইকোরে প্রাপ্ত দুইটি নরসিংহমূৰ্ত্তিও কেবলমাত্র দেহসৌষ্ঠবে উচ্চশ্রেণীর শিল্পে পরিণত হইয়াছে।
বাঘরার বলরামমূর্ত্তির মুখে শিল্পী একটি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্যের ছাপ দিয়াছেন। ইহার সরল অনাড়ম্বর পশ্চাদপটে মূল মূর্ত্তি এবং তাঁহার পার্শ্বচারিণী ও বাহনের মূর্ত্তি কয়টির সৌন্দৰ্য্য উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে। ছাতিন গ্রামের সরস্বতী মূৰ্ত্তির (চিত্র নং ২৩) অঙ্গসৌষ্ঠব, বসিবার ভঙ্গী ও অপূৰ্ব্ব মুখশ্রী, এবং তাঁহার পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তি ও বিভূষণাদি উচ্চশ্রেণীর শিল্পের পরিচায়ক। নাগইল ও বিক্রমপুরে প্রাপ্ত দুইটি এবং কলিকাতা যাদুঘরে রক্ষিত (চিত্র নং ২৭ গ) গরুড়মূৰ্ত্তিতে শিল্পী যে দাস্য ও ভক্তির মাধুৰ্য্য প্রকটিত করিয়াছেন, তাহা যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচায়ক।
শিবমূৰ্ত্তির মধ্যে শঙ্করবাঁধার নটরাজ শিবের মূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২২ গ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শিবের তাণ্ডবনৃত্যের সহিত উর্দ্ধমুখ বৃষেরা উচ্ছ্বসিত নৃত্য শিল্পীর অপূৰ্ব্ব সৃজনশক্তির পরিচায়ক। নৃত্যের গতিভঙ্গী ও উদ্দামতা এই মূর্ত্তির মধ্য দিয়া অপরূপ রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। বরিশালে প্রাপ্ত ব্রঞ্জের শিবমূৰ্ত্তিতে (চিত্র নং ২৮ খ) শিল্পী একটি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটাইয়া তুলিয়াছেন এবং ধাতুমূৰ্ত্তির নিৰ্মাণকৌশল কত দূর উন্নতি লাভ করিয়াছিল, তাঁহার যথেষ্ট পরিচয় দিয়াছেন। গণেশপুরে প্রস্ফুটিত পদ্মের স্বাভাবিক আকৃতিতে শিল্পী সূক্ষ্ম সৌন্দৰ্যানুভূতি ও স্বাতন্ত্রের পরিচয় দিয়াছেন। বাংলায় চলিত কথায় কার্তিকই সৌন্দর্য্যের আদর্শ। উত্তরবঙ্গে প্রাপ্ত একটি ময়ূরবাহন কার্তিকে (চিত্র নং ২১ ক) শিল্পী এই সৌন্দর্যের পরিচয় দিয়াছেন। শেষোক্ত দুইটি মূৰ্ত্তিতেই অলঙ্কারের বাহুল্য দেখা যায়। শিল্পীর কৌশলে ইহা মূৰ্ত্তিদ্বয়ের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করিয়াছে, কিন্তু নিকৃষ্ট শিল্পীর হস্তে এইরূপ প্রাচুর্যে সৌন্দর্য্যের হানি হয়।
ঈশ্বরীপুরীর গঙ্গামূৰ্ত্তি বাংলার এই যুগের শিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ইহার স্বাভাবিক লীলায়িত পদক্ষেপ ও বিশিষ্ট মুখশ্রী, এবং পার্শ্বচর মূর্ত্তি দুইটির সুন্দর সরল দেহভঙ্গী সমগ্র মূর্ত্তিটিকে অপরূপ সুষমা প্রদান করিয়াছে।
রাজসাহীর ইন্দ্রাণী (চিত্র নং ২২খ), বিক্রমপুরের মহাপতিসরা (চিত্র নং ২১ গ) এবং খালিকৈরের বৌদ্ধ তারাও (চিত্র নং ১৩ ক) এই শ্রেণীর সুন্দর মূর্ত্তি। কঠিন পাথরের মধ্য দিয়ে রক্তমাংসের দেহের কমনীয়তা ও নমনীয়তা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
বাংলায় অনেকগুলি সূর্যমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যে কয়েকখানিতে উচ্চাঙ্গ ও বিশিষ্ট শিল্পজ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। যাত্রাপুরের সূর্যের মুখশ্রী (চিত্র নং ১৬ ক) এবং কোটালিপাড়া (চিত্র নং ১৭) ও চন্দ্রগ্রামের (চিত্র নং ১৬ খ) সূৰ্য্যমূর্ত্তির রচনা-বিন্যাস ও শান্ত-সমাহিত ভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বিহারৈলের বুদ্ধমূর্ত্তিতে বাংলার যে শিল্পধারার সূচনা দেখা যায়, পালযুগে তাঁহার কিরূপ বিকাশ হইয়াছিল, ঝেওয়ারিতে প্রাপ্ত বুদ্ধমূর্ত্তি (চিত্র নং ২৪) তাঁহার উৎকৃষ্ট নিদর্শন। কিন্তু, সম্ভবত ব্ৰহ্মদেশের প্রভাবে, বুদ্ধমূর্ত্তির পরিকল্পনা কিরূপ পরিবর্তিত হইয়াছিল, ঝেওয়ারির আর একটি বুদ্ধমূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২৫) হইতে তাহা জানা যায়। প্রাচীন মগধের শিল্পধারার সহিত বাংলার শিল্পী কিরূপ সুপরিচিত ছিল, শিববাটির বুদ্ধমূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২৭ খ) তাঁহার চমৎকার দৃষ্টান্ত। বুদ্ধ শান্ত সমাহিতভাবে মন্দির-মধ্যে ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট এবং তাঁহার চতুস্পার্শ্বে তাঁহার জীবনের প্রধান প্রধান ঘটনাবলী পৃথক পৃথক ক্ষুদ্র আকারে উৎকীর্ণ। গুপ্তযুগের সারনাথ শিল্পের প্রভাবে অনুপ্রাণিত হইলেও এইরূপ রচনাপ্রণালী মগধ ও বঙ্গের একটি বিশিষ্ট শিল্পকৌশল বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য।
কিন্তু কোনো কোনো বুদ্ধমূৰ্ত্তিতে এই সমুদয় বিদেশীয় প্রভাব বর্ত্তমান থাকিলেও বাংলার শিল্পী অনেক সময়ই বাংলার নিজস্ব শিল্পধারা অব্যাহত রাখিয়া সুন্দর বুদ্ধমূৰ্ত্তি গড়িয়াছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ কলিকাতা যাদুঘরে রক্ষিত অবলোকিতেশ্বর (চিত্র নং ২১ খ) এবং ময়নামতীতে প্রাপ্ত মঞ্জুর বোধিসত্ত্বের (চিত্র নং ১৪) উল্লেখ করা যাইতে পারে। পূর্ব্বোক্ত খালিকৈরের তারামূৰ্ত্তির (চিত্র নং ১৩ ক) ন্যায় এই দুইখানির অনবদ্য মুখশ্রী, সাবলীল দেহভঙ্গী ও রচনাবিন্যাস উৎকৃষ্ট শিল্পের নিদর্শন।
.
৩. চিত্রশিল্প
পালযুগের পূর্ব্বেকার কোনো চিত্র অদ্যাবধি বাংলায় আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু খুব প্রাচীনকাল হইতেই যে এদেশে চিত্রাঙ্কনের চর্চ্চা ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। ফাহিয়ান তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারে অবস্থানকালে বৌদ্ধমূর্ত্তির ছবি আঁকতেন। সুতরাং তখন তাম্রলিপ্তিতে যে চিত্রশিল্প পুরাতন ও সুপরিচিত ছিল, এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
সাধারণ মন্দির ও বৌদ্ধবিহার প্রভৃতির প্রাচীরগাত্র চিত্র দ্বারা শোভিত হইত। পরবর্ত্তীকালের শিল্পশাস্ত্রে স্পষ্ট এইরূপ অনুশাসন আছে এবং ভারতের অনেক স্থানে ইহার চিহ্ন এখনো বর্ত্তমান আছে। বাংলার অনেক মন্দির ও বিহারে সম্ভবত বহু চিত্র ছিল, মন্দির ও বিহারের সঙ্গেই তাহা ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে।
একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দে লিখিত কয়েকখানি বৌদ্ধ গ্রহের পুঁথিতে অঙ্কিত বজ্রযান-তন্ত্রযান মতোক্ত দেব-দেবীর ছবি ব্যতীত প্রাচীন বাংলার আর কোনো ছবি এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। ইহার মধ্যে রামপালের রাজত্বের ৩৯শ বর্ষে ও হরিবর্ম্মার ১৯শ বর্ষে লিখিত দুইখানি অষ্টসাহস্রিকা-এবং হরিবর্ম্মার ৮ম বর্ষে লিখিত একখানি পঞ্চবিংশতিসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথি বাংলার প্রাচীন চিত্রবিদ্যা আলোচনার প্রধান অবলম্বন।
রেখাবিন্যাস ও বর্ণসমাবেশ এই দুয়ের উপরই চিত্রশিল্পের প্রতিষ্ঠা এবং এ দুয়ের প্রাধান্য অনুসারেই চিত্রের দুইটি প্রধান শ্রেণীবিভাগ কল্পিত হইয়াছে। অজন্তা ও এলোরার চিত্রশিল্পে এই দুই শ্রেণীরই চিত্র দেখা যায়, এবং পরবর্ত্তীকালে ভারতের সর্বত্রই ইহার প্রভার পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিম ভারতবর্ষের চিত্রে রেখাবিন্যাসই প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, কিন্তু বাংলার চিত্রে বর্ণসমাবেশ ও রেখাবিন্যাস উভয়েরই প্রভাব পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। পশ্চিম ভারতের চিত্রের সহিত তুলনা করিলে ইহাও বুঝা যায় যে, বাংলার শিল্পী রেখাবিন্যাসে অধিকতর দক্ষতা দেখাইয়াছেন এবং ইহার সাহায্যে যে সৌন্দর্য্য ও মাধুর্যের অবতারণা করিয়াছেন, পশ্চিম ভারতের চিত্রে তাহা দুর্লভ। বাংলার এই চিত্রশিল্পের প্রভাব আসাম, নেপাল ও ব্রহ্মদেশে বিস্তৃত হইয়াছিল।
পরিকল্পনার দিক দিয়া বাংলার চিত্র ও প্রস্তরে উত্তীর্ণ মূর্ত্তির মধ্যে প্রভেদ বড় বেশী নাই। উভয়েরই বিষয়বস্তু ও রচনাপদ্ধতি, এমনকি ভঙ্গী ও অঙ্গসৌষ্ঠব, প্রায় একই প্রকারের। কেন্দ্রস্থলে মূল দেব-দেবী, এবং দুই পার্শ্বে আনুষঙ্গিক মূর্ত্তিগুলি ও কদাচিৎ অলঙ্কাররূপে ব্যবহৃত দৃশ্যাবলী। কেবল দুই-এক স্থলে মূল মূর্ত্তিটি এক পার্শ্বে উপবিষ্ট। এইসব চিত্রে প্রায় এক অর্ধে কেবল মূল মূর্ত্তিটি এবং অপর অর্ধে অন্য সব পারিপার্শ্বিক মূর্ত্তিগুলির সমাবেশ করিয়া মূল মূর্ত্তির প্রাধান্য সূচিত হইয়াছে।
রাজা রামপালের রাজত্বের ৩৯শ বর্ষে লিখিত অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতার পুঁথিখানিতে যে কয়েকটি ছবি আছে, তাহা বাংলার চিত্রশিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে। সাধারণ কয়েকটি বর্ণ এবং সূক্ষ্ম রেখাপাতের সাহায্যে শিল্পী এই সমুদয় চিত্রের মধ্যে একটি লীলায়িত মাধুৰ্য্য ও অনবদ্য সৌন্দর্য্যের সৃষ্টি করিয়া মধ্যযুগের শিল্পজগতে উচ্চস্থান অধিকারের যোগ্যতা অর্জন করিয়াছেন। বাংলার চিত্রশিল্পের নমুনা মুষ্টিমেয় হইলেও, ইহা যে স্বর্ণমুষ্টি তাহা নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে।
কেবলমাত্র রেখার সাহায্যে চিত্র-অঙ্কনে বাংলার শিল্পী কত দূর পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন, সুন্দরবনে প্রাপ্ত ডোম্মনপালের তাম্রশাসনের অপর পৃষ্ঠে উৎকীর্ণ বিষ্ণুর রেখাচিত্র তাঁহার দৃষ্টান্ত। প্রাচীন বাংলার তাম্রপটে উৎকীর্ণ এইরূপ আরও দুইটি রেখাচিত্র পাওয়া গিয়াছে।
.
৪. বাংলার শিল্পী
বাংলার শিল্পীগণের সম্বন্ধে আমরা বিশেষ কিছুই জানি না। তিব্বতীয় লামা তারনাথ লিখিয়াছেন যে, ধীমান ও তাঁহার পুত্র বিৎপালো প্রস্তর ও ধাতুর মূর্ত্তিগঠন এবং চিত্রাঙ্কনে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এবং তাঁহাদের শিষ্য-প্রশিষ্যগণ একটি স্বতন্ত্র শিল্পী সম্প্রদায় গঠন করিয়াছিলেন। এই শিল্পীদ্বয়ের নির্ম্মিত কোনো মূৰ্ত্তি বা তাঁহাদের সম্বন্ধে অন্য কোনো বিবরণ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু বাংলায় যে শিল্পীসংঘ ছিল, বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তিতে তাঁহার উল্লেখ আছে। ইহার ৩২টি অতিবৃহৎ পংক্তির অক্ষরগুলি যেরূপ সুন্দরভাবে পাথরে খোদিত হইয়াছে, তাহা উৎকৃষ্ট শিল্পকাৰ্য্য বলিয়া গণ্য করা যায়। যে শিল্পী ইহা উত্তীর্ণ করিয়াছিলেন, প্রশস্তির শেষ শ্লোকে তাঁহার পরিচয় আছে। তিনি ধর্ম্মের প্রপৌত্র, মনদাসের পৌত্র, বৃহস্পতিবার পুত্র, বরেন্দ্রের শিল্পীগোষ্ঠী-চূড়ামণি রাণক শূলপাণি। ইহা ইহতে অনুমিত হয় যে, বরেন্দ্রে (এবং সম্ভবত বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে) একটি শিল্পীসংঘ ছিল এবং শূলপাণি এই সংঘের প্রধান ছিলেন। রাণক এই উপাধি হইতে মনে হয় যে, তিনি রাজ্যের একজন সম্ভ্রান্ত লোক ছিলেন। কিন্তু ভট্টভবদেবের প্রায়শ্চিত্ত-প্রকরণ’ গ্রন্থ অনুসারে নৰ্ত্তক, তক্ষক, চিত্রোপজীবী, শিল্পী, রঙ্গোপজীবী, স্বর্ণকার ও কর্ম্মকার সমাজে হেয় বলিয়া পরিগণিত হইতেন, এবং কোনো ব্রাহ্মণ এই সমুদয় বৃত্তি অবলম্বন করিলে তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। শূলপাণি সম্ভবত বংশানুক্রমে শিল্পীর কাৰ্য্য করিতেন। প্রস্তরে অক্ষর উত্তীর্ণ করাও যে প্রকৃত শিল্পীরই কাৰ্য্য ছিল, সিলিমপুরের প্রস্তরলিপির একটি শ্লোকে তাঁহার উল্লেখ আছে। এই লিপির উপসংহারে উক্ত হইয়াছে যে, প্রণয়ী যেমন তন্মনা হই বর্ণবিন্যাসে নিজের প্রণয়িনীর চিত্র অঙ্কিত করেন, শিল্পবিৎ সোমেশ্বর তেমনি এই প্রশস্তি লিখিয়াছিলেন। এই একটি সংক্ষিপ্ত বাক্যে শিল্পের প্রকৃতি ও অন্তর্নিহিত ভাবটি অতি সুন্দরভাবে ব্যক্ত হইয়াছে। গভীর অনুরাগ ও আসক্তিই যে শিল্পের প্রেরণা তাহা বাংলার শিল্পীগণ জানিতেন। বাংলার শিলালিপি ও তাম্রশাসন হইতে আমরা আরও কয়েকজন এইরূপ শিল্পীর নাম পাই যথা :
(১) ভোগটের পৌত্র, সুভটের পুত্র তাতট
(২-৩) সৎ-সমতট নিবাসী শুভ্রদাসের পুত্র মঙ্খদাস, ও তৎপুত্র বিমলদাস
(৪) সূত্রধর বিষ্ণুদ্র
(৫-৬) বিক্রমাদিত্য-পুত্র শিল্পী মহীধর ও তৎপুত্র শিল্পী শশীদেব
(৭) শিল্পী কর্ণভদ্র
(৮) শিল্পী তথাগতসার।
ইঁহাদের কয়েকজন স্পষ্টত শিল্পী উপাধিতে ভূষিত হইয়াছেন। মোটের উপর এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে, উল্লিখিত আটজন এবং শূলপাণি ও সোমেশ্বর প্রভৃতি যে কেবল প্রস্তর ও তাম্রপটে অক্ষর উৎকীর্ণ করিতেন তাহা নহে-তাহারা উচ্চশ্রেণীর শিল্পী ছিলেন এবং ধাতু ও প্রস্তরের মূর্ত্তি প্রভৃতিও গঠন করিতেন।
প্রস্তর ও ধাতুর মূৰ্ত্তিনির্মাণ ব্যয়সাপেক্ষ। সুতরাং অর্থশালী লোকই এই সমুদয় প্রতিষ্ঠা করিতেন। শিল্পীগণও এই সম্প্রদায়ের আদেশে এবং শাস্ত্রানুশাসন ও লোকাঁচারের নির্দেশমতো মূর্ত্তি প্রস্তুত করিতেন। ইহাতে তাহাদের শিল্পরচনার শক্তি ও স্বাধীনতা যে অনেক পরিমাণে খৰ্ব্ব হইত, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। বিশেষত এই শিল্পীগণ যাঁহাদের অনুগ্রহে জীবিকা নির্বাহ করিতেন, শিল্পের সৌন্দৰ্যবোধ অপেক্ষা ধর্ম্মনিষ্ঠাই ছিল তাঁহাদের মনে অধিকতর প্রবল; সুতরাং বাংলার এই শিল্পীগণের পরিস্থিতি প্রকৃত শিল্পের উৎকর্ষের অনুকূল ছিল না। ইহা সত্ত্বেও তাহারা যে সূক্ষ্ম সৌন্দৰ্যবোধ ও দক্ষতার পরিচয় দিয়াছেন তাহাতে প্রমাণিত হয় যে, তাঁহাদের মধ্যে শিল্পের একটি সহজ ও স্বাভাবিক অনুভূতি ছিল। ধনী ও অভিজাতবর্গের অনুগ্রহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপুষ্ট এই সমুদয় শিল্পীর রচনা সমাজের উচ্চশ্রেণীর মনোরঞ্জন ও প্রয়োজনের অনুকূল হইত। লোকশিল্পের যে দৃষ্টান্ত পাহাড়পুর, ময়নামতী, মহাস্থান প্রভৃতি স্থানে পাওয়া যায়, পরবর্ত্তী যুগেও হয়তো তাহা ছিল, কিন্তু এযাবৎ তাঁহার কোনো পরিচয় পাওয়া যায় নাই।