অষ্টম পরিচ্ছেদ –দ্বিতীয় পালসাম্রাজ্য
১. মহীপাল
দশম শতাব্দের শেষভাগে যখন পালরাজবংশ দুর্দশা ও অবনতির চরম সীমায় পৌঁছিয়াছিল তখন দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন (আ ৯৮৮)। তাঁহার অর্দ্ধশতাব্দীব্যাপী রাজ্যকালে পালরাজবংশের সৌভাগ্যরবি আবার উদিত হইয়াছিল। তিনি বাংলায় বিলুপ্ত পিতৃরাজ্য উদ্ধার ও পুনরায় পালসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়া যে অতুল কীৰ্ত্তি অর্জন করিয়াছেন তাহা ইতিহাসে তাঁহাকে চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিয়াছে। বাংলা দেশ ধর্ম্মপাল ও দেবপালের নাম ভুলিয়া গিয়াছে কিন্তু ‘ধান ভানতে মহীপালের গীত’ প্রভৃতি লৌকিক প্রবাদ, দিনাজপুরের মহীপালদীঘি এবং মহীপাল, মহীপুর, মহীসন্তোষ প্রভৃতি স্থান আজিও মহীপালের স্মৃতি রক্ষা করিয়া আসিতেছে।
কুমিল্লা নিকটবর্ত্তী বাঘাউড়া ও নারায়ণপুর গ্রামে একটি বিষ্ণু ও একটি গণেশ মূর্ত্তির পাদপীঠে যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ সংবৎসরে উত্তীর্ণ মহীপালের দুইখানি লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে সিংহাসনে আরোহণের ২-৩ বৎসরের মধ্যেই তিনি পূর্ব্ববঙ্গ পুনরাধিকার করিয়াছিলেন। উত্তর অথবা পশ্চিমবঙ্গ জয় না করিয়া তিনি পূৰ্ব্ববঙ্গে যাইতে পারেন নাই। তাঁহার রাজত্বের নবম বৎসরে উত্তীর্ণ বাণগড় লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে উত্তরবঙ্গ তাঁহার অধীন ছিল। সুতরাং রাজ্যারম্ভেই তিনি উত্তর ও পূৰ্ব্ববঙ্গ জয় করেন এই সিদ্ধান্ত অনায়াসে করা যাইতে পারে। বাণগড় লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে মহীপাল ‘রণক্ষেত্রে বাহুদর্পপ্রকাশে সকল বিপক্ষ পক্ষ নিহত করিয়া অনধিকারী কর্ত্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করিয়া, রাজগণের মস্তকে চরণপদ্ম সংস্থাপিত করিয়া, অবনিপাল হইয়াছিলেন।’ সভাকবির এই উক্তি যে ঐতিহাসিক সত্য সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কারণ নাই।
কিন্তু সমগ্র বাংলা দেশ জয় করিবার পূর্ব্বেই দক্ষিণ ভারতের পরাক্রান্ত চোলরাজ রাজেন্দ্র মহীপালের রাজ্য আক্রমণ করিলেন। চোলরাজগণের ন্যায় শক্তিশালী রাজবংশ তখন ভারতবর্ষে আর ছিল না। উড়িষ্যা হইতে আরম্ভ করিয়া রামেশ্বর সেতুবন্ধ পৰ্য্যন্ত ভারতের পূর্ব্ব উপকূল সমস্তই তাঁহাদের অধীন ছিল, এবং তাঁহাদের প্রচণ্ড ও প্রকাণ্ড নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরের পরপারে সুমাত্রা ও মলয় উপদ্বীপের বহু রাজ্য জয় করিয়া দক্ষিণ-পূর্ব্ব এশিয়ার বিপুল বাণিজ্যভাণ্ডারের স্বর্ণদ্বার তাঁহাদের সম্মুখে উক্ত করিয়া দিয়াছিল। এই বিশাল সাম্রাজ্য ও অতুল ঐশ্বর্যের অধিকারী রাজা রাজেন্দ্রচোল শিবের উপাসক ছিলেন। সুতরাং তাঁহার রাজ্য পবিত্র করিবার উদ্দেশে গঙ্গাজল আনয়ন করিবার জন্য তিনি এক বিরাট সৈন্যদল প্রেরণ করেন। তাঁহার সেনাপতি বঙ্গের সীমান্তে উপস্থিত হইয়া প্রথমে দণ্ডভুক্তিরাজ ধর্ম্মপাল ও পরে লোকপ্রসিদ্ধ দক্ষিণ রাঢ়ের অধিপতি রণশূরকে পরাজিত করিয়া এই দুই রাজ্য অধিকার করেন। তারপর তিনি ‘অবিরাম-বর্ষা বারি-সিক্ত’ বঙ্গাল দেশ আক্রমণ করিলে রাজা গোবিন্দচন্দ্র হস্তীপৃষ্ঠ হইতে অবতরণ করিয়া রণক্ষেত্র হইতে পলায়ন করিলেন। তারপর শক্তিশালী মহীপালের সহিত যুদ্ধ হইল। মহীপাল ভীত হইয়া রণস্থল ত্যাগ করিলেন এবং তাঁহার দুর্মদ রণহস্তী, নারীগণ ও ধনরত্ন লুণ্ঠণপূৰ্ব্বক চোলসেনাপতি উত্তর রাঢ় অধিকার করিয়া গঙ্গাতীরে উপনীত হইলেন।
চোলারাজের সভাকবি এই অভিযানের যে বর্ণনা দিয়াছেন তাহাতে অনুমিত হয় যে গঙ্গাজল সংগ্রহ করা ছাড়া ইহার আর কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তামিল ঐতিহাসিকগণও স্বীকার করেন যে এই অভিযানে আর কোনো স্থায়ী ফল লাভ হয় নাই। চোল প্রশস্তিতে বাংলায় চোলরাজ্যের প্রভুত্ব বা প্রতিষ্ঠার কোনো উল্লেখ নাই, কেবল বলা হইয়াছে যে চোলসেনাপতি বাংলার পরাজিত রাজন্যবর্গকে মস্তকে গঙ্গাজল বহন করিয়া আনিতে বাধ্য করিয়াছিলেন। ইহা সত্য হইলে বলিতে হইবে যে পৃথিবীতে অন্ধ ধৰ্ম্মবিশ্বাসের জন্য যত উৎপীড়ন ও অত্যাচার হইয়াছে চোলরাজ্যের বঙ্গদেশ আক্রমণ তাঁহার এক চরম দৃষ্টান্ত। বিনা যুদ্ধে বাংলার রাজগণ যে চোলরাজাকে গঙ্গাজল দিতে অস্বীকার করিয়াছিলেন ইহা চোল প্রশস্তি কার বলেন নাই এবং ইহা স্বভাবতই বিশ্বাস করা কঠিন। সুতরাং ইহার জন্য অনর্থক সহস্র সহস্র লোক হত্যা করা ধর্ম্মের নামে গুরুতর অধৰ্ম্ম বলিয়াই মনে হয়। অপর পক্ষে দিগ্বিজয়ী রাজেন্দ্রচোল যে কেবল গঙ্গাজলের জন্যই সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন, বঙ্গদেশ জয় করা তাঁহার মোটেই উদ্দেশ্য ছিল না, ইহাও বিশ্বাস করা কঠিন। হয়তো এই চেষ্টা সফল হয় নাই বলিয়াই চোলরাজের সভাকবি পরাজয় ও ব্যর্থতার কলঙ্ক গঙ্গাজল দিয়া ধুইয়া ফেলিতে প্রয়াস পাইয়াছেন। আৰ্য্য ক্ষেমীশ্বর প্রণীত চণ্ডকৌশিক নাটকে মহীপাল কর্ত্তৃক কর্ণাটগণের পরাভবের উল্লেখ আছে। কেহ কেহ ইহা হইতে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে পালরাজ মহীপাল চোলসৈন্যকেও পরাস্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু এই মত গ্রহণ করা কঠিন। কারণ চোল ও কর্ণাট দুই ভিন্ন দেশ। সম্ভবত প্রতীহাররাজ মহীপাল কর্ত্তৃক রাষ্ট্রকূট সৈন্যের পরাভবের কথাই চণ্ডকৌশিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে, কারণ রাষ্ট্রকূটগণ কর্ণাট দেশে রাজত্ব করিতেন।
রাজেন্দ্ৰচোলের অভিযানের প্রকৃত উদ্দেশ্য ও ফলাফল যাহাই হউক মোটের উপর একথা সকলেই স্বীকার করেন যে ভাগীরথীর পবিত্র বারি সগ্রহ করিয়া চোলসৈন্যের স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তনের পর বাংলা দেশে তাঁহাদের বিজয় অভিযানের আর কোনো চিহ্ন রহিল না। তামিল প্রশস্তিকারের উল্লিখিত বর্ণনা হইতে মনে হয় যে দণ্ডভুক্তি, দক্ষিণ রাঢ় ও বঙ্গালদেশে তখন ধৰ্ম্মপাল, রণশূর ও গোবিন্দচন্দ্র স্বাধীনভাবে রাজত্ব করিতেছিলেন-কিন্তু উত্তর রাঢ় মহীপালের অধীন ছিল। চোল আক্রমণের ফলে এই রাজনৈতিক অবস্থার কোনো পরিবর্ত্তন হইয়াছিল কি না এবং মহীপাল দক্ষিণ রাঢ় ও দক্ষিণবঙ্গ জয় করিয়া সমগ্র বঙ্গে তাঁহার অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন কি না তাহা ঠিক জানা যায় না।
মহীপালের পিতা ও পিতামহ মগধে রাজত্ব করিতেন। কিন্তু মিথিলাও (উত্তর বিহার) মহীপালের রাজ্যভুক্ত ছিল। সম্ভবত মহীপাল নিজেই মিথিলা জয় করিয়াছিলেন।
বারাণসীর নিকটবর্ত্তী প্রাচীন বৌদ্ধতীর্থ সারনাথে ১০৮৩ সংবতে (১০২৬) উৎকর্ণ একখানি লিপি পাওয়া গিয়াছে। ইহাতে গৌড়াধিপ মহীপালের আদেশে তাঁহার অনুজ শ্ৰীমান স্থিরপাল ও শ্রীমান বসন্তপাল কর্ত্তৃক নূতন নূতন মন্দির নিৰ্ম্মাণ ও পুরাতন মন্দিরাদির জীর্ণসংস্কারের উল্লেখ আছে। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে ১০২৬ অব্দে মহীপালের অধিকার বারাণসী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল।
কিন্তু ইহার অল্পকাল পরেই কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেব মহীপালকে পরাজিত করিয়া বারাণসী অধিকার করেন। কারণ ১০৩৪ খৃষ্টাব্দে যখন আহম্মদ নিয়ালতিগীন বারাণসী আক্রমণ করেন তখন ইহা কলচুরিরাজের অধীন ছিল।
মহীপালের রাজ্যকালে আর্য্যাবর্তের পশ্চিমভাগে বড়ই দুর্দিন উপস্থিত হইয়াছিল। গজনীর সুলতানগণের পুনঃপুন ভারত আক্রমণের ফলে পরাক্রান্ত সাহি ও প্রতীহারবংশের ধ্বংস হয়, অন্যান্য রাজবংশ বিপর্যস্ত ও হতবল হইয়া পড়েন এবং ভারতের প্রসিদ্ধ মন্দির ও নগরগুলি ধ্বংস ও তাহাদের অগণিত ধনরত্ন লুণ্ঠিত হয়। আর্য্যাবর্তের রাজন্যবর্গ একযোগে তাহাদিগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াও কোনো ফল লাভ করিতে পারেন নাই। এই বিধর্মী বিদেশী শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করিবার জন্য মহীপাল কোনো সাহায্য প্রেরণ করেন নাই, এজন্য কোনো এক ঐতিহাসিক তাঁহার প্রতি দোষারোপ করিয়াছেন। কিন্তু মহীপালের ইতিহাস সম্যক্ আলোচনা করিলে এই প্রকার নিন্দা বা অভিযোগের সমর্থন করা যায় না। পিতৃরাজ্যচ্যুত মহীপালকে নিজের বাহুবলে বাংলায় পুনরাধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে হয়। এই কাৰ্য্য সম্পূর্ণ হইবার পূর্ব্বেই রাজেন্দ্রচোল তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করেন। কলচুরিরাজও তাঁহার আর এক শত্রু ছিলেন। তৎকালে রাজেন্দ্রচোল ও গাঙ্গেয়দেবের ন্যায় দিগ্বিজয়ী বীর ভারতবর্ষে আর কেহ ছিল না। ইহাদের ন্যায় শত্রুর হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিতেই তাহাকে সর্বদা বিব্রত থাকিতে হইত। এমতাবস্থায় সুদূর পঞ্চনদে সৈন্য প্রেরণ করা তাঁহার পক্ষে হয়ত সম্ভব ছিল না। সুতরাং তৎকালীন বাংলার অভ্যন্তরীণ অবস্থা সবিশেষ না জানিয়া মহীপালকে ভীরু, কাপুরুষ অথবা দেশের প্রতি কর্তব্যপালনে উদাসীন ইত্যাদি আখ্যায় ভূষিত করা যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয় না।
মহীপাল যাহা করিয়াছিলেন তাহাই তাঁহার শৌর্যবীর্যের যথেষ্ট পরিচয় দিতেছে। পালরাজ্যকে আসন্ন ধ্বংসের হস্ত হইতে রক্ষা করিয়া তিনি বঙ্গদেশের পূৰ্ব্ব সীমান্ত হইতে রাবাণসী পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ভূভাগ ও মিথিলায় পালরাজ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। তারপর ভারতের দুই প্রবল রাজশক্তির সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া তিনি এই রাজ্যের অধিকাংশ রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। ইহাই মহীপালের কৃতিত্বের শ্রেষ্ঠ পরিচয়।
পালরাজশক্তির পুনরাভ্যুদয়ের চিহ্নস্বরূপ মহীপাল প্রাচীন কীর্তির রক্ষণে যত্নশীল ছিলেন। সারনাথ লিপিতে শত শত কীর্তিরত্ন নির্মাণ এবং অশোকস্তূপ, সাঙ্গধর্ম্মচক্র ও “অষ্টমহাস্থান” শৈলবিনির্ম্মিত গন্ধকুটি প্রভৃতি প্রসিদ্ধ প্রাচীন বৌদ্ধকীৰ্ত্তির সংস্কার সাধনের উল্লেখ আছে। এতদ্ব্যতীত মহীপাল অগ্নিদাহে বিনষ্ট নালন্দা মহাবিহারের জীর্ণোদ্ধার এবং বৌদ্ধগয়ায় দুইটি মন্দির নির্মাণ করেন। কাশীধামে নবদুর্গার প্রাচীন মন্দির ও অন্যান্য হিন্দু দেব-দেবীর মন্দিরও সম্ভবত তিনি নির্মাণ করেন। অনেক দীর্ঘিকা ও নগরী এখনো তাঁহার নামের সহিত বিজড়িত হইয়া আছে এবং সম্ভবত তিনিই সেগুলির প্রতিষ্ঠা করেন। মোটের উপর মহীপালের রাজ্যে বাংলায় সকল দিকেই এক নূতন জাতীয় জাগরণের আভাস পাওয়া যায়।
মহীপালের ইমাদপুরে প্রাপ্ত লিপি তাঁহার রাজ্যের ৪৮ বৎসরে লিখিত। সুতরাং অনুমিত হয় যে তিনি প্রায় অর্দ্ধশতাব্দীকাল রাজত্ব করেন (আ ৯৮৮-১০৩৮)।
.
২. বৈদেশিক আক্রমণ ও অন্তর্বিদ্রোহ
মহীপালের পর তাঁহার পুত্র নয়পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন ও অন্তত ১৫ বৎসর রাজত্ব করেন (আ ১০৩৮-১০৫৫)। কলচুরিরাজ গাঙ্গেয়দেবের পুত্র কর্ণ অথবা লক্ষ্মীকর্ণের সহিত সুদীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধই তাঁহার রাজ্যকালের প্রধান ঘটনা। তিব্বতীয় গ্রন্থে এই যুদ্ধের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। কর্ণ মগদ আক্রমণ করিয়া নয়পালকে পরাজিত করেন। তিনি পাল-রাজধানী অধিকার করিতে পারেন নাই, কিন্তু অনেক বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করিয়া মন্দিরের দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করেন। প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচাৰ্য্য অতীশ অথবা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তখন মগধে বাস করিতেছিলেন। তিনি প্রথমে কোনো প্রকারে এই যুদ্ধব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন নাই। কিন্তু পরে যখন নয়পাল কর্ণকে পরাজিত করিয়া কলচুরিসৈন্য বিধ্বস্ত করিতেছিলেন তখন দীপঙ্কর কর্ণ ও তাঁহার সৈন্যকে আশ্রয় দেন। তাঁহার চেষ্টায় উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়।
কিন্তু এই সন্ধি দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই। নয়পালের পুত্র তৃতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে (আ ১০৫৫-১০৭০) কর্ণ পুনরায় বাংলা দেশে যুদ্ধাভিযান করেন। এই যুদ্ধেও কর্ণ প্রথমে জয়লাভ করেন। বীরভূম জিলার অন্তর্গত পাইকোর নামক স্থানে একটি শিলাস্তম্ভের গাত্রে কর্ণের একখানি লিপি উত্তীর্ণ আছে। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, তিনি পশ্চিমবঙ্গের কতক অংশ অধিকার করিয়াছিলেন। কিন্তু পরে তিনি তৃতীয় বিগ্রহপাল কর্ত্তৃক পরাজিত হন। তৃতীয় বিগ্রহপালের সহিত কর্ণের কন্যা যৌবনশ্রীর বিবাহ হয়। সম্ভবত এই বৈবাহিক সম্বন্ধ দ্বারা উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয়।
এই সুদীর্ঘ যুদ্ধের ফলে পালরাজশক্তি ক্রমশই দুর্বল হইয়া পড়ে। ফলে বাংলার নানা প্রদেশে স্বাধীন খণ্ডরাজ্যের উদ্ভব হয়। মহামাণ্ডলিক ঈশ্বরঘোষ ঢেক্করীতে রাজধানী স্থাপিত করিয়া একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ঢেক্করী সম্ভবত বর্দ্ধমান জিলায় অবস্থিত। পূর্ব্ববঙ্গে দুইটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়। বৰ্ম্মবংশীয় রাজগণ বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপিত করিয়া পূর্ব্ববঙ্গের কতকাংশ শাসন করেন। কুমিল্লা অঞ্চলে পট্টিকের নামে আর একটি রাজ্য স্থাপিত হয়। কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী পট্টিকের পরগণা এখনো এই প্রাচীন রাজ্যের স্মৃতিরক্ষা করিয়াছে। এই দুই রাজ্য সম্বন্ধে অন্যত্র বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে।
পালরাজগণের এই আভ্যন্তরিক দুরবস্থার সময় কর্ণাটের চালুক্যরাজগণ বাংলা দেশ আক্রমণ করেন। চালুক্যরাজ সোমেশ্বরের পুত্র কুমার বিক্রমাদিত্য দিগ্বিজয়ে বহির্গত হইয়া গৌড় ও কামরূপ জয় করেন। এতদ্ব্যতীত চালুক্যগণ একাধিকবার বঙ্গ আক্রমণ করেন।
সুযোগ পাইয়া উড়িষ্যার রাজগণও বাংলা আক্রমণ করেন। সোমবংশীয় রাজা মহাশিবগুপ্ত যযাতি গৌড় ও রাঢ়ায় জয়লাভ করিয়াছিলেন এবং রাজা উদ্যোতকেশরী গৌড়ীয় সৈন্যকে পরাস্ত করিয়াছিলেন। ইহাদের কাহারও তারিখ সঠিক জানা যায় না। কিন্তু খুব সম্ভবত উভয়েই একাদশ শতাব্দীতে রাজত্ব করিতেন।
কেবল ব্লাংলায় নহে মগধেও পালরাজশক্তি ক্রমশ হীনবল হইয়া পড়িল। নয়পালের রাজ্যকালেই গয়ার চতুস্পার্শ্ববর্ত্তী ভূভাগে শূদ্রক নামক একজন
সেনানায়ক একটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। শূদ্রক ও তাঁহার পুত্র বিশ্বাদিত্য নামত পালরাজগণের অধীনতা স্বীকার করিতেন। কিন্তু বিশ্বাদিত্যের (নামান্তর বিশ্বরূপ) পুত্র যক্ষপাল স্বাধীন রাজার ন্যায় রাজত্ব করেন।
এইরূপ দেখা যায় যে তৃতীয় বিগ্রহপালের মৃত্যুকালে পালরাজ্য বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে ও অন্তর্বিপ্লবে ছিন্নভিন্ন হইয়া গিয়াছিল। তৃতীয় বিগ্রহপালের তিন পুত্র ছিল-দ্বিতীয় মহীপাল, দ্বিতীয় শূরপাল ও রামপাল। দ্বিতীয় মহীপাল পিতার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। কিন্তু চারিদিকেই তখন বিশৃঙ্খলা ও ষড়যন্ত্র চলিতেছিল। দুষ্ট লোকের কথায় রাজার বিশ্বাস হইল যে তাঁহার দুই ভ্রাতা এই সমুদয় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন। সুতরাং তিনি তাঁহাদিগকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিলেন। কিন্তু শীঘ্রই বরেন্দ্রের সামন্তবর্গ প্রকাশ্যভাবে বিদ্রোহী হইয়া রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিল। মহীপালের সৈন্য বা যুদ্ধসজ্জা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না কিন্তু মন্ত্রীগণের পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া তিনি বিদ্রোহীগণের সহিত যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হইলেন। মহীপাল পরাস্ত ও নিহত হইলেন। কৈবৰ্ত্তজাতীয় নায়ক দিব্য বরেন্দ্রের রাজা হইলেন।
সন্ধ্যাকরনন্দী বিরচিত রামচরিত কাব্যে এই বিদ্রোহ ও তাঁহার পরবর্ত্তী ঘটনা সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে। বাংলার ইতিহাসে এই গ্রন্থখানি অমূল্য-কারণ বাংলার আর কোনো রাজনৈতিক ঘটনার এরূপ বিস্তৃত বিবরণ আমরা কোথাও পাই না। সন্ধ্যাকরনন্দীর পিতা এই সমুদয় ঘটনার কালে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং তিনি নিজেও ইহার অধিকাংশ প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। সুতরাং সমুদয় ঘটনা যথাযথভাবে জানিবার তাঁহার বিশেষ সুযোগ ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই কাব্যখানির সম্যক অর্থ গ্রহণ করা অতিশয় কঠিন। ইহার প্রধান কারণ এই যে কাব্যখানি দ্ব্যর্থবোধক। ইহার প্রতি শ্লোকের দুই প্রকার অর্থ আছে। এক অর্থে ধরিলে কাব্যখানিতে রামায়ণে বর্ণিত রামচন্দ্রের আখ্যান এবং অন্য অর্থে পালরাজগণের, প্রধানত রামপালের, ইতিহাস পাওয়া যায়। দ্বিবিধ অর্থব্যঞ্জনার জন্য শ্লোকগুলির শব্দযোজনা এমনভাবে করিতে হইয়াছে যে সহজে তাহা বিশ্লেষণ করা যায় না। এই জন্যই কবির জীবিতকালেই, অথবা তাঁহার অল্পদিন পরেই, এই কাব্যের একটি টীকা রচিত হয়। তাহাতে দুইপক্ষের অন্বয় ও ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে এই কাব্যের যে একমাত্র পুঁথি আবিষ্কার করেন তাহাতে সম্পূর্ণ মূল গ্রন্থ ও টীকার এক অংশমাত্র পাওয়া যায়। যে অংশের শ্লোকের প্রকৃত ব্যাখ্যা, বিশেষত তাঁহার মধ্যে ঐতিহাসিক ঘটনার যে সমুদয় ইঙ্গিত বা অভ্যাস আছে তাঁহার মর্ম গ্রহণ করা সৰ্ব্বত্র সম্ভবপর হয় নাই। মূল টীকার সাহায্যে মূল গ্রন্থ হইতে বরেন্দ্রের বিদ্রোহ ও রামপাল কর্ত্তৃক বরেন্দ্রের পুনরাধিকার সম্বন্ধে যাহা জানা যায় পরবর্ত্তী অধ্যায়ে তাহা বিবৃত হইবে।