১৬. ষোড়শ পরিচ্ছেদ –ভাষা ও সাহিত্য
১. বাংলা ভাষার উৎপত্তি
সৰ্ব্বপ্রাচীন যুগে আর্য্যগণ যে ভাষা ব্যবহার করিতেন, এবং যে ভাষায় বৈদিক গ্রন্থাদি লিখিত হইয়াছিল, কালপ্রভাবে তাঁহার অনেক পরিবর্ত্তন হয়, এবং এই পরিবর্ত্তনের ফলেই ভারতবর্ষে প্রাচীন ও বর্ত্তমানকালে প্রচলিত বহু ভাষার উদ্ভব হইয়াছে। এই ভাষা-বিবর্ত্তনের সুদীর্ঘ ইতিহাস বর্ণনা করা এই গ্রন্থে সম্ভবপর নহে। তবে নিম্নলিখিত তিনটি শ্রেণীবিভাগ হইতে এ সম্বন্ধে কতক ধারণা করা যাইবে।
১। প্রাচীন সংস্কৃত ঋগ্বেদের সময় হইতে ৬০০ খৃ. পূ. পৰ্য্যন্ত
২। পালি-প্রাকৃত-অপভ্রংশ–৬০০ খৃ. পূ.-১০০০ খৃষ্টাব্দ।
৩। অপভ্রংশ হইতে বাংলা ও অন্যান্য দেশীয় ভাষার উৎপত্তি-১০০০ খৃষ্টাব্দ হইতে
আৰ্য্যগণ বাংলায় আসিবার পূর্ব্বে বাংলার অধিবাসীগণ যে ভাষার ব্যবহার করিতেন তাঁহার কোনো নিদর্শন বর্ত্তমান নাই। তবে ইহার কোনো কোনো শব্দ বা রচনাপদ্ধতি যে সংস্কৃত ও বর্ত্তমান বাংলায় আত্মগোপন করিয়া আছে তাহা খুবই সম্ভব, এবং ইহার কিছু কিছু চিহ্নও পণ্ডিতগণ আবিষ্কার করিয়াছেন। ভাষাতত্ত্বের দিক দিয়া ইহার মূল্য খুব বেশী হইলেও বর্ত্তমান প্রসঙ্গে এই আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যত দূর প্রমাণ পাওয়া যায় তাহাতে অনুমিত হয় যে আর্য্যগণের সংস্পর্শে ও প্রভাবে বাংলার প্রাচীন অধিবাসীগণ নিজেদের ভাষা ত্যাগ করিয়া সম্পূর্ণভাবে আৰ্যভাষা গ্রহণ করেন। উপরে যে শ্ৰেণীভাগ করা হইয়াছে তাহা হইতে দেখা যাইবে যে, যে যুগে আর্য্যগণ এদেশে বসবাস করিতে আরম্ভ করেন তখন প্রাচীন সংস্কৃত হইতে প্রথমে পালি এবং প্রাকৃত ও পরে অপভ্রংশ, এই তিন ভাষার উৎপত্তি হয়। বাংলা দেশেও এই সমুদয় ভাষা প্রচলিত ছিল, কিন্তু ইহাতে কোনো সাহিত্য রচিত হইয়া থাকিলেও তাঁহার বিশেষ কোনো নিদর্শন বর্ত্তমান নাই। অপভ্রংশ হইতে বাংলা প্রভৃতি দেশীয় ভাষার উৎপত্তি হইয়াছে। বাংলার যে সৰ্ব্বপ্রাচীন দেশী ভাষার নমুনা পাওয়া গিয়াছে তাহা দশম শতাব্দীর পূর্ব্বেকার বলিয়া পণ্ডিতগণ মনে করেন না। এই ভাষা হইতেই কালে বর্ত্তমান বাংলা ভাষার সৃষ্টি হইয়াছে, কিন্তু সে হিন্দু যুগের পরের কথা। এই দেশীয় ভাষায় রচিত যে কয়েকটি পদ পাওয়া গিয়াছে তাঁহার সংখ্যা বেশী নহে। কিন্তু ইহা ছাড়া হিন্দযুগে বাঙ্গালীর সাহিত্য প্রধানত সংস্কৃত ভাষায়ই রচিত হইয়াছিল। সুতরাং প্রথমে বাংলার সংস্কৃত সাহিত্যেরই আলোচনা করিব।
.
২. পালযুগের পূৰ্ব্বেকার সংস্কৃত সাহিত্য
মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত বাংলার সৰ্ব্বপ্রাচীন প্রস্তরলিপি প্রাকৃত ভাষায় লিখিত। ইহাই বাংলায় মৌর্যযুগের একমাত্র সাহিত্যিক নিদর্শন। ইহার পাঁচশত বৎসরেরও অধিক পরে সুসুনিয়া পৰ্ব্বতগাত্রে উত্তীর্ণ রাজা চন্দ্রবর্ম্মার লিপি ও গুপ্তযুগের তাম্রশাসনগুলি, সংস্কৃত ভাষায় রচিত। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে, এবং সম্ভবত তাঁহার বহু পূর্ব্বেই, এদেশে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের যথেষ্ট চর্চ্চা ছিল, কিন্তু এই যুগের অন্য কোনো রচনা এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। বাংলা দেশে যে উচ্চশিক্ষা ও বিদ্যাচর্চ্চার বিশেষ প্রসার ছিল, চীন পরিব্রাজক ফাহিয়ান (৫ম শতাব্দী), হুয়েন সাং ও ই-সিং (৭ম শতাব্দী) তাঁহার বিশেষ উল্লেখ করিয়াছেন।
এই চর্চ্চার ফলে সপ্তম শতাব্দীতে বাংলার সংস্কৃত সাহিত্য একটি বিশিষ্ট রূপ ধারণ করিয়াছিল। বাণভট্টের একটি প্রসিদ্ধ শ্লোকে উক্ত হইয়াছে যে উৎকৃষ্ট সাহিত্যের যে সমুদয় আদর্শ গুণ তাঁহার সবগুলি একত্রে কোনো দেশেই প্রায় দেখা যায় না, কিন্তু এক এক দেশের সাহিত্যে এক একটি গুণ প্রকটিত হয়; যেমন উত্তর দেশীয় সাহিত্যে ‘শ্লেষ’, পাশ্চাত্যে ‘অর্থ’, দক্ষিণে ‘উৎপ্রেক্ষা’ এবং গৌড়দেশে ‘অক্ষর-ডম্বর’। কেহ কেহ এই শ্লোক হইতে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে গৌড়দেশের রাজা শশাঙ্কের ন্যায় গৌড়দেশীয় সাহিত্যকেও বাণভট্ট বিদ্বেষের চক্ষে দেখিতেন এবং এই শ্লোকে তাঁহার নিন্দাই করিয়াছেন। কিন্তু এই অনুমান সঙ্গত বলিয়া মনে হয় না। শব্দ-বিন্যাস সাহিত্যের অন্যতম গুণ, এবং গৌড়ীয় সাহিত্যে যে শ্লেষ, অর্থ ও উৎপ্রেক্ষা অপেক্ষা এই গুণেরই প্রাচুর্য দেখিতে পাওয়া যায় ইহা ব্যক্ত করাই সম্ভবত বাণভট্টের অভিপ্রায় ছিল। ভামহ ও দণ্ডী (৭ম ও ৮ম শতাব্দী) যেভাবে গৌড় মার্গ ও গৌড়ী রীতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহাও উপরোক্ত অনুমানের সমর্থন করে। তাঁহাদের মতে তখন সংস্কৃত কাব্যে গৌড়ী ও বৈদভী এই দুইটিই প্রধান রীতি ছিল। ভামহের মতে গৌড়ী এবং দণ্ডীর মতে বৈদভী ইহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
মোটের উপর এই কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সপ্তম শতাব্দীর পূর্ব্বেই বাঙ্গালীর প্রতিভা সংস্কৃত সাহিত্যে একটি অভিনব রচনারীতির প্রবর্ত্তন করিয়াছিল। এই রচনারীতির কিছু কিছু নিদর্শন ত্রিপুরায় প্রাপ্ত লোকনাথের তাম্রশাসন ও নিধানপুরে প্রাপ্ত ভাস্করবর্ম্মার তাম্রশাসনে পাওয়া যায়। প্রথমটি পদ্যে ও দ্বিতীয়টি গদ্যে লিখিত। এ যুগে যে বাংলায় অনেক গ্রন্থ রচিত হইয়াছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই–কিন্তু তাঁহার অধিকাংশই বিলুপ্ত হইয়াছে। যাহা আছে তাহাও এদেশীয় বলিয়া নিঃসন্দেহে গ্রহণ করার কোনো উপায় নাই।
এই যুগের কতকগুলি গ্রন্থ বাঙ্গালীর রচিত বলিয়া কেহ কেহ মত প্রকাশ করিয়াছেন। তাঁহার মধ্যে হস্ত্যায়ুর্ব্বেদ একখানি। চারি খণ্ডে ও ১৬০ অধ্যায়ে বিভক্ত এই বিশাল গ্রন্থে হস্তীর নানারূপ ব্যাধির আলোচনা করা হইয়াছে। ঋষি পালকাপ্য চম্পা নগরীতে অঙ্গদেশের রাজা রামপাদের নিকট ইহা বিবৃত করেন এবং ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে তাঁহার আশ্রম ছিল-উক্ত গ্রন্থে এইরূপ বর্ণিত হইয়াছে। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে, এই গ্রন্থ বাংলা দেশে লিখিত হইয়াছিল, কিন্তু ইহার রচনাকাল সম্বন্ধে পণ্ডিতগণ একমত নহেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ইহার তারিখ খৃষ্টপূর্ব্ব পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্দেশ করিয়াছেন। কিন্তু ইহার সমর্থক কোনো প্রমাণ নাই। অমরকোষ ও অগ্নিপুরাণে এই গ্রন্থের উল্লেখ আছে এবং কালিদাসের রঘুবংশে সম্ভবত ইহার ইঙ্গিত করা হইয়াছে। ইহা সত্য হইলে হস্তায়ুর্ব্বেদ গ্রন্থ অন্তত কালিদাসের পূর্ব্ববর্ত্তী বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। গ্রন্থ প্রণেতা ঋষি পালকাপ্য সম্ভবত কাল্পনিক নাম। এক হস্তিনীর গর্ভে তাঁহার জন্ম হইয়াছিল এরূপ কথিত হইয়াছে।
চান্দ্র ব্যাকরণ একখানি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। ইহার প্রণেতা চন্দ্রগোমিন্ সম্ভবত বাঙ্গালী ছিলেন। ইনি পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন, এবং পাণিনির সূত্রগুলি নূতন প্রণালীতে বিভক্ত করিয়া যে ব্যাকরণ গ্রন্থ ও তাঁহার বৃত্তি রচনা করেন তাহা সমগ্র ভারতবর্ষে বিশেষ খ্যাতি লাভ করে। কাশ্মীর, নেপাল, তিব্বত ও সিংহল দ্বীপে ইহার পঠনপাঠন বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। চন্দ্রগোমিন্ বৌদ্ধ ছিলেন। তিব্বতীয় কিংবদন্তী অনুসারে ‘ন্যায়সিদ্ধালোক’ নামক দার্শনিক গ্রন্থ এবং ৩৬ খানি তন্ত্রশাস্ত্রের রচয়িতা চন্দ্রগোমিন্ ও উল্লিখিত বৈয়াকরণিক চন্দ্রগোমি একই ব্যক্তি; তিনি বরেন্দ্রভূমিতে এক ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেন, তথা হইতে নির্বাসিত হইয়া চন্দ্রদ্বীপে বাস করেন এবং পরে নালন্দায় স্থিরমতির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ইহার সম্বন্ধে তিব্বতে যে সমুদয় আখ্যান প্রচলিত আছে একবিংশ পরিচ্ছেদে তাহা বিবৃত হইবে। চন্দ্রগোমিন্ উপরোক্ত গ্রন্থগুলি ব্যতীত তারা ও মঞ্জুশ্রীর স্তোত্র, ‘লোকানন্দ’ নাটক ও ‘শিষ্য-লেখ-ধৰ্ম্ম’ নামক একখানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। লোকানন্দ নাটকের তিব্বতীয় অনুবাদ মাত্র পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু শিষ্য-লেখ-ধর্ম্মের মূল ও অনুবাদ উভয়ই বর্ত্তমান।
প্রসিদ্ধ দার্শনিক গৌড়পাদ সম্ভবত বাঙ্গালী ছিলেন-কারণ তিনি গৌড়াচাৰ্য্য নামে অভিহিত হইয়াছেন। প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে ইনি শঙ্করাচার্য্যের পরমগুরু অর্থাৎ গুরুর গুরু ছিলেন। ইহার রচিত আগম-শাস্ত্র ‘গৌড়পাদকারিকা’ নামে পরিচিত। ইহার দার্শনিক তথ্য শঙ্করের পূর্ব্বে প্রচলিত বেদান্ত মতবাদ ও মাধ্যমিক শূন্যবাদের সমন্বয়; ইহার কোনো কোনো অংশে বৌদ্ধ প্রভাব লক্ষিত হয়। গৌড়পাদ এতদ্ব্যতীত ঈশ্বরকৃষ্ণ রচিত সাংখ্যকারিকার টীকা করেন; মাঠরবৃত্তির সহিত ইহার অনেক সাদৃশ্য আছে।
চন্দ্রগোমিন্ ও গৌড়পাদ ব্যতীত এই যুগের আর কোনো বাঙ্গালি গ্রন্থকারের নাম এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। কিন্তু এ যুগে যে বাংলায় বহু সংস্কৃত কবি ও পণ্ডিত জন্মিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের গ্রন্থ ভারতবর্ষের সর্বত্র প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল বাণভট্ট, ভামহ ও দণ্ডী এবং চীনদেশীয় পরিব্রাজকগণের লেখা হইতে তাহা আমরা নিঃসন্দেহে জানিতে পারি।
.
৩. পালযুগে সংস্কৃত সাহিত্য
পালরাজগণের বহুসংখ্যক তাম্রশাসনে যে সমুদয় সংস্কৃত শ্লোক আছে তাহা হইতে প্রমাণিত হয় যে এই যুগে বাংলায় সংস্কৃত কাব্য চর্চ্চা ও কাব্য রচনা আরও প্রসার লাভ করিয়াছিল। সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যান্য বিভাগেও যে এই যুগে বাঙ্গালীরা পারদর্শিতা লাভ করিয়াছিলেন এই সমুদয় তাম্রশাসনে তাঁহারও প্রকৃষ্ট প্রমাণ আছে। নারায়ণপালের মন্ত্রী গুরবমিশ্র তাঁহার পূর্ব্বপুরুষগণের প্রশস্তিতে লিখিয়াছেন যে দেবপালের মন্ত্রী দৰ্ভপাণি চতুর্বেদে ব্যুৎপন্ন ছিলেন ও কেদারমিশ্র চতুর্বিদ্যাপয়োধি পান করিয়াছিলেন। তিনি নিজে বেদ, আগম, নীতি ও জ্যোতিষশাস্ত্রে পারদর্শিতা ও বেদের ব্যাখ্যা দ্বারা প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। এইরূপে পালযুগের অন্যান্য তাম্রশাসনে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির বৈদিক সাহিত্য, মীমাংসা, ব্যাকরণ, তর্ক, বেদান্ত ও প্রমাণশাস্ত্রে পাণ্ডিত্যের কথা লিপিবদ্ধ হইয়াছে। চতুর্ভুজ তাঁহার হরিচরিত কাব্যে লিখিয়াছেন যে বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, ব্যাকরণ ও কাব্যে বিচক্ষণ ছিলেন। হরিবৰ্ম্মদেবের মন্ত্রী ভট্টভবদেবের কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। প্রশস্তিকার লিখিয়াছেন যে, তিনি দর্শন, মীমাংসা, অর্থশাস্ত্র, ধর্ম্মশাস্ত্র, আয়ুর্ব্বেদ, অস্ত্রবেদ, সিদ্ধান্ত, তন্ত্র এবং গণিতে পারদর্শী ছিলেন এবং হোরাশাস্ত্রে গ্রন্থ লিখিয়া ‘দ্বিতীয় বরাহ’ উপাধি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। বিভিন্ন তাম্রশাসনে ভূমিদান-গ্রহণকারী ব্রাহ্মণগণের যে পরিচয় আছে তাহা হইতে তাঁহাদের বেদের বিভিন্ন শাখায় পাণ্ডিত্য ও বৈদিক ক্রিয়াকলাপে প্রচুর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়।
সুতরাং বাংলায় যে সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চ্চা বহুল পরিমাণে ছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। দুঃখের বিষয় বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ ব্যতীত এই যুগে বাঙ্গালীর রচিত গ্রন্থ যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা এইরূপ বহু শতাব্দীব্যাপী বিস্তৃত চর্চ্চার নিদর্শন হিসেবে নিতান্তই সামান্য ও অকিঞ্চিৎকর।
মুদ্রারাক্ষস প্রণেতা নাট্যকার বিশাখদত্ত, অনর্ঘরাঘবের কবি মুরারি, চণ্ডকৌশিক নাটকের গ্রন্থকার ক্ষেমীশ্বর, কীচকবধ কাব্য প্রণেতা নীতিবর্ম্মা এবং নৈষধ-চরিত রচয়িতা শ্রীহর্ষ-এই সকল প্রসিদ্ধ লেখক বাঙ্গালী ছিলেন বলিয়া কেহ কেহ মত প্রকাশ করিয়াছেন। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ইহাদের কাহাকেও বাঙ্গালার সন্তান বলিয়া নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যায় না।
অভিনন্দ নামে একজন বাঙ্গালী কবির সন্ধান পাওয়া যায়। শার্গধর-পদ্ধতিতে ইঁহাকে গৌড় অভিনন্দ বলা হইয়াছে, সুতরাং ইনি যে বাঙ্গালী ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। অভিনন্দের রচনা বলিয়া যে সমুদয় শ্লোক বিভিন্ন প্রসিদ্ধ পদ্যসংগ্রহ গ্রন্থে উদ্ধৃত হইয়াছে, সম্ভবত সে সমুদয় তাঁহারই রচনা। কেহ কেহ মনে করেন যে ইনিই কাদম্বরী-কথা-সার নামক কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা। অভিনন্দ সম্ভবত নবম শতাব্দীতে জীবিত ছিলেন।
পালযুগের একখানি কাব্যগ্রন্থ এ পর্য্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা সন্ধ্যাকরনন্দী প্রণীত ‘রামচরিত’ কাব্য। ইহার রচনাপ্রণালী, ঐতিহাসিক মূল্য ও আখ্যানভাগ রামপালের ইতিহাস প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোচিত হইয়াছে। এই দুরূহ শ্লেষাত্মক কাব্যের প্রতি শ্লোক এমন সুকৌশলে রচিত হইয়াছে যে পৃথক পৃথকভাবে বর্ণবিন্যাস ও শব্দযোজনা করিলে ইহা একদিকে রামায়ণের রামচন্দ্রের ও অপরদিকে পালসম্রাট রামপালের পক্ষে প্রযোজ্য হইবে। এই গ্রন্থের উপসংহারে একটি কবিপ্রশস্তি আছে। তাহা হইতে জানা যায় যে সন্ধ্যাকরনন্দী বরেন্দ্রে পুণ্ড্রবর্দ্ধনের নিকট বাস করিতেন। তাঁহার পিতা প্রজাপতিনন্দী রামপালের সান্ধি বিগ্রহিক ছিলেন। মদনপালের রাজত্বকালে এই কাব্য রচিত হয়। দ্ব্যর্থবোধক শ্লোকের দ্বারা ঐতিহাসিক আখ্যান বর্ণনা হেতু এই কাব্যে কবিত্বশক্তি সর্বত্র পরিস্ফুট হইবার সুযোগ পায় নাই। কিন্তু বরেন্দ্র ও রামাবতী নগরীর বর্ণনা ও ভীমের সহিত যুদ্ধের বিবরণ প্রভৃতি সাহিত্যের দিক দিয়াও উপভোগ্য। উচ্চাঙ্গের কবিত্ব না থাকিলেও ‘রামচরিত’ বাঙ্গালীর সংস্কৃত কাব্যে নিষ্ঠা ও নৈপুণ্যের পরিচয় হিসেবে চিরদিনই সমাদৃত হইবে।
দর্শনশাস্ত্রে আমরা এই যুগের মাত্র একজন প্রসিদ্ধ বাঙ্গালী লেখকের নাম জানি। ইনি বিখ্যাত ন্যায়কন্দলী প্রণেতা শ্রীধরভট্ট। ইঁহার পিতার নাম বলদেব, মাতার নাম অব্বোকা, এবং জন্মভূমি দক্ষিণ রাঢ়ের অন্তর্গত ভূরিশ্রেষ্ঠি (বর্দ্ধমানের নিকটবর্ত্তী ভুরশুট গ্রাম)। প্রশস্তপাদ বৈশেষিক সূত্রের যে ‘পদার্থ-ধৰ্ম্ম’ সংগ্রহ নামক ভাষ্য রচনা করেন শ্রীধরভট্ট তাঁহার ন্যায়কন্দলী টীকা দ্বারা ন্যায়বৈশেষিক মতের উপর আস্তিক্যবাদ প্রতিষ্ঠা করিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। শ্রীধর ‘অদ্বয় সিদ্ধি’, ‘তত্ত্বসংবাদিনী’, ‘তপ্রবোধ’ এবং সগ্রহটীকা প্রভৃতি বেদান্ত ও মীমাংসাবিষয়ক কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করেন-কিন্তু ইহার একখানিও পাওয়া যায় নাই। ন্যায়কন্দলীর রচনাকাল ৯১৩ (অথবা ৯১০) শকাব্দ (৯৯১ অথবা ৯৮৮ অব্দ)।
জিনেন্দ্রবুদ্ধি, মৈত্রেয়রক্ষিত এবং বিমলমতি প্রভৃতি এই যুগের কয়েকজন বিখ্যাত বৈয়াকরণিক এবং অমরকোষের টীকাকার সুভূতিচন্দ্রকে কেহ কেহ বাঙ্গালী বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন কিন্তু ইহার সমর্থক সন্তোষজনক প্রমাণ এখনো কিছু পাওয়া যায় নাই।
বৈদ্যক শাস্ত্রে কয়েকজন বাঙ্গালী গ্রন্থকার প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। সুবিখ্যাত ‘রুগবিনিশ্চয়’ অথবা ‘নিদান’ গ্রন্থের প্রণেতা মাধব বাঙ্গালী ছিলেন কি না সন্দেহের বিষয়। কিন্তু চরক ও সুশ্রুতের প্রসিদ্ধ টীকাকার চক্রপাণিদত্ত যে বাঙ্গালী ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। তাঁহার ‘চিকিৎসা সংগ্রহ’ গ্রন্থে তিনি নিজের যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়াছেন তাহা হইতে জানা যায় যে তিনি লোধুবংশীয় কুলীন ছিলেন; তাঁহার পিতা নারায়ণ গৌড়াধিপের পাত্র ও রসবত্যধিকারী (অর্থাৎ রন্ধনশালার অধ্যক্ষ) [কেহ কেহ এই পদের পাঠান্তর কল্পনা করিয়া লিখিয়াছেন যে চক্রপাণিদত্ত নিজেই গৌড়াধিপের পাত্র ছিলেন], এবং তাঁহার ভ্রাতা একজন বিচক্ষণ চিকিৎসক ছিলেন। ষোড়শ শতাব্দীতে শিবদাসসেন এই গ্রন্থের টীকায় লিখিয়াছেন যে উক্ত গৌড়াধিপ নয়পাল। ইহা সত্য হইলে চক্রপাণিদত্ত একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে অথবা প্রথমার্ধে জীবিত ছিলেন এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। তিনি চিকিত্সা সংগ্রহ এবং ‘আয়ুর্ব্বেদ দীপিকা’ নামক চরকের ও ‘ভানুমতী’ নামক সুশ্রুতের টীকা ব্যতীত ‘শব্দচন্দ্রিকা’ ও ‘দ্রব্যগুণ সংগ্রহ’ নামক আরও দুইখানি গ্রন্থ রচনা করেন। নিশ্চলকর ‘রত্নপ্রভা’ নামে ‘চিকিৎসা সংগ্রহের’ যে টীকা লিখিয়াছেন তাহাতে বহু বৈদ্যক গ্রন্থের উল্লেখ আছে। নিশ্চলকর খুব সম্ভবত বাঙ্গালী ছিলেন এবং তিনি সম্রাট রামপাল ও কামরূপ রাজার সাক্ষাতের যে বিবরণ দিয়াছেন তাহাতে মনে হয় যে তিনি রামপালের সমসাময়িক ছিলেন।
সুরেশ্বর অথবা সুরপাল নামে আর একজন বাঙ্গালী বৈদ্যক গ্রন্থকার দ্বাদশ শতাব্দে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন। ইঁহার পিতামহ দেবগণ রাজা গোবিন্দচন্দ্রের এবং পিতা ভদ্রেশ্বর রামপালের সভায় রাজবৈদ্য ছিলেন। তিনি নিজে রাজা ভীমপালের বৈদ্য ছিলেন। সুরেশ্বর আয়ুৰ্ব্বেদোক্ত উদ্ভিদের পরিচয় দিবার জন্য শব্দ-প্রদীপ ও ‘বৃক্ষায়ুর্ব্বেদ’ নামে দুইখানি এবং ঔষধে লৌহের ব্যবহার সম্বন্ধে ‘লোহ-পদ্ধতি বা ‘লোহ-সর্ব্বস্ব’ নামে একখানি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন।
পালযুগে, বিশেষত দশম ও একাদশ শতাব্দীতে, বাংলায় বৈদ্যক শাস্ত্রের বিশেষ উন্নতি হইয়াছিল। অনেকে মনে করেন যে বৈদ্যক গ্রন্থের টীকাকার অরুণদত্ত, বিজয় রক্ষিত, বৃন্দ কুণ্ড, শ্রীকণ্ঠ দত্ত, বঙ্গসেন এবং সুশ্রুতের প্রসিদ্ধ টীকাকার গয়দাস বাঙ্গালী ছিলেন এবং ইহাদের অনেকেই পালযুগে আবির্ভূত হইয়াছিলেন।
‘চিকিৎসা-সার সংগ্রহের’ গ্রন্থকার বঙ্গসেন সম্ভবত বাঙালী ছিলেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।
বাংলায় যে বৈদিক সাহিত্যের চর্চ্চা হইত তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। দশম শতাব্দীতে ‘কুসুমাঞ্জলি’ প্রণেতা উদয়ন (কেহ কেহ ঘঁহাকে বাঙ্গালী বলেন) লিখিয়াছেন যে বাংলার মীমাংসকগণ বেদের প্রকৃত মৰ্ম্ম জানেন না। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে গঙ্গেশ উপাধ্যায়ও এইরূপ বলিয়াছেন। মীমাংসাশাস্ত্রে বিশেষ ব্যুৎপত্তির অভাব সূচিত করিলেও ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে বাংলায় এই বিষয়ে চর্চ্চা ও গ্রন্থ রচিত হইত। অনিরুদ্ধভট্ট ও ভবদেবভট্ট উভয়েই কুমারিলের গ্রন্থে ব্যুৎপন্ন ছিলেন। কিন্তু ভবদেব প্রণীত ‘তৌতাতিত-মত-তিলক’ ব্যতীত বাঙ্গালী রচিত আর কোনো মীমাংসা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায় নাই। বৈদিক কৰ্ম্মানুষ্ঠান সম্বন্ধে উত্তর রাঢ় নিবাসী নারায়ণ ‘ছান্দোগ্য পরিশিষ্টে’র ‘প্রকাশ’ নামক টীকা রচনা করিয়াছিলেন। নারায়ণ দেবপালের সমসাময়িক ছিলেন। ভবদেবভট্টও ‘ছান্দোগ্য কৰ্ম্মানুষ্ঠান পদ্ধতি’ লিখিয়াছিলেন। ইহা ‘দর্শকর্ম্মপদ্ধতি’, ‘দশকৰ্ম্মদীপিকা’ ও ‘সংস্কারপদ্ধতি’ নামেও পরিচিত।
ধর্ম্মশাস্ত্র সম্বন্ধে অনেক বাঙ্গালী গ্রন্থ লিখিয়াছেন। জিতেন্দ্রিয়, বালক এবং যোগ্লোক নামে তিনজন লেখকের বচন ও মত পরবর্ত্তী লেখকগণ বহুস্থানে উল্লেখ করিয়াছেন-কিন্তু ইহাদের মূল গ্রন্থগুলি পাওয়া যায় নাই। ভবদেবভট্ট প্রণীত ‘প্রায়শ্চিত্ত-প্রকরণ’ এ বিষয়ে একখানি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ। ইহা সম্পূর্ণ পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু তাঁহার ব্যবহার তিলক গ্রন্থ পাওয়া যায় নাই। আচার সম্বন্ধে তাঁহার গ্রন্থও পাওয়া যায় নাই। ভবদেবভট্টের এই সমুদয় গ্রন্থ ভারতের প্রসিদ্ধ স্মার্তগণ শ্রদ্ধার সহিত উল্লেখ করিয়াছেন।
জীমূতবাহন সম্ভবত ভবদেবভট্টের পরবর্ত্তী, কিন্তু তাঁহার সঠিক কাল নির্ণয় সম্ভব নহে। জীমূতবাহন রাঢ়দেশীয় পারিভদ্ৰকুলে জন্মগ্রহণ করেন। এই পারিভদ্ৰকুল রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণের ‘পারিহাল’ বা ‘পারি’ গাঁঈর অন্তর্গত। জীমূতবাহন প্রণীত ‘দায়ভাগ’ অনুসারে এখন পর্য্যন্তও বাংলার উত্তরাধিকার, স্ত্রীধন প্রভৃতি বিধিগুলি পরিচালিত হইতেছে। বাংলার বাহিরে ভারতের সৰ্ব্বত্র মিতাক্ষরা আইন প্রচলিত। সুতরাং জীমূতবাহনের মত বাঙ্গালীর একটি বৈশিষ্ট্য সূচিত করিতেছে। তৎপ্রণীত ‘ব্যবহার-মাতৃকা’ বিচারপদ্ধতি সম্বন্ধীয় গ্রন্থ। ইহাও বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। তাঁহার তৃতীয় গ্রন্থ ‘কাল বিবেক। হিন্দুগণের আচরিত বিবিধ অনুষ্ঠানের কাল নিরূপণ করাই এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য। সৌভাগ্যের বিষয় জীমূতবাহনের তিনখানি গ্রন্থই অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়াছে এবং বহুবার মুদ্রিত হইয়াছে।
পালরাজগণ বৌদ্ধ ছিলেন এবং এই সময় ভারতবর্ষে একমাত্র তাহাদের রাজ্যেই অর্থাৎ বাংলায় ও বিহারেই বৌদ্ধধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি বেশ দৃঢ় ছিল। এই যুগে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রকৃতিও অনেক পরিবর্তিত হইয়াছিল এবং মহাযানের পরিবর্তে সহজযান বা সহজিয়া ধৰ্ম্ম প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিল। সপ্তদশ পরিচ্ছেদে এই বিষয় বিস্তারিত উল্লিখিত হইবে। সহজিয়া বৌদ্ধধর্ম্মের এক বিপুল সাহিত্য আছে। তাঁহার অধিকাংশই বাঙ্গালীর রচিত। তাহারা যে সমুদয় গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন তাঁহার অধিকাংশই বিলুপ্ত হইয়াছে। কিন্তু তিব্বতীয় ভাষায় এই সমুদয় গ্রন্থের যে অনুবাদ হইয়াছিল তাহা অবলম্বন করিয়া আমরা এই বিরাট ধর্ম্মসাহিত্যের স্বরূপ নির্ণয় করিতে পারি। যে সমুদয় গ্রন্থের প্রণেতা বাঙ্গালী ছিলেন বলিয়া তিব্বতীয় সাহিত্যে স্পষ্ট উল্লেখ আছে তাহা ছাড়াও হয়তো আরও অনেক বাঙ্গালী গ্রন্থকার ছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে আর কোনো প্রমাণ না পাওয়া পর্য্যন্ত আমরা তাঁহাদিগকে বাঙ্গালী বলিয়া গ্রহণ করিতে পারি না। কিন্তু যেটুকু জানা গিয়াছে তাহা হইতে নিঃসন্দেহে বলা যাইতে পারে যে পালযুগের এই তান্ত্রিক বৌদ্ধ সাহিত্য বাঙ্গালীর একটি বিশেষ মূল্যবান সম্পদ বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য। গ্রন্থকারগণের নাম, পরিচয় ও কাল-নির্ণয় লইয়া অনেক গোলমাল ও বিভিন্ন মতবাদ আছে; এ স্থানে তাঁহার উল্লেখের প্রয়োজন নাই। যে সমুদয় বাঙ্গালীর লেখায় এই তান্ত্রিক সাহিত্য সৃষ্ট ও পুরিপুষ্ট হইয়াছিল মোটামুটিভাবে তাঁহাদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় লিপিবদ্ধ হইল।
পালযুগের পূৰ্ব্ববর্ত্তী হইলেও এই প্রসঙ্গে সর্বপ্রথম মহাযান লেখক শীলভদ্রের নাম করিতে হয়। তাঁহার মাত্র একখানি গ্রন্থ (‘আৰ্য-বুদ্ধ-ভূমি-ব্যাখ্যান’) তিব্বতীয় অনুবাদে রক্ষিত হইয়াছে।
শান্তিদেব নামে দুইজন তান্ত্রিক সাহিত্যের রচয়িতা ছিলেন। আবার ঠিক এই নামধারী একজন মহাযান গ্রন্থের লেখকও আছেন। এই দুই শান্তিদেব এক কি না এবং তিনি বাঙ্গালী কি না নিশ্চিত বলা যায় না। শান্তি রক্ষিত সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। জেরি নামে দুইজন বাঙ্গালী বৌদ্ধ সাহিত্যিক ছিলেন। প্রাচীন জেরি বরেন্দ্রে রাজা সনাতনের রাজ্যে বাস করিতেন এবং দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের গুরু ছিলেন। তৎপ্রণীত তিনখানি ন্যায়ের গ্রন্থের এবং অপর জেরির রচিত ১১ খানি বজ্রযান সাধন গ্রন্থের তিব্বতীয় অনুবাদ মাত্র পাওয়া যায়।
দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান বাংলার একজন শ্রেষ্ঠ ও জগদ্বিখ্যাত পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ১৬৮ খানি গ্রন্থের রচয়িতা। এই সমুদয়ের অধিকাংশই বজ্রযান সাধন গ্রন্থ।
জ্ঞানশ্রীমিত্র ‘কাৰ্য-কারণ-ভাব-সিদ্ধি’ নামক ন্যায় গ্রন্থের প্রণেতা। চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে মাধব তাঁহার ‘সৰ্ব্বদর্শন-সংগ্রহে’ এই গ্রন্থের উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার তিব্বতীয় অনুবাদ মাত্র পাওয়া যায়।
অভয়াকর গুপ্ত ২০ খানি বজ্রযান গ্রন্থের লেখক। ইহার মধ্যে মাত্র চারিখানির মূল সংস্কৃত পুঁথি পাওয়া গিয়াছে।
এ পর্য্যন্ত যে সমুদয় গ্রন্থকারের নামোল্লেখ করা হইল ইহারা সকলেই বাংলার বাহিরে বহু খ্যাতি ও কীৰ্ত্তি অর্জন করিয়াছেন এবং ইহাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী একবিংশ অধ্যায়ে আলোচিত হইয়াছে।
অন্যান্য যে সমুদয় বৌদ্ধ গ্রন্থকার তিব্বতীয় কিংবদন্তী অনুসারে বাঙ্গালী ছিলেন তাঁহাদের নাম, রচিত গ্রন্থ ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নে লিপিবদ্ধ হইল :
নাম | গ্রন্থ (তিব্বতীয় অনুবাদে রক্ষিত) | সংক্ষিপ্ত পরিচয় |
১। দিবাকরচন্দ্র | হেরুক সাধন ও ২ খানি অনুবাদ | নয়পালের রাজ্যকালে মৈত্রীপার শিষ্য ছিলেন। |
২। কুমারচন্দ্র | ৩ খানি তান্ত্রিক পঞ্জিকা | বিক্রমপুরী বিহারের একজন অবধূত। |
৩। কুমারবজ্র | হেরুক সাধক | |
৪। দানশীল | ‘পুস্তক পাঠোপায়’ ও ৬০ খানি তান্ত্রিকগ্রন্থের অনুবাদক | জগদ্দল বিহারে ছিলেন। |
৫। পুতলি | বোধিচিত্ত-বায়ু চরণ-ভাবনোপায় | বঙ্গাল দেশীয় শূদ্র এবং ৮৪ সিদ্ধের অন্যতম। |
৬। নাগবোধি | ১৩ খানি তান্ত্রিক গ্রন্থ | বঙ্গালদেশে শিবসেনা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। |
৭। প্রজ্ঞাবর্ম্মণ | তান্ত্রিকগ্রন্থের ২ খানি টীকা ও অনুবাদ। |
এতদ্ব্যতীত তিব্বতীয় গ্রন্থে বাংলার বিভিন্ন বৌদ্ধবিহারের কয়েকজন প্রসিদ্ধ গ্রন্থকারের উল্লেখ আছে, কিন্তু তাঁহারা বাঙ্গালী ছিলেন কি না তাহা সঠিক জানা যায় না। ইঁহাদের মধ্যে সোমপুর বিহারের বোধিভদ্র এবং জগদ্দল বিহারের মোক্ষাকরগুপ্ত, বিভূতিচন্দ্র এবং শুভাকরের নাম করা যাইতে পারে।
দশম হইতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বাংলায় বহু বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছিল; এই সম্বন্ধে সপ্তদশ অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হইবে। এই সম্প্রদায়ের প্রবর্ত্তকগণ সিদ্ধাচাৰ্য্য নামে খ্যাত। এই সমুদয় সিদ্ধাচার্যগণ অনেকেই অপভ্রংশ অথবা প্রাচীন বাংলায় তাঁহাদের ধর্ম্মমত প্রচার করিয়াছেন। এই সমুদয় গ্রন্থের তিব্বতীয় অনুবাদ ও কতকগুলির মূল পাওয়া গিয়াছে। এই সিদ্ধাচাৰ্যগণের নাম, তারিখ ও বিবরণ সম্বন্ধে বহু মতভেদ আছে; তাঁহার সবিস্তার উল্লেখ না করিয়া সংক্ষেপে ইহাদের পরিচয় দিতেছি। ইঁহাদের প্রণীত দোহা অর্থাৎ প্রাচীন বাংলায় রচিত পদ পরে আলোচিত হইবে।
কুক্কুরপাদ বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিব্বতীয় প্রবাদ অনুসারে তিনি ডাকিনী দেশ হইতে মন্ত্রযান (হেরুক সাধন) এবং অন্যান্য তন্ত্রমত আনিয়া এদেশে প্রচার করেন। শবরীপাদ বঙ্গালদেশের পাহাড়ে শিকার করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিতেন। তিনি ও তাঁহার দুই স্ত্রী, লোকী ও গুণী নাগার্জুনের নিকট দীক্ষা লাভ করেন।
সিদ্ধাচাৰ্য্যগণের মধ্যে লুইপাদ (অথবা লুই-পা) সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি সম্ভবত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের সমসাময়িক। তিনি ৪ খানি বজ্রযান গ্রন্থ এবং বহু দোহা রচনা করেন। তিব্বতীয় প্রবাদ অনুসারে তিনি বাংলা দেশে ধীবর বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং যোগিনীতন্ত্রের প্রবর্ত্তন করেন।
অনেকে মনে করেন লুইপাদ ও মৎস্যেন্দ্রনাথ একই ব্যক্তি। কারণ মৎস্যেন্দ্রনাথ যে নূতন ধর্ম্মমতের প্রবর্ত্তন করেন তাঁহার সহিত যোগিনী তন্ত্রের অনেক সাদৃশ্য আছে এবং তিনিও বাংলা দেশের চন্দ্রদ্বীপে ধীবর বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার ধর্ম্মমত সংস্কৃত গ্রন্থ ও দোহায় প্রচারিত হয়। সংস্কৃত গ্রন্থের মধ্যে ‘কৌলজ্ঞান-নির্ণয়’ সর্বপ্রাচীন ও সমধিক প্রসিদ্ধ।
মৎস্যেন্দ্রনাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ সম্বন্ধে বহু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। বাংলার রাজা গোপীচাঁদের সন্ন্যাস অবলম্বনে রচিত বহু গীতিকা সমস্ত আৰ্য্যাবর্তে সুপ্রসিদ্ধ। এই গোপীচাঁদ ও তাঁহার মাতা ‘নাথ’ নামে পরিচিত এবং ইহার আচাৰ্য্যগণ সংস্কৃত, অপভ্রংশ ও প্রাচীন বাংলায় বহু গ্রন্থ ও পদ রচনা করিয়াছেন।
অন্যান্য সিদ্ধাচাৰ্য্যগণের মধ্যে কৃষ্ণপাদ (অথবা কানুপা), সরহপাদ প্রভৃতি নাম করা যাইতে পারে।
.
৪. সেনযুগে সংস্কৃত সাহিত্য
সেনরাজগণের অভ্যুদয়ের ফলে অপভ্রংশ ও বাংলায় রচিত তান্ত্রিক সহজিয়া সাহিত্যের প্রসার কমিয়া পুনরায় সংস্কৃত সাহিত্যের উন্নতির যুগ আরম্ভ হয়। সেনরাজগণ শৈব ও বৈষ্ণবধর্ম্মের উপাসক ছিলেন এবং বৈদিক যাগযজ্ঞ ও ক্রিয়াকাণ্ডের অনুষ্ঠান করিতেন। সুতরাং তাঁহাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বঙ্গদেশেও সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দুধর্ম্মের নবজাগরণের সূত্রপাত হয়।
বৌদ্ধ ও তান্ত্রিক মতের প্রভাবে হিন্দুর আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াপদ্ধতি অনেকটা লোপ পাইয়াছিল। সুতরাং এই সম্বন্ধীয় গ্রন্থের বিশেষ প্রয়োজন ছিল। বল্লালসেনের গুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট হারলতা ও পিতৃদয়িত’ নামক দুইখানি গ্রন্থে অশৌচ, শ্রাদ্ধ, সন্ধ্যা, তর্পণ প্রভৃতি হিন্দুর বিবিধ অনুষ্ঠানের ও নিত্যকর্মের বিস্তৃত আলোচনা করেন। বল্লালসেন নিজে ‘ব্ৰত-সাগর’, ‘আচার-সাগর’, ‘প্রতিষ্ঠা-সাগর’, ‘দানসাগর’, ও ‘অদ্ভুতসাগর’ নামক পাঁচখানি গ্রন্থ রচনা করেন। কিন্তু মাত্র শেষোক্ত দুইখানি গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে। প্রাচীন বহু ধর্ম্মশাস্ত্র হইতে মত ও উক্তি উদ্ধৃত করিয়া বল্লালসেন এই সমুদয় গ্রন্থে হিন্দুর নানা আচার, প্রতিষ্ঠান, দান কৰ্ম্মাদি ও শুভাশুভাদি নানা নৈমিত্তিক লক্ষণ প্রভৃতির বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন। বল্লালসেনের এই সমুদয় গ্রন্থ যে বাংলায় ও বাংলার বাহিরে প্রামাণিক বলিয়া গণ্য হইত তাঁহার যথেষ্ট প্রমাণ আছে।
হলায়ূধ এই যুগের একজন প্রসিদ্ধ গ্রন্থকার। তিনি অল্প বয়সেই রাজপণ্ডিত ছিলেন; লক্ষ্মণসেন তাঁহাকে যৌবনে মহামাত্য এবং প্রৌঢ় বয়সে ধৰ্ম্মাধ্যক্ষের পদে নিযুক্ত করেন। হলায়ূধ ‘ব্রাহ্মণ-সর্ব্বস্ব’, ‘মীমাংসা-সৰ্ব্বস্ব’, ‘বৈষ্ণব-সর্ব্বস্ব’, ‘শৈব-সর্ব্বস্ব’ ও ‘পণ্ডিত-সর্ব্বস্ব’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন; কিন্তু ব্রাহ্মণ-সৰ্ব্বস্ব ব্যতীত আর কোনো গ্রন্থ এযাবৎ আবিষ্কৃত হয় নাই। হলায়ূধ লিখিয়াছেন যে রাঢ় ও বরেন্দ্রের ব্রাহ্মণগণ বেদ পড়িতেন না এবং বৈদিক অনুষ্ঠান সম্বন্ধে তাঁহাদের প্রকৃত জ্ঞান ছিল না-এইজন্য হিন্দুর আহ্নিক অনুষ্ঠান ও বিবিধ সংস্কারে ব্যবহৃত বৈদিক মন্ত্রের তাৎপৰ্য ব্যাখ্যা করিবার জন্য তিনি ব্রাহ্মণ-সৰ্ব্বস্ব গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। এই গ্রন্থ বঙ্গদেশে ও বাহিরে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। হলায়ুধের দুই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ঈশান ও পশুপতি শ্রাদ্ধ ও অন্যান্য দৈনিক অনুষ্ঠান সম্বন্ধে দুইখানি ‘পদ্ধতি’ রচনা করেন। পশুপাতি শ্রাদ্ধপদ্ধতি ব্যতীত পাক্যজ্ঞ সম্বন্ধেও একখানি গ্রন্থ রচনা করেন।
ভাষাতত্ত্বেও এই যুগের দুই-একজন গ্রন্থকার প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। ইঁহাদের মধ্যে আৰ্ত্তিহর-পুত্র বন্দ্যঘটীয় সর্ব্বানন্দের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘টীকাসৰ্ব্বস্ব’ নামে হঁহার রচিত অমরকোশের টীকা ভারতের সর্বত্র প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। সর্ব্বানন্দ ১১৫৯-৬০ অব্দে এই গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থে তিনি অপূৰ্ব্ব পাণ্ডিত্যের পরিচয় দিয়াছেন এবং বহু দেশী শব্দের উল্লেখ করিয়াছেন। এই সমুদয় দেশী শব্দের অধিকাংশই এখনো বাংলা ভাষায় প্রচলিত।
‘ভাষাবৃত্তি’, ত্রিকাণ্ডশেষ’, ‘হারাবলী’, ‘বর্ণদেশনা’ ও ‘দ্বিরূপকোষ’ প্রভৃতি কোষ ও ব্যাকরণ গ্রন্থের রচয়িতা পুরুষোত্তম বাঙ্গালী ছিলেন বলিয়া অনেকে মত প্রকাশ করিয়াছেন; কিন্তু এই মতের সমর্থক নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নাই।
সেনরাজগণ প্রায় সকলেই কবিতা রচনা করিতেন, এবং এই যুগকে বাংলায় সংস্কৃত কাব্যের সুবর্ণযুগ বলা যাইতে পারে। লক্ষ্মণসেনের সভাসদ ও সুহৃদ বটুদাসের পুত্র শ্রীধর দাস ১২০৬ অব্দে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ নামে সংস্কৃত কবিতা সংগ্রহ প্রকাশিত করেন। ইহাতে ৪৮৫ জন কবির রচিত ২৩৭০টি মনোজ্ঞ কবিতা সংগৃহীত হইয়াছে। এই কবিগণের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞাত এবং সম্ভবত বঙ্গদেশীয় ছিলেন; কিন্তু ইহা সঠিক জানিবার উপায় নাই। সদুক্তিকর্ণামৃতে রাজা বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেনের এবং কেশবসেনের রচিত কবিতা আছে। লক্ষ্মণসেনের রাজসভায় ধোয়ী, উমাপতিধর, গোবর্দ্ধন, শরণ ও জয়দেব এই পাঁচজন প্রসিদ্ধ কবি ছিলেন। ইঁহাদের বহু কবিতা শ্রীধরদাসের সংগ্রহে পাওয়া যায়।
কবি ধোয়ী তাঁহার একটি শ্লোকে লক্ষ্মণসেনকে রাজা বিক্রমাদিত্যের সহিত তুলনা করিয়াছেন। এই তুলনা কেবলমাত্র কবিসুলভ অত্যুক্তি নহে। তাঁহার সভার উক্ত পঞ্চ কবি সত্য সত্যই পঞ্চ রত্ন ছিলেন।
কবি ধোয়ীর ‘পবনদূত’ কাব্য মেঘদূতের অনুকরণে রচিত। গৌড়ের রাজা লক্ষ্মণসেন যখন দিগ্বিজয়ে প্রবৃত্ত হইয়া দাক্ষিণাত্যে গিয়াছিলেন তখন মলয় পৰ্ব্বতের গন্ধৰ্ব্বকন্যা কুবলয়বতী তাঁহার রূপে মুগ্ধ হন এবং পবনমুখে তাঁহার প্রণয়কাহিনী রাজার নিকট প্রেরণ করেন-এই ভূমিকার উপর ১০৪টি শ্লোকে সম্পূর্ণ এই দূতকাব্য রচিত হইয়াছে। কালিদাসের মেঘদূতের অনুকরণে যে সমুদয় দূতকাব্য রচিত হইয়াছে তাঁহার মধ্যে পবনদূতের স্থান খুব উচ্চ। পবনদূত ব্যতীত ধোয়ী সম্ভবত অন্য কাব্যও লিখিয়াছিলেন, কিন্তু ইহা পাওয়া যায় না। জয়দেব ধোয়ীকে কবিক্ষ্মাপতি অর্থাৎ কবিগণের রাজা এবং শ্রুতিধর বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন।
উমাপতিধর সম্বন্ধে জয়দেব লিখিয়াছেন ‘বাচ: পল্লবয়তি’ অর্থাৎ তিনি বাক্যবিন্যাসে পটু। তাঁহার রচিত বিজয়সেনের প্রশস্তি (দেওপাড়া লিপি) এই মন্তব্যের সমর্থন করে। মাধাই নগরে প্রাপ্ত লক্ষ্মণসেনের তাম্রশাসনের একটি শ্লোকও সদুক্তিকর্ণামৃতে উমাপতিধরের রচিত বলিয়া উদ্ধৃত হইয়াছে। সুতরাং এই তাম্রশাসনও সম্ভবত তাঁহারই রচনা। সদুক্তিকর্ণামৃতে উমাপতিধরের ৯০টি শ্লোক উদ্ধৃত হইয়াছে এবং উমাপতিরচিত ‘চন্দ্রচূড়-চরিত’ কাব্যের উল্লেখ আছে। সম্ভবত এই উমাপতি ও উমাপতিধর একই ব্যক্তি।
আচাৰ্য গোবর্দ্ধন সম্বন্ধে জয়দেব লিখিয়াছেন যে শৃঙ্গার রসাত্মক কবিতা রচনায় তাঁহার সমকক্ষ কেহ ছিল না। এই কবি গোবর্দ্ধনই যে ‘আৰ্য্যাসপ্তশতীর’ কবি গোবর্দ্ধনাচাৰ্য সে বিষয়ে বিশেষ কোনো সন্দেহ নাই। এই কাব্যগ্রন্থ গোবর্দ্ধনের অপূৰ্ব্ব কবিত্ব ও পাণ্ডিত্যশক্তির পরিচায়ক। সম্ভবত তাঁহার পাণ্ডিত্যের জন্যই তিনি আচার্য্য বলিয়া অভিহিত হইতেন।
কবি শরণ সম্বন্ধে জয়দেব লিখিয়াছেন যে তিনি শ্লাঘ্য দুরূহ-দ্রুতে অর্থাৎ দুরূহ রচনায় তিনি দ্রুত সিদ্ধহস্ত ছিলেন। ইহা হইতে কেহ কেহ মনে করেন যে তিনি ও দুর্ঘটবৃত্তির’ গ্রন্থকার বৈয়াকরণিক শরণ একই ব্যক্তি। কিন্তু ইহা অনুমান মাত্র। সদুক্তিকর্ণামৃতে শরণের কবিতা উদ্ধৃত হইয়াছে, কিন্তু তাঁহার কোনো কাব্যগ্রন্থ পাওয়া যায় নাই।
লক্ষ্মণসেনের সভাকবিদের মধ্যে জয়দেব যে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। তাঁহার গীতগোবিন্দের ‘কোমল-কান্ত-পদাবলী’ কেবলমাত্র বৈষ্ণবগণের নহে, সাহিত্যরস-পিপাসু মাত্রেরই চিত্তে চিরদিন আনন্দদান করিবে। সংস্কৃত ভাষায় এরূপ শ্রুতিমধুর, জনপ্রিয়, অথচ উচ্চাঙ্গের রসসম্পন্ন কাব্য খুব বেশি নাই। ইহার ৪০ খানি বা ততোধিক টীকা আছে এবং ইহার অনুকরণে প্রায় ১২।১৪ খানি কাব্যগ্রন্থ রচিত হইয়াছে। সমগ্র ভারতে গীতগোবিন্দ যে কিরূপ সমাদর লাভ করিয়াছে ইহাই তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই অসাধারণ জনপ্রিয়তার জন্যই কবি জয়দেবকে মিথিলা ও উড়িষ্যার অধিবাসীরা তাঁহাদের স্বদেশবাসী বলিয়া দাবি করিয়া থাকেন। কিন্তু অজয় নদের তীরে কেন্দুবিল্বগ্রাম তাঁহার জন্মভূমি, এই প্রবাদ এত দৃঢ়ভাবে প্রচলিত যে বিশেষ প্রমাণ না পাইলে অন্যরূপ বিশ্বাস করা কঠিন। এখনো প্রতি বৎসর মাঘী সংক্রান্তিতে জয়দেবের স্মৃতি রক্ষার্থে কেন্দুবিন্ত্রে বিরাট মেলার অধিবেশন হয়। তাঁহার জীবনী সম্বন্ধে বিশেষ কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। গীতগোবিন্দের একটি শ্লোক হইতে জানা যায় যে তাঁহার পিতার নাম ভোজদেব এবং মাতার নাম রামদেবী (পাঠান্তর-রাধাদেবী, বামাদেবী)। তাঁহার স্ত্রীর নাম সম্ভব পদ্মাবতী। জয়দেব যে সঙ্গীতে নিপুণ ছিলেন তাঁহার গীতগোবিন্দ রচনা হইতে তাহা বুঝা যায়। কারণ ইহার অনেক পদ প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতের উপযোগী করিয়াই রচিত এবং এখনো গীত হয়।
গীতগোবিন্দে রাধাকৃষ্ণের প্রেমকাহিনী বর্ণিত হইয়াছে, এবং বাংলার বৈষ্ণব সম্প্রদায় রসশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা হিসেবে ইহাকে তাহাদের একখানি বিশিষ্ট ধর্ম্মগ্রন্থ বলিয়া গণ্য করেন। কিন্তু ইহার আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা ছাড়িয়া দিলেও কেবলমাত্র ভাব ও রসের বিচারে ইহা সংস্কৃত সাহিত্যে একখানি উৎকৃষ্ট কাব্য বলিয়া বিবেচিত হইবার যোগ্য। ইহা প্রচলিত সংস্কৃত কাব্য হইতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রকৃতির এবং সাহিত্যিক জগতে এক নতুন সৃষ্টি। রচনাপ্রণালীর দিক হইতে সংস্কৃত কাব্য অপেক্ষা অপভ্রংশ এবং বাংলা ও মৈথিলী ভাষায় রচিত পদাবলীর সহিত ইহার সাদৃশ্য অনেক বেশী। কেহ কেহ মনে করেন যে গীতগোবিন্দ প্রথমে অপভ্রংশ অথবা প্রাচীন বাংলায় রচিত হইয়াছিল এবং পরে সংস্কৃতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু অনেকেই এই মত গ্রহণ করেন নাই।
দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ বাংলায় সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ যুগ বলা যাইতে পারে। একদিকে ধর্ম্মশাস্ত্র ও অপরদিকে উচ্চাঙ্গের কাব্য এই যুগকে অমর করিয়া রাখিয়াছে। অর্দ্ধশতাব্দীর মধ্যে অনিরুদ্ধ ভট্ট, হলায়ূধ, বল্লালসেন, সর্ব্বানন্দ, জয়দেব, উমাপতি, ধোয়ী, গোবর্দ্ধন ও শরণ-এতগুলি পণ্ডিত ও কবির সমাবেশ যেকোনো দেশের পক্ষেই গৌরবজনক।
.
৫. বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
স্বাভাবিক বিবর্ত্তনের ফলে সংস্কৃত ভাষা হইতে ক্রমে ক্রমে পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ ও দেশীয় ভাষার উৎপত্তির কথা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। কোন সময়ে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয় তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালে কতকগুলি প্রাচীন বৌদ্ধ-চর্য্যাপদ আবিষ্কার করেন এবং বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত করেন। বর্ত্তমান বাংলা ভাষার সহিত অনেক প্রভেদ থাকিলেও এই চর্য্যাপদগুলিই যে সর্বপ্রাচীন বাংলা ভাষার নিদর্শন তাহা সকলেই স্বীকার করেন।
এই চর্য্যাপদগুলির প্রত্যেকটিতে চারি হইতে ছয়টি পদ আছে। এগুলির বিষয়বস্তু সহজিয়া বৌদ্ধমতের গূঢ় আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা। এ পর্য্যন্ত মোট ২২ জন কবি রচিত ৪৭টি চর্য্যাপদ পাওয়া গিয়াছে। এই পদগুলির সংস্কৃত টীকা আছে-কিন্তু তাহাও এত দুরূহ যে সকল স্থলে মূলের তাৎপর্য বোধগম্য হয় না। এই প্রাচীন বাংলায় রচিত চর্যাপদের সঙ্গে শৌরসেনী অপভ্রংশ ভাষায় রচিত সরহ ও কাহ্নের দোহা এবং ‘ডাকার্ণব’ এই তিনখানি পুঁথি পাওয়া গিয়াছে। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন যে দশম শতাব্দে এইগুলি রচিত হয়। ঐযুগে বাংলায় ও বাংলার বাহিরে শৌরসেনী অপভ্রংশই বহুল পরিমাণে সাহিত্যের ভাষা ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রাচীন বাংলাও ক্রমশ পরিপুষ্ট হইয়া সাহিত্যের উপযুক্ত ভাষা বলিয়া পরিগণিত হয়, এবং একই কবি শৌরসেনী অপভ্রংশ ও বাংলা এই দুই ভাষাতেই কবিতা রচনা করেন। খুব সম্ভব এই প্রাচীন বাংলা আরও দুই-একশত বৎসর পূর্ব্ব হইতেই অর্থাৎ পালযুগের প্রারম্ভেই প্রচলিত ছিল, কিন্তু যে চর্য্যাপদগুলি ইহার সৰ্ব্বপ্রাচীন নিদর্শন তাহা সম্ভবত দশম শতাব্দীতে রচিত। তখনো শৌরসেনী অপভ্রংশই আর্য্যাবর্তের পূর্ব্বভাগে সাধুভাষা বলিয়া সম্মানের আসন পাইত। কিন্তু ক্রমে ক্রমে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া বাংলার একমাত্র সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হয়। মোটামুটিভাবে বলা যাইতে পারে যে নবম হইতে দ্বাদশ এই চারি শতাব্দীই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদিম যুগ।
পূৰ্ব্বে যে ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের কথা উল্লিখিত হইয়াছে তাহারাই পূর্ব্বোক্ত দোহা ও চর্য্যাপদগুলির রচয়িতা। এগুলি তিব্বতীয় ভাষায় অনূদিত হইয়াছিল। তেঙ্গুর নামক বিখ্যাত তিব্বতীয় গ্রন্থে ৫০টি চর্যাপদের অনুবাদ পাওয়া গিয়াছে। সুতরাং পূর্ব্বোক্ত ৪৭টি ব্যতীত আরও তিনটি প্রাচীন বাংলা চর্য্যাপদ ছিল,-শাস্ত্রী মহাশয়ের আবিষ্কৃত পুঁথি খণ্ডিত হওয়ায় এই তিনটির মূল পাওয়া যায় নাই।
বাংলায় প্রচলিত ময়নামতীর গানে চর্য্যাপদ রচয়িতা এই সিদ্ধাচার্যগণের কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। ময়নামতী রাজা গোপীচাঁদের মাতা ও গোরক্ষনাথের শিষ্যা ছিলেন। তিনি যোগবলে জানিতে পারিলেন যে তাঁহার পুত্র সন্ন্যাস গ্রহণ না করিলে অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হইবেন। গোপীচাঁদ তাঁহার দুই রাণী অদুনা ও পদুনার বহু বাধা সত্ত্বেও মাতার আজ্ঞায় সন্ন্যাসী হইলেন এবং গোরক্ষনাথের শিষ্য জালন্ধরিপাদ অথবা হাড়িপার শিষ্যত্ব গ্রহণ করিলেন।
সিদ্ধ ও যোগীপুরুষ হিসাবে গোরক্ষনাথের খ্যাতি ভারতের সর্বত্র বিস্তৃত, এবং তপ্রবর্তিত কানফাটা যোগী সম্প্রদায় সমগ্র হিন্দুস্থানে, বিশেষত পাঞ্জাবে ও রাজপুতনায়, এখন পর্য্যন্ত বিশেষ প্রভাবশালী। তাঁহার পুত্র মীননাথ অথবা মৎস্যেন্দ্রনাথ। স্বয়ং শিব তাঁহাকে গুহ্য মন্ত্র প্রদান করেন এবং তিনি আদি সিদ্ধ নামে কথিত হইয়া থাকেন। ময়নামতীর গানে এই সম্প্রদায়ের নিম্নলিখিত রূপ গুরুপরম্পরা পাওয়া যায়।
মৎস্যোন্দ্রনাথ (মনীনাথ)
।
গোরক্ষনাথ (গোরখনাথ)
।
জালন্ধরিপাদ (হাড়িপা)
।
কৃষ্ণপাদ (কানুপা, কাহ্নপা)
যে ৪৭টি চর্য্যাপদ পাওয়া গিয়াছে তাঁহার মধ্যে ১২টির রচয়িতা কৃষ্ণপাদ বা কাহ্নপা। তিনি একটি পদে যেভাবে জালন্ধরিপাদের উল্লেখ করিয়াছেন তাহাতে মনে হয় যে ইনি তাঁহার গুরু। সুতরাং পদরচয়িতা কৃষ্ণপাদ ও গোরক্ষনাথের প্রশিষ্য কৃষ্ণপাদ একই ব্যক্তি এইরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। লুইপা দুইটি চৰ্য্যাপদের রচয়িতা। তিব্বতীয় আখ্যানের উপর নির্ভর করিয়া কেহ ঘঁহাকে আদি সিদ্ধ মৎস্যেন্দ্রনাথের সহিত অভিন্ন মনে করেন, ইহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। এই সমুদয় পদরচয়িতা সিদ্ধ গুরুদিগের কাল-নির্ণয় সম্বন্ধে পণ্ডিতেরা একমত নহেন। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় অনুমান করেন যে গোরক্ষনাথ দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে বর্ত্তমান ছিলেন। কিন্তু ড. শহীদুল্লাহ নেপালের প্রচলিত কিংবদন্তীর উপর নির্ভর করিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে মৎস্যেন্দ্রনাথ সপ্তম শতাব্দের লোক। কিন্তু অনেকেই এই মত গ্রহণ করেন না। চর্যাপদের ভাষা দশম শতাব্দীর পূৰ্ব্বকার নহে, ইহাই প্রচলিত মত।
চর্য্যাপদগুলিকে বাংলা সাহিত্যের আদিম উৎস বলা যাইতে পারে এবং ইহার প্রভাবেই পরবর্ত্তী যুগের বাংলার সহজিয়া গান, বৈষ্ণব পদাবলী, শাক্ত ও বাউল গান প্রভৃতির সৃষ্টি হইয়াছে। সুতরাং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের দিক দিয়া ইহার মূল্য খুব বেশী। নিছক সাহিত্য হিসাবে সৌন্দৰ্য্য বিকাশিত হইবার সুযোগ পায় নাই-কিন্তু মাঝে মাঝে ইহাতে প্রকৃত কবিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। নিম্নে নমুনাস্বরূপ একটি প্রাচীন চর্য্যাপদ ও বর্ত্তমান বাংলা ভাষায় তাঁহার যথাসম্ভব রূপান্তর দেখানো হইতেছে। ইহা হইতে প্রাচীন চর্যাপদের ভাষা ও ভাব সম্বন্ধে ধারণা অনেকটা স্পষ্ট হইবে।
চর্য্যাপদ ১৪
১। গঙ্গা জউনা মাঝেঁ রে বইই নাঈ।
তহিঁ চড়িলী মাতঙ্গি পোইআ লীলে পার করেই।
২। বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইল উছারা।
সদ্গুরু পাআ-পসাএঁ জাইব পুণু জিমউরা৷
৩। পাঞ্চ কেড়ুআল পড়ন্তেঁ মাঙ্গে পীঠত কাছী বান্ধী।
গঅন উখোলেঁ সিঞ্চহু পাণী ন পইসই সান্ধি৷
৪। চান্দ সুজ দুই চাকা সিঠি সংহার পুলিন্দা।
বাম দাহিণ দুই মাগ ন চেবই বাহ তু ছন্দা।।
৫। কবড়ী ন লেই বোড়ী ন লেই সুচ্ছলে পার করেই।
জো রথে চড়িলা বাহবা ‘। জানি কুলেঁ কুল বুলই।।
বর্ত্তমান বাংলায় রূপান্তর
১। গঙ্গা যমুনা মধ্যে যে বহে নৌকা।
তাহাতে চড়িয়া চণ্ডালী ডোবা লোককে অবলীলাক্রমে পার করে।
২। বাহ্ ডোমনী! বাহ্ লো ডোমনী! পথে হইল বেলা গত।
সদ্গুরু-পাদ-প্রসাদে যাইব পুনঃ জিনপুর (জিন= বুদ্ধ) ॥
৩। পাঁচ দাঁড় পড়িতে নৌকার গলুইয়ে, পিঠে কাছি বান্ধিয়া।
গগন-উখলিতে (দ্বারা) ছেঁচ পানি, না পসিবে সন্ধিতে। (ছিদ্রে জল প্রবেশ করিবে না)।।
৪। চাঁদ-সূৰ্য্য দুই চাকা, সৃষ্টি-সংহার (দুই) মাস্তুল।
বাম ডাহিনে দুই মার্গ না বোধ হয়, বাহ্ স্বচ্ছন্দে।।
৫। কড়ি না লয়, বুড়ি (পয়সা) না লয়, অমনি পার করে।
যে রথে চড়িল, (নৌকা) বাহিতে না জানিয়া কূলে কূলে বেড়ায়।।
চর্য্যাপদ ব্যতীত যে ঐযুগে প্রাচীন বাংলায় রচিত অন্যান্য শ্রেণীর সাহিত্য ছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। এ বিষয়ে কিছু কিছু প্রমাণও আছে। চালুক্যরাজ তৃতীয় সোমেশ্বরের রাজ্যকাল (১১২৭-১১৩৮ অব্দ) রচিত মানসোল্লাস’ গ্রন্থের ‘গীত-বিনোদ’ অধ্যায়ে বিভিন্ন দেশীয় ভাষায় রচিত গীতের দৃষ্টান্ত আছে। ইহার মধ্যে বিষ্ণুর অবতার ও গোপীগণের সহিত কৃষ্ণের লীলাবিষয়ক কয়েকটি বাংলা গীতের অংশ আছে। গীতগোবিন্দের রচনাভঙ্গী যে প্রাচীন বাংলা ও অপভ্রংশে রচিত গীতিকবিতার অনুরূপ, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি জনপ্রিয় সংস্কৃত মহাকাব্য অবলম্বনে যে বাংলা ভাষায় একটি লৌকিক সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল ইহাও খুবই সম্ভব। কিন্তু এরূপ রচনার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নাই। মোটের উপর একথা বলা যাইতে পারে যে, বৌদ্ধ সহজিয়া মতের চর্য্যাপদগুলি ছাড়া প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত এমন আর কিছুই পাওয়া যায় নাই, যাহা দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ব্বেকার বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। মধ্যযুগে বৈষ্ণব ধর্ম্মের প্রভাবে যে বাংলা সাহিত্যের অপূৰ্ব্ব পরিপুষ্টি ও শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছিল, সম্ভবত পুরাতন বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম্মের প্রভাবেই সেই সাহিত্যের প্রথম সৃষ্টি হয়। পণ্ডিত ও প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষকগণ সংস্কৃতকেই একমাত্র সাধুভাষা ও সাহিত্যের বাহন মনে করিতেন, কিন্তু নূতন ও অর্ব্বাচীন ধর্ম্মমত জনসাধারণে প্রচলিত করার জন্য ইহার আচাৰ্য্যগণ জনসাধারণের ভাষায়ই ইহাকে প্রচার করিতে যত্নবান ছিলেন। ইহাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৃষ্টি ও পরিপুষ্টির প্রধান কারণ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
.
৫. বাংলা লিপি
অনেকের বিশ্বাস যে প্রাচীনকালেও সংস্কৃত ভাষা নাগরী অক্ষরেই লিখিত হইত, এবং বাংলা ভাষার ন্যায় বাংলায় প্রচলিত অক্ষরগুলিও অপেক্ষাকৃত আধুনিক। কিন্তু এই দুইটি মতই ভ্রান্ত। সর্বত্রই সংস্কৃত, প্রাকৃত ও দেশীয় ভাষা সবই একরকম অক্ষরে লিখিত হইত, এবং দেশ ও কাল অনুসারে তাঁহার ভিন্ন ভিন্ন রূপ ছিল। কেবলমাত্র সংস্কৃত লেখার জন্য কোনো পৃথক অক্ষর ব্যবহৃত হইত না।
মৌৰ্য্যসম্রাট অশোক খৃষ্টপূর্ব্ব তৃতীয় শতাব্দীতে যে ব্রাহ্মী লিপিতে তাঁহার অধিকাংশ শাসনমালা উত্তীর্ণ করান তাহা হইতেই ক্রমে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন বর্ণমালার উদ্ভব হইয়াছে। সম্রাট অশোকের সময়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ব্যতীত আর সৰ্ব্বত্রই এই এক প্রকার লিপিরই প্রচলন ছিল। কালক্রমে ও স্থানীয় লোকের বিভিন্ন রুচি অনুযায়ী বিভিন্ন প্রদেশে ইহার কিছু কিছু পরিবর্ত্তন আরম্ভ হয়। এই সমুদয় পরিবর্ত্তন সত্ত্বেও গুপ্তযুগের পূর্ব্ব পর্য্যন্ত ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যে সমুদয় বিভিন্ন বর্ণমালা প্রচলিত ছিল তাহাদের মধ্যে প্রভেদ খুব বেশী ছিল না। এক দেশের লোক অন্য দেশের বর্ণমালা পড়িতে পারিত।
গুপ্তযুগেই প্রথম প্রাদেশিক বর্ণমালার মধ্যে স্বাতন্ত্র ও প্রভেদ বাড়িয়া উঠে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীতে পূর্ব্ব ভারতের ও পশ্চিম ভারতের বর্ণমালা দুইটি স্বতন্ত্র পদ্ধতি অবলম্বন করে। পশ্চিম ভারতের সিদ্ধমাতৃকা-বর্ণমালা ক্রমশ রূপান্তর হইতে হইতে নাগরীতে পরিণত হয়। আর পূর্ব্ব ভারতের বর্ণমালা হইতেই অবশেষে বাংলা বর্ণমালার উৎপত্তি হয়।
সমাচার দেবের কোটালিপাড়া তাম্রশাসনে পূর্ব্ব ভারতে প্রচলিত এই বিশিষ্ট পদ্ধতির বর্ণমালার নিদর্শন পাওয়া যায়। সপ্তম হইতে নবম শতাব্দী পর্য্যন্ত ইহার ক্রমশ অনেক পরিবর্ত্তন হয়। দশম শতাব্দীতে পশ্চিম ভারতের বর্ণমালা ইহার উপর কিছু প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু ঐ শতাব্দের শেষভাগে প্রথম মহীপালের রাজত্বে এই প্রভাব দূর হয়, এবং পূৰ্ব্ব ভারতীয় বর্ণমালায় বাংলা বর্ণমালার পূৰ্ব্বাভাস পাওয়া যায়। প্রথম মহীপালের বাণগড়-লিপিতে ব্যবহৃত অ, উ, ক, খ, গ, ধ, ন, ম, ল এবং ক্ষ অনেকটা বাংলা অক্ষরের আকার ধারণ করিয়াছে। জ একেবারে সম্পূর্ণ বাংলা জ’য়ের অনুরূপ। দ্বাদশ শতাব্দীতে উত্তীর্ণ বিজয়সেনের দেওপাড়া-প্রশস্তিতে যে বর্ণমালা ব্যবহৃত হইয়াছে, তাঁহার মধ্যে ২২টি পুরাপুরি অথবা প্রায় বাংলা অক্ষরের মতন। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষে এবং এয়োদশ শতাব্দের প্রথমে তাম্রশাসনের অক্ষর প্রায় সম্পূর্ণ আধুনিক বাংলা অক্ষরে পরিণত হইয়াছে। ইহার পর তিন-চারিশত বত্সর পর্য্যন্ত স্বাভাবিক নিয়মে এই অক্ষরের কিছু কিছু পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে পরিবর্ত্তন বিশেষ কিছু হয় নাই। ঊনবিংশ শতাব্দী হইতে মুদ্রাযন্ত্রের প্রচলনের ফলে বাংলা অক্ষরগুলি একটি নির্দিষ্ট রূপ ধারণ করিয়াছে। ভবিষ্যতে ইহার আর কোনোরূপ পরিবর্ত্তন হইবে বলিয়া মনে হয় না। এইরূপে দেখা যায় যে গুপ্তযুগের পরবর্ত্তীকালে বাংলায় যখন একটি স্বাধীন পরাক্রান্ত রাজ্য স্থাপিত হয়, সেই সময় হইতেই পূৰ্ব্ব ভারতে একটি বিশিষ্ট বর্ণমালার প্রচলন হয়। ক্রমে এই বর্ণমালা পরিবর্তিত হইয়া বাংলার নিজস্ব একটি বর্ণমালায় পরিণত হয়। বলা বাহুল্য যে চিরকালই বাংলার প্রচলিত অক্ষরেই বাংলায় সংস্কৃত, প্রাকৃত ও দেশীয় ভাষা প্রভৃতি লিখিত হয়। সংস্কৃত ভাষা লিখিবার জন্য নাগরী অক্ষরের ব্যবহার অতি আধুনিক কালেই হইয়াছে। প্রাচীন বাংলার সংস্কৃত ভাষায় লিখিত সমুদয় তাম্রশাসন ও পুঁথিই তকালে প্রচলিত বাংলা অক্ষরেই লেখা হইয়াছে। আর নাগরী অক্ষর বাংলা অপেক্ষা প্রাচীন নহে; অর্থাৎ দশম শতাব্দীতে বাংলা দেশে ব্যবহৃত অক্ষরের সহিত বর্ত্তমান বাংলা অক্ষরের যে সম্বন্ধ, ঐ সময়ে পশ্চিম ভারতে ব্যবহৃত অক্ষরের সহিত বর্ত্তমান নাগরী অক্ষরের সম্বন্ধ তদপেক্ষা অধিকতর ঘনিষ্ঠ নহে।