সপ্তম পরিচ্ছেদ –পালসাম্রাজ্যের পতন
দেবপালের মৃত্যুর পর তিনশত বৎসর পর্য্যন্ত পালরাজবংশের ইতিহাস কবি-বর্ণিত “পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায়” অগ্রসর হইয়াছিল। উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে চারিশত বৎসরকাল অতিবাহিত করিয়া অবশেষে এই প্রসিদ্ধ রাজ্য ও রাজবংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ইহাই স্বাভাবিককালের গতি। বরং এত সুদীর্ঘকাল রাজত্বের দৃষ্টান্ত আৰ্য্যাবর্তের ইতিহাসে অতি বিরল, নাই বলিলেও চলে।
দেবপালের মৃত্যুর পর বিগ্রহপাল সিংহাসনে আরোহণ করেন। দেবপাল ও বিগ্রহপালের সম্বন্ধ লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কাহারও মতে বিগ্রহপাল দেবপালের পুত্র। কিন্তু অধিকাংশ পণ্ডিতগণই মনে করেন যে বিগ্রহপাল ধৰ্ম্মপালের ভ্রাতা বাপালের পৌত্র ও জয়পালের পুত্র। এই মতই সমীচীন বলিয়া বোধ হয় এবং বিগ্রহপালের পুত্র নারায়ণপালের তাম্রশাসনে পালরাজগণের যে বংশাবলী বিবৃত হইয়াছে তাহাও এই মতের সমর্থন করে। ইহাতে তৃতীয় শ্লোকে ধর্ম্মপালের বর্ণনার পরে চতুর্থ শ্লোকে তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা বাপালের ও পঞ্চম শ্লোকে তাঁহার পুত্র জয়পালের উল্লেখ আছে। এই শ্লোকে কথিত হইয়াছে যে জয়পাল ধর্ম্মদ্বেষিগণকে যুদ্ধে বশীভূত করিয়া পূৰ্ব্বজ দেবপালকে ভুবনরাজ্যসুখের অধিকারী করিয়া দিয়াছিলেন। পরবর্ত্তী ষষ্ঠ শ্লোকে জয়পাল কর্ত্তৃক উকল ও কামরূপ জয় বর্ণিত হইয়াছে। সপ্তম শ্লোকে বলা হইয়াছে তাঁহার অজাতশত্রুর ন্যায় বিগ্রহপাল নামক পুত্র জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। সংস্কৃতি রচনানীতি অনুসারে তাঁহার এই সর্বনাম শব্দ নিকটবর্ত্তী বিশেষ্য পদকেই সূচিত করে। সুতরাং পঞ্চম ও সপ্তম শ্লোকের ‘তাঁহার’ এই সর্বনাম শব্দ যথাক্রমে বাপাল ও জয়পাল সম্বন্ধে প্রযুক্ত হইয়াছে ইহাই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। অতএব বাপালের পুত্রই যে জয়পাল, এবং জয়পালের পুত্র বিগ্রহপাল, উক্ত দুই শ্লোক হইতে এইরূপ সিদ্ধান্ত হয়। অপর পক্ষ বলেন যে, দেবপাল জয়পালের পূৰ্ব্বজ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন, সুতরাং জয়পাল দেবপালের কনিষ্ঠ সহোদর অর্থাৎ ধর্ম্মপালের পুত্র। অতএব পঞ্চম ও সপ্তম শ্লোকের ‘তাঁহার’ এই সৰ্ব্বনাম শব্দ যথাক্রমে ধর্ম্মপাল ও দেবপালের সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। এই যুক্তি সঙ্গত বলিয়া মনে হয় না, কারণ পূৰ্ব্বজ শব্দে কেবল জ্যেষ্ঠ বুঝায়, জ্যেষ্ঠ সহোদর অর্থ গ্রহণ করিতে হইবে এমন কোনো কথা নাই। অপর পক্ষে ইহাও বিবেচ্য যে ধর্ম্মপাল বা দেবপালের তাম্রশাসনে বাপালের বা জয়পালের কোনো উল্লেখ নাই, সহসা নারায়ণপালের তাম্রশাসনে তাঁহাদের এই গুণ-ব্যাখ্যানের হেতু কী? ইহার একমাত্র সঙ্গত কারণ এই মনে হয় যে বিগ্রহপাল ও তাঁহার বংশধরগণ দেবপালের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারী ছিলেন না, সুতরাং তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষগণের কৃতিত্ব দ্বারাই তাঁহাদের সিংহাসন অধিকারের সমর্থন করার প্রয়োজন ছিল। অন্যথা তিন পুরুষ পরে এই প্রাচীন কীর্তিগাথা উদ্ধারের আর কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না।
দেবপালের কোনো পুত্র না থাকায় বিগ্রহপাল পিতৃব্যের সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন ইহা খুব সম্ভব বলিয়া মনে হয় না, কারণ দেবপালের রাজ্যের ৩৩ বর্ষে অর্থাৎ তাঁহার মৃত্যুর অনধিকাল পূর্ব্বের উৎকীর্ণ একখানি তাম্রশাসনে তাঁহার পুত্র রাজ্যপালের যৌবরাজ্যে অভিষেকের উল্লেখ আছে। অবশ্য পিতার জীবিতকালেই রাজ্যপালের মৃত্যু হইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু ইহাও অসম্ভব নহে যে সেনাপতি জয়পাল বৃদ্ধ রাজা দেবপালের মৃত্যুর পর অনুগত সৈন্যবলের সাহায্যে নিজের পুত্রকেই সিংহাসনে বসাইয়াছিলেন। দেবপালের মৃত্যুর পরই যে পালরাজ্য ধ্বংসোন্মুখ হইয়াছিল হয়তো এই গৃহবিবাদই তাঁহার পথ প্রশস্ত করিয়া দিয়াছিল। কিন্তু এ সম্বন্ধে উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।
বিগ্রহপাল শূরপাল নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি শান্তিপ্রিয় ও সংসারবিরাগী ছিলেন। অল্পকাল (আ ৮৫০-৮৫৪) রাজ্য করিয়াই তিনি পুত্র নারায়ণপালের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ করিয়া বানপ্রস্থ অবলম্বন করেন। নারায়ণপাল সুদীর্ঘকাল রাজত্ব করেন (আ ৮৫৪-৯০৮)। তাঁহার ৫৪ রাজ্যসংবৎসরের একখানি লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। তিনিও পিতার ন্যায় উদ্যমহীন শান্তিপ্রিয় ছিলেন। কেদারমিশ্রের পুত্র গুরবমিশ্র তাঁহার মন্ত্রী ছিলেন। এই গুরবমিশ্রের লিপিতে ধর্ম্মপাল ও দেবপালের অনেক রাজ্যজয়ের উল্লেখ আছে। কিন্তু বিগ্রহপাল ও নারায়ণপাল সম্বন্ধে সেরূপ কোনো উক্তি নাই। রাজা শূরপাল সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে যে তিনি কেদারমিশ্রের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইয়া অনেকবার শ্রদ্ধাবনতশিরে পবিত্র শান্তিবারি গ্রহণ করিয়াছিলেন।
ধর্ম্মপাল ও দেবপাল বাহুবলে যে বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন যজ্ঞের শান্তিবারি বা তপস্যা দ্বারা তাহা রক্ষা করা সম্ভবপর ছিল না। সুতরাং বিগ্রহপাল ও নারায়ণপালের অর্দ্ধশতাব্দীর অধিককালব্যাপী রাজ্যকালে বিশাল পালসাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হইয়া গেল, এমনকি বিহার ও বাংলা দেশের কোনো কোনো অংশও বহিঃশত্রু কর্ত্তৃক অধিকৃত হইল।
রাষ্ট্রকূটরাজ অমোঘবর্ষের লিপিতে উক্ত হইয়াছে যে অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধের অধিপতি তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন। আ ৮৬০ অব্দে অমোঘবর্ষ কৃষ্ণা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্ত্তী বেঙ্গি দেশ জয় করেন। সম্ভবত ইহার অনতিকাল পরেই তিনি পালরাজ্য আক্রমণ করেন। অঙ্গ বঙ্গ ও মগধের পৃথক উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় যে এগুলি তখন পৃথক স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল-কিন্তু এ অনুমান সত্য না-ও হইতে পারে। সম্ভবত পালরাজ পরাজিত হইয়াছিলেন-কিন্তু রাষ্ট্রকূটরাজ যে স্থায়ীভাবে এ দেশের কোনো অংশ অধিকার করিয়াছিলেন তাহা মনে হয় না। তবে এই পরাজয়ে পালরাজগণের খ্যাতি ও প্রতিপত্তির অনেক লাঘব হইয়াছিল এবং সম্ভবত এই সুযোগে উড়িষ্যার শুক্তিবংশীয় মহারাজাধিরাজ রণস্তম্ভ রাঢ়ের কিয়দংশ অধিকার করেন।
পালরাজ যখন এইরূপে দক্ষিণ দিক হইতে আগত শত্রুর আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত তখন প্রতীহাররাজ ভোজ পুনরায় আৰ্য্যাবর্তে স্বীয় প্রাধান্য স্থাপনের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। যত দিন দেবপাল জীবিত ছিলেন তত দিন তাঁহার চেষ্টা ফলবতী হয় নাই। কিন্তু নারায়ণপালের ন্যায় দুৰ্বল রাজার পক্ষে ভোজের গতিরোধ করা সম্ভবপর হইল না। ভোজ কলচুরি ও গুহিলোট রাজগণের সহায়তায় নারায়ণপালকে গুরুতররূপে পরাজিত করিলেন। পালসাম্রাজ্যের ধ্বংসের উপর প্রতীহার রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হইল। ভোজের পুত্র মহেন্দ্রপাল পুনরায় পালরাজ্য আক্রমণ করিয়া বিহার প্রদেশ অধিকার করেন। তারপর অগ্রসর হইয়া ক্রমে তিনি উত্তর বাংলায় স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করিলেন। বাংলা ও বিহারে মহেন্দ্রপালের যে সমুদয় লিপি পাওয়া গিয়াছে তাহাদের তারিখ ৮৮৭ হইতে ৯০৪ অব্দের মধ্যে। কলচুরিরাজ কোক্কলুও সম্ভবত এই সময়ে বঙ্গ আক্রমণ করিয়া ইহার ধনরত্ন লুণ্ঠন করেন।
এইরূপে নবম শতাব্দের শেষভাবে কেবলমাত্র আর্য্যাবর্তের বিস্তৃত সাম্রাজ্য নহে, পালরাজগণের নিজ রাজ্যও শত্রুর করতলগত হইল। নারায়ণপালের অক্ষমতা ব্যতীত হয়তো এইরূপ শোচনীয় পরিণামের অন্য কারণও বিদ্যমান ছিল। দেবপালের মৃত্যুর পর পালরাজবংশের গৃহবিবাদের কথা পূর্ব্বেই আলোচিত হইয়াছে। রাষ্ট্রকূটরাজ দ্বিতীয় কৃষ্ণ (আ ৮৮০-৯১৪) পালরাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন। বিজিত কামরূপ ও উৎকলের রাজগণ এই সময়ে প্রবল হইয়া ওঠেন এবং সম্ভবত তাঁহাদের সহিতও নারায়ণপালের সংগ্রাম হইয়াছিল। এইরূপে আভ্যন্তরিক কলহ ও চতুর্দিকে বহিঃশত্রুর আক্রমণে পালরাজ্যের দুর্দশা চরমে পৌঁছিয়াছিল।
পালরাজগণ আৰ্য্যাবর্ত্ত ও দাক্ষিণাত্যের দুইটি প্রবল রাজবংশের সহিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইয়া নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিগ্রহপাল কলচুর অথবা হৈহয় রাজবংশের কন্যা লজ্জাদেবীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও কলচুরিগণ নারায়ণপালের শত্রুপক্ষে যোগদান করিয়াছিল।
নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপাল রাষ্ট্রকৃটরাজ তুঙ্গের কন্যা ভাগ্যদেবীকে বিবাহ করেন। এই তুঙ্গ সম্ভবত দ্বিতীয় কৃষ্ণের পুত্র জগঙ্গ। এই বিবাহের ফলে পালরাজগণের কিছু সুবিধা হইয়াছিল কি না জানা যায় না। কিন্তু নারায়ণপালের সুদীর্ঘ রাজ্যের শেষে তিনি প্রতীহারগণকে দূর করিয়া পুনরায় বিহার ও বাংলায় স্বীয় প্রাধান্য স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
নারায়ণপালের মৃত্যুর পর যথাক্রমে তাঁহার পুত্র রাজ্যপাল (আ ৯০৮ ৯৪০) ও তৎপুত্র দ্বিতীয় গোপাল (আ ৯৪০-৯৬০) রাজত্ব করেন। পালরাজগণের সভাকবি লিখিয়াছেন যে রাজ্যপাল সমুদ্রের ন্যায় গভীর জলাশয় খনন ও পৰ্ব্বতের তুল্য উচ্চ মন্দির নির্মাণ করিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি রাজ্যপাল ও গোপালের কোনোরূপ বিজয়কাহিনীর উল্লেখ করেন নাই। রাজ্যপাল সম্ভবত নিরুদ্বেগে রাজত্ব করিতে পারিয়াছিলেন। কারণ তাঁহার রাজ্যের প্রারম্ভেই চিরশত্রু প্রতীহাররাজ রাষ্ট্রকূটরাজ ইন্দ্র কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিল। ইন্দ্র প্রতীহার রাজধানী কান্যকুব্জ অধিকার করিয়া লুণ্ঠন করিয়াছিল এবং প্রতীহাররাজ মহীপাল পলাইয়া কোনোমতে প্রাণ রক্ষা করিয়াছিলেন। এই নিদারুণ বিপর্যয়ের ফলে প্রতীহার রাজ্য ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইল এবং পালরাজগণও অনেকটা নিরাপদ হইলেন।
কিন্তু শীঘ্রই অন্য শত্রুর আবির্ভাব হইল। পাল ও প্রতীহার সাম্রাজ্যের পতনের পরে আর্য্যাবর্তে নূতন নূতন রাজশক্তির উদয় হইল এবং ইহারা অনেকেই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাল, প্রতীহার ও অন্যান্য রাজ্যের সহিত যুদ্ধে লিপ্ত হইল। এইরূপে সর্বপ্রথমে মধ্যভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলে চন্দ্রাত্রেয় বা চল্লে রাজ্য প্রবল হইয়া ওঠে। চন্দেল্লরাজ যশোবৰ্মণ প্রসিদ্ধ কালঞ্জয় গিরিদুর্গ অধিকার করিয়া আৰ্য্যাবর্তে প্রাধান্য লাভ করেন এবং তাঁহার বিজয়বাহিনী কাশ্মীর হইতে বাংলা দেশ পর্য্যন্ত যুদ্ধাভিযান করে। চন্দেল্লরাজের সভাকবি লিখিয়াছেন যে যশোবর্ম্মণ গৌড়দিগকে উদ্যানলতার ন্যায় অবলীলাক্রমে অসি দ্বারা ছেদন করিয়াছিলেন এবং তাঁহার পুত্র ধঙ্গ (আ ৯৫৪-১০০০) রাঢ়া ও অঙ্গদেশের রাণীকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন। এই সমুদয় শ্লেষোক্তি নিছক সত্য না হইলেও পালরাজগণ চন্দেল্লরাজ কর্ত্তৃক পরাজিত হইয়াছিলেন ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। চন্দেল্লগণের ন্যায় কলচুরি রাজগণও দশ শতাব্দের মধ্যভাগে আর্য্যাবর্তে নানা দেশ আক্রমণ করেন। কলচুরিরাজ প্রথম যুবরাজ ও তাঁহার পুত্র লক্ষ্মণরাজ যথাক্রমে গৌড় ও বঙ্গাল দেশ জয় করেন বলিয়া তাহাদের সভাকবি বর্ণনা করিয়াছেন।
এই সমুদয় আক্রমণের ফলে পালরাজগণ ক্রমেই শক্তিহীন হইয়া পড়িলেন এবং বাংলা দেশের বিভিন্ন অংশে স্বাধীন খণ্ডরাজ্যের উদ্ভব হইল। চন্দেল্ল ও কলচুরি রাজবংশের সভাকবিরা যে অঙ্গ, রাঢ়া, গৌড় ও বঙ্গাল প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহা সম্ভবত এইরূপ পৃথক পৃথক স্বাধীন রাজ্যের সূচনা করে। কিন্তু ইহার অন্যবিধ প্রমাণও আছে।
দ্বিতীয় গোপালের পুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল আ ৯৬০ হইতে ৯৮৮ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। তাঁহার পুত্র মহীপালের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তিনি (মহীপাল) অনধিকারী কর্ত্তৃক বিলুপ্ত পিতৃরাজ্যের উদ্ধার সাধন করেন। সুতরাং দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালেই পালগণের পৈত্রিক রাজ্যের বিলোপ হইয়াছিল। উত্তরবঙ্গের একখানি শিলালিপি ও পশ্চিমবঙ্গের একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, এই সময়ে এই দুই প্রদেশে কাম্বোজবংশীয় রাজগণ রাজত্ব করিতেন। সুতরাং এই কাম্বোজ রাজগণই যে মহীপালের তাম্ৰশাসনোক্ত ‘অনধিকারী’ তাহা নিঃসন্দেহে স্বীকার করা যায়।
বাংলার এই কাম্বোজ রাজবংশের উৎপত্তি গভীর রহস্যে আবৃত। ইহার প্রতিষ্ঠাতা মহারাজাধিরাজ রাজ্যপাল কামোজ-বংশ-তিলক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। তাঁহার রাণীর নাম ভাগ্যদেবী। তাঁহার পর তাঁহার দুই পুত্র নারায়ণপাল ও নয়পাল যথাক্রমে পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। প্রিয় নামক নগরে নয়পালের রাজধানী ছিল।
বাংলার পালসম্রাট নারায়ণপালের পুত্র রাজ্যপালের কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। তাঁহার রাণীর নামও ভাগ্যদেবী। এইরূপ নামসাদৃশ্য হইতে এই দুই রাজ্যপালকে অভিন্ন মনে করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু তাহা হইলে ‘কাম্বোজবংশ তিলক’ এই উপাধির সার্থকতা কী? কেহ কেহ অনুমান করেন যে পালসম্রাট রাজ্যপালের মাতা সম্ভবত কাম্বোজবংশীয়া রাজকন্যা ছিলেন এবং সেই জন্যই রাজ্যপাল কাম্বোজবংশ-তিলক বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন। এরূপ মাতৃবংশ দ্বারা পরিচয়ের দৃষ্টান্ত অন্যান্য রাজবংশের ইতিহাসেও পাওয়া যায়। এই দুই রাজ্যপালের অভিন্নতা মানিয়া লইলে এই সিদ্ধান্ত করিতে হয় যে তাঁহার মৃত্যুর পর রাজ্যের এক অংশে (অঙ্গ ও মগধে) তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় গোপাল ও তৎপুত্র দ্বিতীয় বিগ্রহপাল ও অন্য অংশে (উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গে) তাঁহার দুই পুত্র নারায়ণপাল ও নয়পাল যথাক্রমে রাজত্ব করেন। অন্যথা স্বীকার করিতে হয় যে রাজ্যপাল নামক কাম্বোজবংশীয় এক ব্যক্তি কোনো উপায়ে পালরাজগণের হস্ত হইতে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ অধিকার করিয়া একটি স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেন।
ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে কামোজ জাতির আদি বাসস্থল। এই সুদূর দেশ হইতে আসিয়া কামোজ জাতি বাংলা দেশ জয় করিয়াছিল ইহা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয় না। তিব্বতীয়েরা কোনো কোনো গ্রন্থে কাম্বোজ নামে অভিহিত হইয়াছে এবং কোনো কোনো তিব্বতীয় গ্রন্থে লুসাই পৰ্ব্বতের নিকটবর্ত্তী বঙ্গ ও ব্রহ্মদেশের সীমান্ত প্রদেশে অবস্থিত কাম্বোজ জাতির উল্লেখ পাওয়া যায়। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, যে কামোজ জাতি বাংলা দেশ জয় করিয়াছিল তাহা এ দুয়ের অন্যতম। কিন্তু কাম্বোজ জাতি যে বাংলা দেশ আক্রমণ করিয়া জয় করিয়াছিল এরূপ স্থির সিদ্ধান্ত করিবার কোনো কারণ নাই। পালরাজগণ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হইতে সৈন্য সংগ্রহ করিতেন। দেবপালের লিপি হইতে জানা যায় যে, কাম্বোজ দেশ হইতে পালরাজগণের যুদ্ধ-অশ্ব সংগৃহীত হইত। সুতরাং অসম্ভব নহে যে কামোজদেশীয় রাজ্যপাল পালরাজাগণের অধীনে সৈন্য অথবা অন্য কোনো বিভাগে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং পালরাজগণের দুর্বলতার সুযোগে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। যে উপায়েই কাম্বোজ রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হউক, দশম শতাব্দের মধ্যভাগে যে তাঁহাদের অধীনে উত্তর ও পশ্চিমবঙ্গ একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।
বাংলার অন্যান্য অঞ্চলেও কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল। মহারাজাধিরাজ কান্তিদেব হরিকেলে রাজত্ব করিতেন এবং তাঁহার রাজধানীর অথবা এক প্রধান নগরীর নাম ছিল বর্দ্ধমানপুর। হরিকেল বলিতে সাধারণত পূৰ্ব্ববঙ্গ বুঝায় কিন্তু ইহা বঙ্গের নামান্তররূপেও ব্যবহৃত হইয়াছে। সুতরাং কান্তি দেবের রাজ্য কোথায় এবং কত দূর বিস্তৃত ছিল বলা যায় না। যদি বর্দ্ধমানপুর সুপরিচিত বর্দ্ধমান নগরী হয় তাহা হইলে বলিতে হইবে যে কান্তিদেবের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও বিস্তৃত ছিল। কান্তিদেব বিন্দুরতি নাম্নী এক শক্তিশালী রাজার কন্যা বিবাহ করিয়াছিলেন এবং সম্ভবত ইহাই তাঁহার সৌভাগ্যের মূল। কারণ তাঁহার পিতা বা পিতামহ রাজা ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। কান্তিদেব কোন সময়ে রাজত্ব করিয়াছিলেন তাহা সঠিক নির্ণয় করা যায় না। খুব সম্ভবত দেবপালের পরবর্ত্তী দুৰ্বল পালরাজগণের সময়েই তিনি পূর্ব্ববঙ্গে স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। পরে দক্ষিণ বাংলা ও সম্ভবত পশ্চিম বাংলার কিয়দংশও অধিকার করেন। দশম শতাব্দী হইতে যে বঙ্গাল রাজ্যের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় সম্ভবত কান্তিদেবই তাঁহার পত্তন করেন। কান্তিদেব বৌদ্ধ ছিলেন। তাঁহার বংশধরগণের সম্বন্ধে এ পৰ্য্যন্ত কিছুই জানা যায় নাই।
কান্তিদেবের অনতিকাল পরেই লয়হচন্দ্রদেব কুমিল্লা অঞ্চলে রাজত্ব করেন। তাঁহার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। কিন্তু চন্দ্ৰ উপাধিধারী এক বৌদ্ধ রাজবংশ দশম শতাব্দের শেষভাগে হরিকেলে রাজত্ব করিতেন। চন্দ্রদ্বীপ তাঁহাদের রাজ্যভুক্ত ছিল এবং সম্ভবত রাজবংশের উপাধি হইতেই এই নামকরণ হইয়াছিল। লামা তারনাথ চন্দ্রবংশীয় রাজাদের বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন কিন্তু তাঁহার মতে এই সকল রাজাই পালরাজগণের পূর্ব্ববর্ত্তী ছিলেন। দশম শতাব্দীতে বাংলায় যে চন্দ্রবংশ রাজত্ব করিতেন তাঁহাদের সহিত তারনাথ বর্ণিত চন্দ্রবংশের অথবা আরাকানে চন্দ্ৰ উপাধিধারী যে সমুদয় রাজগণ রাজত্ব করিয়াছেন তাহাদের কোনো সম্বন্ধ ছিল কি না তাহা অদ্যাবধি নির্ণীত হয় নাই। আলোচ্য চন্দ্রবংশের মাত্র দুইজন রাজার নাম এ পর্য্যন্ত জানা গিয়াছে–মহারাজাধিরাজ ত্রৈলোক্যচন্দ্র ও তাঁহার পুত্র মহারাজাধিরাজ শ্রীচন্দ্র। ত্রৈলোক্যচন্দ্রের পিতা সুবর্ণচন্দ্র ও পিতামহ পূর্ণচন্দ্রের সম্বন্ধে আমরা কেবলমাত্র এইটুকু জানি যে তাঁহারা অথবা তাহাদের পূর্ব্বপুরুষগণ রোহিতাগিরিতে রাজত্ব করিতেন। ত্রৈলোক্যচন্দ্ৰই প্রথমে হরিকেলে ও চন্দ্রদ্বীপে একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। রোহিতাগিরি কোথায় ছিল ঠিক বলা যায় না। কেহ কেহ মনে করেন যে ইহাই বর্ত্তমানে রোটা গড় নামে পরিচিত। আবার কাহারও মতে কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী লালমাই অথবা লালমাটি সংস্কৃত রোহিতাগিরিতে পরিণত হইয়াছে। চন্দ্রবংশের আদিম নিবাস পূর্ব্ববঙ্গে ছিল ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়। এই পর্য্যন্ত এ বংশের যে পাঁচখানি তাম্রশাসন পাওয়া গিয়াছে তাহা বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার হইতে প্রদত্ত। সুতরাং বিক্রমপুর তাঁহাদের রাজধানী ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। বাংলার ইতিহাস প্রসিদ্ধ রাজধানী বিক্রমপুর সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজারাই প্রতিষ্ঠা করেন। প্রাচীনকালে বঙ্গ ও বঙ্গাল বলিলে যে দেশ বুঝাইত ত্রৈলোক্যচন্দ্র ও শ্রীচন্দ্র তাঁহার রাজা ছিলেন। শ্রীচন্দ্র অন্তত ৪৪ বৎসর রাজত্ব করেন। সম্ভবত তাঁহার রাজ্যকালেই কলচুরিরাজ লক্ষ্মণরাজ বঙ্গাল দেশ আক্রমণ করেন।
একাদশ শতাব্দের প্রারম্ভে গোবিন্দচন্দ্র দক্ষিণ ও পূৰ্ব্ববঙ্গে রাজত্ব করিতেন। চোলরাজ রাজেন্দ্ৰচোলের লিপিতে তিনি বঙ্গাল দেশের রাজা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন, কিন্তু বিক্রমপুরেও তাঁহার দ্বাদশ ও এয়োবিংশ রাজ্যাব্দের দুইখানি লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। গোবিন্দচন্দ্র সম্ভবত চন্দ্রবংশীয় রাজা, কিন্তু শ্রীচন্দ্রের সহিত তাঁহার কী সম্বন্ধ ছিল তাহা জানা যায় নাই।
উল্লিখিত আলোচনা হইতে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে দ্বিতীয় গোপাল ও দ্বিতীয় বিগ্রহপালের রাজ্যকালে পালরাজ্য তিনটি প্রধান ভাগে বিভক্ত হইয়াছিল। পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণবঙ্গ অর্থাৎ বঙ্গ ও বঙ্গাল দেশে চন্দ্রবংশীয় রাজ্য, পশ্চিম ও উত্তরবঙ্গ অর্থাৎ রাঢ়া ও বরেন্দ্রে অথবা গৌড়ে কাম্বোজবংশীয় রাজ্য, এবং বিহার অর্থাৎ অঙ্গ ও মগধে পালবংশীয় রাজ্য। এতদ্ব্যতীত পশ্চিমবঙ্গে আরও দু-একটি ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য ছিল, তাহা পরে আলোচিত হইবে। এই সময় পালরাজগণের পিতৃভূমি বিশাল বাংলা দেশে তাঁহাদের কোনো প্রকার অধিকার ছিল বলিয়া মনে হয় না।
চন্দ্রেল্ল ও কলচুরি রাজগণের প্রশস্তিতে যে বঙ্গ, বঙ্গাল, গৌড়, রাঢ়া, অঙ্গ প্রভৃতি রাজ্য জয়ের উল্লেখ আছে তাহা খুব সম্ভবত এই সমুদয় স্বাধীন খণ্ডরাজ্যের প্রতি প্রযোজ্য।