সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
প্রথম খণ্ড-ধৰ্ম্মমত
১. আৰ্য্যধর্ম্মের প্রতিষ্ঠা
আৰ্যগণের সংস্পর্শে ও প্রভাবে তাঁহাদের ধর্ম্মগত ও সামাজিক রীতিনীতি ক্রমে ক্রমে বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। খৃষ্টপূৰ্ব চতুর্থ শতাব্দের শেষ ভাগে যখন আলেকজাণ্ডার ভারত আক্রমণ করিয়াছিলেন তখন গঙ্গাসাগরসঙ্গম হইতে পঞ্চনদের পূৰ্ব্বসীমা পর্য্যন্ত ভূভাগ এক অখণ্ড বিরাট রাজ্যের অধীন ছিল। সুতরাং এই সময়ে যে বাংলায় আৰ্যপ্রভাব বিস্তৃত হইয়াছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। বৌধায়ন-ধৰ্ম্মসূত্র প্রভৃতি গ্রন্থ হইতে প্রমাণিত হয় যে তখনো বাংলা দেশে আৰ্য সভ্যতা বিস্তৃত হয় নাই। সুতরাং খৃষ্টপূর্ব্ব ষষ্ঠ ও চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে আৰ্য সভ্যতা বাংলায় প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে।
ইহার পূর্ব্বে যাঁহারা বাংলায় বাস করিতেন, তাঁহাদের ধর্ম্মমত কিরূপ ছিল তাহা জানিবার উপায় নাই। কারণ ঐতিহাসিক যুগে তাহারা সকলেই বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য প্রভৃতি আৰ্য্যগণের ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। তবে ইহা খুবই সম্ভব যে তাঁহাদের প্রাচীন ধর্ম্মমত, সংস্কার, পূজাপদ্ধতি প্রভৃতি রূপান্তরিত হইয়া আৰ্য্য ধৰ্ম্মের সহিত মিশিয়া গিয়াছে। ভারতবর্ষে ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের যে গুরুতর প্রভেদ দেখা যায়, সম্ভবত প্রাচীন অধিবাসীগণের ধর্ম্ম ও সংস্কারের প্রভাব তাঁহার অন্যতম কারণ। বর্ত্তমানকালে বাংলায় ও ভারতের অন্যান্য দেশে প্রচলিত ধর্ম্ম অনুষ্ঠানের মধ্যে অনেক প্রভেদ দেখা যায়। অসম্ভব নহে যে ইহা অন্তত কতকাংশে বাংলার প্রাচীন অধিবাসীদিগের আচার-অনুষ্ঠানের প্রভাবের ফল। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলেও প্রাচীন বাঙ্গালীর ধর্ম্মমত সম্বন্ধে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা করা যায় না। সুতরাং বাংলায় আৰ্য্য ধর্ম্মের প্রতিষ্ঠার পূর্ব্বে যে ধর্ম্ম প্রচলিত ছিল তাঁহার কোনো বিবরণ দেওয়া সম্ভবপর নহে। আর্য্য সভ্যতার প্রভাবে খুব প্রাচীনকালেই বাংলায় বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্ম প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। কিন্তু গুপ্তযুগের অর্থাৎ খৃষ্টীয় চতুর্থ কি পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব্বে বাংলার এই সমুদয় ধৰ্ম্ম সম্বন্ধে বিস্তৃত কোনো বিবরণ জানিবার উপায় নাই।
.
২. বৈদিক ধর্ম্ম
গুপ্তযুগের তাম্রশাসনগুলি হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে বৈদিক যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়া বাংলায় বহুল পরিমাণে অনুষ্ঠিত হইত। এই সমুদয় তাম্রশাসনে অগ্নিহোত্র ও পঞ্চ মহাযজ্ঞ প্রভৃতি অনুষ্ঠান এবং মন্দির নির্মাণ ও দেব-দেবীর পূজার ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্রাহ্মণদিগকে ভূমিদানের উল্লেখ আছে। এই সমুদয় ব্রাহ্মণদিগের পরিচয় প্রসঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে যে তাঁহারা ঋক, যজু অথবা সামবেদ অধ্যয়ন করিতেন। ভূমিদান করিয়া ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠা করা বিশেষ পুণ্যের কাৰ্য্য বলিয়া বিবেচিত হইত এবং একখানি তাম্রশাসনে বাংলার পূর্ব্ব সীমান্তে ব্যাঘ্রাদি হিংস্র জন্তুসমাকুল নিবিড় অরণ্য প্রদেশেও মন্দির নির্মাণ এবং বহুসংখ্যক বেদজ্ঞ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ আছে। উত্তরে হিমালয় শিখরেও মন্দির নির্ম্মিত হইত। সুতরাং সমস্ত বাংলা দেশেই যে গুপ্তযুগে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মের, বিশেষত বৈদিক অনুষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা হইয়াছিল যে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কামরূপরাজ ভাস্করবর্ম্মার নিধানপুরে প্রাপ্ত তাম্রশাসনে শ্রীহট্ট অঞ্চলে খৃষ্টীয় ষষ্ট শতাব্দীতে ভূমিদানপূর্ব্বক ২০০৫ জন ব্রাহ্মণের প্রতিষ্ঠার কথা লিখিত আছে। এই ব্রাহ্মণগণের বিভিন্ন বৈদিক শাখা ও গোত্রের নামও উল্লিখিত হইয়াছে। রাতবংশীয় রাজগণের সময়েও কুমিল্লা অঞ্চলে বহু ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করা হইয়াছিল।
পালরাজগণের তাম্রশাসনেও বেদ, বেদাঙ্গ, মীমাংসা প্রভৃতিতে ব্যুৎপন্ন এবং বৈদিক যজ্ঞাদি অনুষ্ঠানে অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণ বংশের বহু উল্লেখ পাওয়া যায়। বৰ্ম ও সেনরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় বৈদিক ধর্ম্ম বাংলায় আরও প্রসার লাভ করে। ভট্টভবদেবের প্রশস্তিতে বেদবিদ, সাবর্ণ গোত্র ব্রাহ্মণ-অধ্যুষিত শত গ্রামের উল্লেখ আছে। বৰ্ম্মরাজগণ বৈদিক ধর্ম্মের রক্ষক বলিয়া তাম্রশাসনে অভিহিত হইয়াছেন। ব্রহ্মবাদী সামন্তসেন শেষ বয়সে যজ্ঞধূমে পরিপূর্ণ গঙ্গাতীরস্থিত পবিত্র ঋষির আশ্রমে বাস করিতেন। সমসাময়িক লিপির এই সমুদয় উক্তি হইতে প্রমাণিত হয় যে গুপ্তযুগ হইতে হিন্দু যুগের শেষ পর্য্যন্ত বাংলায় বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান হইত। সেনযুগে রচিত কয়েকখানি গ্রন্থও এই অনুমানের সমর্থন করে।
তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, মধ্যদেশ হইতে আসিয়া কোনো কোনো বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ বাংলা দেশে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। ইহা হইতে এরূপ মনে করিবার কারণ নাই যে বাংলা দেশে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের অভাব ছিল। কারণ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ভারতবর্ষের এক প্রদেশ হইতে অন্য প্রদেশে যাইয়া বাস স্থাপন করিয়াছেন, এরূপ বহু দৃষ্টান্ত তাম্রশাসন হইতে জানা যায়। বাংলা দেশ হইতে বহু বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের দেশান্তরে গমনের কথা তাম্রশাসনে পাওয়া যায়। এদেশে একটি জনশ্রুতি বিশেষভাবে প্রচলিত আছে যে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের অভাব হওয়ায় রাজা আদিশূর কান্যকুব্জ হইতে যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন, বাংলার রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ, অর্থাৎ বৈদিক প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র সম্প্রদায় ব্যতীত প্রায় সকল ব্রাহ্মণই, তাঁহাদের বংশসম্ভূত। পূৰ্ব্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহা এই মতের সম্পূর্ণ বিরোধী, এবং বাংলায় যে গুপ্তযুগের পরবর্ত্তী কোনোকালে বৈদিক অনুষ্ঠানে অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণের একেবারে অভাব ছিল, এরূপ মনে করিবার কারণ নাই। তবে হয়তো ভারতবর্ষের অন্য কোনো কোনো প্রদেশের তুলনায় বাংলায় বৈদিক চর্চ্চা খুবই কম হইত। পালযুগে বহুশতাব্দী পর্য্যন্ত বৌদ্ধধর্ম্মের প্রভাবের কথা স্মরণ করিলে ইহাই খুব সম্ভব বলিয়া মনে হয়।
কুলশাস্ত্রমতে যে রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ বৈদিক অনুষ্ঠানের জন্য এদেশে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, পণ্ডিতপ্রবর হলায়ূধ স্পষ্টত তাঁহাদেরই বৈদিক জ্ঞানের অভাবের উল্লেখ করিয়াছেন। হলায়ুধের উক্তি হইতে প্রমাণিত হয় যে (সম্ভবত অন্য প্রদেশের তুলনায়) তাঁহার কালে বাংলায় বৈদিক জ্ঞানের খুব প্রসার ছিল না, এবং কোনো কোনো শ্রেণীর ব্রাহ্মণের এ বিষয়ে যথেষ্ট শৈথিল্য ছিল। কিন্তু তাঁহার সময়েও যে বাংলায় বেদের পঠনপাঠন ও বৈদিক অনুষ্ঠান বিশেষভাবেই প্রচলিত ছিল তাঁহার নিজের জীবনী এবং অন্যান্য গ্রন্থ হইতে তাহা স্পষ্ট প্রমাণিত হয়।
.
৩. পৌরাণিক ধৰ্ম্ম
ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় গুপ্তযুগে বাংলায় পৌরাণিক ধৰ্ম্মের যথেষ্ট প্রসার ছিল। বাংলায় যে সমুদয় তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাতে অনেক পৌরাণিক দেব-দেবী ও তাঁহাদের বহু আখ্যান পাওয়া যায়। দেবরাজ ইন্দ্র অথবা পুরন্দর, এবং দৈত্যরাজ বলির হস্তে তাঁহার পরাজয়; বিষ্ণু (হরি, মুরারি), লক্ষ্মী এবং তাঁহাদের বাহন গরুড়; বিষ্ণুর নাভিকমল হইতে ব্রহ্মার উৎপত্তি, সত্যযুগে বলি এবং দ্বাপরে কর্ণের দানশীলতা; অগস্ত্য কর্ত্তৃক সমুদ্রপান; পরশুরাম কর্ত্তৃক ক্ষত্রিয়কুল সংহার; রামচন্দ্রের বীরত্ব; পৃথু, সগর, নল, ধনঞ্জয়, যযাতি ও অম্বরীষ প্রভৃতির কাহিনী,-এই সমুদয় তাম্রশাসনে পুনঃপুন উল্লিখিত হইয়াছে।
বাংলায় যে বৈষ্ণব ও শৈবধর্ম্মের বিশেষ প্রসার ছিল তাহাও এই সমুদয় তাম্রশাসন হইতে জানা যায়। ভাগবত সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা বিষ্ণু কৃষ্ণে রূপান্তরিত হইয়াছেন। কৃষ্ণের জন্ম ও বাল্যলীলা, বিশেষত গোপীদিগের সহিত ক্রীড়া প্রভৃতির অনেক প্রসঙ্গ আছে-এবং তিনি যে বিষ্ণুর অবতার তাঁহারও উল্লেখ আছে। বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারগণেরও নাম ও কীর্তি বর্ণিত হইয়াছে। শিবের ভিন্ন ভিন্ন নাম (যথা সদাশিব, অর্দ্ধনারীশ্বর, ধুর্জটি ও মহেশ্বর); তাঁহার শক্তি সর্বাণী, উমা অথবা সতী; দক্ষযজ্ঞে সতীর দেহত্যাগ; কার্ত্তিক গণেশ নামে তাঁহার দুই পুত্র প্রভৃতিরও উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই সমুদয় দেব-দেবীর মূর্ত্তির সংখ্যা ও গঠনপ্রণালীর বিভিন্নতা হইতে সহজেই অনুমান করা যায় যে, বাংলায় ইহাদের পূজা বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল এবং উপাসকগণ বহুসংখ্যক বিশিষ্ট সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিলেন।
.
৪. বৈষ্ণব ধর্ম্ম
বাঁকুড়া নগরীর ১২ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সুসুনিয়া নামক পৰ্ব্বতের গুহায় উৎকীর্ণ রাজা চন্দ্রবর্ম্মার একখানি লিপিতে বাংলায় সর্বপ্রথমে বিষ্ণুপূজার উল্লেখ পাওয়া যায়। এই গুহাগাত্রে একটি চক্র খোদিত আছে। সুতারং অনুমিত হয় যে ইহা একটি বিষ্ণুর মন্দির ছিল। রাজা চন্দ্রবর্ম্মা চতুর্থ শতাব্দীতে উত্তরবঙ্গে, এবং এমনকি সুদূর হিমালয় শিখরে গোবিন্দস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী, কোকামুখস্বামী প্রভৃতির মন্দির প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সম্ভবত এ সমুদয়ই বিষ্ণুমূর্ত্তি। সপ্তম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ লিপিতে বাংলার পূর্ব্বপ্রান্তে হিংস্রপশুসমাকুল গভীর অরণ্য প্রদেশও ভগবান অনন্তনারায়ণের মন্দির ও পূজার উল্লেখ আছে। সুতরাং ইহার বহু পূর্ব্বেই যে বৈষ্ণব ধর্ম্ম বাংলার সর্বত্র বিস্তৃত হইয়াছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে।
বাংলার বৈষ্ণব ধৰ্ম্মে কৃষ্ণলীলার বিশেষ প্রাধান্য ছিল। পাহাড়পুর মন্দিরগাত্রে কৃষ্ণের বাল্যলীলার অনেক কাহিনী উত্তীর্ণ আছে। সদ্যপ্রসূত কৃষ্ণকে লইয়া বসুদেবের গোকুলে গমন, গোপগোপীগণের সহিত ক্রীড়া, গোবর্দ্ধনধারণ, যমলাৰ্জ্জুন সংহার, কেশীবধ, চানুর ও মুষ্টিকের সহিত যুদ্ধ প্রভৃতি কাহিনী যে ষষ্ঠ শতাব্দী বা তাঁহার পূর্ব্বেই এদেশে প্রচলিত ছিল পাহাড়পুরের প্রস্তরশিল্প হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। একখানি প্রস্তরে কৃষ্ণ ও একটি স্ত্রীমূর্ত্তি খোদিত আছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইহা রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্ত্তি। পরবর্ত্তীকালে রাধা বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে প্রাধান্য লাভ করিলেও হালের সপ্তশতী ব্যতীত প্রাচীন কোনো গ্রন্থে রাধার উল্লেখ নাই। পাহাড়পুরে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূৰ্ত্তি থাকিলে বাংলায় ইহাই রাধার আখ্যানের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন। কিন্তু খুব সম্ভবত পাহাড়পুরের উক্ত স্ত্রীমূর্ত্তি রুক্সিণী অথবা সত্যভামা। সুতরাং সপ্তম শতাব্দীতে কৃষ্ণলীলা বাংলায় খুব জনপ্রিয় হইলেও ঐ সময়ে রাধা-কৃষ্ণের কাহিনী প্রচলিত ছিল কি না তাহা নিঃসংশয়ে বলা যায় না।
অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতাব্দী পর্য্যন্ত যে বৈষ্ণব ধর্ম্ম বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল ঐযুগের বহুসংখ্যক বিষ্ণুমূৰ্ত্তি হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। রাজা লক্ষ্মণসেন পরম বৈষ্ণব ছিলেন এবং তাঁহার সময় হইতে রাজকীয় শাসনের প্রারম্ভে শিবের পরিবর্তে বিষ্ণুর স্তবের প্রচলন হয়। তাঁহার সভাকবি জয়দেবের গীতগোবিন্দ যে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে বিশেষ সম্মানীত ও আদৃত তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। গীতগোবিন্দে যে বিষ্ণুর দশ অবতারের বর্ণনা আছে কালে তাহাই সমগ্র ভারতে গৃহীত হইয়াছে। ইহার পূৰ্ব্বে অবতার সম্বন্ধে কোনো নির্দিষ্ট বা সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। ভাগবত পুরাণে অবতারের যে তিনটি তালিকা আছে তাহাতে অবতারের সংখ্যা যথাক্রমে ২২, ২৩ ও ১৬। হরিবংশে দশ অবতারের উল্লেখ থাকিলেও তাঁহার সহিত জয়দেবের কথিত এবং বর্ত্তমানে প্রচলিত দশ অবতারের অনেক প্রভেদ। মহাভারত ও বায়ুপুরাণে এই দশ অবতারের তালিকা আছে-কিন্তু তাঁহার পাশেই বিভিন্ন তালিকাও দেওয়া হইয়াছে। জয়দেব বর্ণিত যে অবতারবাদ ক্রমে ভারতের সর্বত্র প্রামাণিক বলিয়া গৃহীত হইয়াছে তাহা ভারতে বাংলার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি প্রধান দান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। জয়দেব বর্ণিত রাধাকৃষ্ণ লীলাও সম্ভবত বাংলায়ই প্রথমে প্রচলিত হয় ও পরে সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
.
৫. শৈবধর্ম্ম
বৈষ্ণব ধর্ম্মের ন্যায় শৈবধৰ্ম্মও গুপ্তযুগে এদেশে প্রচলিত ছিল। পঞ্চম শতাব্দের লিপিতে হিমালয় গিরিশিখরে পূর্ব্বোক্ত শ্বেতবরাহস্বামী ও কোকামুখ স্বামীর মন্দির পার্শ্বে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠার উল্লেখ পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতাব্দীতে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত ও সপ্তম শতাব্দীতে মহারাজাধিরাজ শশাঙ্ক ও ভাস্করবর্ম্মা শৈবধর্ম্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। পাহাড়পুরের মন্দিরগাত্রে শিবের কয়েকটি মূর্ত্তি উত্তীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়।
আর্য্যাবর্তে পাশুপত মতাবলম্বীরাই সর্বপ্রাচীন শৈব-সম্প্রদায়। সম্রাট নারায়ণপালের একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, তিনি নিজে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়া তথাকার পাশুপতাচাৰ্য্য-পরিষদের ব্যবহারের জন্য একটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে, বাংলায় পাশুপত-সম্প্রদায় খুব প্রবল ছিল। সদাশিব সেনরাজগণের ইষ্টদেবতা ছিলেন এবং রাজকীয় মুদ্রায় তাঁহার মূর্ত্তি উত্তীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। বিজয়সেন ও বল্লালসেন শৈব ছিলেন। লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার বংশধরগণ বৈষ্ণব হইলেও কুলদেবতা সদাশিবকে পরিত্যাগ করেন নাই।
খুব প্রাচীনকাল হইতেই বাংলায় শক্তিপূজার প্রচলন হইয়াছিল। দেবীপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে, রাঢ় ও বরেন্দ্রে বামাচারী শাক্ত সম্প্রদায় বিভিন্নরূপে দেবীর উপাসনা করিতেন। দেবীপুরাণ সম্ভবত সপ্তম শতাব্দের শেষে অথবা অষ্টম শতাব্দের প্রারম্ভে রচিত হইয়াছিল। বাংলার বহু তান্ত্রিক গ্রন্থে শাক্ত মত প্রচারিত হইয়াছে। কিন্তু এই শ্রেণীর কোনো গ্রন্থ দ্বাদশ শতাব্দীর পূর্ব্বে রচিত হইয়াছিল কি না বলা কঠিন। তবে তন্ত্রোক্ত শাক্তমত যে হিন্দু যুগ শেষ হইবার পূর্ব্বেই বাংলায় প্রসার লাভ করিয়াছিল ইহাই সম্ভব বলিয়া মনে হয়। পাহাড়পুরের মন্দিরগাত্রে একটি মনুষ্যমূর্ত্তি বাম হস্তে মস্তকের শিখা ধরিয়া দক্ষিণ হস্তে তরবারির দ্বারা নিজের গ্রীবাদেশ কাটিতে উদ্যত এরূপ একটি দৃশ্য উত্তীর্ণ আছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে, ইহা দেবীর নিকট শাক্তভক্তের শিরশ্চেদের দৃশ্য। সুতরাং ইহা সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীতে শাক্ত-সম্প্রদায়ের অস্তিত্বের প্রমাণস্বরূপ গ্রহণ করা যাইতে পারে।
.
৬. অন্যান্য পৌরাণিক ধৰ্ম্ম-সম্প্রদায়
বিষ্ণু, শিব ও শক্তি ব্যতীত অন্যান্য পৌরাণিক দেব-দেবীর পূজাও বাংলায় প্রচলিত ছিল। কিন্তু এইসব সম্প্রদায় সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। রাজতরঙ্গিণীতে উক্ত হইয়াছে যে, পুণ্ড্রবর্দ্ধনে কার্তিকের এক মন্দির ছিল। কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেন তাঁহাদের তাম্রশাসনে পরমসৌর বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। সুতরাং সূৰ্য্য-দেবতার উপাসক সৌর সম্প্রদায় বাংলায় প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। এই সূৰ্য্য বৈদিক সূৰ্য্য দেবতা নহেন। সম্ভবত মগ ব্রাহ্মণগণ কুশাণযুগে শকদ্বীপ হইতে এই সূৰ্য্যপূজার প্রচলন করেন।
কিন্তু সমসাময়িক লিপি বা সাহিত্যে অন্য সম্প্রদায়ের উল্লেখ না থাকিলেও বাংলায় কার্তিক ও সূৰ্য্য ব্যতীত অন্যান্য দেব-দেবীর বহুসংখ্যক মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে। সুতরাং ইহাদের পূজাও যে এদেশে প্রচলিত ছিল, তাহা সহজেই বুঝা যায়।
.
৭. জৈনধর্ম্ম
প্রাচীন জৈনধর্ম্মগ্রন্থে লিখিত আছে যে, বর্দ্ধমান মহাবীর রাঢ় প্রদেশে আসিয়াছিলেন, কিন্তু সেখানকার লোকেরা তাঁহার সহিত অত্যন্ত অসদ্ব্যবহার করিয়াছিল। কোন সময়ে জৈনধৰ্ম্ম বাংলায় প্রথম প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তাহা সঠিক বলা যায় না। দিব্যাবদানে আশোকের সম্বন্ধে একটি গল্প আছে। পুণ্ড্রবর্দ্ধন নগরীর জৈনগণ মহাবীরের চরণতলে পতিত বুদ্ধদেবের চিত্র অঙ্কিত করিয়াছে শুনিয়া তিনি নাকি পাটলিপুত্রের সমস্ত জৈনগণকে হত্যা করিয়াছিলেন। এই গল্পটির মূলে কতটা সত্য আছে বলা কঠিন-সুতরাং আশোকের সময়ে উত্তরবঙ্গে জৈন-সম্প্রদায় বর্ত্তমান ছিল এরূপ সিদ্ধান্ত করা সঙ্গত নহে।
কিন্তু অশোকের সময় না থাকিলেও খৃষ্টপূৰ্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে যে বঙ্গে জৈনধৰ্ম্ম দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাঁহার প্রমাণ আছে। প্রাচীন জৈনগ্রন্থ কল্পসূত্র মতে মৌৰ্য্যম্রাট চন্দ্রগুপ্তের সমসাময়িক জৈন আচাৰ্য্য দ্রবাহুল্য শিষ্য গোদাস যে গোদাসগণ প্রতিষ্ঠিত করেন, কালক্রমে তাহা চারি শাখায় বিভক্ত হয়। ইহার তিনটির নাম তাম্রলিপ্তিক, কোটীবর্ষীয় এবং পুণ্ড্রবর্দ্ধনীয়। এই তিনটি যে বাংলার তিনটি সুপরিচিত নগরীর নাম হইতে উদ্ভূত তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কল্পসূত্রোক্ত এই শাখাগুলি কাল্পনিক নহে, সত্য-সত্যই ছিল, কারণ খৃষ্টপূর্ব্ব প্রথম শতাব্দীতে উত্তীর্ণ শিলালিপিতে তাহাদের উল্লেখ আছে। সুতরাং উত্তরবঙ্গ (পুণ্ড্রবর্দ্ধন, কোটীবর্ষ) ও দক্ষিণবঙ্গে (তাম্রলিপ্তি) যে খুব প্রাচীনকাল হইতেই জৈন সম্প্রদায় প্রসার লাভ করিয়াছিল তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই।
পাহাড়পুরে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে বা তাঁহার পূর্ব্বে ঐ স্থানে একটি জৈনবিহার ছিল। চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাং লিখিয়াছেন যে, তাঁহার সময়ে বাংলায় দিগম্বর জৈনের সংখ্যা খুব বেশি ছিল। কিন্তু তাঁহার পরই বাংলায় জৈনধৰ্ম্মের প্রভাব হ্রাস হয়। পাল ও সেনরাজগণের তাম্রশাসনে এই সম্প্রদায়ের কোনো উল্লেখ নাই। তবে ইহা যে একেবারে লুপ্ত হয় নাই, প্রাচীন জৈনমূৰ্ত্তি হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়।
.
৮. বৌদ্ধধর্ম্ম
সম্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধধর্ম্ম বাংলায় প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। ইহার পূর্ব্বেও সম্ভবত এদেশে বৌদ্ধধর্ম্মের প্রচার হইয়াছিল, তবে এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে উত্তীর্ণ একখানি শিলালিপি হইতে জানা যায় যে, বঙ্গদেশে বৌদ্ধধর্ম্মের একটি প্রধান কেন্দ্র ছিল।
পঞ্চম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম্ম বাংলায় বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। ফাহিয়ান লিখিয়াছেন যে, তখন তাম্রলিপ্তি নগরীতে ২২টি বৌদ্ধবিহার ছিল। তিনি তথায় দুই বৎসর থাকিয়া বৌদ্ধ গ্রন্থ লিখিয়াছিলেন এবং বুদ্ধমূর্ত্তির ছবি আঁকিয়াছিলেন। তাঁহার বিস্তৃত বর্ণনায় তাম্রলিপ্তির বিশাল বৌদ্ধ সংঘের একটি উজ্জ্বল চিত্র ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
৫০৬-৭ অব্দে উত্তীর্ণ একখানি শিলালিপি হইতে জানা যায় যে, কুমিল্লা অঞ্চলে তখন বহু বৌদ্ধবিহার ছিল। তাঁহার মধ্যে একটির নাম রাজবিহার; সম্ভবত কোনো রাজা কর্ত্তৃক ইহা প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সুতরাং পঞ্চম শতাব্দীতে বাংলার সর্বত্রই যে বৌদ্ধধর্ম্মের খুব প্রতিপত্তি ছিল, এরূপ সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে।
সপ্তম শতাব্দীতে বাংলায় যে বৌদ্ধধর্ম্ম বেশ প্রভাবশালী ছিল, বহু চীনদেশীয় পরিব্রাজকের উক্তি হইতে তাহা জানা যায়। ইঁহাদের মধ্যে হুয়েন সাংয়ের বিবরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করিয়া স্বচক্ষে দেখিয়া যাহা লিখিয়াছেন, তাঁহার সারমর্ম নিম্নে দিতেছি।
“কজঙ্গল (রাজমহলের নিকটবর্ত্তী) প্রদেশে ছয়-সাতটি বিহারে তিন শতেরও অধিক ভিক্ষু বাস করেন। অন্যান্য ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ের দশটি মন্দির আছে। এই প্রদেশের উত্তর ভাগে গঙ্গাতীরের নিকট বিশাল উচ্চ দেবালয় আছে। ইহা প্রস্তর ও ইষ্টকে নির্ম্মিত এবং ইহার ভিত্তি-গাত্রে ক্ষোদিত ভাস্কৰ্য্য উচ্চ শিল্পকলার নিদর্শন। চতুর্দিকের দেয়ালে বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে বুদ্ধ, অন্যান্য দেবতা ও সাধু পুরুষদের মূর্ত্তি উৎকীর্ণ।”
“পুণ্ড্রবর্দ্ধনে (উত্তরবঙ্গ) ২০টি বিহারে তিন শতেরও অধিক হীনযান ও মহাযান সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করেন। অন্যান্য সম্প্রদায়ের প্রায় একশত দেবমন্দির আছে। উলঙ্গ নিগ্রন্থপন্থীদের (জৈন) সংখ্যা খুব বেশী। রাজধানীর তিন-চারি মাইল পশ্চিমে পো-চি-পো সংঘারাম। ইহার অঙ্গনগুলি যেমন প্রশস্ত, কক্ষ ও শিখরগুলিও তেমনি উচ্চ। ইহার ভিক্ষুসংখ্যা ৭০০। সকলেই মহাযান মতাবলম্বী। পূর্ব্ব ভারতের বহু প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ আচার্য্য এখানে বাস করেন। সমতট (পূর্ব্ববঙ্গ) প্রদেশের রাজধানীতে প্রায় ৩০টি বৌদ্ধবিহারে ২০০০ ভিক্ষু থাকেন। অন্যান্য ধর্ম্ম-সম্প্রদায়ের মন্দিরের সংখ্যা একশত। জৈনগণ সংখ্যায় খুব বেশী। তাম্রলিপ্তে দশটি বিহারে সহস্র বৌদ্ধ ভিক্ষু বাস করেন। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মন্দিরসংখ্যা পঞ্চাশ। কর্ণসুবর্ণে দশটি বৌদ্ধবিহারে হীনযান মতাবলম্বী দুই সহস্র ভিক্ষু বাস করেন। অন্যান্য ধর্ম্মাবলম্বীর সংখ্যা খুব বেশী-তাহাদের দেবমন্দিরের সংখ্যা পঞ্চাশ। রাজধানীর নিকটে লো-টো-বি-চি বিহার। ইহার কক্ষগুলি প্রশস্ত ও উচ্চ। বহুতালায় নির্ম্মিত বিহারটিও খুব উচ্চ। রাজ্যের সমুদয় সম্ভ্রান্ত শিক্ষিত ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণ এখানে সমবেত হন।”
এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনা হইতে বেশ বুঝা যায় যে, তখন বাংলায় বৈষ্ণব, শৈব, বৌদ্ধ ও জৈন প্রভৃতি বিবিধ ধৰ্ম্ম-সম্প্রদায়ের বহুসংখ্যক মন্দির ও বিহার বর্ত্তমান ছিল। জৈন ভিক্ষুগণ সংখ্যায় বৌদ্ধ ভিক্ষু অপেক্ষা বেশী ছিলেন বলিয়াই মনে হয়। বৌদ্ধগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ না হইলেও বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্মের বেশ প্রভাব ছিল। ইৎসিং তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছেন, তাহাতে জানা যায় যে, তথাকার ভিক্ষুগণের জীবন বৌদ্ধধর্ম্মের উচ্চ আদর্শ ও বিধিবিধানের সম্পূর্ণ অনুবর্ত্তী ছিল। শেংচি নামে ইৎসিংয়ের সমসাময়িক আর একজন চীনদেশীয় বৌদ্ধ পরিব্রাজক লিখিয়াছেন যে, সমতটের রাজধানীতে চারি সহস্রের বেশী বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী ছিলেন এবং ঐ দেশের রাজা রাজভট প্রতিদিন বুদ্ধের লক্ষ মৃন্ময়মূৰ্ত্তি নিৰ্মাণ করিতেন এবং মহাপ্রজ্ঞাপারমিতার লক্ষ শ্লোক পাঠ করিতেন। রাজভট সম্ভবত খড়গবংশীয় রাজা ছিলেন। এই সমুদয় বর্ণনা হইতে বেশ বোঝা যায় যে, সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম্ম বাংলায় খুব শক্তিশালী ছিল এবং বাংলার বৌদ্ধগণ জ্ঞান, ধর্ম্মনিষ্ঠা ও আচার-ব্যবহারে সমগ্র বৌদ্ধজগতের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র হইয়াছিলেন।
সপ্তম শতাব্দীতে একজন বাঙ্গালী বৌদ্ধজগতে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ইহার নাম শীলভদ্র-সমতটের রাজবংশে হঁহার জন্ম হয়। ইনি জগদ্বিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আচার্য্য ও সর্বাধ্যক্ষের পদ অলঙ্কত করিয়া বাঙ্গালীর মুখ উজ্জ্বল করিয়া গিয়াছেন। ইহার জীবনী একবিংশ পরিচ্ছেদে আলোচিত হইবে।
অষ্টম শতাব্দীতে বৌদ্ধ পালরাজগণের অভ্যুদয়ে বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্মের প্রভাব খুব বৃদ্ধি পাইয়াছিল। এই সময় হইতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বৌদ্ধধর্ম্ম ক্রমশ ক্ষীণবল হইয়া আসিতেছিল এবং দুই-এক শত বৎসরের মধ্যেই তাঁহার প্রভাব প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হইয়াছিল। কিন্তু পালরাজগণের সুদীর্ঘ চারিশত বৎসর রাজত্বকালে বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রবল ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ তুর্কী আক্রমণের ফলে যখন প্রথমে মগধের ও পরে উত্তর বাংলার বৌদ্ধবিহার ও মন্দিরগুলি ধ্বংস হয়, তখনই বৌদ্ধ সংঘ ভারতের পূর্ব্ব-প্রান্তস্থিত এই সর্ব্বশেষ আশ্রয়স্থান হইতে বিতাড়িত হইয়া আত্মরক্ষার জন্য নেপাল ও তিব্বতে গমন করে। বৌদ্ধ সংঘই ছিল বৌদ্ধধর্ম্মের প্রধান কেন্দ্র। কাজেই বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে সঙ্গে বৌদ্ধধর্ম্মও ভারতবর্ষ হইতে বিলুপ্ত হয়।
অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতাব্দের মধ্যে বাংলায় ও বিহারে বৌদ্ধধর্ম্মের অনেক গুরুতর পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল। এই চারিশত বৎসরে ইহা উত্তরে তিব্বত ও দক্ষিণে যবদ্বীপ, সুমাত্রা, মালয় প্রভৃতি অঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল! বাংলার পালরাজগণ ভারতে বৌদ্ধধর্ম্মের শেষ রক্ষক হিসেবে সমগ্র বৌদ্ধজগতে শ্রেষ্ঠ সম্মানের আসন পাইয়াছিলেন। ইহার ফলে বাংলায় ও বিহারে বৌদ্ধধর্ম্মের যে পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছিল, তাহা এই সমুদয় দেশেও ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। বাংলা ও বিহারের প্রসিদ্ধ আচাৰ্য্যগণ এই সমুদয় দেশে গিয়া এই নতুন ধর্ম্মের ভিত্তি দৃঢ় করিয়াছিলেন।
পাল সম্রাটগণ বহু বৌদ্ধবিহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে ধর্ম্মপাল প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীল মহাবিহারই সমধিক প্রসিদ্ধ। ভাগীরথী তীরে এক গিরিশীর্ষে এই মহাবিহারটি অবস্থিত ছিল। বর্ত্তমান পাথরঘাটায় (ভাগলপুর জিলা) কেহ কেহ ইহার অবস্থিতি নির্দেশ করিয়াছেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। ধর্ম্মপাল প্রতিষ্ঠিত এই মহাবিহার এবং সোমপুর ও ওদন্তপুরী বিহারের কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে, সুতরাং এ স্থলে ইহাদের বর্ণনা অনাবশ্যক।
সোমপুর ব্যতীত বাংলায় আরও কয়েকটি প্রসিদ্ধ বিহার ছিল। যে ত্রৈকূটক বিহারে আচাৰ্য্য হরিদ্র অভিসময়ালঙ্কার গ্রন্থের প্রসিদ্ধ টীকা প্রণয়ন করেন, তাহা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত ছিল। বরেন্দ্রের দেবীকোট ও জগদ্দল, চট্টগ্রামের পণ্ডিতবিহার, এবং বিক্রমপুর ও পট্টিকেরা (কুমিল্লার নিকটবর্ত্তী) প্রভৃতি বৌদ্ধবিহারে যে সমুদয় বৌদ্ধ আচার্য্য ছিলেন, তাঁহাদের অনেকে তিব্বতীয় বৌদ্ধ সাহিত্যে বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন।
পালযুগে বাংলায় অন্যান্য বৌদ্ধরাজবংশেরও পরিচয় পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিক্রমপুরের চন্দ্ররাজবংশ এবং হরিকেলরাজ কান্তিদেবের উল্লেখ করা যাইতে পারে। সেনরাজগণের অভ্যুদয়ের ফলে বাংলায় শৈব ও বৈষ্ণব ধর্ম্ম এবং প্রাচীন বৈদিক ও পৌরাণিক ধৰ্ম্মানুষ্ঠান ও আচার-ব্যবহার পুনরুজ্জীবিত করিবার এক প্রবল চেষ্টা হয়। ইহাও বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্মের পতনের একটি কারণ। কিন্তু তুর্কী আক্রমণের ফলে বৌদ্ধবিহারগুলি ধ্বংস না হইলে সম্ভবত বৌদ্ধধর্ম্ম বাংলা হইতে একেবারে বিলুপ্ত হইত না। বর্ত্তমানে এক চট্টগ্রাম জেলায় কয়েক সহস্র বৌদ্ধ ব্যতীত বাংলা ও বিহারে বৌদ্ধধর্ম্মের চিহ্ন বিলুপ্ত হইয়াছে।
.
৯. সহজিয়া ধৰ্ম্ম
প্রাচীনকাল হইতেই বৌদ্ধধর্ম্মমতের অনেক পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে। ভারতে বৌদ্ধধর্ম্মের এই বিবর্ত্তনের ইতিহাস এক্ষেত্রে আলোচনা করা সম্ভব নহে। সংক্ষেপে বলা যাইতে পারে যে, হুয়েন সাং সপ্তম শতাব্দীতে ভারতে যে বৌদ্ধধর্ম্ম প্রচলিত দেখিয়াছিলেন, তাহা গৌতম বুদ্ধ, অশোক, এমনকি কনিষ্কের সময়কার বৌদ্ধধর্ম্ম অপেক্ষা অনেক পৃথক। কিন্তু পালযুগে বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্ম যে রূপ ধারণ করিয়াছিল, তাঁহার প্রকৃতি ইহা হইতেও সম্পূর্ণ বিভিন্ন। প্রাচীন সর্ব্বাস্তিবাদ, সম্মিতীয় প্রভৃতি বৌদ্ধ মত তখন বিলুপ্ত হইয়াছে। এমনকি, অপেক্ষাকৃত আধুনিক মহাযান মতবাদও বজ্রযান ও তন্ত্রযান প্রভৃতিতে পরিণত হইয়া সম্পূর্ণ নূতন আকার ধারণ করিয়াছে।
ছোটখাটো প্রভেদ থাকিলেও এই নূতন ধর্ম্মমতগুলির মধ্যে যথেষ্ট ঐক্য ছিল এবং মোটের উপর ইহাদিগকে সহজযান বা সহজিয়া ধৰ্ম্ম বলা যাইতে পারে। এই ধৰ্ম্মের আচাৰ্য্যগণ সিদ্ধাচাৰ্য নামে খ্যাত। মোট ৮৪ জন সিদ্ধাচাৰ্য্য ছিলেন বলিয়া প্রসিদ্ধি আছে। দশম হইতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যেই সম্ভবত এই সমুদয় সিদ্ধাচার্যগণ জন্মগ্রহণ করেন। ইহারা অপভ্রংশ ও দেশীয় ভাষায় গ্রন্থ লিখিতেন। তিব্বতীয় বৌদ্ধ আচাৰ্য্যগণ বাংলা ও বিহারের বৌদ্ধ পণ্ডিতগণের সহায়তায় এই সমুদয় গ্রন্থ তিব্বতীয় ভাষায় তর্জমা করেন এবং সে তর্জমা তিব্বতীয় তেজুর নামক গ্রন্থে আছে। মূল গ্রন্থগুলি কিন্তু প্রায় সবই বিলুপ্ত হইয়াছে। প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত যে চর্য্যাপদগুলির কথা পূর্ব্ববর্ত্তী অধ্যায়ে উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা এই সিদ্ধাচার্যগণেরই রচিত। এই চর্যাপদ ও সিদ্ধাচাৰ্য্য সরহ ও কৃষ্ণের দোহাকোষ প্রভৃতি যে কয়েকখানি মূল সহজিয়া গ্রন্থ পাওয়া গিয়াছে, তাহা হইতে এই নূতন ধর্ম্মমত সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যাইতে পারে।
এই ধর্ম্মে গুরুর স্থান খুব উচ্চ। “ধৰ্ম্মের সূক্ষ্ম উপদেশ গুরুর মুখ হইতে শুনিতে হইবে, পুস্তক পড়িয়া কিছু হইবে না; গুরু বুদ্ধ অপেক্ষাও বড়; গুরু যাহা বলিবেন বিচার না করিয়া তাহা তৎক্ষণাৎ করিতে হইবে”–ইহাই এই ধৰ্ম্ম সম্প্রদায়ের মূলনীতি।
বৈদিক ধর্ম্ম, পৌরাণিক পূজা-পদ্ধতি, জৈন এবং এমনকি বৌদ্ধধর্ম্ম সম্প্রদায়ের প্রতি যেরূপ তীব্র শ্লেষ, কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গোক্তি এই সমুদয় গ্রন্থে স্থান পাইয়াছে, তাহা পড়িলে ঊনবিংশ শতাব্দীতে খৃষ্টীয় মিশনারী কর্ত্তৃক হিন্দুধর্ম্মের সমালোচনার কথা স্মরণ হয়। সরহের দোহাকোষ হইতে দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি। “হোম করিলে মুক্তি যত হোক না হোক, ধোঁয়ায় চক্ষের পীড়া হয় এই মাত্র।” “ঈশ্বরপরায়ণেরা গায়ে ছাই মাখে, মাথায় জটা ধরে, প্রদীপ জ্বালিয়ে ঘরে বসিয়া থাকে, ঘরের ঈশান কোণে বসিয়া ঘণ্টা চালে, আসন করিয়া বসে, চক্ষু মিটমিট করে, কানে খুসখুস করে ও লোককে ধাঁধা দেয়।” “ক্ষপণকেরা কপট মায়াজাল বিস্তার করিয়া লোক ঠকাইতেছে; তাহারা তত্ত্ব জানে না, মলিন বেশ ধারণ করিয়া থাকে। এবং আপনার শরীরকে কষ্ট দেয়; নগ্ন হইয়া থাকে এবং আপনার কেশোৎপাটন করে। যদি নগ্ন হইলে মুক্তি হয়, তাহা হইলে শৃগাল কুকুরের মুক্তি আগে হইবে।”
বৌদ্ধ শ্রমণদের সম্বন্ধে উক্তি এইরূপ :
“বড় বড় স্থবির আছেন, কাহারও দশ শিষ্য, কাহারও কোটি শিষ্য, সকলেই গেরুয়া কাপড় পরে, সন্ন্যাসী হয় ও লোক ঠকাইয়া খায়। যাহারা হীনযান (তাহারা যদি শীল রক্ষা করে) তাহাদের না হয় স্বর্গই হউক, মোক্ষ হইতে পারে না। যাহারা মহাযান আশ্রয় করে, তাহাদেরও মোক্ষ হয় না, কারণ তাহারা কেহ কেহ সূত্র ব্যাখ্যা করে, কিন্তু তাহাদের ব্যাখ্যা অদ্ভুত, সে সকল নূতন ব্যাখ্যায় কেবল নরকই হয়।” উপসংহারে বলা হইয়াছে “সহজ পন্থা ভিন্ন পন্থাই নাই। সহজ পন্থা গুরুর মুখে শুনিতে হয়।”
জাতিভেদ সম্বন্ধে সরহ বলেন : “ব্রাহ্মণ ব্রহ্মার মুখ হইতে হইয়াছিল; যখন হইয়াছিল তখন হইয়াছিল, এখন ত অন্যেও যেরূপে হয়, ব্রাহ্মণও সেইরূপে হয়, তবে আর ব্রাহ্মণত্ব রহিল কী করিয়া? যদি বল সংস্কারে ব্রাহ্মণ হয়, চণ্ডালকে সংস্কার দেও, সে ব্রাহ্মণ হোক; যদি বল বেদ পড়িলে ব্রাহ্মণ হয়, তারাও পড়ক। আর তারা পড়েও ত, ব্যাকরণের মধ্যে ত বেদের শব্দ আছে।”
এইরূপে সিদ্ধাচার্যগণ সমুদয় প্রাচীন সংস্কার ও ধর্ম্মমতের তীব্র সমালোচনা করিয়া যে স্বাধীন চিন্তা ও বিচারবুদ্ধির পরিচয় দিয়াছেন, তাহা পড়িলে মনে হয় যে, মধ্যযুগে ও বর্ত্তমানকালে যে সমুদয় প্রাচীন-পন্থা-বিরোধী উদার ধর্ম্মমতবাদ এদেশে প্রচারিত হইয়াছে, তাহা কেবল ইসলাম বা খৃষ্টীয় ধর্ম্ম এবং পাশ্চাত্য শিক্ষার ফল বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। যে সংস্কার-বিমুক্ত স্বাধীন চিত্ত ও চিন্তাশক্তির উপর এইগুলি প্রতিষ্ঠিত, তাঁহার মূল সহজিয়া-মতবাদে স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই সহজিয়ামতই আবার চরম গুরুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। একদিকে সূক্ষ্ম স্বাধীন চিন্তা, অপরদিকে নির্বিচারে গুরুর প্রতি আস্থা-এই পরস্পরবিরুদ্ধ মনুষ্য-প্রবৃদ্ধির উপর কিরূপে সহজিয়া ধর্ম্মের ভিত্তি স্থাপিত হইয়াছিল, তাহা ভাবিলে বিস্মিত হইতে হয়। কিন্তু পরবর্ত্তীকালের বাংলার ধর্ম্ম ও সমাজের ইতিহাসে এরূপ বিরুদ্ধ মনোবৃত্তির একত্র সমাবেশ বিরল নহে।
যে ধর্ম্মে কেবলমাত্র গুরুর বচনই প্রামাণিক, তাঁহার সাধন-প্রণালী অনেক পরিমাণেই গুহ্য ও রহস্যে আবৃত। সুতরাং সহজিয়া ধর্ম্মের সাধারণ বিবরণ ব্যতীত বিস্তৃত বিশ্লেষণ সম্ভবপর নহে। এই ধর্ম্মে গুরু প্রথমত সাধকের আধ্যাত্মিক শক্তির উৎকর্ষ অপকর্ষ বিবেচনা করিয়া তাঁহার জন্য তদনুযায়ী সাধন মার্গ নির্দিষ্ট করিয়া দিতেন। এই শক্তির পরিমাণ অনুসারে পাঁচটি কুল (শ্রেণী) কল্পিত হইয়াছিল-ইহাদের নাম ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী ও ব্রাহ্মণী। যে পঞ্চ মহাভূত দেহের প্রধান উপকরণ (স্কন্ধ) তাঁহার উপরই এই কুল-বিভাগ প্রতিষ্ঠিত। উপাসকের মধ্যে কোন স্কন্ধটি কিরূপ প্রবল তাহা স্থির করিয়া গুরু তাঁহার প্রজ্ঞা বা শক্তির স্বরূপ নির্ণয় করেন। পরে যে সাধন-প্রণালী অনুসরণ করিলে ঐ বিশেষ শক্তির বৃদ্ধি হইতে পারে প্রতি সাধকের জন্য তিনি তাঁহার ব্যবস্থা করেন।
এই সাধন-প্রণালী এক প্রকার যোগবিশেষ। শরীরের মধ্যে যে ৩২টি নাড়ী আছে তাঁহার মধ্য দিয়ে শক্তিকে মস্তকের সর্বোচ্চ প্রদেশে (মহাসূক্ষ্ম স্থানে) প্রবাহিত করা এই যোগের লক্ষ্য। এই স্থানটি চতুঃষষ্ঠি অথবা সহস্রদল পদ্মরূপে কল্পিত হইয়াছে। রেলওয়ে লাইনে যেমন স্টেশন ও জংশন আছে, দেহাভ্যন্তরের নাড়ীগুলিরও সেই বিরাম ও সংযোগস্থল আছে; ইহাগিদকে পদ্ম ও চক্রের সহিত তুলনা করা হইয়াছে এবং ঊর্ধ্বগমনকালে শক্তিকে এই সমুদয় অতিক্রম করিতে হয়। শক্তি যখন মহাসূক্ষ্মস্থানে পৌঁছে তখন সাধনার শেষ ও সাধকের পরম ও চরম আনন্দ অর্থাৎ মহাসুখ লাভ হয়। সাধকের নিকট তখন বহির্জগৎ লুপ্ত হয়, ইন্দ্রিয়াদি কিছুরই জ্ঞান থাকে না। সাধক, জগৎ, বুদ্ধ সব একাকার হইয়া যায়,-অদ্বৈত জ্ঞান ব্যতীত আর সকলই শূন্যতাপ্রাপ্ত হয়।
সহজিয়া ধর্ম্মের ইহাই মূল তত্ত্ব। তবে বজ্রযান, সহজযান, কালচক্রযান প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধন-প্রণালীর মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। বজ্রযানে সাধক সাঙ্কেতিক মন্ত্রোচ্চারণের সাহায্যে দেব-দেবীকে পূজা করেন। ইহার ফলে দেব-দেবীগণ মণ্ডলাকারে সাধকের চতুর্দিকে উপবিষ্ট হন। তখন আর তাঁহার মন্ত্র উচ্চারণ করিবার শক্তি থাকে না, কেবলমাত্র মুদ্রা অর্থাৎ হস্তের ও অঙ্গুলির নানারূপ বিন্যাস দ্বারাই পূজা করিতে হয়। সহজযানে এইসব পূজার বিধি নাই। কালচক্রযানেও উল্লিখিত যোগ সাধনাই প্রধান, এবং এই সাধনার উপযুক্ত কাল, অর্থাৎ মুহূর্ত, তিথি, নক্ষত্রের উপরেই বেশী জোর দেওয়া হইয়াছে।
চরম গুরুবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত ও গোপন রহস্যে আবৃত থাকায় সহজিয়া ধৰ্ম্ম ক্ৰমেই আধ্যাত্মিক অধঃপতনের পথে অগ্রসর হইতে লাগিল। বৌদ্ধধর্ম্মের বিধিবিধান যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তাহা নিশ্চিহ্ন হইয়া লোপ পাইল। অনুরূপ কারণে হিন্দুর তন্ত্রোক্ত সাধনাও এই অবস্থায় পরিণত হইয়াছিল। ক্রমে সহজিয়া ধর্ম্ম ও তান্ত্রিক সাধনা একাকার হইয়া বাংলার ধৰ্ম্ম-জগতে যে বীভৎসতার সৃজন করিল তাঁহার বিস্তৃত পরিচয় অনাবশ্যক।
বাংলার শাক্ত ধৰ্ম্মও এই সহজিয়া মতের সহিত মিলিত হইয়া গেল। ফলে একদিকে নূতন নূতন শাক্ত সম্প্রদায় ও অপরদিকে নাথপন্থী, সহজিয়া, অবধূত, বাউল প্রভৃতির সৃষ্টি হইল।
সম্প্রতি নেপালে এই প্রকার এক নূতন শাক্ত সাম্প্রদায়ের কতকগুলি শাস্ত্রগ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই সম্প্রদায় কৌল নামে অভিহিত এবং ইহার গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ। কৌল নামটি কুল শব্দ হইতে উৎপন্ন, এবং এই কুল বা শ্রেণীবিভাগ যে সহজিয়া ধর্ম্মের একটি প্রধান অঙ্গ, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। এই কৌল সম্প্রদায়ের লোকেরা কৌল, কুলপুত্র অথবা কুলীন নামে অভিহিত হইয়াছে এবং ইহাদের শাস্ত্রের নাম কুলাগম অথবা কুলশাস্ত্র। কুলই শক্তি: শিব অকুল; এবং দেহাভ্যন্তরে প্রচ্ছন্ন দেবী শক্তির নাম কুলকুণ্ডলিনী। এই ধর্ম্মের আলোচনা করিলে সন্দেহমাত্র থাকে না যে, ইহার প্রধান তত্ত্বগুলি সহজিয়া মতবাদ হইতে গৃহীত। কিন্তু একটি বিষয়ে ইহার প্রভেদ ছিল। ইহা জাতিভেদ মানিয়া চলিত। এই জন্যই ইহা ব্রাহ্মণ্য শাক্ত সম্প্রদায়ের সহিত মিশিতে পারিয়াছিল এবং হিন্দুসমাজে ইহার প্রাধান্য সহজে নষ্ট হয় নাই। যাহারা বর্ণাশ্রম মানিত না, তাহারাই ক্রমে নাথপন্থী, সহজিয়া, অবধূত, বাউল প্রভৃতি বৰ্ত্তমানকালে সুপরিচিত সম্প্রদায়গুলি সৃষ্টি করিয়াছে। এই সকল সম্প্রদায়ের প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে ইহারা সকলেই কালক্রমে-হিন্দু যুগের অবসানের পরে-বাংলার ধৰ্ম্মজগতে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিয়াছিল। নাথপন্থীদের গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ ও তাঁহার শিষ্য গোরক্ষনাথের কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। ময়নামতীর গান হইতে বুঝা যায় যে এককালে বাংলা দেশে ইহাদের প্রভাব খুব বেশি ছিল। সহজিয়া সম্প্রদায় ও মহাপ্রভু চৈতন্যের পূর্ব্বেই প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল। বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস একজন সহজিয়া ছিলেন। পরবর্ত্তীকালে সহজিয়া সম্প্রদায় বৈষ্ণব ভাবাপন্ন হইয়া, পরম সত্যকে কৃষ্ণ ও তাঁহার শক্তিকে রাধারূপে কল্পনা করে; কিন্তু নাড়ী, চক্র প্রভৃতি প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম্মের যোগসাধন-প্রণালী একেবারে পরিত্যাগ করে নাই। চণ্ডীদাসের রজকিনী প্রেম প্রাচীন সহজিয়া ধর্ম্মের পঞ্চকুলের অন্যতম রজকীর কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। বাউল সম্প্রদায় বৈষ্ণব প্রভাব হইতে মুক্ত থাকিয়া প্রাচীন বৌদ্ধ সহজিয়া ধর্ম্মের সহিত ঘনিষ্ঠ রক্ষা যোগসূত্র রক্ষা করিতে পারিয়াছে।
বাংলায় বৌদ্ধধর্ম্মের যে রূপান্তর ঘটিয়াছিল, তাঁহার অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত আলোচনা করা হইল,-কারণ যত দূর জানা যায় তাহাতে ইহাই ধৰ্ম্মজগতে বাংলার বিশিষ্ট দান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। অন্য যে সমুদয় ধর্ম্মমত বাংলায় প্রচলিত ছিল-তাহা মোটামুটিভাবে নিখিল ভারতবর্ষীয় ধর্ম্মেরই অনুরূপ, তাঁহার মধ্যে বাংলার বৈশিষ্ট্য কিছু থাকিলেও তাহা নিরূপণ করিবার কোনো উপায় নাই। কিন্তু অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধধর্ম্মের যে রূপান্তর ঘটিয়াছিল তাঁহার উপর ব্লাঙ্গালীর প্রভাবই যে বেশী একথা সকলেই স্বীকার করেন। এই রূপান্তরই আবার বাংলার অন্যান্য ধর্ম্মমতের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া বাংলার ধর্ম্ম ও সমাজে যে বিপ্লব ঘটাইয়াছিল, বাংলার মধ্যযুগে, এমনকি বর্ত্তমানকালেও তাঁহার স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। বৌদ্ধধর্ম্ম বাংলা হইতে বিলুপ্ত হইয়াছে-একথা এক হিসাবে সত্য। কিন্তু এত বড় একটা ধর্ম্মমত যে একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে ইহা বিশ্বাস করা কঠিন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মত প্রকাশ করিয়াছিলেন যে ধর্ম্মঠাকুরের পূজাই বৌদ্ধধর্ম্মের শেষ। কিন্তু বাংলার বৌদ্ধধর্ম্ম কেবলমাত্র এই সব লৌকিক অনুষ্ঠানেই পৰ্য্যবসিত হয় নাই। উল্লিখিত আলোচনা হইতে বুঝা যাইবে যে, যে সমুদয় ধর্ম্মমত মধ্যযুগে বাংলায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছিল তাহা অনেকাংশে প্রত্যক্ষ অথবা প্রচ্ছন্নভাবে বৌদ্ধমতের পরিণতি মাত্র।
.
১০. বাংলার ধর্ম্মমত
এ পর্য্যন্ত আমরা বিভিন্ন ধর্ম্মসম্প্রদায় সম্বন্ধে পৃথকভাবে আলোচনা করিয়াছি। উপসংহারে বাংলার ধর্ম্মমত সম্বন্ধে কয়েকটি সাধারণ তথ্যের উল্লেখ আবশ্যক। প্রাচীন বাংলায় বৈদিক, পৌরাণিক, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্ম্মের আপেক্ষিক প্রভাব ও প্রতিপত্তি কিরূপ ছিল তাহা জানিতে স্বতই ইচ্ছা হয়। পূৰ্ব্বে হুয়েন সাংয়ের যে উক্তি উদ্ধৃত হইয়াছে, তাহা হইতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ ও জৈনদিগের তুলনায় ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মাবলম্বীর সংখ্যা খুব বেশী ছিল। ঐ সময়ে জৈনগণের সংখ্যাও অনেক ছিল। পরবর্ত্তীকালে জৈনগণের সংখ্যা খুবই কমিয়া যায়, কিন্তু পৌরাণিক ধৰ্ম্ম পূৰ্ব্ববৎ বৌদ্ধধর্ম্ম অপেক্ষা অধিকতর শক্তিশালী ছিল কি না, ইহা নিশ্চিত বলা যায় না। পালরাজগণের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম্ম যথেষ্ট প্রতিপত্তি লাভ করিলেও ইহার প্রভাব যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্মকে ছাড়াইয়া উঠিয়াছিল, অনেকে এরূপ মনে করেন না। কারণ অষ্টম হইতে দ্বাদশ শতাব্দীর যে সমুদয় মূর্ত্তি বা লিপি এযাবৎ পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার অধিকাংশই পৌরাণিক ধর্ম্মের প্রভাব সূচিত করে। তবে ইহা অসম্ভব নহে যে, বৌদ্ধধৰ্ম্ম জনসাধারণের মধ্যে বেশি প্রচলিত ছিল এবং পৌরাণিক ধৰ্ম্ম সাধারণত ধনী, শিক্ষিত ও উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সহজিয়া ধর্ম্মের বিবরণ হইতে এরূপ ধারণা করা অসঙ্গত হইবে না যে, সমাজের নিম্নস্তরের মধ্যেই ইহার বিশেষ প্রসার ছিল। ডোম্বী, নটী, রজকী, চণ্ডালী প্রভৃতি কুলের নামে ইহার স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং চর্য্যাপদগুলি পাঠ করিলেও এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়। পরবর্ত্তীকালে সহজিয়া বৌদ্ধমত হইতে যে সমুদয় ধর্ম্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব হইয়াছিল, তাহাও সমাজের নিম্নশ্রেণীর মধ্যেই বেশী প্রচলিত ছিল। সরহের দোহা হইতে জানা যায় যে, সিদ্ধাচার্যগণ ব্রাহ্মণের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে তীব্র মত পোষণ করিতেন, এবং স্বীয় সম্প্রদায়ে জাতিভেদ প্রথা দূর করিয়াছিলেন। অসম্ভব নহে যে, সহজিয়া মতের জনপ্রিয়তার ইহাও একটি কারণ। বাংলা দেশে মোট জনসংখ্যার তুলনায় উচ্চশ্রেণীর হিন্দুগণ সংখ্যায় এত কম কেন, এই সমস্যার কোনো সন্তোষজনক মীমাংসা হয় নাই। বাংলায় হিন্দু যুগের শেষে বৌদ্ধমতের প্রভাব ইহার অন্যতম কারণ বলিয়া অনুমান করা খুব অসঙ্গত নহে।
শৈব ও বৈষ্ণব এই দুই ধৰ্ম্মমতের মধ্যে কোনটি প্রবল ছিল, তাহা বলা শক্ত। তবে হিন্দু যুগের শেষ দুই-তিন শতাব্দীর যে সমুদয় মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার সংখ্যামূলক তুলনা করিলে বৈষ্ণব ধর্ম্মমতেরই প্রাধান্য সূচিত হয়।
রাজগণের ধর্ম্মমত অনেক সময় অন্তত কতক পরিমাণে জনসাধারণের ধর্ম্মমত প্রতিফলিত করে। সুতরাং বাংলার রাজগণের ধর্ম্মমত কিরূপ ছিল, তাঁহার আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক নহে। পূর্ব্ববর্ত্তী কয়েকটি অধ্যায়ে বিভিন্ন রাজবংশের যে ইতিহাস বর্ণিত হইয়াছে, তাহা হইতে জানা যায় যে, খড়গ, চন্দ্র ও পালবংশ এবং কান্তিদেব, রণবঙ্কমল্ল প্রভৃতি রাজা বৌদ্ধ ছিলেন। বৈন্যগুপ্ত শশাঙ্ক, লোকনাথ, ডোম্মনপাল এবং সেনবংশীয় বিজয়সেন ও বল্লালসেন শৈব ছিলেন। বর্ম্মণ ও দেববংশ এবং বল্লালসেনের পরবর্ত্তী সেনবংশীয় রাজগণ বৈষ্ণব ছিলেন। গুপ্তযুগের পরবর্ত্তী বাংলার প্রথম স্বাধীন রাজগণ-গোপচন্দ্ৰ ধৰ্ম্মাদিত্য, সমাচারদেব-ব্রাহ্মণ ধর্ম্মাবলম্বী ছিলেন; কিন্তু তাঁহারা শৈব, বৈষ্ণব প্রভৃতি সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন কি না, তাহা নির্ণয় করিবার উপায় নাই।
এই সমুদয় বিভিন্ন সম্প্রদায় বর্ত্তমান থাকিলেও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের ন্যায় বাংলায়ও যে ইহাদের মধ্যে কলহ ও দ্বেষ হিংসা ছিল না, বরং যথেষ্ট সম্ভাব ছিল, তাঁহার বহু প্রমাণ আছে। রাজগণ ধর্ম্ম বিষয়ে উদার মত পোষণ করিতেন। বৌদ্ধ পালরাজগণ যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম্ম বিষয়ে বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, তাঁহাদের শাসনলিপি হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। ধর্ম্মপাল ও তৃতীয় বিগ্রহপাল যে বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম মানিয়া চলিতেন, দুইখানি তাম্রশাসনে তাঁহার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। নারায়ণপাল নিজে একটি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এবং তাঁহার ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হইয়া অনেকবার শ্রদ্ধা-সলিলাপুত-হৃদয়ে নতশিরে, পবিত্র (শান্তি) বারি গ্রহণ করিয়াছিলেন”। মদনপালের প্রধানা মহিষী চিত্রমতিকা মহাভারত-পাঠ শ্রবণ করিয়া দক্ষিণস্বরূপ ব্রাহ্মণকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। বৌদ্ধ দেবখগের মহিষী প্রভাবতী চণ্ডীমূর্ত্তির প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। অপরদিকে শৈব রাজা বৈন্যগুপ্ত বৌদ্ধবিহার নির্মাণ, এবং একজন ব্রাহ্মণ সস্ত্রীক সোমপুরের জৈন বিহারের ব্যয় নিৰ্বাহাৰ্থ ভূমিদান করিয়াছিলেন। রাজা শ্রীধরণরাতের মন্ত্রী জয়নাথ বৌদ্ধবিহার ও ব্রাহ্মণদিগকে ভূমিদান করেন। এই সমুদয় দৃষ্টান্ত হইতে বুঝা যায় যে, সেকালে পরস্পরের ধর্ম্মমতের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ছিল। কান্তিদেবের তাম্রশাসনে ইহার আরও ব্যাপক পরিচয় পাই। তাঁহার পিতা ধনদও বৌদ্ধ ছিলেন, কিন্তু তাঁহার মাতা ছিলেন শিবের উপাসিকা। ধনদত্ত বৌদ্ধ হইলেও রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণ প্রভৃতিতে অভিজ্ঞ ছিলেন, একথা তাঁহার পুত্রের তাম্রশাসনে স্পষ্ট উল্লিখিত হইয়াছে।
তৎকালে শৈব, বৈষ্ণব, সৌর প্রভৃতি পৌরাণিক বিভিন্ন ধর্ম্মসম্প্রদায়ের মধ্যে কেবলমাত্র যে সদ্ভাব ছিল তাহা নহে, ইহাদের ব্যবধানরেখাও সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হইয়া ওঠে নাই। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে তাঁহাকে পরম-মাহেশ্বর ডোম্মনপালের তাম্রশাসনে ভগবান নারায়ণের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হইয়াছে। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের সদাশিব মুদ্রা-সংযুক্ত তাম্রশাসনে প্রথমে নারায়ণ ও পরে সূর্য্যের স্তব আছে, কিন্তু উক্ত রাজগণ পরমসৌর বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। এই তাম্রশাসনগুলি শৈব, বৈষ্ণব ও সৌর সম্প্রদায়ের অপূৰ্ব্ব সমন্বয়ের দৃষ্টান্ত।
.
দ্বিতীয় খণ্ড –দেব-দেবীর মূর্ত্তি পরিচয়
বাংলা দেশের প্রায় সৰ্ব্বত্রই বহু দেব-দেবীর মূর্ত্তি, আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহাদের উল্লেখ বা বিস্তৃত বর্ণনা করা বর্ত্তমান গ্রন্থে সম্ভবপর নহে। সুতরাং সংক্ষেপেই এ বিষয়টি আলোচনা করিব।
১. বিষ্ণমূৰ্ত্তি
বিষ্ণুমূৰ্ত্তির চারিহস্তে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম থাকে। কোনো কোনো স্থলে চক্র ও গদার প্রতিকৃতির পরিবর্তে একটি পুরুষ ও নারীমূর্ত্তি দেখা যায়। ইহাদের নাম চক্ৰপুরুষ ও গদাদেবী। বিষ্ণুর ভিন্ন ভিন্ন হস্তে এই চারিটি ভূষণ পরিবর্ত্তন করিয়া ২৪টি বিভিন্ন প্রকারের বিষ্ণুমূর্ত্তি পরিকল্পিত হইয়াছে। বাংলায় সচরাচর ত্রিবিক্রম রূপের বিষ্ণুই দেখা যায়। ইহার নিম্ন ও উৰ্দ্ধবাম এবং উৰ্দ্ধ ও নিম্নদক্ষিণ হস্তে যথাক্রমে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম, এবং দুই পার্শ্বে শ্রী ও পুষ্টি অর্থাৎ লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মূর্ত্তি। মালদহ জিলার হাঁকরাইল গ্রামে প্রাপ্ত মূর্ত্তিই সম্ভবত বাঙ্গালার সৰ্ব্বপ্রাচীন বিষ্ণুমূৰ্ত্তি। ইহার পদদ্বয় ও দুই হস্ত ভগ্ন এবং নিম্নদক্ষিণ হস্তে পদ্ম ও উপরের বাম হস্তে শঙ্খ। মূর্ত্তিটির মস্তকে কিরীট, কর্ণে কুণ্ডল, গলায় হার, বাহুতে অঙ্গদ ও বক্ষোদেশে যজ্ঞোপবীত।
বরিশাল জিলার অন্তর্গত লক্ষ্মণকাটি গ্রামে একটি প্রকাণ্ড বিষ্ণুমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার উচ্চতা ৬’-৪”। ঊর্ধ্বে উড্ডীয়মান ত্রিনেত্র গরুড়ের পক্ষোপরি বিষ্ণু ললিতাসনে উপবিষ্ট। তাঁহার উৰ্দ্ধদক্ষিণ ও বাম হস্তে ধৃত পদ্মনালের উপর যথাক্রমে লক্ষ্মী (গজ লক্ষ্মী) ও বীণাবাদিনী বাণীমূর্ত্তি। অন্য দুই হস্তে চক্ৰপুরুষসহ চক্র ও গদাদেবী। মস্তকের ষট্কোণ কিরীটের মধ্যস্থলে ধ্যানস্থ চতুর্ভুজ দেবমূর্ত্তি। হস্তোপরি লক্ষ্মী ও সরস্বতী (শ্ৰী ও পুষ্টি) এবং কিরীটস্থ ধ্যানী দেবমূৰ্ত্তি,-এই দুইটিই আলোচ্য মূর্ত্তির বিশেষত্ব, এবং ইহা সম্ভবত বৌদ্ধ মহাযান মতের প্রভাব সূচিত করে। কেহ কেহ এই মূর্ত্তিটি গুপ্তযুগের বলিয়া মনে করেন, কিন্তু ইহা সম্ভবত আরও অনেক পরবর্ত্তী কালের।
চৈতন্যপুরের (বর্দ্ধমান) একটি বিষ্ণুমূৰ্ত্তির পরিকল্পনায়ও বিশেষত্ব আছে। গদা ও চক্রের নীচে গদাদেবী ও চক্ৰপুরুষ। দণ্ডায়মান বিষ্ণুর দুই হস্ত ঘঁহাদের মাথায় আর দুই হস্তে শঙ্খ ও পদ্ম। মূর্ত্তিটির মুখাকৃতি ও পরিহিত বসন সবই একটু অদ্ভুত রকমের। ইহা সম্ভবত বৈখানসাগমে বর্ণিত অভিচারক-স্থানক মূর্ত্তি।
সাগরদীঘিতে প্রাপ্ত অষ্টধাতুনির্ম্মিত বিষ্ণুমূর্ত্তির বিশেষত্ব এই যে তাঁহার তিনটি ভূষণ-শঙ্খ, চক্র ও গদা-একটি পূর্ণ-প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর রক্ষিত এবং প্রতি পদ্মের নালটি বিষ্ণু হস্তে ধরিয়া আছেন।
দিনাজপুর জিলার সুরাহর গ্রামে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূৰ্ত্তি সাতটি নাগফণার নীচে দণ্ডায়মান। শ্রী ও পুষ্টির পরিবর্তে দুইপার্শ্বে দুইটি পুরুষমূর্ত্তি (সম্ভবত শঙ্খপুরুষ ও চক্ৰপুরুষ)। মধ্যস্থিত নাগফণার উপরিভাগে ক্ষুদ্র দ্বিভুজ ধ্যানী মূর্ত্তি এবং পাদপীঠের মধ্যভাগে ষড়ভুজ নৃত্যপরায়ণ শিব। অনেকে অনুমান করেন যে, উপরিস্থিত ধ্যানীমূৰ্ত্তি ব্রহ্মা এবং সমগ্র মূর্ত্তিটি ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব এই ত্রিমূর্ত্তির পরিকল্পনা। কিন্তু ব্রহ্মার দুই ভুজ ও এক মুখ বড় দেখা যায় না। সুতরাং এ মূর্ত্তিটিও সম্ভবত মহাযান মতের প্রভাবের ফল।
এইরূপ বিশেষত্ব খুব কম মূর্ত্তিতেই দেখা যায়। সচরাচর যে সমুদয় বিষ্ণুমূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়, বাঘাউরা গ্রামে প্রাপ্ত সম্রাট মহীপালের তৃতীয় রাজ্য সম্বৎসরে উৎকীর্ণ লিপি-সংযুক্ত মূর্ত্তিটি তাঁহার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন (চিত্র নং ১৮)। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী দণ্ডায়মান বিষ্ণুমূৰ্ত্তি উত্তম বসন-ভূষণে সজ্জিত; কিরীট, কুণ্ডল, অঙ্গদ, বনমালা, মেখলা, বসন প্রভৃতি বিচিত্র কারুকাৰ্য্য-খচিত; ঊর্ধে মস্তকোপরি প্রভাবলী, তাঁহার দুই পার্শ্বে পুস্পমাল্য-হস্তে উডড্ডীয়মান বিদ্যাধরযুগলের মূর্ত্তি, মূর্ত্তির পশ্চাতে সিংহাসন ও অধোদেশে দুই পার্শ্বে লক্ষ্মী ও সরস্বতী; পাদপীঠের মধ্যস্থলে প্রস্ফুটিত পদ্মদলের উপর বিষ্ণুর চরণযুগল; ইহার দক্ষিণভাগে দুইটি ও বামভাগে একটি মনুষ্যমূর্ত্তি, সম্ভবত ইহারা মূর্ত্তি-প্রতিষ্ঠাকারী ও তাঁহার পরিবারবর্গ।
বিষ্ণুমূৰ্ত্তি সাধারণত দণ্ডায়মান (চিত্র নং ১৯), কিন্তু কোনো কোনো স্থলে অর্দ্ধশয়ান, অথবা যোগাসনে উপবিষ্ট। কোনো কোনো মূর্ত্তিতে বিষ্ণু ও লক্ষ্মী একত্র উপবিষ্ট দেখা যায়। ঢাকা জিলাস্থিত বাস্তা গ্রামের লক্ষ্মী-নারায়ণ মূৰ্ত্তি ইহার একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বিষ্ণু ও তাঁহার বাম উরুর উপর লক্ষ্মী, এই যুগলমূৰ্ত্তি গরুড়ের পৃষ্ঠদেশে বসিয়া আছেন। উভয়েরই একটি চরণ গরুড়ের প্রসারিত এক এক হস্তে র উপর স্থাপিত। গরুড়ের অন্য দুইটি হস্ত সম্মুখে অঞ্জলিবদ্ধ।
বিষ্ণুর দশ অবতারের মূর্ত্তি-সম্বলিত প্রস্তরখণ্ড অনেক পাওয়া গিয়াছে। পৃথকভাবে বরাহ, নরসিংহ ও বামন অবতারের মূর্ত্তিই সাধারণত দেখা যায়। মৎস্য, বলরাম ও পরশুরাম এই তিন অবতারেরও মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। মৎস্য মূর্ত্তি চতুর্ভুজ; ঊর্ধ্বদেশ মানুষের ও অধোদেশ মৎস্যের আকৃতি (চিত্র নং ২০)। বরাহমূৰ্ত্তিরও কেবল মুখটি বরাহের, অন্যান্য অংশ মানুষের মতন।
রাজসাহী চিত্রশালায় একটি দণ্ডায়মান মূৰ্ত্তির বিশ হস্তে গদা, অঙ্কুশ, খড়গ, মুদ্র, শূল, শর, চক্র, খেটক, ধনু, পাশ, শঙ্খ প্রভৃতি আয়ুধ। দুই পার্শ্বে স্থুলোদর দুইটি মূর্ত্তি। মূল মূৰ্ত্তি বনমালা ও অন্যান্য ভূষণে ভূষিত। ইহা সম্ভবত বিষ্ণুর বিশ্বরূপ মূর্ত্তি।
ব্রহ্মা ও বিষ্ণুর একাত্মক একটি মূৰ্ত্তি উত্তরবঙ্গে পাওয়া গিয়াছে। চতুর্মুখ ব্রহ্মার তিনটি মুখই কেবল দেখা যায়; তাঁহার চারি হস্তে সুক, সুব, অক্ষমালা ও কমণ্ডলু। মূৰ্ত্তির দুই পার্শ্বে লক্ষ্মী, সরস্বতী, শঙ্খপুরুষ ও চক্ৰপুরুষ এবং গলে বনমালা বিষ্ণুর নিদর্শন। পাদপীঠের এক পার্শ্বে ব্রহ্মার বাহন হংস ও অপর পার্শ্বে বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের মূর্ত্তি।
ব্রহ্মার যে সমুদয় পৃথক মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে, তাহাও চতুর্মুখ (একটি অদৃশ্যমান) ও স্থূলোদর এবং তাঁহার বাহন ও চারি হস্তে ধৃত দ্রব্যাদি উক্ত মূর্ত্তির অনুরূপ।
সাধারণত বিষ্ণুমূর্ত্তির বাহন ও পার্শ্বচরীরূপে পরিকল্পিত হইলেও গরুড়, (চিত্র নং ২৭ গ) লক্ষ্মী ও সরস্বতীর পৃথক মূৰ্ত্তিও পাওয়া গিয়াছে। রাজসাহী চিত্রশালায় এইরূপ একটি গরুড়মূৰ্ত্তি রক্ষিত আছে। ইহার অঞ্জলিবদ্ধ হস্তে ও মুখশ্রীতে সেবকের ভক্তি ও শ্রদ্ধার ভাব চমৎকার ফুটিয়া উঠিয়াছে।
বগুড়ায় একটি চমৎকার অষ্টধাতুনির্ম্মিত লক্ষ্মীমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ত্রিভঙ্গ ভঙ্গীতে দণ্ডায়মান দেবীর তিন হস্তে ফল, অঙ্কুশ ও ঝাঁপি (আর এক হস্ত ভগ্ন); দুই পার্শ্বে চামরহস্তে পার্শ্বচরী; মস্তকোপরি প্রস্ফুটিত পদ্মদলের দুই দিক হইতে দুইটি হস্তী শুণ্ডধৃত কলসীর জল দিয়া দেবীকে স্নান করাইতেছে। লক্ষ্মীর এই প্রকার গজমূৰ্ত্তিই সাধারণত দেখা যায়। কিন্তু দুই হস্তবিশিষ্ট সাধারণ লক্ষ্মীমূৰ্ত্তিও পাওয়া গিয়াছে।
সরস্বতীর মূর্ত্তি সাধারণত চারি হস্ত-বিশিষ্ট। দেবী দুই হস্তে বীণা বাজাইতেছেন, অপর দুই হস্তে অক্ষমালা ও পুস্তক। দেবীর দুই পার্শ্বে চামরধারিণী, পাদপীঠে কোনো কোনো স্থলে তাঁহার সুপরিচিত বাহন হংস, কিন্তু কোনো স্থলে আবার একটি মেষের মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়। ছাতিনা গ্রামে প্রাপ্ত সরস্বতীর মূর্ত্তি (চিত্র নং ২৩) ইহার চমৎকার দৃষ্টান্ত।
.
২. শৈবমূর্ত্তি
শিব সাধারণত লিঙ্গরূপেই পূজিত হইতেন। লিঙ্গ প্রধানত দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। সাধারণ শিবলিঙ্গ বাংলায় সুপরিচিত এবং চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্ত্তির ন্যায় ইহাও এদেশে বহু সংখ্যায় পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু আর এক প্রকার লিঙ্গ আছে। ইহাতে লিঙ্গের উপর শিবের মুখ খোদিত থাকে, ইহার নাম মুখলিঙ্গ। মুখের সংখ্যা অনুসারে মুখলিঙ্গ একমুখ বা চতুর্মুখ। একমুখ লিঙ্গই বেশী পাওয়া যায়। ত্রিপুরা জিলায় উনকোটি গ্রামে প্রস্তরনির্ম্মিত এবং মুর্শিদাবাদে অষ্টধাতুর চতুর্মুখ লিঙ্গ পাওয়া গিয়াছে।
শিবের মূর্ত্তি নানারূপে কল্পিত হইয়াছে। ইহার মধ্যে চন্দ্রশেখর, নটরাজ বা নৃত্যমূৰ্ত্তি, সদাশিব, উমা-মহেশ্বর, অর্দ্ধনারীশ্বর ও কল্যাণ-সুন্দর, শিবের সৌম্য ভাব দ্যোতক, এবং অঘোর-রুদ্র তাঁহার উগ্রভাবের পরিকল্পনা। পাহাড়পুরে শিবের তিনটি চন্দ্রশেখর-মূৰ্ত্তি খোদিত আছে। ইহাদের তিন নেত্র, উলিঙ্গ ও জটামুকুট এবং দুই হস্তে ত্রিশূল, অক্ষমালা ও কমণ্ডলু প্রভৃতি লক্ষিত হয়। একটি মূর্ত্তিতে সর্প শিবের গলদেশে জড়াইয়া আছে। বিবসন হইলেও শিবের গলায় হার, কর্ণে, কুণ্ডল এবং বাহুতে কেয়ুর প্রভৃতি ভূষণ ও গলায় যজ্ঞোপবীত আছে।
পরবর্ত্তীকালে শিবের মূর্ত্তিতে আরও অনেক বৈচিত্র্য ও উপাদান-বাহুল্য দেখা যায়। রাজসাহী জিলার গণেশপুরে প্রাপ্ত মূৰ্ত্তি (চিত্র নং ২২ ক) ইহার এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। চতুর্ভুজ মূর্ত্তির এক হস্তে দীর্ঘ দলবিশিষ্ট পদ্ম, আর এক হস্তে শূল অথবা খট্টাঙ্গ (অপর দুই হস্ত ভগ্ন)। বিচিত্র কারুকাৰ্য্যশোভিত সপ্তরথ পাদপীঠের কেন্দ্রস্থলে বিশ্বপদ্মের উপর নানা বিভূষণে সজ্জিত শিব ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান। মস্তকের চতুর্দিকে বিচিত্র প্রভাবলী,ইহার দুই পার্শ্বে মালা হস্তে উড্ডীয়মান গন্ধৰ্ব্ব। মূর্ত্তির পশ্চাতে কারুকার্যখচিত সিংহাসন ও নিম্নে দুই পার্শ্বে দুইজন কিঙ্কর ও কিঙ্করী। কিঙ্করগণের হস্তে শূল ও কপাল এবং কিঙ্করীগণের হস্তে চামর। ইহা শিবের ঈশানমূৰ্ত্তি। বরিশাল জিলার অন্তর্গত কাশীপুর গ্রামে বিরূপাক্ষরূপে পূজিত চতুর্ভুজ শিব সম্ভবত নীলকণ্ঠ। সারদাতিলক তন্ত্র অনুসারে নীলকণ্ঠের পাঁচটি মুখ। এই মূর্ত্তির মুখ মাত্র একটি, কিন্তু উক্ত তন্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী ইহার হস্তে অক্ষমালা, ত্রিশূল, খট্টাঙ্গ ও কপাল আছে। বর্ণনার অতিরিক্ত এই মূর্ত্তিতে কীর্তিমুখের পরিবর্তে ছত্র, প্রভাবলীর দুই পার্শ্বে কার্তিক-গণেশের মূৰ্ত্তি ও নিয়ে দুই পার্শ্বে মকরবাহিনী গঙ্গা ও সিংহবাহিনী পার্ব্বতীর মূর্ত্তি প্রভৃতি বিশেষ লক্ষ্য করিবার বিষয়। মূৰ্ত্তির অধোভাগে শিবের বাহন নন্দীর মূর্ত্তি। বরিশাল জিলায় প্রাপ্ত একটি ব্রঞ্জের শিবমূৰ্ত্তির (চিত্র নং ২৮ খ) শীর্ষদেশে ধ্যানীবুদ্ধের মূর্ত্তির ন্যায় একটি মূর্ত্তি বিশেষভাবে লক্ষ্য করিবার বিষয়। এরূপ দ্বিতীয় মূৰ্ত্তি এখনো পাওয়া যায় নাই।
বাংলায় নটরাজ শিবের যে সমুদয় মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার হস্তসংখ্যা দশ অথবা বারো এবং শিব বৃষপৃষ্ঠে নৃত্যপরায়ণ। দক্ষিণ ভারতের নটরাজ বৃষারূঢ় নহেন এবং তাঁহার মাত্র চারি হাত। বাংলার দশভুজ নটরাজ মূর্ত্তির সহিত মৎস্যপুরাণের বর্ণনার ঐক্য আছে। এই বর্ণনা অনুযায়ী শিবের দক্ষিণ চারি হস্তে খড়গ, শক্তি, দণ্ড, ত্রিশূল এবং বাম চারি হস্তে খেটক, কপাল, নাগ ও খট্টাঙ্গ; নবম হস্তে অক্ষমালা, এবং দশম হস্ত বরদামুদ্রাযুক্ত। দ্বাদশভুজ শিবের মূর্ত্তি অন্যরূপ। শিব দুই হস্তে বীণা বাজাইতেছেন, দুই হস্তে তাল দিতেছেন ও আর দুই হস্তে ছত্রের ন্যায় সর্প ধরিয়া আছেন; বাকী হস্তগুলিতে শিবের সুপরিচিত আয়ুধাদি আছে। ঢাকা জিলাস্থিত শঙ্করবাঁধা গ্রামে প্রাপ্ত একটি মূর্ত্তি (চিত্র নং ২২ গ) নটরাজ শিবের সুন্দর দৃষ্টান্ত। ইহার দশ হস্তে মৎস্যপুরাণোক্ত আয়ুধাদি আছে। শিবের বাহন বৃষটিও নৃত্যশীল প্রভুর দিকে মুখ ফিরাইয়া দুই পা ঊর্ধ্বে তুলিয়া নৃত্য করিতেছে। ইহার দুই পার্শ্বে মকরবাহিনী গঙ্গা ও সিংহবাহিনী পার্ব্বতী। মূর্ত্তির উপরে ও উভয় পার্শ্বে প্রধান প্রধান দেব-দেবীর মূর্ত্তি। পাদপীঠে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য নাগ-নাগিনী ও গণের নৃত্যপরায়ণ মূর্ত্তি। শিল্পী পারিপার্শ্বিকের সাহায্যে নটরাজ শিবের সৌন্দর্য্য উজ্জ্বলরূপে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন।
সদাশিব-মূর্ত্তি বাংলায় অনেক পাওয়া গিয়াছে। সেনরাজগণের তাম্রশাসন মুদ্রায় যে এই মূর্ত্তি উল্কীর্ণ তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। মহানিৰ্বাণতন্ত্র, উত্তরকামিকাগম এবং গরুড়পুরাণে সদাশিব মূৰ্ত্তির বর্ণনা আছে। শেষোক্ত দুইখানি গ্রন্থের বর্ণনার সহিত বাংলার সদাশিব-মূৰ্ত্তির অধিকতর সঙ্গতি দেখা যায়। এই বর্ণনা অনুসারে বদ্ধপদ্মাসনস্থিত সদাশিব-মূর্ত্তির পাঁচটি মুখ ও দশটি হস্ত থাকিবে। দক্ষিণ দুই হস্ত অভয় ও বরদ মুদ্রাযুক্ত এবং অবশিষ্ট তিন হস্তে শক্তি, ত্রিশূল ও খট্টাঙ্গ; বাম পাঁচ হস্তে সর্প, অক্ষমালা, ডমরু, নীলোৎপল ও লেবুফল থাকিবে। তাঁহার পার্শ্বে মনোম্মানীর মূর্ত্তি থাকিবে। দিনাজপুর জিলার অন্তর্গত রাজিবপুরে তৃতীয় গোপালের লিপিযুক্ত সদাশিব-মূর্ত্তি বাংলার এই জাতীয় মূর্ত্তির একটি সুন্দর নিদর্শন। ইহাতে মনোম্মানীর মূৰ্ত্তি নাই, কিন্তু পঞ্চরথ পাদপীঠের মধ্যস্থলে শূলধারী দুইটি শিবকিঙ্করের মূর্ত্তি আছে। বাংলার সদাশিব মূর্ত্তিগুলির সহিত দক্ষিণ ভারতে রচিত শাস্ত্রের বর্ণনার সামঞ্জস্য এবং সেনরাজগণের শাসনমুদ্রায় সদাশিব মূর্ত্তি দেখিয়া কেহ কেহ অনুমান করেন যে, সেনরাজগণই দাক্ষিণাত্য হইতে বাংলায় সদাশিব-মূর্ত্তির প্রচলন করেন। কিন্তু যে শৈব আগম হইতে সদাশিব পূজার উৎপত্তি, তাহা উত্তর ভারতেই রচিত হয়। সম্ভবত এই আগমোক্ত সদাশিব পূজা প্রথমে উত্তর ভারত হইতে দাক্ষিণাত্যে প্রচারিত হয়, পরে সেনরাজগণ তথা হইতে ইহা বাংলায় প্রচলন করেন।
শিবের আলিঙ্গন অথবা উমা-মহেশ্বর মূর্ত্তি বাংলায় সুপরিচিত। শিবের বাম জানুর উপর উপবিষ্ট উমা দক্ষিণ হস্তে শিবের গলদেশ বেষ্টন করিয়াছেন এবং বাম হস্তে একখানি দর্পণ ধরিয়া আছেন। শিবের দক্ষিণ হস্তে একটি পদ্ম এবং বাম হস্ত দ্বারা তিনি দেবীকে আলিঙ্গন করিয়া আছেন। সম্ভবত তান্ত্রিক ধৰ্ম্মমতের প্রভাবেই বাংলায় এই মূর্ত্তির বহুল প্রচার হইয়াছিল। কারণ তন্ত্রমতে সাধকগণকে শিবের ক্রোড়ে উপবিষ্টা দেবীমূর্ত্তিকে ধ্যান করিতে হয়, এবং এই প্রকার মূৰ্ত্তি সম্মুখে রাখিলে এই ধ্যানযোগের সুবিধা হয়।
বৈবাহিক অথবা কল্যাণসুন্দর মূর্ত্তিতে শিবের ঠিক সম্মুখেই গৌরী দাঁড়াইয়া আছেন। শেষোক্ত দুই প্রকার মূর্ত্তিতে শিব ও উমার মূর্ত্তি একত্র হইলেও পৃথক। কিন্তু অর্দ্ধনারীশ্বর মূর্ত্তিতে উভয়ে এক দেহে পরিণত হইয়াছেন। এই মূর্ত্তির দক্ষিণ-অর্দ্ধ শিবের ও বাম-অৰ্দ্ধ উমার। অর্দ্ধনারীশ্বর ও কল্যাণসুন্দর মূর্ত্তি বাংলায় খুব বেশী পাওয়া যায় নাই।
এ পর্য্যন্ত শিবের যে সমুদয় মূর্ত্তি আলোচিত হইয়াছে, তাহা সৌমাভাবের দ্যোতক। শিবের রুদ্র মূর্ত্তি ভারতের অন্যান্য প্রদেশে খুব প্রচলিত থাকিলেও বাংলায় মাত্র অল্প কয়েকটি পাওয়া গিয়াছে। এইগুলিতে শিবের দিগম্বর, নরমুণ্ডমালা-বিভূষিত, উলঙ্গ নরদেহের উপর দণ্ডায়মান মূর্ত্তি এবং গুর্ধ-শকুনী পরিবেষ্টিত নরমুণ্ড-রচিত পাদপীঠ প্রভৃতি বীভৎস ভাবের পরিকল্পনা দেখা যায়।
শিবের পুত্র গণেশের বহুসংখ্যক মূর্ত্তি বাংলায় পাওয়া গিয়াছে। উপবিষ্ট, দণ্ডায়মান ও নৃত্যশীল, গণেশের এই তিন প্রকার মূর্ত্তি পরিকল্পিত হইয়াছে। কার্তিকের পৃথক মূৰ্ত্তি খুবই কম। কিন্তু উত্তরবঙ্গে ময়ূরবাহন কার্তিকের একটি সুন্দর মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে (চিত্র নং–২১ ক)।
.
৩. শক্তি-মূর্ত্তি
বাংলায় বহুসংখ্যক ও বিভিন্ন শ্রেণীর দেবীমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার কোনো কোনোটিতে বৈষ্ণব প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু অধিকাংশই শাক্তগণের আরাধ্য দেবী।
ত্রিপুরা জেলার দেউবাড়ী স্থানে প্রাপ্ত অষ্টধাতুনির্ম্মিত দেবীমূর্ত্তির পাদপীঠে খড়গবংশীয়া রাণী প্রভাবতীর লিপি উৎকীর্ণ আছে। সুতরাং ইহা সপ্তম শতাব্দীর এবং এই শ্রেণীর মূর্ত্তির সর্বপ্রাচীন নিদর্শন। দেবী অষ্টভুজা ও সিংহবাহিনী, এবং তাঁহার হস্তে শঙ্খ, তীর, অসি, চক্র, ঢাল, ত্রিশূল, ঘণ্টা ও ধনু। পরবর্ত্তীকালে রচিত শারদাতিলক-তন্ত্রে এই দেবী দ্রদুর্গা, ভদ্রকালী, অম্বিকা, ক্ষেমঙ্করী ও বেদগর্ভা প্রভৃতি নামে অভিহিত হইয়াছেন, কিন্তু উত্তীর্ণ লিপি অনুসারে ইহার নাম সৰ্ব্বাণী।
বাংলায় এক শ্রেণীর চতুর্ভুজা দেবীমূৰ্ত্তি সচরাচর দেখা যায়। কেহ কেহ ইহাকে চণ্ডী এবং কেহ কেহ গৌরী-পাৰ্বতী নামে অভিহিত করিয়াছেন। এই দণ্ডায়মানা দেবীমূৰ্ত্তির হস্তে অক্ষসহ শিবলিঙ্গ, ত্রিদী অথবা ত্রিশূল, দাড়িম্ব ও কমণ্ডলু এবং পাদপীঠে একটি গোধিকার মূর্ত্তি। কোনো কোনো মূৰ্ত্তিতে দেবীর দুই পার্শ্বে কার্তিক-গণেশ অথবা লক্ষ্মী-সরস্বতী, সিংহ, মৃগ, ও কদলী বৃক্ষ, ঊর্ধ্বে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এবং নবগ্রহ প্রভৃতির মূর্ত্তি দেখিতে পাওয়া যায়।
উপবিষ্টা দুর্গামূৰ্ত্তিও অনেক দেখিতে পাওয়া যায়। ইহার কোনোটি চতুর্ভুজা, কোনোটি ষড়ভুজা। বিংশভুজা একটি মূর্ত্তিও পাওয়া গিয়াছে–ইনি সম্ভবত মহালক্ষ্মী। বিক্রমপুরের কাগজিপাড়ায় পাষাণ লিঙ্গের উদ্ধৃভাগ হইতে আবির্ভূত একটি দেবীমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে; ইহার চারি হস্ত। দুইটি হস্ত ধ্যানমুদ্রাযুক্ত ও বক্ষোদেশের নিম্নভাগে সংন্যস্ত। তৃতীয় হস্তে অক্ষমালা ও চতুর্থ হস্তে পুঁথি। ইনি সম্ভবত মহামায়া অথবা ত্রিপুরভৈরবী।
দেবীর রুদ্রভাবদ্যোতক অনেক মূৰ্ত্তি পাওয়া যায়। ইহার মধ্যে মহিষমর্দিনীই সমধিক প্রসিদ্ধ। বর্ত্তমানে শরৎকালে বাংলায় যে দুর্গার পূজা হয়, তাহা এই মহিষ মর্দিনীর মূৰ্ত্তি হইতেই উদ্ভূত। এই মূর্ত্তি কেবল ভারতের সৰ্ব্বত্র নহে, সুদূর যবদ্বীপেও সুপরিচিত ছিল। মার্কণ্ডেয় পুরাণের চণ্ডী অধ্যায়ে এই দেবীর সবিশেষ বিবরণ আছে। অষ্ট অথবা দশভুজা সিংহবাহিনী দেবী সদ্য নিহত মহিষের দেহ হইতে নিষ্ক্রান্ত অসুরের সহিত যুদ্ধে নিরত, তাঁহার হস্তে ত্রিশূল, খেটক, শর, খড়গ, ধনু, পরশু, অঙ্কুশ, নাগপাশ প্রভৃতি আয়ুধ। দিনাজপুর জিলার পোর্শা গ্রামে নবদুর্গার মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার মধ্যস্থলে একটি বড় এবং চতুস্পার্শ্বে ক্ষুদ্র আটটি মহিষ-মর্দিনীর মূৰ্ত্তি। বড় মূর্ত্তিটির অষ্টাদশ এবং ক্ষুদ্র মূর্ত্তিগুলির ষোড়শ ভুজ। ভবিষ্যৎ পুরাণে এই দেবীর বর্ণনা আছে। দিনাজপুরের বেত্রা গ্রামে ৩২টি হস্তবিশিষ্টা অসুরের সহিত যুদ্ধরতা একটি দেবীর মূর্ত্তিও পাওয়া গিয়াছে। কোনো গ্রন্থেই ইহার বর্ণনা নাই এবং এরূপ অন্য কোনো মূৰ্ত্তিও এ পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই। বাখরগঞ্জের অন্তর্গত শিকারপুর গ্রামে পূজিতা উগ্রতারা দেবীমূৰ্ত্তির চারি হস্তে খড়গ, তরবারি, নীলোৎপল ও নরমুণ্ড। শবের উপর দণ্ডায়মান দেবীমূর্ত্তির উপরিভাগে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কার্তিক ও গণেশের মূর্ত্তি উৎকীর্ণ।
বাংলায় পাশাপাশি উত্তীর্ণ সপ্তমাতৃকার মুক্তিযুক্ত প্রস্তরখণ্ড অনেক পাওয়া গিয়াছে। এই মাতৃকাগণ দেবগণের শক্তিরূপে কল্পিত। ইঁহাদের নাম ব্রহ্মাণী, মাহেশ্বরী, কৌমারী, ইন্দ্রাণী, বৈষ্ণবী, বারাহী ও চামুণ্ডা। চামুণ্ডার পৃথক ও বিভিন্ন রূপের মূর্ত্তি অনেক পাওয়া যায়। ইহার কোনো কোনোটি ষড়ভুজা, নানা আয়ুধধারিণী ও নৃত্যপরায়ণা। বর্দ্ধমান জিলার অট্টহাস গ্রামে চামুণ্ডা দেবীর দম্ভরারূপের এক অদ্ভুত মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার অতি ক্ষীণ শীর্ণ দেহ, গোলাকৃতি চক্ষু, বিকশিত দন্ত, পৈশাচিক হাস্য, কোটরগত জঠর ও ঊৰ্দ্ধজানু হইয়া বসিবার ভঙ্গী-সকলই একটা অদ্ভুত ভৌতিক রহস্যের দ্যোতক।
চামুণ্ডা ব্যতীত ব্রহ্মাণী, বারাহী ও ইন্দ্রাণী (চিত্র নং ২২ খ) এই তিন মাতৃকারও পৃথক মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। তবে তাহা সংখ্যায় অল্প।
প্রধান প্রধান ধর্ম্মমত ব্যতীত এদেশে অনেক লৌকিক ধৰ্ম্মানুষ্ঠান ও দেব দেবীর পূজা জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ছিল। পরবর্ত্তীকালে এই সমুদয় দেব দেবী শিব অথবা বিষ্ণুর পরিবারভুক্ত বলিয়া গণ্য হইলেও আদিতে হঁহারা লৌকিক দেবতা মাত্র ছিলেন, এরূপ অনুমানই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। এইরূপ যে সমুদয় দেবীর মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে তাহাদের মধ্যে মনসা, হারীতী, ষষ্ঠী, শীতলা প্রভৃতির উল্লেখ করা যাইতে পারে। গঙ্গা ও যমুনার মূর্ত্তি সাধারণত মন্দিরের দরজার দুই পার্শ্বে খোদিত থাকে, কিন্তু তাঁহাদের পৃথক মূর্ত্তিও পাওয়া গিয়াছে (চিত্র নং ৯)।
বাংলা দেশে ও পূর্ব্ব ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এক শ্রেণীর দেবীমূর্ত্তি বহুসংখ্যায় দেখিতে পাওয়া যায়। দেবী একটি শিশুপুত্র পার্শ্বে লইয়া শুইয়া আছেন এবং একটি কিঙ্করী তাঁহার পদসেবা করিতেছে। উৰ্দ্ধদেশে শিবলিঙ্গ এবং কার্তিক, গণেশ ও নবগ্রহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মূর্ত্তি। কেহ কেহ ইহাকে কৃষ্ণ-যশোদার মূর্ত্তি বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন, আবার কেহ কেহ মনে করেন যে, শিশুটি সদ্যোজাত শিবের মূর্ত্তি।
.
৪. অন্যান্য পৌরাণিক দেবমূর্ত্তি
রাজসাহী জিলার অন্তর্গত কুমারপুর ও নিয়ামপুরে যে দুইটি সূৰ্য্যমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে, তাহা গুপ্তযুগে নির্ম্মিত বলিয়া অনুমিত হয়। এই প্রাচীন মূর্ত্তিতে সূর্যের দুই হস্ত সনাল পদ্ম, দুই পার্শ্বে অনুচর ও পাদপীঠে সপ্তাশ্ব উত্তীর্ণ দেখিতে পাওয়া যায়। বগুড়া জিলার দেওড়া গ্রামে প্রাপ্ত রথারূঢ় সূৰ্য্যমূর্ত্তিতে সারথি অরুণের দুই পার্শ্বে দণ্ডী ও পিঙ্গল নামক দুই অনুচর ব্যতীত শরনিক্ষেপকারিণী ঊষা ও প্রত্যুষা নামে দুই দেবী আছেন। পরবর্ত্তীকালের সূৰ্য্যমূৰ্ত্তিতে সংজ্ঞা ও ছায়া নামে সূর্যের দুই রাণী ও মহাশ্বেতা নামে আর এক পার্শ্বচারিণীর মূর্ত্তি এবং মূল মূর্ত্তির বক্ষোদেশ উপবীত ও পদদ্বয়ে জুতা দেখা যায় (চিত্র নং ১৫-১৭)। সূৰ্য্যমূৰ্ত্তি সাধারণত দ্বিভুজ কিন্তু দিনাজপুরের অন্তর্গত মহেন্দ্র নামক স্থানে একটি ষড়ভুজ সূৰ্য্যমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। দক্ষিণ ভারতের সূৰ্য্যমূর্ত্তির ন্যায় বাংলার কৃচিৎ দুই-একটি মূর্ত্তিতে জুতা দেখিতে পাওয়া যায় না। রাজসাহী জিলার অন্তর্গত মান্দায় প্রাপ্ত একটি সূৰ্য্যমূর্ত্তির তিনটি মুখ ও দশটি বাহু। পার্শ্বের দুইটি মুখের ভাব অতিশয় উগ্র ও দশ বাহুতে শক্তি, খট্টাঙ্গ, ডমরু প্রভৃতি দেখিয়া অনুমিত হয় যে ইহা মার্তণ্ড-ভৈরবের মূর্ত্তি। কিন্তু শারদাতিলক তন্ত্র অনুসারে মার্তণ্ড-ভৈরবের চারিটি মুখ।
পুরাণ অনুসারে রেবন্ত সূর্যের পুত্র। রেবন্তের কয়েকটি মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। দিনাজপুর জিলার ঘাটনগরে প্রাপ্ত মূর্ত্তিটি বুটজুতা-পরিহিত ও অশ্বারূঢ়; এক হস্তে কশা, অন্য হস্তে অশ্বের বলগা; একটি অনুচর দেবমূৰ্ত্তির মস্তকে ছত্র ধারণ করিয়া আছে; সম্মুখ হইতে একটি ও পশ্চাতে বৃক্ষের উপর হইতে আর একটি দস্যু রেবন্তকে আক্রমণ করিতে উদ্যত। ত্রিপুরা জিলায় বড়কামতা গ্রামে প্রাপ্ত ভগ্ন একটি মূর্ত্তিতে অশ্বারূঢ় রেবন্তের হস্তে একটি পাত্র এবং তাঁহার পশ্চাতে কুকুর, বাদক ও অনুচরের দল। সম্ভবত এটি মৃগয়াযাত্রার দৃশ্য। বৃহৎসংহিতা ও অন্যান্য গ্রন্থে রেবন্তের এইরূপ বর্ণনা আছে। ঘাটনগরের মূর্ত্তিটি মার্কণ্ডেয় পুরাণের বর্ণনার অনুরূপ।
নবগ্রহের সহিতও সূর্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ। নবগ্রহের মূৰ্ত্তি সাধারণত একসঙ্গে পৃথক কোনো প্রস্তরখণ্ডে অথবা অন্য কোনো দেবমূর্ত্তির পারিপার্শ্বিকরূপে উত্তীর্ণ দেখা যায়। চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত কাকলদীঘি গ্রামে নবগ্রহের একটি সুন্দর মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। নয়টি গ্রহদেবতা তাঁহাদের বিশিষ্ট লাঞ্ছন হস্তে এক পংক্তিতে দাঁড়াইয়া আছেন এবং তাঁহাদের বাহনগুলি যথাক্রমে পাদপীঠের নিম্নভাগে উত্তীর্ণ হইয়াছে। অগ্রভাগে গণেশের একটি মূর্ত্তি আছে। এই প্রকার নবগ্রহমূর্ত্তির সাহায্যেই সম্ভবত স্বস্ত্যয়ন অথবা গ্রহযোগ সম্পন্ন হইত। নবগ্রহের পৃথক পৃথক মূৰ্ত্তি বড় একটা পাওয়া যায় না। তবে পাহাড়পুরের প্রধান মন্দিরের তলভাগে যে সমুদয় প্রস্তরফলক আছে, তাহাতে চন্দ্র ও বৃহস্পতির দুইটি মূৰ্ত্তি উত্তীর্ণ আছে।
ইন্দ্র, অগ্নি, যম, বরুণ, কুবের প্রভৃতি দিকপালের মূৰ্ত্তিও পাহাড়পুরে ও বাংলার অন্যান্য স্থানে পাওয়া গিয়াছে।
.
৫. জৈনমূৰ্ত্তি
সাধারণত বাংলায় যে সকল দেবমূৰ্ত্তি পাওয়া যায়, তাহা অষ্টম শতাব্দীর পরবর্ত্তী। সম্ভবত ঐ সময় হইতেই বাংলায় জৈনধর্ম্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তি খুবই কমিয়া যায় এবং এই কারণেই জৈনমূৰ্ত্তি বাংলায় খুব কমই পাওয়া গিয়াছে।
দিনাজপুর জিলার অন্তর্গত সুরহর গ্রামে তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের একটি অপূৰ্ব্ব মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। মন্দিরাকারে গঠিত শিলাপটের ঠিক মধ্যস্থলে বদ্ধপদ্মাসনে জিন ঋষভনাথ উপবিষ্ট, এবং পাদপীঠের নিম্নে তাঁহার বিশেষ লাঞ্ছন বৃষমূর্ত্তি। এই মূর্ত্তির উর্ধ্বে তিন সারিতে ও দুই পার্শ্বে দুই শ্রেণীতে অনুরূপ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মন্দিরে উপবিষ্ট অবশিষ্ট তেইশজন তীর্থঙ্করের ক্ষুদ্র মূর্ত্তি। মূল মূর্ত্তির দুই ধারে চৌরী হস্তে দুইজন অনুচর ও মস্তকের দুই পার্শ্বে মাল্যহস্তে দুইজন গন্ধৰ্ব্ব। এই সুন্দর মূর্ত্তিটি সূক্ষ্ম শিল্পজ্ঞানের পরিচায়ক এবং সম্ভবত পালযুগের প্রথমভাগে নির্ম্মিত। মেদিনীপুর জিলার বরভূমে ঋষভনাথের আর একটি মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহাতে কেন্দ্রস্থলে মূল মূর্ত্তির দুই পার্শ্বে চব্বিশজন তীর্থঙ্করের মূর্ত্তি; সকলেই কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান।
বাঁকুড়ার অন্তর্গত দেউলভিরে জিন পার্শ্বনাথের একটি মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। জিন যোগাসনে বসিয়া আছেন এবং তাঁহার মস্তকের উপর একটি সর্প সাতটি ফণা বিস্তার করিয়া আছে। চব্বিশ পরগণার কাঁটাবেনিয়ায় কায়োৎসর্গ মুদ্রায় দণ্ডায়মান একটি পার্শ্বনাথের মূর্ত্তির দুই পার্শ্বে অবশিষ্ট তেইশজন তীর্থঙ্করের মূর্ত্তি উত্তীর্ণ হইয়াছে।
বর্দ্ধমান জিলার উজানী গ্রামে জিন শান্তিনাথের একটি দণ্ডায়মান মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। পাদপীঠে তাঁহার বিশেষ লাঞ্ছন মৃগ এবং পশ্চাতে নবগ্রহের মূর্ত্তি খোদিত।
.
৬. বুদ্ধমূর্ত্তি
বাংলা দেশে যে সমুদয় বুদ্ধমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার মধ্যে রাজশাহী জিলার অন্তর্গত বিহারৈল গ্রামে প্রাপ্ত একটি মূর্ত্তি সর্বপ্রাচীন। ইহা গুপ্তযুগে নির্ম্মিত সারনাথের বুদ্ধমূর্ত্তিগুলির অনুরূপ।
খুলনা জিলার অন্তর্গত শিববাটি গ্রামে শিবরূপে পূজিত একটি মূর্ত্তি (চিত্র নং ২৭ খ) পরবর্ত্তীকালের বুদ্ধমূর্ত্তির একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত। জটিল ও বিচিত্র কারুকার্যখচিত প্রস্তরখণ্ডের মধ্যস্থলে মন্দিরের মধ্যে বুদ্ধ ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট। বুদ্ধের জীবনের প্রধান প্রধান কতকগুলি ঘটনা–জন্ম, প্রথম উপদেশ, মহাপরিনির্বাণ, নালাগিরি-দমন, ত্রয়স্ত্রিংশ স্বর্গ হইতে অবতরণ প্রভৃতি-মূল মূর্ত্তির প্রভাবলীতে খোদিত। এই ঘটনাগুলি পৃথকভাবেও খোদিত দেখিতে পাওয়া যায়।
মহাযান ও বজ্রযান সম্প্রদায় যে পালযুগে এদেশে বিশেষ প্রসার লাভ করিয়াছিল, এই দুই মতের অনুযায়ী বহুসংখ্যক দেব-দেবীর মূর্ত্তিই তাঁহার সাক্ষ্য প্রদান করে। ইঁহাদের মধ্যে ধ্যানীবুদ্ধ, অবলোকিতেশ্বর (অথবা লোকেশ্বর) (চিত্র নং ২১ খ) ও মঞ্জুশ্রী নামক দুই বোধিসত্ত্ব, এবং তারা কয়েকটি প্রধান এবং জম্ভল, হেরুক ও হেবজ্র এই কয়টি অপ্রধান।
ধ্যানীবুদ্ধের মূৰ্ত্তি খুব বেশী পাওয়া যায় নাই। ঢাকা জিলার সুখবাসপুরে বজ্ৰসত্ত্বের একটি মূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। বীরাসনে উপবিষ্ট এই মূর্ত্তিটির দক্ষিণ হস্তে বজ্র এবং বাম হস্তে ঘণ্টা। পশ্চাদ্ভাগে উত্তীর্ণ লিপি হইতে অনুমিত হয় যে, মূর্ত্তিটি দশম শতাব্দীতে নির্ম্মিত।
অবলোকিতেশ্বরের বহুসংখ্যক এবং খসর্পণ, সুগতি-সন্দর্শন, ষড়ক্ষরী প্রভৃতি বহুশ্রেণীর মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ঢাকা জিলার মহাকালীতে একাদশ শতাব্দীতে নিৰ্মিত খসর্পণের একটি অতিশয় সুন্দর মূর্ত্তি পাওয়া গিয়ছে। সপ্তরথ পাদপীঠের উপর সনাল-পদ্ম-হস্তে ললিতাসনে উপবিষ্ট অবলোকিতেশ্বর যেন পরমকরুণাভরে পৃথিবী অবলোকন করিতেছেন। তাঁহার দক্ষিণ পার্শ্বে তারা ও সুধনকুমার এবং বাম পার্শ্বে ভূকুটী ও হয়গ্রীব পৃথক পৃথক পদ্মের উপরে আসীন। ঊর্ধ্বে প্রভাবলীতে পাঁচটি মন্দিরাভ্যন্তরে পঞ্চতথাগতের ধ্যানমূৰ্ত্তি এবং নিম্নে পাদপীঠে সূচীমুখমূর্ত্তি এবং নানা রত্ন ও উপচার খোদিত। রাজসাহী চিত্রশালায় ষড়ভুজ লোকেশ্বরের যে মূৰ্ত্তি আছে তাহা সম্ভবত সুগতি-সন্দর্শন লোকেশ্বর। ইঁহার এক হস্তে বরদমুদ্রা এবং এবং অন্য পাঁচ হস্তে পুঁথি, পাশ, ত্রিদণ্ডী (অথবা ত্রিশূল), অক্ষমালা এবং কমণ্ডলু। মালদহ জিলায় বাণীপুরে প্রাপ্ত ষড়ক্ষরী লোকেশ্বরের মূর্ত্তি বজ্ৰপৰ্য্যঙ্ক আসনে উপবিষ্ট ও চতুর্ভুজ; দুই হস্ত অঞ্জলিবদ্ধ ও অপর দুই হস্তে অক্ষমালা ও পদ্ম। মূর্ত্তির মস্তকে বজ্রমুকুট এবং দুই পার্শ্বে মণিধর ও ষড়ক্ষরী মহাবিদ্যার ক্ষুদ্র মূর্ত্তি।
মহাস্থানের নিকটে বলাইধাপে একটি সুন্দর মঞ্জুশ্রীর মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। মূর্ত্তিটি অষ্টধাতুনির্ম্মিত কিন্তু স্বর্ণপটে আচ্ছাদিত, এবং ইহার মস্তকের জটামধ্যে ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্যের মূর্ত্তি। দ্বিভঙ্গ ভঙ্গীতে দণ্ডায়মান মঞ্জুশ্রীর বাম হস্তে ব্যাখ্যান বা বিতর্ক-মুদ্রা-কারণ ইনি হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার ন্যায় জ্ঞান ও পাণ্ডিত্যের আকর। পরিহিত ধুতি মেখলা দ্বারা আবদ্ধ এবং চাদরখানি উপবীতের ন্যায় বাম স্কন্ধের উপর দিয়ে দেহের ঊর্ধ্বভাগ বেষ্টন করিয়া আছে। ঢাকা জিলার জালকুণ্ডী গ্রামে মঞ্জুশ্রীর অরপচন রূপের একখানি মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। তরবারিধৃত দক্ষিণ হস্ত খানির অগ্রভাগ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে; বাম হস্তে বুকের নিকট একখানা পুঁথি ধরিয়া আছেন। চারপাশে জালিনী, উপকেশিনী, সূৰ্য্যপ্রভা ও চন্দ্রপ্রভা নামে তাঁহার চারিটি ক্ষুদ্র প্রতিমূর্ত্তি এবং প্রভাবলীর উপরিভাগে বৈরোচন, অক্ষোভ্য, অমিতাভ ও রত্নসম্ভব এই চারিটি ধ্যানীবুদ্ধের মূর্ত্তি।
বৌদ্ধ দেবতা জম্ভল পৌরাণিক দেবতা কুবেরের ন্যায় যক্ষগণের অধিপতি ও ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্ দেবতা। বাংলায় বহু জলমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। স্থূলোদর এই মূৰ্ত্তির দক্ষিণ হস্তে অক্ষমা; বাম হস্তে একটি নকুলের গলা টিপিয়া ইহার মুখ হইতে ধন-রত্ন বাহির করিতেছেন। মূর্ত্তির নিম্নে একটি ধনপূর্ণ ঘট উপুড় হইয়া আছে।
হেরুকের মূৰ্ত্তি খুব কমই পাওয়া যায়। ত্রিপুরা জিলার শুভপুর গ্রামে হেরুকের একটি মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। নৃত্যপরায়ণ, দংষ্ট্ৰাকরালবদন এই মূর্ত্তির বাম হস্তে কপাল ও দক্ষিণ হস্তে বজ্ৰ; মস্তকে ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্যের মূর্ত্তি, গলদেশে নরমুণ্ডমালা এবং বাম স্কন্ধে খট্বাঙ্গ।
হেবজ্রের একটি মূর্ত্তি মুর্শিদাবাদে পাওয়া গিয়াছে। শক্তির সহিত নিবিড় আলিঙ্গনাবদ্ধ দণ্ডায়মান মূর্ত্তির আট মস্তক ও ষোলো হাত; প্রতি হাতে একটি নরকপাল ও পদতলে কতকগুলি নর-শব।
মহাযান ও বজ্রযানে উপাস্যা দেবীর সংখ্যা অনেক। তন্মধ্যে প্রজ্ঞাপারমিতা, মারীচী, পর্ণশবরী, চুণ্ডা ও হারীতী এবং বিভিন্ন ধ্যানীবুদ্ধ হইতে প্রসূত বিভিন্ন তারা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রজ্ঞাপারমিতা দিব্যজ্ঞানের প্রতীক। তাঁহার মূর্ত্তি কমই পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু অনেক প্রজ্ঞাপারমিতা-পুঁথির আচ্ছাদনের উপর তাঁহার ছবি উজ্জ্বল ও নানা রঙ্গে চিত্রিত আছে। পদ্মাসনে আসীনা দেবীর মুখমণ্ডলে জ্ঞানের দীপ্তি, এবং বক্ষোদেশ-সন্নদ্ধ এক হস্তে ব্যাখ্যান-মুদ্রা, অপর হস্তে জ্ঞানমুদ্রা ও প্রজ্ঞাপারমিতা-পুঁথি দেখিতে পাওয়া যায়।
মারীচীর তিন মুখ (একটি শূকরীর মুখ); আট হাতে বজ্র, অঙ্কুশ, শর, অশোকপত্র, সূচী, ধনু, পাশ ও তর্জনীমুদ্রা; মস্তকে ধ্যানীবুদ্ধ বিরোচনের মূর্ত্তি। সূৰ্য্যের ন্যায় তিনি প্রত্যূষের দেবী। সারথি রাহুচালিত সপ্তশূকরবাহিত রথে প্রত্যালীঢ় ভঙ্গীতে দণ্ডায়মান মারীচী মূর্ত্তিই সাধারণত এদেশে পাওয়া যায়।
রাজসাহী যাদুঘরে অষ্টাদশভুজা একটি চুণ্ডা মূর্ত্তি আছে। বিক্রমপুরের পর্ণশবরীর দুইটি মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার তিনটি মাথা ও ছয়খানি হাত; হাতে বজ্র, পরশু, শর, ধনু, পর্ণপিচ্ছিক প্রভৃতি। কয়েকটি বৃক্ষপত্র ব্যতীত অন্য কোনো পরিধান নাই। সম্ভবত পার্ব্বত্য শবরজাতির উপাস্যা দেবী বৌদ্ধ দেবীতে পরিণত হইয়াছেন।
অমোঘসিদ্ধি, রত্নসম্ভব এবং অমিতাভ এই তিন ধ্যানীবুদ্ধ হইতে প্রসূত তারা যথাক্রমে শ্যামতারা, বজ্রতারা ও ভূকুটীতারা নামে পরিচিত। শ্যামতারার মূৰ্ত্তি খুব বেশী পাওয়া যায়। তাঁহার হাতে একটি নীলপদ্ম এবং পার্শ্বে অশোককান্তা ও একজটার মূর্ত্তি। ফরিদপুর জিলায় মাজবাড়ী গ্রামে অষ্টধাতুনির্ম্মিত একটি বজ্রতারার মূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহা একটি পদ্মের আকার। পদ্মের কেন্দ্রস্থলে দেবীমূৰ্ত্তি এবং আটটি দলের মধ্যে তাঁহার আটটি অনুচরীর মূর্ত্তি। এই আটটি দল ইচ্ছা করিলে বন্ধ করিয়া রাখা যায়-তখন বাহির হইতে ইহা কেবলমাত্র একটি অষ্টদল পদ্ম বলিয়া মনে হয়। ঢাকা জিলার অন্তর্গত ভবানীপুর গ্রামে বীরাসনে উপবিষ্টা একটি দেবীমূর্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। ইহার তিন মাথা ও আট হাত। মূর্ত্তির মস্তকে অমিতাভ ও পাদপীঠে গণেশের মূৰ্ত্তি। কেহ কেহ মনে করেন যে, ইহা ভূকুটীতারার মূর্ত্তি।
এতদ্ভিন্ন আরও অনেক বৌদ্ধ দেবী বা শক্তিমূৰ্ত্তি পাওয়া গিয়াছে। অষ্টভুজা একটি সুন্দর দেবীমূৰ্ত্তি কেহ কেহ সিতাপত্রা বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন। আর একটি দেবীমূৰ্ত্তি মহাপ্রতিসরা (চিত্র নং ২১ গ) বলিয়া কেহ কেহ অনুমান করেন। কিন্তু প্রাচীন সাধনমালায় এই সমুদয় দেবীর যে বর্ণনা আছে, তাঁহার সহিত এই দুই মূর্ত্তির সামঞ্জস্য নাই।