১৪. চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ –বাংলার শেষ স্বাধীন রাজ্য
১. দেববংশ
লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের শেষভাগে মেঘনার পূর্ব্বতীরের মধুমথনদেব একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। মধুমথনদেবের পিতা পুরুষোত্তম ‘দেবাম্বয়-গ্রামণী’ অর্থাৎ দেববংশের প্রধান বলিয়া আখ্যাত হইয়াছেন, কিন্তু এই বংশের কোনো তাম্রশাসনেই তাঁহার সম্বন্ধে রাজপদবীজ্ঞাপক কোনো উপাধি ব্যবহৃত হয় নাই। মধুমথনদেব ও তাঁহার পুত্র বাসুদেব সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। কিন্তু বাসুদেবের পুত্র দামোদরদেবের দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহা হইতে জানা যায় যে, তিনি ১২৩১ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অন্তত ১২৪৩ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। এই তাম্রশাসনদ্বয় হইতে অনুমিত হয় যে দামোদরদেবের রাজ্য বর্ত্তমান ত্রিপুরা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জিলায় সীমাবদ্ধ ছিল। সকল ‘ভূপাল চক্রবর্ত্তী’ ও ‘অরিরাজ-চাণুর-মাধব’ এই উপাধিদ্বয় হইতে অনুমিত হয় যে দামোদর পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। সম্ভবত সেনবংশীয় রাজা বিশ্বরূপসেনের মৃত্যুর পর তিনি পৈত্রিক রাজ্যের সীমা বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
দামোদরদেবের মৃত্যুর পর তাঁহার রাজ্যের কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু ঢাকা জিলার আদাবাড়ী নামক স্থানে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসনে দেব উপাধিধারী আর এক রাজার নাম পাওয়া যায়। এই তাম্রশাসনখানি অতিশয় জীর্ণ এবং ইহার সম্পূর্ণ পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নাই। যেটুকু পড়া গিয়াছে তাহা হইতে জানা যায় যে, পরমেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ অরিরাজ-দনুজমাধব দশরথদেব বিক্রমপুর রাজধানী হইতে এই তাম্রশাসন দান করিয়াছিলেন। কেশবসেন ও বিশ্বরূপসেনের অনুকরণে তিনি অশ্বপতি, গজপতি, নরপতি, রাজত্রয়াধিপতি উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন, এবং সেনরাজগণের “সেনকুল-কমল বিকাস-ভাস্কর” পদবীর পরিবর্তে তাঁহার শাসনে “দেবাম্বয়-কমল-বিকাস-ভাস্কর” ব্যবহৃত হইয়াছে। সুতরাং তিনি যে দেশবংশীয় ও এই দেববংশ যে অভিন্ন তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায় না।
দশরথদেবের উপাধিদৃষ্টে সহজেই অনুমিত হয় যে সেনবংশীয় শেষ রাজগণের অনতিকাল পরেই তিনি রাজত্ব করেন। পূর্ব্বেই উক্ত হইয়াছে যে লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ অন্তত ১২৪৫ অথবা ১২৬০ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। সম্ভবত ইহার পর কোনো সময়ে দশরথদেব সেনরাজগণের রাজ্য অধিকার করিয়া থাকিবেন। তাঁহার তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তিনি নারায়ণের কৃপায় গৌড় রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন। মুসলমান ঐতিহাসিকগণের মতে গৌড় এই সময়ে তুরস্ক রাজগণের অধীনে ছিল। তবে তুরস্ক নায়কগণের গৃহবিবাদের সুযোগে দশরথদেব গৌড়ের কিয়দংশ অধিকার করিয়া কিছুদিন রাজত্ব করিয়াছিলেন ইহা একেবারে অবিশ্বাস্য বলা যায় না। বাংলা দেশে তুরস্ক প্রভুত্ব দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইতে বহুদিন লাগিয়াছিল, এবং এই সময়ের মধ্যে যে হিন্দুরাজগণ লুপ্ত রাজ্য উদ্ধার করিতে পুনঃপুন চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং আংশিকভাবে কৃতকাৰ্য্য হইয়াছিলেন তাহাতে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। জিয়াউদ্দিন বার্ণীর ইতিহাসে কথিত হইয়াছে যে দিল্লীর সুলতান গিয়াসুদ্দিন বলবন যখন তুঘরিল খানের বিদ্রোহ দমন করিবার জন্য বঙ্গদেশে অভিযান করেন তখন সোনারগাঁয়ের রাজা দনুজরায়ের সহিত তাঁহার এইরূপ এক চুক্তিপত্র হয় যে তুঘরিল যাহাতে জলপথে পলায়ন করিতে না পারে দনুজরায় তাঁহার ব্যবস্থা করিবেন। অনেকে অনুমান করেন যে এই দনুজরায় ও অরিরাজ-দনুজমাধব দশরথ অভিন্ন। সোনারগাঁ ও বিক্রমপুর বর্ত্তমানে ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত। সুতরাং বিক্রমপুরের দিনুজমাধব’ উপাধিধারী রাজা বিদেশী ঐতিহাসিক কর্ত্তৃক সোনারগাঁয়ের রাজা দনুজরায় রূপে অভিহিত হইবেন ইহা খুব অস্বাভাবিক নহে। বাংলার কুলজী গ্রন্থেও দেখিতে পাওয়া যায় যে কেশবসেনের অনতিকাল পরে দনুজমাধব নামে এক রাজা রাজত্ব করিতেন। দশরথদেব ও দনুজরায়কে অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করিলে স্বীকার করিতে হয় যে দশরথদেব বলবনের অভিযান সময়ে অর্থাৎ ১২৮৩ খৃষ্টাব্দে সিংহাসনে আসীন ছিলেন।
শ্রীহট্টের নিকটবর্ত্তী ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত দুইখানি তাম্রশাসন হইতে দেববংশীয় কয়েকজন রাজার বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁহাদের বংশতালিকা এইরূপ।
খরবাণ
।
গোকুলদেব
।
নারায়ণদেব
।
কেশবসেনদেব
।
ঈশানদেব
কেশবদেব একজন বিখ্যাত যোদ্ধা ছিলেন এবং তুলাপুরুষ যজ্ঞ করিয়াছিলেন। ঈশানদেব অন্তত ১৭ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। তাম্রশাসন দুইটির অক্ষরদৃষ্টে অনুমান হয় যে উক্ত রাজগণ ত্রয়োদশ অথবা চতুর্দ্দশ শতাব্দীতে রাজত্ব করেন। দেব উপাধি হইতে অনুমিত হয় যে এই রাজগণও দেববংশীয় ছিলেন। কিন্তু ইঁহাদের সহিত পূর্ব্বোক্ত দেববংশীয় রাজগণের কোনো সম্বন্ধ ছিল কি না তাহা বলা যায় না। শ্রীহট্টের উকিল শ্ৰীযুক্ত কমলাকান্ত গুপ্ত চৌধুরীর নিকট “হট্টনাথের পাঁচালী” নামক একখানি পুঁথি আছে। ইহাতে এই রাজবংশের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়।
যে স্থানে তাম্রশাসন দুইটি পাওয়া গিয়াছে সেখানে একটি জনপ্রবাদ প্রচলিত আছে যে তথাকার রাজা গৌরগোবিন্দ শাহজালাল কর্ত্তৃক পরাজিত হন। এই ঘটনার তারিখ ১২৫৭ অব্দ। কেশবদেবের এক উপাধি ছিল রিপুরাজ গোপী গোবিন্দ। কেহ কেহ মনে করেন যে এই রাজাই জনপ্রবাদের গৌরগোবিন্দ।
.
২. পট্টিকেরা রাজ্য
বর্ত্তমান কুমিল্লা জিলায় পট্টিকেরা রাজ্য অবস্থিত ছিল। পট্টিকেরা নামে একটি পরগণা এখনো এই প্রাচীন রাজ্যের স্মৃতি বহন করিতেছে। বিগত মহাযুদ্ধের সময় (১৯৪৩ অব্দ) সামরিক প্রয়োজনে মাটি খনন করার ফলে কুমিল্লার অনতিদূরবর্ত্তী লালমাই বা ময়নামতী পাহাড়ে বহু প্রাচীন স্তূপ, মন্দির প্রভৃতির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। প্রায় দশ মাইল ব্যাপিয়া এই সমুদয় প্রাচীন কীৰ্ত্তির চিহ্ন এখনো বিদ্যমান। এই স্থানেই যে প্রাচীন পট্টিকেরা রাজ্যের রাজধানী অথবা অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল তাহা এক প্রকার নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে।
১০১৫ অব্দে লিখিত একখানি পুঁথিতে ষোড়শভুজা এক দেবীর চিত্রের নিম্নে লিখিত আছে “পট্টিকেরে চুন্দাবরভবনে চুন্দা”। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে রাজধানী পট্টিকেরে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ চুন্দা দেবীর মূর্ত্তি একাদশ শতাব্দীর পূর্ব্বেই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। পূর্ব্বোক্ত ধ্বংসাবশেষ হইতে অনুমিত হয় যে ইহারও ৩-৪ শত বৎসর পূর্ব্বে পট্টিকেরা একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল।
ব্রহ্মদেশের ঐতিহাসিক আখ্যানে পট্টিকেরা রাজ্যের বহু উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ব্রহ্মের প্রসিদ্ধ রাজা অনিরুদ্ধ (১০৪৪-১০৭৭ অব্দ) পট্টিকেরা পর্য্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তার করেন এবং এই সময় হইতেই দুই রাজ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্থাপিত হয়। ব্রহ্মরাজ কনজিথের (১০৮৪-১১১২) কন্যার সহিত পট্টিকেরার রাজপুত্রের ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী ব্রহ্মদেশের আখ্যানে সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে এবং এই ঘটনা অবলম্বন করিয়া তথায় অনেক কবিতা ও নাটক রচিত হইয়াছে। এই সমুদয় নাটক এখনো ব্রহ্মদেশে অভিনীত হয়। ব্রহ্মরাজের ইচ্ছা থাকিলেও রাজনৈতিক কারণে তাঁহার কন্যার সহিত পট্টিকেরার রাজকুমারের বিবাহ অসম্ভব হইলে উক্ত রাজকুমার আত্মহত্যা করেন। কিন্তু এই রাজকন্যার গর্ভজাত পুত্র অলংসিথু মাতামহের মৃত্যুর পর ব্রহ্মদেশের রাজা হন এবং পট্টিকেরার রাজার কন্যাকে বিবাহ করেন। অলংসিথুর মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র নরথু সিংহাসনে আরোহণ করিয়া স্বহস্তে তাঁহার বিমাতা পট্টিকেরার রাজকন্যাকে বধ করেন। কন্যার মৃত্যুসংবাদ শ্রবণ করিয়া পট্টিকেরার রাজা প্রতিশোধ লইতে সংকল্প করিলেন। তিনি আটজন বিশ্বস্ত সৈনিককে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ব্রহ্মদেশের রাজধানী পাগানে পাঠাইলেন। ব্রাহ্মণেরা আশীর্বাদ করিবার ছলে রাজসমীপে উপস্থিত হইয়া রাজাকে বধ করে এবং সকলেই স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জন দেয়। এই সমুদয় কাহিনী কত দূর সত্য বলা যায় না, কিন্তু ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে পট্টিকেরা একটি প্রসিদ্ধ রাজ্য ছিল এবং নিকটবর্ত্তী ব্রহ্মদেশের সহিত তাঁহার রাজনৈতিক সম্বন্ধ ছিল।
ময়নামতী পাহাড়ে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসনে রণবঙ্কমল্ল শ্রীহরিকালদেব নামক পট্টিকেরার এক রাজার নাম পাওয়া যায়। ইনি ১২০৮ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং অন্তত ১৭ বৎসর রাজত্ব করেন। এই তাম্রশাসন দ্বারা রাজমন্ত্রী শ্রী ধড়ি-এব পট্টিকেরা নগরে এক বৌদ্ধবিহারে কিঞ্চিৎ ভূমি দান করেন। রাজমন্ত্রীর পিতার নামে হেদি-এব এবং তাম্রশাসনের লেখকের নাম মেদিনী-এব। এই সমুদয় নাম ব্রহ্মদেশীয় নামের অনুরূপ এবং পট্টিকেরা রাজ্যের সহিত ব্রহ্মদেশের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের পরিচায়ক।
শ্রীহরিকালদেব প্রাচীন পট্টিকেরা-রাজবংশীয় ছিলেন অথবা নিজেই একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তাহা বলা যায় না। এই সময়ে যে দেববংশীয় রাজগণ এই অঞ্চলে রাজত্ব করিতেন তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। অসম্ভব নহে যে শ্রীহরিকালদেবও দেববংশীয় ছিলেন। কিন্তু তাঁহার নামের অন্ত স্থিত ‘দেব’ শব্দ বংশপদবী অথবা রাজকীয় সম্মানসূচক পদমাত্র তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। তবে রণবঙ্কমল্ল উপাধিধারী শ্রীহরিকালদেবের পর যে পট্টিকেরা রাজ্য দেববংশীয় দামোদরদেবের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়।