১৮. সমাজের কথা

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ – সমাজের কথা

জাতিভেদ

যে যুগে মনুস্মৃতি, মহাভারত প্রভৃতি রচিত হয়, সেই যুগেই যে আৰ্য্য ধর্ম্ম ও সামাজিক রীতিনীতি প্রভৃতি বাংলা দেশে প্রভাব বিস্তার করে, তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। ইহার পূর্ব্বেকার বাঙ্গালীর ধর্ম্ম ও সমাজ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান খুবই অল্প। সামান্য যাহা কিছু জানা গিয়াছে, তাহাও সংক্ষেপে পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে।

জাতিভেদ আৰ্যসমাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। আর্য্যগণ এদেশে বসবাস করিবার ফলে বাংলায়ও ইহার প্রবর্ত্তন হয়। ইহার ফলে বঙ্গ, সুহ্ম, শবর, পুলিন্দ, কিরাত, পুণ্ড প্রভৃতি বাংলার আদিম অধিবাসীগণ প্রাচীন গ্রন্থে ক্ষত্রিয় বলিয়া গণ্য হয়। অল্পসংখ্যক বাঙ্গালী যে ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিগণিত হইত ইহা খুবই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়, কিন্তু কোনো প্রাচীন গ্রন্থে ইহার উল্লেখ পাওয়া যায় নাই। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে দীর্ঘতমা ঋষির যে কাহিনী উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা হইতে স্পষ্টই প্রমাণিত হয় যে, আৰ্য ব্রাহ্মণগণ বাঙ্গালী কন্যা বিবাহ করিতেন। এইরূপ বিবাহের ফলেই আৰ্যপ্রভাব এদেশে পরিপুষ্টি লাভ করিয়াছিল।

যে সমুদয় বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ অথবা ক্ষত্রিয় হইয়াছিল, তাহারা সম্ভবত সংখ্যায় খুব বেশী ছিল না। বাংলার আদিম অধিবাসীদের অধিকাংশই শূদ্রজাতিভুক্ত হইয়াছিল। মনুসংহিতাতে উক্ত হইয়াছে যে পুণ্ড্রক এবং কিরাত এই দুই ক্ষত্রিয় জাতি ব্রাহ্মণের সহিত সংস্রব না থাকায় ও শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকৰ্ম্মাদির অনুষ্ঠান না করায় শূদ্রত্ব লাভ করিয়াছে। কৈবর্ত্তজাতি মনুসংহিতায় সংকর জাতি বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু বিষ্ণুপুরাণে অব্ৰহ্মণ্য বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। সম্ভবত এইরূপে আরও অনেকের জাতি-বিপর্যয় ঘটিয়াছে। সুতরাং ইহা সহজেই অনুমান করা যায় যে বাংলা দেশের জাতি বিভাগ বহু পরিবর্ত্তনের মধ্য দিয়া বর্ত্তমান আকার ধারণ করিয়াছে।

খৃষ্টীয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে যে এদেশে বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ বাস করিতেন, তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। তাঁহার পরবর্ত্তী সকল যুগেই যে এদেশে বহু ব্রাহ্মণ বাস করিতেন, তাঁহার বহুবিধ প্রমাণ আছে। বাংলার বহু রাজবংশ-পাল, সেন, বৰ্ম প্রভৃতি তাঁহাদের লিপিতে ক্ষত্রিয় বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। এদেশে এরূপ একটি মত প্রচলিত আছে যে, বাংলায় কলিকালে ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য ছিল না, কেবল ব্রাহ্মণ ও শূদ্র এই দুই বর্ণ ছিল। ইহার কোনো ভিত্তি নাই। প্রাচীনকালে বাংলায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারি বর্ণই ছিল এবং হিন্দু যুগের শেষভাগে বাংলায় রচিত প্রামাণিক শাস্ত্রীয় গ্রন্থাদিতে চারি বর্ণেরই উল্লেখ এবং তাহাদের বৃত্তি প্রভৃতি নির্দিষ্ট আছে।

কিন্তু আৰ্যসমাজ আদিতে চারি বর্ণে বিভক্ত হইলেও ক্রমে বহুসংখ্যক বিভিন্ন জাতির সৃষ্টি হয়। যে সময় বাংলায় আৰ্যপ্রভাব বিস্তৃত হয়, সে সময় আৰ্যসমাজে এরূপ বহু জাতির উদ্ভব হইয়াছে। মনুসংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন ধর্ম্মশাস্ত্রে উক্ত হইয়াছে যে, বিভিন্ন বর্ণের পুরুষ ও স্ত্রীর সন্তান হইতেই এই সমুদয় মিশ্রবর্ণের সৃষ্টি হইয়াছে এবং কোন কোন বর্ণ অথবা জাতির মিশ্রণের ফলে কোন কোন মিশ্রবর্ণের সৃষ্টি হইল, তাঁহার সুদীর্ঘ তালিকা আছে। এই তালিকাগুলির মধ্যে অনেক বৈষম্য দেখা যায়। তাঁহার কারণ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মিশ্রবর্ণের উদ্ভব হইয়াছিল। প্রতি ধৰ্ম্মশাস্ত্রে সাধারণত তৎকালে স্থানীয় সমাজে প্রচলিত মিশ্রবর্ণেরই উল্লেখ আছে, সুতরাং স্থান ও কাল অনুসারে এই মিশ্রবর্ণের যে পরিবর্ত্তন হইয়াছে। ধর্ম্মশাস্ত্রে তাঁহার পরিচয় পাওয়া যায়। ধর্ম্মশাস্ত্রে মিশ্রবর্ণেরই উৎপত্তির যে ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে, তাহা যে অধিকাংশস্থলেই কাল্পনিক, সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু একথাও অস্বীকার করা কঠিন যে, এইরূপ ব্যাখ্যার উপর নির্ভর করিয়াই প্রধানত সমাজে এই সমুদয় মিশ্রবর্ণের উচ্চ-নীচ ভেদ নির্দিষ্ট হইয়াছে। বাংলা দেশের সমাজে যখন এই জাতিভেদ প্রথা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন ভারতের সর্বত্রই আৰ্যসমাজে আদিম চতুৰ্ব্বর্ণের পরিবর্তে এইরূপ মিশ্র জাতিই সমাজের প্রধান অঙ্গে পরিণত হইয়াছে। সুতরাং বাঙ্গালী সমাজের প্রকৃত পরিচয় জানিতে হইলে, বাংলার এই মিশ্র জাতি সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করার প্রয়োজন।

হিন্দু যুগে বাংলা দেশে রচিত কোনো শাস্ত্রগ্রন্থে মিশ্র জাতির তালিকা থাকিলে, বাংলার জাতিভেদ সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ সম্ভবপর হইত, কিন্তু এরূপ কোনো গ্রন্থের অস্তিত্ব এখন পর্য্যন্ত সঠিকভাবে জানা যায় নাই। তবে বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ এই দুইখানি গ্রন্থ, হিন্দু যুগের না হইলেও, ইহার অবসানের অব্যবহিত পরেই রচিত, এবং ইহাতে মিশ্র জাতির যে বর্ণনা আছে, তাহা বাংলা দেশ সম্বন্ধে বিশেষভাবে প্রযোজ্য, এরূপ অনুমান করিবার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সুতরাং এই দুইখানি গ্রন্থের সাহায্যে বাংলা সমাজের জাতিভেদ-প্রথা সম্বন্ধে আলোচনা করিলে, হিন্দু যুগের অবসানকালে ইহা কিরূপ ছিল, তাঁহার সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা করা যাইবে।

বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ সম্ভবত ত্রয়োদশ শতাব্দী বা তাঁহার অব্যবহিত পরে রচিত হইয়াছিল। ইহাতে ব্রাহ্মণের মাছ-মাংস খাওয়ার বিধি আছে এবং ব্রাহ্মণের সমুদয় লোককে ৩৬টি শূদ্র জাতিতে বিভক্ত করা হইয়াছে। এই দুইটিই বাংলা দেশের সমাজের বৈশিষ্ট্য বলিয়া ধরা যাইতে পারে। কারণ আৰ্য্যাবর্তের অন্যত্র ব্রাহ্মণেরা নিরামিষাশী, এবং বাংলায় চলিত কথায় এখনো ছত্রিশ জাতির উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে পদ্মা ও বাংলার যমুনা নদীর উল্লেখও বাংলার সহিত ইহার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ সূচিত করে। তবে ব্রাহ্মণ ভিন্ন সকলেই যে শূদ্র-জাতীয়, ইহা সম্ভবত হিন্দু যুগের সম্বন্ধে প্রযোজ্য নহে; ইহার পরবর্ত্তী যুগের অর্থাৎ উক্ত গ্রন্থরচনাকালের ধারণা।

বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে রাজা বেন বর্ণাশ্রম ধৰ্ম্ম নষ্ট করিবার অভিপ্রায়ে বলপূর্ব্বক বিভিন্ন বর্ণের নরনারীর সংযোগ সাধন করেন এবং ইহার ফলে বিভিন্ন মিশ্রবর্ণের উৎপত্তি হয়। এই মিশ্রবর্ণগুলি সবই শূদ্র-জাতীয় এবং উত্তম, মধ্যম ও অধম এই তিন সংকর শ্রেণীতে বিভক্ত।

করণ, অন্বষ্ঠ, উগ্র, মাগধ, তন্ত্রবায়, গান্ধিকবণিক, নাপিত, গোপ (লেখক), কৰ্ম্মকার, তৌলিক (সুপারি-ব্যবসায়ী), কুম্ভকার, কুংসকার, শংখিক, দাস (কৃষিজীবী), বারজীবী, মোক, মালাকার, সূত, রাজপুত ও তামুলী এই কুড়িটি উত্তম সংকর।

তক্ষণ, রজক, স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর তৈলকারক, ধীবর, শৌপ্তিক, নট, শাবাক, শেখর, জালিক-এই বারোটি মধ্যম সংকর। মলেগ্রহি, কুড়ব, চাণ্ডাল, বরুড়, তক্ষ, চর্মকার, ঘউজীবী, দোলাবাহী ও মল্ল এই নয়টি অধম সংকর, ইহারা অন্ত্যজ ও বর্ণাশ্রম-বহিষ্কৃত অর্থাৎ বর্ণাশ্রমের অন্তর্গত নহে।

গ্রন্থে ৩৬টি জাতির উল্লেখ আছে-কিন্তু এই তালিকায় আছে ৪১টি; সুতরাং ৫টি পরবর্ত্তীকালে যোজিত হইয়াছে। যাহাদের পিতা-মাতা উভয়ই চতুৰ্বর্ণভুক্ত, তাহারা উত্তম সংকর; যাহাদের মাতা চতুৰ্ব্বর্ণভুক্ত কিন্তু পিতা উত্তম সংকর, তাহারা মধ্যম সংকর; এবং যাহাদের পিতা-মাতা উভয়ই সংকর, তাহারা অধম সংকর; এই সাধারণ বিধি অনুসারের উপরোক্ত তিনটি শ্রেণীবিভাগ পরিকল্পিত হইয়াছে। প্রত্যেক বর্ণেরই পৃথক বৃত্তি নির্দিষ্ট হইয়াছে। শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণেরা কেবলমাত্র উত্তম সংকর শ্রেণীভুক্ত বর্ণের পৌরোহিত্য করিবেন। অন্য দুই শ্রেণীর পুরোহিতেরা পতিত ব্রাহ্মণ বলিয়া গণিত এবং যজমানের বর্ণ প্রাপ্ত হইবেন। এতদ্ব্যতীত দেবল ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে। গরুড় কর্ত্তৃক শকদ্বীপ হইতে আনীত বলিয়া ইহারা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হইতেন। দেবল পিতা ও বৈশ্য মাতার গর্ভজাত সন্তান গণক অথবা গ্রহবিপ্র। উপসংহারে উক্ত হইয়াছে যে বেনের দেহ হইতে ম্লেচ্ছ নামে এক পুত্র জন্মে এবং তাঁহার সন্তানগণ পুলিন্দ, পুস, খস, যবন, সুহ্ম, কম্বোজ, শবর, খর ইত্যাদি নামে খ্যাত হয়।

উল্লিখিত উত্তম ও মধ্যম সংকরভুক্ত বর্ণের অধিকাংশই এখনো বাংলায় সুপরিচিত জাতি। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ অনুসারে করণ ও অনুষ্ঠ সংকর বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। অনুষ্ঠগণ চিকিৎসা ব্যবসায় করিত বলিয়া বৈদ্য নামেও অভিহিত হইয়াছে। করণেরা লিপিকর ও রাজকার্যে অভিজ্ঞ এবং সৎশূদ্র বলিয়া কথিত হইয়াছে। এই করণই পরে বাংলায় কায়স্থ জাতিতে পরিণত হইয়াছে। এখনো বাংলা দেশে ব্রাহ্মণের পরেই বৈদ্য ও কায়স্থ উচ্চ জাতি বলিয়া পরিগণিত হয়। শঙ্কার, দাস (কৃষিজীবী), তন্তুবায়, মোদক, কর্ম্মকার ও সুবর্ণবণিক জাতি বাংলায় সুপরিচিত, কিন্তু বাংলার বাহিরে বড় একটা দেখা যায় না। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণ যে প্রাচীন বাংলার সমাজ অবলম্বনে লিখিত এই সমুদয় কারণেও তাহা সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়।

ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে মিশ্রবর্ণের যে তালিকা আছে তাঁহার সহিত বৃহদ্ধৰ্ম্মোক্ত তালিকার যথেষ্ট সাদৃশ্য আছে। তবে কিছু কিছু প্রভেদও দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাতে প্রথমে গোপ, নাপিত, ভিলু, মোদক, কুবর, তামুলি, স্বর্ণকার ও বণিক ইত্যাদি সৎশূদ্র বলিয়া অভিহিত হইয়াছে, এবং ইহার পরই করণ ও অমৃষ্ঠের কথা আছে। তৎপর বিশ্বকর্মার ঔরসে শূদ্রা-গর্ভজাত নয়টি শিল্পকার জাতির উল্লেখ আছে। ইহাদের মধ্যে মালাকার, কর্ম্মকার, শঙ্কার, কুবিন্দক (তন্তুবায়), কুম্ভকার ও কংসকার এই ছয়টি উত্তম শিল্পী জাতি। কিন্তু স্বর্ণ চুরির জন্য স্বর্ণকার ও কর্তব্য অবহেলার জন্য সূত্রধর ও চিত্রকর এই তিনটি শিল্পী জাতি ব্রহ্মশাপে পতিত। স্বর্ণকারের সংসর্গহেতু এবং স্বর্ণ চুরির জন্য এক শ্রেণীর বণিকও (সম্ভবত সুবর্ণবণিক) ব্রহ্মশাপে পতিত। ইহার পর পতিত সংকর জাতির এক সুদীর্ঘ তালিকার মধ্যে অট্টালিকাকার, কোটক, তীবর, তৈলকার, লেট, মল্ল, চর্মকার, শুণ্ডী, পৌণ্ড্রক, মাংসচ্ছেদ, রাজপুত্র, কৈবত্ত (কলিযুগে ধীবর), রজক, কৌয়ালী, গঙ্গাপুত্র, যুঙ্গী প্রভৃতির নাম আছে। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণোক্ত অধিকাংশ উত্তম ও মধ্যম সংকর জাতিই ব্রহ্মবৈবর্তে সৎশূদ্র বলিয়া কথিত হইয়াছে। বৃহদ্ধৰ্ম্মের ন্যায় ইহাতেও নানাবিধ ম্লেচ্ছজাতির কথা আছে। ইহারা বলবান, দুরন্ত, অবিদ্ধকৰ্ণ, কুর, নির্ভয়, রণদুর্জয়, দুর্ধর্ষ, ধৰ্ম্মবর্জিত ও শৌচাচার-বিহীন বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। এতদ্ব্যতীত ব্যাধ, ভড়, কোল, কোঞ্চ, হচ্ছি, ডোম, জোলা, বাগতাত (বাগাদি?), ব্যালগ্রাহী (বেদে?) এবং চাণ্ডাল প্রভৃতি যে সমুদয় নীচ জাতির উল্লেখ আছে তাঁহার প্রায় সমস্তই এখনো বাংলা দেশে বর্ত্তমান। উপসংহার ব্রহ্মবৈবর্তে বৈদ্য জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে এক বিস্তৃত আখ্যান এবং গণক ও অগ্রদানী ব্রাহ্মণের পাণ্ডিত্যের কারণ উল্লিখিত হইয়াছে।

বল্লালচরিতে যে সমুদয় আখ্যান উদ্ধৃত হইয়াছে তাহা হইতে মনে হয় যে রাজা মনে করিলে কোনো জাতিকে উন্নত অথবা অবনত করিতে পারিতেন। কিন্তু পালরাজগণের লিপিতে তাঁহাদের বর্ণাশ্রমধর্ম্ম প্রতিপালনের উল্লেখ হইতে প্রমাণিত হয় যে সাধারণত রাজগণ সমাজের বিধান সযত্নে রক্ষা করিয়া চলিতেন; বিশেষত রক্ষণশীল হিন্দুসমাজে কোনোরূপ গুরুতর পরিবর্ত্তন সহজসাধ্য ছিল না। অবশ্য কালক্রমে এরূপ পরিবর্ত্তন নিশ্চয়ই অল্পবিস্তর হইয়াছে। কিন্তু বৃহদ্ধর্ম্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে সামাজিক জাতিভেদের যে চিত্র পাওয়া যায় তাঁহার সহিত বর্ত্তমানকালের প্রভেদ এতই কম যে, হিন্দু যুগের অবসানে বাঙ্গালী সমাজের এই সমুদয় বিভিন্ন জাতি-অন্তত ইহার অধিকাংশই-যে বর্ত্তমান ছিল এবং তাহাদের শ্রেণীবিভাগ যে মোটামুটি একই প্রকারের ছিল তাহা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যাইতে পারে।

প্রাচীন শাস্ত্রমতে সমাজের প্রত্যেক জাতিরই নির্দিষ্ট বৃত্তি ছিল। কিন্তু ইহা যে খুব কঠোরভাবে অনুসরণ করা হইত না তাঁহার বহু প্রমাণ আছে। অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন, যাজন-ইহাই ছিল ব্রাহ্মণের নির্দিষ্ট কৰ্ম্ম। কিন্তু সমসাময়িক লিপি হইতে জানা যায় যে, ব্রাহ্মণেরা রাজ্যশাসন ও যুদ্ধ বিভাগে কাৰ্য্য করিতেন। এইরূপ আমরা দেখিতে পাই যে কৈবর্ত্ত উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন, করণ যুদ্ধ ও চিকিৎসা করিতেন, বৈদ্য মন্ত্রীর কাজ করিতেন এবং দাসজাতীয় ব্যক্তি রাজকর্ম্মচারী ও সভাকবি ছিলেন।

বিভিন্ন জাতির মধ্যে অনুগ্রহণ ও বৈবাহিক সম্বন্ধ বিষয়ে উনবিংশ শতাব্দীর ন্যায় কঠোরতা প্রাচীন হিন্দু যুগে ছিল না। একজাতির মধ্যেই সাধারণত বিবাহাদি হইত, কিন্তু উচ্চশ্রেণীর বর ও নিম্নশ্রেণীর কন্যার বিবাহ শাস্ত্রে অনুমোদিত ছিল এবং কখনো কখনো সমাজে অনুষ্ঠিত হইত। শিলালিপিতে স্পষ্ট প্রমাণ আছে যে ব্রাহ্মণ শূদ্রকন্যা বিবাহ করিতেন, এবং তাঁহাদের সন্তান সমাজে ও রাজদরবারে বেশ সম্মান লাভ করিতেন। সামন্তরাজ লোকনাথ ভরদ্বাজ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু তাঁহার মাতামহ ছিলেন পারশব অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পিতা ও শূদ্রা মাতার সন্তান। কিন্তু পারশব হইলেও তিনি সেনাপতির পদ অলঙ্কৃত করিতেন। হিন্দু যুগের শেষ পর্য্যন্ত যে এইরূপ বিবাহ প্রচলিত ছিল ভট্টভবদেব ও জীমূতবাহনের গ্রন্থ হইতে তাহা বেশ বোঝা যায়। তবে দ্বিজাতির শূদ্রকন্যা বিবাহ যে ক্রমশ নিন্দনীয় হইয়া উঠিয়াছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই।

বিভিন্ন জাতির মধ্যে পান ও ভোজন সম্বন্ধে নিষেধের কঠোরতাও এইরূপ আস্তে আস্তে গড়িয়া উঠিয়াছে। প্রাচীন স্মৃতি অনুসারে সাধারণত কেবলমাত্র ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের অন্ন ও জল গ্রহণ করিতেন না, এবং এই বিধিও খুব কঠোরভাবে প্রতিপালিত হইত না। এ সম্বন্ধে হিন্দু যুগের অবসানকালে বাংলা সমাজের কিরূপ বিধি প্রচলিত ছিল ভবদেবভট্ট প্রণীত ‘প্রায়শ্চিত্ত-প্রকরণ’ গ্রন্থে তাঁহার কিছু পরিচয় পাওয়া যায়।

ভবদেব বিধান করিয়াছেন যে চাণ্ডালস্পৃষ্ট ও চাণ্ডালদি অন্ত্যজ জাতির পাত্রে রক্ষিত জল পান করিলে ব্রাহ্মণাদি চতুৰ্ব্বণের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। শূদ্রের জল পান করিলে ব্রাহ্মণের সামান্য প্রায়শ্চিত্ত করিলে শুদ্ধি হইত। ব্রাহ্মণেতর জাতির পক্ষে এরূপ কোনো নিষেধ দেখা যায় না।

অন্ন বিষয়েও কেবল চাণ্ডালস্পৃষ্ট এবং চাণ্ডাল, অন্ত্যজ ও নটনৰ্তকাদি কতকগুলি জাতির পক্ অন্ন বিষয়ে নিষেধের ব্যবস্থা আছে। আপস্তম্বের একটি শ্লোকে উক্ত হইয়াছে যে, ব্রাহ্মণ শূদ্রের অন্ন গ্রহণ করিলে তাঁহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। ভবদেব এই শ্লোকের উল্লেখ করিয়া নিম্নলিখিতরূপ মন্তব্য করিয়াছেন : ব্রাহ্মণ বৈশ্যান্ন গ্রহণ করিলে প্রায়শ্চিত্তের মাত্রা চতুর্থাংশ কম এবং ক্ষত্রিয়ান্ন গ্রহণ করিলে অর্ধেক; ক্ষত্রিয় শূদ্ৰান্ন ভোজন করিলে প্রায়শ্চিত্তের মাত্রা চতুর্থাংশ কম ও বৈশ্যান্ন গ্রহণ করিলে অর্ধেক; এবং বৈশ্য শূদ্ৰান্ন গ্রহণ করিলে প্রায়শ্চিত্ত অর্ধেক–এইরূপ বুঝিতে হইবে। ভবদেব যে মূল শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন তাহাতে কিন্তু এরূপ কোনো কথা নাই, এবং এই উক্তির সমর্থক অন্য কোনো শাস্ত্রবাক্য থাকিলে ভবদেব নিশ্চয়ই তাঁহার উল্লেখ করিতেন। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে শূদ্র ও অন্ত Uজ ব্যতীত অন্য জাতির অনুগ্রহণ করা পূর্ব্বে ব্রাহ্মণের পক্ষেও নিষিদ্ধ ছিল না; ক্রমে হিন্দু যুগের অবসানকালে এই প্রথা ধীরে ধীরে গড়িয়া উঠিতেছিল। ভবদেব-শূদ্রের কন্দুপক্ক, তৈল-পক্ক, পায়েস, দধি প্রভৃতি ভোজ্য গ্রহণীয়-হারীতের এই উক্তি এবং আপস্তম্বের একটি বচন সমর্থন করিয়াছেন-তাহাতে বলা হইয়াছে যে ব্রাহ্মণ যদি আপকালে শূদ্রের অন্ন ভোজন করেন তাহা হইলে মনস্তাপ দ্বারাই শুদ্ধ হন। দ্বাদশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ বাঙ্গালী স্মাৰ্ত্ত ভবদেবভট্টের এই সমুদয় উক্তি হইতে অনুমিত হয় যে বিভিন্ন জাতির মধ্যে পান-ভোজন সম্বন্ধে নিষেধ তখনো পরবর্ত্তীকালের ন্যায় কঠোর রূপ ধারণ করে নাই এবং চাণ্ডালান্ন গ্রহণ করিলেও ব্রাহ্মণের জাতিপাত হইত না-প্রায়শ্চিত্ত করিলেই শুদ্ধি হইত।

.

২. ব্রাহ্মণ

হিন্দু যুগে বাংলায় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যজাতির সম্বন্ধে বিস্তৃত কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু প্রাচীনকাল হইতেই যে এদেশে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। গুপ্তযুগে বাংলার সর্বত্র ব্রাহ্মণের বসবাসের কথা পূর্ব্বেই আলোচিত হইয়াছে। তাম্রশাসন ও শিলালিপি হইতে দেখা যায় যে, পরবর্ত্তীকালে বিদেশ হইতে আগত বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ এদেশে স্থায়ীভাবে বাস করিয়াছেন, আবার এদেশ হইতেও বহুসংখ্যক ব্রাহ্মণ অন্য দেশে গিয়াছেন। কালক্রমে বাংলার ব্রাহ্মণগণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র, বৈদিক, শাসদ্বীপী প্রভৃতি শ্রেণীতে বিভক্ত হইয়াছিলেন। রাজা অথবা ধনীলোক ব্রাহ্মণদিগকে ভূমি, কখনো বা সমস্ত গ্রাম, দান করিয়া প্রতিষ্ঠা করিতেন। এই সমুদয় গ্রামের নাম হইতে ব্রাহ্মণদের গাঁঞীর সৃষ্টি হয় এবং ইহা তাঁহাদের নামের শেষে উপাধিস্বরূপ ব্যবহৃত হয়। এইরূপে বন্দ্যঘটী, মুখটী, গাঙ্গুলী প্রভৃতি গ্রামের নাম ও গাঁঞী হইতে বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, গঙ্গোপাধ্যায় প্রভৃতি সুপরিচিত উপাধির সৃষ্টি হইয়াছে। পুতিতুণ্ড, পিপলাই, ভট্টশালী, কুশারী, মাসচটক, বটব্যাল, ঘোষাল, মৈত্র, লাহিড়ী প্রভৃতি উপাধিও এইরূপে উদ্ভূত হইয়াছে। হিন্দু যুগের অবসানের পূর্ব্বেই যে বাংলায় ব্রাহ্মণদের মধ্যে পূর্ব্বোক্ত শ্রেণীবিভাগ এবং গাঁঞীপ্রথা প্রচলিত ছিল তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু বাংলার কুলজী গ্রন্থে ইহাদের উৎপত্তি সম্বন্ধে যে বিস্তৃত বিবরণ আছে তাহা সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায় না।

রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ সম্বন্ধে কুলজীর উক্তি সংক্ষিপ্ত এই :

“গৌড়ের রাজা আদিশূর বৈদিক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করিবার জন্য কান্যকুব্জ হইতে পাঁচজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণ আনয়ন করেন, কারণ বাংলার ব্রাহ্মণেরা বেদে অনভিজ্ঞ ছিলেন। এই পঞ্চ ব্রাহ্মণ স্ত্রীপুত্রাদিসহ বাংলা দেশে বসবাস করেন এবং আদিশূর তাঁহাদের বাসের জন্য পাঁচখানি গ্রাম দান করেন। কালক্রমে এই পঞ্চ ব্রাহ্মণের সন্তানগণমধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইল এবং তাঁহার ফলে কতক রাঢ়দেশে ও কতক বরেন্দ্রভূমে বাস করিতে লাগিলেন। পরে মহারাজা বল্লালসেনের রাজ্যকালে বাসস্থানের নাম অনুসারের তাঁহারা রাঢ়ী এবং বারেন্দ্র নামে দুইটি নির্দিষ্ট শ্রেণীতে বিভক্ত হইলেন। কালক্রমে তাঁহাদের বংশধরেরা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাইল। আদিশূরের পৌত্র ক্ষিতিশূরের সময় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণগণের মোট সংখ্যা হয় ঊনষাট। ক্ষিতিশূর তাঁহাদের বাসের জন্য উনষাটুখানি গ্রাম দান করেন। এই সমুদয় গ্রামের নাম হইতেই রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের গাঁঞীর উৎপত্তি হইয়াছে। রাজা ক্ষিতিশূরের পুত্র ধরাশূর এই সমুদয় ব্রাহ্মণদিগকে মুখ্য কুলীন, গৌণ কুলীন এবং শ্রোত্রীয় এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণ মহারাজা বল্লালসেনের সময়ে কুলীন, শ্রোত্রীয় ও কাপ এই তিন ভাগে বিভক্ত হন। তাঁহাদের গাঁঞীর সংখ্যা একশত”।

উপরে যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হইল তাঁহার প্রত্যেকটি বিষয় সম্বন্ধে বিভিন্ন কুলজী গ্রন্থের মধ্যে গুরুতর প্রভেদ বর্ত্তমান। মহারাজা আদিশূরের বংশ ও তারিখ, পঞ্চ ব্রাহ্মণের নাম ও আনয়নের কারণ, বঙ্গদেশে তাঁহাদের প্রতিষ্ঠা, রাঢ়ী ও বারেন্দ্র এই দুই শ্রেণীর উৎপত্তির কারণ, গাঁঞীর নাম ও সংখ্যা, কৌলীন্য প্রথার প্রবর্ত্তনের কারণ ও বিবর্ত্তনের ইতিহাস প্রভৃতি প্রত্যেক বিষয়েই পরস্পরবিরোধী বহু উক্তি বিভিন্ন কুলগ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায়। এই সমুদয় কুলগ্রন্থের কোনোখানিই খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দের পূর্ব্বে রচিত নহে। সুতরাং এই সমুদয় গ্রন্থের উপর নির্ভর করিয়া বঙ্গীয় ব্রাহ্মণগণের ইতিহাস রচনা করা কোনোমতেই সমীচীন নহে। কুলজীর মতে আদিশূর কর্ত্তৃক পঞ্চ ব্রাহ্মণ আনয়নের পূৰ্ব্বে বাংলায় মাত্র সাতশত ঘর ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁহাদের বংশধরেরা সপ্তশতী নামে খ্যাত ছিলেন এবং ব্রাহ্মণসমাজে বিশেষ হীন বলিয়া বিবেচিত হইতেন। কালক্রমে সাতশতী ব্রাহ্মণ বাংলাদেশ হইতে বিলুপ্ত হইয়াছে। সুতরাং পরবর্ত্তীকালে আগত বৈদিক প্রভৃতি কয়েকটি বিশিষ্ট শ্রেণীর অতি অল্পসংখ্যক ব্রাহ্মণ ব্যতীত বাংলা দেশের প্রায় সকল ব্রাহ্মণই কান্যকুব্জ হইতে আগত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সন্তান। এই উক্তি বা প্রচলিত মত বিশ্বাসের সম্পূর্ণ অযোগ্য। কান্যকুব্জ হইতে পাঁচজন বা ততোধিক ব্রাহ্মণ এদেশে আসিয়াছিলেন ইহা অবিশ্বাস করিবার কারণ নাই। কারণ তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে মধ্যদেশ হইতে আগত বহু ব্রাহ্মণ এদেশে ও ভারতের অন্যত্র স্থায়ীভাবে বসবাস করিয়াছেন। ইঁহারা বাংলা দেশের ব্রাহ্মণদের সহিত মিশিয়া গিয়াছেন, এবং বাসস্থানের নাম অনুসারে রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র প্রভৃতি বিভিন্ন ব্রাহ্মণ শ্রেণীর উদ্ভব হইয়াছে, ইহাই সঙ্গত ও স্বাভাবিক সিদ্ধান্ত বলিয়া মনে হয়। কৌলীন্য মৰ্য্যাদার উৎপত্তি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে কুলগ্রন্থের বর্ণনাও অধিকাংশই কাল্পনিক ও অতিরঞ্জিত।

বাংলার বৈদিক ব্রাহ্মণগণ সংখ্যায় অল্প হইলেও বিশেষ সম্মানভাজন। ইঁহারা দাক্ষিণাত্য ও পাশ্চাত্য এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণের ন্যায় ইহাদের কোনো গাঁঞী বা কৌলীন্যপ্রথা নাই।

দাক্ষিণাত্য বৈদিকগণের মতে তাঁহাদের পূর্ব্বপুরুষেরা উৎকল, দ্রাবিড় প্রভৃতি দেশ হইতে আসিয়া বাংলায় বসবাস করেন। ইঁহারা বলেন যে আর্য্যাবর্তে মুসলমানদিগের রাজ্য প্রতিষ্ঠা হইলে সেখানে বেদাদি শাস্ত্রচর্চ্চার ক্রমশ হ্রাস হইল। কিন্তু দ্রাবিড়াদি দাক্ষিণাত্য প্রদেশে বেদের বিলক্ষণ চর্চ্চা থাকায় বঙ্গদেশীয় ব্রাহ্মণগণ তাহাদিগকে সাদরে স্বদেশে বাস করাইলেন।

পাশ্চাত্য বৈদিকগণের কুলগ্রন্থে তাঁহাদের যে বিবরণ পাওয়া যায় তাহা সংক্ষিপ্ত এই :

“গৌড়দেশের রাজা শ্যামলবর্ম্মা বিক্রমপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। একদিন তাঁহার রাজপ্রাসাদে একটি শকুনি পতিত হওয়ায় শান্তি যজ্ঞের অনুষ্ঠান আবশ্যক হইল। গৌড়ের ব্রাহ্মণগণ নিরগ্নিক ও যজ্ঞে অনভিজ্ঞ, সুতরাং রাজা শ্যামলবর্ম্মা তাঁহার শ্বশুর কান্যকুজের (মতান্তরে কাশীর) রাজা নীলকণ্ঠের নিকট গমন করিয়া তথা হইতে যশোধর মিশ্র ও অন্য চারিজন সাগ্নিক ব্রাহ্মণকে সঙ্গে লইয়া ১০০১ শাকে (১০৭৯ অব্দে) স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন করেন। যজ্ঞ সমাপনান্তে শ্যামলবর্ম্মা গ্রামাদি দান করিয়া তাহাদিগকে এই দেশে প্রতিষ্ঠিত করিলেন। তাঁহাদের সন্তানেরাই পাশ্চাত্য বৈদিক নামে খ্যাত হইয়াছেন।”

পূর্ব্বোক্ত রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের কুলগ্রন্থের ন্যায় উল্লিখিত বিবরণের প্রায় প্রত্যেক বিষয়েই বৈদিক কুলজী গ্রন্থে পরস্পরবিরোধী মত পাওয় যায়। এমনকি কোনো কোনো কুলগ্রন্থে রাজার নাম শ্যামলবর্ম্মার পরিবর্তে হরিবর্ম্মা বলিয়া লিখিত হইয়াছে। অবশ্য এই দুইজনই বৰ্ম্মবংশীয় প্রসিদ্ধ রাজা। কোনো কোনো কুলগ্রন্থে বর্ণিত হইয়াছে যে শ্যামলবর্ম্মা কর্ত্তৃক আনীত পঞ্চ গোত্রীয় বৈদিক ব্রাহ্মণেরা কালক্রমে ‘বেদজ্ঞান-বিমূঢ় হওয়াতে ১১০২ শকাব্দে অন্য গোত্রীয় ব্রাহ্মণেরা আসিয়া বৈদিক কুলে মিলিত হন। সুতরাং এই সমুদয় মতামতের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।

বাংলায় গ্রহ-বিপ্র নামে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ আছেন। ইঁহারা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ বলিয়াও পরিচিত। ইঁহাদের কুলপঞ্জিকায় উক্ত হইয়াছে যে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক রোগাক্রান্ত হইয়া বৈদ্যগণের চিকিৎসায় সুফল না পাওয়ায় সরযূ নদীর তীরবাসী জপ-যজ্ঞপরায়ণ দ্বাদশ জন ব্রাহ্মণকে আনাইয়া গ্ৰহযজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন ও রোগমুক্ত হন। রাজার আদেশে ইঁহারা সপরিবারে গৌড়দেশে বাস করেন। ইঁহারা শাকদ্বীপবাসী মার্তণ্ডাদি আটজন মুনির বংশধর। গরুড় শাকদ্বীপ হইতে ইহাদের পূৰ্বপুরুষগণকে মধ্যদেশে আনয়ন করিয়াছিলেন।

এতদ্ব্যতীত অন্য কোনো কোনো শ্রেণীর ব্রাহ্মণও সম্ভবত হিন্দু যুগে বাংলায় ছিলেন। কিন্তু তাঁহাদের সম্বন্ধে বিশ্বাসযোগ্য কোনো বিবরণ পাওয়া যায় না। বল্লালসেন তাঁহার গুরু অনিরুদ্ধভট্ট সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন তাহাতে অনুমিত হয় যে তিনি সারস্বত শ্রেণীর ব্রাহ্মণ ছিলেন। কুলজী অনুসারে অন্ধরাজ শূদ্রক সরস্বতী নদীর তীর হইতে তাঁহাদিগকে আনয়ন করেন। কুলজী গ্রন্থে ব্যাস, পরাশর, কৌণ্ডিণ্য, সপ্তশতী প্রভৃতি অন্য যে সমুদয়, ব্রাহ্মণশ্রেণীর উল্লেখ আছে তাঁহার কোনোটিই যে প্রাচীন হিন্দু যুগে বাংলায় বিদ্যমান ছিল, ইহার বিশ্বস্ত প্রমাণ এখন পৰ্য্যন্তও পাওয়া যায় নাই।

ব্রাহ্মণগণ যে সমাজে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ মৰ্যাদা লাভ করিতেন এবং তাঁহাদের মধ্যে অনেকে প্রকৃত ব্রাহ্মণের উচ্চ আদর্শ অনুযায়ী জীবন যাপন করিতেন সে বিষয়ে সন্দেহ করিবার কারণ নাই। তাহাদের পাণ্ডিত্য, চরিত্র, ও অনাড়ম্বর জীবনযাত্রা সমাজের আদর্শ ছিল। কিন্তু সকল ব্রাহ্মণই যে এইরূপ আদর্শ অনুসারে চলিতেন এরূপ মনে করা ভুল। এমনকি শাস্ত্রে ব্রাহ্মণের যে সমুদয় নির্দিষ্ট কৰ্ম্ম আছে, অনেক বিশিষ্ট ব্রাহ্মণও তাহা মানিয়া চলেন নাই। ভবদেবভট্ট ও দর্ভপানি বংশানুক্রমিক রাজমন্ত্রী ছিলেন। সমতটে দুইটি ব্রাহ্মণ বংশ সপ্তম শতাব্দীতে রাজত্ব করিতেন। ব্রাহ্মণেরা যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। ব্রাহ্মণেরা যে অন্য নানাবিধ বৃত্তি দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিতেন শাস্ত্রে তাঁহার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইহার কোনো কোনোটি-যেমন কৃষিকার্য্যে-অনুমোদিত ছিল। কিন্তু অনেকগুলিই নিন্দনীয় ছিল এবং তাঁহার জন্য ব্রাহ্মণগণকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইত। ভবদেবভট্ট এইরূপ কার্য্যের এক সুদীর্ঘ তালিকা দিয়াছেন। শূদ্রের অধ্যাপনা ও যাজন ইহার অন্যতম। তৎকালে জাতিভেদের কুফল ও সমাজের অধঃপতন কত দূর পৌঁছিয়াছিল ইহা হইতে তাহা জানা যায়। ভবদেবভট্ট রাজার মন্ত্রীত্ব ও যুদ্ধ করিয়াও ব্রাহ্মণের সর্বোচ্চ পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণের আদর্শ বৃত্তি অধ্যাপন ও যাজন অবলম্বন করিয়া কোনো ব্রাহ্মণ যদি শূদ্রের জ্ঞান লাভে ও ধৰ্ম্মকাৰ্য্যে সহায়তা করিত তবে তাহাকে প্রায়শ্চিত্ত করিয়া শুদ্ধ হইতে হইত। অর্থাৎ ধৰ্ম্ম ও জ্ঞান লাভের জন্য ব্রাহ্মণের উপদেশ যাহাদের সর্বাপেক্ষা বেশী প্রয়োজন, তাহাদিগকে সাহায্য করা ব্রাহ্মণের পক্ষে নিন্দনীয় ছিল। চিত্রাদি শিল্প, বৈদ্যক ও জ্যোতিষশাস্ত্র প্রভৃতির চর্চ্চাও ব্রাহ্মণগণের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু রাজ্যশাসন, যুদ্ধ করা প্রভৃতি ব্রাহ্মণের আদর্শের সম্পূর্ণ বিরোধী কাজ করিয়াও ভবদেবের ন্যায় ব্রাহ্মণগণ আত্মশ্লাঘা করিতেন। ব্রাহ্মণগণের এই মনোবৃত্তিই যে সামাজিক অবনতি ও জ্ঞান বিজ্ঞানের অনুন্নতির একটি প্রধান কারণ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।

.

৩. করণ-কায়স্থ

প্রাচীন বঙ্গসমাজে ব্রাহ্মণের পরেই সম্ভবত করণ জাতির প্রাধান্য ছিল। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে সংকর জাতির মধ্যে প্রথমেই করণের উল্লেখ আছে। করণগণ যে খুব উচ্চপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তাঁহারও প্রমাণ আছে। সামন্ত রাজা লোকনাথ করণ ছিলেন এবং বৈন্যগুপ্তের তাম্রশাসনে একজন করণ কায়স্থ সান্ধিবিগ্রহিক বলিয়া উক্ত হইয়াছেন। শব্দ-প্রদীপ নামক একখানি বৈদ্যক গ্রন্থের প্রণেতা নিজেকে করণায় বলিয়াছেন। তিনি নিজে রাজবৈদ্য ছিলেন এবং তাঁহার পিতা ও পিতামহ রামপাল ও গোবিন্দচন্দ্রের রাজবৈদ্য ছিলেন। রামচরিত-প্রণেতা সন্ধ্যাকর নন্দীর পিতা সান্ধিবিগ্রহিক ও করণাগুণের শ্রেষ্ঠ বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন।

প্রাচীন ধর্ম্মশাস্ত্রে করণ শব্দে একটি জাতি ও এক শ্রেণীর কর্ম্মচারী (লেখক, হিসাবরক্ষক প্রভৃতি) বুঝায়। কায়স্থ শব্দও প্রথমে এই শ্রেণীর রাজকর্ম্মচারী বুঝাইত, পরে জাতিবাচক সংজ্ঞায় পরিণত হয়। কোষকার বৈজয়ন্তী কায়স্থ ও করণ প্রতিশব্দরূপে ব্যবহার করিয়াছেন। প্রাচীন লিপিতেও করণ ও কায়স্থ একই অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে। করণজাতি হিন্দু যুগের পরে ক্রমে বঙ্গদেশে লোপ পাইয়াছে, আবার কায়স্থ জাতি হিন্দু যুগের পূর্ব্বে এদেশে সুপরিচিত ছিল না, পরে প্রাধান্য লাভ করিয়াছে। সুতরাং এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত হইবে না যে, ভারতবর্ষের অন্য কোনো কোনো প্রদেশের ন্যায় বাংলা দেশেও করণ কায়স্থে পরিণত হইয়াছে অর্থাৎ উভয়ে মিলিয়া এক জাতিতে পরিণত হইয়াছে।

খৃষ্টীয় পঞ্চম, ষষ্ঠ ও অষ্টম শতাব্দীর তাম্রশাসনে ‘প্রথম-কায়স্থ’ ও ‘জ্যেষ্ঠকায়স্থ প্রভৃতির উল্লেখ দেখিয়া মনে হয় যে তখনো বাংলায় কায়স্থ শব্দে এক শ্রেণীর রাজকর্ম্মচারী মাত্র বুঝাইত। খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীর একখানি শিলালিপিতে গৌড় কায়স্থ বংশের উল্লেখ আছে। সুতরাং এই সময়ে বাংলায় কায়স্থ জাতির উৎপত্তি হইয়াছে এরূপ মনে করা যাইতে পারে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে বৃহদ্ধর্ম্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে কায়স্থের কোনো উল্লেখ নাই। কুলজী গ্রন্থের মতে আদিশূর কর্ত্তৃক আনীত পঞ্চ ব্রাহ্মণের সঙ্গে যে পঞ্চ ভৃত্য আসিয়াছিল তাহারাই ঘোষ, বসু, গুহ, মিত্র, দত্ত প্রভৃতি কুলীন কায়স্থের আদিপুরুষ।

.

৪. অনুষ্ঠ-বৈদ্য

বৈদ্য শব্দে প্রথমে চিকিৎসক মাত্র বুঝাইত-পরে ইহা একটি জাতিবাচক সংজ্ঞায় পরিণত হইয়াছে। ঠিক কোন সময়ে বাংলা দেশে এই জাতির প্রতিষ্ঠা হয় তাহা বলা কঠিন। সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর চারিখানি লিপিতে দক্ষিণ ভারতবর্ষে বৈদ্যজাতির উল্লেখ আছে। ইঁহারা রাজ্যে ও সমাজে উচ্চমৰ্য্যাদার অধিকারী ছিলেন এবং হঁহাদের কেহ কেহ ব্রাহ্মণ বলিয়া বিবেচিত হইতেন। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দের পূৰ্ব্বে বাংলায় বৈদ্যজাতির অস্তিত্বের কোনো বিশ্বস্ত প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। শ্রীহট্টের রাজা ঈশানদেবের তাম্রশাসনে তাঁহার মন্ত্রী (পউনিক) বনমালীকর বৈদ্যবংশপ্রদীপ’ বলিয়া উল্লেখিত হইয়াছেন। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলার তিনজন রাজার রাজবৈদ্য করণবংশীয় ছিলেন। সুতরাং হিন্দু যুগে বাংলার চিকিৎসা-ব্যবসায়ীরা যে বৈদ্য নামক বিশিষ্ট কোনো জাতি বলিয়া পরিগণিত হইতেন ইহা সম্ভব বলিয়া মনে হয় না।

প্রাচীন ধর্ম্মশাস্ত্রে অন্বষ্ঠ জাতির উল্লেখ আছে। মনুসংহিতা অনুসারে চিকিৎসা ইহাদের বৃত্তি। মধ্যযুগে বাংলা দেশে অন্বষ্ঠ বৈদ্যজাতির অপর নাম বলিয়া গৃহীত হইত। বর্ত্তমানকালে অনেক বৈদ্য ইহা স্বীকার করেন না, কিন্তু সুপ্রসিদ্ধ। ভরতমল্লিক অনুষ্ঠ ও বৈদ্য বলিয়া নিজের পরিচয় দিয়াছেন। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে অনুষ্ঠ ও বৈদ্য একই জাতির নাম, কিন্তু ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ অনুসারে এ দুইটি ভিন্ন জাতি। সম্ভবত বাংলায় বৈদ্য ও অনুষ্ঠ, কায়স্থ ও করণের ন্যায় একসঙ্গে মিশিয়া গিয়াছে। কিন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। বিহার ও যুক্তপ্রদেশে অনেক কায়স্থ অন্বষ্ঠ বলিয়া পরিচয় দেন। সূতসংহিতায় অন্বষ্ঠকে মাহিষ্য বলা হইয়াছে, কিন্তু ভরতমল্লিক বৈদ্য ও অন্যষ্ঠের অভিন্নত্ব-সূচক ব্যাস, অগ্নিবেশ ও শঙ্খস্মৃতি হইতে তিনটি শ্লোক উদ্ধৃত করিয়াছেন। ইহার কোনো স্মৃতিই খুব প্রাচীন নহে, এবং শ্লোকগুলিও অকৃত্রিম কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

.

৫. অন্যান্য জাতি

বাংলার অন্যান্য জাতি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। যুগী, সুবর্ণবণিক ও কৈবর্ত্ত জাতি সম্বন্ধে বল্লালচরিতে অনেক কথা আছে, কিন্তু এই সমুদয় কাহিনী বিশ্বাসযোগ্য নহে। রামপালের প্রসঙ্গে দিব্য নামক কৈবৰ্ত্তনায়কের বিদ্রোহের উল্লেখ করা হইয়াছে। দিব্য, রুদোক ও ভীম এই তিনজন কৈবর্ত্ত রাজা বরেন্দ্রে রাজত্ব করেন, সুতরাং রাজ্যে ও সমাজে কৈবর্ত্ত জাতির যে বিশেষ প্রতিপত্তি ছিল ইহা অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু সমসাময়িক স্মাৰ্ত্ত পণ্ডিত ভবদেবভট্ট কৈবৰ্ত্তকে অন্ত্যজ জাতি বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কৈবর্ত্ত ও মাহিষ্য সম্ভবত একই জাতি, কারণ উভয়েই স্মৃতি ও পুরাণে ক্ষত্রিয় পিতা ও বৈশ্যা মাতার সন্তান বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। বর্ত্তমানকালে পূর্ব্ববঙ্গের মাহিষ্য এবং পশ্চিমবঙ্গের চাষী কৈবৰ্ত্ত এক জাতি বলিয়া পরিগণিত। ইঁহাদের মধ্যে অনেক জমিদার ও তালুকদার আছেন এবং মেদিনীপুর জিলায় হঁহারাই খুব সম্ভ্রান্ত শ্ৰেণী। কিন্তু আর এক শ্রেণীর কৈবর্ত্ত ধীবর বলিয়া পরিচিত এবং মৎস্য বিক্রয়ই ইহাদের ব্যবসায়। ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে উক্ত হইয়াছে যে তীবর-সংসর্গহেতু কলিযুগে কৈবৰ্তগণ পতিত হইয়া ধীবরে পরিণত হইয়াছে। সম্ভবত বর্ত্তমানকালের ন্যায় প্রাচীনকালেও কৈবর্ত্ত জাতি হালিক ও জালিক এই দুই বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। বিষ্ণুপুরাণে যে কৈর্বত্ত জাতিকে অব্ৰহ্মণ্য বলা হইয়াছে, এবং বল্লালসেন যে কৈবৰ্ত্ত জাতিকে জলাচরণীয় করিয়াছিলেন বলিয়া বল্লালচরিতে উক্ত হইয়াছে, তাহা সম্ভবত কেবলমাত্র শেষোক্ত শ্ৰেণী সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। বাংলার আরও অনেক জাতির মধ্যে এইরূপ উচ্চ ও নীচ শ্ৰেণী দেখিতে পাওয়া যায়। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে উত্তম সংকর শ্ৰেণীর মধ্যে গোপের উল্লেখ আছে, ইহারা লেখক; কিন্তু মধ্যম সংকরের মধ্যে আভীর জাতির উল্লেখ আছে, ইহারা সম্ভবত দুগ্ধ-ব্যবসায়ী। বর্ত্তমানকালেও সপোপ ও গয়লা দুইটি বিভিন্ন জাতি।

বৃহদ্ধর্ম্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে যে সমুদয় নীচ জাতির উল্লেখ আছে তাঁহার প্রায় সকলগুলিই বর্ত্তমানকালে সুপরিচিত। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে ইহাদিগকে বর্ণাশ্রম-বহিষ্কৃত ও অন্ত্যজ বলা হইয়াছে। ভবদেবভট্টের মতে রজক, চর্মকার, নট, বরুড় কৈবর্ত্ত, মদে ও ভিল্ল এই সাতটি অন্ত্যজ জাতি। কিন্তু বৃহদ্ধর্ম্ম অনুসারে রজক ও নট মধ্যম সংকর জাতীয় এবং ব্রহ্মবৈবর্ত্ত মতে ভিল্ল সৎশূদ্র। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে স্থান ও কাল অনুসারে সমাজে বিভিন্ন জাতির উন্নতি ও অবনতি হইয়াছে।

প্রাচীন বৌদ্ধ চর্যাপদে ডোম, চণ্ডাল, ও শবরের কিছু কিছু বিবরণ আছে। ডোমেরা শহরের বাহিরে বাস করিত এবং অস্পৃশ্য বলিয়া গণ্য হইত। তাহারা বাঁশের ঝুড়ি বানাইত ও তাঁত বুনিত। ডোম মেয়েদের স্বভাব-চরিত্র ভালো ছিল না; তাহারা নাচিয়া-গাহিয়া বেড়াইত। চণ্ডালেরা মাঝে মাঝে গৃহস্থের বধূ চুরি করিয়া নিত। শবরেরা পাহাড়ে বাস করিত। তাহাদের মেয়েরা কানে দুল এবং ময়ূরপুচ্ছ ও গুঞ্জাফলের মালা পরিত। নৈহাটি তাম্রশাসনে পুলিন্দ নামে আর এক শ্রেণীর আদিম জাতির উল্লেখ আছে। তাহারা বনে বাস করিত, এবং তাহাদের মেয়েরাও গুঞ্জাফলের মালা পরিত। শবর জাতির কথা প্রাচীন বাংলার অন্য গ্রন্থেও আছে। সম্ভবত পাহাড়পুরের মন্দিরগাত্রে যে কয়েকটি আদিম অসভ্য নর-নারীর মূৰ্ত্তি আছে তাহারা শবর অথবা পুলিন্দজাতীয়। ইহাদের মধ্যে নর-নারী উভয়েরই কটিদেশে কয়েকটি বৃক্ষপত্র ব্যতীত আর কোনো আবরণ নাই। মেয়েরা কিন্তু পরিপাটি করিয়া কেশ-বিন্যাস করিত এবং পত্রপুষ্পের অনেক অলঙ্কার পরিত। পুরুষ ও স্ত্রীলোক উভয়েই বেশ সবলকায় ছিল এবং তীর-ধনুক ও খড়গ ব্যবহার করিতে জানিত। একটি উৎকীর্ণ ফলকে দেখা যায় একজন স্ত্রীলোক একটি মৃত জন্তু হাতে ঝুলাইয়া বীরদর্পে চলিয়াছে,-সম্ভবত নিজেই ইহা শিকার করিয়া আনিয়াছে, এবং ইহাই তাহাদের প্রধান খাদ্য ছিল। বাংলা দেশে সৰ্ব্বপ্রাচীনকালে যে সমুদয় জাতি বাস করিত সম্ভবত ইহারা তাহাদেরই বংশধর, এবং সহস্রাধিক বৎসরেও ইহাদের জীবনযাত্রার বিশেষ কোনো পরিবর্ত্তন হয় নাই।

.

৬. পূজা-পার্ব্বণ এবং আমোদ-উৎসব

দেব-দেবীর পূজা ব্যতীত ধর্ম্মের অনেক লৌকিক অনুষ্ঠানও প্রাচীনকালের সামাজিক জীবনে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিত। ধর্ম্মশাস্ত্রে বহুবিধ সংস্কারের উল্লেখ আছে,-জন্মের পূৰ্ব্ব হইতে মৃত্যুর পর পর্য্যন্ত মানুষের বিভিন্ন অবস্থায় এইগুলি পালনীয়। শিশুর জন্মের পূর্ব্বেই তাঁহার মঙ্গলের জন্য গর্ভাধান, পুংসবন, সীমন্তোন্নয়ন ও শোষ্যন্তী-হোম অনুষ্ঠিত হইত। জন্মের পর জাতকৰ্ম্ম, নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, পৌষ্টককৰ্ম্ম, অন্নপ্রাশন, চূড়াকরণ ও উপনয়ন। তাঁহার পর ছাত্রজীবনের আরম্ভ। শিক্ষা সমাপ্ত হইলে গৃহে প্রত্যাগত হইয়া সমাবর্ত্তন উৎসব; তৎপর বিবাহ ও নূতন গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে শালাকৰ্ম্ম অনুষ্ঠান করিতে হইত। মৃত্যুর অব্যবহিত পূৰ্ব্বে ও পরে নানাবিধ ঔদ্ধদৈহিক ক্রিয়ার ব্যবস্থা ছিল এবং অশৌচ পালন ও শ্রাদ্ধাদি শাস্ত্রের নিয়ম অনুসারেই আচরিত হইত। বাংলার স্মার্ত পণ্ডিতেরা এই সমুদয়ের যে বিস্তৃত বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন তাহা হইতে মনে হয় যে, ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের শাস্ত্রীয় ব্যবস্থার সহিত বাংলার এই বিষয়ে বিশেষ কোনো অনৈক্য ছিল না, এবং লোকাঁচারের যে প্রভেদ ছিল বর্ত্তমানকালেও তাঁহার প্রায় সবই বর্ত্তমান। এই সমুদয় সংস্কার ছাড়াও বাঙ্গালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় ধর্ম্মশাস্ত্রের প্রবল প্রভাব ছিল। কোন কোন তিথিতে কী কী খাদ্য ও কর্ম্ম নিষিদ্ধ, কোন তিথিতে উপবাস করিতে হইবে, এবং অধ্যয়ন, বিদেশযাত্রা, তীর্থগমন প্রভৃতির জন্য কোন কোন কাল শুভ বা অশুভ ইত্যাদি বিষয়ে শাস্ত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুশাসন দ্বারা প্রত্যেকের জীবন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হইত। কিন্তু তাই বলিয়া সেকালের জীবন একেবারে নিরানন্দ বা বৈচিত্র্যহীন ছিল না। বিবাহাদি উপলক্ষে নৃত্যগীতাদি আমোদ-উৎসব হইত। চর্যাপদে উক্ত হইয়াছে যে, বর বিবাহ করিতে যাইবার সময় পটহ, মাদল, করৎ, কলা, দুন্দুভি প্রভৃতির বাদ্য হইত। ইহা ছাড়া তখনো বাংলায় বারো মাসে তেরো পার্ব্বণ হইত এবং এই সমুদয় পূজা পাৰ্বণ প্রভৃতি উপলক্ষে নানাবিধ আমোদ-উৎসব অনুষ্ঠিত হইত।

এখানকার ন্যায় প্রাচীন হিন্দু যুগেও দুর্গাপূজাই বাংলার প্রধান পৰ্ব ছিল। সন্ধ্যাকরনন্দী রামচরিতে লিখিয়াছেন যে উমা অর্থাৎ দুর্গার অর্চনা উপলক্ষে বরেন্দ্রে বিপুল উৎসব হইত। অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থেও এই উৎসবের বিবরণ আছে। শারদীয় দুর্গাপূজায় বিজয়া দশমীর দিন শাবরোৎসব’ নামে এক প্রকার নৃত্য গীতির অনুষ্ঠান হইত। শবরজাতির ন্যায় কেবলমাত্র বৃক্ষপত্র পরিধান করিয়া এবং সারা গায়ে কাদা মাখিয়া, ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে সঙ্গে লোকেরা অশ্লীল গান গাহিত এবং তদনুরূপ কুৎসিত অঙ্গভঙ্গী করিত। জীমূতবাহন কাল-বিবেক’ গ্রন্থে যে ভাষায় এই নৃত্যগীতের বর্ণনা করিয়াছেন বর্ত্তমানকালের রুচি অনুসারে তাঁহার উল্লেখ বা ইঙ্গিত করাও অসম্ভব। অথচ তিনিই লিখিয়াছেন যে, যে ইহা না করিবে ভগবতী ক্রুদ্ধা হইয়া তাহাকে নিদারুণ শাপ দিবেন। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে কতিপয় অশ্লীল শব্দ সম্বন্ধে উক্ত হইয়াছে যে ইহা অপরের সম্মুখে উচ্চারণ করা কর্তব্য নহে, কিন্তু আশ্বিন মাসে মহাপূজার দিনে ইহা উচ্চারণ করিবে,-তবে মাতা, ভগিনী এবং শক্তিমন্ত্রে অদীক্ষিতা শিষ্যার সম্মুখে নহে। ইহার সপক্ষে এই পুরাণে যে যুক্তি দেওয়া হইয়াছে, শ্লীলতা বজায় রাখিয়া তাঁহার উল্লেখ করা যায় না। ধর্ম্মের নামে এই সমুদয় বীভৎসতা যে অনেক পরিমাণে তান্ত্রিক অনুষ্ঠানের ফল তাহা অস্বীকার করা কঠিন। উপযুক্ত অধিকারীর পক্ষে এই সমুদয় অনুষ্ঠান প্রয়োজনীয় অথবা ফলপ্রদ হইতে পারে, তর্কের খাতিরে ইহা স্বীকার করিলেও সৰ্ব্বসাধারণের উপর ইহার প্রভাব যে নীতি ও রুচির দিক দিয়া অত্যন্ত অশুভ হইয়াছিল, বাংলার সামাজিক ইতিহাস আলোচনা করিলে যে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না। চৈত্র মাসে কাম মহোৎসবেও বাদ্য-সহকারে এই প্রকার অশ্লীল গীত গান করা হইত, কারণ লোকের বিশ্বাস ছিল যে ইহাতে পরিতুষ্ট হইয়া কামদেব ধন, পুত্র প্রভৃতি দান করিবেন। হোলকা-বৰ্ত্তমান কালের হোলি-একটি প্রধান উৎসব ছিল। স্ত্রী-পুরুষ সকলেই ইহাতে যোগদান করিত, কিন্তু ইহার কোনো বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। দূত-প্রতিপদ নামে একটি বিশেষ উৎসব কার্তিক মাসের শুক্ল প্রতিপদে অনুষ্ঠিত হইত। প্রাতে বাজী রাখিয়া পাশা খেলা হইত, এবং লোকের বিশ্বাস ছিল যে ইহার ফলাফল আগামী বৎসরের শুভাশুভ নির্দেশ করে। তাঁহার পর বসন-ভূষণ পরিধান ও গন্ধ দ্রব্যাদি লেপন করিয়া সকলে গীতবাদ্যে যোগদান করিত এবং বন্ধুবান্ধবসহ ভোজন করিত। রাত্রে শয়নকক্ষ ও শয্যা বিশেষভাবে সজ্জিত হইত এবং প্রণয়ীযুগল একত্রে রাত্রি যাপন করিত। কোজাগরী পূর্ণিমার রাত্রেও অক্ষক্রীড়া হইত এবং আত্মীয় ও বন্ধুবান্ধব একত্র হইয়া ভোজন। করিতেন। চিড়া ও নারিকেলের প্রস্তুত নানাবিধ দ্রব্য এই রাত্রে প্রধান খাদ্য ছিল। কার্তিক মাসে সুখরাত্রিব্রত পালিত হইত। সন্ধ্যাকালে গরীব-দুঃখীকে খাওয়ানো হইত এবং পরদিন প্রভাতে যাহার সহিত দেখা হইত, বন্ধু বা আত্মীয় না হইলেও তাহাকে কুশলবচন এবং পুষ্প, গন্ধ, দধি প্রভৃতি দ্বারা অর্চনা করা হইত। ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া, পাষাণ-চতুর্দশীব্রত, আকাশ-প্রদীপ, জন্মাষ্টমী, অক্ষয়-তৃতীয়া, দশহরার গঙ্গাস্নান, অষ্টমীতে ব্রহ্মপুত্র স্নান প্রভৃতি বৰ্ত্তমানকালের সুপরিচিত অনুষ্ঠানগুলিও তকালে প্রচলিত ছিল। সেই যুগে শক্রোখান নামে একটি উৎসব ছিল। ভাদ্র মাসের শুক্লাষ্টমীতে ইন্দ্রের কাষ্ঠনির্ম্মিত বিশাল ধ্বজ-দণ্ড উত্তোলন করা হইত। এই উপলক্ষে সুবেশধারী নাগরিকগণ সমবেত হইতেন এবং রাজা স্বয়ং দৈবজ্ঞ, সচিব, কুঞ্চুকী ও ব্রাহ্মণগণ সমভিব্যাহারে উপস্থিত হইয়া উৎসবে যোগদান করিতেন। এই জাতীয় উৎসব এখন একেবারেই লোপ পাইয়াছে। এই সমুদয় পূজা-পাৰ্বণ, উৎসব প্রভৃতি ও তদুপলক্ষে আমোদ-প্রমোদ বাঙ্গালীর সামাজিক জীবনের বৈশিষ্ট্য ছিল।

.

৭. বাঙ্গালীর চরিত্র ও জীবনযাত্রা

এই যুগে সাধারণ বাঙ্গালীর দৈনন্দিন জীবনযাত্রার কোনো স্পষ্ট বা বিস্তৃত বিবরণ জানিবার উপায় নাই। প্রাচীন বাংলায় লিখিত চর্যাপদগুলিতে এ বিষয়ে কিছু কিছু উল্লেখ আছে। কিন্তু এই পদগুলি দশম শতাব্দী বা তাঁহার পরে রচিত, এবং অন্যান্য যে সমুদয় গ্রন্থে ইহার কোনো বিবরণ আছে তাহা ইহারও পরবর্ত্তীকালের রচনা। প্রাচীন লিপি, শিল্প ও বৈদেশিক ভ্রমণকারীর বিবরণী হইতে এ বিষয়ে যে তথ্য সংগ্রহ করা যায় তাহাও অতিশয় স্বল্প। এই সমুদয়ের উপর নির্ভর করিয়াই বাঙ্গালীর জীবনের বিভিন্ন দিক সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করিতেছি।

সপ্তম শতাব্দীতে চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করিয়া ইহার অধিবাসীদের সম্বন্ধে যে সমুদয় মন্তব্য করিয়াছেন তাহা বাঙ্গালী মাত্রেরই শ্লাঘার বিষয়। ‘সমতটের লোকেরা স্বভাবতই শ্রমসহিষ্ণু, তাম্রলিপ্তির অধিবাসীরা দৃঢ় ও সাহসী কিন্তু চঞ্চল ও ব্যস্তবাগীশ, এবং কর্ণসুবর্ণবাসীরা সাধু ও অমায়িক’-তাঁহার এই কয়েকটি সংক্ষিপ্ত মন্তব্যে প্রাচীন বাঙ্গালীর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়া উঠিয়াছে। তাছাড়া তিনি পুণ্ড্রবর্দ্ধন, সমতট ও কর্ণসুবর্ণে সর্ব্বসাধারণের মধ্যে লেখাপড়া শিখিবার অদম্য আগ্রহ ও প্রাণপণ চেষ্টার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করিয়াছেন। সহস্রাধিক বৎসর পরে আজিও ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের তুলনায় বাংলায় স্কুল-কলেজের সংখ্যাধিক্য বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনের এই বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিতেছে।

বাংলায় সাধারণত বেদ, মীমাংসা, ধর্ম্মশাস্ত্র, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, অর্থশাস্ত্র গণিত, জ্যোতিষ, কাব্য, তর্ক, ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ছন্দ, আয়ুর্ব্বেদ, অস্ত্রবেদ, আগম, তন্ত্র প্রভৃতির পঠনপাঠন প্রচলিত ছিল। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম্মের গ্রন্থাদিও পঠিত হইত। ফাহিয়ান ও ইৎসিং উভয়েই বৌদ্ধ গ্রন্থের চর্চ্চার জন্য তাম্রলিপ্তির বৌদ্ধবিহারে কিছুকাল অবস্থান করিয়াছিলেন।

জ্ঞান লাভের জন্য বাঙ্গালী দূরদেশে এমনকি সুদূর কাশীর পর্য্যন্ত যাইত। কিন্তু বাঙ্গালী ছাত্রদের কোনো কোনো বিষয়ে দুর্নাম ছিল। ক্ষেমেন্দ্র দশোপদেশ নামক হাস্যরসাত্মক কাব্যে লিখিয়াছেন যে গৌড়ের ছাত্রগণ যখন প্রথম কাশ্মীরে আসে তখন তাহাদের ক্ষীণ দেহ দেখিয়া মনে হয় যেন ছুঁইলেই ভাঙ্গিয়া পড়িবে; কিন্তু এখানকার জলবায়ুর গুণে তাহারা শীঘ্রই এমন উদ্ধত হইয়া উঠে যে, দোকানদার দাম চাহিলে দাম দেয় না, সামান্য উত্তেজনার বশেই মারিবার জন্য ছুরি উঠায়। বিজ্ঞানেশ্বরও লিখিয়াছেন যে গৌড়ের লোকেরা বিবাদপ্রিয়।

কিন্তু বাংলার মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। বাৎস্যায়ন তাহাদিগকে মৃদ্যুভাষিণী, কোমলাঙ্গী ও অনুরাগবতী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পবনদূত বিজয়পুরের বর্ণনা পড়িয়া মনে হয়, সেকালে মেয়েদের মধ্যে অবরোধ-প্রথা ছিল না-তাহারা স্বচ্ছন্দে বাহিরে ভ্রমণ করিত। কিন্তু বাৎস্যায়ন লিখিয়াছেন যে রাজান্তঃপুরের মেয়েরা পর্দার আড়াল হইতে অনাত্মীয় পুরুষের সহিত আলাপ করিত। মেয়েরা লেখাপড়া শিখিত। ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের ন্যায় বাংলায়ও মেয়েদের কোনো প্রকার স্বাতন্ত্র্য বা স্বাধীনতা ছিল না, প্রথমে পিতা পরে স্বামীর পরিবারবর্গের অধীনে থাকিতে হইত। এক বিষয়ে বাংলার বৈশিষ্ট্য ছিল। জীমূতবাহনের মতে অপুত্রক স্বামীর মৃত্যু হইলে বিধবা তাঁহার সমস্ত সম্পত্তির অধিকারিণী হইবে। এ বিষয়ে প্রাচীনকালে অনেক বিরুদ্ধ মত ছিল, যেমন পুত্রের অভাবে ভ্রাতা উত্তরাধিকারী এবং বিধবা কেবল গ্রাসাচ্ছাদনের অধিকারিণী হইবে। জীমূতবাহন এই সমুদয় মত খণ্ডন করিয়া বিধবার দাবী সমর্থন করিয়া গিয়াছেন, সুতরাং বাংলা দেশে এই বিধি প্রচলিত ছিল ইহা অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও সেকালের বিধবার জীবন এখনকার ন্যায়ই ছিল। কারণ জীমূতবাহনের মতে সম্পত্তির অধিকারিণী হইলেও ইহার দান ও বিক্রয় সম্বন্ধে বিধবার কোনো অধিকার থাকিবে না, এবং তাহাকে সতী-সাধ্বী স্ত্রীর ন্যায় কেবলমাত্র স্বামীর স্মৃতি বহন করিয়া জীবন ধারণ করিতে হইবে। স্বামীর পরিবারে সর্ববিষয়ে-এমনকি সম্পত্তির ব্যবস্থা সম্বন্ধেও-তাহাদের আনুগত্য স্বীকার করিয়া থাকিতে হইবে, এবং নিজের প্রাণধারণাৰ্থ যাহা প্রয়োজন, মাত্র তাহা ব্যয় করিয়া অবশিষ্ট স্বামীর পারলৌকিক কল্যাণের সর্ববিধ বিলাস-বর্জন ও কৃচ্ছসাধন করিতে হইত। সধবা অবস্থায় তাঁহার ব্যক্তিগত প্রভাব ও প্রতিপত্তি কিরূপ ছিল ঠিক বলা যায় না। তবে পুরুষের বহু-বিবাহ প্রচলিত ছিল এবং অনেক স্ত্রীকেই সপত্নীর সহিত একত্র জীবন যাপন করিতে হইত। সহমরণ প্রথা সেকালেও প্রচলিত ছিল এবং বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে ইহার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা আছে।

বাংলার অধিবাসীরা তখন বেশির ভাগ গ্রামেই বাস করিত। কিন্তু ধন-সম্পদপূর্ণ শহরেরও অভাব ছিল না। রামচরিতে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বঙ্গভূমির এবং পাল-রাজধানী রামাবতীর মনোরম বর্ণনা আছে। পবনদূতে সেন রাজধানী বিজয়পুরের বিবরণ পাওয়া যায়। অত্যুক্তিদোষে দূষিত হইলেও এই সমুদয় বর্ণনা হইতে সেকালের গ্রাম্য ও নাগরিক জীবনের কিছু আভাস পাওয়া যায়।

রামাবতী বর্ণনা প্রসঙ্গে কবি লিখিয়াছেন যে প্রশস্ত রাজপথের ধারে কনক পরিপূর্ণ ধবল প্রাসাদ-শ্ৰেণী মেরু-শিকরের ন্যায় প্রতীয়মান ইহত এবং ইহার উপর স্বর্ণকলস শোভা পাইত; নানা স্থানে মন্দির, স্তূপ, বিহার, উদ্যান, পুষ্করিণী, ক্রীড়াশৈল, ক্রীড়াবাপী ও নানাবিধ পুষ্প, লতা, তরু, গুল্ম নগরের শোভাবৃদ্ধি করিত। হীরক, বৈদুৰ্য্যমণি, মুক্তা, মরকত, মানিক্য ও নীলমণিখচিত আভরণ, বহুবিধ স্বর্ণখচিত তৈজসপত্র ও অন্যান্য গৃহোপকরণ, মহামূল্য বিচিত্র, সূক্ষ্ম বসন, কস্তুরী, কালাগুরু, চন্দন, কুঙ্কুম ও কপূরাদি গন্ধদ্রব্য, এবং নানা যন্ত্রোখিত মন্দ্রমধুর ধ্বনির সহিত তানলয়-বিশুদ্ধ সঙ্গীত সেকালের নাগরিকদের ঐশ্বর্য, সম্পদ, রুচি ও বিলাসিতার পরিচয় প্রদান করিত। সন্ধ্যাকরনন্দী স্পষ্টই লিখিয়াছেন যে, সেকালে সমাজে ব্যভিচারী ও সাত্ত্বিক উভয় শ্রেণীর লোক ছিল। নগরে বিলাসিতা ও উজ্জ্বলতা অবশ্য গ্রামের তুলনায় বেশী মাত্রায়ই ছিল।

বাংলার প্রাচীন ধর্ম্মশাস্ত্রে নৈতিক জীবনের খুব উচ্চ আদর্শের পরিচয় পাওয়া যায়। একদিকে সত্য, শৌচ, দয়া, দান প্রভৃতি সর্ব্ববিধগুণের মহিমা কীর্তন এবং অপরদিকে ব্রহ্মহত্যা, সুরাপান, চৌর্য্য ও পরদারগমন প্রভৃতি মহাপাতক বলিয়া গণ্য করিয়া তাঁহার জন্য কঠোর শাস্তি ও গুরুতর প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। ব্যক্তিগত জীবনে এই আদর্শ কী পরিমাণে অনুসৃত হইত তাঁহার সম্বন্ধে সঠিক ধারণা করা যায় না। সামাজিক জীবনের কিছু কিছু দুর্নীতি ও অশ্লীলতার কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। ইন্দ্রিয় সংযম বা দৈহিক পবিত্রতার আদর্শ যে হিন্দু যুগের অবসানকালে অনেক পরিমাণে খৰ্ব্ব হইয়াছিল এরূপ সিদ্ধান্ত করিবার যথেষ্ট কারণ আছে। এই যুগের কাব্যে ইন্দ্রিয়ের উচ্ছলতা যেভাবে প্রতিধ্বনিত হইয়াছে তাহা কেবলমাত্র কবির কল্পনা বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না। যে যুগের স্মার্ত পণ্ডিতগণ প্রামাণিক গ্রন্থে অকুণ্ঠিত চিত্তে লিখিয়াছেন যে শূদ্রাকে বিবাহ করা অসঙ্গত কিন্তু তাঁহার সহিত অবৈধ সহবাস করা তাদৃশ নিন্দনীয় নয়; যে যুগের কবি রাজপ্রশস্তিতে রাজার কৃতিত্বের নিদর্শনস্বরূপ গৰ্ব্বভরে বলিয়াছেন যে রাজপ্রাসাদে (অথবা রাজধানীতে) প্রতি সন্ধ্যায় ‘বেশবিলাসিনীজনের মঞ্জীর মঙুস্বনে’ আকাশ প্রতিধ্বনিত হয়; যে যুগের কবি মন্দিরের একশত দেবদাসীর রূপ-যৌবন বর্ণনায় উচ্ছ্বসিত হইয়া লিখিয়াছেন যে, ইহারা ‘কামিজনের কারাগার ও সঙ্গীত-কেলি-শ্রীর সঙ্গমগৃহ’ এবং ইহাদের দৃষ্টিমাত্রে ভস্মীভূত কাম পুনরুজ্জীবিত হয়; যে যুগের কবি বিষ্ণুমন্দিরে লীলাকমলহস্তে দেবদাসীগণকে লক্ষ্মীর সহিত তুলনা করিতে দ্বিধা বোধ করেন নাই; সে যুগের নর-নারীর যৌন সম্বন্ধের ধারণা ও আদর্শ বর্ত্তমানকালের মাপকাঠিতে বিচার করিলে খুব উচ্চ ও মহৎ ছিল এরূপ বিশ্বাস করা কঠিন। এ বিষয়ে পূৰ্ব্বেও বাঙ্গালীর যে খুব সুনাম ছিল না, তাঁহারও কিছু কিছু প্রমাণ আছে। বাৎস্যায়ন গৌড় ও বঙ্গের রাজান্ত :পুরবাসিনীদের ব্যভিচারের উল্লেখ করিয়াছেন। বৃহস্পতি ভারতের বিভিন্ন জনপদের আচার-ব্যবহার বর্ণনা প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন যে, পূৰ্ব্বদেশের দ্বিজাতিগণ মৎস্যাহারী এবং তাহাদের স্ত্রীগণ দুর্নীতিপরায়ণ।

ভাত, মাছ, মাংস, শাকসজী, ফলমূল, দুগ্ধ এবং দুগ্ধজাত নানাপ্রকারের দ্রব্য (ক্ষীর, দধি, ঘৃত ইত্যাদি) বাঙ্গালীর প্রধান খাদ্য ছিল। বাংলার বাহিরে ব্রাহ্মণেরা সাধারণত মাছ-মাংস খাইতেন না এবং ইহা নিন্দনীয় মনে করিতেন। কিন্তু বাংলায় ব্রাহ্মণেরা আমিষ ভোজন করিতেন, এবং ভবদেবভট্ট নানাবিধ যুক্তি প্রয়োগে ইহার সমর্থন করিয়াছেন। বৃহদ্ধর্ম্মপুরাণে রোহিত, সকুল, শফর এবং অন্যান্য শ্বেত ও শল্কমুক্ত মৎস্যভক্ষণের ব্যবস্থা আছে। সেকালে ইলিশ মৎস্য এবং পূৰ্ব্ববঙ্গে শুটকী মৎস্যের খুব আদর ছিল। নানারূপ মাদক পানীয় ব্যবহৃত হইত। ভবদেবভট্টের মতে সুরাপান সকলের পক্ষেই নিষিদ্ধ, কিন্তু এই ব্যবস্থা কত দূর কাৰ্য্যকরী ছিল বলা কঠিন। চর্য্যাপদে শৌণ্ডিকালয়ের উল্লেখ আছে।

পাহাড়পুরের মূর্ত্তিগুলি দেখিলে মনে হয় যে, সেকালের বাঙ্গালী নর-নারী সাধারণত এখনকার মতোই একখানা ধুতি ও শাড়ী পরিত। পুরুষেরা মালকোছা দিয়া খাটো ধুতি পরিত এবং অধিকাংশ সময়ই ইহা হাঁটুর নিচে নামিত না। কিন্তু মেয়েদের শাড়ী পায়ের গোড়ালি পর্য্যন্ত পৌঁছাত। ধুতি ও শাড়ি কেবল দেহের নিম্নাদ্ধা আবৃত করিত। নাভির উপরের অংশ কখনো খোলা থাকিত, কখনো পুরুষেরা উত্তরীয় এবং মেয়েরা ওড়না ব্যবহার করিত। মেয়েরা কদাচিৎ চৌলি বা স্তনপট্ট এবং বডিসের ন্যায় জামাও ব্যবহার করিত। উৎসবে বা বিশেষ উপলক্ষে সম্ভবত বিশেষ পরিচ্ছদের ব্যবস্থা ছিল।

পুরুষ ও মেয়েরা উভয়েই অঙ্গুরী, কানে কুণ্ডল, গলায় হার, হাতে কেয়ুর ও বলয়, কটিদেশে মেখলা ও পায়ে মল পরিত। শঙ্খ-বলয় কেবল মেয়েরাই ব্যবহার করিত। পুরুষ ও মেয়ে উভয়েই একাধিক হার গলায় দিত এবং মেয়েরা অনেক সময় এখনকার পশ্চিমদেশীয় স্ত্রীলোকের ন্যায় হাতে অনেকগুলি চুড়িবালা পরিত। ধনীরা সোনা, রূপা, মণি, মুক্তার অনেক আভরণ ব্যবহার করিত।

পুরুষ বা স্ত্রী কেহই কোনোরূপ শিরোভূষণ ব্যবহার করিত না। কিন্তু উভয়ের সুদীর্ঘ কুঞ্চিত কেশদাম নিপুণ কৌশলে বিন্যস্ত হইত। পুরুষদের চুল বাবরির ন্যায় কাঁধের উপর ঝুলিয়া পড়িত, মেয়েরা নানা রকম খোঁপা বাঁধিত।

সেকালের সাহিত্যে চামড়ার জুতা, কাঠের খড়ম এবং ছাতার উল্লেখ আছে। বাংলার প্রস্তুরমূর্ত্তিতে কেবল যোদ্ধাদের পায়ে কখনো কখনো জুতা দেখা যায়। সম্ভবত ইহা সাধারণত ব্যবহৃত হইত না। কয়েকটি মূর্ত্তিতে ছাতার ব্যবহার দেখা যায়।

মেয়েরা বিবাহ হইলে কপালে সিন্দুর পরিত। তাছাড়া চরণদ্বয় অলক্তক, ও নিম্নাধর সিন্দুর দ্বারা রঞ্জিত করিত। কুঙ্কুমাদি নানা গন্ধ দ্রব্যের ব্যবহার ছিল।

সেকালে নানাবিধ ক্রীড়াকৌতুক ছিল। পাশা ও দাবা খেলা এবং নৃত্য-গীত অভিনয়ের খুব প্রচলন ছিল। চৰ্য্যাপদে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের নাম আছে। পাহাড়পুরের খোদিত ফলকে নানা প্রকার বাদ্যযন্ত্র দেখিতে পাওয়া যায়। বীণা, বাঁশী, মৃদঙ্গ, করতাল, ঢাক-ঢোল প্রভৃতি তো ছিলই, এমনকি মাটির ভাণ্ডও বাদ্যযন্ত্ররূপে ব্যবহৃত হইত। পুরুষেরা শিকার, মল্লযুদ্ধ, ব্যায়াম ও নানাবিধ বাজীকরের খেলা করিত। মেয়েরা উদ্যান-রচনা, জলক্রীড়া প্রভৃতি ভালোবাসিত।

গরুর গাড়ি ও নৌকাস্থল ও জলপথের প্রধান যানবাহন ছিল। ধনী লোকেরা হস্তী, অশ্ব, রথ, অশ্ব-শকট প্রভৃতি ব্যবহার করিত। বিবাহের পর বর গরুর গাড়ীতে বধূকে লইয়া বাড়ী ফিরিতেন। গরুর গাড়ী কিংশুক ও শাল্মলী কাষ্ঠে নির্ম্মিত হইত। গ্রামের লোকেরা ভেলা ব্যবহার করিত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *