দ্বাদশ পরিচ্ছেদ –সেনরাজবংশ
১. উৎপত্তি
সেনরাজগণের পূর্ব্বপুরুষগণ দাক্ষিণাত্যের অন্তর্গত কর্ণাটদেশের অধিবাসী ছিলেন। বম্বে প্রদেশ ও হায়দ্রাবাদ রাজ্যের দক্ষিণ এবং মহীশূর রাজ্যের উত্তর ও পশ্চিম ভাগ প্রাচীন কর্ণাটদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেনরাজগণের শিলালিপি অনুসারে তাঁহারা চন্দ্রবংশীয় এবং ব্রহ্মক্ষত্রিয় ছিলেন। বাংলা দেশের প্রাচীন কুলজী গ্রন্থে তাঁহাদিগকে বৈদ্য জাতীয় বলা হইয়াছে। আধুনিককালে তাহাদিগকে কায়স্থ এবং বাংলা দেশের অন্যান্য সুপরিচিত জাতিভুক্ত বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা হইয়াছে। কিন্তু এ বিষয়ে সমসাময়িক লিপিতে তাঁহাদের নিজেদের উক্তি সত্য বলিয়া গ্রহণ করিতে হইবে। সুতরাং সেনরাজগণ যে জাতিতে ব্রহ্মক্ষত্রিয় ছিলেন সে সম্বন্ধে সন্দেহ করিবার কোনো কারণ নাই। বাংলা দেশে আসিবার পর তাহারা হয়ত বৈবাহিক সম্বন্ধ দ্বারা বৈদ্য অথবা অন্য কোনো জাতির অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিলেন, কিন্তু এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না।
ব্ৰহ্মক্ষত্রিয় একটি সুপরিচিত জাতি। অনেকে মনে করেন যে প্রথমে ব্রাহ্মণ ও পরে ক্ষত্রিয় হওয়াতেই এই জাতির এরূপ নামকরণ হইয়াছে। সেনরাজগণের এক পূৰ্বপুরুষ ব্রহ্মবাদী বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। এই সময় কর্ণাটদেশে (বর্ত্তমান ধারবাড় জিলায়) সেন উপাধিধারী অনেক জৈন আচার্যের নাম পাওয়া যায়। ইঁহারা সেনবংশীয় বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে বাংলার সেনরাজগণ এই জৈন আশ্চার্যবংশে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে তাঁহারা জৈনধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া শৈবধর্ম্ম ও পরবর্ত্তীকালে ধৰ্ম্মচৰ্য্যার পরিবর্তে শস্ত্ৰচৰ্য্যা গ্রহণ করেন। এই অনুমান কত দূর সত্য তাহা বলা কঠিন।
সেনরাজগণ কোন সময়ে বাংলা দেশে প্রথম বসতি স্থাপন করেন সে সম্বন্ধে সেনরাজগণের লিপিতে যে দুইটি উক্তি আছে তাহা প্রথমে পরস্পরবিরোধী বলিয়াই মনে হয়। বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপিতে কথিত হইয়াছে যে সামন্তসেন রামেশ্বর সেতুবন্ধ পর্য্যন্ত বহু যুদ্ধাভিযান করিয়া এবং দুৰ্বত্ত কর্ণাটলক্ষ্মী-লুণ্ঠনকারী শত্রুকুলকে ধ্বংস করিয়া শেষ বয়সে গঙ্গাতটে পুণ্যাশ্রমে জীবন যাপন করিয়াছিলেন। ইহা হইতে স্বতঃই অনুমিত হয় যে সামন্তসেনই প্রথমে কর্ণাট হইতে বঙ্গদেশে আসিয়া গঙ্গাতীরে বাস করেন। কিন্তু বল্লালসেনের নৈহাটি তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে চন্দ্রের বংশে জাত অনেক রাজপুত্র রাঢ়দেশের অলঙ্কারস্বরূপ ছিলেন এবং তাঁহাদের বংশে সামন্তসেন জন্মগ্রহণ করেন। এখানে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, সামন্তসেনের পূর্ব্বপুরুষগণ রাঢ়দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। এই দুইটি উক্তির সামঞ্জস্য সাধন করিতে হইলে বলিতে হয় যে কর্ণাটের এক সেনবংশ বহুদিন যাবৎ রাঢ়দেশে বাস করিতেছিলেন, কিন্তু তাঁহারা কর্ণাট দেশের সহিতও সম্বন্ধ রক্ষা করিয়া আসিতেছিলেন। এই বংশের সামন্তসেন যৌবনে কর্ণাট দেশে বহু যুদ্ধে নিজের শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়া এই বংশের উন্নতির সূত্রপাত করেন এবং সম্ভবত ইহার ফলেই তাঁহার পুত্র হেমন্তসেন রাঢ়দেশে একটি স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।
কী উপায়ে বিদেশীয় সেনগণ সুদূর কর্ণাট দেশ হইতে আসিয়া বাংলায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন তাহা অদ্যাবধি সঠিক নির্ণীত হয় নাই। কেহ কেহ অনুমান করেন যে তাঁহারা প্রথমে পালরাজগণের অধীনে সৈন্যাধ্যক্ষ অথবা অন্য কোনো উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন। পরে পালরাজগণের দুর্বলতার সুযোগে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই অনুমানের সপক্ষে বলা যাইতে পারে যে পালরাজগণের তাম্রশাসনগুলিতে যে কর্ম্মচারীর তালিকা আছে তাঁহার মধ্যে নিয়মিতভাব ‘গৌড়-মালব-খশ-হূণ-কুলিক-কর্ণাট-লাট-চাট-ভাট’ এই পদের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং সম্ভবত পালরাজগণ খশ হূণ প্রভৃতির ন্যায় কর্ণাটগণকেও সৈন্যদলে নিযুক্ত করিতেন এবং সেনবংশীয় তাহাদের নায়ক কোনো সুযোগে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্র এক রাজ্যের অধিপতি হইয়াছিলেন।
কেহ কেহ বলেন যে, কর্ণাটদেশীয় সেনরাজগণের পূর্ব্বপুরুষ কোনো আক্রমণকারী রাজার সহিত দাক্ষিণাত্য হইতে বঙ্গদেশে আসিয়া প্রথমে শাসনকর্ত্তা বা সামন্তরাজরূপে প্রতিষ্ঠিত হন এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিন্ধিয়া হোলকার প্রভৃতি মহারাষ্ট্র নায়কগণের ন্যায় ক্রমে পশ্চিমবঙ্গে এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। কর্ণাটের চালুক্যরাজগণ যে একাধিকবার বঙ্গদেশ আক্রমণ করেন তাহা পূর্ব্বেই। বলা হইয়াছে। যুবরাজ বিক্রমাদিত্য আ ১০৬৮ অব্দে গৌড় ও কামরূপ আক্রমণ করিয়া জয়লাভ করিয়াছিলেন। ইহার পূর্ব্বে ও পরে এইরূপ আরও বিজয়াভিযানের কথা চালুক্যগণের শিলালিপিতে উল্লিখিত হইয়াছে। একখানি লিপি হইতে জানা যায় যে একাদশ শতাব্দীর শেষ অথবা দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে আচ নামক • চালুক্যরাজ বিক্রমাদিত্যের একজন সামন্ত বঙ্গ ও কলিঙ্গ রাজ্যে স্বীয় প্রভুর আধিপত্য স্থাপন করিয়াছিলেন। ১১২১ ও ১১২৪ অব্দে উৎকীর্ণ লিপিতে বিক্রমাদিত্য কর্ত্তৃক অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, গৌড়, মগধ ও নেপাল জয়ের উল্লেখ আছে। সুতরাং ইহা অসম্ভব নহে যে, এই সমস্ত অভিযানের ফলেই কর্ণাটবংশীয় সেনগণ বঙ্গদেশে এবং নান্যদেব মিথিলায় প্রভুত্ব স্থাপনের সুযোগ পাইয়াছিলেন।
কেহ কেহ অনুমান করেন যে সেনরাজগণের পূৰ্বপুরুষ চোলরাজ রাজেন্দ্ৰচোলের সঙ্গে বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন। কিন্তু রাজেন্দ্ৰচোল কর্ণাটবাসী ছিলেন না, সুতরাং পূর্ব্বোক্ত অনুমানই অধিকতর বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয়।
সেনরাজগণ যে সময় এবং যেভাবেই বঙ্গদেশে আসিয়া থাকুন, সামন্তসেনের পূৰ্ব্বে তাঁহাদের কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায় নাই। সামন্তসেন কর্ণাট দেশে অনেক যুদ্ধে যশোলাভ করিয়া বৃদ্ধ বয়সে রাঢ়দেশে গঙ্গাতীরে বাসস্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি কোনো স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। কারণ তাঁহার পৌত্র বিজয়সেনের শিলালিপিতে তাঁহার নামের সঙ্গে কোনো রাজত্বসূচক পদবী ব্যবহৃত হয় নাই। অপর পক্ষে বিজয়সেনের লিপিতে তাঁহার পিতা হেমন্তসেন মহারাজাধিরাজ ও মাতা যশোদেবী মহারাজ্ঞী উপাধীতে ভূষিত হইয়াছেন। সুতরাং হেমন্তসেনই এই বংশের প্রথম রাজা ছিলেন এই অনুমানই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। কিন্তু হেমন্তসেন সম্বন্ধে আর কোনো বিবরণ এ পর্য্যন্ত জানা যায় নাই। যদিও পরবর্ত্তীকালে তাঁহার পুত্রের লিপিতে তাহাকে মহারাজাধিরাজ বলা হইয়াছে, তথাপি খুব সম্ভবত তিনি রামপালের অধীনস্থ একজন সামন্ত রাজা ছিলেন।
.
২. বিজয়সেন
হেমন্তসেনের মৃত্যুর পর তাঁহার পুত্র বিজয়সেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। বিজয়সেনের একখানি তাম্রশাসন ও একখানি শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে। তাম্রশাসনখানিতে তাঁহার যে রাজ্যাঙ্ক লিখিত আছে তাঁহার প্রকৃত পাঠ সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কেহ কেহ ইহাকে ৩২ এবং কেহ কেহ ৬২ পাঠ করিয়াছেন। এই শেষোক্ত মতই এখন সাধারণত গৃহীত হইয়া থাকে এবং ইহা সত্য হইলে বিজয়সেন আ ১০৯৫ অব্দে রাজ্য লাভ করিয়াছিলেন। অপর পক্ষে তাম্ৰশাসনোক্ত রাজ্যাঙ্ক ৩২ পাঠ করিলে তিনি আ ১১২৫ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন এরূপ অনুমানই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া মনে হয়।
পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে পালরাজ রামপাল আ ১০৭০ হইতে ১১২০ অব্দ পর্য্যন্ত রাজত্ব করেন। সুতরাং যদি বিজয়সেন ১০৯৫ অব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়া থাকেন তাহা হইলে তাঁহার রাজত্বের প্রথম ১৫ বৎসর তিনি ক্ষুদ্র ভূখণ্ডের অধিপতি এবং অন্তত কিছুকাল রামপালের সামন্ত ছিলেন এই সিদ্ধান্ত সমীচীন বলিয়া মনে হয়। যে সমুদয় সামন্তরাজ রামপালকে বরেন্দ্র উদ্ধারে সাহায্য করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে নিদ্রাবলীর বিজয়রাজ একজন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে এই বিজয়রাজই সেনরাজ বিজয়সেন। আবার বিজয়সেনের শিলালিপির ঊনবিংশ শ্লোকে গূঢ় শ্লেষ অর্থ কল্পনা করিয়া কেহ কেহ সিদ্ধান্ত করিয়াছেন যে বিজয়সেন কৈবর্ত্যরাজ দিব্যকে পরাজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু এই অনুমান ভিত্তিহীন বলিয়াই মনে হয়।
রামপালের মৃত্যুর পর যখন পালরাজ্যে গোলযোগ উপস্থিত হইল তখনই বিজয়সেন স্বীয় শক্তি বৃদ্ধি করিবার সুযোগ পাইলেন। শূরবংশীয় রাজকন্যা বিলাসদেবী তাঁহার প্রধানা মহিষী ছিলেন। রামপালের সামন্ত রাজগণের মধ্যে অরণ্য প্রদেশস্থ সামন্তবর্গের চূড়ামণি অপরমারের অধিপতি লক্ষ্মীশূরের উল্লেখ আছে। রাজেন্দ্ৰচোলের লিপিতে দক্ষিণ রাঢ়ের অধিপতি রণশূরের নাম পাওয়া যায়। সুতরাং একাদশ শতাব্দীতে দক্ষিণ রাঢ় অথবা ইহার অধিকাংশ শূরবংশীয় রাজগণের অধীনে ছিল। সম্ভবত বিলাসদেবী এই বংশীয় ছিলেন এবং তাঁহাকে বিবাহ করিয়া বিজয়সেন রাঢ়দেশে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করিবার সুবিধা পাইয়াছিলেন। কিন্তু কর্ণাটরাজের সামন্ত আচ কর্ত্তৃক বঙ্গদেশে প্রভুত্ব স্থাপনই সম্ভবত কর্ণাটদেশীয় বিজয়সেনের শক্তিবৃদ্ধির প্রধান কারণ।
যে উপায়ে হউক বিজয়সেন যে রামপালের মৃত্যুর অনতিকাল পরেই সমগ্র বঙ্গদেশে প্রভুত্ব স্থাপনের প্রয়াসী হইয়াছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তিনি বৰ্ম্মরাজকে পরাজিত করিয়া পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণবঙ্গ অধিকার করেন। তাঁহার দেওপাড়া শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে যে নান্য, বীর, রাঘব ও বর্দ্ধন নামক রাজগণ তাঁহার সহিত যুদ্ধে পরাভূত হন এবং তিনি কামরূপরাজকে দূরীভূত, কলিঙ্গরাজকে পরাজিত এবং গৌড়রাজকে দ্রুত পলায়ন করিতে বাধ্য করেন।
বিজয়সেনের ন্যায় কর্ণাটদেশীয় নান্যদেব মিথিলায় রাজত্ব স্থাপন করিয়াছিলেন। সম্ভবত তিনিও বঙ্গদেশ অধিকার করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন এবং এই সূত্রেই বিজয়সেনের সহিত তাঁহার যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পরাজিত হইয়া নান্যদেব বঙ্গজয়ের আশা ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। বীর, বর্দ্ধন ও রাঘব এই তিনজন রাজা কোথায় রাজত্ব করিতেন তাহা নিশ্চিত বলা যায় না।
বিজয়সেন কর্ত্তৃক পরাজিত গৌড়রাজ যে মদনপাল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। রাজসাহী জিলার অন্তর্গত দেওপাড়া নামক স্থানে বিজয়সেনের যে শিলালিপি পাওয়া গিয়াছে তাহা হইতে জানা যায় যে তিনি ঐ স্থানে প্রদ্যুম্নেশ্বরের এক প্রকাণ্ড মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। সুতরাং বরেন্দ্রের অন্তত এক অংশ যে বিজয়সেনের রাজ্যভুক্ত হইয়াছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। কামরূপ ও কলিঙ্গের অভিযানের ফলে বিজয়সেন কী পরিমাণ ঐ দুই রাজ্যে স্বীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছিলেন তাহা নিশ্চিত বলা যায় না, কিন্তু ইহা হইতে সিদ্ধান্ত করা যায় যে সমগ্র পূর্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গে বিজয়সেনের আধিপত্য দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কারণ তাহা না হইলে তাঁহার পক্ষে কামরূপ ও কলিঙ্গে কোনো অভিযান প্রেরণ করা সম্ভবপর ছিল বলিয়া মনে হয় না।
এইরূপে বহু যুদ্ধে জয়লাভ করিয়া বিজয়সেন প্রায় সমগ্র বাংলা দেশে এক অখণ্ড রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। পালরাজগণ মগধে আশ্রয় লইয়াছিলেন। বরেন্দ্রের এক অংশে তাঁহাদের কোনো আধিপত্য ছিল কি না বলা যায় না, কিন্তু বঙ্গদেশের অন্য কোনো স্থানে তাঁহাদের যে কোনো প্রকার প্রভুত্বই। ছিল না সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই।
দেওপাড়া লিপিতে উল্লিখিত হইয়াছে যে পাশ্চাত্য চক্র জয় করিবার জন্য বিজয়সেনের নৌ-বিতান গঙ্গা নদীর মধ্য দিয়ে অগ্রসর হইয়াছিল। এই রণসজ্জার উদ্দেশ্য ও ফলাফল কিছুই নিশ্চিতরূপে জানা যায় না। সম্ভবত মগধের পাল ও গাহড়বাল এই দুই রাজশক্তির বিরুদ্ধেই ইহা প্রেরিত হইয়াছিল। যদি ইহা রাজমহল অতিক্রম করিয়া থাকে তাহা হইলে বলিতে হইবে যে বরেন্দ্র ও মিথিলা এই উভয় প্রদেশেই বিজয়সেনের শক্তি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কিন্তু পাশ্চাত্য শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা যে বিশেষ সফল হইয়াছিল দেওপাড়া লিপির বর্ণনা হইতে এরূপ মনে হয় না।
বিজয়সেনের রাজত্ব বাংলার ইতিহাসে বিশেষ একটি স্মরণীয় ঘটনা। বহুদিন পরে আবার একটি দৃঢ় রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়া দেশে সুখ ও শান্তি আনয়ন করিয়াছিল। পালরাজত্বের শেষ যুগে বাংলার রাজনৈতিক একতা বিনষ্ট হইয়াছিল এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সামন্তরাজগণ স্বীয় স্বার্থের প্রেরণায় বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের আদর্শ ভুলিয়া পরস্পর কলহে মত্ত ছিলেন। অর্থ ও রাজ্যের লোভ দেখাইয়া রামপাল ইহাদিগকে কিছুদিনের জন্য স্বপক্ষে আনিয়াছিলেন, কিন্তু ইহাদিগকে দমন করিয়া দৃঢ় অখণ্ড রাজশক্তির প্রভাব পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করিতে পারেন নাই। বিজয়সেন ইহা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন এবং তাঁহাদের প্রবল প্রতাপে বাংলায় এক নূতন গৌরবময় যুগের সূচনা হইল। বিজয়সেন এইরূপ কঠোর শাসনের প্রবর্ত্তন না করিলে বাংলা দেশে পুনরায় অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায়ের প্রাদুর্ভাব হইত। সাধারণত একজন সামন্তরাজের পদ হইতে নিজের বুদ্ধি সাহস ও রণ-কৌশলে বিজয়সেন বাংলার সার্বভৌম রাজার স্থান অধিকার করিয়াছিলেন। ইহাই তাঁহার প্রধান কৃতিত্ব ও অসামান্য ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। তিনি পরমেশ্বর পরমভট্টারক ও মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন এবং অরিরাজ-বৃষভশঙ্কর এই গৌরবসূচক নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁহার রাজত্বে যে বাংলায় নবযুগের সূত্রপাত হইয়াছিল কবি উমাপতিধর রচিত দেওপাড়া প্রশস্তি তাঁহার সাক্ষ্য দিতেছে। অত্যুক্তি দোষে দূষিত হইলেও এই প্রশস্তির মধ্যে এক নবজাগ্রত জাতি ও রাজশক্তির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আদর্শ প্রতিধ্বনিত হইয়াছে এবং বিজয়সেনের এক বিরাট মহিমাময় চিত্র প্রতিফলিত হইয়াছে। প্রসিদ্ধ কবি শ্রীহর্ষ-রচিত বিজয়-প্রশস্তি ও গৌড়োৰ্ব্বীশ-কুল-প্রশস্তি বিজয়সেনের উদ্দেশ্যেই লিখিত হইয়াছিল এরূপ মনে করিবার সঙ্গত কারণ আছে।
.
৩. বল্লালসেন
আ ১১৫৮ অব্দে বিজয়সেনের মৃত্যু হয় এবং তৎপুত্র বল্লালসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। বল্লালসেনের একখানি তাম্রশাসন এবং তাঁহার রচিত দানসাগর এবং অদ্ভুতসাগর নামক দুইখানি গ্রন্থ হইতে তাঁহার সম্বন্ধে কিছু কিছু বিবরণ জানা যায়। এতদ্ব্যতীত ‘বল্লাল-চরিত’ নামক দুইখানি গ্রন্থ আবিষ্কৃত হইয়াছে; ইহাতে বল্লালসেনের অনেক কাহিনী বিবৃত হইয়াছে। বল্লালচরিতের একখানি গ্রন্থের পুস্পিকা হইতে জানা যায় যে ইহার প্রথম দুই খণ্ড বল্লালসেনের অনুরোধে তাঁহার শিক্ষক গোপালভট্ট কর্ত্তৃক ১৩০০ শকাব্দে, এবং তৃতীয় খণ্ড নবদ্বীপাধিপতির আদেশে গোপালভট্টের বংশধর আনন্দভট্ট কর্ত্তৃক ১৫০০ শকাব্দে রচিত হইয়াছিল। বল্লালচরিতের দ্বিতীয় গ্রন্থ নবদ্বীপের রাজা বুদ্ধিমন্তখানের আদেশে আনন্দভট্ট কর্ত্তৃক ১৪৩২ শকাব্দে রচিত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে প্রথম গ্রন্থখানি জাল এবং দ্বিতীয় গ্রন্থখানিই প্রকৃত বল্লালচরিত। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন। উভয় গ্রন্থই কতকগুলি বংশাবলী এবং জনপ্রবাদের সমষ্টিমাত্র এবং ইহার কোনোখানিই প্রামাণিক বা অকৃত্রিম বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। সম্ভবত ষোড়শ কি সপ্তদশ শতাব্দীতে কেবলমাত্র প্রচলিত কিংবদন্তী অবলম্বন করিয়াই এই গ্রন্থ দুইখানি লিখিত হইয়াছিল এবং উনবিংশ শতাব্দীতেও ইহার কোনো কোনো অংশ পরিবর্তিত অথবা পরিবর্ধিত হইয়াছে। সুতরাং বল্লালচরিতের কোনো উক্তি অন্য প্রমাণাভাবে বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া গ্রহণ করা সঙ্গত নহে।
দানসাগর ও অদ্ভুতসাগরের উপসংহারে বল্লালসেনের পরিচায়ক কয়েকটি শ্লোক আছে। ইহা হইতে জানা যায় যে, গুরু অনিরুদ্ধের নিকট বল্লালসেন বেদস্মৃতিপুরাণ প্রভৃতি বহুশাস্ত্র অধ্যয়ন করিয়াছিলেন। বল্লালসেন যে যাগযজ্ঞাদি ধৰ্ম্মানুষ্ঠানে রত প্রবীণ শাস্ত্রবিৎ পণ্ডিত ছিলেন তাঁহার রচিত উক্ত দুইখানি গ্রন্থই তাঁহার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। এদেশে বল্লালসেনের সম্বন্ধে যে সমুদয় প্রবাদ প্রচলিত আছে তাহাও এই সিদ্ধান্তের সমর্থন করে। বঙ্গীয় কুলজী গ্রন্থে কৌলিন্য প্রথার উৎপত্তির সহিত বল্লালসেনের নাম অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। বাংলা দেশ বিজয়সেনকে ভুলিয়া গিয়াছে কিন্তু বল্লালসেনের নাম ও স্মৃতি এদেশ হইতে বিলুপ্ত হয় নাই। খুব সম্ভবত বল্লালসেনের একটি বিরাট গ্রন্থালয় ছিল দুই-তিন শত বৎসর পরেও ইহা বর্ত্তমান ছিল, অন্তত ইহার সম্বন্ধে জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল। রঘুনন্দন প্রণীত স্মৃতিতত্ত্বের একখানি পুঁথিতে বল্লালসেন দেবাহৃত দ্বিখণ্ডাক্ষর লিখিত ‘শ্রীহয়শীর্ষপঞ্চরাত্রেয়’ পুস্তকের উল্লেখ আছে।
প্রধানত যাগযজ্ঞ, শাস্ত্রচর্চ্চা ও সমাজসংস্কার প্রভৃতি কার্যে নিযুক্ত থাকিলেও বল্লালসেন যুদ্ধবিগ্রহ হইতে একেবারে নিরস্ত্র থাকিতে পারেন নাই। অদ্ভুতসাগরে তাঁহাকে “গৌড়েন্দ্র-কুঞ্জরালান-স্তম্ভবাহুর্মহীপতিঃ” বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে গৌড়রাজের সহিত তিনি যুদ্ধ করিয়াছিলেন। এই গৌড়রাজ সম্ভবত গোবিন্দপাল, কারণ তিনি গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করিতেন। পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে গোবিন্দপাল মগধে রাজত্ব করিতেন এবং ১১৬২ অব্দে তাঁহার রাজ্য বিনষ্ট হয়। সুতরাং খুব সম্ভব বল্লালসেনের হস্তেই তিনি পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হন। বল্লালচরিতে বল্লালসেনের মগধ-জয়ের উল্লেখ আছে। এই গ্রন্থে আরও উক্ত হইয়াছে যে পিতার জীবদ্দশায় তিনি মিথিলা জয় করেন। মিথিলা যে সেনরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এরূপ অনুমান করিবার সঙ্গত কারণ আছে। প্রথমত নান্যদেবের মৃত্যুর অব্যবহিত পরবর্ত্তী যুগে মিথিলার কোনো বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ ঐ দেশীয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হয় নাই। দ্বিতীয়ত প্রচলিত ও সুপ্রসিদ্ধ জনপ্রবাদ অনুসারে বল্লালসেন স্বীয় রাজ্য রাঢ়, বরেন্দ্র, বাগড়ী, বঙ্গ ও মিথিলা এই পাঁচভাগে বিভক্ত করেন। তৃতীয় বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেনের নামযুক্ত সংবৎ মিথিলায় অদ্যাবধি প্রচলিত আছে। মিথিলার বাহিরে অন্য কোনো স্থানে এই অব্দ জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ছিল এরূপ প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। মিথিলা সেনরাজ্যভুক্ত না হইলে তথায় এই অব্দ প্রচলনের কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ পাওয়া যায় না। সুতরাং বল্লালসেন মিথিলা জয় করিয়াছিলেন এই প্রবাদ সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে।
বল্লালসেন যে পিতৃরাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখিয়াছিলেন তাহা নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যাইতে পারে। সম্ভবত মিথিলা ও মগধের কতকাংশ তাঁহার রাজ্যভুক্ত ছিল। তিনি চালুক্যরাজের (সম্ভবত দ্বিতীয় জগদেবমল্ল) দুহিতা রামদেবীকে বিবাহ করেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে সেনরাজগণের সম্মান ও প্রতিপত্তি বাংলার বাহিরে বিস্তৃত হইয়াছিল এবং পিতৃভূমি কর্ণাটের সহিতও তাঁহাদের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন হয় নাই। পিতার অনুকরণে বল্লালসেন সম্রাটসূচক অন্যান্য পদবীর সহিত ‘অরিরাজ নিঃশঙ্কশঙ্কর’ এই নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। বল্লালসেন যে কেবল রাজগণের নহে বিদ্বানমণ্ডলীরও চক্রবর্ত্তী ছিলেন প্রশস্তিকারের এই উক্তি অনেকাংশে সত্য।
শস্ত্রচালনা ও শাস্ত্রচর্চ্চায় জীবন অতিবাহিত করিয়া রাজর্ষিতুল্য বল্লালসেন বৃদ্ধ বয়সে পুত্র লক্ষ্মণসেনের হস্তে রাজ্যভার অর্পণ এবং তাঁহাকে সাম্রাজ্যরক্ষারূপ মহাদীক্ষায় দীক্ষিত করিয়া সস্ত্রীক ত্রিবেণীর নিকট গঙ্গাতীরে বানপ্রস্থ অবলম্বনপূৰ্ব্বক শেষ জীবন অতিবাহিত করেন। অদ্ভুতসাগরের একটি শ্লোক হইতে আমরা এই বিবরণ পাই। এই শ্লোকের এরূপ অর্থও করা যাইতে পারে যে বৃদ্ধ রাজা ও রাণী স্বেচ্ছায় গঙ্গাগর্ভে দেহত্যাগ করিয়াছিলেন।
.
৪. লক্ষ্মণসেন
১১৭৯ অব্দে লক্ষ্মণসেন পিতৃসিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার রাজ্যকালের আটখানি তাম্রশাসন, তাঁহার সভাকবিগণ রচিত কয়েকটি স্তুতিবাচক শ্লোক, তাঁহার পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসন ও মুসলমান ঐতিহাসিক মীনহাজুদ্দিন বিরচিত তবকাং-ই নাসিরী নামক গ্রন্থ হইতে তাঁহার রাজ্যের অনেক বিবরণ পাওয়া যায়। বাল্যকালেই তিনি পিতা ও পিতামহের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া রণকুশলতার পরিচয় দিয়াছিলেন। তাঁহার দুইখানি তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তিনি কৌমারে উদ্ধত গৌড়েশ্বরের শ্রীহরণ ও যৌবনে কলিঙ্গ দেশে অভিযান করিয়াছিলেন; তিনি যুদ্ধে কাশিরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন এবং ভীরু প্ৰাগজ্যোতিষের (কামরূপ আসাম) রাজা তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন। আমরা পূর্ব্বে দেখিয়াছি যে বিজয়সেন ও বল্লালসেন উভয়েই গৌড়েশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। সুতরাং খুব সম্ভবত কুমার লক্ষ্মণসেন পিতা অথবা পিতামহের রাজত্বকালে গৌড়ে যে অভিযান করিয়াছিলেন প্রশস্তিকার এস্থলে তাঁহারই উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু প্রশস্তিকার অন্যত্র লিখিয়াছেন যে লক্ষ্মণসেন নিজভুজবলে সমর-সমুদ্র মন্থন করিয়া গৌড়লক্ষ্মী লাভ করিয়াছিলেন। বিজয়সেন গৌড়রাজাকে দূরীভূত করিলেও তাঁহার রাজ্যকালে গৌড়বিজয় সম্ভবত সম্পূর্ণ হয় নাই। কারণ গোবিন্দপাল গৌড়েশ্বর উপাধি ধারণ করিতেন এবং বল্লালসেনকে গৌড়ে অভিযান করিতে হইয়াছিল। লক্ষ্মণসেনই সম্ভবত সম্পূর্ণরূপে গৌড়দেশ জয় করেন। কারণ রাজধানী গৌড়ের লক্ষ্মণাবতী এই নাম সম্ভবত লক্ষ্মণসেনের নাম অনুসারেই হইয়াছিল এবং সৰ্ব্বপ্রথম তাঁহার তাম্রশাসনেই সেনরাজগণের নামের পূর্ব্বে গৌড়েশ্বর এই উপাধি ব্যবহৃত হইয়াছিল।
লক্ষ্মণসেনের কলিঙ্গ ও কামরূপ জয়ও সম্ভবত তাঁহার পিতামহের রাজ্যকালেই সংঘটিত হইয়াছিল। কারণ বিজয়সেনের রাজ্যকালেই এই দুই দেশ বিজিত হইয়াছিল। তবে ইহাও অসম্ভব নহে যে গৌড়ের ন্যায় এই দুই রাজ্যও লক্ষ্মণসেনই সম্পূর্ণরূপে জয় করেন এবং এইজন্য তাঁহাকে পুনরায় যুদ্ধ করিতে হইয়াছিল। কারণ তাঁহার পুত্রদ্বয়ের তাম্রশাসনে উক্ত হইয়াছে যে তিনি সমুদ্রতীরে পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে, কাশীতে ও প্রয়াগে যজ্ঞকূপের সহিত ‘সমরজয়স্তম্ভ’ স্থাপিত করিয়াছিলেন। এই সময়ে গঙ্গাবংশীয় রাজগণ কলিঙ্গ ও উৎকল উভয় দেশেই রাজত্ব করিতেন। সম্ভবত লক্ষ্মণসেন কোনো গঙ্গরাজাকে পরাজিত করিয়াই পুরীতে জয়স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন।
কাশী ও প্রয়াগে জয়স্তম্ভ স্থাপন পশ্চিম দিকে গাহড়বাল রাজার বিরুদ্ধে তাঁহার বিজয়াভিযান সূচিত করিতেছে। পালবংশের পতনের পূর্ব্বেই যে গাহড়বাল রাজগণ মগধে আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন তাহা পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে। বিজয়সেন নৌবাহিনী পাঠাইয়াও তাহাদের বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো জয়লাভ করিতে পারেন নাই। বল্লালসেন কিছু সফলতা লাভ করিয়াছিলেন, কিন্তু গোবিন্দপালের রাজ্য নষ্ট করায় গাহড়বালগণ মগধে আরও অধিকার বিস্তারের সুযোগ পাইলেন। গাহড়বালরাজ বিজয়চন্দ্র ও জয়চন্দ্রের লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ১১৬৯ হইতে ১১৯০ অব্দের মধ্যে মগধের পশ্চিম ও মধ্যভাগ গাহড়বাল রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। গাহড়বাল রাজ্যের পূর্ব্বদিকে এইরূপ দ্রুত বিস্তার সেনরাজ্যের পক্ষে বিশেষ আশঙ্কাজনক হওয়ায় লক্ষ্মণসেনের সহিত গাহড়বাল রাজ্যের যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হইয়া উঠিয়াছিল। বিস্তৃত বিবরণ জানা না থাকিলেও লক্ষ্মণসেন যে এই যুদ্ধে বিশেষ সফলতা লাভ করিয়াছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। মগধের মধ্যভাগে গয়া জিলায় যে লক্ষ্মণসেন রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন বৌদ্ধগয়ায় প্রাপ্ত দুইখানি লিপিতে তাঁহার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। গাহড়বালরাজ জয়চন্দ্রের লিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে, ১১৮২ হইতে ১১৯২ অব্দের মধ্যে তিনি গয়ায় রাজত্ব করিতেন। তাঁহাকে পরাজিত না করিয়া লক্ষ্মণসেন কখনো গয়া অধিকার করিতে পারেন নাই। লক্ষ্মণসেন কর্ত্তৃক জয়চন্দ্রের পরাজয়ের এরূপ স্পষ্ট প্রমাণ বিদ্যমান থাকায় লক্ষ্মণসেন যে কাশী ও প্রয়াগে জয়স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন তাম্রশাসনের এই বিশিষ্ট উক্তি নিছক কল্পনা মনে করিয়া অগ্রাহ্য করিবার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই।
এইরূপে দেখা যায় যে, উত্তরে গৌড়, পূৰ্ব্বে কামরূপ ও দক্ষিণে কলিঙ্গরাজকে পরাভূত করিয়া লক্ষ্মণসেন পৈত্রিক রাজ্য অক্ষুণ্ণ এবং সুদৃঢ় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। পশ্চিমে তিনি স্বীয় পিতা ও পিতামহ অপেক্ষা অধিকতর সফলতা অর্জন করিয়াছিলেন এবং অন্তত মগধে রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যু ও সেনরাজ্য ধ্বংসের বহুকাল পরেও মগধে তাঁহার রাজ্য শেষ হইতে সংবৎসর গণনা করা হইত। মগধে লক্ষ্মণসেনের ক্ষমতা যে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল ইহাই তাঁহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
লক্ষ্মণসেনের দুই সভাকবি উমাপতিধর ও শরণ রচিত কয়েকটি শ্লোকে এক রাজার বিজয়কাহিনীর উল্লেখ আছে। শ্লোকগুলিতে রাজার নাম নাই কিন্তু তিনি যে প্ৰাগজ্যোতিষ (কামরূপ), গৌড়, কলিঙ্গ, কাশী, মগধ প্রভৃতি জয় করিয়াছিলেন এবং চেদি ম্লেচ্ছরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন তাঁহার উল্লেখ আছে। এই সমুদয় শ্লোক যে লক্ষ্মণসেনকে উদ্দেশ্য করিয়াই তাঁহার সভাকবিরা রচনা করিয়াছিলেন এরূপ সিদ্ধান্ত অনায়াসেই করা যাইতে পারে। কারণ চেদি ও ম্লেচ্ছরাজের পরাজয় ব্যতীত অন্যান্য বিজয়কাহিনী যে লক্ষ্মণসেনের সম্বন্ধে প্রযোজ্য পূর্ব্বেই তাহা উল্লিখিত হইয়াছে। সুতরাং লক্ষ্মণসেন যে চেদি (কলচুরি) ও কোনো ম্লেচ্ছরাজকে পরাজিত করিয়াছিলেন এরূপ অনুমান অসঙ্গত নহে। রতনপুরের কলচুরিরাজগণের সামন্ত বল্লভরাজ গৌড়রাজকে পরাভূত করিয়াছিলেন, মধ্যপ্রদেশের একখানি শিলালিপিতে এরূপ উল্লেখ আছে। সুতরাং লক্ষ্মণসেনের সহিত চেদিরাজের সংঘর্ষ সম্ভবত ঐতিহাসিক ঘটনা। এই যুদ্ধে দুই পক্ষই জয়ের দাবি করিয়াছেন-সুতরাং ইহার ফলাফল অনিশ্চিত বলিয়াই গ্রহণ করিতে হইবে।
উল্লিখিত আলোচনা হইতে দেখা যায় যে, লক্ষ্মণসেন বাল্যকাল হইতে আরম্ভ করিয়া প্রায় সারা জীবনই যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। ধর্ম্মপাল ও দেবপালের পরে বাংলার আর কোনো রাজা তাঁহার ন্যায় বাংলার সীমান্তের বাহিরে যুদ্ধে এরূপ সফলতা লাভ করিতে পারেন নাই। কিন্তু যুদ্ধ ব্যবসায়ী হইলেও রাজা লক্ষ্মণসেন শাস্ত্র ও ধর্ম্মচর্চ্চায় পিতার উপযুক্ত পুত্র ছিলেন। বল্লালসেন তাঁহার অদ্ভুতসাগর গ্রন্থ সমাপ্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই। পিতার নির্দেশক্রমে লক্ষ্মণসেন এই গ্রন্থ সমাপ্ত করেন। লক্ষ্মণসেন নিজে সুকবি ছিলেন এবং তাঁহার রচিত কয়েকটি শ্লোক পাওয়া গিয়াছে। ঘোয়ী, শরণ, জয়দেব, গোবর্দ্ধন এবং উমাপতিধর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ কবিগণ তাঁহার রাজসভা অলঙ্কৃত করিতেন। তাঁহার প্রধানমন্ত্রী ও ধর্ম্মাধ্যক্ষ হলায়ূধ ভারত প্রসিদ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। জয়দেব এখনো একজন শ্রেষ্ঠ সংস্কৃত কবি বলিয়া জগদ্বিখ্যাত। তাঁহার মধুর বৈষ্ণব পদাবলী এখনো ভারতের ঘরে ঘরে গীত হইয়া থাকে।
লক্ষ্মণসেন নিজেও বৈষ্ণবধর্ম্মের অনুরাগী ছিলেন। বিজয় সেন ও বল্লালসেন পরম-মাহেশ্বর উপাধি ধারণ করিতেন। তাঁহাদের তাম্রশাসনে প্রথমেই শিবের প্রণাম ও স্তুতিবাচক শ্লোক এবং মুদ্রায় কুলদেবতা সদাশিবের মূর্ত্তি অঙ্কিত থাকিত। লক্ষ্মণসেন সদাশিব মুদ্রার পরিবর্ত্তন করেন নাই কিন্তু তিনি পরম-মাহেশ্বরের পরিবর্তে পরমবৈষ্ণব উপাধি গ্রহণ করেন এবং তাঁহার তাম্রশাসনগুলি নারায়ণের প্রণাম ও স্তুতিবাচক শ্লোক দিয়া আরম্ভ করা হইয়াছে। সুতরাং লক্ষ্মণসেন কৌলিক শৈবধর্ম্ম ত্যাগ করিয়া বৈষ্ণব ধর্ম্মে দীক্ষিত হইয়াছিলেন ইহাই সম্ভবপর বলিয়া মনে হয়।
লক্ষ্মণসেন যখন সিংহাসনে আরোহণ করেন তখন তাঁহার বয়স প্রায় ষাট বৎসর। প্রায় ২০ বৎসর রাজত্ব করিয়া এই অশীতিপর বৃদ্ধ রাজা পিতার ন্যায় গঙ্গাতীরে অবস্থান করিবার উদ্দেশ্যে নবদ্বীপে গমন করেন। তাঁহার এই শেষ বয়সে রাজ্যে আভ্যন্তরিক বিপ্লবের সূচনা দেখা যায়। ১১৯৬ অব্দের একখানি তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, ডোম্মনপাল নামক এক ব্যক্তি সুন্দরবনের খাড়ী পরগণায় বিদ্রোহী হইয়া এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল। এই সময় আর্য্যাবর্তেও বিষম বিপদ উপস্থিত হয়। তুরস্কজাতীয় ঘোর দেশের অধিপতি মহম্মদ ঘোরী চৌহান পৃথ্বীরাজ ও গাহড়বাল জয়চন্দ্রকে পরাজিত করিয়া ক্রমে ক্রমে প্রায় সমগ্র হিন্দুস্থানে নিজের রাজ্য বিস্তার করেন। আর্য্যাবর্তের প্রসিদ্ধ রাজপুত রাজ্যগুলি একে একে বিজেতা তুর্কীগণের পদানত হয়। ক্রমে তুর্কীগণ যুক্তপ্রদেশ অধিকার করিয়া মগধের সীমান্তে উপনীত হইল।
এই ঘোর দুর্দিনে লক্ষ্মণসেন স্বীয় রাজ্য রক্ষার কী উদ্যোগ করিয়াছিলেন তাহা জানিবার কোনো উপায় নাই। বাঙ্গালী অথবা ভারতীয় কোনো লেখক রচিত দেশের এই দুর্যোগময় যুগের কোনো বিবরণই পাওয়া যায় নাই। ইহার অর্দ্ধশতাব্দী পরে তুর্কী বিজেতার সভাসদ ঐতিহাসিক লোকমুখে সেনরাজ্য জয়ের যে কাহিনী শুনিয়াছিলেন তাহা অবলম্বন করিয়াই এই যুগের ইতিহাস রচিত হইয়াছে। আর সেই ইতিহাসেরও প্রকৃত মর্ম গ্রহণ না করিয়া তাঁহার বিকৃত ব্যাখ্যান দ্বারা কেহ কেহ প্রচার করিয়াছেন যে ১৭ জন তুরস্ক অশ্বারোহী বঙ্গদেশ জয় করিয়াছিল এবং এই অদ্ভুত উপাখ্যানে বিশ্বাস করিয়া অনেকেই লক্ষ্মণসেনকে কাপুরুষ বলিয়া হতশ্রদ্ধা করিয়া আসিতেছে। এইজন্যই এই বিষয়টির একটু বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন।
.
৫. তুরস্ক সেনা কর্ত্তৃক গৌড় জয়
তবকাৎ-ই-নাসিরী নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থে তুরস্কগণ কর্ত্তৃক মগধ ও গৌড় জয়ের সৰ্ব্বপ্রাচীন বিবরণ পাওয়া যায়। গ্রন্থকার মীনহাজুদ্দিন দিল্লীর সুলতানের অধীনে উচ্চ রাজকার্যে নিযুক্ত ছিলেন এবং নানা স্থানে ঘুরিয়া সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আ ১২৬০ অব্দের কিছু পরে এই ইতিহাস রচনা করেন। গৌড় ও মগধ জয়ের সম্বন্ধে কোনো সরকারী বিবরণ বা দলিল তাঁহার হস্তগত হয় নাই। মগধ জয়ের ৪০ বৎসর পরে লক্ষ্মণাবতী নগরীতে দুইজন বৃদ্ধ সৈনিকের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। ইহারা এই যুদ্ধে যোগদান করিয়াছিল এবং ইহাদের নিকট শুনিয়াই মীনহাজ মগধ জয়ের বিবরণ লিখিয়াছেন। গৌড়ের অভিযানে লিপ্ত ছিল এরূপ কোনো ব্যক্তির সহিত সম্ভবত তাঁহার দেখা হয় নাই। কারণ তিনি কেবলমাত্র বলিয়াছেন যে বিশ্বাসী লোকদের নিকট হইতে তিনি গৌড় বিজয়ের কাহিনী শুনিয়াছেন।
এইরূপে অর্দ্ধশতাব্দী পরে কেবলমাত্র লোকমুখে শুনিয়া মীনহাজ মগধ ও গৌড় জয়ের যে ঐতিহাসিক বিবরণ লিখিয়াছেন তাঁহার সারমর্ম নিম্নে দেওয়া হইল :
“মুহম্মদ বখতিয়ার নামক খিলজীবংশীয় একজন তুরস্ক সেনানায়ক উপযুক্ত কৰ্ম্মানুসন্ধানে মহম্মদ ঘোরী ও কুতবুদ্দিনের নিকট গিয়া বিফলমনোরথ হইয়া অবশেষে অযোধ্যায় মালিক হুসামুদ্দিনের অনুগ্রহে চুনারগড়ের নিকট দুইটি পরগণা জায়গীরপ্রাপ্ত হন। এখান হইতে বখতিয়ার দুই বত্সর যাবৎ মগধের নানা স্থান লুণ্ঠন করেন এবং লুণ্ঠিত অর্থের দ্বারা সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করিয়া অবশেষে দুইশত অশ্বারোহী সৈন্যসহ হঠাৎ আক্রমণ করিয়া ‘কিল্লা বিহার’ অধিকার করেন। ইহার মুণ্ডিত-মস্তক অধিবাসীদিগকে নিহত ও বিস্তর দ্রব্য লুণ্ঠন করার পরে আক্রমণকারীগণ জানিতে পারিলেন যে, ইহা বস্তুত ‘কিল্লা’ বা দুর্গ নহে, একটি বিদ্যালয় মাত্র, এবং হিন্দুর ভাষায় ইহাকে ‘বিহার’ বলে।
“কিল্লা বিহারের লুণ্ঠিত ধনরত্নসহ বখতিয়ার স্বয়ং দিল্লীতে গিয়া কুতবুদ্দিনের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং বহু সম্মান প্রাপ্ত হন। দিল্লী হইতে ফিরিয়া আসিয়া তিনি বিহার প্রদেশ জয় করিয়াছিলেন।
“এই সময়ে রায় লখমনিয়া রাজধানী ‘নদিয়া’তে অবস্থান করিতেছিলেন। তাঁহার পিতার মৃত্যুসময়ে তিনি মাতৃগর্ভে ছিলেন। তাঁহার জন্মকালে দৈবজ্ঞগণ গণনা করিয়া বলিল যে যদি এই শিশুর এখনই জন্ম হয় তবে সে কখনোই রাজা হইবে না, কিন্তু আর দুই ঘণ্টা পরে জন্মিলে সে ৮০ বৎসর রাজত্ব করিবে। এই কথা শুনিয়া রাজমাতার আদেশে তাঁহার দুই পা বাঁধিয়া মাথা নিচের দিকে করিয়া তাঁহাকে ঝুলাইয়া রাখা হইল। শুভ মুহূর্ত উপস্থিত হইলে তাঁহাকে নামানো হয়, কিন্তু পুত্র প্রসবের পরেই তাঁহার মৃত্যু হইল। রায় লখমনিয়া ৮০ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং হিন্দুস্থানের একজন প্রসিদ্ধ রাজা ছিলেন।
“বখতিয়ার কর্ত্তৃক বিহার জয়ের পরে তাঁহার বীরত্বের খ্যাতি নদীয়ায় পৌঁছিল। দৈবজ্ঞ, পণ্ডিত ও ব্রাহ্মণগণ রাজাকে বলিলেন, ‘শাস্ত্রে লেখা আছে তুরস্কেরা এ দেশ জয় করিবে, এবং তাঁহার কাল উপস্থিত, সুতরাং অবিলম্বে পলায়ন করাই সঙ্গত।’ রাজার প্রশ্নোত্তরে তাঁহারা জানাইলেন যে তুরস্ক বিজয়ীর চেহারা কিরূপ তাহাও শাস্ত্রে লেখা আছে। গুপ্তচর পাঠাইয়া বখতিয়ারের আকৃতির বিবরণ আনানো হইলে দেখা গেল যে শাস্ত্রের বর্ণনার সহিত ইহার সম্পূর্ণ ঐক্য আছে। তখন বহু ব্রাহ্মণ ও বণিকগণ নদীয়া হইতে পলায়ন করিল, কিন্তু রাজা লখমনিয়া রাজধানী ত্যাগ করিতে স্বীকৃত হইলেন না।
“ইহার এক বৎসর পরে বখতিয়ার একদল সৈন্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করিয়া বিহার হইতে যাত্রা করিলেন। তিনি এরূপ দ্রুতগতিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন যে যখন অতর্কিতভাবে তিনি সহসা নদীয়া পৌঁছিলেন, তখন মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী তাঁহার সঙ্গে আসিতে পারিয়াছিল, বাকী সৈন্য পশ্চাতে আসিতেছিল। নগরদ্বারে উপস্থিত হইয়া বখতিয়ার কাহাকেও কিছু না বলিয়া এমন ধীরেসুস্থে সঙ্গীগণসহ শহরে প্রবেশ করিলেন যে লোকেরা মনে করিল যে, সম্ভবত ইহারা একদল সওদাগর, অশ্ব বিক্রয় করিতে আসিয়াছে। বখতিয়ার যখন রাজপ্রাসাদের দ্বারে উপনীত হইলেন তখন বৃদ্ধ রাজা লখমনিয়া মধ্যাহ্নভোজন করিতেছিলেন। সহসা প্রাসাদদ্বারে এবং নগরীর অভ্যন্তর হইতে তুমুল কলরব শোনা গেল। লখমনিয়া এই কলরবের প্রকৃত কারণ জানিবার পূর্ব্বেই বখতিয়ার সদলে রাজপুরীতে প্রবেশ করিয়া রাজার অনুচরগণকে হত্যা করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন রাজা নগ্নপদে প্রাসাদের পশ্চাৎ দ্বার দিয়া বাহির হইয়া নৌকাযোগে পলায়ন করিলেন। বখতিয়ারের সমুদয় সেনা নদীয়ায় উপস্থিত হইয়া ঐ নগরী ও তাঁহার চতুস্পার্শ্ববর্ত্তী স্থানসমূহ অধিকার করিল এবং বখতিয়ারও সেখানেই বসতি স্থাপন করিলেন। ওদিকে রায় লখমনিয়া সঙ্কনাৎ ও বঙ্গের অভিমুখে প্রস্থান করিলেন। তথায় অল্পদিন পরেই তাঁহার রাজ্য শেষ হইল, কিন্তু তাঁহার বংশধরগণ এখনো বঙ্গদেশে রাজত্ব করিতেছেন।
“রায় লখমনিয়ার রাজ্য অধিকার করার পরে বখতিয়ার ধ্বংসপ্রায় নদীয়া ত্যাগ করিয়া বর্ত্তমানে যে স্থান লক্ষ্মণাবতী নামে পরিচিত সেই স্থানে রাজধানী স্থাপন করিলেন।”
বখতিয়ার খিলজী কর্ত্তৃক বাংলা দেশ জয় সম্বন্ধে যত কাহিনী ও মতবাদ প্রচলিত আছে তাহা উল্লিখিত বিবরণের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ এ সম্বন্ধে অন্য কোনো সমসাময়িক ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় নাই। মীনহাজুদ্দিনের বিবরণ সম্পূর্ণ ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করিলেও প্রচলিত বিশ্বাস অনেক পরিমাণে ভ্রান্ত বলিয়াই প্রতিপন্ন হইবে। প্রথমত “সপ্তদশ অশ্বারোহী যবনের ডরে” কাপুরুষ লক্ষ্মণসেন “সোনার বাংলা রাজ্য” বিসর্জন দিয়াছিলেন, কবিবর নবীনচন্দ্রের এই উক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বখতিয়ার যখন নগরদ্বারে উপনীত হইয়াছিলেন তখন তাঁহার সহিত মাত্র ১৮ জন অশ্বারোহী সৈন্য ছিল, কিন্তু বাকী সৈন্য নিকটেই পশ্চাতে ছিল। কারণ যে সময় বখতিয়ার রাজবাড়ী পৌঁছিয়াছিলেন সেই সময়ই এই সৈন্য বা অন্তত তাঁহার এক বড় অংশ শহরে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। তাঁহার ফলে নগরমধ্যে যে আর্তনাদ উঠিয়াছিল বখতিয়ার রাজপ্রাসাদে প্রবেশের পূর্ব্বেই রাজার কর্ণে তাহা প্রবেশ করিয়াছিল। সুতরাং লক্ষ্মণসেন যখন পলায়ন করিয়াছিলেন তখন বখতিয়ারের বহু সৈন্য নগরমধ্যে ছিল। তারপর যখন সকল সৈন্য পৌঁছিল তখনই নদীয়া অধিকৃত হইল। বখতিয়ারের এই দিনকার অভিযানে কেবল এই নগরটিই অধিকৃত হইয়াছিল-সমস্ত বঙ্গদেশ তো দূরের কথা গৌড়ের অপর কোনো অংশই বিজিত হয় নাই।
যখন তুরস্ক আক্রমণের আশঙ্কায় নদীয়ার অধিবাসীরা বৎসরাবধি অন্যত্র পলাইতে ব্যস্ত ছিল তখন এই অশীতিপর বৃদ্ধ রাজা মন্ত্রী, দৈবজ্ঞ ও সভাসদ পণ্ডিতগণের পরামর্শ অগ্রাহ্য করিয়া রাজধানীতেই অবস্থান করিতেছিলেন। সুতরাং প্রজাবৰ্গ অপেক্ষা রাজার শৌর্য্য ও সাহস অনেক বেশী পরিমাণেই ছিল। যখন নগররক্ষীগণের মূর্খতায় বা অন্য কোনো কারণে বিনা বাধায় তুরস্ক সৈন্যগণ রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করিল, তখন অতর্কিত সহসা আক্রান্ত হইয়া বৃদ্ধ রাজার পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করা ভিন্ন আর কোনো উপায় ছিল না। সুতরাং ইহাকে কোনোমতেই কাপুরুষতার দৃষ্টান্ত বলা যায় না।
মীনহাজুদ্দিনের বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া যাহারা লক্ষ্মণসেনের চরিত্রে দোষারোপ করেন তাঁহারা ভুলিয়া যান যে মীনহাজুদ্দিন স্বয়ং তাঁহার বহু সুখ্যাতি করিয়াছেন। তিনি লক্ষ্মণসেনকে হিন্দুস্থানের “রায়গণের পুরুষানুক্রমিক খলিফাস্থানীয়” বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। সুতরাং মীনহাজুদ্দিনের মতে লক্ষ্মণসেন আর্য্যাবর্তের রাজগণের মধ্যে সৰ্ব্বপ্রধান ছিলেন। তিনি পৃথ্বীরাজ ও জয়চাঁদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই বলেন নাই, কিন্তু লক্ষ্মণসেনের জন্মকাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করিয়া তাঁহার দানশীলতার সুখ্যাতি ও শাসনরীতির প্রশংসা করিয়াছেন। এমনকি সাধারণত মুসলমান লেখকেরা অমুসলমান সম্বন্ধে যে প্রকার উক্তি করেন না, তিনি লক্ষ্মণসেন সম্বন্ধে তাহাও করিয়াছেন। তিনি তাঁহাকে “সুলতান করিম কুতবুদ্দীন হাতেমুজ্জামান” বা সেই যুগের হাতেম কুতবুদ্দীনের সঙ্গে তুলনা করিয়াছেন এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা জানাইয়াছেন যেন তিনি “পরলোকে লক্ষ্মণসেনের শাস্তির (যাহা অমুসলমান মাত্রেরই প্রাপ্য) লাঘব করেন।”
সুতরাং মীনহাজুদ্দিনের উক্তি সম্পূর্ণ সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলেও লক্ষ্মণসেনের চরিত্র ও খ্যাতি সম্বন্ধে উচ্চ ধারণাই পোষণ করিতে হয়। বখতিয়ার কর্ত্তৃক নদীয়া অধিকারের জন্য যে বৃদ্ধ রাজা অপেক্ষা তাঁহার মন্ত্রী, সৈন্যাধ্যক্ষগণ ও প্রজাবৰ্গই অধিকতর দায়ী যে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ থাকিতে পারে না। যিনি আকৌমার যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্যবীর্যের পরিচয় দিয়াছিলেন, গৌড়, কামরূপ, কলিঙ্গ, বারাণসী ও প্রয়াগে যাঁহার বীরত্ব খ্যাতি বিস্তৃত হইয়াছিল, মীনহাজুদ্দিনের লেখনী তাঁহার পূত চরিত্রে কলঙ্ক কালিমা লেপন করে নাই।
কিন্তু মীনহাজুদ্দিনের নদীয়া অভিযান কাহিনী সম্পূর্ণরূপে সত্য বলিয়া গ্রহণ করা কঠিন। যে বিশ্বাসী লোকেরা তাঁহাকে সংবাদ যোগাইয়াছিল, তাহাদের জ্ঞান ও বুদ্ধি কত দূর ছিল, তাহা লক্ষ্মণসেনের অদ্ভুত জন্মবিবরণ ও তাঁহার ৮০ বৎসর রাজত্বের কথা হইতেই বুঝা যায়। বিশেষত এই কাহিনীর মধ্যে অনেক সুপরিচিত প্রবাদ, কথা ও অবিশ্বাস্য ঘটনার সমাবেশ আছে। ‘তুরস্ক আক্রমণ সম্বন্ধে হিন্দুর শাস্ত্রবাণী’ চচ্নামা নামক গ্রন্থে সিন্ধুদেশ সম্বন্ধেও উল্লিখিত হইয়াছে। এই শাস্ত্রবাণীর মূল্য যাহাই হউক, ইহাতে প্রমাণিত হয় যে নদীয়া আক্রমণের অন্তত এক বৎসর পূর্ব্বে ইহার সম্ভাবনা রাজকর্ম্মচারীরা জ্ঞাত ছিলেন। অথচ বখতিয়ার বিহার হইতে নদীয়া পৌঁছিলেন, ইহার মধ্যে তাঁহার অভিযানের কোনো সংবাদ সেন রাজদরবারে পৌঁছিল না। যে সময় তুরস্ক সেনা কর্ত্তৃক দেশ আক্রান্ত হইবার পূর্ণ সম্ভাবনা বিদ্যমান, সেই সময়ে রাজধানীর দ্বাররক্ষাকারীরা ১৮ জন অশ্বারোহী তুর্কীকে বিনা বাধায় নগরে প্রবেশ করিতে দিল এবং অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বর্ম্মাবৃত সৈন্যকে অশ্বব্যবসায়ী বলিয়া ভুল করিল; নগররক্ষীরাও কোনো সন্দেহ করিল না এবং বখতিয়ার বিনা বাধায় রাজপ্রাসাদের তোরণ পৰ্য্যন্ত পৌঁছিলেন; যখন বখতিয়ারের অবশিষ্ট সৈন্যদল নগরে প্রবেশ করিল তখনো এই অগ্রগামী ১৮ জন অশ্বারোহীকে সন্দেহ করিয়া কেহ তাহাদের গতি প্রতিরোধ করিতে অগ্রসর হইল না! রাজার দেহরক্ষী বা সৈন্যদল অবশ্যই ছিল; এবং যখন রাজা স্বয়ং নদীয়াতে ছিলেন তখন অন্তত একদল রাজসৈন্য তাঁহার রক্ষাকার্যে নিযুক্ত ছিল; অথচ বখতিয়ারের সৈন্যদলের কাহারও গায়ে একটি আঁচড় লাগিল না, তাহারা স্বচ্ছন্দে বিনা বাধায় হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠনকার্য চালাইতে লাগিল। এ সমুদয় এতই অস্বাভাবিক যে খুব দৃঢ় বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ ব্যতীত সত্য বলিয়া স্বীকার করা অসম্ভব।
অথচ যে প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া মীনহাজুদ্দিন এই অদ্ভুত কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহা খুবই অকিঞ্চিৎকর। একজন অতিবৃদ্ধ সৈনিক তাঁহাকে বিহার অভিযানের কাহিনী শুনাইয়াছিল। নদীয়া অভিযানের সম্বন্ধে কোনো লিখিত দলিল বা বিবরণ তিনি পান নাই। যে এই কাহিনী বলিয়াছিল তাঁহার এই অভিযানের সম্বন্ধে কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকিলে মীনহাজুদ্দিন তাহা উল্লেখ করিতেন। সুতরাং লক্ষ্মণাবতীর বাজারে প্রচলিত নানাবিধ জনপ্রবাদের উপরই এই কাহিনী প্রতিষ্ঠিত এই অনুমান অসঙ্গত নহে। যে সময়ে মীনহাজুদ্দিন এই কাহিনী শুনিয়াছিলেন তখন অর্দ্ধশতাব্দী যাবৎ তুর্কীদের রাজ্য আৰ্যাবর্তে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে এবং একে একে প্রাচীন হিন্দুরাজ্য তাহাদের পদানত হইয়াছে। বিজয়গৰ্ব্বে দৃপ্ত, প্রভুত্বের উন্মাদনায় মত্ত, বিজিত পরাধীন জাতির প্রতি হতশ্রদ্ধ সাধারণ তুরস্ক সৈনিক অথবা রাজপুরুষ যে নিজেদের অতীত জয়ের ইতিহাস অতিশয়োক্তি ও অলৌকিক কাহিনী দ্বারা রঞ্জিত করিবে ইহা খুব স্বাভাবিক। নদীয়া জয়ের সম্বন্ধে মীনহাজুদ্দিনের বিবরণ ছাড়া আরও অনেক অদ্ভুত কাহিনী প্রচলিত ছিল। মীনহাজুদ্দিনের গ্রন্থরচনার অনধিক এক শতাব্দী পরে (১৩৫০ অব্দে) ঐতিহাসিক ইসমী তাঁহার ফুতু-উস-সলাটিন গ্রন্থে লিখিয়াছেন: “মুহম্মদ বখতিয়ার বণিকের ন্যায় সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইতেন। রাজা লখমনিয়া শুনিলেন যে একজন সওদাগর বহু মূল্যবান দ্রব্যজাত ও তাতার দেশীয় অশ্ব বিক্রয় করিতে তাঁহার রাজধানীতে আসিয়াছে। লক্ষ্মণসেন রাজপ্রাসাদ হইতে বাহির হইয়া দ্রব্যগুলি ক্রয় করিবার জন্য সওদাগরের নিকট গেলেন। বখতিয়ার রাজাকে দ্রব্য দেখাইতেছেন এমন সময় পূৰ্ব্বব্যবস্থামতো তাঁহার ইঙ্গিতে তাঁহার অনুচরগণ সহসা চতুর্দিক হইতে হিন্দুদিগকে আক্রমণ করিল। অতর্কিত আক্রমণে হিন্দুরা ছত্রভঙ্গ হইয়া পড়িল কিন্তু রাজার দেহরক্ষীগণ বহুক্ষণ পর্য্যন্ত যুদ্ধ করিল। খিলজী বীরগণ অল্পসংখ্যক রক্ষীগণকে হত্যা করিয়া রাজাকে বন্দী করিয়া বখতিয়ারের নিকট লইয়া গেলেন। বখতিয়ার ঐ রাজ্যের রাজা হইলেন।”
এই কাহিনীর সমালোচনা নিষ্প্রয়োজন। মীনহাজুদ্দিনের কাহিনী যে সে যুগেও সকলে ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া গ্রহণ করে নাই ইহা তাঁহার একটি প্রমাণ। কারণ তাহা হইলে অব্যবহিত পরবর্ত্তী অপর একজন ঐতিহাসিক তাঁহার উল্লেখমাত্র না করিয়া এইরূপ অদ্ভুত আখ্যানের অবতারণা করিতেন না। ইহা হইতে আরও প্রমাণিত হয় যে বখতিয়ার কর্ত্তৃক লক্ষ্মণসেনের পরাজয় সম্বন্ধে কোনো বিশ্বস্ত বিবরণ ঐতিহাসিকগণের জানা ছিল না, এবং এ সম্বন্ধে বিবিধ আজগুবি কাহিনীর সৃষ্টি হইয়াছিল। মীনহাজুদ্দিন ও ইসমী দুইটি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, এবং সম্ভবত এরূপ আরও অনেক গল্প প্রচলিত ছিল।
কেহ কেহ মীনহাজুদ্দিনের বিবরণ একেবারে অমূলক বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। কিন্তু তাহা সঙ্গত বোধ হয় না। মোটের ওপর মীনহাজুদ্দিনের উক্তি হইতে এই সিদ্ধান্ত করা যাইতে পারে যে বৃদ্ধ রাজা লক্ষ্মণসেন যখন নদীয়ায় বাস করিতেছিলেন তখন বখতিয়ার খিলজী তাঁহাকে বন্দী করিবার জন্য এক ক্ষুদ্র অশ্বারোহী সৈন্যদল লইয়া বিহার হইতে দ্রুতগতিতে অপ্রত্যাশিত পথে আসিয়া অতর্কিতে ঐ নগরী আক্রমণ করেন, এবং রাজাকে না পাইয়া ঐ নগরী লুণ্ঠন করিয়া প্রস্থান করিয়াছিলেন। নদীয়া তখন সেনদের প্রধান রাজধানী অথবা বিশেষভাবে সুরক্ষিত ছিল কি না তাহা নিশ্চিত জানিবার উপায় নাই।
বখতিয়ার যে নদীয়ায় বসতি করেন নাই, বরং ইহা ধ্বংস করিয়াছিলেন, মীনহাজুদ্দিন তাহা স্বীকার করিয়াছেন। তাঁহার নদীয়া আক্রমণ গৌড় জয়ের প্রথম অভিযান কি না তাহাও নিশ্চিত করিয়া বলা যায় না। মীনহাজুদ্দিন লিখিয়াছেন যে বিহার জয়ের পূর্ব্বে তিনি ঐ প্রদেশের নানা স্থানে লুটতরাজ করিয়া ফিরিতেন। “কিল্লা বিহারের” ন্যায় কেবলমাত্র লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যেই তিনি অতর্কিত নদীয়া আক্রমণ করিয়া থাকিবেন ইহাও অসম্ভব নহে।
১২৫৫ অব্দে মুঘিসুদ্দিন উজবেক নদীয়া জয়ের চিহ্নস্বরূপ যে মুদ্রা প্রচলিত করেন তাহা হইতে অনুমিত হয় যে ঐ তারিখের পূৰ্ব্বে নদীয়ায় তুর্কী শাসন স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। সুতরাং নদীয়া কিছুদিন বখতিয়ারের অধিকারে থাকিলেও ইহা যে আবার সেন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল এরূপ অনুমান করাই সঙ্গত।
নদীয়া জয়ের কত দিন পরে এবং কিভাবে বখতিয়ার লক্ষ্মণাবতী জয় করিয়া সেখানে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন মীনহাজুদ্দিনের গ্রন্থে তাঁহার কোনো উল্লেখ নাই। লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার বংশধরেরা নদীয়া জয়ের পর বহু বৎসর বঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন। তিনি এবং তাঁহার দুই পুত্র যে ম্লেচ্ছ ও যবনদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হইয়াছিলেন সমসাময়িক তাম্রশাসন ও কবিতায় তাঁহার স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যখন প্রায় সমগ্র আর্য্যাবর্ত্ত তুর্কীগণের পদানত, তখনো যাঁহারা বীরবিক্রমে বঙ্গের স্বাধীনতা রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, তাঁহাদের সৈন্যবল এত দুৰ্বল বা শাসনতন্ত্র এমন বিশৃঙ্খল ছিল না যে অতর্কিত আক্রমণে নদীয়া অধিকার করিতে পারিলেও বখতিয়ার বিনা বাধায় গৌড় জয় করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কিন্তু এই গৌড় জয়ের কোনো ঐতিহাসিক বিবরণই পাওয়া যায় নাই।
.
৬. সেন রাজ্যের পতন
আ ১২০২ অব্দে বখতিয়ার নদীয়া আক্রমণ করেন। ইহার পরও লক্ষ্মণসেন অন্তত তিন-চারি বৎসর রাজ্য করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সময়কার দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহাতে রাজকবি যেভাবে তাঁহার শৌর্যবীর্যের ও প্রাচীন রীতি অনুযায়ী রাজপদবী প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছেন তাহাতে বাংলা দেশের গুরুতর রাষ্ট্রীয় পরিবর্ত্তনের কোনো আভাসই পাওয়া যায় না। অপরদিকে উত্তরবঙ্গ অথবা তাঁহার এক অংশ ব্যতীত বখতিয়ার বাংলার আর কোনো প্রদেশে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিয়াছিলেন ইহার কোনো প্রমাণ নাই। বঙ্গজয় সম্পূর্ণ না করিয়াই বখতিয়ার সুদূর তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং এই অভিযানে সর্ব্বস্বান্ত হইয়া ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করেন। বখতিয়ারের এই বিফলতার সহিত সেনরাজগণের যুদ্ধোদ্যমের কোনো সম্বন্ধ আছে কি না তুর্কী ঐতিহাসিকগণ সে সম্বন্ধে একেবারে নীরব।
লক্ষ্মণসেন ও বখতিয়ার উভয়েই সম্ভবত ১২০৫ অব্দে বা তাঁহার দুই-এক বৎসরের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। লক্ষ্মণসেনের পর তাঁহার দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্ভবত বিশ্বরূপসেনই জ্যেষ্ঠ ছিলেন এবং প্রথমে রাজত্ব করেন, কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যায়। এই দুই রাজারই তাম্রশাসন পাওয়া গিয়াছে। ইহাতে বিশ্বরূপসেন “অরিরাজ বৃষভাঙ্কশঙ্কর গৌড়েশ্বর” ও কেশবসেন “অরিরাজ অসহ্য শঙ্কর গৌড়েশ্বর উপাধিতে ভূষিত হইয়াছেন। উভয়েই ‘সৌর’ অর্থাৎ সূর্যের উপাসক ছিলেন। এইরূপে দেখা যায় যে, সেনরাজগণ যথাক্রমে শৈব, বৈষ্ণব ও সৌর সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়াছিলেন।
এই দুই রাজার রাজ্যকালের কোনো বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু দক্ষিণ ও পূৰ্ব্ব বাংলা যে তাঁহাদের রাজ্যভুক্ত ছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। কারণ ইহাদের তাম্রশাসনে বিক্রমপুর ও দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্রতীরে ভূমিদানের উল্লেখ আছে। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন উভয়েই “যবনান্বয়-প্রলয়-কাল-রুদ্র” বলিয়া তাম্রশাসনে অভিহিত হইয়াছেন। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে উভয়েই উত্তরবঙ্গের মুসলমান তুর্কীরাজ্যের সহিত যুদ্ধে সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। ইহা কেবলমাত্র প্রশস্তিকারের স্তুতিবাক্য নহে। কারণ মীনহাজুদ্দিনের ইতিহাস হইতেও প্রমাণিত হয় যে তুর্কীগণ উত্তরবঙ্গের সমগ্র অথবা অধিকাংশ অধিকার করিলেও বহুদিন পৰ্য্যন্ত পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণবঙ্গ অধিকার করিতে পারেন নাই। তিনি লিখিয়াছেন যে গঙ্গার দুই তীরে, রাঢ় ও বরেন্দ্রেই, তুর্কীরাজা সীমাবদ্ধ ছিল, এবং তখনো লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ বঙ্গে রাজত্ব করিতেন। তুর্কীরাজগণ যে মধ্যে মধ্যে বঙ্গে অভিযান করিতেন তাহাও এই গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে। সুতরাং বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন যে যবণ-রাজকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া পূৰ্ব্ব ও দক্ষিণবঙ্গ স্বীয় অধিকারে রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
বিশ্বরূপসেনের একখানি তাম্রশাসন তাঁহার রাজত্বের চতুর্দ্দশ সম্বৎসরে এবং আর একখানি ইহার পরে প্রদত্ত হইয়াছিল। কেশবসেনের তাম্রশাসনখানির তারিখ তাঁহার রাজ্যের তৃতীয় বৎসর। সুতরাং এই দুই ভ্রাতার মোট রাজ্যকাল প্রায় ২৫ বৎসর ছিল এরূপ অনুমান করা যাইতে পারে। কেশবসেনের মৃত্যুর পরে (আ ১২৩০) কে রাজসিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন তাহা জানা যায় না। বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে কুমার সূৰ্য্যসেন ও কুমার পুরুষোত্তমসেনের নামোল্লেখ আছে। কুমার’ এই উপাধি হইতে অনুমিত হয় যে ইহারা উভয়েই রাজপুত্র, অন্তত রাজবংশীয়, ছিলেন। কিন্তু ইহাদের কেহ যে রাজা হইয়াছিলেন তাঁহার প্রমাণ নাই। পরবর্ত্তীকালে রচিত রাজাবলী, বিপ্রকল্পলতিকা প্রভৃতি গ্রন্থ, আবুল ফজল প্রণীত আইন-ই-আকবরী এবং এদেশে প্রচলিত লৌকিক কাহিনীতে অনেক সেনরাজার নামোল্লেখ আছে, কিন্তু এই সমুদয় বিবরণ ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না। মীনহাজুদ্দিনের পূৰ্বোল্লিখিত উক্তি হইতে প্রমাণিত হয় যে তিনি যে সময়ে তাঁহার গ্রন্থ সমাপ্ত করেন (আ ১২৬০ অব্দ),-অন্তত যে সময়ে লক্ষ্মণাবতীতে আসিয়া বাংলা দেশের ঐতিহাসিক বিবরণ সংগ্রহ করেন (আ ১২৪৪ অব্দ)-তখনো লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ বঙ্গে রাজত্ব করিতেন। সুতরাং কেশবসেনের পরেও যে এক বা একাধিক সেন রাজা বঙ্গে রাজত্ব করিয়াছিলেন সে সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নাই।
‘পঞ্চরক্ষা’ নামক একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থের পুঁথি হইতে জানা যায় যে, ইহা ১২১১ শকে (১২৮৯ অব্দে) পরমসৌগত পরমরাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর মধুসেনের রাজ্যে লিখিত হইয়াছিল। এই বৌদ্ধ নরপতি মধুসেন লক্ষ্মণসেনের বংশধর কি না তাহা সঠিক জানা যায় না, কিন্তু তাঁহার ‘সেন’ উপাধি হইতে এরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। মধুসেন এয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে রাজত্ব করেন। কিন্তু তাঁহার রাজ্যের অবস্থিতি ও বিস্তৃতি সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তিনি গৌড়েশ্বর উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু গৌড়ের কোনো অংশ তাঁহার রাজ্যভুক্ত ছিল কি না অন্য সমর্থক প্রমাণ না পাইলে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যা না। মুধুসেনের পর বাংলায় সেন উপাধিধারী কোনো রাজার অস্তিত্বের প্রমাণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই। বর্দ্ধমান জিলার কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত মঙ্গলকোট নামক গ্রামের এক মসজিদে একখানি ভগ্ন প্রস্তরখণ্ডে একটি সংস্কৃত লিপির কিয়দংশ উত্তীর্ণ আছে। কেহ কেহ বলেন ইহাতে চন্দ্রসেন নামক রাজার উল্লেখ আছে। কিন্তু এই রাজার সম্বন্ধে আর কোনো বিবরণ জানা যায় নাই।
এয়োদশ শতাব্দীতে বুদ্ধসেন ও তাঁহার পুত্র জয়সেন পীঠি রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। বর্ত্তমান গয়া জিলায় পীঠি রাজ্য অবস্থিত ছিল। পীঠিপতি আচাৰ্য্য জয়সেন “লক্ষ্মণসেনস্য অতীতরাজ্য-সম্বৎসর-৮৩” এই অব্দে বৌদ্ধগয়ার মহাবোধি বিহারকে একখানি গ্রাম দান করেন। এই তারিখের প্রকৃত অর্থ লইয়া পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। “লক্ষ্মণসেনের রাজ্য ধ্বংস হওয়ার ৮৩ বৎসর পরে,”-উক্ত পদের এই প্রকার অর্থই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়। গয়া অঞ্চলে আ ১২০০ অব্দে সেনরাজ্য ধ্বংস হয়। সুতরাং বুদ্ধসেন ও জয়সেন ত্রয়োদশ শতাব্দের শেষার্ধে রাজত্ব করিতেন। ইহা হইতে প্রমাণিত হয় যে তুরস্ক বিজয়ের পরও মগধে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দেশীয় রাজ্য বিদ্যমান ছিল এবং সেন উপাধিধারী রাজগণ তথায় রাজত্ব করিতেন।
তিব্বতীয় লামা তারনাথ লিখিয়াছেন যে সেনবংশীয় লবসেন, কাশসেন, মণিতসেন এবং রাথিকসেন এই চারিজন রাজা মোট ৮০ বৎসর রাজত্ব করেন। তৎপর লবসেন, বুদ্ধসেন, হরিতসেন এবং প্রতীতসেন এই চারিজন তুরস্ক রাজার অধীনে রাজত্ব করেন। তারনাথের এই উক্তির সমর্থক কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু অসম্ভব নহে যে তারনাথ কথিত বুদ্ধসেনই পূর্ব্বোক্ত পীঠিপতি বুদ্ধসেন।
পীঠির সেনরাজগণের সহিত বাংলার সেনরাজবংশের কোনো সম্বন্ধ ছিল কি না তাহা নিশ্চিত বলা যায় না। জয়সেনের লিপিতে লক্ষ্মণসেনের নাম সংযুক্ত সম্বৎসর ব্যবহৃত হওয়ায় ইহাই প্রমাণিত হয় যে এককালে এই অঞ্চল লক্ষ্মণসেনের রাজ্যভুক্ত ছিল কিন্তু ইহা হইতে জয়সেনের সহিত লক্ষ্মণসেনের কোনো বংশগত সম্বন্ধ ছিল এরূপ সিদ্ধান্ত করা যায় না। তবে এরূপ সম্বন্ধ থাকা অস্বাভাবিক বা অসম্ভব নহে।
পঞ্জাবের অন্তর্গত সুকে, কেওস্থল, কষ্টওয়ার এবং মণ্ডী প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষুদ্র পার্ব্বত্য রাজ্যের রাজাদের মধ্যে একটি প্রাচীন প্রবাদ প্রচলিত আছে যে তাঁহাদের পূৰ্বপুরুষগণ গৌড়ের রাজা ছিলেন। এই সমুদয় রাজাদের সেন উপাধি হইতে কেহ কেহ অনুমান করেন যে, হঁহারা বাংলার সেনরাজগণের বংশধর। অবশ্য সমর্থক অন্য প্রমাণ না পাইলে এ সম্বন্ধে নিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্ত করা যায় না।
তুর্কী আক্রমণই সেন রাজবংশের পতনের একমাত্র কারণ নহে। সম্ভবত আভ্যন্তরিক বিদ্রোহও ইহার ধ্বংসের পথ প্রশস্ত করিয়াছিল। ডোম্মনপাল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে সুন্দরবন অঞ্চলে যে এক স্বাধীন রাজ্যের পত্তন করিয়াছিলেন তাহা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। তুর্কী আক্রমণের ফলে সেনরাজগণের বিপদ ও দুর্বলতার সুযোগে এইরূপ আরও কয়েকটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়। পরবর্ত্তী অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হইয়াছে।
সেনরাজগণের রাজধানী কোথায় ছিল সে সম্বন্ধে এ যাবৎ বহু বাদানুবাদ হইয়াছে। ইহার বিস্তৃত আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। রাঢ় দেশের কোন অংশে হেমন্ত সেন রাজত্ব করিতেন এবং তাঁহার রাজধানী কোথায় ছিল তাহা বলা যায় না। কিন্তু বিজয়সেন বঙ্গদেশ জয় করার পর যে ঢাকার নিকটবর্ত্তী বিক্রমপুরে সেনরাজগণের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। বিজয়সেন ও বল্লালসেনের এবং লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের প্রথমভাগের যে সমুদয় তাম্রশাসন অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হইয়াছে তাঁহার সকলই “শ্রীবিক্রমপুর-সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবার” হইতে প্রদত্ত। “স্কন্ধাবার” শব্দে শিবির ও রাজধানী উভয়ই বুঝায়, কিন্তু যখন তিনজন রাজার তাম্রশাসনেই এই এক স্কন্ধাবারের উল্লেখ পাওয়া যায়, তখন ইহাকে রাজধানী অর্থেই গ্রহণ করা সঙ্গত। ইহার অন্যবিধ প্রমাণও আছে। বিজয়সেনের তাম্রশাসন হইতে জানা যায় যে, তাঁহার মহাদেবী অর্থাৎ প্রধানা মহিষী বিলাসদেবী বিক্রমপুর উপকারিকা মধ্যে তুলাপুরুষ মহাদান নামক বিরাট অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন। সুতরাং বিক্রমপুর যে অস্থায়ী শিবির মাত্র নহে, কিন্তু স্থায়ী রাজধানী ছিল, সে বিষয় সন্দেহ নাই। এখনো স্থানীয় প্রবাদ অনুসারে বিক্রমপুরে বল্লালবাড়ী প্রভৃতি সেনরাজগণের অতীত কীৰ্ত্তির ধ্বংসপ্রাপ্ত নিদর্শন আছে।
লক্ষ্মণসেনের রাজত্বের শেষভাগে উৎকীর্ণ দুইখানি তাম্রশাসন ধার্যগ্রাম, ও তাঁহার দুই পুত্রের তাম্রশাসন ফল্পগ্রাম স্কন্ধাবার হইতে প্রদত্ত। ধাৰ্য্যগ্রাম ও ফরুগ্রামের অবস্থিতি সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। লক্ষ্মণসেন ও তাঁহার পুত্রগণ বিক্রমপুর পরিত্যাগ করিয়া এই দুই স্থানে রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন কি না তাহাও নিশ্চিত বলা যায় না।
অনুমিত হয় যে পালরাজগণের ন্যায় সেনরাজগণেরও একাধিক রাজধানী ছিল। লক্ষ্মণসেনের সময় অথবা তাঁহার পূৰ্ব্বে সম্ভবত গৌড় ও নদীয়ায় সেনরাজগণের রাজধানী স্থাপিত হইয়াছিল। কারণ মুসলমান ইতিহাস গৌড় লক্ষ্মণাবতী নামে পরিচিত এবং সম্ভবত লক্ষ্মণসেনের নাম অনুসারেই গৌড়ের এই নাম পরিবর্ত্তন হইয়াছিল। মীনহাজুদ্দিনের বর্ণনা অনুসারে মহম্মদ বখতিয়ারের আক্রমণের সময় লক্ষ্মণসেন রাজধানী নদীয়ায় অবস্থিতি করিতেছিলেন। বাংলার কুলজী গ্রন্থ অনুসারে বল্লালসেন বৃদ্ধবয়সে রাজধানী নবদ্বীপে বাস করিতেন। বল্লালচরিতে উক্ত হইয়াছে যে বল্লালসেনের তিনটি রাজধানী ছিল বিক্রমপুর, গৌড় ও স্বর্ণগ্রাম। কবি ধোয় রচিত পবনদূত কাব্যে গঙ্গাতীরবর্ত্তী বিজয়পুর নগরী লক্ষ্মণসেনের রাজধানীরূপে বর্ণিত হইয়াছে। এই বিজয়পুরের অবস্থিতি সম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বিজয়পুরকে নদীয়ার সহিত অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন, আবার কাহারও মতে রাজসাহীর অন্তর্গত রামপুর বোয়ালিয়ার দশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত বিজয়নগর গ্রামই প্রাচীন বিজয়পুর; কিন্তু পবনদূতে ত্রিবেণী সঙ্গমের পরই বিজয়পুরের উল্লেখ করা হইয়াছে এবং গঙ্গা নদী পার হইবার কোনো প্রসঙ্গ নাই, সুতরাং বর্ত্তমান নদীয়াই প্রাচীন বিজয়পুর এই মতটিই সমীচীন বলিয়া মনে হয়। সম্ভবত বিজয়সেনের নাম অনুসারেই এই নামকরণ হইয়াছিল।