চতুর্থ পরিচ্ছেদ –গুপ্ত-যুগ
১. গুপ্ত-শাসন
খৃষ্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তবংশীয় রাজগণ ভারতে বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। এই বংশের আদিপুরুষ শ্রীগুপ্ত খৃষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর শেষে অথবা চতুর্থ শতাব্দীর প্রারম্ভে কোনো ক্ষুদ্র রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। তাঁহার পৌত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত প্রপৌত্র সমুদ্রগুপ্ত বহু দেশ জয় করিয়া একটি বিরাট সাম্রাজ্য গঠন করেন। এই সাম্রাজ্য ক্রমে বঙ্গদেশ হইতে কাঠিয়াবার পর্য্যন্ত বিস্তৃত হয়।
আদিম গুপ্তরাজ্য কোথায় অবস্থিত ছিল, সে সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। অনেক ঐতিহাসিক অনুমান করেন যে শ্রীগুপ্ত মগধে রাজত্ব করিতেন। কিন্তু চীনদেশীয় পরিব্রাজক ইৎসিং লিখিয়াছেন যে মহারাজ শ্রীগুপ্ত চীনদেশীয় শ্রমণদের জন্য মৃগস্থাপন স্তূপের নিকটে একটি মন্দির নির্মাণ করিয়াছিলেন। একখানি বৌদ্ধ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে মৃগস্থাপন স্কুপ বরেন্দ্রে অবস্থিত ছিল। সুতরাং মহারাজ শ্রীগুপ্ত যে বরেন্দ্রে অথবা তাঁহার সমীপবর্ত্তী প্রদেশে রাজত্ব করিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইৎসিং বর্ণিত এই শ্রীগুপ্তই গুপ্তরাজবংশের আদিপুরুষ। ইৎসিং বলেন যে শ্রীগুপ্ত পাঁচশত বৎসর পূর্ব্বে রাজত্ব করিতেন। তাহা হইলে শ্রীগুপ্তের রাজ্যকাল দ্বিতীয় শতাব্দের শেষভাগে পড়ে। কিন্তু ইৎসিং-কথিত পাঁচশত বৎসর মোটামুটিভাবে ধরিলে তল্লিখিত শ্রীগুপ্তকে গুপ্তরাজগণের আদিপুরুষ বলিয়া গণ্য করা যায় এবং অনেক পণ্ডিতই এই মত গ্রহণ করিয়াছেন। এই মত অনুসারে বঙ্গদেশের এক অংশ আদিম গুপ্তরাজ্যের অন্তর্গত ছিল। কেহ কেহ অনুমান করেন যে গুপ্তগণ বাঙ্গালী ছিলেন এবং প্রথমে বাংলা দেশেই রাজত্ব করিতেন। কিন্তু ইহার সমর্থক কোনো প্রমাণ অদ্যাবধি আবিষ্কৃত হয় নাই।
প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত যখন বিশাল গুপ্তসাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন বাংলা দেশে কতকগুলি স্বাধীন রাজ্য ছিল। বাঁকুড়ার নিকটবর্ত্তী সুসুনিয়া নামক স্থানে পৰ্বতগাত্রে ক্ষোদিত একখানি লিপিতে পুষ্করণের অধিপতি সিংহবর্ম্মা ও তাঁহার পুত্র চন্দ্রবর্ম্মার উল্লেখ আছে। সুসুনিয়ার ২৫ মাইল উত্তর-পূৰ্ব্বে দামোদর নদের দক্ষিণ তটে পোর্ণা নামে একটি গ্রাম আছে। এখানে খুব প্রাচীনকালের মূর্ত্তি ও অন্যান্য দ্রব্য পাওয়া গিয়াছে। খুব সম্ভবত ইহাই সিংহবর্ম্মা ও চন্দ্রবর্ম্মার প্রাচীন রাজধানী পুষ্করণের ধ্বংসাবশেষ। চন্দ্রবর্ম্মার রাজ্য কত দূর বিস্তৃত ছিল বলা যায় না। ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত কোটালিপাড়ায় চন্দ্রবর্ম্মকোট নামক একটি দুর্গ ছিল। ষষ্ঠ শতাব্দীর শিলালিপিতে ইহার উল্লেখ আছে। কেহ কেহ অনুমান করেন যে উল্লিখিত চন্দ্ৰবৰ্ম্মার নাম অনুসারেই এই দুর্গের ঐরূপ নামকরণ হইয়াছিল। এই মত অনুসারে চন্দ্রবর্ম্মার রাজ্য বাঁকুড়া হইতে ফরিদপুর পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল। সমুদ্রগুপ্ত যে সমুদয় রাজাকে পরাজিত করিয়া আৰ্য্যাবর্তে সাম্রাজ্য বিস্তার করেন, তাঁহাদের মধ্যে একজনের নাম চন্দ্রবর্ম্মা। খুব সম্ভবত ইনিই পুষ্করণাধিপতি চন্দ্রবর্ম্মা এবং ইহাকে পরাজিত করিয়াই সমুদ্রগুপ্ত পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলা অধিকার করেন। বাংলা দেশের উত্তর ভাগ সম্ভবত গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। কারণ সমুদ্রগুপ্তের শিলালিপিতে কামরূপ (বর্ত্তমান আসাম) গুপ্তসাম্রাজ্যের সীমান্তস্থিত করদরাজ্যরূপে বর্ণিত হইয়াছে।
প্রাচীন দিল্লীতে কুতবমিনারের নিকটে একটি লৌহস্তম্ভ আছে। এই স্তম্ভগাত্রে ক্ষোদিত লিপি হইতে জানা যায় যে চন্দ্র নামক একজন রাজা বঙ্গের সম্মিলিত রাজশক্তিকে পরাজিত করিয়াছিলেন। এই চন্দ্র কে এবং কোথায় রাজত্ব করিতেন, তৎসম্বন্ধে পণ্ডিতগণের মধ্যে মতভেদ আছে। কাহারও কাহারও মতে, তিনি গুপ্তসম্রাট প্রথম অথবা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। প্রথমোক্ত অনুমান স্বীকার করিলে বলিতে হয় যে সমুদ্রগুপ্তের পূর্ব্বেই তাঁহার পিতা বঙ্গদেশ জয় করিয়াছিলেন। দ্বিতীয় অনুমান অনুসারে সমুদ্রগুপ্তের বঙ্গ জয়ের পরেও তাঁহার পুত্রকে আবার বঙ্গদেশ জয় করিতে হইয়াছিল। খুব সম্ভবত লৌহস্তম্ভে উল্লিখিত রাজা চন্দ্র গুপ্তবংশীয় সম্রাট নহেন। এ সম্বন্ধে অন্য যে সমুদয় মতবাদ প্রচলিত তাঁহার সবিস্তারে উল্লেখ করার প্রয়োজন নাই। কিন্তু রাজা চন্দ্র যিনিই হউন, দিল্লীর স্তম্ভলিপি হইতে প্রমাণিত হয় যে গুপ্তযুগের প্রাক্কালে বঙ্গে একাধিক স্বাধীন রাজ্য ছিল এবং আত্মরক্ষার জন্য প্রয়োজন হইলে তাহারা সম্মিলিত হইয়া বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিত।
সমতট প্রথমে করদরাজ্য হইলেও ক্রমে ইহা গুপ্তসাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং সমস্ত বাংলা দেশই পঞ্চম শতাব্দীতে গুপ্তসাম্রাজ্যের অংশমাত্র ছিল। উত্তরবঙ্গে এই যুগের কয়েকখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। এগুলি হইতে জানা যায় যে, বঙ্গদেশের এই অংশ পুণ্ড্রবর্দ্ধন-ভুক্তি নামক বিভাগের অন্ত ভুক্ত এবং গুপ্তসম্রাট কর্ত্তৃক নিযুক্ত এক শাসনকর্ত্তার অধীনে ছিল। এই ভুক্তি বা বিভাগ কতকগুলি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। ৫৪৪ খৃষ্টাব্দে গুপ্তবংশীয় সম্রাট স্বীয় পুত্রকে এই ভুক্তির শাসনকর্ত্তার পদে নিয়োগ করিয়াছিলেন। ৫০৭ অব্দে পূৰ্ব্ববঙ্গ অথবা সমতট মহারাজ বৈন্যগুপ্ত শাসন করিতেন। তাঁহার রাজধানী ছিল ক্রীপুর। তিনি পরে নিজ নামে স্বর্ণমুদ্রা প্রচলিত করিয়াছিলেন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি গুপ্তবংশীয় ছিলেন এবং প্রথমে বঙ্গের শাসনকর্ত্তা হইলেও পরে গুপ্তসাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। দক্ষিণ ও পশ্চিমবঙ্গে গুপ্তরাজাগণের শাসনপ্রণালী কিরূপ ছিল, তাহা জানা যায় না।
.
২. স্বাধীন বঙ্গরাজ্য
অন্তর্বিদ্রোহ ও হূণজাতির পুনঃপুন আক্রমণের ফলে খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথমার্ধে গুপ্তসম্রাটগণ হীনবল হইয়া পড়েন। এই সময়ে যশোধর্ম্মণ নামে এক দুর্ধর্ষ বীর সমগ্ৰ আৰ্য্যাবৰ্ত্তে আপনার প্রভাব বিস্তার করেন। তাঁহার জয়স্তম্ভে উল্লিখিত হইয়াছে যে তিনি পূর্ব্বে ব্রহ্মপুত্র নদ হইতে পশ্চিমে আরবসাগর এবং উত্তরে হিমালয় হইতে দক্ষিণে মহেন্দ্রগিরি (গঞ্জাম জিলায় অবস্থিত) পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত রাজ্য জয় করিয়াছিলেন। তাঁহার প্রশস্তিকারের এই উক্তি সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলে বাংলা দেশও তাঁহার অধীনস্থ ছিল, একথা স্বীকার করিতে হয়। যশোধর্ম্মণের রাজ্য দীর্ঘকাল স্থায়ী না হইলেও ইহার ফলে গুপ্তসাম্রাজ্যের ধ্বংস আরম্ভ হয়। এই সময় এবং সম্ভবত এই সুযোগে দক্ষিণ ও পূৰ্ব্ববঙ্গ গুপ্তসম্রাটগণের অধীনতাপাশ ছিন্ন করিয়া একটি পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজ্যে পরিণত হয়। কোটালিপাড়ার পাঁচখানি এবং বর্দ্ধমান জিলার অন্তর্গত মল্লসারুলে প্রাপ্ত একখানি তাম্রশাসনে এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যর কিছু কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। এই ছয়টি তাম্রশাসনে গোপচন্দ্র, ধৰ্ম্মাদিত্য ও সমাচারদেব এই তিনজন রাজার নাম পাওয়া যায়। ইহারা সকলেই মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। সমাচারদেবের স্বর্ণমুদ্রা এবং নালন্দার ধ্বংসাবশেষ মধ্যে তাঁহার নামাঙ্কিত শাসনমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। সুতরাং তাহারা যে বেশ শক্তিশালী স্বাধীন রাজা ছিলেন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সমগ্র দক্ষিণ এবং পূৰ্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গের অন্তত কতকাংশ এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এই যুগের আরও কতকগুলি স্বর্ণমুদ্রা বাংলা দেশের নানা স্থানে আবিষ্কৃত হইয়াছে। সম্ভবত পূর্ব্বোক্ত স্বাধীন বঙ্গদেশের রাজগণই এগুলি প্রচলিত করিয়াছিলেন। এই সমুদয় মুদ্রায় যে সকল রাজার নাম আছে, তাঁহার মধ্যে মাত্র দুইটি অনেকটা নিশ্চিতরূপে পড়া যায়। একটি পৃথুবীর অপরটি শ্রীসুধন্যাদিত্য।
এই সমুদয় রাজাই একবংশীয় কি না তাহা বলা কঠিন। যে সমুদয় রাজার নাম পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার মধ্যে গোপচন্দ্ৰই সৰ্ব্বপ্রাচীন ছিলেন বলিয়া মনে হয়। তিনি অন্তত ১৮ বৎসর রাজত্ব করেন। তাঁহার পর ধৰ্ম্মাদিত্য ও সমাচারদেব যথাক্রমে অন্তত ৩ ও ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। সম্ভবত এই তিনজন রাজা খৃষ্টীয় ৫২৫ হইতে ৫৭৫ অব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। দুঃখের বিষয়, এই রাজাদের সম্বন্ধে বিশেষ কোনো বিবরণই জানা যায় না। এমনকি তাঁহাদের পরস্পরের মধ্যে কী সম্বন্ধ ছিল, তাহাও নির্ণয় করিবার উপায় নাই। তবে তাঁহাদের তাম্রশাসনগুলি পড়িলে মনে হয় যে তাঁহাদের অধীনে স্বাধীন বঙ্গরাজ্য প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধিশালী ছিল।
কোন সময়ে কিভাবে এই স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের অবসান হয়, তাহা বলা যায়। দাক্ষিণাত্যের চালুক্যরাজ কীৰ্ত্তিবৰ্মণ ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষপাদে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ ও মগধ জয় করেন বলিয়া তাঁহার প্রশস্তিকারেরা উল্লেখ করিয়াছেন। চালুক্যরাজের আক্রমণের ফলেই হয়তো বঙ্গরাজ্য দুৰ্বল হইয়া পড়িয়াছিল। তবে খুব সম্ভবত স্বাধীন গৌড়রাজ্যের অভ্যুদয়ই ইহার পতনের প্রধান কারণ।
.
৩. গৌড় রাজ্য
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর পরবর্ত্তী ‘গুপ্তবংশ’ নামে পরিচিত এক বংশের গুপ্ত উপাধিধারী রাজগণ এই সাম্রাজ্যের এক অংশ অধিকার করিয়াছিলেন। খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের কতকাংশ এই রাজবংশের অধীন ছিল। এই সময়ে বাংলা দেশে এই অঞ্চল গৌড় নামে প্রসিদ্ধ হয়। নামত গুপ্তরাজগণের অধীন হইলেও ষষ্ঠ শতাব্দীর মধ্যভাগে গৌড় একটি বিশিষ্ট জনপদরূপে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল। তখন মৌখরি বংশ বর্ত্তমান যুক্তপ্রদেশে রাজত্ব করিতেন। এই বংশের পরাক্রান্ত রাজা ঈশানবর্ম্মা সম্বন্ধে তাঁহার একখানি শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে যে তিনি গৌড়গণকে পরাজিত ও বিপর্যস্ত করিয়া তাহাদিগকে সমুদ্রে আশ্রয় লইতে বাধ্য করেন। ইহার অর্থ সম্ভবত এই যে গৌড়ের অধিবাসীগণ সমুদ্রতীরে যাইয়া আত্মরক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইহাতে বাঙ্গালীর নৌবলের সাহায্যে আত্মরক্ষা অথবা সমুদ্র লঙ্নপূৰ্ব্বক অন্য দেশে যাইয়া বাসস্থানের ইঙ্গিত করা হইয়াছে। সে যাহাই হউক, সমুদ্রের উল্লেখ হইতে মনে হয় যে তখন সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ গৌড়ের অন্তর্গত ছিল।
মৌখরি ও পরবর্ত্তী গুপ্তবংশীয় রাজগণের মধ্যে পুরুষানুক্রমিক বিবাদ চলিতেছিল। ঈশানবর্ম্মা কর্ত্তৃক গৌড় বিজয় এই বিবাদের ইতিহাসে একটি ক্ষুদ্র অধ্যায়মাত্র। গুপ্তরাজগণের শিলালিপি অনুসারে গুপ্তরাজ কুমারগুপ্ত ঈশানবর্ম্মাকে পরাজিত করেন এবং কুমারগুপ্তের পুত্র দামোদরগুপ্ত মৌখরিদের সহিত যুদ্ধে জয়লাভ করেন। ঈশানবর্ম্মার পরবর্ত্তী মৌখরিরাজ শৰ্ব্ববর্ম্মা ও অবন্তিবর্ম্মা সম্ভবত মগধের কিয়দংশ অধিকার করেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে ইহার ফলে গুপ্তরাজগণ মগধ ও গৌড় পরিত্যাগ করিয়া মালবে রাজত্ব করেন। কিন্তু ইহা সত্য হউক বা না হউক, ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগে যে গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্তের রাজ্য পূৰ্ব্বে ব্রহ্মপুত্র নদ পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই। সুতরাং গৌড় ও মগধ তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
অর্দ্ধশতাব্দীব্যাপী এই সংঘর্ষের ফলে এবং উত্তর হইতে তিব্বতীয়দের এবং দক্ষিণ হইতে চালুক্যরাজ্যের আক্রমণে সম্ভবত পরবর্ত্তী গুপ্তরাজগণ হীনবল হইয়া পড়েন এবং এই সুযোগে গৌড়দেশে শশাঙ্ক এক স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।
.
৪. শশাঙ্ক
বাঙ্গালী রাজগণের মধ্যে শশাঙ্কই প্রথম সাৰ্বভৌম নরপতি। তাঁহার বংশ বা বাল্যজীবন সম্বন্ধে সঠিক কিছুই জানা যায় না। কেহ কেহ মতপ্রকাশ করিয়াছেন যে শশাঙ্কের অপর নাম নরেন্দ্র গুপ্ত এবং তিনি গুপ্তরাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এই মতটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলিয়াই মনে হয়। প্রাচীন রোহিতাশ্বের (রোটাসগড়) গিরিগাত্রে শ্রীমহাসামন্ত শশাঙ্ক এই নামটি ক্ষোদিত আছে। যদি এই শশাঙ্ক ও গৌড়রাজ শশাঙ্ককে অভিন্ন বলিয়া গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে স্বীকার করিতে হয় যে, শশাঙ্ক প্রথমে একজন মহাসামন্ত মাত্র ছিলেন। কেহ কেহ অনুমান করেন যে শশাঙ্ক মৌখরিরাজ্যের অধীনস্থ সামন্তরাজা ছিলেন। কিন্তু পূর্ব্বেই বলা হইয়াছে যে ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাবে গুপ্তরাজ মহাসেনগুপ্ত মগধ ও গৌড়ের অধিপতি ছিলেন। সুতরাং শশাঙ্ক এই মহাসেনগুপ্তের অধীনে মহাসামন্ত ছিলেন, এই মতই সঙ্গত বলিয়া মনে হয়।
৬০৬ অব্দের পূর্ব্বেই শশাঙ্ক একটি স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। তাঁহার রাজধানী কর্ণসুবর্ণ খুব সম্ভবত মুর্শিদাবাদ জেলায় বহরমপুরের ছয় মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে রাঙ্গামাটি নামক স্থানে অবস্থিত ছিল। শশাঙ্ক দক্ষিণে দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর জেলা), উল্কল, ও গঞ্জাম জেলায় অবস্থিত কোঙ্গোদ রাজ্য জয় করেন। উৎকল ও দণ্ডভুক্তি তাঁহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শৈলোদ্ভব বংশীয় রাজগণ তাঁহার অধীনস্থ সামন্তরূপে কোঙ্গোদ শাসন করিতেন। পশ্চিমে মগধ রাজ্যও শশাঙ্ক জয় করেন। দক্ষিণবঙ্গে যে স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের কথা পূৰ্ব্বে উল্লিখিত হইয়াছে, সম্ভবত তাহাও শশাঙ্কের অধীনতা স্বীকার করে। কিন্তু এ সম্বন্ধে সঠিক কিছু বলা যায় না।
শশাঙ্কের পূৰ্ব্বে আর কোনো বাঙ্গালী রাজা এইরূপ বিস্তৃত সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন বলিয়া জানা নাই। কিন্তু শশাঙ্ক ইহাতেই সন্তুষ্ট হন নাই। তিনি গৌড়ের চিরশত্রু মৌখরিদিগকে দমন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন।
মৌখরিরাজ গ্রহবর্ম্মা পরাক্রান্ত স্থাণীশ্বরের (থানেশ্বর) রাজা প্রভাকরবর্দ্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। কামরূপরাজ ভাস্করবর্ম্মাও শশাঙ্কের ভয়ে থানেশ্বররাজের সহিত মিত্রতা স্থাপন করেন। শশাঙ্কও এই দুই মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে সাহায্যের জন্য মালবরাজ দেবগুপ্তের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হন।
কী কারণে এই দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ উপস্থিত হয় এবং এই যুদ্ধের প্রথম ভাগের বিবরণ নিশ্চিত জানা যায় না। শশাঙ্ক সম্ভবত প্রথমে বারাণসী অধিকার করিয়া পশ্চিম দিকে অগ্রসর হন এবং দেবগুপ্তও মালব হইতে সসৈন্যে কান্যকুব্জ (কনৌজ) যাত্রা করেন। ইহার পরবর্ত্তী ঘটনা সম্বন্ধে সমসাময়িক ‘হর্ষচরিত গ্রন্থে নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়।
‘থানেশ্বররাজ প্রভাকরবর্দ্ধনের মৃত্যুর পর তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্যবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। এমন সময় কান্যকুব্জ হইতে দূত আসিয়া সংবাদ দিল যে মালবের রাজা কান্যকুব্জরাজ গ্রহবর্ম্মাকে যুদ্ধে পরাস্ত ও নিহত করিয়া রাণী রাজশ্রীকে কারারুদ্ধ করিয়াছেন এবং থানেশ্বর আক্রমণের উদ্যোগ করিতেছেন। এই নিদারুণ সংবাদ শুনিয়া রাজ্যবর্দ্ধন কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্দ্ধনের উপর রাজ্যভার ন্যস্ত করিয়া অবিলম্বে দশ সহস্র অশ্বারোহী সৈন্য মাত্র লইয়া ভগিনীর উদ্ধারের নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। পথে মালবরাজের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। তিনি মালবকে পরাজিত করিয়া তাঁহার বহু সৈন্য বন্দী করিয়া থানেশ্বরে প্রেরণ করিলেন। কিন্তু কান্যকুজে পৌঁছিবার পূর্ব্বেই শশাঙ্কের হস্তে তাঁহার মৃত্যু হয়।’
হর্ষচরিত্রের বিভিন্ন স্থানে এই ঘটনার যেরূপ উল্লেখ আছে, তাহাতে মনে হয় যে দেবগুপ্ত কান্যকুব্জ জয় করিয়াই শশাঙ্কের জন্য অপেক্ষা না করিয়া থানেশ্বরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শশাঙ্ক কান্যকুজে পৌঁছিয়া এই সংবাদ শুনিয়া দেবগুপ্তের সাহায্যে অগ্রসর হন। কিন্তু এই দুই মিত্রশক্তি মিলিত হইবার পূর্ব্বেই রাজ্যবর্দ্ধন দেবগুপ্তকে পরাস্ত ও নিহত করেন। দেবগুপ্তের ন্যায় রাজ্যবর্দ্ধনও জয়োল্লাসে সমূহ-বিপদের আশঙ্কা না করিয়া নিজের ক্ষুদ্র সৈন্যের কতক বন্দী মালবসৈন্যের সঙ্গে থানেশ্বরে প্রেরণ করেন এবং অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া কান্যকুজের দিকে অগ্রসর হন। সম্ভবত পথে শশাঙ্কের সঙ্গে তাঁহার যুদ্ধ হয় এবং তিনি পরাস্ত ও নিহত হন।
শশাঙ্ক কর্ত্তৃক রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যার কথা আমরা তিনটি বিভিন্ন সূত্রে জানিতে পারি। হর্ষবর্দ্ধনের সভাকবি বাণভট্টের হর্ষচরিত গ্রন্থ, হর্ষবর্দ্ধনের পরম সুহৃদ চীনদেশীয় পরিব্রাজক হুয়েন সাংয়ের কাহিনী, এবং হর্ষবর্দ্ধনের শিলালিপি। বাণভট্ট লিখিয়াছেন যে মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত হইয়া রাজ্যবর্দ্ধন একাকী নিরস্ত্র শশাঙ্কের ভবনে গমন করেন এবং তৎকর্ত্তৃক নিহত হন। রাজ্যবর্দ্ধন কেন এইরূপ অসহায় অবস্থায় শত্রুর হাতে আত্মসমর্পণ করিলেন বাণভট্ট সে সম্বন্ধে একেবারে নীরব। হর্ষচরিতের টীকাকার শঙ্কর লিখিয়াছেন যে শশাঙ্ক তাঁহার কন্যার সহিত বিবাহের প্রলোভন দেখাইয়া রাজ্যবর্দ্ধনকে স্বীয় ভবনে আনয়ন করেন এবং রাজ্যবর্দ্ধন তাঁহার সঙ্গীগণসহ আহারে প্রবৃত্ত হইলে ছদ্মবেশে তাঁহাকে হত্যা করেন। শঙ্কর সম্ভবত চতুর্দ্দশ শতাব্দীর অথবা পরবর্ত্তীকালের লোক। যে ঘটনা বাণভট্ট উল্লেখ করেন নাই হাজার বৎসর পরে শঙ্কর কিরূপে তাঁহার সন্ধান পাইলেন জানি না। কিন্তু তাঁহার বর্ণনার সহিত বাণভট্ট কথিত এ নিরস্ত্রকারী’ রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যুর কাহিনীর সামঞ্জস্য নাই।
হুয়েন সাং বলেন যে, শশাঙ্ক পুনঃপুন তাঁহার মন্ত্রীগণকে বলিতেন যে সীমান্ত রাজ্যে রাজ্যবর্দ্ধনের ন্যায় ধার্মিক রাজা থাকিলে নিজ রাজ্যের কল্যাণ নাই। এই কথা শুনিয়া শশাঙ্কের মন্ত্রীগণ রাজ্যবর্দ্ধনকে একটি সভায় আমন্ত্রণ করিয়া তাহাকে হত্যা করে। হুয়েন সাংয়ের এই উক্তি কোনোমতেই বিশ্বাসযোগ্য নহে। কারণ রাজ্যবর্দ্ধন সিংহাসনে আরোহণ করিয়াই যুদ্ধযাত্রা করেন। তিনি ধার্মিক বা অধাৰ্মিক ইহা বিচার করিবার এবং এ বিষয়ে পুনঃপুন মন্ত্রীগণকে বলিবার সুযোগ বা সম্ভাবনা শশাঙ্কের ছিল না। অন্যত্র হুয়েন সাং লিখিয়াছেন, “রাজ্যবর্দ্ধনের মন্ত্রীগণের দোষেই রাজ্যবর্দ্ধন শক্তহস্তে নিহত হইয়াছেন-মন্ত্রীরাই ইহার জন্য দায়ী”। বাণভট্ট-কথিত ‘মিথ্যা উপচারে আশ্বস্ত রাজ্যবর্দ্ধনের একাকী নিরস্ত্র শশাঙ্কভবনে গমনের সহিত ইহার সঙ্গতি নাই।
হর্ষবর্দ্ধনের শিলালিপিতে উক্ত হইয়াছে যে সত্যানুরোধে রাজ্যবর্দ্ধন শক্ৰভবনে প্রাণত্যাগ করিয়াছিলেন। এখানে শশাঙ্কের বিশ্বাসঘাতকতার কোনো ইঙ্গিতই নাই।
তিনটি সমসাময়িক বিবরণে একই ঘটনা সম্বন্ধে এই প্রকার বিরোধিতা দেখিলে স্বতই তাঁহার সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে। তারপর ইহাও উল্লেখযোগ্য যে বাণভট্ট ও হুয়েন সাং উভয়েই শশাঙ্কের পরম বিদ্বেষী এবং তাহাদের গ্রন্থের নানা স্থানে শশাঙ্ক সম্বন্ধে অশিষ্ট উক্তি ও অলীক কাহিনীতে এই বিদ্বেষভাব প্রকটিত হইয়াছে। সুতরাং কেবলমাত্র এই দুইজনের উক্তির উপর নির্ভর করিয়া শশাঙ্ক বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া রাজ্যবর্দ্ধনকে হত্যা করিয়াছিলেন, এই মত গ্রহণ করা সমীচীন নহে। যুদ্ধে নিরত দুই পক্ষের পরস্পরের প্রতি অভিযোগ প্রায়শই কত অমূলক বর্ত্তমানকালের দুইটি মহাযুদ্ধে তাঁহার বহু প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। এই প্রসঙ্গে শিবাজী কর্ত্তৃক আফজলখানের হত্যার কাহিনী উল্লেখযোগ্য। মহারাষ্ট্র গ্রন্থমতে আফজলখানই বিশ্বাসঘাতক, আবার মুসলমান ঐতিহাসিকেরা শিবাজী সম্বন্ধে ঐ অপবাদ ঘোষণা করেন। শশাঙ্ক সম্বন্ধে গৌড়দেশীয় কোনো লেখকের গ্রন্থ থাকিলে তাহাতে সম্ভবত রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যার সম্পূর্ণ বিভিন্ন রকম বিবরণই পাওয়া যাইত।
এই প্রসঙ্গে রোম সম্রাট ভ্যালেরিয়ানের উল্লেখ করা যাইতে পারে। কাহারও মতে, ভ্যালেরিয়ান যখন পারস্যের রাজার সহিত সন্ধির কথাবার্তা চালাইতেছিলেন, তখন পারস্যের রাজা তাঁহাকে আমন্ত্রণ করেন এবং সাক্ষাৎ হইলে বন্দী করেন। অপর মত অনুসারে ভ্যালেরিয়ান অল্প সৈন্য লইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন এবং পারস্যরাজের হস্তে পরাজিত ও বন্দী হইয়াছিলেন। কেহ কেহ বলেন যে এক অবরুদ্ধ দুর্গে অবস্থানকালে স্বীয় বিদ্রোহী সৈন্যের হস্ত হইতে আত্মরক্ষার জন্য তিনি পলাইয়া পারস্যরাজের নিকট আত্মসমর্পণ করেন। অসম্ভব নহে যে অনুরূপ কোনো কারণেই রাজ্যবর্দ্ধন শশাঙ্কের বন্দী হইয়াছিলেন। বাণভট্ট নিজেই বলিয়াছেন যে মাত্র দশ সহস্র সৈন্য লইয়া তিনি মালবরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে কতক মালবরাজের সহিত যুদ্ধে হতাহত হইয়াছিল এবং কতক বন্দী মালব সৈন্যসহ থানেশ্বরে প্রেরিত হইয়াছিল। শশাঙ্ক যে দশ সহস্রের অনধিক সৈন্য লইয়া সুদূর কান্যকুজে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, এইরূপ অনুমান করা অসঙ্গত নহে। অপরপক্ষে রাজ্যবর্দ্ধন বৌদ্ধ ছিলেন। পরবর্ত্তীকালে হর্ষবর্দ্ধনের বৌদ্ধধর্ম্মের প্রতি অনুরাগের জন্য তাঁহার প্রজাগণ তাঁহার প্রাণনাশের জন্য ষড়যন্ত্র করিয়াছিল। সুতরাং রাজ্যবর্দ্ধনের মন্ত্রীগণও যে কৌশলে তাঁহার হত্যাসাধনে সহায়তা করিবেন, ইহা একেবারে অবিশ্বাস্য নহে। “রাজ্যবর্দ্ধনের মৃত্যুর জন্য তাঁহার মন্ত্রীগণই দায়ী” হুয়েন সাংয়ের এই উক্তি এই অনুমানের পরিপোষক। যুদ্ধে পরাজয় অথবা মন্ত্রীগণের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে যদি রাজ্যবর্দ্ধন নিহত হইয়া থাকেন, তবে হর্ষবর্দ্ধনের পক্ষীয় লেখক যে এই কলঙ্কের উল্লেখ করিবেন না ইহাই খুব স্বাভাবিক। সুতরাং কেবলমাত্র বাণভট্ট ও হুয়েন সাংয়ের পরস্পরবিরোধী, অস্বাভাবিক, অস্পষ্ট উক্তি এবং অসম্পূর্ণ কাহিনীর উপর নির্ভর করিয়া শশাঙ্ককে বিশ্বাসঘাতক হত্যাকারীরূপে গ্রহণ করা কোনো ক্রমেই যুক্তিসিদ্ধ নহে।
বাণভট্ট বলেন যে রাজ্যবর্দ্ধনের হত্যার সংবাদ শুনিয়া হর্ষবর্দ্ধন শপথ করিলেন যে যদি নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে তিনি পৃথিবী গৌড়শূন্য করিতে না পারেন, তবে অগ্নিতে ঝাঁপ দিয়া প্রাণত্যাগ করিবেন। অতঃপর গৌড়রাজের বিরুদ্ধে বিপুল সমর-সজ্জা হইল। হর্ষ সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া পথিমধ্যে শুনিলেন যে তাঁহার ভগ্নী রাজ্যশ্রী কারাগার হইতে পলাইয়া বিন্ধ্যপর্বতে প্রস্থান করিয়াছেন। সুতরাং সেনাপতি ভণ্ডীকে সসৈন্যে অগ্রসর হইতে আদেশ দিয়া তিনি নিজে ভগ্নীর সন্ধানে বিন্ধ্যপর্বতে গমন করিলেন। সেখানে রাজ্যশ্রীকে উদ্ধার করিয়া তিনি গঙ্গাতীরে স্বীয় সৈন্যের সহিত মিলিত হইলেন।
বাণভট্টের গ্রন্থ এখানেই শেষ হইয়াছে। শশাঙ্কের সহিত হর্ষের যুদ্ধের কথা বাণভট্ট কিছুই বলেন নাই। কিন্তু হুয়েন সাং লিখিয়াছেন যে হর্ষ ছয় বৎসর যাবৎ অনবরত যুদ্ধ করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষ জয় করিয়াছিলেন। এই উক্তি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। হর্ষবর্দ্ধন দাক্ষিণাত্যের রাজা পুলকেশীর হস্তে পরাজিত হইয়াছিলেন। আর্য্যাবর্তে অন্তত ৬১৯ খৃ. অব্দ পর্য্যন্ত শশাঙ্ক একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। কারণ ঐ বৎসরে উত্তীর্ণ একখানি তাম্রশাসনে গঞ্জাম জিলাস্থিত কোঙ্গোদের শৈলোববংশীয় রাজা “চতুরুদধিসলিলবীচীমেখলা দ্বীপগিরিপত্তনবতী” বসুন্ধরার অধিপতি মহারাজাধিরাজ শ্রীশশাঙ্কের মহাসামন্ত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। শশাঙ্ক যে মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত মগধের অধিপতি ছিলেন হুয়েন সাংয়ের উক্তি হইতেই তাহা প্রমাণিত হয়। কারণ হুয়েন সাংয়ের উক্তি অনুসারে ৬৩৭ খৃষ্টাব্দের অনতিকাল পূৰ্ব্বে শশাঙ্ক গয়ার বোধিবৃক্ষ ছেদন করেন এবং নিকটবর্ত্তী একটি মন্দির হইতে বুদ্ধমূর্ত্তি সরাইতে আদেশ দেন; ইহার ফলে শশাঙ্কের সর্বাঙ্গে ক্ষত হয়, তাঁহার মাংস পচিয়া যায় এবং অল্পকাল মধ্যেই তাঁহার মৃত্যু হয়।
সুতরাং হর্ষবর্দ্ধন তাঁহার কঠোর প্রতিজ্ঞা ও বিরাট যুদ্ধসজ্জা সত্ত্বেও শশাঙ্কের বিশেষ কিছু অনিষ্ট করিতে পারেন নাই। শশাঙ্কের সহিত তাঁহার কোনো যুদ্ধ হইয়াছিল কি না তাহাও নিশ্চিত জানা যায় না। কেবলমাত্র আমঞ্জুশ্রীমূলকল্প নামক গ্রন্থে ইহার উল্লেখ আছে। এই বৌদ্ধ গ্রন্থখানি খুব প্রাচীন নহে। পুরাণের মতো এই গ্রন্থে ভবিষ্যৎ রাজাদের বিবরণ আছে। কিন্তু কোনো রাজার নামই পুরাপুরি দেওয়া নাই, হয় প্রথম অক্ষর অথবা সমার্থক কোনো শব্দ দ্বারা সূচিত করা হইয়াছে। এই গ্রন্থ ঐতিহাসিক বলিয়া গ্রহণ করা যায় না, ইহা মধ্যযুগের কতকগুলি কিংবদন্তীর সমাবেশ মাত্র। এই গ্রন্থোক্ত রাজা ‘সোম’ সম্ভবত শশাঙ্ক এবং তাঁহার শত্রু হকারাখ্য রাজা ও তাঁহার রকারাখ্য জ্যেষ্ঠভ্রাতা যথাক্রমে হর্ষবর্দ্ধন ও রাজ্যবর্দ্ধন। এই অনুমান স্বীকার করিয়া লইলে এই গ্রন্থে আমরা নিম্নোক্ত বিবরণ পাই।
“এই সময়ে মধ্যদেশে বৈশ্যজাতীয় রাজ্যবর্দ্ধন রাজা হইবেন। তিনি শশাঙ্কের তুল্য শক্তিশালী হইবেন। নগ্নজাতীয় রাজার হস্তে তাঁহার মৃত্যু হইবে। অসাধারণ পরাক্রমশালী তাঁহার কনিষ্ঠভ্রাতা হর্ষবর্দ্ধন বহু সৈন্যসহ শশাঙ্কের রাজধানী পুণ্ড্রনগরীর বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তিনি দুবৃত্ত শশাঙ্ককে পরাজিত করেন এবং ঐ বৰ্বর দেশে যথোপযুক্ত সম্মান না পাওয়ায় (মতান্তরে ‘পাইয়া’) স্বীয় রাজ্যে প্রত্যাবর্ত্তন করেন।”
এই উক্তি কত দূর সত্য বলা যায় না। কিন্তু ইহা সত্য বলিয়া গ্রহণ করিলেও মাত্র ইহাই প্রমাণিত হয় যে হর্ষবর্দ্ধন শশাঙ্কের রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন কিন্তু বিশেষ কোনো সাফল্য লাভ করিতে না পারিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিলেন।
মঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প মতে শশাঙ্ক মাত্র ১৭ বৎসর রাজত্ব করেন। কিন্তু ইহা সত্য নহে। শশাঙ্ক ৬.৬ অব্দের পূর্ব্বেই রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন এবং পূৰ্ব্বোদ্ধৃত হুয়েন সাংয়ের উক্তি হইতে প্রমাণিত হয় যে ৬৩৭ অব্দের অনতিকাল পূৰ্ব্বে তাঁহার মৃত্যু হয়। শশাঙ্কের যে তিনখানি লিপি পাওয়া গিয়াছে, তাঁহার একখানির তারিখ ৬১৯ অব্দ। খুব সম্ভবত মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত শশাঙ্ক গৌড়, মগধ, দণ্ডভুক্তি, উৎকল ও কোঙ্গোদের অধিপতি ছিলেন।
শশাঙ্ক শিবের উপাসক ছিলেন। হুয়েন সাং তাঁহার বৌদ্ধবিদ্বেষ সম্বন্ধে অনেক গল্প লিখিয়াছেন কিন্তু এগুলি বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ হুয়েন সাংয়ের বর্ণনা হইতেই বেশ বোঝা যায় যে শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণে এবং তাঁহার রাজ্যের সৰ্ব্বত্র বৌদ্ধধর্ম্মের বেশ প্রসার ও প্রতিপত্তি ছিল।
বাংলার ইতিহাসে শশাঙ্কের একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। তিনিই প্রথম আৰ্য্যাবর্তে বাঙ্গালীর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন এবং ইহা আংশিকভাবে কাৰ্য্যে পরিণত করেন। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রবল মৌখরিরাজশক্তি তাঁহার কূটনীতি ও বাহুবলে সমূলে ধ্বংস হয়। সমগ্র উত্তরাপথের অধীশ্বর প্রবল শক্তিশালী হর্ষবর্দ্ধনের সমুদয় চেষ্টা ব্যর্থ করিয়া তিনি বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যার আধিপত্য বজায় রাখিয়াছিলেন। বাণভট্টের মতো চরিত-লেখক অথবা হুয়েন সাংয়ের মতো সুহৃৎ থাকিলে হয়ত হর্ষবর্দ্ধনের মতোই তাঁহার খ্যাতি চতুর্দিকে বিস্তৃত হইত। কিন্তু অদৃষ্টের নিদারুণ বিড়ম্বনায় তিনি স্বদেশে অখ্যাত এবং অজ্ঞাত; এবং শত্রুর কলঙ্ককালিমাই তাহাকে জগতে পরিচিত করিয়াছে।