১৭. দূরবীনের উল্টোদিক

দূরবীনের উল্টোদিক

এই দেখুন, সানফ্রান্সিসকো!

সানফ্রান্সিসকোর ডাক নাম ফ্রিসকো। মার্সেদ থেকে পাক্কা ১২০ মাইল। গতকাল সন্ধে সাড়ে ৮টা নাগাদ গ্রে-লাইন বাসে আমি, লেদু তার নন্দিন ফ্রিসকো এসে পৌঁছেছি। টার্মিনালে ছন্দাদের বন্ধু মহীতোষ সান্যাল দাঁড়িয়েছিল। হাতে চ্যাটার্জি লেখা পোস্টার।

জ্যাপান এয়ারলাইন্স হংকং পর্যন্ত ওকে টিকিরি কনফার্ম করেছে। হংকং থেকে আপনাদের এয়ার ইন্ডিয়া ধরতে হবে। শ্বেতকেতুর (লেদুর ভাল নাম) টিকিটের পনের দিন এক্সটেনশান হয়েছে। কাল সকাল আটটায় এয়ার লাইন্সের বাস আসবে। এত খবর একসঙ্গে দিয়ে মহীতোষ জানাল, সব ব্যবস্থা ছন্দাদিই করেছেন।

গতকাল ৬টা নাগাদ যখন বাস ছাড়ল, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মডেস্টো থেকে ওকল্যান্ড পর্যন্ত ঘণ্টাখানেক বেশ আলো ছিল। টানা ফ্রিসকো পর্যন্ত এক্সপ্রেস হাইওয়ে বাস, ওকল্যান্ড পেরিয়ে, একটা ছোটখাটো স্ন্যাক বারের সামনে একবার যা মিনিট পাঁচেক দাঁড়াল। আমরা বাস থেকে নামিনি। এয়ার-কন্ডিশানড বাসের নস্যি-রঙা কাচের মধ্যে দিয়ে একটা সাদা গির্জার পিছনে পাঁচ মিনিট ধরে জীবনের শ্রেষ্ঠ সূর্যাস্ত দেখলাম। দেখলাম, গির্জা-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে নীল পপিফুলের ক্ষেত। তার মধ্যে দিয়ে বাসের দিকে হন্তদন্ত, দ্রুত এগিয়ে আসছেন কালো জোব্বা পরা পুরোহিত। তাঁকে ভনভন করে হেঁকে ধরেছে একরাশ প্রজাপতি। বিরক্ত হাত নেড়ে প্রজাপতি তাড়াতে তাড়াতে তিনি ছুটতে শুরু করলেন। তাঁর গলায় দুলছে ক্ৰশ। ঠিক মাথার পিছনে বৃত্তাকার সূর্য।

ফ্রিসকোর আগে একের-পর-এক সমুদ্র-সেতু পেরতে পেরতে ব্রিজের নিচে প্যাসিফিকের নীল জল ক্রমে কালো হয়ে এল। যেতে যেতে, যেন যুগান্ত পেরিয়ে, একটা সামান্য ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। মানুষের কী যে মনে থাকে। আর কী যে সে ভুলে যায়!

ঠিক কোন বছর মনে নেই, ১৪/১৫ বছর আগে তো হবেই। কোনও এক নবমীর দিন, খুব ভোরবেলায় সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ে বিবেকানন্দ পার্কের বাসস্টপে আমি এল নাইনের জন্যে একা দাঁড়িয়ে। আগের দিন বন্ধু অজিত হালদারের বাড়িতে এত মাতাল হয়ে পড়ি যে, রাতে থেকে যেতে হয়। ভোরের প্রথম বাসে বাড়ি ফিরব।

সারারাত খুব ঝড়বৃষ্টি। হঠাৎ দেখি, ভিজে ফুটপাথ ধরে একটা শালিক-ছানা আমার দিকে হেঁটে আসছে।

হয় ডানা ভেঙেছে, নয়ত, আহারে, এখনও উড়তে শেখেনি। আমি তাড়াতাড়ি সেটাকে হাতে তুলে নিতে-না-নিতে বাসও এসে পড়ে এবং আমি বাসে উঠে পড়ি।

টিকিট? আমার তালুর ওপর ভিজে পাখিটার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে কন্ডাক্টর বলল, এটাকে নিয়ে উঠেছেন কেন?

তার সমর্থন পাব এমনটাই নিশ্চিত জেনে আমি বললাম, দেখুন, এটা ঝড়ে রাস্তায়…

অ্যানিম্যাল নিয়ে বাসে ওঠার নিয়ম নেই। আপনি নেমে যান।

কিন্তু দেখুন, কাচুমাচু হয়ে আমি বলি, এটা অ্যানিম্যাল না। পাখির ছানা একটা। ঝড়ে…

আপনি নেক্সট স্টপে নেমে যান! বলে আমাকে স্তম্ভিত করে সে ঘণ্টা মারে। বিদীর্ণ, বিস্ফারিত চোখে আমি যাত্রীদের দিকে তাকাই। ভোরের প্রথম বাসে দুধের ডিপোর মেয়ে, কারখানার প্রথম শিফটের শ্রমিক, বাজারের ফড়ে-যাত্রী বলতে কজন বা। বোধহয় তখন নকশাল আমল বলেই কেউ আমার সমর্থনে একটা কথাও বলল না। আমি একবার ভাবলাম, সে কি আমাকে এ কথা বলছে, না, আমার উচ্ছন্ন চেহারা, আমার শ্যাবি ধুতি-পাঞ্জাবিকে?নাকি, পোর্ট কমিশনারের মোহরমারা কেরানিকে সে চিনে ফেলেছে? পাঞ্জাবির কোঁচকানো প্রান্ত হাত দিয়ে মসৃণ করতে করতে আমি আবার বলি, দেখুন, এ এখনও উড়তে শেখেনি।

বাস রসা রোড স্টপে দাঁড়াল।

কফি হাউসে, আমার মুখে গল্পটা এই পর্যন্ত শুনে তরুণ কবি দেবপ্রসাদ সহাস্যে জানতে চেয়েছিল, তখন আপনি কী করলেন? নিশ্চয়ই উড়িয়ে দিলেন পাখিটা?

সানফ্রান্সিসকো ঢোকার আগে শেষ সমুদ্র-সেতু সান মাটি ও ব্রিজের নিচে কালো জলস্রোত আমাকে প্রশ্ন করে, তুমি কার জন্যে এভাবে উন্মাদের মতো ছুটে এসেছ? তোমার মেয়ে না ভাইপো?যদি তোমার মেয়ে এখানে না থাকত…

পাখির ছানাটাকে জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ার আগে (ফুটপাথের ওপর মুখ থুবড়ে পড়েছিল) সে আঁচড়ে দিয়েছিল আমার হাতের তালু। অঞ্জনের প্রখরতর প্রশ্ন এখন তার বাঘ-নখে আমার সারা বুক আঁচড়ে রক্ত ঝরায়।

 

৭টায় ভোর। মুখটুখ ধুয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি, সক্কালবেলায় একটা মেশিন চালিয়ে দিয়ে তার ওপর উঠে মহীতোষ মর্নিং ওয়াক করছে। পায়ের নিচে দিয়ে দ্রুত সরে যাচ্ছে একটা লোহার রাস্তা। সে একটা হ্যান্ডেল ধরে, একই জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার ওপর দৌড়ে যাচ্ছে। আমাদের দেখে মহীতোষ মেশিন বন্ধ করল। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে গ্লাস-প্যানেল থেকে পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলল, ওই দেখুন, সানফ্রান্সিসকো!

ওই দেখুন, গোল্ডেন গেট ব্রিজ, মহীতোষ তখনও হাঁফাচ্ছে, ওই যে বনটা দেখেছেন ওটা গোল্ডেন গেট পার্ক। ও-দিকে ফিশারমেন্স হোয়াফ। সুন্দর জায়গা। জ্যাপান টাউন। চায়না টাউন। ঘিরাডেল্লি স্কোয়্যার। ওই যে ক্রুকেড স্ট্রিট। একের পর এক রঙিন পিকচার পোস্টকার্ড ফেলতে থাকে সে, ওই যে দূরে, সমুদ্রের মধ্যে আলকাট্রজ দ্বীপ। একসময় ডাকসাইটে বন্দীরা থাকত। এখন ট্যুরিস্ট স্পট। মহীতোষ অনুযোগ করল, আপনারা তো থাকলেন না। শ্বেতকেতুকে সব দেখিয়ে দেব।

যেন ওগুলো সব দেখা হয়ে গেল, লেদু ল্যাজ নাড়িয়ে বলে রাখে, আমাকে লাস ভেগাস দেখাতে হবে কাকু!

ওই দেখুন, সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্ট। ওই যে ট্রান্স আমেরিকান পিরামিড বিল্ডিং। রাতে দেখলে ইনক্রেডি মনে হবে।

মহীতোষের বাড়ি এক ছোটখাটো পাহাড়ের ওপর। এখান থেকে আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল পাহাড় ও সমুদ্র দিয়ে ঘেরা ফ্রিসকোকে সত্যিই স্বর্গের রাজধানীর মতন দেখায়। পৃথিবীর তিনভাগ জল এসে তার পা ধুইয়ে দিচ্ছে। নিচে, রৌদ্রস্নাতদূর বিমানবন্দরে, আমাদের বেনেটোলার বাড়ির গোল বারান্দা থেকে ছাড়া একটা কাগজের প্লেন ভাসতে ভাসতে ঘুরে-ঘুরে নামছে।

মানুষের কখন যে কী মনে পড়ে যায়। কেন যে! আমি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা মহীতোষ, আল কাপিতান এখান থেকে দেখা যায় না?

আল কাপিতান? সে তো অনেক দূর! কেন ওদের বাড়ি থেকে দেখেননি? ওখান থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। ইনফ্যাক্ট, ট্যুরিস্ট গাইডে মার্সেদের নামই তো আপনার গেটওয়ে টু আল কাপিতান।

না, মানে, তোমার এখান থেকে… আহা। পাওয়ারফুল বায়নাকুলার দিয়ে এখান থেকেও দেখা যায়। আমার আছেও একটা, মহীতোষ বলল, দেখবেন?

মহীতোষ আমাকে দোতলার ব্যালকনিতে নিয়ে গেল। আমার হাতে একটা ফুট দেড়েক লম্বা বায়নাকুলার ধরিয়ে দিয়ে বলল, ওই দিকে খুঁজুন। দেখতে পাচ্ছেন?

হ্যাঁ। ওই যে। আজ বরফ পড়েছে নাকি!

বরফ? হ্যাঁ, তা পড়তে পারে। আপনি কিন্তু তাড়াতাড়ি নিচে আসবেন। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি। বাস আসতেও দেরি নেই।

ক্যালিফোর্নিয়ার গোটা পূর্ব সীমানা জুড়ে রেড ইন্ডিয়ান ঈশ্বরের নিজের হাতে তোলা উঁচু পাঁচিল: সিয়েরা নেভাদা পর্বতমালা। তার মাঝখানে আল কাপিতান। একখণ্ড সাদা গ্রানাইট দিয়ে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু সমাধিফলক। এখান থেকে শুধু তার সমতল চূড়াটি দেখা যায়। আজ, এই প্রথম কাপিতানের মাথায় বরফ।

কিন্তু… আমি কি ভুল দেখলাম? বরফে-ঢাকা আল কাপিতানের মাথায় আমি পলকের জন্য একবার দেখতে পেলাম একটি কালো হারমোনিয়াম। পর মুহূর্তে, অনন্ত শুভ্রতার ঢাল বেয়ে, উল্টে-পাল্টে সেটা নিচের দিকে গড়িয়ে এল। মাত্র একবার আমি স্পষ্ট দেখলাম। তারপর আর দেখা গেল না।

আমি কিদূরবীনের ভুল দিকটা দিয়ে দেখছিলাম?

 

বাবা, বাস এসে গেছে। কী করছ তুমি! শিগগির নেমে এসো।

আসুক বাস। জিনিসপত্র বলতে তো সঙ্গে কিছু নেই। শুধু উঠে পড়া। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ধীরে নামতে নামতে আমি ভাবলাম, না, দূরবীন নয়। এ আমার চোখেরই ভুল। তৃষিত মানুষ মরীচিকা দেখে। আমি দেখেছি সমাধি ফলকের মাথায় সুরযন্ত্র। এ হতেই পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *