১৪. রঞ্জনের সঙ্গে কথাবার্তা

রঞ্জনের সঙ্গে কথাবার্তা

৯ মে।

কীরে নদা, সেই এলি তাহলে?

……

খুব ভাল লাগছে। ব, কেমন দেখছিস আমার ঘরবাড়ি?

ঠিকই আছে।

ঠিক আছে কীরে। ওই যেখানে পাহাড়ের শুরু, ওই পর্যন্ত সবটা আমার।

আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি।

সে কীরে। এ কথা বলার স্পর্ধা তোর হয় কী করে। নে একটা কমলা লেবু খা।

না।

আরে, খা না!

না।

না?… এই যে ঘড়িটা পরে আছি, এটার দাম কত জানিস?

ন্‌না তো।

এগুলো জেনিভার পেজেঘড়ি। গত ৫ বছরে এরা এই মডেলটা মাত্র ১৭৫টা তৈরি করেছে। আমি পরে আছি ১৫৫ নং ঘড়িটা। দ্যাখ, নম্বর লেখা আছে। এর দাম কত জানিস? ১৯ হাজার ১শো ৬০ ডলার। রাফলি ১৪ দিয়ে গুণ কর। লাখ তিনেক টাকা হবে আর কী। আমার আর একটা পেজে আছে। হোয়াইট গোল্ডের। ডায়মন্ড সেট করা। ৮০ হাজার ডলার দাম। ওটা আছে এল-এ-র ফাইডেলিটি ব্যাঙ্কের ভল্টে ডু ইউ নো হাউ মাচ রিয়েল এস্টেট আই ওন— ওয়ার্দি অফ হাউ মেনি ডলার্স। হাউ মাচ ইন ক্যাশ? টেন মিলিয়ন, টুয়েন্টি, থার্টি-ট্রাই টু গেস…

আমি জানি না।

ও-কে। ইয়া। বাট দে আর দেয়ার। ওয়েল, ইউ কান্ট পসিবলি ডিসপিউট দেম। ক্যান ইউ? ইউ ক্যান নট আউট দা থিস দ্যাট একজিস্ট, দো দে আর বিয়ন্ড ইউ। ও-কে? তোর ফ্ল্যাট কত বড়?

সাড়ে ছ-শো।

কিনতে পেরেছিস?”

না।

ব্যাঙ্কে কত?

আমার এখন বিশ হাজার টাকার মতো ধার।

আমি টিকিট পাঠালাম। এলি না! আই শ্যাল বায় ইউ দা রিটার্ন প্যাসেজ এনিওয়ে।

আমার জুতোর ঘরে ঢুকেছিলি?

হ্যাঁ।

ক-জোড়া জুতো ওখানে জানিস। জানিস না। ৮০ জোড়া। তোর?

আমার এক জোড়া জুতো।

মোজা এক জোড়া?

হ্যাঁ।

এই যে জামাটা পরে আছি, ম্যানুফ্যাকচারারের নাম জানিস?

না।

গুচে। বছরে ৫০০ শার্ট বানায়। এর যে ইজিপসিয়ান কটন, এরা নিজেরা তৈরি করে। আমার বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে— সোলার প্ল্যান্ট, নিজের জেনারেটর যা ওই উইন্ডমিল তৈরি করে—৭২ ফিটের সুইমিং পুল—একে বলে জাকুসি। এতে পর পর দুটো ডুব মারলে, একটা ঠাণ্ডা আর একটা গরম—লোকে বাপের নাম ভুলে যায়, বুঝলি? তুই আমার লিভিংরুমে যা কিছু দেখলি এভরি বিট অফ ইট ইজ ফ্রম ক্যাশমিয়ের। অলটুগেদার বাড়িটার দাম কত জানিস? কিনেছিলাম দেড় মিলিয়নে। মানে দুকোটি আর কি। কিন্তু এখন? কতটা জমি, তোর ধারণা? বাহান্ন বিঘে। তুই আবার হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ আ ম্যান রিকোয়ার গল্পটা শোনাবি না তো? হ্যাঃ, হ্যাঃ, হ্যাঃ।

কিন্তু, আমি তো ঠিক তাই শোনাব। আমি তো দেখছি তুই একটা কয়েদী?

ডোন্ট বি সিলি।

হ্যাঁ। অ্যান্ড ফর ইওর হোল লাইফ টার্ম অ্যাট দ্যাট।

কী রকম?

দ্যাখ যখন এয়ারপোর্টের বেড়ার ওপার থেকে দুটো স্বাস্থ্যবান ছেলে আর ঝকঝকে বৌ-এর কনুই ধরে এগিয়ে আসতিস… প্রথমবার এসে কী বলেছিলি মনে আছে?

কী বলেছিলাম বল তো? এত রোগা আর ইমাসিয়েটেড, কীরে, তোরা কি খেতে পাস না?

রাইট। এখন এখানে তোকে দেখেও তাই মনে হচ্ছে। অবশ্য, এভরিবডি নোজ হিয়ার দ্যাট ইউ আর আ রাইটার। কাজেই, তোর মতো চেহারাটাও কোয়ালিটেটিভলি চলে যাবে। হ্যাঁ, লাইফটার্মের ব্যাপারটা কী বলছিলি বল তো?

কী বলছিলাম…আ-হা, এয়ারপোর্টে তোদের দেখে দেশে ও-রকম মনে হত। মনে হত স্বর্গ থেকে আসছিস। ভাবতাম, কেন ফিরবি তোরা এই হতভাগা দেশে, এই পৃথিবীতে?

আর এসে কী দেখছিস?

দ্যাখ, আগে যদি আসতাম, আমি ঢের হয়েছে এখন চল তো বলে বোঁচকা-কুঁচকি তুলে তোদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতাম। হ্যাঁ, সম্ভব হলে ঘাড় ধরে। তোরা টাকার গাছ পুঁতেছিস বটে একটা। কিন্তু, তার চারদিকে জেলখানার দেওয়াল। ইয়েস, ইউ আর সার্ভিং লাইফ। ফর শিওর!

অ্যাই…স্টপ দ্যাট বুলশিট।

নো আই অ্যাম টেলিং ইউ হোয়াট ইউ রিয়েলি আর। দ্য ট্রুথ!

তুই তোর মেয়ের ফিউচারের জন্যে, বৌদির জন্যে কী করেছিস? ইউ ইরেসপনসিবল প্যারাসাইট! মেয়েটার ভবিষ্যতের ভার পর্যন্ত আমার হাতে তুলে দিলি!

আমি জানতাম না। ভেবেছিলাম তোরা একটা-কিছু। ইউ হ্যাভ অ্যাচিভড সামথিং। এসে দেখছি, এই বাড়িঘর, গাড়ি, অৰ্চাৰ্ড, সুইমিং পুল…এ তো বনে ফিরে যাওয়া একটা হাতির নাদা, কাঁচা কয়লার উনুন থেকে উড়ন্ত ধোঁয়ার চেয়েও বেশি ধোঁয়া বেরচ্ছে এ-থেকে। ইউ রিয়েলি হ্যাভ অ্যাচিভড নাথিং।

রিয়েলি?

হ্যাঁ। অন্তত একবার আমার কথা মন দিয়ে শোন। শুধু নিজের সংসারের শ্রীবৃদ্ধি করা কোনও অ্যাচিভমেন্ট নয়। এর বাইরে অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে যা আমাদের প্রত্যেকের সত্ত্বা-আমাদের প্রত্যেকের সেলফ জানে। সে কথা ভুলে মেরে দিয়ে শুধু নিজের সংসারের বেঁচে থাকাকে নিজের বেঁচে-থাকা ভাবা… সংসার ছেড়ে, বৌকে ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে তুই চলে যেতে পারিস। মানুষ যায়। কিন্তু নিজেকে ছেড়ে তুই কোথায় যাবি?

তোর মেয়ের বিয়ে দিবি কী করে? টাকা পাবি কোথায়? ওখানে তো ডাওরি লাগে?

ওহ। ইউ ইনকরিজিবুল হামবাগ। ইউ ভেইন! ইউ ফুল! তা যদি লাগে, শি উইল প্রস্টিটিউট হারসেলফ, কালেক্ট দা মানি অ্যান্ড প্রেজেন্ট দা ডাওরি টু হার হাজবন্ড। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?

আমি ডাক্তার। আমি মানুষ বাঁচাই। হোয়াট ডু ইউ ডু?

আ। ফর ওয়ন্স ডোন্ট বি আ হিপোক্রিট। সত্যি করে বল তো, তুই ডাক্তার, না, ব্যবসাদার? ডাক্তারের গাইডিং ফোর্স তো দুটো। এক, জ্ঞান। দুই, রোগীকে সারিয়ে তোলা। এর মধ্যে ব্যবসা আসে কোথা থেকে রে? কেন ওই অৰ্চাৰ্ড, গোল্ড মাইনের অর্ধেকটা কিনেছিস কেন, কেন ১৪টা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দিয়েছিস?তই ছেলের জন্যে কত রেখে গেছিস?দশমিলিয়ন, কড়ি মিলিয়ন? তোদের শোবার ঘরে নিউ ওয়েভার্স জাজ বাজিয়ে, ইউ নো হোয়াট…তোদের বিছানায়। হ্যামলেট মাকে বলেছিল, এখনও তোমার বিছানা থেকে বাবার বীর্য শুকোয়নি তুমি এর মধ্যে কাকার সঙ্গে ওই বিছানায় শুলে? ফ্রেয়লটি, দাই নেম ইজ… এ তো সেই বৃত্তান্ত। তারা এর নাম ছেলেকে এডুকেশন দিচ্ছিলিস? এ তো আমেরিকান জন্তু একটা। আরন্ট ইউ অ্যাশেমড় অফ আ সন লাইব দ্যাট—স্বীকার কর হতভাগা। যে ব্যর্থ যদি কেউ হয়ে থাকে, সে তুই। আমি নয়। তুই! তুই!

ন’দা! আমি তোকে চিরকাল আমার অলটার-ইগো ভেবেছি। আমি যখন ডাক্তারি পড়তাম, তখন আমার বাক্স থেকে হাড়, মাথার খুলি এ-সব তুই চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলি। মার্কাস স্কোয়্যারের বঙ্গ সংস্কৃতি সম্মেলনে তোদের অতি আধুনিকা বলে বই-এর দোকানে কবিতার বইএর পেপার ওয়েট হিসেবে এগুলো ব্যবহার করেছিলি। আমি কত রাগ করেছিলাম, মনে আছে?

একদিন লুকিয়ে তোর শার্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। তুই জামাটা আমার গা থেকে খুলে নিয়েছিলি। সেদিন আমি মার্কাস স্কোয়্যারে গিয়েছিলাম গেঞ্জি পরে।

আমাদের তো ক্লাস ফোর অবধি খালিশা। নটি বয় পেলাম ফাইভে উঠে। প্রথম মোজা পরে মেডিকেল কলেজে যাই।

ক্লাস ফোর অবধি খালি পা। ঠিকই। কিন্তু আমাদের সেজন্যে কোনও অভাববোধ ছিল কী?

না… তা…তখন…।

দেয়ার ইউ আর! এই অভাববোধের অভাব— এ যতদিন বেঁচে থাকবে মানুষের মনে— যতদিন, যাদের মধ্যে বেঁচে থাকবে–যতদিন শিশু বেঁচে থাকবে পৃথিবীতে—ততদিন সে তার কাছ থেকে এটা শিখবেই—ততদিন অ্যাচিভমেন্ট বলতে সে অন্য জিনিস ভাববে। আর, তুই যা করেছিস, তাকে মনে হবে এলিফ্যান্ট-শিট!

ব্লেসেড ইজ দা পুওর ইন স্পিরিট?

ব্রেসেড ইজ দা চাইল্ড ইন স্পিরিট!

তোকে টি. এস. এলিয়টের একটা বই পাঠিয়েছিলাম। পাতা উল্টে দেখেছিলিস?

না। সময় পাইনি।

আহা, অন্তত দ্য বেরিয়াল অফ দা ডেড-এর এই কটা লাইনও যদি, যদি তুই পড়তিস, যাতে ছিল…

Unreal City
Under the brown fog of winter dawn
A crowd flowed over London Bridge.
So many
I had not thought
Death had undone so many…

তুই একবার পাতা উল্টেও দেখলি না বইটার?

অথচ, আমি পাঠিয়েছিলাম! তাহলে তো তুই তখনই জানতে পারতিস সেই সব জিনিসের কথা যাদের অস্তিত্ব আছে। যাদের অস্বীকার করা যায় না। যারা তোর মনোযোগ দাবি করে।

কী অ-ব্যর্থভাবে মরে গেলাম না রে ন’দা?

আমাদের বেনেটোলার বাড়ির গোলবারান্দা থেকে আমরা কাগজের প্লেন ছাড়তাম, তোর মনে পড়ে?

হ্যাঁ। আমারটা আগে মুখ থুবড়ে পড়ত।

আচ্ছা, আমি কেন এভাবে বেঘোরে মারা গেলাম, তুই জানিস?

বল্‌ না। আমি অশিক্ষিত। এলিয়ট পড়িনি। তুই বল আমাকে।

আমি এতক্ষণ তো সেই কথাই বললাম।

এলিয়ট পড়িনি, তাই। না রে, নদা?

দ্যাখ, মৃত্যু হল আমি বেঁচেছিলাম এই মুখোশটার খসে পড়া। এ ছাড়া কিছু তো নয়। মুখোশটাকে তুই মুখ ভাবতে গেলি কেন রে রুনু?

জীয়ন মরে গেল কেন?

ওইটুকুন ছেলে। ওর অপরাধ কী?

জানি না।

আই হ্যাভ আ হাঞ্চ। ওকে অবিকল আমার মতো দেখতে হয়েছিল। হয়ত তাই। রাইট?

আমি জানি না।

আর সুমিতা

আমি জানি না।

সহমরণে যাবে বলে নিশ্চয় নয়? বল না! আই হ্যাভ আ হাঞ্চ।

হোয়াট হ্যাপেন্ড অ্যাট দীঘা?

আমি জানি না।

সুমিতা আমাকে সানফ্রান্সিসকো নিয়ে যাচ্ছিল কেন? বলল, চল না, হেভি সারপ্রাইজ দেব তোমাকে। নইলে তো আমরা ৯১ নং ফ্রি-ওয়ে ধরে ফিরতাম। তুই জানিস কেন?

আমি জানি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *