১৩. হ্যারি, জেফ, মারিয়া ও লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল

হ্যারি, জেফ, মারিয়া ও লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল

৮ মে।

মারিয়া পৃথুলা, ছোটখাটো, দুধ-সাদা, ঘাডের বদলে গর্দান, মাথায় গোলাপিরুমাল, গায়ে সাদা অ্যাপ্রন। লাল পাতলা ঠোঁট। তাকে জিপসি-জিপসি দেখতে। মারিয়া নাকি ছাগল পোষে। ছোটবেলায় জীয়ন-অঞ্জন দুজনেই ওর ছাগলের দুধ খেয়েছে। রোজ সকালে একটা ফোর্ড গাড়িতে চেপে ছাগল আসত। সামনে দুয়ে দিত। এখন মারিয়া আসে ফিয়াটে। অঞ্জন ওকে এখনও গোট উওম্যান বলে।

আমি মারিয়ার কাছে জানতে চাইলাম, এখন বুঝি বরফ পড়ে না।

এ-রকম আবহাওয়ায় না। মারিয়া বলল, তবে পরপর কয়েকদিন ধরে আকাশ খুব পরিষ্কার আর নীল থাকলে পড়তে পারে। আবহাওয়াও ড্রাই থাকা দরকার।

কিচেনের জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে দেখি। বেলা ১০টা হবে। এখনও কুয়াশা কাটেনি। তবে শুকনো হাওয়া বইতে শুরু হয়েছে। মাঠের উত্তর দিকের গমক্ষেতে একটা ট্রাক্টর কুয়াশার মধ্যে ফুটে রয়েছে। বহুদূরে, শুনেছি ৭০/৮০ মাইল দূরে, কুয়াশা ছাড়িয়ে কাপিনের চূড়া দেখা যায়। একটা হলুদ আলোর রশ্মি কোথা থেকে উঠে এসে পর্বতচূড়ায় লাগল। কিছুক্ষণ থাকল। তারপর রঙ বদল করতে করতে শেষ পর্যন্ত কালো হয়ে ভারি রহস্যময়ভাবে কুয়াশার মধ্যে ঢুকে গেল।

৮ মে।

শ্রাদ্ধ ১১ মে। কার্ড এসে গেছে। ওপরে আমি নিজের হাতে বাংলায় লিখে দিয়েছিলাম। ছাপা হয়েছে। পোস্ট করার জন্য সমস্ত কার্ড জেফের অফিসে দিয়ে এলাম।

জেফ কোনিগ অনেক খবর দিল। ডক্টর চ্যাটার্জির অলিভ অ্যাভিনিউ-এর মেডিক্যাল সেন্টার সে বন্ধ করে দিয়েছে। দুটি মেয়ে কাজ করত, ছাড়িয়ে দিয়েছে। ইনসিওরেন্স কোম্পানিগুলোর কাছে ক্লেম-পিটিশন দেওয়া হয়েছে। চারজন উকিল চারটি কমপেনশেসন কেস করেছে। জন পার্লের নামে পুলিস সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডারের মামলা এনেছে। কাল কেস উঠবে।

এদিকে শ্রাদ্ধের আয়োজন সম্পূর্ণ, সে বলল। সানফ্রান্সিসকোয় দা হিমালয়া রেস্তোরাঁকে ১৫০টি ভারতীয় এবং ওলিয়েন্ডারকে ৫০টি বিদেশি লাঞ্চ লিভারমোর টেম্পলে পাঠাতে বলা হয়েছে।

৮ মে।

দুপুরবেলাটা বড় একা লাগে। গান-টান শুনি। টিভি দেখি। মাঠে গিয়ে বসে থাকি। মাঠের মাঝখানে গিয়ে বসলে সবচেয়ে নিরাপদ লাগে। মনে হয়, আর যাই হোক, আকাশ তো ভেঙে পড়বে না! ওদিককার ঘরগুলোয় যাইনা। লিভিং রুমেও যাই না। ওখানে একটা ছৌ-মুখোশ আছে। দুর্গার মুখ! তার গর্জন তেল মেশানো হলুদ পালিশ অন্ধকারে দেখা যায়। চোখ দুটো, আলো পড়লে ঠিকরায়। আমি নন্দিনের ঘর ছেড়ে কোথাও যাই না। টেলিফোন এ-ঘরে এনে রেখেছি।

আজ দুপুরবেলা নন্দিনের ঘরের পর্দা সরাতে প্রথমেই লেটার বক্সটি চোখে পড়ল। লন পেরিয়ে সাইডওয়াকের ধারে লোহার খুঁটির ওপর পোঁতা একটা কাঠের বাক্স। পোস্টম্যান এসে তার পাশে গাড়ি রাখছে। দেখলাম, ড্রাইভারের সিট থেকে না নেমে সে শুধু দরজা খুলেই বাক্সে চিঠি দেওয়া-নেওয়া করতে পারে। আমি আজ দুটি চিঠি ওখানে রেখেছি। বাক্সর দরজা বন্ধ করে দিয়ে লাল হাতলটা সে তুলে দিয়ে গেল। মানে, অন্তত একটি চিঠি এসেছে।

প্রথম দু-চারদিন কত চিঠি, বইপত্র আসত। কত দ্রুত কমে এল! গত দুদিনে তো কিছুই আসেনি। সবাই জেনে যাচ্ছে। আমি রোজ ছোটকাকার ডাকবাক্স থেকে চিঠি আনি। এটা আমার কাজ। ছোটকাকার অনেক চিঠি আসে। বইপত্র আসে। বেশ ভারি হয়। কিন্তু, তোমাদের একটি চিঠি থাকলে একটুও ভারি লাগে না। প্রথম দিকে নন্দিন লিখেছিল।

বাক্স খুলে দেখি, কল্যাণ লিখেছে। তার বক্তব্য: ফোনে আমি যা বলেছি, শুনে তার মনে হয়েছে, একজন বিশ্বাসযোগ্য লোকাল গার্জেন ঠিক করেনন্দিনকে এবং সম্ভব হলে, মাসখানেকের জন্যে হলেও, অঞ্জনকে নিয়ে আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসা উচিত। অঞ্জন আমেরিকাতেই পড়াশোনা করবে। তার শেকড় ওপড়াননা মোটেই উচিত হবে না। কোনও প্রলোভনেই তুমি যেন ওখানে থেকে যেও না বাক্যটির নিচে লাল কালি বুলিয়ে কল্যাণ আন্ডারলাইন করে দিয়েছে। চিনু নন্দিনকে লিখেছে কান্না দিয়ে। ওরে, তোকে আর কিছু হতে হবে না। কিছু করতে হবে না। তুই আমার বুকে ফিরে আয়। ইত্যাদি।

দুপুরবেলা। শহরতলির এই দামি আবাসন-এলাকায় কেউ কোথাও নেই। কুকুর নেই এমন রাস্তা ভাবা যায়! কিন্তু, পথিক নেই, তবু পথ? এখানে শত শত মাইল ড্রাইভ করে গেলেও একজন পথিক চোখে পড়ে না। পথ এখানে পথে পড়ে থাকে।

সবুজ ডাকবাক্স। গায়ে লেখা ২৮৫৬। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট ড্রাইভ। পথের ধারে অচেনা বৃক্ষরাজির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি আকাশপাতাল ভাবতে থাকি। এই সেই ২৮৫৬ হোয়াইট গেট, ক্যা–৯৫৩৪০, যেখানে চিঠিতে-কার্ডে সপ্তাহে দুটো করে ধরলেও গত এক বছরে শুধু নন্দিনের জন্যে শতাধিক চিঠি এসে পড়েছে এই বাক্সে। আর, এইভাবে তরুণ সুদর্শন সাহেব পোস্টম্যান গাড়ি চেপে এসে ড্রাইভারের সিটে বসে সযত্নে চিঠিগুলি একে একে রেখে হাতল তুলে দিয়ে গেছে। বাড়ি থাকলে, নন্দিন এসেছে ছুটতে ছুটতে। ওই সেই বাড়ি, হাজার হাজার মাইল দূরে যার অস্তিত্বের কথা আমি মুহূর্তের জন্যও কখনও অস্বীকার করতে পারিনি, যদিও তা ছিল কালপুরুষের পায়ের কাছে বশংবদ লুব্ধকের চেয়েও ঢের অবাস্তব, কেননা, লুব্ধককে তো চোখে দেখা যায়।

বিদেশ নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখেছি কত-না। আশ্চর্য যে, প্রত্যেকটির পটভূমি ছিল আমেরিকা। রঞ্জন তো ইংল্যান্ডেও ছিল, কানাডার সাসকাচুয়ান আর এডমন্টনে ছিল ছমাস করে— কই, এদের কখনও দেখিনি তো স্বপ্নে! তা ছাড়া, ভিয়েনা, টোকিও, রোম, মিউনিখ…এরাও রয়েছে। পৃথিবীর কোথায় যে রয়েছে, থেকে গেছে রিও-ডি-জেনেরো! হয়ত ব্রাজিলে। যেন মৃত্যুর মতো এরা সব। মানো বা না মাননা, মনে রাখো বা ভুলে যাও, যা তোমার খুশি। সে তুমি যেখানে থাক, যে চুলোয়, এরা আছে। দূরে… কিন্তু আছে। অপেক্ষা করছে। একদিন তুমি সেখানে যাবে বলে।

বস্তুত, বিদেশ শব্দটির মধ্যে একটা কাছে আয় ডাক আছেই। বিদেশি জিনিসের প্রতি আমাদের অদম্য আকর্ষণের কথাই ভাবা যাক না কেন। সেই যে একবার রঞ্জন আমার জন্যে এনেছিল একটা পালকের মতো হালকা গ্যাস লাইটার— তখন এখানে লাইটার বলতে লম্ফ, কেরোসিনে জ্বলে যার বোতাম টিপলেই জ্বলে উঠত দপ করে আগুন এবং আগুন না নেভা পর্যন্ত বিখ্যাত সব সোনাটা থেকে রেকর্ড করা সাতটি সুরের একটা-না-একটা বেজে যেত। বেজেই চলত! একটির সুর নাকি ছিল মোৎসার্টের দ্য ম্যারেজ অফ ফিগারো থেকে?

তো, সেই কবে ১৯৭২ সালে রঞ্জন আমেরিকা যাওয়ার পর থেকে স্বপ্নে আমি বহুবার আমেরিকা গেছি। কিন্তু সে তো এই মার্সেদ নয়, এই বাড়ি নয়, এই রাস্তা নয়। বরাবরই আমি এ-দেশে এসেছি বিনা পাসপোর্টে ও বিনা ভিসায়। আর, পালতোলা জেলে-ডিঙিতে। আর, সে অভিযাত্রায় প্রধান আকর্ষণ ছিল কী? না, ভয় পৌঁছনো কোনওমতে। কাস্টমসকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়া। আর, পুলিসকে ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে থাকা। আর, রঞ্জনকে খোঁজা। যেজন্যে ডক এরিয়া থেকে খুব বেশি দূরে কখনও যেতে পারিনি। ধরা পড়ার ভয়ে।

ডাকবাক্সর ধারে দাঁড়িয়ে আমার স্পষ্ট মনে পড়ল, অন্তত একবার আমি রঞ্জনকে খুঁজে পাই। পশ্চিম উপকূলের দক্ষিণতম বিন্দুর কোনও এক শহরে সেদিন ভোরবেলা সাইক্লোনের আবহাওয়া। ঝোড়ো হাওয়া আর উড়ন্ত বৃষ্টিকণার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি অবশেষে রঞ্জনকে খুঁজে পাই একটা হতদরিদ্র অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের ঝুলন্ত চারতলায়, মাটি থেকে যার তিনটি তলা গেছে। ভেঙে, এবং, রঞ্জনের তখনও তা জানা নেই! কী ভয়ঙ্কর! রঞ্জনের ঘরে ঢুকে দেখি, মেঝেয় পাতা অনেকগুলো বিছানা। কেউ নেই। রঞ্জন একা শতরঞ্চি-সহ নিজের বিছানা গোটাচ্ছে। আমাকে দেখে সে দারুণ রেগে গেল। আমার দিকে অভিযোগের তর্জনী তুলে বলল, এই সাইক্লোন আসছে কাঁথির সাইক্লোন-আই থেকে! আমি লক্ষ্য করলাম, স্বপ্নের সেই দরিদ্র আমেরিকা, সেই বাস্তুহারা রঞ্জন, সেই ভিজে মৃত্যু-আবহাওয়া, আজকের ঝকঝকে দুপুরের তুলনায় আমার কাছে

অনেক বেশি সত্য হয়ে আছে।

এই সব সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় দেখি একটি বিশাল পিক আপ ভ্যান হোয়াইট গেট থেকে এদিকে ৬০/৭০ মাইল বেগে ছুটে আসছে। রাস্তার ধারেই দাঁড়িয়েছিলাম। আমি তাড়াতাড়ি সাইডওয়াকের ওপর উঠে দাঁড়াই। তারপর কী ভেবে আরও পিছিয়ে লনের ঘাসের ওপর গিয়ে দাঁড়াই।

গাড়ি না বলে দোতলা বাড়িই বলা উচিত। কলকাতার এল নাইনের মতন। হাব-ভাবে মনে হয়েছিল বেরিয়ে যাবে, তা না, গাড়িটা হঠাৎ আমার উল্টোদিকে সশব্দে দাঁড়াল। দেখলাম, সিঁড়ি নামিয়ে ড্রাইভারের কেবিন থেকে একজন লাল আমেরিকান নামছে। রাস্তার ওপার থেকে হাত তুলে সে যখন বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড আমি সত্যিই আঁতকে উঠেছিলাম।

এখানে ভয় পেতে পেতে আমি এতটুকু হয়ে গেছি। ভয় একটাই: রঞ্জন-সুমিতা আমাকে এভাবে উড়িয়ে এনেছে, সে কি আমাকে ধৃংস করবে বলে? কী ওদের ইচ্ছে? অপঘাতে মৃত প্রেতাত্মা, যার নাকি মাটির মায়া সহজে যায় না, আর এখনও তো শ্রাদ্ধও হয়নি…

আকাশ ভেঙে পড়ে না। তাই মাঝে মাঝে মাঠে গিয়ে বসি। তখন সাহস পাই। তখন ওদের শুনিয়ে মনে মনে বলি, আমি সব বাজি রেখে ২০ হাজার টাকা ধার রেখে এভাবে ছুটে এলাম, সবটাই কি আমার মেয়ের জন্যে? তোমাদের ছেলের জন্য নয়? তোমাদের ফিউনারালে থাকব বলে নয়? তোমাদের মৃত আত্মার সম্মানের জন্য নয়?

একটি প্রশ্নেরও আমি উত্তর পাই না।

লোকটা রাস্তা পেরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। পরনে লাল শর্টস, গায়ের সাদা গেঞ্জির ওপর লেখা: ডু নট কাম ইন মাই ওয়ে!

সে আবার বলল, ডোন্ট বি অ্যাফ্রেড। মাই নেমে ইজ হ্যারি কেলার।

আমি কিলারই শুনলাম। এবং শুনে সাদা হয়ে গেল আমার মুখ। লোকটা তাও দেখল। বলল, কে ই এল এল ই আর। নট কিলার।

আমার বৌ কারা ডক্টর চ্যাটার্জির মেডিকেল সেন্টারে নার্স ছিল। হি ওয়জ আ ব্রেভ ম্যান। আ গ্রেট ডক্টর।

সে আর তার বৌ এবং মেয়ে ন্যান্সি শ্রাদ্ধে যেতে চায়। কারণ, এখানে ছিল না বলে ফিউনারালে যেতে পারেনি। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চায়।

লোকটা এ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। প্রহ্লাদ বলতে লোকটা খুবই রোগা।

রোগা আমেরিকান… আমার মনে পড়ল, প্রথম মোর্নার হিসেবে সবার আগে বাড়িতে এসেছিল এই হ্যারি না?

মাই ডটার ন্যান্সি অ্যান্ড জন আর গুড ফ্রেন্ডস।

জন বলতে অঞ্জন। সাহেবরা ওকে জন বলে ডাকে।

৮ মে।

বিকেলবেলা। ছোট্ট এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল। হোয়াইট গেট ড্রাইভ জুড়ে যতদূর দেখা যায় বৃষ্টি শেষের কনে-দেখা-আলো।

রাস্তার দুধারে একই জাতের তরু-বীথিকা। তাতে কাঠগোলাপের মতো সাদা সাদা ফুল।

সারা পথ জুড়ে সেই দুপুর থেকে এখনও কোনও পথিকের দেখা নেই। হাওয়া নেই। শুধু মাঝে মাঝে গাড়ি গেছে নিঃশব্দে।

একটু আগে সুন্দর তামার ঘটে রঞ্জন, সুমিতা, আর জীয়নের অ্যাসেস দিয়ে গেছে।

সারা রাস্তায়, পথের মাঝামাঝি একটা ঝকঝকে নীল অটোমোবাইল দাঁড়িয়ে।

লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *