১২. দ্য গোল্ড রাশ

দ্য গোল্ড রাশ

৭ মে।

এখানে সবই পার্সেন্টেজ। বা দালালি।

সারাদিনে চার-পাঁচটা টেলিফোন আসে শুধু উকিলদের কাছ থেকে। সকলে পরিচয় দিয়ে প্রথমেই বলে, নমস্কার। আপনার একটাও পয়সা লাগবে না। আমি লিঙ্কন কন্টিনেন্টাল কোম্পানির বিরুদ্ধে ১০ মিলিয়ন ডলারের কেস করব। আমার কাছে খবর আছে, ওই ব্যাচের গাড়িগুলো ছিল ডিফেক্টিভ। এর গ্যাসোলিন ট্যাঙ্ক ছিল পিছন দিকে। টোকিওর এক অ্যাকসিডেন্টে ১০ মিলিয়ন ক্ষতিপূরণ দেবার পর ওরা মডেল বদলায়। ট্যাঙ্ক সামনে আনে। কিন্তু আপনার ভাইকে কি ওরা সতর্ক করেছিল? ৫ মিলিয়ন আপনাদের। ৫ আমার। নমস্কার। আমি ক্যাম্ফ অ্যান্ড ক্লিভারের বিরুদ্ধে কেস করব। যারা জন পার্ল ফ্রি-ওয়ে ধরে গাড়ি ড্রাইভ করছে জেনেও তাকে অতটা মদ সার্ভ করেছিল। নমস্কার। আমি স্যাম পিয়ার্সনের বিরুদ্ধে কেস করব, যে ওর মতো হেবোকে তার গাড়ি দিয়েছিল। টু মিলিয়ন ডলার্স। ভেসে-ওঠা এইসব ইয়াঙ্কি ডুডলদের আমি জেফ-এর নাম্বার জানিয়ে দিই।

ডলার! ডলার! ডলার! টিভির সমস্ত অনুষ্ঠানে সুসজ্জিত লালমুখো বাঁদরের এই একটাই চিৎকার, আর ল্যাজ-আস্ফালন। এক কুৎসিত লোলচৰ্মা বুড়িকে নিয়ে বিখ্যাত ৩০ মিনিট-এ সারাক্ষণ দেখাল। কী? না, সে ১০ মিলিয়ন ডলার লটারিতে পেয়েছে! ১৬ নং চ্যানেলে একটি হিট প্রোগ্রামের নাম হল, হিয়ার কামস দা চাম্প! ফেক রেসলিং দেখায়। মনে হয় যেন সত্যি কুস্তি হচ্ছে, তা নয়। এরা রেফারির বাঁশি কেড়ে নেয়। পরস্পরকে শেষ পর্যন্ত চেয়ার, বেঞ্চি, খুঁটি যা পায় তাই তুলে মারে। ঘাড় মটকে ঘুরিয়ে দেয়। কটাং করে শব্দ হয়। বলা বাহুল্য, ঘাড়গুলো তখন রবারের,তবে বোঝা যায় না। কাল সন্ধেবেলা হল কী, একজন চারমণি রেসলার বাঁ-দিক থেকে ঢুকল। তার পরনে কাস্তে-হাতুড়ি-তারাসহ লাল পতাকা দিয়ে তৈরি ল্যাঙট। অর্থাৎ, সে রাশিয়া! ভাবলাম, ছিঃ, এরা এত ইতর। ওমা, পরমূহুর্তে ছিপছিপে আমেরিকান কুস্তিগীর স্টার্স অ্যান্ড স্টিপস্-সহ আমেরিকান পতাকার ল্যাঙট পরে মঞ্চে হাজির। বুঝলাম:আজকের বিষয় রাশিয়া ভার্সাস আমেরিকা। এই বর্বর ভাঁড়ামো কেন? উত্তর একটাহ: ফান! বস্তুত, পর্দায় সমবেত দর্শকরা হেসে হাঃ হাঃ। আজকের বিজেতা পুরস্কার পাবেন—-টিংটং–পর্দায় ভেসে ওঠে গাড়ি, উড়ন্ত এরোপ্লেন (ট্রিপ টু হনলুলু) ইত্যাদি ইত্যাদি। অ্যান্ড–এইট্টি থাউজান্ড ডালার!

জেফ আমাকে বলেছে, হ্যাঁ, তুমি গার্জেন হতেই পার। তোমার ক্লেমই সবার আগে বা, একমাত্র। তবে, তোমাকে আমেরিকান সিটিজেন হতে হবে। ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে সিটিজেন ছাড়া কেউ মাইনরের গার্জেন হতে পারে না। হুইচ মিনস্ ইউ হ্যাভ টু ড্রপ ইওর ইন্ডিয়ান সিটিজেনশিপ। আই উইশ ইউ ডু দ্যাট ফর ইওর নেফিউজ শেক। সে আরও জানাল, আমেরিকায় অবৈতনিকনয় কিছুই। গার্জেন এবং অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দুই-ই তুমি হতে পার এবং এজন্যে প্রপার্টির আয়ের মোট ২৫% তুমি পাবে। এবং আমার ধারণা ডাঃ চ্যাটার্জির এস্টেটের দাম ১২ মিলিয়নের কম হবে না। অর্থাৎ, সেই ডলার! ১২ মিলিয়ন মানে কত। ১ কোটি ২০ লক্ষ ডলার! ! তাকে ১৪ দিয়ে গুণ করে ১২% সুদ কষলে কাকেশ্বর কুচকুচের সেই সাত-দুগুণে-কত-হয় তা জানা যেতে পারে। কিন্তু, সেটাও আমার কাছে হবে একটা সংখ্যা মাত্র। আমি বড় পরাধীনভাবে টাকাকানা। জন্মান্ধ। এর অন্যথা হওয়ার নয়। পরপর দুদিন দুপুরবেলা ১২ চ্যানেলে একটা প্রোগ্রাম। দেখলাম। দেখে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেছে।

মারিপোজের এক ভদ্রমহিলার মেয়ে কাউন্টি স্কুলের স্কুল-লিভিং সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে, এদিকে সে এক লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না। দেশ-বিদেশ-ইতিহাস-ভূগোল কিছুই সে জানে না। সে শুধু জানে আমেরিকা। আমেরিকা পৃথিবীর সেরা দেশ। আর কেউ নেই।

কিছু নেই। জানিবার মতো আর কিছু নাই আমেরিকা ছাড়া! ভদ্রমহিলা ২০ মিলিয়ন ডলারের কেস করেছেন স্কুলের বিরুদ্ধে। তাঁর মেয়ের স্কুল-জীবনের ১২টা বছরের ১৩টা বাজাবার জন্যে।

পুরো কোর্ট-সিন দুদিন ধরে দেখাল। বিবাদিপক্ষের কৌঁসুলি আমেরিকার শিক্ষা-ব্যবস্থার যার নাম প্যান্টুল খুলে ছেড়ে দিলেন। তিনি দেখালেন, কীভাবে ইহুদিরা আমেরিকার মিডিয়াগুলো, টাকা, রাজনীতি এবং শিক্ষাকে কন্ট্রোল করছে। সমস্ত বড় কাগজ ওয়াশিংটন পোস্ট, টাইম, নিউজউইক, নিউ ইয়র্ক টাইমস সব… সব জু-দের কন্ট্রোলে! জুইশ ডিফেন্স লিগ, জুইশ ডিফেন্স

কংগ্রেস, সাইমন সেন্টার— এই সব হাই-প্রোফাইল ইহুদি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছে খ্রিস্টান আমেরিকাকে! ভদ্রমহিলার কৌঁসুলি ব্রায়ান ব্রথ নামে একইহুদি গডফাদারের বিরুদ্ধে খুব বিষোদ্গার করলেন। না জানি, তিনি কে। জুডাসের প্রেতাত্মা বিরচিত এই নতুন শিক্ষা-নীতি আমেরিকার নব প্রজন্মকে একটি পুরোপুরি হোবো এবং মোরোন জেনারেশনে পরিণত করে, নিতে চলেছে ভয়ঙ্কর প্রতিহিংসা, উপসংহারে তিনি জানালেন। স্কুল কর্তৃপক্ষের কৌঁসুলি ও শিক্ষা দপ্তর তাঁদের সওয়াল ও সাক্ষ্যে যেভাবে আমেরিকার নতুন শিক্ষানীতিকে ডিফেন্ড করলেন, তা শুনেই আমি বিশেষত তাজ্জব। বলা হল, হোমোসেপিয়ান মানুষ যখন হাত তুলে পায়ের ওপর দাঁড়াল, যখন হাত দুটি জানতে চাইল, আমি এবার কী করব সেই তখন থেকে মানুষের মাথার দিগন্ত খুলে যাওয়ার শুরু। তার আগে পর্যন্ত অন্যান্য চতুষ্পদের সঙ্গে মানুষের তো কোনও তফাতই ছিল না। কালক্রমে লাভ দাই নেবার থেকে তথাকথিত রেনেশাঁ-সহ, কম্যুনিজম-প্রমুখ বিবিধ সামাজিক মূল্যবোধে আক্রান্ত হতে থাকে মানুষের মাথা। এভাবে মানুষ আবার সেই চতুষ্পদের যুগেই ফিরে যাচ্ছে। সে হাতদুটি পুনরায় মাটিতে নামিয়ে দিয়েছে।

আমেরিকার নতুন বিপ্লবী শিক্ষানীতি চাইছে নতুন করে আবার মানুষকে দুটি হাত দেওয়ার জন্যে। যাতে, মানুষের মাথা নতুন করে সৃষ্টিশীল হয়। এবং, ফের মানুষ একটা নতুন দিগন্তের মুখোমুখি হয়। এই জন্যেই প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রীকে দেওয়া হয়েছে একটি করে পার্সোনাল কম্পিউটার। যা মনে রাখবে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, ওই কম্পিউটার মানুষের আর-একটি মাথা। যা-কিছু সৃজনশীল নয়, যা-কিছু নন-এসেন্সিয়াল, সেগুলো মনে রাখার দায়িত্ব তার! মানুষের মনোমন্দির থাকবে লেপাপোঁছা। খোলা থাকবে দরজা। যাতে নব নব সৃজনশীলতা সেখানে প্রবেশ করে ও আসন গ্রহণ করতে বাধা না পায়। দুদিন ধরে শুনে আমি ভাবলাম, মোটে দুটো। আমাদের রাবণের ছিল দশটা মাথা। কী হল শেষ পর্যন্ত? লঙ্কাকাণ্ড!

ছন্দার বর অমিয় লিভারডোরে ভেঙ্কটেশ্বর মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রধান হোতা, ওই মন্দির প্রসঙ্গে সে আমাকে বলেছিল এ-আর কী দেখছেন। কটা টাকা। আমেরিকার মোস্ট এক্সপেনসিভ টেম্পল হল সান্টা আনাতে। ৩০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে ওরা ওখানে চার্চ তৈরি করেছে। যিশু আসবেন বলে।

আমি বলেছিলাম, কিন্তু আমার ধারণা ঈশ্বর যদি আসেন তো আসবেন আমাদের ভাঙা মন্দিরে।

 

রোজ সন্ধেবেলা ১৯-চ্যানেলে যে কুইজ প্রোগ্রামটা হয় তার নাম:ইউ ক্যান ডু।

মঞ্চের পেছনে টাঙানো থাকে বিশাল কারুকার্যময় অক্ষরমালা দিয়ে তৈরি একটি বাক্য। শুরুতে অক্ষরগুলো থাকে ওল্টানো। অক্ষর দিয়ে তৈরি প্রতিটি শব্দের মধ্যে, যে-কোনও লিখিত বাক্যে যেমন, ফাঁক থাকে। কাল ছিল ৪২টি অক্ষর দিয়ে তৈরি ১১টি শব্দ। বলতে হবে ওখানে পুরো বাক্যটি কী।

তারপর দেখানো হল প্রায় আলিবাবার রত্নগুহা এক: এত প্রাইজ! এরপর নিলাম চলতে থাকে। সারা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আসা ভাগ্যান্বেষীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১০ জন দর-হাঁকিয়ে যখন মঞ্চে উঠল, ততক্ষণে সাত মিলিয়ন ডলার জমা পড়ে গেছে। এবার তারা এক-একটি অক্ষর বলে অজানা বাক্যটি সম্পূর্ণ করতে প্রয়াসী হয়।

প্রথম একজন হাসতে হাসতে আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে: আই উড কল ফর অ্যান N.

উন্মত্ত জাজের সঙ্গে ভাঙা-নৃত্যের রতিপটিয়সীদের মধ্যে একজন এগিয়ে গিয়ে শেষের অক্ষরটি উল্টে দেয়। বিপুল হর্ষধৃনি। দেখা গেল সেখানে একটি N ছিল। বহুবর্ণ আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে তা থেকে।

আর-একজন সহাস্যে বলল: আই নিড আ T. দেখা গেল T-ও রয়েছে। চিৎকার। নাচ সমানে চলেছে।

ইলেকট্রনিক ঘড়িতে টিক-টক, টিক-টক… সময় ৩০ সেকেন্ড। কারও মোট তিনবার না মিললে সে মঞ্চ থেকে নেমে আসবে। অর্থাৎ, পয়সা হজম।

আই নিড আ F.

নোও?

এ-ভাবে আধঘণ্টার মধ্যে, বাঁ-দিকে ON E শেষের দিকে ROB–R এবং একেবারে শেষে TAN পর্যন্ত তৈরি হতে না হতেই, অসমাপ্ত শব্দের বাকি অক্ষরগুলো মনে মনে বসিয়ে এবং ৪২টি অক্ষর আঙুলে গুনে, উঠে দাঁড়িয়ে একজন গড়গড় করে বলে গেল

ONCE UPON A TIME THERE LIVED A ROBBER NAMED AL CAPITAN.এ-ভাবে, বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালির মধ্যে, আল কাপিতান মুহূর্ত মধ্যে একজনকে রাজা ও নজনকে ফকির করে দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে মিলিয়ে গেল।

পলকের জন্য দেখা গেল তার পাখি-পালকের উষ্ণীষ এবং উদ্যত বর্শা। তাকে এরা কেউ কখনও দেখতে পায়নি। পেল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *