০৯. ডাউন উইথ আমেরিকা! ডাউন! ডাউন!

ডাউন উইথ আমেরিকা! ডাউন! ডাউন!

৪ মে।

১১ মে শনিবার শ্রাদ্ধ হবে। নিয়মমাফিক ৯ তারিখ। কলকাতা থেকে সেইরকমই বলেছিল। শনিবার ছুটির দিনে এগিয়ে দিতে হয়েছে।

শ্রাদ্ধ হবে এখান থেকে ৯০ মাইল দূরে লিভারমোরের ভেঙ্কটেশ্বর মন্দিরে। ছন্দারা বাড়ি চলে গেছে। শ্রাদ্ধের যাবতীয় দায়িত্ব নিয়েছে অমিয় আর ছন্দা। ওরা কাছাকাছি থাকে। অবশ্য এখানে দূর বলে কিছু নেই। যে-কোনও কাজের ব্যাপারে ফোন তুললেই ও-দিক থেকে মিষ্টি স্মিত স্বর:মে আই হেল্প ইউ?

অঞ্জন যথাসম্ভব অশেীচ পালন করছে। মাংস খাচ্ছে না। চালচলনে ও চেহারায় ২৪/২৫ বছরের যুবকের মতো হলেও, আসলে তো ১৫ প্লাস, গোঁফ-দাড়ি যথাকালে ছাড়া গজাতে চায়নি। দাড়ি রাখার তাই প্রশ্ন ওঠেনি। পৈতে ছাড়া শ্রাদ্ধ হয় না বলে সে আমার থেকে এক দণ্ডি পৈতে নিয়েছে। এবং চাবি লাগিয়ে গলায় তা পরেও আছে। তবে জামা ও হাওয়াই চপ্পল পরছে।

ফিউনারাল সার্ভিসের দিন কাউন্ট হল শোকার্থীতে ভরে গিয়েছিল। গোটা মার্সে ফেয়ারগ্রাউন্ড গাড়িতে ভর্তি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, এখানে গ্যারেজ নেই এবং বাড়ি প্রতি অন্তত দুটি করে গাড়ি সামনের লনে খালি দেশলাই বাক্সের মতো অবহেলায় পড়ে থাকে। তাছাড়া, আমি শুনেছি, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বলে কিছু, এক টেলিফোনে-ট্যাক্সি ছাড়া, অন্তত ক্যালিফোর্নিয়ার স্মল টাউন গুলিতে থাকে না। অবশ্য, মার্সেদ ছাড়া কোনও শহর আমি এখনও দেখিনি।

কাউন্টি হলে মঞ্চের সামনে, মেঝের ওপর ট্রলিতে তিনটি ক্যাসকেট, দুদিকে রঞ্জন ও সুমিতা, মাঝখানে জীয়ন। জীয়নের ক্যাসকেটটি অপেক্ষাকৃত ছোট, তার ওপর ওর খেলনা এল এম জি যা থেকে একদিন সেকেন্ডে একশত জলবুলেট বেরুত ঝাঁকে ঝাঁকে। রঞ্জন ও সুমিতাকে চিহ্নিত করার জন্যে ওদের ক্যাসকেটের ওপর ছন্দা রঞ্জনের বাবুমশাই ধুতি ও গরদের পাঞ্জাবি এবং সুমিতার প্রিয়তম শাড়ি নীল জমির ওপর রুপালি বুটিদার বেনারসী বিছিয়ে দিয়েছে।

এর সবটাই ছন্দার কল্পনা। দেখে আমার বিশ্বাস হল, সত্যিই ওরা ছিল অনসূয়া-প্রিয়ংবদা। অথচ ফ্রিমন্ট থেকে ফোন করে পূজ বলল…

অন্যদিকে, ছন্দা আমাকে ধূজ সম্পর্কে যে কথা বলেছে, তাতে ধূর্জটিকে তো নরাধমই বলতে হয়। ২৭ এপ্রিল ভোরবেলা কাগজ দেখেই ছন্দা ধূর্জটিকে ফোন করেছিল: তোমরা তো একঘণ্টার ফ্লাইটে থাক। তোমরা কি যাচ্ছ? তার তখন হাত-পা কাঁপছে, ধূর্জটি ছিল না। বৌ বলল, ভাই, ওর কারখানায় এখন যে রেটে লে-অফ হচ্ছে… ও তো যেতেই পারবে না। তখন অমিয় ফোন করে বসকে বলল, যা ভাল বোঝেন করবেন। আমি যাচ্ছি। ছন্দা কাজ করে রিয়েল এস্টেট কেনাবেচার অফিসে। সে অফিসে খবর দেয় মার্সেদে পৌঁছে, তবে ওরা একবস্ত্রে গাড়ি নিয়ে বেরয়। বিকেলবেলা মার্সেদ পৌঁছে শুনল, ভোরের প্লেনে মার্সেদ পৌঁছে মিঃ অ্যান্ড মিসেস ধূজ সাড়ে তিনটের ফ্লাইটে ফিরে গেছে। অঞ্জন তখন রেড্ডি দের বাড়িতে দরজা-বন্ধ বন্দী। নন্দিন বাড়ির চাবি ওদের দিয়েছিল। সারা বাড়ি তছনছ করে, বিশেষ করে কম্পিউটার রুমে, ওরা কী খুঁজেছিল? কী পেয়েছে? কী নিয়ে গেছে? ওরা কে? কবার দেখা হয়েছে ওদের রঞ্জনদাদের সঙ্গে? কতদিনের আলাপ? এই সব প্রশ্ন ক্রুদ্ধা ফণিনীর মতো ছন্দা আমার সামনে রাখতে থাকে। এখানে সবচেয়ে কঠিন কাজ আমার একটাই। কাকে বিশ্বাস করব আর কাকে করব না। সমগ্র ফিউনারাল সার্ভিসটা ছিল মোট দশ মিনিটের অনুষ্ঠান। শেষে কালো স্যুট পরে ভারতীয় দর্শন কিন্তু আত্মায় আমেরিকান (বার্মিংহাম ট্রিবিউনের ইন্টারভিউতে অঞ্জন তাই বলেছিল—এত সাবালক! )—একপোঁচ কম সাদা, বয়স মাইনাস-১৬, মার্সেদ ড্রাগন ফুটবল ক্লাবের সফলতম স্কোরার যখন মঞ্চ থেকে মাত্র একটি বাক্যের ধন্যবাদ জানাল, তখন ভাগ্যিস দুফোঁটা জল এসে আমাকে বলে গেল তুমি চক্ষুষ্মন…নইলে তো নিজেকে অন্ধ ভাবতাম! আমি তৃপ্ত হলাম এই ভেবে যে, আমার উপদেশ মতো মাত্র একটি বাক্যই সে বলেছে, নয়ত, আমি তাকে বলেছিলাম, দুটি সেনটেন্স বলতে গেলে তুমি হয়ত কেঁদে ফেলবে এবং সেটা তোমার বাবার সম্মানের পক্ষে উপযুক্ত হবে না। লোকে তোমাকে দুর্বল ভাববে। হ্যাঁ, এই প্রথম অঞ্জন আমার একটা কথা শুনেছে বটে। তবে এখানেও দেখলাম সে তার স্বেচ্ছাচার ঈষভাবে প্রয়োগ করল। ও বলল, লেডিজ অ্যান্ড জেন্টেলমেন, প্লিজ অ্যাকসেপ্ট মোস্ট সিনসিয়ার থ্যাঙ্কস অন বিহাফ অফ মাইসেলফ অ্যান্ড মাই ফ্যামিলি। আমি বলেছিলাম ফ্যামিলির আগে চ্যাটার্জি শব্দটি রাখতে।

অনুষ্ঠান ১০ মিনিটের। কিন্তু রীতিমাফিক করমর্দন চলল প্রায় একঘণ্টা ধরে। শোকার্থীদের অধিকাংশই সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে এসে পাশাপাশি আমাদের দুজনের হাত পরপর ধরে প্রায় ফিসফিসিয়ে কিছু না-কিছু সন্তপ্ত মোনোসিলেবিল উচ্চারণ করে গেলেন। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম: শোক বলতে এরা বোঝে স্তব্ধতা। পিয়ানোর সুরে কিন্ডারগার্টেনের স্বর্গচ্যুতা পরীশিশুরা যে শোকগান গেয়ে চলেছে তাও যেন রাগিণী নীরবতায়।

লক্ষ্য করলাম শোকজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে অনেকেই যখন হাত-নাড়া দিয়ে অঞ্জনকে বললেন, হাউ একজ্যাক্টলি ইউ লুক লাইক ইওর আঙ্কল..অঞ্জন রীতিমত অস্বস্তি বোধ করছে। বস্তুত, তার জুতো ঘষার শব্দ আমি দুএকবার শুনতে পেলাম।

মডেস্টো ক্রিমেশান হোমে পাশাপাশি তিনটি বিদ্যুৎ-চিতার মধ্যে তিনখণ্ড বিশাল পাঊরুটি, সেঁকা হবে বলে, কত ব্যঞ্জনাবিহীনভাবে ঢুকে গেল।

বাবা-মা-ভাই পুড়িয়ে, গায়ে মেখে চিতার ছাই, অঞ্জন সে-রাতে মুভি দেখতে গেল।

নইলে নাকি, বন্ধুরা ওকে উইক ভাববে!

হতভাগা!

আর, এই যদি হয় আমেরিকার নব-প্রজন্মের সবল ছেলেরা, তবে তারা গোল্লায় যাক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *