০৫. ডাকোটা থেকে জাম্বো জেট-এ

ডাকোটা থেকে জাম্বো জেট-এ

ডাকোটায়, অ্যালুমিনিয়ামের বেঞ্চিতে বসে, কোমরে বেঁধে ক্যাম্বিসের বেল্ট, হিরণ একবার জোড়হাট গিয়েছিল। সেট লিগ্যাসিও লেদুর নেই। তবে, এয়ার ইন্ডিয়ার দোতলা জাম্বো জেট, শ দুয়েক নাকি প্যাসেঞ্জারই যাচ্ছে, এ-সম্পর্কে কোনওরকম পূর্ব-ধারণা তাদের দুজনের কারোরই ছিল না। দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত, হাতে অমন এক জবরদস্ত বিদেশ-রেখা থাকা সত্ত্বেও, গত বিশ-পঁচিশ বছর ধরে সহাস্যে হিরণ শুধু সি-অফই করে যাচ্ছিল। রান-ওয়ে ধরে ধীর ও গম্ভীরগতিতে, যেন কোথাও যাবার নেই এমনভাবে চলে সেই শান্ত, অননুমেয় ইউ টার্ন, তারপর যা ভাবতেও পারা যায়নি, সহসা স্পিড বাড়িয়ে ধোঁয়া এবং গর্জনের মধ্যে শেষ পদাঘাতে মাটি কাঁপিয়ে কেউ নীল আকাশে মিলিয়ে গেছে তীর হয়ে, কেউ ঢুকে গেছে মেঘের মধ্যে মেঘ হয়ে, যেদিন যা। গত সেপ্টেম্বরে নন্দিন ঢুকে গেল শরতের সাদা মেঘের মধ্যে। মেঘই হয়ে গেল। তখন সন্ধেবেলা, ফেব্রুয়ারির শীতের বিকেল, সেদিন আকাশ ঝকঝকে নীল, যেদিন, যখন, সুমিতা শেষবারের মতো মিলিয়ে গেল নীলিমা ও নৈরাজ্যে।

গত ২৬ বছরে শুধু রঞ্জনকেই সি-অফ করেছে তা বারপনের তো হবেই। প্রথমবার অবশ্য হাওড়া স্টেশনে, জাহাজ ছিল বোম্বে থেকে তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় ওরা চার বন্ধু, চুনী, অরুণেশ, বিষ্ণু আর রঞ্জন। বগির গায়ে টাঙানো লালু শালু: হরি সিং, ট্রাভেল এজেন্ট। এক গাড়ি লোক বিদেশ যাচ্ছে শুধু কলকাতা থেকেই। ওদের মধ্যে অরুণেশ আর রঞ্জন ফিরে এসেছিল একসঙ্গে, ৫/৬ বছরের মধ্যে। দুজনেরই তখন এফ-আর-সি-এস করা হয়ে গেছে।

রঞ্জন ফিরে গেল মাস দুই পরে। অরুণেশ গেল না।

আমার দাদা হবার কথা ছিল গাইনি। রঞ্জনই বলল, তোের আঙুল বেঁটে, তোর আঙুল বেঁটে, পদবী ধাড়া, ধাড়া; তুই অর্থোপিডিক্স কর। এবার পুজোর আগে অলিম্পিয়ায় দেখা, খুব মালটাল খেয়ে অরুণেশ একা বসে ছিল। মদ খেলে বড় বাক্যের মধ্যে অধীন ক্লজগুলো ও দুবার করে বলে, এক প্রিন্সিপালটি ছাড়া, এটা সে আগেও দেখেছে।

রঞ্জনরা এখন কোথায় দাদা? সে জানতে চায়।

মাস দুই আগের কথা, তখনও ওরা বহালতবিয়তে বেঁচে, হিরণ তাই বলেছিল, মার্সেদে। বলে মাসে কোথায় ওকে বোঝায়। আরও মদ খেয়ে অরুণেশ বলেছিল, আমার দাদা রোজগার, আনঅফিসিয়ালি বলছি আপনাকে, আনঅফিসিয়ালি বলছি, এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে, এ মাস থেকে ১০ হাজার ক্রশ করেছে।

মাসিক না দৈনিক? হিরণ ভেবে দেখল, কলকাতার বিখ্যাত অর্থোপিডিক্স সার্জন নিঃসন্দেহে দিনমজুরির কথাই বলেছে।

অথচ, অরুণেশ তার সত্যিই খুব বাঁটকুলে আর থ্যাবড়া আঙুলগুলোর দিকে অনেকক্ষণ সস্নেহে তাকিয়ে থেকে বোধহয় রঞ্জনের কথাই ভাবছিল, অথচ, দেখুন দাদা, আমি ধাড়া। আমি ধাড়া। আর রঞ্জন পড়ে আছে ধাড়ধাড়া মার্সেদপুরে। মার্সেদপুরে। তাই না? হাঃহাঃহাঃ। এবার প্রিন্সিপাল ক্লজটিতেও সে দ্বৈততা দেয়, হাঃ-হাঃ-হাঃ।

এই সেটেলাইট প্যাড থেকে মেঝেয় পদাঘাত করে, আমাকে লঞ্চ করতে আমার সাবপোস্টমাস্টার বাপের, বাপের, খরচা হয়েছিল কত জানেন দাদা? কত জানেন দাদা সাড়ে ৭০০ টাকা। জাহাজে বিস্কুট খেয়ে থাকতাম। বিস্কুট খেয়ে থাকতাম। রঞ্জনের কত লেগেছিল দাদা?

রঞ্জনের সেকালেই হাজার চারেক লেগেছিল। অরুণেশের মাত্র ৭৫০? রঞ্জন একটা স্যুট করিয়েছিল বটে মহম্মদালি থেকে হাজারখানেক তো হিরণই দিয়েছিল অফিস কো-অপারেটিভ থেকে ধার করে। তা, অরুণেশ কি ইজের পরে গিয়েছিল?

গত বছর নন্দিনীকে সি-অফ করতে যাওয়াটাও এ জীবনে ভোলার নয়। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬। ফ্লাইট নং জিরো-জিরো-থ্রি। রাত ৯ টা। আত্মীয়-স্বজন সব ঝেটিয়ে এসেছে এয়ারপোর্টে। বিশেষ করে নন্দিনের মামার বাড়ির লোক। এয়ার ইন্ডিয়ার মূল ফ্লাইট বোম্বে থেকে। কাল সন্ধেবেলা। বোম্বে, লন্ডন, নিউইয়র্ক। সেখান থেকে ইন্টার্নাল ফ্লাইটে ক্যালিফোর্নিয়া। বেশ জটিল ভ্রমণ-সূচি। যাচ্ছে, একা। অবশ্য, এয়ার ইন্ডিয়া দায়িত্ব নিয়েছে। নিউইয়র্কে প্লেন ধরিয়ে দেবে বলেছে।

৮টার সময় চেকিং-এ ডাকল। ৮টার সময় সবাই ভেতরে চলে গেল। থেকে গেল শুধু হিরণ, আর লেদু। লেদু বলল, প্লেন উড়ে যাওয়া পর্যন্ত দেখে যাবে।

ভাগ্যিস ছিল। বোম্বে নিয়ে যাবার জন্যে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর প্লেনটা, প্রথমে বলতে লাগল, লেট। তারপর রাত ১২টা নাগাদ নন্দিন সুটকেস-বোঝাই ট্রলি ঠেলে সিকিউরিটি-বেড়া পেরিয়ে হাজির। বলল, বাবা, প্লেন আসবে কাল ভোরে। আমাদের আজ এয়ারপোর্ট হোটেলে রাখবে। যান্ত্রিক গোলযোগ। বলে হাসল।

আমাদের? ওর পাশের ভদ্রমহিলা বললেন, নমস্কার। আমি সূলতা সরকার। আমিও সানফ্রান্সিসকো যাচ্ছি। খুব ভাল লেগেছে আপনার মেয়েকে। আমি ওকে নিয়ে যাব। হোটেলে আজকের রাতটা দুজনে একসঙ্গে থাকব। আপনি চিন্তা করবেন না। বাড়ি চলে যান।

লেদু আর হিরণ সারারাত এয়ারপোর্টে থেকে গেল। লেদুর মোটর সাইকেল আছে। কোথা থেকে একটা রাম কিনে আনল। সেটা শেষ করতে বার-কয়েক টয়লেটে যেতে যেতেই রাত কেটে গেল।

যান্ত্রিক গোলযোগ বলে যে মেয়ে অমন সাহসী হাসি হাসতে পারে, পরদিন ভোরে সে অমন কাণ্ড করবে তা কে ভাবতে পেরেছিল।

১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৬। ভোরবেলা। হাওয়া জোরে বইছে। একটু জোলো, অন্তত শীত-শীত লাগছে বেশ। হিরণ আর লেদু শুধু ওরা দুজন তিনতলায় এয়ারপোর্টের দিকে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে। প্যাসেঞ্জারদের জন্য ঢাকা করিডর দু-ভাঁজে ঢালু হয়ে নেমে গেছে প্লেনের প্রায় দরজা পর্যন্ত। প্যাসেঞ্জাররা প্লেনে উঠছে। প্লেন প্রায় দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।

প্রথম ভাঁজের মুখে আগে সুলতা তারপর নন্দিনকে দেখা গেল। দু-হাতে দুটো মস্ত সুটকেস, বাঁক নিয়েই সে বাঁ-দিকে মুখ তুলে তাকায় এবং ছাদের আলসেয় হিরণ আর লেদুকে দেখতে পায়! বারান্দায় শুধু তারা দুজন। একজন বেঁটে, একজন লম্বা। ভুল হবার কথা নয়। করিডরের দ্বিতীয় ভাঁজের মাঝামাঝি পর্যন্ত এসে নন্দিন সেই অপ্রত্যাশিত কাণ্ডটা ঘটায়।

সে সুটকেস দুটি ধীরে নামিয়ে রাখল। আহা, অত ভারি আর যা রোগা মেয়ে। অত বোঝা আর টানতে পারছে না বেচারা, হিরণ ভেবেছিল। কেন যে অত জিনিস দিতে গেল চিনু। কিন্তু, তা নয়। সেজন্য নয়।

তারপর, হঠাৎ, একেবারে অপ্রত্যাশিত, নীলিমা থেকে বজ্রাঘাতের মতো, বলা নেই, কওয়া নেই, দুদিকে দুই সুটকেস, মধ্যিখানে নন্দিন, করিডরের কাচের দেওয়ালে মাথা রাখল।

ঢাকা করিডর। স্বচ্ছ টানেলের মতো। খোলা থাকলেও শোনা যেত না। বেশ, অনেকটা দূরে। চোখের জল দেখা যেত না। তবু, হিরণ, বুঝল,নন্দিন কাঁদছে।

সে এক সত্যিই, বড় অসহ্য ছবি। ছবিই তো। শব্দ নেই, স্পর্শ নেই— ঢালু করিডর দিয়ে প্যাসেঞ্জাররা দ্রুত নেমে যাচ্ছে, শুধু নন্দিন একা দাঁড়িয়ে। কেঁদে চলেছে। চলচ্চিত্র যখন মুখর হয়নি, সেই সাইলেন্ট যুগের একটি লঙ-শট যেন। নিচে সাব-টাইটেল:বাবা, কী অপরাধ করেছিলাম যে এ-ভাবে যেতে দিচ্ছ: বাধা দিচ্ছ না?

সুলতা সরকার ফিরে এসে ওর পিঠে হাত রেখেছেন।

ঐ যে, সুটকেস তুলে নিচ্ছে নন্দিন। প্লেনে ওঠার সিঁড়ির নিচের দিকটা করিডর আড়াল করেছে। ওপরের অংশ পুরোটা দেখা যায়। কারুকে বিদায় দেবার জন্য কেউ দাঁড়িয়ে নেই, তবু অনেকেই হাত নেড়ে প্লেনে ঢুকল। শেষ দুই যাত্রী ছিল সুলতা আর নন্দিন। সুলতা তাদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন। কিন্তু, করিডরের বাকি পথ বা সিঁড়ি থেকে নন্দিন একবার ফিরেও তাকাল না।

প্লেনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পিছুটানের তুলনায়, সামনে থেকে টানটা সব সময়েই বেশি শক্তিশালী, ভাগ্যিস। নইলে, হিরণ যা ভয় করেছিল, ফিরে না আসে মেয়েটা। বা, সে নিজেই হাত নাড়ানোর বিদায়-ভঙ্গিমা পাল্টে না বলে ওঠে, যেতে হবে না। চলে আয়! মৃতের তুলনায় যে-জীবিত, তার বেঁচে থাকা অনেক বেশি ইমপর্টান্ট, ভাগ্যিস। নইলে তো মৃতের জন্য পিছনের জন্য, বিলাপ করেই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত।

তবে জীবন জুড়ে বিদায়-নাটকের সেরা দৃশ্য তবু এটা নয়। সেটা দেখা দিয়েছিল ক্লারা আর কুমুদকে বিদায় দেবার সময়। গ্রিস থেকে এসে, এখানে বিয়ে করে; ওরা বায় ল্যান্ড গ্রিসে ফিরে যাচ্ছে। স্থান:হাওড়া স্টেশন। ট্রেন ছাড়ার পূর্ব-মুহূর্তে শ্বেতাঙ্গিনী বন্ধুপত্নী জানালার কাছে তাকে ডেকে এনে বলল, হিরণ, তুমি তো আচ্ছা লোক। আমাদের বিয়ের পার্টিতে সামওয়ান ওয়জ মেকিং পাসেস অ্যাট ইওর ওয়াইফ অল দা হোয়াইল, আর তুমি এমন ড্রাঙ্ক হয়ে গেলে যে তা নোটিসই করলে না।

এ-সব যৌবনকালের দৃশ্য। তখন বছর খানেকও হয়নি তাদের বিয়ে হয়েছে। শুনে ভর্তি চায়ের খুরি মাটিতে আছড়ে ফেলে হিরণ ছুটে চলেছে ট্রেনের সঙ্গে আর বলে চলেছে কে, কে, তুমি নাম বলে যাও ক্লারা, প্লিজ, যে কোন শালা আর জানালায় অপসৃয়মাণ জাস্ট-ম্যারেড ক্লারা হাসতে হাসতে তখন আঙুল তুলে তার অট্টহাস্যমুখর বরকে দেখাচ্ছে… অবশ্যই ঠাট্টা। বিদায়দৃশ্যগুলির মধ্যে ত এটাই, সবাইকে ছাপিয়ে, সবচেয়ে কাছের জিনিস হয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *