১৫. নারকীয় রাত
সে ভারি দুঃখের ব্যাপার, আমরা এতো কষ্ট করে ডাকাতদের হদিস জোগাড় করে আনলাম কিন্তু ডাকাতদের বাধা দেয়ার সব পরিকল্পনা করা হল আমাদের কোন কথা না শুনেই। এমনকি ইসমাইল খাঁ একবার আমাদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বললেন! রবিন অসহায় রাগে বসে বসে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে আমাদের দিকে তাকাল।
সলিলকে ইসমাইল খাঁর ছোট ছেলের সাথে থানায় পাঠান হল। সলিল অবিশ্যি যেতে চাচ্ছিল না এখানকার মজাটাই সে দেখতে চায়, কিন্তু ওকে বোঝানো হল সে ফিরে এসেও মজা দেখতে পারবে।
ইসমাইল খাঁ চুপিচুপি কি আয়োজন করলেন আমরা জানতে পারলাম না। প্রচুর লোক জোগাড় করা হচ্ছে, গোপনে আরো দুটি বন্দুক আনা হয়েছে আর করিমন নামের মেয়ে লোকটিকে আটকে ফেলা হয়েছে এটুকুই শুধু টের পেলাম। কিন্তু ঠিক কিভাবে ডাকাতগুলিকে ধরা হবে, কিংবা ধরা হবে কিনা, কিছুই জানতে পারলাম না। আমাদের যখন কোন গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না তখন ভীষণ খারাপ লাগছিল। রবিন একবার একটা বুদ্ধি বাতলে দিতে গেলে ইসমাইল খাঁ মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, তোমরা ছেলে ছোকরারা এর মাঝে কেন?
রবিন চোখ মুখ লাল করে ফেরত আসল। অনেকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে এক সময় আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, চল পালাই।
কোথায়?
বাইরে, এদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে, ঠিক আসল সময়টাতেই আমাদের বের হতে দেবে না!
ঠিক বলেছিস! বলে আমরা খুব অন্যমনস্ক ভঙ্গি করে চুপিচুপি বাইরে বেরিয়ে এলাম। এতো উত্তেজনা এবং ব্যস্ততার মাঝে আমাদের কেউ খেয়াল করল না।
.
বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে একটি বড় পেয়ারা গাছ পাওয়া গেল। আমরা চুপিচুপি সেটাতে উঠে বসলাম। আমি ভাঙা হাত নিয়ে কিছুতেই উঠতে পারছিলাম না, অন্যেরা টেনে তুললো। অনেক উপরে বেশ আরাম করে বসে রবিন বলল, এই জন্যে আমরা নিজের ফাইট দিতে চাচ্ছিলাম! দেখলি? আমাদের কেউ পাত্তা দিচ্ছে না?
ওদের দোষ কি। দেখেছে বয়েস কম।
বয়েস কম? বয়েসই কি সব? আমাদের কি ইয়ে কম আছে নাকি?
কিয়ে?
বুদ্ধি, সাহস, অস্ত্রশস্ত্র, কায়দা? আমরাই সব করলাম, অথচ অথচ –
আমরা চুপ করে থাকলাম। রবিন গজগজ করতে লাগল, ওর দুঃখ পাবার ন্যায্য কারণ আছে।
.
খানিকক্ষণ পরে দেখি ইসমাইল খাঁর লোকজন আমাদের খোঁজ করছে। নাম জানে না তাই খোকারা, খোকাসকল বলে ডাকছে। আমরা হাসি চেপে চুপচাপ গাছের ডালে বসে রইলাম। হীরা ফিসফিস করে বলল, খোঁজ ব্যটারা খোঁজ!
যখন খুঁজে পেল না তখন শুনলাম বলাবলি করছে, রাগ করেছে নাকি? কেউ নজর দিচ্ছিল না। না খেয়ে আছে নাকি কে জানে!
ধাপ্পা দিল না তো?
আজকালকার ছেলে ছোকরা।
হয়তো মজা করার জন্যে তবু সাবধান থাকা ভাল। বলা তো যায় না!
না মজা করেনি। ওদের একজন থানায় গেল না?
তা বটে। কিন্তু অন্যেরা গেল কই?
আমরা গাছে বসে খিকখিক করে হাসতে লাগলাম।
অনেকক্ষণ হল আমরা গাছে বসে আছি। আকাশে ভাঙা একটা চাঁদ, একটা নবম জ্যোৎস্না ছড়িয়ে আছে – ডুবতে দেরি নেই। বেশ ঠাণ্ডা বাতাস, অল্প অল্প হিম পড়ে মাথা ভিজে যাচ্ছে। কি একটা পাখি কাকক্যাক করতে করতে উড়ে গেল।
এক সময়ে ইসমাইল খাঁর বাড়ির সব আলো নিভে গেল। চুপচাপ সুমসাম করছে। বাইরে থেকে দেখে কে বুঝবে ভিতরে ভিতরে বাড়িটার চারিপাশে শক্ত পাহারা, লাঠি, সড়কি বন্দুক নিয়ে শ’খানেক লোক লুকিয়ে অপেক্ষা করছে।
.
বসে থাকতে থাকতে তন্দ্রামত এসে গেল, মনে হচ্ছে কয়েক যুগ বসে আছি। হঠাৎ রবিন খোঁচা মারল, আমি চমকে উঠলাম। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল দূরে ছায়ার মত কারা যেন চুপিচুপি গুড়ি মেরে আসছে। আমার দম বন্ধ হয়ে এল, বুকের ভিতর স্পষ্ট শুনতে পেলাম ঢিপঢিপ ঢিপঢিপ শব্দ। টিপু আমার কাঁধ খুব শক্ত করে খামচে ধরল। লোকগুলি ঠিক পেয়ারা গাছটার নিচে দিয়ে চুপিচুপি হেঁটে গেল ইসমাইল খাঁর বাড়ির দিকে। অন্ধকার তাই চেহারা ছবি দেখা যায় না, শুধু বন্দুকের নল আর লম্বা লম্বা লাঠি সড়কির মাথাগুলি আবছা দেখা যাচ্ছিল। লোকগুলি ভিতরে উঠনে ঢুকতেই রবিন নড়েচড়ে উঠল, ফিসফিস করে বলল, চল নামি।
মানে?
ভিতরে গিয়ে দেখি।
কি সর্বনাশ! এখন মারামারি হবে!
দেখবি না?
ভীতু বলে প্রমাণিত হতে হয় তাই চুপিচুপি সরসর করে গাছ থেকে নামতে লাগলাম। আমি তখনো নামিনি, প্লাস্টার করা হাতটা নিয়ে একটু বেকায়দায় পড়েছি। অমনি হঠাৎ দ্রুমদ্রাম গুলির শব্দ হল। স্যাঁৎ স্যাঁৎ করে চারদিকে মশাল জ্বলে উঠল হৈ চৈ শব্দে শ’খানেক লোক ডাকাত গুলোকে ঘিরে ফেলল।
আমি গাছ থেকে লাফ দিলাম। ভিতরে তখন ভীষণ হৈ চৈ মার মার শব্দ। গ্রুম গ্রুম করে গুলি হচ্ছে – দু একটা আর্তনাদ শুনলাম। কোথাও আগুন লেগে গেছে, চড় চড় শব্দ হচ্ছে, ভীষণ আলো হয়ে সবকিছুর লম্বা লম্বা ছায়া পড়েছে। ঠাশ ঠাশ করে লাঠির শব্দ হতে থাকল, কে একজন গুলির মত আমাদের পাশ দিয়ে ছুটে গেল।
আমরা স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। রবিন দৌড় দিয়ে ভিতরে যেতে গিয়ে একটা বাঁশের সাথে পা বেঁধে ভীষণ জোরে আছাড় খেল, ভাগ্যিস হাতের রিভলবারে ট্রিগারে চাপ পড়ে গুলিটুলি বের হয়ে যায়নি। আমরা কাছে গিয়ে দেখতে পেলাম, বাঁশটা ডাকাতদের কীর্তি। কেউ পিছু নিতে গেলে পা বেঁধে আছাড় খেয়ে পড়বে! আমরা বাঁশটা খুলে নিলাম ঠিক এমন সময় দেখা গেল ভিতর থেকে কে একজন গ্রুম গ্রুম করে গুলি করে ছুটে আসছে। পিছনে পিছনে অনেক লোক। মশালের আলোতে দেখলাম বাম হাত কাটা সেই ভয়াবহ ডাকাত সর্দার! সর্দারটা ওখানে দাঁড়িয়ে আবার লোকজনের দিকে নির্মম ভাবে গুলি করল, সবাই হুটোপুটি করতে করতে ভিতরে সরে গেল। তারপর কাটা হাতে বন্দুকটা বুকের সাথে চেপে ধরে কিভাবে জানি খুলে গুলি ভরে আমাদের দিকে ছুটে আসতে লাগল।
আমরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছি, সর্দারটি আমাদের দেখেনি। বুঝতে পারছি পাশ দিয়ে ছুটে যাবে। আমার মাথায় কি ভর করল জানি না ডাকাতটি ছুটে ঠিক আমাদের পাশে আসতেই হাতের লম্বা বাঁশটি তার পায়ের ভিতর ঢুকিয়ে দিলাম।
হঠাৎ বাঁশে পা লেগে ডাকাত সর্দার তাল হারিয়ে দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেল। বাঁশের ধাক্কায় আমি টিপুকে নিয়ে ছিটকে পড়লাম অন্য পাশে। টিপুর হাতের টর্চলাইট আমার কপালে ঠুকে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ে জ্বলে উঠল। আমি তুলে নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ডাকাতটির মুখে ধরলাম কিছু না বুঝেই।
রবিন রিভলবারটা সোজা ডাকাত সর্দারের বুকের দিকে তাক করে ধরে বলল, একটু নড়বে কি গুলি করে দেব।
ডাকাত সর্দারের চোখ ধ্বক করে জ্বলে উঠল। কাটা হাতটায় ভর দিয়ে সে আস্তে আস্তে উঠে বসল। তারপর খুব ধীরে ধীরে ডান হাতে ধরে থাকা বন্দুকটি রবিনের দিকে ঘুরিয়ে আনতে লাগল।
খবরদার! রবিন হিস হিস করে চেঁচিয়ে উঠল!
খবরদার, নড়বে না— গুলি করে দেব! ডাকাতটির মুখ বিকৃত হয়ে উঠল, তবু সে আস্তে আস্তে বন্দুকটি ঘুরিয়ে আনতে লাগল।
খবরদার! রবিন পাগলের মত চিৎকার করে উঠল তবু গুলি করল না।
আমি শিউরে উঠে বুঝতে পারলাম রবিন যতই চেঁচামেচি করুক আসলে সে গুলি করতে পারবে না। একটা মানুষকে সামনাসামনি গুলি করতে মন যতটুকু শক্ত হওয়া দরকার রবিনের মন ততটুকু শক্ত নয়। ডাকাতটি এতক্ষণে বন্দুক ঘুরিয়ে এনে রবিনকে তাক করেছে, মুখে মনে হল একটা ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল। পিছন থেকে অনেক লোক ছুটে আসছে, কিন্তু লাভ কি? সামনাসামনি দুজন দুজনকে তাক করে আছে। কে আগে গুলি করে— কে আগে গুলি করে— কে আগে…
আমি চোখ বুজে একটা চিৎকার করে উঠলাম সাথে সাথে একসাথে অনেকগুলি গুলির আওয়াজ হল। চিৎকার আর্তনাদ, চেঁচামেচি, বারুদের গন্ধে পরিবেশটা নারকীয় হয়ে উঠল। আমি মুখ ঢেকে বসে পড়লাম কে গুলি খেয়েছে দেখার সাহস নেই। রবিন না ডাকাত সর্দার? রবিন না ডাকাত সর্দার? রবিন না—
এমন সময় বহুদূরে রাইফেলের গুলির আওয়াজ হল, পরপর অনেকগুলি। পুলিস আসছে। ইসমাইল খাঁর গলার আওয়াজ শুনলাম, ছেলেগুলির কিছু হয়নি তো?
না। কে একজন বলল, শুধু হাত কাটা ছেলেটা –
হাত কাটা ছেলেটা? আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে এসে প্রচণ্ড শব্দে ধ্বক ধ্বক করে উঠল।
শুধু হাত কাটা ছেলেটা ফিট হয়ে গেছে।
গুলি টুলি লাগেনি তো?
না।। পানি আন, পানি আন
খুব ধীরে ধীরে বুক থেকে একটা আটকে থাকা শ্বাস বের করে আমি আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালাম। হাজার হাজার মানুষ গিজগিজ করছে। রক্তে মাখামাখি ডাকাত সর্দারকে ধরে সরিয়ে নিচ্ছে, চেঁচামেচি হৈ চৈ দৌড়াদৌড়ি পড়ে গেছে।
কে একজন আমাদের পিঠে হাত দিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেল। রবিনকে আগেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, ওর মাথায় মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে বাড়ির মেয়েরা। চারদিকে ভিড়। আমরা ওকে ঘিরে বসলাম, অন্যের ঠেলেঠুলে আমাদের জায়গা করে দিল।
রবিন হঠাৎ চোখ খুলল। খানিকক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে সবকিছু মনে করে নিল। এদিক সেদিক তাকিয়ে আমাদের দেখে হঠাৎ উঠে বসল তারপর খপ করে আমার হাত আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, মরে গেছে! মরে গেছে লোকটা?
আমি বললাম, না।
রবিন একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কেঁদে ফেলল। এই প্রথম আমি রবিনকে কাঁদতে দেখলাম। যখন কাঁদার কোন অর্থ নেই— প্রয়োজন নেই। কারণ নেই।
আমরা চুপচাপ বসে রইলাম, বাইরে পুলিস এসে গেছে। মিশু আর সলিলের গলার স্বর শুনতে পেলাম। মিশুর আব্বাও এসেছেন মনে হয়। খবর পেয়ে আমাদের খোঁজে এসেছিলেন, এখন একেবারে ঘটনাস্থলে এসে পড়েছেন। সবাই মিলে ভিতর আসছে আমাদের কাছে, হারিকেন হাতে পথ দেখিয়ে আনছে ইসমাইল খাঁ। মিশুর আব্বাকে খাকী ঝকঝকে পোশাক দেখে ভারি একটা বিগলিত ভাব। পিছনে রাইফেল হাতে অনেক পুলিস, তার পিছনে শুধু মানুষ।
সলিল আর মিশু উঠানের মাঝে থেকে এক ছুট দিল আমাদের দিকে চিৎকার করতে করতে। আমরা চুপ করে বসে থাকলাম, রবিন তখনো মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে। তাহলে সব চুকেবুকে গেল। আমি আস্তে আস্তে একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। দীর্ঘ নিঃশ্বাস!