০৭. ধূমকেতু

০৭. ধূমকেতু

প্রথমে নান্টু বলল, ভোররাতে আকাশে ধূমকেতু দেখা যায়। পরে টিপু বলল সে নাকি দেখেছেও। ধূমকেতুর নামও বলল- ইকেয়াসেকী। পরে সবাই বলল তারা সবাই নাকি দেখেছে। মাথাটা নাকি ছোট্ট আর লেজ বিরাট লম্বা। আমরাও দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কিন্তু ভোররাতে ঘুম থেকে ওঠা কি সোজা কথা? আম্মাকে খুব করে ডেকে তুলতে বলে রাখলাম। আম্মাও একদিন ডাকতে শুরু করলেন। কিন্তু লেপের তলা। থেকে বের হতে এত বিরক্তি লাগল কি বলব। আম্মা বললেন, এই টোপন, ওঠ। ধূমকেতু দেখবি না?

উঁ। বিরক্ত করো না।

সারাদিন বলে রাখলি এখন বিরক্ত? ওঠ

না, না—

ওঠ বলছি।

উঠছি।

ওঠ।

এই, এই উঠলাম—

কি? উঠলি?

এই তো।

আহ! উঠবি না?

উঁ আর একটু

কাজেই আমার আর ওঠা হয় না ধূমকেতুও দেখা হয় না। শুধু আমার না সবার। এভাবে অনেকদিন পার হয়ে গেল। টিপু এসে একদিন বলল, ধূমকেতু আর বেশিদিন দেখা যাবে না। তখন আমাদের সবার টনক নড়ল।

.

রবিন এসে একদিন বলল আজ রাতে সে যেভাবে হোক ঘুম থেকে উঠবে তারপর সবাইকে ডেকে তুলবে। সত্যি সত্যি শেষ রাতে শুনি রবিন ডাকছে।

এই টোপন ওঠ। না হয় দিলাম পানি ঢেলে।

উঁ। আমি নড়েচড়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

ওঠ! ওঠ বলছি। না হয় দিলাম পানি ঢেলে।

বিরক্ত করিস না।

তিন পর্যন্ত গুনবো। তারপর পানি ঢালবো। এক।

আমি শুয়েই থাকলাম।

দুই। আমি পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম সত্যি হাতে পানিটানি কিছু আছে কিনা।

তিন বলেই কিছু বোঝার আগে রবিন আমার গায়ে পানি ঢেলে দিল। আমি লাফিয়ে উঠে বসলাম রবিন খালি গ্লাসটা হাতে নিয়ে হি হি করে হাসতে লাগল। আমার এমন রাগ লাগছিল যে বলার নয় কিন্তু ঘুমটা ভেঙেছে ঠিকই। আম্মা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ঠিক হয়েছে। এভাবেই তোর ঘুম ভাঙাতে হয়।

রবিন বলল, আম্মাও আমাকে এভাবে ঘুম থেকে তুলেছেন। এই দেখেন না, শার্ট ভেজা রবিন তার ভেজা শার্টের কলার দেখাল।

ভেজা শার্ট! বদলে যাও আম্মা আতঙ্কিত স্বরে বললেন- অসুখ করবে তো।

কিছু হবে না। বলে রবিন আমাকে নিয়ে চলল সলিলদের বাসায়। দুটো ডাক দিতেই সলিল চটপট উঠে গেল। তারপর আমরা গেলাম নান্টুর বাসায়। নান্টুর কানে পালক দিয় সুড়সুড়ি দিয়ে রবিন ওকে ডেকে তুলল। ঘুম থেকে উঠে নান্টু রাগে গজ গজ করতে লাগল। আমাদের দল ভারি হয়ে উঠলে হৈ চৈ চেঁচামেচিতে সবাই উঠে পড়ল। আমাদের ছোট ভাইবোন, আব্বা, আম্মা, শিরি আপা, বুলা আপা, শফিক ভাই, বীরু ভাই, বীরু ভাইদের অ্যালসেশিয়ান কুকুর, সলিলদের মোরগ— সবাই জেগে উঠে ভীষণ হৈ চৈ করতে লাগল। মনে হতে লাগল বুঝি আজ ঈদ। সবাই খোলা মাঠে এসে ধূমকেতু দেখতে লাগলাম। নান্টুর টেলিস্কোপটা সবার হাতে হাতে ঘুরতে লাগল আর নান্টু গর্বে এমন ভাব করতে লাগল যেন টেলিস্কোপ নয়, সে একটা আস্ত রকেট বানিয়েছে।

.

ধূমকেতুটা দেখতে যা ভীষণ— সেটা বুঝিয়ে বলা যায় না। ছোট্ট জ্বলজ্বলে একটা মাথা আর প্রকাণ্ড বড় লেজ আকাশটা প্রায় অর্ধেক দখল করে রেখেছে। তবে খুব ঝাপসা, নান্টুর টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে আরো ঝাপসা দেখা যায়। কিছুক্ষণের ভিতর সবার ধূমকেতু দেখা শেষ হয়ে গেল। সবাই ঘুমোতে চলল। কিন্তু চেঁচামেচি হৈ চৈ করে আমাদের এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন হাজার চেষ্টা করলেও ঘুম আসবে না। আমরা ঠিক করলাম এখন আর ঘুমাবো না, লুকোচুরি খেলব।

.

আম্মারা বৃথাই খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করে গিয়ে শুয়ে পড়লেন— আমরা খুব উৎসাহের সাথে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। খানিকক্ষণ পরেই ভয় ভয় লাগতে লাগল। অন্ধকারে কে কোথায় লুকিয়েছে বোঝা যায় না আর বুকের ভিতর ধুক ধুক করতে থাকে, মনে হয় অন্ধকার থেকে কেউ বুঝি লাফিয়ে ঘাড়ে এসে বসবে।

এর মাঝে হঠাৎ রবিন বলল, চল আমাদের গুপ্তধনটা দেখে আসি।

এতো রাতে?

হ্যাঁ। ক্ষতি কি?

শ্মশানের কাছে! জঙ্গলে! না বাবা আমি যাব না! নান্টু বেঁকে বসল।

যাবি না কেন? আমরা এতগুলো মানুষ।

ব্যাপারটাতে বেশ খানিকটা ভয় আছে। সবাই মিলে যাব তাই ভয়টা গায়ে লাগবে না, অথচ ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর হবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম, নান্টুও বাধ্য হয়ে রাজি হল।

সেই শেষরাতে, অন্ধকারে, নির্জন পথে আমরা দল বেঁধে হাঁটতে লাগলাম। অন্ধকার ছমছমে ভাব, নির্জন রাস্তা, মাঝে মাঝে টিমটিমে লাইট পোস্টের আলো, সব মিলিয়ে এমন হয়ে গেল যে আমরা ধীরে ধীরে চুপচাপ হয়ে গেলাম। কথাবার্তা হতে লাগল ফিসফিস করে, মনে হতে লাগল জোরে কথা বললেই একটা কিছু ঘটে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় একটা গাছের নিচে আসতেই একটা পাখি এমন ঝটপট করতে করতে উড়ে গেল যে আমরা সবাই ভীষণ চমকে উঠলাম।

নদীর তীরে এসে আমাদের গা ছমছম করতে লাগল। এখন শ্মশান পার হয়ে জঙ্গলে ঢোকা সত্যি খুব সাহসের কাজ। সবগুলি ভূতের গল্প আমার একসাথে মনে পড়ে গেল।

ঐ দেখ! ফিসফিস করে বলে সলিল হঠাৎ ছিটকে আমাদের কাছে সরে আসল।

কি? আমরা চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কি?

সলিল নদীর তীরে খানিকটা দূরে আঙুল দিয়ে দেখাল। আবছা অন্ধকার তার মাঝে খানিকটা অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখি জমাট অন্ধকারগুলি অল্প অল্প নড়ছে। ঈষৎ আলো হঠাৎ জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল।

কি ওখানে? নান্টুর গলার স্বরে বুঝতে পারলাম ও ভয় পেয়েছে।

কয়েকজন মানুষ নৌকা থেকে নামছে। রবিন আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ল। আমরা আরো ভাল করে তাকালাম। নদীর তীর যখন নৌকা হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু ঐ বড় জমাট অন্ধকারটা কিসের?

চল যাই। রবিনের কথায় আমরা চমকে উঠলাম।

কোথায়?

ওখানে, দেখে আসি।

পাগল। কেন না কে– আমাদের খুন করে রেখে যাবে।

ইহ! আমরা এতোজন ছেলে।

ওরা যদি আমাদের থেকে বেশি হয়?

আমরা লুকিয়ে থাকব দেখতে পাবে না তো। রবিন ফিসফিস করে বলল, উঁচু সড়কটার পাশে উবু হয়ে বসে থাকব।

না, না। নান্টুর মোটেই উৎসাহ নেই।

আরে চল না— রবিনের উৎসাহ দেখে আমাদের রাজি হতে হল। ওর মাথাটা সাফ, আমাদের ভিতর যাদের শার্ট সাদা সেগুলি খুলে হাতে নিতে বলল, অন্ধকারে সেগুলি অনেকদূর থেকে দেখা যায়। আমরা সাদা শার্টগুলি খুলে গুটি পাকিয়ে হাতে নিয়ে নিলাম। তারপর গুড়ি মেরে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

আমরা যেদিক দিয়ে যাচ্ছি সেটা রাস্তা নয়, রাস্তার পাশে শুকনো নালাটা। খানাখন্দ, ইট পাথর জঙ্গল, গোবর সব মাড়িয়ে আমরা যতটুকু সম্ভব কাছে গেলাম উত্তেজনায় আমাদের বুক ঢিপ ঢিপ করছে। যেটাকে জমাট বাধা বড়োসড়ো খানিকটা অন্ধকার দেখা যাচ্ছিল সেটা আসলে একটা রিক্সা। নদীর তীরে বালুর উপর দিয়ে ছেড়ে এতদূরে রিক্সা কেন এনেছে বুঝতে পারলাম না। রিক্সাটা নদী থেকে অল্প দূরে। নদীতে একটা নৌকা। টিপুর নৌকাটার মতোই তবে আরো সরু আর অল্প কিছু লম্বা। আমরা কয়েকজন লোকের চাপা গলার স্বর শুনতে পেলাম, কিন্তু কি বলছে বুঝতে পারলাম না।

হঠাৎ একটা চাপা আর্তনাদ শোনা গেল। মনে হল কাউকে যেন কেউ ছোরা মেরেছে। আমরা ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। উঠে দৌড় দেব কিনা বুঝতে পারছিলাম না ঠিক সেই সময় গোঙানোর আওয়াজ শোনা গেল, কে যেন গোঙাতে গোঙাতে বিশ্রী ভাষায় গালি দিচ্ছে।

একটু পরেই দেখা গেল নৌকা থেকে একজন লোককে কয়েকজন ধরাধরি করে নামাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে লোকটি অসুস্থ, এতক্ষণ ধরে সেই গোঙাচ্ছিল, সেই গালিগালাজ করছিল।

হারামজাদা, ঠিক করে ধরতে পারিস না? লোকটা আবার কাকে গালি দিল। অসুস্থ অবস্থাতেই এর এতো দাপট? আমরা ভারি অবাক হলাম। কে একজন বেকায়দা ধরতেই লোকটা আবার চাপা আর্তনাদ করে উঠল শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা মেরে ফেলল! আঃ! আহ—

বুঝতে পারলাম কোথাও ওর মারাত্মক জখম আছে। অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না ঠিক কোথায়। ওকে টেনে রিক্সায় তোলা হল। রিক্সায় উঠে গলা নামিয়ে বলল– কিন্তু আমরা ঠিকই শুনতে পেলাম, কেউ দেখেনি তো?

না।

অন্ধকারে আমাদের হাত পা মিটিয়ে গেল।

একটা বিড়ি দে তো। আবার লোকটার গলার আওয়াজ শোনা গেল। তাকে একটা বিড়ি দেয়া হল। ম্যাচ আলতেই দেখলাম নিষ্ঠুর উৎকট একটা মুখ, লম্বা লম্বা চুল মিশমিশে কাল, বাম হাতে কাপড় জড়ানো ভাঁজ করে বুকের কাছে রাখা, কাপড়ে রক্তের কালচে ছোপ। একটা পাও মনে হল কাপড়ে জড়ানো! দেখে আমাদের বুকের ভিতর গুরগুর করে উঠল।

এই ইয়াসিন, চল। একটা লোক যার নাম ইয়াসিন, রিক্সাকে টেনে নিতে থাকে অন্যের পিছনে ঠেলতে থাকে আর ঐ বীভৎস দর্শন ভয়াবহ লোকটা রিক্সার ঝাঁকুনির সাথে সাথে আঃ উঃ করতে থাকে।

আমরা আবার পা টিপে টিপে শ্মশানের কাছে ফিরে এলাম তারপর একটি কথাও না বলে ভয়ে ভয়ে বাসায়। পথে প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছিল সেই দলটার সাথে দেখা হয়ে যাবে আর ওরা হা হা করে আমাদের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে।

.

লোকটা হচ্ছে একটা ডাকাত সর্দার। কথাটা রবিন প্রথম বললেও আমরাও সবাই মনে মনে এটি ভাবছিলাম। ভীষণ দর্শন সব লোকদেরই আমাদের ডাকাত বলে ভাবতে ইচ্ছে করে আর এর তো কোন প্রশ্নই ওঠে না। কি ভয়ানক সন্দেহজনক কথাবার্তা, কাজকর্ম, কি ভয়াবহ চেহারা, বাঁ হাতে জখম, রক্তের ছোপ এ যদি ডাকাত না হয় ডাকাত কে হবে?

ওকে আমরা ধরিয়ে দেব।

কেমন করে? সলিল জিজ্ঞেস করে, চলেই তা গেল রিক্সা করে।

খুঁজে বের করব। কোথায় গেছে তো বোঝাই যাচ্ছে।

কোথায় গেছে?

ডাক্তারের কাছে। রবিন বিজ্ঞের মত বলল, দেখিসনি হাতে গুলি লেগেছে? এবারে হাত কেটে ফেলতে হবে। রবিন একটু হাসল, তারপর নিজের কাটা হাতটি নাড়ল।

গুলি? হীরা সন্দেহ প্রকাশ করল। গুলি তুই কেমন করে বুঝলি? হয়তো ফোঁড়া উঠেছে

আরে ধেৎ গাধা! ফোঁড়া উঠলে এরকম হয়? রবিন খিকখিক করে হাসল। এটা গুলি ছাড়া আর কিছু নয় কোথায় ডাকাতি করতে গিয়েছিল আর বেকায়দায় পড়ে গুলি খেয়েছে।

পেপারে পাওয়া যাবে তাহলে আমি একটু ভেবে বললাম, কাল পরশুর পেপারে দেখতে হবে আশে-পাশে কোথাও ডাকাতি করতে গিয়ে কোন ডাকাত দল গুলি খেয়েছে কি না।

ঠিক বলেছিস! রবিন আমার ঘাড়ে থাবা দিল। বলল একটা প্ল্যান করে কাজ করতে হবে। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, নৌকাটার উপর নজর রাখতে হবে, আবার কোথায় না কোথায় চলে যায়। তারপর গলার স্বর নামিয়ে বলল, আর সবাই শোন, কাউকে কিছু বলবি না কিন্তু খবরদার।

.

আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাব প্রথম বারের মত একটা সত্যিকারের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *