০৬. নদীর সাথে পরিচয়
শহরের সেরা ফুটবল টিম নাম হয়ে যাবার পর আমাদের আর ফুটবল খেলতে ভাল লাগে না। আগে আমাদের তবু একটা উদ্দেশ্য ছিল এখন কোন উদ্দেশ্য নেই। কি করব কিছুতেই ঠিক করতে পারছিলাম না ঠিক এই সময়ে আমরা একটা নৌকা পেয়ে গেলাম।
আমাদের সাথে ভর্তি হয়েছিল নতুন একটা ছেলে, নাম টিপু, ভারি সুন্দর দেখতে। ওদের বাসা নদীর তীরে। ছেলেটা আমাদের খুব বন্ধু হয়ে গেল। প্রথমে অবিশ্যি ওর ভাব। হল নান্টুর সাথে। নান্টুর মত টিপুও ভীষণ গল্পের বই পড়ে। বই বদলাবদলি করতে করতে ওদের বন্ধুত্ব হয়েছিল। পরে দেখা গেল নান্টুর সাথে তার অনেক মিল। সেও নান্টুর মত একটা ল্যাবরেটরি তৈরি করতে চায়। নান্টু যেরকম কিছু জোগাড় করতে পারেনি ওর অবিশ্যি সেরকম অবস্থা নয়। বেশ অনেক যন্ত্রপাতি আছে, নিজে নাকি একটা সিনেমা প্রোজেক্টরও বানিয়েছে। ওর সাথে পরিচয় হবার আগে আমরা ভেবেছিলাম ও ভীষণ নাক উঁচু অহঙ্কারী। কিন্তু আমাদের বন্ধু হয়ে যাবার পর দেখলাম ওর স্বভাব ভীষণ ভাল। টিপু এতো ভাল ছেলে যে সবার সাথেই সে বন্ধু হয়ে যায়। ও কখনো রাগ করে না, খারাপ কথা বলে না। ওকে আমরা তুই তুই করে বললেও সে কিন্তু ভুলেও কখনো আমাদের তুই বলে না। ওকে এ সম্বন্ধে কিছু জিজ্ঞেস করলে শুধু হাসে!
একদিন টিপু এসে আমাদের বলল, তোমরা আমাদের বাসায় এসো। আমি একটা নৌকা কিনেছি।
নৌকা? কিনেছিস?
আমি কিনিনি, আব্বা কিনে দিয়েছেন।
কিনে দিয়েছেন? তোকে? আমরা ভারি অবাক হলাম। নৌকা আবার কিনে দেবার জিনিস নাকি? ফুটবল হলে না হয় একটা কথা ছিল, বড় জোর সাইকেল। তাই বলে নৌকা?
আব্বাকে বলেছিলাম। প্রথমে রাজি হননি পরে কিনে দিয়েছেন।
কত বড় নৌকা?
বেশি বড় না। দশ বারজন বসা যায়। আমি খুব ছোট চাইছিলাম, আব্বা বললেন একটু বড় হলে ডোবার ভয় কম থাকে।
ছই আছে? বৈঠা? পাল?
কিছুই নেই শুধু একটা বৈঠা আছে।
আমরা ভারি উৎসাহিত হলাম। স্কুল ছুটি হতেই বাসায় না গিয়ে সবাই টিপুর লাসায় হাজির হলাম। টিপু আমাদের নিয়ে ওদের বসার ঘরে বসাল। কি চমৎকার ঘর! নীল রংয়ের ভারি পর্দা ঘরটাকে আবছা অন্ধকার করে রেখেছে। লাল কার্পেট, ঝকমকে সোফা, দেয়ালে বড় বড় ছবি, শেলফে হাজার হাজার বই, শোকেসে চিনামাটির পুতুল। আমরা বুঝতে পারলাম টিপুর আব্বা খুব বড়লোক।
একটু পর টিপু এল, সাথে তার আব্বা। আমরা লজ্জায় জড়োসড়ো হয়ে গেলাম। হীরা তার বিচ্ছিরি থ্যাবড়া পা দুটো সোফার তলায় লুকিয়ে ফেলল।
আব্বা, এরা আমার বন্ধু। নৌকা দেখতে এসেছে।
হুম! টিপুর আব্বা চশমার উপর দিয়ে তাকালেন। বললেন, এতগুলো বন্ধু জানলে তো আরেকটু বড় নৌকা কিনে দিতাম। তোমরা সবাই সাঁতার জানো তো?
আমরা ঘাড় নাড়লাম। টিপুর আব্বা রবিনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি?
রবিন বলল, আমিও পারি।
টিপুর আব্বা বললেন, গুড! আমরা ভেবেছিলাম এবারে রবিনকে জিজ্ঞেস করবেন ওর হাতটা কিভাবে কেটেছে। কিন্তু দেখা গেল জিজ্ঞেস করলেন না। খানিকক্ষণ একথা সেকথা আলাপ করে বললেন, তোমরা বসে বিস্কুট খাও। আমি যাই। আবার দেখা হবে।
টিপুর আব্বা চলে গেলে হীরা বলল, তোর আব্বাটা তো খুব ভাল। যা চাস তাই কিনে দেন।
আসলে আমার একটা প্রাইজ পাওনা ছিল। কথা ছিল যা চাইব তাই কিনে দেবেন। এখানে নদী দেখে নৌকার কথা মনে হল। একবার কথা দিয়েছেন আর না করতে পারেন না! নৌকা কিনে দিতেই হল!
কিসের প্রাইজ?
টিপু একটু ইতস্তত করে বলল, বৃত্তি পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছিলাম তো!
তুই ফাস্ট হয়েছিলি?
টিপু মাথা নাড়ল। আমরা আড়চোখে মিশুকে দেখলাম। মিশু আমাদের ফার্স্ট বয়। এবারে ওর সাথে টিপুর যুদ্ধ হবে।
.
নৌকাটা ভারি চমৎকার। দশজন অনায়াসে বসতে পারে। দুটো দাড় লাগিয়ে নিলে তীরের মত উড়িয়ে নেয়া যাবে। একটা পাল বসাতে পারলে তো কথাই নেই। নৌকা করে নদীতে অল্প কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আমরা বাসায় ফিরে আসলাম। দেরি করে বাসায় ফেরার জন্যে আজ সবার ভাগ্যে অল্প বিস্তর পিটুনি জুটল। কিন্তু এখন আমরা একটা আস্ত নৌকার মালিক। ছোটখাট পিটুনির কথা অনায়াসে ভুলে যেতে পারি এবং ভুলে গেলামও।
আমরা এর পরে সময় পেলেই নৌকায় চড়ে বেড়াতাম। নদীর তীরে আশেপাশে বিস্তীর্ণ এলাকায় কোথায় কি আছে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেল। আমরা সবাই কম বেশি নৌকা চালাতে শিখে গেলাম। পিছনে হাল ধরে নৌকাকে সোজা সামনে নিয়ে যাওয়া দেখে খুব সহজ কাজ মনে হলেও আসলে মোটেই সোজা নয়। নৌকা চালাতে চালাতে আমাদের হাতের মাংসপেশী শক্ত হয়ে উঠতে লাগল আর নদী সম্পর্কে ভীতি একেবারে কেটে গেল।
রবিনের কথা অবিশ্যি আলাদা। নৌকায় উঠে ও শুধু ছটফট করত। এক হাতে বৈঠা ধরে চালান যায় না কাজেই তার আর নৌকা চালানো শেখা হল না। ওর উৎসাহে নৌকায় দুটো দাড় লাগান হল। মাঝে মাঝে এক হাতে ও দড়ি টানত কিন্তু অল্পক্ষণেই ক্লান্ত হয়ে পড়ত। এত সহজে হার মানার ছেলে রবিন নয়। নিজের অক্ষমতাটা কিছুতেই ও মেনে নিত না। তাই কিছু করার না পেয়ে ও বাসা থেকে একটা পুরানো চাদর নিয়ে এসে বাশের সাথে লাগিয়ে একদিন ও একটা পাল তৈরি করে ফেলল।
নৌকা চালিয়ে নদীর মাঝামাঝি এসে আমরা যখন পুরোপুরি বাতাসের আওতায় পৌঁছে গেলাম তখন রবিন পাল তুলে দিল। সাথে সাথে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। বাতাস পেয়ে ভট করে পাল ফুলে উঠল, নৌকা সঁই করে ঘুরে গেল আর নৌকার পাশে বসে থাকা মিশু, হীরা আর আমি ঝুপঝুপ করে পানিতে পড়ে গেলাম। সঁতরে নৌকায় উঠে আমরা রবিনকে যাচ্ছেতাই করে গালিগালাজ করতে লাগলাম। শার্ট প্যান্ট ভিজে জবজব করছে। আমাদের অবস্থা দেখে সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে লাগল! রবিন যতই হাসতে লাগল আমাদের রাগ ততই বেড়ে উঠতে লাগল।
রবিন কিছুক্ষণের মাঝেই পালের কৌশল শিখে গেল। দেখা গেল পালে বাতাস লাগলে নৌকা উজান ঠেলেও তীরের মত ছুটে চলে। একজন শক্ত করে হালটা ধরে থাকলেই হয়। পাল টানিয়ে আমরা খুব তাড়াতাড়ি বহুদূরে চলে এলাম। আগে কখনো এসব জায়গায় আমরা আসিনি। এখানে নদীর মাঝে চর, বালুর মাঝে অদ্ভুত ধরনের লম্বা লম্বা ঘাস, বালি হাঁস, খানিক দূরে বেশ খানিকটা জঙ্গল! একটা বহু পুরানো ভাঙা বাঁশের ঘর কাত হয়ে আছে। সব মিলিয়ে ভারি চমৎকার জায়গা। এত দূরে আসতে আমাদের কোন পরিশ্রমই হল না। পালের বাতাসেই কাজ চলে গেল।
যখন বিকেল ঘনিয়ে এসেছে তখন আমাদের ফেরার কথা মনে হল। আর হঠাৎ করে সবার প্রায় একই সাথে মনে হল যাওয়ার সময় বাতাস উল্টোদিকে পবি। পাল খাটিয়ে যাওয়া যাবে না। এতো দূরে চলে এসেছি যে আমাদের বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে। সবার মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। আজও ভাগ্যে পিটুনি আছে।
আমরা নৌকা ঘুরিয়ে বাসার দিকে ছুটলাম। ভাগ্য ভাল ভাটার টানে স্রোতটা তখন আমাদের পক্ষে। রবিন হেইয়া হে, হেইয়া হো বলে একটা দ্রুত তাল তৈরি করে ফেলল ঝপাঝপ সেই তালে দাঁড় পড়তে লাগল। আস্তে আস্তে তাল আরো দ্রুত হয়ে উঠতে থাকে। আর তার সাথে সাথে ঝপাং ঝপাং করে দড়ি পড়তে থাকে। বৈঠা হাতে একজন শক্ত করে হাল ধরে রাখে। দুজন ক্লান্ত হতেই নতুন দূজন পঁড়ি নিয়ে বসল। ঝপাঝপ ঝপাঝপ। শব্দ তুলে নৌকা ছুটে যেতে লাগল।
আমরা চেঁচামেচি হৈ চৈ করে একটা অদৃশ্য নৌকার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু করলাম, প্রতিমুহূর্তে আমরা সেটাকে প্রায় ধরে ফেলছিলাম। সন্ধ্যার অল্প আলোয় দু তীরের চাষী, গ্রাম্য বউ, ছেলেমেয়েরা হাসি মুখে আমাদের এই পাগলামি লক্ষ্য করছিল। তারা তো জানত না বাসার পিটুনি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে এই তাড়াহুড়ো।
তবুও রাত আটটার আগে আমরা পৌঁছতে পারলাম না। বুক ঢিপঢিপ করতে করতে যখন আমরা বাসায় ফিরে আসছিলাম তখন এশার নামাজের আযান হচ্ছে। রবিন একটু চিন্তিত মুখে বলল, নৌকায় আরও দুটো দাঁড় বসাতে হবে!
হীরা মুখ খিঁচিয়ে বলল, আগে দ্যাখ বাসায় গেলে হাড় একটা আস্ত থাকে কি না!
নাই বা থাকল রবিন তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল!