১১. প্রথম সকাল
আমার ঘুমটা গাঢ় হল না, অসুস্থ হলে হয়ও না। আমি আধে! ঘুম আধো জাগরণে আবছা আবছা ভাবে ওদের কথাবার্তা শুনছিলাম। ওরা মাঝে মাঝে জায়গা বদল করছে টের পাচ্ছিলাম, একবার হীরাকে খানিকক্ষণ গালিগালাজ করতেও শুনলাম। কিছু সময় কে যেন আমার পাশে শুয়ে থাকল। শেষ রাতের দিকে মনে হল নৌকাটা থামানো হয়েছে।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করব করব ভেবে আবার ঘুমিয়ে বিচিত্র সব স্বপ্ন দেখতে। লাগলাম। বিরাট বড় গোলক ধাঁধায় আটকে পড়ে ঘড়ির কাটার সাথে সাথে ঘুরছি আর প্রতিবারই হিসেব ভুল করে একই দিকে সরে আসছি। লাল নীল হলুদ রংয়ের চক্র ছোট থেকে বড় হয় ক্রমাগত মিলিয়ে যাচ্ছিল আবার নতুন করে তৈরি হচ্ছিল। দেখতে দেখতে একসময় আমার ঘুম ভেঙে গেল, ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। আমি উঠে বসে আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম ঐটুকু জায়গায় জড়াজড়ি করে সবাই শুন্তে আছে। বাইরে রবিন শুধু কম্বল গায়ে জড়িয়ে প্রেতের মত বসে আছে। আমি ডাকলাম রবিন –
উঁ
নৌকা থামিয়ে রেখেছিস?
হ্যাঁ। ডাকাতেরাও থেমেছে।
কতদূর আছে?
বেশিদূর না।
কি করছে?
কিছু না। জোয়ারের সময়টুকু বোধ হয় ওরা এখানেই থাকবে। তোর জ্বর আছে এখনো?
নাহ! পানি আছে খাবার?
চারিদিকে এতো পানি? খা না কত খাবি।
ধেৎ! নোংরা!
ঐ খেতে হবে। আমরাও এই খাচ্ছি। বলে সে একটা মগ বের করে নদী থেকে পানি তুলে আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি একটু ইতস্তত করে ঢকঢক করে খেয়ে ফেললাম। বুকটা যেন জুড়িয়ে গেল।
কয়টা বেজেছে?
হাতে বাঁধা টিপুর ঘড়িটা দেখে রবিন বলল, পৌনে পাঁচ।
সকাল হয়ে গেছে তাহলে।
হ্যাঁ—কি সুন্দর লাগছে, উঠে এসে দ্যাখ। রবিন হাত দিয়ে বাইরে দেখায়।
আমি হামাগুড়ি দিয়ে বাইরে এসে বসলাম। কুয়াশা পড়ে নৌকার পাটাতন ভিজে আছে। জোয়ারের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে নৌকার উপর আছড়ে পড়ছে। চারিদিকে ধোঁয়াটে একটা ভাব। আলো যেন গুঁড়ো করে কেউ পাউডারের মত ছড়িয়ে দিচ্ছে। আমি একটু বিলের মত তাকিয়ে রইলাম। একবারও মনে হল না জ্বর নিয়ে বাসা থেকে পালিয়ে ডাকাতের পিছু পিছু নোকায় বসে আছি। নদীর বাঁক, দুধারে গাছ গাছালি, আবছা মাটির ঘর, আকাশে হালকা মেঘ, পুব দিকে লালচে আভা, শুকতারা। জ্বলজ্বল করছে, সব মিলিয়ে ভারি আশ্চর্য।
রবিন উঠে দাঁড়াল, বলল, এখন টিপুর পাহারা, পাঁচটা বেজে গিয়েছে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ছইয়ের ভিতর ঢুকে টিপুকে খোঁচাতে লাগল, এই টিপু ওঠ! এই টিপু
টিপু বার দুয়েক উ আঁ করল কিন্তু উঠল না। দেখে আমার মায়া হল, আমি রবিনকে বললাম, শুধু শুধু ওকে ডাকিস না, আমি পাহারা দিছি। বেচারা ঘুমাক।
তুই? তোর না জ্বর?
ভাল হয়ে গেছে।
দেখিস আবার বলে রবিন শুয়ে পড়ল এবং শুতে না শুতেই ঘুম। নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে আছে।
আমি এই বিজন নদীর তীরে একলা নৌকায় বসে রইলাম। সামনে ডাকাতের নৌকাটা ভাটা শুরু না হওয়া পর্যন্ত ছাড়বে না, বোঝাই যাচ্ছে। আমি অলস ভাবে বসে থাকলাম, মাঝে মাঝে নৌকাটা দেখছিলাম। শীত পড়েছে। মাথায় হিম পড়ে ভিজে যাচ্ছে। আমি কম্বল দিয়ে ভাল করে মাথা ঢেকে নিলাম। ওদিকে নৌকার ভিতরে সবাই গাদাগাদি করে তখনো ঘুমোচ্ছে।
খুব ধীরে ধীরে ভোর হয়ে এল। আশেপাশে গাছপালা বাড়িঘর স্পষ্ট হয়ে উঠল। একটু দূরে খানিকটা ফাঁকা মত জায়গা তার আশেপাশে ছোট ছোট ঘর – বাজার ঢাজার হবে হয়তো। লোকজন গামছা ঘটি নিয়ে ইতস্ততঃ হাঁটাহাঁটি করছে। কেউ কেউ দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষে নদীর পানি দিয়ে কুলকুচা করতে লাগল। কয়েকজন আমাদের নৌকার খুব আশেপাশে এসে সশব্দে ওজু করতে লাগল। আমার শুধু ভয় করছিল, এক্ষুনি হয়তো কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে বসবে। কিন্তু করল না, আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরো নৌকা বাঁধা ছিল সে জন্যেই কোন রকম সন্দেহ করেনি বোধ হয়।
আমি ডাকাতদের নোকাটা দেখছিলাম, লম্বা পানসী। কালো কুচকুচে রং, ছইটাও কালো। একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, ঢেউয়ের সাথে সাথে নড়ছিল না পর্যন্ত। ওটাকে দেখতে দেখতে আমি কেমন জানি বুকের ভিতর শিহরণ অনুভব করলাম।
ওরা সবাই অনেক বেলা করে উঠল। হৈ চৈ করে হাত মুখ ধুয়ে উৎসাহ একেকজন টগবগ করতে লাগল। রবিন এর মাঝে বার দুয়েক রিভলবারটায় গুলি ভরে আবার খুলে রাখল। বিছানার তলা থেকে একটা লম্বা চাকু বের করে পরীক্ষা করে দেখল। এরপরে কি করা হবে ঠিক করতে গিয়ে দেখা গেল ভীষণ খিদে পেয়েছে।
আমাদের কাছে পয়সা-কড়ি খুব বেশি নেই। রঞ্জুর ব্যাঙ্কটা ভেঙে মাত্র তিন টাকার মত পাওয়া গেছে। কতদিন এখানে থাকতে হবে ঠিক কি? কাজেই খুব সাবধানে পয়সা খরচ করতে হবে। হীরা আর সলিল বের হল নাস্তা কিনতে। আমরা বসে বসে একটা প্ল্যান বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম!
টিপু বলল, এখানে যদি আশেপাশে থানা থাকে তাহলে আমরা খবর দিয়ে আসতে পারি।
কিসের?
কেন? ডাকাতদের ধরে নিয়ে যাক।
রবিন মুখ খিঁচিয়ে বলল, তাহলে এতো কষ্ট করে এখানে এলাম কি জন্যে? একটা ফাইট –
ফাইট?
বাঃ! রিভলবার, ড্যাগার নিয়ে এসেছি কি খাওয়ার জন্যে? যুদ্ধ করব না?
মিশু ইতস্তত করে, যুদ্ধ! কিভাবে করবে? ওরা কতোজন, কতো বন্দুক! আমরা এই কয়জন, তার উপর দুজনের মাত্র একটি করে হাত চালু!
তুই বাসায় চলে যা। রবিন রক্তচক্ষু করে তাকাল, বাসায় গিয়ে রীনা, স্বপ্নাদের সাথে বুড়ী-চি খেলগে—যা!
টিপু একটু নড়েচড়ে বলল, রবিন তুমি শুধুশুধু এতো সব কথা বলছ। যুদ্ধটা করবে কিভাবে?
ও! তুইও তাহলে বুড়ী-চি খেলবি?
টিপু একটুও না ক্ষেপে বলল, বাজে কথা বল না। আমাকে আগে বুঝিয়ে দাও যুদ্ধটা কিভাবে হবে?
কেন? আমরা ইয়ে মানে, যখন ওরা আর কি—ইয়ে—রবিন মাথা চুলকাতে লাগল।
বল। টিপু গম্ভীর হয়ে পানিতে পা নাচাতে লাগল।
সে যখন হবে তখন দেখা যাবে।
বাঃ! একটা প্ল্যান নেই কিছু নেই, শুধু বললেই হবে?
এই সময়ে সলিল আর হীরা এক ছড়া কলা আর একটা মস্ত বড় ঠোঙা নিয়ে হাজির হল। সলিল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, লোকগুলো কি বোকা! এতগুলো কলা পঁচিশ পয়সায় দিয়ে দিল।
হীরা দুহাতে ঠোঙাটা উঁচু করে বলল, বল দেখি এখানে কতোর মুড়ি?
বুঝতে পারলাম সস্তায় কিনে এনেছে তাই মজা করার জন্যে বললাম, কতো আর হবে, দু পয়সার হবে। নাকি চার পয়সা?
হীরা মুখ খিঁচিয়ে বলল, হ্যাঁ, মুড়িওয়ালা তোমার শ্বশুর কিনা! আধাসের মুড়ি চার পয়সা! আমরা হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করলাম, কতো?
পাক্কা পঞ্চাশ পয়সা।
আমরা মুড়ি গুড় আর কলা খেতে লাগলাম। এমন সুন্দর শীতের সকাল, নদীর পানিতে নৌকায় বসে মুড়ি খাওয়া, ভারি চমৎকার লাগছে। বাসার কথা মনে হল। নিশ্চয়ই সবাই এখন খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। আমার একটু মন খারাপ হয়ে গেল।
.
আমরা আবার ডাকাত ধরার পরিকল্পনা করতে লাগলাম। রবিন বারবার করে বলল সে একটা যুদ্ধ না করে কিছুতেই পুলিসে খবর দিয়ে ডাকাত ধরিয়ে দেবে না। কিন্তু যুদ্ধটা কিভাবে হবে সেটি সে কিছুতেই পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে পারল না।
আমি শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে বললাম, এক কাজ করলে হয় না?
কি? সবাই আমার দিকে তাকাল।
আমরা কিছুতেই ডাকাতগুলির পিছু ছাড়ব না। আজ হোক কাল হোক ডাকাতগুলি নিশ্চয়ই কোথাও ডাকাতি করবে। আমরা ঠিক সে সময়ে তাদের বাধা দেব। এদিকে আগে থেকে পুলিসে খবর দেয়া থাকবে—ব্যাস একেবারে হাতেনাতে গ্রেপ্তার।
ইহ! সব যেন তোর ইচ্ছেমত হতে থাকবে। আমি অসুস্থ দেখে রবিন বেশি মেজাজ দেখাল না, বলল, ডাকাতেরা কখন ডাকাতি করবে তুই জানবি কেমন করে?
বাঃ! আমরা ডাকাতদের পিছু পিছু আছি না?
বেশ, তা না হয় জানলে, টিপু জিজ্ঞেস করল, এতো অল্প সময়ে পুলিসে খবর দেবে কেমন করে?
কেন? অসুবিধে কি? আমি একটু অবাক হয়ে বললাম, আমরা যখন দেখব ডাকাতেরা ডাকাতি করতে রওনা হচ্ছে, তখনি কয়েকজন কাছাকাছি থানায় খবর দিয়ে আসবে।
বলতে সোজাই, করতে কঠিন। মিশু বলল, একেকটা থানা কত দূর দূর জানিস? দশ পনেরো মাইলের কম না।
মিশুর আব্বা ডি এস পি, কাজেই থানা টানা সম্পর্কে তার কথা আমি উড়িয়ে দিতে পারলাম না।
টিপু অনেকক্ষণ ভেবে বলল, আমরা যদি আগে জানতে পারি ওরা কবে কোথায় ডাকাতি করবে তাহলে টোপনের বুদ্ধিটা কাজে লাগানো যেতে পারে।
সবাই একটু চিন্তা করে সায় দিল, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ওদের পরিকল্পনা আগে থেকে জানা যায় কেমন করে?
ওরা তো মাইক ভাড়া করে চেঁচিয়ে বেড়াবে না যে আমরা অমুক দিন অমুক জায়গায় এতটার সময় ডাকাতি করব! রবিন বিরক্ত হয়ে বলল, এর থেকে সোজাসুজি একটা ফাইট দেয়া কতো ভাল!