০৯. অঘটন
ছুটির দিনগুলি কেটে যেতে লাগল খুব তাড়াতাড়ি কিন্তু আমরা ডাকাত সর্দারের আর কোন হদিসই খুঁজে পেলাম না। আমরা চেষ্টা করলাম শহরের সব কয়জন ডাক্তারকে চোখে চোখে রাখতে কিন্তু সেটা সহজ নয়। রোদে ঘুরে ঘুরে আমাদের চেহারা খারাপ হয়ে উঠতে লাগল আর ঘন ঘন বাসায় বকাঝকা পিটুনি খেতে লাগলাম। শেষে সবাই বিরক্ত হয়ে উঠলাম, মনে হতে লাগল ডাকাত সর্দারকে ধরে কাজ নেই অন্য কিছু করা যাক।
ঠিক এই সময় একটা অঘটন ঘটল। দেয়াল থেকে পড়ে আমার বাম হাতটার কনুইয়ের খানিকটা নিচে ভেঙে গেল। সেদিন দুপুরে আমরা বড়ই খাচ্ছিলাম। আমি বসেছি দেয়ালের উপর, দু পকেট বোঝাই কাঁচা বড়ই, আমার বাম হাতে ঝাল মেশানো লবণ। এমন সময় সাঁই করে একটা কালো ভোমরা মাথার কাছে দিয়ে উড়ে গেল। আমি মাথা নিচু করে তাল সামলানোর চেষ্টা করতে গিয়ে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, সামলে উঠে কোনমতে ঠিক হয়ে বসলাম। ঠিক সেই মুহুর্তেই কথা নেই বার্তা নেই আমি কি ভাবে জানি পিছন দিকে পিছলে পড়ে গেলাম। ছয় সাত ফুট উঁচু দেয়াল, মাখা মাটিতে ঠুকে যাবে তাই হাত পিছনে দিয়ে তাল সামলানোর চেষ্টা করলাম আর কি আশ্চর্য! হাতটা মট কর ভেঙে গেল।
রবিন পরে বলেছিল আমি যখন হাত তুললাম তখন হাতটা নাকি উল্টো দিকে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছিল। যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করে উঠলাম, আরেকটু হলে কেঁদেই ফেলতাম, কিন্তু ঠিক সেই সময়ে কোথা থেকে পাড়ার মেয়েগুলো ছুটে এল।
কান্নাটাকে ঢোক গিলে ফেলে মুখ বিকৃত করে আমি ডান হাত দিয়ে বাম হাতটা ধরলাম। ভিতরে কোথায় কি লেগে ঝনঝন করে সমস্ত শরীর যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠল। রবিন আমার উপর ঝুঁকে পড়ে বলল, কিচ্ছু ভয় নেই, হাড়টা ভেঙে গেছে! ঠিক হয়ে যাবে। তারপর হীরাকে বলল, দৌড়ে যা শফিক ভাই বা অন্য কোন বড় কাউকে ডেকে আন। টোপনকে হাসপাতালে নিতে হবে।
সবাই, বিশেষ করে মেয়েরা ফ্যাকাসে মুখে আমার দিকে তাকিয়েছিল। শুধু ওদের দেখানোর জন্যেই আমি বললাম, আমি নিজেই পারব। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে প্রচণ্ড যন্ত্রণা সহ্য করে উঠে দাঁড়ালাম।
.
হাসপাতালে রবিনের আব্বা গম্ভীর মুখে এক্স-রে করলেন। হাতটা তখন কালচে হয়ে ফুলে উঠেছে। পনেরো মিনিটের ভিতর এক্স-রে প্লেট পাওয়া গেল। দেখা গেল দুটো হাড়ই ভেঙেছে। কজি থেকে কনুই পর্যন্ত যে দুটো হাড় থাকে, ওটা আমি তখনই প্রথম জানলাম।
ডাক্তার চাচা খানিকক্ষণ এক্স রে প্লেটটা লক্ষ্য করে আমার কাছে এগিয়ে আসলেন। তারপর এক বিচ্ছিরি ঘটনা ঘটল। হ্যাঁচকা টান দিয়ে হাতটা সোজা করে আবার ভাঁজ করে ভীষণ নিষ্ঠুরভাবে ডাক্তার চাচা কি যেন করতে লাগলেন। শফিক ভাই আমাকে শক্ত করে ধরে রাখলেন। কাঁদবো না কাঁদবো না করেও আমি ঠোঁট কামড়ে কেঁদে ফেললাম।
পরে যখন প্লাস্টার অফ প্যারিসের গুঁড়ো মাখানো ব্যাণ্ডেজ দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে প্লাস্টার করে দেয়া হল তখন নেহায়েত মন্দ লাগছিল না। ধবধবে সাদা প্লাস্টারের উপর ডাক্তার চাচা তারিখ লিখে দিয়ে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, ব্রেভ বয়। ওয়েল ডান।
হাতটা ভেঙে যাবার পর প্রথমে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, পরে দেখা গেল ব্যাপারটা সেরকম খারাপ না। আব্বা তখন তখনই পাঁচটা টাকা দিয়ে দিলেন, আম্মা একটা রংয়ের বাক্স কিনে দেবেন বললেন। অন্যেরা সবাই আমাকে হিংসে করতে লাগল! প্লাস্টার করা হাত নিয়ে আমার স্বাধীনতা অনেকটুকু কমে গেল ঠিকই কিন্তু কয়েকদিনেই অভ্যাস হয়ে গেল। রবিন এক হাতে সব কাজ কিভাবে করে ফেলত এতদিনে আমি বুঝতে পারলাম!
.
ডাকাত সর্দারের ঝোঁকটা কেটে যাবার পর আমরা ঈদের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ঈদ যতই কাছে আসতে লাগল দিনগুলি যেন ততই লম্বা হয়ে যেতে লাগল। কিন্তু ঈদের দিনটা শেষ হয়ে গেল কিছুক্ষণের ভিতর! ঈদের পর দিনগুলি কাটতে লাগল খুব খারাপ ভাবে। স্কুল খুলতে দেরি নেই আমাদের সবার ভিতরেই একটু অস্বস্তি, চাপা ভয় আর নিরানন্দের ভাব। এর ভিতর আবার একদিন আমার গা কেঁপে জ্বর এল। দুদিন ভূগেই ভীষণ দুর্বল হয়ে গেছি, চুপচাপ বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে থাকি। সব মিলিয়ে ভয়ানক খারাপ যাচ্ছে সময়টা।
ঠিক সেই সময়ে আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটা ঘটল।
.
আমি সারাদিন চুপচাপ শুয়ে বসে থেকে বিরক্ত হয়ে সন্ধেবেলা একটা গল্পের বই নিয়ে বসেছি। কাহিনীটা খুব জমে উঠেছে—কিভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল টের পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ এক সময় রবিন এসে হাজির। আমার কানের কাছে মুখ নামিয়ে। বলল, একটু বাইরে আয়।
কোথায়?
আয় না! ও অধৈর্য হয়ে ছটফট করে উঠল।
আম্মা বকবে, ঠাণ্ডা লাগানো নিষেধ।
সে আমি জানি না, রবিন ফিসফিস করে বলল, ব্যাপার আছে! তাড়াতাড়ি
আমি আম্মাকে কিছু না বলে চুপি চুপি বাইরে চলে এলাম। পেয়ারাতলায় গিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে। এমন কি এত রাত্তিতে টিপুও আছে, পাশে একটা সাইকেল দেয়ালে হেলান দিয়ে রেখেছে। আমাকে দেখে ওরা সবাই ফিসফিস করে উঠল।
সবাই একসাথে বোঝাতে চাইছিল বলে আমার বুঝতে একটু দেরি হল। শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম এইমাত্র টিপু আর রবিন খবর এনেছে সেই ভয়ানক ডাকাত সর্দারটা হাতে গুলি লেগেছিল বলে হাতটা কেটে ফেলেছে, সে তার দলবল নিয়ে নদীতে অপেক্ষা করছে। রাত গভীর হলেই রওনা দিয়ে দেবে।
আমি ভীষণ অবাক হয়ে বললাম, তোরা কেমন করে জানলি?
সবাই হড়বড় করে বলার চেষ্টা করল, হীরার গলার স্বর উঠল সবচেয়ে উপরে এবং আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।
শ–স-স— রবিন ঠোটে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে। সবাই চুপ করতেই টিপু আমাকে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দেয়। কোন জিনিস টিপুর মত গুছিয়ে কেউ বলতে পারে না। হীরা হলে বলতে বলতে দশবার হাসতো, চারবার আগেরটা পরে, আর পরেরটা আগে বলে ফেলত, সবশেষে কিছু বোঝাতে না পরে ঝগড়া করে ফেলত।
টিপু সংক্ষেপে বলল সে নিজে ডাকাতটিকে আগে কখনো দেখেনি কারণ সে আমাদের সাথে সে রাতে ছিল না। তবু সবার কাছ থেকে যেরকম বর্ণনা শুনেছে সেটি ওর ছোটবোন ঝুমুকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। বিশেষ জোর দিয়েছিল হাতের উপর, যে, হাতটা হয়তো কাটা থাকবে। ডাকাতদের নৌকা কি করম হয় সেটিও রীতিমত ছবি একে ঝুমুকে বুঝিয়ে দিয়েছিল। তারপর ওকে নান্টুর তৈরি টেলিস্কোপটা দিয়ে বলেছিল বাসার ছাদ থেকে নদীর উপরে নজর রেখে যদি সে রকম কোন নৌকা আর সে রকম কোন লোক খুঁজে বের করতে পারে তাহলে ওকে ওর প্রোজেক্টরটি দিয়ে। দেবে। ওর ছোটবোন ঝুমুর নাকি অনেকদিন থেকে এই প্রোজেক্টরটার ওপর লোভ। সেই থেকে ঝুমু সময় পেলেই বাসার ছাদ থেকে নদীর দিকে টেলিস্কোপ দিয়ে তাকিয়ে থাকত। ঝুমু কখনও বাসা থেকে বের হয় না, কারও সাথে মেশে না, ওর ডান পাটা একটু বাঁকা, সেজন্যেই বোধ হয়। তাই যতক্ষণ বাসায় থাকত, সারাক্ষণই টেলিস্কোপ দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত। এর জন্যে টিপু ওকে কদিন পরে পরেই টফির প্যাকেট কিনে দিত।
.
এরপরে অনেকদিন পার হয়ে গিয়েছে। টিপু আর ঝুমু, দুজনেই ব্যাপারটা ভুলে গিয়েছিল। নেহায়েত অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল বলে ঝুমু প্রতিদিন বিকেলে ছাদে উঠে টেলিস্কোপ দিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকত। এটা তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই যে টেলিস্কোপে কিছু দেখার মত আনন্দ আর কিছুতে নেই – যাকে দেখছে সে কিছু টের পাচ্ছে না অথচ তাকে কতো কাছে থেকে দেখা যাচ্ছে!
আজ বিকেলে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা লম্বা সাম্পানে কালোমত একটা হাতকাটা লোককে দেখে ঝুমুর হঠাৎ করে সব কথা মনে পড়ে যায়। নৌকাটি চলে যাচ্ছিল, বাঁকটার কাছে গিয়ে কেন জানি ফিরে এসে শ্মশানের কাছে থামিয়ে রেখেছে।
টিপু বিকেলে ম্যাটিনি শো’তে আলাদীনের সিনেমা দেখতে গিয়েছিল। ফিরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় ফিরতেই ঝুমু খবরটি দিয়ে প্রোজেক্টরটি নিয়ে গেছে।
আমি বললাম, তুমি বুঝলে কেমন করে ওটাই সেই ডাকাত সর্দার? আর এতো দেরি করে খবর এনেছ কেন? সন্ধে হয় সাড়ে পাঁচটায় – এখন আটটা বাজে!
আমার দিকে তাকিয়ে টিপু বলল, ওরা ঠিক ডাকাত কিনা বোঝার জন্যেই তো এতো দেরি হল।
কি রকম? আমি খুকখুক করে কাশতে কাশতে জিজ্ঞেস করলাম। এই ঠাণ্ডায় গাছতলায় দাঁড়িয়ে শিশিরে ভেজার ফল শুরু হল বুঝি।
বাসা থেকে টেলিস্কোপ দিয়ে শুধু আবছা নৌকাটাকে দেখা যায় কিছু বোঝা যায়, তার উপর সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। তাই কাছে থেকে দেখার জন্যে নৌকার কাছে গিয়েছিলাম।
একা?
না সাইকেলে করে এসে রবিনকে নিয়ে গিয়েছিলাম।
আমাদের বললি না কেন? আমরা কি হীরা ফোস করে উঠল।
আহ! শসস— রবিন আবার ঠোটে আঙুল চাপা দেয়। বেশি মানুষ নিয়ে গেলে হৈ চৈ হত। আর তোরা ছিলিও না কেউ।
তারপর কি হল? নান্টু তাগাদা দেয়, তাড়াতাড়ি বল, ভাত খেতে হবে।
ভাত? রবিন চোখ পাকায় এখনো ভাতের চিন্তা করছিস?
আহ! বল না
টিপু বলুক এটাই চাইছিলাম কিন্তু রবিনের উৎসাহকে ঠাণ্ডা করবে এমন দুঃসাহস কার?
রবিন বলতে শুরু করল, আমি আর টিপু হামাগুড়ি দিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে শ্মশানে “পার্থপ্রতিম মজুমদার” নাম লেখা যে বেদীটা আছে তার পিছে ঘুপচির ভিতরে গিয়ে বসলাম। সরসর করে পায়ের উপর দিয়ে সাপ চলে যাচ্ছে
সাপ? আমরা আঁতকে উঠলাম।
ঐ হলো। সাপ না হলে অন্য কিছু হবে।
টিপু আস্তে আস্তে বলল, ওগুলো তেলাপোকা ছিল।
হুঁ! রবিন টিপুর দিকে একটু ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার শুরু করল, আমরা যখন ওদের নৌকা থেকে মাত্র দুহাত দূরে ছিলাম –
দু হাত? হীরা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল।
ঐ রকমই হবে চার পাঁচ হাত।
না না এতো কাছে না, কুড়ি পঁচিশ হাত দূরে ছিলাম।
রবিন আবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে টিপুকে দেখে বলল, আমরা সেখান থেকে স্পষ্ট দেখলাম হাত কাটা সেই ডাকাতটা রাইফেলে তেল দিচ্ছে, গুলি ভরে
টিপু আবার বাধা দিল। গুলি ভরছিল না, নৌকার তলা থেকে বের করে বিছানার নিচে রাখল। আরে ওটা রাইফেল না, রাইফেলের নব থাকে। ওটা বন্দুক, দোনালা।
রবিন খেপে গিয়ে বলল, বেশ তুইই বল। একটা কথাও বলতে দিবি না –
মিশু বিরক্ত হয়ে বলল, এত বাড়িয়ে বলতে হয় নাকি? যা দেখেছিস তাই বল না।
রবিন মুখ খিঁচিয়ে বলতে শুরু করল। ও যা বলল সেটার আজগুবি অংশগুলি বাদ দিলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এরকম, ওরা যখন ওদের লক্ষ্য করছিল তখন দুজন নৌকা থেকে নেমে বিড়ি খেতে খেতে তীরে উঠে এল। তাদের আলাপ শুনে বোঝা গেল ইয়াসিন নামের কে একজন টাউনে গেছে, এগারোটার সময় আসবে। ওরা তার জন্যে অপেক্ষা করছে। অন্ধকার ছিল, একজন গোবরে পা দিয়ে পিছলে পড়ল, তাই দেখে অন্যেরা সবাই খুব হাসতে লাগল। যে পিছলে পড়েছে সে উঠে দেখে ওর সারা শরীর কাদায় গোবরে মাখামাখি। সে কাপড়, জামা খুলে রাখল ওই বেদীটার উপর—যার পিছনে ওরা দুজন লুকিয়ে ছিল। তারপর কোমর থেকে কি একটা খুলে রাখল – শব্দ শুনে মনে হল ধাতব কিছু। ডাকাতটা যখন নদীতে গোসল করতে নামল—এই শীতের মাঝে, তখন রবিন আস্তে আস্তে কাপড়, জামার ভিতর হতে হাত ঢুকিয়ে সেই ধাতব জিনিসটা বের করে আনল। ভেবেছিল ছোরা টোরা হবে কিন্তু হাতে নিয়ে দেখে রিভলবার! একেবারে সত্যিকারের রিভলবার!
তারপর ওরা আর দেরি করেনি গুঁড়ি মেরে সরে এসে সাইকেলে চড়ে পালিয়ে এনেছে।
রিভলবারটা? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
নিয়ে এসেছি।
নিয়ে এসেছিস? আমরা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কই? দেখা দেখি।
রবিন এদিক সেদিক তাকিয়ে কোমর থেকে রিভলব্যরটা বের করল, প্যান্টের ভিতর খুঁজে রেখেছিল। দেখি দেখি বলে সবাই হাত বাড়িয়ে দিল। টিপু বলল, খবরদার গুলি ভরা আছে কিন্তু।
আমরা হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশ ভারি। এখানে অন্ধকার ঠিক দেখা যাচ্ছিল না। মিশু হাতে নিয়ে কোথায় চাপ দিয়ে কড়াৎ করে খুলে ফেলল, অমনি গুলি গুলো খুলে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ল। আমরা হা হা করে উঠতেই মিশু বলল, ঠিক আব্বারটার মতো।
আমাদের খেয়াল হল মিশুর আব্বার রিভলবার আছে, তিনি এখানকার ডি এস পি। মিশু রিভলবার খুলে গুলি ভরতে পারে। সে দেখিয়ে দিল কিভাবে সেফটি ক্যাচ অফ করে ফেলার পর আর গুলি করা যায় না, আবার অন করতেই কিভাবে গুলি করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে ওঠে।
আমরা গুলিগুলো খুলে নিয়ে ফাঁকা রিভলবার দিয়ে গুলি করার চেষ্টা করলাম। ট্রিগারটা ভীষণ শক্ত, রবিন ছাড়া আর কেউ এক হাতে গুলি করতে পারল না। ওর সব কাজ এক হাতে করতে হয় তাই ওর হাতের আঙুলে দারুণ জোর।
বিভলবারটা রবিন আবার লুকিয়ে ফেলল কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এখন কি করবি? ডাকাতদের কথা থানায় –
থানায় বলে লাভ নাই। আমাদের কথা কেউ বিশ্বাস করবে না।
রিভলবারটা দেখাব।
তাহলে তোমাকেই ধরবে। বেআইনী অস্ত্র হাতে থাকলেই দশ বছরের জেল।
তাহলে উপায়? আর ওরা তো এতক্ষণে হয়তো রওনাই দিয়ে দিয়েছে।
সবাই চুপ করে থাকল! আমি বললাম তাহলে কি করা যায় কল!
রবিন কাটা হাতটা নাড়তে লাগল, সমস্যায় পড়ে গেলে ও সাধারণতঃ যা করে।
কি হল?
গলা খাকারি দিয়ে রবিন বলল, আমরা ঠিক করেছি টিপুর নৌকা দিয়ে আমরা ডাকাত দলটার পিছু পিছু যাব।
শুনে আমার বুকের ভিতর রক্ত ছলাৎ করে উঠল। উত্তাল নদীতে ডাকাত দলের পিছনে আমরা নৌকা নিয়ে ছুটে যাচ্ছি, প্রচণ্ড অট্টহাসির শব্দ, তার সাথে চ্যাট ট্যাট ট্যাট করে গুলি! পালে বাতাস লেগে নৌকা পানির বুক চিরে উড়ে চলছে, সবার চুল উড়ছে বাতাসে, তার মাঝে যুদ্ধ! মুহূর্তে আমার চোখের সামনে দিয়ে দৃশ্যগুলি ভেসে। উঠল। কিন্তু সাথে সাথেই আমার মনে পড়ল আমার বাম হাতটা ভাঙা, প্লাস্টার খুলবে আরো চৌদ্দদিন পরে, মনে পড়ল আমি জ্বরে কাহিল, ঠাণ্ডা লাগানো নিষেধ, সাথে সাথে খুকখুক করে কেশেও উঠলাম।
আমি সব ভুলে গিয়ে বললাম, তাহলে আর সময় কই? আমাদের রেডী হতে হবে না?
রবিন কিছু বলল না, পা দিয়ে মাটিতে দাগ কাটতে লাগল।
কি ব্যাপার?
তাহলে শোন—রবিন আবার গলা খাকারি দিল, তোকে আমাদের সাথে নিচ্ছি না।
কেন? আমার গলার আওয়াজ আর্তনাদের মত শোনালেও আমি বুঝতে পারলাম আমাকে সত্যি ওরা নেবে না, আর নেয়া সম্ভবও না। এক হাত ভেঙে পঙ্গু, এখনও জ্বর ভাল করে সারেনি, অনিয়ম করলে মারা যাব, ডাক্তার চাচা বলে গেছেন। তবু ব্যাপারটা ভাবতে গিয়ে আমার বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগল। রবিন, মিশু, টিপু, সলিল, হীরা, কাসেম, নান্টু সবাই যাবে। ডাকাত দলের পিছু পিছু ধাওয়া করে বেড়াবে, আর আমি, এই টোপন কিনা বাসায় বসে থাকব? ভাবতেই দুঃখে দম বন্ধ হয়ে এল।
আমি যাবই। কোন যুক্তি ছাড়াই আমি গোঁয়ারের মত চেঁচিয়ে উঠলাম।
তখন সবাই মিলে আমাকে বোঝাতে বসল। প্রথমে কেউই কথাটি বলতে পারছিল না, কিন্তু একবার বলার পর ব্যাপারটি খুব সহজ হয়ে গেল। টিপু বলল, নৌকা ডুবে গেলে সাঁতরাতে পারবে না, তোমার হাত প্লাস্টার করা।
আর রবিনের যে হাতই নেই!
আমার তো অভ্যাস হয়ে গেছে। এক হাতেই আবার সাঁতরানো শিখেছি! তোর হাত ভেঙেছে মাত্র সেদিন, এখনো হাড় জোড়া লাগেনি।
আর তোর অসুখও কমেনি—হীরা বলল, ঠাণ্ডা লেগে মরে যাবি।
এখনই খুকখুক করে কাশছিস।
হাতটা ধরে নান্টু বলল, শরীরে এখনো অল্প অল্প জ্বর। তুই থাক টোপন, আমরা যাই।
দুদিনের বেশি লাগবে না। আমরা এসে পড়ব।
এর পরের বার নিশ্চয়ই তোর অসুখ থাকবে না, তখন সবাই মিলে যাব।
আর কাল যখন হৈ চৈ পড়ে যাবে তুমি বুদ্ধি করে সামলে নিতে পারবে। সবাই তো তোমার কাছেই আসবে।
বলবি পিকনিকে গেছি, এসে পড়ব।
আরো সব কথা সবাই বলতে লাগল, আমি কিছু শুনতে পাচ্ছিলাম না। আমি বুঝতে পারলাম সত্যি ওরা আমাকে নেবে না। দুঃখে অভিমানে চোখে পানি এসে গেল। অন্ধকার তাই কেউ টের পেল না।
আমি মাথা নিচু করে ফিরে এলাম। সবাই বাসার দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। ওদেরও দুঃখ লাগছিল কিন্তু তাতে আমার দুঃখ কিভাবে কমবে? আমি ঢোক গিলে চোখ মুছে নিলাম। কি হবে দুঃখ করে?