১৪. ইসমাইল খাঁ
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা পিছনে ডাকাতের নৌকাটা দেখতে পেলাম। ওরা অনেক পিছনে, টেলিস্কোপে অনেক কষ্ট করে আবছা মত দেখা যায় তবে খুব তাড়াতাড়ি ছুটে আসছে। সবগুলি ডাকাতই খুব দারুণ নৌকা বাইতে পারে। আর একেকটার স্বাস্থ্য কি!
একটু পরেই সন্ধে হয়ে আসবে, আমরা জোরে জোরে হাত চালালাম! শুভাপুর আর বেশি দূরে নয়, বামদিকে বিষখালি নদীর মুখ, ওদিক দিয়ে মাইলখানেক যেতে হবে। বিষখালির মুখে এসে দেখি ভাটার টানে পানি হুড় হুড় করে বের হচ্ছে। সে কী স্রোত! এই স্রোত ঠেলে যাওয়া আমাদের কর্ম নয়! আমরা সেখানেই নৌকা বেঁধে ফেললাম, বেশি দরকার হলে একমাইল হেঁটেই চলে যাব।
টিপু হাঁড়িতে পানি গরম করে চা, চিনি বের করতে লাগল। ওর নাকি বিকালে চা না খেলে বিকালটা কাটতেই চায় না! চা তৈরি করতে করতে ডাকাতের নৌকাটা এসে পড়ল, থামল আমাদের কাছ থেকে অল্প দূরে। সেখানেই লগি পুঁতে তার সাথে বেঁধে ফেলল। আমরা একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলাম, ভাগ্য ভাল থাকলে এরকমই হয়। রবিন আর আমি ছইয়ের ভিতর ঢুকে পড়লাম, আমাদের দেখলে চিনে ফেলতে পারে। একটু পরেই অন্ধকার হয়ে যাবে তখন আর কোন ভয় থাকবে না। ডাকাতেরা ভাত রাঁধার আয়োজন করতে লাগল, আমাদের আশে-পাশে থেমে থাকা নৌকাগুলিও দেখি ভাত চড়িয়ে দিতে লাগল। কিন্তু আমাদের আর ভাত রাঁধার উৎসাহ ছিল না। টিপু বুদ্ধি দিল চিড়ে আর কলা কিনে আনতে। হীরা টিপু আর আমি চাদর মুড়ি দিয়ে ভাল করে ঢেকেঢুকে চিড়ে কলা কিনতে গেলাম। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে শুভাপুরের রাস্তা, ইদরিস খাঁর বাড়ি, কাছাকাছি থানায় যাবার সোজা পথ এসব জেনে আসব।
যাবার সময় রবিন আর সলিলকে আমরা নানাভাবে সাবধান করে এসেছি। ভীষণ শীত পড়েছে তার মাঝে গুটিশুটি মেরে আমরা চাদর জড়িয়ে যাচ্ছিলাম। আমার মনে হল গত পরশুদিনও জ্বরে বিছানায় শুয়ে ছিলাম! ভাগ্যিস আর জ্বর আসেনি।
বহুদূরে ছোট্ট একটা দোকান পাওয়া গেল। সন্ধ্যে হতে না হতেই ঝপ ফেলে বন্ধ করার আয়োজন করছে। আমরা চিড়ে কলা আর গুড় কিনলাম। আসার সময় ইদরিস খাঁর বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করতেই দোকানদার একটু অবাক হয়ে তাকাল, জিজ্ঞেস করল, ক্যান?
একটু দরকার ছিল।
এখানে তো ইদরিস খাঁ বলে কেউ নেই।
কেউ নেই? আমরা হতবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেউ নেই?
ইসমাইল খাঁ আছে। খানবাড়ির।
সেই হবে, টিপু মাথা নাড়ে। আমাদের ভুল হয়ে গেছে।
ইসমাইল খাঁর বাড়িটাই কদ্দুর?
এখান থেকে আধক্রোশ, দক্ষিণে।
একটু ভাল করে চিনিয়ে দেন না, আমরা যাব।
দোকানদার আমাদের বুঝিয়ে দিল। কাঁচা সড়কটা ধরে এক মাইল গেলে একটা মসজিদ পাওয়া যাবে, শায়েস্তা খাঁর আমলের, সেটার বাম পাশে বাঁশের সাকো। ওটা পার হয়ে ছোট সড়কটা ধরে খালের পাশেপাশে গেলে বড় যে টিনের বাড়িটা চোখে পড়বে, সামনে বড় দিঘি, সেটাই ইসমাইল খাঁর বাড়ি। ধানের গোলা আছে আর সামনে বড় বড় পাচ ছয়টা খড়ের পালা।
আমি একটু ইতস্ততঃ করে জিজ্ঞেস করলাম, কাছাকাছি কোথায় থানা আছে বলতে পারেন?
দোকানদার একটু অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকাল তারপর বলল, থানা দিয়ে কি হবে?
কাজ ছিল, বলে টিপু খুব অন্তরঙ্গ সুরে আবার থানার কথা জিজ্ঞেস করল।
জানা গেল শুভাপুর গ্রামটা দুটি থানার ঠিক মাঝামাঝি জায়গায়। দুটি থানাই নৌকায় দু ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টার পথ। তবে মিশু যেখানে আটকা আছে সেটি তুলনামূলক ভাবে কাছে। হেঁটেও যাওয়া যায়। ঠিক ঠিক শর্টকাট গলি ধরতে পারলে নাকি ঘণ্টা দেড়েকেও পৌঁছা যায়।
আমরা সব খবরাখবর নিয়ে আবার গুটিগুটি ফিরে এলাম। ফিরে আসার সময় দোকানদার কোথা থেকে এসেছি কোথায় যাব এইসব জিজ্ঞেস করছিল। আমরা না শোনার ভান করে পা চালিয়ে চলে এসেছি। আমার মনে হল ব্যাপারটা ভাল হল না, কিন্তু এছাড়া উপায়ও ছিল না।
নৌকায় এসে দেখি সলিল টেলিস্কোপটা হাতে নিয়ে ঝিমুচ্ছে। আমাদের দেখে ধড়মড় করে জেগে উঠল, অ্যাঁ তোরা? এতক্ষণে এসেছিস?
হুঁ। রবিন কই?
রবিন? সলিল বোকার মত এদিক সেদিক তাকায়। এই তো, এখানেই ছিল।
কই গেল? আমরাও এদিক-সেদিক খুঁজলাম, চাপা স্বরে ডাকলাম, রবিন! রবিন!!
এখন চুপচাপ বসে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কি করা যায়! চারিদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, ভাঙা চাঁদটা মিছেই অন্ধকার দূর করার চেষ্টা করছে। এক্ষুনি থানাতে রওনা দিয়ে দেয়া দরকার। কিন্তু রবিনকে না পেলে সেটি করাও যাচ্ছে না। হম্বিতম্বি করে নিজেকে সর্দার বলে দাবি করে সত্যি কিন্তু ওকে ছাড়া কাজও চালানো যায় না।
প্রায় পনেরো মিনিট পর রবিন হঠাৎ পানি থেকে ভুস করে ভেসে উঠল। মাথায় কচুরিপানা লেগে আছে, শীতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে লম্বা লম্বা শ্বাস নিচ্ছে। আমরা ওকে টেনে নৌকায় তুললাম।
কি করছিলি? পানিতে নেমেছিলি ক্যান?
বলছি। রবিন হি হি করে কাঁপতে থাকে। কাপড় বদলে কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে উত্তেজিত রবিন হড়বড় করে বলল, ও অন্ধকারে ডাকাতের নৌকার পাশে ঘুপচি মেরে ভেসেছিল, মাথা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে। ওদের পরিকল্পনা খুঁটিনাটি শুনে এসেছে। আমরা মহা উত্তেজিত হয়ে রবিনকে খামচাখামচি শুরু করলাম, তোর দারুণ সাহস তো!
সাংঘাতিক!
এই শীতের মাঝে গেলি কেমন করে?
ভয় করল না?
রবিন বুকের মাঝে টোকা দিয়ে বলল, ইয়ে হায় রবিন কা বাচ্চা রবিন!
আমরা ডাকাতদের পুরো পরিকল্পনাটা রবিনের মুখে শুনলাম। রবিন বলল, যে বাড়িতে ডাকাতি করবে তার নাম ইসমাইল খাঁ— ইদরিস খাঁ নয়।
আমরা একে অন্যের মুখের দিকে তাকালাম। টিপু বলল, ইদরিস খাঁ বলে আসলে কেউ নেইও। খোঁজ নিয়ে এসেছি।
ডাকাতেরা চাঁদ ডুবে যাওয়ার ঠিক পরে পরে রওনা দেবে। ইসমাইল খাঁর বাড়িতে -করিমন নামের একটা মেয়ে লোক থাকে, সে দরজা খুলে রাখবে। ওরা ভিতরে ঢুকবে ছয়জন, বাইরে পাহারা থাকবে ছয়জন। দুজন দিঘির পাড়ে অন্যের বাড়ির আশেপাশে ডাকাতি করার সময়ে প্রথমে ফাঁকা গুলি করবে আর চেঁচামেচি করে এদিকে সেদিকে আগুন লাগিয়ে দেবে। লোকজনকে বেঁধে ফেলবে, ঘরে বন্ধ করে রাখবে, দরকার হলে মারধর করবে।
সলিল একটু শিউরে উঠল।
যারা ভিতরে ঢুকবে তারা ইসমাইল খাঁ আর তার ছেলেদের বেঁধে ফেলবে, তারপর ভীষণ মার দিতে থাকবে যতক্ষণ না সিন্দুকের চাবি দিয়ে দেয়। গতকাল বিক্রি করা ধানের সতের হাজার টাকা, ইসমাইল খাঁ আর তার ছেলেদের বৌয়ের বিশত্রিশ ভরি সোনার গয়না, ইসমাইল খাঁর দোনালা বন্দুকটা, আর মূল্যবান জিনিসপত্র যা আছে সব নিয়ে ওরা বের হবে।
সর্বনাশ! তারপর?
যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে ওরা ইসমাইল খাঁয়ের চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে ঢুকবে, একই ভাবে। তারপর পাশের বাড়ি, তারপর তার পাশেরটা এভাবে যতক্ষণ পারা যায়।
একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে রবিন একটু দম নিল। আমি আরও কিছুক্ষণ থাকতাম কিন্তু পানির ভিতরে কি একটা পায়ের উপর দিয়ে স্যাঁৎ করে চলে গেল। নড়ে উঠতেই একটু শব্দ হয়ে গেল, সাথে সাথে ডাকাতেরা সবাই চুপ করে গেল। সর্দারটা একজনকে বলল বাইরে কি শব্দ করছে দেখতে।
সর্বনাশ! তারপর?
আমি সাথে সাথে ডুব সাঁতার দিয়ে একেবারে এইখানে।
টিপু বলল, আর কিছু শোনোনি? কতজন লোক কি সমাচার?
রবিন অধৈর্য হয়ে মাথা ঝাঁকালো, ওরা কি আর চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পরামর্শ করছে। গুজগুজ করে কথা বলে আর কি বিশ্রী ভাষা! ভীষণ তর্ক করছিল তাই এক কথা বারবার বলছিল। তাতেই কিছু কিছু বোঝা গেল।
ওদের কটা বন্দুক?
তিন চারটা হবে। অন্যেরা বর্শা দা এসব নিয়ে যাবে। রিভলবারটা হারিয়েছে বলে চান্দু নামে একটা ডাকাতকে সবাই বিশ্রী করে একটু পরে পরে গালি দিচ্ছে।
ওরা কি কাউকে মেরে টেরে ফেলতে পারে?
দরকার না পড়লে ওরা কাউকে খুন করবে না বলেছে! কিন্তু দরকার হয়তো পড়তে পারে। ইসমাইল খাঁ নাকি খুব শক্ত মানুষ!
ডাকাতদের পিছে পিছে রওনা দেয়ার সময় আমরা যেসব হালকা অ্যাডভেঞ্চারের কথা ভেবে রেখেছিলাম, ঘটনার ঠিক সামনাসামনি এসে সেসব কর্পূরের মত উবে গেছে। সবার ভিতরে আতঙ্ক ঢুকে গেছে, রবিন পর্যন্ত কোন কথা না বলে রিভলবারটা নাড়তে লাগল।
অনেকক্ষণ পর টিপু বলল, আমাদের এখনই থানায় খবর পাঠানো উচিত।
সলিল বলল, অবস্থা যে রকম তাতে মনে হচ্ছে আমরা নিজেরা কিছু করতে পারব না।
রবিন চোখ পাকিয়ে সলিলের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
.
চিড়ে গুলো কলা দিয়ে চিবিয়ে খেয়ে আমরা বেশি করে পানি খেয়ে নিলাম। রবিন গুলি ভরে রিভলবারটা কোমরে বেঁধে নিল, অন্যেরা চাকু টর্চ দড়ি এইসব নিয়ে যুদ্ধ সাজে সেজে নিলাম। তারপর গায়ে চাদর জড়িয়ে নৌকা ছেড়ে তীরে উঠে আমরা। হাঁটতে লাগলাম। সলিল আর হীরাকে থানার রাস্তায় উঠিয়ে দিয়ে আমরা গোপনে ইসমাইল খাঁর বাড়ি যাব।
একটু পরেই রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। আমরা তার মাঝে দ্রুত হেঁটে চলেছি। হঠাৎ পিছনে ভীষণ একটা গলার আওয়াজ শোনা গেল, কারা যায়? দাঁড়াও!
ঝট করে কোমরে হাত দিয়ে রবিন ঘুরে দাঁড়াল, সাথে সাথে আমরাও। দুজন লোক এগিয়ে আসছে। টিপু টর্চ জ্বাললো, একজন সেই দোকানদার, আরেকজনকে চিনি না।
লোকটি বয়স্ক, লম্বা চওড়া, পাকা দাড়ি, অভিজাত চেহারা। দোকানদার আমাদের দেখিয়ে বলল, এই যে হুজুর, এরা।
পাকা দাড়িওয়ালা লোকটা আমাদের একনজর দেখল তারপর কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমরা কারা? কোত্থেকে এসেছ?
রবিন উদ্ধত স্বরে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?
লোকটি ক্ষেপে গেল মনে হল। এগিয়ে এসে আরো কঠোর গলায় জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে এসেছ তোমরা? কি চাও?
আমরা মনে হচ্ছিল এ লোকটিই ইসমাইল খাঁ। একটু দ্বিধা করে জিজ্ঞেসই করে ফেললাম, আপনার নাম কি ইসমাইল খাঁ?
লোকটি ঘুরে আমার দিকে তাকাল। বলল, হ্যাঁ।
রবিন হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল, আপনাকেই আমাদের দরকার। আমাদের আপনার বাড়ি নিয়ে চলুন। তাড়াতাড়ি।
টিপু বলল, থানাতে এক্ষুনি একটা লোক পাঠাতে হবে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে যেন পৌঁছে যায়।
ইসমাইল খাঁ একটু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। বললেন, কি বলছ তোমরা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না!
সব বুঝিয়ে দেব। রবিনের গলায় আবার কর্তৃত্বের স্বর ফুটে ওঠে, তাড়াতাড়ি নিয়ে চলুন, দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
সবাই মিলে আমরা ইসমাইল খাঁর বাড়িতে ছুটলাম।