০৪. সাহেব বাড়ির ভূত
কদিন ধরেই দেখছি রবিন কি যেন ভাবছে, আমাদের কিছু বলছে না। বুঝতে পারলাম কাসেমকে দলে টানার প্ল্যান করছে। অনেক করে বলার পরও রবিন আগে থেকে কিছু জানাতে রাজি হল না।
সেদিন রাত আটটার দিকে রবিন আমাদের বাসায় এসে হাজির। আমাকে সোজাসুজি অগ্রাহ্য করে আম্মার কাছে গিয়ে বলল ও একটু বাইরে যাবে আমাকে নিয়ে যেতে চায়। ঘণ্টাখানেকের মাঝেই ফিরে আসবে। আম্মা বহুদিন থেকে আমাদের চেনেন কাজেই কথা না বলে আমায় ডেকে দিলেন। রবিনকে নিয়ে বাইরে এসে দেখি হীরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে, সলিলও আছে। সলিলের হাতে একটা কালো কাপড়ের বাণ্ডিল, হীরার কাছে একটা বড় বোতল, দুটি মাটির হাঁড়ি।
কি ব্যাপার? আমি অবাক হলাম। এসব দিয়ে কি করবি?
আয় না! কাসেমের বারোটা বাজাব।
রবিনের কাছে জানতে পারলাম কাসেম রাতে অংক স্যারের বাসায় অংক করতে যায়। যে পথ দিয়ে ফিরে আসে সেখানে সাহেব বাড়িটা পড়ে। পুরানো দালানের পাশে বেশ খানিকটা জঙ্গল, রাত বিরেতে ওখানে নাকি ভূত দেখা যায়। রবিন অনেক খবর নিয়েছে, রাত সাড়ে আটটার দিকে কাসেম নাকি এই পথ দিয়ে একা ফিরে যায়। রবিন ঠিক করেছে আজ সাহেব বাড়ির পাশে থেকে কাসেমকে ভয় দেখিয়ে দেবে – যেন আর ঠাকুরপাড়ার টীমে না খেলে।
আমার ঠিক বিশ্বাস না হলেও পুরো ব্যাপারটা ভারি মজার মনে হচ্ছিল। সবাই মিলে গুটিগুটি হেঁটে সাহেব বাড়ির পাশে হাজির হলাম। অন্ধকার, জঙ্গল, গাছপালা দেখে আমার বেশ ভয় ভয় করতে লাগল। এরপর রবিন হীরাকে সাজাতে বসল। মাটির হাঁড়িটা হাতে নিয়ে হীরা হাত উঁচু করে দাঁড়াল আর কালো শাড়িটা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ওকে ঢেকে দেয়া হল। দেখতে হল নাংগা একটা পেত্নীর মত। তারপর রবিন একটা মুখোশ বের করল, ভয়ানক বিচ্ছিরি দেখতে – আমার গা ছমছম করে উঠে। তারপর সেটি ওর উঁচুকরা দু হাতে ধরে রাখা হাঁড়িটার সাথে বেঁধে দেয়া হল।
কাসেম যখন আসতে থাকবে তখন তুই কিছু করবি না। রবিন হীরাকে এর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। যখন কাছে আসবে তখন আস্তে আস্তে হেঁটেহেঁটে ওর খুব কাছে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে এই জঙ্গলে ঢুকে পড়বি। ব্যাস একটা কথাও বলবি না, একবারও সোজাসুজি ওর দিকে তাকাবি না। বাকি সব আমরা করব।
সলিলকে পানি ভর্তি বোতলটা দিয়ে রবিন ওকে একটা গাছে তুলে দিল। গাছে উঠে বসলে বুঝিয়ে দিল, তোর কাছাকাছি আসতেই বোতলটা কাত করে পানি ঢালতে থাকবি। পারলে ওর শরীরের উপর! সলিল শুনে খিকখিক করে হেসে উঠল।
আমাদের ভাগ্য ভাল এর মাঝে কেউ এসে পড়েনি। দূরে কার গলার আওয়াজ পেয়ে আমি আর রবিন তাড়াতাড়ি জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়লাম। দুজন লোক হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল। রবিন অনেকগুলো ঢিল জড়ো করে সাহেব বাড়িটার বারান্দায় উচু রেলিংয়ের পাশে বসে রইল। আমি একটু এগিয়ে লক্ষ্য করতে থাকলাম কাসেমকে দেখা যায় কিনা।
সলিল যখন পিঁপড়ের কামড় খেয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল, হীরার দুহাত যখন টন টন করতে থাকল তখন শোনা গেল কাসেম আসছে। আমাদের হিসেবে ভুল করে দিয়ে সাথে ঠাকুরপাড়ার একটা ছেলে, গলা শুনে বুঝতে পারলাম আক্কাস, ঠাকুরপাড়ার ফুটবল টীমের ক্যাপ্টেন। একজনকে ভয় দেখানো যত সহজ দুজনকে দেখানো তত নয়। তবু আমরা হাল ছাড়লাম না। ওরা একটু কাছাকাছি আসতেই রবিন দুটো ঢিল ছুঁড়ল। ঢিল দুটো পড়ল ওদের পিছনে বেশ শব্দ করে।
ও কি? কাসেম ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল।
কি জানি। আক্কাসের গলার স্বরে ভয়। আমার হাসিতে পেট ফেটে যেতে চাইল। ঢিল দুটো পিছনে পড়েছে তাই ওরা পিছনে যেতে সাহস পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে এগুতে লাগল। অমনি রবিন বাকি মাটির হাঁড়িটার ভিতর মুখ ঢুকিয়ে নাক চেপে বিদঘুটে আওয়াজ করল, ঘ্রাঁ ঘোঁ ওঁ ওঁ ওঁ…।
লাইলাহা ইল্লাল্লাহু … কাসেম তোতলাতে থাকে।
আক্কাস ফিসফিস করে বলল, কাসেম তাড়াতাড়ি চল। জায়গাটা খারাপ।
অমনি রবিন নাক চেপে, মাটির হাঁড়ি মুখে নিয়ে উৎকট স্বরে সুর করে বলতে থাকে,
ঘ্রাঁ ঘোঁ ঘ্রাঁ ঘোঁ নাকঁ কাঁটা পেঁট ফুঁটো হাঁদা
ভিঁন পাড়াঁতে ঘুঁরিস কেঁন কাঁসেম হাঁরামাজাঁদা
নাঁক খসবেঁ চোঁখ ফুলবেঁ কিকঁকিড় মিঁককিড় ধাঁ
রক্তঁ দিঁয়ে চুষেঁ খাব ঘাড় কলঁজে পাঁ
…।
ইয়াল্লা— কাসেম আর্তনাদ করে ওঠে। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ….
আমি এদিকে সেদিকে তিন চারটা ঢিল মারলাম। ওরা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়াতেই দুটো ঢিল মারলাম পিছনে। ওরা আবার দৌড়াতে থাকে। সলিলের গাছের নিচে আসতেই ঝরঝর করে সলিল পানিটা ঢেলে দেয়।
আক্কাস চেঁচিয়ে ওঠে, কে যেন– কে যেন আমার গায়ে পেশাব করে দিয়েছে
আমি বুঝতে পারলাম রবিন বোতলে সাধারণ পানি দেয়নি। কাসেমের গলার স্বর বিকৃত হয়ে গেছে। শুনলাম ও বলছে দৌড় দে– দৌড় দে—
ঠিক এই সময়ে ওরা হীরাকে দেখতে পেল। লম্বা মিশমিশে কালো, দাঁত বের করা বীভৎস মূর্তি খুব আস্তে আস্তে হেঁটে রাস্তা পার হচ্ছে।
কে? কে? বলে কাসেম মিছেই ভাঙা গলায় চেঁচাল।
রবিন কাছাকাছি এসে আবার উৎকট স্বরে শুরু করল,
ঘ্রাঁ ঘোঁ ঘ্রাঁ ঘোঁ নাঁক কাঁটা পেঁট
ফুঁটো হাঁদা।
ভিঁন পাড়াঁতে ঘুঁরিস কেন কাঁসেম হাঁরামজাঁদা …
ঠিক সেই মুহূর্তে একটা কেলেঙ্কারি হয়ে গেল। কাসেম আঁ আঁ করে চেঁচাতে চেঁচাতে হীরাকে জাপটে ধরে গোঁ গোঁ করতে লাগল। আমার মনে হল ফিট হয়ে গেছে। হীরা ঘাবড়ে গিয়ে মুখোশ খুলে চেঁচিয়ে উঠল, ছাড়, ছাড় বলছি, আমি হীরা!
কে শোনে কার কথা! কাসেম তখন ভয়ের শেষসীমায় পৌঁছে সব রকম কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছে। আমরা সবাই ছুটে এলাম সলিলও গাছ থেকে নেমে এল। আমরা যে ওকে ভয় দেখিয়েছি ভূতটা যে হীরা, কাসেম সেসব কিছুই বুঝতে পারছিল না। কি রকম একটা শব্দ করে থর থর করে কাঁপছিল। আমার ভয় হতে লাগল, মরেই যাবে নাকি?
আক্কাস প্রথমে আমাদের খুব বিশ্রী করে গালি দিল। কাসেমের এ অবস্থা না হলে হয়ত মেরেই বসত। কাসেম খানিকক্ষণ পর একটু ধাতস্থ হয়ে আমাদের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। আমরা কি করব বুঝতে না পেরে বোকার মত হাসতে লাগলাম। আক্কাস আরেকবার গালিগালাজ শুরু করতেই রবিন ধমকে উঠে বলল, থাম তো। তুইই বললি ভয় দেখাতে, আবার এখন নিজেই–
আমি? আক্কাসের চোখ কপালে উঠে গেল!
রবিন আমাকে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ খোঁচা দেয়, দ্যাখ দ্যাখ কি রকম অ্যাকটিং করছে!
আক্কাস মুখ চোখ লাল করে বলল, মিছে কথা বলবি না।
রবিন ভীষণ সরলভাবে বলল বাঃ! আমরা কাসেমকে শুধু শুধু ভয় দেখাব কেন? তুইই তো সেদিন বললি, কাসেম নাকি ভীতু ওকে ভয় দেখিয়ে মজা পাওয়া যায়!
এক চড়ে দাঁত ভেঙে ফেলব। আক্কাস তোতলাতে থাকে।
দ্যাখ রবিনও ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। কাউকে বলতে নিষেধ করে তুই কবিতাটা পর্যন্ত লিখে দিলি। মাটির হাঁড়ি জোগাড় করে দিলি। আমাদের বললি আজ যেভাবে হোক কাসেমকে নিয়ে আসবি।
আক্কাস এইরকম আক্রমণে একেবারে হতবাক হয়ে পড়ে। আমরাও তখন শুরু করলাম,
আমি বললাম, কাজ নেই কাসেম ভয় পেতে পারে, তুই বললি ভীতু ছেলেকেই তো ভয় দেখাতে মজা!
কাসেম কখনো ভীতু নয়- হীরা বলল, সেবার মিউনিসিপ্যাল স্কুলের সাথে মারামারি করেছে না?
তাই তো! সলিলও খুব অবাক হবার ভান করে, আক্কাস কেন যে ভীতু ভীতু করছিল বুঝতে পারছিলাম না।
আমরা সবাই কাসেমের কাছে মাফ চেয়ে নিলাম। আক্কাসের বুদ্ধি অনুযায়ী এটা যে করা উচিত হয়নি রবিন বারবার সেটা স্বীকার করল।
পরদিন প্রকাশ্যে স্কুলের মাঠে কাসেম আর আক্কাসের মারামারি হয়ে গেল। হেডস্যার দুজনকেই পিটিয়ে দিলেন। সেদিন বিকেলেই কাসেম আক্কাসের টীমে লাথি মেরে আমাদের টীমে চলে আসল! কৃতজ্ঞতা বশতঃ হীরা ওকে ভাইস ক্যাপ্টেনের পদটা ছেড়ে দিল।