০১. নতুন ভাড়াটে

হাতকাটা রবিন – মুহম্মদ জাফর ইকবাল

ভূমিকা

তোমরা কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস কর আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ কি, আমি কি বলব জান? আমি বলব, আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ যে আমি বড় হয়ে গেছি! আমার চমৎকার শৈশবটি আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে, আর কখনো আমি সেটা ফিরে পাব না।

কিন্তু মজার ব্যাপার হল আমি যখন তোমাদের জন্যে লিখি হঠাৎ হঠাৎ আমার সেই হারিয়ে যাওয়া কৈশোর এসে আমার কাছে ধরা দেয়! মনে হয় আবার আমি ছোট হয়ে গেছি, তখন আমি উপন্যাসের চরিত্রদের সাথে মাঠে-ঘাটে, বনে-জংগলে ঘুরে বেড়াই, বিচিত্র সব এডভেঞ্চারে অংশ নিই, আর আমার বুকের ভিতরে আশ্চর্য এক ধরনের আনন্দ হতে থাকে।

এই বইয়ের উপন্যাসগুলি পড়ে তোমরা যদি আমার সেই আনন্দটুকু একটুখানিও অনুভব করতে পার আমার আর কিছু চাইবার নেই।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পল্লবী, ঢাকা

.

০১. নতুন ভাড়াটে

আমাদের পাশের বাসাটা অনেকদিন খালি পড়ে ছিল। গতরাতে নতুন ভাড়াটে এসেছে। আগে এখানে মাসুদরা থাকত। মাসুদ ছিল আমাদের এক নাম্বারের বন্ধু। তাই মাসুদের আব্বা বদলি হয়ে চলে গেলে আমরা সবাই মনমরা হয়ে কয়েকদিন ঘুরোঘুরি করেছিলাম। তারপর আমাদের হাসপাতালটা উঠে গেল। (সে যে কি দারুণ একটা হাসপাতাল আমাদের ছিল!) আমাদের হাসপাতালে মাসুদ ডাক্তার, ওর আব্বা ডাক্তার কিনা, আর আমরা সবাই নার্স। মাসুদরা চলে গেলে ডাক্তারের অভাব হয়ে গেল। তাই হাসপাতালটাও উঠে গেল। আমরা কেউ বুঝতে পারিনি যে মাসুদ চলে যাবে তাহলে না হয় আমরা কেউ ডাক্তারিটা শিখে নিতাম– ওটা এমন কিছু কঠিন নয়।

মাসুদরা চলে গেলে ওই বাসায় যারা এসেছিল তাদের আব্বাও ডাক্তার। এটা সরকারী ডাক্তারের বাসা আর এখানে সবসময় ডাক্তার আসেন। আমরা ভাবলাম এ ছেলেটা হয়তো আমাদের ডাক্তার হবে, আমরা হাসপাতালটা আবার চালু করব। কিন্তু ছেলেটা মোটেই আমাদের সাথে কথা বলল না। বোনদের নিয়ে বারান্দায় বসে লুডু খেলত। আমাদের ফুটবল টিমে একজন কম পড়েছিল বলে তাকে কত ডাকলাম তা সে কিছুতেই এল না। ওদের একটা গাড়ি ছিল সেটাতে করে ঘুরে বেড়াত আর আমাদের দিকে এমনভাবে তাকাত যেন আমরা রাস্তার ‘ছোঁড়া’! হীরা ঠিক করেছিল ওর মাথায় একদিন ঢিল মারবে, মেরেছিল কিনা কে জানে! ওটা যা পাজি! পরে আমাদের দেখলেই ওই ছেলেটা ঘরের ভিতরে চলে যেত। ওরা চলে গেলে আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম।

আমি দেখেছি একবার কোনো বাসায় বন্ধু থাকলে, এর পরে যে আসে সে শত্রু হয়। এরপর আবার বন্ধু আসে। আমি নান্টু, হীরা, সলিল, মিশু ওদেরকেও এটা বলেছি, ওরা সবাই আমার কথা স্বীকার করেছে। মিশুরা যখন ঢাকায় থাকত তখন নাকি এটা ওর এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে ওর বন্ধুরা চলে গেলে সে বাসায় যাবা আসত তাদের সাথে সে কথাই বলত না, কারণ এ তো জানা কথা তারা ওর শত্রু হবে। এরপর শত্রুরা চলে গিয়ে আর কেউ আসলে ও আবার বন্ধু তৈরি করত। এটা নাকি ওর ভীষণ অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

কাল রাতে যখন মাসুদদের বাসায় নতুন ভাড়াটে আসল তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবারে একজন বন্ধু পাব। আমি জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম– একটা ছেলেকে আবছা আবছা দেখেছি। আমি ঠিক জানি ও আমাদের বন্ধু হবে। তাই সকালবেলা আমরা ওই বাসার সামনে ঘুরোঘুরি করছিলাম। তারপর আমরা বাসার সামনে বড় পেয়ারা গাছটাতে পা দুলিয়ে বসে থাকলাম। গাছটায় একটাও বড় পেয়ারা নেই সব খেয়ে ফেলেছে। মাঝে মাঝে পাতার আড়ালে হঠাৎ করে বড় পেয়ারা পেয়ে গেলে আমরা সবাইকে এক কামড় করে খেতে দিই। হীরাটার কথা অবিশ্যি আলাদা, ও পেলে একলাই খায়।

অনেকক্ষণ ওই বাসাটার দিকে তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমাদের বয়সী একটা ছেলে তিন লাফে বেরিয়ে এল, তারপর আবার ঢুকে গেল। খানিকক্ষণ পর ছেলেটা একটা শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে আবার বেরিয়ে এল। ওকে দেখে আমরা এত অবাক হলাম যে গাছ থেকে নেমে ওকে ডাকার কথা ভুলে গেলাম। আমাদের সমানই হবে ছেলেটা, কাল হাফপ্যান্ট আর লাল ফুলশার্ট পরনে। শাটটার বাম হাতটা কনুইয়ের পর গিঁট মেরে ঝুলিয়ে রেখেছে–ওর হাতটা ওখান থেকে কাটা।

ছেলেটা এদিক সেদিক তাকাল তারপর আমাদের গাছে বসে থাকতে দেখে হেঁটে হেঁটে গাছটার নিচে এসে দাঁড়াল, এক হাতে তরতর করে কি ভাবে জানি গাছটাতে উঠে মুখ কুঁচকে বলল, তোরা সব এ পড়ার ছেলে? হ্যাঁ?

বিশ্বাস হতে চায় না, পরিচয় নেই কথাবার্তা নেই অথচ প্রথমেই ঠিক এই কথাটা বলল? আমরা ভীষণ অবাক হলাম। রাগ হলাম আরও বেশি। হীরা বলল, খবরদার, তুই তুই করে কথা বলবি না।

তুইও তো তুই তুই করে বললি! বলে ছেলেটা ফ্যাকফাক করে হেসে ফেলল। তারপর বলল, তোরা নিজেরা তুই তুই করে বলিস না?

হুঁ। আমি মাথা নাড়লাম। বলি তো কি হয়েছে?

আমি বললে দোষ কি? আমিও তো এখানে থাকব।

ওর যুক্তিটা আমরা ফেলতে পারলাম না। বলতে কি উত্তরে বলার মত কিছু পেলামও না। তাই বলে খুব খুশি মনে যে ওকে স্বীকার করে নিলাম তা নয়। নেহায়েত হাতটা কাটা তাই একটু কৌতূহল হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার হাত কেটেছে কেমন করে?

কাটেনি।

তাহলে?

ইঁদুরে খেয়ে নিয়েছে। বলে সে কাটা হাতটা দুলিয়ে হিঃ হিঃ করে হেসে উঠল।

বলো না শুনি।

বলব না। বলে এই আশ্চর্য ছেলেটা চুপ করে গেল। তারপর পা দোলাতে দোলাতে জিজ্ঞেস করল, তোরা দিনরাত গাছে বসে থাকিস?

আমি মুখ বাঁকা করে তাচ্ছিল্য করে ওকে উড়িয়ে দিলাম। বললাম, আমাদের ম্যালা কাজ। গাছে বসে থাকব কেন?

আজ যে বসে আছিস?

আজ যে ওর সাথে পরিচয় করার জন্যে বসে আছি সেটা তো আর বলতে পারি না! আমি তাই কোন উত্তর দিলাম না। বুঝতে পারলাম এ ছেলেটা ভারি পাজি হবে, আমাদের অনেক জ্বালাবে।

তোরা কি করিস? ছেলেটা আবার খোঁচাতে শুরু করল। মেয়েদের সাথে বুড়ী-চি খেলিস বুঝি? নাকি এক্কা দোকা? তারপর আবার হিঃ হিঃ করে হাসতে লাগল।

দ্যাখ নতুন এসেছিস বলে তোকে ছেড়ে দেবো ভাবিস না। আবার ওরকম খ্যাক খ্যাক করলে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেব। হীরা অনেকক্ষণ সহ্য করে যাচ্ছিল, এবারে একটু ধাতানি দিল।

হাড় গুঁড়ো করে দিবি বুঝি? দে না বলে সেই অবাক ছেলে হীরার কাছে এগিয়ে যায়।

হীরা হাড় গুঁড়ো করার কোন উৎসাহ দেখায় না। আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে পড়ে। সাথে সাথে আমরাও, বুঝতে পারলাম এই প্রথম আমাদের বন্ধুর পর শত্রু, শত্রুর পর আবার বন্ধু আসার নিয়মটা খাটল না। এবারে শত্রুর পর আবার শত্রু চলে এসেছে। আমাদের চলে যেতে দেখে ছেলেটা গাছ থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিস?

আমরা উত্তর না দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

দাঁড়া, আমিও আসি বলে এক হাতে একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ে সে দুই লাফে আমাদের কাছে চলে এল।

কথা বলছিস না যে?

হীরা গোঁ গোঁ করে বলল, তোকে কেউ ডাকছে না।

ছেলেটা না শোনার ভান করে পাশাপাশি হেঁটে যেতে থাকে। পথে একটা কুকুরকে ঢিল ছুঁড়ে ভয় দেখাল, একটা ছাগলের বাচ্চার পিছনের দুই পা ধরে খানিকক্ষণ দুই পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে বেড়াল। তারপর আবার গম্ভীর হয়ে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে এটা সেটা জিজ্ঞেস করতে লাগল। আমরা কখনো ওর কথার উত্তর দিচ্ছিলাম, কখনো দিচ্ছিলাম না, ও মোটেই সেসব খেয়াল করছিল না। সত্যি কথা বলতে কি এই হাত কাটা ছেলেটাকে আমার খারাপ লাগছিল না আর এমন কৌতূহলী হয়ে উঠছিলাম যে বলার নয়।

নান্টুদের বাসার বাইরে আমরা এসে দাঁড়ালাম। ওদের বাসার বাইরের দিকে একট ঘর সবসময় খালি পড়ে থাকত। আমরা এটাকে পরিষ্কার করে নিয়ে আমাদের হাসপাতাল খুলেছিলাম। হাসপাতাল উঠে যাবার পর আমরা যে সার্কাসের টিম খুলেছিলাম সেটার হেড অফিসও ছিল এখানে। এখন এখানে আমাদের ডিটেকটিভ এজেন্সির অফিস। হাত কাটা ছেলেটাকে এখানে নিয়ে এসে গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠল। ঘরের বাইরে আমাদের সাইন বোর্ড (শফিক ভাই করে দিয়েছেন, উনি যা চমৎকার ছবি আঁকেন!) সাইন বোর্ডে লেখা, ‘ “প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি কোঃ” শার্লক হোমস অ্যাভিনিউ’। (আমরা এই এলাকাটাকে শার্লক হোমস অ্যাভিনিউ নাম দিয়েছি-– পিয়নকে বলে দিয়েছিলাম শার্লক হোমস অ্যাভিনিউয়ে কোন চিঠি এলে যেন এ পাড়াতে নিয়ে আসে।) ছেলেটা খুব মনোযোগ দিয়ে সাইন বোর্ডটি পড়ল। আমার সন্দেহ হল হয়ত এই ছেলেটা শার্লক হোমসকে চেনে না। তাই জিজ্ঞেস করলাম, শার্লক হোমস কে জান?

ছেলেটা ঠোঁট উল্টে বলল, খুব জানি। ওর সিনেমা পর্যন্ত দেখেছি।

আমি একটু দমে গেলাম। ভেবেছিলাম শার্লক হোমসের পরিচয় দেব, ওঁর সম্বন্ধে দু একটা কাহিনী বলব, আর নাচুনে পুতুলের গুপ্ত সংকেত যে আমরাও জানি সেটাও জানিয়ে দেব। কিন্তু ছেলেটা নাকি শার্লক হোমসের সিনেমাও দেখেছে!

আমি গম্ভীর হয়ে নান্টুকে বললাম তালাটা খোল তো। দরজায় একটা নাম্বার লক লাগানো, নাম্বার মিলিয়ে খুলতে হয়। নাম্বারটা আমরা ছাড়া পৃথিবীর আর কেউ জানে না। ‘প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সি কোঃ’র সব সদস্যদের প্রথমেই প্রতিজ্ঞা করতে হয় কোন অবস্থাতেই তারা কাউকে এ নাম্বার জানাবে না। এই ঘরে আমাদের যাবতীয় গোপন তথ্য। আমরা তালা খুলে ভিতরে ঢুকে জানালা খুলে দিলাম। ভিতরটা দারুণ ভাবে সাজানো। একটা টেবিল, সামনাসামনি দুটো চেয়ার, একটা টুল, একটা বাক্স (অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই); দেয়ালে দুর্ধর্ষ ডিটেকটিভদের ছবি— শার্লক হোমস, জেমস বণ্ডেরও আছে। তাকে সেরা সেরা সব ডিটেকটিভ বই। বাংলাগুলো সবাই তিন চারবার করে পড়েছি, ইংরেজিগুলো বড় হয়ে পড়ব।

কি করিস এইখানে। ছেলেটা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল।

এটা আমাদের ডিটেকটিভ ক্লাব। এ পাড়ায় যত খুন ডাকাতি হয় সব আমরা খুঁজে বের করি।

ইহ! ছেলেটা অবিশ্বাসের শব্দ করল।

 বিশ্বাস করলি না? তুই রুনুকে জিজ্ঞেস করে দেখ, ওর আংটি হারিয়ে গেলে আমরা খুঁজে বের করে দিয়েছি কিনা!

.

ছেলেটা চুপ করে থাকল। রুনুর আংটি হারিয়ে গেলে আমরা সবাই সত্যি সত্যি খুঁজে বের করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের এতো ডিটেকটিভের বিদ্যে সেবার কাজে লাগেনি। রুনু খেলতে খেলতে হারিয়ে ফেলেছিল, তাই বোঝাই যাচ্ছে ওটা মাঠে কোথাও পড়েছে। আমরা তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করে ফেললাম অবিশ্যি কাউকে যখন গল্পটা বলি তখন এমন ভাব দেখাই যে ভীষণ মাথা খাটিয়ে ওটা বের করতে হয়েছে!

এরপরে অবিশ্যি আমাদের হাতে আর কোন কেস আসেনি। এ পাড়ায় একটাও খুন হয় না, এমন কি একটা বিড়াল মারা যায় না। সেবার পল্টুদের একটা বিলাতী মোরগ মারা গেল। আমরা সবাই সন্দেহ করেছিলাম ওটা নিশ্চয়ই কোন অপরাধী মারাত্মক বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে। আমরা যখন অপরাধীকে সন্দেহ করে প্রায় বের করে ফেলেছিলাম তখন জানা গেল আরেকটা মোরগ মারা গেছে, অন্যগুলিও ঝিমাচ্ছে। ওদের নাকি রানীক্ষেত রোগ হয়েছে। আমাদের তখন এতো মন খারাপ হল!

এরপর আমরা নিজেরাই একদল ডাকাত সেজে ডাকাতি করতাম অন্যেরা ডিটেকটিভ হয়ে খুঁজে বের করত। কিন্তু তাতে কি মজা লাগে? একটা খুন যে কেন হয় না বুঝি না।

বইটইগুলি দেখে ছেলেটি জিজ্ঞেস করল তোদের ফুটবল ক্লাব নাই? আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম। সত্যি কথাটা বলতে একটু দ্বিধা হচ্ছিল। ছেলেটা অধৈর্য হয়ে তার কাটা হাতের শার্টের হাতার বাড়তি অংশটা দিয়ে নান্টুর ঘাড়ে চাটি লাগাল — কি, নাই?

ছিল। ভেঙে দিয়েছি।

কেন?

বল নাই।

বল নাই? ছেলেটা একটু অবাক হল মনে হল। বলল, কিনিস না কেন?

কিনেছিলাম তো। সবাই চাঁদা তুলে কিনেছিলাম, কিন্তু ঝগড়া হবার পর সবাই চাঁদার পয়সা ফেরত চাইল।

তারপর?

পয়সা তো নাই – তাই বলটাকে কেটে নয় টুকরো করে সবাই এক টুকরো করে নিয়েছিলাম।

আমার ব্লাডারের টুকরোটা দিয়ে আমি গুলতি বানিয়েছি, এই দ্যাখ – বলে হীরা পকেট থেকে গুলতি বের করল তারপর চটাশ করে একটা গুলি জানালা দিয়ে বাইরে পাঠিয়ে দিল।

মনে হল এই প্রথমবারের মত ছেলেটার আমাদের প্রতি একটু সম্মানবোধ জেগে উঠেছে।

তোরা আর কি করিস?

আমাদের গুপ্তধন আছে। বলেই হীরা ঠোঁট কামড়ে চুপ করে গেল। আমরা আঙুল ফুটো করে রক্ত বের করে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কেউ এই গুপ্তধনের কথা বাইরের কাউকে বললে সাথে সাথে তার মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আমার হীরার জন্যে দুঃখ হল— হীরাকে এখন আমাদের মেরে ফেলতে হবে।

 গুপ্তধন কি হয়েছে? ছেলেটা কৌতূহলী হয়ে উঠল। হীরা অপরাধীর মত আমাদের দিকে তাকাতে লাগল। আমরা কঠোর চোখে ওর দিকে তাকালাম।

কি হল? গুপ্তধন– বলে ছেলেটা শার্টের হাতার বাড়তি অংশটা দিয়ে আমার গালে চটাশ করে মেরে বসল। মনে হল গালটা ফেটে গেছে, আমি ক্ষেপে উঠে সাথে সাথে ওর ঘাড়ে ঘুষি মারলাম।

ছেলেটা ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে বিড়বিড় করে বলল, বেশি জোরে হয়ে গিয়েছিল। তারপর জিজ্ঞেস করল, গুপ্তধনের কথা বললি না?

ওটা বলা যাবে না। নান্টু গম্ভীর স্বরে বলল, আমরা রক্ত শপথ করেছি বলে সেও জিবে কামড় দিল। রক্ত শপথের কথা বললেও মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নিয়ম। নান্টুটাকেও মেরে ফেলতে হবে। আমাদের দুজন লোক কমে গেল।

ছেলেটা চোখ পিটপিট করে বলল, তোরা তাহলে বলবি না?

না। আমার অবিশ্যি ইচ্ছে করছিল ওকে বলতে। ওকে নিলে দলটা আরো ভাল হয়। দলে একজন হাত কাটা ছেলে থাকলে দারুণ রোমহর্ষক দেখায়।

বেশ! ছেলেটার মুখটা একটু ভারি দেখায়। তাহলে তোদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আমি ভাবলাম তোদের পাড়ায় এসেছি যখন, তোরা নিশ্চয়ই আমার বন্ধু হবি, আমাকেও তোদের সাথে নিবি। তা তোরা যখন নিবি না, না নিলি। আমার মেকানো সেট ছিল, একশোটা থেকেও বেশি কমিক ছিল, হেডফোন, ফুটবল সব ছিল ভাবলাম ওগুলো দিয়ে খেলব– একটা ফুটবল টিম খুলব! ছেলেটা বিষন্ন স্বরে বলল, তাহলে কিভাবে হাতটা কাটল তাও বলতাম! তা তোরা যখন আমাকে নিবিই না …।

আমরা ভেবে দেখলাম ও যদি হাত কাটার গল্প বলে তাহলে ওকে গুপ্তধনের কথা বলা যায়। ও যখন এখানেই থাকবে, ফুটবল দেবে, ফুটবল টিম খুলবে, ওকে আমাদের দলে নিয়ে নিলে ক্ষতি হবে না। বরং অন্য সব পাড়ার ছেলেরা হিংসা করবে, ওদের তো কারো হাত কাটা ছেলে নেই।

আমরা ওকে বললাম পিন ফুটো করে রক্ত বের করে স্বাক্ষর করতে হবে তাহলেই ওকে দলে নিয়ে নেব। ও রাজি হল। দরজা বন্ধ করে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ওকে আমাদের গোপন ব্ল্যাক মার্ডার দলে নিয়ে নিলাম। তারপর গুপ্তধনের ম্যাপ দেখালাম গুপ্তধনে কি কি আছে তাও বললাম। এরপর ওর অনেক রকম কসম খেতে হল। এরপরেও সে যদি কিছু ফাঁস করে দেয় তাহলে আমাদের কিছু বলার নেই কারণ ইহকালটাই তো শেষ নয় পরকালও আছে। পরকালে কে শয়তানের ক্রীতদাস হয়ে থাকতে চাইবে? কসম খাওয়ার সময় প্রথমেই খোদার নাম নিয়ে বলতে হয়, কিছু ফাঁস করে দিলে আমি শয়তানের ক্রীতদাস, নরক আমার স্থান।

তারপর সবাই গোল হয়ে বসলাম। আমি বললাম, এবারে বল তোর হাত কি করে কাটল?

তার আগে বল আমাকে তোদের সর্দার বানাবি।

ইহ! আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম, সর্দারের অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী।

তাহলে কিভাবে হাত কেটেছে বলব না। ছেলেটা মুখ কঠোর করে বসে রইল। আমরা সবাই ভীষণ ক্ষেপে উঠে ওকে যা ইচ্ছে তাই বলে গালিগালাজ করলাম। এমন নিমকহারাম কেউ কোনদিন দেখেনি।

বেশ। ছেলেটা মুখ শক্ত করেই বলল, আমাকে তাহলে সর্দার বানাবি না?

না।

তোদের সর্দার কে?

হীরা আমার মুখের দিকে, আমি হীরার মুখের দিকে তাকালাম। আমাদের দুজনের ভিতরে একজন হবে কিন্তু কে এখনও ঠিক করা হয়নি।

তোদের যে সর্দার তার সাথে মারামারি করব। যে জিতবে সে সর্দার হবে। এ ছাড়া হাত কাটার গল্প বলব না।

প্রস্তাবটা খারাপ না, কারণ ছেলেটার সাথে জিতে ওঠা কঠিন হবে না। একটা মাত্র হাত, ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে ক্যাঁক করে ঘাড়টা আঁকড়ে ধরলেই হলো।

ঠিক আছে। আমি রাজি হলাম।

ঠিক হ্যাঁয়। হীরাও রাজি হল।

আজ বিকালেই?

হ্যাঁ, আজ বিকালেই।

ছেলেটা খুশি হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাল তারপর শার্টের হাতার বাড়তি অংশটা দিয়ে নিজের গালে চটাশ করে মেরে বসল! এমন অবাক ছেলে।

তাহলে শোন, কিভাবে হাত কাটল। ছেলেটা গল্প শুরু করল। বছর দুয়েক আগে জীপ অ্যাকসিডেন্টে কিভাবে ওর হাত থেঁতলে গিয়েছিল, না কেটে উপায় ছিল না। সেই গল্প শুনতে শুনতে আমাদের দম বন্ধ হয়ে এল।

এক সময় মিশু শিউরে উঠে বলল, ইশ!

ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বলল তোরা যদি দেখতি — আমার দুটো আঙুল কেটে মাটিতে পড়ে টিকটিকির ল্যাজের মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফাচ্ছিল!

যাঃ!

হ্যাঁ। ছেলেটা জোর দিয়ে বলল। তারপর অনেকদিন স্কুলে যেতে হয়নি। হাসপাতালে ছিলাম। তাতেই এক বছর নষ্ট হয়ে গেল। তোরা কোন ক্লাসে পড়িস?

আমি সেভেনে, নান্টুও সেভেনে, হীরা সিক্স।

ছেলেটা খুশি হল। নিচের ক্লাসে হলে ওর সর্দার হওয়া একটু কঠিন হবে কিনা।

আরও খানিকক্ষণ গল্প করে আমরা বাসায় চলে এলাম। দুপুর হয়ে গিয়েছিল। আসার সময় ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, ডাক নামটা কি?

হাকার-বিন!

মানে?

মানে হাত কাটা রবিন। বলে সে হিঃ হিঃ করে হাসল!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *