০৮. খোঁজখবর
ভোরেই বুঝতে পারলাম দিনটা ভীষণ উত্তেজনাপূর্ণ হবে। গতরাতের সদ্য সদ্য ঘটা সেই ঘটনা কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না। পড়াতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিলাম না, কল্পনায় দেখছিলাম আমরা এই দুর্ধর্ষ ডাকাত দলটিকে ধরে ফেলেছি। পেপারে পেপারে আমাদের ছবি ছাপা হয়েছে। সবাই ভীষণ অবাক হয়ে বলছে, এতদিন গুরুত্ব দিইনি, কিন্তু এরা তো সাংঘাতিক!
আম্মা আমাকে বইয়ের সামনে এরকম উদাস ভাবে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি রে? সকালবেলা থেকে বসে বসে কি ভাবছিস?
আমি লজ্জা পেয়ে বইয়ের দিকে তাকালাম। তারপর গুনগুন করে পড়তে লাগলাম, দুই ভাগ হাইড্রোজেন ও এক ভাগ অক্সিজেনের সংমিশ্রণে পানি তৈরি হয়।
স্কুলে যাওয়ার সময় রবিনকে ডেকে নিয়ে যাওয়ার কথা। আমি রবিনদের বাসার সামনে গিয়ে রবিনকে ডাক দিলাম! সাথে সাথে রবিন বেরিয়ে এল পিছু পিছু চিরুনি হাতে তার আম্মা। বলছিলেন, চুল আঁচড়ে যা বাঁদর।
রবিন বিরক্ত হয়ে মাথা পেতে দিয়ে গজগজ করতে লাগল। তার আম্মা চুল আঁচড়ে দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকালেন। বললেন, এসো টোপন তোমারটাও আঁচড়ে দিই।
আমি লাল হয়ে বললাম, না খালাম্মা, লাগবে না!
আহা এসোই না! মাথাটা তো কাকের বাসা হয়ে আছে!
রবিনের আম্মা চুল আঁচড়াবার সময় আমার চিবুক ধরে নিলেন। আমার ভীষণ লজ্জা করতে লাগল আর ভয় হচ্ছিল হয়তো কেউ এ অবস্থায় দেখে ফেলবে। চুল আঁচড়ানো শেষ হলে আমরা স্কুলে রওনা দিলাম। একটু দূরে এসে জিজ্ঞেস করলাম, দ্যাখ তো রবিন, সিঁথিটা মাঝে হয়ে যায়নি তো? আমার কেমন জানি মনে হচ্ছিল।
রবিন আমার মাথার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। তোকে মেয়েদের মত দেখাচ্ছে রে! মাঝে সিঁথিতে তোকে রীনার মত দেখাচ্ছে!
আমি তাড়াতাড়ি মাথার চুল এলোমেলো করে ফেললাম মাথার মাঝখানে সিঁথি করে স্কুলে গেলে উপায় আছে? আমার নামই হয়তো দিয়ে দেবে করিমন নেসা।
রবিন তখন আরো জোরে হাসতে লাগল। তারপর একসময় হাসি থামিয়ে বলল, তুই একটা গাধা। মাঝখানে সিথি হবে কেন? ঠিকই ছিল! আম্মা কি তোর সাথে ইয়ার্কি করবে নাকি?
আমি লজ্জা পেলাম, রাগ হলাম আরও বেশি। কিন্তু উপায় কি? রবিনটা বরাবরই এ রকম বিচ্ছু।
.
একটা ডাক্তারখানার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করে আমার গত রাতের কথা মনে হয়ে গেল। আমি গল নামিয়ে ফিসফিস করে রবিনকে জিজ্ঞেস করলাম, রবিন, ডাকাত সর্দারকে কিভাবে ধরব কিছু ঠিক করেছিস?
রবিন অকারণেই চারিদিক তাকিয়ে গলা আরও নামিয়ে বলল, এখনও ঠিক করিনি। তোর বুদ্ধিটা ভালই। আগে পত্রিকায় দেখব আশে-পাশে কোথাও ডাকাতি হয়েছে কিনা। তারপর সব ডাক্তারের কাছে খোঁজ নিতে হবে কেন হাতে গুলি খাওয়া রোগী গেছে কিনা।
খুব সাবধানে কাজ করতে হবে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে বললাম, কেউ যেন টের না পায়। উত্তেজনায় আমার বুকের ভিতর কাঁপতে শুরু করল। সত্যি, কি একটা দারুণ কাজ আমরা করতে যাচ্ছি।
.
স্কুলে গিয়ে দেখি সলিল, নান্টু আর মিশু টিপুকে নিয়ে মাঠের এক কোণায় বসে গুজগুজ করছে। আমাদের দেখে ছুটে এল। ক্লাসে বই রেখে এসে আমরা তক্ষুনি মাঠের এক কোণায় গোল হয় বসে পড়লাম। অনেক তর্কবিতর্ক, আলোচনা করে ঠিক করা হল টিপুর বাসা থেকে টিপু নান্টুর টেলিস্কোপ দিয়ে সবসময় নদীর উপর নজর রাখবে। টিপু আমাদের সাথে ছিল না, সে নৌকা বা ডাকাত কাউকেই দেখেনি। কাজই নান্টুর উপর ভার থাকল টিপুকে সে নৌকাটা চিনিয়ে দেয়ার। নান্টু গজগজ করতে লাগল, রাত্রি বেলা, অন্ধকার, কিছু দেখিনি, কাউকে চিনি না, কিভাবে বের করব?
তাহলে যা বুড়ী-চি খেলগে মেয়েদের সাথে। রবিন খেঁকিয়ে উঠল, শার্ট খুলে ফ্রক পর একটা!
নান্টু খুব অনিচ্ছার সাথে রাজি হল। বলতে লাগল, চিনতে না পারলে কিন্তু আমার দোষ নেই।
আমরা ওর কথা না শোনার ভান করলাম। সলিল আর মিশুর উপর ভার থাকল গত সপ্তাহের কাগজ দেখে কোথায় কোথায় ডাকাতি হয়েছে তার একটা লিস্টি তৈরি করার। মিশু এই কেরানীর কাজে আপত্তি জানাতেই আমরা হৈ হৈ করে উঠলাম, তুই ছাড়া এসব কে করবে? ইংরেজি পত্রিকা তো আমরা পড়তেই পারি না। আর সব আসল খবর থাকে ইংরেজি পত্রিকাতে। বাংলা পত্রিকায় থাকে শুধু সিনেমার খবর।
সত্যি সত্যি মিশু ইংরেজিতে দারুণ ভাল। পরীক্ষায় সত্তর আশি করে নাম্বার পায়। হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেও চুলকানি কিংবা বমি বমি ভাব এসব শব্দের ইংরেজি বলে দিতে পারে। ছেলেবেলায় নাকি ও ইংরেজি স্কুলে পড়ত।
আমি, রবিন, হীরা আর কাসেম সব ডাক্তারখানাতে খোঁজ নিতে যাব ঠিক করলাম। দেখা গেল মনে মনে সবারই আমাদের সাথে যাবার ইচ্ছে। আমরা নানারকম ভয়ভীতি দেখিয়ে ওদের ঠাণ্ডা করলাম। বেশি মানুষ দেখলে সন্দেহ করবে এরকম কথাবার্তা বললাম।
আরো কয়েকটা ব্যাপার ঠিক করে নেয়ার কথা ছিল কিন্তু ঠিক এই সময় ঘণ্টা পড়ে গেল। আমরা উঠে ক্লাসের দিকে রওনা দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছি এমন সময় রবিন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, ঐ যা! সর্বনাশ হয়েছে!
কি?
ইংরেজি গ্রামার খাতাটা আনিনি!
আমরা অনুকম্পার দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম। আজ ওর ভাগ্যে শক্ত পিটুনি আছে। আজীজ স্যার যে কড়া! হীরা দাঁত বের করে বলল, খাবি কষে মার। হিঃ হিঃ হিঃ।
.
স্কুল ছয় পিরিয়ড হয়ে ছুটি হয়ে গেল, স্যারদের নাকি কি একটা মিটিং আছে। আমার কাছে লক্ষণটা বড় ভাল মনে হল। এমনিতেই আমাদের কাজ শুরু করার জন্যে বেশ সময় দরকার ছিল। তার উপর শেষ ক্লাসটা ছিল ইতিহাস স্যারের, ক্লাসটা করা লাগল না। ইতিহাস স্যারটা পড়া না পারলে এমন মার মারতে পারে! (ছেলেরা বলে স্যারের বুকে নাকি লোম নাই, বুকে লোম না থাকলে লোকেরা নাকি নিষ্ঠুর হয়)।
সকাল সকাল ছুটি পেয়ে আমরা সবাই যে যার কাজে চলে গেলাম। নান্টু তার বাসায় বই রেখে টেলিস্কোপটা নিয়ে টিপুর সাথে গেল। ওরা গুজগুজ করে সারাক্ষণ একটা রকেট বানানোর কথা বলছিল। কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছিল ডাকাত ধরায় ওদের উৎসাহ নেই, রকেট বানানোই যেন বেশি দরকার।
.
সলিল আর মিশু বারান্দায় বসে বসে খবরের কাগজ খুটে খুটে পড়তে লাগল। আমি হীরা আর রবিন কিভাবে কাজ শুরু করব ঠিক করার জন্যে এক জায়গায় বসলাম। কাসেম শুধু থাকতে পারল না, আজ নাকি ওর ওদের খালার বাসায় যাওয়ার কথা।
অনেক তর্কবিতর্ক করে আমরা প্রথমে গেলাম হাসপাতালে।
রবিনের আব্বা হাসপাতালের ডাক্তার, রবিন ওখানকার সবাইকেই চেনে। জিজ্ঞেস করে জানা গেল হাতে জখম এমন কোন রোগী এখানে আসেনি।
এরপর আমরা একজন একজন কর সব কয়জন ডাক্তারের কাছে গেলাম, নানা ভাবে জানতে চেষ্টা করলাম তারা কোন হাতে জখম এমন রোগীর চিকিৎসা করেছে কি না! আমাদেরকে কেউ এতটুকু পাত্তা দিল না। কম্পাউণ্ডার অর কর্মচারীরা আমাদের কথার উত্তর দেয়া দূরে থাক, মাঝে মাঝেই ধমকে দিল। তার মাঝেও আমরা চেষ্টা করলাম আসল খবরটি বের করে নিতে। খবর পাওয়া গেল খুব কম আর যেটুকু পাওয়া গেল সেটুকুও খুব হতাশাব্যঞ্জক।
ডাকাত সর্দারটি যে কিভাবে বাতাসে উবে গেল আমরা বুঝতেই পারলাম না। লাভের মাঝে লাভ হল হীরা একটা ওষুধের দোকানের কর্মচারীর সাথে ঝগড়া করে বলে আসল রাতে ঢিল মেরে সব ওষুধের শিশি গুঁড়ো করে দেবে।
.
আমরা ফিরে এসে দেখি অন্য সবাই মিলে কিংকুইন খেলছে। দেখেই আমাদের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। আমরা এত কষ্ট করে ঘুরোঘুরি করে খবরাখবর জোগাড় করার চেষ্টা করছি আর তারা মজা করে খেলছে? হীরা মুখ চোখ লাল করে ওদের গালি দিল, তোদের কাজ করেছিস কিছু? খুব যে খেলা শুরু করেছিস?
ওরা খেলায় এত ব্যস্ত ছিল যে আমাদের লক্ষ্যই করল না। সলিল তো ভুল করে হীরার পিঠে টেনিস বলটা দড়াম করে মেরেই বসল—তারপর বিচ্ছিরি মারামারি।
সবাইকে ঠাণ্ডা করে বসিয়ে দিয়ে আমরা কাজ শুরু করলাম।
ডাকাতটা ধরতে পারলি? মিশু জিজ্ঞেস করল।
ডাকাত তো রসগোল্লাটা! আমি উল্টো ধমক দিলাম, তোমার জন্যে রাস্তার মোড়ে বসে আছে কি না।
মিশু লজ্জা পেল। বিড়বিড় করে কি জানি বলে থেমে গেল। আমরা আমাদের পুরো তিক্ত অভিজ্ঞতাটা বর্ণনা করলাম। শুনে সবাই দমে গেল।
যাই হোক, রবিন মিশুকে জিজ্ঞেস করল, তোর কাজ কতদূর?
কমপ্লিট। বলে সে পকেট থেকে একটা ফুলস্ক্যাপ কাগজ বের করে দিল। সেখানে মোট আঠারোটা ডাকাতির খবর। চট্টগ্রামের ধূমচাচিয়া গ্রামের হোসেন মিয়ার বাড়ি থেকে শুরু করে দিনাজপুরের মেথিকান্দা গ্রামের হরেন পালের দোকান লুটের খবর পর্যন্ত আছে। সবচেয়ে পুরানোটি একমাস এগারো দিন আগেকার আর সবচেয়ে নতুনটি গত সপ্তাহের। সবমিলিয়ে মানুষ মারা গেছে ছয়জন, আহত হয়েছে পনেরোজন, ডাকাত ধরা পড়েছে সাতজন। ডাকাতি হয়েছে আনুমানিক তিন লক্ষ দুই হাজার সাত শত বাইশ টাকা! মিশু ছক কেটে পরিষ্কার হাতের লেখায় সবকিছু সুন্দর করে লিখে এনেছে, দেখে একনজরেই সবকিছু বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের যে খবরটি দরকার, আশে-পাশে কোথাও আজকালের ভিতর ডাকাতি হয়েছে কিনা এবং ডাকাতি করতে গিয়ে ডাকাত গুলি-টুলি খেয়েছে কিনা, সে খবরটি কোথাও নেই। মিশু বলল সেরকম কোন ঘটনা ঘটলেও সামনের সপ্তাহের আগে সেটা জানা যাবে না – সবকিছু দেরি করে ছাপানো খবরের কাগজের অভ্যাস, এতক্ষণ খবরের কাগজ ঘেঁটে সে এইটুকু মাত্র জানতে পেরেছে।
এরপরে নান্টু আর টিপুক জিজ্ঞেস করা হল তাদের কাজ কতদূর। ওরা সাফ বলে দিল যে ওরা কোনো নৌকা দেখেনি।
কোনো নৌকাই দেখিসনি?
তা দেখেছি। পাট নিয়ে যাচ্ছে মোটা মোটা নৌকা, খেয়াপার করছে আর জেলে নৌকা জাল ফেলে রাখছে!
আমরা হতাশ হয়ে পড়লাম। এরকম একটা দুর্ধর্ষ ডাকাত যদি হাতের কাছে এসে ফসকে যায়, তাহলে কি রকম লাগে? তার উপর আমরা এতোগুলো ছেলে!
আমরা অনেকক্ষণ মনমরা হয়ে বসে থেকে আবার ধীরে ধীরে চাঙা হয়ে উঠলাম। ডাকাতটার যে অবস্থা বেশ কয়দিন তাকে এখানে থাকতে হবে, আমরা তার মাঝে একটা বুদ্ধি ঠিক বের করে ফেলব। আর সবচেয় বড় কথা কয়েকদিনের ভিতরেই স্কুল ছুটি হয়ে যাবে। রোজার ছুটি। পরীক্ষাও হয়ে গেছে, পড়াশোনার ঝামেলা নেই। আমরা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা খেটে ঠিক ডাকাতটাকে ধরে ফেলব।