১০. নিঃসঙ্গ অ্যাডভেঞ্চার

১০. নিঃসঙ্গ অ্যাডভেঞ্চার

অনেকক্ষণ একা একা চুপচাপ বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়েছিলাম টিক টিক করে ঘড়ির কাটা ঘুরছে, দশটা বেজে গিয়েছে। কিছুক্ষণের ভিতরেই রবিন, টিপু, সলিল, নান্টু, ওরা সবাই বাসা থেকে পালাবে।

আমাকে এরকম চুপচাপ বসে থাকতে দেখে আম্মা ভাবলেন ঠাণ্ডা লাগানোর জন্যে তার বকুনি খেয়ে মন খারাপ করেছি। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, যা বাবা। ঘুমো গিয়ে। জ্বর এসেছিল আর?

আমি মাথা নাড়লাম, না। তারপর খুব ক্লান্ত ভাবে আমার আর রঞ্জুর শোবার ঘরটাতে এসে ঢুকলাম। রঞ্জু বিছানায় বসে মশারি ফেলে চারিদিকে গুঁজে দিচ্ছিল। আমি রাস্তার দিকে জানালাটা খুলে দিলাম সাথে সাথে হু হু করে বাতাস এসে ঢুকল।

ভাইয়া, জানালা বন্ধ করে দাও, বাতাস আসছে।

চুপ। আমি রক্তচক্ষু করে তাকালাম, কথা বলবি নে।

অন্য যেকোন সময় হলে রঞ্জু পাল্টা জবাব দিত, ঝগড়া করত আম্মাকে নালিশ করত, কিন্তু অজি কিছু বলল না। সত্যিই চুপ করে শুয়ে পড়ল।

লাইট নিভিয়ে আমি জানালার কাছে বসে থাকলাম। ওরা যখন যাবে তখন আমি দেখব। ঠাণ্ডা বাতাসটা একেবারে হাড়ের ভিতর দিয়ে কেটে কেটে যাচ্ছিল, তাই বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। হু হু করে ঠাণ্ডা বাতাস যেন আমার বুকের ভিতর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে। আমার ঘুম আসছিল না, ইচ্ছে হচ্ছিল কাঁদি। একটু পরেই রঞ্জু ঘুমিয়ে কাদা হয়ে অভ্যাসমত আমার গায়ের উপর পা তুলে দিতে লাগল আর আমি ঝটকা মেরে তার পা সরিয়ে দিতে লাগলাম।

এক সময় সবাই শুয়ে পড়ল। ঘড়ির টিকটিক ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। মাঝে মাঝে সেই বিশেষ ধরনের টুকটাক শব্দ শোনা যেতে লাগল যেগুলি রাত জাগলেই শোনা যায় কিন্তু কি জন্যে হচ্ছে বোঝা যায় না। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম-ঠিক সেই সময়ে জানালায় আবছা ভাবে রবিনকে দেখা গেল।

লাফিয়ে উঠতে গিয়ে সামলে নিয়ে সন্তর্পণে উঠে বসলাম। রবিন জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, মন খারাপ করিস নে। তারপর গলা আরও নামিয়ে বলল, নান্টু ধরা পড়ে গেছে।

সত্যি?

হ্যাঁ! ঐ শুনিস না ওদের বাসার আওয়াজ?

আমি কান পেতে শুনলাম সত্যি সত্যি খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। রবিন বলল, যাই!

আমি শুকনো গলায় বললাম, যা!

রবিন লাফিয়ে নেমে গেল। একটু দূরে অন্যের দাঁড়িয়েছিল আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।

.

অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। চোখে আর ঘুম আসে না। নান্টুদের বাসা থেকে গোলমালের আওয়াজ আর শোনা যাচ্ছে না। ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে শুনতে ভাবতে লাগলাম এখন ওরা চৌরাস্তায় পৌচেছে, একটু পরেই স্কুল পার হয়ে নদীর ঘাটে পৌঁছে যাবে। আমি কল্পনা করতে লাগলাম ওরা অন্ধকারে গুড়ি মেরে হেঁটে যাচ্ছে, নৌকায় উঠছে, সবকিছু ঠিকঠাক করে নিয়ে টেলিস্কোপে ডাকাতদের নৌকাটাকে লক্ষ্য করছে অধৈর্য হয়ে অপেক্ষা করছে কখন ওটা ছাড়বে। রবিন গালিগালাজ করছে, টিপু তার স্বভাবসুলভ শান্ত ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে রবিনের কথার উত্তর দিচ্ছে। এক সময় নৌকা ছেড়ে দিল — অন্ধকার রাত, আকাশে তারা মিটমিট করছে, ঠাণ্ডা বাতাস হিল হিল করে বইছে, ছপাৎ ছপাৎ করে হীরা আর মিশু দাড় টানছে। অন্ধকারে আবছাভাবে তীরের গাছপালা জঙ্গল দেখা যাচ্ছে।

ভীষণ যন্ত্রণায় আমার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। আমি উঠে বসলাম আর ঠিক তক্ষুনি, কিছু না ভেবেচিন্তে হঠাৎ ঠিক করে ফেললাম আমিও ওদের সাথে যাব। যেভাবেই হোক।

এতক্ষণে ওরা নিশ্চয়ই রওনা দিয়ে দেয়নি, ডাকাতদের নৌকাটা কখন ছাড়বে ঠিক কি? আর ছেড়েই যদি দেয় আমি নদীর তীরে তীরে দৌড়িয়ে ঠিক ধরে ফেলব। আমি একটু চিন্তা করে নিলাম তারপর খুব আস্তে আস্তে উঠে কাজ শুরু করলাম।

চৌকির নিচেই ক্যানভাসের খালি ব্যাগটা পেয়ে গেলাম। বালিশের নিচে ছিল সোয়েটারটা, সেটা পরে ফেললাম। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে গরম প্যান্টটা বের করতে অনেক সময় লাগল। খাকী হাফ প্যান্টটা খুঁজে বের করতেও অনেক সময় নষ্ট হল। আলো থাকলে কি সহজেই না সবকিছু পাওয়া যায়। হকি সু গুলি পরে ফেললাম, মোজা ছাড়াই। ওগুলি এই অন্ধকারে কে খুঁজে বের করবে? এখন দরকার একটা অস্ত্র, চাকু বা ঐ জাতীয় কিছু কিছু টাকা, একটা টর্চলাইট, একটা কম্বল আর ওষুধগুলি।

ওষুধের শিশিগুলি বের করার জন্যে যেই টেবিলে হাত দিয়েছি অমনি মিকচারের শিশিটা ঠক করে টেবিলে পড়ে গেল। আমি আঁতকে উঠে শিউরে উঠলাম, এখন নিশ্চয়ই কেউ না কেউ ঘুম থেকে উঠে যাবে! হলোও তাই, আব্বা পাশের ঘর থেকে জিজ্ঞেস করলেন, কে?

আমি এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বললাম, আমি আব্বা!

ও। কি করিস?

পানি খাব। বলেই খুট করে লাইট জ্বাললাম, অন্ধকারে পানি খাওয়া স্বাভাবিক নয়। আমার কপালে তখন বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে, আব্বা যদি একবার উঠে আসেন তাহলে শার্ট প্যান্ট জুতা পরা অবস্থায় দেখলে বুঝতে কিছু বাকি থাকবে না। ভাগ্য ভাল আব্বা উঠলেন না। আমি শব্দ করে পানি খেলাম, আর আলোতে পরিষ্কার সবকিছু দেখতে পেয়ে মোজা জোড়া খুঁজে বের করে পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। তাক থেকে রঞ্জুর মাটির ব্যাঙ্কটা নামিয়ে ব্যাগে ভরে ফেললাম, মাস তিনেক ধরে সে ওখানে পয়সা জমিয়ে যাচ্ছে। ওষুধের শিশি, ট্যাবলেটগুলি পকেটে ভরে ফেলে আমি আবার লাইট নিভিয়ে দিলাম, পানি খেতে বেশি সময় লাগার কথা না! অন্ধকারে পা টিপে টিপে বিছানার উপর থেকে কম্বলটা নিয়ে ভাঁজ করে ফেললাম, এক হাতে ভাঁজ করা কি সোজা ব্যাপার? চাকু আর টর্চ পাওয়া গেল না কিন্তু আর দেরি করা যায় না। আমি ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বিদায় নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হলাম। আমার হঠাৎ কেন জানি বুকের ভিতর ফাঁকা ফাঁকা লাগল। দরজা খোলার সময়ে এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল যেয়ে কাজ নেই, কিন্তু মনকে শক্ত করে খুব ধীরে ধীরে নিঃশব্দে ছিটকিনি খুলে ফেললাম, ওটা আবার খোলার সময় মাঝে মাঝে শব্দ করে। তারপর একেবারে অন্ধকার রাস্তায়।

কাল ভোরে যখন দেখবে এ পাড়ার সব ছেলে উধাও তখনই সবাই বুঝে নেবে, তার উপর নান্টু তে থাকলই।

বাইরে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার! রাত কয়টাই বা হয়েছে অথচ কোথাও একটি লোক নেই। আমি রাস্তার ধার ঘেঁষে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাঁটতে লাগলাম। মোড়টা পার হলেই সার্কিট হাউজের পাশের সেই বটগাছটা – যেখানে নাকি রাত গভীর হলেই জ্বিনেরা নাচগান করে! জায়গাটা একা কেমন করে পার হব ভেবে আমার এই শীতেই কপাল ঘেমে উঠতে লাগল।

আচ্ছন্নের মত আমি দ্রুত পায় হাঁটতে লাগলাম, মাঝে মাঝে নিজের পায়ের শব্দ শুনে আমি নিজেই চমকে উঠছি। যত দোয়া দরুদ জানা ছিল আমি একটির পর একটি আওড়ে যাচ্ছিলাম, নদীর ঘাটে পৌঁছার বেশি বাকি নেই। হঠাৎ রাস্তা খুঁড়ে কোথেকে একটি লোক হাজির হল, দেখে আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে এসে ধ্বক ধ্বক করতে লাগল। লোকটি বিরাট, ছোটখাট পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করতে লাগল। আমি খুব সন্তর্পণে রাস্তা পার হয়ে হন হন করে হাঁটতে লাগলাম। লোকটি ম্যাচের কাঠির আলোতে আমাকে দেখার চেষ্টা করল বলে মনে হল। যখন দৌড় দেব কিনা ভাবছিলাম তখন সে কাঠিটা ফেলে আপন মনে বিড়বিড় করে জড়িত স্বরে বলল, লে বাবা! শিয়াল টিয়াল নাকি? তারপর উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করল, দেখলাম অল্প অল্প টলছে।

.

এত বিপদের মাঝেও আমার হাসি পেল। লোকটা আমাকে কিনা শেষ পর্যন্ত শেয়াল ভাবল? নিশ্চয়ই মদ খেয়েছে। এদিকে কাছেই কোথায় মদের দোকান আর খারাপ জায়গা টায়গা আছে।

.

কিভাবে কিভাবে শেষ পর্যন্ত আমি নদীর তীরে এসে পৌঁছে গেলাম। পথে দুজন টহল পুলিসকে দেখে শুধু খানিকক্ষণ গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলাম, ওরা দেখলে মুশকিল হত। বাজারটার মুখে একটা কুকুরও খুব বিরক্ত করেছিল, ঘেউ ঘেউ করে মনে হচ্ছিল বাজারের সব লোক তুলে ফেলবে। আমি অবিশ্যি খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে চলে এসেছি। কিন্তু নদীর তীরে এসে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। খুব উদ্বেগ নিয়ে যেখানে টিপুর নৌকা বাঁধা থাকে সেখানে ছুটে গিয়ে দেখি ওখানে কিছু নেই। কাছে গিয়ে দেখলাম টিপুর নৌকার শিকলটা পানিতে ডুবে আছে। আর কিচ্ছু নেই—কোন চিহ্ন নেই, ওরা চলে গেছে!

কতক্ষণ আগে গেছে? কোনদিকে গেছে? ভাবতে গিয়ে অসহায় বোধ করলাম। হঠাৎ করে আমি ভীষণ দূর্বল বোধ করতে লাগলাম। মনে হল সেখানেই মুখ ঢেকে বসে পড়ি। এতক্ষণ যে জোরটা আমাকে ছুটিয়ে এনেছে সেটা যেন কর্পূরের মত উবে গেছে। ঠিক তক্ষুণি আমার মনে হল প্রতিমুহূর্তে ওরা আরো দূরে চলে যাচ্ছে। এক্ষুনি রওনা দিতে হয়। কিন্তু কোনদিকে?

নদীতে তখন মাত্র ভাঁটা শুরু হয়েছে, কয়েকটা কচুরিপানা ভাসতে ভাসতে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছে। আমার মনে হল ডাকাতেরা নিশ্চয়ই ভাঁটার জন্যে অপেক্ষা করছিল। ভাঁটা শুরু হওয়ার পর এখন নিশ্চয়ই স্রোত ঠেলে উল্টো দিকে যাবে না। আমি ভাল হাতটা দিয়ে টেনে ব্যাগটা কাঁধে তুলে নিলাম তারপর দক্ষিণ দিকে ছুটলাম। বিদ্যুৎ ঝিলিকের মত মনে হল একটু দূরেই সেই শ্মশানটা!

অন্ধকার রাত। হাজার হাজার তারা আর একটা বিবর্ণ চাঁদের আলোতে আমি ছুটে চলেছি। মাঝে মাঝে দেখছিলাম নদীতে কোন নৌকা দেখা যায় কিনা। কাটা গাছ, লতাপাতা কাদা, গোবর কোন কিছুকে ভ্রুক্ষেপ না করে আমি হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটতে লাগলাম, প্লাস্টার করা বাম হাতটা ভারি অসুবিধা করছিল। কম্বলটা মনে হচ্ছিল অতিকায়, ব্যাগটা মনে হচ্ছিল সীসে দিয়ে ভরা। আমার দৌড়ের সাথে সাথে ওগুলি ঝক্করঝক্কর করে কাঁধে লাফাতে লাগল, মাঝে মাঝে চোয়ালের সাথেও ঘষে যাচ্ছিল।

.

শ্মশানের পাশ দিয়ে যখন ছুটে যাই হঠাৎ আমার তখন মনে হল পিছনে পিছনে কেউ আমার সাথে ছুটে আসছে, এই বুঝি ধরে ফেলল – এই বুঝি ধরে ফেলল! আমি পিছনে ফিরে তাকাতে সাহস পাচ্ছিলাম না, যদি দেখি সত্যিই কেউ আসছে! ভয়ে আতঙ্কে আমি মৃত প্রায় হয়ে গেছি হঠাৎ দেখি নদীতে কালোমত একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে। কার নৌকা, কিংবা আসলে নৌকাই কিনা আমি জানি না – তবু আশায় ভর করে, ছুটতে ছুটতে প্রাণপণে চেচাঁলাম, র… বি…ন…

.

ছুটতে ছুটতে ওটার কাছাকাছি এসে দেখি নৌকাই বটে, তবে টিপুর নৌকা না। সেটাতে ছই ছিল না। হতাশায় আমি ভেঙে পড়লাম, ক্লান্তিতে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, তবুও আমি থামলাম না। সামনে নিশ্চয়ই ওরা আছে।

ঠিক সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ ঝলকের মত রবিনের গলার স্বর শুনলাম, টো…প…ন…কোথায়?

.

আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। ওটা টিপুর নৌকাই, ছই লাগিয়ে নিয়েছে। আমি ভাল হাতটা নাড়তে নাড়তে ছুটে গেলাম। নৌকাটা তীরের দিকে ছুটে আসতে লাগল। পানিতে বেশ কিছু দূর থাকতেই আমি জুতো টুতো নিয়ে লাফিয়ে পড়লাম। ওরা আমাকে টেনে নৌকায় তুলে ফেলল।

আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, যাক, তোদের পাওয়া গেল তাহলে।

হীরা এক ঝটকায় নৌকাটাকে নদীর মাঝখানে নিয়ে যেতে লাগল। অন্যেরা আমাকে ঘিরে বসল। আমি ভিজে জুতো এক হাতে খুলতে খুলতে বললাম, ভেবে দেখলাম আমি একলা একলা থাকতে পারব না। তাই

সবাই খুশিতে আমাকে জাপটাজাপটি করতে লাগল, রবিন বলল, খুব ভাল করেছিস। তোকে ফেলে এসে আমার এত খারাপ লাগছিল। একটু আগে বলছিলাম ফিরে গিয়ে তোকে নিয়ে আসি।

টিপু বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল টোপন এসে পড়বে। তোমরা তো বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার সত্যি মনে হচ্ছিল।

মিশু আমার জুতো খুলতে সাহায্য করতে করতে বলল, তোর সাহস আছে সত্যি!

সলিল দাঁড়টা ছপাৎ করে ফেলে এক টান দিয়ে বলল, টোপনের সত্যি খুব সাহস। একলা একলা কেমন শ্মশানের ভেতর দিয়ে চলে এল!

আমি খুশিতে হাসতে হাসতে বললাম, ডাকাতদের নৌকাটা কতদূর?

ও! অনেক সামনে। এই দ্যাখ, বলে রবিন টেলিস্কোপটা আমার হাতে দিল। ঐ ছোট্ট আলোটাতে ফোকাস কর।

.

ফোকাস করে আমি টিমটিমে একটা হারিকেন দেখতে পেলাম, ওটাই নাকি নৌকাটা! আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে মনে হল কাসেমকে দেখছি না। বললাম, কিরে কাসেম কই?

বুঝলাম না। ও আসল না কেন? বোধ হয় আসার ইচ্ছে নেই।

আমারও তাই মনে হচ্ছিল।

আমি বললাম, আমি না আসলে তো তোদের মানুষই কম পড়ত। কাসেমও নেই নান্টুও নেই।

তুমি এসেই আমাদের লাভ কি! টিপু হাসতে হাসতে বলল, হাতখানা ভাঙা, তার ওপর জ্বর! তুমি বরং ভিতরে গিয়ে কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে থাক। দেখে কেমন চমৎকার চাটাইয়ের ছই তৈরি করেছি, ভিতরে ঠাণ্ডা বাতাস আসতে পারবে না।

রবিন গম্ভীর হয়ে বলল, হ্যাঁ টোপন, ভিতরে গিয়ে শুয়ে থাক। একটা ট্যাবলেট খেয়ে নিবি নাকি? অনেক ওষুধ এনেছি।।

ওর ভাবখানা ওর আব্বা ডাক্তার তাই সেও হাফ ডাক্তার! আমি বললাম, না, আমি নিজের ওষুধগুলিই এনেছি।

.

আমি পকেট থেকে মিকচারের শিশি, ট্যাবলেটের প্যাকেট বের করতে লাগলাম। হীরা বাইরে থেকে চেঁচাল, আধাঘণ্টা হল কিনা দ্যাখ। আমার হাত ব্যথা হয়ে গেছে। টিপুর হাতে একটা জ্বলজ্বলে ঘড়ি। দেখে বলল, আর মাত্র চার মিনিট।

হীরা জোরে জোরে বৈঠা চালাতে লাগল। আমি ভিতরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু দুর্বল, একটু অসুস্থ লাগছিল কিন্তু খারাপ লাগছিল না মোটেই। রিভলবারটির কথা মনে হল, উঠে বসে অকারণেই গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, রিভলবারটি এনেছিস তো?

হ্যাঁ হ্যাঁ! ওসব ভুল করি নাকি? রবিন দাঁত বের করে হাসল। বলল, তুই নিশ্চিন্ত মনে ঘুমো।

হ্যাঁ তুমি বিশ্রাম নাও। টিপুর গলা শুনতে পেলাম। অন্ধকারে মুখের ভাব দেখা যায়। না আন্তরিক সুরটা শুধু ধরা পড়ে।

শুয়ে শুয়ে পুরো ব্যাপারটা ভাবতে চেষ্টা করলাম। হঠাৎ মনে হল, যদি নৌকা ডুবে যায়? তাহলে এক হাতে সাঁতরাতে না পেরে টুপ করে ডুবে যাব। তার উপর স্রোতের কি টান! আমি জোর করে চিন্তাটা সরিয়ে দিলাম। শুধু খারাপ খারাপ জিনিস চিন্তা করলে কি আর কোন কাজ করা যায়!

আমি ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। শুনতে পেলাম সলিল গুনগুন করে গান গাচ্ছে। ওর গানের গলাটা চমৎকার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *