১৫. ছেলে তিনটের অভিসন্ধি

১৫.

জিশান খাওয়া থামিয়ে দিল। ছেলে তিনটের অভিসন্ধি বুঝতে চাইল।

কিন্তু তার জন্য জিশানকে বেশি মাথা ঘামাতে হল না, কারণ, তার আগেই দক্ষ নাচিয়ের তৎপরতায় কদমছাঁট চুল রেস্তরাঁর দরজার কাছে পৌঁছে গেছে এবং মেয়েটির পথ আগলে দাঁড়িয়েছে।

আর ওর বাকি দুই সঙ্গী তখন মেয়েটির বাবা-মা-ভাইয়ের ঠিক পিছনে পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছে।

জিশান টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু গুনাজি ওর হাত চেপে ধরল। বলল, ‘দাদা, আপনি ঝামেলায় জড়াবেন না। তা হলে মার্শাল খেপে যাবেন। এখানকার এটাই দস্তুর। সবাই চুপচাপ দেখে যায়, এড়িয়ে যায়। যা করার পিস ফোর্সের গার্ডরা করে। মেয়েটির সঙ্গে যারা আছে—মানে, ওর বাবা-মা—ওরা পিস ফোর্সের লোকাল ইউনিটে ফোন করে দিলেই গার্ডরা চলে আসবে…।’

জিশান গুনাজির দিকে অবাক চোখে তাকাল। জিগ্যেস করল, ‘ততক্ষণ সবাই চুপচাপ বসে এই মেয়েটির হেনস্থা দেখবে?’

‘হ্যাঁ।’ গুনাজি অনুনয় করে বলল, ‘প্লিজ, দাদা, আমার কথাটা শুনুন। চলুন, আমরা বরং চলে যাই—।’

এ-কথায় জিশান কী ভাবল কে জানে! ও উঠে দাঁড়াল।

টেবিলের একপাশে কার্ড সোয়াইপ করার স্লট ছিল। সেই স্লটে জিশানের স্মার্ট কার্ডটা সোয়াইপ করে খাওয়ার বিল মেটাল গুনাজি। তারপর সিমানের জন্য নেওয়া সফট এনার্জি প্যাকটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।

ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি রেস্তরাঁর দরজার দিকে পা বাড়াল।

কদমছাঁট চুল তখন মেয়েটিকে বলছে, ‘তুমি খুব সুন্দর। আর আমি সুন্দর জিনিস পছন্দ করি—।’

মেয়েটি লোফার ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে বেরোতে গেল, কিন্তু ছেলেটা দ্রুত পাশে সরে গিয়ে ওর পথ আগলে দিল।

রেস্তরাঁর অনেকেই এখন টিভির পরদা থেকে চোখ সরিয়ে জ্যান্ত ‘নাটক’ দেখছে।

জিশান লক্ষ করল, মেয়েটির বাবা কিংবা মা সাহায্য চেয়ে চারপাশের লোকজনের দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না। হয়তো ওঁরা জানেন, এইভাবে সাহায্য চেয়ে কোনও লাভ নেই।

মেয়েটি এবার বলল, ‘সরুন। আমাকে যেতে দিন—।’

‘তোমার সঙ্গে আমার কথা বলতে ইচ্ছে করছে…।’

‘আমার একটুও ইচ্ছে করছে না।’

‘তাই?’ বলে জোরে হেসে উঠল অসভ্য কদমছাঁট।

জিশান আর গুনাজি ততক্ষণে রেস্তরাঁর দরজার কাছে পৌঁছে গেছে। গুনাজি কী এক অদ্ভুত কারণে জিশানের কবজি মুঠো করে ধরে রেখেছিল—যেমন করে ছোট বাচ্চা বাবার হাত ধরে রাখে। ওর ভয় হচ্ছিল, এই বুঝি জিশান গন্ডগোলে জড়িয়ে পড়ে।

জিশান কদমছাঁটের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্লিজ, একটু সরুন—আমরা বাইরে বেরোব।’

গুনাজির বুকের ভেতরে তখন অকারণেই ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছিল।

কদমছাঁট ছেলেটা তখনও মেয়েটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। জিশানের কথায় ওর দিকে না তাকিয়েই ছেলেটা সামান্য সরে দাঁড়াল। জিশান আর গুনাজিকে পথ করে দিল। গুনাজি আগে, পিছনে জিশান। গুনাজির হাতে জিশানের হাত।

জিশান হঠাৎই থমকে দাঁড়াল। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসুন—আপনারাও আসুন…।’

এ-কথায় মেয়েটি এক-পা এগোনোমাত্রই হাত বাড়িয়ে ওকে বাধা দিল কদমছাঁট। ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ও এখন যাবে না। আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি—।’

‘কিন্তু ও তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে না।’

জিশান এ-কথা বলামাত্রই গুনাজি ওর কবজিতে টান মারল। উত্তরে জিশান একটা ছোট মোচড়ে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে গুনাজির বুকের ভেতরে বিপদের পাগলাঘণ্টি বাজতে শুরু করল।

কদমছাঁটের দুজন সঙ্গী এখন জিশানের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।

জিশান ওদের দিকে একপলক দেখল। ওদের মুখে নেশাগ্রস্ত জঙ্গীভাব ফুটে উঠেছে।

এতক্ষণ পর কদমছাঁট চুলের মালিক জিশানের দিকে ভালো করে তাকাল। ঘেন্নায় নাক-মুখ কুঁচকে বলল, ‘তুমি যেখানে যাচ্ছ যাও। নইলে প্রবলেম আছে।’

‘কীসের প্রবলেম?’

এ-কথার উত্তর না দিয়ে ছেলেটা দরজার পাশের ধাতব দেওয়ালে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি বসিয়ে দিল।

দেওয়ালের পাত তুবড়ে গেল। দেওয়ালের সঙ্গে ঘুষির সংঘর্ষের শক্তি দরজার ফ্রেমের দিকে প্রবাহিত হয়ে দরজার কাচ ঝনঝন শব্দে ভেঙে পড়ল।

টিভির পরদার দিকে যারা তাকিয়েছিল তাদের নজর ঘুরে গেল দরজার দিকে। চাপা গুঞ্জন শুরু হল। একজন মহিলার ভয়ের চিৎকার শোনা গেল।

জিশান দেখল, ওর সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী মেয়েটির মুখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কিন্তু ওর মা-বাবা আর ভাইয়ের চোখে আশঙ্কা ছায়া ফেলেছে।

জিশান কদমছাঁটের চোখের দিকে তাকাল। ধীরে-ধীরে বলল, ‘দেওয়ালরা খুব ভালো। কখনও পালটা ঘুসি মারে না…।’

কথাটা বলেই জিশান মাথা থেকে নীল টুপিটা খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল।

কদমছাঁট চুল অসভ্য ছেলেটা সঙ্গে-সঙ্গে জিশানকে চিনতে পারল। ওর চকচকে মার্বেল-চোখ ছিটকে গেল টিভির পরদার দিকে। তারপর জিশানের দিকে। হ্যাঁ, টিভির সুপারহিরোটাই ওর সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

ছেলেটার মনোযোগ এবার মেয়েটির দিক থেকে সরে গেল—পুরোপুরি চলে এল জিশানের দিকে। এ কী অপূর্ব সুযোগ ওর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে! বরাবর যা নিয়ে ওর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তার সরাসরি সমাধান এই মুহূর্তে এসে গেছে হাতের মুঠোয়! একেই বলে কপাল!

কদমছাঁট চুল হেসে ফেলল। প্রথমে দাঁত-দেখানো নি:শব্দ হাসি—তারপর শব্দ করে তাচ্ছিল্যের হাসি।

জিশান ছেলেটার হাসির অর্থ একটু-একটু বুঝতে পারছিল। ও মেঝেতে পড়ে থাকা কাচের টুকরোগুলোর দিকে তাকাল। রেস্তরাঁর ভেতরে যদি হাতাহাতি শুরু হয়ে যায় তা হলে বাড়াবাড়িরকমের ভাঙচুর হতে পারে। তার চেয়ে রেস্তরাঁর দরজার বাইরে চলে যাওয়া ভালো।

সুন্দরী মেয়েটি জিশানের হাতের নাগালের মধ্যে ছিল। জিশান আচমকা ছোঁ মেরে ওর হাত খামচে ধরল। তারপর এক ঝটকায় ওকে টেনে নিল দরজার বাইরে। একইসঙ্গে চাপা গলায় বলল, ‘শিগগিরই এখান থেকে চলে যাও—।’

মেয়েটির মুখে তখন বিহ্বল ভাব। সেটা চট করে কাটিয়ে উঠে ও ইশারায় মা-বাবাকে বাইরে আসতে বলল।

প্রতিক্রিয়া দেখাতে কদমছাঁট চুল কয়েক পলক সময় নিল। তারপর জিশান যা ভেবেছিল ও ঠিক তাই করল। সরাসরি তেড়ে এল জিশানের দিকে। পিছনে ওর দুই শাগরেদ।

রেস্তরাঁর বাইরে একটা বড়সড় লাউঞ্জ। লাউঞ্জে ব্যাক লাইটেড গ্রাফিক গ্লাসের সিলিং আর চারপাশে অনেক বড়-বড় চৌকো ক্রিস্টালের পিলার। পিলারের গায়ে ফুটে উঠছে চলমান রঙিন ছবি—নানান জিনিসের রঙিন অডিয়োভিশুয়াল বিজ্ঞাপন। সেই রঙিন আলো জিশানের গায়ে পড়ছে। ওর মুখটা অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে, জিশান নিজেও একটা রঙিন বিজ্ঞাপন।

লাউঞ্জে যারা চলাফেরা করছিল তাদের দু-চারজন জিশানকে চিনতে পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই ছেলেটা সত্যিই কিল গেমে কোয়ালিফাই করা, টিভিতে দেখা, জিশান পাল চৌধুরী কি না তাই নিয়ে নিজেদের মধ্যে তর্ক জুড়ে দিল।

গুনাজি কখন যেন আবার জিশানের হাত ধরে ফেলেছিল, আলতো করে টান মারছিল। আসন্ন মারপিটের ব্যাপারটাকে ও এড়াতে চাইছিল। কিন্তু এড়ানো যে যাবে না মনে-মনে সেটাও বুঝতে পারছিল।

জিশানের তিন-চার হাতের মধ্যে এসে কদমছাঁট থামল। জিশানের চোখের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, ‘কী সুপারহিরো, লাইভ টেলিকাস্ট ছাড়া রিয়েলিটি শো হবে নাকি?’

ওর শাগরেদ দুজন একে অপরের দিকে চোখ ঠারল। তারপর হেসে চেঁচিয়ে বলল, ‘জিশান, তুমি জিতলে আমরা চাঁদা তুলে তোমাকে প্রাইজমানি দেব। মাইরি—কসম খেয়ে বলছি…।’ নিজের টুটিতে আঙুল ছোঁয়াল একজন।

‘জিশান’ নামটা শোনামাত্রই গুঞ্জন উঠল লাউঞ্জে। জিশানদের ঘিরে ভিড়টা আরও গাঢ় হল। ভিড়ের বৃত্তের দ্বিতীয় কি তৃতীয় স্তরে মেয়েটি সপরিবারে দাঁড়িয়েছিল। চিবুক উঁচু করে জিশানকে স্পষ্ট করে দেখতে চেষ্টা করছিল। ওর মুখে উদ্বেগের ছোঁয়া।

কদমছাঁট ছেলেটা হাতের চার আঙুল নেড়ে জিশানকে কাছে আসার জন্য ওসকাচ্ছিল আর বলছিল, ‘এসো, সুপারহিরো—দাদাগিরির প্রাইজমানি নেবে এসো। ও:, কাম অন—।’

ওর শাগরেদ দুজনের একজন—বোধহয় কোঁকড়া চুল—হিংস্র গলায় কদমছাঁটকে লক্ষ করে বলল, ‘চামোন, মালটাকে গিলে খেয়ে নে!’

জিশান বুঝতে পারছিল, মেয়েটির ব্যাপারে হঠাৎ এভাবে উত্তেজিত হয়ে পড়াটা ওর ঠিক হয়নি। কদমছাঁট চুল ছেলেটিকে ওর ঠান্ডা মাথায় বোঝানো উচিত ছিল। কারণ, অসভ্যতাকে অ-সভ্যতা দিয়ে রুখলে ব্যাপারটা শেষ হতে চায় না। নিউক্লিয়ার চেইন রিয়্যাকশনের মতো তার তেজস্ক্রিয় বিকিরণ চলতেই থাকে। যেমন এখন চলছে।

তাই জিশান আচমকা গুনাজির মুঠো থেকে নিজের হাতটা টেনে ছাড়িয়ে নিয়ে জোড়হাত করে ফেলল। চামোনকে অনুরোধের গলায় বলল, ‘ভাই, কিছু মনে করবেন না। আমাদের কোথাও একটা ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে—।’

‘তাই?’ চামোন ন্যাকা গলায় জিগ্যেস করল। তারপর ওরা তিনজনেই বস্তির নোংরা ভাষায় গালাগাল ছুড়ে দিল।

জিশান তাও হাল ছাড়ল না। ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে হাতজোড় করে ওদের শান্ত হওয়ার জন্য অনুরোধ করতে লাগল।

উত্তরে সমবেত জনতাকে রীতিমতো চমকে দিয়ে চামোন জিশানের রগে সপাটে এক ঘুসি বসিয়ে দিল।

পটকা ফাটার শব্দ হল। জিশানের বাঁ-কানে তালা লেগে গেল পলকে। একইসঙ্গে ও কাচ-চকচকে মার্বেলের মেঝেতে ছিটকে পড়ল।

ও যাতে গায়ের ওপরে এসে না পড়ে সেজন্য ভিড়ের বৃত্ত চট করে সরে গেল পিছনে। চিৎকারের একটা ঢেউ উঠল লাউঞ্জে।

গুনাজি আর দেরি করল না। পকেট থেকে একটা স্যাটেলাইট ফোন বের করে বোতাম টিপতে শুরু করল। পিস ফোর্সের লোকাল ইউনিটে এখনই খবর দেওয়া দরকার।

জিশান ঘুসির আঘাতটা সামলে নিতে পারল। মাসের পর মাস ধরে নিউ সিটিতে ট্রেনিং নিয়ে ও লড়াই করতে যেমন শিখেছে, সহ্য করতেও তেমন শিখেছে। ওর রোজকার ওয়ার্কআউট রুটিনে এক কণাও ছন্দপতন হয়নি। তাই মেঝেতে দুবার পাক খেয়েই ওর শরীরটা আবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছে।

চামোন তখন পরের আক্রমণের জন্য তৈরি হয়ে অপেক্ষা করছে।

ওদের ঘিরে মানুষের ভিড় আরও বেড়েছে। জিশানকে চিনতে পেরে অনেকেই অবাক হয়ে গুনগুন করে ওর নাম বলছে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে।

জিশান শান্ত গলায় চামোনকে বলল, ‘ভাই, আমি মারপিট করতে চাই না। মারপিট আমার ভালো লাগে না। প্লিজ, কুল ডাউন। আমি…।’

উত্তরে চামোন ওর শরীরটা একপাশে হেলিয়ে জিশানকে লক্ষ করে জোরালো লাথি চালাল। জিশান কথা বলতে-বলতেই দু-হাত একজোট করে অনায়াসে লাথিটা রুখে দিল।

‘প্লিজ, আমার কথা শুনুন…’ জিশান বলতে লাগল, ‘মাথা ঠান্ডা করুন। আপনারা রেস্তরাঁয় ফিরে যান। হাতজোড় করে বলছি, মারপিট আমি ভালোবাসি না। শুধু ওই মেয়েটিকে আপনারা ডিসটার্ব করছিলেন বলে…।’

জিশানের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা লাথি এসে পড়ল ওর শরীরে। যেহেতু লাথিটা এসেছে ওর পিছন থেকে তাই জিশান এটা রুখতে পারল না। আবার ছিটকে পড়ল মেঝেতে।

লাথিটা মেরেছিল চামোনের ব্যাকব্রাশ চুল বন্ধু। সে কখন যেন জিশানের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধুকে শাসিয়ে উঠেছে চামোন : ‘অ্যাই, কিছু করবি না। আমি একা। আমি একা—।’

এ-কথায় ব্যাকব্রাশ চুল দমে গেল। ওর মুখটা কাঁচুমাচু হয়ে গেল।

কথা বলতে-বলতে জিশানের হাত ধরল চামোন। ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল। ওর দিকে তাকিয়ে ন্যাকাবোকা ভঙ্গিতে হাসল। বলল, ‘আমি একা। তোমাকে আমি একা খতম করব, সুপারহিরো।’

গুনাজির খুব খারাপ লাগছিল। প্রথমটায় ওর মনে হয়েছিল জিশান বুঝি নিজের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটা মোকাবিলায় নেমে পড়তে চাইছে। কিন্তু তার পরের ঘটনাগুলো দেখে ওর উলটোটাই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, না, জিশান মারপিট ভালোবাসে না।

জিশান খুব সময়মতো নিজেকে সামলে নিয়েছিল। এটা ঠিকই যে, চামোনের অসভ্য আচরণ ওর মেজাজ খারাপ করে দিয়েছিল। ও ভেবেছিল, চামোনদের উচিত শিক্ষা দেবে। কিন্তু সেই মূহূর্তেই ওর মনে হয়েছে, সেটা ঠিক হবে না। হিংসা আর প্রতিহিংসা মানুষকে কখনও এগিয়ে দেয় না। তা ছাড়া ওর কন্ট্রোলড ফ্রিডমের কথা মনে পড়েছিল। হয়তো এখানে গন্ডগোল করলে কাল থেকে ওর গুনাজির সঙ্গে বেরোনো বন্ধ হয়ে যাবে। জিপিসি-র গেস্টহাউসেই দমবন্ধ করে মুখ গুঁজে থাকতে হবে। তারপর দেখতে-দেখতে এসে যাবে ২ সেপ্টেম্বর, রবিবার। জিশানের বাঁচা-মরার দিন। কিল গেম। হয়তো তিন তারিখ থেকে জিশান আর কিছুই দেখতে পাবে না। মিনিকে না, অর্কনিশানকেও না।

জিশান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অল্প-অল্প টলছিল, আর এসব কথা ভাবছিল।

চামোন জিশানের গালে অসম্ভব জোরালো একটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল। জিশানের মুন্ডুটা এক ঝটকায় ষাট ডিগ্রি ঘুরে গেল। গাল ফেটে রক্ত বেরোতে শুরু করল।

জিশান যন্ত্রণার চিৎকার করে উঠেছিল, কিন্তু সেটা একটা ছোট্ট টুকরো মাত্র। চিৎকারের বাকিটা ও দাঁতে-দাঁত চেপে সহ্য করছিল। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বড় আক্ষেপের শব্দ বেরিয়ে এল জিশানদের ঘিরে থাকা দর্শকদের ঠোঁট চিরে।

জিশান চোখে ঝাপসা দেখছিল। চারপাশের বিজ্ঞাপনের মিউজিক আর দর্শকদের গুঞ্জন কেমন জড়িয়ে জট পাকিয়ে হিজিবিজি শোনাচ্ছিল। ও কেমন করে চামোনদের বোঝাবে, নিউ সিটির লড়াইয়ে ও সাধ করে আসেনি! ওকে ফাঁদে ফেলে এখানে আনা হয়েছে।

জিশানের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল পিস ফোর্সের মার্শাল শ্রীধর পাট্টার ওপরে। চামোনদের এইরকম বখে যাওয়া আচরণের জন্য ওই শয়তান লোকটাই দায়ী। ওই লোকটাই নিউ সিটির মানুষের কাছে ভ্যালু আর প্রাইস—এই দুটো শব্দের মানে একাকার করে দিয়েছে।

জিশানের রাগটা আবার উথলে উঠছিল। ও গুনাজির দিকে একবার তাকাল। তাকানোর ভঙ্গিতে বোধহয় অনুমতি চাওয়ার একটা নীরব আরজি ছিল। সেই করুণ রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে গুনাজির চোখে জল এসে গেল। ও কান্না চেপে ভাঙা গলায় বলল, ‘দাদা, আর মার খেয়ো না। আমি পিস ফোর্সে খবর দিয়েছি। কিন্তু ওরা আসতে-আসতে তুমি…তুমি…শেষ হয়ে যাবে…।’ কথা শেষ করতে-করতে কেঁদে ফেলল গুনাজি। আর ঠিক তখনই চামোনের পা গুনাজির পেট লক্ষ করে ধেয়ে এল।

সংঘর্ষের ভোঁতা শব্দ হল। একইসঙ্গে গুনাজির মুখ দিয়ে একটা বীভৎস ‘ওঁক’ শব্দ বেরিয়ে এল। গুনাজির হাত থেকে সিমানের জন্য কেনা এনার্জি ড্রিংকের প্যাকটা ছিটকে পড়ল। ওর রোগা লম্বা শরীরটা ভাঁজ হয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে পড়ল দর্শকদের ঘাড়ে। একটা মেয়ে ভয়ে চিৎকার করে উঠল।

জিশান যেন একটা শক খেল। ঝাপসা নজর স্পষ্ট হয়ে গেল পলকে। চটপট হাত-পা নেড়ে ও শরীরের ভেতরের একটা অদৃশ্য সুইচ অন করে দিল। শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের সুইচ।

জিশান সবে চামোনের দিকে এক পা এগিয়েছে, সঙ্গে-সঙ্গে একটা চাপা গুঞ্জন উঠল। ফুড মলের দুজন সিকিওরিটি গার্ড গোলমালের খবর পেয়ে অকুস্থলে এসে হাজির হয়েছে। ওদের পরনে খাকি আর কালো রঙের নকশাদার ইউনিফর্ম। মাথায় কাপড়ের টুপি। হাতে লম্বাটে ওয়াকিটকি।

গার্ড দুজন চিৎকার করতে-করতে আসছিল আর মাঝে মাঝে ওয়াকিটকিতে কথা বলছিল।

ওরা ভিড়ের বৃত্ত ঠেলে-ঠেলে ভেতরে ঢুকে এল। চামোন আর জিশানকে লক্ষ করে একজন বলল, ‘অ্যাই এক্ষুনি হুজ্জুতি বন্ধ করো। যাও, বাইরে যাও!’

দ্বিতীয় গার্ড বলল, ‘এখানে এসব লাফড়া চলবে না। এক্ষুনি পিস ফোর্সের কাছে হ্যান্ডওভার করে দেব…।’

এরপর যা হল সেটা জিশান কল্পনাও করেনি।

চামোন গার্ড দুজনের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে নি:শব্দে হাসছিল। কিন্তু ওর দুজন দোস্ত সবাইকে চমকে দিয়ে গার্ড দুজনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

কোঁকড়ানো লম্বা চুল ছেলেটা সাপের ছোবলের ক্ষিপ্রতায় একজন গার্ডের ওয়াকিটকি কেড়ে নিয়ে সেটা প্রবল শক্তিতে সেই গার্ডের ব্রহ্মতালুতে বসিয়ে দিল। গার্ডটা একটা ‘আঁক’ শব্দ করে স্রেফ খসে পড়ল মেঝেতে।

ভুরুতে মাকড়িওয়ালা ব্যাকব্রাশ চুল সরাসরি দ্বিতীয় গার্ডটার গলা টিপে ধরল দু-হাতে। এবং নিজের মাথা দিয়ে সাংঘাতিক এক ঢুঁ মারল।

গার্ডটার মাথা কাত হয়ে গেল একপাশে। তখন ব্যাকব্রাশ চুল ওকে এমন হেলাফেলা করে ছুড়ে দিল যেন একটা ন্যাকড়ার পুতুল—তাও আবার জলে ভেজা।

গার্ড দুজনকে ডিঅ্যাক্টিভেট করার ব্যাপারটা এত আচমকা ঘটে গেল যে, জমায়েত পাবলিক হইচই চিৎকার করারও সুযোগ পেল না। মুহূর্তের জন্য সবাই কেমন থম মেরে গেল।

কদমছাঁট চুল হঠাৎই শব্দ করে হাততালি দিয়ে উঠল। আর একইসঙ্গে একজোড়া বন্ধুকে লক্ষ করে বলে উঠল, ‘শাবাশ! জিয়ো:!’

উত্তরে ব্যাকব্রাশ চুল মাথা নেড়ে সিটি বাজাল তিনবার। তারপর গার্ড দুজনের নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় নোংরা খিস্তি করে উঠল।

চামোন বক্সারদের মতো লাফাতে-লাফাতে জিশানের কাছে এগিয়ে এল। তারপর প্রচণ্ড এক ঘুসি মারার জন্য ডানহাতটা মুঠো করে পিছিয়ে নিয়ে এল।

গুনাজি আর থাকতে পারল না। চিৎকার করে উঠল, ‘দাদা, এবার মারো! পালটা মারো!’

জিশান যেন হঠাৎই ঘুম থেকে জেগে উঠল। হাড়ে-হাড়ে বুঝতে পারল ওর গাঁধিগিরি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ গাঁধিগিরি প্রয়োগ করা যায় মানুষের ওপরে—অমানুষের ওপরে নয়। তা ছাড়া যে-গুনাজি একটু আগে ওকে ‘ঝামেলায়’ জড়াতে বারণ করছিল সে-ই গুনাজিই এখন বলছে, ‘দাদা, এবার মারো! পালটা মারো!’

জিশানের তাজ্জব লাগল। দুনিয়া কী দ্রুতই না রং পালটায়।

সুতরাং জিশান ডানহাঁটু ভাঁজ করে শূন্যে লাফ দিল বাজপাখির মতো। সামনে হাত বাড়িয়ে দু-হাতের তালুতে বন্দি করল কদমছাঁটের মাথা। এবং হাঁটুর গাঁট দিয়ে ওর চিবুকের নীচে এক মরণ-আঘাত করল।

ব্যাপারটা সেখানেই থামল না। ওর মুন্ডু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে মেঝেতে চিৎ হয়ে আছড়ে পড়ল জিশান। সেই প্রবল টানে মাথায়-মাথায় ঠোকাঠুকি হল। শব্দ শুনে মনে হল এই বুঝি কারও খুলিতে ফাটল ধরল।

জিশানের মুখে তখন ছুঁয়ে রয়েছে কদমছাঁটের মুখ। নাকে আসছে উৎকট ঘামের গন্ধ। জিশান যেন চিড়িয়াখানায় কোনও জন্তুর খাঁচায় ঢুকে পড়েছে হঠাৎ।

নিউ সিটি জিশানকে লড়াইয়ের এইসব কলাকৌশল শিখিয়েছে। শিখিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে কীভাবে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। তাই নিউ সিটির এই অসভ্য জানোয়ারটাকে নিউ সিটির শিক্ষা ফেরত দিচ্ছিল ও। এবং তারই শেষ দফা হিসেবে ও কদমছাঁটের গালে ভয়ংকর এক কামড় বসাল। ব্যাকরণের বাইরে লড়াই।

এর ফলে যে-চিৎকারটা তৈরি হল তাকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। কসাইখানায় ছুরি যখন আগু-পিছু করে কোনও শুয়োরের গলা কাটে তখন সে বোধহয় এরকম আর্তনাদই করে থাকে।

জিশান শরীরটাকে কয়েক পাক গড়িয়ে ছিটকে সরে এল চামোনের কাছ থেকে। ও তখন গালে হাত চেপে কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে আর একইসঙ্গে পাগলের মতো চিৎকার করছে। ওর আঙুলের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে-চুইয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে।

পাবলিক এবার চিৎকারের ঢেউ তুলল। তাতে উত্তেজনার সঙ্গে মিশে আছে ভয়ের ছোঁয়া। কেউ-কেউ ভয়ে সরে গেল অন্য কোথাও। কারা যেন কাদের নাম ধরে ডাকাডাকি করছে। কেউ বা ব্যস্তভাবে মোবাইল ফোনের বোতাম টিপছে।

জিশান উঠে দাঁড়াল। ওর চোখ, মুখ, চোয়ালের রেখা এখন অন্যরকম লাগছে। জিভে নোনা স্বাদ। সত্যিই ও এখন কিল গেমের পার্টিসিপ্যান্ট।

চামোনের দু-বন্ধু জিশানের প্রতিরোধের চেহারা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। জিশানের ক্ষমতা আর শক্তি ওরা এতক্ষণ আঁচ করতে পারেনি। কিন্তু এখন আঁচ করতে পারা সত্বেও বন্ধুর হেরে যাওয়ার অপমানের বদলা নিতে ওরা তিরবেগে ঝাঁপিয়ে এল জিশানের দিকে।

কিন্তু ওই পর্যন্তই।

ওরা বুলেটের মতো জিশানের দিকে আসছিল, কিন্তু ওদের রুখে দিল পাবলিক।

কোঁকড়াচুল আর ব্যাকব্রাশ এটা কল্পনাও করেনি। ওদের সঙ্গে পাবলিকের হুড়োহুড়ি আর ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। রেস্তরাঁর সামনের লাউঞ্জটা মুহূর্তে কুরুক্ষেত্রের চেহারা নিল।

জিশানের চোখ এবার গুনাজিকে খুঁজতে লাগল।

বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না। বরং গুনাজিই ওকে খুঁজে নিল। জটলার ফাঁক দিয়ে আচমকা হাজির হল। তারপর জিশানের হাত ধরে টান মারল : ‘দাদা, শিগগির চলে এসো—।’

ওরা দুজনে প্রায় দৌড়তে শুরু করল।

অটো-এলিভেটরে করে নামার সময় জিশান বলল, ‘সিমানের এনার্জি প্যাক তো আর নেওয়া হল না…।’

গুনাজি হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘পথে কোথাও গাড়ি দাঁড় করিয়ে নিয়ে নেব।’

জিশানের ভালো লাগছিল না। ওর গাল জ্বালা করছিল। ও মারপিট করতে চায়নি। হুলস্থূল বাধাতেও চায়নি। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল!

পার্কিং লটে এসে ওরা গাড়িতে উঠে বসল। জিশান তাকাল সিমানের দিকে। এখনও অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

গুনাজি গাড়িতে স্টার্ট দিতেই জিশান বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো। আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেছে।’

‘চিন্তা কোরো না, দাদা—এক্ষুনি পৌঁছে যাব।’

বাইরে সন্ধে নেমে গেছে। রাস্তার দুপাশের বাড়িগুলোয় আলো জ্বলে গেছে। কখনও-কখনও চোখে পড়ছে বিজ্ঞাপনের রঙিন নকশা। এই রাতটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই নিউ সিটি হিংসা আর প্রতিহিংসার ব্যাবসা করে।

জিশানের নিজের ওপরে ঘেন্না হল।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ও অনেকটা যেন আপনমনেই বলল, ‘বিশ্বাস করো, আমি মারপিট করতে চাইনি…।’ নাকি কথাটা ও বলল মিনিকে?

সামনের রাস্তার দিকে চোখ রেখে গুনাজি বলল, ‘জানি, দাদা। আমি মার্শালের অফিসে খবর পৌঁছে দিয়েছি। বলেছি, তোমাকে ওই গুন্ডাগুলো টরচার করতে-করতে মেরেই ফেলত। বলেছি, তোমার কোনও দোষ নেই। দেখো, মার্শাল তোমাকে কিছুই বলবে না—গ্যারান্টি।’

শেষ শব্দটা শুনে জিশানের হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু হাসতে গিয়েই গালে টান পড়ল। গালের জ্বালাটা বেড়ে গেল।

রঙ্গপ্রকাশের বাড়ি আর কতদূর? মনে-মনে ভাবল জিশান।

একটা আর্ক কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে বসে ছিলেন শ্রীধর পাট্টা। ধনুকের মতো বাঁকানো এল. সি.ডি. পরদায় একটা লোকের নিরীহ মুখ। ফরসা। বেশ গোলগাল দেখতে। চোখগুলো ছোট-ছোট। গালে থুতনিতে খাপছাড়াভাবে হালকা দাড়ি।

মুখটা খুঁটিয়ে দেখে শ্রীধরের পছন্দ হল। দারুণ কনট্রাডিকশান। দেখে যা মনে হয় না লোকটা ঠিক তাই। লোকটার মুখে কেমন একটা নিষ্পাপ বাচ্চা-বাচ্চা ভাব। অথচ লোকটা প্রথম সারির একজন হার্ডকোর ক্রিমিনাল। অপাশি কানোরিয়া। বয়েস পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ।

ওর যা বয়েস ওর খুনের সংখ্যাও প্রায় তাই। এ পর্যন্ত বত্রিশটা খুন করেছে অপাশি। তার মধ্যে তিনটে ফ্যামিলি আছে যাদের ও এক-এক খেপে খুন করে রক্তের হোলি খেলেছে। পরিভাষায় যাকে বলে ম্যাসাকার।

প্রথম ফ্যামিলিতে চারজন ছিল। মাঝবয়েসি বাবা-মা। আর তাদের সদ্য তরুণ ছেলে আর মেয়ে। চপার হাতে আধঘণ্টার মধ্যে সেই চারজনকে ঘুমন্ত অবস্থায় খতম করেছিল অপাশি। ওদের ফ্ল্যাট রক্তে ভেসে গিয়েছিল।

দ্বিতীয় ফ্যামিলিতে ছিল পাঁচজন। অল্পবয়েসি বাবা-মা, আর তাদের ছোট-ছোট তিন সন্তান। দু-ছেলে, এক মেয়ে।

এই হত্যালীলায় অপাশি কানোরিয়ার অস্ত্র ছিল চপার আর শাবল। শাবলটা ও ওদের বাড়ির বাগানে খুঁজে পেয়েছিল।

তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ বুঝতে পেরেছিল যে, বয়েসে সবচেয়ে ছোট আট বছরের মেয়েটাকে অপাশি সবার শেষে খুন করেছিল। ওকে তাড়া করে অপাশি ধরে ফেলে বাড়ির বাগানে। তারপর ওইটুকু বাচ্চা মেয়েকে জঘন্য হেনস্থা করে শাবল দিয়ে পিটিয়ে মেরেছিল।

তৃতীয় ফ্যামিলিতে সদস্যের সংখ্যা ছিল তিন। বাবা-মা আর ষোলো বছরের একটি মেয়ে।

মাথায় থান ইটের বাড়ি মেরে অপাশি প্রথমে ওদের তিনজনকে অজ্ঞান করে দিয়েছিল। তারপর ইলেকট্রিকের তার দিয়ে কষে ওদের হাত-পা বেঁধে ফেলেছিল। সবশেষে ওদের গায়ে পেট্রল ঢেলে ওদের জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিল।

এ ছাড়া নানান কারণে অপাশি প্রচুর খুচরো খুন করেছে। ক্রিকেট খেলায় বাউন্ডারি না মেরে খুচরো এক রান কি দু-রান নেওয়ার মতো। ওর খুন-খুন খেলায় বাউন্ডারি বলতে ওই তিনটে : চার, পাঁচ, আর তিন।

আর্ক কম্পিউটারের পরদায় অপাশি কানোরিয়ার হুলিয়া দেখছিলেন শ্রীধর। আর ওর অত্যন্ত পোটেনশিয়াল সি-ভি খুটিয়ে পড়ছিলেন। কিল গেমের পক্ষে অপাশির সি-ভি সত্যিই এক্সপ্লোসিভ মেটিরিয়াল।

অপাশি কানোরিয়া সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় তার সবই রয়েছে এই সফট ফাইলে। আর সমস্ত বিবরণের পর রয়েছে ফোটো-ফাইল। সেখানে অপাশির নানান ঢঙে তোলা অসংখ্য রঙিন ছবি রয়েছে। আর তার পরে, ওর জীবনীর শেষ অধ্যায় হিসেবে, রয়েছে ওর সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল।

পরদার ওপরে ঝুঁকে পড়ে শ্রীধর পাট্টা লেখাগুলো এক মনে পড়ছিলেন আর ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখছিলেন। একইসঙ্গে মনের মধ্যে খুশি ছটফটিয়ে উঠছিল। কিল গেমে জিশানের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য অপাশি কানোরিয়া ক্যান্ডিডেট হিসেবে একেবারে ‘খাপে খাপ, আবদুল্লার বাপ!’

ঠোঁটের কোণে হাসলেন শ্রীধর। কনট্রাডিকশান। সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল যা বলছে, খুনি হিসেবে কানোরিয়ার দক্ষতা, হিংস্রতা আর অভিজ্ঞতা যা বলছে, ওর ফোটোগ্রাফগুলো ঠিক তার বিপরীত। যেন হাসি-খুশি এক নিষ্পাপ গোলগাল শিশু—যে একটা মশাও মারতে পারে না।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন শ্রীধর। কিল গেমে জিশান পালচৌধুরীর সঙ্গে খেলার জন্য প্রথম প্লেয়ার বাছা হয়ে গেছে।

পকেট থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করলেন। হাঁ করে মুখ তুললেন ওপরদিকে। শিশির ছিপি খুলে কয়েক ফোঁটা এনার্জি সল জিভে ঢাললেন। তারপর আওয়াজ করে স্বাদ নেওয়ার ঢঙে জিভ দিয়ে টাকরায় টকাস-টকাস শব্দ করলেন। শরীরে শক্তির আগুন ঝাঁজিয়ে উঠল।

কিল গেমের তারিখ ক্রমশ এগিয়ে আসছে—দরজায় কড়া নাড়ছে।

শ্রীধর পাট্টার পাশে তিনজন অফিসার দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের প্রত্যেকের গায়ে ব্ল্যাক ইউনিফর্ম। নিউ সিটির সেন্ট্রাল জেলের সব অফিসারের পোশাকই এইরকম। শুধু চিফ জেলারের বুকে দশটা সিলভার স্টার বসানো।

চিফ জেলার হরিমোহন চট্টোপাধ্যায় শ্রীধরের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। চেহারায় ছোটখাটো কিন্তু স্মার্ট। চোখে সরু মেটাল ফ্রেমের চশমা।

হরিমোহন জানেন যে, জানেন যে, কিল গেমের আগে মার্শাল নিজে সেন্ট্রাল জেলে আসেন। কিল গেমের তিনজন প্লেয়ারকে চুলচেরা বিচারের পর সিলেক্ট করেন। সেই সিলেকশানের সময় মার্শালের নানান প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। ডেথ সেন্টেন্স পাওয়া অপরাধীদের সম্পর্কে নানারকম তথ্যের জোগান দিতে হয়। সেজন্যই হরিমোহন সঙ্গে দুজন জুনিয়ার অফিসারকে ডেকে নিয়েছেন।

ওঁরা চারজন এখন যে-ঘরটায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন সেটা সেন্ট্রাল জেলের কন্ট্রোল রুম।

নিউ সিটি আর ওল্ড সিটির সীমানার গা ঘেঁষে সেন্ট্রাল জেলের চার কিলোমিটার বাই দু-কিলোমিটার বিস্তৃত এলাকা। শুটারে চড়ে উড়ে আসার সময় ওপর থেকে নীচে তাকালে সেন্ট্রাল জেলের মানচিত্রটা ছবির মতো ধরা পড়ে।

জেল এলাকার একটা দিক পরিখা বরাবর টানা দু-কিলোমিটার। সেদিক দিয়ে কোনও অপরাধীর জেল ভেঙে পালানোর কোনও উপায় নেই। কারণ, পরিখার খাড়া কংক্রিটের দেওয়াল। সেই দেওয়াল বরাবর পঁচিশ ফুট গভীরতায় গেলে তবেই জলের শুরু। আর সেই গভীর খালের মধ্যে কিলবিল করছে বিষধর সাপ আর পিরানহা মাছ। ওরা যাতে আরামে বেঁচে থাকতে পারে সেজন্য জলের উষ্ণতা, নোনতা ভাব—সবকিছুই সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

পরিখার দিকটা জেল বিল্ডিং-এর পিছনদিক। বিল্ডিংটা লম্বায় পাঁচশো মিটার। একতলা। গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি। বিল্ডিং-এর সব গেটেই বুলেটপ্রুফ পলিমারের অটোমেটিক শাটার। সেন্ট্রাল লকিং সিস্টেম দিয়ে লক করা।

জেল বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলে পাওয়া যাবে এক অদ্ভুত দৃশ্য।

ডানদিকে আর বাঁ-দিকে সাড়ে সাতশো মিটার করে ধু-ধু মাঠ। আর সামনে চার কিলোমিটার ফাঁকা জায়গা। সেখানে দেড়-দু-ইঞ্চি লম্বা মিহি ঘাসের শিষ ছাড়া আর কিছু নেই। তাও ঘাস রয়েছে কোথাও-কোথাও—বেশিরভাগ জায়গাটাই ধুলো মাখা ধূসর মাঠ।

জেল বিল্ডিং ছাড়া বাকি জায়গাটা হাতের তালুর মতো ফাঁকা। পোকামাকড় ছাড়া আর কোনও প্রাণীর পক্ষে সেই খোলা জায়গায় লুকোনো সম্ভব নয়। যদি কোনও ক্রিমিনাল জেল ভেঙে পালাতে পারে তা হলে জেল বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে তাকে ধু-ধু মাঠের ওপর দিয়ে অন্তত সাড়ে সাতশো মিটার পেরোতে হবে।

সেই সময় তাকে লক্ষ্য করে ছুটে আসবে রক্ষীদের মিসাইল পিস্তলের গুলি। এই আলট্রামডার্ন পিস্তলের গুলি ইনফ্রারেড সোর্স লক্ষ্য করে ছুটে যায়। মানুষের শরীর থেকে যে-ইনফ্রারেড তাপ-তরঙ্গ বেরোয় সেটাই গুলিটাকে জানিয়ে দেয় কোথায় গিয়ে তাকে আঘাত করতে হবে। মানুষটা যেভাবেই এঁকেবেঁকে দৌড়োক না কেন গুলিও ‘বুদ্ধিমান’ ছুঁচোবাজির মতো তার পিছন-পিছন এঁকেবেঁকে ছুটবে। তারপর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে ছুটন্ত মানুষটাকে গতিতে হারিয়ে দেবে। এবং খেল খতম।

ধরে নেওয়া যাক, কোনও অপরাধী মিসাইল পিস্তলের গুলিকে ফাঁকি দিয়ে জেল এলাকার সীমানায় পৌঁছতে পারল।

সেখানে তার মুখোমুখি হবে কুড়ি ফুট উঁচু বুলেটপ্রুফ পলিমারের মসৃণ স্বচ্ছ পাঁচিল। সেই পাঁচিল পেরোলেই মুক্তি।

কিন্তু সেই পাঁচিলের মাথার দিকে প্রায় এক ফুট-জায়গা জুড়ে রয়েছে অনেকগুলো সমান্তরাল তামার তার। সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। পলিমার অন্তরক পদার্থ হওয়ায় তামার তারগুলো পলিমারের মধ্যে অর্ধেকটা করে গেঁথে বসানো—পরিভাষায় যাকে বলে এমবেড করা। সেই তারে রয়েছে 6.6 কিলোভোল্ট এসি সাপ্লাই।

স্বচ্ছ পাঁচিলের মাথায় যদি কেউ উঠতে চায় তা হলে তাকে ভয়ংকর শক খেয়ে মরতে হবে।

জেল এলাকার ধু-ধু মাঠের নানান জায়গায় রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।

ওয়াচ টাওয়ারগুলো একটু অদ্ভুত চেহারার।

স্বচ্ছ ফাইবারের একটা লম্বা খুঁটি খাড়া উঠে গেছে ওপরদিকে। সেই খুঁটির মাথায়—প্রায় চল্লিশ ফুট ওপরে—রয়েছে একটা ট্রান্সপারেন্ট কিউবিকল। সেখানে একজন সান্ত্রী মিসাইল পিস্তল নিয়ে পাহারা দিচ্ছে।

ওয়াচ টাওয়ারে যেহেতু ওঠা-নামার কোনও সিঁড়ি নেই তাই সান্ত্রী বদলের কাজটা করা হয় শুটার দিয়ে। সেন্ট্রাল জেলের আন্ডারে মোট দশটা শুটার রয়েছে।

ওয়াচ টাওয়ারের মাথা থেকে ছাতার ফ্রেমের মতো ন’টা মেটালিক আর্ম বেরিয়ে রয়েছে। প্রায় দশমিটার লম্বা এই বাহুগুলোর প্রান্তে লাগানো রয়েছে অতি শক্তিশালী মেটাল হ্যালাইড ল্যাম্প। রাতে এই বাতিগুলো জেল এলাকাকে আলোর বন্যায় ভাসিয়ে দেয়। সেই আলোয় একটা নেংটি ইঁদুরও ছায়ার আড়াল খুঁজে পায় না।

নিউ সিটির সেন্ট্রাল জেল নিউ সিটির গর্ব। দেশবিদেশ থেকে বহু হোমরাচোমরা মানুষ এই হাই-টেক আলট্রামডার্ন জেল দেখতে আসেন। এটা শ্রীধর পাট্টার খুব ভালো লাগে। গর্বে বুক কয়েক ইঞ্চি ফুলেও ওঠে হয়তো। কারণ, এই সেন্ট্রাল জেলের চিফ ডিজাইনার শ্রীধর নিজে।

শ্রীধর পাট্টা চেয়ারে বসে পড়লেন আবার। হরিমোহনকে ইশারায় বসতে বললেন। হরিমোহন ঘাড়টা সামান্য বেঁকিয়ে বোধহয় একটা বেয়াদব ব্যথাকে শায়েস্তা করলেন। তারপর একটা খালি চেয়ার টেনে নিয়ে শ্রীধরের একরকম মুখোমুখি বসে পড়লেন। ওঁদের দুজনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গা দিয়ে আর্ক কম্পিউটারের মনিটর চোখে পড়ছিল। সেখানে অপাশি কানোরিয়ার বেশ কয়েকটা রঙিন ফোটোগ্রাফ।

বাঁ-হাতের পিঠের ওপরে ডানহাতের আঙুল দিয়ে কয়েকবার তাল ঠুকলেন শ্রীধর। ছোট করে ওপর-নীচে থুতনি নাড়লেন কয়েকবার। তারপর খুব আলতো গলায় বললেন, ‘এই ক্রিমিনালটাকে আমার পছন্দ হয়েছে। জিশান পালচৌধুরীর মোকাবিলা করতে হলে এরকম হার্ডকোর ক্রিমিনালই দরকার। ওর সি-ভি আমার দারুণ লেগেছে।’ অল্প হাসলেন শ্রীধর : ‘ওকে কোথায় পেলেন? লাস্ট কিল গেমের সময় যখন আমি সিলেকশানে এসেছিলাম তখন ওর সি-ভি তো স্টোরেজ ফাইলে ছিল না!’

ছোট্ট করে দুবার কাশলেন হরিমোহন। মার্শালের স্মৃতিশক্তির তারিফ না করে উপায় নেই!

তারপর ওপরের ঠোঁটটা একবার চেটে নিয়ে বললেন, ‘ঠিকই ধরেছেন, স্যার। অপাশি কানোরিয়া আমার জেলে এসেছে আড়াই মাস। ওর ডোসিয়ারের ফার্স্ট পেজে ওর এন্ট্রির তারিখটা লেখা আছে। ওল্ড সিটির নর্দার্ন বেল্টের পাহাড়ি এলাকা থেকে ওকে আমরা অ্যারেস্ট করেছিলাম।’

‘আমি ওর ফাইলটা ওপর-ওপর স্ক্যান করেছি। ভয়ংকর মানুষ হিসেবে খুবই অ্যাট্রাকটিভ সি-ভি। ওর টোটাল ফাইলটার একটা সফট কপি আর একটা হার্ড কপি কাল বিকেলের মধ্যে আমার কিল গেমের ইন-বক্সে পাঠিয়ে দেবেন। এখন ওর ব্যাপারে ইন আ নাটশেল কিছু আমাকে বলবেন?’

জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলেন হরিমোহন। বিনা প্রয়োজনে হাত কচলানোর ঢঙে হাতে হাত ঘষলেন। তারপর : ‘আপনি এগজ্যাক্টলি কী জানতে চাইছেন জানি না, স্যার… তবে…অপাশির ফেরোসিটি কোশেন্ট হল 9.4—অর্থাৎ, আলট্রা-হাই রেঞ্জে…।’

নিউ সিটির সেন্ট্রাল জেলে ভয়ংকর ক্রিমিনালদের রেটিং ঠিক করা হয় ফেরোসিটি স্কেল দিয়ে—অনেকটা ভূমিকম্পের রিখটার স্কেলের মতো। একজন অ্যাভারেজ ক্রিমিনালের ফেরোসিটি কোশেন্ট হল 4.5। আর, একজন সিরিয়াল কিলারের ফেরোসিটি কোশেন্ট 8.0।

শ্রীধর পাট্টার নির্দেশে ডক্টর মনসুখ চক্রপাণি আর ডক্টর গণপত আচারিয়া—যাঁদের শ্রীধর যথাক্রমে ‘এ’ এবং ‘কিউ’ বলে ডাকেন—এই ফেরোসিটি স্কেলের কনসেপ্ট আর তার ভ্যালু কমপিউট করার ইমপিরিক্যাল ফরমুলা আবিষ্কার করেছেন। সেন্ট্রাল জেলে সব অপরাধীরই ফেরোসিটি স্কেল হিসেব করা আছে।

‘চমৎকার! চমৎকার!’ হাঁটুতে ছোট-ছোট তিনটে চাপড় মারলেন শ্রীধর। ফেরোসিটি স্কেল যার ৯.৪ তার কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করা যেতে পারে।

দুবার জোরে-জোরে নাক টানলেন। তারপর ভুরু উঁচিয়ে হরিমোহনকে জিগ্যেস করলেন, ‘আর ফিজিক্যাল স্ট্রেংথ? সেটা কীরকম?’

হরিমোহন চটপট জবাব দিলেন, ‘সেটাও খারাপ নয়। তবে ওর হাত আর কাঁধে জোর সবচেয়ে বেশি। স্রেফ চপার চালিয়ে অপাশি একটা ছোটখাটো গাছের গুঁড়ি এককোপে কেটে ফেলতে পারে—।’

‘আর কোনও ইমপরট্যান্ট ইনফরমেশান?’

একটু ইতস্তত করলেন। তারপর : ‘এটা আদৌ কোনও ইনফরমেশান কি না জানি না—তবে অপাশি একটু একাচোরা টাইপের…।’

‘মানে?’

‘মানে…মানে…সবসময় একা-একা থাকতে ভালোবাসে। বিকেলের রিল্যাক্স আওয়ারে ও কারও সঙ্গে মেশে না। উঁহু, ”মেশে না” কী বলব, কথাই বলে না…।’

থুতনিতে আঙুল বোলালেন শ্রীধর। বিড়বিড় করে বললেন, ‘ওর সি-ভি-তে ক্রাইম রেকর্ডও একই কথা বলছে। সবক’টা খুন ও একা করেছে—সঙ্গে কোনও অ্যাকমপ্লিস নেয়নি। হি ইজ আ লোন অপারেটার।’

চিফ জেলারের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা বলার পর শ্রীধর বললেন, ‘এবার আমি অপাশি কানোরিয়াকে দেখব। ওর সঙ্গে কথা বলব—।’

‘অফ কোর্স, স্যার।’ হরিমোহন চোখের পলকে ‘হুজুরে হাজির’ হয়ে গেলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

সঙ্গে-সঙ্গে দুজন অফিসার তাঁদের শরীরের ঢিলেঢালা ভাবটাকে পলকে ঝেড়ে ফেলে টান-টান হয়ে দাঁড়ালেন।

‘অপাশি কানোরিয়া—’ হরিমোহন বললেন : ‘কোড নম্বর A-1207। মার্শাল স্যার ওর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন—কথা বলবেন। যান, গিয়ে অ্যারেঞ্জমেন্ট করুন, আমি মার্শাল স্যারকে নিয়ে আসছি…।’

অফিসার দুজন জুতোর গটগট শব্দ করে চলে গেলেন।

ওদের মিনিট দশেক সময় দিলেন হরিমোহন। শ্রীধরের সঙ্গে সেন্ট্রাল জেলের নানান সুবিধে-অসুবিধে নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। তারপর একসময় বিনীত গলায় মার্শালকে বললেন, ‘চলুন, স্যার। অপাশি কানোরিয়া—।’

হরিমোহন চট্টোপাধ্যায় পথ দেখিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। শ্রীধর চুপচাপ ওঁকে অনুসরণ করতে লাগলেন।

করিডর আর তার দুপাশের ঘর, দেওয়াল ইত্যাদি, আলোর ব্যবস্থা, এমনকী সিলিংও যথেষ্ট আধুনিক এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। দেখে জেলের বদলে একটা থ্রি স্টার হোটেলের কথা আগে মনে পড়ে। জেলের এই স্তরের যত্ন নেওয়ার খরচ জোগায় সিন্ডিকেট—অথবা, আরও সরাসরি বলা ভালো—শ্রীধর পাট্টা। কারণ, এই জেলের হার্ডকোর ক্রিমিনালদের ওপরে নির্ভর করছে কিল গেমের জনপ্রিয়তা এবং সাফল্য, বিজ্ঞাপনের রেভিনিউ, নিউ সিটির ইকনমি।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওঁরা একটা লেসার ডিসপ্লে দেখতে পেলেন। তাতে লাল আলোর হরফে ইংরেজিতে লেখা ‘রেস্ট্রিকটেড এরিয়া’। তারপরই বিভাজনের স্বচ্ছ দেওয়াল।

হরিমোহন মার্শালের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘স্যার, আপনি এক বছর আগে সেন্ট্রাল জেল মডার্নাইজেশানের জন্যে যে-তিরিশ কোটি টাকা গ্রান্ট দিয়েছিলেন সেটা ইউটিলাইজ করেই এসব হাই-টেক ব্যাপার করেছি। এই দেওয়াল পেরোলেই হার্ডকোর ক্রিমিনালদের এলাকা। তাই দেওয়ালটা আক্ষরিক অর্থেই একদম ”হার্ডকোর”—মানে, ট্রান্সপারেন্ট, রেসিলিয়েন্ট আর বুলেটপ্রুফ।’

কথা থামিয়ে পরিতৃপ্তির চোখে মার্শালের দিকে তাকালেন হরিমোহন।

প্রভুভক্ত অ্যালসেশিয়ানের পিঠ চাপড়ে দেওয়ার ঢঙে চিফ জেলারের পিঠ চাপড়ে দিলেন শ্রীধর : ‘আপনার এফিশিয়েন্সি আমি ভালো করেই জানি। সেইজন্যেই তো আপনার ওপরে এতটা ডিপেন্ড করি…।’

হরিমোহন জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটলেন। ওঁর লেজ থাকলে সেটা নিশ্চয়ই এখন এদিক-ওদিক দুলত।

স্বচ্ছ দেওয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে চারজন সিকিওরিটি গার্ড। তাদের কোমরে শকার এবং হাতে মিসাইল পিস্তল। ওদের দেখে মনে হচ্ছিল ওরা মানুষ নয়—পাথরের মূর্তি। হরিমোহন আর শ্রীধরকে দেখে ওরা যান্ত্রিকভাবে বাও করল।

দেওয়ালের গায়ে কোনও দরজা চোখে পড়ছিল না শ্রীধরের। ঠিক যেন একটা সিমলেস বিভাজন পাত।

তিনি সামান্য ভুরু কুঁচকে হরিমোহনের দিকে তাকাতেই হরিমোহন পকেট থেকে একটা ছোট রিমোট ইউনিট বের করে সেটা দেওয়ালের দিকে তাক করে একটা দশ ডিজিটের কোড ইনপুট করলেন।

স্বচ্ছ দেওয়ালের একটা স্বচ্ছতর অংশ নি:শব্দে একপাশে সরে গেল। হরিমোহন শ্রীধরকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।

হার্ডকোর ক্রিমিনালদের এলাকায় আলোর কোনও ঘাটতি নেই। এ ছাড়া তার নানা জায়গায় আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া।

হরিমোহন অলিপথ ধরে হাঁটছিলেন আর রিমোটের কীসব বোতাম টিপছিলেন। পাথরের মেঝেতে ওঁদের জুতোর শব্দ ফাঁকা প্রতিধ্বনি তুলছিল।

একটু পরেই একটা সেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন দুজনে।

স্বচ্ছ ফাইবারে তৈরি একটা ওয়ান রুম স্টুডিয়ো ফ্ল্যাট। ভেতরে উজ্জ্বল আলো। একজন মোটাসোটা লোক টেবিলের কাছে বসে কী যেন লেখালিখি করছে।

হরিমোহন চাপা গলায় বললেন, ‘অপাশি কানোরিয়া, মার্শাল স্যার—।’

শ্রীধর দেখলেন, ঘরটা সুন্দরভাবে সাজানো। এমনকী ঘরে রঙিন টিভি পর্যন্ত রয়েছে।

না:, এদের যত্নআত্তির ব্যাপারে কোনও খামতি নেই। হরিমোহন জানেন, এরা নিউ সিটির বলতে গেলে অ্যাসেট।

শ্রীধরদের দিকে একবারও চোখ তুলে তাকাল না অপাশি। নিজের মনে লিখতে লাগল। তারপর হঠাৎই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পায়চারি করতে লাগল। শ্রীধরদের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবতে লাগল।

অপাশি সরাসরি শ্রীধরদের দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু চোখে শূন্য দৃষ্টি।

শ্রীধর পাট্টা অস্বস্তি পাচ্ছিলেন। ইতস্তত করে অবাক চোখে চিফ জেলারের দিকে তাকালেন।

হরিমোহন হেসে বললেন, ‘আপনাকে চমকে দেব বলে আগে থেকে বলিনি, স্যার। আমি রিমোটের বোতাম টিপে একটা স্পেশাল কোড ইনপুট দিলেই এই সেলের ফাইবারের ওয়ালগুলো সব ওয়ান ওয়ে মিরার হয়ে যায়। তাই অপাশি ওর ঘরের দেওয়ালগুলোকে এখন আয়না হিসেবে দেখছে—আমাদের দেখতে পাচ্ছে না।’

শ্রীধর অপাশিকে দেখতে লাগলেন।

একটু আগে কম্পিউটারে যা দেখেছিলেন, কনট্রাডিকশান যেন তার চেয়েও অনেক বেশি। যেমন নিষ্পাপ চেহারা ঠিক তেমনই নিষ্পাপ বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর অভিব্যক্তি। তবে ছোট-ছোট সরু চোখের কোথায় যেন মিশে আছে এক ফোঁটা সতর্কতা।

শ্রীধরের কেন জানি না মনে হচ্ছিল, এই ওয়ান ওয়ে মিরারের গল্পটা অপাশির অজানা নয়।

বেশ কয়েক মিনিট অপাশিকে লক্ষ করলেন ওঁরা দুজনে। তারপর শ্রীধরের ইশারায় রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটের বোতাম টিপে সেলের ফাইবার ওয়ালের ক্যারেকটার পালটে দিলেন হরিমোহন। ওটা এখন টু ওয়ে সি থ্রু ফাইবার শিট হয়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে অপাশি ওঁদের দুজনকে দেখতে পেল। সরলভাবে একগাল হেসে দিল ও।

সেই মুহূর্তে কনট্রাডিকশানের মাত্রাটা এক ঝটকায় এমন বেড়ে গেল যে, শ্রীধর পাট্টার মতন মানুষও চমকে উঠলেন।

হরিমোহন আবার রিমোট ইউনিটের বোতাম টিপলেন।

ওঁদের সামনের দেওয়ালে আটটা ছোট-ছোট জানলা তৈরি হয়ে গেল। দুটো সারিতে চারটে করে খুদে জানলা—প্রত্যেকটা মাপে এক ইঞ্চি বাই এক ইঞ্চি।

হরিমোহন গর্বের হাসি নিয়ে ঘুরে তাকালেন মার্শালের দিকে। বললেন, ‘সেলের কয়েদিদের সঙ্গে কথা বলার জন্যে এই ব্যবস্থা, স্যার…।’

শ্রীধর ওঁর দিকে চেয়ে একচিলতে হাসলেন শুধু।

এবার হরিমোহন অপাশির দিকে ইশারা করে ওকে ডাকলেন : ‘মিস্টার কানোরিয়া, প্লিজ, আমাদের কাছে আসুন—।’

শ্রীধর অবাক হয়ে চিফ জেলারের দিকে তাকালেন।

চিফ জেলার বললেন, ‘ও ”আপনি-আজ্ঞে” ব্যাপারটা খুব পছন্দ করে। তাতে বেশ হাসি-খুশি আর শান্ত থাকে।’

অপাশি কানোরিয়া শ্রীধরদের খুব কাছে এসে দাঁড়াল। মুখে হাসি, চোখে সামান্য কৌতূহল।

চিফ জেলার শ্রীধরের সঙ্গে অপাশির পরিচয় করিয়ে দিলেন।

‘মিস্টার কানোরিয়া, ইনি হলেন নিউ সিটির পিস ফোর্সের মার্শাল মিস্টার শ্রীধর পাট্টা। ঠিকভাবে বলতে গেলে, ইনিই নিউ সিটির শেষ কথা…।’

হাসল কানোরিয়া। বলল, ‘যেমন এই জেলে আপনিই শেষ কথা।’ তারপর শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে : ‘হাউ আর য়ু, মার্শাল,? নাইস টু মিট য়ু…।’

শ্রীধর কানোরিয়ার শেষের দিকের কথাগুলো ঠিকঠাক শুনতে পাচ্ছিলেন না। কারণ, ওঁর মাথায় ঘুরছিল কনট্রাডিকশান।

কানোরিয়ার মধ্যে কনট্রাডিকশানের চূড়ান্ত দেখে শ্রীধর ভেতরে-ভেতরে টগবগ করছিলেন।

কী আশ্চর্য মিহি অপাশি কানোরিয়ার গলার স্বর! এ যেন কোনও মেয়ের গলাকেও হার মানায়!

অথচ এই লোকটাই গুনে-গুনে বত্রিশটা মানুষকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে! বত্রিশ রান!

কিল গেমের দিন ও নিশ্চয়ই অনায়াসে আরও একটা রান স্কোর করতে পারবে!

সিমানকে অনেকক্ষণ ধরে ফোন করে পাচ্ছিলেন না রঙ্গপ্রকাশ। ওঁর কপালে ভাঁজ পড়ছিল। একইসঙ্গে ব্যথার জগতে হারিয়ে যাচ্ছিলেন।

প্রায়ই এরকম হয়। ছেলেটা বলতে গেলে সবসময়েই রঙ্গপ্রকাশ আর পর্ণমালাকে দুশ্চিন্তায় রাখে। কে জানে কোনও বিপদে পড়ল কি না!

সিমানের সঙ্গে-সঙ্গে নিজের ইকনমিক ইনডেক্স-এর কথাও ভাবছিলেন। ভাবছিলেন ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর কথা।

মাথার দুপাশ দপদপ করছিল। কেউ যেন প্যাঁচ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে ইস্পাতের তুরপুন চালিয়ে দিচ্ছে মাথার ভেতরে।

পর্ণমালা পাশের ঘরে। বোধহয় পামটপ নিয়ে ব্যস্ত। নিশ্চয়ই ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কাউন্সিলের ভবিষ্যৎ আরও উজ্জ্বল করার চেষ্টা করছে। হয়তো ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তাও করছে, কিন্তু পর্ণমালাকে বাইরে থেকে দেখে ওর ভেতরের ঝড় খুব একটা আঁচ করা যায় না। কিন্তু রঙ্গপ্রকাশের সে-দক্ষতা নেই। তাই ওঁর কান্না পেয়ে যাচ্ছিল।

গলা তুলে পর্ণমালাকে এক কাপ কফি দেওয়ার জন্য বললেন। দেখা যাক, এক কাপ কফি তুরপুনের তেজ কমাতে পারে কি না।

প্লাজমা কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকালেন। সেখানে জিশানের ভিডিয়ো ছবি চলছে—তবে সাউন্ড ‘মিউট’ করে দেওয়া। শব্দহীন চলচ্চিত্র দেখছেন ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস। কারণ, ওঁর প্রিয় এলাকা হল ‘কাইনেসিকস’। অর্থাৎ, অঙ্গভঙ্গি আর শরীরের ভাষার মাধ্যমে ভাবপ্রকাশচর্চার বিজ্ঞান। না বলা মনের ভাব, উদ্দেশ্য ইত্যাদি বিশ্লেষণের মাধ্যমে বুঝে নেওয়া।

এখন জিশানের নি:শব্দ ছবি দেখে ওর মনের ভেতরের রহস্য আরও গভীরভাবে বুঝতে চাইছেন। যা-যা বুঝতে পারবেন সেসব চলে যাবে জিশানের সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইলের ফাইলে।

ঠিক এমন একটা সময়ে, প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে, অচেনা একটা নম্বর থেকে ফোন এসেছিল।

তিনি ‘হ্যালো’ বলামাত্রই ও-প্রান্ত থেকে জিশান পালচৌধুরীর গলা শোনা গিয়েছিল। হ্যাঁ, জিশান—জিশান পালচৌধুরী!

টেলিফোনে জিশানের বলা কথাগুলো রঙ্গপ্রকাশের মনের ভেতরে হঠাৎই বেজে উঠল আবার।

‘হ্যালো, জিশান বলছি—জিশান পালচৌধুরী…।’

উত্তর দেওয়ার সময় রঙ্গপ্রকাশের গলা কেঁপে গিয়েছিল। তারপর…।

তারপর, সিমানের কথা শোনার পর, মন এবং গলা সংযত করে জিশানকে ধন্যবাদ দিয়েছেন। কিন্তু ফোনে কথা বলা শেষ করার পর নিজেকে আর সুস্থির রাখতে পারেননি। তাসের ঘরের মতো ছত্রখান হয়ে গিয়েছেন।

মরণাপন্ন জন্তুর মতো আর্তনাদ করে ডুকরে উঠেছেন। পাঁজরার পলকা হাড়গুলো যেন পটপট করে মটকে যাচ্ছিল।

অদ্ভুত যন্ত্রণার শব্দে পর্ণমালা ছুটে এসেছেন কম্পিউটার রুমে। বিস্ময়ের ধাক্কা খেয়ে দেখেছেন বিজ্ঞানী স্বামী টেবিলের ওপরে মাথা রেখে সব-হারানো বাচ্চার মতো কষ্টে জর্জরিত হয়ে ছটফট করছেন।

পর্ণমালার হাত থেকে গরম কফির কাপ খসে পড়েছে অ্যান্টি-স্ট্যাটিক ফ্লোরে। কাপটা পাঁচ টুকরো হয়ে গেছে। আর কফিও ছড়িয়ে গেছে যেখানে-সেখানে।

ওঁর মুখ দিয়ে গোঙানির মতো ‘সিমান! সিমান!’ শব্দটা বেরিয়ে আসছিল বারবার। ওঁকে দেখে পায়ে কুচলে দেওয়া কেন্নোর মতো লাগছিল।

ছেলেকে যে তিনি কতটা ভালোবাসেন সেটা যেন আবার নতুন করে বুঝতে পারছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। ভয় হচ্ছিল, তিনি বোধহয় শত-সহস্র টুকরোয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে শেষ পর্যন্ত ধুলো হয়ে যাবেন।

কিন্তু সেটা হল না পর্ণমালার জন্য।

ছুটে এসে স্বামীকে জাপটে ধরে সামাল দিতে লাগলেন। সান্ত্বনা দিতে, সাহস জোগাতে কত না এলোমেলো কথা বললেন। তারই মধ্যে উতলা গলায় জিগ্যেস করছিলেন, ‘কী হয়েছে? সিমানের কী হয়েছে?’

ওঁদের আপাত সুন্দর সুখী বাড়িটার ভেতরে দুশ্চিন্তা আর শোকের ঢেউ উথলে উঠছিল বারবার। কিন্তু বাইরের রাস্তা থেকে সেসব কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না।

প্রায় চল্লিশ মিনিট পর ওঁরা সামলে উঠলেন। তারপর সোফায় হেলান দিয়ে থমথমে মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন। সিমান কখন আসবে কে জানে!

স্বামীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য পর্ণমালা আরও তিনবার কফি তৈরি করে নিয়ে এলেন। রঙ্গপ্রকাশকে দিলেন, নিজেও নিলেন। তারপর পরিস্থিতির চাপ হালকা করার জন্য প্লাজমা কম্পিউটারে জিশানের হলোগ্রাম ভিডিয়ো ইমেজ দেখতে শুরু করলেন।

রঙ্গপ্রকাশের চোখের কোল ফোলা। বারবার নাক টানছেন। কিন্তু একইসঙ্গে ওঁর চোখ আটকে রয়েছে কম্পিউটারের পরদায়। কীভাবে যেন ওঁর বিজ্ঞানী সত্তার একটা ছোট্ট অংশ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। ‘কাইনেসিকস’ রঙ্গপ্রকাশকে উসকে দিচ্ছে।

এভাবে কতক্ষণ যে কেটেছে ডক্টরের খেয়াল নেই। হঠাৎই ওঁর কম্পিউটার রুমের দরজায় হাজির হয়ে গেল দুজন মানুষ।

জিশান আর সিমান।

রঙ্গপ্রকাশ কয়েক সেকেন্ড কোনও কথা বলতে পারলেন না। নিষ্পলক চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই টগবগে তরুণ কোন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় প্লাজমা কম্পিউটারের মনিটর থেকে লাফিয়ে নেমে পড়েছে ওঁর ঘরের দরজায়।

অনেক পরে মনোযোগ গেল ছেলের দিকে।

ক্লান্ত-শ্রান্ত বিধ্বস্ত চেহারা। কপালে ব্যান্ডেজ। গায়ে হসপিটালের রুগিদের মতো ঢোলা পোশাক। জিশানের গায়ে হেলান দিয়ে কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

কফির কাপ টেবিলে রেখে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন পর্ণমালা। চোখ ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। আপাত সংযমের বর্মের নানান স্তর মোচার খোলার মতো খসে পড়ল একে-একে। দৃষ্টিহীন মানুষের মতো এলোমেলো পা ফেলে ছেলের কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর আচমকা ওকে বুকে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।

‘সিমান! সিমান! এ কী দশা হয়েছে তোর! কোথায় ছিলি তুই? কোথায় ছিলি, বাবা?’

জিশান আর রঙ্গপ্রকাশ মা আর ছেলেকে দেখতে লাগলেন। জিশানের মনে পড়ল অর্কনিশানের কথা! ও:! কতদিন ওর সোনামণি শিশুটাকে ও বুকে জড়িয়ে ধরেনি!

স্ত্রীকে দেখে খানিকটা যেন অবাক হচ্ছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। সিমানের জন্য পর্ণমালার এতটা টান তিনি আগে কখনও বুঝতে পারেননি। মাতৃস্নেহ তা হলে সহজে মরে না!

জিশানের হাতে একটা বায়োডিগ্রেডেবল প্যাকেট ছিল। তার মধ্যে সিমানের ভিজে জামাকাপড় রয়েছে।

ও দু-পা সামনে এগিয়ে প্যাকেটটা কফি টেবলের ওপরে রাখল। বলল, ‘এর মধ্যে সিমানের ভেজা জামা-প্যান্ট রয়েছে…।’

জিশানকে সামনাসামনি দেখা আর সিমানকে ঠিকঠাক অবস্থায় ফিরে পাওয়ার শক ধীরে-ধীরে কাটিয়ে উঠলেন রঙ্গপ্রকাশ। সোফা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর এক পা সামনে এগিয়ে জিশানের দিকে হাত-বাড়িয়ে দিলেন।

‘থ্যাংকস। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ…।’ রঙ্গপ্রকাশের চোখে জল এসে গেল। ভাঙা গলায় নিজের আর পর্ণমালার পরিচয় দিলেন।

জিশান হাত মেলাল। সামান্য হাসল : ‘ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, ডক্টর বিশ্বাস। একজন সাধারণ মানুষ যা করত আমি তা-ই করেছি—তার বেশি কিছু করিনি—।’

এইজন্যই বোধহয় জিশান অসাধারণ। ভাবলেন রঙ্গপ্রকাশ।

‘আপনি প্লিজ বসুন…।’

একটা সিঙ্গল সোফার দিকে ইশারা করলেন ডক্টর। চোখ মুছে নিজের জায়গায় বসে পড়লেন।

জিশান বসল—রঙ্গপ্রকাশের মুখোমুখি। সিমান আর পর্ণমালাকে একপলক দেখল। তারপর অ্যাক্সিডেন্টের শুরু থেকে সব বলতে শুরু করল।

গাড়িতেই সিমানের নেশার ঘোর কেটে গিয়েছিল। তখন গাড়ি থামিয়েছে গুনাজি। জিশান গাড়ি থেকে নেমে সিমানের পাশে গিয়ে বসেছে। ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে সফট এনার্জি প্যাক থেকে অল্প-অল্প করে এনার্জি ড্রিংক ওকে খাইয়েছে। তারপর ওর শরীরটাকে যত্ন করে আঁকড়ে ধরে বসে থেকেছে।

গুনাজির স্টিয়ারিং তখন রঙ্গপ্রকাশের বাড়ির সঙ্গে ওঁর সি থ্রু অটোমোবিলের দূরত্ব দ্রুতগতিতে কমাচ্ছে।

‘সিমানের সবরকম মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট করা হয়ে গেছে—’ জিশান রঙ্গপ্রকাশের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘এখন ওর শুধু রেস্ট দরকার।’

জিশানের কাছে সব ঘটনা শুনতে-শুনতে রঙ্গপ্রকাশের চোখ আবার ভিজে উঠেছে। তিনি চট করে উঠে দাঁড়ালেন। সিমান আর পর্ণমালার কাছে গেলেন। ছেলের মাথায় স্নেহমাখা হাত বোলালেন কয়েকবার। বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে নিজের চোখের জল মুছলেন। ভারী গলায় পর্ণমালাকে বললেন, ‘ওকে ভেতরে নিয়ে যাও। বিছানায় শুইয়ে দাও। রেস্ট—অ্যাবসোলিউট রেস্ট। ওকে এত ভাঙাচোরা দেখাচ্ছে…।’

পর্ণমালা ছেলেকে নিয়ে ধীরে-ধীরে চলে গেলেন ভেতরের ঘরের দিকে।

রঙ্গপ্রকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর হঠাৎই যেন খেয়াল করলেন, সামনের কম্পিউটারের পরদায় জিশান চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে—কিন্তু কোনও শব্দ নেই।

কম্পিউটারের মনিটর থেকে পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি নজর ঘোরালেই আসল জিশান।

রঙ্গপ্রকাশের বিজ্ঞানী সত্তা বলে উঠল, ‘আচ্ছা, ছবির জিশান, আর সামনে বসে থাকা জলজ্যান্ত জিশান—কাইনেসিকস কি এই দুজনের শরীরের ভাষার তুলনামূলক বিচার করে নতুন কোনও উত্তর বের করতে পারে?’

সামনে বসা জিশানকে দেখছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন, জিশান যতই বিনয় করে বলুক না কেন, ও আসলে সাধারণ নয়। ও যে অন্যরকম, তার একটা অদৃশ্য বিকিরণের তেজ রঙ্গপ্রকাশ অনুভব করতে পারছিলেন। সেইসঙ্গে সিমানকে নিরাপদে ফিরে পাওয়ার স্বস্তি এবং আনন্দ মনের ভেতরে বুদ্বুদের ফোয়ারা তৈরি করছিল। আর সামনে বসা তরুণটির প্রতি কৃতজ্ঞতার ঢেউ বুকের ভেতরে আছড়ে পড়ছিল বারবার।

জিশান ঘরটা অবাক চোখে দেখছিল। দেখছিল সেমি-ট্রান্সপারেন্ট গ্লাস পার্টিকল ইমপ্রেগনেটেড পলিমারের ফার্নিচার। আর দেওয়ালের জায়ান্ট প্লেট টিভি এবং প্লাজমা কম্পিউটারের মনিটর।

রঙ্গপ্রকাশ ওকে লক্ষ করছিলেন।

জিশানের কপালে একটু ভাঁজ পড়েছে। একটা ভুরু সামান্য উঁচিয়ে রয়েছে। হাত, হাতের আঙুল উদ্দেশ্যহীনভাবে ইতস্তত নড়াচাড়া করছে।

সব মিলিয়ে বিস্ময়, কৌতূহল, অস্বস্তি।

সত্যি, ‘কাইনেসিকস’ বড় বিচিত্র বিষয়। প্রায় চারশো বছর আগে নৃবিজ্ঞানী রে বার্ডহুইস্টেল প্রথম এই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। তিনি গবেষণা করে বুঝতে চেয়েছিলেন, মুখের ভাবভঙ্গি, হাতের ইশারা, পায়ের নড়াচড়া, দাঁড়ানোর ঢং এসবের মাধ্যমে মানুষ কীভাবে ভাবের আদানপ্রদান করে। এই নন-ভার্বাল ল্যাঙ্গুয়েজ ফর্মের ব্যাকরণও তৈরি করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, আমরা যে সামাজিক জীবনে নিয়মিত ভাব বিনিময় করি তার মাত্র তিরিশ কি পঁয়ত্রিশ শতাংশ করি ভাষার মাধ্যমে—আর বাকিটা অভিব্যক্তি আর অঙ্গভঙ্গি দিয়ে।

সেসব কথা খুব মনে পড়ছিল এখন।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিশান বলল, ‘গাড়িতে আসার সময় আমি সিমানের সঙ্গে…কথা বলছিলাম। তাতে যা…জেনেছি…সেগুলো আপনাকে…জানানো দরকার। সিমানের ভালোর জন্যে…।’

রঙ্গপ্রকাশ ছোট একটা ধাক্কা খেলেন। ‘সিমানের ভালোর জন্যে….।’ তার মানে?

উৎকণ্ঠিত হয়ে জিশানের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন।

একসময় অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন, ‘বলুন—কী বলবেন…।’

টেবিলের দিকে চোখ নামাল জিশান। নীচু গলায় বলল, ‘আপনার ছেলে সিমান…সুইসাইড করতে চেয়েছিল…।’

এবার বড় একটা ধাক্কা খেলেন। সুইসাইড করতে চেয়েছিল সিমান?

কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না রঙ্গপ্রকাশ। ওঁর ঠোঁট সামান্য কাঁপতে লাগল। কিন্তু ওঁর বিজ্ঞানী সত্তা তখনও জিশানের অভিব্যক্তি আর নড়াচড়া লক্ষ করছিল।

না, জিশান যে মিথ্যে বলছে সেরকম কোনও লক্ষণ চোখে পড়ছে না।

রঙ্গপ্রকাশের বুকের ভেতরে কয়েকটা বিশাল লোহার বল গড়াতে লাগল। দম আটকে আসতে চাইল। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, এখন কথা বলার চেষ্টা করলে শুধুই কান্না বেরিয়ে আসবে।

যে-ছেলেটার জন্য তিনি সবসময় মানসিক চাপ আর যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, যার জন্য নিউ সিটি ছেড়ে চলে যাওয়ার আতঙ্ক মনের আকাশে কালো মেঘের মতো ছেয়ে রয়েছে, সে রঙ্গপ্রকাশ আর পর্ণমালার জীবন থেকে চিরকালের জন্য চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

রঙ্গপ্রকাশ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। পর্ণমালাকে এ-ঘরে একবার ডাকা দরকার। কারণ, জিশান এবার যে-কথাগুলো বলবে সেগুলো একা-একা শোনার মতো সাহস তিনি তৈরি করতে পারছেন না। নিউ সিটির ‘সাইকোঅ্যানালিসিস সেন্টার’-এর চিফ সাইেকোলজিস্ট এখন নিজের মনের শক্তি এবং গতি-প্রকৃতি নিয়ে বিভ্রান্ত।

জিশানকে বললেন, ‘আপনি একটু বসুন। আমার ওয়াইফকে একটু ডেকে নিয়ে আসি—।’

ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। টের পাচ্ছিলেন পা দুটো ঠিকঠাক জায়গামতো পড়ছে না। ভয় পাচ্ছিলেন, এই বুঝি টলে পড়ে যাবেন।

ভাগ্য নেহাত ভালো বলতে হবে যে, চারটে কি পাঁচটা পা ফেলার পরই পর্ণমালাকে দেখতে পেলেন। একটা শৌখিন ট্রে হাতে এগিয়ে আসছেন ওঁদের দিকে। ট্রে-তে স্ন্যাক্স আর কফি—জিশানের জন্য।

তাড়াতাড়ি সোফার কাছে ফিরে এলেন রঙ্গপ্রকাশ। সোফায় বসার আগে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বললেন, ‘সিমান?’

কফির টেবিলে হাতের ট্রে-টা নামিয়ে রেখে শান্ত গলায় জবাব দিলেন, ‘ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা নার্ভ সুদার দিয়েছি…।’

‘পর্ণ, তুমি একটু এখানে বোসো। মিস্টার পালচৌধুরী কী বলছেন শোনো—।’

স্বামীর কাছে বসলেন পর্ণমালা। জিশানের দিকে তাকালেন।

জিশান খেয়াল করল, সিমানের জন্য কান্নাকাটি করে পর্ণমালা ওর মেকাপের ধার যেটুকু নষ্ট করেছিলেন সেটা এটুকু সময়ের মধ্যেই সাধ্যমতো মেরামত করে এসেছেন।

জিশান কফির কাপে চুমুক দিল।

রঙ্গপ্রকাশ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘জিশান, বলুন, সিমানের কথা কী বলছিলেন—।’

‘হ্যাঁ-বলছি।’ পর্ণমালার দিকে তাকাল জিশান : ‘ম্যাডাম, আপনাদের ছেলে সিমান গাড়ি চালিয়ে স্কাই-হাই ফ্লাইওভার থেকে সেন্ট্রাল লেকে ঝাঁপ দিয়েছে। ও সুইসাইড করতে চেয়েছিল। তারপর…তারপর কীভাবে ওকে রেসকিউ করা হয়, মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট দেওয়া হয়, সেসব তো আগেই ডক্টর বিশ্বাসকে আমি ফোনে জানিয়েছি…।’

রঙ্গপ্রকাশ পাশে হাত বাড়ালেন। পর্ণমালার হাতটা খুঁজলেন। একসময় সেটা পেয়ে আঁকড়ে ধরলেন।

‘ও সুইসাইড করতে চেয়েছিল কী করে বুঝলেন?’ পর্ণমালার ভুরুতে ভাঁজ। কণ্ঠস্বরে হালকা বিদ্রোহ।

জিশান হাতে হাত ঘষল। এদিক-ওদিক উদ্দেশ্যহীন তাকাল। তাকাল, কিন্তু ওর চোখ কিছু দেখতে পেল না।

রঙ্গপ্রকাশ বুঝলেন, ও দোটানায় পড়েছে। স্পষ্ট কথা বলবে, নাকি মানবিক সৌজন্য বজায় রাখবে? একজন বাবা-মা-কে আঘাত দেবে, নাকি দেবে না?

শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হল।

জিশান রঙ্গপ্রকাশ আর পর্ণমালার দিকে একপলক করে তাকিয়ে মাথা নীচু করল। বলল, ‘সিমান নিজে আমাকে বলেছে…।’

খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখালেন পর্ণমালা। পালটা জিগ্যেস করলেন, ‘কেন, সুইসাইড করতে চেয়েছে কেন? ওর কীসের কষ্ট? কীসের অভাব? আমাদের কোনও ব্যবহারে কি ও ব্যথা পেয়েছে?’

জিশান ইতস্তত করে বলল, ‘না, না, ঠিক সেরকম নয়। আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। সিমান ওর খুব পারসোনাল কথা…গাড়িতে আসার সময় আমাকে বলেছে…।’

‘খুব পারসোনাল কথা। অথচ আমাদের না বলে আপনাকে বলেছে!’ পর্ণমালার ভুরু এখনও কুঁচকে রয়েছে। চোখের তারায় আলতো বিস্ময়।

জিশান একটু নড়েচড়ে বসল। সোফায় শরীরটাকে খানিকটা এলিয়ে দিল। কিছুক্ষণ চুপ করে গিয়ে কফির কাপে কয়েকবার চুমুক দিল। স্ন্যাক্সে কামড় দিল। তারপর বলল, ‘আশা করি আপনারা এগুলো সিমানের সঙ্গে আলোচনা করবেন না।’ ঠোঁটের ওপরে একবার আঙুল বুলিয়ে নিল জিশান। এপাশ-ওপাশ তাকাল। তারপর : ‘আলোচনা যদিও বা করেন, প্লিজ, বলবেন না যে, এসব আপনারা আমার কাছ থেকে শুনেছেন। তা হলে…তা হলে আমার প্রতি ওর যে আস্থা আর বিশ্বাস—সব নষ্ট হয়ে যাবে। সেটা…সেটা আমার ভালো লাগবে না…।’

‘আপনাকে এসব পারসোনাল কথা ও বলতে গেল কেন?’ পর্ণমালা এখনও সেই একই প্রশ্নে আটকে আছেন। কারণ, জিশানকে সিমানের ব্যক্তিগত কথাবার্তা বলার ব্যাপারটা পর্ণমালা আর রঙ্গপ্রকাশের সঙ্গে সিমানের সম্পর্কের দূরত্বটাকে বড্ড কুৎসিতভাবে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে।

‘একটা কথা বলি, ম্যাডাম—’ পর্ণমালার দিকে সরাসরি তাকাল জিশান : ‘আমাকে নিশ্চয়ই আপনাদের খুব কাছের মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কারণ, গত তিনমাস ধরে টিভিতে, রাস্তাঘাটের বিলবোর্ডে, নানান জায়গায় আমাকে—আমার ছবিকে—বেপরোয়াভাবে প্রচার করা হয়েছে। আপনাদের মিডিয়া আমাকে আপনাদের ঘরের লোক করে তুলেছে। এই শহরে ঘুরে বেড়িয়ে আমি দেখেছি, কিল গেম পার্টিসিপ্যান্ট জিশান পালচৌধুরীকে নিয়ে অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের মধ্যে কী উৎসাহ, কী উদ্দীপনা, কী হুল্লোড় মাতামাতি আর হইচই। ওদের কাছে আমি সুপারহিরো হয়ে গেছি—।’

রঙ্গপ্রকাশ বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমাদের কাছেও।’

পর্ণমালা স্বামীর দিকে একবার তাকালেন। তারপর জিশানের দিকে আবার মনোযোগ দিলেন।

‘সেইজন্যেই বোধহয় সিমান ওর মনের কথা আমার কাছে বলেছে।… বলেছে, ও ইচ্ছে করে ফ্লাইওভার থেকে সেন্ট্রাল লেকের জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। ওর আর বাঁচতে ইচ্ছে করছিল না…।’

আপনি ওর লাইফ সেভ করেছেন।’ রঙ্গপ্রকাশ বললেন, ‘উই আর গ্রেটফুল টু য়ু…।’

‘প্লিজ—’ অনুনয় করে বলল জিশান, ‘একটা মামুলি কর্তব্যকে শুধু-শুধু বড় করে দেখাবেন না। যাই হোক, ডক্টর বিশ্বাস, মিসেস বিশ্বাস…আপনাদের ছেলে প্রায় একবছর ধরে ড্রাগ, বেটিং আর গ্যাম্বলিং-এ মেতে আছে। আপনাদের এই নিউ সিটির সুপারফাস্ট লাইফস্টাইলে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। অথচ এই লাইফস্টাইলের ভেতরটা যে ফোঁপরা সেটা আপনারা দুজন নিশ্চয়ই বোঝেন।

‘ডক্টর, টাকা খরচ করতে পারার ক্ষমতাটাই একমাত্র ক্ষমতা নয়, গায়ের জোরে কাউকে হারাতে পারার ক্ষমতাটাই একমাত্র ক্ষমতা নয়। যারা এসব সত্যি বলে ভাবে তারা ভালোবাসার ক্ষমতার কথা জানে না…।’ কফিতে আবার চুমুক দিল জিশান : ‘আসলে কী জানেন, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে যে-টান—সেই টানটাই সবচেয়ে পাওয়ারফুল। আপনাদের সঙ্গে সিমানের রিলেশানের টান কতটা ডেভেলাপ করেছিল সেটা আপনারাই ভালো জানেন। তবে…তবে…’ একটু ইতস্তত করল জিশান। তারপর নীচু গলায় বলল, ‘সিমান বলছিল, সেই টানটা ও কখনও সেভাবে টের পায়নি। ওর সবসময় মনে হয়, ওর কোনও পিছুটান নেই—।’

রঙ্গপ্রকাশ অবাক হয়ে জিশানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এসব কী শোনাচ্ছে জিশান। রঙ্গপ্রকাশ আর পর্ণমালার সঙ্গে সিমানের সম্পর্কের গোপন কথা?

কে সাইকোলজিস্ট? রঙ্গপ্রকাশ, না জিশান?

রঙ্গপ্রকাশ জিশানের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছিলেন না। ‘কাইনেসিকস’ বলবে, তিনি আসলে বিষয়টাকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন।

আড়চোখে পর্ণমালার দিকে তাকালেন। ওঁর অবস্থাও একইরকম। ঘরের ফার্নিচার খুঁটিয়ে দেখার কাজে মনোযোগ দিয়েছেন।

জিশান তখন বলছিল, ‘আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলছি বলে, প্লিজ, ক্ষমা করবেন। কিন্তু সিমানের কথাগুলো শুনে আমার মনে হল সেগুলো আপনাদের দুজনের কাছে পৌঁছোনো দরকার। তা হলে হয়তো সিমানের সঙ্গে আপনাদের কমিউনিকেশানের গ্যাপটা কমবে। যেমন ধরুন…।’ সামান্য মাথা ঝাঁকাল জিশান। রঙ্গপ্রকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে আঙুলে আঙুল ঠেকাল।

রঙ্গপ্রকাশ বুঝতে পারছিলেন, যে-কথাটা জিশান এখন বলতে চায় সেটা বলতে ও ইতস্তত করছে, সময় নিচ্ছে। বোধহয় কথাটা বেশ স্পর্শকাতর।

‘যেমন ধরুন, আপনি—ডক্টর বিশ্বাস—আমার সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল তৈরি করছেন…।’

রঙ্গপ্রকাশ চমকে গেলেন। জিশান এ-কথা জানল কেমন করে? ওর তো এসব জানার কথা নয়!

পর্ণামালাও অবাক হয়েছিলেন। ফার্নিচারের দিক থেকে চকিতে চোখ ফিরিয়ে তাকিয়েছেন জিশানের দিকে।

জিশান বলল, ‘না, না, ডক্টর—এতে আপনার অস্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই। সেপ্টেম্বরের দু-তারিখে আমাকে কিল গেমে নামতে হচ্ছে। এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সত্যি—এর মধ্যে কোনও ‘ইফস অ্যান্ড বাটস’ নেই। এবং আপনাকে বলে রাখছি, আমি সেদিন প্রাণপণ লড়ব। জেতার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করব। কেন জানেন, ডক্টর?’

হঠাৎই উঠে দাঁড়াল জিশান। পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওর মাইক্রোভিডিয়োফোন ইউনিটটা বের করল।

এই মুহূর্তে ওর মিনির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে। শানুকেও দেখতে ইচ্ছে করছে।

সেটটা অন করে একটু টিউন করতেই জিশানের আপনজনেরা চলে এল ওর চোখের সামনে।

মিনি। সুন্দর মুখে ঘাম এবং হাসি। জিশানের দিকে তাকিয়ে ওর চোখ দুটো আরও জীবন্ত হয়ে উঠল। আস্তে করে জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছ?’

জিশান হাসল : ‘ভালো—।’

‘দু-তারিখ তো দেখতে-দেখতে এসে যাবে…।’ সামান্য চোখ নামাল মিনি।

‘হ্যাঁ, এসে যাবে। তারপর পেরিয়েও যাবে। তখন তোমাদের কাছে ফিরে যাব। আমার দেরি সইছে না।’

‘তখন…তখন…’ মিনির কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল : ‘তখন যদি ওই শ্রীধর পাট্টা তোমাকে ফিরতে না দেয়?’

‘না দিলে ওকে চিবিয়ে গুঁড়ো করে ফেলব। তারপর তোমাদের কাছে ফিরে যাব।’

কথাটা বলার সময় জিশানের চোয়ালের রেখা যে শক্ত হল সেটা রঙ্গপ্রকাশের চোখ এড়াল না।

‘শানু কোথায়?’ জিশান ছেলেকে দেখতে চাইল।

মিনি ওর এমভিপি সেটটা নিয়ে গেল ছোট্ট ছেলেটার কাছে। বলল, ‘এই দ্যাখো, মেঝেতে খেলনা ছড়িয়ে কী কাণ্ড করছে!’

ছেলেকে দেখতে পেল জিশান। এই চার মাসে কত বড় হয়ে গেছে!

কয়েকটা ভাঙা গাড়ি আর রঙিন পুতুল চারপাশে ছড়িয়ে মেঝেতে বসে আছে।

এমভিপির পরদায় শানুর ফুটফুটে মুখ দেখা গেল। জিশান ওর এমভিপি সেটটা নিয়ে চলে এল রঙ্গপ্রকাশের পাশে। পরদার ছবিটা দেখিয়ে বলল, ‘আমার ছেলে, ডক্টর। ওর কাছে ফিরে যাওয়ার জন্যে আমাকে কিল গেমে জিততে হবে। ওর মায়ের কাছে ফেরার জন্যেও। ওরাই আমার সবচেয়ে জোরালো টান, সবচেয়ে বড় শক্তি—।’

পর্ণমালাও ঝুঁকে পড়ে শানুকে দেখছিলেন। ওঁদের সিমানও একদিন এইরকম ফুটফুটে ছিল।

জিশান সরে এল নিজের সোফার কাছে। বসে পড়ল। আরও কয়েক মিনিট মিনি আর শানুর সঙ্গে কথা বলে কাটাল। তারপর সেটটা অফ করে দিল।

রঙ্গপ্রকাশ আর পর্ণমালা দুজনেই তাকিয়ে ছিলেন জিশানের মুখের দিকে। সেখানে এক অদ্ভুত দ্যুতি ওঁরা দেখতে পাচ্ছিলেন : প্রিয়জনের ভালোবাসার দ্যুতি। সেই দ্যুতির সঙ্গে প্রাণশক্তির উজ্জ্বলতাও মিশে ছিল।

রঙ্গপ্রকাশ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আড়চোখে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন সেই দীর্ঘশ্বাসের কোমল শব্দ পর্ণমালা শুনতে পেয়েছেন।

জিশান বলল, ‘ডক্টর বিশ্বাস, আপনি আমার সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল তৈরি করছেন। নিশ্চয়ই শ্রীধর পাট্টার জন্যে। কিল গেমের জন্যে। যাই হোক, আপনার কাজ আপনি করবেন। আমারটা আমি। তবে একটা কথা আপনাকে বলি। কিল গেমের ফরম্যাট অনুযায়ী দু-তারিখে তিনজন মার্ডারার—লাইফার—আমাকে খুন করতে নামবে। আমি ওদের ফাঁকি দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচে থাকার চেষ্টা করব। যেটুকু জেনেছি তাতে এখানকার নিয়ম অনুযায়ী যাবজ্জীবনের সাজা পাওয়া আসামিকে সত্যি-সত্যি সারাটা জীবন জেলে কাটাতে হয়। তাই ওই তিনজনের সামনে কোনও নতুন ভবিষ্যৎ নেই। বর্তমানটাই ওদের ভবিষ্যৎ…’ একটু থামল জিশান। অপলক চোখে তাকাল রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাসের দিকে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর বলল, ‘কিন্তু আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ এক নয়, ডক্টর। আমি মিনি আর শানুর কাছে ফিরে যাব। ফিরে যাওয়ার এই টানটা আমার বর্তমান, আর ফিরে যাওয়াটা আমার ভবিষ্যৎ।

‘আপনার তৈরি করা সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইলে এই ফিলিংটা নিশ্চয়ই নেই। আপনি কাইন্ডলি এটা ইনক্লুড করে নেবেন। আমি চাই নিউ সিটির সবাই জানুক আমি একজন ডেসপারেট ফ্যামিলি ম্যান—।’

জিশানের ফরসা মুখে লালচে আভা দেখতে পাচ্ছিলেন রঙ্গপ্রকাশ।

জিশান ওঁর বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে, এত কথা বলছে—সেটা রঙ্গপ্রকাশের সাইকোলজিস্ট ব্যক্তিত্বের ভালো লাগছিল। কারণ, খুব দ্রুত প্রচুর তথ্য পাচ্ছিলেন। তিনি জিশানের প্রাোফাইল এ পর্যন্ত যা তৈরি করেছেন এখন পাওয়া তথ্যকণাসাগর তার সঙ্গে জুড়ে নিলে প্রাোফাইলটা অনেক গুণ সমৃদ্ধ হবে।

আর সরাসরি যেটা বুঝতে পারছিলেন, কিল গেমে জিশান সহজে হারবে না, সহজে মরবে না। ও সত্যিই একজন ডেসপারেট ফ্যামিলি ম্যান। ও হারার আগে মারবে, মরার আগেও মারবে। ফ্যামিলির জন্য টান ওর সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র।

কিন্তু যে-প্রশ্নটা রঙ্গপ্রকাশকে খোঁচাচ্ছিল সেই প্রশ্নটাই এবার করলেন, ‘আমি যে আপনার সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল তৈরি করছি সেটা আপনি জানলেন কেমন করে?’

‘সিমান।’ বলে হাসল জিশান। মাথা দোলাল কয়েকবার। তারপর : ‘সিমান আরও অনেক কিছু জানে। ও জানে যে, আপনার ইকনমিক ইনডেক্স ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে চলে গেছে। সেটা ইমপ্রুভ করার জন্যে আপনার হাতে সময় রয়েছে নব্বই দিনেরও কম…।’

রঙ্গপ্রকাশ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ভয় পাওয়া বিমূঢ় মুখে তাকিয়ে রইলেন জিশানের দিকে।

পর্ণমালা এক ঝটকায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়েছেন স্বামীর দিকে। এ কী কথা শুনছেন তিনি! ই. আই. নেমে গেছে!

রঙ্গপ্রকাশ কাঁপতে লাগলেন। বিস্ময় আর নপুংসক রাগ ওঁর ভেতরে উত্তাল ঢেউ তুলল।

সিমান এ-কথা জানল কেমন করে! যে-কথা রঙ্গপ্রকাশ ভীষণ যত্নে গোপন রাখতে চেয়েছেন সেটা এখন যেন হুড়মুড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সবার সামনে কফি টেবলের ওপরে।

পর্ণমালা যে এ-ঘটনায় বেশ ধাক্কা খেয়েছেন সেটা ওঁর বিহ্বল চোখ-মুখে স্পষ্ট ধরা পড়েছে।

রঙ্গপ্রকাশের মুখে যে-নীরব প্রশ্নটা ফুটে উঠেছিল সেটা জিশান পড়ে নিতে পেরেছিল। তাই ও আলতো গলায় থেমে-থেমে বলল, ‘সিমান…আপনার… আপনার ই-মেল অ্যাকাউন্ট…হ্যাক করেছে। হ্যাক করে সব জেনেছে। ই. আই. ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে নেমে যাওয়ার কথাও…।’

পর্ণমালা স্বামীর পাশে চলে এলেন। অসহায় মুখে ওঁর দিকে তাকিয়ে ওঁর জামা খামচে ধরলেন : ‘এসব…এসব সত্যি? আমাদের ইকনমিক ইনডেক্স ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে চলে গেছে! সিমান…সিমান তোমার মেল হ্যাক করেছে!’

রঙ্গপ্রকাশ মাথা ঝুঁকিয়ে বসলেন। সামান্য মাথা নাড়লেন ওপর-নীচে। ভাঙা গলায় বললেন, ‘সত্যি—সব সত্যি…।’

জিশান ভেঙে পড়া বাবা-মা-কে দেখছিল। ওর খুব খারাপ লাগছিল। নিউ সিটির ইকনমিক ইনডেক্সের ব্যাপারটা সিমানই ওকে বলেছে। জিশানের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল তক্ষুনি। মনে পড়ে গিয়েছিল বাবার কথা। যে-বাবা সবসময় মাথা তুলে বাঁচার কথা বলতেন।

ইকনমিক ইনডেক্স! মুখের ভেতরটা তেতো লাগল জিশানের। এই অমানবিক নিয়ম একমাত্র নিউ সিটিকেই মানায়।

এখন কী করবেন রঙ্গপ্রকাশ? কোথায় মুখ লুকোবেন? সিমান ওঁর মেল হ্যাক করে সবকিছু জেনেছে বলেই কি সুইসাইড করতে গিয়েছিল?

সম্পর্কের টানের অভাব বহুদিন ধরে টের পেয়েছে সিমান। আর একইসঙ্গে জানতে পেরেছে ই. আই.-এর নড়বড়ে অবস্থা। তাই হয়তো ও সুইসাইড করতে গিয়েছিল এবং জিশান দেবদূত হয়ে ওকে বাঁচিয়েছে। কিন্তু এখন কী হবে?

সিমানকে ফিরে পেয়ে রঙ্গপ্রকাশ আর পর্ণমালা প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। কিন্তু এখন যদি সিমান জানতে পারে যে, ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে নেমে যাওয়া এই ই. আই.-কে মেরামত করার কোনও ক্ষমতা ওঁদের নেই! তা হলে কী হবে? সিমান কি সেরে উঠে আরও উচ্ছৃংখল হয়ে উঠবে, নাকি আবার সুইসাইড করায় চেষ্টা করবে?

তখন?

রঙ্গপ্রকাশ পর্ণমালার দিকে তাকালেন। ভেতরে-ভেতরে ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। জিশানকে কি খুলে বলবেন নতুন সমস্যার কথা? যদি এক্ষুনি জিশানকে কিছু না জানান তা হলে পরে আর জানানোর সুযোগ পাওয়া যাবে না। জিশান হয়তো আর পাঁচ-দশ মিনিট কথা বলেই চলে যাবে। তারপর হয়তো ওর সঙ্গে আর কোনওদিনও দেখা হবে না।

রঙ্গপ্রকাশের বারবার মনে হচ্ছিল, জিশান এমনই একজন মানুষ যে সব পারে। সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে নিমেষে। ওর সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল থেকেও ওর ‘প্রবলেম সলভিং স্কিল’-এর ব্যাপারটা বোঝা যাচ্ছিল। তা হলে একবার বলেই দেখা যাক না!

রঙ্গপ্রকাশ স্ত্রীর দিকে ঝুঁকে এলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘আমাকে ক্ষমা কোরো, পর্ণ। আমি তোমাকে ই. আই.-এর ব্যাপারটা সাহস করে বলে উঠতে পারিনি। আমি পাগলের মতো একটা সলিউশান খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম—কিন্তু কোনও পথ পাইনি।’

প্রায় ফিসফিস করে পর্ণমালা বললেন, ‘আমরা…আমরা এখন কী করব? আমাদের তা হলে নিউ সিটি ছেড়ে চলে যেতে হবে?’

‘জানি না।’ মাথা নাড়লেন রঙ্গপ্রকাশ : ‘হাতে এখনও মাস তিনেক সময় আছে। কিন্তু তাতে কী লাভ! যখন সামনে কোনও ওয়ে আউট দেখতে পাচ্ছি না…।’

‘ওল্ড সিটিতে গিয়ে থাকতে হলে আমি…আমি সিম্পলি মরে যাব। আর…আর সিমানও কতটুকু বাঁচবে জানি না…।’ পর্ণমালার চোখে জল এসে গেল। হাত দিয়ে চোখ মুছলেন।

জিশান খুব অস্বস্তি পাচ্ছিল। বুঝতে পারছিল, একটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত আলোচনার আবহাওয়ায় ও ঢুকে পড়েছে।

রঙ্গপ্রকাশ জিশানের দিকে তাকালেন। একটু আগেই জিশান বলছিল, ও একজন ডেসপারেট ফ্যামিলি ম্যান। কিন্তু রঙ্গপ্রকাশের এখন মনে হল, জিশান একা নয়—তিনি নিজেও একজন ডেসপারেট ফ্যামিলি ম্যান।

রঙ্গপ্রকাশ দুবার ঢোঁক গিললেন। চোয়াল শক্ত করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তারপর জিশানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জিশান, আপনি আমার ছেলেকে আজ বাঁচিয়েছেন বটে কিন্তু আসলে পুরোপুরি বাঁচাতে পারলেন না। কারণ, আমরা তিনজনেই শেষ হয়ে গেছি। আমাদের হাতে আর মাত্র তিন মাস সময়—তারপরই আমরা শেষ।’

জিশান বলল, ‘জানি—ভালো করেই জানি। আমি একসময় এই নিউ সিটিতে ছিলাম। আমার যখন বারো বছর বয়েস তখন এই ই. আই.-এর প্রবলেমের জন্যে আমাকে আর আমার বাবাকে নিউ সিটি ছেড়ে চলে যেতে হয়। বাবার চোখের জলের কথা আমার এখনও মনে পড়ে। তখন আমার নাম ছিল নিশান। ওল্ড সিটিতে গিয়ে বাবা আমার নতুন নাম রাখেন জিশান। আমি সেই দিনটার কথা ভুলতে পারি না, ডক্টর। আমার বাবা বাকি জীবনটা কী কষ্ট পেয়েছিলেন তা আমি ভালো করে জানি।’

রঙ্গপ্রকাশ মুখ নামালেন। জিশানের ব্যথাটা অনুভব করতে চাইলেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল জিশান। তারপর আস্তে-আস্তে বলল, ‘ডক্টর, আপনার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কোড নম্বরটা আমাকে দিতে পারেন?’

‘কেন?’ চমকে উঠে মুখ তুললেন রঙ্গপ্রকাশ।

জিশান বলল, ‘দিন না—একটু দরকার আছে—।’

রঙ্গপ্রকাশ পর্ণমালার দিকে তাকালেন। দেখলেন, ওঁর মুখেও বিস্ময়।

জিশানের কথা আর ভঙ্গিতে এমন একটা কিছু ছিল যে, রঙ্গপ্রকাশ আর আপত্তি করতে পারলেন না।

কিছুক্ষণ ইতস্তত করে পকেট থেকে একটা ম্যাগনেটিক কার্ড বের করলেন। জিশানও ওর পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোনটা বের করে নিল।

রঙ্গপ্রকাশ ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না। অ্যাকাউন্ট কোড কেন চাইছে জিশান? ও কি রঙ্গপ্রকাশের ই. আই.-এর ব্যাপারটা হাতে-কলমে যাচাই করে নিতে চাইছে?

খানিকক্ষণ ইতস্তত করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের কোড নম্বরটা ধীরে-ধীরে বলতে শুরু করলেন। আর জিশানও টাচ স্ক্রিন কি-প্যাডে আঙুল ছুঁইয়ে সংখ্যাগুলো ওর ফোনে ইনপুট করতে লাগল।

নম্বর বলা শেষ হলে রঙ্গপ্রকাশ কার্ডটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘এই কোড নাম্বার দিয়ে আপনি কী করবেন?’

‘এই কোড নম্বর দিয়ে আমি সিমানকে বাঁচাব। এবার বোধহয় ওকে পুরোপুরি বাঁচাতে পারব।’

‘তার মানে?’ পর্ণমালা। ওঁর চোখের পাতা সামান্য কাঁপছে।

হাসল জিশান : ‘ম্যাডাম, এই নিউ সিটিতে এসে আমি বহু টাকার প্রাইজ জিতেছি। আমার এক বন্ধু মনোহর সিং-ও ওর প্রাইজ মানি আমার ছেলেকে গিফট করে গেছে। আমার এখন অনেক টাকা। এই টাকাটা আমি কাজে লাগাতে চাই…।’ কথা বলতে-বলতে স্যাটেলাইট ফোনের কি-প্যাডে আঙুল ছোঁয়াচ্ছিল জিশান। কয়েক সেকেন্ড পরে মুখ তুলে রঙ্গপ্রকাশের দিকে তাকাল, হাসল : ‘আপনার অ্যাকাউন্টে আমি আট লাখ টাকা ট্রান্সফার করলাম, ডক্টর…। আপনাদের জন্যে না—সিমানের জন্যে। আর একটা কথা…প্লিজ, আমাকে কোনও ধন্যবাদ জানাবেন না…।’

রঙ্গপ্রকাশ হঠাৎ কেঁদে ফেললেন। পর্ণমালা স্বামীর গায়ে হেলে পড়লেন, ওঁর বাহু আঁকড়ে ধরলেন।

পর্ণমালার চোখ বোজা। ঠোঁট কাঁপছে।

রঙ্গপ্রকাশ কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু ওঁর কথা জড়িয়ে গেল।

জিশান ঠোঁটে আঙুল তুলে ইশারায় ওঁকে চুপ করতে বলল। তারপর উঠে দাঁড়াল।

‘ডক্টর, কিল গেমে জিতে আমি যে-একশো কোটি টাকা পাব তা দিয়ে ওল্ড সিটির প্রচুর মানুষকে আমি নিউ সিটির সিটিজেন করে দিতে পারব। আমি ওদের এখানে নিয়ে আসতে চাই কেন জানেন?’ ঠোঁটের কোণে হাসল জিশান। বলল, ‘আপনাদের এখানে মনুষ্যত্বের বড় অভাব। ওরা এখানে এলে সেই অভাব অনেকটা ঘুচবে…।’

এক লহমা চুপ করে থেকে জিশান বলল, ‘যাই, দেরি হয়ে যাচ্ছে। আশা করি সেপ্টেম্বরের দু-তারিখের পর আমাদের আবার দেখা হবে।’

ওঁরা দুজনেই রুদ্ধ গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, দেখা হবে। তখন আমরা অনেক গল্প করব। উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট, জিশান—।’

স্যাটেলাইট ফোনটা পকেটে ঢোকাতে-ঢোকাতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল জিশান। খুব টায়ার্ড লাগছে। গালটাও সামান্য জ্বালা করছে। তবে মনটা ভালো লাগছিল।

জিশান ঘড়ি দেখল। না, আর দেরি করলে চলবে না। সুধাসুন্দরীর কাছে সময়ের মধ্যে ফিরতে হবে। কন্ট্রোলড ফ্রিডম।

বাইরে বেরিয়ে আসার সময় ও একটা হাই তুলল।

সুখারাম নস্কর মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল।

কী সাংঘাতিক নীল! দেখলে লোভ হয়। যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বলছে, ‘চলে আয়!’

আর সেই নীলের চাদরে গাঁথা রয়েছে একটা ঝলমলে সোনালি বল। জ্বলছে। তবে এখন বিকেল বলে তেজ কম।

এই দুটো জিনিসের দিকে তাকালেই সুখারামের স্বাধীন হতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে এই সেন্ট্রাল জেল থেকে পালাতে। আর তখনই ওর মন-কেমন-করা শুরু হয়।

সেন্ট্রাল জেলের প্রকাণ্ড মাঠে এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল কয়েদিরা। কেউ-কেউ বারবেল বা ডাম্বেল নিয়ে শরীরচর্চা করছে। কয়েকজন নিজেদের মধ্যে টিম তৈরি করে খেলাধুলো করছে। পাঁচটা ফুটবল মাঠের মধ্যে ছুটোছুটি করছে। তার পিছনে খেলোয়াড়রা। আবার কোথাও বা ক্রিকেট বল আর ব্যাট নিয়ে হইহই চলছে।

সব কয়েদির পরনে একইরকম পোশাক। ছাই রঙের টাইট স্লিভলেস ভেস্ট আর কালো রঙের টাইট প্যান্ট। প্রত্যেকের ভেস্টের ওপরে সামনে এবং পিছনে বারকোড প্রিন্ট করা। এই বারকোড লেজার স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করলেই সেই কয়েদির সমস্ত খুঁটিনাটি স্ক্যানারের ফাইবার অপটিক কেবল দিয়ে চলে যাবে কম্পিউটারের মেমোরিতে। এবং কম্পিউটারের মনিটরে ফুটে উঠবে।

শুধুমাত্র বিকেলের এই ড্রিলের সময় কয়েদিদের সেল থেকে বেরোতে দেওয়া হয়। চারটে থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত এই ‘স্বাধীনতা’-র সময়টাকে ওরা ঠাট্টা করে বলে ‘ফান আওয়ার’। এই সময়টা জেলের খোলা মাঠে ওরা খেলাধুলো কি গল্পগুজব করে নিজেদের খুশিমতো সময় কাটায়।

জেল বিল্ডিং-এর এক কোণে রয়েছে ‘ড্রিল কাউন্টার’। সেই কাউন্টার থেকে কয়েদিরা নিজেদের পছন্দমতো ‘ড্রিল আইটেম’ পেতে পারে। ‘আইটেম’ বলতে ফুটবল, ব্যায়ামের যন্ত্র, ক্রিকেট খেলার ব্যাট-বল—এইসব। তারপর সাড়ে পাঁচটা বাজলেই সমস্ত আইটেম কাউন্টারে আবার ফেরত দিয়ে জেল বিল্ডিং-এ ঢুকতে হয়। কেউ যদি কোনও আইটেম কাউন্টারে জমা না দিয়ে জেল বিল্ডিং-এ ঢোকে তা হলে স্পেশাল লেজার স্ক্যানার লাগানো দরজা দিয়ে পার হওয়ার সময় বিশেষ ধরনের বিপিং সাউন্ড শোনা যাবে। তখন শাস্তি হিসেবে সেই ‘অপরাধী’-কে একটানা তিনদিন স্রেফ জল খেয়ে কাটাতে হবে।

সুখারাম মাঠের একটা জায়গায় পা ছড়িয়ে চুপচাপ বসে ছিল। চারপাশের চেনা দৃশ্যটা একজন নিরপেক্ষ দর্শকের চোখে দেখছিল। আর মাঝে-মাঝে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল।

ড্রিলের এই সময়টা মাঠে বসে বা শুয়ে আকাশের দিকে তাকালেই ওর এই সেন্ট্রাল জেল থেকে পালাতে ইচ্ছে করে। যদিও ও জানে সেটা অসম্ভব।

হঠাৎই সুখারামের নজরে পড়ল, বেশ খানিকটা দূরে দুজন কয়েদির মধ্যে হাতাহাতি লেগেছে।

ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে সেন্ট্রাল জেলের লং ডিসট্যান্স লেজার স্ক্যানার কাজ শুরু করে দিল। বেশ কয়েকটা ওয়াচ টাওয়ার থেকে সিকিওরিটি গার্ডদের লেজার স্ক্যানিং গান পলকে অ্যাক্টিভ হয়ে উঠল। সেই লেজারের আলো গিয়ে পড়ল যুযুধান দুই কয়েদির ওপরে। ওদের বারকোড স্ক্যান হয়ে সমস্ত তথ্য ঢুকে পড়ল জেলের কম্পিউটারে।

এরপর কী হবে সুখারাম জানে।

ওই কয়েদি দুজনকে নিয়মমাফিক কম-বেশি শাস্তি পেতে হবে।

সত্যি, এই সেন্ট্রাল জেলের নজরদারির প্রযুক্তির তুলনা নেই!

সুখারাম নস্করের বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ও অলসভাবে চেয়ে রইল লড়াইখ্যাপা দুই কয়েদির দিকে।

কয়েদি দুজনের লড়াই একটু পরেই থেমে গেল।

এরকমটা প্রায়ই হয় : এই লড়াই, তো এই ভাব।

এই জেলে সুখারাম আছে তিন বছর, কিন্তু তিন বছরে মাত্র চারবার ওর সঙ্গে অন্য কয়েদির হাতাহাতি হয়েছে। আর প্রত্যেকবারই সুখারাম ঝগড়া মিটিয়ে নিয়েছে। তারপর হেসে হ্যান্ডশেক করেছে শত্রুর সঙ্গে।

কোনও-কোনও কয়েদি সুখারামকে দুর্বল ভাবলেও বেশিরভাগ কয়েদি তা ভাবেনি। বরং তাদের মনে হয়েছে, যে-ছেলেটা ছ’ফুট এক ইঞ্চি লম্বা, যার হাত আর পায়ের মাসল নমনীয় অথচ মজবুত, যে দৌড়ে হরিণকে হার মানাতে পারে, শূন্যে ছ’ফুট লাফাতে পারে, সে আর যা-ই হোক দুর্বল হতে পারে না।

সুখারাম নস্কর নিজেও সেটা জানে। তবে যেটা অনেকেই জানে না সেটা হল, ঝগড়া কিংবা মারপিট করতে ওর ভালো লাগে না। ওর ভালো লাগে খোলা আকাশের নীচে দৌড়তে। দৌড়, দৌড়, দৌড়।

ও স্বপ্ন দ্যাখে, ও দৌড়চ্ছে—না, দৌড়চ্ছে না, উড়ে যাচ্ছে বাতাসের বেগে, আর ওর মাথার ওপরে নীল আকাশ আর সোনালি সূর্য।

অথচ হাফ-ম্যারাথন রানার সুখরাম নস্কর এখন সেন্ট্রাল জেলের ট্রান্সপারেন্ট ফাইবারের পাঁচিলের ঘেরাটোপে বন্দি।

সুখারাম পুরোনো অভ্যেস ছাড়তে পারেনি। একজন লং ডিসট্যান্স রানারের প্র্যাকটিসের অভ্যেস। এই জেলে আসার আগে, যখন ও স্বাধীন ছিল, তখন ও সপ্তাহে গড়ে ছাপ্পান্ন কিলোমিটার করে দৌড়ত। প্রতিদিন প্র্যাকটিসের সময় ওর কোচ বরাট স্যার স্টপ ওয়াচ হাতে লক্ষ রাখতেন। বলতেন, ‘সুখা, অ্যাভারেজে তোর এক-একমাইল কভার করতে পঞ্চান্ন সেকেন্ড লেগে যাচ্ছে!’ মাথা নাড়তেন বরাট স্যার : ‘কমা, কমা। টাইম আরও কমা। অন্তত পঞ্চাশ সেকেন্ড কর…।’

বরাট স্যার কোচিং-এর জন্য সবার কাছ থেকে টাকা নিতেন—শুধু সুখারামের কাছ থেকে কিছু নিতেন না। কারণ, তিনি সুখারামের বাড়ির অবস্থা জানতেন। অসুস্থ বিধবা মা, আর স্কুলে পড়া একটা ছোট বোন। অভাব ছাড়া ওদের সম্বল বলতে আর কিছু ছিল না। তিনটে প্রাণীর দু-বেলার খোরাকি জোটাতে সুখারাম ওল্ড সিটিতে দিনে দশঘণ্টা করে সাইকেল ভ্যান টানত। বরাট স্যার ওকে উৎসাহ দিয়ে বলতেন, ‘বাচ্চা, চালিয়ে যা। জানিস, লোড করা সাইকেল ভ্যান টানলে পায়ের কাফ মাসল কত ডেভেলাপ করে, কত স্ট্রং হয়!’

পঁচিশ বছরের সুখারাম সব বুঝত। বরাট স্যারের কথাগুলো মিথ্যে ছিল না। কিন্তু তার মধ্যে একটা আক্ষেপ লুকিয়ে থাকত। নিজের সেরা ছাত্র সুখারামের জন্য তিনি একটা ভালো চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেননি।

সুখারামের তাতে দু:খ ছিল না। ও হাসিমুখে সাইকেল ভ্যান টানত। আর রোজ ভোরবেলা প্র্যাকটিসে আসত—একদিনও কামাই করত না। কারণ, দৌড়তে ওর দারুণ ভালো লাগত। ওর মনে হত, দৌড়টাই ওর জীবন।

সেইজন্যই সুখারাম ওর পুরোনো অভ্যেস ছাড়তে পারেনি। জেলের ভেতরে এই বিশাল খোলা মাঠে ও ড্রিলের সময়টায় দৌড় প্র্যাকটিস করে। রোজ গড়ে আট কিলোমিটার করে ওর দৌড়নো চাই-ই চাই। তা হলে সপ্তাহে ছাপ্পান্ন কিলোমিটারের কোটা পূরণ হয়। বরাট স্যার যা বলেছিলেন।

এই মাঠে যখন ও দৌড়য় তখন ওয়াচ টাওয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও একজন সান্ত্রীকে ও বরাট স্যার বলে কল্পনা করে নেয়।

বয়েস পঞ্চাশ-বাহান্ন। রোগা চেহারা। মাথায় অর্ধেকটা টাক। চোখে চশমা। গাল বসা। কপালে অনেক ভাঁজ। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ঢোলা ফুলপ্যান্ট। এবং সেই পাঞ্জাবি বা ফুলপ্যান্টের কোথাও না কোথাও অল্পবিস্তর ছেঁড়া থাকবেই। মানুষটা রেগে গিয়ে যখন চিৎকার করে ছাত্রদের গালিগালাজ করত তখন তার মুখ দিয়ে থুতু ছিটকে বেরোত।

বরাট স্যার বয়েসকালে লং ডিসট্যান্স রানার ছিলেন। তবে দৌড়ে খুব বেশি এগোতে পারেননি। এ-পাড়া সে-পাড়ায় দু-চারটে লোকাল কাপ জিতেছেন—ব্যস, এই পর্যন্তই।

অনেকে আড়ালে ওঁকে ব্যঙ্গ করে বলে, যারা অ্যাথলেটিক্সে আলটিমেটলি কিছু করতে পারে না, তারাই বয়েস হলে কোচ হয়ে ইয়াং অ্যাথলিটদের ওপরে মাতব্বরি করে আর পয়সা কামায়।

কথাটা কী করে যেন পাঁচকান হয়ে বরাট স্যারের কানে গিয়েছিল। পরদিন ভোরবেলা মাঠে এসে বরাট স্যার বলেছিলেন, ‘শোন, আমি তোদের আর প্র্যাকটিস করাব না।’

সুখারামরা মোট পাঁচজন ছিল সেদিন। ওরা প্রায় একসঙ্গে জিগ্যেস করেছিল, ‘কেন, স্যার? শেখাবেন না কেন?’

বরাট স্যার ওদের খুব কাছে এগিয়ে এসেছিলেন। ভাঙা গলায় জানতে চেয়েছিলেন, ‘আমি তোদের ওপরে মাতব্বরি করি? তোদের কাছ থেকে পয়সা কামাই?’

বরাট স্যারের সেই অপমান মাখা কণ্ঠস্বর সুখারামের আজও মনে আছে। প্রশ্ন দুটো করার সময় বরাট স্যার কেঁদে ফেলেছিলেন। এবং সেই কান্না মেশানো গলায় একই প্রশ্ন বারবার করতে-করতে ভাঙাচোরা মানুষটা পাশের একটা গাছের নীচে বসে পড়েছিলেন। আর সুখারামরা স্যারকে ঘিরে ধরে প্রাণপণে সান্ত্বনা দিয়েছিল, আর বারবার বুঝিয়েছিল যে, কথাগুলো সব মিথ্যে।

প্রায় আধঘণ্টা পর চশমার কাচ মুছে আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং কোচিং শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেদিন ততটা মন দিয়ে শেখাতে পারেননি।

স্যারের কথা ভাবতে-ভাবতে সুখারাম নস্কর জেলের মাঠে শুয়ে পড়েছিল। ওর চোখে জলও এসে গিয়েছিল। বরাট স্যার এখন কী করছেন কে জানে! তিনি যদি জানতেন, সুখারাম একজন সান্ত্রীকে বরাট স্যার ভেবে নিয়ে সেন্ট্রাল জেলের এই মাঠে রোজ বিকেলে দৌড় প্র্যাকটিস করে তা হলে কী খুশিই না হতেন!

চোখ বুজে স্যারের কথা ভাবছিল সুখারাম, আর মনে-মনে রেসিং ট্র্যাকে দৌড়চ্ছিল। ট্র্যাকের এক-একটা পাক শেষ করার সময় ট্র্যাকের ঠিক পাশে ও বরাট স্যারকে দেখতে পাচ্ছিল। স্টপ ওয়াচ দেখছেন আর উত্তেজিত হাতের ইশারা করে বলছেন, ‘চালিয়ে যা, সুখা! চালিয়ে যা!’

সুখারামকে স্যার খুব ভালোবাসতেন। সবসময় বলতেন, ‘তুই আমার সেরা ছাত্র। আমি শিয়োর—তুই একদিন কিছু না কিছু করে দেখাবি…।’

তো রিজিওন্যাল মিটে সুখারাম নস্কর পাঁচ কিলোমিটার রেসে ফার্স্ট হয়েছিল। কাপ, ক্যাশ প্রাইজ আর সার্টিফিকেট নিয়ে ডায়াস থেকে নামতেই বরাট স্যার ওকে জাপটে ধরেছিলেন। আবেগে মানুষটা কোনও কথা বলতে পারছিল না। বারবার শুধু বলছিল, ‘সুখা…সুখা…সুখা…।’

প্রাইজের টাকা দিয়ে বরাট স্যারকে একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি আর একটা সস্তার ফুলপ্যান্ট কিনে দিয়েছিল সুখারাম। ওঁর বস্তির দেড়খানা ঘরে গিয়ে যখন ও উপহারের প্যাকেটটা স্যারকে দেয় তখন হতবাক মানুষটা আবার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। তারপর আবেগে কেঁপে যাওয়া গলায় বিড়বিড় করে বলছিল, ‘এ তুই কী করলি! এ তুই কী করলি! তোর নিজেরই এত টানাটানি…।’

সুখারাম উত্তরে নীচু হয়ে স্যারের পা জড়িয়ে ধরেছিল। ভাঙা গলায় বলেছিল, ‘এ আমার গুরুদক্ষিণা, স্যার…গুরুদক্ষিণা…।’

বরাট স্যার ওকে একহাতে ধরে দাঁড় করিয়ে মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘তোকে প্রাণভরে আশীর্বাদ করি, সুখা। তুই আমার সেরা ছাত্র…।’

স্যারের পাঞ্জাবিতে মুখ গুঁজে সুখারাম বলেছিল, ‘আমি শুধু ছুটতে চাই, স্যার। সারাজীবন ছুটতে চাই…।’

ওর মাথায় হাত বোলাতে-বোলাতে স্যার বলেছিলেন, ‘শুধু ছুটবি না—আমি জানি তুই একদিন বড় কিছু একটা করে দেখাবি। অনেক বড় কিছু…।’

আজ হঠাৎ বরাট স্যারের কথাগুলো খুব বেশি করে মনে পড়ছে।

স্যার বলতেন, ‘শোন, পিচের রাস্তা কিংবা সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে কখনও দৌড়বি না। আর মাঠে যদি কোনও ঢাল টের পাস তো সেখানেও প্র্যাকটিস করবি না। সমান জায়গা চাই—সমান। আর শোন, ছোটার সময় পায়ের তলার মাটি স্প্রিং-এর কাজ করে। এই স্প্রিং অ্যাকশান সিমেন্টে কি অ্যাসফাল্টে পাবি না—।’

একদিন জুতোর ফিতে ঢিলে করে বাঁধা ছিল বলে ছুটতে-ছুটতে আচমকা ট্র্যাকে ছিটকে পড়েছিল সুখারাম। একইসঙ্গে সেই রেস থেকেও ছিটকে গিয়েছিল।

তাতে বরাট স্যার ব্যাপক রেগে গিয়েছিলেন। দু-চারটে অশ্লীল গালিগালাজও বয়স্ক লোকটার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। সুখারামকে সেদিন স্যার মুখে তুলোধোনা করেছিলেন। কথার সঙ্গে-সঙ্গে সেদিন স্যারের মুখ থেকে থুতু ছিটকে বেরোচ্ছিল।

‘আরে ছাগল, প্রিপ্যারেশানে ধেয়ান দে! তুই যখন ট্র্যাকে দৌড়স তখন কি আসলে তুই দৌড়স নাকি?’

সুখারাম প্রশ্নটার মানে বুঝতে না পেরে হাঁ করে স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল।

রাগে অগ্নিশর্মা মানুষটা তখন বলেছিল, ‘শোন পাঁঠা, ট্র্যাকে যখন তুই দৌড়স তখন তুই না—আসলে তোর ভেতরে আমি দৌড়ই! আমি! আমি!’

এ-কথা বলতে-বলতে পাগলের মতো নিজের বুকে আঙুল ঠুকেছিল লোকটা।

‘সুখা, তোকে নিয়ে আমার কত আশা! আর তোর এই ভুল! ছি:!’ আপশোশে এপাশ-ওপাশ মাথা নেড়েছিলেন বরাট স্যর : ‘মন দিয়ে প্র্যাকটিস কর—মন দিয়ে। আমি শিয়োর, তুই একদিন বড় কিছু একটা করে দেখাবি… বড় কিছু…।’

হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত ‘বড় কিছু একটা’ করে দেখিয়েছে সুখারাম। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একা পাঁচ-পাঁচটা ক্রিমিনালকে খতম করে দিয়েছে। আর সেই ‘বড়’ কাজটা করার সময় ওকে দৌড়তে হয়েছিল। এমন দৌড় ও লাইফে কখনও দৌড়য়নি।

এই সাংঘাতিক ঘটনাটার খবর পেয়ে বরাট স্যার থানায় ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। এসে প্রিয় ছাত্রকে আশীর্বাদ করেছিলেন, বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন।

সেদিন স্যারের বুকে মুখ রেখে সুখারাম নস্কর হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। আর একইসঙ্গে ও স্যারের খদ্দরের পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ পেয়েছিল।

সেই গন্ধে এত আদর আর আন্তরিকতা মাখানো ছিল যে, সুখারামের মনে হয়েছিল এই গন্ধটা স্বর্গ থেকে ভেসে আসছে।

রবিবারের সেই মেঘলা বিকেলটা সুখারামের স্পষ্ট মনে আছে। যে-বিকেল থেকে ওর জীবনটা বাঁক নেওয়া শুরু করেছিল।

কাঠ-মিলের মাঠে ফুটবল ম্যাচ ছিল। সুখারামদের বস্তির সঙ্গে পোড়া বস্তির ছেলেদের।

কাঠ-মিলের মাঠটা মাপে বিশাল বড়। তার তিন দিক ঘিরে রয়েছে বড়-বড় স’মিল। তার মধ্যে গোটা ছয়েক চালু রয়েছে, আর বাকিগুলো গা-ছমছমে ভাঙাচোরা পোড়োবাড়ি। কাঠ-মিলগুলোর সামনে ছোট-বড় কাঠের গুঁড়ির স্তূপ। লম্বা করে শোয়ানো। একটার ওপরে একটা চাপিয়ে সার দিয়ে ছোট-ছোট পিরামিডের মতো সাজানো। ক’দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে বলে গুঁড়িগুলো ভেজা, বাতাসে ভেজা কাঠের ভুসির গন্ধ। ছোটবেলায় সুখারাম যখন বন্ধুদের সঙ্গে মিলে ঝুলন সাজাত তখন এইসব মিল থেকে বিনাপয়সায় কাঠের ভুসি নিয়ে যেত।

কাঠ-মিলের মাঠের একদিকে ছাল-ওঠা এবড়োখেবড়ো পিচের রাস্তা। আর তারপরই নোংরা জলের সরু খাল।

খালের জল কালো, তেলচিটে—অনেকটাই কচুরিপানায় ঢাকা। খালের দু-পাড় থেকে কালো মাটি আর পাঁক ঢাল বেয়ে প্রায় মাঝখান পর্যন্ত চলে এসেছে। খালের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে প্রবল দুর্গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারে। তার একটা বড় কারণ, কুকুর-বেড়াল গোরু-ছাগল মারা গেলে তাদের ডেডবডি ফেলার জায়গাও এই খাল।

খালপাড় ধরে একটানা ঝুপড়ি। বর্ষার আক্রমণ ঠেকাতে নীল, সবুজ, কালো কিংবা লালরঙের পলিথিনের টুকরোয় ঢাকা।

মাঠের কাছ থেকে প্রায় কিলোমিটারখানেক দূরে পোড়া বস্তি। সুখারামের খুব ছোটবেলায় খালধারের ওই বস্তিটায় আগুন লেগে গিয়েছিল। তার পর থেকেই ওটার নাম হয়ে গেছে পোড়া বস্তি।

পোড়া বস্তির বেশিরভাগ ছেলেই চুরি, ডাকাতি আর ছিনতাইয়ের কাজে জড়িয়ে থাকে। তার সঙ্গে খুন-জখমের খেলাও আছে। ওদের মধ্যে ফেরোশাস যে দু-চারজন, তারা ধীরে-ধীরে ‘ভাইয়া’ বনে গেছে। ফলে তারা পয়সা করেছে। বস্তিতে থেকেও ঠাটবাট বজায় রাখতে পারে। মোটরবাইকে চেপে ঘুরে বেড়ায়।

সুখারামের সঙ্গে পোড়া বস্তির কারও কোনওরকম দোস্তি ছিল না। তবে সুখারামদের বস্তির কয়েকজন ছেলের সঙ্গে ওদের যোগাযোগ ছিল। আর সেই যোগাযোগ থেকেই কীভাবে যেন ফুটবল ম্যাচটার ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছিল।

সকাল থেকেই মেঘলা, আর আকাশ থেকে একঘেয়েভাবে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল।

বিকেল চারটের সময় দুটো দল দুটো ফুটবল নিয়ে কাঠ-মিলের মাঠে হাজির হয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া মাঠে ছিল জনা তিরিশ কি চল্লিশজন দর্শক। কারও মাথায় ছাতা, কারও বা পলিথিন, আবার কারও মাথায় শুধুই ভেজা আকাশ। মাঠের পাশে রাখা ভেজা কাঠের গুঁড়ির গ্যালারিতে দর্শকরা যে-যার মতো বসে পড়েছিল। এ ছাড়া মাঠে» গোলপোস্টের পিছনে দাঁড় করানো ছিল বেশ কয়েকটা সাইকেল, মোটরবাইক, আর সাইকেল ভ্যান। তার মধ্যে সুখারামের সাইকেল ভ্যানটাও ছিল।

খেলা শুরু হওয়ার দু-পাঁচ মিনিট পরেই বৃষ্টি থেমে গেল। ফলে দর্শকের ভিড়টা আরও একটু বেড়ে গেল। হইচই চিৎকারের মধ্যে খেলা চলতে লাগল। মাঠ ভরতি জল-কাদায় বাইশজন প্লেয়ার আর একজন রেফারি বেদম ছুটোছুটি করতে লাগল।

প্লেয়ারদের কারও পায়ে কেডস, কারও পায়ে সস্তার স্নিকার, আর বেশিরভাগেরই খালি পা।

সুখারামের দু-জোড়া রানিং শু। একজোড়া নতুন, একজোড়া পুরোনো। ও পুরোনো জুতোটা পরেই মাঠে নেমেছিল। এ ছাড়া পোশাক বলতে হাফপ্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি।

সুখারাম ফুটবল প্লেয়ার হিসেবে বিরাট কিছু নয়, তবে লং ডিসট্যান্স রানার হওয়ার সুবাদে ও অনায়াসে বলের পিছনে ছুটোছুটি করতে পারছিল। অন্যদের মতো সহজে হাঁপিয়ে পড়ছিল না।

খেলা যখন প্রায় শেষের দিকে তখনই গোলমালটা বাধল।

ম্যাচের রেজাল্ট তখন ফোর টু থ্রি। সুখারামদের টিম এক গোলে হারছিল।

সেই অবস্থায় হঠাৎই মিডফিল্ড থেকে সুখারাম পায়ে বল পেয়ে গেল এবং হরিণের মতো ছুটতে শুরু করল।

ছুটতে-ছুটতে ও ঢুকে গেল বিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে। কিন্তু গোলে শট নেওয়ার মতো পজিশন তৈরি করার আগেই বিপক্ষের একজন ডিফেন্ডার পাশ থেকে ছুটে-এসে ওকে হাঁটুর নীচে লাথি মারল।

সুখারাম উলটে পড়ল এবং রেফারি বাঁশি বাজাল। পেনাল্টি।

ম্যাচ ড্র করতে পারার সুযোগ সামনে পেয়ে ওদের দলের সবাই ‘পেনাল্টি! পেনাল্টি!’ বলে চেঁচাতে লাগল। আর ওদের সাপোর্টাররা তার দশগুণ চিৎকারে মেঘলা আকাশ ফাটাতে লাগল।

সুখারাম সেরকম কোনও চোট পায়নি। পড়ে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও উঠে দাঁড়িয়েছিল। মাথাটা পলকের জন্য গরম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেফারি পেনাল্টির বাঁশি বাজানোয় ও রাগটাকে সামলে নিয়েছিল। শুধু বেঁটে মোটা ডিফেন্ডারটার দিকে কটমট করে কয়েকবার তাকিয়েছিল।

রেফারির দেখিয়ে দেওয়া জায়গায় বল বসিয়ে সুখারাম যখন পেনাল্টি শট নেওয়ার জন্য কয়েক পা পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে, ঠিক তখনই সেই ডিফেন্ডার ছেলেটা ছুটে এসে এক লাথিতে বলটাকে উড়িয়ে দিল। তারপর সুখারামকে লক্ষ করে খিস্তির বন্যা ছুটিয়ে তেড়ে গেল ওর দিকে। জোড়া হাতের জোরালো ধাক্কায় ওকে ছিটকে ফেলে দিল।

ব্যস, শুরু হয়ে গেল প্রবল হট্টগোল আর হাতাহাতি। রেফারি গণ্ডগোল থামানোর চেষ্টায় ঘন-ঘন বাঁশি বাজাতে লাগল, কিন্তু কেউ তাতে কান দিচ্ছিল না।

একটু পরেই হাতাহাতিটা মারপিটে পৌঁছে গেল। তার সঙ্গে পরস্পরের দিকে আঙুল উঁচিয়ে চোখ রাঙিয়ে গলাবাজি করে তর্কাতর্কি।

মাঠের ধার থেকে, কাঠের গুঁড়ির ‘গ্যালারি’ থেকে, দর্শকরা নেমে এল মাঠের মধ্যে। তারপর ব্যাপারটা ‘দুই বস্তির মধ্যে সংঘর্ষ’ গোছের চেহারা নিল।

সংঘর্ষের নিউক্লিয়াসটা মাঠের মধ্যে এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়াতে-বেড়াতে কী করে যেন মাঠের কিনারায় চলে এল।

বেঁটে ডিফেন্ডারটা বারবারই সুখারামের দিকে তেড়ে যেতে চাইছিল, কিন্তু কয়েকজন ওর হাত-কোমর ইত্যাদি আঁকড়ে ধরে ওকে বশে রাখছিল। যেটা বশে রাখা যাচ্ছিল না, সেটা হল ওর মুখ থেকে ফোয়ারার তোড়ে বেরিয়ে আসা অশ্রাব্য খিস্তি।

সুখারাম হাত-পা নেড়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল, তবে বড় কোনও গোলমালে জড়াতে চাইছিল না।

হঠাৎই বেঁটে ডিফেন্ডারটা বুনো মোষের শক্তি দিয়ে এক ঝটকায় সঙ্গীদের হাতের বাধন ছাড়িয়ে নিল। তারপর সুখারামের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর মুখে একটার পর একটা ঘুসি বসাতে লাগল।

সুখারাম যতটা পারল সেগুলো এড়িয়ে গেল কিংবা মুখের সামনে হাতের ঢাল তৈরি করে আটকাল। তারপর অ্যাথলিটের ক্ষিপ্রতায় পাশে সরে গেল।

ঘুসিগুলো জুতসইভাবে প্রতিপক্ষের মুখে না লাগায় ডিফেন্ডার ছেলেটা খেপে গেল। ও ষাঁড়ের মতো একরোখাভাবে ছুটে গেল সুখারামের দিকে। ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ছেলেটার মাথায় বোধহয় একজোড়া শিং রয়েছে। সেটা দিয়ে ও সুখারামকে গুঁতিয়ে খতম করতে চাইছে।

একেবারে শেষ মুহূর্তে সুখারাম ছেলেটার আক্রমণ-রেখা থেকে ছিটকে সরে গেল।

তিরবেগে ছুটে যাওয়া ছেলেটার মাথা কাঠের গুঁড়িতে গিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল। সংঘর্ষের শব্দটা এমন জোরালো শোনাল যে, সবাই চমকে উঠল।

ডিফেন্ডার ছেলেটা ক্যারমের ঘুঁটির মতো কাঠের গুঁড়িতে রিবাউন্ড করে মাঠে ছিটকে পড়ে গেল। তারপর আর একটুও নড়ল না।

এতক্ষণ ধরে যে-শোরগোলটা চলছিল সেটা হঠাৎই থেমে গেল।

দু-চারজন ছেলেটার ওপর ঝুঁকে পড়ে ওকে ডাকতে লাগল : ‘মদনোয়া! এ মদনোয়া! উঠ, সালে! উঠ জলদি…!’

কিন্তু মদন, অথবা মদনোয়া, সে-ডাকে সাড়া দিল না।

তখন দুজন ওর মাথার কাছে উবু হয়ে বসে পড়ল। ওর কাঁধ আর বুকে হাত রেখে ওকে ঠেলতে লাগল আর নাম ধরে ডাকতে লাগল।

কিন্তু মদনোয়া নড়ল না।

দর্শকদের মধ্যে থেকে একজন বয়স্ক লোক সামনে এগিয়ে এল। মিশকালো রং, গায়ে ময়লা প্যান্ট-শার্ট। গালে দু-চারদিনের না-কামানো সাদা খোঁচা-খোঁচা দাড়ি।

মদনোয়াকে ঘিরে থাকা ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়ল লোকটা। মদনোয়ার মাথার কাছে বসে ওর কানের তিন আঙুল নীচে হাত রেখে কী যেন অনুভব করতে চাইল।

তারপর ওর নাকের খুব কাছে হাতের পিঠ রেখে বুঝতে চাইল নিশ্বাস পড়ছে কি না।

ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ল লোকটা। তারপর শেষতম পরীক্ষার জন্য উপুড় হয়ে মাথা পেতে দিল মদনোয়ার বুকে।

না:, হৃৎপিণ্ডের কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সব চুপচাপ।

বৃদ্ধ লোকটা মাথা তুলে চোখ বড়-বড় করে তাকাল চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দিকে। ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল, ‘আরে, ইয়ে সালা তো মর গয়া!’

কথাটা শোনামাত্রই কোন এক আশ্চর্য ম্যাজিকে জমে থাকা ভিড়টা পাতলা হতে শুরু করল। তিন-চারটে ছেলে মদনোয়ার ওপরে ঝুঁকে পড়ে ওর শরীরটাকে পাগলের মতো ঝাঁকাতে শুরু করল, আর গলা ফাটিয়ে ওর নাম ধরে ডাকতে লাগল।

সুখারাম একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল। ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না এখন কী করবে। তাই এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল।

ওর বস্তির দু-চারজন ছেলে ওর কাছে এসে দাঁড়াল। একজন বলল, ‘সালা কেলো হয়ে গেল। মদনোয়ার দাদা বদনোয়া পোড়া বস্তির ভাইয়া। ও সালা বহুত খতরনাক তোলাছপ্পন মাল। এ কেস তো সহজে সালটাবে না…।’

আর-একজন বলল, ‘সুখা, তুই হাপিস হয়ে যা। নইলে বদনোয়া তোকে পালিশ দিয়ে গিলে করে দেবে।’

সুখারাম অবাক হয়ে বলল, ‘কেন, আমি কী করেছি? কেসটা তো পাতি অ্যাক্সিডেন্ট! মদনোয়ার বুকে সালা খিঁচ ছিল—তাই টপকে গেছে…।’

‘সে তো অ্যাক্সিডেন্ট আমরা সবাই জানি। কিন্তু বদনোয়ার গ্যাং সেটা মানবে না। সালারা বদলা নিতে আসবে—।’

কয়েকটা মোটরবাইক স্টার্ট নেওয়ার শব্দ শোনা গেল। সুখারাম শব্দের উৎসের দিকে চোখ ফেরাল। গোল পোস্টের পিছনে দাঁড় করিয়ে রাখা তিনটে মোটরবাইক ততক্ষণে স্টার্ট নিয়ে খালপাড়ের রাস্তায় পৌঁছে গেছে। ফটফট আওয়াজ তুলে বাইকগুলো পোড়া বস্তির দিকে ছুটে গেল। বোধহয় বদনোয়াকে খবর দিতে।

সুখারামকে ওর সঙ্গীরা নানান পরামর্শ দিতে লাগল। তার মধ্যে সংখ্যার হিসেবে সবচেয়ে বেশি যে-পরামর্শটা পাওয়া গেল সেটা হল, কোথাও পালিয়ে গিয়ে কয়েকদিন লুকিয়ে থাকা।

বিধবা মা আর বোনের কথা মনে পড়ল সুখারামের। ওদের ছেড়ে ও কোথায় যাবে? ওর তো যাওয়ার আর কোনও জায়গা নেই! এমন কোনও আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধব নেই যাদের কাছে গিয়ে এক-দু-সপ্তাহ গা-ঢাকা দিয়ে থাকা যায়।

তা হলে কোথায় পালাবে সুখারাম?

গিন্টি নামে একজন বন্ধুর কাছে মোবাইল ফোনটা জমা রেখে ও ম্যাচ খেলতে নেমেছিল। গিন্টি বস্তিতে ওর পাশেই থাকে। ও গিন্টিকে ডেকে ফোনটা চেয়ে নিল। তারপর বাড়িতে একটা ফোন করল।

মা ফোন ধরল।

‘মা, সুখা, বলছি।’

‘বল—।’

‘ফুটবল ম্যাচে একটা কেস হয়ে গেছে—।’

‘কী হয়েছে?’ মায়ের গলায় উদ্বেগ।

সুখারাম সব বলল।

বদনোয়া আর তার গ্যাঙের কথা শুনে মা একটু ভয় পেয়ে গেল।

‘এখন কী করবি?’

‘ক’টা দিন একটু গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। গিন্টিরা সব তাই বলছে…।’

‘সে কী রে!’ মায়ের গলায় কান্না এসে গেল।

‘হ্যাঁ। আমি এক্ষুনি বাড়ি যাচ্ছি। টুকটাক ক’টা জিনিস গুছিয়ে নিয়ে কেটে পড়ব। তুই একদম চিন্তা করিস না, মা। সব সালটে যাবে—।’

ফোন কেটে দিয়ে সাইকেল ভ্যানের দিকে ছুটল সুখারাম। তারপর মজবুত পায়ে প্যাডেল করে সোজা বাড়ির দিকে।

মাঠে তখনও বেশ কিছু লোকের ভিড় ছিল। সুখারাম জানে, ভাইয়ের অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে একটু পরেই বদনোয়া আসবে, তারপর হয়তো পুলিশ। কিন্তু ওল্ড সিটিতে পুলিশের যা অবস্থা তাতে ওদের শুধু গায়ের পোশাক আর তকমাটুকুই আছে—বাকি সব গেছে।

বদনোয়াকে ওর বস্তির ছেলেরা নানারকম রং চড়ানো গল্প শোনাবে, ওকে ওসকাবে। তারপর ক্ষিপ্ত বদনোয়া সুখারামের পিছনে ছুটবে। তখন ওকে তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হবে। যেমন করে হোক প্রাণে বাঁচতে হবে। কারণ, সুখারাম প্রাণে না বাঁচলে ওর মা আর বোন বাঁচবে কেমন করে! সুখা বিনা ওরা ভুখা মরে যাবে।

গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্যাডেল করছিল সুখারাম। ওর মনে হচ্ছিল যেন ও কোনও রেসিং ট্র্যাকে ছুটছে। তখনই ওর বরাট স্যারের কথা মনে পড়ল। কাল ভোরবেলা ও প্র্যাকটিসে যেতে পারবে না ভেবে খারাপ লাগল। ক’টা ভোরবেলা এখন নষ্ট হবে কে জানে!

সন্ধের অন্ধকার নেমে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। সাইকেল ভ্যান নিয়ে সুখা ওর বস্তিতে ঢুকে পড়ল।

নোংরা কাদা প্যাচপেচে রাস্তা, টিমটিমে আলো, দুপাশে আবর্জনার স্তূপ। দম আটকানো বাতাসে উৎকট দুর্গন্ধ। কিন্তু এসবই সুখারামের গা সওয়া। ওকে মোটেই নাক টিপে ধরতে হয় না। বরং এই দুর্গন্ধটা ওর অস্তিত্বের এক ধরনের পরিচয়পত্র। এই বিশেষ গন্ধটা নাকে এলেই ওর মনে হয় ও বাড়ি ফিরেছে। মা আর বোনের কাছে ফিরেছে।

সাইকেল ভ্যানটা ওদের ঝুপড়ির সামনে দাঁড় করাল। মশার ঝাঁক ওকে ঘিরে ধরে পিনপিন শব্দে উড়তে লাগল।

দরজায় ধাক্কা দিতেই সুখারামের বোন চোলি দরজা খুলল। ওর পিছনে হ্যারিকেনের আলো থাকায় ওর মুখটা অন্ধকার দেখাচ্ছিল। কিন্তু সুখারাম জানে চোলিকে সুন্দর দেখতে, আর সেজন্য ওদের অনেক বাজে উৎপাত সহ্য করতে হয়।

সুখারাম ঘরে ঢুকতেই চোলি দরজাটা চটপট আবার বন্ধ করে দিল। তারপর চাপা গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে, দাদাভাই?’

মা ঝুপড়ি-ঘরের এক কোণে বসে ছিল। ঘরের মেঝেতে পলিথিনের চাদর পাতা, তার ওপরে চাটাই আর পুরোনো পিচবোর্ড। এক পাশে তেলচিটে বিছানা। মা আর চোলি ওই বিছানায় শোয়।

বিছানাটার পাশেই দরমার ‘পাঁচিল’। সেই পাঁচিলের ওপারে সুখারামের বিছানা পাতা।

সুখারাম মায়ের পাশে গিয়ে পলিথিনের ওপরে বসে পড়ল। চোলিও ওর কাছ ঘেঁষে উবু হয়ে বসল।

সুখারাম মাঠের কাহিনি সংক্ষেপে আবার বলল।

বদনোয়ার নাম শুনে মা ডুকরে উঠল। চোলি কাঁদতে শুরু করল।

চোলির দিকে তাকিয়ে সুখারামের বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল।

হলদে রঙের একটা সালোয়ার কামিজ পরে আছে। সেটা ময়লা হলেও ওকে বেশ মানিয়েছে। পোশাকটায় কোথাও না কোথাও ছেঁড়া-ফাটা নিশ্চয়ই আছে, তবে সেটা দেখা যাচ্ছে না।

চোলির বয়েস উনিশ-কুড়ি। মাজা রং। ওকে দেখে মোটেই ঝুপড়িবাসী বলে মনে হয় না। বরং ঠিকঠাক পোশাক পরলে ওর সঙ্গে সুখারামদের দূরত্বটা অনেক বেড়ে যাবে।

চোলির জন্য মাঝে-মাঝে দু:খ হয় ওর। কেন যে এই সুন্দরী মেয়েটা এই বস্তিতে জন্মাতে গেল! ওর একটা বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে নিশ্চিন্ত হওয়া যেত। মা আর সুখারাম ওর বিয়ের জন্য চেষ্টা করছে, খোঁজখবর করছে—কিন্তু এখনও যোগাযোগ করে উঠতে পারেনি।

সুখারাম ঠিক করেছে, ঝুপড়ির কোনও ছেলের সঙ্গে বোনের বিয়ে দেবে না। তার জন্য যত কষ্ট করতে হয় হোক।

এখনও পর্যন্ত যে চোলির কোনও সম্বন্ধ ঠিক করা যায়নি তার একটা তুচ্ছ কারণ আছে : চোলির বাঁ-পাটা লম্বায় সামান্য খাটো—তাই ও একটু খুঁড়িয়ে চলে।

কিন্তু ওকে যে এত সুন্দর দেখতে, সেটা কিছু নয়!

চোলি আর মা-কে ক’দিন ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে সুখারামের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল।

ও বোনের চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘মোবাইল ফোনটা ঠিকমতো চার্জ দিয়ে রাখিস, মা। আমি খুব ভোরবেলা আর রাত বারোটার পর ফোন করব…।’

বস্তির ঘরে-ঘরে বিদ্যুৎ না পৌঁছোলেও বস্তির ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় মোবাইল ফোন চার্জ করার সকেট লাগানো আছে।

চোলি আর মা-ও এবার উঠে পড়ল। সুখারামের দরকারি জিনিসগুলো ভরে দিল একটা নাইলনের থলেতে। বিছানার নীচ থেকে কিছু টাকা বের করে মা ছেলের হাতে দিল। তারপর কাঁদো-কাঁদো গলায় বলল, ‘ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করিস, সুখা…।’

‘তুই কোনও চিন্তা করিস না। ক’টা দিনের তো ব্যাপার। সব্বাই দেখেছে ওটা অ্যাক্সিডেন্ট—আমি কিচ্ছু করিনি…।’

হঠাৎ করে সুখারামের কী মনে হল, ও ঝুঁকে পড়ে চট করে মা-কে প্রণাম করল। তারপর চোলির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, ‘বরাট স্যারকে আমি ফোন করে দেব যে, ক’দিন প্র্যাকটিসে যাব না। নইলে স্যার চিন্তা করবে…বাড়িতে খোঁজ নিতে চলে আসবে।’ থলেটা হাতে তুলে নিল : ‘তোরা সাবধানে থাকিস। কোনও প্রবলেম হলে আমাকে ফোন করবি। আমি গাড়িটা নিয়ে যাচ্ছি…।’

চোলি কাঁদছিল। কাঁদতে-কাঁদতেই জড়ানো গলায় জিগ্যেস করল, ‘তুই কোথায় যাচ্ছিস?’

‘জানি না। জানলেও বলতাম না। বদনোয়ার গ্যাং বাড়িতে এসে হামলা করতে পারে। তখন আমার ঠেক জানার জন্যে তোদের জ্বালিয়ে খাবে—টরচার করবে।’

না, মা আর বোনকে সুখরাম ওর ভাবী আস্তানার কথা জানায়নি। যদিও ও মনে-মনে ওর লুকোনোর জায়গাটা ঠিক করে ফেলেছিল।

চোখে জল নিয়ে চোলি আর মা দরজার কাছে এল। অন্ধকারের মধ্যে সুখারামের ছায়া সাইকেল ভ্যানে উঠল। তারপর গাড়িটা চলতে শুরু করল।

এবড়োখেবড়ো পথে নেমে এসে সুখারাম ভাবল, এখন ওর আর মায়ের দুটো মোবাইল ফোনই সমস্ত ভরসা। সস্তায় কেনা এই সেকেন্ড হ্যান্ড কি থার্ড হ্যান্ড মোবাইল সেটগুলো ঠিকঠাক কাজ করলে হয়!

ঘোরালো নির্জন পথ ধরে সাইকেল ভ্যানটা ছুটে যাচ্ছিল। এই রাস্তাগুলো দিনের বেলাতেও কেউ ব্যবহার করে না। নেহাত রাস্তাগুলোর পালানোর উপায় নেই তাই ওরা চুপচাপ এখানে পড়ে আছে। নইলে ওরাও এই নির্জনতা ছেড়ে পালাত।

রাস্তার পাশে কখনও-সখনও ল্যাম্পপোস্ট চোখে পড়ছে এবং তার দু-একটায় মলিন বালব জ্বলছে। ভাঙাচোরা রাস্তার এখানে-সেখানে বৃষ্টির জল জমে আছে।

সুখারাম জোরে-জোরে প্যাডেল ঘোরাচ্ছিল আর ভাবছিল বরাট স্যারের কথা। ওর কাফ মাসল এখন প্রতি মুহূর্তেই শক্তিশালী হচ্ছে। ক’দিন প্র্যাকটিসে না যেতে পারার খামতিটা ওকে মাঝরাত্তিরে ভ্যান চালিয়েই পুষিয়ে নিতে হবে।

সুখরাম লুকিয়ে থাকার যে-জায়গাটা পছন্দ করেছে সেটা কাঠ-মিলের মাঠের পাশেই। যে-মিলগুলো বহু বছর ধরে অকেজো হয়ে পড়ে আছে তারই একটা ভাঙাচোরা গা-ছমছমে মডেল বেছে নিয়ে সুখারাম তার অন্দরমহলে আস্তানা গাড়বে। বদনোয়া বা ওর গ্যাং ভাবতেই পারবে না সুখারাম নস্কর অকুস্থলের এত কাছাকাছি গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে।

না, এখন সুখারাম ওখানে যাচ্ছে না। কারণ, এখনও হয়তো মাঠে মদনোয়ার ডেডবডি পড়ে রয়েছে। এখনও হয়তো মাঠে গজল্লা চলছে।

তাই এখন ও সাইকেল ভ্যান নিয়ে খানাখন্দে ভরা অন্ধকার নির্জন রাস্তাগুলোয় ঘুরে বেড়াবে। কিংবা কোথাও গাড়ি লাগিয়ে বিশ্রাম নেবে। তারপর রাত অনেক গাঢ় হলে কোনও সস্তার হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে ওর নতুন আস্তানায় গিয়ে ঢুকবে।

অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চালানোর পর একটা লোহালক্কড়ের স্তূপ দেখতে পেল সুখারাম। তার পাশে একটুকরো ফাঁকা জায়গা। কী ভেবে সেখানে একটু আড়াল করে গাড়িটা লাগাল। তারপর গাড়িতেই চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ল, থলেটা মাথার নীচে দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে রইল।

মেঘ সরে গিয়ে তারা ফুটেছে। কালো আকাশে সোনার কুচি জ্বলছে। ওদের দিকে তাকিয়ে মনে যে-আনন্দ পাওয়া যায় সেটা সবার জন্য—সেখানে গরিব-বড়লোক কোনও ভাগাভাগি নেই। কিন্তু মাঝে-মাঝে ওর মনে হয়, ইস, ওরা যদি অল্প-অল্প বড়লোক হত তা হলে খুব ভালো হত। বেশ কিছুটা বরপণ দিয়ে চোলিটার বিয়ে দেওয়া যেত। তখন মায়ের দুশ্চিন্তা কমে যেত। সুখারামেরও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *