১০. কন্ট্রোল রুম-এর এসি

১০.

কন্ট্রোল রুম-এর এসি এতটাই জোরালো যে, জিশানের শীত করতে লাগল।

ঘরে পাঁচজন সিকিওরিটি অফিসার বিভিন্ন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একমনে কাজ করছিল। ওদের পরনে গাঢ় নীল ইউনিফর্ম—তার কোনও-কোনও জায়গায় সাদা বিডের লাইনিং।

এ ছাড়া আরও একজন অফিসার ঘরের ডানদিকের এককোণে একটা অল-গ্লাস কিউবিকলে বসে ছিল। তার সামনের টেবিলে একটা আর্ক কম্পিউটার স্ক্রিন। লম্বা, ধনুকের মতো বাঁকানো তার এল. সি. ডি. পরদা।

জিশানরা ঘরে ঢুকতেই কিউবিকলের অফিসার চোখ তুলে তাকাল। এবং পরমুহূর্তেই চটপট আঙুল চালিয়ে কম্পিউটারের কিবোর্ডের কয়েকটা বোতাম টিপে দিল। তারপর একগাল হেসে উঠে দাঁড়াল।

কিউবিকলের বাইরে বেরিয়ে এল অফিসার।

মাথায় কাঁচাপাকা চুল। তামাটে মুখে হাসির ভাঁজ। লম্বা-চওড়া চেহারা। দেখে সিকিওরিটি অফিসার বলে সমীহ হয়।

ভদ্রলোকের কোমরে কালো রঙের পার্টিকল গান। এই বন্দুকের সুইচ টিপলেই হাই-এনার্জি পার্টিকল স্ট্রিম বেরিয়ে আসে। শত্রুকে অকেজো করে দেয়। পিস ফোর্সের উঁচু স্তরের অফিসাররা এই বন্দুক ব্যবহার করে।

‘হাই, জিশান।’ বলে জিশানের দিকে হাতে বাড়াল অফিসার : ‘উইশ য়ু লাক ইন কিল গেম।’

হ্যান্ডশেক করে জিশান বলল, ‘থ্যাংকস।’

এবার পান্ডা আর মূর্তির দিকে তাকিয়ে অফিসার বলল, ‘তোমরা এ-ঘরে ঢোকামাত্রই এই গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর চারটে অডিয়ো-ভিশুয়াল সারভেইল্যান্স জোন আমি ডি-অ্যাক্টিভেট করে দিয়েছি। ফলে এখানে জিশানকে কেউ ওয়াচ করতে পারবে না। তা ছাড়া সিকিওরিটি সেন্ট্রালের তিনটে অফিসে আমার কোর লিডারদের সঙ্গে কথা বলা আছে। ওরা তো এককথায় রাজি…।’

পান্ডা জিশানের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাল। ছোট্ট করে বলল, ‘জিশান ম্যাজিক।’

জিশান ঠোঁটে হাসল।

এরপর জিশানকে ‘তৈরি’ করার পালা।

পান্ডা আর মূর্তি জিশানকে খোলসা করে কিছু বলেনি। কিন্তু ওকে পাশের একটা ছোট ঘরে নিয়ে গিয়ে ওরা যা শুরু করল সেটা থিয়েটারের গ্রিনরুমকেও হার মানায়। অফিসারটির তত্বাবধানে আনমোল নামে একজন সিকিওরিটি গার্ড জিশানের ভোল পালটানোর কাজে হাত দিল।

পান্ডা আর মূর্তি নিজেদের মধ্যে গল্প করছিল। আর পান্ডা মাঝে-মাঝেই শ্রীধর পাট্টার মুণ্ডপাত করে উত্তেজিত সব মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল।

প্রথমে জিশানকে বলা হল, জামাকাপড় ছেড়ে সিকিওরিটি গার্ডের ইউনিফর্ম পরে নিতে।

অফিসার পান্ডাকে লক্ষ করে বলল, ‘জানো, এই স্পেয়ার ইউনিফর্মটা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে স্টোর থেকে ম্যানেজ করতে হয়েছে। প্রত্যেকটা ইউনিফর্মে ম্যাগনেটিক সেন্সর লাগানো আছে। আমি রূপমকে বলেছিলাম। ও স্টোরের সারভেইল্যান্স চিফ। ও হেলপ না করলে হত না।’

জিশান ইউনিফর্মটা পরতে-পরতে অচেনা রূপমকে ধন্যবাদ দিল। ওর মনে হল, এই অন্যরকম প্রতিবাদী মানুষগুলো জিশানকে সাহায্য করেই সিন্ডিকেটের অবিচারের বিরুদ্ধে ওদের প্রতিবাদ জানাচ্ছে। জিশান কিল গেমে কোয়ালিফাই করে গার্ডদের সহানুভূতি জিতে নিয়েছে। ফাঁসির আসামির শেষ ইচ্ছে পূরণের মতোই ওরা জিশানের ‘শেষ’ ইচ্ছেগুলো পূরণ করে চলেছে।

গার্ডের সাহায্যে কয়েকমিনিটের মধ্যেই জিশানের পোশাক বদল শেষ হল। অফিসার ওকে শকার, স্মার্ট কার্ড সব দিল। হেসে বলল, ‘ওই আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াও। নিজেকে একবার দেখে নাও—।’

একটা মেটাল ক্যাবিনেটের খোলা পাল্লার ভেতরদিকে একটা ঝকঝকে আয়না লাগানো ছিল। জিশান আয়নাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।

কী আশ্চর্য! একটা কালো ইউনিফর্ম জিশানকে কী সাংঘাতিক পালটে দিয়েছে। এখন ও বলতে গেলে নিউ সিটির নিরাপত্তার যান্ত্রিক ব্যবস্থার একটা অংশ হয়ে গেছে।

গার্ড জিশানের কাছে এসে দাঁড়াল। ওর হাতে ছাই রঙের একটা মেকাপ বক্স। বলল, ‘এবার একটু হালকা মেকাপ…ব্যস…।’

পান্ডা হেসে বলল, ‘আনমোল একসময় যাত্রাদলের মেকাপম্যান ছিল। তারপর পেটের দায়ে এই বেশি মাইনের হতচ্ছাড়া চাকরিতে এসেছে। ওর মেকাপ কমপ্লিট হওয়ার পর তোমার ওয়াইফই তোমাকে আর চিনতে পারবে না—শ্রীধরের বাচ্চা তো কোন ছাড়!’

আনমোলের দিকে তাকাল জিশান। বয়েস তিরিশ ছুঁয়েছে কি না সন্দেহ। ফরসা মুখে ব্রণের দাগ। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। মুখ থেকে পেপারমিন্টের গন্ধ বেরোচ্ছে। চোখ ছোট-ছোট, তবে নজর তীক্ষ্ণ।

দক্ষ হাতে জিশানের মুখে কাজ শুরু করল আনমোল।

ঘরের দেওয়াল-ঘড়ির হিসেবে সময় লাগল উনিশ মিনিটের কয়েকসেকেন্ড বেশি। কিন্তু ওই অল্প সময়েই আনমোল জিশানকে পালটে দিল।

পান্ডা আর মূর্তি ওদের ‘নাইট সাফারি’-র প্ল্যান নিয়ে অফিসারের সঙ্গে আলোচনা করছিল। অফিসার বলল, ‘বেশি রিসক নেওয়ার দরকার নেই। শুধু সেফ জায়গাগুলোই জিশানকে ঘুরিয়ে দেখাও। নানান জোনের গার্ডদের সঙ্গে ওকে মিশিয়ে দেবে। তা হলেই ওকে আর কেউ নজর করতে পারবে না। নইলে…বুঝতেই তো পারছ…যদি আমাদের মার্শাল কোনওরকমে ব্যাপারটা টের পায় তা হলে আমরা কেউই আর বাদ যাব না। একজন ধরা পড়লেই ও টরচার করে তার পেটের সব কথা বের করে নেবে। একটা লোককে কী করে না মেরেও মেরে ফেলা যায় সেটা শ্রীধর পাট্টা ভালো করেই জানে। সুতরাং, কেয়ারফুল…।’

অফিসারের সঙ্গে কথা শেষ করে পান্ডা আর মূর্তি জিশানকে নিয়ে সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে এল। করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল।

চকচকে বাদামি গ্রানাইট পাথর বসানো মেঝেতে আয়নার মতো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছিল। জিশানের দুপাশে পান্ডা আর মূর্তি। প্যারেডের মতো সমান তালে পা মিলিয়ে ব্যস্তভাবে হেঁটে চলেছে। দেখে মনে হবে, ওরা কোনও মিশনে চলেছে। কন্ট্রোল রুমের অফিসার পান্ডা আর মূর্তিকে ঠিক এইভাবে হেঁটে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। জিশানের নিরাপত্তার জন্য এটা ওদের একরকম ছদ্মবেশ।

করিডরের দৈর্ঘ্য শেষ হতেই কয়েকধাপ সিঁড়ি। তারপর স্মার্ট ডোর। নির্দিষ্ট স্লটে নিজের স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করল মূর্তি। দরজা খুলে গেল। সামনেই খোলা চত্বর। চত্বরের বাইরে একফালি মিহি ঘাসজমির পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা কিউ-মোবাইল। তার গায়ে সিন্ডিকেটের লোগো আঁকা।

জিশান চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।

জায়গাটা একদম ফাঁকা এবং অন্ধকার। পান্ডা চাপা গলায় বলল যে, এটা গেস্টহাউসের পিছনদিক। এদিকটায় শুধু গার্ডরাই চলাফেরা করে। ওদের ব্যবহারের জন্য যেসব কিউ-মোবাইল গেস্টহাউসে আসা-যাওয়া করে সেগুলো এখানেই পার্ক করা হয়। এখানে এসে গাড়িগুলো থামে, গার্ডরা ওঠা-নামা করে।

জিশানদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিউ-মোবাইলটার কাছ থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরে আরও ছ’টা কিউ-মোবাইল পার্ক করা রয়েছে। পার্কিং জোনে লাল আলো জ্বলছে। বুঝিয়ে দিচ্ছে এটা ‘রেড অ্যালার্ট’ জোন।

দূরে চারজন গার্ডকে দেখতে পেল জিশান। ওদের দিকে ইশারা করে পান্ডা হাত নাড়ল। ওরাও হাত নেড়ে জবাব দিল।

গাড়িটার কাছাকাছি গিয়ে পান্ডা পকেট থেকে একটা রিমোট বের করে বোতাম টিপল।

কিউ-মোবাইলের চারটে দরজা ডানার মতো খুলে গেল। জিশান দেখল, গাড়িতে কেউ নেই। তা হলে গাড়িটা চালাবে কে?

চোখে এই প্রশ্ন নিয়ে পান্ডার দিকে তাকাল জিশান।

পান্ডা হাসল। বলল, ‘আমি চালাব। কোনও ভয় নেই। আমার এই গাড়ি ড্রাইভিং-এর লাইসেন্স আছে। অনেক গার্ডকেই কিউ-মোবাইল ড্রাইভিং-এর ট্রেনিং দেওয়া হয়। কেউ সে-ট্রেনিং নেয়, কেউ নেয় না।’

পান্ডা পাইলটের সিটে বসে পড়ল। ওর বাঁ-পাশে জিশান। আর তার পর মূর্তি। শকারগুলো খুলে ওরা গাড়ির পিছনের সিটে রেখে দিল।

রিমোট টিপতেই গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পান্ডা গাড়ি স্টার্ট দিল। সঙ্গে-সঙ্গে অটোমেটিক এসি চালু হয়ে গেল।

দক্ষ হাতে গাড়িটাকে চওড়া রাস্তায় নিয়ে এল পান্ডা। তারপর মসৃণ পথ ধরে নি:শব্দে গাড়ি ছোটাল।

একটু পরে পান্ডা আপনমনে বলতে লাগল, ‘জানো ভাই, জিশান, ছোটবেলা থেকেই আমার গাড়ি চালানোর খুব শখ। আমার বাপের গাড়ি রং করার দোকান ছিল। তো ওইসব পুডিং ঘষা রং চটা গাড়ি—লুকিয়ে ওগুলোর চাবি নিয়ে চালাতাম। টের পেলেই বাপ খ্যাঁচখ্যাঁচ করত। বলত, খদ্দেরদের গাড়ি। আমি পাত্তা দিতাম না। গাড়ি আমাকে টানত।’

মূর্তি বলল, ‘শুরুর দিকে ও সিন্ডিকেটের গাড়ি চালাত। একটা অ্যাক্সিডেন্ট করার পর থেকে সিকিওরিটি গার্ড হয়েছে।’

‘যাকগে, ওসব বাদ দাও—’ জিশানকে কনুইয়ের খোঁচা দিল পান্ডা : ‘নিউ সিটির কী-কী দেখবে বলো…।’

জিশান পান্ডার দিকে তাকাল। অন্ধকারে আবছা পান্ডার মুখ। তার ওপরে রাস্তার মেটাল ল্যাম্প থেকে ছিটকে আসা আলোর হাইলাইট।

কী বলবে জিশান? বাড়ির ঠিকানা, আর বাবার চোখের জল—নিউ সিটির এটুকুই তো মনে আছে!

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ও বলল, ‘এন—টুয়েলভ কমা থার্টি সিক্স। এই ঠিকানায় আমি থাকতাম। আজ থেকে প্রায় দেড়যুগ আগে।’

‘তাই?’ অবাক চোখে জিশানের দিকে তাকাল মূর্তি। পান্ডাও।

নিউ সিটিকে অনেকগুলো ছোট-ছোট জোনে ভাগ করা আছে। জোনগুলোর নাম এ, বি, সি, ডি ইত্যাদি। এইরকম প্রতিটি জোনের এক-একটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট স্থানাঙ্ক বা কো-অর্ডিনেট আছে। সেই সংখ্যা দিয়েই কোনও জোনের একটি বিশেষ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। জিশানের শুধু এটুকুই মনে আছে : এন—টুয়েলভ কমা থার্টি সিক্স।

জিশান সংক্ষেপে ওর ছোটবেলার কথা বলতে লাগল।

গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাস পেরিয়ে কিউ-মোবাইল অনেকক্ষণ আগেই বড় রাস্তায় এসে পড়েছিল। রাস্তার দু-ধারের আলোয় ছবির মতো পথটা দেখতে পাচ্ছিল জিশান। কালচে রুপোলি রং। ধাতুর পাতের মতো চকচকে। তারই ওপরে ছোট-ছোট বুটি। ঠিক যেন ব্যাঙের চামড়া। গাড়ির চাকা এই রাস্তায় সহজে পিছলে যাবে না। বাড়তি ঘর্ষণ গুণাঙ্ক সেই নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে।

রাস্তায় বড়-বড় ইলেকট্রনিক বিলবোর্ড চোখে পড়ছিল। সেগুলোর বেশিরভাগই প্রসাধন আর নেশার হরেকরকম উপকরণের বিজ্ঞাপন। জিশান অবাক হয়ে দেখছিল, বিজ্ঞাপনের চলমান ছবিগুলো ঠিক যেন আসলের মতো—ত্রিমাত্রিক।

মূর্তিকে সে-কথা জিগ্যেস করতেই ও বলল, ‘এখানে নিয়মিত ফরেন টেকনোলজি কেনা হয়। কথায়-কথায় সবাই জাপান আর আমেরিকা দেখায়। ওই বিজ্ঞাপনের ছবিগুলো সব হলোগ্রাম ইমেজ…তাই ওরকম আসলের মতো দেখাচ্ছে।’

একটু পরেই রঙিন হলোগ্রাম ইমেজ দেখে-দেখে জিশানের চোখ সয়ে গেল।

কিন্তু শুধু বিলবোর্ড নয়, নানান অফিস বিল্ডিং-এর চেহারা আর আলোকসজ্জা দেখেও তাক লেগে যায়। মনে হয় যেন শহরটা সৌন্দর্যে স্বর্গের খুব কাছাকাছি। যদিও স্বর্গের সৌন্দর্য কেমন জিশান জানে না।

ওল্ড সিটির কথা মনে পড়ে গেল জিশানের। কষ্ট হল। মনে হল, একটা লেসার বিলবোর্ডের খরচ দিয়ে ওর শহরের দশটা গরিব পরিবারের একমাস খাওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এরকম একটা সুন্দর বিল্ডিং-এর বদলে ওল্ড সিটিতে অনায়াসে গড়ে তোলা যায় দুটো ভদ্রস্থ হাসপাতাল, কিংবা হাফডজন স্কুল।

কিউ-মোবাইল ছুটছিল। আর জিশান মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এতটাই আকর্ষণীয় হতে পারে! আধুনিক এই প্রযুক্তির পাশাপাশি কী সাংঘাতিক ওইসব আদিম হিংস্র খেলা! বাইরের এই রঙিন সুন্দরের আড়ালে কী অদ্ভুতভাবেই না ঘাপটি মেরে বসে আছে ভয়ংকর কুৎসিত!

জিশানের বমি পেয়ে গেল। আচমকা ‘ওয়াক’ তুলল দুবার।

মূর্তি জিগ্যেস করল, ‘কী হল?’

জিশান মুখে হাত চাপা দিয়ে কাশল, বলল, ‘কিছু না।’

পান্ডা ওর দিকে একবার তাকাল শুধু—কিছু বলল না।

দশ কি পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে পান্ডা গাড়িটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে এল যাকে স্বপ্নের জগৎ ছাড়া আর কিছু বলে ভাবা যায় না। একটা বিশাল এলাকা জুড়ে নানান উচ্চতার বিমূর্ত ছাঁদের বাড়ি। তার সর্বত্র উৎসবের আলোকমালা। হাজার রঙের লেসার-ছবি বাড়িগুলোর গায়ে অদ্ভুত ছন্দে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে।

পান্ডা পার্কিংজোনে গাড়িটা পার্ক করতে-করতে বলল, ‘এই কমপ্লেক্সটার নাম ”ই-ল্যান্ড”—এনটারটেইনমেন্ট ল্যান্ড। ফূর্তি-জোনও বলতে পারো। চার কিলোমিটার বাই চার কিলোমিটার এলাকা। টুয়েন্টি ফোর সেভেন খোলা…।’

রিমোট দিয়ে গাড়ির দরজা খুলল পান্ডা। নামতে-নামতে মূর্তিকে বলল, ‘এই, শকারগুলো নিয়ে নে। কোমরে ঝোলাতে হবে।’

জিশান আর মূর্তি অন্য দরজা দিয়ে নামল। পিছনের সিট থেকে শকারগুলো তুলে নিল মূর্তি। জিশানকে একটা দিল, আর বাকি দুটো হাতে করে পান্ডার কাছে গেল।

পান্ডা কিউ-মোবাইলের দরজা বন্ধ করল। তারপর রিমোটের অন্য একটা বোতাম টিপে গাড়িটা ‘ফার্মলক’ করে দিল।

জিশান অবাক হয়ে সুবিশাল ইলেকট্রনিক হাঙ্গামার দিকে তাকিয়ে ছিল। যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই এনটারটেইনমেন্ট। নন-স্টপ বিনোদন।

চঞ্চল আলোর রঙিন আভা জিশান, পান্ডা আর মূর্তির মুখে খেলা করছিল।

ওরা তিনজনে এগোল ‘ই-ল্যান্ড’-এর দিকে। দেখে মনে হচ্ছিল, পিস ফোর্সের তিনজন গার্ড ব্যস্তভাবে ডিউটিতে চলেছে।

স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়ল জিশান। ওর মনে হল, ও অলৌকিক কোনও শহরে এসে পড়েছে। যেখানে অটোমেশান, ইলেকট্রনিক্স আর অপটিকস তাদের ‘ছলাকলা’র মরণপণ প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

পান্ডা আর মূর্তির সঙ্গে হাঁটছিল জিশান। সব জায়গায় স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করার ব্যাপারটা ওরা দুজন সামলাচ্ছিল। আর জিশান ওপরদিকে তাকিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে আশ্চর্য জগতের অভিঘাতটা শুষে নেওয়ার চেষ্টা করছিল।

পান্ডা ওকে বলছিল, ‘…এখানে দোকানপাট আছে, ব্যাঙ্ক আছে, ক্লাব আছে, গেমস পারলার আছে, নকল সমুদ্র আছে, সি-বিচ আছে…কী নেই!’

কথা বলতে-বলতে একটা মল-বিল্ডিং-এর গ্রাউন্ড ফ্লোরে ঢুকে পড়ল ওরা।

চারিদিকে শুধু কাচ আর কাচ, আলো আর আলো। আলো যেমন নানান রঙের, কাচের দেওয়ালগুলোও তাই। এ ছাড়া রয়েছে স্বচ্ছ ফাইবারের সিঁড়ি আর মেঝে। সিঁড়ি চলছে, কোথাও-কোথাও মেঝেও।

তাজ্জব জিশানকে নিয়ে এদিক-সেদিক ঘুরিয়ে দেখাতে লাগল পান্ডা আর মূর্তি। তারপর একটা গেমস পারলারের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। পারলারের কাচের দেওয়ালের দিকে আঙুল দেখিয়ে মূর্তি বলল ‘ওই দ্যাখো—।’

জিশান তাকাল। এবং নিজেকে দেখতে পেল।

কাচের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে, পারলারের ভেতরে জায়ান্ট টিভি চলছে এবং সেখানে জিশানকে দেখা যাচ্ছে।

পান্ডা জিশানের হাত ধরে টানল। ওরা তিনজন পারলারে ঢুকে পড়ল।

জিশান অবাক হয়ে দেখল, টিভিতে কিলগেমের প্রাোমো চলছে। তাতে জিশানের নানারকম ক্লিপিংস দেখানো হচ্ছে। জিশান ঘরে পায়চারি করছে, খেলার মাঠে বল খেলছে, অ্যানালগ জিমে ব্যায়াম করছে, কানে হেডফোন লাগিয়ে শুটিং প্র্যাকটিস করছে, কমব্যাট পার্কে কোমোডো ড্রাগনের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে, টিভি ক্যামেরাম্যানকে দু-হাতে মাথার ওপরে তুলে নিয়েছে, স্নেক লেকে প্রাণপণে দৌড়চ্ছে, জাব্বার সঙ্গে মরিয়া লড়াই চালাচ্ছে…।

এবং তারপর কিল গেমের বিজ্ঞাপন। খুব শিগগিরই কিল গেমের দিনক্ষণ জানানো হবে। সেই খেলার সিধা প্রসারণের সময় যাঁরা বিজ্ঞাপন দিতে চান তাঁরা অন-লাইনে বুকিং করুন। তারপরই পরদায় ফুটে উঠছে কয়েকটি ওয়েবসাইট আর সাইবার লিংকের অ্যাড্রেস।

পারলারে ভিড় ছিল। নানান বিচিত্র গেম খেলায় ব্যস্ত নানাবয়েসি ছেলে-মেয়ে। তা ছাড়া আরও অনেকে এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল। জিশান লক্ষ করল, ওকে নিয়ে কিল গেমের প্রাোমো চলছে দেখে টিভির সামনে ভিড় বাড়ছিল। এবং টিভিতে ওর মুখ দেখানোমাত্রই হইচইয়ের জোয়ার উঠছিল।

আশপাশের মানুষজনের কথা শুনতে পাচ্ছিল জিশান।

কেউ ওর বডির প্রশংসা করছিল। কেউ বলছিল, ‘লোকটাকে কী হ্যান্ডসাম দেখতে!’ কেউ বলছিল, জাব্বার মতো একজোড়া পালোয়ানের সঙ্গে ও অনায়াসে মহড়া নিতে পারে। আবার আর-একজনের মন্তব্য : ‘আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা কিল গেমে জিতে যাবে…।’

পান্ডা জিশানকে খোঁচা দিল। জিশান ওর দিকে ফিরে তাকাতেই পান্ডা চোখ ঠারল। যার অর্থ হল : ‘দেখছ, সবাই তোমার কথা বলছে!’

যতক্ষণ কিল গেমের প্রাোমো চলল ততক্ষণ টিভির সামনে ভিড় লেগে রইল। দর্শকদের উচ্ছ্বাস জিশানকে অবাক করে দিল। গার্ডরা ওকে যে পছন্দ করে তার পিছনে হয়তো শ্রীধর পাট্টাকে অপছন্দের কারণ রয়েছে। কিন্তু পারলারে বিনোদনের সন্ধানে আসা জনগণ? ওরা কি চাইছে জিশানের ভালো হোক, জিশান জিতুক? নাকি আসলে চাইছে কিল গেম জমে উঠুক?

পান্ডা আর মূর্তির হাত ধরে টান মারল জিশান। তারপর ওরা তিনজনে গেমস পারলার থেকে বেরিয়ে এল।

মূর্তি বলল, ‘জিশান, তোমাকে নিয়ে লোক কিন্তু হেভি এক্সাইটেড। তোমার বিজ্ঞাপনগুলোও পাবলিককে হেভি টানছে…।’

‘বিজ্ঞাপন? তার মানে?’ জিশান অবাক হয়ে মূর্তিকে দেখল।

তখন পান্ডা বলল, ‘প্রায় একমাস ধরে সিন্ডিকেট এই কাজটা শুরু করেছে। তোমার ডিফারেন্ট টাইপের ক্লিপিংস দেখিয়ে তার ফাঁকে-ফাঁকে নানান প্রাোডাক্টের অ্যাড চলছে। এরপর…কিল গেমের আগে…তোমাকে নিয়ে ক’দিন শুটিং চলবে। নতুন-নতুন জিনিসের বিজ্ঞাপন। গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া থেকে শুরু করে প্রাোটিন ফুড আর ক্রাঞ্চি মিল পর্যন্ত…।’

জিশান চুপ করে রইল। একটা ক্লাবের পাশ দিয়ে ওরা হেঁটে যাচ্ছিল। তার কাচের দেওয়ালে রঙিন এল. সি. ডি. ডিসপ্লে-তে ইংরেজিতে লেখা ‘ফানডম’। তার নীচে লেখা : ‘ডু নট এন্টার ইফ য়ু আর অ্যাবাভ সিক্সটিন।’

জিশান সেদিকে তাকিয়ে আছে দেখে পান্ডা হেসে বলল, ‘ ”ই-ল্যান্ড”-এ যে ক’টা ক্লাব আছে তার একটার নামও নাইট ক্লাব নয়। কেন জানো?’

জিশান পান্ডার দিকে তাকিয়ে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল। জানে না।

পান্ডা আর মূর্তি এ-ওর গায়ে চাপড় মারল, হাসাহাসি করল। তারপর মূর্তি বলল, ‘ক্লাবগুলো দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে বলে এগুলোর নাম নাইট ক্লাব নয়।’

‘তা ছাড়া নানান ক্লাবের নানারকম বয়েসের লিমিট আছে।’ পান্ডা বলল। আঙুল তুলে ‘ফানডম’-এর নীচের লেখাটা দেখাল: ‘ওই যে…ওইরকম।’

এরপর ”ই-ল্যান্ড”-এর আরও অনেকগুলো বিল্ডিং ঘুরে দেখল ওরা। ট্রান্সপারেন্ট ফাইবারের এসক্যালেটরে চড়ে বহুবার ওপর-নীচ করল। হরেকরকম বিনোদনের পসরা দেখে জিশানের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছিল। বেশ কয়েকটা দোকানে জায়ান্ট স্ক্রিন টিভিতে নিজেকে দেখতে পেল জিশান। ওকে নিয়ে তৈরি দু-তিনটে বিজ্ঞাপনও দেখল।

আশ্চর্য! এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা ও কিছুই জানে না!

পান্ডা আপনমনে বলল, ‘তোমাকে সিন্ডিকেট প্রাইজ মানি দিচ্ছে ঠিকই—কিন্তু সেই টাকা কড়ায়-গন্ডায় উশুল করে নিচ্ছে। তোমাকে নিয়ে ওরা মিডিয়া হাইপ তৈরি করছে। কিল গেমের ব্যাপক পাবলিসিটি করছে—যাতে প্রচুর অ্যাড পাওয়া যায়।’

জিশান চুপ করে রইল। সিন্ডিকেটের অঙ্কটা মনে-মনে বোঝার চেষ্টা করল। বিজ্ঞাপনের শুটিং করতে হবে ওকে! ওকে পাবলিসিটি দিয়ে জনপ্রিয় করে তুলে তারপর ফায়দা তোলার পালা। আর সবশেষে রয়েছে পাঁঠাবলির লাইভ টেলিকাস্ট।

‘ই-ল্যান্ড’ থেকে বেরিয়ে ওরা কিউ-মোবাইলে উঠে আবার রওনা দিল। নানান রাস্তা ঘুরে জিশানের ছোটবেলার বাড়ির কাছে পৌঁছে গেল।

জায়গাটা দেখে জিশানের বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। পুরোনো কিছুই আর নেই। নতুন-নতুন সব বাড়ি-ঘর তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

‘এইখানে একটা দোতলা বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে আমি থাকতাম।’ পান্ডার দিকে তাকিয়ে বলল জিশান। মনে-মনে ও ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছিল। ওদের বাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় ছিল সেটা আঁচ করার চেষ্টা করছিল।

রোজ ঘুম থেকে উঠে যে-বারান্দাটায় গিয়ে ও দাঁড়াত সেটা কোনদিকে ছিল যেন? সূর্যটা কোনদিক থেকে ওঠে? কোনটা পুবদিক?

আকাশের দিকে তাকাল জিশান। একটুকরো চাঁদ, তারা, আর অন্ধকার। পুবদিক কোনদিকটা হতে পারে সেটা আন্দাজ করে ‘বারান্দা’টা আবার খুঁজল। পেল না।

সবকিছু কেমন গুলিয়ে গিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল জিশান। শুধু বিড়বিড় করে বারবার বলতে লাগল, ‘এইখানে আমাদের বাড়ি ছিল। এইখানে…আমাদের… বাড়ি…ছিল…।’

বাবার ডাক শুনতে পেল জিশান। বাবা ওকে ডাকছে : ‘জিশু! জিশু—!’

জিশান চোখ মুছল। চোয়াল শক্ত করল। পুরোনো মুছে গিয়ে ভালোই হয়েছে। মনে-মনে ভাবল জিশান। পুরোনো সবকিছু থাকলে স্মৃতি ওর চোখের জলে আরও ঢেউ তুলত। ‘পুরোনো’কে ঝাপসা করে দেওয়ার জন্য ‘নতুন’কে ধন্যবাদ জানাল। মনটা আরও শক্ত করতে চাইল।

শহরের আরও অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখানোর পর কিউ-মোবাইল জিপিসি-র পথ ধরল। এই কয়েকঘণ্টার শহর ভ্রমণে জিশান নিজের অনেক ছবি দেখেছে। বেশ কয়েকটা বিলবোর্ডেও জিশান পালচৌধুরী হাজির। চারিদিকে ওর এত ছবি!

‘ছবি’ হয়ে যাওয়ার আগে এখানে বোধহয় এরকমটাই হয়।

গেস্টহাউসে নিজের রুমে ফিরে আসার পর জিশানের খুব ক্লান্ত লাগছিল—তবে চোখে ঘুম আসছিল না। অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে ছিল। চোখের নজর ঘরের সিলিং-এর দিকে। সেদিকে তাকিয়ে এক অন্ধকার সিনেমার পরদায় ও যেন নিজের জীবনের ছায়াছবি দেখছিল।

গত কয়েকটা মাসে কত ঘটনাই না ঘটে গেছে ওর জীবনে! ওর ওল্ড সিটির বস্তিবাড়িতে শ্রীধর পাট্টা হাজির হওয়ার পর থেকেই শান্ত সুন্দর জীবনটা কেমন বদলে গেল। ওর ওল্ড সিটির হতমান অবস্থার মধ্যে কোনও সৌন্দর্য ছিল না ঠিকই, কিন্তু ওর জীবনের ভেতরে সৌন্দর্য ছিল।

আর এখানে! নিউ সিটির অঙ্গসজ্জায় সৌন্দর্যই প্রথম এবং শেষ কথা। কিন্তু তার গভীরতা শরীরের ত্বক পর্যন্তই। তারপর…ত্বকের গভীরতার পর থেকেই শুরু হয়ে গেছে কুৎসিতের জয়জয়কার। তাই কিল গেমে ‘মৃত্যুপথযাত্রী’ জিশানকে নিয়েও ওরা নির্লজ্জ ব্যাবসা শুরু করে দিয়েছে।

কেন জানি না, জিশান মনে-মনে ভীষণ ভেঙে পড়ছিল। আর কতদিন…আর কতদিন ও কুৎসিতের সঙ্গে এরকম মরিয়া লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে?

কিল গেম পর্যন্ত সুপারগেমস কর্পোরেশন জিশানকে নিয়ে চূড়ান্ত ব্যাবসা করবে। তারপর…কিল গেম শেষ হলে…অথবা, জিশান শেষ হলে…ওরা নতুন আর-একজন ‘সুপারহিরো’র সন্ধানে নেমে পড়বে।

কিন্তু ওই তিনটে খুনির সঙ্গে ‘ক্যাট অ্যান্ড মাউস’ গেমে জিশান যদি জিতে যায়!

তা হলে জিশান হয়ে যাবে ‘মেগা সুপারহিরো’। ওকে নিয়ে সিন্ডিকেট আরও কিছুদিন রমরমা ব্যাবসা চালাবে। প্রাইজমানি ছাড়াও ওকে নিউ সিটির একটা ফ্ল্যাট গিফট করবে। আরও সব নানান কোম্পানি ওকে হরেকরকম উপঢৌকন দেবে। তার মধ্যে গাড়ি তো আছেই! তা ছাড়াও থাকবে আধুনিক জীবনযাত্রার নানান সরঞ্জাম।

তখন মিনি আর শানুকে নিয়ে জিশান ওল্ড সিটি ছেড়ে চলে আসতে পারবে। চিরকালের জন্য। দু:খের জগৎ থেকে ওরা তিনজন চলে আসবে সুখের জগতে।

কিন্তু ওল্ড সিটির বাকি মানুষজন? ওরা কি ছন্নছাড়া জীবন আর অভাবের জাঁতাকলে পিষে মরবে?

যতই চিন্তা করছিল ততই জিশানের পাগল-পাগল লাগছিল। ও বিছানায় ছটফট করতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর ও বিছানায় উঠে বসল। বল রিমোটের বোতাম টিপে ঘরের আলো জ্বেলে দিল। তারপর দেওয়ালের প্লেট টিভিটার দিকে তাকাল।

জিপিসি-র এই গেস্টহাউসে আসার পর জিশান প্রথম দু-এক সপ্তাহ নানান চ্যানেলের প্রাোগ্রাম দেখেছিল। তারপর থেকে ও গেমস-এর চ্যানেল আর চালায় না। ওইসব চ্যানেল দেখলে ওর মনের ওপর চাপ পড়ে। তাই ও নিয়ম করে দু-চারটে নিউজ চ্যানেল ছাড়া অন্য কোনও চ্যানেল আর দ্যাখে না। আর বেশিরভাগ সময় টিভিটাকে অন-লাইন ইনটারঅ্যাকটিভ মোডে রাখে, যাতে সিন্ডিকেট বা সুপারগেমস কর্পোরেশনের সঙ্গে ওর যোগাযোগ থাকে। এ ছাড়া টিভিটাতে একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা আছে—সিন্ডিকেট যখন ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় তখন যদি টিভিটা অফ থাকে তা হলে সেটা নিজে থেকেই অন হয়ে যায় এবং ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল চালু হয়ে যায়।

আর টিভি যদি চালু থাকে এবং তাতে অন্য চ্যানেল চলতে থাকে, তা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চ্যানেল সোয়াপ হয়ে গিয়ে ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল পরদায় চলে আসে।

টিভির দিকে তাকিয়ে জিশান ওর আজকের নাইট সাফারির কথা ভাবছিল। ভাবছিল, ওকে নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের মাতামাতির কথা।

রিমোটের বোতাম টিপে টিভি অন করে দিল জিশান। চ্যানেল সার্ফ করে একটা গেমের চ্যানেলে গিয়ে থামল। লাইভ টেলিকাস্ট নয়—সেখানে তখন একটা ‘হাংরি ডলফিন’ গেমের ভিডিয়ো রেকর্ডিং দেখাচ্ছে। সমুদ্রের জলে ডলফিনের সঙ্গে মিশে আছে ডলফিনের ‘ছদ্মবেশ’ নেওয়া হিংস্র হাঙর। তাদের মধ্যে সাঁতারে বেড়াচ্ছে প্রতিযোগী।

হঠাৎই শুরু হল কর্মাশিয়াল ব্রেক। আর সেই ব্রেকের সময়ে টিভির পরদায় দেখা দিল জিশান। ওকে নিয়ে বিজ্ঞাপন শুরু হল।

অ্যানালগ জিমে জিশান ব্যায়াম করছে। বাটারফ্লাই ক্রাঞ্চ! রুমে এসি থাকা সত্বেও ওর ত্বকের ওপরে ঘামের চকচকে স্তর। হঠাৎ সেই ছবি সরে গিয়ে একটা ভাইটালাইজিং পাউডারের কনটেইনারের ছবি। পাশে একজন স্লিম সুন্দরী তরুণী। মিষ্টি গলায় পাউডারের নানান গুণপনার কথা বলছে। পাউডারের কৌটোটাকে উষ্ণ আদরের ভঙ্গিতে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। আদুরে ঢঙে হাস্কি ভয়েসে বলছে, ‘তুমি আমার। আমার তুমি।’ তারপরই জিশানের হাসিমুখ। আবার জিশানের ব্যায়াম। আবার পাউডারের কৌটো।

বিজ্ঞাপনটা শেষ হওয়ার পর জিশান ভাবতে বসল। টিভিতে তখন অন্য বিজ্ঞাপন শুরু হয়ে গেলেও সেদিকে ওর মন ছিল না।

এই বিজ্ঞাপনের ব্যাপারটা জিশান জানতেও পারেনি। জিশানকে জানানোর দরকারও মনে করেনি কেউ। ওর ব্যায়ামের ছবির ক্লিপিং-এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে ওই ভাইটালাইজিং পাউডারের ছবি, মেয়েটির ছবি। তারপর এডিটিং-এর কারসাজিতে ছবিগুলো বিনুনির মতো জুড়িয়ে দিয়েছে। তারই মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে জিশানের হাসিমুখ। কোনওসময় ও হয়তো মনোহর বা খোকনের সঙ্গে হাসি-মশকরা করছিল, তখন লুকোনো টেলিক্যামেরায় তুলে নিয়েছে ওর হাসিমুখের ছবি।

জিশানের খুব রাগ হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ও বুঝল, এ রাগের কোনও মানে নেই। ওর ফোঁসফোঁসানিই সার—ওর কামড়ে কোনও বিষ নেই।

হতাশা আর ক্ষোভে ওর চোখ জ্বালা করতে লাগল।

বিছানার মাথার দিকে তাকাল জিশান। বালিশের পাশেই পড়ে আছে এম. ভি. পি.—মাইক্রোভিডিয়োফোন।

মিনিকে ভীষণ ফোন করতে ইচ্ছে করল।

দেওয়াল-ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত দেড়টা।

মিনি নিশ্চয়ই এখন ঘুমিয়ে আছে। আর মা-কে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে ছোট্ট শানু। তা ছাড়া এই মাঝরাতে মিনির এম. ভি. পি. নিশ্চয়ই সুইচ অফ করা আছে।

এতসব ভাবনার পরেও জিশান শরীরটা ঝুঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে এম. ভি. পি.-টা মুঠো করে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গে ওর মনে হল, মিনি এসে গেছে হাতের মুঠোয়।

সোজা হয়ে বসল। এম. ভি. পি.-টা মুখের সামনে তুলে ধরল। তারপর বোতাম টিপল।

আজকের রাতটার মধ্যে বোধহয় ম্যাজিক আছে। কারণ, ফোনের বাজনা তৃতীয়বার শেষ হওয়ার আগেই মিনি ফোন ধরল।

ছোট্ট এল.সি.ডি. পরদায় ওকে দেখতে পেল জিশান।

ঘরের অন্ধকারে ভাসছে মিনির সদ্য-ঘুম-ভাঙা মুখ। ফোনের আলোর আভায় ওর মুখটা অলৌকিক দেখাচ্ছে।

‘মিনি—।’

‘জিশান! কী হয়েছে? এত রাতে!’ ঘুম জড়ানো গলায় মিনি বলল। ওর কথায় আশঙ্কা উঁকি মারছে।

‘না, কিছু হয়নি।’

‘না—বলো। তুমি লুকোচ্ছ। প্লিজ বলো—!’

‘না, মিনি—কিচ্ছু না। বিশ্বাস করো।’ একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, ‘আসলে তোমাকে ভীষণ ফোন করতে ইচ্ছে করল। দেখতে ইচ্ছে করল। আমি…শুধু-শুধু তোমার ঘুম ভাঙালাম…।’

‘তাতে কী আছে! তোমার ফোন আসতে পারে ভেবে আমি রোজ ফোনটা অন করে বালিশের পাশে রেখে শুই।’

‘আমার এখানে আর ভাল্লাগছে না।’ বাচ্চা ছেলের বায়নার ঢঙে বলল,’আমার কিছু ভাল্লাগছে না।’

‘ভালো লাগবে কেমন করে! নিউ সিটি মোটেই ভালো লাগার জায়গা নয়…সবাই জানে…।’

জিশান আর মিনি কথা বলতে লাগল। ওদের কথা আর ফুরোতে চায় না। কিন্তু বরাদ্দ দশমিনিট ধীরে-ধীরে ফুরিয়ে আসছিল।

জিশান বেশ বুঝতে পারছিল, ওরা দুজনেই কিল গেমের কথা এড়িয়ে যাচ্ছে। যেন ব্যাপারটাকে অস্বীকার করলেই ওটা উধাও হয়ে যাবে।

সময় ফুরিয়ে আসছিল বলে জিশান মিনিকে ওর নাইট সাফারির কথা বলল। বলল পান্ডা আর মূর্তির সাহায্যের কথা। আনমোলের কথা। সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুমের অফিসারের কথা।

পান্ডা আর মূর্তির কথা মিনি জিশানের কাছে আগেই শুনেছিল। এখন জানতে পারল, আরও অনেক সিকিওরিটি গার্ড জিশানের ভালো চাইছে। চাইছে জিশান জিতুক।

জিশান এবার বিজ্ঞাপনের কথা বলল। বলল, কীভাবে সিন্ডিকেট ওকে বিপণনের কাজে লাগাচ্ছে।

‘…আমার হাত-পা বাঁধা। কিছু করতে পারছি না। মিনি, আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে…।’ জিশান কেঁদে ফেলল।

‘হ্যাঁ—জানি, তোমার ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু উপায় কী! তোমাকে সহ্য করতেই হবে। প্লিজ, কেঁদো না…।’

জিশান চোখের জল মুছে বলল, ‘এরপর হয়তো ওরা ক্লিপিংস ইউজ না করে আমাকে দিয়ে অ্যাডের শুটিং করাবে। একটা বলির পাঁঠাকে নিয়ে আর কত হেনস্থা করবে ওরা! ওই শয়তানটা…ওই হারামজাদা শ্রীধর পাট্টা…ওকে খতম করতে পারলে…।’

‘শোনো, জিশান!’ ওকে বাধা দিয়ে বলল মিনি, ‘এইসব হেনস্থার জবাব তোমাকে দিতে হবে কিল গেমে।’

‘কিল গেমে!’ হঠাৎ করে কিল গেমের প্রসঙ্গ সরাসরি উঠে আসায় জিশান অবাক হল। মিনির ছবির দিকে তাকাল।

‘হ্যাঁ। কিল গেমের দিন ঠিক হলে ওই গেম সিটিতেই তোমাকে জবাব দিতে হবে। ওই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে—।’

চোয়াল শক্ত করল জিশান : ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ।’ মাথা নাড়ল : ‘ওই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই জবাব দিতে হবে।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘চব্বিশ ঘণ্টা নয়—তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিটের মধ্যে—।’

‘হ্যাঁ। তুমি…।’

দশ মিনিট ফুরিয়ে গেল। এম.ভি.পি.-র পরদায় মিনির ছবি দপ করে নিভে গেল।

জিশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ও যেন এতক্ষণ স্বর্গে ছিল—এই মুহূর্তে নরকের অন্ধকূপে খসে পড়ল।

এম.ভি.পি.-টা সুইচ অফ করে বালিশের কাছে ছুড়ে দিল। বল রিমোটের বোতাম টিপে প্লেট টিভি অফ করল। তারপর ঘরের আলোটাও নিভিয়ে দিল।

অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর।

জীবন্ত প্রেতের মতো মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইল জিশান। হতাশার স্রোত ওকে আলোয়ানের মতো জড়িয়ে নিচ্ছিল। এবং অন্ধকারে চুপচাপ বসে ও প্রাণপণে তার সঙ্গে লড়াই চালাচ্ছিল।

এভাবে কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে! হঠাৎই টিভির ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল দপ করে চালু হয়ে গেল।

আলোর ঝলকানিতে চমকে উঠল জিশান। তাকাল টিভির দিকে।

একজন সুন্দরী মিষ্টি গলায় ওর নাম ধরে ডাকল : ‘জিশান! জিশান!’

মেয়েটি বোধহয় ভেবেছে জিশান ঘুমিয়ে আছে।

আরও দু-একবার ডাকার পর জিশান বিছানা ছেড়ে উঠল। টিভির কাছে গিয়ে বলল, ‘বলো। জেগে আছি।’

হাসল মেয়ে : ‘সরি, জিশান। ডিসটার্ব করছি। তোমাকে আমাদের পিস ফোর্সের মাননীয় মার্শাল ডেকে পাঠিয়েছেন। তুমি রেডি হয়ে নাও। পিস ফোর্সের গার্ডরা ঠিক সাত মিনিট পর তোমাকে নিতে আসবে। থ্যাংক য়ু।’

ইনটারঅ্যাকটিভ চ্যানেল অফ হয়ে গেল। মেয়ে মিলিয়ে গেল।

রিমোটের বোতাম টিপে আলো জ্বালল জিশান। ওয়ার্ডরোবের কাছে গিয়ে পাল্লা খুলল। একটা ছাই রঙা কর্ডের প্যান্ট আর নীল রঙের পোলো নেক টি-শার্ট পরে নিল।

শ্রীধর পাট্টা ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন!

কিন্তু কেন?

সাত মিনিট শেষ হতে না হতেই দরজায় কলিংবেল। গার্ডরা এসে গেছে।

দরজা খুলল জিশান। পিস ফোর্সের তিনজন গার্ড। অভিব্যক্তিহীন মুখ। কোমরে শকার—সুইচ অন করা।

না, গার্ডদের একটা মুখও ওর চেনা নয়।

‘চলো—মাননীয় মার্শাল…।’ ওদের একজন বলতে শুরু করেছিল।

‘জানি।’ লোকটাকে থামিয়ে দিয়ে জিশান বলল। এবং ওদের সঙ্গে রওনা হল।

করিডর ধরে যেতে-যেতে জিশান ওদের কাছে বারবার জানতে চাইল, শ্রীধর পাট্টা ওকে কেন ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু ওরা কোনও জবাব দিল না।

আরও অনেকবার জিশান একই কথা জিগ্যেস করল। কিন্তু তা সত্বেও কোনও জবাব নেই।

এলিভেটরে করে নামার সময় জিশান ওদের অনুনয় করে বলল, ‘প্লিজ, ভাই! যদি জানা থাকে আমাকে বলো। প্লিজ!’

গার্ডরা নিজেদের মধ্যে একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর বরফ গলল। ওদের একজন জিগ্যেস করল, ‘তুমি আজ রাতে গেস্টহাউস ছেড়ে বেরিয়েছিলে?’

জিশান কোনও উত্তর দিতে পারল না। হতবাক হয়ে গার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আর-একজন গার্ড বলল, ‘তুমি জিপিসি-র ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়েছিলে। মনে হয়, শ্রীধর পাট্টা সেটা জানতে পেরেছেন…।’

জিশানের বুকের ভেতর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নামতে শুরু করল। আবার তা হলে ‘রোলারবল’?

কিন্তু শ্রীধর জানতে পারলেন কেমন করে!

.

১১.

জিপিসির গেস্টহাউস থেকে নীচে নেমে এল জিশান। তিনজন গার্ডের সঙ্গে পা ফেলে এগিয়ে গেল একটা কিউ-মোবাইলের দিকে।

গাড়িতে একজন পাইলট স্টিয়ারিং-এর সামনে বসেছিল। তার পাশে জিশানকে বসিয়ে একজন গার্ড জিশানের বাঁ-পাশ ঘেঁষে বসে পড়ল। আর বাকি দুজন পিছনে। ওরা সবাই গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ির চারটে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি চলতে শুরু করল।

জিপিসি-র ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরিয়ে কিউ-মোবাইল ছুটে চলল। গাড়ির ড্যাশবোর্ডের ইলেকট্রনিক প্যানেলের দিকে তাকাল জিশান। ডিজিটাল ঘড়িতে দুটো দশ। তার পাশেই বসানো ছোট টিভির পরদায় রক ব্যান্ডের লাইভ শো দেখানো হচ্ছে।

গন্তব্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়ার পর জিশান বিল্ডিংটাকে চিনতে পারল : সিন্ডিকেট হেডকোয়ার্টার। এত রাতেও বহুতল বিল্ডিংটার নানান ফ্লোরে আলো জ্বলছে। আগেই জিশান শুনেছিল, এখানে প্রায় সব অফিসেই নাইট শিফটে কাজ হয়।

গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর দিকে এগোল ওরা।

রাতের বাতাস কেটে শিসের শব্দ শুনতে পেল জিশান। মাথা তুলে ওপরে তাকাল।

দুটো শুটার বাঁক নিয়ে ছুটে গেল আকাশে। বোধহয় রাতে ওরা নিউ সিটির আকাশে টহল দেয়। নজরদারির কাজ করে। হয়তো ওই শুটার থেকেই কোনও টহলদার গার্ড জিশানের নাইট সাফারির কথা জানতে পেরেছে—তারপর শ্রীধর পাট্টাকে খবর দিয়েছে।

বিল্ডিং-এর ভেতরে ঢুকে পড়তেই শীতাতপ পরিবেশে উষ্ণতা বেশ কয়েক ডিগ্রি নেমে গেল। অথচ গ্রানাইট, কাচ, প্লাস্টিক আর স্টেইনলেস স্টিল দিয়ে তৈরি আধুনিকতম সব ঘর আর বারান্দার নকশা। অথচ চারপাশে তাকালে কেমন যেন নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক ভাব।

জিশান লক্ষ করল, করিডরে লোক চলাচল দিনের তুলনায় বেশ কম। তবে যে-ক’জন গার্ডকে নজরে পড়ল তারা সকলেই একইরকম স্মার্ট এবং ওদের কোমরে ঝোলানো শকার একইরকম সক্রিয়।

প্রথমে ভার্টিকাল এলিভেটর। তারপর হরাইজন্টাল এলিভেটর। তাতে ওঠার পর একজন গার্ড ডিজিটাল প্যানেলে কো-অর্ডিনেট পাঞ্চ করল। এক্স-ওয়াই স্থানাঙ্ক পাওয়ামাত্রই মসৃণ এলিভেটর নি:শব্দে গন্তব্যে ছুটে চলল।

জিশান কোনও কথা বলছিল না। গার্ড তিনজনও চুপচাপ। ঠিক যেন কারও মৃত্যুশোকে নীরবতা পালন চলছে। বোধহয় শোকের ঘটনার আগেই স্মরণসভা শুরু হয়ে গেছে।

শেষ পর্যন্ত জিশানকে যেখানে নিয়ে আসা হল বেশ বড় মাপের একটা দরজার সামনে। গার্ড তিনজন দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ইশারায় জিশানকে ভেতরে ঢুকতে বলল।

কপালে-যা-থাকে-থাক ভেবে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ল জিশান।

একটা বিশাল হলঘর। ঘরের একপ্রান্তে অদ্ভুত জ্যামিতিক চেহারার একটা কনফারেন্স টেবিল। তাকে ঘিরে পাঁচটা চেয়ার।

একটা চেয়ারে বসে আছেন অবশ্যই শ্রীধর পাট্টা। পরনে ধবধবে সাদা পোশাক। সোনালি বোতাম। বুকপকেটের ওপরে জ্বলজ্বলে নীল হলোগ্রাম।

এই রাত আড়াইটের সময়েও মানুষটার শরীর চাবুকের মতো টান-টান, গিরগিটির মতো সজাগ।

জিশানকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়ালেন শ্রীধর। ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘ওয়েলকাম, জিশান—ওয়েলকাম…।’

জিশান মানুষটার দিকে একবার তাকাল শুধু—কোনও কথা বলল না। লোকটার ফরসা মসৃণ মুখ দেখে মনে হচ্ছিল সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করা এক কুৎসিত ভাস্কর্য।

শ্রীধরের দুপাশের দুটো চেয়ারে বসেছিল দুজন পুরুষ। ডানদিকে যে বসেছিল তার বয়েস পঞ্চাশ-টঞ্চাশ গোছের হবে। তামাটে রং, মাথায় টাক, চোখে চশমা, ভাঙা চোয়াল, থুতনিতে সামান্য দাড়ি।

আর শ্রীধর পাট্টার বাঁ-দিকের লোকটির বয়েস প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। মাঝারি রং, অসম্ভব রোগা, মাথার সাদা চুলগুলো এলোমেলো—দেখে মনে হয় চিরুনির সঙ্গে ওদের বহুকাল দেখা নেই। লম্বা খাড়া নাক, চোখে সরু ফ্রেমের চশমা, নাকের নীচে পাতলা সাদা গোঁফ।

দুজন মানুষকে দুরকম দেখতে হলেও ওদের মধ্যে একটা মিল খুঁজে পেল জিশান : দুজনের চোখেই ঘুম-ঘুম ভাব।

হঠাৎই হাততালি দিলেন শ্রীধর—পরপর দুবার। হাসলেন। ছড়া কেটে বললেন, ‘এসো, জিশান—গুড বয়/করো এদের সঙ্গে পরিচয়।’

হাততালির শব্দেই শ্রীধরের দিকে মুখ ফিরিয়েছিল জিশান। শ্রীধর টাকমাথা লোকটির দিকে হাতের ইশারা করে বললেন, ‘গণপত আচারিয়া। আমাদের সিন্ডিকেটের দু-নম্বর সায়েন্টিস্ট। গ্রেট ইনভেন্টর। তবে…’ এবার বাঁ-দিকের মানুষটার দিকে ইশারা করে : ‘ইনি হলেন আমাদের এক নম্বর সায়েন্টিস্ট। মনসুখ চক্রপাণি। গ্রেট, গ্রেটার, গ্রেটেস্ট ইনভেন্টর। নিউ সিটির বিজ্ঞানদেবতা।

‘এই দুজনের কাছে, জিশান, সবরকম কোশ্চেনের আনসার রয়েছে। তাই ডক্টর আচারিয়াকে আমি ”কোশ্চেন” বলে ডাকি, আর প্রফেসর চক্রপাণির আমি নাম দিয়েছি ”আনসার”। ওঁরা দুজন যদি একজোট হন তা হলে সব কোশ্চেনেরই আনসার পাওয়া যায়। তাই সংক্ষেপে ওঁদের আমি ”কিউ” আর ”এ” বলে ডাকি…।’

.

১২.

কয়েক সেকেন্ড থামলেন শ্রীধর। তারপর একটা লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, ‘যে-ফেনোমেনাল ফাইটারের কথা আপনাদের বলছিলাম ডক্টরস—এই সেই জিশান পালচৌধুরী…।’

চশমার কাচের পিছন থেকে দু-জোড়া চোখ জিশানকে দেখতে লাগল। সে-চোখে খানিকটা কৌতূহল, খানিকটা বিস্ময়।

কিউ উঠে দাঁড়ালেন চেয়ার ছেড়ে, বললেন, ‘হাই, জিশান।’

জিশান ডানহাতটা খানিকটা তুলল শুধু—কোনও কথা বলল না।

এ একবার হাই তুললেন। তারপর বসে-বসেই বললেন, ‘নাইস টু মিট য়ু—।’

জিশান আবার হাত তুলল, হাসল। বলল, ‘থ্যাংকস। হাউ ডু য়ু ডু?’

পকেট থেকে একটা ফোন বের করলেন শ্রীধর। চেহারা দেখে জিশানের মনে হল বস্তুটা স্যাটেলাইট ভিডিয়োফোন। সেটা অন করে শ্রীধর চাপা গলায় কথা বললেন। তারপর অপেক্ষা করতে লাগলেন।

অপেক্ষার একমিনিটও বোধহয় পুরোপুরি কাটেনি, হলঘরের অন্যপ্রান্তে একটা দরজা খুলে গেল। কয়েকজন লোক ঘরে ঢুকল। সঙ্গে চারজন গার্ড। হাতে শকার—আত্মরক্ষা কিংবা আক্রমণের জন্য তৈরি।

যাদের জিশান ‘লোক’ বলে ভাবছিল তারা যে প্রায় সকলেই ওর চেনা সেটা ও বুঝতে পারল একটু দেরিতে। কারণ, তাদের চোখ-মুখ নানান জায়গায় ফুলে আছে, কোথাও-কোথাও রক্ত জমাট বেঁধে আছে, কারও-বা ভুরুর কাছে কেটে গিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।

রক্তের দাগ-টাগ থাকা সত্বেও জিশান প্রথমে সেই অফিসারকে চিনতে পারল। কাল রাতে সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুমে অল-গ্লাস কিউবিকলের ভেতরে আর্ক কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে যে বসেছিল। মাথায় তার কাঁচাপাকা চুল। কাল রাতে যে-চেহারাটা জিশানের বেশ লম্বা-চওড়া বলে মনে হয়েছি এখন আর ততটা লম্বা-চওড়া বলে মনে হল না। শ্রীধর পাট্টার অত্যাচার মানুষটাকে একইসঙ্গে অনেক খাটো, অনেক ভঙ্গুর, আর অনেক নমনীয় করে দিয়েছে।

দ্বিতীয়জন আনমোল। জিশানের কাল রাতের মেকাপম্যান। ওর ভুরুর কাছে অনেকটা জায়গা কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। তাই জিশানের ওকে চিনতে একটু বেশি সময় লেগেছে।

আনমোলের চোখে শূন্য দৃষ্টি। স্থিরভাবে ঘরের একটা আলোর ফিক্সচারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

তৃতীয়জনকে চিনতে পারার পরই একটা জোরাল ধাক্কা খেল। পান্ডা। ওর ঠোঁটের বাঁ-দিকটা ফুলে আছে। কালচে হয়ে রক্ত জমে আছে। ডানচোখটার অবস্থাও একইরকম। ফুলে উঠে চোখটা প্রায় বুজে গেছে। চোখের ওপরটা আর পাশটা নীল হয়ে আছে।

মুখে এতরকম ‘কারুকাজ’ থাকা সত্বেও পান্ডাকে জিশানের চিনতে ততটা সময় লাগেনি। কারণ, মানুষটা চঞ্চলভাবে এপাশ-ওপাশ তাকাচ্ছিল। জিশানকে লক্ষ করামাত্রই ও জিশানের দিকে অনেকক্ষণ স্থির নজরে তাকিয়ে থেকেছে। তারপর ঠোঁট জোর করে টেনে লম্বা করে সামান্য হাসি ফুটিয়ে তোলারও চেষ্টা করেছে।

আশ্চর্য মানুষ বটে! সামনে খোদ শ্রীধর পাট্টা হাজির—তবুও কোনও ভয়ডর নেই।

ওরা তিনজন ছাড়াও একজন আহত যুবক ওদের সঙ্গে ছিল। জিশান তাকে চিনতে পারল না।

হঠাৎই পান্ডা খসে পড়ে গেল মেঝেতে।

সঙ্গে-সঙ্গে দুজন গার্ড ঝুঁকে পড়ে ওকে ঝটকা মেরে টেনে তুলল। আবার দাঁড় করিয়ে দিল।

পান্ডা দাঁড়িয়ে রইল বটে, কিন্তু ওর দেহটা সামান্য নড়তে লাগল।

অন্য সময় হলে জিশান ভাবত পান্ডা নেশা করেছে। কিন্তু এখন ওর মনে হল, পিস ফোর্সের গার্ডরা পান্ডাকে অসম্ভব মারধোর করেছে। তাই ও ঠিকভাবে দাঁড়াতেও পারছে না।

‘জিশান—!’ হঠাৎই চেঁচিয়ে ডেকে উঠলেন শ্রীধর পাট্টা।

ডাকটা শোনামাত্রই গার্ডরা কেমন যেন অ্যাটেনশানের ভঙ্গিতে চলে গেল। কিন্তু জিশান শুধু স্লো মোশানে চোখ ফেরাল টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মার্শালের দিকে।

‘জিশান, কাল রাতে তুমি ক্যাম্পাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছিলে, তাই না?’

প্রশ্নটা শুনে জিশানের হঠাৎই মনে হল, শ্রীধর এখনও এই প্রশ্নটার সুনিশ্চিত উত্তর পাননি। এই চারজন মানুষের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে শ্রীধর যদি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেন তা হলে জিশানকে আর এই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতেন না। সুতরাং জিশান বুঝতে পারল ওর উত্তর কী হওয়া উচিত।

একইসঙ্গে ও ভেবে দেখল, শ্রীধর কতটা খবর পেয়েছেন বা পাননি তার ওপরে ওর উত্তরটা নির্ভর করছে না। ও যদি বলে, হ্যাঁ, ও কাল রাতে জিপিসি ছেড়ে বেরিয়েছিল তা হলে আনমোল, পান্ডাদের ওপরে টরচার আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে। বরং উলটো উত্তরটাই সঠিক উত্তর: না, ও ক্যাম্পাস ছেড়ে বেরোয়নি। শ্রীধরের নলেজ বেসের স্টেটাসের সঙ্গে এই উত্তরটার নড়চড় হওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই।

জিশান জবাব দিল, ‘না, আমি ক্যাম্পাস থেকে বেরোইনি।’

ঘরের সিলিং-এর দিকে মুখ তুলে মিহি গলায় হেসে উঠলেন শ্রীধর। তারপর মুখ নামিয়ে তাকালেন জিশানের দিকে। ভুরু উঁচিয়ে ব্যঙ্গের সুরে জিগ্যেস করলেন, ‘তাই? বেরোওনি? লক্ষ্মীছেলে হয়ে ছিলে? ঘুমু-ঘুমু করছিলে?’

জিশান চুপ করে রইল। ভাবতে চেষ্টা করল, এরপর শ্রীধর কোন পদক্ষেপ নেবেন।

শ্রীধর পাট্টা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালেন। ঘাড় ঘুরিয়ে জিশানের দিকে একবার দেখলেন, তারপর তাকালেন পান্ডাদের দিকে। চিবিয়ে-চিবিয়ে বললেন, ‘এই চারটে লক্ষ্মীছাড়া জানোয়ারও একই কথা বলছে। অথচ এদের একজনের ছবি ই-ল্যান্ডের ক্লোজড সার্কিট টিভির ফুটেজে ধরা পড়েছে। তা ছাড়া কাল রাতে গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর চারটে সারভেইল্যান্স জোন কী কারণে যেন সাডেনলি ডি-অ্যাক্টিভেটেড হয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটা খুব গোলমেলে। আপনারা কী বলেন, এ এবং কিউ?’ মনসুখ চক্রপাণি আর গণপত আচারিয়ার দিকে মুখ ফিরিয়ে শেষ প্রশ্নটা করলেন শ্রীধর পাট্টা।

ওঁরা দুজনে একইসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘অফ কোর্স গোলমেলে—সাসপিশাস।’

সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন শ্রীধর। পান্ডাদের দিকে বেশ কয়েক পা এগিয়ে গেলেন। জিশানের দিকে একবার ফিরে তাকালেন। তারপর আবার এগোলেন। একেবারে পান্ডার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। এবং কোনওরকম ভূমিকা ছাড়াই পান্ডার গালে সপাটে এক থাপ্পড় কষালেন।

বিকট শব্দ হল। পান্ডা ছিটকে পড়ে গেল মার্বেলের মেঝেতে। কিন্তু ওর মুখ থেকে কোনও যন্ত্রণার শব্দ বেরোল না।

শ্রীধরের হাতে বোধহয় রক্ত-টক্ত লেগে গিয়েছিল। তাই সামনে দাঁড়ানো একজন গার্ডের য়ুনিফর্মে হাতটা ঘষে-ঘষে মুছলেন। বললেন, ‘এক্ষুনি গিয়ে য়ুনিফর্মটা পালটে নাও—।’

সঙ্গে-সঙ্গে অ্যাবাউট টার্ন করে গার্ড চলে গেল।

পান্ডা তখনও মেঝেতে পড়ে ছিল। গালে আলতো করে হাত বোলাচ্ছিল। আর ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে ছিল শ্রীধরের দিকে। শুধু শ্রীধরেরই দিকে।

শ্রীধর সেই ঠান্ডা দৃষ্টি সহ্য করতে পারলেন না। একটা নোংরা গালাগাল দিয়ে বুটের এক লাথি কষিয়ে দিলেন পান্ডার পাঁজরে।

সংঘর্ষের শব্দ হল। পান্ডার শরীরটা ভাঁজ খেয়ে গেল আঘাতে। কিন্তু না—এত সত্বেও ওর মুখ থেকে কোনও শব্দ বেরোল না। কুঁকড়ে যাওয়া শরীরটাকে খানিকটা সোজা করে ও আবার তাকিয়ে রইল শ্রীধরের দিকে।

সেই অভিব্যক্তিহীন ঠান্ডা দৃষ্টির সামনে পড়লে কেমন যেন অস্বস্তি হয়। জিশান দেখল, শ্রীধর পাট্টা চোখ সরিয়ে নিলেন পান্ডার দিক থেকে।

এই ছোটখাটো দুর্বল মাতাল মানুষটার কী অবিচল নি:শব্দ প্রতিরোধ! ওর দৃষ্টিতে জিশান যেন একইসঙ্গে দেখতে পেল ঘৃণা আর প্রতিবাদ।

সত্যি, জিশানকে ওরা কীভাবে আগলে রেখেছে! দু-হাতের তালুর আড়ালে নিশ্চিন্তে স্থির হয়ে থাকা জ্বলন্ত প্রদীপের শিখার মতো। হাত দুটো আঘাতে-আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেও তাদের আড়ালে প্রদীপের শিখা অবিচল, অমলিন।

মনে-মনে পান্ডাদের সেলাম জানাল জিশান। মানুষগুলো এত সয়েছে ওর জন্য! এত!

শ্রীধর পকেট থেকে ছোট্ট শিশি বের করলেন। ওপরদিকে মুখ তুলে হাঁ করলেন। তারপর শিশি থেকে তিন ফোঁটা তরল মুখের ভেতর ঢেলে দিলেন।

জোরে-জোরে শ্বাস টানলেন শ্রীধর। জিভের ডগাটা দু-ঠোঁটের ফাঁকে চট করে এপাশ-ওপাশ নাড়লেন। তারপর কাঁধে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে নতুন তেজে ফিরে এলেন জিশানের কাছে।

‘জিশান, তুমি সত্যি কথা বলছ কি না সেটার জন্যে আমি একটা ছোট্ট এক্সপেরিমেন্ট করব। এই এক্সপেরিমেন্টটা কিউ অ্যান্ড এ-র ডিজাইন। মানে, ওই…’ হাত তুলে দুই বিজ্ঞানীর দিকে দেখালেন শ্রীধর : ‘…আচারিয়া আর চক্রপাণির ইনভেনশান। এই এক্সপেরিমেন্টটার মজা হচ্ছে এতে তোমার কোনও ফিজিক্যাল পেইন হবে না। য়ু ওন্ট বি হার্ট। য়ু উইল রিমেইন ইন গুড হেলথ—অ্যান্ড ইন ওয়ান পিস। কিন্তু…না:, থাক—বলব না। সে তুমি দেখতেই পাবে। এই ”কিন্তু”টাই এক্সপেরিমেন্ট। নাউ গেট রেডি অ্যান্ড বি স্টেডি…।’ মোলায়েম হেসে কথা শেষ করলেন শ্রীধর পাট্টা।

তারপরই চোখের পলকে ঘুরে দাঁড়ালেন, তাকালেন পান্ডাদের দিকে। একজন গার্ডকে ইশারা করে বললেন, ‘ওদের নিয়ে যাও—যার-যার ডিউটি করার জন্যে ছেড়ে দাও। আর ওদের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দাও। আমি তোমার বসকে ক্লিয়ারেন্স কোড জানিয়ে দিচ্ছি…।’

পকেট থেকে আবার স্যাটেলাইট ভিডিয়োফোন বের করলেন। অন করে কার সঙ্গে যেন কথা বললেন। তারপর গার্ডদের দিকে ইশারা করে মাথা নাড়তেই ওরা পান্ডা, আনমোলদের রুক্ষভাবে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে চলে গেল।

জিশান লক্ষ করল, ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত পান্ডা জিশানের চোখে তাকিয়ে রইল।

বিজ্ঞানী দুজন জিশানের কাছাকাছি এগিয়ে এলেন। নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় কীসব আলোচনা করতে লাগলেন।

শ্রীধর ফোনে আবার কথা বলছিলেন। সংক্ষিপ্ত এবং তীক্ষ্ণ উচ্চারণে কাউকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। নির্দেশ দেওয়া শেষ হওয়ার মিনিট তিন-চারেকেরই মধ্যেই ঘরে ছ’জন গার্ড ব্যস্তভাবে ঢুকে পড়ল। তাদের পিছন-পিছন চারজন লোক—তারা একটা বড়সড় ভারী মেটাল টপ কাঠের টেবিলকে শূন্যে ভাসিয়ে বয়ে নিয়ে আসছে।

টেবিলটা ঘরের একপ্রান্তে মাঝামাঝি রাখা হল। টেবিল থেকে ঘরের তিনটে দেওয়ালেরই দূরত্ব অন্তত দশফুট।

চারজন টেবিল-বাহক ঘর ছেড়ে চলে গেল। ছ’জন গার্ড টেবিলটাকে অর্ধচন্দ্রের ঢঙে ঘিরে দাঁড়াল। কোমর থেকে শকার খুলে তরোয়ালের মতো উঁচিয়ে ধরল।

জিশানের মনে হচ্ছিল, কোনও একটা নাটকের শোয়ের জন্য স্টেজ তৈরি করা হচ্ছে, তার ওপরে প্রপস সাজানো হচ্ছে। শুধু কুশীলবদের স্টেজে ঢুকে পড়াটাই বাকি।

এ এবং কিউ তখন নিজেদের মধ্যে বিজ্ঞানের জটিল কোনও বিষয় নিয়ে হাত-মুখ-চোখ নেড়ে গভীর আলোচনা করছেন। এবং মাঝে-মাঝেই হাই তুলছেন।

শ্রীধর পাট্টা ওঁর বাঁ-হাতের নখ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিলেন। সেই অবস্থাতেই বললেন, ‘জিশান, এবার তোমাকে টি-শার্টটা খুলে ফেলতে হবে।’

জিশান চমকে উঠে শ্রীধরের দিকে তাকাল। এ কী বলছেন শ্রীধর? গায়ের জামা খুলে ফেলতে হবে?

শ্রীধর হাসলেন, ছন্দবাণীতে বললেন, ‘খোলো, খোলো। এবার তোমার শো হবে সোলো—।’

শ্রীধর যে অধৈর্য হয়ে পড়েছেন সেটা বোঝা গেল ওঁর কথা বলার ভঙ্গিতে। কারণ জিশানকে লক্ষ্য করে শব্দগুলো উচ্চারণ করার সময় তিনি ডানহাতের দু-আঙুলে টুসকি দেওয়ার চটাচট শব্দ করলেন।

জিশান অবাক চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে পোলো নেক টি-শার্টটা খুলতে শুরু করল।

শ্রীধর এবার বিজ্ঞানী দুজনের দিকে তাকালেন। ভুরু উঁচিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘আপনারা দুজন কি তৈরি?’

‘ইয়েস, স্যার।’ চটপট জবাব দিলেন চক্রপাণি। আচারিয়ার দিকে তাকালেন। এবং ঘুম তাড়াতে আঙুল দিয়ে দু-চোখ রগড়ে নিলেন।

আচারিয়া সাদা-কালো চেকশার্ট পরেছিলেন। সঙ্গে চকোলেট রঙের ঢোলা ট্রাউজার্স। তারই পকেটে ব্যস্তভাবে হাত ঢোকাতে-ঢোকাতে বললেন, ‘হ্যাঁ, স্যার, আমরা তৈরি—।’

জিশানের খারাপ লাগল। বাবার কথা মনে পড়ল। শ্রীধর পাট্টার মতে নিউ সিটির এক নম্বর এবং দু-নম্বর সায়েন্টিস্ট যথাক্রমে একনম্বর এবং দু-নম্বর চাকরের মতো আচরণ করছে! শিক্ষা-দীক্ষা বিজ্ঞান এঁদের মধ্যে মর্যাদাবোধ তৈরি করতে পারেনি।

গণপত আচারিয়া পকেট থেকে একটা কৌটো বের করে নিলেন। তারপর সেটা উঁচিয়ে ধরে শ্রীধরকে দেখালেন। জিশানও সেটা দেখল।

দুই কি আড়াই ইঞ্চি ব্যাসের একটা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কৌটো। উচ্চতায় ইঞ্চি চারেক হবে। কৌটোর ভেতরে চকচকে অথচ স্বচ্ছ একটা তরল। আলো পড়ে ধাতুর মতো ঝিকমিক করছে। অথচ পারদ নয়—তার তুলনায় ঘনত্ব অনেক কম। কোনও তরলের এরকম রং জিশান আগে কখনও দেখেনি।

ওর টি-শার্ট খোলা হয়ে গিয়েছিল। সেটা মেঝেতে ফেলে দিল। খালি গায়ে দাঁড়িয়ে শীতাতপের প্রভাবে ওর শীত করতে লাগল।

জিশান অপেক্ষা করতে লাগল। শ্রীধরের এর পরের নির্দেশ কী হবে কে জানে! ওর কর্ডের প্যান্টটার ভাগ্যেও কি টি-শার্টের পরিণতি লেখা আছে?

সেটা বোঝা গেল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই।

শ্রীধর পাট্টা জিশানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। জিশানের শরীর পরখ করছিলেন। ফরসা, সুঠাম দেহ। বুকের মাঝখানটা সামান্য লোমশ। কিন্তু তার জন্য উদ্ধত পেশিগুলো দেখতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বোঝাই যাচ্ছে, এ-দেহ অনেক লড়াই দেবে।

শ্রীধরের মনে-মনে নেওয়া ‘পরীক্ষা’য় জিশান বোধহয় পাশ করল। কারণ, শ্রীধর ছোট্ট করে সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন এবং হাসলেন।

তারপরই বললেন, ‘এবার কর্ডের প্যান্টের পালা। খোলো, জিশান!’ বারদুয়েক শ্বাস নিয়ে বিপ্লবের জিগির দেওয়ার ঢঙে বললেন, ‘কর্ডের প্যান্ট, দূর হঠো!’

জিশান মনে-মনে নিজেকে বলল, ‘ধৈর্য হারালে চলবে না। শান্ত হও। শান্ত থাকো। এখনও ধৈর্য হারানোর সময় আসেনি। ধৈর্য তুমি তখনই হারাবে যখন প্রতিপক্ষকে অনেক-অনেক লড়াই দিতে পারবে…।’

জিশান মুখের ভাব সংযত রেখে প্যান্টের বোতামে হাত দিল। তখনই লক্ষ করল, চক্রপাণি পকেট থেকে একজোড়া হালকা নীল রঙের গ্লাভস বের করে নিলেন। স্বচ্ছ। রাবার লেটেক্স-এর তৈরি। জিশানের দিকে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে গ্লাভস পরে নিতে লাগলেন। দুবার হাই তুললেন।

জিশানের ভেতরে হেনস্থার ঘৃণা অসংখ্য বুদ্বুদ হয়ে উথলে উঠতে লাগল। কিন্তু ও চোয়াল শক্ত করে প্যান্টের বোতাম খুলতে লাগল।

শ্রীধর ডানহাত শূন্যে তুলে ম্যাজিশিয়ানদের মতো একটা ইশারা করলেন। বোঝা গেল ইশারাটা টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের জন্য। ওদের চারজন পলকে গতিশীল হল। এগিয়ে আসতে লাগল জিশানের দিকে।

বাকি দুজন গার্ড টেবিলের গায়ে লাগানো লুকোনো কোনও বোতাম টিপল। সঙ্গে-সঙ্গে চারটে স্টেইনলেস স্টিলের ব্যান্ড টেবিলের মেটাল টপ ফুঁড়ে গজিয়ে উঠল। ব্যান্ডগুলো দেখতে ওলটানো ‘ইউ’ অক্ষরের মতো।

জিশান কর্ডের প্যান্টটা খুলে মেঝেতে ছুড়ে দিল। খানিকটা অবাক চোখে টেবিলের চারটে স্টিল ব্যান্ডকে দেখতে লাগল। ওর শরীরের সঙ্গে এই বিশেষ টেবিলটার সম্পর্ক ও ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।

জিশানের জাঙ্গিয়া পরা লম্বা দেহটার দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইলেন শ্রীধর। দেখলেন এ এবং কিউ-র দিকে। এ তখন গ্লাভস পরে তৈরি। তৈরি জিশানকে ঘিরে থাকা চারজন গার্ডও।

শ্রীধর হাসলেন। চাপা গলায় বললেন, ‘স্টার্ট অপারেশান—।’

সঙ্গে-সঙ্গে চারজন গার্ড একরকম ছিটকে চলে এল জিশানের কাছে। নিমেষের মধ্যে দুজন ওর হাত চেপে ধরল। আর বাকি দুজন মেঝেতে থেবড়ে বসে পড়ে ওর পা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল।

জিশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। গার্ডদের বাঁধন ছাড়ানোর এতটুকুও চেষ্টা করল না। প্রথমত, ও দেখতে চাইছিল ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়। দ্বিতীয়ত, ও গার্ডদের কোমরে ঝোলানো শকারগুলোর কথা ভোলেনি।

দু-হাতের কবজিতে এবং দু-পায়ের গোড়ালির গাঁটের ঠিক ওপরে জিশান গার্ডদের মুঠোর চাপ অনুভব করছিল। ও তাকিয়ে ছিল এ আর কিউ-র দিকে। দেখল, কিউ-র হাতের ঝিকিমিকি তরলের স্বচ্ছ কৌটোটা চালান হয়ে গেল এ-র গ্লাভস পরা হাতে। এ কৌটোটা শূন্যে উঁচিয়ে ধরে চোখ সরু করে কী যেন পরখ করতে লাগলেন। কৌটোর তরলটা মাঝে-মাঝে নাড়ছিলেন, এবং আপনমনেই বিড়বিড় করে কীসব বলছিলেন।

শ্রীধর পাট্টা কোমরে দু-হাত রেখে ঠোঁটে সামান্য তেরছা হাসি ফুটিয়ে জিশানকে দেখছিলেন। এ-র দিকে নজর ফিরিয়ে মিহি অথচ রুক্ষ গলায় বললেন, ‘সময় নষ্ট না করে কাজ শুরু করুন—।’

এ চমকে শ্রীধরের দিকে তাকালেন। শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘করছি, স্যার, করছি—।’

এ কৌটোটা হাতে করে কিউ-কে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন জিশানের ঠিক পিছনে। জিশান ওঁদের আর দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টাও করল না।

কৌটোর ঢাকনা খুললেন এ। কৌটো কাত করে খানিকটা তরল গ্লাভস পরা হাতে ঢেলে নিলেন। কৌটো আর ঢাকনা কিউ-র হাতে ধরিয়ে দিলেন। তারপর হাতের তরল তেল মাখানোর মতো করে জিশানের পিঠে মেখে দিতে লাগলেন।

জিশান অবাক হলেও চুপ করে রইল। পিঠে মাখিয়ে দেওয়া তেলটা যে বেশ ঠান্ডা সেটা অনুভবে টের পেল।

ঘরে কোনও শব্দ নেই। শুধু জিশানের নগ্ন পিঠে দস্তানা পরা একটা হাতের তেল মাখানোর চাপড়ের শব্দ।

শ্রীধর পাট্টা পাথরের মূর্তির মতো স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ব্যাপারটা লক্ষ করছিলেন আর কোনও কিছু ঘটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

জিশানের ঘাড়, পিঠ, কোমরের পিছনে জাঙ্গিয়ার সীমারেখা পর্যন্ত তেল মাখানো হয়ে গিয়েছিল। তাই এ থামলেন। তাকালেন পাশে দাঁড়ানো কিউ-র দিকে।

ওঁদের মধ্যে নীরবে কী কথা হল। কিউ তরলের কৌটো এবং ঢাকনা এ-র হাতে তুলে দিলেন। তারপর নিজের পকেট থেকে একজোড়া নীলচে গ্লাভস বের করে হাতে পরে নিলেন। এ-র কাছ থেকে তরল ঢেলে নিলেন হাতে। এবং মেঝেতে উবু হয়ে বসে জিশানের পায়ের পিছনদিকটায় মাখাতে লাগলেন।

তেল মাখানোর সুবিধের জন্য জিশানের পা ধরে থাকা দুজন গার্ড তাদের হাতের বাঁধন সরিয়ে নিল।

জিশানের অস্বস্তি হচ্ছিল। একজন নামি বিজ্ঞানী, সিন্ডিকেটের দু-নম্বর সায়েন্টিস্ট, ওর পায়ে এভাবে ‘তেল’ মাখাচ্ছেন। কিন্তু পরক্ষণেই ওর মনে হল গণপত আচারিয়া দু-নম্বর সায়েন্টিস্ট নয়, ‘দু-নম্বরি’ সায়েন্টিস্ট। সেইজন্যই শ্রীধর পাট্টার পায়ে উনি তেল মাখান—দিন-রাত। জিশানের পা শ্রীধরের চেয়ে এমন কিছু খারাপ নয়! সুতরাং জিশান কেন অস্বস্তি পাবে?

কিন্তু মনে-মনে যতই যুক্তি খাড়া করুক না কেন, জিশান কিছুতেই পুরোপুরি সহজ হতে পারছিল না।

তরল মাখানোর কাজ শেষ হলে কিউ সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। এ আর কিউ জিশানের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরে গেলেন। তারপর ওঁরা তাকালেন শ্রীধর পাট্টার দিকে। যে-দৃষ্টির অর্থ, আমাদের কাজ শেষ।

‘থ্যাংক য়ু—’ বললেন শ্রীধর এবং আঙুলে তুড়ি মেরে গার্ডদের ইশারা করলেন।

চারজন গার্ডের একজন জিশানের খুব কাছে এসে ছোট্ট করে বলল, ‘ওই টেবিলটায় গিয়ে শুয়ে পড়ো…’ তারপরই ফিসফিস করে বলল, ‘প্লিজ…।’

জিশান চমকে চোখ ফেরাল গার্ডের চোখে। ও কি ভুল শুনছে? লোকটা বলছে, ‘প্লিজ…!’

গার্ডের চোখে একচিলতে ‘বন্ধু’র ছোঁয়া। তার সঙ্গে সামান্য শ্রদ্ধাও কি টের পাওয়া যাচ্ছে না?

জিশান একইরকম দৃষ্টি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। তারপর চটপট পা ফেলে বাধ্য ছেলের মতো বিশাল টেবিলটার ওপরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তখনই ও লক্ষ করল, এ এবং কিউ ঘন-ঘন হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন।

চারজন গার্ড টেবিলের চারদিক থেকে এগিয়ে এল। কী এক কায়দায় চারটে স্টিল ব্যান্ড জিশানের হাতে-পায়ে এঁটে দিল। জিশান লক্ষ করল, ওই চারজন গার্ডও কখন যেন এ এবং কিউ-র মতো হাতে লেটেক্স-এর দস্তানা পরে নিয়েছে।

জিশান বন্দি অবস্থায় ইংরেজি ‘এক্স’ অক্ষরের মতো চিত হয়ে পড়ে রইল টেবিলে। ঘরের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে রইল। সিলিং-এর ধপধপে সাদা কারুকাজ দেখতে লাগল। উজ্জ্বল আলোর আধুনিক জরিপ করতে লাগল।

এইসব শৌখিন ঘর আর তার আধুনিক সরঞ্জাম ওল্ড সিটির অভাবী মানুষগুলোর কল্পনার বাইরে। বস্তির ওই ঘরে মিনি ছোট্ট শানুকে নিয়ে কী কষ্টেই না দিন কাটাচ্ছে! মিনিকে ও গত সপ্তাহেই ওর প্রাইজ মানি থেকে চল্লিশ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। সিন্ডিকেট টাকা পাঠানোর সব বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। কিন্তু…

সঙ্গে-সঙ্গে মনোহর সিং-এর কথা মনে পড়ল। হাসিখুশি সরল লোকটা এই দুনিয়ায় একা ছিল। না কোই আগে, না কোই পিছে/উপর আসমা, ধরতী নীচে। এখানে এসে জিশান, খোকন ওদের সঙ্গে লোকটার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর হয়ে গেল বলেই জিশানরা এখন মনে-মনে এত কষ্ট পাচ্ছে। ওই গর্তের ভেতরে শেষ নিশ্বাস ফেলার সময় মনোহরেরও নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হয়েছে।

জিশান নানান চিন্তায় বিভোর ছিল। হঠাৎই খেয়াল করল, এ আর কিউ দস্তানা পরা হাতে ওর বুকে তেল মাখাচ্ছেন।

কিন্তু কেন?

এই তেলের কী এমন গুণ? এই তেল কী এমন শাস্তি দিতে পারে? শ্রীধর বলছেন, এই শাস্তিতে কোনও ব্যথা লাগবে না, জিশানের কেটে-ছড়ে যাবে না, ‘য়ু উইল রিমেইন ইন গুড হেলথ—অ্যান্ড ইন ওয়ান পিস।’ তা হলে শাস্তিটা হবে কেমন করে?

জিশান অবাক হয়ে এইসব ভাবছিল আর দুই বিজ্ঞানী জিশানের বুকে, হাতে, পায়ে তেল মাখাচ্ছিলেন।

শ্রীধর কৌতুকের চোখে ব্যাপারস্যাপার লক্ষ করছিলেন। দুটো হাত বুকের কাছে আড়াআড়িভাবে রেখে টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। জিশানের অবাক ভাবটা বেশ আন্তরিকভাবে উপভোগ করছিলেন।

তেল মাখানো শেষ হয়ে গেল মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই। তেলের কৌটোটা দস্তানা পরা একজন গার্ডের হাতে ধরা ছিল। সেটা চেয়ে নিলেন আচারিয়া। তারপর তিনি আর চক্রপাণি জিশানের কাছ থেকে সরে দাঁড়ালেন। আচারিয়া শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমাদের কাজ শেষ, স্যার…।’

‘গুড। গুড—’ বিজ্ঞানী দুজনের দিকে দু-পা এগিয়ে এলেন শ্রীধর। হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে আচারিয়ার দিকে নজর ফেরালেন। চোখ নাচিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘সিনেমা শুরু হতে আর কতক্ষণ লাগবে?’

তেলের কৌটো পকেটে রেখে আচারিয়া টাকে আলতো করে হাত বোলালেন। নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললেন, ‘বড়জোর দশ মিনিট…।’

‘আর য়ু শিয়োর?’ ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন।

‘অফ কোর্স উই আর…।’ উত্তরটা দিলেন মনসুখ চক্রপাণি।

শ্রীধর ছোট্ট করে ‘হুঁ’ শব্দ করলেন। তারপর এদিক-ওদিক পায়চারি করতে শুরু করলেন। দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন গভীর কোনও চিন্তায় ডুবে আছেন।

কিউ এবং এ ওঁদের চেয়ারের কাছে ফিরে গেলেন, বসে পড়লেন।

চক্রপাণি চশমাটা চোখ থেকে খুলে ফেললেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে চশমার কাচ ঘষে-ঘষে মুছতে লাগলেন। এবং পরপর তিনবার হাই তুললেন।

আচারিয়া চক্রপাণির হাই তোলা দেখছিলেন এবং নিজের হাই ওঠার ঝোঁকটা প্রাণপণে চাপতে চেষ্টা করছিলেন।

হাই তুলতে-তুলতে মিহি জড়ানো গলায় এ কিউ-কে বললেন, ‘সাবজেক্টের রিঅ্যাকশানগুলো নোট করে নিন। সলিউশানটার ইমপ্রুভমেন্টে কাজে লাগবে।’

‘য়ু আর রাইট।’ বলে কিউ জামার বুকপকেট থেকে ছোট নোটবই আর পেন বের করে তৈরি হয়ে বসলেন।

সময় খুব ধীরে-ধীরে কাটছিল। ঘরে কোনও শব্দ নেই। শুধু বুকের ভেতরে হৃৎপিণ্ডের ধকধক শব্দটা জিশানের কানে ঘড়ির কাঁটার শব্দ বলে মনে হচ্ছিল। গণপত আচারিয়ার ‘দশ মিনিট’ কথাটা জিশান শুনতে পেয়েছিল। তাই ও ধৈর্য ধরে সময়ের এক-একটা স্তর ডিঙোতে লাগল।

সাড়ে ন’ মিনিটের মতো সময় পেরোতেই শ্রীধর পাট্টা জিশানের টেবিলের কাছে পায়ে-পায়ে এগিয়ে এলেন। চিত হয়ে থাকা অসহায় জিশানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটে হেসে বললেন, ‘সিনেমাটা আমি ভালো করে পুরোটা দেখতে চাই। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু মিস ইভন আ সিঙ্গল মোমেন্ট অফ দ্য শো—।’

জিশান কোনও উত্তর দিল না। শুধু স্থির চোখে শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখ জ্বালা করছিল। ক্লান্তিতে হাই উঠতে চাইছিল।

কিছুক্ষণ পর ব্যাপারটা হঠাৎ করেই শুরু হল।

জিশানের মনে হল, অণু-পরমাণু মাপের সূক্ষ্ম পিঁপড়ে—অসংখ্য পিঁপড়ে —ওকে সূক্ষ্ম কামড়ের হুল ফোটাতে শুরু করেছে। বলতে গেলে হালকা চুলকুনির মতো হয়ে ব্যাপারটা শুরু হল।

প্রথম-প্রথম জিশানের আরাম লাগছিল, কিন্তু দশ-পনেরো সেকেন্ড পার হতেই চিড়বিড়ে চুলকুনি জিশানকে অস্থির করে তুলল। কিন্তু তা সত্বেও ও দাঁতে দাঁত চেপে ওই অদ্ভুত চুলকুনি সহ্য করতে লাগল।

ব্যাপারটা ক্রমেই তীব্রতায় বাড়তে লাগল। মিষ্টি এবং তীব্র চুলকুনি। তাতে কোনও জ্বালা নেই, কোনও যন্ত্রণা নেই। কিন্তু জায়গাটা চুলকোতে না পারার কষ্ট জিশানকে ক্ষিপ্ত করে তুলল। ওর হাত-পা শক্ত বাঁধনে বাঁধা জেনেও ও হাত-পায়ের বাঁধন ছাড়াতে চাইল। তাতে যা হওয়ার তাই হল। স্টিল ব্যান্ডের সঙ্গে ঘষটানিতে ওর কবজি এবং গোড়ালির গাঁট ছড়ে যেতে লাগল।

শ্রীধর পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে জিশানের দশাবিপর্যয় লক্ষ করছিলেন আর মুচকি-মুচকি হাসছিলেন।

জিশানের দেহটা ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে শূন্যে উঠছিল আর শব্দ করে মসৃণ টেবিলে আছড়ে পড়ছিল। একইসঙ্গে ও মাথা ঝাঁকাচ্ছিল এপাশ-ওপাশ। আর ওর হাতের আঙুলগুলো বারবার বাতাস আঁকড়ে ধরছিল। মনে হচ্ছিল, ও বাতাসের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে, আপ্রাণ বাঁচতে চেষ্টা করছে।

জিশান পাগলের মতো ছটফট করছিল বটে কিন্তু মুখ দিয়ে কোনও আর্ত শব্দ করতে চাইছিল না। কারণ, শ্রীধর পাট্টার সামনে এই প্রায়-উলঙ্গ অবস্থায় অসহায়ভাবে চিৎকার করাটা প্রায় প্রাণভিক্ষার কাতর অনুনয়ের মতো শোনাতে পারে। সেটা জিশান কিছুতেই করতে চায় না। তাই ও প্রাণপণে আত্মসম্মান রক্ষার চেষ্টা করছিল।

কিন্তু তা সত্বেও চাপা গোঙানির মতো একটা শব্দ জিশানের গলার ভেতর থেকে উথলে উঠছিল।

বিছুটিপাতা গায়ে ঘষলে কীরকম চুলকোয় জিশান জানে না। কিন্তু ও নিশ্চিতভাবে বলতে পারে, এই ঝিকিমিকি তরলের ক্ষমতা বিছুটিপাতার চেয়েও অনেক বেশি। কারণ জিশানের সর্ব অঙ্গে চুলকুনির এমনই ফুলঝুরি ছুটছিল যে, ওর মস্তিষ্ক ঠিক-ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারছিল না।

তবুও জিশান মিনি আর শানুর কথা ভাবতে লাগল।

শ্রীধর পাট্টা ওকে জিগ্যেস করলেন, ‘বাবু জিশান, কাল রাতে তুমি জিপিসির বাইরে বেরিয়েছিলে?’

যে-চিৎকার জিশান এতক্ষণ ধরে প্রাণপণে চেপে রেখেছিল সেটাই শ্রীধরের প্রশ্নের উত্তর হয়ে আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতো ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এল : ‘না! না! না! না! না!’

শ্রীধর চওড়া হাসলেন : ‘তুমি তা হলে কাল রাতে তোমার কোয়ার্টার ছেড়ে বেরোওনি?’

আবার ছিটকে বেরোল সেই লাভাস্রোত : ‘না-না-না-না-না!’

জিশান পান্ডার কথা ভাবছিল। ওর সেই অভিব্যক্তিহীন ঠান্ডা দৃষ্টি। যে-দৃষ্টিতে স্থির প্রতিজ্ঞা ঝিলিক মারছিল। অথচ ওর শরীর তখন অত্যাচারে ক্ষতবিক্ষত।

জিশান হিমশীতল চোখে শ্রীধরের দিকে তাকাল। মনে-মনে ভাবল, ও যেন বেরিয়ে এসেছে নিজের দেহের বাইরে। শূন্যে ভেসে বেড়াতে-বেড়াতে ও তাকিয়ে দেখছে নিজের ছটফটানো শরীরের দিকে। দেখছে শ্রীধরের অহঙ্কার। ওঁর ক্ষমতা আর প্রভুত্ব মেশানো বেপরোয়া অভিব্যক্তি।

নিজের অনুভূতির সুইচ অফ করে দিল জিশান। অন্তত অফ করে দিতে চেষ্টা করল। মনে-মনে ভাবল, আর কতক্ষণ এই অমানুষিক অবস্থা চলবে কে জানে!

দূরের টেবিলে বসে গণপত আচারিয়া জিশানের প্রতিটি প্রতিক্রিয়া খুঁটিয়ে লক্ষ করছিলেন আর নোট নিচ্ছিলেন। মাঝে-মাঝে চক্রপাণির সঙ্গে চাপা গলায় কীসব আলোচনা করছিলেন।

চক্রপাণি হঠাৎই এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘অ্যামেজিং এনডিয়োর‌্যান্স! আর কেউ এতটা সহ্য করতে পারত না…।’

আচারিয়া বললেন, ‘তা হলে কি আমাদের কেমিক্যালটা ততটা স্ট্রং হয়নি? কিন্তু আমরা নরম্যাল কোনও মানুষকে যে-অ্যামাউন্টের কেমিক্যাল অ্যাপ্লাই করে রেজাল্ট পাই জিশানকে তার অ্যাপ্রক্সিমেটলি থ্রি টাইমস অ্যাপ্লাই করেছিলাম। তাতেও তো দেখছি…।’

‘এখন এসব ডিসকাশন থাক—’ আচারিয়াকে থামিয়ে দিলেন চক্রপাণি। চাপা গলায় বললেন, ‘মার্শাল এসব কথা শুনলে প্রবলেম হতে পারে। বরং আমরা এই কনক্লুশানই জানাব যে, জিশান পালচৌধুরী নরম্যাল মানুষ নয়—ওর এনডিয়োর‌্যান্স ফ্যাক্টর অ্যাবনরম্যালি হাই। জিশান ইজ অ্যান একসেপশান…।’

চক্রপাণির কথায় সায় দিয়ে আচারিয়া চুপ করে গেলেন। তারপর কবজির ঘড়ির দিকে তাকালেন। ছোট্ট করে বললেন, ‘টাইম ইজ আপ—।’

এ-কথা বলার দশ-বারো সেকেন্ডের মধ্যেই জিশানের চুলকুনি কমতে লাগল। ও চোখ বুজে হাঁপাতে লাগল। ওর বুক ওঠা-নামা করতে লাগল। হাপরের শব্দ বেরোতে লাগল মুখ দিয়ে।

শ্রীধর পাট্টার মুখের সূর্যোদয়ের মুচকি হাসি মিলিয়ে গিয়েছিল। তার বদলে সূর্যাস্ত নেমে আসছিল। হিমশীতল ইস্পাতের প্রলেপ ছড়িয়ে পড়ছিল মুখের ওপরে।

হারতে শ্রীধরের ভালো লাগে না। কিন্তু নিতান্তই যদি হারতে হয় তা হলে পরমুহূর্ত থেকেই পরের লড়াইয়ের জন্য তৈরি হতেও জানেন তিনি।

সুতরাং শ্রীধর চোয়াল শক্ত করলেন। দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের দিকে ইশারা করলেন। বললেন জিশানের বাঁধন খুলে দিতে। তারপর ধীরে-ধীরে পা ফেলে আচারিয়া আর চক্রপাণির টেবিলের কাছে ফিরে গেলেন।

স্টিল ব্যান্ডের বাঁধন খুলে যেতেই জিশান টেবিলে উঠে বসল। মাথা ঝুঁকিয়ে হাঁপাতে লাগল। ওর শরীরে সামান্য জ্বালা-জ্বালা ভাব চিড়বিড় করছিল। ও কবজির ছড়ে যাওয়া জায়গার জ্বালা কমাতে কবজি দুটো কয়েকবার চেপে-চেপে ধরল, হাত বোলাল পায়ের গোড়ালির গাঁটের কাছটায়। হাত বুলিয়ে আর হাত চেপে শুশ্রূষা করতে চাইল। তারপর পাছায় ভর দিয়ে শরীরটাকে নব্বই ডিগ্রি ঘুরিয়ে টেবিল থেকে নেমে দাঁড়াল। লক্ষ করল, ওর ফরসা শরীর বেশ লালচে হয়ে গেছে।

জিশান শ্রীধরকে দেখছিল। লোকটা বোধহয় স্যাডিস্ট প্রকৃতির। কিন্তু আজ জিশান ওঁকে জেতার তৃপ্তি দেয়নি। লোকটার দিকে তাকিয়ে জিশানের ঘেন্নায় থুতু ফেলতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ও তা করল না। বরং ঠোঁটের কোণে একচিলতে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে শ্রীধরকে দেখতে লাগল। যেন বলতে চাইল, ‘তুমি কতদূর যেতে চাও? আমি তার চেয়েও বেশি দূর যাওয়ার ক্ষমতা রাখি।’

শ্রীধরের চোখে চোখ রেখে মেঝেতে পড়ে থাকা প্যান্ট আর টি-শার্টের কাছে গেল জিশান। শ্রীধরের দিকে তাকিয়েই ধীরে-ধীরে পোশাক পরে নিল। তারপর শ্রীধরের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ঠোঁটে সেই হাসির ছোঁয়া।

শ্রীধরের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো জিশানের হাসি দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত, জিশানকে চড়-থাপ্পড় মেরে হেনস্থা করে প্রতিশোধ নিত। কিন্তু শ্রীধর আশ্চর্য ধাতুতে গড়া।

জিশানের কাছে এগিয়ে এসে ডানহাত বাড়িয়ে দিলেন। ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে বললেন, ‘থ্যাংক য়ু ফর ইয়োর নাইস কোঅপারেশান। য়ু মে লিভ নাউ—।’

জিশান ঠোঁটের হাসিটা আরও একটু ছড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘য়ু আর ওয়েলকাম…।’

শ্রীধর দুজন গার্ডকে ইশারা করলেন। ওরা সঙ্গে-সঙ্গে জিশানের দুপাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা জিশানকে এসকর্ট করে জিপিসি-র কোয়ার্টারে পৌঁছে দেবে।

এতক্ষণ পর ঘুমের টান আর ক্লান্তিতে জিশান একটা হাই তুলল।

সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইলিং কাজটা বড় সহজ নয়। কম্পিউটারের মনিটরের দিকে তাকিয়ে ট্রাই-ডাইম হলোগ্রাম ইমেজগুলো দেখতে-দেখতে এই কথাটাই বারবার রঙ্গপ্রকাশের মনে হচ্ছিল।

নিউ সিটিতে জিশান পাল চৌধুরী আসার পর থেকে ওর যত ভিডিয়ো ফটো আর হলোগ্রাম ইমেজ তোলা হয়েছে তার সবটাই একটা ট্রাই-ডাইম মাইক্রোসিডি-তে রাইট করে সুপারগেমস কর্পোরেশন রঙ্গপ্রকাশকে দিয়েছে। রঙ্গপ্রকাশের কাজ হল সেই ভিডিয়ো খুঁটিয়ে দেখে জিশান পাল চৌধুরীর একটা সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল তৈরি করা।

ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস নিউ সিটির বিখ্যাত সাইকোঅ্যানালিস্ট। নিউ সিটির ‘সাইকোঅ্যানালিসিস সেন্টার’-এর চিফ সাইকোলজিস্ট। নিউ সিটির সিস্টেমের বিরুদ্ধে যারা সরাসরি কিংবা আড়ালে আওয়াজ তোলে তাদের সাইকোপ্রাোব করাটা রঙ্গপ্রকাশের প্রধান কাজের তালিকার মধ্যে পড়ে। সিন্ডিকেটের ‘ক্রাইম কন্ট্রোল’ ডিভিশন প্রায়ই রঙ্গপ্রকাশের সাহায্য চায়। এবং রঙ্গপ্রকাশ সাহায্য করেও থাকেন।

গত দু-সপ্তাহ ধরে জিশানের সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইলিং-এর কাজে ব্যস্ত তিনি। কম্পিউটারের পরদায় ওর ছবি বারবার দেখছেন। দেখছেন টু-ডাইমেনশন্যাল এবং হলোগ্রাম ভিডিয়ো ইমেজ। ভিডিয়ো ক্লিপগুলো কখনও ‘নরম্যাল’ স্পিডে দেখছেন, কখন আবার ‘স্লো’ কিংবা ‘ভেরি স্লো’ মোডে দেখছেন। ইচ্ছেমতো কোনও ফ্রেমকে ‘ক্লোজ-আপ’ মোডে দেখছেন কিংবা বেশ কয়েক গুণ ম্যাগনিফাই করে জিশানের চোখের কোণের ভাঁজ অথবা রোমকূপ পর্যন্ত পরখ করে নিচ্ছেন। আর সেই ভিডিয়োর মিছিল থেকে দরকার মতো ছবি ক্লিপ করে নতুন-নতুন ফাইলে স্টোর করে নিচ্ছেন।

তারপর সেই ফাইলের ছবি ও কথা আবার স্টাডি করছেন এবং কখনও-কখনও প্রিন্ট-আউট বের করছেন।

এইসব তথ্যের সঙ্গে নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি ও বিবেচনা কাজে লাগিয়ে জিশানের সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইলের রিপোর্ট তৈরি করছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। রিপোর্ট শেষ হলেই সেটা ‘কনফিডেনশিয়াল’ খামে ভরে তুলে দিতে হবে শ্রীধর পাট্টার হাতে। ওটা কিল গেমের প্রাোমোশনাল ভিডিয়ো ট্রেলার-এ ব্যবহার করা হবে। কিংবা হয়তো আরও কোনও কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে—সেটা একমাত্র শ্রীধর পাট্টাই ভালো করে জানেন।

ক্লান্তিতে ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল রঙ্গপ্রকাশের। অথচ দুশ্চিন্তায় ঘুম আসছিল না। দুশ্চিন্তার পেন্ডুলামটা মাথার ভেতরে দুলছিল। আর শব্দ হচ্ছিল, ‘ঢং-ঢং।’ সেই শব্দ রঙ্গপ্রকাশ ছাড়া আর কেউ শুনতে পাচ্ছিল না।

দুশ্চিন্তার কারণটা এখনও স্ত্রীকে খুলে বলেননি। আর ছেলে সিমানকে বলার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না! যেহেতু আজ, এই মুহূর্তে, যে-সংকটের মুখোমুখি রঙ্গপ্রকাশ দাঁড়িয়ে রয়েছেন তার উৎসে রয়েছে সিমান।

চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। দু-চোখ বুজে মাথাটা পিছনদিকে হেলিয়ে দিলেন। একটা বড় শ্বাস ছাড়লেন : ‘আ-আ-আ:!’

ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস নিউ সিটির কদরদান বিজ্ঞানী। ডক্টর মনসুখ চক্রপাণি আর ডক্টর গণপত আচারিয়া তাঁদের আবিষ্কার এবং গবেষণার জন্য শ্রীধর পাট্টার খুব প্রিয় ঠিকই, কিন্তু ডক্টর বিশ্বাসও শ্রীধরের কাছে কম প্রয়োজনীয় নয়। তার কারণ, রঙ্গপ্রকাশের কাজের ধরনটা একটু অন্যরকম।

চক্রপাণি এবং আচারিয়া যেসব গবেষণা করেন বা আবিষ্কার করেন তার দরকার বাইরের পার্থিব জগতের জন্য। সেগুলো চোখে দেখা যায়। তার ফল পাওয়া যায় হাতেনাতে—অন্তত এখন না হলেও ভবিষ্যতে। তাই ব্যাপারটা প্রচারের আলোয় চলে আসে চটপট।

রঙ্গপ্রকাশের কাজ অন্ত:সলিলা। মানুষের মন নিয়ে ওঁর কাজ। বেশিরভাগ সময়েই ওঁকে কোনও মানুষের ফটোগ্রাফ দেখে কিংবা ভিডিয়ো ফুটেজ দেখে তার মানসিক গঠন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিতে হয়। সেইসব মতামত থেকে শ্রীধর পাট্টা, সিন্ডিকেট, কিংবা সুপারগেমস কর্পোরেশন অতীতে বহুবার লাভবান হয়েছে। কিন্তু তাতে বাইরে কোনও হইচই হয়নি। শুধু শ্রীধর পাট্টা বা সিন্ডিকেট রঙ্গপ্রকাশকে বাহবা দিয়েছে। তার সঙ্গে আর্থিক পুরস্কারও জুটে গেছে কপালে। কিন্তু প্রচারের আলোর বৃত্তে ঢুকতে পারেননি। কারণ, ওঁর কাজের ধরনটাই গোপন—একান্ত গোপন।

এসব ছাড়া রঙ্গপ্রকাশ নিয়মিতভাবে আরও একটা দায়িত্ব পালন করেন: তিনি শ্রীধর পাট্টার পার্সোনাল থেরাপিস্ট। এই একটিমাত্র ক্ষেত্রে তিনি কোনও পেশেন্টের সঙ্গে সরাসরি ইন্টারঅ্যাক্ট করে সাইকিয়াট্রিস্টের প্রথাগত ভূমিকা নেন। এবং এই কাজটা করেন অত্যন্ত গোপনে। ডাক্তার এবং পেশেন্ট ছাড়া আর কোনও তৃতীয় ব্যক্তি এই নিয়মিত থেরাপির কথা জানে না। আর-কেউ যে জানবে না, সেটাই শ্রীধরের নির্দেশ—সুতরাং সেটাই ‘আলটিমেট কোড অফ কনডাক্ট’।

রঙ্গপ্রকাশের এই বিশেষ দায়িত্বটা বলতে গেলে একধরনের গোপন সম্মান। শ্রীধরের মনের অলিগলির খোঁজখবর শ্রীধরের চেয়ে অনেক বেশি জানেন রঙ্গপ্রকাশ। শ্রীধর পাট্টাকে তিনি ভেতর-বাইরে দেখতে পান। আর দেখতে পান বলেই ওঁকে ভয় পান। অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি ভয় পান।

কিন্তু এখন সিমানের তৈরি করা দুশ্চিন্তা ওঁকে শ্রীধরের ভয় ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন বলতে গেলে সিমানই ঠিক করে দেবে ওঁদের আগামীদিনের জীবন কীরকম হবে।

অদ্ভুত এক বেদনায় রঙ্গপ্রকাশের চোখে জল এসে গেল। চোখ বুজে থাকা অবস্থাতেই কষ্টটা অনুভব করতে লাগলেন। মনের জোরে সেটাকে কমাতে চাইলেন। একটু পরে ভিজে চোখ খুলে সামনের খোলা জানলার দিকে তাকালেন।

জানলায় ফোটোক্রোমিক ন্যানোপলিমার প্লেট লাগানো। কিন্তু জানলার দিকে তাকিয়ে সেটার অস্তিত্ব বোঝার কোনও উপায় নেই। মনে হচ্ছে, হাত বাড়ালেই প্রকৃতিকে ছোঁয়া যাবে। অথচ বাইরের সূক্ষ্ম ধূলিকণা বা জীবাণু জানলা দিয়ে ঘরের ভেতরে আসতে পারবে না। অর্থাৎ, রঙ্গপ্রকাশ ও তাঁর পরিবার সুরক্ষিত।

কিন্তু সত্যিই কি সুরক্ষিত?

খোলা জানলায় অতিস্বচ্ছ ন্যানোপলিমার প্লেট অদৃশ্য মায়া তৈরি করেছে। সেই মায়ার ঘেরাটোপে বসে নিজেকে সুরক্ষিত ভাবছেন রঙ্গপ্রকাশ।

বাড়িতে এখন কেউ নেই। স্ত্রী পর্ণমালা মিটিং-এ গেছে। নিউ সিটির ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কাউন্সিলের ও সেক্রেটারি। আজ নতুন একটা ইমপোর্ট পলিসি নিয়ে সাংঘাতিক জরুরি একটা মিটিং আছে। মিটিং শেষ হতে সময় লাগবে।

ছেলে সিমানও বাড়িতে নেই এখন। রোজ বিকেলে যেমন বন্ধুবান্ধব নিয়ে বেরোয় তেমনই বেরিয়েছে। রাত বারোটার আগে ও ফিরবে না। আঠেরো বছর বয়েসেই সিমান জীবনের ‘আসল’ মানে জেনে গেছে : জীবন মানে ফুর্তি আর বাজি। অর্থাৎ, ই-ল্যান্ডে গিয়ে ফুর্তি করো, আর বিভিন্ন গেমে বেপরোয়া বাজি ধরো।

ওরা কেউ বাড়িতে নেই। তাই রঙ্গপ্রকাশ প্রাণ খুলে কাঁদতে পারছিলেন।

নিউ সিটির বৈভবের জীবনটা ধীরে-ধীরে এরকম ফাঁপা হয়ে যাক তিনি কখনও চাননি। অথচ…।

রঙ্গপ্রকাশের কম্পিউটার-রুমটা মাপে বিশাল।

তিরিশ বাই কুড়ি মাপের ঘরটা আধুনিক পেশাদার অফিসের মতো করে সাজানো। ঘরে পাশাপাশি তিনটে টেবিলে তিনটে প্লাজমা কম্পিউটার। তিনটে মেশিনই রঙ্গপ্রকাশ একা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া রয়েছে একটা বড় অফিস-টেবল। তাতে নানান কাগজপত্র, ট্রাই-ডাইম মাইক্রোসিডি, পেন, বই, মোবাইল ফোন এলোমেলোভাবে ছড়ানো। এই ছন্নছাড়া টেবিলটা দেখে বোঝা যায় যে, রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস বিজ্ঞানী। যদিও পর্ণমালা এবং সিমানের ধারণা, সাইকিয়াট্রিস্টকে ঠিক বিজ্ঞানী বলা যায় না।

ওদের কথা শুনে রঙ্গপ্রকাশ মনে-মনে হাসেন। ওঁর মনে পড়ে যায় কয়েকশো বছর আগের একজন বিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের কথা। যাঁর হাতে মনোবিজ্ঞান সঠিক চেহারা পেয়েছিল, একটা দিশা খুঁজে পেয়েছিল। ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘অনেকেরই ধারণা সাইকোলজি বিষয়টা তাঁরা বেশ ভালোই বোঝেন—কারণ, তাঁরা প্রত্যেকেই একটা করে মনের মালিক।’

রঙ্গপ্রকাশ জানেন, মনের ওপর মালিকানা থাকলেই তাকে বোঝা যায় এমনটা কখনওই নয়। তাই যদি হত তা হলে শ্রীধর পাট্টা মোটেই রঙ্গপ্রকাশের কাছে নিয়মিত ‘সিটিং’ দিতেন না।

চোখের জল মুছে রঙ্গপ্রকাশ ঘরটাকে জরিপ করতে শুরু করলেন। ভাবতে চাইলেন, তিনি যেন এক অচেনা আগন্তুক—হঠাৎ করে এই ঘরটায় এসে পড়েছেন এবং অপরিচিতের চোখে ঘরটাকে খুঁটিয়ে দেখছেন।

ঘরের সব ফার্নিচারই সেমি-ট্রান্সপারেন্ট—গ্লাস পার্টিকল ইমপ্রেগনেটেড পলিমারের তৈরি। ফলে বাইরে থেকে আসা বিকেলের আলো আর ঘরের সাদা আলো মিলেমিশে ঢুকে পড়ছে ফার্নিচারের অন্দরমহলের আনাচেকানাচে। ছোট-বড় নানান মাপের আলোর টুকরো দিয়ে এক রহস্যময় নকশা তৈরি করেছে।

ঘরে পাশাপাশি দাঁড় করানো চারটে সুদৃশ্য বুককেস। তাতে সাইকোলজির প্রচুর বই আর মাইক্রোসিডির বাক্স ঠাসা। ডানদিকের দেওয়ালে ফোটো-অ্যাকটিভেটেড একটা জায়ান্ট সাইজের প্লেট টিভি। টিভির মুখোমুখি আর-এক দেওয়াল ঘেঁষে একটা সুন্দর ছাঁদের লম্বা সোফা। তার গদি-বালিশ সবই স্বচ্ছ পলিমারের আবরণে বন্দি রঙিন বাতাস দিয়ে তৈরি। ওই আবরণের ভেতরে বিভিন্ন রঙের স্রোত অত্যন্ত ধীরে খুশিমতো ভেসে বেড়াচ্ছে। রঙ্গপ্রকাশ জানেন, ইমপোর্টেড এই জিনিসগুলোতে ডায়ানামিক ডেনসিটি গ্র্যাডিয়েন্ট আর স্ট্যাটিক চার্জ টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে।

ঘরের ভেতরে একটা হালকা সুগন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। বিজ্ঞানীর মুড ঠিক করার জন্য এই রুম ফ্রেশনারের ব্যবস্থা। এ ছাড়া খুব নীচু গ্রামে হালকা মিউজিক বাজছিল। ভালো করে খেয়াল করলে তবেই সেই মিউজিকের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীর ক্রিয়েটিভিটিকে উসকে দেওয়ার এই ব্যবস্থা রঙ্গপ্রকাশের খুব পজিটিভ বলে মনে হয়।

কিন্তু এই মুহূর্তে সবই কেমন নেগেটিভ লাগছিল।

জানলার বাইরে তাকিয়ে, রঙ্গপ্রকাশ দেখছিলেন লতানে গাছ। গাছে ছোট-ছোট বর্ণালি ফুল। দূরে, রাস্তার ওপারে, সুন্দর ছোট-বড় বাড়ি। সব বাড়িরই চেহারায় আকর্ষণীয় জ্যামিতি। শুধু চোখে দেখেই বোঝা যায়, নিউ সিটির আর্কিটেকচার কত আধুনিক।

আধুনিক এই শহর ছেড়ে যেতে চান না তিনি। কিন্তু হয়তো যেতে হবে। কারণ, আজ সকালেই ইন্টারঅ্যাকটিভ প্লেট টিভিতে সিন্ডিকেটের ওয়ার্নিং পেয়েছেন।

এই ওয়ার্নিং-এর পিছনে কে আছে তিনি জানেন—শ্রীধর পাট্টা। কিন্তু শ্রীধরকে ঠিক দায়ী করা যায় না। কারণ, নিউ সিটির বরাবরের নিয়ম এটাই। ই-আই—মানে, ইকনমিক ইনডেক্সই এখানে প্রথম—এবং শেষ কথা।

ওয়ার্নিং-টা যে আসতে চলেছে মাসখানেক আগে থেকেই সেটা অনুমান করতে পেরেছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। এবং আজ সকালে সেটা এসে গেছে।

ওয়ার্নিং-টার কথা পর্ণমালাকে এখনও বলেননি। সিমানকেও নয়।

এই ওয়ার্নিং পাওয়ার পর সিন্ডিকেট মাত্র তিনমাস সময় দেয়। সেই তিনমাসে ই-আই-টাকে ‘ক্রিটিক্যাল ভ্যালু’র ওপরে নিয়ে আসতে হয়। যদি সেটা সম্ভব না হয়, তা হলে ‘বাই-বাই নিউ সিটি’।

বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। এত বছর ধরে নিউ সিটির মনোরম বিলাসী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে তারপর হঠাৎ করে এক্সপালশান! ত্যাজ্যপুত্রের মতো রঙ্গপ্রকাশরা হয়ে যাবেন ‘ত্যাজ্য-নাগরিক’। ওঁদের গিয়ে থাকতে হবে ওই জঘন্য ক্লেদাক্ত হিংস্র ওল্ড সিটিতে!

টিভিতে ওল্ড সিটির চেহারা দেখে আর নানান খবর দেখে শিউরে ওঠেন রঙ্গপ্রকাশ। আইন-শৃঙ্খলার কোনও বালাই নেই—

সর্বত্র ‘ফ্রি ফর অল’। সেখানে রঙ্গপ্রকাশরা বাঁচবেন কেমন করে!

হিংস্রতা অবশ্য নিউ সিটিতেও আছে—’শৃঙ্খলাবদ্ধ’ হিংস্রতা। অভিনব সব মরণখেলা। সেগুলোকে ব্যবহার করে লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকার ব্যাবসা। এইসব ‘খেলা’-র লাইভ টেলিকাস্ট রাইট গোটা পৃথিবী জুড়ে বিক্রি করে সিন্ডিকেট। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বেটিং আর বিজ্ঞাপনের রমরমা বাজার।

না, এই ‘শৃঙ্খলাবদ্ধ’ হিংস্রতাও রঙ্গপ্রকাশ পছন্দ করেন না। একটুও না। শুধুমাত্র বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার সবরকম আধুনিক সুযোগ এখানে আছে বলে তিনি এখনও নিউ সিটি ছেড়ে যাননি।

তা ছাড়া যাবেনই বা কোথায়? ওই ওল্ড সিটিতে? যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ আক্রান্ত?

‘আর এখানে যে মনুষ্যত্ব আক্রান্ত!’ রঙ্গপ্রকাশের বুকের নিউক্লিয়াস থেকে চিৎকার করে কে যেন বলে উঠল। বুকের ভেতরের ওই অজানা-অচেনা লোকটা প্রায়ই এরকম পাগলের মতো চিৎকার করে। সে-চিৎকার রঙ্গপ্রকাশ শুধু একা শুনতে পান। পর্ণমালা বা সিমান শুনতে পায় না।

কিন্তু এখন? এখন তো ওয়ার্নিং এসে গেছে। তিনটে মাস রঙ্গপ্রকাশকে প্রাণপণে লড়তে হবে। ই-আই-কে আপগ্রেড করতে হবে—’ক্রিটিক্যাল ভ্যালু’র ওপরে যেতে হবে।

না, এখন পর্ণমালাকে ব্যাপারটা জানাবেন না। জানালে হয়তো পর্ণমালা পাগল হয়ে যাবে। সিমানের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে। তার চেয়ে বরং আরও সাত-দশদিন যাক—তারপর…।

হঠাৎই মাথা ঝাঁকিয়ে দুশ্চিন্তার বাঁধন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কম্পিউটারের টাচ-স্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে মেশিন শাট-ডাউন করে দিলেন।

হালকা ব্যায়ামের ভঙ্গিতে হাত-পা নাড়াচাড়া দিলেন রঙ্গপ্রকাশ। কপালে হাত বোলালেন কয়েকবার। আবার মাথা ঝাঁকালেন এপাশ-ওপাশ।

যন্ত্রণা। যন্ত্রণা। জ্বালা। জ্বালা।

ঘরের মধ্যে এলোমেলো হাঁটতে লাগলেন।

আয়নার কাছে এসে দাঁড়ালেন।

হিরের মতো ঝকঝকে আয়নায় এ কাকে দেখছেন! ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস? নিউ সিটিতে যিনি অ্যাপ্লায়েড সাইকোলজির ‘দেবতা’!

 ছোট-ছোট করে ছাটা কাঁচাপাকা চুল। ভাঙা গাল। কপালে বলিরেখা। চশমার পলিমার লেন্সের পিছনে নিষ্প্রভ দুটি চোখ। মুখে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি।

সব মিলিয়ে হতাশায় উদভ্রান্ত একজন মানুষ।

অথচ গতকালই ওঁর গাল দুটো এতটা ভাঙা মনে হয়নি। কপালে বলিরেখার সংখ্যা আরও কম ছিল। চোখের মণি ছিল উজ্জ্বল। সেখান থেকে আত্মবিশ্বাসের জ্যোতি বেরোচ্ছিল।

কী করবেন এখন? কী করা উচিত?

প্রশ্ন দুটোর উত্তর ভেবে ওঠার আগেই টেবিলে পড়ে থাকা মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল বুকের ভেতরে।

শ্রীধর পাট্টা। একমাত্র শ্রীধর ফোন করলেই রঙ্গপ্রকাশের ফোন এই বিশেষ সুরে বেজে ওঠে। এই মিউজিকটা তৈরি করা হয়েছে অসংখ্য প্রজাপতির ডানা নাড়ার শব্দ দিয়ে। শব্দগুলোকে একহাজার গুণ অ্যামপ্লিফাই করে একটার সঙ্গে আর-একটা মিশিয়ে ডিজিটাল প্রসেসিং করে ফিলটার করে তৈরি হয়েছে এই কপিরাইট রিং টোন। নিউ সিটির হাতে গোনা কয়েকজন শৌখিন মানুষ এই রিং টোন ব্যবহার করে। তার মধ্যে রঙ্গপ্রকাশ একজন।

অফিস-টেবলের কাছে এগিয়ে গেলেন। মোবাইল ফোন হাতে তুলে নিলেন। বুকের ভেতরে একটা গুমগুম শব্দ শুরু হয়ে গেল।

‘হ্যালো—।’

‘মার্শাল স্পিকিং—।’

‘ইয়েস, স্যার।’ গলার স্বরটা যাতে কেঁপে না যায় তার জন্য বেশ সতর্ক হয়ে কথাগুলো বললেন।

‘ডক্টর বিশ্বাস, আই নিড য়ু। ইমার্জেন্সি। আপনি একবার আমার বাড়িতে চলে আসুন। আজ বিকেল পাঁচটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত আমার সিকিওরিটি কোড হল ফোর ওয়ান জিরো জিরো টু এ-সি-এক্স। আজ সিটিং-এর পর জরুরি কথা আছে। জিশান পাল চৌধুরীর প্রাোফাইল নিয়ে আর আপনার ই-আই নিয়ে।’ একটু থামলেন শ্রীধর। তারপর : ‘আপনাকে ক’টা নাগাদ আমি এক্সপেক্ট করব, ডক্টর?’

কানে ফোন ধরে হাতঘড়ির দিকে তাকালেন রঙ্গপ্রকাশ। সাড়ে পাঁচটা বাজে। এখান থেকে শ্রীধরের বাড়ি একঘণ্টার ড্রাইভ। আর সিকিওরিটির ঝামেলা পেরোতে আরও দশমিনিট। সুতরাং…।

‘আমি পৌনে সাতটার মধ্যে রিচ করে যাব, স্যার।’

‘ও.কে. দেন। সামনে এলে কথা হবে।’

ফোন কেটে গেল।

শ্রীধরের দেওয়া সিকিওরিটি কোডটা শোনামাত্রই মনে গেঁথে নিয়েছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। এখন সেটা মোবাইলে স্টোর করে নিলেন।

শ্রীধরের রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সে ঢোকার জন্য আজ বিকেলে পাঁচ ঘণ্টার জন্য এই সিকিওরিটি কোডটা অ্যাকটিভেট করা আছে। শ্রীধর নিজের সুবিধেমতো এই কোডটা পালটে দেন। ওঁর বাড়ির কমপ্লেক্সের মেইন গেটে ভিজিটরের জন্য সিকিওরিটি কোড প্যানেল রয়েছে। ওই প্যানেলে সংখ্যা এবং ইংরেজি হরফের বোতাম রয়েছে। সিকিওরিটি কোড জানা থাকলে তবেই সঠিক বোতাম টিপে কমপ্লেক্সের মেইন গেট পেরোনো সম্ভব। তারপর রয়েছে সিকিওরিটি চেকের আরও দুটো স্তর। প্রথম স্তরে চারজন আর্মড গার্ড অতিথিকে সার্চ করে। সার্চ করে তারা সন্তুষ্ট হলে তবেই অতিথি যেতে পারবেন দ্বিতীয় স্তরে। সেখানে কোনও মানুষ নেই। একটা অদ্ভুত চেহারার গেটের মধ্যে দিয়ে অতিথিকে হেঁটে যেতে হয়। হেঁটে যাওয়ার সময় একটা সফট এক্স রে স্ক্যানার অ্যাকটিভেটেড হয়। স্ক্যানারের আউটপুট কম্পিউটারে প্রসেস করে ডিজিটাল উত্তর বেরোয় : ‘হ্যাঁ’, অথবা ‘না’। তার ওপর নির্ভর করে অতিথির চোখের সামনে ডিজিটাল প্যানেলে সবুজ রঙে ফুটে ওঠে : ‘প্লিজ এন্টার।’ অথবা, উজ্জ্বল লাল আলোয় ফুটে ওঠে : ‘ফর ইয়োর সেফটি, ডু নট এন্টার।’

এই নির্দেশ পালন না করলে অতিথির বিপদ। সিকিওরিটি ইউনিট রুমে অ্যালার্ম বেজে উঠবে আর তার ঠিক এক মিনিট পর হাই এনার্জি পার্টিকল রেডিয়েশান অতিথিকে ঝাঁঝরা করে দেবে।

অর্থাৎ শ্রীধর পাট্টা না চাইলে ওঁর সঙ্গে কারও দেখা করার উপায় নেই।

মোবাইল ফোন পকেটে রেখে দেওয়ার পরেও বেশ কয়েক মিনিট ধরে নিজের বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পেলেন রঙ্গপ্রকাশ। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছু একটা ভাবতে চাইছিলেন কিন্তু কিছুতেই ভাবনার পরম্পরা সঠিকভাবে সাজাতে পারছিলেন না।

কিছুক্ষণ চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিলেন। একটা লম্বা শ্বাস ফেলে কম্পিউটারের কাছে এগিয়ে গেলেন। টেবিল থেকে একটা গোলাপি প্লাস্টিক ফোল্ডার তুলে নিয়ে জিশানের কয়েকটা কালার প্রিন্ট-আউট তার মধ্যে ভরে নিলেন। প্রিন্টারের পাশে এলোমেলোভাবে খসড়া রিপোর্টের কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ে ছিল। সেগুলোও ফোল্ডারে ঢুকিয়ে নিলেন। শ্রীধরের সঙ্গে জিশানের সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল নিয়ে আলোচনার সময় এই ফটো আর রিপোর্টের পাতাগুলো কাজে লাগতে পারে।

ফোল্ডারটা হাতে নিয়ে কম্পিউটার-রুম থেকে বেরিয়ে এলেন। তারপর মিনি অটোমেটিক এলিভেটরে চড়ে নীচে নেমে এলেন। বাড়ির বাইরে বেরিয়ে সদর দরজাটা সফটওয়্যার লক করে দিলেন। পর্ণমালা আর সিমান দুজনেই আনলক করার কোডটা জানে। তাই বাড়িতে খুশিমতো ঢুকতে ওদের কোনও অসুবিধে হবে না।

বাইরের লনের পাশে রঙ্গপ্রকাশের জি-মোবাইল দাঁড়িয়ে ছিল। নিউ সিটিতে সিভিলিয়ানরা বেশিরভাগই এই লাল রঙের জি-মোবাইল ব্যবহার করে। এই গাড়ির যারা মালিক তাদের সিটিজেন কোড নম্বরই হল গাড়ির নম্বর। তবে তার সঙ্গে একটা ইংরেজি ‘সি’ হরফ যোগ করা আছে।

পকেট থেকে সিটিজেন’স আই-ডি স্মার্ট কার্ড বের করলেন। গাড়ির কাছে গিয়ে দরজার স্লটে কার্ডটা ঢুকিয়ে সোয়াইপ করলেন।

গাড়ির দরজা খুলে গেল।

ড্রাইভিং সিটে বসলেন রঙ্গপ্রকাশ। সুইচ অন করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ড্যাশবোর্ডের ব্যাক-লাইটেড এল-সি-ডি প্যানেলে নিউ সিটির ম্যাপ ফুটে উঠল। অ্যাকটিভেটেড হয়ে গেল ‘সারফেস নেভিগেটর’ সফটওয়্যার।

ম্যাপে নিজের বাড়ির লোকেশানে আঙুল ছোঁয়ালেন। তারপর শ্রীধর পাট্টার বাড়ির জায়গায় তজর্নি রাখলেন। মানচিত্রে দুটো নীল রঙের বিন্দু দপদপ করতে লাগল—সোর্স আর ডেস্টিনেশান। তখন মুখে বললেন, ‘শর্টেস্ট রুট’। অডিয়ো অ্যাকটিভেটেড সিস্টেম চোখের পলকে রঙিন মানচিত্রের ওপরে একটা লাল রঙের রেখা এঁকে দুটো নীল বিন্দুকে জুড়ে দিল।

গাড়ি স্টার্ট করতেই অটোমেটিক নেভিগেটর গাড়ি চালানোর দায়িত্ব নিয়ে নিল। রঙ্গপ্রকাশ অলসভাবে বসে গাড়ির জানলা দিয়ে ওঁর পছন্দের শহরটাকে দেখতে লাগলেন।

ওঁর বুকের শব্দটা এখন আগের চেয়ে অনেক কমে এসেছে।

গাড়ি যে নিউ সিটির রাস্তা ধরে ঘণ্টায় সত্তর কিলোমিটার বেগে ছুটছিল সেটা রঙ্গপ্রকাশ বুঝতে পারছিলেন না। কারণ, তিনি চোখ বুজেছিলেন।

গাড়ির স্বয়ংক্রিয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রঙ্গপ্রকাশের ‘কমফোর্ট কোশেন্ট’ অনুযায়ী নির্ভুলভাবে কাজ করছিল। রঙ্গপ্রকাশের শরীর প্রতিটি রোমকূপ দিয়ে সেই শীতল আরামটুকু ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিচ্ছিল। পিছনদিকে ছুটে চলে যাওয়া রাজপথ, মেটাল ফ্লাইওভার, হাইরাইজ স্ট্রাকচার, আধুনিক বাড়ি-ঘর—কিছুই তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। আর ‘জিরো গ্র্যাডিয়েন্ট’ রাস্তার মসৃণ গঠন ওঁকে কোনও সূক্ষ্ম ঝাঁকুনিও টের পেতে দিচ্ছিল না। অবশ্য এর পিছনে জি-মোবাইল-এর আধুনিক প্রযুক্তিরও অবদান ছিল।

রঙ্গপ্রকাশ ধীরে-ধীরে শান্ত হচ্ছিলেন। বুকের বাড়তি শব্দের ঢেউ এখন প্রায় মিলিয়ে গেছে। টেনশান কমাতে শরীর আর মনকে মনে-মনে শূন্যে ভাসিয়ে দিলেন। চোখ মেলে জি-মোবাইল-এর জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন।

একটু আগের বিকেলটা এখন হামাগুড়ি দিয়ে সন্ধের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়ছে। পশ্চিমের আকাশে লাল-হলুদ আর কমলা রঙের খেলা। সূর্য চলে যাচ্ছে—কাল সকালে ফিরে আসার জন্য।

এই সূর্য দেখা যাচ্ছে ওল্ড সিটি থেকেও। ভাবলেন রঙ্গপ্রকাশ। এমনকী ওই যে সিলুয়েট পাখির মিছিল কমলা রঙের পটভূমিতে ‘স্লো মোশান’-এ উড়ে যাচ্ছে, সেটাও হয়তো দেখা যাচ্ছে ওল্ড সিটি থেকে।

রাস্তার দুপাশে সুন্দর সারিতে লাগানো রয়েছে বিশাল উচ্চতার বিদেশি পাতাবাহার গাছ। তার বড়-বড় পাতায় যেন রামধনু-রঙের ছোপ। জি-মোবাইল-এর ভেতর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলেন, সেই রঙিন পাতাগুলো বাতাসে উড়ছে।

তৃপ্তির দৃষ্টিতে এসব দেখতে-দেখতে কোথা থেকে যেন চোখে জল এসে গেল। যে সুন্দর সে স্বর্গেও সুন্দর, নরকেও সুন্দর। এই ডুবে যাওয়া সূর্যের আলো এই মুহূর্তে ওল্ড সিটিকেও ছুঁয়ে আছে। ওই পাখির দল অনায়াসে উড়ে চলে যেতে পারে নিউ সিটির সীমানা ছাড়িয়ে। পিস ফোর্সের সমস্ত প্রতিরোধ সেখানে অকেজো। ওই যে গাছের পাতা নিয়ে খেলা করছে যে-অস্থির বাতাস, তাকেও কেউ রুখতে পারবে না। শুধু মানুষেরই সীমানা ডিঙোনোর কোনও অধিকার নেই।

হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছলেন রঙ্গপ্রকাশ। বদ্ধ গাড়ির ভেতরে থেকেও তীব্র শিসের শব্দ শুনতে পেলেন। চোখ তুললেন আকাশের দিকে। চারটে ইস্পাতের পাখি উড়ে যাচ্ছে। চারটে শুটার। ওদের নজরদারির কাজে ক্ষান্তি নেই, ক্লান্তি নেই। জিয়োগ্রাফিক্যাল ইনফরমেশান সিস্টেমের অতি আধুনিক সফটওয়্যার এ-কাজে ওদের সাহায্য করছে।

সারফেস নেভিগেটরের পরদার দিকে তাকালেন। জি-মোবাইল গন্তব্যে প্রায় পৌঁছে গেছে।

আর সাত সেকেন্ডের মধ্যেই ওঁর পেশেন্টের রেসিডেনশিয়াল কমপ্লেক্সে পৌঁছে গেলেন রঙ্গপ্রকাশ। টের পেলেন বুকের ভেতরের শব্দটা আবার শুরু হয়ে গেছে।

সন্ধে নেমেছে। কমপ্লেক্সের মেইন গেটের বাইরে অসংখ্য আলোর বন্যা। সেই আলো গায়ে মেখে দুজন সিকিওরিটি গার্ড দাঁড়িয়ে ছিল। রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাসকে চিনতে পারলেও তাদের ভাবলেশহীন মুখের চেহারা পালটাল না। রঙ্গপ্রকাশ আগে বহুবার এখানে ‘অতিথি’ হয়ে এসেছেন—তাই নিয়মকানুন সব জানেন। তা সত্বেও একজন গার্ড ইশারায় ওঁকে কার পার্কিং জোনটা দেখাল। ততক্ষণে রঙ্গপ্রকাশ পার্কিং জোন লক্ষ্য করে গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেছেন।

পার্কিং জোনটা ইস্পাতের তৈরি। সেখানে গাড়ির মাপে অনেকগুলো আয়তক্ষেত্র পাশাপাশি আঁকা। দূরের এরকমই একটি আয়তাকার স্লটে হালকা মেরুন রঙের একটা কিউ-মোবাইল দাঁড়িয়ে আছে। রঙ্গপ্রকাশ ওঁর গাড়িটা একটা স্লটে দাঁড় করালেন। গাড়ি থেকে নেমে সরে আসার পরই দেখলেন গাড়িটা যেখানে পার্ক করেছেন সেই আয়তাকার অংশটা ধীরে-ধীরে নীচে নামতে শুরু করল। গ্রাউন্ড লেভেল থেকে প্রায় ফুটখানেক নীচে নামার পর অংশটা স্থির হল।

এই হাইড্রলিক সিকিওরিটি সিস্টেম রঙ্গপ্রকাশের খুব চেনা। এখন ওঁর গাড়িটা ফুটখানেক গভীর গর্তের মধ্যে বন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইচ্ছে করলেই রঙ্গপ্রকাশ খুশিমতো গাড়ি চালিয়ে চলে যেতে পারবেন না। যখন এখানকার সিকিওরিটি সিস্টেম ওঁকে চলে যাওয়ার ছাড়পত্র দেবে তখনই ওঁর গাড়ির চাকা আবার ধীরে-ধীরে গ্রাউন্ড লেভেলে উঠে আসবে।

যে-মানুষ যত ভয় পায় তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা তত বেশি। শ্রীধর পাট্টা আসলে একজন ভিতু মানুষ। প্রাণভয়ে সবসময় কাঁটা হয়ে আছেন। আর ভয় পান বলেই, নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে, অন্যকে আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।

এইসব কথা ভাবতে-ভাবতে ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ শ্রীধরের কমপ্লেক্সের মেইন গেটের কাছে পৌঁছে গেলেন। সিকিওরিটি কোড প্যানেলে আঙুল ছুঁইয়ে পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করলেন। মোবাইলের বোতাম টিপে-টিপে ওপেন করলেন নির্দিষ্ট উইন্ডো। সেখানে স্টোর করা কারেন্ট সিকিওরিটি কোডটা দেখা গেল। সেটা সিকিউরিটি কোড প্যানেলে পাঞ্চ করলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে একটা মেটাল প্লেট পাশে সরে গিয়ে গেট খুলে গেল। দু-ফুট চওড়া একটা পথ তৈরি হল—যার ভেতর দিয়ে মাত্র একজন মানুষ যেতে পারে।

প্রথম নিরাপত্তার স্তর পেরিয়ে রঙ্গপ্রকাশ ভেতরে ঢুকে পড়লেন। তিনি জানেন, এই পথের দুপাশের দেওয়ালে লাগানো রয়েছে অপটিক্যাল ডিভাইস। ক’জন মানুষ গেট পেরিয়ে ঢুকল এই যন্ত্র তার হিসেব রাখে। যেহেতু এখন একজন ঢোকার কথা তাই রঙ্গপ্রকাশ অপটিক্যাল সেন্সরের নজরদারি পেরোতেই মেইন গেটের মেটাল প্লেট ‘ক্র্যাক’ শব্দ করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জায়গামতো ফিরে গিয়ে এঁটে গেল।

এরপর নিয়মমাফিক নিরাপত্তার আরও দুটো স্তর পেরোলেন। শ্রীধর পাট্টার পার্সোনাল থেরাপিস্ট বলে আলাদা কোনও খ্যাতির নেই।

একসময় রঙ্গপ্রকাশ পৌঁছে গেলেন বাড়ির সদর দরজায়।

ভারী কাঠের দরজায় রঙিন কাচ আর কাঠখোদাইয়ের কারুকাজ।

হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। পৌনে সাতটা বাজতে মোটামুটি দেড়মিনিট বাকি। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে শ্রীধরের নম্বর ডায়াল করলেন।

একবার রিং হওয়ার পরই দরজা খুলে গেল। চোখে পড়ল একটা হলঘর। একটা লুকোনো স্পিকারে শ্রীধরের সংক্ষিপ্ত আবাহন শোনা গেল : ‘ওয়েলকাম, ডক্টর।’

রঙ্গপ্রকাশের সামনে কেউ নেই। কেউ ওঁকে রিসিভ করতে আসেনি।

এতে রঙ্গপ্রকাশ মোটেই অবাক হলেন না। কারণ, এই অপরূপ সুন্দর, হাইলি অটোমেটেড এবং ল্যাভিশলি ফারনিশড তিনতলা বাড়িটায় শ্রীধর পাট্টা সম্পূর্ণ একা থাকেন। নিরাপত্তার কারণেই কাউকে তিনি বিশ্বাস করেন না।

খুবই স্বাভাবিক। কারণ, শ্রীধরের মধ্যে তিনি সোশিয়োপ্যাথিক ডিসঅর্ডার ছাড়াও প্যারানয়েড পারসোনালিটির হদিস পেয়েছেন। প্যারানয়েড পারসোনালিটির মানুষ হাইপারসেনসিটিভ আর সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হয়।

রঙ্গপ্রকাশ হলঘরে ঢুকতেই ওঁর পিছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হওয়ার শব্দের ফাঁপা প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

হলঘরের মাঝখান থেকে একটা স্টেইনলেস স্টিলের সিঁড়ি অদ্ভুত ছন্দে পাক খেয়ে উঠে গেছে দোতলায়। তারপর পাকের ব্যাসার্ধ বাড়িয়ে সেটা ঘরের দেওয়ালে সেঁটে গিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যালকনি তৈরি করে ফেলেছে। ঘরের উজ্জ্বল সাদা আলোয় সিঁড়ি আর ব্যালকনি ঝকঝক করছে।

সেই ব্যালকনির এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীধর পাট্টা। গায়ে ফুলহাতা কালো টি-শার্ট আর পায়ে কালো প্যান্ট। দেখে মনে হচ্ছে, টানটান ঋজু ভঙ্গিতে একটা কালো পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে।

শ্রীধর চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কারণ, তিনি জানেন, রঙ্গপ্রকাশকে কোনওরকম নির্দেশ দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

থমথমে নিস্তব্ধতার মধ্যে হলঘরের কার্পেটের ওপরে পা ফেলে এগোলেন ডক্টর। কার্পেটের ডিজাইনটা নিউ সিটির রঙিন ম্যাপ। এই কার্পেট বিদেশ থেকে অর্ডার দিয়ে তৈরি। এবং এই কার্পেট মাত্র একপিসই তৈরি করা হয়েছে।

হলঘরের দেওয়ালে আট-দশটা হলোগ্রাম পেইন্টিং। গত পাঁচশো বছরের নামি শিল্পীদের বিখ্যাত সব পেইন্টিং-এর হলোগ্রাফিক রিপ্রাোডাকশন। তার মধ্যে ভ্যান গঘ, সালভাদোর দালি, রবীন্দ্রনাথ, বিকাশ ভট্টাচার্য, মকবুল ফিদা হুসেনও রয়েছেন।

ছবি-টবি সব সাজিয়েছেন বটে, কিন্তু শিল্পী এবং শিল্পের খোঁজ শ্রীধর কতটা রাখেন সন্দেহ আছে।

এ-কথা ভাবতে ভাবতে স্টেইনলেস স্টিলের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলেন রঙ্গপ্রকাশ। শ্রীধর একইভাবে দাঁড়িয়ে ওঁকে লক্ষ করতে লাগলেন।

রঙ্গপ্রকাশ যখন শ্রীধরের খুব কাছাকাছি চলে এলেন তখন শ্রীধর কথা বললেন, ‘চলুন—কনফারেন্স রুম ওয়ানে গিয়ে বসি।’ এবং সেদিক লক্ষ্য করে হাঁটা দিলেন।

শ্রীধরের বাড়িতে তিনটে কনফারেন্স রুম আছে। তাদের নম্বর ওয়ান, টু এবং থ্রি। রুম নম্বর ওয়ানটা মাপে সবচেয়ে ছোট। বড়জোর পাঁচজন মানুষ সেখানে বসে আলোচনা করতে পারে। দু-নম্বর ঘরটা পনেরোজনের জন্য। আর শেষ কনফারেন্স রুমটায় তিরিশজন বসতে পারে।

শ্রীধরের বাড়ির সমস্ত দরজা এবং জানলার কাচগুলো আসলে মামুলি কাচ নয়—ফোটোক্রোমিক ন্যানোপলিমার প্লেট। ওগুলো স্বচ্ছ তো বটেই, তার ওপর শ্যাটারপ্রুফ এবং বুলেটপ্রুফ। যদি কোনও স্নাইপার বহুদূরের কোনও হাইরাইজ বিল্ডিং থেকে হাই পাওয়ার টেলিস্কোপিক রাইফেল কিংবা অটো-কনভার্জিং রকেট লঞ্চার থেকে শ্রীধরের বাড়ির জানলা লক্ষ্য করে ফায়ার করে তবে সে ভীষণ হতাশ হবে।

আক্রমণকারীদের হতাশ করাই শ্রীধর পাট্টার একমাত্র মিশন।

কনফারেন্স রুম ওয়ানের কাচের দরজা ঠেলে ওঁরা দুজনে ঢুকে পড়লেন।

ঘরটা ঠান্ডা। সেন্ট্রাল এসি সিস্টেম নি:শব্দে কাজ করে চলেছে।

ঘরের ডানদিকে কনফারেন্স টেবিল, আর পাঁচটা মোটর অপারেটেড আরামের গদি-আঁটা চেয়ার। চেয়ারগুলোর পায়ায় চাকা লাগানো। আর, ডানদিকের হাতলে ছোট কন্ট্রোল প্যানেল। প্যানেলের বোতাম টিপে চেয়ারগুলোকে খুশিমতো চালানো যায়।

ঘরের বাঁ-দিকে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা বেঁটেখাটো চেহারার ডোমেস্টিক রোবট। তার মাথাটা বেঢপ, হাত-পাগুলো দৈর্ঘ্যে ছোট হলেও বেশ মোটাসোটা, মজবুত। রোবটটার বুকের কাছটায় একটা চৌকো গর্ত—সেটা কালো কাচে ঢাকা। রঙ্গপ্রকাশ জানেন, ওটা রিমোট অ্যাক্টিভেশানের রিসেপটর। তার পাশেই দুটো সবুজ আলো—একটা স্থিরভাবে জ্বলছে, অন্যটা দপদপ করছে।

ডোমেস্টিক রোবটটার পাশেই দাঁড় করানো রয়েছে তিনটে অল-গ্লাস ভেন্ডিং মেশিন। তাদের প্রথমটায় কফি, দ্বিতীয়টায় বিভারেজ আর তৃতীয়টায় স্ন্যাক্স সার্ভ করার ব্যবস্থা রয়েছে। দরকার পড়লে কনফারেন্সে আমন্ত্রিত অতিথিদের এই ডোমেস্টিক রোবটই কফি, বিভারেজ এবং স্ন্যাক্স সার্ভ করে।

ঘরের সবচেয়ে দূর-প্রান্তে গাঢ় বাদামি রঙের দুটো সোফা। তাদের গালফোলা গদির রকমসকম দেখেই বোঝা যায় ওগুলো বসার পক্ষে অতিরিক্ত আরামের। বাদামি সোফা দুটির মাঝখানে একটা কালচে বাদামি রঙের কফি টেবল। তার কাঠের পালিশ অক্ষত রাখার জন্য সিরামিক ল্যাকারের কোটিং দেওয়া রয়েছে।

টেবিলের ওপরে একটা ল্যাপটপ কম্পিউটার খোলা। তার পরদায় শ্রীধর পাট্টার মুখের ছবি। শ্রীধরের ল্যাপটপের স্ক্রিনসেভার হিসেবে এর চেয়ে ভালো ছবি আর কী হতে পারে!

শ্রীধর ডক্টরকে ইশারা করলেন। তারপর দুটো সোফায় বসে পড়লেন দুজনে।

বড় করে একটা শ্বাস ছাড়লেন শ্রীধর। রঙ্গপ্রকাশকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

‘কী নেবেন বলুন, ডক্টর? হট, না কোল্ড?’

রঙ্গপ্রকাশ ল্যাপটপের স্ক্রিনসেভারের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। শ্রীধরের মধ্যে যে সামান্য মেগালোম্যানিয়ার লক্ষণ তিনি টের পেয়েছেন, বোধহয় সেটার কথাই ভাবছিলেন।

শ্রীধরের প্রশ্নে চমকে মুখ তুলে তাকালেন। বললেন, ‘কুকিজ। আর সফট ড্রিংক।’

শ্রীধর পকেট থেকে ছোট্ট একটা রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট বের করলেন। পটাপট কয়েকটা বোতাম টিপলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে ডোমেস্টিক রোবট সচল হল। ওটার পেটের কাছ থেকে একটা মেটাল ট্রে বেরিয়ে এল বাইরে। রোবটটা ভেন্ডিং মেশিনের কাছে গিয়ে বোতাম টিপল। মেশিন থেকে সফট ড্রিংক আর কুকিজ বেরিয়ে এল। রোবটটা সেগুলো ওর ট্রেতে সাজিয়ে নিল। তারপর কোমরের কাছে দুটো লুকোনো চেম্বারের দরজা খুলে দুটো ক্রিস্টালের গ্লাস বের করল। সফট ড্রিংকের বোতলের পাশে রাখল।

এবার রোবটটা ওর পায়ের চাকা গড়িয়ে কফি-টেবলের কাছে এল। নিখুঁত দক্ষতায় টেবিলে ওগুলো নামিয়ে সফট ড্রিংক অর কুকিজ সার্ভ করল। তারপর নিজের জায়গায় ফিরে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। শুধু দপদপ করা সবুজ আলোটা জানিয়ে দিতে লাগল যে, ও এখনও অ্যাকটিভ।

‘শেভ করেননি কেন?’

শ্রীধরের আচমকা প্রশ্নে রঙ্গপ্রকাশ কেমন হকচকিয়ে গেলেন। নিজের অজান্তেই গালে হাত চলে গেল। খোঁচা-খোঁচা দাড়িতে আঙুল বোলালেন। বললেন, ‘এমনি…।’

শ্রীধর কুকিজ তুলে মুখে দিলেন। সফট ড্রিংক সিপ করলেন। রঙ্গপ্রকাশকে স্থিরচোখে জরিপ করতে-করতে বললেন, ‘ও. কে., ডক্টর। আপনার টেনশান নিয়ে পরে কথা বলব।’ সোফায় হেলান দিয়ে শরীরটাকে ডুবিয়ে দিলেন : ‘আগে আমার টেনশান নিয়ে কথা হোক…।’

রঙ্গপ্রকাশ নড়েচড়ে বসলেন। কুকিজ তুলে কামড় বসালেন। সফট ড্রিংকের গ্লাসে চুমুক দিলেন। ঝাঁঝটা নাকে জ্বালা ধরাল। কিন্তু মিষ্টি তরলের ঠান্ডা ছোঁয়ায় কেমন যেন এক প্রশান্তি খুঁজে পেলেন। দু-হাতে মুখ মুছলেন। ইকনমিক ইনডেক্স নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নিউ সিটির একজন নাগরিককে পিছনে ঠেলে দিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাসকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করলেন। গলায় পেশাদারি গাম্ভীর্য এনে প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কেমন আছেন?’

‘ভালো না।’ ঠোঁট টিপে বললেন শ্রীধর। ফরসা মুখে অপ্রসন্ন ভাঁজ ফেললেন : ‘কতকগুলো স্বপ্ন বড় ঝামেলা করছে।’

‘স্বপ্ন?’ অবাক হলেন রঙ্গপ্রকাশ।

‘হ্যাঁ, স্বপ্ন—’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। চোখ বুজে ধীরে-ধীরে বললেন, ‘এমনিতে স্বপ্নগুলো হয়তো তেমন খারাপ কিছু নয়…কিন্তু আমার কাছে ওগুলো সিম্পলি নাইটমেয়ার—দু:স্বপ্ন।’

‘কেন? কী দেখেছেন স্বপ্নে?’ ভুরুতে ভাঁজ ফেললেন ডক্টর।

‘যেমন, একটা মরুভূমি। চারিদিকে শুধু হলদে বালি আর বালি। সেই বালি থেকে তাপ উঠছে। আমার পা পুড়ে যাচ্ছে…কিন্তু আমি হেঁটে চলেছি। ঢেউখেলানো বালির পাহাড় একের পর এক ডিঙিয়ে চলেছি—অথচ বালির শেষ নেই। বাতাসে বালির কণা উড়ছে—চোখে-মুখে এসে লাগছে। মনে হচ্ছে ওগুলো আগুনের কণা…।’

শ্রীধর চোখ বুজে কথা বলছিলেন। খুব ধীরে এক-একটা শব্দ স্পষ্ট করে উচ্চারণ করছিলেন।

রঙ্গপ্রকাশ বেশ বুঝতে পারছিলেন স্বপ্নের প্রতীক কী বলতে চাইছে, কীসের ইশারা করছে। দুর্ভিক্ষ, অনাহার, মৃত্যু, জাতিদাঙ্গা, সম্পত্তির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি।

সোফায় শরীর এলিয়ে চোখ বুজে বসে থাকা এই নিষ্ঠুর মানুষটা এতদিন ধরে শুধু ভয় আর ক্ষয় বিক্রি করে চলেছে। এবার কি ওর সেগুলো কেনার পালা? স্বপ্নটা কি সে-কথাই জানাতে চাইছে?

কিন্তু সেসব তো শ্রীধরকে বলা যাবে না। কারণ, সেই ভয় আর ক্ষয়।

তাই উত্তরটাকে মনে-মনে সাজিয়ে নিয়ে বারকয়েক রিহার্সাল দিয়ে তারপর ডক্টর বললেন, ‘এর অর্থ হচ্ছে, আপনি একা। একজন সেলফমেড ম্যান। আর…আপনার সামনে লড়াই—।’

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

শ্রীধর পাট্টা চোখ খুললেন। কুকিজ আর সফট ড্রিংক চলতে লাগল।

একসময় রঙ্গপ্রকাশ জিগ্যেস করলেন, ‘আর কী স্বপ্ন দেখেন আপনি?’

চোখ বুজলেন শ্রীধর। আলতো করে বললেন, ‘আয়নার স্বপ্ন দেখি। আয়নায় আমার…আমার মুখ দেখতে পাই…।’

‘স্পষ্ট দেখতে পান?’

‘হ্যাঁ…’ সফট ড্রিংক সিপ করলেন শ্রীধর : ‘প্রায় স্পষ্টই বলা যায়, আয়নার সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমার মুখে চাকা-চাকা দাগ। অনেকটা জলবসন্তের গুটির মতো। আর আয়নায় আমার মুখের পেছনটা গাঢ় অন্ধকার। আমি খুব চেষ্টা করেও অন্ধকারের মধ্যে কিছু দেখতে পাচ্ছি না। অথচ…অথচ আমার মনে হচ্ছে…মনে হচ্ছে, অন্ধকারটা নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে…।’

রঙ্গপ্রকাশ বুঝতে পারছিলেন। এই স্বপ্নের ব্যাপারটা যদি শ্রীধর ঠিকঠাক বলে থাকেন তা হলে এই স্বপ্নের অর্থ একটাই : শ্রীধর খুব শিগগিরই রূঢ় এবং কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন। শ্রীধরের দিক থেকে দেখলে সেই বাস্তব কুৎসিত—তাই ওঁর মুখে জলবসন্তের গুটির চাকা-চাকা দাগ। আর ওই যে অন্ধকার, নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে—সেটা হল অজানা আশঙ্কা, ভয়।

কিন্তু শ্রীধর পাট্টাকে এর কতটুকু বলা যায়?

কিংবা আদৌ কি বলা যায়?

এই লোকটা প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে কত মানুষের যে মৃত্যুর কারণ হয়েছে তার কোনও হিসেব নেই। অথচ লোকটার মধ্যে অপরাধবোধও নেই।

তার কারণ ওর অপরিণত বিবেক। সাইকোলজির ভাষায় যাকে বলে ‘আন্ডারডেভেলাপড কনশানস’। সোজা কথায় শ্রীধর পাট্টা একজন ‘মরাল মোরন’। এই ধরনের অ্যান্টিসোশাল পারসোনালিটির মানুষরা মুখে সবসময় মূল্যবোধের কথা বলে, কিন্তু বিবেক অপরিণত হওয়ায় মূল্যবোধের বোধটাই থাকে না। এদের বুদ্ধি ক্ষুরধার, কিন্তু বিবেক ভোঁতা।

এখন সেইরকম একটা মানুষের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। ফরসা তেলতেলে মুখ। মুখে কেমন একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব।

অনেকক্ষণ চুপ করে রয়েছেন। এবার কিছু একটা বলা দরকার।

এ-কথা ভাবার সঙ্গে-সঙ্গেই শ্রীধর বলে উঠলেন, ‘ডক্টর, কিছু বুঝতে পারলেন?’

ঘোর থেকে জেগে উঠলেন রঙ্গপ্রকাশ। টেবিল থেকে কুকিজ তুলে নিয়ে মুখে দিলেন, সফট ড্রিংকের গ্লাসে চুমুক দিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে বললেন, ‘স্যার, আপনার…আপনার সামনে যে-লড়াই…সেই লড়াইটা খুব মসৃণ হবে না। তাই আপনার মুখের রিফ্লেকশানে ওইরকম…চাকা-চাকা দাগ।’ মাথা ঝুঁকিয়ে বসলেন। ঘাড়ে একবার হাত বোলালেন। তারপর শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে আলতো করে যোগ করলেন, ‘আক্রমণ যেটা আসবে…মানে, শত্রুর দিক থেকে…সেটা হবে আনএক্সপেক্টেড। মানে, আপনি আগে থেকে গেস করতে পারবেন না। সেইজন্যেই ওরকম অন্ধকার দেখেছেন…নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে…জীবন্ত অন্ধকার।’

কে হতে পারে সেই অপ্রত্যাশিত শত্রু? কে হতে পারে সেই জীবন্ত অন্ধকার?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজের অজান্তেই শ্রীধর পাট্টার কপালে ভাঁজ পড়েছিল। রঙ্গপ্রকাশ সেই দুশ্চিন্তাটাকেই যেন আরও তীব্র করতে প্রশ্ন করলেন, ‘এমন কোনও শত্রুর কথা কি আপনি ভাবতে পারছেন, স্যার? যাকে এখনও শত্রু বলে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না—অথচ যে আনএক্সপেক্টেড দিক থেকে সাডেনলি অ্যাটাক করতে পারে?’

সফট ড্রিংকে চুমুক দিয়ে মেঝের দিকে তাকালেন শ্রীধর। কয়েক সেকেন্ড মাথা ঝুঁকিয়ে থেকে ধীরে-ধীরে মাথা নাড়লেন এপাশ-ওপাশ।

‘না, এরকম এনিমি হিসেবে কাউকে এখন আইডেনটিফাই করতে পারছি না…।’

সোফা এবং নিজের শরীরের মাঝে খাড়া করে দাঁড় করানো গোলাপি ফোল্ডারটার দিকে রঙ্গপ্রকাশের চোখ গেল। জিশানের সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল নিয়ে শ্রীধরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তবে সেসব কথা শুরু করার আগে থেরাপির ‘কিউ অ্যান্ড এ’ সেশানটা সেরে নেওয়া যাক।

একবার হাতঘড়ির দিকে তাকালেন ডক্টর। তারপর বললেন, ‘যা-যা বললেন সে ছাড়া আর কোনও স্বপ্ন কি দেখেন আপনি?’

‘না:, শুধু ওইগুলোই। ঘুরেফিরে ওই স্বপ্নগুলোই আসে—তবে তার ডিটেইলের একটু-আধটু রকমফের হয়।’

‘তা হলে কোয়েশ্চেন-আনসার সেশান শুরু করি, স্যার?’

‘হ্যাঁ—করুন।’

কথাটা বলেই সোফায় শরীর এলিয়ে দিলেন শ্রীধর। সেই অবস্থাতেই পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করে দেওয়ালের একটা কালো ফাইবার প্লেটের দিকে তাক করে বোতাম টিপলেন। সঙ্গে-সঙ্গে ওয়াল মাউন্টেড একটা অডিয়ো সিস্টেম ‘রেকর্ডিং অ্যাকটিভ’ হয়ে গেল।

রঙ্গপ্রকাশের সঙ্গে প্রতিটি সাইকোথেরাপি সেশান রেকর্ড করে নেন শ্রীধর। সেই রেকর্ডিং-এ দিন এবং সময় বসিয়ে নেয় অডিয়ো সিস্টেম নিজেই। রেকর্ড করা সেশানের একটা কপি একটা মাইক্রোসিডিতে করে রঙ্গপ্রকাশকে দিয়ে দেন। ফলে ডক্টর এবং ক্লায়েন্ট দুজনেই থেরাপির প্রগ্রেস সম্পর্কে পুরোপুরি আপডেটেড থাকেন। প্রয়োজনে কখনও সেগুলো নিয়ে নিজেরা আলোচনাও করতে পারেন।

পকেট থেকে ছোট একটা নোটবই আর পেন বের করে নিলেন ডক্টর। কারণ, সেশানের মাঝে-মাঝে কোনও-কোনও পয়েন্ট নোট করে নেওয়ার দরকার হয়। এই নোটগুলো ওঁর নিজের। এগুলো শ্রীধর পাট্টার জন্য নয়।

ঠোঁটের ওপর জিভ বুলিয়ে নিলেন রঙ্গপ্রকাশ। তারপর আচমকা শুরু করলেন।

‘ছোটবেলাতে আপনি ফিরে যেতে চান?’

‘না—না।’

শ্রীধর চোখ বুজে ফেলেছিলেন। বোধহয় তীক্ষ্ণ মন:সংযোগ তৈরি করতে চাইছিলেন। ওঁকে দেখে রঙ্গপ্রকাশের মনে এক বিচিত্র ভাব জেগে উঠল। তীব্র প্রতিশোধকামী যে-নিষ্ঠুর মানুষটাকে তিনি জেনে এসেছেন এখন তাকে দেখে অসহায় ঘুমন্ত শিশু বলে মনে হচ্ছে।

‘ছোটবেলায় ফিরতে চান না কেন? অনেকেরই তো ছোটবেলায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে…।’

‘না, আমার ছোটবেলায় ফিরতে ইচ্ছে করে না।’

‘ছোটবেলায় সবাই ফিরে যেতে চায় সিকিওরিটির জন্যে। কারণ, তখন চারপাশে বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন—সব গুরুজনেরা থাকেন। তাঁরা ছোটবেলার নিরাপত্তার জোগান দেন। দে প্রাোভাইড দ্য সেফটি ওয়ালস…।’

‘না, আমি ফিরব না। আমার কোনও সেফটি ওয়াল ছিল না।’

‘তা হলে কী ছিল?’

‘কিছুই ছিল না। কেউ ছিল না। শুধু আমি ছিলাম। একা। একেবারে একা।’

‘একা থাকতে আপনার ভয় করত না?’

‘না। ফিয়ার ওয়জ মাই ওনলি রিলেটিভ। ওনলি ফ্রেন্ড…।’

নোটবইতে কয়েকটা পয়েন্ট টুকে নিলেন রঙ্গপ্রকাশ। অদ্ভুত মন্তব্য। ‘ফিয়ার ওয়জ মাই ওনলি রিলেটিভ। ওনলি ফ্রেন্ড…।’ ভয় আমার একমাত্র আত্মীয়। একমাত্র বন্ধু…।

‘ভয় কীভাবে আপনার আত্মীয় হল? বন্ধু হল?’

‘আমার চারপাশে ভয় ছিল। ভয় আমাকে ঘিরে থাকত। মাঝে-মাঝে মনে হত, ইট ওয়জ মাই সেফটি ওয়াল।’

‘আপনি কি তাড়াতাড়ি বড় হতে চাইতেন? মনে হত, এই দুনিয়ার সঙ্গে ঠিকঠাক মোকাবিলা করার জন্যে আপনার তাড়াতাড়ি বড় হয়ে ওঠা দরকার?’

‘হ্যাঁ—মনে হত। মাঝে-মাঝে মনে হত।’

‘আপনার তো বন্ধু ছিল না বললেন—তাই তো?’

‘হ্যাঁ—।’

‘কোনও শত্রু ছিল?’

‘প্রচুর। আমার মনে হত, আমার চারপাশে শত্রু। কিলবিল করছে। ওদের আমি ঘেন্না করি। আই ডেসপাইজ দেম।’

‘কারা সেই শত্রু? দু-একজনের নাম বলতে পারেন?’

‘নাম? নাম কী বলব! সবাই শত্রু। দ্য হোল সোসাইটি ওয়জ মাই এনিমি—।’

শ্রীধরের উত্তর শুনতে-শুনতে নোট নিলেন ডক্টর। সোসাইটির প্রতি অ্যাপ্যাথি। সমাজ নাপসন্দ। সেই থেকেই হয়তো সমাজকে দখল করে শাসন করার ইচ্ছেটা অবচেতনে দানা বেঁধেছে। এখন নিউ সিটিতে তিনি যেটা করছেন। শাসন। অতিশাসন। অপশাসন।

‘সবাই কেন শত্রু হবে?’ কোমল গলায় বললেন ডক্টর। তারপর কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘ছোটবেলায় কে আপনাকে দেখাশোনা করত?’

শ্রীধরের যে বাবা-মা ছিল না সেটা আগের নানান থেরাপি সেশান থেকে রঙ্গপ্রকাশ জানেন। কিন্তু বাবা-মায়ের বদলে কারা ওঁকে ছোটবেলাটায় মানুষ করেছেন সেটা এখনও জানা যায়নি। শ্রীধর সবসময় প্রশ্নটা এড়িয়ে গেছেন। আজ আবার কথায়-কথায় সেই একই প্রশ্ন এসে গেছে।

শ্রীধর চোখ বুজে ছিলেন। ওঁর ফরসা মুখে অপ্রসন্নতার কয়েকটা ভাঁজ পড়ল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর বললেন, ‘দেখাশোনা কেউ করত না। জ্ঞান হয়ে থেকেই দেখেছি আমি সবার ফাইফরমাশ খাটছি। আমাকে যে-সে শাসন করছে—চড়-থাপ্পড় মারছে—গায়ে থুতু দিচ্ছে।’

‘বাবা-মায়ের খোঁজ করেননি কখনও?’

‘প্রথম-প্রথম একে-তাকে জিগ্যেস করতাম…পরে আর করিনি।’

‘কেন, করেননি কেন?’

‘যারা ইচ্ছে করে লুকিয়ে পড়ে তাদের কখনও খুঁজে পাওয়া যায়! আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমার মা-বাবা আমাকে ফেলে পালিয়ে গেছে—লুকিয়ে পড়েছে—আর কখনও আমার সামনে আসবে না বলে…।’

‘বাবা-মাকে কাছে পাওয়ার জন্যে মন টানত না? কষ্ট হত না…কান্না পেত না?’

‘প্রথম-প্রথম মন টানত। আমার বয়েসি বাচ্চা-কাচ্চাগুলো রাস্তার ধারের নোংরা ঝুপড়িতে থাকত। দু-বেলা ঠিকমতো খেতে পেত না। খাবারের খোঁজে আবর্জনা ঘাঁটত। কিন্তু ওদের দেখতাম বাবা-মায়ের সঙ্গে খেলা করছে, হাসছে—কী আনন্দে আছে। তখন আমার কষ্ট হত, কান্না পেত। তারপর…তারপর…রাগ হত। অসহ্য রাগ। সবার বাবা-মায়ের জন্যে আমার ঘেন্না হত।’

নোট নিতে-নিতে মুখ তুললেন রঙ্গপ্রকাশ। শ্রীধরের দিকে তাকালেন। ওঁর মুখে একটা লালচে আভা। আর তার সঙ্গে ঘৃণা আর উত্তেজনার ছাপ।

‘হ্যাঁ—বুঝতে পারছি। কিন্তু…একটা কথা বলুন তো। ছোটবেলায় যেখানে আপনি থাকতেন—মানে, ওল্ড সিটিতে—সেখানে আপনার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না?’

‘না, না, না-না-না!’ শ্রীধরের ঠোঁট চিরে হিসহিস শব্দে ‘না’-এর স্রোতটা বেরিয়ে এল। মুখের লালচে আভা আরও গাঢ় হল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন ডক্টর। শ্রীধরের উত্তেজনার পারদকে খানিকটা নেমে আসার সময় দিলেন। তারপর : ‘ওল্ড সিটিকে আপনার ভালো লাগে না?’

‘ভালো লাগবে?’ অবাক সুরে পালটা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন : ‘কেন, ভালো লাগবে কেন?’

‘আপনার জন্মভূমি—তাই…।’

‘জন্মভূমি মাই ফুট। আই হেট ওল্ড সিটি। ওল্ড সিটিকে আমি ঘেন্না করি। ওই নোংরা, অসুস্থ, ক্লেদাক্ত শহরটা আমাকে কী দিয়েছে? কিছুই না! কিচ্ছু না! ওই শহরটাকে আমি হাতের মুঠোয় পিষে গুঁড়ো করে ফেলতে চাই। আই ওয়ন্ট টু অ্যানিহিলেট দ্যাট রটন হেল অ্যালংউইথ অল দ্য স্কাম ইন ইট।’

শ্রীধর বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিলেন। ওঁর ঠোঁট নড়ছিল। নি:শব্দে কিছু একটা বিড়বিড় করছিলেন।

নোটবইয়ের পাতায় রঙ্গপ্রকাশের পেন ব্যস্তভাবে চলছিল। একইসঙ্গে ওঁর মনের ভেতরে শ্রীধর পাট্টার মনস্তাত্বিক মূল্যায়নও চলছিল। সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল তৈরি হচ্ছিল।

ওল্ড সিটির প্রতি শ্রীধরের এই একরোখা ঘৃণার জন্যই কি সুপারগেমস কর্পোরেশনের নানান হাই রিসক গেমসের প্রতিযোগী জোগাড় করা হয় শুধুমাত্র ওল্ড সিটি থেকে? এই কারণেই কি বড়লোক বানানোর লোভ দেখিয়ে ওল্ড সিটির গরিব ‘ছোটলোক’গুলোকে দোজখের দরজায় পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়?

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রীধরের পরিচয়হীনতার ক্ষোভ। সেখান থেকেই তৈরি হয়েছে সুস্থ সমাজের প্রতি ওঁর আক্রোশ।

শ্রীধর পাট্টার মনের গঠনের মানচিত্র যেন অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। সন্দেহবাতিকগ্রস্ত একজন অতিমাত্রায় সংবেদনশীল মানুষ। ওঁর মধ্যে রয়েছে গোঁয়ার্তুমি, হিংসা, অসার আত্মগর্ব। এ ধরনের মানুষ নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই কোনও গুরুত্ব দেয় না, আর নিজের ভুল বা ব্যর্থতার জন্য সবসময় অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপায়। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অপরিণত বিবেক আর অপরিণত অপরাধবোধ।

সব মিলিয়ে একটা জটিল প্যারানয়েড পারসোনালিটি।

‘ওল্ড সিটি আপনি ছেড়ে এলেন কেমন করে?’ নোট নেওয়া শেষ করে প্রশ্নটা করলেন রঙ্গপ্রকাশ।

‘সেটা এক আশ্চর্য ঘটনা।’ চোখ বুজেই ঠোঁটে হাসলেন শ্রীধর। তারপর এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন স্লো মোশানে একটা সিনেমা দেখছেন এবং অস্ফুট স্বরে ধীরে-ধীরে সেটার বর্ণনা করছেন।

‘আমার দাদা বলধর পাট্টা আমাকে ওল্ড সিটিতে হঠাৎই খুঁজে পায়। আমার গলার একটা চেন দেখে চিনতে পারে। আমার খুব ছোটবেলায় এই নিউ সিটিতে পিস ফোর্সের একটা বিদ্রোহ হয়েছিল। শুনেছি তখন আমার বয়েস ছিল নাকি এক বছর দু-মাস। সেই বিদ্রোহের সময় পিস ফোর্সের ছ’জন বিদ্রোহী অফিসার আমাকে কিডন্যাপ করে শুটারে চেপে ওল্ড সিটিতে পালিয়ে যায়। ওরা দাদাকে থ্রেট করে—বলে যে, কাউকে এই কিডন্যাপিং-এর কথা জানালে ওরা আমাকে খুন করে ফেলবে। পরে দাদা মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করে সবক’টা বিদ্রোহীকে খুঁজে বের করে গুনে-গুনে খতম করে। কিন্তু আমাকে আর খুঁজে পায়নি। পেয়েছে তার অনেক বছর পরে—প্রায় তেরো বছর পরে। তখন দাদার কাছেই সব কথা শুনেছি—।’

এই গল্পটা শ্রীধর তৈরি করেননি—করেছিলেন বলধর পাট্টা। গল্পটা বানানো হলেও এর মধ্যে পিস ফোর্সের বিদ্রোহের অংশটা সত্যি। এই গল্পটা দীর্ঘদিন ধরে সবাইকে বলে-বলে ব্যাপারটা এখন এমন দাঁড়িয়ে গেছে যে, শ্রীধর নিজেও গল্পটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন।

কিন্তু গল্পটার মধ্যে একটা ফাঁক রয়ে গেছে। এবং সেই ফাঁকের দিকে তাক করেই পরের প্রশ্নটা করলেন রঙ্গপ্রকাশ।

‘বলধর পাট্টার তো বাবা-মায়ের পরিচয় ছিল। তা হলে আপনি নিজেকে পরিচয়হীন বলছেন কেন?’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শ্রীধর জবাব দিলেন, ‘যখন একটা শিশুর বাবা-মা-কে ভীষণ প্রয়োজন তখন যদি তাদের না পায় তা হলে সে কোন বিশ্বাস নিয়ে বড় হয়ে উঠবে? আমার এক বছর দু-মাস বয়েস থেকে প্রায় চোদ্দো বছর বয়েস পর্যন্ত আমি আবর্জনার মতো বড় হয়ে উঠলাম। বাবা-মা-কে সচেতনভাবে কখনও চোখেই দেখলাম না। তাঁরা শুধু হলোগ্রামের ছবি হয়ে আমার কাছে বেঁচে রইল। তা হলে আমার মনে হবে না কি যে, আমার মা-বাবা বলে কেউ ছিল না! আই অ্যাম আ ব্লাডি অরফ্যান!’

এই ব্যাখ্যাটা শ্রীধর পাট্টা বহুবছর আগেই তৈরি করেছেন। প্রয়োজনে ব্যবহার করেন। যেমন এখন ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাসের থেরাপির সময় ব্যবহার করছেন।

শ্রীধর ব্যাখ্যা দিলেও সাইকোঅ্যানালিস্ট রঙ্গপ্রকাশ তার মধ্যে একটু-আধটু ফাঁকফোকর দেখতে পাচ্ছিলেন। আসলে সাইকোথেরাপি সেশানের সময় ডক্টর এবং পেশেন্ট দুজনকেই কমিটেড হতে হয়। পেশেন্ট যখন নিজের সমস্যার কথা ডক্টরকে বলবে তখন তাকে সৎ হতে হবে—কোনও মিথ্যে কথা বললে চলবে না। আর থেরাপিস্টকেও হতে হবে অবজেকটিভ, প্রফেশনাল, সাপোর্টিভ—আর, সেশানের সব কথাই তাঁকে গোপন রাখতে হবে।

শ্রীধর পাট্টার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বডি ল্যাঙ্গুয়েজ লক্ষ করে রঙ্গপ্রকাশের মনে হচ্ছিল, শ্রীধর ওঁর সততার শর্ত পুরোপুরি পূরণ করতে পারছেন না।

ঘড়ির দিকে তাকালেন। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। থেরাপি সেশান এখানেই শেষ করা যাক। তাই টেপ-রেকর্ডারকে শোনানোর জন্য বললেন, ‘এন্ড অফ থেরাপি সেশান। থ্যাংক য়ু, স্যার।’

কথাগুলো শুনলেন শ্রীধরও। কিন্তু তিনি শুনতে পেয়েছেন বলে বোঝা যাচ্ছিল না। একইরকমভাবে চোখ বুজে শরীর এলিয়ে শুয়ে আছেন। শুধু বুকটা ওঠা-নামা করছে।

নোটবই আর পেন পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন রঙ্গপ্রকাশ। একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লেন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরের উষ্ণতা বোধহয় অনেকটা কমে গিয়ে থাকবে। কারণ, এখন বেশ শীত-শীত করছিল।

হঠাৎই ডক্টরকে চমকে দিয়ে স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো ছিটকে সোজা হয়ে বসলেন শ্রীধর। চোখ খুললেন। ডক্টরের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘ওয়েল, ডক্টর, হোয়াট ডু য়ু থিংক?’

গোলাপি প্লাস্টিকের ফোল্ডারটা কোলের ওপর তুলে নিয়েছিলেন রঙ্গপ্রকাশ। সেটা নাড়াচাড়া করছিলেন। শ্রীধরের প্রশ্নের উত্তরে আলতো করে বললেন, ‘আই থিংক ইট ইজ ভেরি ইন্টারেস্টিং, স্যার। আরও কয়েকটা সেশানের পর আমি হয়তো আপনাকে কিছু মেডিসিন নেওয়ার কথা বলব। তার আগে আমাকে একজন সাইকোফার্মাকোলজিস্টের সঙ্গে ডিসকাস করতে হবে…।’

‘যত খুশি ডিসকাস করুন—শুধু মনে রাখবেন, আমার নাম যেন কোনওভাবেই মেনশানড না হয়। যদি হয় তা হলে আই অ্যাম গোয়িং টু বি ইয়োর লাস্ট পেশেন্ট, ডক্টর…।’

শেষ কথাটায় রঙ্গপ্রকাশের গায়ে কাঁটা দিল। ফোল্ডারের ওপরে ওঁর হাতের আঙুল অকারণেই দ্রুত নড়াচড়া করতে লাগল। প্রাণপণে তিনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

শ্রীধর দু-হাত শূন্যে তুলে আড়মোড়া ভাঙলেন। ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়ামের ভঙ্গিতে হাত দুটো কয়েকবার পাশে ছড়ালেন, ওপর-নীচ করলেন।

রঙ্গপ্রকাশ হাতের ফোল্ডারটা খুললেন। আলতো করে বললেন, ‘স্যার, এবার জিশান পালচৌধুরীর সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল নিয়ে একটু কথা বলতে পারি?’

‘হ্যাঁ—পারেন।’ অনুমতি দিলেন শ্রীধর এবং রঙ্গপ্রকাশের দিকে ঝুঁকে বসলেন।

হ্যাঁ, জিশান পালচৌধুরীর ভেতরটা তিনি এবার বুঝতে চান।

থেরাপি সেশান শেষ হওয়ার পর রঙ্গপ্রকাশের বুক থেকে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। মনে হল, এতক্ষণ ধরে ওঁর যেন দম-বন্ধ-করা অবস্থা চলছিল—এবং এই প্রথম স্বাধীনভাবে শ্বাস নিতে পারছেন।

‘স্যার, আগে এগুলো একবার দেখে নিন। এতে সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল সম্পর্কে বেশ কিছু ইমপরট্যান্ট নোটস আছে আর রেলিভ্যান্ট কয়েকটা ফোটোগ্রাফ আছে।’ কথাগুলো বলে খোলা ফোল্ডরটা শ্রীধর পাট্টার দিকে এগিয়ে দিলেন।

শ্রীধর ফোল্ডারটা নিয়ে মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলেন। পাতার পর পাতা ওলটাতে লাগলেন। ফোটোগ্রাফগুলো খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।

রঙ্গপ্রকাশ দেখছিলেন শ্রীধরের কপালে ভাঁজ তৈরি হয়েছে। পাতলা ঠোঁট মাঝে-মাঝে নি:শব্দে নড়ছে। শ্রীধরের মনের মেশিনে জিশান পালচৌধুরীর সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইলের মূল্যায়ন তৈরি হচ্ছে।

সৎ। স্পষ্ট। মানবিক মূল্যবোধের দুর্বলতায় আচ্ছন্ন। বড় সহজে বন্ধুত্ব তৈরির চেষ্টা করে। শত্রুকেও বন্ধু বলে ভাবতে চায়।

জিশান সম্পর্কে এই কথাগুলোই শ্রীধর ভাবছিলেন।

কিন্তু ছেলেটার মধ্যে পোটেনশিয়াল আছে। আছে পোটেনশিয়াল এনার্জি। জাব্বার সঙ্গে পিট ফাইটের সময় সেই পোটেনশিয়াল এনার্জিকে শ্রীধর কাইনেটিক এনার্জিতে বদলে যেতে দেখেছেন। তা ছাড়া এই ধরনের মানুষ পেশাদার নয় বলেই মূল্যবোধের হাতিয়ার নিয়ে মরিয়া হয়ে উঠতে পারে।

শ্রীধর ভাবছিলেন। শুধু ভাবছিলেন।

জিশানের কিল গেম-এর তারিখ এবার ঠিক করতে হবে। এবং জেলখানা থেকে তিনজন কিলার—না, না…সুপারকিলার—কিংবা সুপারি কিলারও বলা যেতে পরে—তিনজন মারাত্মক খুনিকে বেছে নিয়ে আসতে হবে—চব্বিশ ঘণ্টার জন্য। তারপর গেম সিটিতে চব্বিশ ঘণ্টার কিল গেম। সেই খেলার লাইভ টেলিকাস্ট দেখতে-দেখতে সবার বন্ধ হয়ে আসবে দম। এবং জিশান খতম।

আপনমনে মাথা নাড়লেন শ্রীধর। সুপারহিরোকে শেষ করতে সুপারকিলারই দরকার। সুতরাং এই ‘খুনি’ বাছাইয়ের কাজে এবার শ্রীধর নিজেই যাবেন। জেলে যতজন মারাত্মক খুনি আছে তাদের সকলের ‘কারিকিউলাম ভিটা’ খুঁটিয়ে পরখ করে দেখবেন—বারবার। তারপর বেছে নেবেন তিনজনকে। যারা শয়তানিতে শয়তানকেও হারাতে পারে।

জিশানের একটা ফোটোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন শ্রীধর। মনে হচ্ছিল এই জোয়ান ছেলেটা এক-একটা খেলায় কোয়ালিফাই করে ধীরে-ধীরে যেন কিল গেম-এর দিকে নয়—শ্রীধরের দিকে এগোচ্ছে। শ্রীধর পাট্টাকে নি:শব্দে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে।

না:, জিশান কিছুতেই কিল গেম-এ জিততে পারে না। যদি জেতেও, তা সত্বেও ওকে হারতেই হবে। শ্রীধর সে-ব্যবস্থা অবশ্যই করে রাখবেন। কারণ, জিশানকে জিততে দেওয়া যাবে না। জিশান যদি জেতে তা হলে সেটা হবে নিউ সিটির স্বাস্থ্যের পক্ষে বিপজ্জনক।

শ্রীধরের চোয়াল শক্ত হল। ঠোঁট টিপলেন। ছোট্ট করে মাথা দোলালেন। তারপর জিশানের মুখের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন—যেন ওর সঙ্গে কথা বলছেন।

রঙ্গপ্রকাশ চুপ করে বসে নিজের পেশেন্টকে লক্ষ করছিলেন। ও জানে না ওর অপরাধবোধ অপরিণত, বিবেকেরও একই দশা। জানে না, ও একজন প্যারানয়েড পারসোনালিটির মানুষ, ‘মরাল মোরন’। ও নিজে যে-পথে চলার কথা ভাবে সেটাই ওর কাছে একমাত্র সঠিক পথ।

শ্রীধরের পকেটের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল। শুটারের শিসের শব্দ, আর তার সঙ্গে মিশে আছে যুদ্ধ ঘোষণার ঝংকার তোলা ব্যান্ড। এই কপিরাইট রিং টোন শুধুমাত্র শ্রীধর পাট্টার জন্য তৈরি।

হাতের ফোল্ডার শব্দ করে বন্ধ করলেন শ্রীধর। রঙ্গপ্রকাশের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘রিপোর্টটা তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করুন। আমাকে এর একটা সফট কপি মাইক্রোসিডিতে করে দেবেন—আর তার সঙ্গে একটা হার্ড কপি। একটা কথা মনে রাখবেন : আপনার অ্যাসেসমেন্ট যেন ক্রিস্টাল ক্লিয়ার হয়। ওতে যেন কোনওরকম ঝাপসা মন্তব্য না থাকে। মানে সায়েন্টিফিক জারগন দিয়ে পাশ কাটাতে চেষ্টা করবেন না…।’

ফোল্ডারটা ফেরত পেলেন রঙ্গপ্রকাশ। শ্রীধরের ফোন তখনও বাজছিল।

উঠে দাঁড়ালেন। ফোন বের করে কানে দিলেন। বাঁ-গালে আঙুলের ডগা ঘষলেন কয়েকবার।

রঙ্গপ্রকাশও সঙ্গে-সঙ্গে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

‘হ্যালো—।’ শ্রীধর ঠান্ডা গলায় বললেন।

‘মার্শাল, স্যার—’ ওপাশ থেকে সিকিওরিটি চিফের গলা ভেসে এল : ‘আপনাকে ডিসটার্ব করার জন্যে দু:খিত, কিন্তু এইমাত্র আমার দুই সাবর্ডিনেট স্টাফ ভীষণ ইমপরট্যান্ট খবর নিয়ে এসেছে…।’

‘শুনছি…’ নিরুত্তাপ গলায় বললেন শ্রীধর। কারণ, সহজে উত্তেজিত হওয়া শ্রীধরের স্বভাব নয়। তা ছাড়া ওঁর সিকিওরিটি স্টাফ প্রায়ই নানান গোপন খবর ওঁর কাছে পৌঁছে দেয়। যেহেতু কোনও সঠিক খবর পৌঁছে দিলে ভালোরকম ক্যাশ প্রাইজের ব্যবস্থা আছে, এবং খবরের গুরুত্ব বুঝে প্রাোমোশনও দ্রুত হয়ে যেতে পারে, সেহেতু খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য সিকিওরিটি টিমের মধ্যে এক অদ্ভুত অদৃশ্য প্রতিযোগিতা আছে। শ্রীধর সেটা ভালো করেই জানেন এবং এই প্রতিযোগিতার মনোভাবটা তিনি জিইয়ে রাখতে চান। কারণ, প্রতিযোগিতা থেকেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আসে। আর সেখান থেকেই আসে অবিশ্বাস। পরস্পরের প্রতি।

এই অবিশ্বাসের সম্পর্কটা শ্রীধর জিইয়ে রাখতে চান। তাতে ওদের ওপরে শাসনের নিয়ন্ত্রণটা সহজে কায়েম করা যায়। আর ওদের পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাসের ছিদ্র পথে শ্রীধর অনেক গোপন খবর পান—পরস্পরবিরোধী গোপন খবর। সেইসব খবরকণিকা থেকে তোলমোল করে শ্রীধর ছেঁকে বের করে নেন নির্যাসটুকু। তারপর নিজস্ব ঢঙে প্রতিরোধী ব্যবস্থা নেন।

‘স্যার, ওদের আপনার কাছে নিয়ে আসছি। ওদের কোড নম্বর হল…’ সিকিওরিটি চিফ সেই দুজন সিকিওরিটি স্টাফের কোড নম্বর বললেন।

রঙ্গপ্রকাশ দেখলেন শ্রীধর কোড নম্বরগুলো শুধু শুনে নিলেন—কোথাও টুকে নিলেন না। না, ভুল হল। বরং বলা ভালো, শ্রীধর পাট্টা নম্বরগুলো ওঁর মাথায় টুকে নিলেন। সত্যি, অমানুষ এই মানুষটার আশ্চর্য মেমোরি! প্রাচীন যুগ হলে শ্রীধরকে অনায়াসে ‘শ্রুতিধর’ বলা যেত।

‘ঠিক আছে, ওদের নিয়ে আসুন। আমি আপনার আর ওদের কোড নম্বর পাঞ্চ করে ইনটারনাল সিকিওরিটি ক্লিয়ারেন্স থ্রু করে রাখছি…।’

কথা বলা শেষ করে স্যাটেলাইট ফোনটা চোখের সামনে ধরলেন। সিকিওরিটি চিফ আর তার দুজন স্টাফের কোড নম্বর তিনটে দ্রুত পাঞ্চ করলেন। তারপর আরও কয়েকটা বোতাম টিপে দিলেন পরপর।

স্যাটেলাইট ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে আড়চোখে রঙ্গপ্রকাশের দিকে তাকালেন : ‘ডক্টর, প্লিজ একটু ওয়েট করুন। পাশের ঘরে গিয়ে আমি একটা ইমার্জেন্সি ব্যাপার চট করে সেরে আসছি। এসে আপনার ই. আই. নিয়ে কথা বলছি। এক্সকিউজ মি…।’

শ্রীধর চলে গেলেন। রঙ্গপ্রকাশ ওঁর চলে যাওয়া দেখলেন।

ওঁর পা ফেলার ঢং থেকে আত্মবিশ্বাসের বিকিরণ টের পেলেন ডক্টর। অবাক হয়ে ভাবলেন, মানুষটা কোথা থেকে কোথায় এসে পৌঁছেছে! ওল্ড সিটির আবর্জনায় তেরো বছর কাটিয়ে শ্রীধর হয়তো দাঁত-নখের লড়াইটা শিখেছেন, কিন্তু লেখাপড়া?

উত্তরটা শ্রীধরের নানান থেরাপি সেশান থেকেই পেয়েছেন রঙ্গপ্রকাশ। বলধর পাট্টা ‘হারানো’ ছোট ভাইকে খুঁজে পাওয়ার পর দশবছর ধরে তাকে নিবিড় প্রশিক্ষণ দিয়েছেন—নানান বিষয়ে। তার মধ্যে প্রধান ছিল ইংরেজি শেখা আর ম্যানার্স শেখা। এ দুটো শেখার জন্য শ্রীধরকে দু-বছর ক্যালিফোর্নিয়ায় রেখেছিলেন বলধর। সেখানে ওঁর জন্য স্পেশাল প্রাইভেট কোচিং-এর ব্যবস্থা ছিল।

তারপর এল জাপানের পালা। কিক বক্সিং আর সামুরাই সোর্ড। এই দুটো বিষয়ে শ্রীধরের আগ্রহ আর দক্ষতা বলধর পাট্টাকে অবাক করেছিল। তিন বছর ট্রেনিং-এর পর শ্রীধর যেখানে পৌঁছেছিলেন একজন প্রতিভাবান শিক্ষার্থী সাধারণত দশ বছরে সেখানে পৌঁছোতে পারে।

জাপান থেকে ফেরার পর বাড়িতে থেকেই শ্রীধর লেখাপড়া শিখেছেন আর শরীরচর্চা করে গেছেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন লড়াইয়ে শ্রীধর নাম দিয়েছেন। ওঁর সাকসেস রেট ছিল নাইনটি ওয়ান পারসেন্ট।

বলধর লক্ষ করেছিলেন, শ্রীধরের মধ্যে একটা সহজাত পশু-প্রবৃত্তি রয়েছে। সেটা হল, প্রতিপক্ষকে চূর্ণ বিচূর্ণ করা, খতম করা। এই অ্যানিম্যাল ইনস্টিংকট-ই শ্রীধরের মেজর অ্যাসেট।

শ্রীধরের লেখাপড়ার প্রায় পুরোটাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে শেখা, অথবা বিদেশ থেকে আনা কাস্টম-বিলট মাইক্রোসিডি কমপিউটারে চালিয়ে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। সবকিছু শেখার ব্যাপারে ওঁর অসাধারণ মেমোরি ওঁকে দুর্দান্তভাবে সাহায্য করেছে। এবং সেই সময়ে শ্রীধর যতগুলো অন-লাইন টেস্ট দিয়েছেন তার সবগুলোতেই দারুণ রেজাল্ট করেছেন।

শ্রীধরকে নিয়ে বলধর পাট্টা খুব গর্ব অনুভব করতেন। একটা সময়ের পরে তিনি শ্রীধরকে সত্যি-সত্যি নিজের ভাই বলে ভাবতে শুরু করেন। মৃত্যুর মুহূর্ত পর্যন্ত ওঁর এই ভাবনা অটুট ছিল।

রঙ্গপ্রকাশ ছোট-ছোট পা ফেলে পায়চারি করছিলেন। কী এক কৌতূহলে তিনি কনফারেন্স রুম ওয়ানের কাচের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন।

স্বচ্ছ দরজা ভেদ করে রঙ্গপ্রকাশের দৃষ্টি দূরে পৌঁছে গেল।

একটা কাচের ঘর দেখতে পাচ্ছিলেন। সেই ঘরের দরজায় হলোগ্রাম দিয়ে রঙিন ডিজাইন করে লেখা রয়েছে ‘ভিজিটর’।

ঘরের ভেতরে প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন শ্রীধর। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, একটা চাপা অস্থিরতা ওঁর ভেতরে কাজ করছে। শরীরের ওজনটা বারবার এক পা থেকে আর-এক পায়ে নিচ্ছেন, থেকে-থেকেই তাকাচ্ছেন স্টেইনলেস স্টিলের প্যাঁচানো সিঁড়ির দিকে।

একটু পরেই কালো য়ুনিফর্ম পরা তিনজন লোক সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। কাচের দেওয়ালে পেরিয়ে শ্রীধর পাট্টাকে দেখতে পেল। সুতরাং লক্ষ্য স্থির করে তিনজনে দম দেওয়া খেলনা পুতুলের মতো ‘ভিজিটর’ লেখা ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল।

শ্রীধরের কাছে পৌঁছে ওরা মিলিটারি কায়দায় স্যালুট ঠুকল।

শ্রীধর একচিলতে হেসে ওদের অভিবাদন ফিরিয়ে দিলেন।

তিনজনের মধ্যে যার বয়েস একটু বেশি সে-ই বোধহয় সিকিওরিটি চিফ—কারণ, তার য়ুনিফর্মের বুকের কাছে লাল ও নীল রঙের দুটো কাপড়ের স্ট্রিপ, আর তার ওপরে চারটে করে মেটাল স্টার।

বছর চল্লিশের মানুষটার লম্বাটে মুখ যেন তামাটে পাথরে খোদাই করা। চোখ দুটো ছোট-ছোট। দু-গাল এমন বসে গেছে যে, হঠাৎ করে প্রেত বলে মনে হয়।

মাথার টুপিতে আঙুল ছুঁইয়ে চিফ বলল, ‘স্যার, এই যে—এরা দুজন—কুশিয়া চতুর্বেদী আর নন্দরাম সরখেল। ওরা একটা টেররিস্ট গ্রুপের কিছু টপ সিক্রেট ইনফরমেশান লাকিলি জানতে পেরেছে।… সেই…সেই ইয়েগুলো আপনাকে জানাতে চায়। ফার্স্ট হ্যান্ড…।’

শ্রীধর কুশিয়া আর নন্দরামকে দেখলেন। শুধু দেখলেন না, ঠান্ডা দৃষ্টিতে মেপেও নিলেন। বয়েস খুব বেশি হলে চব্বিশ কি পঁচিশ। দুজনেরই মুখে একটা ‘খোকা-খোকা’ ভাব। নিষ্পাপ চোখ, তেলতেলে মুখ, চওড়া গোঁফ।

সব মিলিয়ে মুখ দুটোয় বেশ মিল আছে।

বেশ কয়েক সেকেন্ড পর শ্রীধর চিফের দিকে তাকালেন। তারপর হাতের ইশারায় চিফকে ডিসমিস করে দিলেন, বললেন, ‘আপনি এবার আসতে পারেন…।’

ঘরের এক কোণে একটা বড় সোফা রাখা ছিল। সেটার দিকে ইশারা করে কুশিয়া আর নন্দরামকে বসতে বললেন শ্রীধর। ওরা বাধ্য ছাত্রের মতো ‘স্যার’-এর কথা শুনল। সোফার কাছে গিয়ে পাশাপাশি বসে পড়ল দুজনে।

নিউ সিটির টেররিস্ট গ্রুপ সত্যিই বেশ চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শ্রীধরের খুব ছোটবেলায় পিস ফোর্সের যে-বিদ্রোহ হয়েছিল বলধর পাট্টা তার আগুন নেভাতে পেরেছিলেন। বলধর জানতেন, যদি একটা মানুষের জীবনযাপনের সব আরাম তাকে উপহার দেওয়া যায় তা হলে সে আর বিদ্রোহ করবে না। তাই নিউ সিটির মানুষের রোজকার জীবনের যা-যা বস্তুতান্ত্রিক চাহিদা, যদি নিখুঁতভাবে তার নিয়মিত জোগান দেওয়া যায়, তা হলে কারও আর কোনও ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকবে না।

সেই পথই ধরেছিলেন বলধর। পিস ফোর্সের গার্ডÇদের কোনও অভাব রাখেননি, কিন্তু একইসঙ্গে তাদের ওপরে গোপন নজরদারির তীব্রতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

কিন্তু বলধর পাট্টা আগুন নেভালেও ছাই থেকে গিয়েছিল। আর সেই ছাইয়ের আড়ালে লুকিয়ে ছিল আগুনের কিছু কণা। সেই কণা থেকেই মাঝে-মাঝে জ্বলে উঠত নতুন আগুন। ছোটখাটো অসন্তোষ, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ।

কেন এই অসন্তোষ, বিদ্রোহ, তা বলরাম বুঝতে পারতেন না। তার কারণ, বস্তুতান্ত্রিক চাহিদার বাইরেও যে মানুষের চাহিদা থাকে সেটা তিনি বোঝেননি। তাই শিকারির গুলিতে একটা পাখির মৃত্যু হলে অন্য একজন মানুষ কেন দু:খ পাবে সেটা বলধর বুঝতেন না। বুঝতে পারতেন না, কয়েকটা প্রজাপতি আগুনের আঁচে পুড়ে মরলে কেন মানুষ কষ্ট পাবে। সবসময় ভাবতেন, না, এর কোনও লজিক নেই। তেমনই ভাবতেন সুপারগেমস কর্পোরেশনের ডিজাইন করা মনোহারী সব খেলায় কোনও পার্টিসিপ্যান্ট আহত কিংবা নিহত হলে নিউ সিটির কেউ কেন দু:খ পাবে। অচেনা, অজানা, অনাত্মীয় কোনও মানুষ মারা গেলেও কারও দু:খ পাওয়া উচিত নয়। এইসব ইললজিক্যাল ব্যাপারের কোনও মানে হয় না।

বলধর পাট্টা নিজেকে যথেষ্ট লজিক্যাল মানুষ বলে মনে করতেন। তাই ওঁর যান্ত্রিক লজিকের কাঠামো দিয়ে এইসব ‘আলতু-ফালতু’ ব্যাপারকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতেন—কিন্তু পারতেন না।

শ্রীধর পাট্টাকে বলধর নিজের জেরক্স কপি তৈরি করতে চেয়েছিলেন। সেটা করতে গিয়ে দেখেছিলেন, শ্রীধর যেন আগে থেকেই বলরামের জুতোয় পা গলিয়ে বসে আছেন।

সুতরাং বলধরের কাজটা অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল। নিজের হাতে তিনি বলতে গেলে দ্বিতীয় বলধর পাট্টা তৈরি করে গিয়েছিলেন। নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, ভাবনা—সবই তিনি শ্রীধরের মধ্যে চারিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

তবে শ্রীধর কিন্তু দ্বিতীয় বলধর হননি। বরং বলধরকে বেশ কয়েকগুণ ছাপিয়ে গিয়েছেন। বলধর পাট্টা যদি বেঁচে থাকতেন তা হলে এই ‘বেশ কয়েক গুণ’ বলধরকে দেখে খুশি হতেন। এবং, এটা মনে রাখতে হবে, বলধর পাট্টাকে খুশি করা বেশ শক্ত কাজ ছিল।

বলধর যেভাবে ছোটখাটো বিদ্রোহ বা বিক্ষোভগুলোর মোকাবিলা করতেন, শ্রীধরও একইভাবে সেগুলো নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তিনি নিউ সিটির বাসিন্দাদের এটা বোঝাতে চেয়েছেন এইসব বিদ্রোহীরা আসলে টেররিস্ট, সন্ত্রাসবাদী। এরা অকারণে নির্বিচারে নিরীহ মানুষকে খুন করে। সেটা বোঝাতে গিয়ে শ্রীধর পাট্টা বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে গোপনে কোতল করে তার দায় বিদ্রোহীদের ঘাড়ে চাপিয়েছেন। তা ছাড়া সারা শহর জুড়ে গোপন নজরদারির কাজ আরও ব্যাপক, আরও শক্তিশালী করেছেন। কিন্তু তা সত্বেও…।

শ্রীধর চুপচাপ দাঁড়িয়ে কুশিয়া আর নন্দরামকে লক্ষ করছিলেন। তারই মধ্যে কখন যেন স্যাটেলাইট ফোনটা পকেট থেকে বের করে আবার হাতে তুলে নিয়েছেন।

একটু অপেক্ষা করার পর শ্রীধর বললেন, ‘কী বলবে বলো…।’

কুশিয়া তখন বলতে শুরু করল, ‘স্যার…মার্শাল, স্যার…কী হয়েছে বলছি।’ কয়েকবার ঢোঁক গিলল কুশিয়া। তারপর : ‘মার্শাল, স্যার, ডি, জি আর এম জোনে টেররিস্ট গ্রুপের বেশ কয়েকজন লোক আছে। ওদের কাছে আর্মসও আছে। আমি আর নন্দরাম…’ নন্দরামের দিকে তাকাল কুশিয়া : ‘গতকাল ওই তিনটে জোনে সিক্রেট প্যাট্রলে ছিলাম। ঘুরতে-ঘুরতে আমরা এম জোনের টুয়েলভ কমা সেভেন্টি এইট কো-অর্ডিনেটে যাই। সেখানে একটা শপিং মলে ঢুকি। আমরা…আমরা ফুড প্লাজায় একটা টেবিলে বসে…আমরা খাবারের অর্ডার দেব বলে ভাবছিলাম। তখন পাশের টেবিলে বসা দুজন লোকের কথা আমাদের কানে এল…।’ নন্দরামের দিকে তাকিয়ে কুশিয়া বলল, ‘এবার তুমি বলো…।’

নন্দরাম সোফায় বসার পর থেকেই উসখুস করছিল। এখন একটু নড়েচড়ে বসে স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করল। তারপর বলল, ‘স্যার, ওদের কথার পয়েন্টসগুলো আমি লিখে এনেছি। কয়েকটা ফোন নাম্বারও টুকেছি। ডি আর জি জোনে ওদের কনট্যাক্ট আছে। এই দেখুন…’ বলে প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাল নন্দরাম।

তার পরের ঘটনাগুলো শ্রীধর যেন স্লো মোশানে দেখতে পেলেন।

নন্দরাম ওর পকেট থেকে পয়েন্টস লেখা কাগজ বের করার বদলে একটা ০.২২ ক্যালিবারের হ্যান্ডগান বের করে নিয়েছে, এবং লেসার পয়েন্টার লাগানো ছোট্ট পিস্তলটা ধীরে-ধীরে উঁচিয়ে ধরছে শ্রীধরের দিকে।

‘ওয়ালথার টি-পি-এইচ স্টেইনলেস’ ডাবল অ্যাকশন হ্যান্ডগান। ম্যাট ফিনিশ স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। ওজন মাত্র ৩৯৫ গ্রাম। ছ’রাউন্ড গুলি ছোড়া যায়। পিস্তলের হাতলটা কালো রঙের সিনথেটিক মেটিরিয়াল।

চেহারায় ছোটখাটো কিন্তু বেশ কাজের এই হ্যান্ডগান দিব্যি প্যান্টের পকেটে এঁটে যায়।

কুশিয়াও কিন্তু বসে ছিল না। নন্দরামকে অনুকরণ করে সে-ও একটা ওয়ালথার টি-পি-এইচ স্টেইনলেস পকেট থেকে বের করে নিয়েছে এবং সেটা তাক করছে শ্রীধরের দিকে।

‘আমরাই সেই টেররিস্ট, মার্শাল, স্যার—।’ কুশিয়া দাঁতে দাঁত চেপে চাপা গলায় বলল।

এরকম সংকটের মুহূর্ত শ্রীধর পাট্টার জীবনে অনেক এসেছে। তিনি যখন চোদ্দো বছরের পিলটু তখন থেকেই। সুতরাং শ্রীধরকে কেউ চমকে দিতে পারে না, ওঁর কাছে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলে কিছু নেই। আসলে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত হওয়াটা যে কত বড় ‘যোগ্যতা’ শ্রীধর পাট্টা তার উজ্জ্বল প্রমাণ।

নন্দরাম এবং কুশিয়া যতই সিকিওরিটি ফোর্সের সদস্য হোক ওরা কখনওই শ্রীধর পাট্টার কাছে সন্দেহের ওপরে ছিল না—বরং বলা যায়, সন্দেহের অনেকটা নীচে। আসলে শ্রীধরের কাছে—একমাত্র তিনি নিজে ছাড়া—আর কেউই সন্দেহের ওপরে নয়।

সুতরাং ভাবলেশহীন শ্রীধর নিজস্ব অভিনব পদ্ধতিতে এই ‘গেরিলা’ আক্রমণের জন্য তৈরি ছিলেন। আর সেইজন্যই স্যাটেলাইট ফোনটা তিনি হাতে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন। নন্দরাম পকেট থেকে হ্যান্ডগান বের করে নেওয়ামাত্রই তিনি স্যাটেলাইট ফোনের একটি বিশেষ বোতাম টিপেছেন এবং তৎক্ষণাৎ একটা জোরালো ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড স্বচ্ছ দেওয়ালের মতো নন্দরামদের কাছ থেকে শ্রীধর পাট্টাকে আলাদা করে দিয়েছে।

নন্দরাম ফায়ার করেছিল। তার কয়েক লহমা পরে কুশিয়াও। কিন্তু ফোর্স ফিল্ডের শিল্ড হাইস্পিড মেটাল বুলেটগুলোকে রুখে দিল। ওদের কাইনেটিক এনার্জি বদলে গেল থার্মাল এনার্জিতে। হাই টেম্পারেচারে ওগুলো প্লাজমা হয়ে গেল। সেই প্লাজমাকে ফোর্স ফিল্ড ট্র্যাপ করে নিল।

নন্দরাম আর কুশিয়া ফায়ার করেই যাচ্ছিল। ফোর্সÇ ফিল্ড যেহেতু চোখে দেখা যায় না তাই ব্যাপারটা যে ঠিক কী হচ্ছে সেটা ওরা ঠাহর করতে পারছিল না। শুধু দেখছিল, ভাবলেশহীন পাথরের মুখ নিয়ে শ্রীধর পাট্টা একইভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এবং মরা মাছের চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।

প্রাথমিকভাবে ‘বিপ্লব’ অথবা ‘বিদ্রোহ’ শেষ হলে নন্দরাম আর কুশিয়া হকচকিয়ে গেল। শয়তানটা এখনও দু-পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আঁচড়হীন।

এরপর উত্তেজনা এবং বিদ্রোহের জোশ বিদ্রোহীদের দিয়ে যা করিয়ে থাকে নন্দরাম আর কুশিয়াও তাই করল।

হ্যান্ডগান উদ্যত হাতুড়ির মতো বাগিয়ে ধরে ওরা ক্ষিপ্তের মতো ছুটে এল শ্রীধরের দিকে।

এই ধরনের প্রতিবর্তী ক্রিয়ার সঙ্গে শ্রীধর ভীষণ পরিচিত। তাই চমকানোর কোনও প্রশ্নই উঠল না। শুধু হাতের মুঠোয় ধরা স্যাটেলাইট ফোনের বোতাম টিপে ফোর্স ফিল্ডের ইনটেনসিটি কমিয়ে ‘স্টানিং’ লেভেলে নিয়ে এলেন। ফলে নন্দরাম-কুশিয়া ফিল্ডের দেওয়াল ছোঁওয়ামাত্রই শক খেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে, তার চেয়ে বেশি কিছু হবে না।

এবং তাই হল। দুটো জোয়ান শরীর লুটিয়ে পড়ল ‘ভিজিটর’ রুমের মার্বেল পাথরের মেঝেতে। ওরা এখন কমপক্ষে দু-ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে থাকবে।

এবার শ্রীধর একচিলতে হাসলেন। ফোনের বোতাম টিপে ফোর্স ফিল্ডকে ডি-অ্যাকটিভেট করে দিলেন।

এই লোকদুটোকে জ্যান্ত রাখাটা খুব জরুরি। কারণ, ওদের কাছে থেকে সিক্রেট টেররিস্ট গ্রুপগুলো সম্পর্কে অনেক খবর পাওয়া যাবে। ফল পিষে যেভাবে ফলের রস বের করা হয় ঠিক সেইভাবে খবরগুলো ওদের ব্রেন থেকে বের করে নেওয়া হবে। তারপর ছিবড়ে ফেলে দেওয়া হবে নেক্রোসিটির কবরস্থানে।

এ ছাড়া আরও কিছু কাজ বাকি।

এই দুটো ছেলে—নন্দরাম আর কুশিয়া—গত সাতদিনে যেসব লোকের সঙ্গে সরাসরি কিংবা ফোনে যোগাযোগ করেছে তাদের তুলে নিয়ে আসতে হবে। এবং টপ লেভেল সিকিওরিটি গ্রিলিং দিতে হবে। এই সন্দেহভাজনদের তালিকায় যদি কোনও সিকিওরিটি স্টাফ থাকে তা হলে তারও কোনও রেহাই নেই।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শ্রীধর। এই শৌখিন বাড়িটার একটা সিক্রেট বলধর পাট্টা জানতেন—আর ওঁর কাছ থেকে জেনেছেন শ্রীধর পাট্টা। এ ছাড়া আর কেউ সেই গোপন খবরটা জানে না। সেটা হল, এই বাড়ির আনাচেকানাচে সাড়ে সাতষট্টি রকম মডার্ন অটোমেটেড সিকিওরিটির ব্যবস্থা করা আছে। সেগুলোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিশদ আলোচনা করে একটা টেকনিক্যাল বই লিখলে ‘মডার্ন সিকিওরিটি সিস্টেম’-এর আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কোর্স প্রায় কাভার্ড হয়ে যাবে। সুতরাং নন্দরাম ও কুশিয়া জাতীয় এলিমেন্টরা যে নাস্তানাবুদ হবে এইটাই স্বাভাবিক নিয়ম। তা ছাড়া ‘ভিজিটর’ রুমে গোপন সিকিওরিটির ব্যবস্থাটা একটু বেশি কড়া—লেভেল ফাইভ। এই লেভেল ফাইভ সিকিওরিটি আর আছে শ্রীধরের বেডরুমে।

মোবাইল ফোনের বোতাম টিপে সিকিওরিটি চিফের সঙ্গে কথা বললেন শ্রীধর।

‘ইমার্জেন্সি সিচুয়েশান। দুটো সেন্সলেস বডিকে ইন্টারোগেশান প্রসেস-এ পাঠাতে হবে। এ ছাড়া হ্যান্ড্রেড পারসেন্ট ফিজিক্যাল আর সাইকোলজিক্যাল স্ক্যানিং করতে হবে। ছিয়ানব্বই ঘণ্টার মধ্যে আমার ফুল অ্যান্ড ফাইনাল রিপোর্ট চাই। আন্ডারস্টুড?’

‘পারফেক্টলি আন্ডারস্টুড, মার্শাল স্যার…।’

ফোন কেটে দিলেন শ্রীধর। কাচের দেওয়াল ভেদ করে কনফারেন্স রুম নাম্বার ওয়ানের দিকে নজর চলে গেল ওঁর। ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস এদিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। বোধহয় এই ঘরে ঘটে যাওয়া রোমাঞ্চকর ‘সিনেমা’টা পুরোটাই দমবন্ধ করে দেখেছেন। অবশ্য দেখেও সবকিছু ঠিকঠাক বুঝতে পারেননি। যেহেতু ফোর্স ফিল্ড আর প্লাজমার ব্যাপারটা চোখে দেখা যায় না।

একমিনিটের মধ্যেই দুটো ম্যাগনেটিক মেটাল স্ট্রেচার নিয়ে চারজন ইউনিফর্ম পরা গার্ড চলে এল। সঙ্গে সিকিওরিটি চিফ।

গার্ডদের হাতে গাঢ় সবুজ চাদরের মতো দুটো মোটা কাপড় ছিল। সেগুলো দিয়ে ওরা অজ্ঞান নন্দরাম আর কুশিয়াকে কাঁধ থেকে কোমর পর্যন্ত জড়িয়ে দিল। ওদের হাতজোড়া চাদরের মধ্যে বন্দি হয়ে গেল। চাদরে জ্যাকেটের মতো জিপ টানার ব্যবস্থা ছিল। গার্ডরা সেটা টেনে আটকে দিল। তারপর ওদের স্ট্রেচারে শুইয়ে দিয়ে স্ট্রেচারের লুকোনো ইলেকট্রোম্যাগনেট অ্যাক্টিভেট করে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে সবুজ চাদরের ভেতরে লাগানো লোহার পাত চুম্বকের টানে স্ট্রেচারের সঙ্গে আটকে গেল। এখন কারও সাহায্য ছাড়া নন্দরাম আর কুশিয়া স্ট্রেচার ছেড়ে পালাতে পারবে না।

স্ট্রেচার দুটো নিয়ে ওরা পাঁচজন চলে যেতেই স্যাটেলাইট ফোন পকেটে ঢোকালেন শ্রীধর। তারপর হাততালি দিয়ে হাত ঝাড়লেন। বেরিয়ে এলেন ‘ভিজিটর’ রুম ছেড়ে।

এবার রঙ্গপ্রকাশের সঙ্গে ওঁর ইকনমিক ইনডেক্স নিয়ে কথা বলতে হবে।

কনফারেন্স রুম নাম্বার ওয়ানে শ্রীধর পাট্টা যখন এসে ঢুকলেন, তখন ওঁকে দেখে রঙ্গপ্রকাশের মনে হল এতক্ষণ ‘ভিজিটর’ রুমে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো শ্রীধরের জীবনে যেন ঘটেনি—তিনি এতটাই স্বাভাবিক।

শ্রীধরও রঙ্গপ্রকাশকে দেখছিলেন। দেখে বুঝতে চাইছিলেন, শ্রীধরের শত্রু প্রতিরোধের অদ্ভুত পদ্ধতির লাইভ ডেমনস্ট্রেশান রঙ্গপ্রকাশ ঠিকঠাক দেখেছেন কি না।

রঙ্গপ্রকাশ যে সেটা দেখেছেন সেটা ওঁর মুখচোখের চেহারা দেখেই বুঝতে পারলেন শ্রীধর। কিন্তু সামান্য হেসে অত্যন্ত স্বাভাবিক সুরে বললেন, ‘আসুন, ডক্টর—বসুন। আমাদের বাকি আলোচনাটুকু সেরে নিই। ওই যে, ইকনমিক ইনডেক্স…।’

আবার মুখোমুখি বসলেন দুজনে।

‘ইকনমিক ইনডেক্সটাকে আপগ্রেড করার ব্যাপারে আপনি কিছু ভাবছেন?’ গায়ের কালো টি-শার্ট থেকে কাল্পনিক ধুলো ঝাড়তে-ঝাড়তে শ্রীধর পাট্টা জিগ্যেস করলেন।

রঙ্গপ্রকাশ কিছুক্ষণ আমতা-আমতা করলেন। বোধহয় সঠিক উত্তর খুঁজতে চাইছিলেন। তারপর বললেন, ‘ভেবেছি…তবে ডেফিনিট পথ কিছু খুঁজে পাইনি। ভাবছি…ভাবছি কারও কাছে লোন নেব…।’

‘যদি তাই মনে হয় তা হলে নিন।’ ভুরু উঁচিয়ে বললেন শ্রীধর, ‘কিন্তু দেখবেন, আপনাকে লোন দিতে গিয়ে তার ই-আই-টা যেন ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে না চলে যায়।’

ক্রিটিক্যাল ভ্যালু। কী সুন্দর কথা! সব জিনিসেরই বোধহয় একটা ক্রিটিক্যাল ভ্যালু থাকে। জীবনেরও। ভাবলেন ডক্টর।

যেমন শ্রীধরের মতে জিশানের দাম ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে। না, ভুল ভেবেছেন রঙ্গপ্রকাশ। শ্রীধরের কাছে বোধহয় সবার জীবনের দামই ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে। শুধু নিজের জীবনটা ছাড়া।

‘না, স্যার।’ শ্রীধরের মন্তব্যের জবাব দিলেন, ‘সেটা আমি খেয়াল রাখব…।’

খেয়াল রাখবেন বটে, কিন্তু রঙ্গপ্রকাশ টাকা ধার নেবেন কার কাছে? মনে-মনে বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজনের তালিকার ওপরে অনুসন্ধানী নজর বুলিয়ে নিলেন।

না:, সেরকম কেউ নেই। এমনকী শ্বশুরবাড়ির কথাও ভাবলেন। সেখানেও সমাধান অমিল। কারণ, পর্ণমালাদের বাড়ির অবস্থা এমন যে, রঙ্গপ্রকাশকে ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর ওপরে তুলতে গেলে ওদের ইকনমিক ইনডেক্স ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে চলে যাবে।

এ ছাড়া, কারও কাছ থেকে লোন পেলেও রঙ্গপ্রকাশের আরও একটা সমস্যা রয়েছে। সিমানের যা লাইফস্টাইল তাতে লোন নেওয়া টাকা উড়িয়ে দিতে ও খুব বেশি সময় নেবে না। ই-ল্যান্ড আর কমপিটিশানের গেমগুলোই ওর দফারফা করে দেবে।

একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বুক ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল। আর মাত্র তিন মাস সময়। মানে নব্বই দিন। তার মধ্যে আজ একটা দিন পার হয়ে গেল। বাকি থাকবে উননব্বই দিন। তার মধ্যে যা হোক কিছু একটা করতে হবে।

শ্রীধর যেন ডক্টরের হিসেবটা মনে-মনে পড়ে ফেললেন। বললেন, ‘আজকের দিনটা বাদ দিলে আর মাত্র উননব্বই দিন…। কাউন্ট ডাউনটা খেয়াল রাখবেন, ডক্টর…।’

আচ্ছা, শ্রীধরকে কি সিমানের কথা বলা যায়? বলা যায় উড়নচণ্ডী নেশাতুর ছেলের কথা? ওঁর কথা শুনে শ্রীধর হাসবেন না তো?

‘একটা কথা বলব, স্যার?’

‘কী কথা?’ ভুরু কুঁচকে তাকালেন শ্রীধর : ‘বলুন…।’

শ্রীধর জানেন, রঙ্গপ্রকাশ কখনওই নিজের জন্য কোনও সুবিধে চান না। শ্রীধরের পার্সোনাল থেরাপিস্ট হওয়ার সুবাদে তিনি শ্রীধরের অনেক কাছাকাছি আসার সুযোগ পেয়েছেন। ফলে অনেক সুযোগ চাওয়ারও সুযোগ পেয়েছেন—কিন্তু চাননি।

মানুষটার জন্যে শ্রীধরের করুণা হল। আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদা বড় জ্বালা!সবসময় অন্তরে-অন্তরে জ্বালিয়ে মারে। দেখি মানুষটা কী বলতে চায়। ভাবলেন শ্রীধর। যদি কোনও সুযোগ চায় বা টাকা ধার চায় তা হলে শ্রীধর এককথায় দিয়ে দেবেন। আজ কেন যেন ডক্টর বিশ্বাসের প্রতি শ্রীধরের দক্ষিণ্যের একটা ঝোঁক চেপেছে।

‘আমার ছেলেকে ফেরানো যায় না?’ রঙ্গপ্রকাশের গলাটা সর্বহারার মতো শোনাল।

শ্রীধর পাট্টা কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। প্রশ্নটার অর্থ ওঁকে পাশ কাটিয়ে গেল।

‘ফেরানো মানে?’

‘ফেরানো মানে…’ রঙ্গপ্রকাশ মরিয়া হয়ে বলতে শুরু করলেন। কার সামনে তিনি কী বলছেন সেটা ভুলে গেলেন : ‘সিমান…মানে, আমার ছেলে…ও…ও খুব বাজে রাস্তায় চলে গেছে। ও নেশা করে। সুপারগেমস কর্পোরেশনের কমপিটিটিভ গেমসগুলোয় পাগলের মতো বাজি ধরে। ওকে…ওকে দেখে মনে হয়…মনে হয়…ওটাই জীবন। এসব ছাড়া জীবনে আর কিছু নেই। ওর…ওর নেশার খিদে মেটাতে গিয়ে আমার সমস্ত সেভিংস তলানিতে এসে ঠেকেছে। আমার ই. আই. ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে নেমে গেছে।’ দু-হাতে মাথা আঁকড়ে ধরলেন রঙ্গপ্রকাশ। কান্নার দমক ছিটকে বেরোতে চাইল গলা দিয়ে। ওঁর চোয়াল দুটো ব্যথা করছিল, চোখ জ্বালা করছিল। কান্না চেপে কোনওরকমে বললেন, ‘স্যার, বিশ্বাস করুন…আমাদের তিনজনের জীবনটাই ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর নীচে নেমে গেছে। সিমানকে যদি ফেরাতে পারি তবেই আমি আর পর্ণমালা সবচেয়ে বেশি খুশি হব। বুঝব, আমাদের তিনজনের লাইফ ইনডেক্স ক্রিটিক্যাল ভ্যালুর ওপরে উঠেছে। সেই জীবনগুলোকে নিয়ে বাঁচা যায়।’ মাথা থেকে হাত সরালেন রঙ্গপ্রকাশ। সজল চোখে শ্রীধরের দিকে তাকালেন। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে আচমকা আবেগে শ্রীধরের হাত দুটো চেপে ধরলেন : ‘স্যার, প্লিজ হেল্প করুন। আমার…আমার ছেলেটাকে ফেরানোর পথ বলুন। ওকে বাঁচান। প্লিজ, স্যার…।’

রঙ্গপ্রকাশ কান্নাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেন না। ভেঙেচুরে গেলেন।

শ্রীধর পাট্টা দু:খী মানুষটার হাত থেকে নিজের হাত দুটো আলতো করে ছাড়িয়ে নিলেন। খানিকটা অবাক চোখে নিউ সিটির সাইকো অ্যানালিসিস সেন্টারের চিফ সাইকোলজিস্টকে দেখতে লাগলেন। সন্তানের ভালোর জন্য পিতার আকুলিবিকুলির মূল তত্ব উপলব্ধি করতে চাইছিলেন। কিন্তু ঠিকঠাক পারছিলেন না। কারণ, শ্রীধর পাট্টা সংসারে একাকী। ‘বাবা’ ডাকের মর্মস্পর্শিতা কিংবা অন্তর্ভেদী শক্তি—দুটোর কোনওটাই শ্রীধরের জানা নেই। তাই নিথর নয়নে অসহায় মানুষটার দু-গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলের রেখার দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শ্রীধর বললেন, ‘ডক্টর, আই ফিল ফর য়ু। কিন্তু আপনি তো জানেন গেম শো হচ্ছে নিউ সিটির এক্সক্লুসিভ ব্র্যান্ড। বিনোদনকে আমরা যে-লেভেলে নিয়ে গেছি সেটা আর কোনও সিটি পারেনি। আমাদের শহরের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ ডিরেক্টলি কিংবা ইনডিরেক্টলি এইসব মাইন্ডব্লোয়িং গেমসের সঙ্গে জড়িত। আমাদের শহরের স্ট্রং ইকনমি এইসব গেমসের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। আপনি কি জানেন, পৃথিবীর কত শহর এই একটা কারণে আমাদের কীরকম ঈর্ষা করে! আমরাই দুনিয়ার এক নম্বর, ডক্টর বিশ্বাস, এক নম্বর! আর সেই একনম্বর শহরের নাগরিক আপনি—অন্তত এখনও। য়ু শুড ফিল প্রাউড অ্যাবাউট ইট…।’

শ্রীধর থামলেন। ওঁর মুখ-চোখে লালচে আভা। আর তার সঙ্গে গর্বের ছটা।

‘কিন্তু আমার…আমার ছেলেটা?’

পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করলেন শ্রীধর। শূন্যে মুখ উঁচিয়ে শিশি থেকে দু-ফোঁটা তরল জিভে ঢাললেন। টাকরায় জিভ ঠেকিয়ে চটাস-চটাস শব্দ করলেন দুবার। মাথাটা দুপাশে ঝাঁকালেন। ঘন-ঘন শ্বাস ফেললেন কয়েকবার। তারপর হাঁটুতে ছোট্ট চাপড় মেরে বললেন, ‘কন্ট্রোল। কন্ট্রোলই হচ্ছে আসল। ভালো থাকার পাসওয়ার্ড। যে-কোনও ধরনের এক্সাসাইটমেন্টই একটা নেশার মতো। সেটা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। তবে সেটাকে স্ট্রং রেসিস্ট্যান্স দিয়ে কন্ট্রোলের মধ্যে রাখতে হয়…।’

শ্রীধর আরও অনেক কথা বলছিলেন, কিন্তু তার একটি বর্ণও রঙ্গপ্রকাশের কানে ঢুকছিল না। মনে হচ্ছিল, শ্রীধর কোনও জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধের বই পড়ে শোনাচ্ছেন।

রঙ্গপ্রকাশের অন্তরে একটা হাহাকার ঢেউ তুলল। শ্রীধর কেতাবি জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন আর ওঁর প্রাণের ছেলেটা ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। মাপে ছোট হয়ে যাচ্ছে।

এরপর যদি সিমানকে আর দেখতে না পাওয়া যায়!

এ-কথা ভাবামাত্রই রঙ্গপ্রকাশের শরীরে একটা শিরশিরে অনুভূতি খেলে গেল। গায়ে কাঁটা দিল।

রঙ্গপ্রকাশ বুঝলেন, শ্রীধর পাট্টার কাছে বিনোদন এবং বৈভব হল দুই ‘শ্রদ্ধেয়’ দেবতা। আর হিংসা এবং নিষ্ঠুরতা তাঁদের বাহন।

একজন অসহায় আশঙ্কিত চুরমার পিতা বসে-বসে ভাবতে লাগলেন, কী করে তাঁর একমাত্র ছেলেকে সঠিক পথে ফেরানো যায়।

ঘরের বাইরে গ্লো-সাইন দিয়ে লেখা ‘জয় রুম’। শুধু আনন্দের জন্য তৈরি ঘর।

ঘরের দেওয়ালগুলো সব কাচের তৈরি। কিন্তু সাধারণ কাচের নয়—আয়না-কাচ। ঘরের ভেতর থেকে বাইরের সবকিছু আবছাভাবে দেখা গেলেও বাইরে থেকে কিছুই দেখা যায় না—মনে হয় যেন আয়না।

বিশাল ঘরটার ভেতরে নানান রঙের ধোঁয়া উড়ে বেড়াচ্ছিল। সুতোর তৈরি সাপের মতো সূক্ষ্ম ধোঁয়ার রেখাগুলো দেখে মনে হয় যেন কেউ শূন্যে স্বপ্নের জাল বিছিয়ে দিয়েছে।

ঠিক স্বপ্ন না হলেও এই ধোঁয়া স্বপ্ন তৈরি করে। কারণ, নানান ধরনের ড্রাগ থেকে তৈরি এই নেশার ধোঁয়ায় ঘণ্টাখানেক কাটালে মাথা ঝিমঝিম করে, শরীরটা পাখির মতো হালকা মনে হয়। সচেতন মন আড়ালে চলে গিয়ে অবচেতন মন তখন রাজত্ব শুরু করে। সে তখন দু-কাঁধে দুটো সুন্দর ডানা লাগিয়ে দেয়। তারপর আচমকা এক উড়ান দিয়ে আশ্চর্য সব স্বপ্নের জগতে বেড়াতে নিয়ে যায়। ভাসতে থাকা শরীর আর ভাসতে থাকা মন তখন অপরূপ আনন্দের স্বাদ নিয়ে বেড়ায়।

সিমান সেই আনন্দের জগতেই ভেসে বেড়াচ্ছিল।

‘জয় রুম’-এ হালকা মিউজিক বাজছিল। আর সেই তালে-তালে ঘরের চার দেওয়ালে আলোয় আঁকা চঞ্চল ঝরনার ছবি রং পালটাচ্ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল পূর্ণিমার রাতে অপরূপ এক জঙ্গলের মাঝে ঝরনা ঘেরা কোনও প্রাকৃতিক উদ্যানে সবাই দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্তিমিত মিউজিকের ফাঁকে-ফাঁকে ঝরনার কল্লোল শোনা যাচ্ছিল। আর ঘরের ঠিক মাঝখানে এক ঝাঁক তরুণ-তরুণী সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো এলোমেলো ছন্দে শরীরে ঝাঁকুনি তুলছিল।

ওদের বয়েস সতেরো কি আঠেরো থেকে উনিশ-কুড়ির মধ্যে। পরনে আধুনিক রঙিন পোশাক। জিনস, স্লিভলেস, ক্যাপরি, কার্গো, হলটার, ভেস্ট, আরও কতরকম। হাতে-পায়ে, পিঠে কিংবা গলায়-গালে অনেকেরই ফ্লুওরেসেন্ট ট্যাটু আঁকা। কারও-কারও ট্যাটু লেসার হলোগ্রাম দিয়ে তৈরি। প্রযুক্তির কী এক কৌশলে সেগুলো শরীরের চামড়ায় একেবারে জড়িয়ে গেছে।

‘জয় রুম’-টা মাপে বিশাল। কমপক্ষে তিরিশ ফুট বাই পঞ্চাশ ফুট। তারই ঠিক মাঝখানটায় মিউজিক, আলো আর নাচের ব্যাপারটা চলছিল। সেখানে রঙিন ছায়া মাখা শরীর নিয়ে সিমান নাচছিল, আর ওপরদিকে নাক উঁচিয়ে ধরে বড়-বড় শ্বাস টানছিল। তাতে ওর নেশাটা আরও গাঢ় হচ্ছিল।

‘জয় রুম’-এর মেঝেতে কৃত্রিম ঘাসের গালিচা পাতা। তার রং আর ধরন এমন যে, আসল ঘাসও হার মানবে। নাচতে-নাচতে তরুণ-তরুণীদের কেউ-কেউ—অথবা, কিশোর-কিশোরীদের কেউ কেউ—সেই ঘাসের মেঝেতে শুয়ে পড়ছিল। আবার একটু পরেই শরীর ভাঁজ করে ঝটকা মেরে উঠে পড়ছিল। তারপর নাচছিল।

হঠাৎই মিউজিক স্তিমিত হল। লুকোনো কোনও স্পিকার থেকে একটি মেয়ের মিষ্টি গলা শোনা গেল। গলাটা একইসঙ্গে মিষ্টি এবং নেশাতুর।

‘ফোকস, নাউ উই স্টপ ডান্স অ্যান্ড মিউজিক। নাচ আর বাজনা এবার শেষ। শুরু হবে হলোগ্রাম ফাইট গেম। তোমাদের হট ফেবারিট শো…।’

ঘোষণার সঙ্গে-সঙ্গে খুশির হল্লা শোনা গেল। ছায়া-ছায়া মানুষগুলো ‘জয় রুম’-এর মাঝখান থেকে সরে গেল দেওয়ালের দিকে। ফলে মাঝখানটায় বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়ে গেল।

তারপর মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল। রঙিন ধোঁয়ার সুতোগুলোর বেশিরভাগটাই কোনও লুকোনো সাকশান ফ্যান যেন মুহূর্তে গিলে নিল। এবং সেগুলো মিলিয়ে যেতেই ঘরের মেঝেতে দুটো আলোকিত শরীর জন্ম নিল।

লেসার দিয়ে তৈরি দুটো হলোগ্রাম শরীর। একটা লাল, অন্যটা নীল। দুটো শরীরই চাপ-চাপ পেশি দিয়ে তৈরি। ওদের পরনে শুধু ধপধপে সাদা দুটো জাঙ্গিয়া।

শরীর দুটোর মাঝে চার-পাঁচ হাতের দূরত্ব। ওরা লড়াইয়ের ভঙ্গিতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে রয়েছে।

স্কিন টাইট কালো পোশাক পরা আট-দশজন লোক ‘জয় রুম’-এ ঢুকে পড়ল। ওদের বুকে ‘জয় রুম’-এর ফ্লুওরেসেন্ট লোগো জ্বলজ্বল করছে। ওরা ইলেকট্রনিক প্যানেল বসানো চারটে কাউন্টার মূর্তি দুটোকে ঘিরে বসিয়ে দিল। ফলে লড়াকু দুজন যোদ্ধার জন্য একটি চৌকোনা এরিনা তৈরি হয়ে গেল। ঘরের হুল্লোড় করা ছেলেমেয়েগুলো ইলেকট্রনিক প্যানেলের কাছে ভিড় করে এসে দাঁড়াল।

এখুনি হলোগ্রাম ফাইট গেম শুরু হবে। শুরু হবে লাল আর নীলের লড়াই। র‌্যান্ডমাইজ করা সফটওয়্যার যোদ্ধা দুজনকে পরিচালনা করবে। দাবার চালের মতো লড়াইয়ের ছোট-ছোট চাল অ্যাক্টিভেট করবে। তবে কখন কোন চাল অ্যাক্টিভেটেড হবে কেউ বলতে পারবে না। তার কারণ র‌্যান্ডমাইজেশান।

কিন্তু এর পরেও একটা মজা আছে।

লড়াই দেখতে-দেখতে যে-কোনও দর্শক কন্ট্রোল প্যানেলের বোতাম টিপে লড়াইয়ের কোনও একটা মুভ অ্যাক্টিভেট করতে পারে। এর ফলে সফটওয়্যার জেনারেটেড র‌্যান্ডম সিকোয়েন্সের ধরন বদলে যেতে পারে। এবং তখন লড়াইটা হয়ে উঠবে আরও আনপ্রেডিক্টেবল।

স্বাভাবিকভাবেই এই হলোগ্রাম যোদ্ধা দুজন কখনও ক্লান্ত হয় না। তবে ওরা হাঁপায়, ওদের শরীরে ঘাম দেখা দেয়। স্পেশাল টেকনিক দিয়ে এগুলো ডিজাইন করা হয়েছে ফাইট গেমটাকে রিয়েলিস্টিক করার জন্য।

এই লড়াই চলবে ঠিক এক ঘণ্টা। তাতে যে-হলোগ্রাম ফাইটার পয়েন্টে জিতবে তার শরীরটা এরিনার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকবে। অন্যজন শুয়ে পড়বে মেঝেতে। উইনারের হয়ে যারা ইলেকট্রনিক প্যানেলে বোতাম টিপে লড়াইয়ের মুভ অ্যাক্টিভেট করেছে তাদের প্রাইজ দেওয়া হবে। তাদের চিনে নেওয়া হবে ফিঙ্গারপ্রিন্ট অটো-ম্যাচ টেকনিকের মাধ্যমে।

এ ছাড়া এই দুজন ফাইটারকে নিয়ে বাজি ধরায় কোনও বাধা নেই।

হলোগ্রাম ফাইট গেম শুরু হল। তার সঙ্গে মানানসই সাউন্ড এফেক্ট।

সঙ্গে-সঙ্গে নেশাতুর মানুষগুলো হাত-পা ছুড়ে চিৎকার শুরু করল।

‘রেড! রেড!’

‘ব্লু! ব্লু!’

একইসঙ্গে দর্শকদের অনেকেই কন্ট্রোল প্যানেলের বোতাম টিপে ‘রেড’ আর ‘ব্লু’-র জন্য লড়াইয়ের নানানরকম মুভ অ্যাক্টিভেট করছিল। আর কালো পোশাক পরা লোকগুলোর কাছে গিয়ে টাকা দিয়ে বাজি ধরছিল।

সিমানও চুপ করে ছিল না। উত্তেজনা আর আগ্রহ নিয়ে যুযুধান ফাইটার দুজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর থেকে থেকেই উল্লাসের চিৎকার করে কন্ট্রোল প্যানেলের বোতাম টিপছিল। ওর চোখে হলোগ্রাম ফাইটারদের লাল-নীল ছায়া চঞ্চলভাবে নড়ছিল।

সিমানকে দেখে মনে হচ্ছিল, এই লড়াইটাই ওর একমাত্র পৃথিবী। একটু আগেই ও ‘রেড’ ফাইটার জিতবে বলে আট হাজার টাকা বাজি ধরেছে। যদি ও জেতে তা হলে হাতে-হাতে পাবে ষোলো হাজার টাকা। তাতে আরও কিছুদিন আনন্দ আর ফুর্তি করা যাবে। বাবার কাছ থেকে ইদানীং হাতখরচের টাকা পেতে একটু অসুবিধে হচ্ছে।

এ-কথাটা মনে হতেই সিমানের মধ্যে একটা বিরক্তির ভাব উথলে উঠল।

লড়াই ক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠতে লাগল। যোদ্ধা দুজন হলোগ্রাম ইমেজ হলে হবে কী, ওদের শরীর রক্ত-মাংসের শরীরের মতোই ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিল। হাতে-কপালে কেটে গিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল। মুখ দিয়ে যন্ত্রণার ‘উ:! আ:!’ শব্দও বেরোচ্ছিল।

ঘরের প্রায় সিলিং-এর কাছাকাছি শূন্যে ভেসে আছে একটা হলোগ্রাম স্কোরবোর্ড। তাতে ডিজিটাল হরফে নীল এবং লাল রঙে যথাক্রমে ব্লু এবং রেড-এর পয়েন্ট দেখা যাচ্ছে। লড়াইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পয়েন্ট বাড়ছে—কখনও লালের, কখনও নীলের।

সবকিছু মানুষের মতো হলেও হলোগ্রাম ফাইটাররা লড়াই করছিল অতিমানবের মতো। এমন সব মার কিংবা মারপ্যাঁচ ব্যবহার করছিল যা একমাত্র সিনেমার স্পেশাল এফেক্টের মাধ্যমে দেখানো সম্ভব। ওদের লড়াইয়ের অভিনব মুভগুলো দেখতে-দেখতে দর্শকের দল উত্তেজনায় চিৎকার করছিল।

এসবের মধ্যে হঠাৎ করেই একটা গন্ডগোল শুরু হল।

কন্ট্রোল প্যানেলের বোতাম টেপার দখল নিয়ে সিমানের সঙ্গে একটা মেয়ের ঝামেলা লাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *