১৯. বারোজন সুপারকিলারের ছবি

১৯.

জিশান দশ-পনেরো সেকেন্ড ধরে কিলার প্রোটনকে দেখল। যে বারোজন সুপারকিলারের ছবি নিয়ে টিভিতে ‘সুপারকিলার কনটেস্ট’ শুরু হয়েছিল তাদের মুখগুলো জিশানের আবছাভাবে মনে আছে। কিন্তু এই মুখটা সেই বারোজনের মধ্যে ছিল বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য এই লোকটার পোশাক-আশাক মেকাপ এমন যে, আসল চেহারাটা ভালো করে ঠাহর করা যাচ্ছে না।

জিশানের বেশ মনে আছে, ‘সুপারকিলার কনটেস্ট’ প্রতিয়োগিতায় প্রথম পুরস্কার ছিল পঁচিশ লক্ষ টাকা। ওর আরও মনে আছে, কনটেস্টের বারোজন খুনির মধ্যে আটজন পুরুষ, আর চারজন মেয়ে ছিল। কিন্তু প্রাোটনের সঙ্গে তাদের কোনও মিল…না:, মাথা নাড়ল জিশান। টিভির সুইচ অফ করে দিল।

টিভি রুকস্যাকে রেখে আবার ট্র্যাকার দেখল জিশান। একটা লাল ডটের সঙ্গে ওর দূরত্ব বেশ কমে এসেছে। মনে হয় অপাশি মরিয়া হয়ে বাইক চালিয়ে ওকে নাগালের মধ্যে নিয়ে আসতে চাইছে।

ট্র্যাকার রেখে বাইক ছোটাল জিশান। রিয়ারভিউর কনভেক্স মিরারে ওর নজর বারবার ছিটকে যাচ্ছিল। না:, এখনও কোনও গাড়ি বা বাইক দেখা যাচ্ছে না।

চড়া রোদে জিশান ঘামছিল। বাঁ-হাতের কবজিতে বাঁধা কাউন্টডাউন রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল। এখনও অনেক সময় বাকি। আজ মনে হচ্ছে, সূর্য খুব ধীরে আকাশপথে হাঁটছে—সন্ধে হতে আজ অনেক দেরি হবে।

ফাঁকা রাস্তায় বাইকের গোঁ-গোঁ আওয়াজ ফাঁপা প্রতিধ্বনি তুলছিল। কোথা থেকে শব্দগুলো ধাক্কা খেয়ে আবার কানে ফিরে আসছে কে জানে!

হঠাৎই রিয়ারভিউ মিরারে একটা বাইক দেখতে পেল। একটা কালো ফুটকি। ফুটকিটা ক্রমশ মাপে বড় হচ্ছিল।

জিশান অ্যাকসিলারেটরে চাপ দিল। বাড়তি আওয়াজ তুলে ওর বাইক এক ঝটকায় আরও জোরে পিছলে গেল সামনের দিকে।

বাঁ-দিকে জঙ্গল, ডানদিকে কয়েকটা বাড়ি-ঘর। দ্রুত ছুটে যাচ্ছে পিছনে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দূরে ফ্লাইওভারটা দেখা গেল। উঁচু হয়ে আকাশের দিকে উঠেছে।

জিশান ঠিক করল, ফ্লাইওভার পেরিয়ে ও বাঁ-দিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়বে। তারপর ট্র্যাকার দেখে ফুড পয়েন্ট বের করবে। ভীষণ খিদে পেয়েছে। জল তেষ্টাও।

বাইক ফুলস্পিডে ছুটছিল। বাতাসের টুকরো দুরন্ত বেগে ছুটে এসে জিশানের মুখে গায়ে বিঁধছিল।

ফ্লাইওভারে পৌঁছে গেল জিশান। তখনই ও আকাশের দিক থেকে ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দ পেল। ওপরদিকে তাকাতেই একটা হেলিকপ্টার দেখতে পেল। অনেক উঁচুতে পাক খাচ্ছে।

তা হলে আকাশ থেকেও কিল গেমের দিকে নজর রাখার বন্দোবস্ত করেছেন শ্রীধর!

বাইক চালাতে-চালাতেই মুখ তুলে গোটা আকাশটায় চোখ বুলিয়ে নিল জিশান। উত্তরের আকাশে অনেক দূরে আর-একটা হেলিকপ্টার দেখতে পেল। এত দূরে যে, ওটার আওয়াজ ভালো করে ঠাহর হচ্ছে না। উড়ন্ত মেশিনটার আশেপাশে কয়েকটা চিল উড়ছে। অন্তত প্রক্ষিপ্ত দর্শনে আকাশের পটভূমিতে সেরকমই মনে হচ্ছে।

আকাশ থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকাতেই জিশান ব্রেক কষতে বাধ্য হল। দূরে চোখে পড়ছে একটা নীল রঙের অটোমোবিল। পাগল করা গতিবেগে ফ্লাইওভারের দিকেই ধেয়ে আসছে।

কে আছে ওই গাড়িতে? কিলার সুখারাম? নাকি প্রাোটন?

রিয়ারভিউ মিরারে তাকাল জিশান। ও ব্রেক কষার ফলে পিছনে ছুটে আসা ফুটকিটা এখন মাপে অনেক বড় দেখাচ্ছে। অপাশি কানোরিয়াকে অস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। গোলগাল মোটাসোটা চেহারাটা উত্তল দর্পণে আরও মোটা আর বিকৃত দেখাচ্ছে।

ঝটিতি সিদ্ধান্ত নিল জিশান। সামনে থেকে ছুটে আসা অটোমোবিলটার সঙ্গে যদি ওর কলিশন হয় তা হলে মোটরবাইকটার আস্ত থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। তার সঙ্গে জিশানেরও।

তার চেয়ে বরং অপাশির মোটরবাইকের সঙ্গে কিছু একটা করার চেষ্টা করা অনেক ভালো।

সুখারাম নস্কর এর মধ্যেই বাইক পালটে গাড়ি নিয়েছে।

নীল গাড়িটার জানলা দিয়ে একটা আলট্রা হাই-পাওয়ার রাইফেলের নল বেরিয়ে এল। তারপর জিশানের বাইক লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল কিলার সুখারাম। ‘ক্র্যাক’ এবং ‘সাঁই’ শব্দ হল। হেভিওয়েট বুলেট ছুটে গেল জিশানের দিকে।

ব্রেক কষলেও জিশান একটিবারের জন্যও বাইক থামায়নি। প্যাঁচালো পথে নকশা বুনে ফ্লাইওভারের ওপরে বাইকটাকে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছিল। কারণ, ‘সিটিং টারগেট’-এর চেয়ে ‘মুভিং টারগেট’ অনেক ভালো। ও বেশ বুঝতে পারল, একটা গরম বুলেট ওর বাইকের কাছ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। তারপরই ও রাইফেলের শব্দটা শুনতে পেল।

সঙ্গে-সঙ্গে অপাশিকে লক্ষ্য করে বাইক ছোটাল জিশান। ইঞ্জিনে ‘গোঁ-ওঁ-ওঁ’ শব্দ তুলে বাইকের স্পিড তুলে দিল চরমে। তারপর স্টিয়ারিঙের কায়দায় সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে ছিটকে গেল অপাশির দিকে।

কিলার অপাশি মিসাইল গান ফায়ার করতে সাহস পাচ্ছিল না। কারণ, যদি ও টার্গেট মিস করেও তা হলে মিসাইলের ইনফ্রারেড ট্র্যাকার ওর বাইকের ইঞ্জিন লক্ষ্য করে ছুটে আসতে পারে।

সুতরাং ও চলন্ত অবস্থাতেই বাইকের কেরিয়ার থেকে মেশিন পিস্তল বের করে পরপর দুবার ফায়ার করল।

কিন্তু মিস করল। কারণ, জিশানের বাইক বলতে গেলে সার্কাসের কসরত দেখাতে-দেখাতে এদিক-ওদিক হেলে অপাশির দিকে ছুটে আসছিল।

মেশিন পিস্তল ফেলে একটা চপার তুলে নিল ও। ততক্ষণে লং রেঞ্জ পিস্তল তুলে নিয়ে অপাশিকে লক্ষ্য করে দুবার ফায়ার করেছে জিশান। কিন্তু দুটো ছুটন্ত মোটরবাইকের বিচিত্র আপেক্ষিক গতিবেগ জিশানকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করে দিল।

ততক্ষণে অপাশির ছুড়ে দেওয়া চপার বাতাসে লাট খেয়ে জিশানের দিকে ছুটে আসছে। জিশান নিমেষের মধ্যে ছুটন্ত বাইকটাকে কাত করে একটা চোখা বাঁক নিল। অপাশির চপার ওর পিছনের সিটে কেটে বসে গেল।

অপাশি দাঁত খিচিয়ে মিহি চিৎকার করে উঠল। আবার মেশিন পিস্তল তুলে নিল হাতে। শত্রুকে এত কাছে পাওয়া গেছে! এইবার খতম।

আর উত্তরে জিশান নিখুঁত লক্ষ্যে ওর বাইকের চাকা দিয়ে অপাশির বাইকের পিছনের চাকায় আড়াআড়ি ধাক্কা মারল।

দুরন্ত গতির সংঘর্ষ। ফলে যা হওয়ার তাই হল।

অপাশির বাইক লাট্টুর মতো ঘুরপাক খেতে-খেতে শূন্যে উঠে পড়ল। সরাসরি গিয়ে ধাক্কা খেল ফ্লাইওভারের রেলিঙে। ‘দড়াম’ শব্দ হল। রেলিং আর বাইকের মাঝে পড়ে অপাশির মাথা থেঁতলে গেল। ওর হাতে তখনও মেশিন পিস্তল ধরা রয়েছে।

একটা মিহি আর্ত চিৎকার শোনা গেল। অপাশি এবং ওর বাইক ছিটকে গেল আকাশে। তারপর অদ্ভুত এক কক্ষপথে বাতাস কেটে পড়তে লাগল নদীর দিকে।

সংঘর্ষের পর জিশানের বাইকও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। অপাশির বাইকের সংঘর্ষের জায়গা থেকে প্রায় বারো-তেরো ফুট বাঁ-দিকে ওর বাইক ফ্লাইওভারের রেলিঙে ধাক্কা মারল। ঠিক তার আগের মুহূর্তে জিশান বাইক ছেড়ে শূন্যে লাফিয়ে উঠল। বাইকটা রেলিঙের খানিকটা অংশ ধসিয়ে দিয়ে বোমার সপ্লিন্টারের মতো ছিটকে গেল বাতাসে। জিশান তখন ওর বাইক থেকে কয়েক হাত দূরে বাতাস কেটে নদীর দিকে পড়ছিল। ওর মনে হচ্ছিল, ওর কোনও ওজন নেই। আর সেই অদ্ভুত সময়ে প্যাসকোর কথা মনে পড়ে গেল ওর।

অপাশির বাইকটা নীচে পড়তে-পড়তে আচমকাই শূন্যে বোমার মতন ফেটে গেল। বিস্ফোরণের শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়। বাইক আর অপাশির ছোট-বড় টুকরো ভয়ংকর গতিতে ঠিকরে গেল চারিদিকে। বিস্ফোরণের আগুনের তেজ আর ঝলক জিশানের চোখ ধাঁধিয়ে দিল।

বাতাসে পোড়া গন্ধ, কালো ধোঁয়া। ও চোখ বুজে ফেলল। ভাসতে-ভাসতেই হাঁটু মুড়ে দু-হাতে হাঁটুজোড়া জাপটে ধরল। ওর শরীরটা শূন্যে কয়েকবার লাট খেল। তারপরই চোখ খুলল জিশান। দেখল, নদীর ঘোলাটে জল ওর দিকে ছুটে আসছে। সঙ্গে-সঙ্গে দক্ষ ডাইভারদের মতো হাত দুটো সামনে টান-টান করে বাড়িয়ে ধরল। এবং শরীরটাকে সামান্য নিয়ন্ত্রণ করতেই ওর হাত দুটো বর্শার ফলার মতো নদীর জল চিরে ঢুকে গেল। তার পিছন পিছন ঢুকে পড়ল জিশানের শরীর।

একটা চাপ। একটা ঠান্ডা অনুভূতি। চোখের নজর ঘোলাটে। মুখে কিছুটা জল ঢুকে গেল। নদীর জলের ঘাত-প্রতিঘাতে জিশানের শরীরটা বেসামাল হয়ে গেল।

কিন্তু একটু পরেই জলের ওপরে ‘ভু-উ-স’ করে ভেসে উঠল জিশান। তাড়াতাড়ি পকেট হাতড়ে স্যাটেলাইট ফোনটা বের করল। বেশ কিছুটা ভিজে গেছে। অকেজো হয়ে গেল কি না কে জানে!

ফোনটাকে ডানহাতে শূন্যে তুলে ধরল। জল ঝরানোর জন্য ওটা কয়েকবার জোরে-জোরে ঝাঁকাল। তারপর চোখ তুলল ফ্লাইওভারের দিকে। সেখানে একটা মানুষের সিলুয়েট দেখতে পেল। ভাঙা রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে নদীর জলের দিকেই তাকিয়ে আছে। মনে হয়, জিশানকে দেখছে কিলার সুখারাম।

মানুষটার পিছনেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা নীল রঙের গাড়ি।

জিশান লক্ষ করল, আকাশের দুটো হেলিকপ্টার এখন মাথার ওপরে ব্যস্তভাবে চক্কর কাটছে। বোধহয় ওরা অপাশি আর জিশানের মোকাবিলাটা দেখতে পেয়েছে।

নদীর স্রোতের সঙ্গে গা ভাসিয়ে জিশান সাঁতার কাটতে লাগল। একইসঙ্গে ও নিজের বেখাপ্পা অবস্থাটার কথা ভাবতে লাগল।

ওর কাছে এখন অপটিক্যাল ট্যাবলেট নেই। ট্র্যাকার নেই। ফুড ম্যাপ নেই। মোটরবাইক নেই। অস্ত্র নেই—যা-ও বা আছে, জলে ভেজা। আর স্যাটেলাইট ফোনটার কী হাল কে জানে!

এখন ও খাবার খুঁজে পাবে কোথায়?

তবে ভালো খবর হল, এখন ওকে তিনজনের বদলে দুজন কিলারের সঙ্গে লড়তে হবে। লড়াই করে বাঁচতে হবে।

মিনি নিশ্চয়ই ওর লড়াই দেখেছে—দেখছে।

জিশান একটা হাত আর দুটো পা ব্যবহার করে কোনওরকমে সাঁতার কাটছিল। চেষ্টা করছিল, নদীর বাঁ-দিকের পাড়ের কাছে সরে যেতে। তখনই ও দেখতে পেল লম্বা ছিপের মতো অনেকগুলো মেটাল লিভার নদীর দিকে ঝুঁকে রয়েছে। সেগুলোর ডগায় ক্যামেরা বসানো। অর্থাৎ, জিশান সবসময় লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি দর্শকের চোখের সামনে রয়েছে।

একটু পরেই নদীর পাড়ে উঠে এল। হাতে-পায়ে কোথাও-কোথাও বোধহয় কেটে-ছড়ে গেছে, কারণ, জ্বালা করছে।

ধপ করে বসে পড়ল আগাছা আর বুনো ঘাসের ওপরে। বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগল। ভেজা রুকস্যাকটা পিঠ থেকে নামিয়ে রাখল পাশে। ওটা আয়তনে বড় হওয়ায় ওকে জলে ভেসে থাকতে সাহায্য করেছে।

এবার স্যাটেলাইট ফোনটা নিয়ে পড়ল। শ্রীধর পাট্টাকে এখুনি ফোন করা দরকার।

ফোনের বোতাম টিপতে লাগল জিশান।

ডায়াল করতেই একটা ঘড়ঘড় শব্দ জিশানকে অভ্যর্থনা জানাল। তার ওপরে সুপারইমপোজড হয়ে রিং বাজতে লাগল।

এক হাতে ফোন কানে চেপে ধরে অন্য হাতে রুকস্যাকের কভার ফ্ল্যাপ খুলতে লাগল জিশান।

ফোনটা এখনও ঘড়ঘড় ফাটা আওয়াজে বাজছে। শ্রীধর ফোন ধরতে এত দেরি করছেন কেন?

ভেজা, সপসপে রুকস্যাক থেকে ট্যাবলেট বেরোল। ছোট টিভিটাও বেরোল। সব ইলেকট্রনিক পরদা অন্ধকার। কোনও আলোর চিহ্ন নেই সেখানে।

জিশানের বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। চারিদিক যেন ইলেকট্রনিক পরদার মতোই অন্ধকার দেখাল। কী করে এখন ও লড়াই চালাবে! কী করে কিলারদের লোকেশান ট্র্যাক করবে! কী করে খাবার খুঁজে পাবে?

ফোন কানে চেপে ধরে জিশান অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। মনে-মনে শ্রীধরকে বলছিল, ‘শ্রীধর…ধর…ধর…।’

একটু পরেই শ্রীধর পাট্টার গলা পাওয়া গেল : ‘জি-জি-শ-শান!’

শ্রীধরের গলায় স্বর কেটে-কেটে যাচ্ছিল।

স্যাটেলাইট ফোনটা যে অল্পবিস্তর কাজ করছে সেই প্রমাণটুকু জিশানকে আশাভরসা দিল। ও ফোনের সনিক রিসিভারের সামনে মুখ নিয়ে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘আমাকে এখুনি একটা অপটিক্যাল ট্যাবলেট দিন, ট্র্যাকার দিন। আমার ট্যাবলেট, ট্র্যাকার, টিভি, সব জলে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে—।’

ও-প্রান্তে খলখল করে হাসলেন শ্রীধর। আওয়াজটা ফাটা ডায়াফ্রামের কাঁপুনির মতো শোনাল। তার ওপরে ফোনের কথা কেটে-কেটে যাওয়ায় শ্রীধরের হাসি শুনে মনে হচ্ছিল কোনও পিশাচের হাসি।

এরপর শ্রীধর কথা বলতে শুরু করলেন। বারবার ইলেকট্রনিক হোঁচট খেলেও কথাগুলো বুঝতে পারছিল জিশান।

‘সরি, জিশান। কিল গেম ইজ আ ভেরি ফেয়ার গেম। নো এক্সট্রা সাপোর্ট। নো এক্সট্রা ব্যাক-আপ। নো এক্সট্রা অ্যাডভান্টেজ…। এই গেমটার নাম কিল গেম—কোনও ছেলেখেলা নয়।’

জিশান বুঝতে পারছিল হাতে সময় কম। কিলার প্রাোটন আর কিলার সুখারাম হয়তো এই মুহূর্তে নির্ভুল লক্ষ্যে ওর দিকে কনভার্জ করছে, ওর সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে আনছে।

জিশানের প্রচণ্ড রাগ হল। শ্রীধর পাট্টাকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করল। আচমকা খেপে গিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল ও।

‘শ্রীধর….পাট্টা! এই মুহূর্তে কোটি-কোটি মানুষ টিভিতে আমাকে দেখছে। আমি জানি, ওরা আমার সঙ্গে আছে। আমার অপটিক্যাল ট্যাবলেট চাই, চাই, চাই! এটা আমাকে না দিলে কিল গেমের সারভাইভাল ফ্যাক্টর জিরো হয়ে যাবে। তাই আমি নিউ সিটির জনতার আদালতে বিচার চাইছি।’ কথা বলতে-বলতে উঠে দাঁড়াল জিশান। দু-হাত শূন্যে তুলে টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট দেখা দর্শকদের উদ্দেশ করে চিৎকার করে বলল, ‘আপনারা আমাকে ন্যায়বিচার দিন! আপনাদের কাছে আমি বিচার চাইছি! আপনারা মার্শালকে বলুন, যেন উনি এক্ষুনি আমাকে একটা অপটিক্যাল ট্যাবলেট দেন…এক্ষুনি…!’

 ভেজা রুকস্যাকটা তুলে নিয়ে জঙ্গলের দিকে ছুটল জিশান। এবার গা-ঢাকা দেওয়া দরকার। টিভির দর্শকরা নিশ্চয়ই ওর আবেদন ঠিকঠাক শুনতে পেয়েছে, ওকে সরাসরি দেখতেও পেয়েছে। এখন দেখা যাক কী হয়।

সঙ্গে-সঙ্গে যেটা হল সেটা শ্রীধর পাট্টাকে একটা বিশাল ধাক্কা দিল।

সুপারগেমস কর্পোরেশনের কিল গেম কন্ট্রোল রুমের হেলপলাইনে একের পর এক ফোন আসতে লাগল। নিউ সিটির সিটিজেনরা সবাই যেন জিশানের জন্য পাগল হয়ে গেছে। ওরা শুধু ফোনের বোতাম টিপছে। কন্ট্রোল রুমে কেউ ফোন ধরামাত্রই শুনছে, ‘এক্ষুনি জিশানকে অপটিক্যাল ট্যাবলেট আর ট্র্যাকার দিন। ডোন্ট স্পয়েল দ্য গেম, য়ু ড্যাম ফুল!’

হুড়মুড়িয়ে ফোন আসতে লাগল আর ফোনের ভাষা ক্রমশ রুক্ষ আর নোংরা হতে লাগল। শেষ পর্যন্ত, কয়েক মিনিটের মধ্যেই, ভাষাটা কাঁচা খিস্তির পর্যায়ে পৌঁছে গেল।

শুধু যে ভয়েস কল তা নয়। তার সঙ্গে ঝাঁকে-ঝাঁকে ই-মেল আর ভিডিয়ো কল। কন্ট্রোল রুমের সব কর্মীর একবারে পাগল হওয়ার জোগাড়।

বেগতিক দেখে কন্ট্রোল রুমের চিফ অফিসার সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এ শ্রীধর পাট্টাকে ফোন করলেন।

 সেখানে শ্রীধরের তখন প্রায় একই অবস্থা। ই-মেল আর ভিডিয়ো কলের সুনামিতে একেবারে খাবি খাচ্ছেন। সবাই একই দাবি জানাচ্ছে : ‘জিশানকে এক্ষুনি অপটিক্যাল ট্যাবলেট দিন। কিল গেমের থ্রিল আর স্ট্যান্ডার্ড নষ্ট করবেন না।’ অসংখ্য ই-মেল আর কলের মধ্যে কেউ-কেউ শ্রীধরকে দু-চারটে বাজে কথাও বলেছে। কিন্তু এই চাপের সময়ে সেইসব নচ্ছার মানুষগুলোকে লোকেট করে শায়েস্তা করা অসম্ভব। তবে শ্রীধর অবাক হয়ে মানুষগুলোর মাথাচাড়া দেওয়া স্পর্ধার কথা ভাবছিলেন। জিশান ছেলেটা নিউ সিটির সিটিজেনদের স্পর্ধা উসকে দিয়েছে। জিশানের জনপ্রিয়তার যে এরকম মাশুল দিতে হবে সেটা শ্রীধর পাট্টা ভাবেননি।

শ্রীধরের একটা বড় গুণ হচ্ছে, পরিস্থিতি আঁচ করে তিনি খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

এখনও তাই নিলেন। স্যাটেলাইট ফোন তুলে পরপর তিনজন কর্তাকে ফোন করলেন। চটপট কতকগুলো ইনস্ট্রাকশন দিলেন। তারপর ফোন পকেটে রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

অন্যান্য কিল গেমে কখনও এরকম ব্যাপার হয়নি। শ্রীধরের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। যাক, এখনকার মতো তো কেসটাকে সামলে নেওয়া গেছে। জিশানের দাবি তিনি মেনে নিয়েছেন। জিশানের জন্য নতুন একটা স্যাটেলাইট ফোন আর অপটিক্যাল ট্যাবলেট কাম ট্র্যাকার নিয়ে একটা শুটার রওনা হচ্ছে। তাও আবার একটা ট্যাবলেট নয়—দু-দুটো ট্যাবলেট। কারণ, এই মুহূর্তে পাবলিক আনরেস্ট শুরু হয়ে গেলে কিল গেমের তেরোটা বেজে যাবে। হাজার-হাজার লক্ষ-লক্ষ কোটি টাকার লোকসান হয়ে যাবে।

শ্রীধর হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। তাঁর ডায়রেক্টিভ পাওয়ামাত্র সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর ছাদ থেকে শুটার রওনা হয়ে গেছে। দুটো ফ্যালকন হেলিকপ্টার অনেকক্ষণ ধরেই গেম সিটির ওপরে কড়া নজরদারির কাজ চালাচ্ছে। ওদের সঙ্গে শুটারের সিকিওরিটি অফিসার ওয়াকিটকিতে কথা বলে নেবে। জিশানের এগজ্যাক্ট লোকেশন কো-অর্ডিনেট জেনে নেবে।

টেনশনে ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করে দিলেন। দু-হাত মুঠো করলেন, খুললেন। পরপর কয়েকবার। তারপর ভাবলেন, শুধু তো আজকের রাতটা! কাল সকালে জিশান থাকবে কি না ঠিক নেই। তারপর ধীরেসুস্থে পাবলিক আনরেস্ট প্রবলেমটার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করবেন।

পকেট থেকে ফোন বের করলেন শ্রীধর। জিশানের নম্বর লাগালেন। খেয়াল করলেন, ওঁর আঙুলগুলো অল্প-অল্প কাঁপছে।

‘জিশান!’

উত্তরে কয়েক সেকেন্ড ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পেলেন। সেই আওয়াজটা কমতেই প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, ‘জিশান! তোমার অপটিক্যাল ট্যাবলেট শুটারে করে রওনা হয়ে গেছে। একটা নয় দুটো। তার সঙ্গে একটা নতুন স্যাটেলাইট ফোন। ডোন্ট উয়ারি…।’

ও-প্রান্তে জিশানের হাসির শব্দ শোনা গেল। হয়তো জিশানের হ্যান্ডসেটের সমস্যার জন্য শব্দটা খুব চাপা শোনাল। হাসির শেষে উনতিরিশ বছরের লড়াকু ছেলেটা যে-ভঙ্গিতে ‘থ্যাংক…য়ু।’ কথাটা উচ্চারণ করল তাতে স্পষ্ট বোঝা গেল, কথাটার ওপরে ব্যঙ্গের নুন-মরিচ বেশ ভালো করেই ছেটানো রয়েছে।

জিশানের বাঁ-হাতে লাগানো মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটারের সিগন্যাল ট্র্যাক করে শুটারটা খুব সহজেই জিশানকে খুঁজে পেল। ওর বেশ কাছাকাছি একটা ছোট্ট মাপের ফাঁকা জায়গায় আকাশযানটা শিস দিয়ে ভারটিক্যালি ল্যান্ড করল। জিশান সেদিকে এগিয়ে গেল।

অফিসারটির সঙ্গে ওর কোনও কথা হল না—শুধু জিনিস বিনিময় হল। ভেজা রুকস্যাক, বিকল অপটিক্যাল ট্যাবলেট আর স্যাটেলাইট ফোন চলে গেল শুটারে। আর শুটার থেকে পাওয়া গেল নতুন রুকস্যাক—যার ভেতরে রয়েছে একজোড়া নতুন অপটিক্যাল ট্যাবলেট আর স্যাটেলাইট ফোন।

শুটারটা শূন্যে উঠে পড়তেই একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। ক্যামেরার লেন্সকে আড়াল করে সিকিওরিটি অফিসার জিশানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে মাথা নেড়ে চোখ মারল। যার অর্থ একটাই : ‘লড়ে যাও, ভাই।’

জিশানের শরীরে নতুন শক্তি ঝলসে উঠল। ও জঙ্গলের গভীরে ছুট লাগাল। ছুটতে-ছুটতেই অপটিক্যাল ট্যাবলেটের লাল চৌকো বোতামটা টিপল। ফুড ম্যাপ ফুটে উঠল পরদায়। খাবার চাই, খাবার। জিশানের পাগলের মতো খিদে পাচ্ছে।

একটুও সময় নষ্ট না করে নিয়ারেস্ট ফুড পয়েন্টের দিকে ছুটল। মাটি খুঁড়ে খাবারের বাক্স বের করে ফেলল চটপট।

খেতে-খেতে জিশানের মনে হল, খিদের শক্তি অন্যান্য অনেক শক্তির চেয়ে জোরালো।

একটু পরে খাওয়া প্রায় শেষ করে ট্র্যাকারে দুজন কিলারের পজিশন দেখল। মোটামুটি দূরে রয়েছে ওরা। তা ছাড়া ওরা সংখ্যায় একজন কমে যাওয়ায় ‘ত্রিভুজ’ ফাঁদে জিশানকে আর ফেলতে পারবে না। ওদের কাছ থেকে দূরত্ব বাড়ানোর জন্য জিশান জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকতে লাগল। তখনও ওর চোয়াল নড়ছে—খাওয়া তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।

এদিকটা শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। সূর্যের আলো ভেতরে প্রায় ঢুকতেই পারছে না। শুধু গাছের পাতা থেকে ঠিকরে আসা অথবা ঈষদচ্ছ পাতা ভেদ করে আসা মোলায়েম এক আলো চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। কখনও-কখনও পশু-পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘুঘুর ডাকও শুনতে পেল জিশান। ডাকটার মধ্যে কেমন যেন দুপুর-দুপুর গন্ধ।

ঘড়ি দেখল। আর তিন কি চার ঘণ্টা। তারপরই আঁধারের ছায়া নামবে আকাশে।

ঠিক তখনই মোটরবাইকের শব্দ শুনতে পেল জিশান। শব্দটা ভয়ংকর রকমের কাছাকাছি।

অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি ট্র্যাকার দেখল। না:, কিলার দুজন তো বেশ দূরে। তা ছাড়া ওরা রয়েছে একেবারে অন্যদিকে।

জিশান গাছের আড়ালে-আড়ালে শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল। ডানহাতে তুলে নিল মিসাইল গান। জলে ভিজে গেলেও অস্ত্রটা দিব্যি ঠিকঠাক আছে। কারণ, এর বুলেটগুলোর প্রোপালসিভ ফোর্স বারুদের বদলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার থেকে তৈরি হয়।

খানিকটা পথ পেরোতেই গাছের ফাঁক দিয়ে মোটরবাইকটাকে দেখতে পেল জিশান। কালো আর হলদে রঙের গাড়িটার ওপরে সওয়ার হয়ে রয়েছে একজন মাঝবয়েসি ভদ্রলোক। মোটাসোটা। মাথায় টাক। গালে চাপদাড়ি। গায়ে হালকা নীল রঙের ফুল স্লিভ শার্ট আর গাঢ় নীল জিনস। মোটরবাইক দাঁড় করিয়ে জঙ্গলের এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, উঁকিঝুঁকি মারছে।

আড়াল থেকে লোকটিকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

কে এই লোকটা? কিলার অপাশির রিপ্লেসমেন্ট কিলার? শ্রীধরের নতুন সারপ্রাইজ?

না:, সেরকম মনে হচ্ছে না। তা ছাড়া লোকটির সঙ্গে কোনওরকম অস্ত্রশস্ত্র আছে বলে ঠাহর হচ্ছে না।

গাছের আড়াল থেকে প্রকাণ্ড এক লাফ দিল জিশান। মাটিতে একবার পাক খেয়ে বলের মতো গড়িয়ে লোকটির কাছে পৌঁছে গেল। বাঁধন ছেড়া গোটানো স্প্রিং-এর মতো ছিটকে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং মিসাইল গানের লম্বা নলটা লোকটার মাথার পিছনে ঠেকাল। থেমে-থেমে বলল, ‘ট্রিগার টেপামাত্রই তোমার কপাল ফুঁড়ে গুলি বেরিয়ে চলে যাবে…।’

লোকটি হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘জিশান ভাইয়া, ম্যায় তেরেকো হেলপ করনেকো আয়া। তেরে লিয়ে টিভি লায়া…।’

কথাটা শোনামাত্রই জিশান ব্যাপারটা বুঝতে পারল। লোকটা লাইভ টেলিকাস্ট থেকে জানতে পেরেছে, জিশানের টিভি অকেজো হয়ে গেছে। তাই ওর জন্য টিভি নিয়ে এসেছে।

বাইকের কেরিয়ার থেকে একটা ছোট টিভি বের করল চাপদাড়ি লোকটা। জিশানকে দিল। জিশান ওটা তাড়াতাড়ি রুকস্যাকে ঢুকিয়ে নিল।

কিন্তু লোকটা জিশানকে খুঁজে পেল কী করে?

এই প্রশ্নের উত্তরে লোকটা হিন্দিতে যা বলল, তার সারাংশ হল এই :

লাইভ টেলিকাস্টে জিশানের টিভির সমস্যা জানার পর গেম সিটির ‘মক’ সিটিজেনরা খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন একটা বাড়িতে জড়ো হয়ে জিশানকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে বাইশ জন সিটিজেন বাইশটা মোটরবাইকে চড়ে বসে। প্রত্যেকের সঙ্গে একটা করে টিভি। ওরা ঠিক করে যে, পুরো গেম সিটি চষে বেড়িয়ে যে করে হোক জিশানকে খুঁজে বের করতে হবে। তারপর বাইশজনের মধ্যে যে প্রথমে জিশানের দেখা পাবে, সে ওর হাতে কালার টিভিটা তুলে দেবে।

লোকটির নাম রউফ লালা। রউফ সবার আগে জিশানকে খুঁজে পেয়েছে বলে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করছে। যে-বাইশজন জিশানের খোঁজে বাইক নিয়ে বিপজ্জনক অভিযানে বেরিয়ে পড়েছে সুপারগেমস কর্পোরেশন ইতিমধ্যেই তাদের জন্য কুড়ি হাজার টাকা করে বোনাস পুরস্কার ঘোষণা করেছে। আর রউফ যেহেতু জিশানের দেখা পেয়েছে, ওর হাতে টিভিটা দিতে পেরেছে, তাতে মনে হয় রউফের জন্য আরও উঁচুদরের বোনাস পুরস্কার ঘোষণা করা হবে।

রউফ লালা জিশানের চোখের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাতজোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি করল : ‘জিশান ভাইয়া, ম্যাঁয় বহত লাকি হুঁ। কিঁউ কে তেরে সাথ আচানক মেরা সবসে পহেলে ভেট হো গিয়া…।’

এমন সময় গাছের পাতায় আওয়াজ তুলে একটা বড়সড় ইটের টুকরো অথবা পাথর ওদের কাছ থেকে খানিকটা দূরে এসে পড়ল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ। এবং কয়েকটা গাছে আগুন ধরে গেল। শুরু হল পাখপাখালি আর নানান প্রাণীর চিৎকার।

জিশানের মনে হল, এটা বোধহয় হাই-এনার্জি রকেট লঞ্চারের কীর্তি। ও রউফকে কিছু বলে ওঠার আগেই রউফ বলল, ‘ডেঞ্জার, জিশান ভাইয়া! জলদি! তু মেরা বাইক লেকে জলদি নিকল যা। মেরা ফিকর মত কর…।’

পলকে তাই হল। জিশান রউফের বাইকে চড়ে এঁকেবেঁকে রওনা দিল। আর রউফ একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে জিশানের চলে যাওয়া দেখতে লাগল। দেখতে-দেখতে বিড়বিড় করে বলল, ‘সরফরোশি কি তমন্না অব হামারে দিল মে হ্যায়/দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু-এ কাতিল মে হ্যায়…।’

আগুন এর মধ্যেই বড়সড় চেহারা নিয়েছে। রউফ সতর্কভাবে চারপাশে তাকাল। গাছের আড়ালে-আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ও ফেরার পথ খুঁজতে লাগল।

কয়েক পা যেতে না যেতেই কী একটা যেন আচমকা ছুটে এসে ওর বুকে ভীষণ জোরে ধাক্কা মারল। পিছনদিকে ছিটকে পড়ার সময় ও অবাক হয়ে দেখল, ওর বুকে হঠাৎ করে একটা প্রকাণ্ড গর্ত গজিয়ে উঠেছে। গর্তের ভেতরটা টকটকে লাল।

রউফ লালা মারা যাওয়ার আগে শেষবারের মতো ওর সবচেয়ে প্রিয় নামটা ধরে চিৎকার করে উঠল : ‘আ—ল—লা—আ…আ…আ…!’

ওর মুখ দিয়ে শব্দ আর রক্ত একইসঙ্গে বেরিয়ে এল।

ঠিক তখনই দূরের একটা পিপুল গাছের আড়াল থেকে কিলার প্রাোটনের মুখটা দেখা গেল। চোখে আইগিয়ার থাকায় চোখ দেখা যাচ্ছে না। তবে ওর ঠোটের কোণে এক চিলতে হাসি নজরে পড়ছে।

জঙ্গল পেরিয়ে জিশান আবার রাস্তায় নেমে পড়ল। কিছুক্ষণ ধরেই ও বাতাসে পোড়া গন্ধ পাচ্ছিল। জঙ্গল পুড়ছে। এই আগুন ছড়িয়ে পড়ে গোটা জঙ্গলকে না শেষ করে দেয়!

ও রউফ লালার কথা ভাবছিল। হাসতে-হাসতে ঝুঁকি নেওয়া এক আশ্চর্য মানুষ! জিশানকে একবার সামনাসামনি দেখতে পেয়েই যে-মানুষটা নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারে। ওর ‘তুই-তুই’ সম্বোধনের মধ্যেও কোথায় যেন একটা ভালোবাসার, আন্তরিকতার, টান ছিল।

ওই ভাগ্যবান মানুষটা ভালো থাকুক। মনে-মনে বলল জিশান। তারপর রাস্তা ধরে বাইক ছোটাল।

খাঁ-খাঁ গেম সিটির সব জায়গা যেন একইরকম। ধুধু পথঘাট। কোথাও খোলা মাঠ, কোথাও গাছপালা জঙ্গল। আবার কোথাও থোকা-থোকা ফুলের মতো দশ-বিশটা বাড়ি। কখনও চোখে পড়ছে পাথুরে পাহাড়, কখনও-বা নদী।

শহরটায় সব আছে, শুধু প্রাণ নেই। নিউ সিটির অবস্থাটাও যেন অনেকটা তাই। শুধু অল্প কিছু মানুষের বুকের ভেতরে সত্যিকারের মানুষ রয়েছে।

জিশান ভীষণ জোরে বাইক চালাচ্ছিল। কখনও রাস্তায়, কখনও খোলা মাঠের ওপর দিয়ে, কখনও গেম সিটির সিটিজেনদের বাড়ির পাশ দিয়ে, কখনও টিলার ওপর দিয়ে, কখনও-বা ফ্লাই ওভারের ওপর দিয়ে। তবে পথ চলার ফাঁকে-ফাঁকে ও থামছিল। ফুড ম্যাপ দেখছিল, ট্র্যাকার দেখছিল, টিভি দেখছিল। আর খিদে পেলে খেয়ে নিচ্ছিল।

টিভিতে ভাষ্যকারদের গলায় স্বরে উত্তেজনার পারদ বেশ কয়েক ধাপ চড়ে গেছে। কিল গেমের ইঁদুর-বেড়াল খেলা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানান মতামত শোনানো হচ্ছে। তারই মাঝে-মাঝে ঢুকে পড়ছে পুরোনো সব কিল গেমের ক্লিপিংস। আর এসবের ফাঁকফোকরে রুটিনমাফিক বিজ্ঞাপনের ব্রেক তো আছেই!

মাথার ওপরে সূর্য অন্তত পনেরো ডিগ্রি হেলে গেছে পশ্চিম দিকে। আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা—তারপরই অন্ধকার। যেটা ভগবানের দেওয়া জিশানের কালো পোশাক। তখন ওকে সুখারাম আর প্রাোটন দেখতে পাবে না। অবশ্য জিশানও ওদের দেখতে পাবে না। কিন্তু তা সত্বেও জিশান মাথা তুলে সূর্যের দিকে তাকাল। সূর্যদেবকে তাড়াতাড়ি অস্ত যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল।

এক ঝাঁক বাড়ি-ঘরের পাশ দিয়ে জিশানের বাইক ছুটে যাচ্ছিল। সিটিজেনদের হইচই জিশানের কানে এল। ওদের অনেকেই এখন বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে। কিল গেমের রোমাঞ্চ আরও ভালো করে অনুভব করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ওদের সাহসও বেড়েছে।

জিশানের বারবার মিনি আর শানুর কথা মনে পড়ছিল। কিন্তু ও জোর করে ওদের মন থেকে সরিয়ে রাখতে চাইছিল। ওদের নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবলেই জিশান দুর্বল হয়ে পড়বে। ও চায় না, টিভির লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি দর্শক ওর দুর্বলতা দেখে ফেলুক।

জিশান মনকে শক্ত করছিল। বলছিল, মনে-মনে, ‘আর তো মাত্র পনেরো ঘণ্টা!’ কিন্তু ওর ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। সেই ভোর ছ’টা থেকে ও ছুটছে, শুধু ছুটছে। মোটরবাইকের ইঞ্জিনের তাপ ওর শরীরের সমস্ত রস যেন ক্রমাগত শুষে নিচ্ছে। হয়তো সেইজন্যই ওর এত বেশি ক্লান্ত লাগছে, একটু-আধটু ঘুমও পাচ্ছে।

কিন্তু এখন ঘুম পেলে চলবে না। পনেরো ঘণ্টা পর ও ঘুমোবে।

বাইক চালাতে-চালাতে নকল পাহাড়ের কাছে পৌঁছে গেল। পাশাপাশি দুটো নকল পাহাড়—দেখতে হুবহু আসল পাহাড়ের মতো, তবে উচ্চতায় বড়জোর একশো মিটার। প্রথম পাহাড়টার পাকদণ্ডী বেয়ে জিশানের বাইক ওপরে উঠতে লাগল।

সরু এবড়োখেবড়ো পথ। তার একপাশে ঝোপঝাড় কাঁটাগাছ। আর অন্যদিকে নকল পাথরের দেওয়াল। সেই দেওয়ালের ফাটল থেকে ছোট-বড় গাছ গজিয়েছে। সেই গাছে ফুটে রয়েছে গোলাপি, সাদা আর কমলা রঙের অসংখ্য ছোট-ছোট ফুল।

জিশানের মনে হল, কতদিন পর একজন মানুষ ফুলগুলোকে দেখতে এল। তাও আবার ওল্ড সিটির দূরের শহর থেকে। ওর আরও মনে হল, ওকে দেখে ফুলগুলো যেন খুশিতে হাসছে, অল্প-অল্প দুলছে।

অপাশিরা কথাও মনে পড়ছিল জিশানের। অপাশিকে ও চেনে না, জানে না—কিন্তু তা সত্বেও ওকে খুন করে বসল! যে-মানুষ দুটো পরস্পরের অচেনা, যাদের মধ্যে এককণাও ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা বিনিয়ম হয়নি, তারা একে অপরের প্রাণের জন্য পাগল!

নিজেকে ধিক্কার দিল জিশান। ওর সান্ত্বনা শুধু এটুকুই যে, অপাশি কানোরিয়ার জন্য সুনিশ্চিত মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা করছিল। আর প্রাোটন কিংবা সুখারামের ক্ষেত্রেও তাই।

পাহাড়ে অনেকটা উঠে আসার পর জিশান থামল। এই উচ্চতা থেকে শহরটাকে কী সুন্দর দেখাচ্ছে! রাস্তার পাশে বাইক থামিয়ে পাহাড়ের ছায়ায় ঘাস আর আগাছার ওপরে ও বসে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের জন্য কিল গেমের কথা ভুলে গেল। ভুলে গেল, ওর নাম কী, ও কোথায়, কী করতে এই পাহাড়ে বসে আছে।

চোখের সামনে সাদা আর নীল মেশানো আকাশ। কয়েকটা কালো পাখি। চিড়িক-চিড়িক করে ডাকতে-ডাকতে জিশানের চোখ বরাবর উড়ে গেল। শব্দ করে বাতাস বইছে। জিশানের মনে হচ্ছিল, বাতাস ওর সঙ্গে কথা বলছে।

জিশান কেমন উদাসীন হয়ে গেল, আনমনা হয়ে গেল।

হঠাৎই একটা চিলের চিৎকারে ও বাস্তবে ফিরে এল। পোশাকের হাতা দিয়ে কপাল আর গালের ঘাম মুছল। বাঁ-হাতের অপারেশনের জায়গাটা অল্প-অল্প ব্যথা করছে। ট্র্যাকারের মাইক্রোট্রান্সমিটারটা এই জায়গায় মাংসের আড়ালে আস্তানা গেড়ে আছে।

উঠে দাঁড়াল। ক্লান্ত পায়ে রুকস্যাকের দিকে এগোল। হাত দুটো শূন্যে তুলে কয়েকবার ঘোরাল। পা টানটান করে কাল্পনিক শত্রুর দিকে কয়েকবার লাথি ছুড়ল। জড়তা কাটিয়ে চাঙ্গা হওয়া দরকার।

রুকস্যাক থেকে টিভি বের করল। অন করামাত্রই উত্তেজনাময় রানিং কমেন্ট্রি। আর ক্লোজ-আপ ছবিতে প্রাোটন। পাথর খোদাই করা নিষ্প্রাণ মুখ।

‘…ফোকস, হাই অ্যাড্রিনালিন গেম এখন পিক-এ পৌঁছে গেছে। কারণ, সুপারহিরো জিশান এখন জোড়া পাহাড়ের হিল নাম্বার ওয়ান-এ, এইটি মিটার লেভেলে, আর কিলার প্রাোটন হিল নাম্বার ওয়ানের বেস-এ পৌঁছে গেছে।

‘হিল নাম্বার ওয়ান থেকে নামার পথ তিনটে। তার মধ্যে দুটো রাস্তা প্রাোটন গাড়ি দিয়ে ব্লক করে দিয়েছে। আর অন্য রাস্তা ধরে ও এখন মোটরবাইক নিয়ে পাহাড়ে উঠবে। সো, হেড টু হেড এনকাউন্টার ইজ ইনএভিটেবল। মোকাবিলা হচ্ছেই…।’

কিন্তু গাড়ি দিয়ে প্রাোটন দুটো রাস্তা ব্লক করল কেমন করে! ও একা দুটো গাড়ি আর একটা মোটরবাইক হিল নাম্বার ওয়ান পর্যন্ত নিয়ে এল কেমন করে! সুখারাম বা আরও কেউ কি ওকে হেলপ করেছে? এটাও কি শ্রীধর পাট্টার একটা সারপ্রাইজ?

এসব কথা ভাবতে-ভাবতে জিশান চটপট ট্র্যাকার বের করল। তারপর ট্র্যাকারের দিকে চোখ রেখেই হান্টিং নাইফ আর মিসাইল গান বের করে নিল রুকস্যাক থেকে।

ট্র্যাকারে সবচেয়ে কাছের লাল ডটটা ওর কাছ থেকে প্রায় একশো মিটার দূরে রয়েছে। না, ‘দূরে’ রয়েছে না বলে ‘কাছে’ রয়েছে বলাটাই বোধহয় ভালো।

জিশান পাহাড়ের কিনারায় এসে খাদের দিকে তাকাল। পাহাড়ে ওঠার রাস্তাগুলোর শুরুর দিকটা দেখতে চাইল। কিন্তু না, দেখা যাচ্ছে না। গাছপালায় আড়াল হয়ে গেছে।

টিভিতে তখন জিশানের ছবি। পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে। আর তার সঙ্গে রানিং কমেন্ট্রি চলছে : ‘…নিজের মোটরবাইকের সঙ্গে দুটো গাড়ি চেন দিয়ে বেঁধে প্রাোটন টো করে হিল নাম্বার ওয়ান পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। তারপর রোড ব্লক করেছে। ঠিক যেন কোনও মানুষের মেইন আর্টারি ব্লক করে দেওয়া। সত্যি, বন্ধুগণ মানতেই হবে প্রাোটনের ব্রেন সুপারকুল…।’

জিশানের ঠিক পিছনে পাহাড়ের পাথুরে দেওয়ালে সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেল।

ওর কানে তালা লেগে গেল। পাথরের ছোট-বড় টুকরো সপ্লিন্টারের মতো ছিটকে গেল চারিদিকে। ও চট করে একটা বোল্ডারের আড়ালে চলে গেল। প্রাোটনের অস্ত্রটা কী হতে পারে? লেসার টেলিশটার? নাকি হালকা, লং ডিসট্যান্স রাইফেল?

কয়েক সেকেন্ড পর গলা বাড়িয়ে নীচের দিকে দেখতে চেষ্টা করল। সঙ্গে-সঙ্গে ‘ক্র্যাক’ আওয়াজ। জিশান এক ঝটকায় মাথা নামাল। ওর পিছনের পাথর থেকে আবার স্টোন চিপস উড়ে গেল নানান দিকে।

জিশানও পালটা জবাব দিল মিসাইল গান দিয়ে। নীচের দিকে আন্দাজ করে চকিতে পরপর তিনবার ট্রিগার টিপল। তারপর ছুটে চলে গেল টিভি সেটের কাছে। হ্যাঁ, ওর আর প্রাোটনের অ্যাকশনের লাইভ টেলিকাস্ট চলছে। প্রাোটনের কানে স্যাটেলাইট ফোন। বোধহয় সুখারামের সঙ্গে কথা বলছে। প্ল্যান আঁটছে।

এবার জিশানের ক্লোজ-আপ দেখা যাচ্ছে। সারা মুখে ঘাম। কোথাও-কোথাও রক্তের ছিটে। চুলে ধুলোর আস্তরণ।

কিন্তু সুখারাম এখন কোথায়? কতটা দূরে?

ট্র্যাকার দেখল। সুখারামের লাল ডটটা বেশ কিছুটা দূরে, কিন্তু এগিয়ে আসছে সবুজ ডটের দিকেই।

না, আর দেরি নয়। চটপট রুকস্যাকে ট্র্যাকার, টিভি সব গুছিয়ে নিল। হান্টিং নাইফ আর মিসাইল গান কোমরে গুঁজে নিল। তারপর রুকস্যাক পিঠে বেঁধে পাহাড়ের গা বেয়ে নামতে শুরু করল। ছোট-বড় বোল্ডারকে ডিঙিয়ে বা পাশ কাটিয়ে, গাছের ঝুঁটি ধরে নিজেকে সামলে জিশান নামতে লাগল। নামার সময় প্রাোটনের পজিশন আন্দাজ করে নিজেকে পাথর কিংবা গাছের আড়ালে-আড়ালে রাখতে লাগল।

নামতে-নামতে ভাবছিল জিশান। পথ দিয়ে নয়, বিপথ দিয়েই ওকে পালাতে হবে, কিলার প্রাোটনকে এড়াতে হবে। তারপর অন্ধকারের অপেক্ষা।

কিন্তু জিশান যেরকম ভাবল, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম হল না।

নামার সময় বেশ বিপজ্জনক ঢাল ওকে ম্যানেজ করতে হচ্ছিল। ওর হঠাৎই মনে হল, যদি কোনওভাবে ওর পা স্লিপ করে তা হলে বিপদ তো হবেই, তার ওপর রুকস্যাকের টিভি, ট্র্যাকার, স্যাটেলাইট ফোন সবকিছুর বারোটা বাজবে। নতুন করে টিভি আর ট্র্যাকার জোগাড় করার ঝঞ্ঝাটের ব্যাপারটা মনে-মনে ভাবল। তারপর রুকস্যাকটা খুলে নামিয়ে দুটো বড় পাথরের খাঁজে লুকিয়ে ফেলল। জায়গাটা ভালো করে নোট করে মাথায় গেঁথে নিল। এবার মিসাইল গান আর হান্টিং নাইফ সম্বল করেই নামা যাক।

জিশান নামতে লাগল। পড়ে যেতে-যেতে টাল সামলাতে লাগল বারবার। আর দু-চোখ সরু করে প্রাোটনকে খুঁজতে লাগল।

প্রাোটনও জিশানকে খুঁজছিল। কিন্তু ও ভেবেছিল, জিশান তিনটে পাকদণ্ডীর একটা বেয়ে নামবে। ও যে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামার ঝুঁকি নেবে সেটা ভাবেনি। তাই জিশানকে প্রাোটন ট্র্যাক করতে পারেনি। মিনিট কয়েক খোঁজাখুজির পর প্রাোটন চুপ করে ভাবতে শুরু করল। জিশানের বুদ্ধির সঙ্গে নিজের বুদ্ধি খাপ খাওয়াতে লাগল। জিশানের স্ট্র্যাটেজি কী হতে পারে সেটা আঁচ করতে লাগল। আর চিবুক তুলে শকুনের চোখে পাহাড়ের ঢালের প্রতিটি কণা ছানবিন করতে লাগল।

প্রাোটন ভাবতে লাগল, ‘আমি জিশান হলে কোন এসকেপ রুট ব্যবহার করতাম?’ এবং মনে-মনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে চলল।

একটু পরেই প্রাোটন যে-উত্তরটা খুঁজে পেল সেটা জিশানের সঙ্গে মিলে গেল। তাই পাহাড়ের গা বেয়ে প্রাোটন উঠতে শুরু করল। পিঠে রুকস্যাক। স্যাটেলাইট ফোনটা রুকস্যাকে চালান করে দিয়েছে। লেসার টেলিশটার আড়াআড়িভাবে দাঁতে চেপে ধরা। চোয়ালের রেখা উঁচু হয়ে চেয়ে আছে। লম্বা-লম্বা হাত-পা ব্যবহার করে এমনভাবে ও পাহাড় বেয়ে উঠছে যেন একটা কালো রঙের মাউন্টেন লায়ন।

পাহাড়ের কালচে পাথরের মাঝে কালো পোশাক পরা প্রাোটনকে খুঁজে পাচ্ছিল না জিশান। তাই ও সামান্যতম নড়াচড়া দেখতে পাওয়ার অপেক্ষায় রইল।

কিন্তু হঠাৎই একটা অঘটন ঘটল।

পাহাড়ের পাথরের খাঁজে বোধহয় একটা চিল বাসা বেঁধেছিল। জিশান আচমকা ওটার সামনে হাজির হয়ে পড়তেই মা-চিলটা ডানা ঝপটে তেড়ে এল ওর দিকে। এবং সাপের ছোবল মারার ক্ষিপ্রতায় জিশানের কপালে বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে দিল।

জিশানের কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে এল। শক্ত ঠোঁটের আঘাতে কপালে বেশ ব্যথাও টের পেল। কিন্তু তার চেয়েও মারাত্মক ক্ষতি হল অন্যভাবে।

জিশান ব্যালান্স হারিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে পড়তে লাগল।

পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে নেমে আসা শরীরটাকে প্রাোটন সহজেই দেখতে পেল। একটা পাথরের ওপরে দাঁড়িয়ে ও জিশানকে তাক করে লেসার টেলিশটার পরপর দুবার ফায়ার করল।

মুভিৎ টারগেট। তাই প্রাোটন লক্ষভ্রষ্ট হল। আশপাশের পাথরের ছিলকা উড়ে গেল। এবং জিশানের গড়িয়ে পড়া শরীর একেবারে প্রাোটনের ঘাড়ে এসে পড়ল।

দুটো শরীর জড়াজড়ি করে নীচে পড়ছিল, কিন্তু একটা পাথরের চাতাল ওদের বাঁচিয়ে দিল।

ওদের সংঘর্ষের জায়গা থেকে কয়েক মিটার নীচে একটা পাথরের চাতাল ছিল। তার শরীরে অনেক ছোট-বড় ফাটল, কিন্তু পাথরটা চেহারায় ঠিক যেন একটা বড় মাপের ডাইনিং টেবিল। তার গায়ের চারপাশে আর নানান ফাটলে শুধু আগাছা আর ঘাস।

জিশান আর প্রাোটন সেখানে এসে পড়ল। একটা শাখামুটি সাপ চাতালটায় শুয়ে বোধহয় রোদ পোহাচ্ছিল, চমকে উঠে সড়সড় করে একটা ফাটলে গিয়ে ঢুকে পড়ল।

নিজেকে সামলে নিতে জিশানের এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগেনি। আর প্রাোটনের পেট লক্ষ্য করে লাথি চালাতে সময় লাগল বাড়তি আরও একটা সেকেন্ড।

প্রাোটনের লেসার টেলিশটার ওর হাত থেকে ছিটকে গিয়েছিল। পাহাড়ের ঢালের পাথরে-পাথরে ঠোক্কর খেয়ে ওটা নীচে পড়ে গেছে। রুকস্যাকের দশাও তাই। স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে কখন যেন আশপাশে ছিটকে পড়েছে।

আর জিশানের হালও একইরকম। ওর কোমরে গোঁজা মিসাইল গান চিলের আচমকা আক্রমণে নীচে পড়ার সময় কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। শুধু হান্টিং নাইফটা কোমরে তখনও ছিল। ওটার ফলার খোঁচা খেয়ে কোমরের বাঁ-দিকটায় কোথাও একটা চোট লেগেছে। জায়গাটা বেশ জ্বালা-জ্বালা করছে।

প্রাোটনের ক্ষিপ্র প্রতিবর্তী ক্রিয়া জিশানকে অবাক করে দিল। বেজির তৎপরতায় ও জিশানের লাথির সংঘাতটা প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ এড়িয়ে গেল। সার্কাসের পেশাদার অ্যাক্রোব্যাটদের মতো দুবার সামারসল্ট খেয়ে পলকে চলে গেল জিশানের হাত-পায়ের নাগালের বাইরে।

এরপর যে-লড়াইটা হল সেটা কারাটে আর কিক বক্সিং-এর অদ্ভুত মিশেল। এই সব লড়াইয়ের আধুনিক নাম জিশান না জানলেও লড়াইটা জানে। আর প্রাোটনও তার চেয়ে কিছু কম জানে না।

ওদের দুজনের হাত-পা চলতে লাগল বিদ্যুৎগতিতে। আর সংঘর্ষের চোখাচোখা শব্দ হতে লাগল। ওর ছিপছিপে লম্বা প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে জিশান তার শক্তি যতটা হওয়া উচিত বলে আঁচ করেছিল, এখন বুঝতে পারছিল প্রাোটনের শক্তি তার চেয়ে অনেকটা বেশি।

ঘুরন্ত চাকার মতো শরীরটাকে শূন্যে পাক খাইয়ে দিল প্রাোটন। একইসঙ্গে ওর ডান-পা একটা বৃত্তচাপ এঁকে দিল বাতাসে। আর পায়ের গতিপথে জিশানের চোয়ালকে পেয়ে গেল।

জিশান একটা ঝটকা দিয়ে মাথাটা সরিয়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু সেটার টাইমিং যে ঠিক হয়নি সেটা চোয়ালের আঘাত ওকে জানিয়ে দিল। ও পিছনদিকে টাল খেয়ে পড়ে গেল পাথরের দেওয়ালে। কিন্তু এক সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে আবার সামলে নিল।

প্রাোটন ওর পোশাকের কোনও একটা পকেট থেকে একটা ইস্পাতের স্টার বের করে নিয়েছিল। সেটার প্রান্তগুলো ক্ষুরের মতো ধারালো। স্টারটা মাপে একটা বিস্কুটের মতো। সেটা ডানহাতের তর্জনী আর মধ্যমার মাঝে চেপে ধরল—যেন জিনিসটা একটা চ্যাপটা সিগারেট।

জিশান হান্টিং নাইফটা কোমর থেকে খামচে বের করে নিল। কিন্তু ততক্ষণে প্রাোটন পা ভাঁজ করে সামান্য কুঁজো হয়ে ইস্পাতের ঝকঝকে তারাটা ফ্রিসবি ছোড়ার ভঙ্গিতে জিশানের ডানহাত লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল।

 ছোট্ট অস্ত্রটা বাতাস চিরে ধেয়ে গেল জিশানের দিকে, ওর ছুরি ধরা হাতের পিঠে গিয়ে প্রথম আঘাত করল, কিন্তু সেখানেই থামল না। দুরন্ত গতিতে চাকার মতো গড়িয়ে হাত বেয়ে ছুটে গেল। তারপর ছুঁচোবাজির মতো এলোমেলো বাঁক নিয়ে জিশানের বুকের ওপরে আড়াআড়িভাবে ধারালো ফলার দাগ টেনে দিল।

জিশানের হাত, বুক, জ্বলে গেল। রক্তের রেখা ফুটে উঠল হাতে, বুকে। হান্টিং নাইফ হাত থেকে খসে পড়ে গেল।

আচমকা আঘাত আর যন্ত্রণায় জিশান হয়তো কয়েক সেকেন্ডের জন্য কাবু হয়েছিল, সেই ফাঁকে প্রাোটন এক ঝাঁক ইস্পাতের পিন জিশানের চোখ-মুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে দিয়েছে।

পিনগুলো মাপে ইঞ্চিচারেক। চকচকে। ডগাগুলো সূক্ষ্ম।

জিশান ঝটিতি বসে পড়েছিল। কিন্তু তা সত্বেও ও সবক’টা পিন এড়াতে পারল না। তিনটে ইস্পাতের পিন ছুটে এসে ওর কপালে আর গালে বিঁধে গেল।

সেই অবস্থাতেই জিশান একটা মাঝারি মাপের বোল্ডার তুলে নিয়ে শট পাটের ভঙ্গিতে ছুড়ে দিল। ওর শরীরটা চক্কর খেয়ে দেড়পাক ঘুরে গেল। এবং ভারি পাথরটা প্রচণ্ড ভরবেগ নিয়ে প্রাোটনের পেটে গিয়ে ধাক্কা মারল। সংঘর্ষের অভিঘাতে প্রাোটন পিছনদিকে টাল খেয়ে গেল। ব্যালান্স রাখার জন্য ও দু-হাত চরকির মতো শূন্যে ঘোরাতে লাগল। এই পড়ো-পড়ো অবস্থায় তিন-চার সেকেন্ড বাতাসে চিত-সাঁতার কাটল। তারপর টলে পড়ে গেল পাথরের চাতাল থেকে।

জিশান এত সব কাণ্ড দেখার জন্য মোটেই অপেক্ষা করেনি। মসৃণ পাথরটা শক্রকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে ও বুঝতে পেরেছিল লক্ষ্যভেদ হবেই। নিউ সিটির সুদীর্ঘ ট্রেনিং ওর আত্মবিশ্বাসকে অকল্পনীয় ভিতের ওপরে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাই ও ঘুরে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ের ঢালের দিকে। তারপর শুধু হাতে রক ক্লাইম্বিং শুরু করে দিয়েছে। মাকড়সার মতো তরতর করে বেয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে।

ও জানে, প্রাোটনের হাতে এই মুহূর্তে কোনও লং ডিসট্যান্স অস্ত্র নেই। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে মোটরবাইকের কাছে পৌঁছতে হবে। জলদি! জলদি!

প্রাোটন চাতাল থেকে প্রায় দশ-বারো ফুট নীচে পড়ে গিয়েছিল। ওর মাথা ঠুকে গিয়েছিল একটা বড় বোল্ডারে। ওর শরীরটা সেই বোল্ডারের খাঁজে আটকে গিয়ে ওর প্রাণ বাঁচাল বটে, কিন্তু ও অজ্ঞান হয়ে গেল। ওর চোখের আইগিয়ার আশ্চর্যভাবে বেঁচে গেছে—তাতে এতটুকু চিড় ধরেনি। তাই চিত হয়ে পড়ে থাকা প্রাোটনকে বিকেলের রোদে ভারি বিচিত্র দেখাচ্ছিল। ওর দুটো কালো ‘চোখ’ নিষ্পলকে তাকিয়ে ছিল আকাশের দিকে।

জিশান পাগলের মতো ওর মোটরবাইকের কাছে পৌঁছতে চাইছিল। ওর এখন মোটরবাইকটা দরকার। ওটাই এখন ওর সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে-উঠতে জিশান সুখারাম নস্করের কথা ভাবছিল। সুখারাম এখনও অকুস্থলে এসে পৌঁছতে পারল না কেন? ওর তো এতক্ষণ দেরি হওয়ার কথা নয়! তা হলে কি ও ট্র্যাকার দেখে জিশানের কাছাকাছি কোথাও এসে গেছে, কিন্তু পাহাড়ের ঢালে সঠিক জায়গাটা খুঁজে পায়নি?

আর বেশি ভাবার দরকার নেই! হাঁপাতে-হাঁপাতে জিশান ওর পুরোনো জায়গাটায় বেয়ে উঠল। ওই তো ওর রুকস্যাক! ওই তো ওর মোটরবাইক!

বিকেলের আলোয় জিশানকে ভারী অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। ওর মুখে, গালে, চিবুকে ঘাম আর রক্ত। হাত আর বুকের ওপরে আঁকা হয়ে গেছে রক্তের রেখা। সারা শরীরে জ্বালা-পোড়া। তিনটে ইস্পাতের পিন লম্বভাবে বিঁধে রয়েছে কপালে আর বাঁ-গালে। এতক্ষণ পিনগুলো খোলার কথা মনে হয়নি। এখন টান মেরে খুলে ফেলল। নতুন জ্বালার অনুভূতি হুল ফোটাল তিনটে বিন্দুতে। ভাগ্যিস এগুলোর ডগায় বিষ মেশানো নেই! আর হাতাহাতি লড়াইয়ের সময় প্রাোটনের নখের আঁচড় থেকে ও নিতান্ত ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছে।

রুকস্যাক পিঠে নিয়ে মোটরবাইক ছুটিয়ে দিল জিশান। তার আগে বাইকের কেরিয়ারে রাখা প্লেট টিভিটা অন করে দিল। ছবি দেখা না যাক, অন্তত রানিং কমেন্ট্রিটা শোনা যাক। তা থেকে যতটুকু খবর পাওয়া যায়।

‘এইমাত্র আপনারা যা দেখলেন সেটা একটা অবিশ্বাস্য লড়াই। এইরকম থ্রিলিং টেবল-টপ ফাইট এর আগে কোনও কিল গেমে দেখা যায়নি। কিলার প্রাোটন এখনও অজ্ঞান হয়ে আছে। আশা করি আর কিছুক্ষণের মধ্যে ও জ্ঞান ফিরে পাবে। তারপর আবার নতুন এনার্জি নিয়ে লড়াইয়ে নামবে।

‘বন্ধুগণ, আপনাদের জানিয়ে রাখি কিল গেমের নানানরকম ইভেন্ট নিয়ে যেসব ”ফোরসি দ্য আউটকাম”-এর সুইপস্টেক-এর ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে এ পর্যন্ত বাজি ধরেছেন চোদ্দোশো তিরিশ মিলিয়ন দর্শক। এরকম বিশাল নাম্বারের পার্টিসিপেশান আগে কখনও কোনও কিল গেমে দেখা যায়নি। দিস ইজ অ্যান অল টাইম রেকর্ড, ফোকস, অল টাইম সুপারডুপার হিট!

‘ওই দেখুন, জিশান এখন পাহাড় থেকে নামছে। কিন্তু রাস্তার শেষে রোড ব্লক রয়েছে। একটা গাড়ি সেখানে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে গেছে কিলার প্রাোটন। দেখা যাক, আমাদের সুপারহিরো কী করে! আপনারা ভুলে যাবেন না, জিশান এখন উন্ডেড আর টায়ার্ড। সেটা ওকে দেখেই আপনারা স্পষ্ট বুঝতে পারছেন।

‘আর-একটা প্লাস পয়েন্ট ফর জিশান। কিলার প্রাোটন এখন টেম্পোরারিলি ডি-অ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেছে, কিন্তু তা সত্বেও জিশান ওর মোটরবাইকের কাছে এসে রুকস্যাক থেকে ওয়েপন নিয়ে আবার প্রাোটনের কাছে ফিরে যায়নি। ওকে পারমানেন্টলি ডিঅ্যাক্টিভেট করে দেয়নি। সো, ফোকস, থ্রি চিয়ার্স ফর জিশান, থ্রি চিয়ার্স ফর হিজ সফট হার্ট—।’

জিশান এসব শুনতে পাচ্ছিল আর পাকদণ্ডী বেয়ে নামছিল। একইসঙ্গে ভাবছিল, কী করে ও রোডব্লকটা পেরোবে। ওর সামনে পশ্চিমে ঝুঁকে পড়া সূর্য। সরাসরি যেন তাকিয়ে আছে জিশানের দিকে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও পাহাড়ের প্রায় নীচের দিকে চলে এল। আর তখনই ওর চোখে পড়ল, সরু রাস্তায় প্রায় আড়াআড়িভাবে একটা রুপোলি রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার দুপাশে এমন কোনও ফাঁক নেই যা দিয়ে একটা মোটরবাইক গলে যেতে পারে।

জিশান বাইকের গতি কমাতে বাধ্য হল। এবং থামল। রুপোলি গাড়ির ‘পাঁচিল’টার দিকে তাকিয়ে রইল।

সুখারাম নস্করের ভালো লাগছিল না। ও জানে, ওর ফেরোসিটি কোশেন্ট 8.9। জানে, ও বেজির মতো ক্ষিপ্র, চন্দ্রবোড়ার মতো সতর্ক, তৎপর। আর ছুটতে পারে হরিণের মতো—সেটাও আবার একটানা, অনেকক্ষণ ধরে।

নিয়মিত শরীরচর্চা করাটা সেন্ট্রাল জেলের কয়েদিদের রুটিনের মধ্যে পড়ে। তা ছাড়া দৌড়ের অভ্যেসটা ও জেলের মধ্যেও বজায় রেখেছে। ফলে এখন ও বদনোয়ার গ্যাঙের তিন-চারজনের সঙ্গে খালি হাতে দিব্যি মহড়া নিতে পারে। তা সত্বেও শ্রীধর পাট্টা ওর সারা শরীরে নানান মারণাস্ত্র সাজিয়ে দিয়েছেন। আর বিশেষ যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য দিয়েছেন স্যাটেলাইট ফোন।

কারণ একটাই : গেম সিটির সীমানার মধ্যে ওকে জিশানকে শিকার করতে হবে।

এইখানেই হয়েছে যত মুশকিল!

কিল গেমে নামার আগে জিশানের নানান গেমের ক্লিপিংস সুখারাম দেখেছে। দেখেছে ওর আরও অন্যান্য ক্লিপিংস। সেইসব দেখার পর থেকেই ওল্ড সিটির এই লড়াকু ছেলেটার প্রতি ওর শ্রদ্ধা বেড়ে গেছে। বারবার মনে হয়েছে, জিশান ওর ভাই—ওরা একই শহরে মানুষ হয়েছে। এই নিউ সিটিতে আসার পর থেকে জিশান ওর শহরের হয়ে লড়াই করছে, ন্যায়ের হয়ে লড়াই করছে।

সুখারামের মনে পড়ল, মনোহর সিং-এর হয়ে জিশান রুখে দাঁড়িয়েছে, জাব্বাকে পিট ফাইটে নিকেশ করতে-করতেও ও ছেড়ে দিয়েছে, অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করেনি।

এসব কথা ভাবতে-ভাবতে সুখারামের মনের ভেতরে শ্রীধর পাট্টার মুখটা বদনোয়ার মতো হয়ে গেল, আর জিশানের মুখটা ওর মতো। সুখারামও তো ন্যায়ের জন্যই লড়াই করেছিল!

সুখারাম যদি জিশানকে খতম করতে পারে তা হলে তার বিনিময়ে ও কী পাবে? মৃত্যুদণ্ড রদ। সেইসঙ্গে মুক্তি। আর হয়তো অনেক টাকা পুরস্কার। কিন্তু সেগুলো নিয়ে ও করবে কী? কোথায় যাবে? মা নেই। চোলিও নিশ্চয়ই আর নেই। তা হলে ও যাবে কোথায়? অনিশ্চিত জীবনের পথে শুধু দৌড়বে, আর দৌড়বে!

বরাট স্যারের কথা মনে পড়ল। স্যারের খদ্দরের পাঞ্জাবি থেকে ঘামের গন্ধ ভেসে এল ওর নাকে। স্যার প্রায়ই বলতেন, ‘তুই একদিন বড় কিছু একটা করে দেখাবি….।’ বদনোয়া আর ওর চারটে চুন্নুকে খতম করে ও পৃথিবী থেকে পাঁচ-পাঁচটা পাপীকে মুক্তি দিয়েছিল। একটা ‘বড়’ কাজ করে দেখিয়েছিল।

আজ আবার একটা সুযোগ এসেছে—একটা ‘বড়’ কিছু করে দেখানোর। তাই ও শ্রীধরের পোষা অন্ধ কুকুরের মতো জিশানকে তাড়া করে ছুটে বেড়াতে পারছিল না। ওর ভেতরে ভীষণ তীব্র একটা অনিচ্ছার ঝোঁক কাজ করছিল। তাই সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে ওর আর জিশানের মধ্যে দূরত্বের ফারাক তেমন একটা কমছিল না।

এর জন্য বেশ কয়েকবার শ্রীধর ওকে ফোন করে ধমক দিয়েছেন : ‘কী ব্যাপার, সুখারাম? তুমি কি ভুলে গেলে তোমার ফেরোসিটি কোশেন্ট 8.9? তোমার অ্যাক্টিভিটি দেখে তো মনে হচ্ছে ওটা 2.5-এরও কম!’

শুধু শ্রীধর পাট্টা নয়, টিভির কমেন্টেটররাও ওকে ঘন-ঘন সমালোচনা করেছে। ও গেম সিটির কয়েকটা দোকানে দাঁড়িয়ে দোকানের টিভিতে নিজের কানে সেইসব সমালোচনা শুনেছে। কমেন্টেটররা কখনও ওকে ‘সুখী সুখারাম’ বলে সম্বোধন করেছে, আবার কখনও বা বলেছে, ‘ওর নাম মনে হয় সুখারাম নস্কর নয়, সুখারাম গদাইলশকর!’

কিন্তু না—তাতেও সুখারামের ভেতরের ইচ্ছেটা, কিংবা অনিচ্ছাটা, পালটায়নি। কিল গেমটা ও জিশানের সঙ্গে লড়তে চায় না, শ্রীধরের সঙ্গে লড়তে চায়। ওর আবার একটা ‘বড়’ কাজ করে দেখাতে ইচ্ছে করছে। বরাট স্যার যেখানেই থাকুন, নিশ্চয়ই ওর এই কাজের কথা জানতে পারবেন।

ওর নাকে স্যারের ঘামের গন্ধটা আবার ভেসে এল।

জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সুখারাম। হাতে ধরা হাই-ফাই ইলেকট্রনিক ট্র্যাকার। একটা সবুজ ডট, আর দুটো লাল ডট। সবুজ ডটটা নড়ছে বটে, কিন্তু লাল ডট দুটো স্থির।

অপাশি যে আর নেই সেটা সুখারাম জানে। সুতরাং দুটো লাল ডটের একটা ও নিজে, আর অন্যটা প্রাোটন। সুখারাম চুপচাপ একজায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাই ওর লাল ডট স্থির। কিন্তু প্রাোটনও কি তা হলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে! কিন্তু কেন?

প্রাোটনকে ফোন করল সুখারাম। রিং বাজতে শুরু করল। অনেকক্ষণ ধরে বাজতেই থাকল—কেউ ধরল না। অবশ্য ধরলেও প্রাোটন এত কম কথা বলে যে, সেগুলোকে ‘কথা’ না বলে ‘হু-হাঁ’ গোছের ‘শব্দ’ বলাই ভালো।

ফোন কেটে দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে খানিকটা আকাশ দেখা যাচ্ছে। সন্ধে নেমে আসতে আর খুব বেশি দেরি নেই—অন্তত আকাশ তাই বলছে। একটা হেলিকপ্টার আকাশ চিরে উড়ে গেল। ওটার ‘ভোমরার ডাক’ হালকাভাবে ভেসে এল।

সুখারাম এবার নড়েচড়ে উঠল। ছল-ছুতোয় ও অনেক সময় ‘নষ্ট’ করেছে। আরও বেশিরকম গা ঢিলে দিলে শ্রীধর পাট্টা হয়তো তিতিবিরক্ত হয়ে শুটারে করে রিপ্লেসমেন্ট কিলার পাঠিয়ে দেবেন।

সুখারাম জঙ্গলের বাইরে পা চালাল। কাছেই পিচের রাস্তা। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওর সোনালি রঙের হাই-স্পিড অটোমোবিল। চ্যাপটা, ছ’চাকাওয়ালা। আগের নীল গাড়িটা সুখারাম বদলে নিয়েছে।

গাড়িতে বসে ইঞ্জিনে স্টার্ট দিল সুখারাম নস্কর। শেষ পর্যন্ত যা-ই হোক না কেন, জিশানের সঙ্গে ওর দেখা হওয়াটা দরকার—ভীষণ দরকার।

জিশান বাইক থামাল মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ও প্যাসকোর কথা ভাবল। ভাবল রুপোলি গাড়ির ‘পাঁচিল’ ডিঙোনোর একটা স্ট্র্যাটেজির কথা। তারপর বাইকে আবার স্টার্ট দিল। এবং ওই ‘পাঁচিল’ লক্ষ্য করেই গোঁ-গোঁ করে বাইক ছুটিয়ে দিল।

কিছুটা পথ গিয়েই বাইক তুলে দিল পাহাড়ের ঢালে। এবড়োখেবড়ো জমি, বড়-বড় ঘাস আর আগাছা, সঙ্গে ছোট-বড় পাথর—তার ওপর দিয়েই ওর বাইক কোলাব্যাঙের মতো লাফাতে-লাফাতে ছুটে চলল। পাহাড়ের ঢালে বাইকটা হেলে থাকলেও ওটার স্পিড মাধ্যাকর্ষণের টানের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। জিশানের বারবার মনে পড়ছিল প্যাসকোর কথা : গেম সিটিতে মোটরবাইকটা একটা অস্ত্র। এখন জিশান সেই অস্ত্র ব্যবহার করছে।

গাড়িটার কাছে পৌঁছে জিশান মোটরবাইকের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে নেমে পড়ল গাড়ির বনেটের ওপরে। তারপর সেখান থেকে বাইকের চাকা লাফিয়ে-লাফিয়ে রাস্তায়। তারপর জিশানের বাইক স্বচ্ছন্দে ছুটে চলল।

একটু ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে বাইক থামল। বাঁ-দিকে অনেকটা ফাঁকা জমি। তার পরেই একটা বিশাল জলা। এদিক-ওদিক তাকালে চোখে পড়ে বেশ কয়েকটা বড়-বড় গাছ।

বিকেলের ঢলে পড়া আলোয় জায়গাটা কী সুন্দর, শান্ত আর নির্জন!

রুকস্যাক থেকে ট্র্যাকার বের করে দেখল জিশান। দুটো লাল ডটই এখন নড়ছে। তার মানে, কিলার প্রাোটন জ্ঞান ফিরে পেয়েছে।

ইস, এই ট্র্যাকারটা যদি না থাকত।

তা হলে জিশান ওই জলার মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে লুকিয়ে থাকত। সুখারাম আর প্রাোটনের চোখে ধুলো দিয়ে রাত কাবার করে দিত।

হঠাৎই ওর মাথায় একটা নতুন চিন্তা খেলে গেল : ওর বাঁ-হাতের যে-জায়গায় শ্রীধর পাট্টার মেডিকরা অপারেশন করে মাইক্রোট্রান্সমিটারটা ঢুকিয়ে দিয়েছে, সে-জায়গার মাংস খুবলে ট্রান্সমিটারটাকে বের করে এখানকার জমিতে কোথাও পুঁতে দিলে হয় না! তা হলে দুই কিলারের ট্র্যাকারে দেখাবে জিশান এখানেই কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছে, অথচ জিশান তখন এখান থেকে অনেক দূরে কোনও নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে।

সুতরাং বাইক থেকে নেমে পড়ল জিশান। রুকস্যাকে ট্র্যাকার রেখে দিয়ে বের করে নিল হান্টিং নাইফ। আর প্যান্টের পকেট থেকে বের করল স্পার্কার। এর বোতাম টিপলেই ছিটকে বেরোবে আগুনের নীল শিখা।

স্পার্কার অন করে হান্টিং নাইফের ইস্পাতের ফলাটা ও গরম করতে শুরু করল। শরীরে ঢোকানোর আগে ছুরির ফলাটাকে স্টেরিলাইজ করে নেওয়া দরকার।

জিশান চারপাশে একবার তাকাল। তারপর বাইকের পাশে রাস্তায় বসে পড়ল। ডানহাতে ছুরিটা বাগিয়ে ধরে বাঁ-হাতটা উঁচিয়ে ধরল চোখের সামনে। অপারেশন করে ট্রান্সমিটার ঢোকানোর জায়গাটা জিশানের স্পষ্ট মনে আছে। এই তো! এই জায়গাটায়! টি-শার্টের কালো চকচকে সিনথেটিক মেটিরিয়ালের ঠিক পিছনেই।

টিভির লাইভ টেলিকাস্টে জিশানকে কি এখন দেখা যাচ্ছে? কেউ কি বুঝতে পেরে গেছে ওর প্ল্যান?

এমন সময় জিশানের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল।

ফোনের আওয়াজে জিশান চমকে উঠল। ওর ছুরি ধরা হাত থমকে গেল। বাঁ-হাত এগিয়ে গেল বাইকে রাখা রুকস্যাকের দিকে।

ফোন বের করে কলটা রিসিভ করতেই চেনা গলা শোনা গেল।

‘বাবু জিশান, কোনও দুষ্টুমি কোরো না।’ খুকখুক হাসি : ‘তা হলে আমাকেও দুষ্টুমি করতে হবে—।’

‘আমি…মানে…।’

‘হ্যাঁ, জানি। তুমি গরম হান্টিং নাইফ দিয়ে বগল চুলকোতে যাচ্ছিলে।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর : ‘আমি ওল্ড সিটিতে ফোর্স পাঠাচ্ছি—তোমার বউ আর ছেলেটাকে নিউ সিটিতে তুলে আনার জন্যে। ওরা হবে আমার সিকিওরিটি ডিপোজিট। তোমার কোনও দুষ্টুমি দেখলেই আমি ওদের নিয়ে অল্পস্বল্প দুষ্টুমি করব…।’

শ্রীধরের ঠান্ডা গলা শুনে জিশানের হাত থেকে হান্টিং নাইফ পড়ে গেল। ওর গলা চিরে একটা যন্ত্রণার চিৎকার বেরিয়ে এল, ‘না! না! আমার ওয়াইফ আর ছেলেকে আপনি টাচ করবেন না। প্লিজ! প্লিজ…!’

ততক্ষণে শ্রীধর ফোনের লাইন কেটে দিয়েছেন।

জিশান কয়েক সেকেন্ড হাঁটুগেড়ে বসে রইল। ওর চোখে জল এসে গেল। শ্রীধর পাট্টা ওর সবচেয়ে দুর্বল জায়গায় ঘা দিয়েছেন। শালা, বাস্টার্ড!

হঠাৎই জিশানের খেয়াল হল, লাইভ টেলিকাস্টে দর্শকরা ওর চোখের জল দেখতে পাচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিল। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিল। চটপটে ভঙ্গিতে হান্টিং নাইফ রুকস্যাকে ঢুকিয়ে বাইকে চড়ে বসল।

বাইক চালাতে-চালাতেই টের পেল, ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে ওর বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ শোনা যাচ্ছে। এইরকম একটা সময়ে মিনি আর শানুর কথা তুলে শ্রীধর পাট্টা সত্যি-সত্যি ওকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন।

ঝকঝকে মসৃণ রাস্তায় বাইকের চাকা পিছলে যাচ্ছিল—লাল ডট দুটোর কাছ থেকে দূরে, আরও দূরে। রাস্তার দুপাশে গাছপালা আর উঁচু-নীচু প্রান্তর। জিশানের ক্লান্ত লাগছিল। শরীরের বেশ কয়েক জায়গায় জ্বালা করছিল। মুখে, হাতে ধুলোর আস্তর—তার সঙ্গে ঘাম। ও বেশ বুঝতে পারছিল, এখন ওর একটু বিশ্রাম দরকার।

হঠাৎই ওর চোখে পড়ল, দূরে রাস্তার ধারে দুটো বাড়ি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুটো বাড়িই দোতলা। একটা হালকা ছাই রঙের, আর তার পাশেরটা আবছা নীল। বাড়ি দুটো তীব্র গতিতে ক্রমশ ওর কাছে এগিয়ে আসছে।

জিশান লক্ষ করল, বাড়ি দুটোর বারান্দা কিংবা জানলায় কোনও উৎসুক মানুষের ভিড় নেই। ব্যাপারটা ওকে একটু অবাক করল। গেম সিটির কোনও মক সিটিজেন কি এ-দুটো বাড়িতে নেই?

জিশানের বাইক বাড়ি দুটোর সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়ির একতলার দুটো দোকানঘর খাঁ-খাঁ করছে। জানলা আর বারান্দাও তাই।

জিশান বাইকটা একটা দোকানঘরে ঢুকিয়ে আড়ালে দাঁড় করাল। রুকস্যাক পিঠে নিল। বাইকের কেরিয়ার থেকে তুলে নিল ট্র্যাকার। তারপর মিসাইল গান হাতে বাগিয়ে ধরে খুব সাবধানে ধীরে-ধীরে পা ফেলে ঢুকে পড়ল একটা বাড়িতে।

বাড়িটার সবক’টা ঘর ঘুরে দেখল। আশ্চর্য! বাড়িতে কেউ নেই!

এই বাড়িটায় কোনও মক সিটিজেন নেই কেন? অপটিক্যাল ট্যাবলেট থেকে বাড়িটার লোকেশন দেখল। গেম সিটির পশ্চিম প্রান্তের দিকে। হয়তো মক সিটিজেনের তুলনায় বাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। তাই পশ্চিমদিকের এই দুটো বাড়ি সুনসান—খাঁখাঁ।

ঠিক তখনই পাশের বাড়ি থেকে টিভির কথাবার্তা শুনতে পেল। দোতলার একটা জানলা দিয়ে উঁকি মেরে পাশের বাড়ির খোলা জানলা দিয়ে একটা ঘরের ভেতরে নজর চালাল জিশান। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।

তখন ও চটপট সিঁড়ি নেমে রওনা হল পাশের বাড়ির দিকে।

নতুন বাড়িটায় ঢুকে এ-ঘর ও-ঘর খোঁজ করে কাউকে না পেয়ে জিশান উঠে গেল দোতলায়। টিভির শব্দ লক্ষ্য করে পৌঁছে গেল একটা ঘরে।

ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেল।

আশি কি নব্বই বছর বয়েসি একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ একটি আরাম-চেয়ারে বসে রঙিন টিভির পরদার দিকে তাকিয়ে আছেন। ফরসা মানুষটার চোখে কোনও চশমা নেই। মাথায় অল্পবিস্তর টাক—বাকিটা শোনপাপড়ির আঁশের মতো লম্বা-লম্বা চুল। গালে আর থুতনিতে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। গায়ের চামড়া গিলে করা। পরনে একটা সাদা কুর্তা আর ছাই রঙের পাজামা।

জিশান ঘরে ঢোকার সময় দরজায় শব্দ হয়েছিল। বৃদ্ধ টিভি থেকে চোখ সরিয়ে জিশানের দিকে তাকালেন। কাঁপা গলায় বললেন, ‘এসো, জিশান…।’

জিশান ঘরের ভেতরে দু-পা ঢুকে জিগ্যেস করল, ‘বাড়িতে আর কেউ নেই?’

‘না, নেই। আমি একা—ভীষণ একা।’ একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলল মানুষটা : ‘তুমি হঠাৎ এলে। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে…।’ একটু চুপ করে থেকে ডানহাতের ইশারায় একটা চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘একটু বোসো ওখানে—।’

কী যে হল জিশানের—বৃদ্ধের অনুরোধ ফেলতে পারল না। হঠাৎ বাবার মুখটা ভেসে উঠল সামনে। ও চেয়ারটায় বসে পড়ল। মিসাইল গানটা পকেটে ঢুকিয়ে নিল।

তারপর অবাক হয়ে বলল, ‘ফাঁকা বাড়িতে আপনি একা-একা বসে টিভি দেখছেন!’

‘দেখছি আর কোথায়! শুনছি—’ করুণ হাসলেন : ‘আমি চোখে দেখতে পাই না। ছানি…ছানি…।’

জিশান বৃদ্ধকে দেখছিল। দুটো চোখের মণিই ঘোলাটে—যেন চোখের মণির ওপরে মাছের আঁশ বসানো। চোখের কোণে পিচুটি। ওপরের ঠোঁট বসে গেছে ভেতরে। বোধহয় ওপরের পাটির সামনের কয়েকটা দাঁত নেই। দুটো ঠোঁটই থরথর করে কাঁপছে। ঠোঁটের একপাশ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে।

লক্ষ করল, ওর চেয়ারের পাশে একটা ছোট টেবিলে অনেক ওষুধপত্র।

জিশান জিগ্যেস করল, ‘আপনার এত বয়েস! চোখে দেখতে পান না! তা সত্বেও গেম সিটিতে মক সিটিজেন হয়ে এসেছেন!’ একটু থেমে তারপর : ‘যদি আপনার কোনও বিপদ-আপদ হয়!’

হাসলেন বৃদ্ধ। কয়েকটা দাঁত দেখা গেল। কয়েকটা নেই। খসখসে কাঁপা গলায় বললেন, ‘আমার তিন কুলে আর কেউ নেই। এই বয়েসে তাই আমার আর কোনও ভয় নেই। তা ছাড়া…তা ছাড়া…আমার ছেলে সংগ্রামজিৎ—আমার বৃদ্ধ বয়েসের ছেলে—এই কিল গেমে হেরে গিয়েছিল। শেষ সংগ্রামটায় আর জিততে পারেনি বেচারা…।’ কিছুক্ষণ মাথা ঝুঁকিয়ে বসে রইলেন। তারপর : ‘কিল গেমের আগে অনেকগুলো গেমের রাউন্ড জিতেছিল সঙ্গু—সঙ্গু ওর ডাকনাম।’

‘আপনি…আপনি কি ওল্ড সিটিতে থাকতেন?’

‘হ্যাঁ—’ ধীরে-ধীরে ওপরে-নীচে মাথা নাড়লেন। কাশলেন দুবার। ঘোলাটে দু-চোখ মেলে জিশানের চোখে তাকালেন : ‘সংগ্রাম হেরে যেতেই ওর মা চোখ বুজল—ধাক্কাটা নিতে পারল না। ফলে সংসারে আমি একা হয়ে গেলাম। সে বহুদিন আগের কথা…।

‘সংগ্রামের পাওয়া প্রাইজ-মানি নেহাত কম ছিল না। তাই একা আমি একটা ডিসিশান নিলাম—নিউ সিটির ইকনমিক ইনডেক্সের পাঁচিল ডিঙিয়ে গেছি বলে ওল্ড সিটি ছেড়ে এখানে চলে এলাম। তারপর থেকে প্রত্যেকটা কিল গেমে আমি মক সিটিজেন হয়ে পার্টিসিপেট করি। একটা নিরিবিলি ফাঁকা বাড়ি দেখে তাতে ঢুকে পড়ি। আর সঙ্গুর কথা ভাবি…’ বৃদ্ধ কথা বলতে-বলতে হাঁপাচ্ছিলেন : ‘আমি…আমি এই…গেম সিটির সিনিয়ারমোস্ট সিটিজেন…।’

জিশান বৃদ্ধের কথা শুনছিল আর মাঝে-মাঝেই টিভির দিকে তাকাচ্ছিল। টিভিতে কমেন্টেটররা জিশানের লোকেশনের কথা বলছিল। আর এও বলছিল যে, দুজন কিলার ক্রমশ জিশানের কো-অর্ডিনেটের দিকে এগিয়ে আসছে।

সুতরাং হাতে আর খুব বেশি সময় নেই।

জিশান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সূক্ষ্ম শব্দ হলেও বৃদ্ধ সেটা টের পেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমাকে…তোমাকে তো আবার…ছুটতে হবে।’

চেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। জিশানের কাছে এগিয়ে আসতে-আসতে বললেন, ‘সঙ্গু খুব চেষ্টা করেছিল…কিন্তু পারেনি। আমার খুব আশা…কেউ না কেউ পারবে। এই বয়েসে মরার ভয় করি না। তাই…আশায়-আশায় আসি…।’

আন্দাজে ভর করে জিশানের গায়ে হাত দিলেন বৃদ্ধ। সেখান থেকে হাতড়ে-হাতড়ে ওর মুখে চলে গেলেন। তারপর ওর চিবুকে আঙুল ছুঁইয়ে কাঁপা গলায় বললেন, ‘সঙ্গু, এবার তোকে জিততেই হবে! মনে থাকে যেন…।’

জিশান বৃদ্ধকে দেখছিল। ভাঁজে-ভাঁজে ঝুলে পড়া চামড়ায় তৈরি এক প্রাগৈতিহাসিক মূর্তি। সেই মূর্তির ছানি পড়া চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।

জিশান আলতো গলায় বলল, ‘চেষ্টা করব…খুব চেষ্টা করব…।’ তারপর পকেট থেকে মিসাইল গান বের করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।

আবার পথ চলা। তবে আশার কথা, সূর্য এখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। একটু পরেই নেমে আসবে অন্ধকার। প্রিয়তম অন্ধকার।

অন্ধকার যখন জিশানকে কালো চাদরে জড়িয়ে নিল তখন জিশান নতুন করে আবার অবাক হল। ওর গায়ের ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর প্যান্টের কালো কাপড়ের ওপরে জ্বলজ্বল রঙিন রেখায় ফুটে উঠেছে নানান হিজিবিজি নকশা। এরকম লুকোনো ফ্লুওরেসেন্ট কালারের কথা জিশান কখনও শোনেনি। এটা শ্রীধর পাট্টার আরও একটা সারপ্রাইজ। অন্ধকারের মধ্যেও জিশানকে তাক করে গোলাগুলি ছুড়তে প্রাোটন বা সুখারামের কোনও অসুবিধে হবে না। আর জিশান শতকরা একশো ভাগ নিশ্চিত যে, প্রাোটন এবং সুখারামের পোশাকে এরকম কোনও হিডন ফ্লুওরেসেন্ট কালারের নকশা নেই।

অন্ধকার নেমে আসার পর আরও একটা ঘটনা ঘটল গেম সিটিতে: গেম সিটির নানান জায়গায় জোরালো আলোর বন্যা বয়ে গেল—রাস্তায়, মাঠে-ঘাটে, নদীর দু-পাড়ে, ফ্লাইওভারে, পাহাড়ে, এমনকী জঙ্গলেও।

তবুও তারই মধ্যে জিশান ছোটখাটো ছায়ার আড়াল খুঁজতে লাগল।

ও জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দেখল, দু-একটা জন্তু-জানোয়ার উদভ্রান্তের মতো ছুটে পালাচ্ছে অন্ধকার অঞ্চলের দিকে।

জিশান একটা ছোট্ট আঁধারি অঞ্চল বেছে নিল। তারপর রুকস্যাক পিঠে ঝোলানো অবস্থায় একটা ঝুপসি গাছ বেয়ে উঠতে শুরু করল।

অনেকটা ওপরে ওঠার পর ও একটা শক্তপোক্ত ‘ওয়াই’-এর মতো ডালের খাঁজ খুঁজে পেল। শরীরটাকে ভাঁজ-টাজ করে মানিয়ে সেই খাঁজে জুত করে বসল। রুকস্যাক থেকে বের করে নিল ট্র্যাকার আর প্লেট টিভি।

জঙ্গলের বুনো গন্ধ জিশানের নাকে ঝাপটা মারছিল। কানে আসছিল পাখির ডাক, অজানা পশুর ডাক। আর সব ছাপিয়ে ঝিঁঝির ডাক।

ট্র্যাকার দেখল জিশান। লাল ডট দুটো সবুজ ডটের কাছ থেকে খুব বেশি দূরে নেই। কিন্তু জিশান কী করবে? এই ক্লান্ত শ্রান্ত শরীরে আর কত দৌড়বে? সাংঘাতিক খিদে না পেলে ও কখনও ফুড পয়েন্টের খোঁজে যায়নি। একটু আগেই ও ফুড পয়েন্ট থেকে খেয়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে পেট ভরে জল খেয়েছে। ঘাড়ে মাথায় ভালো করে জল দিয়েছে। আশায়-আশায় বারবার ভেবেছে, রাত পোহালেই লড়াই শেষ। তখন ওর, মিনির আর শানুর জীবনে সত্যিকারের ভোর আসবে।

কিন্তু এই গাছে ও কতক্ষণ লুকিয়ে থাকবে? লাল ডটগুলো আরও কাছে এগিয়ে এলে ও তখন বরং গাছ পালটে নেবে। কিংবা ভেবে-টেবে যা হোক কিছু করবে।

ট্র্যাকার রেখে প্লেট টিভি অন করল জিশান। ভলিয়ুম খুব কমিয়ে দিল। দেখল, টিভিতে ও আর সংগ্রামজিতের বৃদ্ধ বাবা। তার সঙ্গে ধারাভাষ্য চলছে। আর মাঝে-মাঝে জাম্প কাট করে ঢুকে পড়ছে সংগ্রামজিতের কিল গেমের ক্লিপিংস।

একটু পরেই বৃদ্ধের মুখের ক্লোজ আপ দেখা গেল। জিশানের মনে হল, বৃদ্ধ যেন ঘোলাটে চোখ মেলে সরাসরি ওর দিকেই তাকিয়ে আছেন।

টিভি অফ করে নিজের দিকে তাকাল জিশান।

ও লুকোবে কী! ওর সারা গায়ে রঙিন আলোর নকশা জ্বলজ্বল করছে। এরকম ‘ব্রাইট টারগেট’ একজন কালার ব্লাইন্ড শুটারও মিস করবে না। আর সুখারাম এবং প্রাোটন তো সুপারকিলার!

হঠাৎ জিশানের মনে হল টি-শার্টটা খুলে ফেললে কেমন হয়! তা হলে অন্তত রঙের রোশনাইয়ের হাত থেকে বাঁচা যাবে। তারপর প্যান্টের পালা।

টি-শার্টের বুকপকেট থেকে মিনি আর শানুর ফটোটা বের করে নিল। অন্ধকারে ওদের মুখ দেখা যাচ্ছিল না। তাই একটা লম্বা শ্বাস ফেলে প্যান্টের কোমরের পটি টেনে ঢিলে করে জাঙিয়ার ইলাস্টিকের পিছনে ফটোটা চালান করে দিল। এটাই এখন সবচেয়ে সেফ জায়গা।

তারপর রুকস্যাক থেকে হান্টিং নাইফ বের করে টি-শার্টের চার-পাঁচ জায়গায় লম্বা করে ছুরি টেনে দিল। হাতের কয়েক টানে টি-শার্টের খোসা চটপট ছাড়িয়ে ফেলল। কাপড়ের ছেঁড়া টুকরোগুলো ছুড়ে দিল অন্ধকারের দিকে।

কিন্তু একইসঙ্গে জিশান চমকে উঠল।

ফুল স্লিভ টি-শার্টের নীচে ওর আর কোনও পোশাক ছিল না। ও অবাক হয়ে দেখল, ওর গায়ে ঠিক জামাটার মতোই ফ্লুওরেসেন্ট রঙের জ্বলজ্বলে ডিজাইন আঁকা। টি-শার্টটা ও না ছিঁড়ে ফেললেই পারত। কিন্তু এই নকশা ওর গায়ে কে, কখন আঁকল? কেউ তো আঁকেনি!

শ্রীধর পাট্টা বোধহয় জিশানের দিকে লক্ষ রাখছিলেন, মজা দেখছিলেন। কারণ, তখনই জিশানের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল।

ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে নিষ্ঠুরতার হিংস্র কারিগর বলে উঠলেন : ‘সারপ্রাইজ, জিশান—আবার সারপ্রাইজ…।’

জিশান চুপ করে রইল। ওর অবাক ভাবটা তখনও কাটেনি।

‘শোনো, জিশান / এই রঙের ফান। এই রঙে আঁকা ড্রেস এক ঘণ্টা গায়ে দিয়ে থাকলেই তোমার বডি টেম্পারেচারে রঙের কেমিক্যালটা অদ্ভুত এক রিয়্যাকশন ইনিশিয়েট করে তোমার ড্রেসের ফ্যাব্রিক চুঁইয়ে তোমার গায়ে চলে যাবে। তোমার পোশাকের নকশার ফোটোকপি এঁকে দেবে তোমার চামড়ায়।’ হাসলেন : ‘এক্সট্রিমলি সুপার-সারপ্রাইজিং টেকনোলজি—তাই না?’

জিশান চুপচাপ ভাবছিল। তাই শ্রীধরের কথাবার্তার সময় একটুকরো জবাবও দিচ্ছিল না। এখন ওর সামনে আর কী-কী পথ খোলা রয়েছে সেটাই চিন্তা করছিল। আধো-আঁধারিতে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে রঙিন উলকি আঁকা আদিবাসী বলে মনে হচ্ছিল।

‘থ্যাংক—ইউ—মার্শাল।’ কাটা-কাটা সুরে বলল জিশান এবং ফোন রিসেট করে দিল।

জিশান বুঝতে পেরেছিল, খানিকক্ষণ পরপরই ওকে লুকোনোর জায়গা পালটাতে হবে। তবে ও জঙ্গলের মধ্যেই থাকতে চায়—খোলা জায়গায় যেতে চায় না। কারণ, খোলা জায়গায় গেলে ওর একটা বাহন দরকার—গাড়ি কিংবা মোটরবাইক। সেটা কীভাবে খুঁজে পাবে ও জানে না। গেম সিটিতে এখন কোথাও আলো, কোথাও অন্ধকার।

গাছ থেকে নেমে পড়ল জিশান। জঙ্গলের মধ্যে এখানে-ওখানে ছুটোছুটি করে আস্তানা পালটাতে লাগল। কখনও গাছের ওপরে, কখনও ঝোপঝাড়ের আড়ালে, কখনও বা এবড়োখেবড়ো পাথর কিংবা ঢিবির খাঁজে।

উড়ন্ত জোনাকির আলো ওর চোখে পড়ছিল। চোখে পড়ছিল জোড়া-জোড়া জ্বলন্ত সবুজ চোখ।

নানান জায়গায় আলো জ্বলে ওঠায় জঙ্গলটা ভারী অদ্ভুত লাগছিল। দুটো লাইটেড জোনের মাঝামাঝি জায়গাটা অনেক বেশি গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা বলে মনে হচ্ছিল।

জিশানের কবজিতে বাঁধা কাউন্টডাউন ওয়াচে সময় ক্রমেই জিরো আওয়ারের দিকে এগোচ্ছিল—সেটাই জিশানের একমাত্র আশা-ভরসা-আনন্দ। তবে ও বুঝতে পারছিল, এভাবে পালিয়ে-পালিয়ে লাল ডটজোড়ার হাত থেকে ও বেশিক্ষণ বাঁচতে পারবে না। কিছু একটা ওকে করতে হবে—এবং সেই ‘করা’টা শ্রীধর পাট্টার পছন্দ হোক বা না হোক।

জঙ্গলের মধ্যে ছুটে-ছুটে নতুন একটা আস্তানা খুঁজে পেল। একটা বেঁটে মোটা গাছ। সার্চলাইটের আলো ছিটকে পড়েছে তার গুঁড়িতে, পাতায়। গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল। শরীরে আর কতটুকু শক্তি বাকি আছে কে জানে!

রুকস্যাক থেকে হান্টিং নাইফ বের করে নিল। পকেট থেকে স্পার্কার বের করে হান্টিং নাইফের ফলাটা গরম করতে শুরু করল। হ্যাঁ, মাইক্রোট্রান্সমিটারটা এবার শরীর থেকে ও বের করবেই। লাল ডটজোড়ার সঙ্গে সবুজ ডটটা আর লুকোচুরি খেলতে পারছে না।

জিশানের চোয়াল শক্ত হল। যন্ত্রণা সহ্য করার জন্য তৈরি হল।

বাঁ-হাতের বিশেষ জায়গাটার দিকে তাকাল। ওর শরীরটা হাঁটুর পর থেকে নীচের দিকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আলোয় আলো। ওপরদিকটা অন্ধকারে ঢাকা—তবে সে-অন্ধকার আলোর ছটায় কিছুটা ফিকে।

বিশেষ জায়গাটা অনুমান করতে জিশানের খুব একটা অসুবিধে হল না। কিন্তু হান্টিং নাইফের ফলা সেখানে বসাতে না বসাতেই ওর ফোন বাজতে শুরু করল।

শ্রীধর পাট্টার ফোন নিশ্চয়ই।

জিশান গাছের আড়ালে রাখা রুকস্যাকের দিকে তাকাল। কিন্ত স্যাটেলাইট ফোনটা বের করার জন্য একটুও ব্যস্ত হল না। বরং ওর ডানহাত কসাইয়ের কাজ করে চলল।

ও:! আ:! মিনি! শানু!

মিনি আর শানুর কথা ভেবে জিশান যন্ত্রণাটাকে মনে-মনে কমাতে চেষ্টা করল। একইসঙ্গে মাইক্রোট্রান্সমিটারের খোঁজে বাঁ-হাতের মাংস খুঁড়তে লাগল।

একটু পরেই ছুরির খোঁচায় চটচটে আঠালো লাল রঙের তরল মাখা ট্রান্সমিটারটা বেরিয়ে খসে পড়ল মাটিতে। হাতড়ে-হাতড়ে সেটাকে তুলে নিল জিশান। ওটাকে গাছের গুঁড়ির গায়ে চেপে ধরে হান্টিং নাইফের ধারালো ফলার পোচে দু-টুকরো করে দিল।

এখন ওই খুদে যন্ত্রটা কাউকে আর কোনওরকম সিগন্যাল পাঠাতে পারবে না। সুখারাম আর প্রাোটনের ট্র্যাকার থেকে সবুজ ডটটা নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে নিভে গেছে।

আ—আ—:!

যন্ত্রণার মধ্যেও জিশানের বুকে ঠেলে একটা স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ও রুকস্যাক খুলে একটা ‘ফার্স্ট এইড’ প্যাক বের করে নিল। প্যাকের বোতাম খুলে চটপট বের করে নিল একটা কেমিক্যালের গুঁড়ো—’ব্লাড কোয়াগুলেটর’। সেটা একখাবলা তুলে নিয়ে চেপে ধরল বাঁ-হাতের ক্ষতস্থানে। সঙ্গে-সঙ্গে টের পেল, যন্ত্রণা কমতে শুরু করেছে। একটু পরে রক্ত পড়াও বন্ধ হয়ে যাবে।

রুকস্যাকের ভেতরে স্যাটেলাইট ফোন তখনও একঘেয়েভাবে বেজে যাচ্ছিল। শ্রীধর পাট্টা সহজে ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র নন।

জিশান যখন ফোন ধরল ততক্ষণে প্রায় দশমিনিট কেটে গেছে। এবং ফোন ধরামাত্রই শোনা গেল শ্রীধর পাট্টার হিংস্র হুঙ্কার।

‘জিশান, য়ু বাস্টার্ড! সন অফ আ বিচ! হাউ ডেয়ার য়ু…!’

জিশান উত্তরে শব্দ করে হাসল : ‘এ ছাড়া আমার আর কোনও পথ নেই রে, শুয়োরের বাচ্চা!’

‘তুই তোর বউ আর ছেলের কথা কি ভুলে গেছিস?’ একটা খিদে পাওয়া বাঘ যেন গর্জন করে প্রশ্নটা করল।

‘না, ভুলিনি—।’

‘ঠিক আছে। তুই যেভাবে খেলতে চাস সেভাবেই খেলব। আমি তোর বউ আর ছেলেকে ওল্ড সিটি থেকে এখুনি তুলে নিয়ে আসছি। তারপর দেখি…তোর পাগলামো বন্ধ করা যায় কি না!’

শ্রীধর হয়তো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু জিশান ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে।

ও রুকস্যাক গুছিয়ে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে আবার পথ চলতে শুরু করল। অন্ধকার এলাকা ছুঁয়ে-ছুঁয়ে ও একেঁবেঁকে ছুটতে লাগল। এখন ওর ‘হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। কারণ, খুনিদের ট্র্যাকারে আর কোনও সবুজ ডট নেই। আর টিভির কমেন্টেটররা কখনও ওর পজিশন কো-অর্ডিনেট কমেন্ট্রিতে বলবে না। সেটাই নিয়ম। তবুও শ্রীধর যদি ওদের নিয়ম ভাঙতে বলেন, তা হলে আর-এক মুশকিল। কারণ, লক্ষ-হাজার ক্যামেরার নম্বর আর লোকেশন চেক করে, সেখান থেকে জিশানের পজিশন কো-অর্ডিনেট ব্লক কম্পিউট করে, রানিং কমেন্ট্রিতে বলতে-বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে যাবে—ততক্ষণে জিশান হয়তো অন্য কোথাও ছিটকে যাবে। তা ছাড়া কমেন্টেটররা এত টেকনিক্যাল কারিকুরিতে অভ্যস্ত নয়। ফলে ওরা খুনিদের সাহায্য করার বদলে বিভ্রান্ত করবে, এই সম্ভাবনাটাই বেশি।

সুতরাং, হাতে বেশ যন্ত্রণা হলেও জিশানের নিজেকে এখন ‘স্বাধীন’ মনে হচ্ছিল।

একটা ঘন গাছগাছালির অন্ধকারে আস্তানা গেড়ে প্রথমে ট্র্যাকার খুলল জিশান। শুধুমাত্র দুটো লাল ডট ট্র্যাকারের মানচিত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবে ওরা যে ঠিক কোথায় সেটা বোঝা গেল না। আর সবুজ ডট থেকে ওদের দূরত্বই বা কত কে জানে!

এই অসুবিধেটার কথা জিশান ভাবেনি।

একটু পরেই টিভি খুলল।

‘…স্টানিং নিউজ, ফোকস। কিলারদের ট্র্যাকার থেকে জিশান পালচৌধুরী হারিয়ে গেছে। ওই দেখুন—প্রাোটনের ট্র্যাকার! স্ক্রিনে কোনও গ্রিন ডট নেই! এবার দেখুন কিলার সুখারামের ট্র্যাকার—নো গ্রিন ডট। তা হলে তো কিলার দুজন এখন অন্ধ! ওরা জিশানকে কী করে ট্র্যাক করবে কে জানে!

‘নিশ্চয়ই জিশান মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটারটা কোনও না কোনওভাবে অকেজো করে দিয়েছে। তখন জিশান নিশ্চয়ই আমাদের ক্যামেরা নেটওয়ার্কের ”ব্লাইন্ড স্পট”-এ ছিল। তাই টিভিতে ব্যাপারটা আপনাদের আমরা দেখাতে পারিনি। তবে আমাদের মাননীয় মার্শালের কন্ট্রোল রুমে অনেক হাই পাওয়ার ক্যামেরা নেটওয়ার্কের কানেকশান রয়েছে। ফলে জিশানের কীর্তি মাননীয় মার্শালের চোখ এড়ানোর কথা নয়। মার্শালের কন্ট্রোল রুম থেকে ফিডব্যাক পেলেই আমরা সেই পোরশানের—মানে, যে-পোরশানটা আমরা দেখাতে পারিনি—সেটার ভিডিয়ো ফুটেজ আপনাদের দেখিয়ে দেব। জানিয়ে দেব, জিশান কীভাবে কিলারদের ট্র্যাকারকে ফাঁকি দিয়েছে…।’

একটু পরেই জিশান সেই ফুটেজ দেখতে পেল। এবং আরও দেখতে পেল, অগ্নিশর্মা শ্রীধর পাট্টা হিংস্রভাবে পিস ফোর্সের কমান্ডারদের নির্দেশ দিচ্ছেন। বলছেন, এই মুহূর্তে ওল্ড সিটিতে ফৌজ পাঠাতে। সেই ফৌজ জিশানের বউ আর ছেলেকে অ্যারেস্ট করে শুটারে উড়িয়ে দশ মিনিটের মধ্যে নিউ সিটিতে নিয়ে আসবে—শ্রীধর পাট্টার কাছে।

টিভিতে শ্রীধরের পাগল করা চিৎকার শোনা গেল : ‘গো! গো! গো!…গো-ও-ও-ও!’

তারপরই পরদায় ভেসে উঠল ওল্ড সিটির ছবি। ভাঙাচোরা নোংরা পথঘাটের নানান জায়গায় মানুষের ভিড় আর জটলা। সবাই প্লেট টিভিতে কিল গেম দেখছে। এত রাতেও ওল্ড সিটির সব দোকানপাট খোলা—বিশেষ করে খাবারের দোকান। ফুটপাথের এখানে-সেখানে তেলেভাজা, ঝালমুড়ি, শোনপাপড়ি, মালাই বরফ নিয়ে বসে আছে বহু হকার। মাঝে-মাঝেই শোনা যাচ্ছে জনতার উত্তেজনা আর উল্লাসের চিৎকার।

দৃশ্য বদলে গেল।

রাতের আকাশে ছিটকে লাফিয়ে উঠল আটটা শুটার। দুরন্ত গতিতে শুটারবাহিনী ছুট লাগাল ওল্ড সিটির আকাশের দিকে।

জিশানের মাথায় আগুন জ্বলে গেল। রক্তের অণুতে-অণুতে ঘটে গেল আণবিক বিস্ফোরণ।

ও এরপর যা করল শ্রীধর পাট্টা সেটা ভাবতে পেরেছিলেন কি না কে জানে!

রুকস্যাকে সব গুছিয়ে নিল—হাতে রইল শুধু প্লেট টিভি। তারপর ও ছুট লাগাল।

আলো আর অন্ধকার দাবার ছকের মতো চারপাশে ছড়িয়ে আছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটা পছন্দসই জায়গা খুঁজতে লাগল জিশান। এমন একটা জায়গা যেখানে আলো কটকট করছে—আলোয়-আলোয় জায়গাটা প্রায় দিনের মতো।

দু-তিন মিনিটের মধ্যেই সেরকম একটা জায়গা খুঁজে পেল। তখন লাইটেড জোনের কেন্দ্রবিন্দুতে গিয়ে দাঁড়াল। কারণ, ও জানে, এখানে অনেক ক্যামেরা লাগানো আছে। টিভির লাইভ টেলিকাস্ট কোটি-কোটি দর্শক স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

সুতরাং এইবার!

জিশানের খালি গা। আলোর তেজে শরীরের ফ্লুওরেসেন্ট রঙের ডিজাইন বেশ ফিকে দেখাচ্ছে। ওর বুকে, হাতে, এখানে-সেখানে রক্তের দাগ। গায়ে ঘামের পরত। তাতে শুকনো পাতার টুকরো-টাকরা লেগে আছে। আর বাঁ-হাতের বাহু গড়িয়ে রক্তের ধারা নামছে।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে গাছের গায়ে লাগানো বেশ কয়েকটা ক্যামেরা নজরে পড়ল। সুতরাং…।

এইটাই ঠিক জায়গা, এইটাই ঠিক সময়।

প্লেট টিভিটা একটা গাছের গুঁড়িতে ঠেস দিয়ে রেখে শূন্যে দু-হাত ছুড়ে দিল জিশান। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে কথা বলতে শুরু করল।

‘আমার ওল্ড সিটি আর আর নিউ সিটির ভাই-বোনেরা! কিল গেমের খেলার নিয়মে কোথাও লেখা নেই যে, হাতের মাংস কেটে মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার খুলে ফেলে দেওয়া যাবে না! নিয়মে এ-কথা বলা নেই যে, কিল গেমে কোনও পার্টিসিপ্যান্ট যদি এই ট্রান্সমিটার খুলে ফেলে খুনিদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করে তা হলে নিউ সিটির মার্শাল শ্রীধর পাট্টা সেই খেলোয়াড়ের বউ আর ছোট্ট ছেলেকে ওল্ড সিটি থেকে জোর করে তুলে নিয়ে আসবেন। তারপর তাদের টরচার করার ভয় দেখিয়ে কিল গেমের সেই প্লেয়ারকে ব্ল্যাকমেল করে খতম করার চেষ্টা করবেন।

‘আমার নিউ সিটি আর ওল্ড সিটির বন্ধুরা, আমিই সেই হতভাগ্য প্লেয়ার। ওই দেখুন, আটটা শুটার রওনা হয়ে যাচ্ছে ওল্ড সিটির দিকে—আমার বউ মিনি, আর ছোট্ট ছেলে শানুকে তুলে নিয়ে আসার জন্যে।

‘এতদিন ধরে টিভিতে, রোলার সাইন আর মুভি-বোর্ডে, মার্শাল প্রচার করে এসেছেন যে, কিল গেম ভীষণ ফেয়ার গেম। এই সেই ফেয়ারনেসের নমুনা! এই ফেয়ারনেসের মুখে আমি পেচ্ছাপ করে দিই!’

টিভি সেন্টার তখন দারুণ তৎপরতায় আটটা শুটারকে দেখিয়ে চলেছে। যেন আটটা হানাদার বাজপাখি। শুটারগুলো ওল্ড সিটির আকাশে পৌঁছে গেছে। ওরা একসঙ্গে শিস দিয়ে ধেয়ে চলেছে নীচের দিকে। ওরা নামছে।

সেই ছবিতে জাম্প কাট করে ঢুকে পড়ছে জিশানের চলচ্চিত্র এবং মার্শালের মুখ—শক্ত চোয়াল, কপালে ভাঁজ। আর তার ফাঁকে-ফাঁকে মিনি আর শানুর সুন্দর মিষ্টি ছবি।

‘আমার ওল্ড সিটির বন্ধুরা, আমার নিউ সিটির ভাই-বোনেরা! আপনারা আমাকে ন্যায়বিচার দিন। অবিচারের এগেইনস্টে আপনারা রুখে দাঁড়ান! আপনাদের ঘরেও তো মা, বাবা, বোন, ভাই, ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে রয়েছে। আপনারা এই নোংরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান! আপনাদের কাছে আমি…আমি…আমার বউ আর ছেলের প্রাণভিক্ষা চাইছি। ওদেরকে বাঁচান! আমাকে…আমাকে…সৎভাবে লড়তে দিন! প্লিজ! ওদের বাঁচান! আর কিছু আমি চাই না…কিচ্ছু চাই না…।’

কথা বলতে-বলতে জিশান প্যান্টের কোমরের আড়াল থেকে মিনি আর শানুর ফটোটা শূন্যে তুলে ধরল। কান্না ভাঙা গলায় চিৎকার করে বলল, ‘ওদের আপনারা বাঁচতে দিন! সৎ আর সুন্দরভাবে বাঁচতে দিন! পৃথিবী এখনও আমাদের সবার কাছে সুন্দর। প্লিজ, ওদের…ওদের বাঁচতে দিন…!

জিশান কান্না চাপতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না। মিনি আর শানু যে ওর সবচেয়ে বড় দুর্বল জায়গা!

কিন্তু একইসঙ্গে ও চোয়াল শক্ত করে রেখেছিল। চোয়ালের রেখা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, কিল গেমে ও মোটেই হারতে চায় না।

জিশানের মরিয়া আবেদন লক্ষ-লক্ষ টিভি দর্শকের কাছে পৌঁছে গেল। গেল শুধু নয়, তাদের অনেকেরই বুকে গিয়ে বিঁধল। তারা ওল্ড সিটির মানুষ। তারা নিউ সিটির মানুষ।

নিউ সিটিতে যে-ঘটনা ঘটল সেটা এককথায় অভিনব। যেসব মানুষ ভাবত তাদের মধ্যে আবেগ ব্যাপারটা দিব্যি বেঁচেবর্তে রয়েছে, হঠাৎই তারা আবেগের একটা ঢেউ টের পেল। সেই ঢেউটা যেমন বিশাল, তেমনই শক্তিশালী।

আর যেসব মানুষ ভাবত তাদের মধ্যে আবেগ-টাবেগ খুব একটা বেশি-টেশি নেই-টেই…নিউ সিটিতে থাকতে-থাকতে সেই ব্যাপারটা বলতে গেলে শুকিয়ে-টুকিয়ে গেছে, তারাও হঠাৎ টের পেল তাদের শরীরে, মনে কিংবা মাথায় একটা হিমশীতল পোকা কী এক অলৌকিক ম্যাজিকে আচমকা যেন নড়ে উঠল।

নিউ সিটির মানুষদের অনেকেই ফোন তুলে নিয়ে তাদের চেনা বৃত্তের মানুষজনকে ফোন করতে শুরু করল। কিল গেম খেলায় এই অবিচার কিংবা ব্যভিচার তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। শ্রীধর পাট্টা যতই ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্ট আর পিস ফোর্সের মার্শাল হোন না কেন এই অন্যায় তিনি করতে পারেন না।

নিউ সিটির মানুষদের মধ্যে শুধু কথার দেওয়া-নেওয়া চলতে লাগল। অন্ধকার রাতের সাইবারস্পেসে মানুষের ক্ষোভ আর অসন্তোষের ঝাঁজ ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আর তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুপারগেমস কর্পোরেশনের কন্ট্রোল রুমের হেলপলাইনে ফোনের সুনামি ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার পাশাপাশি ই-মেল আর ভিডিয়ো কলের বন্যা। আগের বারের তুলনায় এবারের ক্ষোভ-বিক্ষোভ বোধহয় কম করেও একশো গুণ বেশি।

সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এ শ্রীধর পাট্টা রাগে দাউদাউ করে জ্বলছিলেন। দুটো আর্ক কম্পিউটার মাথায় ওপরে তুলে সপাটে আছড়ে মারলেন মার্বেল মোড়া মেঝেতে। ওঁর শরীর রাগে থরথর করে কাঁপছিল।

নিউ সিটির সব হতচ্ছাড়া মানুষগুলো হঠাৎই যেন যক্ষ্মা-পাগল হয়ে গেছে। ওদের টেলিফোন, ই-মেল আর ভিডিয়ো কলের ভাষা এতটাই নোংরা হয়ে গেছে যে, শ্রীধরের মাথার শিরা দপদপ করছিল—সেইসঙ্গে বুকে আর মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। এই বুঝি হার্টফেল হয়ে যাবে!

আকাশ থেকে নিউ সিটির দিকে তাকালে তখন একটা অদ্ভুত দৃশ্য শ্রীধর দেখতে পেতেন। রাতের রাস্তায় ক্রমশ গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। ওপর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, অসংখ্য নেংটি ইঁদুর মুখে মিনি টর্চ কামড়ে ধরে ছুটে চলেছে।

কিন্তু ওরা ছুটে চলেছে কোনদিকে?

কিছু গাড়ি ছুটে যাচ্ছে গেম সিটির দিকে, কিছু গাড়ি ছুটে চলেছে সুপারগেমস কর্পোরেশনের বিল্ডিং-এর দিকে, আর বাকি গাড়ির ঝাঁক ছুটে যাচ্ছে সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর দিকে।

নিউ সিটির বেশ কয়েকটা রাস্তায় গাড়ির ঢলের এই অস্বাভাবিক দৃশ্য পিস ফোর্সের নাইটগার্ডদের নজর এড়ায়নি। তারা খবরটা ফোন করে হেডকোয়ার্টারে জানিয়ে দিচ্ছিল। সেখান থেকে খবর পৌঁছে যাচ্ছিল ওপরের স্তরে, তারপর আরও ওপরের স্তরে, এবং আরও ওপরে…।

শেষ পর্যন্ত সর্ব্বোচ্চ স্তরে—অর্থাৎ, শ্রীধর পাট্টার কানে—খবরটা পৌঁছে গেল। কানে শুধু নয়—চোখেও পৌঁছল। কারণ, ওঁর ঘরের তিনটে টিভিতে তখন এই বিচিত্র ‘কার র‌্যালি’-র ফুটেজ দেখানো হচ্ছিল।

ব্যাপারটা কী? একটা মানুষের আবেদনে এত মানুষের চঞ্চল হয়ে ওঠার ঘটনা নিউ সিটির ইতিহাসে কখনও ঘটেনি।

এটাকে কি ‘বিপ্লব’ বলা যেতে পারে? কীভাবে কন্ট্রোল করা যায় এই চঞ্চলতা?

ওল্ড সিটিতে সেই সময়ে যা ঘটছিল, ওল্ড সিটির ইতিহাসে কখনও সেরকম ঘটেনি।

ওল্ড সিটির হাজার-হাজার মানুষ পাগলের মতো চিৎকার করছে, ‘শ্রীধর পাট্টা, মুর্দাবাদ! জিশান, জিশান, জিন্দাবাদ! শ্রীধর পাট্টা, মুর্দাবাদ!…।’ আর অন্ধকার খানাখন্দে ভরা রাস্তা ধরে তারা হইহই করে ছুটে চলেছে জিশানের বস্তির দিকে। তাদের কারও-কারও হাতে জ্বলন্ত মশাল। মাঝে-মাঝে তাদের কেউ-কেউ আকাশের দিকে চোখ তুলে শুটারবাহিনীর দিকে দেখছে। দেখছে ওদের লেজ থেকে বেরোনো আগুনের হলকা। শুনছে ওদের তীক্ষ্ণ শিস।

জিশানের বস্তির এলাকা তখন ছায়া-ছায়া কালো-কালো মানুষে-মানুষে ছয়লাপ। তাদের সমবেত স্বরে জিশানের জয়ধ্বনি, আর শ্রীধরের নৃশংসতার প্রতিবাদ।

‘শ্রীধর পাট্টা, নিপাত যাক!’

‘আমার ভাই, তোমার ভাই / জিশানকে ফেরত চাই!’

‘নিউ সিটি, মুর্দাবাদ!’

‘ওল্ড সিটি, জিন্দাবাদ!’

‘কিল গেম / শেম-শেম!’

‘কিল গেম, নিপাত যাক! শ্রীধর পাট্টা নিপাত যাক!’

ফেটে পড়া আওয়াজে স্লোগান চলতেই লাগল। রাতের ওল্ড সিটি জনতার রাগী চিৎকারে ফেটে চৌচির হয়ে যেতে লাগল।

শুটারগুলো যখন জিশানের বস্তির কাছাকাছি ল্যান্ড করতে চাইল, তখন ওরা কোনও জায়গা খুঁজে পেল না। রাস্তার ওপরে শুধু মানুষের মাথা আর মানুষের মাথা! আর তারই মাঝে-মাঝে মশালের আলোর এলোমেলো যতিচিহ্ন।

শিস দিয়ে কিছুক্ষণ ওড়াউড়ি করল ওরা। স্যাটেলাইট ফোনে ঘন-ঘন খবর পাঠাতে লাগল ওপরওয়ালাকে।

‘এখন কী করব, স্যার?’

‘শুট ডাউন দ্য ব্লাডি ক্রাউড, য়ু মোরন! শুট রাইট নাও! ওদের ছড়িয়ে ছিটকে ছত্রখান করে দাও! চুরচুর করে দাও! যেভাবে হোক জিশানের ওয়াইফ আর সানকে আমাদের চাই-ই চাই! আমাদের মার্শালের স্পেশাল অর্ডার। গো অ্যাহেড…রাইট নাও!’

একটা শুটারের একজন গার্ড জনতার দম আটকানো ভিড় লক্ষ্য করে ওর অটো-পিস্তল ফায়ার করল।

কয়েক ঝলক আলো। কয়েকটা ‘ফট-ফট’ শব্দ।

জনতার ভিড়ে কারও গায়ে গুলি লাগল কিনা না বোঝা গেল না। তবে দশ-বিশজন মানুষ চিৎকার করে ভয়ে ছুটে পালাল। বাকি কয়েক হাজার মানুষ কিন্তু নড়ল না। দু-চারজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘শুয়োরের বাচ্চাদের কাছে কত গুলি আছে? একশো? দু-শো? আর আমরা হাজার-হাজার। মিনি আর শানুকে আমরা কিছুতেই ছাড়ব না!’

‘ছাড়ব না, ছাড়ব না!’ জনসমুদ্রগর্জনে সেই কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

আর একইসঙ্গে জনতার ঝাঁক থেকে বেশ কয়েক ডজন গুলি ছুটে গেল শুটারবাহিনী তাক করে। দুজন গার্ডের হাতে আর কোমরে গুলি লাগল। বাকি গুলিগুলো ছিটকে গেল আকাশে। আর কয়েকটা শুটারের মেটাল বডিতে ধাক্কা খেয়ে ‘ঠং’ শব্দ তুলে দিগভ্রান্তের মতো ঠিকরে গেল।

বেশ বোঝা গেল, ওল্ড সিটির জনগণ মোটেই নিরস্ত্র নয়।

এটা ঠিকই যে, ওল্ড সিটির রিভলভারের মডেলগুলো বেশ পুরোনো, কিন্তু তা থেকে এখনও ঠিকঠাক গুলি বেরোয়, আর সে-গুলি কারও গায়ে লাগলে সে আহত কিংবা নিহত হতে পারে।

সুতরাং, আটটা শুটার মুখ ঘোরাল। উড়ে গেল জিশানের বস্তি থেকে অনেকটা দূরে। ওরা হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে উত্তেজিতভাবে ফোনে কথা বলেই যাচ্ছিল।

মিনি বাড়ির কাছেই একটা সরু গলিতে দাঁড়িয়ে প্লেট টিভিতে জিশানের কিল গেম দেখছিল। মরণ খেলাটা শেষ হতে আর দু-ঘণ্টা মতন বাকি। একটু পরেই হয়তো ভোরের আলোর আভা ফুটে উঠবে। তাই বারবার মুখ তুলে আকাশের দিকে দেখছিল ও।

ও: ভগবান! আর একটু! আর একটু!

অর্কনিশান বাড়িতে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বস্তিরই একটি কিশোরী মেয়ে ওকে পাহারা দিচ্ছে। মেয়েটি জানে যে, মিনিবউদির আজ সারারাত টিভি দেখা দরকার। তাই ও মিনির হয়ে প্রক্সি দিচ্ছে।

হঠাৎই জনতার গর্জনের বিস্ফোরণে বস্তির সবাই চমকে উঠল। মিনিও।

ও এতক্ষণ ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল, কাঁপছিল। শুটারের শিসের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে ছিল। কিন্তু সেই শব্দটা শুনতে-না-শুনতেই ভেসে এল ক্ষিপ্ত জনতার ভয়ংকর গর্জন।

তারপর খুব দ্রুত কীসব যে ঘটে গেল!

ফিসফাস। কানাকানি। কথা চালাচালি।

তারপরই মিনিকে আর শানুকে পিস ফোর্সের হাত থেকে বাঁচাতে অসংখ্য জেহাদি নারী-পুরুষ মিনির ঘর আর মিনিকে ঘিরে বস্তির সব অলিগলিতে ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওরা যে যেমন পেরেছে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। ওদের ঠোঁটে উত্তেজনা আর প্রতিরোধের জিগির। দূর থেকে কানে আসা জনতার গর্জনের সঙ্গে ওদের গর্জন মিলে গেল। যেন দু-দুটো সমুদ্রের দুরন্ত ঢেউ হাতে হাত মিলিয়ে কোলাকুলি করল। ওদের স্লোগান শুনতে-শুনতে মিনির চোখে জল এসে গেল।

জিশানকে এত মানুষ ভালোবাসে!

ওরা বলছে, ‘জান দেব, তবু জিশানকে দেব না! জিশান জিন্দাবাদ! জিশান আমাদের ছিল, আমাদের থাকবে!…।’

ওল্ড সিটির বড়-বড় রাস্তাগুলোয় তখন এক অভাবনীয় দৃশ্য : কাতারে-কাতারে মানুষ ছুটে চলেছে মাস্টার ব্রিজের দিকে—যে-ব্রিজ নিউ সিটি আর ওল্ড সিটিকে আলাদা করে রেখেছে। জিশান-পাগল মানুষের দল এখন আর পিস ফোর্সের গার্ডদের গুলির পরোয়া করে না। ওরা পরিখার পরোয়া করে না। পরোয়া করে না পিরানহা মাছ কিংবা বিষধর সাপের। ওরা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে যে, আজ ওরা মাস্টার ব্রিজের প্রতিরোধ ভাঙবেই।

আজ ওরা জনসমুদ্রের জোয়ারে রাতের নিউ সিটি ভাসিয়ে দেবে। দেবেই।

নিউ সিটি আর ওল্ড সিটিতে দু-রকমের দুটো আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটে গেল। বেরিয়ে এল দু-রকমের দুটো লাভাস্রোত।

কিন্তু সেই লাভাস্রোত দুটো ধীরে-ধীরে মিশে যাচ্ছিল পরস্পরের সঙ্গে।

একটু পরেই দুটো স্রোতকে আর আলাদা করে চেনা গেল না।

জিশানের পাগল-পাগল লাগছিল।

এরপর কী? এরপর কী?

বারবার আকাশের দিকে তাকাচ্ছিল ও। কালো আকাশটাতে খুব সামান্য হলেও ধূসরের ছোঁয়া লেগেছে না? হে ভগবান! আর কিছুটা সময় আমাকে বাঁচিয়ে রাখো। মিনি আর শানুকে আমি একবার দেখতে চাই। একবার—মাত্র একবার…।

যন্ত্রণা আর ক্লান্তির সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে লড়াই করছিল আর এলোমেলোভাবে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছিল। তখনই জিশান দেখতে পেল, গেম সিটির ভেতরে একটা ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। অনেক মোটরবাইক আর গাড়ি নানান দিকে ছুটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে কিছু চিৎকার চেঁচামেচি।

বাইকের কয়েকজন মানুষকে লক্ষ করল জিশান। ওদের গায়ে কোনও স্পেশাল ইউনিফর্ম নেই। ওরা বোধহয় সিভিলিয়ান—গেম সিটির মক সিটিজেন।

কিন্তু ওরা এভাবে গেম সিটির রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছে কেন?

একটু পরেই প্লেট টিভির পরদায় এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। গেম সিটির সিটিজেনরা জিশানকে খুঁজে বের করে আগলে রাখতে চাইছে। ওরা চাইছে জিশানের গায়ে আর যেন আঁচড়টিও না লাগে। তাই ওরা নিয়ম ভেঙে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমে পড়েছে।

রউফ লালার কথা মনে পড়ে গেল জিশানের। কিন্তু ওর বেলায় তবু একটা প্রাইজ-টাইজের ব্যাপার জড়িয়ে ছিল! এখানে তো তা নেই—বরং কুটিল শাস্তিই হয়তো ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু তা হলে এই মানুষগুলো এরকম পাগলামো করছে কেন? ওদের ভয়ডর নেই!

জঙ্গলের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চাইছিল জিশান। কখনও গাছের আড়ালে, বা কখনও গাছের ওপরে বেয়ে উঠে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শরীরের যা অবস্থা তাতে গাছ বেয়ে ওঠার কাজটা মারাত্মকরকম কঠিন হয়ে পড়ছে।

ঘাম আর রক্ত মিশে গিয়ে জিশানের কাটা জায়গাগুলো জ্বলছিল। ও বারবার সেগুলোর ওপরে হাত বোলাচ্ছিল। আলো আর অন্ধকারের জাফরির মধ্যে দিয়ে এদিক-ওদিক নজর চালাচ্ছিল।

হঠাৎই ও দেখতে পেল দুটো হলদেটে সবুজ চোখ। তাদের ঘিরে গাঢ় কালো ছায়া।

জিশান একটুও দেরি না করে হাঁটুর কাছে লাগানো হোলস্টার থেকে লেজার ব্লাস্টার বের করে নিল। এবং ফায়ার করল।

কালো ছায়াটা শূন্যে লাফ দিয়েছিল। একইসঙ্গে চাপা গর্জন করে উঠেছিল। সেটা এখন ‘উড়ে’ এসে জিশানের কাছাকাছি আছড়ে পড়ল। ওটার মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে হিংস্র গজরানি।

প্রকাণ্ড একটা কালো বাঘ। আক্রোশে লেজ আছড়াচ্ছে। পাগলের মতো থাবা ছুড়ছে শূন্যে। ফুঁসছে।

কালো বাঘ যে এত বড় মাপের হয় জিশান জানত না। আর ও এও জানত না, এরা এত জানদার।

তবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বাঘটা বেশ নিস্তেজ হয়ে পড়ল।

জিশান বাঘটাকে লক্ষ্য করে আবার ফায়ার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু ঠিক তখনই একটা গরম কিছু ওর বাঁ-কাঁধ ছুয়ে বেরিয়ে গেল। আর সেই ‘ছোঁয়ার’ অভিঘাতটা এতই মারাত্মক হল যে, জিশানের দেহটা পলকে দুটো পাক খেয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে। ওর বাঁ-কাঁধটা আগুনের আঁচে জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছিল।

তখনই প্রাোটনকে জিশান দেখতে পেল। ওর কাছ থেকে প্রায় সাত-আট হাত দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সরু ছিপছিপে একটা ইস্পাতের চাবুক। চোখের ওপরে ঢাকা কালো কাচ থেকে জঙ্গলের আলোর ঢেউ ঠিকরে পড়ছে। ওর দু-হাতে দু-দুটো অস্ত্র।

জিশানের মনে হল, এইমাত্র প্রাোটন দুটো অস্ত্রই ব্যবহার করেছে : একটা জিশানের ওপরে, আর-একটা কালো পশুটার ওপরে।

এবার তা হলে সব শেষ। এত চেষ্টা, এত পরিশ্রম, এত লড়াই—সব শেষ! জিশানের শরীরের এখন যা অবস্থা তাতে ও কী পালটা কিছু করে প্রাোটনকে ঘায়েল করতে পারবে? ওর হাত আর কাঁধের যন্ত্রণাটা এখন এত বেড়ে গেছে যে মনে হচ্ছে, কেউ যেন মাংসের ভেতরে তুরপুন গেঁথে নিষ্ঠুরভাবে মোচর দিচ্ছে।

কিন্তু প্রাোটন কী করে ওকে খুঁজে পেল? ট্র্যাকারে তো ওর পজিশন প্রাোটন দেখতে পায়নি!

সেটা দেখতে না পেলেও প্রাোটন হাল ছাড়েনি। বুদ্ধি খাটিয়েছে, পরিশ্রম করেছে, আর ওর আই গিয়ারে লাগানো নাইটভিশান ইন্সট্রুমেন্টের সাপোর্ট নিয়েছে। তার ওপরে ভাগ্যও ওকে সাহায্য করেছে।

প্রাোটনের জায়গায় জিশান থাকলেও ঠিক একইরকম মরিয়া চেষ্টা করত।

আর সুখারাম? ও-ও কি জিশানকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে না? ও কি জিশানদের ফায়ারিং-এর শব্দ শুনতে পায়নি?

জিশানের নজর মাঝে-মাঝেই ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু ও জোর করে নিজেকে আবার সজাগ করে তুলেছিল। মিনি, শানু…আর সবার জন্য ওকে যে লড়তে হবে! যে করে হোক, লড়তে হবে।

মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় শরীরটাকে কয়েক ডিগ্রি ঘোরাল জিশান। ডানহাতের আঙুলগুলো গুটিগুটি ব্লাস্টারের হাতলের দিকে এগোতে লাগল।

প্রাোটন চুপচাপ দাঁড়িয়ে জিশানকে দেখছিল। ওর ঠোঁটের রেখাটা সামান্য চওড়া হল। তারপর ডানহাতে ধরা লং রেঞ্জ মালটিশুটার পিস্তলটা জিশানের মাথা লক্ষ্য করে তাক করল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আহত কালো বাঘটা সবাইকে চমকে দিয়ে বিদ্যুতের মতো প্রাোটনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

প্রাোটন ফায়ার করল বটে, কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হল না। কারণ, বাঘটা মারা যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে প্রাোটনকেও ছিঁড়ে-খুঁড়ে রেখে দিয়ে গেল।

গাছপালার গন্ধের সঙ্গে বারুদের গন্ধ মিশে গেল। ফায়ারিং-এর শব্দে অন্ধকারের পশুপাখিরা চঞ্চল হয়ে ডাকাডাকি শুরু করল। কয়েকটা জন্তুজানোয়ারের ছুটোছুটির শব্দও পাওয়া গেল যেন।

জিশান অতি কষ্টে উঠে বসল। তারপর একটা গাছের গুঁড়িতে কোনওরকমে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

বাঘটার দিকে একবার তাকাল। একেবারে নিথর, স্পন্দনহীন।

তারপর জিশান তাকাল প্রাোটনের দিকে। পায়ে-পায়ে সেদিকে এগোল।

প্রাোটন চিত হয়ে পড়ে আছে। তবে ওর মাথাটা একপাশে ঘুরে গেছে। দু-হাত থেকে অস্ত্র খসে পড়েছে। পোশাক ছিঁড়ে গেছে বেশ কয়েক জায়গায়। কোমরের কাছ থেকে বাঁ-পাটা খানিকটা যেন খুলে বেরিয়ে এসেছে। মুখটা অল্প খোলা—বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছে। গায়ে নানা জায়গায় রক্ত লেগে রয়েছে। চোখে শূন্য দৃষ্টি। যেন রাতের জঙ্গলের রূপ দেখে হতবাক হয়ে গেছে।

হঠাৎই জিশান খেয়াল করল, প্রাোটনের বাঁ-পায়ের একটা জায়গায় চামড়া উঠে গেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে চকচকে ধাতু—হয়তো স্টেইনলেস স্টিল কিংবা অন্য কিছু।

ঠিক একইরকম ব্যাপার দেখা গেল ডান কাঁধে আর গালে। তা ছাড়া জিশান লক্ষ করল, প্রাোটনের ঘাড়ের পাশে দুটো ছোট লাল বাতি দপদপ করছে।

জিশানের সবকিছু গুলিয়ে যাচ্ছিল। চামড়া, রক্ত, মাংস, মেটাল, লালবাতি…এসবের মানে কী?

যন্ত্রণায় মুচড়ে ওঠা গলায় প্রাোটন প্রায় ফিসফিস করে বলল,’ জিশান… তুমি জিতে গেলে। আমি…আমি…।’

প্রাোটনের কথা ভালো করে শোনার জন্য জিশান ওর মাথার কাছে উবু হয়ে বসে পড়ল। ব্লাস্টারটা শক্ত মুঠোয় ধরা রইল।

‘আমি…আমি…শেষ। বোনাস লাইফ নিয়ে অনেকদিন টিকে ছিলাম। আর…আর এটাই স্যাটিসফ্যাকশন যে…যে মানুষের হাতে আমাকে মরতে হল না…।’

সব জ্বালা-যন্ত্রণা ভুলে জিশান প্রাোটনের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।

প্রাোটনের গলা একেবারে মেয়েদের মতো। চোখ-মুখের আদলটাও সেরকমটাই লাগছে না কি?

এই মেয়েটাই একজন সুপারকিলার! যার আসল পরিচয় মিডিয়া শেষ দিন পর্যন্ত গোপন রেখেছে!

‘তুমি…তুমি…মেয়ে?’ জিশান জিগ্যেস করল। বাঁ-হাতের গড়িয়ে পড়া রক্ত মুছে নিল।

‘হ্যাঁ, শুরুতে তো তাই ছিলাম। খেলাধুলো ভীষণ ভালোবাসতাম…।’

প্রাোটনের স্যাটেলাইট ফোন বাজতে শুরু করল। বাজতেই থাকল। প্রাোটন ফোন ধরার মতো অবস্থায় নেই। ও মলিন চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর আস্তে-আস্তে কথা বলছিল।

জিশান শুনতে লাগল প্রাোটনের কথা।

ছোটবেলা থেকেই অ্যাথলেটিকসে টান ছিল। প্রাইজও পেয়েছে অনেক। খানিকটা ডানপিটে গোছের হওয়ায় বেশিরভাগ সময় ছেলেদের দঙ্গলে ভিড়ে থাকত। তা ছাড়া, ছিপছিপে চেহারা, বয়কাট চুল এসব দেখে অনেকে ওকে ছেলে বলেও ভুল করত।

বয়েস বাড়তে লাগল, আর তার সঙ্গে-সঙ্গে প্রাোটন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল। ধীরে-ধীরে ছোটখাটো ক্রাইমে জড়িয়ে পড়তে লাগল। আঠেরো বছর পেরোতে না পেরোতেই ও প্রথম খুন করে বসল। কিন্তু পুলিশ ঠিকমতো কেস সাজাতে পারেনি বলে ও তিন বছর জেল খেটে রেহাই পায়।

এরপর ও একটা মারাত্মক গ্যাং ওয়ারে জড়িয়ে পড়ে। পাহাড়ি এলাকার সেই গ্যাং ওয়ারে প্রচুর গোলাগুলি চলে। সেখান থেকে পালানোর সময় প্রাোটনদের জিপ একটা বাঁকের মুখে রাস্তা ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যায় শূন্যে।

জিপের সবাই মারা গিয়েছিল—একমাত্র প্রাোটন ছাড়া।

তবে ওর অবস্থা যা হয়েছিল তাতে ওকে বাঁচানো যাবে বলে কেউ ভাবেনি। ওর গোটা শরীরটা দুমড়েমুচড়ে গিয়েছিল। চোখ ঢুকে গিয়েছিল গর্তে, মাথার খুলির খানিকটা অংশ কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল।

সেই সময় নিউ সিটির বারোজন বিজ্ঞানী একটা কোর রিসার্চ গ্রুপ তৈরি করে রোবোটিক্স আর অ্যানড্রয়েড টেকনোলজি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তাঁদের নানান পরীক্ষার জন্য ‘সাবজেক্ট’ দরকার হয়ে পড়েছিল। তাই প্রাোটনকে তাঁরা ‘সাবজেক্ট’ হিসেবে চেয়ে বসেন। নিউ সিটির সিন্ডিকেট সেই অনুরোধে সায় দেয়।

তারপর বছরের পর বছর চিকিৎসা আর গবেষণা চলতে থাকে। রোবোটিক্স, আরটিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স আর বায়োটেকনোলজি হাত ধরাধরি করে প্রাোটনের ওপরে কাজ করতে থাকে। রক্ত, মাংস, হাড়ের সঙ্গে মিশে যায় স্টিলের প্লেট, ব্যাটারি, তার, সুইচ, অপটিক্যাল সেন্সর, এল. ই. ডি. বাতি আর অসংখ্য মাইক্রোচিপ।

শেষ পর্যন্ত তিন বছরের চেষ্টায় তৈরি হয় সুপারকিলার প্রাোটন। শ্রীধর পাট্টা ওকে ‘সুপারহিউম্যান কিলিং মেশিন’ নাম দিয়েছিলেন। কিন্তু…।

প্রাোটনের কথা শুনতে-শুনতে খানিকটা আনমনা হয়ে পড়েছিল জিশান। তবে ওর চোখ আর কান সাজাগ ছিল। ও শুনতে পেল বেশ কয়েকটা চপারের শব্দ। তার সঙ্গে শুটারের শিস।

কাউন্টডাউন রিস্টওয়াচের দিকে তাকাল জিশান। আর মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট! গত কয়েকটা ঘণ্টা কী করে এত তাড়াতাড়ি পেরিয়ে গেল কে জানে! জিশান অবাক হয়ে ভাবল, সত্যি-সত্যি কি কিল গেমের চব্বিশ ঘণ্টা শেষ হতে চলেছে? না কি ও স্বপ্ন দেখছে?

একবার প্রাোটনের দিকে তাকাল। এখন ওর বুকের কোনও ওঠা-নামা নেই—কালো বাঘটার মতোই স্থির।

কিন্তু জিশান এখন কী করবে? জঙ্গলের মধ্যেই এলোমেলো ছুটে বেড়াবে? না কি খোলা রাস্তায় বেরিয়ে মক সিটিজেনদের আস্তানায় গা-ঢাকা দেওয়ার চেষ্টা করবে? ওদের কাছে আশ্রয় চাইবে?

জিশানের মাথা ঠিকমতো কাজ করছিল না। কিলার সুখারাম এখন কোথায় আছে? কতদূরে?

আন্দাজে জিশানের মনে হল, বেশি দূরে নয়। সুখারামের ট্র্যাকারে জিশানের সবুজ ডট দেখা যাচ্ছে না বটে তবে প্রাোটনের লাল ডটটা নিশ্চয়ই দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, এই অবস্থায় সেরা স্ট্র্যাটেজি হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দুজন কিলারের একজোট হয়ে যাওয়া। তার মানে, সুখারাম নিশ্চয়ই প্রাোটনের লাল ডট লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে।

প্রাোটনের ফোন আবার বেজে উঠল। বাজতেই থাকল।

জিশানের মনে হল, সুখারাম ফোন করে প্রাোটনের সঙ্গে কথা বলতে চাইছে, আর কথা বলতে না পেরে মরিয়া হয়ে ধেয়ে আসছে প্রাোটনের খোঁজে—জিশানের খোঁজে।

রুকস্যাকে সব গুছিয়ে নিয়ে টলতে-টলতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শুধু ডানহাতের মুঠোয় ধরা রইল ব্লাস্টার গান। ওর শরীরের যা অবস্থা তাতে সুখারামের মুখোমুখি হলে কতটা মোকাবিলা করতে পারবে সেটাই প্রশ্ন।

পথ চলতে শুরু করল জিশান। তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে খিদে আর ঘুম। কিন্তু তা সত্বেও আরও কিছুক্ষণ অন্তত ওকে শরীরটাকে সচল রাখতে হবে।

রুকস্যাক থেকে অপটিক্যাল ট্যাবলেট বের করে ফুড ম্যাপ দেখল। তারপর সবচেয়ে কাছের ফুড পয়েন্টে গিয়ে চটপট কিছুটা খিদে-তেষ্টা মিটিয়ে নিল। মুখে-চোখে জলের ঝাপটা দিল।

অপটিক্যাল ট্যাবলেট দেখে নিজের অবস্থানটা বুঝতে চাইল জিশান। তারপর পুবদিক লক্ষ্য করে হাঁটা দিল। ও জানে, কিছুটা পথ গেলেই মেটাল রোড পাওয়া যাবে। সেখান থেকে একটা গাড়ি কিংবা মোটরবাইক নিয়ে নেবে। তারপর আবার দৌড়…দৌড়…দৌড়…।

মেটাল রোডের কাছাকাছি আসতেই অনেক আলো দেখতে পেল। সেইসঙ্গে চপারের ইঞ্জিনের শব্দ, শুটারের শিস, আর মানুষজনের হইচই।

হঠাৎই পিছন থেকে ফিসফিস করে কে যেন ডেকে উঠল : ‘জিশানদা!’

জিশান চমকে উঠল। এক ঝটকায় পিছন দিকে ঘুরে গেল। লেজার ব্লাস্টার তাক করল অন্ধকারের দিকে। দেখল, সেই অন্ধকারের গায়ে সার্চলাইটের টুকরো-টুকরো আলো জোনাকির মতো বিচিত্র নকশা কেটে দিয়েছে।

সেই নকশা গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে আছে একজন ছ’ফুটের বেশি লম্বা মানুষ—যে দৌড়ে হরিণকে হার মানাতে পারে। যে অনায়াসে পাঁচ-পাঁচটা খারাপ মানুষকে খতম করতে পারে।

‘সুখারাম নস্কর….।’ প্রায় ফিসফিস করে উচ্চারণ করল জিশান।

‘হ্যাঁ—সুখারাম, জিশানদা।’ জিশানের আরও কাছে এগিয়ে এল ও : ‘আমি তোমাকে কিছুতেই মারতে পারব না। কেন না ভালো মানুষদের আমি মারতে পারি না। তাতে মার্শালের হাতে আমাকে মরতে হয় মরব—।’

জিশান কী বলবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারছিল না। তবে এটুকু বুঝতে পারছিল, সুখারাম নস্কর কেন এতক্ষণ ধরে ওকে ‘খুঁজে’ পায়নি।

সুখারাম জিশানের হাত চেপে ধরল : ‘এসো, জিশানদা। জলদি। আর সময় নেই।’

ওরা ঘুরপথে মেটাল রোডের দিকে এগোল। সুখারাম খুব নীচু গলায় কথা বলছিল। ও জিশানের ওপরে অনেকক্ষণ ধরেই নজর রাখছে, যাতে জিশানের কোনও বিপদ না হয়। জিশানকে বাঁচানোর জন্য খেলার সব নিয়মকানুন ভেঙে প্রাোটনকেও ও শেষ করে দিত। কিন্তু তার আগেই কালো বাঘ সেজে নিয়তি হাতে লাগাম তুলে নিয়েছে।

দুটো আগুনের তির কোথা থেকে যেন ছুটে এল। ওদের কাছাকাছি গাছপালার ওপরে ঠিকরে পড়ে কানফাটানো বিস্ফোরণ ঘটাল। কালো ধোঁয়া, পোড়া গন্ধ।

শ্রীধর পাট্টা নিশ্চয়ই এয়ার অ্যাটাকের নির্দেশ দিয়েছেন।

কিন্তু হঠাৎ এ-নির্দেশ কেন?

জিশান আর সুখারাম দৌড়তে শুরু করল।

একটু পরেই ওরা গাছপালা পেরিয়ে মেটাল রোডে পৌঁছে গেল। রাস্তার পাশে দাঁড় করানো একটা গাড়িতে উঠে বসল। তারপর সুখারামের হাতে গাড়ি চলতে শুরু করল।

ওদের ছুটন্ত গাড়ি লক্ষ্য করে মিসাইল ছুটে আসছিল বারবার। চোখে পড়ছিল আগুনের রেখা আর শব্দ। কিন্তু সুখারাম কুশলী হাতে স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছিল, অ্যাক্সিলারেটরের কন্ট্রোল সুইচ অপারেট করছিল।

কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পরেই ওদের থামতে হল।

কারণ, সামনের রাস্তা জুড়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য!

জায়গাটা আলোয় আলো। চওড়া রাস্তার মাঝে চারটে শুটার দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার ঠিক মাঝখানে একটা চপার—তার ইঞ্জিন চলছে। চপারটার সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্রীধর পাট্টা। আর কোনও উপায় না দেখে নিজেই গেম সিটিতে চলে এসেছেন।

কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হল, রাস্তার দুপাশে বহু মানুষের ভিড়। মনে হচ্ছিল যেন গেম সিটির সব মক সিটিজেন শ্রীধর পাট্টাকে ঘিরে জড়ো হয়ে গেছে। ওরা হইচই করছে, জিশানের নাম ধরে চিৎকার করছে।

সব চিৎকার হইচই ছাপিয়ে হঠাৎই শ্রীধরের গলা শোনা গেল। একটা মেগাফোন ব্যবহার করে তিনি কথা বলছেন।

‘সব খেলা শেষ, জিশান! আর পালানোর পথ নেই। তুমি কিল গেমের নিয়ম ভেঙেছ—তাই সব খতম। এক্ষুনি নেমে পড়ো গাড়ি থেকে। নইলে আমি শুট করার অর্ডার দেব…।’

ভিড় করে থাকা জনতা প্রতিবাদের চিৎকার করে উঠল।

জিশান গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল। একটা হাত ওপরে তুলে বলল, ‘এটা অন্যায়। এ-অন্যায় আপনি করতে পারেন না, মার্শাল—।’

নিজস্ব ঢঙে ব্যঙ্গের হাসি হাসলেন শ্রীধর : ‘জিশান, তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, নিউ সিটিতে আমিই শেষ কথা।’

‘মোটেই না!’ চিৎকার করে বলল জিশান, ‘সবসময় জনগণই শেষ কথা বলবে। সবাই জানে, আমি কোনও দোষ করিনি…।’

জনতা আবার চেঁচিয়ে উঠল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কয়েকটা বাক্স, কৌটো আর ইট-পাটকেল ছিটকে গেল শ্রীধরের শুটার-বাহিনীর দিকে।

দুজন গার্ড শূন্যে ফায়ার করে জনতাকে ‘ধমক’ দিল।

জিশান বলল, ‘মার্শাল, ভুলে যাবেন না, লাইভ টেলিকাস্ট এখনও চলছে। সবাই আপনার এই অন্যায় দেখছে…।’

হাসলেন শ্রীধর। মাটির দিকে থুতু ছেটালেন। তারপর মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘…ইয়োর লাইভ টেলিকাস্ট! সবাই এবার ডেড টেলিকাস্ট দেখবে।’ ডাইনে-বাঁয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন মার্শাল। তারপর : ‘নাউ, কাম অন। হাত মাথার ওপরে রেখে ধীরে-ধীরে এগিয়ে এসো আমাদের কাছে। আমি দশ পর্যন্ত গুনব। ওয়ান…টু…থ্রি…।’

হঠাৎই জিশানকে অবাক করে দিয়ে সুখারাম এক হ্যাঁচকায় গাড়ি ছুটিয়ে দিল। এবং জিশান বা অন্যান্য কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওর গাড়ি মিসাইলের মতো ধেয়ে গেল শ্রীধর পাট্টার দিকে।

জনতা চিৎকার করে উঠল। গার্ডরা সুখারামকে লক্ষ্য করে বেশ কয়েকবার ফায়ার করল বটে, কিন্তু তাতে কাজ হল না।

সুখারামের গাড়ি বিদ্যুৎবেগে ছুটে গিয়ে শ্রীধরের চপারে সরাসরি ধাক্কা মারল।

সংঘর্ষ, বিস্ফোরণ, আগুন, ধোঁয়া।

শ্রীধর পাশের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করলেন। আর একইসঙ্গে জনগণ গার্ডদের ওপরে জলপ্রপাতের মতো লাফিয়ে পড়ল। শুরু হয়ে গেল দক্ষযজ্ঞ। প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচির মধ্যে ফায়ারিং-এর শব্দও শোনা গেল।

তখনই লাইভ টেলিকাস্টে জানা গেল, জনস্রোতের বন্যা সব প্রতিরোধ ভেঙে গেম সিটিতে ঢুকে পড়েছে।

জিশান বুঝতে পারছিল, জনতার রোষে পড়লে শ্রীধর পাট্টা একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবেন—ওঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর সেই মৃত্যুটা জিশানের চোখে মোটেই ন্যায়বিচার নয়।

সুতরাং, ও শ্রীধরকে লক্ষ্য করে দৌড়ল। ওঁকে আপাতত আগলে রাখা দরকার। পরে ওঁর অন্যায়ের বিচার করা যাবে।

শ্রীধর পাট্টা গায়ের সাদা কোট খুলে ফেলেছিলেন, যাতে কেউ ওঁকে সহজে চিনে ফেলতে না পারে। কিন্তু জিশান ওঁকে চিনতে পারল। রাস্তার পাশের একটা গাছের আড়ালে বসে থরথর করে কাঁপছেন।

একটা শুটারকে কোনওরকমে দখল করল জিশান। ক্ষিপ্ত জনগণ শুটারটাকে ঘিরে ছিল। কিন্তু জিশানকে দেখে ওরা পথ ছেড়ে দিল।

সেই শুটারটায় শ্রীধরকে টেনে তুলল জিশান। সঙ্গে উঠল আরও দুজন মানুষ। তা ছাড়া শুটারের পাইলট তো আছেই!

শ্রীধর কাঁপা-কাঁপা গলায় জিগ্যেস করলেন, ‘আমাকে…আমাকে কো-কোথায় নিয়ে যাচ্ছ, জিশান?’

শুটারে উঠতে-উঠতে জিশান বলল, ‘এখানে থাকলে আপনি খতম হয়ে যাবেন…।’

শুটার শিস দিয়ে আকাশে উঠল। আদিগন্ত নতুন ভোরের আলো। কিল গেমের চব্বিশ ঘণ্টা শেষ।

শ্রীধর তখনও থরথর করে কাঁপছিলেন। অর্থহীন শব্দ করে গুঙিয়ে উঠছিলেন। ওঁকে দেখিয়ে একজন যাত্রী জিগ্যেস করল, ‘জিশান, এই…এই জানোয়ারটাকে আপনি… আপনি ছেড়ে দেবেন?’

জিশান তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, ছেড়ে দেব—মানুষের মধ্যে ছেড়ে দেব। যাতে মানুষের মধ্যে থেকে, মানুষের সঙ্গে মিশে, এই জানোয়ারটা আবার মানুষ হওয়ার চেষ্টা শুরু করতে পারে।’

নীচ থেকে আবছাভাবে জনতার স্লোগান শোনা যাচ্ছিল, ‘নিউ সিটি জিন্দাবাদ! ওল্ড সিটি জিন্দাবাদ!’

সামনের ভোরের দিকে চোখ মেলে দিয়ে জিশান আপনমনেই বলল, ‘আর নিউ সিটি, ওল্ড সিটি নয়—দুটো শহর মিলেমিশে এখন থেকে একটাই নাম হবে ও আওয়ার সিটি—আমাদের শহর।’

জিশান চোখ মেলে নতুন সূর্য ওঠা দেখতে লাগল।

1 Comment
Collapse Comments

sesh ta khub tarahura kore likha hoiche amon mone holo, r aktu dirgho kore mini sanur kotha janale parto

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *