১৩. মেয়েটার চুলগুলো

১৩.

মেয়েটার চুলগুলো ছোট, খাড়া-খাড়া। চোখে সবুজ রঙের ফ্লুওরেসেন্ট কাজল। নাকে আর গলায় দুটো সোনার রিং। কপালে চকচকে কী একটা গুঁড়ো মাখা। তার কণাগুলো জোনাকির মতো ঝিকমিক করছে।

মেয়েটার গায়ে স্লিভলেস শর্ট জ্যাকেট। পায়ে লেদার স্ল্যাক্স, তার ওপরে মেটাল বাটন। ডানহাতে একটা ফানি চকোলেট স্টিক। সেটা মাঝে-মাঝে চুষছে।

ফানি চকোলেট স্টিকটা ঠিক নেশার জিনিস নয়। তবে এটার একটা বিশেষ গুণ আছে। অন্য কোনও কিছু থেকে একবার নেশা হলে ফানি চকোলেট স্টিক সেই নেশার ঝোঁককে বহুক্ষণ ধরে রাখতে সাহায্য করে।

মেয়েটা সিমানকে একটা ধাক্কা মেরে জড়ানো গলায় বলল, ‘য়ু স্কাম! ওই কন্ট্রোল প্যানেলের বাটনগুলো তোমার পার্সোনাল প্রপার্টি নয়। লেট মি প্রেস সাম…।’

সিমান রুখে দাঁড়াল কিন্তু মেয়েটার গায়ে হাত তুলল না। নেশা জড়ানো গলায় বলল, ‘বোতাম টেপাটাও একটা কম্পিটিশান, সিসি। লড়াই করে জায়গা করে নিয়ে তোমাকে বোতাম টিপতে হবে…।’

‘থ্যাংকস ফর দ্য অ্যাডভাইস। আমি ব্লু-র ওপরে এক লক্ষ টাকা বেট করেছি অ্যান্ড আই ওয়ান্ট ব্লু টু উইন। সো আই ওয়ান্ট দ্য উইনিং মুভস, ও.কে.? উড য়ু প্লিজ গেট লস্ট, ডিউড?’

‘হু দ্য হেল আর য়ু?’ মেয়েটার মুখের কাছে হিংস্র মুখ নিয়ে এল সিমান। ওর থুতনিতে একচিলতে দাড়ি। গালে একটা ছোট্ট লাল ফুল—লেসার ট্যুাটু।

তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়ল সিমান : ‘এখানে তোমাকে নতুন মনে হচ্ছে। য়ু ডোন্ট নো দ্য রুলস। কাম ব্যাক হোয়েন য়ু গ্রো আপ, বিচ!’

সিমান কথাগুলো উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে মেয়েটা নোংরা গালিগালাজ করে উঠল এবং সিমানের গালে সপাটে এক চড় কষাল।

সিমান প্রথমটা হকচকিয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই একটা পালটা থাপ্পড় কষিয়ে দিল মেয়েটার গালে। মেয়েটার হাত থেকে ফানি চকোলেট স্টিকটা পড়ে গেল।

তারপর যেটা শুরু হল সেটা কিল-চড়-লাথি-ঘুসির বিচিত্র লড়াই। কোনও পুরুষ এবং মহিলার এরকম অসভ্য লড়াই কল্পনা করাও কঠিন।

হলোগ্রাম ফাইটারদের অক্লান্ত লড়াই চলছিল। তাদের ঘিরে দর্শকদের হইহুল্লোড়ও চলছিল। কিন্তু তারই মধ্যে দশ-বারোজন সিমান এবং মেয়েটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। এবং বিনাপয়সার মজা দেখতে লাগল।

হঠাৎই ওদের কেউ বাজি ধরার ব্যাপারটা শুরু করল। সঙ্গে-সঙ্গে ওরা নিজেদের মধ্যে বাজি ধরতে লাগল। কেউ সিমানকে জেতার জন্য চিয়ার আপ করতে লাগল। আর কেউ মেয়েটাকে।

কিন্তু কেউই ওদের লড়াইটা থামাতে এগিয়ে এল না। বিশৃংখল উল্লাসে ‘জয় রুম’ তখন কাঁপছে।

সিমান আর মেয়েটির শরীর অক্ষত ছিল না। আঁচড়-কামড়ের চিহ্ন থেকে রক্ত বেরোচ্ছিল। কিন্তু সেদিকে ওদের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। ওরা তুচ্ছ কারণে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লড়াই করছিল।

হঠাৎই একটি ছেলে ‘স্টপ দ্য ফাইট! স্টপ ইট!’ বলে চিৎকার করে উঠল। আরও একটি মেয়ে ছেলেটির সঙ্গে গলা মেলাল। ওরা দুজনে ভিড়ের বৃত্ত ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করতে লাগল, আর একইসঙ্গে ‘ওদের থামাও! ওদের থামাও!’ বলে চিৎকার করে চলল।

ভিড়ের মধ্যে থেকে কেউ একজন ছেলেটাকে লক্ষ্য করে গালাগাল ছুড়ে দিল। এবং তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা ঘুসি।

ছেলেটা ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, কিন্তু বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসা একটা অভদ্র ধাক্কা ওর পড়ে যাওয়াটা রুখে দিল। আর তারপরই অন্য এক অ্যাঙ্গেল থেকে কেউ ওকে লক্ষ্য করে আর-একটা ঘুসি চালাল।

তারপর ব্যাপারটা চলতেই থাকল। এবং শেষ পর্যন্ত ছেলেটা পড়ে গেল।

ছেলেটির প্রতিবাদী সঙ্গী মেয়েটিও রেহাই পায়নি। ওর কপালেও একইসঙ্গে কিছু খুচরো চড়-থাপ্পড় জুটেছে। ওর একটা চোখ ফুলে গেছে. নাকের পাশে কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছে। ও কোনওরকমে ভিড়ের বৃত্তের বাইরে পালিয়ে আরও হেনস্থা থেকে বেঁচেছে।

সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এই দাঁড়াল যে, সিমান আর ওই মেয়েটির মারপিট যেন একটা মজাদার সাসপেন্স সিনেমা। দু-একজন ‘পাগল’ ছাড়া কেউই চায় না সিনেমাটা মাঝপথে বন্ধ হোক।

কিন্তু সিনেমাটা একটু পরেই শেষ হল। শেষ করল মেয়েটাই। ও কখন যেন একটা মেটাল কি-রিং বের করে সিমানের গালে বসিয়ে টেনে দিয়েছে।

সিমানের গাল ফাঁক না হয়ে গেলেও ক্ষতটা যে মোটামুটি গভীর সেটা রক্তের ধারা এবং সিমানের যন্ত্রণার চিৎকার শুনে বোঝা গেল।

সিমান ভয়ে ছিটকে পিছিয়ে গেল। একটা হাত আহত গালে চেপে ধরল। চোখে খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা অপমান। আর তার সঙ্গে যন্ত্রণার অশ্রুজল।

সিমানের মুখটা দেখে মায়া হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু জনতার আচরণ দেখে মায়া ব্যাপারটা ওদের মধ্যে আদৌ আছে বলে মনে হল না।

হলোগ্রাম ফাইটার ব্লু এবং রেড তখনও লড়ছিল। হলোগ্রাম স্কোরবোর্ডের হিসেবে ব্লু তখন অনেক এগিয়ে আছে। কিন্তু স্কোর ওলটপালট হয়ে যেতে পারে যে-কোনও মুহূর্তে।

সিমানকে স্রেফ ভুলে গিয়ে ছেলেমেয়ের দল আবার হলোগ্রাম ফাইটের উত্তেজনায় ডুবে গেল।

সিমানের সঙ্গে লড়াইয়ে জিতে যাওয়া মেয়েটা অন্য সকলের সঙ্গে মিলেমিশে হাসাহাসি করছিল। আর পকেট থেকে একটা হিলিং স্প্রে বের করে নিজের শরীরের ক্ষতের ওপরে স্প্রে করছিল। তখন একটা ছেলে একটা সবুজ রঙের ফানি চকোলেট স্টিক মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিল। মেয়েটা ওকে হেসে ‘থ্যাংকস’ জানাল, চকোলেট স্টিকটা চুষতে লাগল।

হলোগ্রাম ফাইট যতই শেষের দিকে এগোতে লাগল চিৎকার আর উত্তেজনার মিটার ততই চড়তে লাগল। সিমান ভিড়ের চক্র থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আহত নজরে লড়াই দেখছিল আর শরীরের কেটে-ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো মেরামত করার চেষ্টা করছিল। ওর বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ করে শব্দ হচ্ছিল। কে জিতবে? রেড, না ব্লু? ওর বাজি ধরা আট হাজার টাকা শেষ পর্যন্ত…।

হলোগ্রাম ফাইট শেষ হতেই চিৎকারের ফোয়ারা ছুটল। তার সঙ্গে তীব্র শিসের আওয়াজ, পশু-পাখির নকল ডাক।

যারা বাজিতে জিতেছে তারা পাগলের মতো হাত তুলে লাফাতে লাগল। আর যারা হেরেছে তাদের চিৎকার, লম্ভঝম্প সব স্তিমিত হয়ে গেল।

রেড ফাইটার শুয়ে পড়েছে মেঝেতে। তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। ব্লু ফাইটার বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাত তুলে নাড়ছে, এরিনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

সেদিকে তাকিয়েই সিমান ভেঙে পড়ল। কাঁদতে শুরু করল। তারপর ওই অবস্থাতেই বসে পড়ল নকল ঘাসের মেঝেতে।

আট হাজার টাকা গেল! এখন তো সম্বল বলতে কিছুই প্রায় নেই! কাল যখন নেশার টানে মনটা আকুলিবিকুলি করবে তখন কী করবে ও? ‘জয় রুম’-এর এন্ট্রি ফি কোথা থেকে পাবে? টাকা চেয়ে বাবার কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। আর মা? মা তো ওর সঙ্গে নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কোনও কথাই বলে না!

তা হলে?

আগামীকালের নেশার তেষ্টার কষ্টটা সিমান যেন এখন থেকেই টের পেতে শুরু করল। ওর গলা শুকিয়ে এল। বুকের মধ্যে কেমন একটা চাপ তৈরি হল। আর একইসঙ্গে দু-চোখে জলের ধারা বইতে লাগল।

কিছুক্ষণ একইভাবে বসে থাকার পর সিমান চোখ মুছল। নাক টানল কয়েকবার। তারপর ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।

না, হাল ছাড়লে চলবে না। ওর কাছে সামান্য যা কিছু টাকা আছে সেটাকেই পুঁজি করে আগামীকালের সন্ধেটা শুরু করতে হবে। যদি ও কয়েকটা ছোট-ছোট বাজি জিততে পারে তা হলেই আর চিন্তা নেই।

কিন্তু ভাগ্য ওকে সাহায্য করবে তো? ও পারবে তো জিততে?

এসব কথা ভাবতে-ভাবতে ভাঙাচোরা সিমান ‘জয় রুম’ থেকে বেরিয়ে এল।

গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাসের জীবন জিশানের অসহ্যরকম একঘেয়ে লাগছিল। সারাটা দিন ধরে শুধু অ্যানালগ জিম, ডিজিটাল জিমের ট্রেনিং, নানান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ট্রেনিং, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, অ্যাথলেটিক অপারেশানস, কিল গেম সিমুলেটর-এ ট্রেনিং আর সাইকোলজিক্যাল সেশান। এরই ফাঁকে বিকেলে দেড় ঘণ্টার ব্রেক। তখন জিশান আর অন্য পার্টিসিপ্যান্টসরা নানান খেলাধুলো আর আড্ডা-গল্পে মেতে ওঠে।

আড্ডা মারার সময় বা গল্প করার সময় জিশান অবাক হয়ে খেয়াল করে ও হাসছে, আর অন্যান্য প্রতিযোগীও তার ব্যতিক্রম নয়। ওদের কেউ-কেউ বেশ জোরে-জোরে হেসে উঠছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভুলে যাচ্ছে, কোন পরিস্থিতির মধ্যে ওরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের মাথার ওপরে ঠিক কী ধরনের এবং কতটা ধারালো খাঁড়া ঝুলছে।

পিট ফাইটের পর একমাস সাতদিন পার হয়ে গেছে। জিশান আরও একমাস সাতদিন এগিয়ে গেছে কিল গেমের দিকে। ওর এটা ভালো লাগছিল। কারণ, মিনি আর শানুর সঙ্গে ওর দেখা হবে কি হবে না তার একটা চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হতে চলেছে। এবং তার পরই ওর জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে শান্তিপূর্ণ জীবন। মিনি-শানুর কাছে ফিরে যেতে পারলে যেমন ওর শান্তি, তেমনই ফিরে যেতে না পারলেও যেখানে ও যাবে সেখানে চিরপ্রশান্তি।

ঘুমের ঘোরে এসব কথা ভাবছিল জিশান। তখনই অটোমেটিক প্লেট টিভি থেকে মিষ্টি মেয়েটার মিষ্টি গলা শুনতে পেল ও।

‘জিশান! জিশান—ওঠো। ভোর হয়েছে…।’

জিশান চোখ খুলল। একটা হাই তুলে উঠে বসল বিছানায়।

প্লেট টিভি ‘অন’ হয়ে গেছে। তার রঙিন ‘পরদানশিন’ মেয়েটি মুখে সুন্দর হাসি ফুটিয়ে জিশানকে ডাকছে।

আশ্চর্য! জিশানের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই মেয়ে বলল, ‘গুড মর্নিং। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও। মার্শাল স্যার ঠিক সাতটায় তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। ওই ইমার্জেন্সি স্পেশাল মিটিং-এর পর তোমার অ্যানালগ জিমের শিডিউল শুরু হবে…।’

জিশান বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল। দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকাল। ছ’টা বেজে পাঁচ মিনিট।

মেয়েটা মনে হল সরাসরি জিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন জিশানের ভিডিয়ো ইমেজ ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।

অসম্ভব কিছু নয়। লুকোনো ক্যামেরা আর আধুনিক প্রযুক্তি যদি হাতে হাত মেলায় তা হলে ব্যাপারটা জলের মতো সহজ।

জিশান মেয়েটির চোখে চোখ রেখে সামান্য জড়ানো গলায় বলল, ‘ও.কে.—থ্যাংক য়ু। আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি…।’

টিভির পরদার আলো দপ করে নিভে গিয়ে অন্ধকার হয়ে গেল। স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্লেট টিভি অফ হয়ে গেছে।

জিশান তৈরি হতে শুরু করল। আর একইসঙ্গে ভাবতে লাগল, শ্রীধর পাট্টা আবার কেন ডেকে পাঠিয়েছেন।

জিপিসির বাইরে বেরোনোর জন্য ওকে শাস্তি দিতে ডেকেছিলেন শ্রীধর। চুলকুনি অস্ত্র দিয়ে অভিনব শাস্তি। কিন্তু তারপর তো চার দিন পার হয়ে গেছে! এর মধ্যে তো জিশান কোনওরকম গোলমাল করেনি! বরং ভালো ছেলের মতো নিয়ম করে রোজকার রুটিন মেনে চলেছে।

তা হলে?

প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেল শ্রীধর পাট্টার অফিসে গিয়ে।

সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর একুশতলায় শ্রীধরের অফিস। এই ভোর সাতটাতেও অফিসটার চরিত্র সকাল এগারোটার মতন।

অফিসঘরে জিশানকে ঢুকিয়ে দিয়ে পিস ফোর্সের ‘বোবা’ গার্ডরা চলে গেল। আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে পা দিয়েই জিশান বিমূর্ত সৌন্দর্যের ধাক্কা খেল।

এত সুন্দর করেও একটা অফিসঘর সাজানো যেতে পারে!

ও হতবাক হয়ে ঐশ্বর্যময় অফিসঘরটাকে দেখছিল। ঘরের ডানপাশে একটা ফুলের বাগান। ফুটপাঁচেক চওড়া—গোল রিং-এর মতো। একটা স্বচ্ছ স্ফটিকের স্তম্ভকে ঘিরে খুব ধীরে ধীরে চক্রের মতো ঘুরছে।

বাগানে ছোট-ছোট ফুলের গাছ—তাতে রঙিন ফুল। এরকম সুন্দর প্রজাপতির মতো ফুল জিশান জীবনে দেখেনি।

বাগানের ঠিক ওপরে উড়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটা ফ্যান টেইলড লাভ-বার্ড। অন্তত জিশানের দেখে তাই মনে হল।

পাখিগুলো কিচকিচ করে ডাকাডাকি করছে, বাগানের ওপরে একটা নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে উড়ছে—এখানে-ওখানে বসছে, কিন্তু কোনও অদৃশ্য মন্ত্রবলে যেদিকে-সেদিকে উড়ে চলে যাচ্ছে না।

এমনটা ভাবার কারণ, কোনও জাল কিংবা খাঁচাজাতীয় বস্তু জিশানের চোখে পড়ছে না।

বাগানের উলটোদিকের দেওয়ালে ঝরনার জল গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ছে। আলো পড়ে চিকচিক করছে। তার সঙ্গে জলের মৃদু কলকল শব্দ। এই ঝরনাকে পটভূমিতে রেখে অদ্ভুত স্টাইলে সাজানো রয়েছে আটটা বড় মাপের টিভির পরদা। তাতে নিউ সিটির কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ এলাকা দেখা যাচ্ছে।

ঘরের সিলিংটা অনেকটা ওলটানো কড়াইয়ের মতো। তাতে নীল আর সাদা ধোঁয়ার ছায়া আকাশের আভাস তৈরি করেছে। তার মধ্যে ছোট-ছোট হলদে আলোর ফুটকি জ্বলজ্বল করছে। যেন অসংখ্য তারা ঘরের আলোর জোগান দিচ্ছে।

ঘরের সমস্ত আসবাবপত্র স্বচ্ছ পলিমারের তৈরি। তার মধ্যে হালকা নীলরঙের আভা জ্যান্ত সাপের মতো নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।

এরকমই একটা বিশাল টেবিলের ওপারে পাথরের মূর্তির মতো বসে রয়েছেন শ্রীধর পাট্টা। ওঁর উলটোদিকে ছ’টা চেয়ার। তার মধ্যে চারটে চেয়ার খালি—ডান-দিকের শেষ দুটো চেয়ারে বসে রয়েছেন দুজন হোমরাচোমরা বয়স্ক মানুষ। ওঁদের ফিটফাট পোশাক আর বয়স্ক চেহারা দেখেই জিশান ওদের হোমরাচোমরা বলে আন্দাজ করেছে।

.

১৪.

দুজনেরই মাথায় টাক। চোখে চশমা। চর্বি ঠাসা গাল ঝুলে পড়েছে। মুখের চামড়ায় অনেক ভাঁজ।

শ্রীধরের টেবিলের সব জিনিস বেশ সুন্দর করে সাজানো। পেন, স্যাটেলাইট ফোন, রাইটিং প্যাড, মিনারেল ওয়াটারের সিপার ইত্যাদি এমনভাব সাজানো যেন কেউ ওগুলো বিক্রির জন্য দোকান সাজিয়ে বসেছে।

টেবিলের ডানদিকে একটা আর্ক কম্পিউটার মনিটর। তার কিবোর্ডের ওপরে শ্রীধরের ডানহাতের আঙুল নড়ছিল। জিশানকে দেখে আঙুল থামল। শ্বেতপাথরের মুখে সামান্য হাসি ফুটল।

‘এসো, জিশান—এসো। বোসো—।’ শ্রীধর উষ্ণ আহ্বান জানালেন।

জিশান টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল। বসে থাকা দুই প্রৌঢ়ের সঙ্গে একটা চেয়ারের তফাত রেখে বসে পড়ল।

বসে পড়ার পরেও জিশান লাভ-বার্ডগুলোর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছিল। ওদের ওড়াউড়ি দেখছিল। আর অদৃশ্য খাঁচাটার রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছিল।

সেটা লক্ষ করে শ্রীধর বললেন, ‘ওগুলো ফ্যান টেইলড লাভ-বার্ড। জোড়ায়-জোড়ায় থাকে। ওদের জোড়ের একটা মারা গেলে অন্যটাও দু-চারদিনের মধ্যে দু:খে মারা যায়।’

জিশান একটু হাসল, মাথা নাড়ল : ‘জানি। আমি ওদের খাঁচাটা দেখার চেষ্টা করছি।’

শ্রীধর শব্দ করে হাসলেন। জিশানের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বললেন, ‘দেখতে পাবে না। কারণ, খাঁচাটা ইনভিজিবল। ওটা ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে তৈরি। পাখিগুলো একটা স্ফিরিক্যাল ফোর্স ফিল্ডের ক্যাভিটির মধ্যে আছে। এলাকার বাইরে গেলেই ওরা স্ট্রং ফিল্ডটা সেন্স করতে পারে। তখনই চট করে কমফোর্টেবল জোনে ফিরে আসে।’ স্বচ্ছ টেবিলে আঙুলের ডগা ঠুকলেন শ্রীধর : ‘এই অদৃশ্য খাঁচা আমাদের সায়েন্টিস্টদের আবিষ্কার। দারুণ, না?’

‘হুঁ, দারুণ—।’ জিশান বলল।

কিন্তু জিশানের কথা ছাপিয়ে দুই প্রৌঢ়ের সম্মিলিত গলা শোনা গেল, ‘একসিলেন্ট, স্যার, একসিলেন্ট। আপনার ইনভেন্টিভ পাওয়ার রিয়েলি একস্ট্রর্ডিনারি—।’

জিশান চাটুকার দুজনের দিকে একবার তাকাল।

জিশান না হয় এই অদ্ভুত খাঁচা প্রথম দেখছে, কিন্তু এঁরা নিশ্চয়ই ব্যাপারটা নতুন দেখছেন না! তা হলে এই চাটূক্তির মানে কী? ‘চাটুকার’ শব্দটা কী ‘চাটা’ থেকে তৈরি হয়েছে?

মনসুখ চক্রপাণি আর গণপত আচারিয়ার কথা মনে পড়ে গেল জিশানের। নিউ সিটির একনম্বর এবং দু-নম্বর সায়েন্টিস্ট। শ্রীধর পাট্টার পা চাটার ব্যাপারেও ওঁরা একনম্বর এবং দু-নম্বর।

এই প্রৌঢ় দুজন কি তা হলে তিননম্বর এবং চারনম্বর?

বাবার একটা কথা মনে পড়ে গেল জিশানের।

‘বিজ্ঞানীদের কেউ-কেউ শাসকদের পা চাটতে পারে—কিন্তু জেনে রাখিস জিশু, বিজ্ঞান কখনও কারও পা চাটে না—।’

জিশান পাশে বসে থাকা লোকদুটোর দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল। তারপর শ্রীধর পাট্টার চোখে চোখ রেখে জিগ্যেস করল, ‘বলুন, আমাকে কেন ডেকেছেন?’

‘শরীর কেমন আছে?’ মোলায়েম গলায় পালটা প্রশ্ন করলেন শ্রীধর।

জিশান ভীষণ অবাক হল। ওর শরীরের খবর নিচ্ছেন শ্রীধর। ঠিকাদার যেমন মাটি-কাটা শ্রমিকের শরীরের খবর জানতে চায়, সেরকম? নতুন কী ‘মাটি-কাটা’র কাজ রয়েছে জিশানের জন্য?

‘ভালো।’ ছোট্ট উত্তর দিল জিশান।

‘গুড। একটু কফি খাও—।’ বলে স্যাটেলাইট ফোন তুলে নিয়ে কাকে যেন ফোন করলেন। চারজনের জন্য কফি আর কুকিজ চেয়ে পাঠালেন।

তারপর : ‘জিশান, এবারে কাজের কথায় আসি। আমাদের কোর কমিটির মিটিং-এ কিল গেমের তারিখ মোটামুটিভাবে ঠিক হয়েছে সেকেন্ড সেপ্টেম্বর, রবিবার।’

জিশানের শরীরের ভেতরে বরফ-জলের স্রোত বয়ে গেল। অথচ এই স্রোতটা বয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। যেহেতু গত তিনমাস ধরে সবই ওর জানা।

জিশান অবাক হল। ‘ফাঁসি’ হবে এটা নিশ্চিতভাবে জানা থাকা সত্বেও ‘ফাঁসি’র তারিখটা শুনলে এরকম হয়? ড্যাশ, কমা, কোলন, সেমিকোলন যতই থাক না কেন ফুল স্টপের ওজনই আলাদা। কিল গেমের এই তারিখটা যেন সেই ফুল স্টপ।

জিশানের মাথাটা কেমন ঘুরে গেল। চোখের সামনে শ্রীধর পাট্টার ছবিটা ঝাপসা হয়ে গেল। বরফ-জলের হিমশীতল স্রোতটা এখন শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে।

সেকেন্ড সেপ্টেম্বর। ফুল স্টপ।

‘…দিনটা মোটামুটিভাবে ঠিক হয়েছে। এখনও হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফাইনাল হয়নি।’ শ্রীধর তখনও কথা বলছিলেন।

জিশান বুঝতে পারছিল, শ্রীধরের কিছু কথা ও মিস করেছে—যেহেতু ওর মাথা ঠিকঠাক কাজ করছে না।

‘…তবে দু-তারিখটায় যদি কোনও প্রবলেম হয় তা হলে আমরা নাইনথ সেপ্টেম্বরে শিফট করব। কারণ, দিনটা রোববার হওয়াটা খুব জরুরি। বুঝতেই পারছ—আমাদের অসংখ্য ভিউয়ার্স দরকার। তা ছাড়া স্পনসরদের কোটি-কোটি টাকার ব্যাপার। আর তুমি যদি জিতে যাও—’ হাসলেন শ্রীধর : ‘তা হলে একশো কোটি টাকার প্রাইজ মানি তো আছেই!’

জিশান সম্মোহিতের মতো চুপচাপ বসে ছিল। শ্রীধরের কথা শুনছিল। কিন্তু ও এখনও বুঝে উঠতে পারছিল না শ্রীধর পাট্টা কেন ওকে সাতসকালে ওঁর অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই ও অপেক্ষা করছিল।

‘জিশান—’ চেয়ারে একটু নড়েচড়ে বসলেন শ্রীধর : ‘আমরা এবার কিল গেমের প্রাোমোশনাল পাবলিসিটি শুরু করতে চাই। তুমি হয়তো টিভিতে দেখেছ তোমার কিছু-কিছু ভিডিয়ো ক্লিপিংস আমরা নানারকম প্রাোডাক্টের অ্যাডে ব্যবহার করছি। কিন্তু এবার আমরা ফুল সুইং-এ ক্যাম্পেন শুরু করতে চাইছি। অর্থাৎ, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে তোমাকে আমরা ব্যবহার করব—অবশ্য তার জন্যে তুমি পয়সা পাবে। এ ছাড়া কিল গেমের পাবলিসিটিতেও তোমাকে ভাগ নিতে হবে।

‘তুমি হয়তো জানো না, আমাদের কিল গেমের যে-লাইভ টেলিকাস্ট আমরা করি তার ভিউয়ার্সের সংখ্যা বিলিয়নস-এ হিসেব করতে হয়। টিভি আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই এক্সাইটিং গেম একেবারে জ্যান্ত হয়ে ঢুকে পড়ে সবার ঘরে। সুতরাং, তুমি রাতারাতি একটা ইন্টারন্যাশনাল ফিগার হয়ে যাবে। একবার ভাবো তো! কোথায় তুমি ওল্ড সিটিতে একটা কেন্নোর মতো ধুঁকে মরছিলে…সেখান থেকে একেবারে ইন্টারন্যাশনাল সেলিব্রিটি! তুমি ভাবতেই পারছ না..।’

শ্রীধরের কথা শেষ হওয়ার আগেই জিশান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল : ‘যদি আপনার আর কোনও কাজের কথা না থাকে তা হলে আমি এবার যাব—।’

শ্রীধর পাট্টা ভুরু উঁচিয়ে সামান্য কৌতুকের চোখে জিশানের দিকে তাকালেন। তারিফের গলায় বললেন, ‘দিস ইজ হোয়াট আই লাইক অ্যাবাউট য়ু। জোশ। তেজ। অথচ কুল ব্রেইন। এই ফ্যাকালটিগুলো তোমাকে নানান গেমে জিততে হেলপ করেছে—’ চেয়ারে হেলান দিয়ে শরীরটাকে দোলাতে লাগলেন : ‘বোসো, বাবু জিশান। শোনো আমার প্ল্যান…।’ এবার হাত দিয়ে জিশানকে বসতে ইশারা করলেন : ‘বোসো, বোসো…।’

জিশান বসে পড়ল আবার। তবে ওর মুখের বিরক্ত ভাবটা গোপন রইল না।

‘কেন তোমাকে এত কথা বলছি শোনো—’ ছোট বাচ্চাকে বোঝানোর মতো করে বলতে শুরু করলেন শ্রীধর, ‘কিল গেমের মোটামুটিভাবে একমাস আটদিন বাকি। এই সময়টা আমরা ইনটেনসিভ প্রাোমোশনাল ক্যাম্পেন করতে চাই। আমরা ফুল সুইং-এ যে-ক্যাম্পেন শুরু করতে চলেছি তাতে সবসময় তোমাকে দরকার হবে। ফলে তোমাকে নিউ সিটির হরেক জায়গায় নানান প্রাোগ্রামে যেতে হবে। তোমার ওপরে নজরদারির জন্য সর্বক্ষণ দু-চারজন গার্ডকে মোতায়েন রাখাটা আনইকনমিক এবং ইরিটেটিং। তা ছাড়া ব্যাপারটা নিউ সিটির সিটিজেনদের চোখে ভালোও ঠেকবে না। বরং তুমি যদি স্বাধীনভাবে সব জায়গায় যেতে পারো, সব প্রাোগ্রাম, অ্যাড ক্যাম্পেন অ্যাটেন্ড করতে পারো সেটা অনেক বেটার। মানুষ দেখবে স্বাধীন জিশান পালচৌধুরী নিউ সিটির যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। দ্যাট উইল বি গ্রেট, তাই না?’

জিশানের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য ওর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন শ্রীধর পাট্টা।

য়ুনিফর্ম পরা একজন লোক ট্রলি নিয়ে ঢুকল ঘরে। স্বচ্ছ কাপ-প্লেটে রাখা কফি আর কুকিজ সাজিয়ে দিল চারজনের সামনে। শ্রীধর ইশারায় সবাইকে কফি নিতে অনুরোধ করলেন। ওরা কাপে চুমুক দিতে শুরু করল।

কফির স্বাদটা তেতো লাগল জিশানের। ও একটা কুকিজ তুলে নিয়ে কামড় বসাল।

স্বাধীনতা? এই নামের কোনও বস্তু হয় নাকি শ্রীধর পাট্টার রাজত্বে?

জিশান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও দেখল, ওর পাশে বসা প্রৌঢ় দুজন অল্প-অল্প হাসছেন, শ্রীধরের কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ছেন।

‘হ্যাঁ, জিশান, তোমাকে আমি ফ্রিডম দেব…’ আবার কথা বলতে শুরু করলেন শ্রীধর, ‘তবে অ্যাবসলিউট ফ্রিডম নয়—কন্ট্রোলড ফ্রিডম। মানে, তুমি স্বাধীনভাবে যতই ঘোরাফেরা করো না কেন একটা প্রিঅ্যাসাইনড টাইমে তোমাকে জিপিসির গেস্টহাউসে ফিরে আসতেই হবে। রোজ। আর তুমি ফিরে আসবে নিজে-নিজে—কাউকে ধরে-বেঁধে নিয়ে আসতে হবে না। যেভাবে শুয়োর নিজে থেকে খোঁয়াড়ে ফিরে আসে। কী, তাই তো?’ শেষের প্রশ্নটা করলেন প্রৌঢ় দুজনের দিকে তাকিয়ে।

প্রৌঢ় দুজন হেসে সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন।

জিশান একটু ধন্দে পড়ে গেল। কন্ট্রোলড ফ্রিডম জিনিসটা আবার কী?

শ্রীধর প্রৌঢ় দুজনের দিকে হাতের ইশারা করে বললেন, ‘এরা হলেন আমাদের টেকনিক্যাল কমিটির চিফ আর আর্মামেন্ট ডিপার্টমেন্টের হেড। কন্ট্রোলড ফ্রিডমের বুদ্ধিটা ওঁরাই বের করেছেন। দারুণ বুদ্ধি, তাই না, জিশান? সারাটা দিন তুমি স্বাধীনভাবে খুশি মতো ঘুরে বেড়াবে, আর সময় হলেই নিজে-নিজে ফিরে আসবে, গুটিগুটি ঢুকে পড়বে খাঁচায়…।’

কথা শেষ করে হেসে উঠলেন শ্রীধর।

কীভাবে এটা সম্ভব? জিশান চিন্তার গোলকধাঁধায় ঘুরতে লাগল।

ঠিক তখনই ফ্যান টেইলড লাভ-বার্ডগুলো জোরে-জোরে ডেকে উঠল।

জিশান ভাবল, ওর জন্য হয়তো নতুন ধরনের কোনও ফোর্স ফিল্ডের ব্যবস্থা করেছেন শ্রীধর। ওই পাখিগুলোর মতো।

কিন্তু সেটা কী?

জিশান মনে-মনে কন্ট্রোলড ফ্রিডমের গূঢ় অর্থটা বুঝতে চেষ্টা করছিল, কিন্তু রহস্যটা ভেদ করতে না পেরে তিনজন মানুষের মুখের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। ওঁদের হাবভাব আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে রহস্যের সমাধানটা আঁচ করার নি:শব্দ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।

জিশানের মুখে একটা অসহায় বোকা-বোকা ভাব ফুটে উঠেছিল। শ্রীধর পাট্টার দিকে তাকিয়ে ও বুঝল শ্রীধর সেটা বেশ রসিয়ে উপভোগ করছেন।

জিশান আর ভাবতে পারছিল না। হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নীচু করল। অপেক্ষা করতে লাগল।

একটু পরেই শ্রীধরের কথা শুনতে পেল ও।

‘আমিই জিশানকে ব্যাপারটা খুলে বলছি। যদি টেকনিক্যাল কোনও পয়েন্ট আমি মিস করি তা হলে সেটা আপনারা—প্লিজ—জুড়ে দেবেন…।’

জিশান মুখ তুলল।

শ্রীধর সরাসরি ওর দিকে তাকালেন। ঠোঁটে একচিলতে হাসির ছোঁয়া। ওঁর ঠিক পিছনেই বিশাল জানলা। ফটোক্রোমিক ন্যানোপলিমার প্লেট লাগানো। এই প্লেটের প্রতিসরাঙ্ক বাতাসের প্রতিসরাঙ্কের ভীষণ কাছাকাছি। ফলে প্লেটটা লাগানো আছে কি নেই সেটা ঠিক বোঝা যায় না।

জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। ভোরের নীল আকাশ। তার সঙ্গে হাইরাইজ কয়েকটা বাড়ির জ্যামিতি।

আকাশে খেয়ালি মুডে ভেসে বেড়ানো বাচ্চা-বাচ্চা মেঘ। আর কখনও-কখনও তাদের চিরে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ব্যস্ত শুটার।

ঝরনার জলের কলকল শব্দ কানে আসছিল, আর লাভ-বার্ডগুলোর কিচকিচ। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

বেশ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পর শ্রীধর মুখ খুললেন।

‘জিশান, আজ রাতে তোমাকে আর্মামেন্ট ডিপার্টমেন্টের ”রিমোট অপারেশানস” ল্যাবে নিয়ে যাওয়া হবে। তোমার ওপরে প্রথমে ”গ্রিন টেস্ট” করা হবে। যার পারপাস হল, তোমার শরীরের সুটেবিলিটি পরীক্ষা করা যে, তুমি কন্ট্রোলড ফ্রিডম প্রাোগ্রামটা নিতে পারবে কি না।’

‘ ”গ্রিন টেস্ট”-এ কোয়ালিফাই করে গেলে তারপর আসল অপারেশান। একটা পলিমার কোটেড সিলভার ক্যাপসুল…।’

শ্রীধর হঠাৎই থমকে গেলেন। চওড়া করে হেসে বললেন, ‘না:, থাক—আর কিছু বলব না। য়ু ফাইন্ড আউট ইয়োরসেলফ।’ সামনে ঝুঁকে এলেন : ‘তুমি জানো, জিশান, লাইফ কেন এত ইন্টারেস্টিং?’

জিশান চুপ করে রইল। পাশের প্রৌঢ় দুজনও চুপচাপ। তবে একজনের চোয়াল নড়ছে। তিনি কিছু একটা চিবোচ্ছেন।

শ্রীধর টেবিলে আঙুলের টোকা মারলেন। ভুরু উঁচিয়ে জিশানের চোখে চোখ রেখে বললেন, ‘জিশান, লাইফ ইজ ইন্টারেস্টিং বিকজ…বিকজ ইট ইজ ফুল অফ সারপ্রাইজেস। আমাদের জীবনে অনেক লুকোনো চমক থাকে যেগুলো আমাদের বাঁচার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়। তুমি আমাদের চেয়ে অনেক লাকি, কারণ, তোমার লাইফে চমকের সংখ্যা অনেক বেশি—অন্তত তুমি নিউ সিটিতে আমাদের হাতে এসে পড়ার পর। আমি এই একটা চমক তোমার জন্যে বাঁচিয়ে রাখলাম। আজ রাতে…দশটার সময়…তুমি যখন ”রিমোট অপারেশানস” ল্যাবে যাবে তখনই জানতে পারবে, ”কন্ট্রোলড ফ্রিডম”-এর রহস্য। সো, য়ু মে লিভ নাউ। তোমার এখন ছুটি…।’

শ্রীধর আচমকা ছিলে ছেঁড়া ধনুকের মতো সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। মিটিং শেষের ইঙ্গিত।

জিশানও উঠে দাঁড়াল। একইসঙ্গে প্রৌঢ় দুজনও।

শ্রীধর জিশানের দিকে আঙুল দেখিয়ে প্রৌঢ় দুজনকে বললেন, ‘তা হলে রাত দশটায় জিশান আপনাদের চার্জে যাচ্ছে…।’

দুজনের মধ্যে একজন প্রৌঢ় বললেন, ‘কোনও চিন্তা করবেন না, স্যার—আমরা তৈরি আছি।’

শ্রীধর ছোট্ট করে হাসলেন। এই নিউ সিটিতে সবসময় তৈরি থাকাটাই দস্তুর।

চারজন সিকিওরিটি গার্ড জিশানকে ‘রিমোট অপারেশানস’ ল্যাবে পৌঁছে দিল।

হাতঘড়ির দিকে তাকাল জিশান। কাঁটায়-কাঁটায় সওয়া দশটা।

দরজার সামনে দাঁড়িয়েই গোটা ল্যাবটা প্রায় দেখা যাচ্ছিল। তার কারণ, চারদিকে শুধু কাচ আর কাচ। দরজা থেকে শুরু করে ল্যাবের সব দেওয়ালই কাচের। তার কোথাও-কোথাও স্টেইনলেস স্টিলের ফিটিংস আর কোথাও বা রঙিন পলিমার।

প্রায় ঘণ্টাখানেক আগে আর্মামেন্ট ডিপার্টমেন্টের হেড জিশানের সঙ্গে ইন্টারঅ্যাকটিভ টারমিনালে কথা বলেছেন। ‘রিমোট অপারেশানস’ ল্যাবের নানান টেস্ট আর ল্যাবের কাজকর্ম নিয়ে জিশানকে একটা ওপর-ওপর ব্রিফিং দিয়েছেন।

ওঁর কাছ থেকেই জিশান জেনেছে, এই ল্যাবের বিভিন্ন সাব-ল্যাবের চার্জে যাঁরা-যাঁরা আছেন তাঁরা ইচ্ছেমতো নিজের-নিজের অংশের কাচের দেওয়ালগুলোকে স্বচ্ছ কিংবা অস্বচ্ছ করতে পারেন। অর্থাৎ একটা স্বচ্ছ কাচকে অস্বচ্ছ করতে চাইলে ন্যানোঅপটিকস প্রযুক্তির জোরে চোখের পলকে সেই কাচটাকে সুপার-পোলারাইজড করে দেওয়া হয়। ব্যস, কাজ শেষ।

প্রযুক্তির এই অভিনব ‘ম্যাজিক’গুলো শেষ পর্যন্ত মানুষের ভালোর জন্য ব্যবহার করা হলে কত ভালো হত!

জিশানের বুকে ছোট্ট অথচ তীব্র একটা ব্যথা চিনচিন করে উঠল।

ঢোকামাত্রই জিশানকে ল্যাবের টিম টেকওভার করল।

ওকে প্রথমে পাঠানো হল স্টেরিলাইজিং স্ক্যানারের মধ্যে দিয়ে। তারপর কাচের গোলকধাঁধার ভেতরে এ-পথ সে-পথ দিয়ে হেঁটে অনেক ঘোরপ্যাঁচের পর ওকে তারা নিয়ে গেল একটা ল্যাবে।

ল্যাবের দরজায় লাগানো এল. সি. ডি. প্যানেলে লেখা ‘ফ্রিডম কন্ট্রোল ল্যাব’।

দরজা দিয়ে ঢুকেই বিশাল বড় মাপের একটা কাচের ঘর। ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে একটা সুন্দর মসৃণ কন্ট্রোল প্যানেল। তার ওপরে বেশ কয়েকটা সি. আর. টি. স্ক্রিন আর ডিজিটাল মিটার লাগানো। তাতে নানান গ্রাফ আর সংখ্যা নাচানাচি করছে।

প্যানেল থেকে হাত তিনেক দূরে একটা লম্বা টেবিলে তিনটে লার্জ স্ক্রিন আর্ক কম্পিউটার। সেগুলোর সামনে বসে দুজন অপারেটর।

বাঁ-দিকে একটা ছোট কন্ট্রোল প্যানেল আর তার সামনে একটা বড় মাপের অদ্ভুত চেয়ার।

অদ্ভুত এই কারণে যে, চেয়ারটা দেখতে অনেকটা ডেন্টিস্টের চেয়ারের মতো হলেও আসলে তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি। চেয়ারটার হাতলের কাছে বেশ কিছু জটিল যন্ত্রপাতি। পায়ের কাছেও কতরকম কনট্র্যাপশন আর অ্যাটাচমেন্ট।

সব দেখেশুনে জিশানের মনে হল, চেয়ারটা যেন কোনও ধর্মীয় পবিত্র বস্তু, কোনও ‘জাগ্রত’ দেবতার সিংহাসন—আর নানান মানুষ তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হওয়ার আশায় ঢিলের বদলে নানান যন্ত্রপাতির টুকরো চেয়ারটার গায়ে বেঁধে দিয়ে গেছে।

চেয়ারের ঠিক পাশটিতে কাঠ-কাঠ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল একজন ভীষণ রোগা তরুণী। পরনে হলুদ চুড়িদার, তার ওপরে বাদামি রঙের লেস দিয়ে বোনা একঝাঁক গোলাপ। গলায় একটা হলুদ ওড়না সাপের মতো প্যাঁচানো।

জিশান মেয়েটিকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। বয়েস কত হবে? খুব বেশি হলে পঁয়ত্রিশ কি ছত্রিশ। ওর রিমিয়ার কথা মনে পড়ে গেল।

মেয়েটির রং কেমন যেন ফ্যাকাসে ধরনের ফরসা। বেশ রোগা হলেও লম্বা। ছোট্ট মুখ—অনেকটা পুতুলের মতো। চোখ দুটো অস্বাভাবিক বড়। প্রজাপতির কোমল ডানার মতো নাকের দুপাশে মেলে আছে।

রিমিয়া খুব স্বপ্ন দেখত। আর এই মেয়ের চোখ দুটো স্বপ্নের মতো—এবং স্বপ্ন দেখানোর মতো।

ওর গলায় বাদামি ক্রিস্টালের একটা মালা। চোখের জলের মতো চিকচিক করছে। আর বাঁ-হাতের অনামিকায় একটা চিকন আংটি।

মেয়েটি এত চুপচাপ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে যে, জিশান ওকে প্রায় পুতুল বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। ঠিক তখনই মেয়েটি জিগ্যেস করল, ‘তুমি জিশান তো?’

প্রশ্নের সপ্রতিভ ঢঙে জিশান অবাক হয়ে গেল। বহুদিনের চেনা মানুষ এইভাবে প্রশ্ন করে। ওর একটু অস্বস্তি হল, কারণ, ল্যাব টিমের তিনজন মানুষ ঠিক এই মুহূর্তে জিশানের পিছনে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। আর কম্পিউটারের সামনে দুজন।

জিশান সহজভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘হ্যাঁ, আমি জিশান—।’

‘আমি ডক্টর সুধাসুন্দরী…না, না, হেসো না—’ হাত তুলে ইশারা করল মেয়েটি : ‘আমি জানি আমি সুন্দরী নই, কিন্তু কী করব, এটা আমার সত্যিকারের নাম…বাবা-মা দিয়েছিল।’

জিশান বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেল। মেয়েটি যে সুন্দরী নয় সেটা ওকে কে বলল? জিশানের তো পুতুলটিকে যথেষ্ট সুন্দর বলে মনে হচ্ছিল।

একে তো নামটা বেশ অদ্ভুত, পুরোনো-পুরোনো। তার ওপর অজানা অচেনা লোকের সঙ্গে কী আজব আন্তরিক কথাবার্তার ঢং! নিউ সিটিতে এটা নতুন।

‘শোনো, জিশান—এখন যে-কাজটা আমি করব সেটা আমার খুব অপছন্দের। কিন্তু করতে হবে—’ ঠোঁট ওলটাল : ‘কাজ তো কাজ!’

জিশান ওর পিছনে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে থাকা তিনজনের দিকে একবার তাকাল। ‘রিমোট অপারেশানস’ ল্যাবে ঢোকা ইস্তক এই তিনজন ওর সঙ্গে ছায়ার মতো জুড়ে গেছে।

দু-এক সেকেন্ডের দ্বিধা কাটিয়ে জিশান জিগ্যেস করে ফেলল, ‘কী কাজ?’

হাসল সুধাসুন্দরী : ‘তোমাকে ম্যাজিক শট দেওয়ার কাজ।’

‘ম্যাজিক শট?’ কপালে উঠল জিশানের ভুরু।

‘হ্যাঁ—স্পেশাল ইনজেকশান।’

কথা বলতে-বলতে সুধা ডানদিকের কন্ট্রোল প্যানেলটার কাছে চলে গিয়েছিল। ব্যস্তভাবে কয়েকটা বোতাম টিপল। দুটো মিটারের রিডিং খুঁটিয়ে দেখল। তারপর জিশানের দিকে ফিরে তাকিয়ে হাতে হাত ঘষল।

‘ও.কে., জিশান, আই অ্যাম রেডি। আই হোপ য়ু আর—।’

জিশান লক্ষ করল ওর ইংরেজি কথা বলার ঢং অনেকটা যেন সাহেবি ধাঁচের। ছোট্ট করে বলল, ‘আপনি রেডি হলেই আমি রেডি।’

‘চমৎকার। তা হলে ওই চেয়ারটায় শুয়ে পড়ো—।’

জিশান ল্যাবের চারপাশে তাকাল। তাকিয়েই অবাক হল। কখন যেন চারটে দেওয়ালের কাচ ঘোলাটে হয়ে গেছে। আর তার সঙ্গে-সঙ্গে ল্যাবের যে-উজ্জ্বল আলোগুলো এতক্ষণ তীব্র কর্কশ মনে হচ্ছিল সেগুলো যেন অনেকটা মোলায়েম হয়ে গেছে।

আরও কিছুক্ষণ ইতস্তত করে বিশাল চেয়ারটার কাছে চলে গেল জিশান। ওটাতে বসে পড়ল, নাকি শুয়ে পড়ল? উঁহু, ব্যাপারটা বসা এবং শোয়ার ঠিক মাঝামাঝি দাঁড়াল।

‘গুড বয়।’ সুধাসুন্দরী ওর কাছে এগিয়ে এল : ‘অ্যান্ড স্টে কুল লাইক আ গুড বয়।’

জিশান চেয়ারে শুয়ে সুধাকে দেখছিল।

ওই রোগা ফরসা পুতুল-পুতুল মেয়েটার ‘পুতুল-পুতুল’ ব্যাপারটা স্রেফ ওপরের চেহারাতেই শেষ। ওর ভেতরে রয়েছে দক্ষতা আর আত্মবিশ্বাসে ঠাসা একজন ডক্টর।

জিশান অবাক হচ্ছিল। এই মেয়েটা শ্রীধরের রাজত্বে এসে পড়ল কেমন করে?

জিশানের তিনজন সঙ্গী চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। বোকা-বোকা নজরে এদিক-ওদিক দেখছিল। ওদের কাজটাই বোধহয় জিশানের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকা।

আচমকা ওদের দিকে ডানহাত উঁচিয়ে কয়েকটা চুটকি দিল সুধা। মিষ্টি গলায় বলল, ‘আপনাদের এখন ল্যাবের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করার সময় এসে গেছে। দিস ইজ দ্য রুল অফ মাই ল্যাব।’

তিনজনের মধ্যে দুজন তক্ষুনি ল্যাবের দরজার দিকে রওনা হওয়ার ঝোঁক নিল, কিন্তু একজন একটু ইতস্তত করতে লাগল।

সেই লোকটা আমতা-আমতা করে বলল, ‘আমাদের বস বলেছেন জিশান পাল চৌধুরীর সঙ্গে-সঙ্গে থাকতে। ওকে এক মুহূর্তের জন্যেও ছেড়ে না যেতে…।’

সুধাসুন্দরী ঠান্ডা গলায় বলল, ‘কে তোমার বস জানি না, তবে হি ইজ ইয়োর বস আউটসাইড মাই ল্যাব। অ্যান্ড সো অল হিজ অর্ডারস সিম্পলি স্টপ আউটসাইড মাই ড্যাম ল্যাব ডোর। নিউ সিটির সবার সব অর্ডার আমার ল্যাবের দরজা পর্যন্ত এসে থেমে যায়—ভেতরে ঢুকতে পারে না…।’

কথা বলতে-বলতে সুধা কম্পিউটার-টেবিলের ওপর থেকে একটা সেল ফোন তুলে নিল। তাতে অটো ডায়াল করে ও-প্রান্তের কথা শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

জিশান লক্ষ করল সুধার কপালে ভাঁজ, আয়ত চোখে বিরক্তি।

প্রতিবাদী লোকটা তখনও বলছিল, ‘ডক্টর, প্লিজ, ভুল বুঝবেন না। আমাদের জিশানের সঙ্গে-সঙ্গে থাকার জন্যে স্ট্রং ইনস্ট্রাকশন দেওয়া হয়েছে। আমরা…।’

‘মার্শাল স্যার, সুধাসুন্দরী বলছি। ফ্রিডম কন্ট্রোল ল্যাব থেকে—।’

জিশান অবাক হয়ে গেল। সুধা সরাসরি শ্রীধর পাট্টার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে! ওর হাত এত লম্বা যে, শ্রীধরকে এককথায় ফোন করতে পারে?

শ্রীধরের গলা শোনা গেল, ‘ইয়েস, সুধা। বলো তোমার জন্যে কী করতে পারি।’

শ্রীধরের কথা শুনতে পাওয়ামাত্রই জিশান বুঝল ঘরের সবাইকে ও-প্রান্তের কথা শোনানোর জন্য সুধা ওর মোবাইল ফোনের স্পিকার অন করে দিয়েছে।

‘আমি এখন জিশান পাল চৌধুরীর ওপরে ”গ্রিন টেস্ট” শুরু করতে চলেছি। এসব টেস্ট কিংবা অপারেশানের সময়—আপনি তো জানেন—আমি আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজন ছাড়া আর কোনও লোকের প্রেজেন্স পছন্দ করি না। কিন্তু এখানে একজন রয়েছে—জিশানের এসকর্ট—সে বলছে কোনও অবস্থাতেই জিশানকে ছেড়ে যাবে না। ওর ওপরে নাকি অর্ডার আছে—’ সুধা ফোনে কথা বলছিল আর এসকর্ট তিনজনের দিকে বারবার তাকাচ্ছিল। মাঝে-মাঝে জিশানের দিকেও। ওদের একজন জিশানের চেয়ারের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে, আর বাকি দুজন ল্যাবের দরজার কাছে—অনেকটা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে।

একটু থেমে সুধাসুন্দরী বলল, ‘আপনি আমাকে দশ সেকেন্ডের মধ্যে ডিসিশান দেবেন, স্যার। না হলে আমি ইলেভেনথ সেকেন্ডে আমার রেজিগনেশান আপনাকে ই-মেলে সাবমিট করে দেব। বিকজ আমার ল্যাবে সায়েন্স ছাড়া আর কারও হুকুমে আমি চলি না।’

জিশান শুধু অবাক নয়, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। ও স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি শ্রীধর পাট্টার সঙ্গে এইভাবে কথা বলা যায়।

ও একদৃষ্টে বিজ্ঞানী মেয়েটাকে দেখছিল।

শ্রীধর পাট্টার শান্ত গলা শোনা গেল : ‘সুধা, তুমি ফোনটা প্লিজ ওই এসকর্টকে দাও—।’

সুধা জিশানের চেয়ারটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। প্রতিবাদী কর্মনিষ্ঠ এসকর্টটির হাতে নিজের ফোনটা তুলে দিল—কিন্তু একটাও কথা বলল না।

লোকটা ফোনটা কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে শ্রীধরের শান্ত গলা শোনা গেল : ‘তোমার নামটা কি জানতে পারি?’

লোকটার মুখ অনেকক্ষণ আগেই ফ্যাকাসে হতে শুরু করেছিল, এখন সেটা প্রায় ব্লটিং পেপারের কাছাকাছি। আর ওর শুকনো মুখে ভয়ের সিলমোহর।

কাঁপা গলায় ও বলল, ‘আ-আমার নাম বি-বিকাশ সাহা, স্যার।’

‘চমৎকার।’ বললেন শ্রীধর, ‘বিকাশ সাহা, তুমি এই মুহূর্তে ডক্টরের হাতে সেল ফোনটা ফেরত দিয়ে ল্যাব থেকে তোমার সাঙ্গপাঙ্গ কাচিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাও—।’

‘ও.কে., স্যার। ইয়েস, স্যার।’ বিকাশের গলা এবং শরীর কাঁপছে।

‘যদি ঘর থেকে বেরোতে তোমার পাঁচ সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে তা হলে আমি তোমার সুইচ পার্মানেন্টলি অফ করে দেব।’

‘খট’ করে লাইন কেটে দেওয়ার শব্দ হল। বিকাশ কাঁপা হাতে ফোনটা সুধাকে ফেরত দিল। এবং প্রায় আলোর গতিতে ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল।

ওর দুজন সাথী ওর আগেই ল্যাবের বাইরে চলে গেছে।

সুধাসুন্দরী ওর মোবাইল ফোনটা অফ করে কম্পিউটার-টেবিলে রেখে দিল। তারপর যেন কিছুই হয়নি এমন মুখের ভাব করে জিশানের চেয়ারের পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘জিশান, প্রথমে তোমার ”গ্রিন টেস্ট” হবে। সেই টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ হলে তবেই ম্যাজিক শট—মানে, ম্যাজিক ইনজেকশান…।’

জিশান একটা হাত তুলে বলল, ‘আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান—আগে আপনাকে কনগ্র্যাটস জানাই—তারপর ওসব টেস্ট-ফেস্ট হবে।’

‘কেন?’ সুধার ফরসা কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘যেভাবে আপনি মার্শালের সঙ্গে কথা বললেন…ওই ফোর্স, ওই কনফিডেন্স…ভাবা যায় না। না:, ডক্টর, আপনাকে সেলাম জানাই।’

জিশানের ভেতরে-ভেতরে একটা সত্যিকারের ঢেউ উথালপাথাল করছিল। আনন্দের ঢেউ। নিউ সিটিতে এরকম দৃপ্ত সাহসী মানুষ আর ক’জন আছে কে জানে!

সুধা জিশানের চোখে চোখ রেখে তাকাল। কিছুক্ষণ পর বলল, ‘জিশান, দুটো কথা। এক, তুমি আমার সঙ্গে ”আপনি-আপনি” করে কথা বলবে না। ”তুমি”-টা ”আপনি”-র চেয়ে অনেক বেটার, অনেক সুন্দর।’ সুধা এবার আঙুল তুলে ইশারায় দুই দেখাল : ‘আর দু-নম্বর কথা হল, ওই ফোর্স, কনফিডেন্স এটসেটরা…। আমি এখানে চাকরি করি, জিশান—কিন্তু তাই বলে এঁদের চাকর নই। আমি শুধু বিজ্ঞানের চাকর—আর কারও নয়।’

সুধাসুন্দরীর মুখে অদ্ভুত এক আলো দেখতে পেল জিশান।

সুধাসুন্দরী কথা বলছিল, আর একইসঙ্গে ব্যস্ত হাতে কাজ করছিল। কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে কতকগুলো মিটার রিডিং দেখল, একটা ছোট মাপের পুশবাটন প্যানেলে আঙুলের ডগা দিয়ে চটপট কয়েকটা বোতাম টিপল।

সঙ্গে-সঙ্গে দরজার কাছ থেকে একটা ‘ক্লিক’ শব্দ শোনা গেল আর দরজার কাচটা অস্বচ্ছ হয়ে গেল।

জিশানের কাছে এল সুধাসুন্দরী : ‘দরজাটা লক করে দিলাম। এবার তোমার ডানহাতটা চেয়ারের হাতলের ওপরে রাখো। হাতের চেটো ওপর দিকে—।’

জিশান কথা শুনল।

‘স্যামি! চিকি!’ আর্ক কম্পিউটারের সামনে বসে থাকা অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজনের দিকে ইশারা করে বলল সুধা, ‘পেশেন্টকে গ্রিন টেস্টের জন্যে রেডি করো—।’

পেশেন্ট! জিশান এখন তা হলে পেশেন্ট? অন্তত সুধার চোখে।

জিশান অপেক্ষা করতে লাগল। অপেক্ষা করতে লাগল সুধাও।

চিকি আর স্যামি কম্পিউটার ছেড়ে উঠে এল। ছিপছিপে চেহারার দুজন স্মার্ট যুবক। একজনের চোখের দৃষ্টিতে কৌতূহল মাখানো, আর-একজনের চোখ একেবারে নির্লিপ্ত, ঠান্ডা।

ঠান্ডা চোখের যুবকটি চটপট জিশানের কাছে এল। জিশানের দুটো হাত চেয়ারের হাতলের সঙ্গে ফাইবারের স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে দিল। তারপর সে উবু হয়ে বসে পড়ল জিশানের পায়ের কাছে। গোড়ালির গাঁটের ঠিক ওপরটায় শক্ত করে স্ট্র্যাপ বেঁধে দিল।

জিশান অবাক হয়ে সুধার দিকে তাকাল।

হাসল সুধা। বলল, ‘সেফটি, জিশান। কারণ এখন যে-টেস্টটা করব তাতে তোমাকে একটা স্পেশাল মেডিসিন ইনজেক্ট করতে হবে। যদি তাতে তোমার কোনও রিয়্যাকশন না হয় তা হলে ওয়েল অ্যান্ড গুড। কোনও প্রবলেম নেই। কিন্তু…’ জিশানের কাছে এগিয়ে এল সুধাসুন্দরী : ‘কিন্তু যদি রিয়্যাকশন হয় তা হলে…তা হলে তোমার ঝামেলা হবে। ঠিক দশ সেকেন্ড তোমার শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা হবে। তখন তুমি পাগলের মতো হাত-পা ছুড়তেও পারো। তাই এই স্ট্র্যাপ। সেফটি।’ আবার হাসল ও।

‘আর যদি কোনও রিয়্যাকশন না হয়, তা হলে?’

‘তা হলে তুমি গ্রিন টেস্টে পাশ। দশ মিনিট পরেই তোমাকে ম্যাজিক শট দেওয়া যাবে।’

দ্বিতীয় লোকটি একটা অদ্ভুত ট্রে নিয়ে এসে দাঁড়াল সুধাসুন্দরীর সামনে। ট্রে-তে স্বচ্ছ প্লাস্টিকের মোড়কে একটা খুব সরু ইনজেকশন সিরিঞ্জ। একজোড়া হালকা নীল রঙের রাবার লেটেক্স-এর গ্লাভস। একটা ছোট্ট ওষুধের শিশি। শিশিতে গাঢ় সবুজ রঙের একটা তরল। আর তার পাশে ছোট্ট গোলাপি সাবানের মতো দেখতে একটা কী যেন।

এতক্ষণে ‘গ্রিন টেস্ট’ নামের মানে বুঝতে পারল জিশান।

সুধাসুন্দরী কাজ শুরু করল রোবটের মতো যান্ত্রিক দক্ষতায়। লেটেক্স গ্লাভস পরে নিয়ে ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা বের করে নিল। ভায়ালে ছুঁচ ফুটিয়ে সবুজ তরলের প্রায় সবটাই টেনে নিল সিরিঞ্জে। ট্রে থেকে গোলাপি টুকরোটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে পড়ল জিশানের ওপরে।

টুকরোটা জিশানের ‘চিত’ করা ডানহাতের শিরার ওপরে ঘষতে-ঘষতে সুধাসুন্দরী বলল, ‘এটা সলিড স্টেরিলাইজার। আর সিরিঞ্জটার স্পেশালিটি হল, এটার ছুঁচটা ভীষণ শক্ত অথচ সরু—এত সরু যে, তুমি টেরই পাবে না এটা তোমার শিরায় ঢুকছে।’

‘আর এই সবুজ লিকুইডটা?’ জিশান জিগ্যেস করল।

‘ওটা একটা স্ট্রেঞ্জ কম্পাউন্ড…’ হাসল সুধা : ‘আমার আবিষ্কার…।’

‘আপনার…মানে, তোমার আবিষ্কার? সত্যি?’

‘হ্যাঁ—এতে অবাক হওয়ার কী আছে? জানো, বায়োকেমিস্ট্রির ফিল্ডে আমার তেতাল্লিশটা পেটেন্ট আছে!’

‘পেটেন্ট?’ অবাক হয়ে সুধার দিকে তাকাল জিশান : ‘সেটা আবার কী?’

‘সোজা কথায় বোঝাতে গেলে, আমার তেতাল্লিশটা আবিষ্কার আছে। সেই আবিষ্কারগুলোর মালিকানা রেজিস্ট্রি করার নামই হল পেটেন্ট…।’ সিরিঞ্জের তীক্ষ্ণ ডগাটা জিশানের হাতের শিরায় ছুঁইয়ে সুধাসুন্দরী বলল, ‘রেডি, স্টেডি, গো—!’

এবং সবুজ তরলটা জিশানের শিরায় ঢুকিয়ে দিয়ে তৎপরভাবে দু-পা পিছিয়ে দাঁড়াল। জিশানের চোখের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল। বোধহয় মনে-মনে এক-দুই গুনে দশ সেকেন্ড পার করছিল। আর ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজন কন্ট্রোল প্যানেলের ডিজিটাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল।

জিশান কোনও যন্ত্রণা টের পাচ্ছিল না। ও স্বাভাবিক গলায় সুধাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি তা হলে খুব নামকরা সায়েন্টিস্ট?’

‘কে জানে!’ ঠোঁট ওলটাল : ‘লোকে তো বলে।’

অ্যাসিস্ট্যান্ট দুজন সুধাকে লক্ষ করে হাতের ইশারা করল। যার অর্থ হল, দশ সেকেন্ড পার হয়ে গেছে।

‘তুমি গ্রিন টেস্টে পাশ করে গেছ, জিশান। য়ু আর নাউ এলিজিবল ফর গেটিং দ্য ম্যাজিক শট।’ হঠাৎই জিশানের মাথায় হাত দিয়ে ওর চুল ঘেঁটে দিল সুধাসুন্দরী। যেমন করে গুরুজনরা বাচ্চাদের আদর করে, অনেকটা সেইরকম।

‘আমার হাত-পা কি এখনও বাঁধা থাকবে?’ চোখের ইশারায় হাত-পায়ের স্ট্র্যাপগুলো দেখাল জিশান।

‘না, না, এক্ষুনি ওগুলো খুলে দিচ্ছি। চিকি—।’

চিকি যন্ত্রের মতো কাজ করতে শুরু করল।

‘এই দশটা মিনিট আমরা কীভাবে কাটাব?’ প্রশ্নটা করে জিশান সুধাসুন্দরীর দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে রইল।

সুধাসুন্দরী ইনজেকশনের সিরিঞ্জটা স্যামির ট্রে-তে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ম্যাজিক শট প্রিপেয়ার করো—।’ তারপর জিশানের দিকে তাকাল : ‘এখন আর ন’মিনিট বাকি আছে। এই সময়টা তোমার সঙ্গে আমি কথা বলতে পারি—ম্যাজিক শট নিয়ে।’

‘তাই? আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে—কী এই ম্যাজিক শট। এই ইনজেকশন নিলে কীভাবে কন্ট্রোলড ফ্রিডম পাওয়া যায়…।’

‘বলছি—’ বলে সুধাসুন্দরী স্যামির দিকে তাকিয়ে কয়েকটা টেকনিক্যাল ইনস্ট্রাকশন দিল। তারপর তাকাল জিশানের দিকে : ‘ছোট্ট একটা পলিমার কোটেড সিলভার ক্যাপসুল তোমার কানের নীচে আমি ইনজেক্ট করে দেব। সেই মোমেন্টটাই হল টাইম জিরো। তারপর থেকে ঠিক চব্বিশ ঘণ্টা পর তোমার ভীষণ জল তেষ্টা পাবে। ভয়ঙ্কর জল তেষ্টা। ডিমনিক থার্স্ট। তুমি কল্পনা করতে পারবে না এমন তেষ্টা।’

‘তেষ্টা পেলে জল খাব—সিম্পল।’ জিশান হালকাভাবে বলল।

‘উঁহু, ওটাই তো মজা! যত খুশি জল তুমি খাও না কেন, ওই তেষ্টা কিছুতেই কমবে না। কিছুতেই না।’

‘তা হলে?’

হাসল সুধা। বলল, ‘চব্বিশ-ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে আমার কাছে—এই ল্যাবে। আমি রিমোট অপারেশানে সিলভার ক্যাপসুলটাকে নেক্সট টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স-এর জন্যে রিচার্জ করে দেব। তখন তুমি আবার স্বাধীন—ইচ্ছেমতো নিউ সিটির যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারো—চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে।’ একটু থামল সুধা। স্যামির দিকে একপলক তাকিয়ে আবার চোখ ফেরাল জিশানের দিকে : ‘আই হোপ নাউ য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড হোয়াট ইজ কন্ট্রোলড ফ্রিডম—।’

‘জিশান মাথা নাড়ল ওপর-নীচে। হ্যাঁ, এবার ও ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে।

স্যামি একটা অদ্ভুত ধরনের পিস্তল আর একটুকরো সলিড স্টেরিলাইজার ট্রে-তে সাজিয়ে সুধাসুন্দরীর কাছে নিয়ে এল।

জিশানের ডানদিকের কানের নীচে স্টেরিলাইজার ঘষল সুধা। তারপর ট্রে থেকে অদ্ভুত ধরনের পিস্তলটা তুলে নিল।

জিশান লক্ষ করল, পিস্তলের নলটা অস্বাভাবিক মোটা, কালো রঙের। গুলির চেম্বারের গায়ে একটা ডিজিটাল ডিসপ্লে উইন্ডো। সেখানে কতকগুলো সংখ্যা দেখা যাচ্ছে।

সুধাসুন্দরী পিস্তলের নলটা জিশানের ডান কানের নীচে চেপে ধরল।

‘সরি, জিশান। এটা না করে আমার উপায় নেই।’

জিশানের ভেতরে কোনও প্রতিরোধ তৈরি হল না। ওর একটা মাংসপেশিও প্রতিরোধের প্রতিবর্তী ক্রিয়ায় শক্ত হল না। বরং মনে হল, আপাতভাবে ‘স্বাধীন’ হয়ে নিউ সিটিতে ঘুরে বেড়ানো যাবে, এটাই বা কম কী!

‘রেডি, স্টেডি, গো—।’ বলে পিস্তলের ট্রিগার টিপল সুধা।

ছোট্ট চাপা শব্দ হল। এবং জিশানের মনে হল একটা অন্ধকার কুয়োর ভেতরে ও পড়ে যাচ্ছে। পরিভাষায় যাকে বলে ‘ফ্রি ফল’।

ও পড়ছে তো পড়ছেই। পেটের ভেতরটা কেমন অদ্ভুতরকম খালি লাগছে।

কিন্তু একফোঁটাও যন্ত্রণা নেই।

বহুদূর থেকে একটা ফাঁপা নলের মধ্যে দিয়ে সুধাসুন্দরীর প্রতিধ্বনিময় গলা ভেসে এল, ‘স্টেডি, জিশান, স্টেডি—।’

হঠাৎই চোখের সামনে আলো ফুটে উঠল। চারপাশটা আবার স্বাভাবিক। ‘ফ্রিডম কন্ট্রোল ল্যাব’-কে আবার আগের চেহারায় দেখতে পেল জিশান। ওই তো সুধাসুন্দরী! ওই তো স্যামি আর চিকি!

সুধা হাসছিল : ‘উঠে দাঁড়াও, জিশান। এখন নিউ সিটির কোথাও তোমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। এনজয় ইয়োর ফ্রিডম…।’

‘থ্যাংকস—’ বলে জিশান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ডান কানের নীচে গলার পাশটায় হাত দিল। একটা মসৃণ চাকতি হাতে ঠেকল ওর। কেউ যেন একটা টিপ কপালের বদলে ওই জায়গাটায় শক্ত করে বসিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে একটু ব্যথা টের পেল ও।

‘ওটা পোস্ট অপস পলিমার সিল। ক্যাপসুলটা শরীরে ঢোকার জন্যে সামান্য যেটুকু ড্যামেজ হয়েছে সেটা আমি সিলিং গান দিয়ে সিল করে দিয়েছি। তখন তুমি ব্ল্যাক আউট স্টেটে ছিলে। তিন ঘণ্টার মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’

জিশান ল্যাবের ভেতরে কয়েক পা পায়চারি করল। না, শরীর কোনও অসুবিধের কথা জানান দিচ্ছে না। সমস্ত পেশি জিশানের নিয়ন্ত্রণেই আছে।

‘আমি কি তা হলে এখন যেতে পারি?’ জানতে চাইল জিশান।

‘হ্যাঁ—পারো।’ সুধাসুন্দরী বলল, ‘কিন্তু কাল তোমাকে রাত ন’টার সময় আমার এই ল্যাবে ফিরে আসতে হবে। যদিও এখন সময়…’ কন্ট্রোল প্যানেলের ঘড়ির দিকে তাকাল : ‘…রাত প্রায় এগারোটা, আমি সেফসাইডে থাকার জন্যে তোমাকে দু-ঘণ্টা আগে আসতে বলছি এবং সেই সময়টাই ফিক্স করেছি। তখন আমি তোমার কন্ট্রোলড ফ্রিডম আবার পরদিন রাত এগারোটা পর্যন্ত রিচার্জ করে দেব। ইনিশিয়াল শটের সময় ওই ক্যাপসুলটা যে-রেফারেন্স টাইম ওর মেমোরিতে স্টোর করে সেই টাইমটার আর নড়চড় হয় না। সো—’ হাতে হাত ঘষল সুধা। ভোরবেলা ফোটা ফুলের মতো প্রশান্ত আয়ত চোখ মেলে জিশানকে দেখল : ‘টুমরো ইভনিং, নাইন ও’ ক্লক। তোমার সঙ্গে রোজ এই ল্যাবে আমার দেখা হবে—।’

‘হ্যাঁ—কিল গেমের আগের রাত পর্যন্ত।’

এ-কথায় সুধা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘স্যামি তোমাকে সঙ্গে করে এখন নিয়ে যাবে। যা-যা ফরম্যালিটি আছে সেগুলো সেরে নেবে—।’

‘ফরম্যালিটি?’ জিশানের ভুরু কুঁচকে গেল।

‘হ্যাঁ—ফরম্যালিটি।’ মাথা নেড়ে বলল সুধাসুন্দরী, ‘রিমোট অপারেশানস ল্যাবে যাওয়া-আসার জন্যে তোমাকে একটা স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। প্রতিদিন রাত পৌনে ন’টা থেকে সওয়া ন’টার মধ্যে তুমি ওই কার্ড সোয়াইপ করে আমার এই ল্যাবে ঢুকে পড়তে পারবে।’

‘তা ছাড়া তোমাকে একটা সি. এফ. সি. স্মার্ট কার্ড দেওয়া হবে। মানে, ”কন্ট্রোলড ফ্রিডম সিটিজেন” কার্ড। নিউ সিটিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় নানা জায়গায় এই স্মার্ট কার্ডটা তোমার কাজে লাগবে। আর তোমাকে একটা পার্সোনাল গাড়িও দেওয়া হবে। তবে ওটা মার্শালের ব্যাপার। উনি ঠিক সময়ে ওটার ব্যবস্থা করে দেবেন।’

হঠাৎই জিশানের দিকে এগিয়ে এল সুধা। হাতটা বাড়িয়ে দিল। বলল, ‘তোমার হিরোইকস আমি টিভিতে দেখেছি। য়ু আর অ’সাম। লাস্ট পাঁচ বছরে তোমার মতো কেউ আসেনি। মনে হচ্ছে, তুমি মার্শালের হিসেব ওলটাতে পারবে। উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট ইন কিল গেম—।’

‘থ্যাংকস—’ বলে সুধার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা মুঠোয় নিল জিশান। হ্যান্ডশেক করল।

স্যামি জিশানের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। জিশান কী ভেবে ওকে বলল, ‘আপনি একটু ল্যাবের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান—আমি আসছি।’

চিকি তখন ওর কাজের টেবিলে চলে গেছে। ওর আর্ক কম্পিউটারের সামনে বসে পড়েছে।

জিশান চিকির দিকে একবার তাকাল। আন্দাজ করতে চেষ্টা করল, ও সুধাকে নীচু গলায় কোনও কথা বললে সেটা চিকি শুনতে পাবে কি না।

জিশান সুধার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে একটা কথা জিগ্যেস করব?’

‘কী কথা?’

প্রায় ফিসফিস করে জিশান বলল, ‘একটা ব্যাপার ভীষণ তাজ্জব লাগছে। তোমার মতো সুপার লেভেলের একজন সায়েন্টিস্ট শ্রীধর পাট্টার তৈরি নরকে বসে কী করছে—।’

সুধাসুন্দরীর মুখের উজ্জ্বল ভাবটা মিলিয়ে গেল। দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল ও। বোধহয় ভাবতে লাগল।

একটু পরে ও বলল, ‘কাল তো তুমি আসছ। কাল বলব।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল : ‘সত্যিই তো! এই নরকে আমার থাকার কথা নয়…।’

সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়ার পর গেস্টহাউসের ঘর ছেড়ে বাইরে এল জিশান। আজ ওর স্বাধীনতার প্রথম দিন।

সকাল সাতটার সময় অটোমেটিক প্লেট টিভি থেকে মিষ্টি গলার মেয়েটি জিশানের ঘুম ভাঙিয়েছে। তারপর ওর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছে।

‘গুড মর্নিং, জিশান।’

‘গুড মর্নিং—’ জিশানও পালটা বলল। ইন্টারঅ্যাকটিভ টিভিতে সে-কথা শুনতে পেল মেয়েটি।

দু-আঙুল তুলে জয়ের ‘ভি’ সংকেত দেখাল মেয়েটি : ‘স্বাধীনতা জিন্দাবাদ!’ তারপর হাসল।

‘থ্যাংকস।’

‘এখন কয়েকটা জরুরি কথা সেরে নিলে তোমার আপত্তি আছে?’

‘না, বলো—।’

‘আমাদের মার্শাল তোমার জন্যে একটা অটোমোবিল অ্যালট করেছেন। সেই গাড়িটা নীচের পার্কিং লটে এখন দাঁড়িয়ে আছে। তুমি আমাদের এই হাই-টেক গাড়ি প্রথম-প্রথম চালাতে পারবে না। তাই গাড়িতে একজন ড্রাইভার রয়েছে। এ ছাড়া তুমি গাড়িতে একটা প্যাকেট পাবে। তাতে জেনারেল প্যাকেট রেডিয়ো সারভিস আর গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম অ্যাক্টিভেট করা একটা স্যাটেলাইট ফোন রয়েছে—নিউ সিটিতে তুমি যতদিন আছ ফোনটা ততদিন তুমি ইউজ করবে। এ ছাড়া নিউ সিটি সম্পর্কে নানান তথ্য জানার জন্যে রয়েছে কয়েকটা ডিভিডি। গাড়ির ডিভিডি প্লেয়ারে তুমি ইচ্ছেমতো ওগুলো চালিয়ে দেখতে পারো—।’

‘নিউ সিটির কোথায় আমি যেতে পারব, আর কোথায় পারব না, তার কোনও ইনস্ট্রাকশন রয়েছে?’ জিশান জিগ্যেস করল।

‘হ্যাঁ, ওই প্যাকেটে রয়েছে তোমার সি. এফ. সি. স্মার্ট কার্ড। সিটির যে-যে জায়গায় তুমি বন্ধ দরজা পাবে সেখানে ঢোকার জন্যে তোমাকে এই সি. এফ. সি. কার্ডটা সোয়াইপ করতে হবে। তাতে দরজা যদি খুলে যায় তা হলে তুমি অ্যালাউড—আর না খুললে, নয়।

 ‘শোনো। ড্রাইভার ছেলেটির নাম গুনাজি। ভীষণ ব্রাইট বয়। ও তোমাকে সবরকমভাবে গাইড করবে, আর সব ব্যাপারে হেলপ করবে। বলতে গেলে ও তোমার লিভিং স্মার্ট কার্ড। ও.কে.?’

জিশান বলল, ‘ও.কে.।’

‘এনি ফারদার কোশ্চেন?’

জিশান ভেবে দেখল, ওর মনে এই মুহূর্তে আর কোনও প্রশ্ন নেই। তাই ও বলল, ‘থ্যাংক য়ু। নো কোশ্চেন।’

হাসল মেয়েটি : ‘গুড। তা হলে শেষ জরুরি কথাটা এবার বলি। টাকা। রাস্তায় বেরোলে তোমার কিছু খরচ হতে পারে। অনেকগুলো কমপিটিশানে জিতে তোমার এখন অনেক টাকা। সেই টাকা থেকে তুমি অনায়াসে খরচ করতে পারো। ওই সি. এফ. সি. স্মার্ট কার্ডই তোমার এটিএম কার্ড। তুমি নিউ সিটির যে-কোনও এটিএম কিয়োস্কে ওই কার্ড সোয়াইপ করে টাকা তুলতে পারো। তোমার এটিএম পিন গুনাজি তোমাকে বলে দেবে। হি ইজ আ ভেরি স্মার্ট বয়।’ হাত নাড়ল মেয়েটি, বলল, ‘বাই, জিশান—।’

‘বাই—।’

ইন্টারঅ্যাকটিভ টিভি অফ হয়ে গেল।

এখন, ব্রেকফাস্টের পর, জিশান ঘরের দরজা টেনে দিয়ে বাইরে বেরিয়েছে। পরনে ব্লু জিনস, কালো রঙের টি-শার্ট, কোমরে সরু কালো বেল্ট। বেল্টের সঙ্গে আটকানো একটা পাউচে মাইক্রোভিডিয়োফোনটা ঢুকিয়ে নিয়েছে। নিউ সিটিতে ঘুরে বেড়ানোর সময় মিনির সঙ্গে কথা বলতে চায় ও। শহরটা দেখতে কেমন তার একটা ধারাবিবরণী দিতে চায়।

গেস্টহাউস ছেড়ে নীচে নেমে পায়ে-পায়ে ফোয়ারার কাছে গিয়ে দাঁড়াল জিশান। ফোয়ারার দিকে তাকিয়ে ওর ফকিরচাঁদের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল ওর হতভাগ্য ভাইয়ের কথা। নেকরোসিটির কথা।

এদিক-ওদিক চোখ ফেরাল জিশান। এখন কী করে ও গুনাজিকে খুঁজে পাবে? ওর গাড়িটাই বা কোথায়?

হঠাৎই দেখল, মেন গেটের দিক থেকে অত্যন্ত রোগা লম্বা একটা ছেলে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ফরসা, খোকা-খোকা চেহারা। গোঁফের রেখা সদ্য গজিয়েছে। মাথার চুল সোনালি রঙে রাঙানো এবং হেয়ার জেলের দৌলতে বেশ খাড়া-খাড়া হয়ে আছে।

জিশানের কাছে এসে একগাল হাসল ছেলেটা। বিচিত্র ঢঙে সেলাম ঠুকে বলল, ‘স্যার, আমার নাম গুনাজি। ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে আমাকে একটা গাড়ি দিয়ে আপনার কাছে পাঠিয়েছে। আপনার সঙ্গে সবসময় থাকব আমি। প্রচুর সার্ভিস দেব—।’

জিশান অবাক হয়ে ছেলেটাকে দেখতে লাগল।

গুনাজির বয়েস বড়জোর উনিশ কি কুড়ি। টগবগে। চাবুকের মতো। মুখ থেকে কম বয়েসের ছটা বেরোচ্ছে।

কিন্তু ছেলেটা জিশানকে হঠাৎ সেলাম ঠুকল কেন? আর ‘স্যার’ই বা বলছে কেন?

এই ব্যাপারগুলো জিশান মোটেই পছন্দ করে না। তাই গুনাজিকে বলল ‘গুনাজি, তুমি আমার ড্রাইভার নয়—আমার মাস্টারমশাই। আমাকে তুমি গাড়ি চালানো শেখাবে। আর একইসঙ্গে তুমি আমার গাইড, আমার বন্ধু। তুমি আমাকে ”স্যার” বলবে না, আর ওইরকম বোকা-বোকা সেলামও ঠুকবে না—।’

জিশানের কথায় ছেলেটা একটু দমে গেল যেন। তারপর বলল, ‘আপনার মতো করে কেউ কখনও বলেনি—সেই ষোলো বছর বয়েস থেকে গাড়ি চালাচ্ছি—।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর : ‘তবে আপনাকে সেলাম ঠুকেছি অন্য কারণে।’

‘কী?’

‘আপনার সমস্ত গেম আমি টিভিতে দেখেছি। আপনি এককথায় সুপার। আপনার মতন কাউকে দেখিনি। তা ছাড়া পিট ফাইটের সময় আপনি লাস্ট মোমেন্ট পর্যন্ত মাথা ঠান্ডা রেখেছিলেন। পাবলিক হাজারটা ওসকানি দেওয়া সত্বেও আপনি জাব্বাকে মেরে ফেলেননি—ছেড়ে দিয়েছেন। সেলামটা সেইজন্যে—।’

জিশান ছেলেটাকে দেখতে লাগল। ও তখনও কথা বলছিল।

‘আসলে আমাদের এই শহরটা থেকে দয়া, মায়া, ক্ষমা—এসব উঠে গেছে। তাই টিভিতে অনেকদিন পর সেটা দেখে খুব ভালো লেগেছিল। আমার কখনও যদি আপনাকে সেলাম করার ইচ্ছে হয় সেটা কিন্তু স্যার বারণ করবেন না।’

‘আবার স্যার?’

‘সরি।’ লাজুক হাসল গুনাজি। আঙুল তুলে বাইরের দিকে দেখাল : ‘চলুন, গাড়িটা ওইদিকে ডান সাইডে পার্ক করা আছে—।’

ওর সঙ্গে হাঁটা দিল জিশান। গুনাজির পাশাপাশি হাঁটতে ওর কেন জানি না ভালো লাগছিল।

ফোয়ারার জলে সকালের রোদ চিকচিক করছিল। অসংখ্য সোনার কুচি। জিশানের চোখ পলকের জন্য আটকে গেল।

তারপর আকাশের দিকে তাকাল। আজ অনেক বেশি নীল লাগছে। সেখানে বেশ কয়েকটা পাখি চোখে পড়ল। ডানা খেলিয়ে উড়ে যাচ্ছে।

জিশানের পাখি হতে ইচ্ছে করল। কন্ট্রোলড ফ্রিডম নয়—ওর টোটাল ফ্রিডম চাই। ওর একার জন্য নয়—সকলের জন্য।

জিশান একটা স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল।

ঠিক তখনই গুনাজি ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে জিগ্যেস করল, ‘আপনার গায়ে খুব জোর, তাই না?’

জিশান ওর দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘শুধু গায়ে নয়, গুনাজি—মনেও জোর চাই…।’

বাতাসে পাখির পালক যখন ভেসে যায় তখন যে-কোমলতার স্পর্শ অনুভব করা যায় জিশানের ঠিক তেমনটাই লাগছিল। গুনাজি যেন গাড়ি চালাচ্ছিল না, একটা তুলতুলে পালক ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল নিউ সিটির নিখুঁত পরিপাটি রাস্তায়।

চারপাশে তাকালেই ছবির মতো সব বাড়ি, ছবির মতো মসৃণ রাস্তাঘাট, পার্ক, গাছপালা, বাগান, লেক। ছবিটা সবমিলিয়ে খুবই সুন্দর, তবে এটা যে ‘বাইরের’ ছবি সেটা জিশানের মনে পড়ল। ‘ভেতরের’ ছবিটা দেখার জন্য জিশান চোখ বুজল—কয়েক সেকেন্ড চোখ বুজে রইল।

গুনাজি গাড়ি চালাচ্ছিল আর টগবগ করে কথা বলছিল। জিশানকে ওর স্যাটেলাইট ফোনটা দিয়ে তার নানান বোতামের ব্যবহার বুঝিয়ে দিচ্ছিল। কী করে ফোন করতে হয়, কী করে ফোন ধরতে হয়, কী করে জি. পি. আর. এস. আর. জি. পি. এস ব্যবহার করতে হয়—এইসব।

‘তুমি এত কিছু শিখলে কী করে?’ জিশান ওকে জিগ্যেস করল।

গাড়ির সামনের কাচে চোখ রেখে হাসল গুনাজি : ‘স্যাটেলাইট ফোন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার স্বভাব। তা ছাড়া আমাদের নিউ সিটির ”ডেটা কমিউনিকেশান সেন্টার”-এ আমি ছ’মাস ট্রেনিং নিয়েছি। আমি লাস্ট দেড় বছর ধরে সবাইকে স্যাটেলাইট ফোন অপারেট করা শেখাই আর সি থ্রু অটোমোবিল চালানো শেখাই। এই কাজটা আমার খুব ভালো লাগে…।’

যে-গাড়িটা গুনাজি জিশানের জন্য নিয়ে এসেছে সেটা ব্যাটারিতে চলে এবং সেটা সি থ্রু। অর্থাৎ, গোটা গাড়িটা স্বচ্ছ ফাইবারের তৈরি। তার ভেতরের বিভিন্ন পার্টস, মোটর, ক্লাচ, গিয়ার বক্স, ডিফারেনশিয়াল গিয়ার—সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গাড়ির ডিজাইন এরোডায়ানামিক এবং একইসঙ্গে আরগোনোমিক। ছুটে যাওয়া গাড়িটাকে যাতে দেখতে কারও অসুবিধে না হয় তার জন্য গাড়িকে ঘিরে ফাইবারের বডির ওপরে ছ’ইঞ্চি চওড়া ফ্লুওরেসেন্ট ব্লু রঙের উজ্জ্বল পটি আঁকা আছে। এই নীল রং দিনে কিংবা রাতে নীল আগুনের মতো জ্বলজ্বল করে।

গাড়িটাকে দেখেই জিশানের তাক লেগে গিয়েছিল। সে-কথা গুনাজিকে বলতেই ও বলল, ‘এ-গাড়িটা ইমপোর্ট করা, স্যার…।’

‘আবার ”স্যার”?’ জিশান বকুনির ঢঙে বলল।

‘না, স্যার—মানে, দাদা। এটা ইমপোর্টেড গাড়ি। তবে কিউ মোবাইলের চেয়ে দামে সস্তা। এ-গাড়ি নিউ সিটিতে অনেক আছে।’

জিশান গাড়ির ভেতরটা অবাক হয়ে দেখছিল। অটো এয়ারকন্ডিশানিং সিস্টেম। অটো নেভিগেশান স্ক্রিন। স্মার্ট গিয়ার। ইন্টেলিজেন্ট কন্ট্রোল। আরও কত কী!

গুনাজি জীবন্ত ‘ম্যানুয়াল’ হয়ে জিশানকে সি থ্রু অটোমোবিল নিয়ে জ্ঞান দিচ্ছিল। ওর কথায় বোঝা যাচ্ছিল, এই গাড়ির কারিগরি নিয়ে ও অনেক সময় খরচ করেছে।

জিপিসি-র গেস্টহাউস থেকে গাড়ি ছাড়ার একটু পরেই জিশান গুনাজিকে বলেছে, ‘গুনাজি, আজ কিন্তু আমি গাড়ি চালানো শিখব না। আজ তুমি নানান জায়গায় ঘুরে আমাকে শহরটা চেনাবে, কেমন?’

‘যা বলবেন…।’

সেই কথামতো জিশানের গাড়ি শহরের নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। কখনও শহরের পার্ক, কখনও লেক, কখনও অফিসপাড়া, কখনও বা সুপারগেমস কর্পোরেশানের বিল্ডিং কিংবা সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টার।

শহরটা দেখতে-দেখতে জিশানের মনখারাপ হয়ে যাচ্ছিল। কারণ, ওর ওল্ড সিটির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। ওর শহরটা একমনে গড়িয়ে যাচ্ছে ক্ষয়ের দিকে।

গাড়ির কন্ট্রোলের দিকে নজর রেখেছিল গুনাজি। আর একইসঙ্গে জিশানের গাইডের কাজ করছিল। শহরের নানান জায়গা সম্পর্কে ও যতটুকু জানে সেটাই অন্তরঙ্গভাবে জিশানকে বলার চেষ্টা করছিল।

শহরের রাস্তাঘাটে পথচারী মানুষজন প্রায় চোখেই পড়ে না। শুধু গাড়ি আর গাড়ি। নানান মাপের, নানান রঙের, নানান ঢঙের। শহরটা যেন শুধু যন্ত্র দিয়ে ঠাসা—ভাবল জিশান। কিন্তু গাড়িগুলো সব ব্যাটারি ড্রিভেন হওয়ায় আকাশ-বাতাস পরিষ্কার—দূষণের ছোঁয়া টের পাওয়া যায় না।

একটা ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে জিশানের গাড়ি ছুটছিল। নীচের দিকে তাকিয়ে জিশান হঠাৎই দেখতে পেল একটা সবুজ জঙ্গল। আকারে চৌকো। তার এক-একদিকের বাহুর মাপ চারশো কি পাঁচশো মিটার হবে।

‘নীচে ওটা কি, গুনাজি?’

‘ওটা পাখির বাসা।’

‘পাখির বাসা মানে?’ অবাক হয়ে গুনাজির দিকে তাকাল জিশান।

জিশানের দিকে চোখ ফেরাল গুনাজি। হাসল : ‘বার্ড স্যাংচুয়ারি, দাদা। আমি শর্টে বলি পাখির বাসা—।’

জিশান হেসে ফেলল।

গুনাজি বলল, ‘এ শহরে এরকম মোট দশটা স্যাংচুয়ারি আছে—শুধু পাখির জন্যে। ওই মিনি জঙ্গলগুলোয় পাখি ছাড়া আর কিছু নেই। যে-কেউ ইচ্ছে করলে টিকিট কেটে ওই জঙ্গলে ঢুকে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবে তার গায়ে মাইক্রো-ক্যামেরা ফিট করে দেওয়া হয়—যাতে পাখিদের কোনও ক্ষতি করতে না পারে। পাখি ধরতে বা মারতে চেষ্টা করলে জঙ্গলের সিকিওরিটি গার্ডরা তাদের মনিটরে সেটা দেখতে পাবে। আর তখনই শাস্তি—।’

‘কী টাইপের শাস্তি?’ জিশান জানতে চাইল।

‘এসব কেসে শাস্তি হচ্ছে ফাইন—মানে, টাকা। আর টাকার ফিগারটা এমন যে, তার ইকনমিক ইনডেক্স পড়ে যেতে পারে। মানে, বাই-বাই নিউ সিটি হয়ে যেতে পারে—।’

জানলা দিয়ে নীচে তাকাল জিশান। আরও একটা পাখির বাসা ওর চোখে পড়ল। শহরের মধ্যে দশ-দশটা পাখির অভয়ারণ্যের ব্যাপারটা ওর ভালো লাগল।

‘গুনাজি, শহরের মধ্যে পাখি ছাড়া আর কিছুর স্যাংচুয়ারি নেই?’

‘না, আর যা আছে সব শহরের বাইরে। নিউ সিটির মধ্যে শুধু পাখি। কারণ, আমাদের মার্শাল পাখি ভালোবাসেন…।’

জিশানের মনে পড়ে গেল শ্রীধরের অফিসের ফ্যানটেইলড লাভবার্ডস- গুলোর কথা। আর একইসঙ্গে মনে পড়ল পাখিগুলোর ‘কন্ট্রোলড ফ্রিডম’-এর কথা।

কিন্তু এই অভয়ারণ্যের পাখিগুলোর স্বাধীনতায় শ্রীধর পাট্টা কোনওরকম খবরদারি করেননি।

শহরের নানান জায়গায় জিশান অনেক ফ্লাইওভার দেখতে পাচ্ছিল। বিশাল-বিশাল, রামধনুর মতো তাদের চেহারা। আর তাদের প্রত্যেকের গায়ে লাল, নীল, হলদের মতো উজ্জ্বল রং। আর সবক’টাই এক অলৌকিক উপায়ে কোনওরকম পিলার ছাড়াই শূন্যে ভেসে আছে।

এখন যদি একটা সত্যিকারের রামধনু ওঠে তা হলে দারুণ হয়। ভাবল জিশান।

শহরে ঘোরাঘুরির পথে গুনাজির গাড়ি এক ফ্লাইওভার ছেড়ে আর-এক ফ্লাইওভারে উঠছিল। জিশানের মনে হচ্ছিল, ও নানান পাহাড়ে উঠছে আর নামছে। আর সেই ‘পাহাড়’ থেকে দেখতে পাচ্ছে গাছপালা, হাই-রাইজ, উড়ে যাওয়া পাখি আর শিস দিয়ে ছুটে যাওয়া শুটার।

দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে নেওয়ার জন্য একটা ফুড মলের কাছে গাড়ি পার্ক করল গুনাজি।

প্রায় দশতলা উঁচু মল-বিল্ডিং। বাইরের চেহারা সুষম বহুভুজের মতো। পুরোটাই কাচে ঢাকা। আর বিল্ডিংটা খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে খুব ধীরে-ধীরে ঘুরছে। বিল্ডিং-এর নানান তলায় বসে থাকা লোকজনকে আকাশের ছায়া-মাখা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে।

শহরের বৈভব আর কারিগরি দক্ষতা জিশানকে যেন আবার নতুন করে ধাক্কা দিল।

গাড়ি থেকে নামার আগে গুনাজি বলল, ‘দাদা, সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে নিন। আর এই ব্লু ক্যাপটা মাথায় পরে নিন—’ গাড়ির পিছনের সিট থেকে একটা ব্যাগ তুলে নিয়ে তার ভেতরে হাত ঢোকাল গুনাজি। একটা সানগ্লাস আর একটা নীল টুপি জিশানের হাতে দিয়ে বলল, ‘আমার ওপরে এরকমই ইনস্ট্রাকশন আছে। এই সানগ্লাস আর টুপি না পরলে পাবলিক চট করে আপনাকে চিনে ফেলতে পারে। তখন ভিড়-টিড় জমে গিয়ে ঝামেলা হবে…।’

জিশান গুনাজির দেওয়া জিনিস দুটো চোখে আর মাথায় পরে নিল। তারপর গাড়ি থেকে নামল।

খাওয়াদাওয়া আর আরামে ঘণ্টাদেড়েক কেটে গেল। মাইক্রোভিডিয়োফোনে মিনির সঙ্গে কথা বলল জিশান। প্রতিদিনের বরাদ্দ দশমিনিট থেকে কিছু-কিছু করে সময় জমিয়ে জিশানের টকটাইম ব্যালান্স এখন এক ঘণ্টারও বেশি। ওর মনে হয়েছে, কিল গেমে যাওয়ার আগের কয়েকটা দিন মিনির সঙ্গে ওর অনেক বেশি সময় ধরে কথা বলতে ইচ্ছে করবে। তাই ও গত একমাস ধরেই এমভিপি-র সময় জমাচ্ছে।

গুনাজি আবার যখন গাড়িতে স্টার্ট দিল তখন জিশান ‘ছদ্মবেশ’ খুলে রেখে মিনি আর শানুর ভাবনায় ডুবে আছে।

গাড়ি চালাতে-চালাতে গুনাজি বলল, ‘দাদা, আমরা এবার সেন্ট্রাল লেকের দিকে যাচ্ছি। এটা শহরের খুব সুন্দর জায়গা। লেকটা মাপে এত বড় যে, এপার থেকে ওপার দেখা যায় না। আর সাহেবদের চোখের মতো নীল জল…।’

ওর তুলনার ঢঙে জিশান হেসে ফেলল। একইসঙ্গে ওল্ড সিটির মা আর ছেলের চিন্তার জাল ছিঁড়ে পলকে চলে এল সি থ্রু অটোমোবিলে। ও গুনাজির দিকে একপলক তাকিয়েই চোখ ফেরাল সামনের দিকে। গাড়ির স্ক্র্যাচপ্রুফ স্বচ্ছ পলিমার উইন্ডশিল্ডটা এমন যে, আছে বলে চট করে বোঝা যায় না।

গাড়ি ছুটে চলল আরও চারমিনিট কি পাঁচমিনিট—তারপরই চোখ-জুড়োনো একটা জায়গায় জিশানরা পৌঁছে গেল।

সীমাহীন একটা হ্রদ। তার জল সত্যিই সাহেবদের চোখের মতো নীল। যেদিকে তাকানো যায় শুধু নীল আর নীল। সেই নীলের বুক চিরে চওড়া কালো ফিতের মতো রাস্তা। রাস্তার দুপাশে হলদে রঙের পাম গাছের ঘন সারি, আর সেগুলোর কোল ঘেঁষে ধবধবে সাদা ছোট-ছোট কটেজ।

রাস্তা থেকে নেমে ঘাসে ছাওয়া জমির ওপরে গাড়ি থামাল গুনাজি। জিশান আবার রোদচশমা আর টুপি পরে নিল। তারপর ওরা দুজনে গাড়ি থেকে নেমে লেকের কিনারায় গিয়ে দাঁড়াল।

লেকের অন্তত একশো মিটার ওপর দিয়ে পাঁচটা রঙিন ফ্লাইওভার চলে গেছে। ওগুলো কী করে শূন্যে ঝুলে আছে জিশান ভেবে পেল না। নিউ সিটির প্রযুক্তিকে মনে-মনে সেলাম দিল জিশান।

সামনে তাকালে দেখা যায়, দূরে—বহুদূরে লেকের নীল জল ঝাপসা সবুজ এক পাহাড়ে গিয়ে মিশেছে।

আর পিছনে, প্রায় সমান দূরে, চোখে পড়ছে হাই-রাইজের সারি।

‘এই হল আমাদের সেন্ট্রাল লেক।’ গুনাজি বলল, ‘নিউ সিটির সবচেয়ে অ্যাট্রাকটিভ টুরিস্ট স্পট। ওই যে কটেজগুলো দেখছেন—’ আঙুল তুলে কটেজগুলো দেখাল : ‘ওগুলোর চার্জ এত ভয়ংকর যে, শুধুমাত্র নিউ সিটির ব্যাপক বড়লোকরাই ওখানে থাকতে পারে। আর এখানকার হিসেবে যারা গরিব, তারা এখানে গাড়ি নিয়ে আসে, একটু ঘোরে-ফেরে, নৌকো চড়ে লেকে রাইড নেয়—তারপর সন্ধে হলে চলে যায়…।’

চারপাশে তাকিয়ে অনেক মানুষজন দেখতে পেল জিশান। লেকের কিনারায় অলস পায়ে বেড়াচ্ছে। বড়দের পাশাপাশি ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরাও রয়েছে।

এ ছাড়া লেকের নীল জলে সুন্দর ছাঁদের রঙিন নৌকো ভেসে রয়েছে। বেড়াতে আসা মানুষরা তাতে বসে আনন্দে হইচই করছে।

প্রাণ ভরে দৃশ্যগুলো দেখতে লাগল জিশান। সত্যি, পৃথিবীটা কী সুন্দর! কিল গেমে যাওয়ার আগের দিন পর্যন্ত ও রোজ একবার করে এখানে আসবে। নিজেকে বারবার করে বিশ্বাস করাবে, পৃথিবী অপরূপ, অলৌকিক। নিউ সিটির যে-ভয়ংকর রূপ সেটা সাময়িক এবং লৌকিক।

সূর্যের দিকে তাকাল জিশান। বেলা সাড়ে তিনটের সূর্য খানিকটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। নীল লেকের জলে তার উজ্জ্বল ছায়া।

আরামের বাতাস বইছিল। হ্রদের জলে কাঁপন ধরিয়ে শিরা উঠছিল। জিশান চোখ বুজে দাঁড়িয়ে বাতাসটা শরীর শুষে নিতে চাইছিল। তখনই কয়েকটা পাখির শিস ওর কানে এল।

চোখ বুজে এক অদ্ভুত সৌন্দর্যকে অনুভব করতে লাগল জিশান।

একটু পরে চোখ খুলে ও তাকাল গুনাজির দিকে : ‘গুনাজি, আমরা কি একটা বোট নিয়ে লেকে বেড়াতে পারি?’

‘হ্যাঁ, দাদা—পারি।’ হাসল ছেলেটা : ‘আপনার সি. এফ. সি. স্মার্ট কার্ডটা দিন—আমি সোয়াইপ করে আনছি…।’

কার্ডটা নিয়ে লেকের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘লেক কন্ট্রোল রুম’-এর দিকে চলে গেল গুনাজি। এবং ফিরে এল পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। তারপর নীল রঙের একটা হাইটেক স্মার্ট বোট নিয়ে ওরা লেকের জলে ভেসে পড়ল।

বোটগুলোয় কোনও চালক নেই। সবটাই প্রি-প্রাোগ্রামড। ফলে চালানোর কোনও ব্যাপার নেই, স্টিয়ারিং ঘোরানোর কোনও ব্যাপার নেই। শুধু আরাম করে বসে থাকলেই হল। নৌকো নিজের মনে চলবে। তার অটোনেভিগেশান এমনই যে, কোনও একটা নৌকোর সঙ্গে আর-একটা নৌকোর কখনওই ধাক্কা লাগবে না। আর নির্দিষ্ট সময় পার হলেই নৌকো পাড়ের কাছে স্টার্টিং পয়েন্টে আবার ফিরে আসবে।

নীল জলের ওপরে জিশানদের নীল রঙের বোট ভেসে বেড়াচ্ছিল। জলের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে জল আর আকাশ মাখামাখি। তারই মাঝে ফ্লাইওভারগুলো কালো ছায়ার দাগ টেনে হ্রদের জলকে চিরে দিয়েছে।

হঠাৎই একটা সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেল।

আওয়াজটা এসেছে ওপরদিক থেকে।

সঙ্গে-সঙ্গে জিশান আর গুনাজি মাথা তুলে তাকাল আকাশের দিকে। দেখল, ফ্লাইওভারের রেলিং ভেঙে একটা সি থ্রু অটোমোবিল ছিটকে গেছে শূন্যে। নীল আকাশের বুকে গাড়ির স্বচ্ছ ফাইবারের বডি সূর্যের আলোয় ঝকঝক করছে। গাড়িটা শূন্যে লাট খেতে-খেতে নেমে আসছে নীচে।

লেকে ভেসে বেড়ানো বোটের যাত্রীরা চিৎকার করে উঠল। সে-চিৎকারে আতঙ্ক ছিল, কারণ প্রতিটি বোটই অটোনোভিগেশানে চলছে। শূন্যে বাতাস কেটে গাড়িটা যেভাবে নেমে আসছে তাতে ওটা যে-কোনও বোটের ওপরে এসে পড়তে পারে।

লেক কন্ট্রোল রুম থেকে বোধহয় কিছু একটা করল, কারণ, হঠাৎই সবক’টা নৌকো ছুটতে শুরু করল পাড়ের স্টার্টিং পয়েন্টের দিকে।

আর তখনই গাড়িটা উল্কার মতো ধেয়ে এসে লেকের নীল জলে ‘ঝপাস’ শব্দ তুলে আছড়ে পড়ল। পড়েই বেশ কয়েক হাত লাফিয়ে উঠল, তারপর আবার আছড়ে পড়ল।

লোকের জল বিস্ফোরণের স্প্লিন্টারের মতো চারিদিকে ছিটকে গেল। সেই জলে নৌকোয় বসা অনেক লোকের জামাকাপড় ভিজে গেল। যাত্রীদের হইচই চিৎকার কিছুতেই থামছিল না। গাড়িটা যে কোনও নৌকার ওপরে আছড়ে পড়েনি তার জন্য লোকজনের সেই চিৎকারে আতঙ্কের চেয়ে এখন আনন্দের ছাপ ছিল অনেক বেশি।

গাড়ির মধ্যে একটা ছেলেকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। পাগলের মতো বেরোনোর চেষ্টা করছে গাড়ি থেকে, কিন্তু গাড়ির দরজা কিছুতেই খুলছে না। বরং গাড়িটা ধীরে-ধীরে লেকের জলে ডুবে যাচ্ছে।

অতটা উঁচু থেকে গাড়িটা পড়ার পরেও ছেলেটা যে বেঁচে আছে সেটা জিশানকে অবাক করেছিল। সে-কথা গুনাজিকে বলতেই ও বলল, ‘এখানকার সব গাড়িতেই অ্যান্টি-কলিশান এয়ারব্যাগ থাকে। হঠাৎ করে ছুটন্ত গাড়ি থেমে গেলে—মানে, কোনও কিছুতে ধাক্কা খেয়ে আচমকা গাড়ির স্পিড কমে গেল—ওই এয়ারব্যাগ 0.1 সেকেন্ডের মধ্যে ফুলে ওঠে আর ড্রাইভারের মাথাটা ঘিরে বসে যায়। ফলে ড্রাইভার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেঁচে যায়। আর ড্রাইভারের পাশে যে বসে সে-ও একইভাবে সেভ হয়ে যায়…।’

গাড়িটা তখনও ডোবেনি, আর ছেলেটাও গাড়ির ভেতরের দেওয়ালে কিল-ঘুসি মারছিল। বন্ধ গাড়ির ভেতর থেকে ওর চাপা চিৎকারও শোনা যাচ্ছিল।

জিশান বুঝতে পারছিল, এইভাবে ছেলেটা আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারবে না। তখন অ্যান্টি-কলিশান এয়ারব্যাগের ব্যাপারটাই মাঠে মারা যাবে। ব্যাগটা ওকে ইমপ্যাক্ট ইনজুরি থেকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু লেকের জল তো ওকে রেহাই দেবে না!

চারপাশে খুব দ্রুত নজর চালিয়ে নিল জিশান।

অন্যান্য বোটের লোকজন এবার মজা দেখছে। বিনাপয়সার রোমাঞ্চকর শো। ওরা গাড়িটার খাবি খাওয়া দেখছে, ছেলেটার মরিয়া হাত-পা ছোড়াছুড়ি দেখছে আর নিজেদের মধ্যে উত্তেজিতভাবে আলোচনা করছে।

রাস্তায় পামগাছের সারির কাছে দাঁড়ানো লোকজনের অবস্থাও তাই।

জিশান আর দেরি করল না। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ছুড়ে দিল বোটের মেঝেতে। তারপর টুপিটাও। এবং ঝাঁপ দিল লেকের জলে।

আগের মজার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ হওয়ায় দর্শকরা আবার উঁচু পরদায় হইহই করে উঠল।

জামা-প্যান্ট পরা অবস্থাতেই জিশান গাড়ি লক্ষ্য করে সাঁতার কাটতে লাগল। লম্বা-লম্বা হাত টেনে আধমিনিটের মধ্যেই ও গাড়িটার কাছে পৌঁছে গেল। ডুবন্ত গাড়ির বনেটের ওপরে উঠে ও সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু পারল না। কারণ, ইঞ্জিনের ভারে গাড়ির সামনের দিকটা ডুবে গিয়ে বনেটটা ঢালু হয়ে গিয়েছিল।

টাল খেয়ে পড়ে যেতে-যেতেও জিশান ডানপায়ের এক প্রচণ্ড লাথি কষিয়ে দিল গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের ওপরে। একটু পরেই আর-একবার।

গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ভেঙে ভেতরে ঢুকে গেল।

জিশান নীচু হয়ে ঝুঁকে হাত বাড়াল গাড়ির ভেতরে। পলকে আঁকড়ে ধরল ছেলেটার জামা। তারপর এক হ্যাঁচকা টানে ওকে ভাঙা উইন্ডস্ক্রিনের ফাঁক দিয়ে টেনে নিল বাইরে।

ছেলেটা আতঙ্কে চোখ বুজে গোঙাচ্ছিল। জিশান ওকে টেনে নিয়ে ভেসে পড়ল জলে। তাড়াতাড়ি ডুবন্ত গাড়িটার কাছ থেকে সরে যেতে চাইল। কারণ, ডুবে যাওয়া গাড়ির জন্য জলে যে-ঘূর্ণি তৈরি হবে তাতে ও তলিয়ে যেতে চায় না।

ছেলেটা হাঁকপাঁক করছিল। ওর কপালের একপাশ থেকে রক্ত বেরোছে। জিশান ওর চুলের মুঠি ধরে সাঁতরে চলল পামগাছের সারির দিকে।

ততক্ষণে লোকজন ওকে চিনতে পেরে গেছে। ওদের শহরের রিয়েলিটি শো-র হিরো জিশান। তাই ওরা উল্লাসে ফেটে পড়ল।

সব বোট তখন স্টার্টিং পয়েন্টে পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে গুনাজি ‘দাদা! দাদা! চলে আসুন! আর-একটু! আর-একটু!’ বলে চেঁচাচ্ছে। ওর আশপাশে আরও অনেক লোক হাত নাড়ছে।

জিশানের মনে হল, ও যেন একটা কমপিটিশানে নাম দিয়েছে। সেখানে ও প্রচণ্ড উত্তেজনার মধ্যে ফিনিশ লাইন বা ওইরকম কোনও কিছুর দিকে এগোচ্ছে।

হঠাৎই লেক কন্ট্রোল রুম থেকে ছ’জন লোক ছুটে বেরিয়ে এল। ওদের গায়ে কালো সিল্কের জ্যাকেট। তার বুকে-পিঠে রুপোলি অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা : ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট।’ ওরা দুটো বোট নিয়ে চট করে পৌঁছে গেল জিশানের দুপাশে। অভ্যস্ত কৌশলে ওদের দুজনকে একটা বোটে তুলে নিল। তারপর বোট দুটো ছুটে চলল পাড়ের দিকে।

জিশানের ভেজা জামা-প্যান্ট থেকে জল ঝরে পড়ছিল। ও ছেলেটাকে দেখছিল। একটু আগে ছটফট করছিল, কিন্তু এখন নিস্তেজ হয়ে চুপচাপ মেঝেতে শুয়ে রয়েছে। বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে। চোখ দুটো শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আকাশের দিকে।

ছেলেটার বয়েস সতেরো কি আঠেরো। ওর থুতনিতে এক চিলতে দাড়ি। আর বাঁ-গালে একটা ছোট্ট লাল ফুল—লেসার ট্যাটু।

জিশান হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল ছেলেটার কাছে। ওর কপাল থেকে এখনও রক্ত পড়ছে। ওকে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া দরকার।

ও ছেলেটার মুখের ওপরে ঝুঁকে পড়ল। গালে আলতো করে দুটো চাপড় মারল : ‘আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? এই যে, শুনতে পাচ্ছ?’

ছেলেটার চোখ এবার জিশানকে দেখতে পেল যেন। কেমন একটা যন্ত্রণার গোঙানি বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে।

জিশান আবার আলতো চড় মারল গালে। জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়?’

ছেলেটার ঠোঁট নড়ল, কিন্তু কোনও কথা বেরোল না। ওর মুখ থেকে ঝিম ধরানো পেপারমিন্টের গন্ধ বেরোচ্ছিল। বোধহয় নেশা-টেশা করেছে।

জিশান ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে আবার চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

ছেলেটা জড়ানো গলায় অতিকষ্টে উচ্চারণ করল, ‘সিমান—।’

গুনাজির আঙুল সি থ্রু অটোমোবিলের কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে নড়াচড়া করছিল। জিশান পাশের সিটে বসে আড়চোখে ওর দক্ষতা লক্ষ করছিল। আর মনে-মনে ওর তারিফ করছিল। তুলতুলে পালকটাকে আবার ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে গুনাজি।

একটু দুশ্চিন্তাও ভেসে বেড়াচ্ছিল জিশানের মনে। মাথা ঘুরিয়ে পিছনের সিটের দিকে একপলক তাকাল ও। নেশায় অচেতন সিমান শুয়ে আছে।

ওকে পাড়ে নিয়ে আসার পর ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট’ গ্রুপের লোকেরা ওর তদারকি করেছে। ওর ভেজা জামাকাপড় পালটে দেওয়া হয়েছে। ইমার্জেন্সি কেয়ার ইউনিট থেকে চিফ মেডিক এসেছেন, সিমানের ট্রিটমেন্ট করেছেন, ওকে একটা ইনজেকশানও দিয়েছেন—কিন্তু সিমানকে জাগানো যায়নি। অবশ্য ইনজেকশানটা ঘুমপাড়ানোর না নেশা থেকে জাগানোর সেটা জিশান জানে না।

‘লেক কন্ট্রোল রুম’-এর কর্মীরা ব্যাপারটা পিস ফোর্সের লোকাল ইউনিটে জানিয়েছে। তারপর যখন ওরা বলল যে, ছেলেটির আইডেনটিটি পাওয়া না গেলে ওকে কয়েকদিন পিস ফোর্সের হেফাজতে থাকতে হতে পারে, তখন জিশান আপত্তি করেছে। এবং ছেলেটির পরিচয় খোঁজার জন্য ওর ভেজা জামা-প্যান্টের পকেট হাতড়ে দেখার অনুমতি চেয়েছে।

জিশান এখন সকলের কাছে সুপারহিরো। তাই ওর কথায় ‘লেক কন্ট্রোল রুম’-এর অফিসাররা রাজি হয়ে গেল। জিশান ঝুঁকে পড়ে সিমানের ভেজা জামাকাপড়ের নানান পকেটে তল্লাশি শুরু করল।

একটু পরেই একটা ম্যাগনেটিক কার্ড পাওয়া গেল ওর পকেট থেকে। তাতে লেখা : ‘সিমান বিশ্বাস। বাবা রঙ্গপ্রকাশ। মা পর্ণমালা। বাড়ির স্থ্যনাঙ্ক : জে— সেভেনটিন কমা ফরটি সিক্স।’ এ ছাড়া রয়েছে ইমার্জেন্সি কনট্যাক্ট কোড।

অফিসারদের অনুমতি নিয়ে নেশায় অচল সিমানকে সি থ্রু অটোমোবিলের পিছনের সিটে তুলে নিয়েছে জিশান। তারপর ও আর গুনাজি সামনের সিটে বসেছে। এবং গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে।

জিশানের স্যাটেলাইট ফোন থেকে গুনাজি সিমানের ইমার্জেন্সি কনট্যাক্ট কোডে ডায়াল করেছে।

ওপাশে কেউ কথা বলতেই জিশানের হাতে ফোন তুলে দিয়েছে গুনাজি। বলেছে, ‘দাদা, আপনি কথা বলুন—।’

‘হ্যালো, জিশান বলছি—জিশান পালচৌধুরী…।’

‘আমি ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস বলছি…।’ কণ্ঠস্বর মসৃণ এবং স্থির রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা পুরোপুরি হল না। শব্দগুলোর উচ্চারণে আঁকাবাঁকা ঢেউ খেলে গেল।

এই সেই জিশান! যার সাইকোজিক্যাল প্রাোফাইলিং নিয়ে দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, সময় কাটিয়েছেন রঙ্গপ্রকাশ!

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই সেই জিশান! কারণ, নিউ সিটিতে জিশান পালচৌধুরী একজনই।

জিশান এবার ধীরে ধীরে সিমানের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা খুলে বলল। বলল যে, দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ‘লেক কন্ট্রোল রুম’-এ সিমানের যথাসাধ্য ট্রিটমেন্ট করা হয়েছে। এখন ও জিশানের সি থ্রু অটোমোবিলে শুয়ে রয়েছে—বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে জিশান ওকে নিয়ে রঙ্গপ্রকাশের বাড়িতে পৌঁছে যাবে।

রঙ্গপ্রকাশের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি কাজ করতে লাগল। মনে হল, হঠাৎই একজন সেলিব্রিটি টিভির পরদা থেকে বেরিয়ে সরাসরি পা রেখেছে রঙ্গপ্রকাশের ঘরে।

রঙ্গপ্রকাশ কেমন একটা অলীক ঘোরের মধ্যে জিশানকে বারবার ধন্যবাদ জানালেন। তারপর বললেন, ‘আপনি আসুন। আমরা আপনার আসার জন্যে ওয়েট করছি—।’

একজিট বোতাম টিপে ফোন রিসেট করল জিশান। ফোনটা গাড়ির সিটে রেখে দিল। জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। তারপর সিমানের দিকে একবার দেখল। ঘুমোচ্ছে।

গাড়ি চালাতে-চালাতে গুনাজি বলল, ‘দাদা, আপনাকে এ-শহরের বহু লোক চেনে। ভালোও বাসে।’

সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে জিশান আনমনাভাবে বলল, ‘হুঁ—।’

গাড়ির ড্যাশবোর্ডের প্যানেলে রঙিন নেভিগেশান ম্যাপ। সেখানে উজ্জ্বল লাল রেখায় সিমানের বাড়ির স্থানাঙ্কে পৌঁছোনোর পথ আঁকা রয়েছে। গুনাজি জানাল, সেখানে পৌঁছতে মোটামুটি ঘণ্টাখানেক লাগবে।

এখন প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে। সূর্য হেলে পড়েছে। জিশানের মনে হল, ঠিক এই সূর্যটাই একইরকমভাবে দেখা যাচ্ছে ওল্ড সিটিতেও।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল জিশানের বুক থেকে।

একটু আগে অল্প খিদে পাচ্ছিল। এখন সেই খিদের বোধটা বড্ড জোরালো হয়ে উঠেছে। গুনাজিকে সে-কথাই বলল জিশান। তখন গুনাজি বলল, ‘দাদা, আমারও একই অবস্থা। আমাকে পাঁচটা মিনিট টাইম দিন, একটা ফুড মলে গাড়ি লাগাচ্ছি—।’

পাঁচ মিনিট নয়—তার কম সময়েই একটা অদ্ভুত চেহারার ফুড মলের পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করাল গুনাজি।

ফুড মলটা একটা গাছের মতো শাখা-প্রশাখা মেলে দাঁড়িয়ে আছে। স্টেইনলেস স্টিল আর কাচ দিয়ে তৈরি। তার ওপর রঙিন আলোর আভা এক অলৌকিক মায়া তৈরি করেছে। ছাই রঙের আকাশের পটভূমিতে এক বিমূর্ত চেহারার আলোকবৃক্ষ।

সিমানকে গাড়িতে রেখে ওরা দুজন নেমে দাঁড়াল।

সন্ধে হয়ে এসেছে। তাই সানগ্লাসটা আর চোখে দিল না জিশান। শুধু নীল টুপিটা মাথায় দিয়ে নিল।

গাড়ির পিছনের দরজা খুলে সিমানের ওপরে ঝুঁকে পড়ল জিশান। ওর কপালে হাত বুলিয়ে তাপ নিল। না:, জ্বর-টর কিছু নেই।

গুনাজির দিকে তাকাল জিশান : ‘আমাদের বেশি দেরি করলে চলবে না। সিমানকে জলদি বাড়িতে পৌঁছতে হবে—।’

সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ল গুনাজি।

‘ওর জন্যে একটা হেলথ ড্রিংক বা ওই টাইপের কিছু নিয়ে নিয়ো। যদি ঘুম থেকে উঠে কিছু খেতে টেতে চায়…।’

‘এক লিটারের একটা সফট এনার্জি প্যাক নিয়ে নেব, দাদা।’

ফুড মলের যে-রেস্তরাঁটায় গিয়ে ওরা ঢুকল সেটার নাম ‘হেভেনস কিচেন।’ রেস্তরাঁর বিশাল বড় প্লেট টিভিতে তখন জিশানের পিট ফাইট দেখানো হচ্ছে। ঘাম-চকচকে শরীর নিয়ে জিশান জাব্বার সঙ্গে লড়ছে।

জিশান একটু অস্বস্তি পেল। মাথার টুপিটাকে টেনে কপালের ওপরে আরও খানিকটা নামিয়ে দিল।

গুনাজি চাপা গলায় বলল, ‘দাদা, আপনার ফাইট দেখাচ্ছে।’

‘হুঁ—।’ বলে একটা খালি টেবিলের কাছে এগিয়ে গেল জিশান। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। গুনাজিও বসে পড়ল ওর পাশে।

স্বচ্ছ টেবিলে ফুটে ওঠা রঙিন ব্যকলাইটেড টাচস্ক্রিন মেনুর দিকে তাকাল গুনাজি। সেখানে হালকা স্ন্যাক্স আইটেমের ওপরে আঙুল ছুঁইয়ে অর্ডার দিল।

রেস্তরাঁটায় বেশ ভিড়। দু-তিনটে টেবিল ছাড়া সব টেবিলেই লোকজন রয়েছে। বেশিরভাগ খদ্দেরই পুরুষ, তবে কয়েকটা টেবিলে ফ্যামিলি চোখে পড়ছে।

প্রায় সকলেরই চোখ টিভির পরদার দিকে। লড়াই দেখতে-দেখতে অনেকে অনেকরকম মন্তব্য করছে। কেউ উত্তেজিতভাবে জিশানকে সাপোর্ট করছে, আর কেউ-বা জাব্বাকে। সব মিলিয়ে একটা চাপা গুঞ্জন আর হইচই।

জিশানের ভালো লাগছিল না। বারবার গাড়িতে রেখে আসা সিমানের কথা মনে পড়ছিল। কতক্ষণে ওকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে সে-কথাই ভাবছিল।

আশপাশের টেবিল থেকে টুকরো-টুকরো কথাবার্তা ছিটকে এসে ওর কানে ঢুকে পড়ছিল। হঠাৎই ও শুনতে পেল পাশের টেবিলে একজন বলছে, ‘এই নিয়মটা বড্ড ফালতু যে, নিউ সিটির কোনও সিটিজেন এইসব কম্পিটিশানে নাম দিতে পারবে না—।’

জিশান তাকাল পাশের টেবিলটার দিকে।

তিনটে ছেলে বসে আছে সেখানে। হ্যামবার্গারে কামড় দিচ্ছে, চোখ প্লেট টিভির দিকে। ওদের সামনে তিনটে প্লেট আর তিনটে গ্লাস। গ্লাসে রঙিন তরল—সফট এনার্জি ড্রিংক কিংবা হার্ড এনার্জি ড্রিংক হতে পারে।

তিনজনের চেহারা তিনরকম, কিন্তু বয়েস আর পোশাক অনেকটা একই রকমের।

একজনের মাথায় কদমছাঁট চুল। গোঁফ কামানো। থুতনিতে একটু দাড়ি—সিমানের মতন। আর কানে চকচকে কোনও ধাতুর মাকড়ি। ছেলেটা বসে থাকলেও লম্বা যে, সেটা বোঝা যায়।

দ্বিতীয়জনের মাথায় লম্বা কোঁকড়ানো চুল। বড় বড় চোখ। চোয়ালের দুপাশের হাড় উঁচু। নাকটা থ্যাবড়ানো। নাকের নীচে সরু গোঁফ।

তৃতীয়জনের চুল ব্যাকব্রাশ করে আঁচড়ানো। কপালের ঠিক মাঝখান বরাবর চুলের এলাকা চোখা হয়ে নেমে এসেছে—ইংরেজিতে যাকে ‘উইডোজ পিক’ বলে। গাল ভাঙা। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। ডানচোখের ভুরুর ওপরে একটা মাকড়ি ঝকঝক করছে।

ওদের দিক থেকে ভেসে আসা প্রথম কথার টুকরোটা জিশানের কৌতূহল উসকে দিয়েছিল। কারণ, ওর ধারণা ছিল নিউ সিটির কোনও মানুষ সুপারগেমস কর্পোরেশনের কোনও খেলায় নাম দিতে চায় না।

কোঁকড়া চুল তখন বলছে, ‘ফালতু মানে? একেবারে ন্যাকাচৈতন নিয়ম। এটা সিন্ডিকেট বোঝে না যে, প্রাইজ মানির কড়কড়ে রোকড়া সব ওল্ড সিটিতে টপকে যাচ্ছে!’

কদমছাঁট চুল তখন বলল, ‘ওই যে জিশান নামের ছেলেটা যে লড়ছে, ওকে পালিশ দেওয়া কি খুব একটা টাফ ব্যাপার? শালা ফালতু কিছু নোট এপার থেকে ওপারে চলে গেল। আর মাঝখান থেকে জিশান বড়লোক হয়ে গেল—।’

কথাগুলো গুনাজির কানেও যাচ্ছিল। ও জিশানের দিকে তাকাল। জিশান ইশারায় ওকে চুপচাপ থাকতে বলল। টুপিটা টেনে আরও খানিকটা সামনের দিকে নামাতে চাইল।

ওদের খাবার টেবিলে এসে গিয়েছিল। ও আর গুনজি মাথা নীচু করে খাওয়া শুরু করল।

চুল ব্যাকব্রাশ করা ছেলেটা বলল, ‘দাঁড়া, কালই সিন্ডিকেটে একটা রিটন অ্যাপিল করছি। তাতে রিকোয়েস্ট করব, নিউ সিটির লোকজনও যেন সুপারগেমস কর্পোরেশনের এই থ্রিলিং কমপিটিশানে নাম দিতে পারে—।’

‘সিন্ডিকেট?’ ব্যঙ্গের সুরে প্রশ্নটা করে কদমছাঁট ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল : ‘সিন্ডিকেট মানে তো একপাল ইনটেলিজেন্ট বুরবাক—শুধু এই মার্শাল শ্রীধর পাট্টা ছাড়া। যাকগে, সে তুই চিঠি যা লেখার লেখ, কিন্তু বাইরের লোকজন এসে সব মালকড়ি নিয়ে কেটে পড়ছে এ-ব্যাপারটা আমার হেভি গায়ে লাগছে।’

কোঁকড়ানো চুল বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। ওর নজর লক্ষ্য করে সেদিকে তাকাল জিশান।

কয়েকটা টেবিল পরেই একটি ফ্যামিলির চারজন একটা টেবিলে খেতে বসেছে। তার মধ্যে একটি অল্পবয়েসি মেয়েও রয়েছে। বয়েস খুব বেশি হলে কুড়ি-একুশ। পরনে উজ্জ্বল হলদে স্লিভলেস টপ। আর কালো রঙের স্কিনটাইট বারমুডা স্ল্যাক্স। মাথার চুল বিচিত্র ভঙ্গিতে উঁচু করে বাঁধা। টানা-টানা রূপসী চোখ। কপালে লেসার হলোগ্রামের টিপ। গলায় গোলাপি পাথরের একটা মালা।

মেয়েটার সঙ্গে রয়েছে সম্ভবত ওরা মা-বাবা আর ভাই। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল, হাসাহাসি করছিল।

কদমছাঁট চুল বাঁকা হাসি হেসে কোঁকড়া চুলের পিঠে একটা থাপ্পড় কষাল।

ব্যাকব্রাশ চুল মজা করে বলল, ‘কী সার্ভে করছেন, স্যার?’

কোঁকড়ানো চুল ছেলেটা বন্ধুদের দিকে ফিরে চোখ টিপল : ‘গ্রেট স্টাফ। এখন ওর জিয়োগ্রাফি সার্ভে করছি। হিস্ট্রি পরে জানার চেষ্টা করব। আর, বস, হিস্ট্রির পর আসবে আর্কিওলজি—।’

কথাটা শেষ হতে না হতেই তিনজনে এমন নোংরা ভঙ্গিতে হাসল যে, কথার নোংরা ইঙ্গিতগুলো জিশানের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। ওর গা ঘিনঘিন করে উঠল। সেইসঙ্গে রাগও হল।

গুনাজি জিশানকে লক্ষ করছিল। জিশানের মনের অবস্থাটা বুঝতেও পারছিল। তাই ও টেবিলের ওপরে হাত বাড়িয়ে জিশানের বাঁ-হাতের পাতার ওপরে রাখল, চাপ দিল। তারপর চাপা গলায় বলল, ‘দাদা, প্লিজ—। এখানকার বেশিরভাগ ছেলেছোকরাই এই টাইপের…।’

ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।

পাশের টেবিলের তিনটে ছেলেই নিজেদের চেয়ারগুলো ঘুরিয়ে সরাসরি মেয়েটার দিকে মুখ করে বসল এবং একদৃষ্টে মেয়েটির দিকে লোভী কুকুরের মতো চেয়ে রইল। শুধু ওদের জিভগুলোই যা বাইরে বেরিয়ে লকলক করছিল না।

গুনাজি বলল, ‘দাদা, চলুন, তাড়াতাড়ি খেয়ে আমরা চটপট বেরিয়ে যাই—।’

জিশান ‘হুঁ’ শব্দ করে খাওয়ায় মন দিল। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ওর নজর ছেলে তিনটের অসভ্যতার দিকে চলে যাচ্ছিল।

টিভিতে জিশানের নানান গেম দেখানো হচ্ছিল কিন্তু সেদিকে ওই তিনজনের আর মন ছিল না।

মেয়েটিকেও লক্ষ করছিল জিশান। ও টিভির পরদার দিকে তাকাচ্ছিল, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল, আর কখনও-কখনও অসভ্য ছেলে তিনটের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হচ্ছিল, অস্বস্তি পাচ্ছিল।

রেস্তরাঁর অন্যান্য খদ্দের ছেলে তিনটের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। কিন্তু শুধু দেখছিলই—কিছু করছিল না।

মেয়েটি ওর মা-বাবাকে বোধহয় কিছু বলল। ওঁরা ছেলে তিনটের দিকে একবার তাকালেন। তারপর একটু যেন আচমকাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।

টেবিলে ওঁদের আধখাওয়া প্লেট পড়ে রইল। ওঁরা ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে রেস্তরাঁর দরজার দিকে এগোলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে ছেলে তিনটেও উঠে দাঁড়াল।

এখন বোঝা গেল, কদমছাঁট চুল ছেলেটা শুধু যে মাথায় লম্বা তা নয়, চওড়াতেও বেশ মানানসই। ওর চোখ দুটো যেন কোটরে বসানো চকচকে মার্বেল—সবসময় এদিক-ওদিক নড়ছে।

ছেলেটার পরনে মেটালিক জিনস। গায়ে একটা প্রিন্টেড পোলো নেক টি-শার্ট।

ওর দু-বন্ধুর টি-শার্টও একই ডিজাইনের—শুধু রং-টা আলাদা।

ছেলে তিনটে নির্লজ্জ বেপরোয়াভাবে মেয়েটার দিকে বাজে ইশারা করছিল। আর বেশ তাড়াহুড়ো করে রেস্তরাঁর দরজার দিকে এগোচ্ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *