০৭. বাচ্চাটার খুব জ্বর

০৭.

‘কী ব্যাপার? গাড়ি আটকালে কেন?’ ভরাট গলা। শুনেই মনে হয়, এই মানুষটা সবসময় আদেশ দিতে অভ্যস্ত।

‘আমার…আমার বাচ্চাটার খুব জ্বর…’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল জিশান, ‘এখুনি হাসপাতালে না নিয়ে গেলে ছেলেটা মরে যাবে…’ কথা বলতে-বলতে জিশান কেঁদে ফেলল। ব্যস্তভাবে হাত নেড়ে মিনিকে কাছে ডাকল। তারপর কী মনে করে ও হাতজোড় করে বলে উঠল, ‘আমার বাচ্চাটাকে বাঁচান, স্যার। আমাদের একটু হাসপাতাল পৌঁছে দিন। প্লিজ। নইলে ছেলেটা মরে যাবে। আমাদের বাঁচান, স্যার…।’

লোকটা গাড়ির ভেতরে কাকে যেন ইশারা করল। অমনি গাড়ির হেডলাইট নিভে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে লোকটার হাতে একটা টর্চ জ্বলে উঠল। জোরালো আলো ছিটকে এসে পড়ল জিশানের অসহায় মুখে, মিনির মুখে। মিনির মুখে আলোটা দু-চার সেকেন্ড বেশি রইল। তারপর ছায়ামানুষটা বলল, ‘ভয় নেই—আমরা পুলিশের লোক। এসো, গাড়িতে ওঠো। তোমাদের হাসপাতালে নামিয়ে দিচ্ছি—।’

জিশান আর মিনি প্রায় দৌড়ে চলে এল গাড়ির কাছে। জিশান আবেগ জড়ানো গলায় বলল, ‘থ্যাংক য়ু, স্যার…থ্যাংক য়ু…।’

লোকটা পিছনের দরজা খুলে ধরল। কোনওরকমে ছাতা দুটো বন্ধ করে পলিথিনে জড়ানো শানুকে সামলে ওরা গাড়িতে উঠে বসল। প্রথমে মিনি, তারপর জিশান। আর সবশেষে উঠে পড়ল লোকটা।

গাড়ির দরজা বন্ধ করার সঙ্গে-সঙ্গেই কানফাটানো শব্দে বাজ পড়ল। শানু কেঁপে উঠল মিনির হাতে। কঁকিয়ে কেঁদে উঠল।

হেডলাইট জ্বলে উঠল। গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। হেডলাইটের আলোয় দেখা যাচ্ছে বৃষ্টি আর ভাঙাচোরা রাস্তা।

জিশানের পাশে বসা লোকটা জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘কোন হসপিটাল?’

‘যেখানে হোক। আমার বাচ্চাটা যেন বেঁচে যায়, স্যার।’

‘ঠিক আছে। ”সোলাস মেডিকেল কলেজ” চলো।’ ড্রাইভারকে লক্ষ করে শেষ কথাটা বলল লোকটা।

মিনি লক্ষ করল, গাড়ির সামনের সিটে দুজন—তার মধ্যে একজন গাড়িটা চালাচ্ছে। আর পিছনের সিটে ওরা তিনজন।

এই প্রবল ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে এই তিনজন পুলিশের লোক কোন কাজে বেরিয়েছে?

মিনি কেমন একটা গন্ধ পাচ্ছিল। শানুকে আরও কাছে টেনে নিয়ে দোলা দিয়ে ও ঘুম পাড়াতে চেষ্টা করল। হাতের পিঠ দিয়ে বাচ্চাটার জ্বর দেখল। ভয়ে ওর প্রাণটা বারবার কেঁদে উঠছিল। শানু ওদের সঙ্গে থাকবে তো? নাকি আকাশে একটা তারা কম আছে? সেখানে শানুকে খুব দরকার?

শানুকে একটু শান্ত করার পর মিনি জিশানের বাহু আঁকড়ে ধরল। ওকে কাছে টানল। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘কীরকম বিচ্ছিরি একটা গন্ধ…।’

জিশান ওর ঊরুতে চাপ দিয়ে ওকে চুপ করতে ইশারা করল। কারণ, গন্ধটা ও চিনতে পেরেছে।

মদের গন্ধ।

জিশানের মনে একটা আশঙ্কা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু শানুকে বাঁচানোর মরিয়া দায় সেই আশঙ্কার গলা টিপে ধরছিল। মিনির ঊরু থেকে ও হাতটা সরাল না। ওর মনে হল, মিনিকে ছুঁয়ে থাকলে ওর মনে উথলে ওঠা ভয়টা কমে যাবে।

গাড়ি ঝাঁকুনি তুলে ছুটে যাচ্ছিল। ঝমঝম বৃষ্টি। নির্জন রাস্তা। রাস্তার দুপাশে কোথাও আলো আছে, কোথাও নেই।

জিশানের পাশে বসে থাকা লোকটা হঠাৎই জিগ্যেস করল, ‘কোথায় থাকো?’

জিশান মদের গন্ধের ঝাপটা টের পেল। লোকটার দিকে ফিরে তাকাল। বৃষ্টির ফোঁটা থেকে ঠিকরে আসা হেডলাইটের আলোর আভায় লোকটার আবছা মুখ দেখা যাচ্ছে।

জোরে শ্বাস টেনে জিশান বলল, ‘মালির বাগানের বস্তিতে। যেখানে গাড়িতে উঠলাম তার কাছেই…।’

লোকটা আর কোনও কথা বলল না।

গাড়িটা এ-রাস্তা সে-রাস্তা ধরে বাঁক নিয়ে ছুটে চলল। কতকগুলো রাস্তায় এমন জল দাঁড়িয়ে গেছে যে, গাড়িটাকে জল ঠেলে এগোতে হচ্ছিল। ড্রাইভার মাঝে-মাঝেই বিরক্তির শব্দ করছিল।

মিনি অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। ভাবছিল, সোলাস মেডিকেল কলেজ আর কতদূর। আর কতদূর? জিশানকে সে-কথা একবার জিগ্যেসও করল। জিশান চাপা গলায় বলল যে, সোলাস মেডিকেল কলেজ ও চেনে না।

একটু পরেই গাড়িটা একটা মাঝারি রাস্তায় ঢুকে পড়ল। রাস্তাটা নির্জন। দু-ধারে বড়-বড় ভাঙাচোরা পুরোনো বাড়ি। ফুটপাথে বেশ কয়েকটা রুগ্ন গাছ। তার নীচে দু-চারটে ঝুপড়ি।

রাস্তাটায় তেমন আলো নেই। গাড়ির হেডলাইটের আলোই একমাত্র ভরসা। সেই আলো জমে থাকা বৃষ্টির জলে নাচছে।

রাস্তার শেষে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে একটা বড় বিল্ডিং—চারতলা কি পাঁচতলা হবে। তার গায়ে একটা গ্লো-সাইন জিশানের নজরে পড়ল। নীল আর লাল আলোকরেখা দিয়ে লেখা ‘সোলাস মেডিকেল কলেজ’। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা অক্ষর অন্ধকার—দাঁতের পাটি থেকে উধাও হয়ে যাওয়া দাঁতের মতো সেই রঙিন আলোর ভাঙাচোরা ছায়া রাস্তায় জমে থাকা জলে কাঁপছে।

মাঝারি রাস্তাটা শেষ হল সোলাস মেডিকেল কলেজে গিয়ে। জিশান দেখল, বিল্ডিং-এর দুপাশ দিয়ে দুটো সরু গলি অন্ধকারে ঢুকে গেছে।

গাড়িতে লোকগুলো নিজেদের মধ্যে প্রায় কোনও কথাই বলেনি। শুধু জিশানের পাশে বসা লোকটা দু-চারবার ছোট্ট করে ড্রাইভারকে কী যেন বলেছে। সেইসব কথার মানে বুঝতে পারেনি জিশান। হয়তো সাদা পোশাকের পুলিশের কোনও সাংকেতিক ভাষা হবে।

হসপিটাল বিল্ডিং-এর দিকে তাকিয়ে জিশানের একটু অবাক লাগছিল। কারণ, বিল্ডিং-এর নানান তলার কয়েকটা জানলায় খাপছাড়াভাবে আলো জ্বলছিল। বাকি সব জানলা অন্ধকার।

এখন রাত বেশি হয়নি। হাসপাতালের ব্যস্ততা এসময় কিছু কম হওয়া উচিত নয়। তা হলে…।

জিশান একটু অস্থির হয়ে পড়ছিল। মিনিকে ছুঁয়ে থাকায় ওর অস্থিরতাও টের পাচ্ছিল। ওদের করসিকা-এইট গাড়িটা গতি কমিয়ে হসপিটালের গাড়িবারান্দার নীচে গিয়ে দাঁড়াল।

কোনও কথা না বলে সামনের সিটে বসা দুজন দুপাশের দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াল।

জিশানের পাশের লোকটা জিশানকে বলল, ‘নেমে পড়ো। আমরা এসে গেছি।’ বলে গাড়ির দরজা খুলে নেমে পড়ল।

জিশান নীচু গলায় মিনিকে বলল, ‘এসো—।’ তারপর নিজে নেমে দাঁড়াল।

শানুকে ভালো করে মুড়ে জিশানের হাতে দিল মিনি। সাবধানে গাড়ি থেকে নামল।

গাড়ির দরজাগুলো শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। জিশানের পাশে দাঁড়ানো লোকটা ওর পিঠে হাত রেখে চাপ দিল : ‘চলো—।’

ওরা সবাই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে ওদের পা ফেলার ছপছপ শব্দ বেশ জোরে শোনা গেল। ঝোড়ো হাওয়ার ঝাপটায় জিশানের হঠাৎ শীত-শীত করে উঠল।

ওরা ভেতরে ঢোকার পর কেউ একজন সদর দরজাটা বন্ধ করে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজের মুখে কেউ যেন রুমাল চেপে ধরল।

ভেতরের দৃশ্যটা জিশান আর মিনিকে অবাক করে দিল। এতটাই যে, ওরা হতবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে চারপাশটা দেখতে লাগল। একইসঙ্গে দেখতে লাগল তিনটে মানুষকেও—যারা এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে দেবতা হয়ে ওদের উপকার করেছে।

যে-ঘরটায় ওরা ঢুকেছে সেটা হসপিটালের রিসেপশান লাউঞ্জ। তবে এককালে ছিল—এখন আর নয়।

স্পেসটা মাপে বিশাল। দেখেই বোঝা যায়, বহুবছর ধরে অবহেলায় পরিত্যক্ত। দেওয়ালে তিনটে জানলা, দুটো দরজা। সবগুলোই বন্ধ। সদর দরজার মুখোমুখি দেওয়ালে একটা করিডর ভেতর দিকে চলে গেছে।

সারাটা ঘর ধুলোয় ধুলোময়। চেয়ার, টেবিল, সোফা, রিসেপশান কাউন্টার সব এলোমেলোভাবে ঘরের নানান দেওয়াল ঘেঁষে ডাঁই করা। তার ওপরে কয়েকটা চেয়ার আর সোফা উলটো করে চাপানো। কয়েকটা আসবাবপত্র সাদা পলিথিন শিট দিয়ে ঢাকা। শিটের ওপরে ধুলোর পুরু আস্তরণ।

ঘরের দেওয়ালে অন্তত গোটাদশেক টুইন টিউবলাইটের ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল ফিটিং। তাই পরিত্যক্ত ঘরটা আলোয় ঝলমল করছে। বাঁ-দিকের দেওয়ালে একটা ডিজিটাল ঘড়ি। তার উজ্জ্বল লাল এল. ই. ডি. বাতিগুলো ভুল সময় দেখাচ্ছে।

রিসেপশান স্পেস-এ একটাও লোক নেই। জিশানের মনে হল, ঘরটা এতদিন ধরে পরিত্যক্ত যে, তা থেকে আরশোলা আর ছাতা-ধরা গন্ধ বেরোচ্ছে। তার সঙ্গে মিশে গেছে ধুলোর গন্ধ আর মদের গন্ধ।

এর নাম হসপিটাল! আর এরাই-বা কেমন পুলিশ!

অবাক হওয়া ভয়ের চোখে মিনির দিকে তাকাল জিশান। কী এক অদৃশ্য সংকেতে সাড়া দিয়ে মিনিও সেই মুহূর্তে তাকিয়েছে স্বামীর দিকে। চোখে-চোখে ওদের কী কথা হল কে জানে! মিনি কেঁদে ফেলল। ছোট্ট শানুকে জিশানের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে আঁকড়ে ধরল বুকে। বাচ্চাটা বোধহয় ঘুমিয়ে ছিল—এই ঝটকায় জেগে গিয়ে কঁকিয়ে উঠল।

জিশান খুব ধীরে-ধীরে ঘুরে দাঁড়াল। তাকাল তিন দেবতার দিকে। ওদের ঠান্ডা পাথরে তৈরি মুখগুলো এখন অপদেবতার মতো লাগছে।

মুখগুলোকে খুঁটিয়ে দেখল জিশান।

ওদের পোশাক জলে ভেজা। মাথার ভেজা চুল লেপটে রয়েছে কপালে, গালে। মুখের চেহারায় তিনজনের মিল না থাকলেও ওদের চোখজোড়া একইরকম : মরা মাছের চোখ।

ওদের তিনজনের দুজন বেঁটে, একজন বেশ লম্বা। উচ্চতার হিসেবেই জিশানের মনে হল, লম্বা লোকটাই গাড়িতে জিশানের পাশে বসেছিল।

প্রথম বেঁটে লোকটার মাথায় টাক। রোগা। রং কালো। মুখে গোঁফ-দাড়ির বালাই নেই। ফলে একটা বাচ্চা-বাচ্চা ভাব ফুটে উঠেছে। লোকটা বড়-বড় শ্বাস ফেলছিল। মিনির দিকে তাকিয়ে ছিল।

দ্বিতীয় বেঁটে লোকটা বেশ মোটা, গোলগাল লালটু মুখ। ফরসা। ঠোঁটের ওপরে পাতলা গোঁফ। মাথায় কোঁকড়ানো চুল। দেখে মনে হয়, বয়েস ছাব্বিশ কি সাতাশের বেশি হবে না। চোখ দুটো ছোট-ছোট। ভেতরে ঢোকানো। বারবার নাক টানছে। বোধহয় জলে ভিজে ঠান্ডা লেগেছে।

লম্বা লোকটাকে দেখে মনে হয় এটাই পালের গোদা। কখন যে সে একটা সিগারেট ধরিয়েছে জিশান টের পায়নি। হয়তো রিসেপশান স্পেসের জরিপে ওর মন ব্যস্ত ছিল বলে সিগারেটের গন্ধ নাকে আসেনি।

লোকটার রং তামাটে। জলে ভেজা মুখ যেন কাঠখোদাই ভাস্কর্য। চোয়ালের হাড় উঁচু হয়ে আছে। দু-গালে ব্রণের দাগ। কপালের ওপরে ভেজা চুল লেপটে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া ছুড়ে দিচ্ছে জিশানের দিকে। ওর কালচে ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের ভাঁজে সামান্য হাসির ছোঁওয়া থাকলেও চোখে তার লেশমাত্র ছিল না।

জিশানের বুকের ভেতরে দুরমুশ পড়ছিল। মিনির আতঙ্কের গোঙানি আর শানুর মিহি গলার কান্না ওর চিন্তা ওলটপালট করে দিচ্ছিল। কী করবে এখন? কী করবে?

জিশান লম্বা লোকটাকে প্রশ্ন করল, ‘এটা…এটা হসপিটাল?’

লম্বা হাসল। সিগারেটে ছোট মাপের হ্যাঁচকা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ। সোলাস মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল। এককালে হেভি নাম ছিল। ভালো-ভালো ব্রেনি ছেলেমেয়েরা এখানে পড়ত। এখন আমরা পড়ি—।’ সঙ্গী দুজনের দিকে আড়চোখে তাকাল সে। ছোট্ট করে হাসল। ধোঁয়া ছাড়ল আবার।

অস্বাভাবিক জোরে বাজ পড়ার শব্দ হল। আলো ঝলসে গেল জানলায়। গোটা বিল্ডিংটা থরথর করে কেঁপে উঠল।

‘আমাদের ছেড়ে দিন। বাচ্চাটা মরে যাবে।’ ওর গলা কান্নায় ভেঙে পড়ছে দেখে জিশান নিজেই অবাক হয়ে গেল : ‘আপনারা তো পুলিশের লোক। দয়া করুন…।’

‘হ্যাঁ, পুলিশের লোক। তবে আমরা দু-দিকেই আছি।’ বলে হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠল লম্বা লোকটা।

মিনি গোঙানি মেশানো গলায় বলে উঠল, ‘আমাদের একটা হসপিটাল কি নার্সিংহোমে নিয়ে চলুন। বাচ্চাটার আবার জ্বর এসে গেছে।’

লম্বা লোকটা সিগারেটে জোরালো টান দিয়ে টুকরোটা মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দিল। ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে মাথা নড়ল : ‘হ্যাঁ, নিয়ে যাব, নিয়ে যাব। কোনও চিন্তা নেই। আধঘণ্টার মধ্যেই তোমাদের ছেড়ে দেব।’

জিশান ভয়ের চোখে মিনির দিকে তাকাল।

টাকমাথা বেঁটে লোকটার দিকে তাকিয়ে লম্বা লোকটা কী একটা যেন ইশারা করল। ইশারা বুঝতে পেরে বেঁটে রিসেপশান কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। তার পিছনে ঝুঁকে পড়ে কী যেন খুঁজতে লাগল।

লম্বা লোকটা ফুসফুসে লুকিয়ে রাখা সিগারেটের ধোঁয়া একটু-একটু করে ছাড়ছিল। সেই কাজ করতে-করতেই জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

‘জিশান।’

হাসল লোকটা : ‘ও. কে., জিশান। বাচ্চাটাকে এবার তুমি কোলে নাও। তোমার বউকে ফ্রি করে দাও।’

জিশান পাগলের চোখে লম্বার দিকে তাকাল। এসব কথার মানে কী? তোমার বউকে ফ্রি করে দাও! কেন?

লম্বাকে সে-কথাই জিগ্যেস করল ও।

‘কেন?’

‘কোশ্চেন কোরো না। যা বলছি তাই করো।’ কথা শেষ করেই আর-এক সঙ্গীকে ইশারা করল লম্বা।

সঙ্গে-সঙ্গে বেঁটে-লালটু লোকটা মিনির পিছনে গিয়ে দাঁড়াল।

লম্বা লোকটার দিকে অপলকে তাকিয়ে জিশান মনে-মনে একটা হিসেব কষছিল। ও কি পারবে না তিন ঘুষিতে এই লোকটাকে মাটিতে পেড়ে ফেলতে? যদিও-বা পারে, তারপর? আরও তো দুজন বাকি থাকবে।

জিশান হিসেব করে দেখল, ও পেরে উঠবে না। ও যখন লম্বার সঙ্গে লড়বে তখন বাকি দুজন ওকে পিছন থেকে আক্রমণ করবে। অথবা, আরও সহজ—ওরা মিনি আর শানুর দখল নিয়ে নেবে।

জিশান লম্বা লোকটার দিকে তাকিয়ে হিসেব কষছিল। তাই টাকমাথা বেঁটে লোকটার দিকে নজর রাখতে পারেনি। যদি পারত, তা হলে হিসেব কষার ব্যাপারটা ও মাঝপথেই থামিয়ে দিত।

লম্বার ইশারায় ও ঘাড় ঘুরিয়ে টাকমাথার দিকে দেখল। সঙ্গে-সঙ্গে ওর শরীরের ভেতরে একটা হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল।

টাকমাথা লোকটার ডানহাতে একটা দু-ফুট লম্বা ঝকঝকে চপার। ওটা হাতে ঝুলিয়ে ও জিশানদের কাছে এগিয়ে আসছে।

মিনি অসহায়ভাবে গলা ছেড়ে কেঁদে উঠল।

লম্বা হেসে বলল, ‘জোরে চেল্লালেও কোনও প্রবলেম নেই। এখানে আমরা ছাড়া শোনার মতো আর কোনও পাবলিক নেই।’ জিশানের দিকে চোখের ইশারা করল : ‘নাও। ঝটপট বাচ্চাটাকে নিয়ে বউকে ফ্রি করো। কাজের সময় এসব ক্যাওড়া কিচকিচ ভাল্লাগে না।’

টাকমাথা লোকটা তখন দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে চপারটা শূন্যে তুলে বাতাস কেটে শ্যাডো প্র্যাকটিস করছে আর হাসছে।

জিশানের চোখের সামনে একটা দু:স্বপ্ন ভেসে উঠল। লালে মাখামাখি দু:স্বপ্ন। ও তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে শানুকে কোলে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে মিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

লম্বা লোকটা জিশানকে বলল, ‘গুড বয়। এবার ছেলেকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যাও।’ বেঁটে-লালটু লোকটাকে লক্ষ করে সে বলল, ‘যা, বসকে খবর দে। বল মাল রেডি। কত নম্বর ঘরে ডেলিভারি দেব জিগ্যেস কর…।’

বেঁটে-লালটু রিসেপশান স্পেসের ডানদিকের একটা দরজার দিকে হাঁটা দিয়েছিল। আর টাকমাথা লোকটা তরোয়াল খেলা থামিয়ে চপার তুলে জিশানকে ভেতরের করিডরের দিকে এগোতে ইশারা করল। মুখে বলল, ‘জলদি। কুইক।’

মিনি বুকের কাছে দু-হাত জড়ো করে গুঙিয়ে কাঁদছিল। আর জিশানের বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিল। ওদের তিনজনের মামুলি জীবনে এরকম ভয়ংকর ঘটনা কখনও ঘটবে ও ভাবতে পারেনি। আজ রাতেই কি শেষ হয়ে যাবে ওদের তিনজনের জীবন?

তখনই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেল জিশান। কোনও একটা সিঁড়ি ধরে একটা ভারী শরীর ধীরে-ধীরে নেমে আসছে।

জিশান থমকে দাঁড়াল। আওয়াজটা কোনদিক থেকে আসছে বুঝতে চেষ্টা করল।

কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই ও চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল, বেঁটে-লালটু লোকটা যে-দরজাটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা ও খোলার আগেই দরজার ওপাশ থেকে পাল্লায় প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিল কেউ।

সেই ধাক্কায় বেঁটে-লালটু ছিটকে পড়ল মেঝেতে। পড়েই রইল। দড়াম শব্দ করে দরজার পাল্লা দুটো হাট হয়ে খুলে গেল। দু-দিকের দেওয়ালে বাড়ি খেয়ে আধাআধি ফিরে এল, কাঁপতে লাগল।

যে-লোকটি ঘরে ঢুকল তাকে লোক না বলে পাহাড় বললেই মানায় ভালো।

লম্বায় অন্তত সাড়ে ছ-ফুট। মাথার চুল কীর্তনিয়াদের মতো ঘাড় ছাপিয়ে নেমে এসেছে। কপালের ওপরেও চুলের ঝালর। তারই ফাঁকফোকর দিয়ে ছলছলে চোখ নজরে পড়ছে। ঈগলপাখির মতো নাক। তার নীচে মোটা গোঁফ। গোঁফের পরেই তামাটে রঙের পুরু ঠোঁট। ঠোঁটজোড়া সামান্য ফাঁক হয়ে আছে। তীক্ষ্ণ চিবুকে একখাবলা দাড়ি।

রিসেপশান স্পেস-এ কয়েক পা ঢুকে পাহাড়ের মতো লোকটা থমকে দাঁড়াল। পলকে চোখ বুলিয়ে পাঁচজন মানুষকে চেটে নিল।

লোকটার গায়ে একটা ছেঁড়া টি শার্ট। তার রং কালো। পায়ে নীল রঙের জিনস। জিনসের পায়া দুটো দেড়ফুট করে ছিঁড়ে বাদ দেওয়া। তাই হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত লোমশ পা দেখা যাচ্ছে। তারপরই গাঢ় নীল রঙের স্নিকার—মোজার কোনও বালাই নেই।

 লোকটার দু-হাতে নীল রঙের রিস্ট ব্যান্ড। আর ডানহাতে দুলছে একটা বাদামি রঙের বোতল।

এতক্ষণ যে-লোকটাকে জিশান পালের গোদা ভেবেছিল সে পাহাড়ের কাছে এগিয়ে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, ‘বস, নিয়ে এসেছি…।’ কথা শেষ করার সঙ্গে-সঙ্গে মিনির দিকে দেখাল।

পাহাড় মিনির দিকে দেখল। মিনির সারা গা বৃষ্টিতে ভেজা। পাতলা ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। ঘন-ঘন চোখের পলক পড়ছে। ওর ভয়ার্ত মুখটাকে জলরঙে আঁকা ছবি বলে মনে হচ্ছে।

‘হুঁ-উ-উ…।’ মুখে অদ্ভুত এক শব্দ করল বস। মিনির দিকে পা বাড়াল। এবং সঙ্গে-সঙ্গেই বেঁটে-লালটুর বডিতে হোঁচট খেল।

বেঁটে-লালটুকে ভয়ংকর এক লাথি কষাল বস। ‘ওঁক’ শব্দ করে বেঁটে-লালটুর বডিটা কয়েক পাক গড়িয়ে গেল।

বিরক্তিতে গালাগাল দিল পাহাড়। শূন্যে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিল : ‘এ লালিপপের বাচ্চাটা এখানে পড়ে কেন?’ যেন দরজার ধাক্কা খেয়ে বেঁটে-লালটু যে পড়ে গেছে সেটা পাহাড় খেয়ালই করেনি।

প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে বাকি দুজন দৌড়ে গিয়ে ঝুঁকে পড়ল বেঁটে-লালটুর ওপর। ওর অজ্ঞান বডিটাকে চটপট টেনেহিঁচড়ে সরিয়ে দিল রিসেপশান কাউন্টারের দিকে।

ততক্ষণে বস মিনির দিকে আরও কয়েক পা এগিয়ে এসেছে।

মদের গন্ধটা এখন আর লুকোচুরি খেলছিল না—বরং সরাসরি নাকে এসে ধাক্কা মারছিল।

মিনির খুব কাছে এসে বস থমকে দাঁড়াল। ছলছলে মাতাল চোখে মিনিকে অনেকক্ষণ ধরে দেখল। তারপর ফিসফিস করে উচ্চারণ করল, ‘বিউটিফুল!’

মিনির মুখে মদের বাষ্পের হলকা এসে লাগল। ও ঝটকা মেরে মুখটা একপাশে সরিয়ে নিল।

পাহাড় হাসল। বাঁ-হাতের তর্জনি মিনির চিবুকে ছোঁয়াল। তারপর তর্জনির চাপে মিনির মুখটা ধীরে-ধীরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। অনেকক্ষণ ধরে মিনিকে দেখল। শেষে ভরাট গলায় বলল, ‘যা কান্নাকাটি করার করে নাও। পরে আর প্যানপ্যান কোরো না যেন।’

রিসেপশান স্পেসের শেষ প্রান্তে জিশান পলিথিন মোড়া বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে সম্মোহিতের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। ও যেন এখানকার কেউ নয়। ও যেন বহু দূরে দাঁড়িয়ে একটা মর্মান্তিক সিনেমা দেখছে। ও দর্শক। ওর কিছু করার নেই।

পাহাড় থেমে-থেমে বলল, ‘একে তিননম্বর ঘরে ডেলিভারি দে। ওটা পেয়িং বেড-এর ঘর। কন্ডিশন ভালো।’

জিশান আর থাকতে না পেরে চিৎকার করে উঠল : ‘না—।’

জিশান চায়নি, কিন্তু ওকে অবাক করে অবাধ্য চিৎকারটা কীভাবে যেন গলা দিয়ে বেরিয়ে গেছে।

বস ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল জিশানের দিকে। এক ঝটকায় ডানহাতের বোতলটা ছুড়ে দিল দেওয়ালে। প্রচণ্ড শব্দে চুরমার হয়ে গেল বোতলটা। বোতলের তরল ছিটকে পড়ল। মদের বিশ্রী গন্ধে চারিদিক ম-ম করে উঠল।

আচমকা এই কাণ্ডে মিনি চমকে কঁকিয়ে উঠেছিল। বস ওর দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। মাথা দুলিয়ে জিগ্যেস করল, ‘ও কে রে? হাজব্যান্ড? হাজব্যান্ড? না বয়ফ্রেন্ড?’

না, উত্তরের অপেক্ষা করল না। পাহাড় পায়ে-পায়ে জিশানের দিকে এগোতে লাগল। ঘরের প্রত্যেকে আশঙ্কায় পাথর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

টাকমাথা সঙ্গীর হাত থেকে এক হ্যাঁচকায় চপার ছিনিয়ে নিল। জিশানের আরও কাছে এগিয়ে এল। ওর শরীরে জিশানের শরীর মিনির চোখে ঢাকা পড়ে গেল।

জিশানের খুব কাছে এসে বাঁ-হাতে ওর চিবুক উঁচিয়ে ধরল পাহাড়। তারপর গলাটা যথাসম্ভব মিষ্টি করে জিগ্যেস করল, ‘কীসের ”না” রে? কী ”না” বলছিস?’

জিশান কাঁপছিল। ওর মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোচ্ছিল না।

পাহাড় চপারটা শূন্যে তুলল। ওটার ফলাটা আশীর্বাদের ভঙ্গিতে জিশানের মাথায় পেতে রাখল। তারপর ফিসফিসে গলায় বলল, ‘আমি বলছি। আজ কোনও ”না” শুনব না। সব হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ—।’

এমন সময় জোরে বাজ পড়ল। অসহায় চূর্ণবিচূর্ণ জিশান মদের বাষ্পের বিষবাতাসে শ্বাস নিতে-নিতে কেঁদে ফেলল। আর ওর কোলে ছোট্ট শানুও কেঁপে উঠে কেঁদে ফেলল।

পাহাড় চমকে উঠল। চপারটা নামিয়ে বাচ্চার কান্নার উৎস আঁচ করে জিশানের কোলের দিকে তাকাল। কিন্তু পলিথিন আর কাপড়চোপড়ের আড়ালে শানুকে ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছিল না।

‘কে রে? কে কাঁদছে?’

‘আমাদের বাচ্চা।’ কান্না ভাঙা গলায় জিশান বলল।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো বাঁ-হাত বাড়াল পাহাড়। পলিথিন আর কাপড়ের আড়াল সরাল। পুঁচকে শানুকে দেখা গেল এবার। চোখ কুঁচকে কাঁদছে।

হাত থেকে চপার খসে পড়ে গেল। শানুর ওপর ঝুঁকে পড়ল পাহাড়। আঙুল দিয়ে ওর লালচে গাল ছুঁল।

‘কাঁদে না, বাবু, কাঁদে না। লক্ষ্মী ছেলে। লক্ষ্মী সোনা আমার—।’

জিশান অবাক চোখে কাছের মানুষটাকে দেখতে লাগল। তারপর বলল,—’আমার ছেলেটার ভীষণ জ্বর। এখুনি হসপিটালে না নিয়ে গেলে মরে যাবে…।’

পাহাড় যেন বিদ্যুতের শক খেল। তাড়াতাড়ি শানুর কপাল ছুঁয়ে দেখল। তারপর নিজের মাথার চুলে হাত চালিয়ে আপনমনেই বলল, ‘আমার…আমার বউটা মরে গেল। তারপর…তারপর…মা-কে না পেয়ে এইটুকুন ছেলেটাও মরে গেল। তারপর…।’

মিনি প্রায় ছুটে চলে এল শানুর কাছে। নিষ্ঠুর পাহাড়কে ভ্রূক্ষেপ না করে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল। পিঠ চাপড়ে দোলা দিয়ে ওর কান্না থামাতে চেষ্টা করল।

জিশান জিগ্যেস করল, ‘আপনার ওয়াইফের কী হয়েছিল?’

পাহাড় মিনির কোলে শানুকে দেখছিল। বলল, ‘সবই কপাল! এই জানোয়ার শহর। চারদিকে জংলি জানোয়ার ঘুরছে।…বউটাকে তুলে নিয়ে গেছিল। তারপর…ও ফিরে এসে সুইসাইড করল। তারপর বাচ্চাটা মরে গেল। ব্যস…সব খতম…শুধু আমি বাকি রয়ে গেছি।’

বাইরে বাজ পড়ল আবার।

পাহাড় ওর লম্বা শাগরেদের কাছে ধীরে-ধীরে এগিয়ে গেল। নোংরা খিস্তি দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় দু-হাতে ওর দু-গালে একসঙ্গে চড় কষিয়ে দিল। ছোটবেলায় কাগজের ঠোঙা ফুলিয়ে হাতের চাপড়ে ফাটাত জিশান। এখন ঠিক সেইরকম কানফাটানো শব্দ হল। যমজ চড় খেয়ে লোকটা মেঝেতে খসে পড়ল। তারপর স্থির হয়ে গেল। বোধহয় বেঁটে-লালটুর মতো অজ্ঞান হয়ে গেল।

টাকমাথা লোকটা একটু দূরে দাঁড়িয়ে একইরকম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু পাহাড় ওর কাছে এগিয়ে গেল না। শুধু হুকুম ছুড়ে দিল, ‘এক্ষুনি এদের গাড়ি করে নিয়ে যা। ”ক্যাপিটাল নার্সিংহোম”-এ পৌঁছে দে। দেরি করলে বাচ্চাটার বিপদ হয়ে যাবে। জলদি বেরিয়ে পড়—।’

টাকমাথা বুলেটের গতিতে সদর দরজা খুলে ছুটে বেরিয়ে গেল।

পাহাড় মিনির কাছে এগিয়ে এল। বাঁ-হাতের পিঠ দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিয়ে ছোট্ট করে বলল, ‘সরি। ভুল হয়ে গেছে।’

জিশানের দিকে তাকাল পাহাড় : ‘জলদি যাও। ছেলেটাকে বাঁচাও।’

জিশান আর মিনি তাড়াতাড়ি পা বাড়াল।

কিন্তু পাহাড় পিছন থেকে ডাকল : ‘শোনো—।’

জিশান থমকে দাঁড়াল। ঘুরে তাকাল।

পাহাড় লম্বা পা ফেলে ওর কাছে এগিয়ে এল। জিনসের পকেট থেকে খাবলা মেরে কী যেন তুলে নিয়ে জিশানের জামার পকেটে গুঁজে দিল।

জিশান তাকিয়ে দেখল। একগাদা টাকা।

ওর কান্না পেয়ে গেল। কিছু একটা বলতে গেল, কিন্তু পারল না। ঠোঁট কাঁপল শুধু।

মিনি জলভরা চোখে বিশাল মানুষটাকে দেখছিল।

পাহাড় জিশানকে ঠেলা মারল : ‘দেরি কোরো না। ছেলেটাকে বাঁচাও।’

জিশান আর মিনি সোলাস মেডিকেল কলেজ থেকে বাইরের ঝড়-বৃষ্টিতে বেরিয়ে এল।

সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতে অলৌকিকভাবে বেঁচে গিয়েছিল শানু আর মিনি। তার সঙ্গে জিশানও। আজও শানু আর মিনিকে রক্ষা করতে জিশানকে অলৌকিক কিছু একটা করতে হবে—করতেই হবে।

জিশানের ভেতরে একটা মরিয়া রাগ তৈরি হল। শ্রীধর পাট্টা আর নিউ সিটির সিন্ডিকেটের প্রতি তীব্র ঘৃণা আগ্নেয়গিরির লাভাস্রোতের মতো গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ল ওর সারা শরীরে। বজ্রের শক্তি নিয়ে ওর ডানহাঁটু আছড়ে পড়ল জাব্বার মুখে। জিশান জাব্বার মাথাটা শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে ছিল। তাই সংঘর্ষটা হল মারাত্মক।

জাব্বার নাক থেবড়ে গেল। রক্ত ছড়িয়ে গেল ঠোঁটে, দাঁতে। ওর শক্তিশালী তীব্র মুঠি পলকে ঢিলে হয়ে গেল। ও একঝটকায় কাত হয়ে গড়িয়ে পড়ল মাটিতে।

জিশান সোজা হয়ে দাঁড়াতে চাইছিল, কিন্তু ওর মাথা টলছিল। সারা গায়ে নানারকম জ্বালা-যন্ত্রণা। নাকের পাশে যেখান দিয়ে রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়েছে সেখানটা চুলকোচ্ছে। মাথার ওপরে চক্রাকারে উজ্জ্বল আলো, মাইকে দ্রুতলয়ের ধারাবিবরণী, দর্শকদের উন্মত্ত ক্ষুধার্ত চিৎকার—সব মিলিয়ে কেমন একটা ঘোর তৈরি হয়ে যাচ্ছিল।

সেই অবস্থাতেই দর্শকদের আসনগুলোয় অনুসন্ধানী চোখ বুলিয়ে নিল জিশান। অসম্ভব জেনেও লাল রঙের পোশাক পরা একটা মেয়েকে খুঁজল। কিন্তু পেল না।

জাব্বা কাদা-মাটিতে পড়ে গিয়েছিল বটে কিন্তু ও নি:শেষ হয়ে যায়নি। যাওয়ার কথাও নয়। ও একপাক গড়িয়ে শরীরটাকে চিত করে নিয়েছিল। তারপর সেই অবস্থাতেই ভয়ংকর এক গর্জন করে অদ্ভুত এক লাফ দিয়েছে। এবং জোড়াপায়ের প্রচণ্ড লাথি জিশানের তলপেটে বসিয়ে দিয়েছে।

জিশান ছিটকে উঠল শূন্যে। প্রায় উড়ে গিয়ে ছ’হাত দূরে আছড়ে পড়ল মাটিতে। তারপর পক্ষাঘাতের রুগির মতো অসাড় শরীরে চিত হয়ে পড়ে রইল। ওর শূন্য চোখ চেয়ে রইল ওপরের কালো আকাশের দিকে। উজ্জ্বল আলোর ঝলসানি পেরিয়ে তারাগুলো এমনিতে চোখে পড়ার কথা নয়, কিন্তু জিশানের চোখের সামনে প্রচুর তারা নাচানাচি করছিল। শরীরের কোনও যন্ত্রণাই ও আর টের পাচ্ছিল না।

জাব্বা তখন যুদ্ধ জয়ের ভঙ্গিতে মুঠি উঁচিয়ে গর্তের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর উল্লাসে পশুর মতো হুঙ্কার ছাড়ছে। গ্যালারিতে উত্তেজনা টগবগ করছে। আকাশে বাতাসে শব্দের খই ফুটছে।

প্রচুর শব্দ জিশানের কানে ঢুকে পড়ছিল। দর্শকদের মধ্যে যারা জিশানকে সমর্থন করছিল তারা ওর নাম ধরে গলা ফাটাতে লাগল। উঠে দাঁড়িয়ে জাব্বাকে খতম করার জন্য হিংস্র গলায় ওকে উৎসাহ দিতে লাগল। কেউ-কেউ ওকে কাপুরুষ বলে দুয়ো দিতে লাগল। আর ওর বিরোধী পক্ষ জাব্বার নাম ধরে অদ্ভুত তালে চিৎকার করতে লাগল। তার সঙ্গে স্লোগান তুলল : ‘জিশান—খতম! জিশান—খতম!’

জায়ান্ট টিভির পরদায় বিভিন্ন দর্শকের ক্লোজ-আপ দেখানো হচ্ছিল। মাঝে-মাঝে ভেসে উঠছিল শ্রীধর পাট্টার মুখ। তার সঙ্গে উত্তেজিত গলায় মণীশ আর রাজশ্রীর ধারাবিবরণী।

টিভিতে দেখা গেল, গ্যালারিতে জাব্বা আর জিশানের সমর্থক দু-দল দর্শকের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে। সিকিওরিটি গার্ডের দল শকার হাতে সেই লড়াই নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। টিভির ধারাবিবরণী আর ছবি পিট ফাইটের জীবন্ত উত্তেজনা নিউ সিটির ঘরে-ঘরে নিখুঁতভাবে পৌঁছে দিচ্ছিল।

.

০৮.

শুয়ে থাকা জিশানের মনে একটা আক্ষেপ তৈরি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ও খুব ক্লান্ত—আর পারবে না। মিনি-শানুর কাছে ফিরতে পারবে না। মনোহরকে দেওয়া কথা রাখতে পারবে না।

ঠিক তখনই জাব্বা দেওয়ালের এক কোণ থেকে ব্ল্যাক মাম্বা সাপটা মুঠো করে তুলে নিয়েছে। ছুড়ে দিয়েছে জিশানের বুকের ওপরে।

কয়েক লহমা সাপটা ল্যাকপ্যাকে কালো পাইপের মতো জিশানের বুকের ওপরে পড়ে রইল। ওর কালো রঙের জিম ভেস্টের সঙ্গে সাপটা মিশে গেল। পরমুহূর্তেই ওটা ক্ষিপ্রগতিতে ছোবল মারল জিশানের গলায়।

জিশান যন্ত্রণায় ঝাঁকুনি খেল। সাপটার বিষ যে বের করে নেওয়া হয়েছে সে-কথা ভুলে গেল। চেতন আর অচেতন জগতের সীমারেখায় একটা ঘোরের মধ্যে দাঁড়িয়ে জিশান মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। মনে হতে লাগল, ও আর পারবে না। প্রতি মুহূর্তে ও শেষ মুহূর্তের দিকে এগোচ্ছে।

এমন সময় এক তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল জিশান।

‘জিশান! জিশা—ন!’

না, জায়ান্ট টিভি থেকে নয়—এই ডাক শোনা যাচ্ছে দর্শকদের গ্যালারি থেকে। একটা তীব্র মেয়েলি চিৎকার। সব হারানোর মুহূর্তে কেউ যেন জিশানের কাছে সাহায্য চেয়ে পাগলের মতো মরিয়া চিৎকার করছে।

ঝাপসা চোখে জিশান মেয়েটিকে খুঁজে চলল। কোথায়? কোথায়?

একটা লাল ঝলক দেখতে পেল। গ্যালারি থেকে ছুটে নেমে আসছে লাল জামা পরা একটা মেয়ে। ওর বয়কাট চুল পিছনদিকে উড়ছে। ও সিঁড়ির ধাপে পা ফেলে ছুটে নামার তালে-তালে সেই চুল লাফাচ্ছে।

রূপকথা!

কথা রেখেছে ও। সত্যি ও লাল ড্রেস পরে এসেছে। কোমর পর্যন্ত ফুলহাতা শার্ট একটা। তার সঙ্গে প্যান্ট। সেটার রং কালো বা নীল একটা কিছু।

মেয়েটা পলকে চলে এল গর্তের কিনারায়। জিশানের দিকে তাকিয়ে গর্তের কিনারা বরাবর দৌড়ে পাক খেতে লাগল। আর জিশানের নাম ধরে উদভ্রান্তের মতো চিৎকার করতে লাগল।

 কোনও সিকিওরিটি গার্ড রিমিয়াকে বাধা দেয়নি। বরং এই গেম শো-র জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য টিভি ক্যামেরা রিমিয়াকে ধরে ফেলল। জায়ান্ট টিভির পরদায় ওর ছবি ধরা পড়ল। ওর চিৎকার শোনা গেল লাউডস্পিকারে।

‘জিশান! জিশান! ওঠো! উঠে পড়ো! তোমাকে জিততে হবে, জিশান—উঠে পড়ো! তুমি বলেছিলে আমি এই খেলা দেখতে এলে তোমার খুব জিততে ইচ্ছে করবে। মনে নেই সে-কথা? আমি তো খেলা দেখতে এসেছি। এবার তুমি তোমার কথা রাখো। ট্রাই হার্ড টু উইন! কাম অন, জিশান! বি আ ম্যান—।’

রিমিয়া চিৎকার করে কথাগুলো বলছিল আর গর্তের পাড়ে পাগলের মতো পাক খাচ্ছিল। ওর লাল জামাটার ওপরে জিশান নজর রাখতে চেষ্টা করছিল। ওর মনে হচ্ছিল, ওটা ম্যাটাডরের লাল রেশমি রুমাল। আর বুল ফাইটের রিং-এর ভেতরে জিশান রক্তাক্ত আহত জেদি ষাঁড়।

রিমিয়াকে দেখতে-দেখতে—অথবা, ওর লাল জামাটা দেখতে-দেখতে—জিশানের ভেতরে একটা গোঁ মাথাচাড়া দিল। ওর না শপথ ছিল মরার আগে ও মরবে না! মালিক আর মনোহরকে ও কথা দিয়েছে না!

আচমকা ব্ল্যাক মাম্বার ছোবল এসে পড়ল জিশানের গালে। গালটা যেন জ্বলে গেল। রক্তের রেখা গড়িয়ে পড়ল ফরসা গাল বেয়ে।

কোন এক অলৌকিক শক্তিতে জিশান উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে-সঙ্গে গর্তের কিনারায় বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকা রিমিয়া থমকে দাঁড়াল। বাচ্চা মেয়ের মতো আনন্দে হাততালি দিয়ে লাফাতে লাগল। ‘জিশান! জিশান!’ বলে খুশিতে চিৎকার করতে লাগল।

জিশানের গা থেকে সাপটা খসে পড়েছিল মাটিতে। ওটার দিকে তাকাল জিশান। হিংস্রতার ঢেউ হঠাৎই উথলে উঠল ওর শরীরে। চোখের পলকে সাপটাকে পা দিয়ে চেপে ধরল। তারপর ঝুঁকে পড়ে দু-হাতের আঙুল বাঁকিয়ে কয়েক খাবলা মাটি তুলে সাপটার মাথা লক্ষ্য করে সজোরে চাপড় মেরে বসিয়ে দিল। একবার—দুবার—বারবার।

আঠালো মাটির নীচে সাপটা জ্যান্ত কবরে চলে গেল। সেই কবরের ওপরে জিশান পা দিয়ে দুরমুশ করতে লাগল। সাপটাকে দম আটকে মরতেই হবে—মরতেই হবে।

এবার জাব্বা।

জাব্বার দিকে তাকাল জিশান। ও তখনও দর্শকদের দিকে তাকিয়ে উল্লাসের অঙ্গভঙ্গি করছে। রিমিয়ার কাছাকাছি গিয়ে জাব্বা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। মুখ উঁচু করে ওর দিকে তাকিয়ে ইশারায় নিজের গলায় ছুরি চালানোর ভঙ্গি করল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘তোর জিশান…খতম!’

এতক্ষণ জাব্বা জিশানকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনেনি। এমন ভাব দেখাচ্ছিল যেন পিট ফাইট শেষ হয়ে গেছে। জিশানের শক্তির শেষ বিন্দুটাও ও ব্লটিং পেপারের মতো শুষে নিয়েছে। তাই ও অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিল। আর সেটাই ওর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল।

জাব্বাকে লক্ষ্য করে আচমকা দৌড় শুরু করল জিশান।

চোখের কোণ দিয়ে আক্রমণটা খেয়াল করে জাব্বা যখন জিশানের দিকে ঘুরে দাঁড়াল ততক্ষণে কয়েক মুহূর্ত দেরি হয়ে গেছে।

দুটো বলবান শরীরের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হল। শরীরে শরীর জট পাকিয়ে গর্তের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ওরা ঠিকরে পড়ল মাটিতে। তারপর দু-দিকে ছিটকে গেল।

জিশান বুঝতে পারছিল, যা কিছু করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। কারণ, ওর ক্ষমতা চুঁইয়ে-চুঁইয়ে প্রায় শেষের দিকে। সুতরাং, এখনই—এখনই।

জাব্বা নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিল, জিশান সেই মুহূর্তে তিনপাক গড়িয়ে পৌঁছে গেল ওর কাছে। চিত হওয়া অবস্থায় শরীরের নীচের অংশটাকে একঝটকায় শূন্যে তুলে লাথি বসিয়ে দিল জাব্বার মুখে। আর প্রায় একইসঙ্গে ওর পা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল।

জাব্বা আবার পড়ে গেল, কিন্তু তারই মধ্যে জিশানের বাঁ-চোখে একটা মারাত্মক ঘুসি বসিয়ে দিল।

জিশান উঠে বসতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর চোখের সামনে পলকে সবকিছু মুছে গিয়ে অসংখ্য তারা ঝিলমিল করে উঠল আবার।

কিন্তু জিশান থামল না। ওই ‘অন্ধ’ অবস্থাতেই প্রতিরক্ষার পদক্ষেপ নিল। ক্ষিপ্রগতিতে জোরালো ঘুসি ছুড়ে দিল সামনে। এবং জাব্বার মুখ ঘুসির নাগালে পেয়ে গেল।

নজর পরিষ্কার করতে জিশান বারদুয়েক ঝটকা মেরে মাথা ঝাঁকাল। তারপর চোখ খুলতেই বুঝতে পারল, ও এখন একটা চোখে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু ওর অন্য চোখটা গেল কোথায়? এখন কোনদিকে তাকিয়ে আছে সেটা? চোখটা কোটরে আছে তো, নাকি বাইরে বেরিয়ে এসেছে?

প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় নেই। এখন শুধু প্রতিরক্ষা। মারের বদলা মার।

জিশান ঝাপসা নজরে তাকাল জাব্বার দিকে। এবং তাকিয়েই অবাক হল।

জাব্বা কোথায়? ওর সামনে শ্রীধর পাট্টার মুখ। সে-মুখে কাদা-মাটি লেগে রয়েছে। রয়েছে রক্তের ছাপ।

জিশান হুমড়ি খেয়ে পড়ল শ্রীধরের শরীরের ওপরে। পাগলের মতো ঘুসি মেরে চলল। ঘুসির পর ঘুসি। শ্রীধরের মুখটা আরও লাল হয়ে যেতে লাগল। হামানদিস্তের ভেতরে রসুনের কোয়া ছেঁচার মতো জিশানের লোহার হাত শ্রীধরের মুখ ছেঁচতে লাগল।

চোখের সামনে জাব্বার মুখটা ফিরে এল আবার। ও চিৎকার করছিল। ওর শরীরটা মাথা ছেঁচে দেওয়া মাগুরমাছের মতো ছটফট করতে লাগল। ওর হাতের আঙুল কখনও জিশানের বাহু, কখনও বাতাস আঁকড়ে ধরছিল।

জিশানের ডানহাতের আঙুলের গাঁট ছড়ে গিয়ে মাংস বেরিয়ে পড়েছে. হাতের মুঠো রক্তে মাখামাখি। বেশিরভাগটাই ওর রক্ত—বাকিটা জাব্বার। কিন্তু ওর শরীর এতটাই অসাড় হয়ে গেছে যে, কোনও যন্ত্রণা ও আর টের পাচ্ছিল না।

জাব্বা হঠাৎই জিশানের গলার নাগাল পেয়ে গেল। ওর সাঁড়াশির মতো আঙুল চেপে বসল গলার নরম মাংসে। জিশানের মাথার ভেতরে একটা শিরা দপদপ করতে লাগল। ওদের যুযুধান শরীর দুটো আহত কেন্নোর মতো পাকাতে লাগল, পরস্পরের সঙ্গে জড়াজড়ি করে এপাশ-ওপাশ মোচড় দিয়ে লড়াই করে চলল।

জিশান বুঝতে পারছিল ওর ব্যাটারি ফুরিয়ে আসছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ওকে লড়াই শেষ করতে হবে—অথবা, নিজে শেষ হয়ে যাবে। একটু আগে কবর দেওয়া সাপটার কথা মনে পড়ল ওর। জাব্বা সাপের চেয়ে কম কী!

মুহূর্তের মধ্যে স্যাঁতসেঁতে জমি থেকে একখাবলা মাটি তুলে নিল জিশান। এক প্রচণ্ড হুঙ্কার তুলে সেই মাটিসমেত হাত দেওয়ালে ঘুঁটে দেওয়ার ঢঙে আছড়ে দিল জাব্বার রক্তাক্ত মুখের ওপরে।

দম আটকে আসায় জাব্বার শরীরটা ধনুকের মতো বেঁকে গেল। জিশানের গলায় ওর হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে গেল। মুখে ঢুকে যাওয়া মাটি থু-থু করে ছুড়ে দিল শূন্যে। তারপর সবে ও যখন বড় করে একটা শ্বাস টানতে শুরু করেছে অমনি জিশানের মাটিসমেত হাতের থাবা ওর মুখে আছড়ে পড়ল দ্বিতীয়বার। তৃতীয়বার। এবং আরও অনেকবার।

জিশান যেন পাগল হয়ে গেছে। দ্বিতীয় ‘সাপ’টাকে কবর দিতে চাইছে প্রাণপণে।

জাব্বার গলা দিয়ে চাপা ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে এল। একটানে ওর কাহিল শরীরটাকে উপুড় করে দিল জিশান। ভাঁজ করা হাঁটু নিয়ে শরীরের সমস্ত ওজন আছড়ে দিল ওর শিরদাঁড়ার ওপরে। তারপর ঘোড়ায় চড়ার মতো ওর পিঠে চেপে বসল। মাথাটা দু-হাতে আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে টানতে লাগল পিছনদিকে।

জাব্বার ঘাড় ক্রমশ ভাঁজ হয়ে যেতে লাগল। মনে হচ্ছিল, জিশান ওকে জোর করে আকাশ দেখাতে চাইছে, আকাশের তারা দেখাতে চাইছে।

একটা ‘মট’ শব্দ হল। হয়তো জাব্বার ঘাড়ের হাড়ের ঠোকাঠুকির শব্দ। একটু আগেই মুখের মাটি থু-থু করে ফেলে দিয়ে জাব্বা হাঁ করে বড়-বড় শ্বাস নিচ্ছিল। সেটা এখন বন্ধ হয়ে গেছে। ওর মুখ থেকে কোনও চাপা ঘড়ঘড় শব্দও বেরোচ্ছে না। ও হয়তো অক্ষম শরীরে শেষ মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করছে।

জিশানও বুঝতে পারছিল আর মাত্র দু-এক ডিগ্রি। ঘাড়টাকে আর দু-এক ডিগ্রি পিছনদিকে বাঁকাতে পারলেই লড়াই খতম—জাব্বাও খতম।

কিন্তু হঠাৎই ওর সামনে ঝড়-বৃষ্টির সেই রাতটা ভেসে উঠল। পাহাড়ের মতো সেই ভয়াবহ মানুষটা সেদিন অনেক কিছুই করতে পারত—কিন্তু করেনি। করেনি বলেই আজ জিশান এখানে মিনি আর শানুর জন্য মরণপণ লড়াই করছে। পাহাড়ের মতো সেই মানুষটার শুধু শরীরটাই পাহাড় ছিল না, একপলকে ওর মনটাও হয়ে গিয়েছিল অনেক বড়—পাহাড়ের মতো। এখন জিশান কি সেরকম কিছু একটা…।

জাব্বার মাথাটা আচমকা ছেড়ে দিল জিশান।

গ্যালারি থেকে উন্মত্ত দর্শকের দল এতক্ষণ ‘খতম! খতম!’ বলে রণডঙ্কা বাজাচ্ছিল। জিশান জাব্বার মাথাটা ছেড়ে দিতেই সব চেঁচামেচি একলহমার জন্য থেমে গেল। গ্যালারি থেকে একটা বিশাল দীর্ঘশ্বাসের ‘ফোঁস’ শব্দ শোনা গেল যেন। তারপরই জিশানের নামে গ্যালারির প্রতিটি বিন্দু কেঁপে উঠল।

জাব্বার শরীর ছেড়ে টলতে-টলতে উঠে দাঁড়াল জিশান। ও হাপরের শব্দ করে হাঁপাচ্ছিল। জাব্বা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। শরীর স্থির হলেও শ্বাসপ্রশ্বাসের সামান্য ওঠা-নামা চোখে পড়ছে। সেদিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থাকার পর প্রতিদ্বন্দ্বীর গায়ে থুতু ছুড়ে দিল জিশান। টকটকে লাল রঙের থুতু দেখে ও নিজেই অবাক হয়ে গেল।

জায়ান্ট টিভির পরদায় সুন্দরী রেফারিকে দেখা গেল এবার। মিষ্টি গলায় ছত্রিশরকম উল্লাস ফুটিয়ে রেফারি চিৎকার করে বলল, ‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলমেন, দ্য উইনার ইজ জিশা—ন। জিশান পালচৌধুরী।’

সঙ্গে-সঙ্গে গ্যালারিতে চিৎকারের নতুন ঢেউ ফেটে পড়ল। রিমিয়া গর্তের কিনারায় পাগলের মতো নাচতে শুরু করল। গ্যালারির দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল প্রতিটি দর্শক এখন শুধু জিশানেরই সাপোর্টার।

লাউডস্পিকারে ব্যান্ডের বাজনা বেজে উঠল। গ্যালারিতে রঙিন বেলুন উড়তে লাগল, পটকা ফাটতে লাগল, হরেকরকম বাজির লাল-নীল-সবুজ আলোর রোশনাই ছড়িয়ে গেল রাতের আকাশে।

টিভিতে জিশানের কৃতিত্বের অডিয়োভিশুয়াল শুরু হয়ে গেল। ধারাভাষ্যকাররা বলতে লাগল, কিল গেম-এর জন্য এরকম হাই পোটেনশিয়াল ফাইটার সত্যিই আগে কখনও আসেনি।

জয়ীর অভিনন্দন কুড়োতে জিশান ওর রক্তাক্ত ডানহাতটা কোনওরকমে একবার ওপরে তুলল। তারপরই বাঁধভাঙা জলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া ক্লান্তির চাপে ও সটান খসে পড়ল মাটিতে।

সঙ্গে-সঙ্গে শ্রীধর পাট্টার নির্দেশে ইমার্জেন্সি মেডিকেল ইউনিট কাজে নেমে পড়ল। লুকোনো ক্রেন দুটোর ধাতব বাহু এগিয়ে এল গর্তের কেন্দ্রের দিকে। তার দুটো কেবিনে ছ’জন করে মেডিক। দক্ষ পরিচালনায় কেবিন দুটো গর্তের ভেতরে নামতে শুরু করল।

জায়ান্ট স্ক্রিনে একবার জিশানের ক্লোজ-আপ আর একবার জাব্বার ক্লোজ-আপ দেখানো হচ্ছিল। দেখানো হচ্ছিল ওদের পিট ফাইটের নানা অংশের স্লো মোশান ক্লিপিং। তারই মধ্যে ইনসেটে মেডিকদের তৎপরতা আর তদারকির লাইভ টেলিকাস্ট চলছিল।

জিশান অসাড় হয়ে মাটিতে পড়েছিল বটে কিন্তু ও অজ্ঞান হয়ে যায়নি। ওর চোখের পাতা এতটাই ভারি ঠেকছিল যে, শত চেষ্টা করেও ও চোখ খুলতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল দুটো লোহার বাটখারা কেউ ওর চোখের পাতার ওপরে বসিয়ে দিয়েছে। ওর ভীষণ ঘুম পাচ্ছিল কিন্তু ঘুম আসছিল না। কেমন একটা তন্দ্রার ঘোরের মধ্যে সাবানজলের রঙিন বুদবুদের মতো ও যেন আলতোভাবে ভেসে বেড়াচ্ছিল।

ওর কানে নানান আওয়াজ ঢুকছিল। দর্শকদের চিৎকার, পটকার শব্দ, টিভির ধারাবিবরণী…সবই যেন স্বপ্নের মধ্যে শোনা শব্দের মতো ওর কানে আসছিল।

চোখ বুজেই জিশান শানুকে দেখতে পেল। বাচ্চাটা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। অনেক নতুন-নতুন কথা শিখে গেছে। ওর হাসিটা এখন আরও শক্তিশালী চুম্বক হয়ে উঠেছে।

শানু ডাকল জিশানকে। যেন স্পষ্ট গলায় বলল, ‘বাপি, চলে এসো।’

‘যাই, সোনা। আর একটু—মাত্র একটা গেম। ব্যস, তারপরই আমি ফিরে যাব।’

‘ওটা তো কিল গেম, বাপি?’

‘হ্যাঁ, বাবা। ওটা কিল গেম। ওটা শেষ করেই আমি তোর কাছে ফিরে যাব…।’

‘তাড়াতাড়ি এসো, বাপি। তোমাকে ছেড়ে আর ভালো লাগছে না।’

‘আমারও…।’

তন্দ্রার মধ্যেই জিশান কেঁদে ফেলল। কতদিন ওর ছোট্ট সোনাকে ও দেখেনি!

লাউড স্পিকারে তখন মণীশের গলা শুনতে পাচ্ছিল জিশান।

‘…এখন জিশান আর জাব্বাকে লেভেল ওয়ান ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হবে। এক্সট্রিম কেয়ার ট্রিটমেন্ট করা হবে ওদের। সুপার চ্যাম্পিয়ান জিশান সেরে উঠলে ওকে আবার কিল গেম ট্রেনিং-এ ফেলা হবে। পালা করে রেস্ট আর ট্রেনিং দিয়ে দু-মাসের মধ্যে ওকে সুপারফিট করে তোলা হবে। তারপর…।’

জিশান জানে তারপর কী। তারপর ছোট্ট দুটো শব্দ : কিল গেম।

স্মার্ট জিমের ন্যানোমিরারের সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন শ্রীধর পাট্টা। ন্যানোস্ট্রাকচারের রিফ্লেকটিং পার্টিকল দিয়ে তৈরি বিশাল আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন। আধুনিক প্রযুক্তির এই আয়নায় শ্রীধরের শরীরের প্রতিটি রোমকূপ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

আয়নায় যা দেখলেন তাতে খুশি হলেন শ্রীধর।

ফরসা ছিপছিপে শরীর। মেয়েলি ঢঙে কথা বললেও শরীরটা মরদের মতো। পটল কিংবা কচি শশার মতো ছোট-ছোট পেশি দিয়ে তৈরি। ফরসা গায়ে লোমের কোনও চিহ্ন নেই। জিমে ব্যায়াম শুরু করার আগে মালটিভাইটালাইজার তেল মেখেছেন বলে চামড়া চকচক করছে। একইসঙ্গে চকচক করছে গলার খাটো চেনটা। অনেকটা ডগ চেনের মতো—প্লাটিনাম আর হিরের ‘পুঁতি’ দিয়ে তৈরি। শ্রীধরের শরীরের একমাত্র অলঙ্কার।

শ্রীধরের চুল তেল মাখানো—টান-টান করে পিছনদিকে আঁচড়ানো। বটগাছের ঝুরির মতো সেই চুল কাঁধ ছুঁয়ে ঝালর হয়ে ঝুলছে।

ডানহাত তুলে চুলের ঝালরে আঙুল বোলালেন শ্রীধর। মনে-মনে ভাবলেন, চুল নয়—সিংহের কেশর। আর লোমহীন এই শরীরটা সিংহ।

ঠোঁটের লাল টুকটুকে লিপস্টিকের দিকে তাকালেন। ফ্লুওরেসেন্ট রং দিয়ে তৈরি বলে তা থেকে আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। কয়েকসেকেন্ডের জন্য ঠোঁট ছুঁচলো করলেন। খুঁটিয়ে দেখে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে গেলেন। সিংহের ঠোঁট। যার আড়ালে রয়েছে ধারালো দাঁত।

শ্রীধরের পায়ে কালো রঙের স্কিন-টাইট পলিট্রাউজার। কোমরে দেড়ইঞ্চি চওড়া মেটাল সেগমেন্টেড বেল্ট। মনে হচ্ছিল, শ্রীধর যেন কোনও কমপিটিশান বা গেমের জন্য তৈরি।

আয়নায় নিজের ছবির দিকে স্থির চোখে তাকালেন। তারপর পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে কাল্পনিক শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ের মূকাভিনয় শুরু করলেন।

কার সঙ্গে লড়ছেন শ্রীধর? ওঁর তো কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই! তাই সবসময় ওঁর লড়াই নিজের সঙ্গে। শ্রীধর নিজেই নিজের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রতিমুহূর্তে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। আর সেই চেষ্টা করেন বলেই নিউ সিটিতে শ্রীধর পাট্টাই শেষ কথা।

এই ‘শেষ কথা’ মানুষটার শুরুটা হয়েছিল ওল্ড সিটির নোংরা আবর্জনাময় ফুটপাথে। ছোটবেলা থেকেই এই লোকটা নিষ্ঠুর হিংস্র পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য লড়ছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় বাড়ি ফেরাটা ওর কাছে ছিল রোজকার ব্যাপার। তাতে অবশ্য কোনও অসুবিধে হয়নি—কারণ, ওর বাড়ি বলতে যা বোঝায় সেরকম কিছু ছিল না। অন্যান্য বাড়িতে সাধারণত আর যারা থাকে—মানে, মা, বাবা, ভাই, বোন—ছেলেটার সেরকমও কেউ ছিল না।

আসলে জন্ম থেকেই ছেলেটা দেখছে ওর মা-বাবা নেই। ওর চারপাশে সব অচেনা মুখ আর অচেনা মানুষ। ওকে সবাই ডাকত পল্টন বলে। সেখান থেকে কীভাবে যেন নামটা ‘পিলটু’ হয়ে গিয়েছিল। দরমা আর পলিথিন শিটের আড়ালে ছেলেটা ‘মানুষ’ হচ্ছিল। ফুটবল খেলায় বাইশটা মানুষ মিলে একটা বলকে যেমন লাথি মারে, ঠিক সেইভাবে বাইশ কিংবা চুয়াল্লিশ পায়ের লাথি খেতে-খেতে ছেলেটা বড় হচ্ছিল। কখনও এ-বাড়িতে ঠাঁই হয় তো কখনও ও-বাড়ি। যদিও ‘বাড়ি’ মানে ছেঁড়া-ফাটা তালিমারা ঝুপড়ি।

ছেলেটার একটাই সম্পদ ছিল : গায়ের রং। ওইরকম টকটকে ফরসা হাতির দাঁতের মতো গায়ের রং ওর সঙ্গী-সাথী আর কারও ছিল না। ওকে সামনে রেখে বড়রা আলোচনা করত, নিশ্চয়ই ও খুব বড় ঘরের ছেলে—বাবা-মায়ের কোল থেকে ছোটবেলায় হারিয়ে গেছে। সেসব শুনে একটা অলীক আকাঙ্ক্ষা ছেলেটার ভেতরে লকলক করে উঠত। ও তখন থেকেই বুঝত ‘বড় ঘর’ মানে বড়লোক। আর বড়লোক মানে বড় ক্ষমতা। সেই বড় ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য ছেলেটা ভেতরে-ভেতরে নেড়ি কুকুরের মতো জিভ বের করে লোভে হাঁপাত।

.

০৯.

পয়সা রোজগার করার জন্য ছেলেটা তখন নিয়মিত চুরি করত, পকেট মারত, আর কখনও-কখনও ভিক্ষে করত। একইসঙ্গে ও বুঝত, এইভাবে চললে এককোটি বছর পরেও ওর স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে। ততদিনে ওর লোভের জিভ কয়েকশো মাইল লম্বা হয়ে যাবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না।

অন্য কেউ হলে হয়তো হতাশ হয়ে পড়ত, হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু পিলটু অন্য ধাতুতে গড়া। ও প্রতি মুহূর্তে একটা সুযোগ খুঁজছিল। আর লড়াই করে বাঁচছিল।

আয়নার দিকে তাকিয়ে যেন পিলটুকে দেখতে পেলেন শ্রীধর। সেইসঙ্গে ভাগ্যফেরানো সেই দিনটাকেও দেখতে পেলেন। দিনটা ছিল মেঘলা। কিন্তু তারই আড়ালে চোদ্দোবছরের ছেলেটার জীবনে মোড় ঘোরানো একটা সূর্য লুকিয়েছিল।

তখন দুপুর হলেও আকাশে জমে থাকা গাঢ় ছাইরঙের মেঘ দুপুরটাকে সন্ধে করে দিয়েছিল। তারই মধ্যে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। একটা মাঝারি রাস্তার ধারে তিনটে প্রাইভেট কার দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িগুলোর চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল পরিত্যক্ত গাড়ির কবরখানা থেকে ওগুলোকে তুলে আনা হয়েছে। রং চটা, তোবড়ানো, বডির নানান জায়গায় চকোলেট কিংবা সাদা রঙের পুডিং ঘষা।

গাড়ি তিনটেয় কোনও লোক ছিল না—ড্রাইভারও না। তাই বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় ঘুরতে-ঘুরতে এই তিনটে গাড়িকেই টার্গেট করেছিল পিলটু। ওর ঢোলা প্যান্টের পকেটে লুকোনো ছিল একটা বড় স্ক্রু-ড্রাইভার আর একটা হাতুড়ি। এই দুটো সাধারণ যন্ত্র দিয়েই ও গাড়ির হেডলাইট, টেললাইট, ড্যাশবোর্ডের মিটার, আরও অনেক কিছু খুলে নিতে পারে। গত কয়েক বছরে ও এই কাজটায় বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠেছে। পকেট মারার চেয়ে এই কাজটা অনেক নিরাপদ। তাই গাড়ির পার্টস চুরি করে বিক্রি করাটাই পিলটুর আসল পেশা। যখন পার্টস চুরি করার মতো কোনও গাড়ি কপালে জোটে না তখন ও ঝুঁকি নিয়ে পকেট মারার কাজে হাত দেয়। সেখানেও কিছু না জুটলে তখন নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা। শেষের কাজটায় গায়ের রংটা ওকে সাহায্য করে। কারণ ওর মতন টকটকে ফরসা ভিখারি ওল্ড সিটিতে বিলুপ্ত প্রজাতি।

মাঝের গাড়িটার লক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ড্যাশবোর্ডের নীচে উবু হয়ে বসে চোরাশিকারির মতন কাজ সারছিল। আর মাঝে-মাঝে মাথা উঁচু করে জানলা দিয়ে বাইরে উঁকি মেরে দেখে নিচ্ছিল গাড়ির মালিক হতে পারে এমন কেউ গাড়ির দিকে আসছে কি না।

রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই। কখনও-কখনও দু-একটা গাড়ি ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ তুলে ছুটে যাচ্ছে। পিলটুর গাড়ির চালে বৃষ্টির ফোঁটা একঘেয়ে শব্দ করে নাচানাচি করছে। ও একমনে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে ড্যাশবোর্ডটা খুলছিল আর ভাবছিল ড্যাশবোর্ডে লাগানো তিনটে মিটার খুলে বেচে দিতে পারলে বেশ কিছু টাকা পাওয়া যাবে। সেই টাকায় ও টোস্ট আর কষা মাংস খেতে পারবে। কতদিন যে ও মাংস খায়নি!

জিভে জল এসে গেল। খিদে চাগাড় দিয়ে উঠল।

আর ঠিক তখনই বেপরোয়া গতির কালো গাড়িটা মাতালের মতো এলোমেলো পথে ছুটে এল। চাকা আর ব্রেকের আর্তনাদ তুলে পার্ক করা তিনটে গাড়িকে নেহাতই ভাগ্যের জোরে এড়িয়ে রাস্তার ধারের একটা ল্যাম্পপোস্টে গিয়ে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল। ল্যাম্পপোস্টটা কাত হয়ে গেল। হেলে পড়তে গিয়েও কীভাবে যেন আটকে গেল।

গাড়ির ভেতর থেকে অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্যটা দেখতে পেল পিলটু।

রাস্তায় লোকজন প্রায় ছিল না। কালো মেঘ আর বৃষ্টি বহু মানুষকেই বাড়িতে বন্দি করে রেখেছে। তা ছাড়া পিলটু আগেই খেয়াল করেছিল, এ রাস্তায় বেশ কয়েকটা ভাঙাচোরা বাড়ি। চেহারা দেখে মনে হয় বাড়িগুলো সাপখোপ বাদুড় চামচিকের পারমানেন্ট অ্যাড্রেস। সাধারণত এরকম নিরাপদ অঞ্চল দেখেই পিলটু রাস্তার ধারে পার্ক করা ‘নিরাপদ’ গাড়ি বেছে নেয়—তারপর কাজে হাত দেয়। সুতরাং অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারটা পিলটু ছাড়া আর কেউ খেয়াল করেছে বলে মনে হল না।

ড্যাশবোর্ডের ওপরে চোখ তুলে পিলটু উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে সতর্ক নজরে অ্যাকসিডেন্ট করা গাড়িটাকে দেখছিল।

যেটা ওর সবচেয়ে অবাক লাগল সেটা হল, গাড়িটা ঝাঁ-চকচকে। কালো বডির ওপরে নানান জায়গায় স্টেইনলেস স্টিল। এরকম ফ্যানট্যাসটিক মডেলের গাড়ি ছেলেটা আগে কখনও ওল্ড সিটিতে দেখেনি। গাড়িটার সারা শরীর থেকে বিলাসিতা আর অহঙ্কার ফুটে বেরোচ্ছে। গাড়ির ছাদে গোল প্লেটের মতো কী একটা জিনিস খাড়া করে বসানো রয়েছে। প্লেট টিভিতে নিউ সিটির নানান প্রাোগ্রাম দেখে পোড় খাওয়া ছেলেটার মনে হল, ওই প্লেটটা বোধহয় ডিশ অ্যানটেনা।

সবমিলিয়ে ছেলেটা সিদ্ধান্ত নিল, এই কালো গাড়িটা নিউ সিটির গাড়ি।

চাকা আর ব্রেকের শব্দ পেয়ে চমকে মাথা তুলে জানলা দিয়ে তাকিয়েছিল। তারপর অ্যাক্সিডেন্টটা বলতে গেলে ওর চোখের সামনেই ঘটে গেছে। তখনই খেয়াল করেছে, গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই।

তা হলে কি ড্রাইভার মদ খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল? নইলে এভাবে আঁকাবাঁকা পথে ছুটে এসে ল্যাম্পপোস্টে ধাক্কা মারার কারণ কী?

নতুন ঝকঝকে গাড়িটা এভাবে অ্যাক্সিডেন্ট করায় ছেলেটার খুব খারাপ লাগল। আবার একইসঙ্গে ওর আনন্দও হল। কারণ, ড্রাইভারটা যদি এই ধাক্কার চোটে অজ্ঞান হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে ওর কপাল খুলে যাবে। এই গাড়িটার কিছু পার্টস ও ঝটপট হাতিয়ে নিতে পারবে। আর ড্রাইভারের পকেটে কিছু মালকড়ি থাকলে তাও চেটেপুটে সাফ করতে পারবে।

হাতের কাজ ফেলে রেখে ছেলেটা গাড়ি থেকে বাইরে বেরোল। তখনই ও দেখল, অ্যাক্সিডেন্ট করা গাড়িটা থেকে নেমে এল সুট-বুট পরা একজন মাঝবয়েসি মানুষ। তার হাতে একটা চওড়া ফোন—বোধহয় স্যাটেলাইট ফোন।

 লোকটার কপাল গাল বেয়ে রক্ত পড়ছে। গায়ের ছাই-রঙা সুটে রক্তের দাগ। লোকটা বাঁ-হাতে রুমাল চেপে ধরেছে কপালে, আর পাগলের মতো ফোনের বোতাম টিপে কাউকে ফোন করার চেষ্টা করছে। উদভ্রান্তের মতো এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

এমনসময় বিকট গর্জন তুলে একটা হাই-পাওয়ার মোটরবাইক ছুটে এল। বাইকটা ধুলো-কাদা মাখা। তার সামনে-পিছনে অনেকগুলো লাইট লাগানো। বাইকে বসে আছে দুজন লোক। মাথায় কালো হেলমেট, চোখে কালো সানগ্লাস। গায়ে কালো টি-শার্ট, পায়ে ফেডেড জিনস। পিছনে বসে থাকা লোকটার হাতে একটা লম্বা নলওয়ালা পিস্তল।

সুট-বুট পরা লোকটা টলতে-টলতে ছুটে গেল একটা ধসে পড়া বাড়ির দিকে। ততক্ষণে বাইকটাকে দাঁড় করিয়ে দুজন লোক রাস্তায় নেমে পড়েছে এবং ছুটে পালানো লোকটাকে তাক করে পিস্তলওয়ালা পরপর দুবার ট্রিগার টিপেছে।

‘সুঁই—’ করে দুবার শব্দ হল। পিলটু বুঝল পিস্তলে সাইলেন্সার লাগানো আছে।

ছুটে পালানো লোকটার কপাল ভালো—ওর গায়ে গুলি লাগল না। ও কপালে রুমাল চেপে ভাঙাচোরা বাড়িটার ভেতরে ঢুকে গেল। আর বাইকের পাবলিক দুজন সানগ্লাস হেলমেট সব ছুড়ে ফেলে দিয়ে শিকারকে তাড়া করল।

পিলটু তখন নিজের মতো করে অঙ্ক কষতে শুরু করল।

যদি ওই পোড়ো বাড়িটার ভেতরে গোলাগুলি চলে তা হলে দু-একটা লাশ পড়ার সম্ভাবনা আছে। তারপর সব গন্ডগোল মিটে গেলে, আততায়ীরা চলে গেলে, লাশ অথবা লাশগুলো চলে আসবে পিলটুর দখলে। তখন তাদের পকেট সাফ করা যাবে। আর শরীরে আংটি, তাবিজ, লকেট যা কিছু পাবে সেগুলোও হাতিয়ে নেওয়া যাবে।

সুতরাং তিনজন মানুষ বাড়িটায় ঢুকে পড়ার পর ছেলেটাও চোরের মতো পা টিপে-টিপে ঢুকে পড়ল।

ভেতরটা অন্ধকার। দেওয়ালের ধসে পড়া ফাঁকফোকর দিয়ে যেটুকু দিনের আলো ঠিকরে আসছে সেটাই একমাত্র আলো। মেঝেতে রাজ্যের ধুলো আর রাবিশ। তারই ওপরে ছড়িয়ে পড়ে আছে লোহার রড, কাঠের টুকরো। সিলিং-এর কাছাকাছি একটা বড় মাপের মাকড়সার জালও চোখে পড়ল।

বাড়িটার ভেতরে পুরোনো দুর্গন্ধ। ওরা চারজন ঢুকে পড়ায় যে-শব্দ-টব্দ হয়েছে তাতে লুকিয়ে থাকা বাদুড় আর চামচিকের দল ওড়াওড়ি শুরু করে দিয়েছে। দেখতে না পেলেও ওদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।

যে-জায়গাটায় ওরা ঢুকেছে সেটা এককালে বোধহয় ঘর-টর কিছু ছিল। এখন ঘরের দেওয়ালগুলো প্রায় না থাকায় জায়গাটাকে বড়মাপের গোডাউন বা ফ্যাক্টরির শেড বলে মনে হচ্ছিল।

পিলটু খুব সাবধানে পা ফেলে অন্ধকারের আড়ালে-আড়ালে এগোচ্ছিল। তারপর একটা ভাঙা দেওয়ালের পিছনে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বসে পড়ল। চোরা নজরে উঁকি মেরে বাকি তিনজনকে খুঁজতে লাগল।

আধো-অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতেই ওদের দেখতে পেল।

কাছাকাছি আর-একটা ভাঙা দেওয়ালের আড়ালে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে প্রৌঢ় মানুষটি। ওর মুখে যে-সামান্য আলোর আভা দেখা যাচ্ছে তাতে পিলটু বুঝল লোকটা এখনও ফোনের বোতাম টিপে কাউকে ধরার চেষ্টা করছে. আর একইসঙ্গে হাঁ করে হাঁপাচ্ছে।

কিলার দুজন খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। নিজেদের মধ্যে ইশারা করছে, পা টিপে-টিপে জায়গা বদল করছে, ইট-কাঠ-লোহা কিছু পায়ে ঠেকলেই সেদিকে না তাকিয়ে লাথি মেরে সরিয়ে দিচ্ছে। তাতে যে শব্দ হচ্ছে তা নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

পিলটুর চোখের সামনে ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলতে লাগল।

হঠাৎই একটা আলো জ্বলে উঠল। আলোছায়ামাখা পোড়ো ঘরের এখানে-সেখানে একটা হলদে আলোর বৃত্ত ঘুরে বেড়াতে লাগল।

কিলারদের কেউ টর্চ জ্বেলেছে।

দেওয়াল থেকে ঠিকরে আসা আলোর আভায় দুজন কিলারকেই দেখতে পেল পিলটু।

প্রথমজন পিস্তল উঁচিয়ে সাবধানে পা ফেলে উঁকিঝুঁকি মেরে শিকারকে খুঁজছে। আর দ্বিতীয়জন বাঁ-হাতে একটা টর্চ ধরে রয়েছে।

পিলটু নিজেকে অন্ধকার খাঁজে আরও মিশিয়ে দিতে চাইল। ওর একটু-একটু যে ভয় করছিল না তা নয়। ও টের পাচ্ছিল, ওর হাত-পায়ের পেশি দপদপ করছে, কাঁপছে। কিন্তু এখন তো পালিয়ে যাওয়া যাবে না! ওকে দেখামাত্রই ওরা গুলি করবে। কারণ, খুনের সাক্ষী না রাখাটাই দস্তুর।

আচমকা মোবাইল ফোনের সুরেলা রিং টোন শোনা গেল।

একটা ধসে পড়া দেওয়ালের পিছনে আলোর আভা চোখে পড়ল। জ্বলছে-নিভছে। সেই আভায় শূন্যে ভেসে থাকা একটা মুখের আদলও দেখা গেল।

প্রথম লোকটার স্যাটেলাইট ফোন।

লোকটা বোধহয় বোতাম টিপে ফোন কেটে দিল। কারণ, রিং টোনটা হঠাৎ থেমে গেল। আর ফোনের আলোটাও হারিয়ে গেল। হয়তো ফোনের আলো চাপা দিতে ফোনটাকে পোশাকের আড়ালে কোথাও চটপট লুকিয়ে ফেলেছে।

কিন্তু ততক্ষণে শব্দ এবং আলো লক্ষ্য করে পিস্তলের গুলি ছুটে গেছে। একবার নয়—অন্তত চারবার। চাপা ‘সুঁই-সুঁই—’ শব্দ হিসেব করে পিলটুর অন্তত তাই মনে হল।

একইসঙ্গে যন্ত্রণার আর্তনাদ শোনা গেল।

শিকারের গায়ে গুলি লেগেছে।

কিলার দুজন নিজেদের মধ্যে আঙুল তুলে ইশারা করল। পিস্তল হাতে লোকটা লম্বা-লম্বা পা ফেলে রাবিশ, লোহা, কাঠ ডিঙিয়ে আহত শিকারের দিকে ছুটে গেল। ভাঙা দেওয়ালের পিছনে গিয়ে শিকারের ওপরে ঝুঁকে পড়ল।

ঠিক তখনই রিভলভারের গুলির শব্দে গোটা বাড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠল। পরপর দুবার।

সঙ্গে-সঙ্গে বাড়িটায় যেন হইচই শুরু হয়ে গেল।

অন্ধকারে আস্তানা গেড়ে থাকা চামচিকের ঝাঁক মিহি কিচকিচ শব্দ করে উড়তে শুরু করল। বাদুড়ের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ পাওয়া গেল। টর্চের আলোয় বেশ কয়েকটা ছটফটে উড়ন্ত শরীর দেখা গেল। একবার যাচ্ছে, একবার আসছে।

দ্বিতীয় কিলারের টর্চের আলো গিয়ে পড়েছিল তার সঙ্গীর ওপরে। সে দেখতে পেল দুটো শরীর জট পাকিয়ে পড়ে আছে। ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে একটা ছোটমাপের রিভলভার বের করে নিল। তারপর এক-পা-এক-পা করে দুটো শিথিল শরীরের দিকে এগোতে লাগল।

পিলটু সবকিছুই লক্ষ করেছে। ওর দমবন্ধ হয়ে আসছিল। বুকের ভেতরে যেন হাতুড়ি পড়ছিল। কী এক অজানা ভয়ে ও পকেট থেকে স্ক্রু-ড্রাইভারটা বের করে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল। তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করতে লাগল।

হঠাৎই উড়ন্ত দুটো চামচিকে ওর মুখে এসে ধাক্কা মারল। নিজের অজান্তেই ও হাতের ঝটকা দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে লাফিয়ে উঠল। মুখ দিয়ে ছোট্ট একটুকরো চিৎকারও বেরিয়ে গেল।

সঙ্গে-সঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেছে। দ্বিতীয় খুনিকে ছেলেটা আর দেখতে পাচ্ছিল না। হয়তো ওর চিৎকার শুনে অন্ধকারের ভাঁজে গা-ঢাকা দিয়েছে।

পিলটু এখন কী করবে? এখানে কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? টর্চ নিভিয়ে লোকটা গেল কোথায়? কোথায় গেল?

দ্বিতীয় খুনির সঙ্গে পিলটুর দূরত্ব ছিল মাত্র দশ-বারো ফুট। সুতরাং পিলটুর চিৎকার ও স্পষ্টই শুনতে পেয়েছে। আর সেইজন্যই আলো নিভিয়ে দিয়েছে। যাতে অন্ধকারে অচেনা শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলাটা বেশ জটিল এবং কঠিন হয়ে ওঠে।

পিলটুর বুকের ভেতরে বিগ ড্রাম বাজাচ্ছিল কেউ। নিশাচর প্রাণীর মতো অন্ধকারে চোখ মেলে ও প্রাণপণে দেখতে চেষ্টা করছিল। বাড়িটার বোটকা দুর্গন্ধ ওর নাকে একেবারে চেপে বসছিল। চঞ্চল চামচিকেগুলো ওদের ওড়াউড়ি এখনও থামায়নি।

বাড়িটার সদরের দিকে নজর দিল পিলটু। সেদিকে তাকালে দরজার হাঁ করা ফ্রেমের মাপে দিনের মেঘলা আলো দেখা যাচ্ছে। পিলটু কি এখন সেদিক লক্ষ্য করে দৌড় দেবে? পকেট বা লকেট হাতানোর মতলব এখন মুলতুবি থাক। আগে নিজের প্রাণটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে গিয়ে সুরক্ষিত করা দরকার।

পিলটু খুব সাবধানে উঠে দাঁড়াল। এবারে শুরু হবে ওর বিপজ্জনক মরণছুট। ওয়ান—টু—থ্রি—।

কিন্তু ছুট শুরু হওয়ার আগেই ওর মুখে আচমকা টর্চের আলো এসে পড়ল। টর্চ হাতে দ্বিতীয় খুনি ওর খুব কাছেই দাঁড়িয়ে। সিগারেট আর মদের গন্ধ পেল পিলটু।

‘কে তুই?’ জড়ানো গলায় খুনি ওকে জিগ্যেস করল।

সঙ্গে-সঙ্গে পিলটু স্ক্রু-ড্রাইভারটা খুনির পেটে ঢুকিয়ে দিল।

পিলটু কখনও মাখন খায়নি। মাখনের মধ্যে ছুরি ঢুকিয়ে দিলে ঠিক কীরকম অনুভূতি হয় ও জানে না। কিন্তু তবুও ওর মনে হল, ব্যাপারটা যেন অনেকটা সেইরকম।

একইসঙ্গে পিলটু ভয়ার্ত পশুর মতো তীব্র চিৎকার করে উঠেছে এবং লোকটাকে প্রচণ্ড জোরে এক ধাক্কা মেরেছে।

অন্ধকারে ইট-কাঠের ওপরে উলটে পড়েছে খুনি। হাত থেকে টর্চ ছিটকে গেছে। ছোট পিস্তল থেকে ‘গুড়ুম’ শব্দ করে একটা গুলি ছুটে গেছে ঘরের ভাঙাচোরা সিলিং-এর দিকে।

প্রচণ্ড ভয় থেকে মানুষের মধ্যে একটা কোণঠাসা বেপরোয়া ব্যাপার জেগে ওঠে। চোদ্দোবছরের ছেলেটারও তাই হল। ও হুড়মুড় করে পৌঁছে গেল মেঝেতে পড়ে থাকা টর্চটার কাছে। ওটা তুলে নিয়ে হাতুড়ির মতো বসিয়ে দিল খুনির মাথায়। সংঘর্ষের ঝটকায় টর্চ নিভে গেল।

স্ক্রু-ড্রাইভার পেটে বেঁধা অবস্থাতেই লোকটা উঠে বসার চেষ্টা করছিল, কিন্তু টর্চের দ্বিতীয় আঘাত ওকে আবার মাটিতে পেড়ে ফেলল। একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এল লোকটার মুখ দিয়ে।

পিলটু বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছিল। ওর এবার মনে হল পালানো দরকার। কারণ, এতবার গুলির শব্দ হয়েছে, চিৎকার-চেঁচামেচি হয়েছে যে, লোকজন এসে পড়তে পারে। বরং একটু পরে ও ঘুরেফিরে এখানে আবার আসবে। তখনও যদি বডিগুলো বেওয়ারিশভাবে পড়ে থাকে তা হলে চটপট ওর কাজ সেরে নেবে।

হাতের চর্চটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে পা বাড়াল। পনেরো-কুড়ি ফুট দূরেই হাঁ-করা সদর দরজা। সেই ফাঁক দিয়ে আলো আর বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে।

মেঝেতে পড়ে থাকা ইট-পাথর আর কাঠ ডিঙিয়ে ছেলেটা চার-ছ’পা এগোতেই মোবাইল ফোনের সুরেলা বাজনা শোনা গেল।

বাজনার সুরটা ছেলেটার চেনা। প্রথম লোকটার স্যাটেলাইট ফোন।

পিছন ফিরে তাকাল। দূরে অন্ধকারে রঙিন আলো জ্বলছে-নিভছে। কেউ ফোন করেছে লোকটাকে।

বিদ্যুৎঝলকের মতো একটা লোভ ঝলসে উঠল মাথায়। পরে যখন কাজ সারতে আসবে, আসবে। এখন স্যাটেলাইট ফোনটা নিয়ে চম্পট দিলে কেমন হয়?

লোভ আর আশঙ্কার লড়াইয়ে লোভ জিতে গেল।

পিলটু ঘুরে দাঁড়াল। পায়ে-পায়ে ফিরে চলল স্যাটেলাইট ফোনটার দিকে।

যখন ও ফোনের খুব কাছে পৌঁছে গেল তখনও ফোনটা বাজছিল। ফোনের আলোয় দেখল দুটো কাহিল শরীর এখনও জট পাকিয়ে পড়ে আছে। তারই একটার হাতের মুঠোয় ফোনটা ধরা।

 ঝুঁকে পড়ে ফোনটার দিকে হাত বাড়াতে যাবে অমনি বোতাম টিপে কলটা রিসিভ করল কেউ। গোঙানির স্বরে কেউ ‘হ্যালো! হ্যালো!’ বলতে লাগল।

আবছা আঁধারে দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত লাগছিল। জটপাকানো শরীর দুটোর দিকে তাকিয়ে পিলটু ‘হ্যালো’ বলা মুখটাকে খুঁজে পাচ্ছিল না। অথচ জটের বাইরে বেরিয়ে থাকা একটা হাত কলটা রিসিভ করেছে।

ফোন থেকেও যে কেউ ‘হ্যালো! হ্যালো!’ বলছে সেটাও ক্ষীণভাবে পিলটুর কানে আসছিল। ও কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না।

কয়েকসেকেন্ডের দ্বিধা কাটিয়ে ও ফোনটা দুর্বল হাতের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিল।

ওর মুখে ফোনের রঙিন আলো পড়ায় ফোনের আহত মালিক বোধহয় ওকে দেখতে পেল।

ভাঙাচোরা কাতর গলায় অন্ধকার মেঝের দিক থেকে কেউ বলে উঠল, ‘খোকা, আমাকে বাঁচাও…।’

লোকটা এখনও বেঁচে আছে!

পিলটু অবাক হল। কলটা কেটে দেওয়ার জন্য ও আন্দাজে ফোনের নানান বোতাম টিপতে লাগল। ফোনের ‘হ্যালো! হ্যালো!’টা হঠাৎই থেমে গেল।

 ফোনটা এবার কণ্ঠস্বরের দিকে ফেরাল পিলটু। দেখল, গাড়ি থেকে নেমে আসা সেই সুট পরা মানুষটা। ওর কপাল মুখ সব রক্তে মাখামাখি। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। ওর বুকের ওপরে উপুড় হয়ে পড়ে আছে কালো টি-শার্ট পরা একটা দেহ। সেইজন্যই সুট পরা মানুষটা ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতে পারছিল না।

‘আমাকে বাঁচাও! তুমি…তুমি যা চাও তাই দেব…তাই দেব।’ কাতর অনুনয়ের সুরে প্রৌঢ় বলল।

পিলটু কী করবে ভেবে না পেয়ে ফোনটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

‘তোমার…নাম কী?’

কয়েকসেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘পিলটু…।’

‘পিলটু, প্লিজ…আমাকে…আমাকে বাঁচাও। আমি নিউ সিটির পিস ফোর্সের…মার্শাল। ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল… বলধর পাট্টা। বলধর পাট্টা। আ-আমাকে বাঁচাও। আমার…আমার…গায়ে গুলি লেগেছে। অনেকগুলো। আমাকে…বাঁচাও। প্লিজ। এখানে ফেলে…যেয়ো না। তুমি যা চাও…সব দেব। প্লিজ…।’ যন্ত্রণায় মোচড় খাওয়া কথাগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে মানুষটা প্রবল হাঁপাচ্ছিল। ফোনের আবছা আলোয় ওর চোখদুটো মরা মানুষের চোখের মতো লাগছিল।

কিন্তু এ কী শুনছে ছেলেটা!

বলধর পাট্টা! পিস ফোর্সের মার্শাল! চিফ! নিউ সিটিতে বলতে গেলে যার কথাই শেষ কথা! যার নামে বুকের ভেতরটা ভয়ে কেঁপে ওঠে! শিরদাঁড়া দিয়ে বরফের স্রোত নেমে যায়। গলা শুকিয়ে যায়! যার ধমকে অনেকেই প্যান্ট ভিজিয়ে ফ্যালে!

রাস্তায়-রাস্তায় বসানো অসংখ্য প্লেট টিভির দৌলতে বলধর পাট্টার কুখ্যাতির কথা পিলটুর অজানা ছিল না। ওল্ড সিটিতে সবাই বলে, বলধরের ডাকনাম হল ‘শয়তান’। বলধর হিংস্রতায় এম. এ., পিএইচ. ডি. আর নিষ্ঠুরতায় ডি. এসসি.।

সেই ‘সাক্ষাৎ যম’ অমানুষটা কাতর অসহায়ভাবে পড়ে আছে ছেলেটার পায়ের কাছে! হদ্দ ভিখারির মতো প্রাণভিক্ষা চাইছে এই কিশোরের কাছে! বলছে, ‘তুমি যা চাও তাই দেব…।’

পিলটুর শরীরে রোমাঞ্চ খেলে গেল। ও পলকে সিদ্ধান্ত নিল। ফোনটা পকেটে রাখল। তারপর ঝুঁকে পড়ে কালো টি শার্ট পরা বডিটাকে টেনে সরাতে লাগল।

কয়েকবারের চেষ্টাতেই বডিটা বলধরের শরীরের ওপর থেকে নামিয়ে দিল পিলটু। ওর দু-বগলে হাত ঢুকিয়ে টেনে ওকে সোজা করল। তারপর পিঠটা দেওয়ালে হেলান দিয়ে কোনওরকমে বসাল।

বলধর যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছিল। ‘আ:! লাগছে…আস্তে…’ এসব বলছিল।

পিলটুর হাত চটচটে কীসে যেন ভিজে গেল। আঁশটে গন্ধ নাকে এল।

‘ফোনটা…ফোনটা…আমাকে দাও…।’

বলধরের মিনমিনে দুর্বল স্বর যেন বহুদূর থেকে পিলটুর কানে ভেসে এল।

ও কোনও কথা না বলে স্যাটেলাইট ফোনটা পকেট থেকে বের করে বলধরের ডানহাতে ধরিয়ে দিল।

কাঁপা আঙুলে ফোনের বোতাম টিপল বলধর। তারপর ফোনটা কানে চেপে ধরল।

মেঘ বোধহয় কিছুটা পরিষ্কার হয়েছিল। কারণ, হঠাৎই পিলটু খেয়াল করল, দিনের আলো খানিকটা বেড়ে গেছে। চামচিকে কিংবা বাদুড়ের ওড়াউড়ির শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। শব্দ বলতে শুধু বলধর আর পিলটুর শ্বাস -প্রশ্বাসের শব্দ।

ও-প্রান্তে ফোনটা কেউ ধরতেই বলধর ক্লান্ত গলায় বলল, ‘মার্শাল পাট্টা। পিস ফোর্স। এস. ও. এস। জলদি এসো। ইমার্জেন্সি—লেভেল থ্রি। জি. পি. এস. কো-অর্ডিনেট সেভেন পয়েন্ট টু থ্রি বাই ফোর পয়েন্ট জিরো ওয়ান। ওল্ড সিটি, ব্লক নাইন। ইমার্জেন্সি—লেভেল থ্রি। এস. ও. এস.। কাম রাইট নাউ। এখানে…আমি আর পিলটু আছি। পিলটু…ওল্ড সিটির ইয়াং বয়। কাম। মেক…ইট…কুইক। সেভ মি। সেভ মি…।’

স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে ফোনে একটানা কথা বলছিল বলধর। তারপর হঠাৎই চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো ওর কথা থেমে গেল। হাত থেকে ফোনটা খসে পড়ল। শরীরটা প্রায় চল্লিশ ডিগ্রি কাত হয়ে গেল মেঝের দিকে।

পিলটু তাড়াতাড়ি বসে পড়ল ওর হেলে পড়া শরীরের কাছে। ওকে আরও হেলিয়ে দিয়ে ওর রক্তাক্ত মাথাটা প্রায় কোলে নিয়ে নিল। বেশ বুঝতে পারল ওর জামা-প্যান্টে রক্ত মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হোক। মার্শালের মাথা কোলে নিতে পারে ক’জন? মার্শাল ওকে বলেছে, ও যা চায় সব দেবে। সব।

বলধরের মাথা কোলে নিয়ে সেই ‘সব’-এর আশায় বসে রইল পিলটু। ওল্ড সিটিতে অনেক হয়েছে। এবার নিউ সিটির স্বপ্নকে ছুঁতে চায় ও।

পিলটু বলধরকে ডাকল, ‘স্যার! স্যার!’

কিন্তু কোনও সাড়া পেল না।

বলধরকে নাড়া দিল পিলটু। তাতে বলধরের শরীরটা যেভাবে নড়ল পিলটু আন্দাজ করল মার্শাল বোধহয় অজ্ঞান হয়ে গেছে।

এমনসময় মেঝেতে পড়ে থাকা ফোনটা আবার বাজতে শুরু করল।

ফোনটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ছেলেটা। কে ফোন করছে মার্শালকে?

ফোনটা তুলে নিল। আন্দাজ করে কল রিসিভ করার বোতামটা টিপল। তারপর ফোনে ‘হ্যালো’ বলল।

ওপাশ থেকে একটা ভারি গলা শোনা গেল : ‘কে, পিলটু?’

থতমত খেয়ে ছেলেটা বলল, ‘হ্যাঁ—।’

‘স্যার তোমার কাছে?’

‘হ্যাঁ।’ কথা বলতে গিয়ে পিলটুর গলা কেঁপে গেল। ও বুঝতে পারল পিস ফোর্সের কেউ ওর সঙ্গে কথা বলছে।

‘তোমার কোনও ভয় নেই। আমাদের অ্যাকশন ফোর্স এক্ষুনি ওখানে পৌঁছে যাচ্ছে। ডোন্ট উয়ারি, ব্রেভ বয়! ওভার অ্যান্ড আউট।’

ফোন কেটে গেল। সব কথার মানে স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও ছেলেটা বুঝল পিস ফোর্স সামরিক পরিস্থিতির ঢঙে কাজে নেমে পড়েছে।

হলও ঠিক তাই। পিস ফোর্স সেই জরাজীর্ণ বাড়িটায় পৌঁছে গেল দশমিনিটের মধ্যেই।

আকাশ থেকে নীল-সাদা চারটে শুটার রাস্তায় নেমে এল। একইসঙ্গে কালো রঙের চারটে গাড়ি শব্দ করে ছুটে এসে তীব্রভাবে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল বৃষ্টিভেজা রাস্তায়। ডিশ অ্যানটেনা লাগানো একটা সাদা ভ্যান তার পাশাপাশি এসে থামল। তার গায়ে লেখা ‘ইমার্জেন্সি মেডিকেল ইউনিট’। সেই ভ্যানের দরজা খুলে ছ’জন মেডিক নেমে পড়ল রাস্তায়। তাদের হাতে অক্সিজেন মাস্ক, ফাইবারের স্ট্রেচার আর ‘এস. ও. এস.’ মেডিকেল কিট। তারা ব্যস্তভাবে ছুটে গেল ভাঙা বাড়িটার দিকে। কেউ একজন চিৎকার করে সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিল।

তারপরই অনেকগুলো হ্যালোজেন টর্চের আলোয় পিলটুদের ‘যুদ্ধক্ষেত্র’টা ভেসে গেল। মেঝেতে, দেওয়ালে, সিলিং-এ সেই উজ্জ্বল সাদা আলো অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় চলে বেড়াতে লাগল। ভারী বুটের শব্দে বাদুড় চামচিকেরা আবার সচকিত হয়ে উঠল। উড়ে বেড়াতে লাগল।

আলোর কাটাকুটি খেলার আড়াল থেকে কেউ একজন ডাকল : ‘পিলটু—।’

‘এই যে। আমি এখানে।’

কয়েকসেকেন্ডের মধ্যেই সবক’টা দেহ আর মৃতদেহ পিস ফোর্সের দখলে চলে গেল।

এরপর যা হল তা পিলটু স্বপ্নেও কখনও ভাবেনি।

শুটারে চড়ে ও আকাশপথে উড়ে চলল নিউ সিটির দিকে। নীচে, বহু নীচে, দেখা যাচ্ছে ওল্ড সিটির জরাজীর্ণ রুগ্ন চেহারা। একটা পুরোনো ঘা-এর মতো ছড়িয়ে রয়েছে শহরটা। আয়ু ফুরিয়ে আসা, বিছানায় মিশে থাকা, একটা রুগির মতো ধুকপুক করছে শহরটার হৃৎপিণ্ড। শ্রান্ত-ক্লান্ত শহরটা হাঁপাচ্ছে।

এই শহরে যদি আর ফিরতে না হয় তা হলে দারুণ হবে। সেই আশায় মনে-মনে প্রার্থনা করতে লাগল পিলটু। আর একইসঙ্গে চাপা উত্তেজনায় ওর বুকের ভেতরটা ধকধক করতে লাগল। ছলনাময়ী ভাগ্যশ্রী এখন ওর জন্য কী উপহার সাজিয়ে রেখেছে কে জানে!

শিসের শব্দ তুলে নীল সাদা রঙের শুটার আকাশপথে ছুটছিল। ছেলেটার পাশে একজন পিস ফোর্সের লোক। ঝকঝকে পোশাক দেখে মনে হয় ফোর্সের কেউকেটা একজন হবেন। আর সামনের সিটে দুজন—তার মধ্যে একজন শুটারের পাইলট।

শুটারটা স্বচ্ছ ডোমে ঢাকা। ভেতরটা এয়ারকন্ডিশনড। সিটে বসে নিউ সিটির মিনিয়েচার ছবি দেখতে পাচ্ছিল ছেলেটা। ঠিক যেন আর্কিটেক্টের তৈরি একটা ঝিনচাক শহরের মডেল। মডেল তো নয়—স্বপ্ন। যেন সেই জীবন্ত স্বপ্নকে কেউ পরম যত্নে মাটিতে বিছিয়ে দিয়েছে।

সেই স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ছেলেটা বিলাসিতার কল্পনা করছিল। আর ওর চোখের সামনে স্বপ্নটা খুব ধীরে-ধীরে বড় হচ্ছিল, সাকার হচ্ছিল। কারণ শুটার নামতে শুরু করেছিল।

স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ক্লান্তিতে ছেলেটা কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ল্যান্ডিং জোনে শুটার ল্যান্ড করতেই ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর পিস ফোর্সের লোকজন ওকে নিয়ে যা শুরু করল তাতে ছেলেটার মনে হল ও কোনও দেশের রাষ্ট্রপতি—অতিথি হয়ে নিউ সিটিতে এসেছে। এখানকার কর্মকর্তারা ওকে কোলে বসাবেন না মাথায় রাখবে ভেবে পাচ্ছেন না।

পিস ফোর্সের লোকজন আর কর্মকর্তাদের কথাবার্তা শুনে ছেলেটা বুঝতে পারল, ওকে টপমোস্ট সিকিওরিটি জোনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে একটা গোল্ডেন পেন্টহাউসে টপমোস্ট কমফোর্ট লেভেলে ওকে রাখা হবে। পিস ফোর্সের ছ’জন স্টাফ চব্বিশঘণ্টা ওর তদারকিতে থাকবে।

ছেলেটার মনে হল, স্বপ্ন যখন সত্যি হয় বোধহয় এরকম হঠাৎ করেই হয়। আর সেইজন্যই ও ব্যাপারটাকে ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছিল না।

ঝকঝকে নতুন জামাকাপড় পরে পেন্টহাউসের বেডরুমে বিছানায় বসে ছিল ছেলেটা। ঘিয়ে রঙের সিল্কের চাদরে ঢাকা নরম বিছানা। তার ওপরে ধীরে-ধীরে হাত বুলিয়ে ও বুঝতে চাইছিল ব্যাপারটা স্বপ্ন, না বাস্তব।

বাস্তব হয়ে ওঠা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে ছেলেটার দিন কাটতে লাগল। আর তারই মধ্যে চলতে লাগল জিজ্ঞাসাবাদ।

পিস ফোর্সের নানান স্তরের লোকজন ওর ঘরে আসতে লাগল। তারা পালা করে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে ওকে প্রশ্ন করতে লাগল। সেদিন দুপুরে বলধর পাট্টাকে দেখা থেকে শুরু করে পিস ফোর্সের অফিসাররা অকুস্থলে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ওকে বারবার বলতে হচ্ছিল।

সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, পিলটুর কথা শুনে-শুনে ওরা ওর স্টেটমেন্টের রিয়েল টাইম ভিডিয়ো সিমুলেশান তৈরি করছিল। ওর ঘরের মধ্যে কমপিউটার এবং আরও কীসব যন্ত্রপাতি এনে তিনজন লোক সিমুলেশানের কাজে ব্যস্ত ছিল। আর দুজন অফিসার পিলটুকে একের পর এক প্রশ্ন করছিল।

পিলটুর উত্তর শুনে-শুনে ওরা সিমুলেশান তৈরি করছিল, কারেকশান করছিল, পিলটুকে বারবার ওটা দেখাচ্ছিল। এইভাবে চারদিন কেটে যাওয়ার পর অডিয়ো-ভিশুয়াল সিমুলেশানটা ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে বলে ওদের মনে হল।

পিলটু যখন ফাইনাল সিমুলেশানটা দেখল তখন ও অবাক হয়ে গেল। সেইদিনকার ঘটনাগুলো নিয়ে কেউ যেন একটা সিনেমা তৈরি করেছে।

সেই সিনেমা শুরু হল। কমপিউটারের পরদার এককোণে সময় দেখা যাচ্ছে। ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে-সঙ্গে একসেকেন্ড-একসেকেন্ড করে সময় পালটে যাচ্ছে। পরদায় ঘটনা শুরু হল। ঝাঁ-চকচকে কালো গাড়িটা মাতালের মতো ছুটে এসে রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারল।

সিনেমাটা দেখে অবাক হয়ে গেল পিলটু। কোথাও কোনও ভুল নেই। ও যেমন-যেমন স্টেটমেন্ট দিয়েছে, নানান প্রশ্নের উত্তরে যা-যা বলেছে, ঠিক সেই-সেই ঘটনাগুলোর চলমান ছবি এঁকে ওরা ওর চোখের সামনে সাজিয়ে দিয়েছে।

একটা আশ্চর্য ভিডিয়ো গেম দেখছিল পিলটু। মানুষগুলো একটু পুতুলের মতো লাগছিল ঠিকই, তবে বাকি সবকিছু যেন আসলের মতো। গাড়ির ব্রেক কষার শব্দ, মোটরবাইকের শব্দ, গুলির আওয়াজ—এমনকী বাদুড় আর চামচিকের ডানা ঝাপটানোর শব্দটাও ওরা আসলের মতো তৈরি করে ঠিকমতো জুড়ে দিয়েছে।

পিলটুকে নিয়ে এসব যখন চলছিল তখন বলধর পাট্টা নিউ সিটির এক্সট্রিম মেডিকেল কেয়ার ইউনিটে সেরে উঠেছিল। তার সেরে ওঠার খবর পিস ফোর্সের অফিসারদের কাছেই শুনছিল পিলটু। বলধরের গায়ে চারটে গুলি লেগেছে, কিন্তু এখন সে বিপদের আওতার বাইরে। চিফ মেডিক অন্তত তাই বলেছেন।

পিস ফোর্সের অফিসাররা বলধরের স্টেটমেন্টও নিয়েছেন। সেই স্টেটমেন্ট পিলটুর স্টেটমেন্টের সঙ্গে মিলিয়ে তবেই ফাইনাল ভিডিয়ো সিমুলেশানটা তৈরি করা হয়েছে। সেটা দেখে বলধর অ্যাপ্রুভ করেছে। সুতরাং এই ফাইনাল সিমুলেশানটাই এভিডেন্স আরকাইভে রাখা হবে।

মার্শাল বলধর পিলটুর সাহসের খুব প্রশংসা করেছে। বলেছে, ‘ও আমার স্পেশাল গেস্ট। ওর আদর যত্নে যেন কোনও ফাঁক না থাকে।’

না, কোনও ফাঁক নেই। কিন্তু সে তো মাত্র ক’দিন! তারপর, বলধরের এই রোমাঞ্চকর মামলার আঁচ মিটে গেলে, পিলটুকে নিশ্চয়ই ফিরিয়ে দেওয়া হবে ওল্ড সিটিতে—ওর আগের জায়গায়, ছেঁড়া-ফাটা পলিথিনে ছাওয়া ঝুপড়ির নীচে। তখন একদিনের জন্য সত্যি হওয়া স্বপ্নটা আবার শুধু স্বপ্ন হয়ে যাবে। আবার ওকে ভিক্ষে করতে হবে, পকেট মারতে হবে, গাড়ির পার্টস চুরি করে বিক্রি করতে হবে।

স্ক্রু-ড্রাইভারটার কথা মনে পড়ল পিলটুর। পিস ফোর্সের অফিসাররা ওটা ওকে আর ফেরত দেননি। বলেছেন, ওটা নাকি ওঁদের এভিডেন্স আরকাইভে রেখে দেওয়া হবে। সুতরাং, হাতুড়িটা সঙ্গে থাকলেও পিলটুকে নতুন একটা স্ক্রু-ডাইভার কিনতে হবে। গাড়ির ‘কাজ’ শুরু করতে গেলে ওটা কেনা দরকার।

গোল্ডেন পেন্টহাউসে বসে পিলটু যখন এসব কথা ভাবছে তখনই ও খবর পেল, বলধর পাট্টা পুরোপুরি সেরে উঠে ওর বাড়িতে ফিরে গেছে। এর সঙ্গে আরও যে-খবরটা ওকে দেওয়া হল সেটা শুনে ওর বুকের ধুকপুকুনি আচমকা বেড়ে গেল। হাতুড়ি পেটার শব্দ হতে লাগল বুকের ভেতরে।

বলধর পাট্টা ওকে ডেকে পাঠিয়েছে নিজের বাড়িতে।

আস্তানা বদলে গেল ছেলেটার।

এক একর সবুজ জমির ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা আধুনিক বিমূর্ত ছাঁদে তৈরি একটা তিনতলা ছোট বাড়ি। তাকে ঘিরে পার্ক, দিঘি, গাছপালা—আরও কত কী! এই বাড়িতে থাকে একজনমাত্র মানুষ। তাকে ঘিরে হুকুম তামিল করার জন্য আছে আরও বারোজন পুরুষ।

বলধর পাট্টা আর একডজন পুরুষ। পিলটু সেখানে গিয়ে মোট পুরুষের সংখ্যা চোদ্দোয় নিয়ে গেল।

আভিজাত্য আর অহঙ্কারে সাজানো একটা বিশাল মাপের ড্রইংরুমে বলধরের মুখোমুখি হল ছেলেটা। বলধরকে ভালো করে দেখল।

মেরুন রঙের ড্রেসিং গাউন পরা প্রৌঢ় কাঠামোটা টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে। মাথার সামনের দিকে শতকরা প্রায় চল্লিশভাগ টাক পড়ে গেছে। বাকিটা কাঁচা-পাকা পাতলা চুলে ঢাকা। চোয়াল চওড়া। দাড়ি-গোঁফ কামানো পরিষ্কার মুখে বয়েসের ভাঁজ। তবে সেইসঙ্গে রুক্ষতার ছাপও আছে। ঠোঁটজোড়া বড় বেশিরকম লালচে। ড্রেসিং গাউনের হাতার বাইরে বেরিয়ে থাকা হাতের শিরা ফুলে আছে। হাতের আঙুলগুলো যে শক্তিশালী সেটা চওড়া গাঁট আর খসখসে চামড়া থেকে আঁচ করা যায়।

পিলটু অবাক চোখে বসবার ঘরের জাঁকজমক দেখছিল। সেইসঙ্গে বিস্ময়ভরা চোখে বলধরকে দেখছিল। অগাধ ক্ষমতা এই মানুষটার। ক্ষমতার সাগরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা এক লাইটহাউস। সেই লাইটহাউসের চূড়া থেকে ক্ষমতার অবিরাম বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।

ভারী গলায় বলধর বলল, ‘পিলটু—তাই তো নাম তোমার?’

বোবা পিলটু মাথা নেড়ে জানাল, ‘হ্যাঁ।’

‘পিলটু, তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।’ বলধর ধীরে-ধীরে বলল, ‘তা ছাড়া তোমার সাহসও কম নয়। কারণ, সেইদিনকার ঘটনার ভিডিয়ো সিমুলেশানটা আমি দেখেছি। য়ু আর রিয়েলি ব্রেভ, পিলটু। আই অ্যাম রিয়েলি প্রাউড অফ য়ু।’

শেষের ইংরেজি কথাগুলোর অর্থ ছেলেটা কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু তবুও ও আন্দাজ করতে পারল যে, কথাগুলো প্রশংসার।

একটু থেমে বলধর পাট্টা আবার বলল, ‘তুমি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছ, পিলটু। ওই বিপদের সময় আমি তোমাকে বলেছিলাম, তুমি যা চাও সব দেব। আজ সে-কথা আমি ভুলে যাইনি। বলধর পাট্টা একবার যা বলে তার কখনও নড়চড় হয় না।’ একটু থামল, পিলটুর কাছে এগিয়ে এসে ঝুঁকে পড়ল : ‘বলো, তুমি কী চাও। কোনওরকম সঙ্কোচ বা লজ্জা করবে না। বলো…।’

কয়েকমুহূর্ত বলধরের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলেটা। ওর গলা কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিল। চারপাশে তাকিয়ে ও ঘরের দেওয়ালের কারুকাজ দেখছিল, বিচিত্র আলোকসজ্জা দেখছিল, বাতাসে নাক টেনে কেমন এক সুগন্ধ টের পাচ্ছিল। আর বিস্ময়ে স্থবির হয়ে ভাবছিল, এটা পৃথিবী, না স্বর্গ?

‘বলো, বলো—লজ্জা কোরো না।’

‘আমি স্যার আপনার কাছে থাকতে চাই।’

তুবড়ির আগুনের ফুলকির মতো মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল কথাগুলো। কথাগুলো বেরিয়ে যাওয়ার পরই পিলটু ভয় পেল। বলধর রাগ করবে না তো! এক্ষুনি পিলটুকে গলা ধাক্কা দিয়ে ওর নরকে পাঠিয়ে দেবে না তো!

কিন্তু বলধর রাগ করল না—বরং হাসল।

‘তোমার বাড়িতে আর কে-কে আছে?’

‘কেউ নেই—।’

‘কেউ নেই?’ বলধর পাট্টার ভুরু কুঁচকে গেল।

‘কেউ নেই। মা, বাবা, ভাই-বোন—কেউ নেই।’ সাহসী স্পষ্ট গলায় বলল ছেলেটা।

বলধর সোজা হয়ে দাঁড়াল। মাথা পিছনে হেলিয়ে হো-হো করে হেসে উঠল। বিশাল ঘরের দেওয়ালে-দেওয়ালে সেই হাসির প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

হাসির দমক থামলে চোখের কোণ থেকে জল মুছে নিল বলধর। বড়-বড় চোখে পিলটুর দিকে তাকিয়ে মজার সুরে বলল, ‘আমারও কেউ নেই। মা, বাবা, ভাই-বোন—কেউ নেই।’

পিলটু আর কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তাই চুপ করে রইল।

ওকে খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখল বলধর। তারপর খুব ধীরে-ধীরে ওপর-নীচে মাথা নাড়ল।

ছেলেটার সাহস আছে। একটা স্ক্রু-ড্রাইভার কেমন অনায়াসে ঢুকিয়ে দিয়েছে একটা জোয়ানের তলপেটে! যেখানে বলধরের কপালে নিশ্চিত মৃত্যু লেখা ছিল সেখানে এই ছেলেটা সেই কপাল-লিখন মুছে বলধরকে নতুন জীবন দিয়েছে। দ্বিতীয় ইনিংস খেলার সুযোগ করে দিয়েছে।

না:, কোনও সন্দেহ নেই, ছেলেটা একটা তেজিয়ান কুঁড়ি। ওর গায়ে হয়তো রুক্ষ অভাবী জীবনের ধুলো-ঝড়-বৃষ্টির নোংরা মলিন প্রলেপ পড়েছে, কিন্তু কুঁড়িটাকে চেনা যাচ্ছে। অন্তত বলধর চিনতে পারছে। এর ভেতরেই লুকিয়ে রয়েছে আগামীদিনের ক্ষমতার ফুলের পাপড়ি। ছেলেটা বাচ্চা হলেও সিংহের বাচ্চা।

ঠোঁটের কোনা কামড়ে বলধর ভাবছিল। ক্ষমতার যে-শীর্ষে বসে সে ক্ষমতার সতেজ তরঙ্গ প্রতিমুহূর্তে বিকিরণ করে চলেছে সেই শীর্ষাসন সে কাকে দিয়ে যাবে? এ-কথা ভেবে-ভেবে কয়েকবছর ধরে রাতে ঘুমোতে পারে না বলধর। তার চারপাশে যারা আছে তাদের মধ্যেও সে খুঁজেছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছে বারবার। কিন্তু সমাধান মেলেনি। যোগ্য কোনও উত্তরাধিকারীকে খুঁজে পায়নি বলধর। এদিকে ওল্ড সিটির গোপন ঘাতকদল বহুদিন ধরেই তাকে খুন করার জন্য ছক কষছে, সুযোগ খুঁজছে। দ্বিমুখী এই চিন্তার চাপ এতদিন বলধরের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে।

বোধহয় আজকের দিনটার জন্যই। সমাধানের এই মুহূর্তটার জন্য। গোপন ঘাতকরা ওকে গুলি করেছিল বলেই আগামীদিনের বলধর পাট্টাকে খুঁজে পেয়েছে বলধর। এই কুঁড়িটাকে অত্যন্ত যত্নে ফুটিয়ে তুলতে হবে।

পিলটুর চিবুকে আঙুল ছোঁয়াল। হেসে বলল, ‘তুমি আমার কাছে থাকবে। আমি তোমাকে নতুন নাম দেব। নতুন জীবন দেব। লেখাপড়া শেখাব। পিস্তল চালানো শেখাব। তোমাকে চ্যাম্পিয়ান তৈরি করব। লোকে জানবে তুমি আমার বহুবছর আগে হারিয়ে যাওয়া ভাই। হঠাৎ করে ওল্ড সিটিতে তোমাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। বুঝেছ?’

ছেলেটা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ও বলধরকে জড়িয়ে ধরল, আবেগে কেঁদে ফেলল। আর তারই মধ্যে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলতে লাগল, ‘স্যার, স্যার…। আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না, স্যার…।’

‘স্যার নয়—দাদা, দাদা—।’ ছেলেটার মাথায় আদরের হাত বোলাতে-বোলাতে বলধর বলল, ‘পিলটু নামটা ভুলে যাও। এখন থেকে তোমার নাম শ্রীধর—শ্রীধর পাট্টা।’

শ্রীধর…শ্রীধর পাট্টা। নতুন নামটা ছেলেটা নি:শব্দে উচ্চারণ করতে লাগল বারবার।

সেই মুহূর্তে পিস ফোর্সের আগামীদিনের মার্শালের জন্ম হয়েছিল। নতুন এক বলধর পাট্টার জীবনরেখা শুরু হল।

জন্মদিনটা আজও মনে আছে শ্রীধরের। ১৯ মে, বুধবার, ২৩৩২ সাল। এক সিংহের আস্তানায় নতুন এক সিংহের জন্ম হয়েছিল।

আজ, এখন, এই সিংহটা ন্যানোমিরারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পল্টনের কথা ভাবছে। আর ভাবতে গিয়ে বারবার মনে হয়, ওটা যেন কোনও প্রাচীন যুগের এক আবছায়া স্বপ্ন। অথবা বড়জোর মনে-মনে কোনও কাল্পনিক কমপিউটারের মনিটরে কোনও আজব সিমুলেশান দেখছেন।

শ্রীধরকে গড়ে তোলার ব্যাপারে বলধর কোনওরকম খামতি রাখেনি। ওকে দিয়ে জিমে ব্যায়াম করিয়েছে, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার শিখিয়েছে। শিখিয়েছে রাজনৈতিক কূটকৌশল—তার সঙ্গে হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা।

হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতায় বলধর যদি ছিল পিএইচ. ডি. আর ডি. এসসি., তা হলে শ্রীধর একেবারে নোবেল লরিয়েট।

বলধরকে ‘দাদা’ ডেকে বড় হতে লাগলেন শ্রীধর—আর সেইসঙ্গে ‘দাদাগিরি’-তেও প্রশিক্ষণ নিতে লাগলেন। মানুষের শরীরকে কতরকমভাবে যন্ত্রণা দেওয়া যায় আজ শ্রীধর তা জানেন। তিনি জানেন কীভাবে ভয়কে ব্যবহার করতে হয়। জানেন আরও বহু গোপন কৌশল।

লড়াইয়ের শ্যাডো প্র্যাকটিস শেষ করলেন। এয়ারকন্ডিশনড জিম হওয়া সত্বেও শ্রীধরের শরীরে ঘামের একটা পাতলা স্তর তৈরি হয়েছিল। একটু দূরে দেওয়ালে রুপোর তৈরি একটা ডিজাইনার হ্যাঙার লাগানো ছিল। তাতে ঝুলছে খরগোশের লোমের মতো মোলায়েম একটা ঘিয়ে রঙের টাওয়েল। সেই টাওয়েলটা তুলে নিয়ে শরীর মুছলেন শ্রীধর। আয়নায় নিজেকে বারবার দেখলেন। প্রতিবিম্বের চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের প্রায় ভুলে-যাওয়া নামটা কয়েকবার আলতো করে ডেকে উঠলেন : ‘পিলটু! পিলটু!…পল্টন…।’

নিজের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। কুড়িটা বছর বড় দীর্ঘ সময়। সেদিনের চোদ্দোবছরের কিশোর আজ চৌতিরিশ বছরের পোড়খাওয়া এক কুখ্যাত মার্শাল। নিউ সিটির লোকজন শ্রীধরের ভয়াবহতা বোঝাতে রসিকতা করে বলে, শ্রীধর যদি কোনও ফুলের বাগানে পা রাখেন তা হলে বাগানের সব ফুল পলকে শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে যাবে।

আজ বলধর নেই। সে মারা গেছে প্রায় আটবছর। প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার হয়ে খুব কষ্ট পেয়ে মারা গেছে। কিন্তু তার আগে বলধর তার কাজ সম্পূর্ণ করে গেছে। পুরোপুরি নিজের ছাঁচে শ্রীধর পাট্টাকে তৈরি করে গেছে। নিউ সিটিকে এক পূর্ণাঙ্গ মার্শাল উপহার দিয়ে গেছে। বলধরের ছেড়ে যাওয়া জুতোয় পা গলিয়ে দিয়েছেন শ্রীধর। বলধরের প্রাসাদে তিনি এখন একা থাকেন। তাঁর সঙ্গে থাকে তদারকির বারোজন পুরুষ।

বলধরের চিকিৎসায় চূড়ান্ত আন্তরিক ছিলেন শ্রীধর। কোনও মানুষের পক্ষে যা-যা করা সম্ভব তার সবটাই করেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের খাতায় বলধরের সময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। তাই ‘বলধর যুগ’ শেষ হল। শুরু হল ‘শ্রীধর যুগ’। নিউ সিটির মানুষের চোখে শ্রীধর পাট্টা হলেন শহরের শৃঙ্খলা আর শাসনের দেবতা।

শ্রীধর নামে হয়তো পিস ফোর্সের মার্শাল। কিন্তু কীভাবে-কীভাবে যেন সুপারগেমস কর্পোরেশন আর সিন্ডিকেটের ওপরেও তাঁর ক্ষমতা কায়েম হয়ে গেছে। শহরের ক্ষমতা-সাম্রাজ্যের যে-অঞ্চলেই কোনও পুতুলনাচ দেখা যাক না কেন, তার সুতো আসলে বাঁধা রয়েছে শ্রীধরের আঙুলে।

গায়ের ঘাম মুছে তোয়ালেটা আবার হ্যাঙারে রেখে দিলেন। পায়ে-পায়ে হেঁটে পৌঁছে গেলেন একটা স্টেইনলেস স্টিলের কাবার্ডের কাছে। কম্বিনেশান লকের বোতাম টিপে-টিপে কাবার্ডের পাল্লা খুললেন। ভেতরে কয়েকটা তাকে নানান টুকিটাকি জিনিস।

তারই মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট শিশি তুলে নিলেন শ্রীধর। শিশিটা চোখের সামনে তুলে ধরে চকচকে নজরে তাকালেন ওটার দিকে। শিশির ভেতরে গাঢ় স্বচ্ছ তরল। ঢাকনা খুলে শিশিটা শূন্যে উঁচু করে ধরলেন। মুখ হাঁ করে তাকালেন ওপরদিকে। কয়েক ফোঁটা তরল ঢেলে দিলেন হাঁ-এর ভেতরে। মুখ বন্ধ করে মাথা ঝাঁকালেন এপাশ-ওপাশ। জিভ দিয়ে টাকরায় তৃপ্তির শব্দ করলেন কয়েকবার। শ্রীধরের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল—সিংহের চোখের মতো। ঢাকনা এঁটে শিশিটা আবার তাকে ফিরিয়ে দিলেন।

এই ওষুধটা এক অদ্ভুত এনার্জি সল। বিদেশ থেকে এই তরল আমদানি করেন শ্রীধর। শুধুমাত্র নিজের জন্য। নিউ সিটির আর কেউ জানে না এই তরলের রহস্য। সারাদিনে কয়েকবার এই ওষুধটা নেন শ্রীধর। এটা ওঁর শরীরে নতুন শক্তি তৈরি করে। এটা খাওয়ার পরই মনে হয় শরীরের ভেতরে অফুরান শক্তি বাজপাখির মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে।

এই আশ্চর্য ওষুধের গোপন রহস্য শ্রীধরকে জানিয়ে গেছে বলধর। নিজের অভ্যাসের উত্তরাধিকার দিয়ে গেছে ‘ছোট ভাই’-কে। এ ছাড়া বলধর আরও একটা ‘অভ্যাস’ শ্রীধরকে ধরিয়ে গেছে। লিপস্টিক। ফ্লুওরেসেন্ট লিপস্টিক। তবে ছড়া কেটে কথা বলার ব্যাপারটা শ্রীধরের নিজস্ব।

কাবার্ডের দরজা বন্ধ করলেন। তোয়ালে দিয়ে আর একবার গা মুছে জিমের লাগোয়া ড্রেসিংরুমে চলে এলেন।

নিজের শত্রুদের কথা ভাবতে লাগলেন শ্রীধর।

বলধরের শত্রু ছিল। এটা খুবই স্বাভাবিক। ক্ষমতায় যদি কেউ থাকে তার শত্রু থাকবেই। সেই কারণেই বলধর নিজের জন্য বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল। নিজের বিশ্বস্ত গুপ্তচর সে ছড়িয়ে রেখেছিল নিউ সিটির মানুষজনের মধ্যে আর সিন্ডিকেটের নানান স্তরে—এমনকী সিন্ডিকেটের সাধারণ কর্মীদের মধ্যেও মিশে ছিল বলধরের অনুচরের দল। তাদের সবাইকে বলধর নিয়মিত টাকা দিত। বছরের পর বছর ক্ষমতায় থেকে বলধর সবাইকে টাকা চিনতে শিখিয়েছে। বোঝাতে চেয়েছে, টাকাই সব। বোঝাতে চেয়েছে, ‘মূল্যবোধ’ শব্দটার আসল অর্থ ‘মূল্যের বোধ’—অর্থাৎ, অর্থমূল্যের বোধ। ‘মূল্য’ আর ‘দাম’ শব্দ দুটোর মধ্যে কোনও তফাত নেই। ঠিক যেমন ইংরেজি ‘ভ্যালু’ আর ‘প্রাইস’ শব্দ দুটোর মধ্যে কোনও তফাত নেই।

সেই পথেই পা ফেলে এগিয়ে চলেছেন শ্রীধর। গুপ্তচর, টাকা ইত্যাদির বিনিময়ে নিজেকে সুরক্ষিত করার বন্দোবস্ত যেমন করেছেন তেমনই ইমার্জেন্সি সিচুয়েশানের জন্য নিজের আওতায় রেখেছেন স্পেশাল শুটার। তিনটে ইঞ্জিন লাগানো এই শক্তিশালী শুটার শ্রীধর নিজেই চালাতে পারেন। এই শুটারের মধ্যে লুকোনো রয়েছে অ্যান্টি-ডেসট্রাকশন স্টিল বক্স। থার্মাল ইনসুলেশান দেওয়া এয়ারটাইট এবং ওয়াটারপ্রুফ সেই বাক্সের ভেতরে রয়েছে শ্রীধরের ইমার্জেন্সি ফান্ড—কয়েক লক্ষ মার্কিন ডলার।

যদি কখনও প্রয়োজন হয় শ্রীধর এই স্পেশাল শুটারে করে নিউ সিটি ছেড়ে উড়ে যাবেন পৃথিবীর যে-কোনও দেশে। সেখানে নিরাপদে জীবন কাটাবেন। একইসঙ্গে ক্ষমতায়নের পুনর্বাসনের অপেক্ষায় থাকবেন। তারপর প্রথম সুযোগেই ফিরে আসবেন নিউ সিটিতে।

কাবার্ডের পাল্লা বন্ধ করে আপনমনে মাথা নাড়লেন শ্রীধর। হাসলেন। যতই এসব ব্যবস্থা থাকুক না কেন শ্রীধর জানেন, এসবের কোনও প্রয়োজন হবে না। শ্রীধর পাট্টা আছেন, এবং থাকবেন। কখনও-কখনও নিজেকে সত্যি অমর বলে মনে হয় শ্রীধরের। তিনি কখনও চান না নিউ সিটিতে তিনি ছাড়া আর কোনও ‘হিরো’ তৈরি হোক। যখনই শ্রীধর এরকম সম্ভাবনা দেখেছেন তখনই ‘ব্যবস্থা’ নিয়েছেন। দ্বিতীয় আর কোনও ব্যক্তিত্বকে মাথা তুলতে দেননি। জনগণকে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিউ সিটির ‘মালিক’ কে।

কিন্তু জিশান? এই জিশান পালচৌধুরী ছেলেটা? ওল্ড সিটি থেকে কিল গেম-এর পার্টিসিপ্যান্ট খুঁজতে গিয়ে ওকে বেছে নিয়েছিলেন শ্রীধর। ভেবেছিলেন, নানান খেলায় ছেলেটা জিতবে, কিন্তু কিল গেম পর্যন্ত পৌঁছবে না। বড় জোর পিট ফাইট পর্যন্ত যাবে। তারপর…।

অথচ জাব্বার মতো বর্ন কিলারের হাতে ছেলেটা শেষ হয়নি। উলটে জাব্বাকে চুরচুর করেও ওকে খতম করেনি। ওকে জীবনভিক্ষা দিয়েছে।

সারা শহর এখন জিশান বলতে পাগল।

একের-পর-এক খেলায় জিতে ছেলেটা ধীরে-ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পিট ফাইটে ও জাব্বাকে বাগে পেয়েও খতম না করে ছেড়ে দেওয়ায় শহরবাসীরা অনেকে খুশি হয়েছে। তারা জিশানকে নিয়ে দিন-রাত চর্চা করছে।

নিউ সিটিতে ছড়ানো গুপ্তচরের মারফত সব খবরই পাচ্ছেন শ্রীধর।

টিভির নানান চ্যানেলে জিশানের নানান গেম-এর পারফরম্যান্স নিয়মিত রিপিট টেলিকাস্ট হচ্ছে। ওকে নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের প্রাোডাক্ট প্রাোমোট করছে। দিন-রাত টেলিভিশানে শুধু জিশান আর জিশান।

শ্রীধর বুঝতে পারছিলেন, এই ছেলেটাকে নিয়ে শহরে ‘হিরো ওয়রশিপ’ শুরু হয়ে গেছে। জনগণ চাইছে কিল গেম-এ জিশান জিতুক। অসম্ভবকে সম্ভব করুক। জিশান পালচৌধুরী ওদের চোখে সুপারহিরো।

কিন্তু কিল গেম-এ তো আজ পর্যন্ত কেউ বাঁচেনি!

এই গেম-এর আইডিয়াটা প্রথম শ্রীধরের মাথায় আসে। তারপর সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম ডিজাইনাররা গেমটাকে ফাইনাল শেপ দেয়। যদিও মিডিয়ার মাধ্যমে সবসময় প্রচার করা হয় কিল গেম-এর সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07, শ্রীধর জানেন আসলে ওটা 0.0। ননজিরো ইনডেক্সটা দেওয়া আছে শুধু ইনটারন্যাশনাল গেম কোডকে বুড়ো আঙুল দেখানোর জন্য।

জিশানের সুপারহিরো হয়ে ওঠার ব্যাপারটা শ্রীধরের মনে কাঁটার মতো খচখচ করতে লাগল।

না। না। কিল গেম-এ জিশানকে হারতে হবে।

হারতেই হবে।

ভোরের আকাশের দিকে তাকিয়ে জিশানের মনটা উদাস হয়ে গেল।

এখন ক’টা বাজে? খুব বেশি হলে সাড়ে পাঁচটা। টিভির মেয়েটি ভোর ছ’টায় মিষ্টি গলায় ওকে ডেকে ওঠার অনেক আগেই জিশান ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে চলে এসেছে এলিভেটরের কাছে। ওর ভীষণ ছাদে যেতে ইচ্ছে করছিল। ওখানে আকাশ অনেক বড়।

এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই পিস ফোর্সের একজন গার্ডকে দেখা গেল। কোমরে ঝুলছে শকার।

জিশানকে দেখে গার্ডের চোয়ালের রেখা নরম হল। মুখের রুক্ষ ভাব মিলিয়ে গেল।

গার্ড জিগ্যেস করল, ‘এখন কেমন আছ?’

‘আগের চেয়ে অনেক ভালো।’

জাব্বার সঙ্গে লড়াই শেষ হওয়ার পর জিশানকে লেভেল ওয়ান ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিটের এক্সট্রিম কেয়ার সেল-এ রাখা হয়েছিল। সেখানে আধুনিক চিকিৎসার চূড়ান্ত ম্যাজিক দেখেছিল জিশান। মেডিকদের মুখে শুনেছিল, ওর পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে, বাঁ-পায়ের ঊরুর একটা পেশি মারাত্মক চোট পেয়েছে, ডান হাঁটুর মালাইচাকি সরে গেছে, ডানহাতের তর্জনি আর মধ্যমার হাড়ে চিড় ধরেছে। এসব সমস্যা ছাড়াও সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা আর যন্ত্রণা তো ছিলই!

জিশানকে জোড়াতালি দিয়ে ঠিক করতে ডাক্তারবাবুদের প্রায় কুড়ি দিন লেগে গেল। যখন ও ফিজিক্যাল রিড্রেসাল ইউনিট থেকে ছাড়া পেল তখনও ওর পাঁজরে আর ডানহাতের আঙুলে স্টিকিং পলিমার ড্রেসিং। এই ড্রেসিং ওয়াটারপ্রুফ—জল লাগলেও কোনও ক্ষতি হয় না।

রিড্রেসাল ইউনিটের বেডে শুয়েই অনেক অভিনন্দন পেয়েছিল জিশান। ডক্টররা, নার্সরা ওকে ‘কনগ্র্যাটস’ জানিয়েছিল—এবং সেটা শুধু জাব্বাকে হারিয়ে জেতার জন্য নয়, জাব্বাকে প্রাণভিক্ষা দেওয়ার জন্যও। রিমিয়াও ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। ছোট্ট করে ওকে বলেছিল, ‘জিশান, আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে। য়ু ক্যান ডু ইট।’

জিশানের অবাক লেগেছিল। ওর মনে পড়ছিল পিট ফাইটের স্টেডিয়ামের কথা। সেই ভয়ংকর রাতে গ্যালারির মানুষগুলো রক্তের জন্য বীভৎস পিপাসায় গর্জন করছিল, হাত-পা ছুড়ছিল। তখন জিশান বুঝতে পারেনি সেখানে অন্যরকম মানুষও রয়েছে। এখন ও নতুন করে বুঝতে পারছিল বৈচিত্র মানুষের প্রধান ধর্ম। পয়সার অন্য পিঠটা ও অল্প-অল্প দেখতে পাচ্ছিল।

রিড্রেসাল ইউনিট থেকে জিশান যখন গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাস-এ ফিরে এসেছিল তখন পিস ফোর্সের বেশ কয়েকজন গার্ড ওকে দেখামাত্রই ওকে ঘিরে ধরে হইচই বাধিয়ে দিয়েছিল।

‘ওয়েলকাম, জিশানভাইয়া। ফাইটার নাম্বার ওয়ান।’ একজন অচেনা গার্ড বলেছিল।

তারপরই চেনা দুজন গার্ডকে দেখতে পেয়েছিল জিশান। লম্বা এবং বেঁটে। জিশান আর ফকিরচাঁদকে নেকরোসিটি দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। এ ছাড়া স্নেক লেক কমপিটিশানের আগে বেঁটে গার্ডটি সকলকে লুকিয়ে জিশানকে স্নেক রিপেলান্ট অয়েল দিয়েছিল। সোজা কথায় বলতে গেলে জিশানের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।

বেঁটে গার্ড ওর কাছে এগিয়ে এল। সন্ধের শুরুতেই লোকটার মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। জিশানের বুকে দুটো চাপড় মেরে জড়ানো গলায় বলল, ‘তুমি সত্যিকারের হিরো, জিশান। তুমি ইচ্ছে করলে জাব্বার গর্দানটা মটাস করে ভেঙে দিতে পারতে—কিন্তু দাওনি। তোমার দিল আছে। বুদ্ধিও। তুমি ভালো করেই জানো, জাব্বাকে মেরে এই খতমের খেলা বন্ধ করা যাবে না। তুমি শুধু হিরো না, ভাই, তুমি একেবারে হিরো নাম্বার ওয়ান।’

কথা শেষ করে জিশানকে জড়িয়ে ধরল। ওর বুকের কাছে একটা চুমু খেল। তারপর হাত তুলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নাচতে শুরু করল। অন্য গার্ডরা সঙ্গীর এই কাণ্ড হাততালি দিয়ে উপভোগ করতে লাগল।

লম্বা গার্ড কোথা থেকে যেন ছিটকে চলে এল জিশানের সামনে। চাপা গলায় বলল, ‘শাবাশ, জিশান, শাবাশ। তোমার জবাব নেই। তুমি বেঁচে থাকলে সবার ভালো হবে। কিন্তু…।’

জিশান বিষণ্ণ হাসল। সামনে কিল গেম। সুতরাং ওই ‘কিন্তু’টাই আসল কথা।

লম্বা গার্ড চটপট জিশানের কাছ থেকে সরে গিয়ে ওর বেঁটে সঙ্গীর হাত চেপে ধরল: ‘অ্যাই, কী করছিস কী! কেউ দেখে রিপোর্ট করলে কী হবে? চল, চল—শিগগির চল।’

এক ঝটকায় লম্বা বন্ধুর হাত ছাড়িয়ে নিল বেঁটে : ‘কোন সালা রিপোর্ট করবে? কোন সালা?’ টলোমলোভাবে মাথার ওপরে হাত ঘুরিয়ে বলল, ‘এখানে তো শুধু আমরাই আছি, নাকি? কী ভাই, তোমরা কি কেউ ওই শ্রীধরের বাচ্চাকে রিপোর্ট করবে? হ্যাঁ?’

আশ্চর্য! বাকি গার্ডরা এলোমেলো গুঞ্জন তুলে বলল, ‘না, না—কীসের রিপোর্ট! জিশান আমাদের হিরো নাম্বার ওয়ান। শুরু থেকে তো আমরা ওর গেম দেখছি। ও একেবারে লা-জবাব।’

বেঁটে গার্ড উত্তেজিতভাবে লম্বা সঙ্গীর ইউনিফর্ম খামচে ধরল : ‘দেখলি, সবাই কী বলছে! দেখলি!’

সবমিলিয়ে হইহট্টগোল বেড়ে উঠছে দেখে শেষ পর্যন্ত জিশানই সবাইকে শান্ত হওয়ার অনুরোধ করতে লাগল। তারপর কথা না বাড়িয়ে ও এগিয়ে গিয়েছিল এলিভেটরের দিকে।

জিশানের অদ্ভুত লাগছিল। এই সাধারণ মানুষগুলো, যারা এখানে স্রেফ দু-পয়সা আয়ের জন্য সিকিওরিটি গার্ডের চাকরি নিয়েছে, জিশানের জেতায় এতটা খুশি হয়েছে! এর একটা কারণ বোধহয় সিন্ডিকেট এবং শ্রীধর পাট্টার প্রতি ওদের ঘৃণা। থমথমে আতঙ্কের নিয়মিত শাসন আর মৃত্যু দেখতে-দেখতে ওদের ভেতর থেকে বমির ভাব উথলে উঠেছে। মুখের ভেতরে যে-থুতু আর জল টের পাচ্ছে তার স্বাদ টক।

নাহাইতলা গ্রামে থাকা গার্ডের কথা মনে পড়ল জিশানের। শান্ত, নরম, ছবির মতো ওর সেই গ্রাম। আর বছরপাঁচেক চাকরি করেই ও গ্রামে ফিরে যাবে। এখানে একটা মুহূর্তও ছেলেটার ভালো লাগছে না।

জিশান ক্রমশই যেন বুঝতে পারছিল, আসলে অনেকেই এখানে ভালো নেই।

জিপিসি-তে ফিরে আসার পর আরও দশদিন জিশানকে ডাক্তারদের নির্দেশ মতো চলতে হয়েছে। ওকে এখন সফট এক্সারসাইজ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে চলছে ফিজিয়োথেরাপি মেশিনের ট্রিটমেন্ট। আর সপ্তাহখানেক পর থেকেই ওর কিল গেম ওয়ার্ম-আপ ট্রেনিং শুরু হবে। তারপর…।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জিশান। অবাক হয়ে খেয়াল করল, ওর মধ্যে এখন উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা, আশঙ্কার তেমন কোনও ছায়াপাত নেই। নিউ সিটিতে আসার শুরুর দিকটায় এই আবেগগুলোই জিশানকে শাসন করত। তারপর কয়েকমাস ধরে নানান খেলায় অংশ নিয়ে জীবন-মরণের ওঠা-পড়া দেখতে-দেখতে এইসব আবেগ কবে জমাট বেঁধে বরফ হয়ে গেছে! জিশান এখন অনেক ধীর, স্থির, শান্ত।

এলিভেটরের ভেতরে ঢুকল জিশান। নি:শব্দে দরজা বন্ধ হল।

‘কোথায় যাবে?’ গার্ড জিগ্যেস করল।

‘ছাদে যাব। ঘরের মধ্যে কেমন যেন দম আটকে আসছে।’

‘হবেই তো! এতদিন ধরে ফ্যামিলি ছেড়ে এখানে একা-একা থাকা…।’

‘তুমিও তো এখানে একা-একা আছ—।’

এলিভেটর উঠতে শুরু করেছিল। ডিসপ্লে প্যানেলের দিকে একপলক তাকিয়ে জিশানের দিকে মুখ ফেরাল গার্ড। হেসে বলল, ‘ফারাকটা বুঝতে পারলে না, ভাই! আমি এখানে একা আছি নিজের ইচ্ছেয়—চাকরি করছি, তাই। আর তুমি এখানে আছ শ্রীধর পাট্টার ইচ্ছেয়। মানে, বন্দি।’

মানুষটার এই সহজ ব্যাখ্যায় জিশান বেশ অবাক হয়ে গেল। ও গার্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

অন্যান্য গার্ডের তুলনায় এর বয়েস কিছুটা বেশি। সাঁইতিরিশ-আটতিরিশ হবে। ফরসা সুন্দর চেহারা। তবে মুখে যেন একটা আবছা লড়াইয়ের ছাপ রয়েছে।

গার্ড জিগ্যেস করল, ‘তোমার সামনে তো কিল গেম?’

জিশান কোনও কথা বলল না—শুধু ওপর-নীচে মাথা নাড়াল।

‘তোমাকে সবসময় টিভিতে দেখায়। তোমার গেমগুলো দেখায়—ট্রেনিং দেখায়। নিউ সিটির প্রায় সবাই তোমাকে চিনে গেছে।’

জিশান চুপ করে রইল। গার্ডকে দেখতে লাগল।

‘মনোহর সিং তোমার দোস্ত ছিল?’

সঙ্গে-সঙ্গে জিশানের মনখারাপ হয়ে গেল। বুক ঠেলে একটা শ্বাস বেরিয়ে এল।

গার্ড বলে চলল, ‘হ্যাঁ…তোমাকে আমি টিভিতে কাঁদতে দেখেছি। পিট ফাইটে মনোহর সিং-এর সঙ্গে লড়াইয়ের অ্যানাউন্সমেন্টের সময়। তারপরে মনোহরকে যখন কুকুরগুলো ছিঁড়ে খেল, তখনও।’

জিশানের বুকের ভেতরে কষ্ট হচ্ছিল। মনোহর নামের হাসিখুশি অশিক্ষিত উদার মানুষটার স্মৃতি ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর চোখের সামনে।

এলিভেটরের দরজা খুলে গেল। সামনে বিশাল ছাদ। ভোরের কোমল আলোয় স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে। এই স্নিগ্ধ শূন্যতা জিশানকে আরও বিষণ্ণ করে তুলল।

গার্ড বলল, ‘এখানে দশবছর চাকরি হয়ে গেল। অন্য কারও জন্যে কোনও ক্যান্ডিডেটকে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। তোমার ভেতরে এখনও মানুষ আছে, ভাই। কিল গেম-এ তুমি জিতলে আমার খুব ভালো লাগবে।’

জিশান এবার বলল, ‘কিন্তু শুনেছি কিল গেম-এ আগে কেউ জেতেনি—।’

‘ঠিকই শুনেছ।’ আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখাল গার্ড : ‘ওপরের ওই অদৃশ্য লোকটার কাছে অনেকেই তো অসম্ভব উদ্ভট অনেক কিছু চায়। কোনওদিন পাবে না জানে, তবু চায় তো!’ হাসল। অনাবিল হাসি : ‘তো আমিও তাই চাইছি।’ একটু থেমে তারপর : ‘আমি একা নয়—অনেকেই চাইছে তুমি কিল গেম-এ জেতো।’

জিশান হাসল। সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, ‘লড়ব—জান কবুল করে লড়ব।’

গার্ড জিশানের দিকে হাত বাড়াল। জিশানও।

হ্যান্ডশেক করে গার্ড বলল, ‘গুড লাক, জিশান।’

‘থ্যাংক য়ু।’

এলিভেটরের দরজা বন্ধ হল। জিপিসি-র গেস্ট হাউসের ছাদে জিশান একা। ওকে ঘিরে সুবিশাল ভোরের আকাশ।

জিশানের মনে হল, আকাশের এই বিশাল ক্ষমতা আর মমতা ওকে আগলে রেখেছে। কিল গেম-এর আঁচ থেকে আকাশ ওকে বাঁচাবে।

ছাদে দুজন গার্ড পাহারায় ছিল। জিশানকে দেখে ওরা তাড়াতাড়ি কাছে এগিয়ে এল। ওদের একজন ভুরু উঁচিয়ে ইশারায় জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার?’

জিশান বলল, ‘কিছু না। ঘুম আসছে না। ঘরের ভেতরে ভাল্লাগছে না। তাই ছাদে পায়চারি করতে এলাম।’

‘কী করে ভালো লাগবে! তোমার ওপরে যা ধকল গেছে।’

আর-একজন বলল, ‘তোমার কথা পান্ডা আর মূর্তির কাছে শুনেছি। ওরা তোমার কথা খুব বলছিল।’

জিশানের ভুরু কুঁচকে গেল : ‘কে পান্ডা আর মূর্তি?’

‘ওই যে—বেঁটে আর লম্বু মানিকজোড়। আমাদের মতো সিকিওরিটি গার্ড। বেঁটেটা পান্ডা। আর লম্বুর নাম মূর্তি।’

জিশান চুপ করে রইল।

প্রথমজন বলল, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে তোমার কথা বলাবলি করি। তুমি খুব হিম্মতওয়ালা।’

ওর সঙ্গী নীচু গলায় বলল, ‘তোমার সামনে কিল গেম। তোমাকে হেলপ করা উচিত। যদি মনখারাপ না করো একটা কথা বলব?’

জিশান মনে-মনে মনখারাপ না করার জন্য তৈরি হল। জিগ্যেস করল, ‘কী?’

‘কিল গেম-এর সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07 বলে সিন্ডিকেট যেটা ঢেঁড়া পিটিয়ে প্রচার করে সেটা ফলস। ওটা আসলে 0.0। কিল গেম-এ, কেউ বাঁচে না। ওই গেম সিটি থেকে কেউ বেঁচে ফিরে আসে না।’

জিশান মলিন হাসল : ‘জানি…।’

‘তোমাকে আমরা যতরকমভাবে পারি হেলপ করব। কারণ, আমরা চাই তুমি জেতো। তবে কী করে জিতবে জানি না।’

জিশান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর কিছু সমর্থক আছে জেনে ওর ভালো লাগছে। তবে সেই সমর্থন ওকে কোথাও পৌঁছে দেবে না।

‘না—তোমাকে আর ডিসটার্ব করব না।’ বলে গার্ড দুজন সরে গেল। যার-যার নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে পজিশন নিল।

জিশান ছাদের কিনারার দিকে হেঁটে গিয়ে পুব আকাশের দিকে তাকাল। ভোরের আলো ফুটে গেছে—এবার সূর্য ফোটার পালা।

রিড্রেসাল ইউনিট থেকে জিপিসি-র গেস্টহাউসে ফেরার দিন গার্ডদের খুশির হইচই জিশানকে অবাক করেছিল। আজও গার্ড তিনজনের প্রতিক্রিয়া ওকে অবাক করল। ওরাও জানে, কিল গেম-এর সারভ্যাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.0। খাঁচার ভেতরে ইঁদুর-বেড়াল খেলা। বেড়ালের হাতে ইঁদুর মরবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

ছাদের সাঁইতিরিশ তলার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে নিউ সিটির ‘ছবি’ দেখছিল জিশান। নানান বাড়ির আকাশছোঁয়া কাঠামোগুলোয় অতি-আধুনিক স্থাপত্যের চিহ্ন। জিশানের বারো বছর বয়েসে নিউ সিটি যা ছিল এখন তা নেই। সময় গড়িয়ে চলার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখানকার নাগরিক জীবনে বহুরকম নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তারই একটা হচ্ছে বিনোদন—পুরুষালি বিনোদন। কে জানে, আগামী আট-দশবছরে সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম ইনভেন্টরসরা হয়তো শুধু মেয়েদের নিয়ে নানান ধরনের রোমাঞ্চকর খেলা আবিষ্কার করবেন। তারপর আসবে পুরুষ এবং মহিলাদের মিশিয়ে আরও নতুন ধরনের গেম-এর পরিকল্পনা। তারপর… তারপর…।

তার পরের ব্যাপারটা ভাবতেই জিশানের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যদি শ্রীধর পাট্টা আর তাঁর গেম ইনভেন্টর সাঙ্গপাঙ্গরা তাঁদের বিকৃত স্যাডিস্ট মনোভাব নিয়ে শিশু আর কিশোরদের জন্য আরও নোংরা চরিত্রের, আরও বেপরোয়া, সব মরণপণ ‘খেলা’ আবিষ্কার করেন? যদি ম্যানিম্যাল রেসে ক্ষুধার্ত ব্লাডহাউন্ডের সঙ্গে কিশোর প্রতিযোগীরা দৌড়য়? যদি অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদের পিছনে লেলিয়ে দেওয়া হয় ভয়ংকর কোমোডো ড্রাগন? যদি স্নেক লেক কমপিটিশানের কনটেস্ট্যান্ট হয় আট-ন’ বছরের বালক-বালিকার দল?

জিশান আর ভাবতে পারছিল না। ওর বমি পাচ্ছিল। এ কয়েকমাসের অভিজ্ঞতায় ওর মনে হচ্ছিল, এরকমটা হতেই পারে—যদি না কেউ সময়মতো বাধা দেয়।

কিন্তু কখন সেই সময়?

ভোরের আলোয় দাঁড়িয়ে জিশানের মনে হল, ওর বুকের ভেতর থেকে কে যেন চেঁচিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিল : ‘এখন! এখন! এখন!’

ততক্ষণে দিগন্তের ক্যানভাসে সূর্য উঠে পড়েছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে একটা চিন্তা জিশানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। চিন্তাটাকে অনেকবার তাড়ানোর চেষ্টা করেছিল ও, কিন্তু চিন্তাটা যায়নি। বারবার ও নিজেকে বোঝাচ্ছিল যে, এটা একটা অবাস্তব আকাঙক্ষা, কিন্তু ওর ছেলেমানুষ মন মানতে চায়নি।

শেষ পর্যন্ত আর থাকতে না পেরে ও পান্ডা আর মূর্তির শরণাপন্ন হল।

ওদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে নিয়েই জিশান গেস্টহাউসের একতলার ফোয়ারার কাছে কয়েকদিন ধরে ঘুরঘুর করছিল। কিন্তু ওদের দেখা পাচ্ছিল না। কে জানে, হয়তো ওদের জিপিসি থেকে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে!

পরপর তিনদিন জিশানের উসখুসুনি দেখে একদিন রাতে একজন গার্ড জিশানকে কাছে ডাকল। জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার বলো তো! ক’দিন ধরে তুমি এখানটায় ঘুরঘুর করছ কেন?’

জিশান ইতস্তত করতে লাগল।

তখন গার্ডটি বলল, ‘আরে ইয়ার, তুমি কিল গেম-এ কোয়ালিফাই করেছ। তোমার জন্যে রুল-টুল আর অত স্ট্রিক্ট নেই। বলো, কী বলবে?’

‘আমি…আমি পান্ডা আর মূর্তির সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। খুব জরুরি ব্যাপার…।’

পিট ফাইটের আগে হলে এই গার্ডই হয়তো জিশানকে পাঁচটা প্রশ্ন করত। কিন্তু এখন কোনও কথা জিগ্যেস করল না। শুধু বলল, ‘কোনও চিন্তা কোরো না। কাল সন্ধেবেলা সাতটা নাগাদ ঘুরতে-ঘুরতে এখানে চলে এসো। পান্ডা আর মূর্তি থাকবে। আমি খবর দিয়ে দেব।’

সেটাই হয়েছিল। পরদিন সন্ধেবেলা সেই দুজন গার্ডের সঙ্গে দেখা হল জিশানের। ওদের একপাশে ডেকে নিয়ে গোপন আকাঙক্ষার কথা বলল জিশান।

শুনে মূর্তি একেবারে আঁতকে উঠল। বলল, ‘কীসব আজেবাজে বকছ! এ কী করে হয়! ধরা পড়লে বা জানাজানি হলে কেলেঙ্কারি হবে। অবশ্য সেই কেলেঙ্কারি দেখার জন্যে আমি বা পান্ডা কেউই আর বেঁচে থাকব না। শ্রীধর পাট্টা আমাদের বটিচচ্চড়ি করে খেয়ে নেবে।’

মূর্তির আতঙ্ক দেখে পান্ডা হাসল। তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নেড়ে নেশা করা জড়ানো গলায় সঙ্গীকে বলল, ‘ওসব ফালতু কথা ছাড় তো! শ্রীধর পাট্টার চেয়ে আমার কি আই. কিউ. কিছু কম আছে? আমি এমন টেকনিকে কাজ হাসিল করব যে, পাট্টার বাপ-ঠাকুরদাও টের পাবে না।’ জিশানের দিকে ফিরে বলল, ‘কোনও ভয় নেই, জিশানভাইয়া—সব হয়ে যাবে…।’

জিশান চাপা গলায় বলল, ‘আমি দশহাজার টাকা দেব।’

পান্ডা লাল চোখ বড়-বড় করে জিশানের দিকে তাকাল। যেন মঙ্গলগ্রহের প্রাণী দেখছে।

‘টাকা? তোমার কাছ থেকে টাকা নেব?’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আপনমনেই কীসব বিড়বিড় করল পান্ডা। তারপর : ‘যদি নিতেই হয় তা হলে নেব কিল গেম-এর পর। তুমি তখন একশো কোটি টাকার প্রাইজ মানি জিতবে। তার থেকে কিছু আমাদের দিয়ো…এই গরিব ভাই দুটোকে দিয়ো।’

জিশান বুঝল, পান্ডা আসলে কী বলতে চাইছে। ও কিল গেম-এ জিতলে তবে না পান্ডা আর মূর্তিকে টাকা দেবে! আসলে ওরা জিশানকে উইশ করছে।

জিশান কোনও কথা বলল না। মলিনভাবে হাসল। ফোয়ারার জলটাকে হঠাৎই ওর চোখের জল বলে মনে হল। ও চারপাশে তাকাল। রাতের আকাশ দেখল। বাতাসের ঘ্রাণ নিল। গেস্ট হাউসের উঁচুতলার দিকে তাকাল। তারপর পান্ডা আর মূর্তিকে দেখল।

আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার মুখ খুলল : ‘ছোটবেলায় আমি এই শহরে থাকতাম। তারপর…তারপর…এই শহর ছেড়ে ওল্ড সিটিতে চলে গেছি। বহুবছর এই শহরটাকে দেখিনি। তাই কিল গেম-এর আগে একবার দেখতে ইচ্ছে করছে…ভীষণ ইচ্ছে করছে। সেইজন্যেই তোমাদের হেলপ চেয়েছি।’

পান্ডা অবাক হয়ে বলল, ‘ও, তাই! তুমি এই শহরে ছিলে! যাকগে, কোনও প্রবলেম নেই। কাল সাড়ে সাতটায় তুমি এখানটায় চলে এসো—আমরা থাকব। তারপর তোমায় গোটা শহরটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব…।’

জিশান ফোয়ারার জলের ধারার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর মনে পড়ছিল মিনির কথা, শানুর কথা। মা-বাবার কথাও। এই শহরটা ছেড়ে যাওয়ার দিনে বাবার চোখের জলের কথা মনে পড়ে গেল জিশানের।

ও পান্ডার হাত চেপে ধরল। ছেলেমানুষের মতো অনুনয় করে বলল, ‘আমার হাতে আর সময় নেই। কিল গেম-এ শেষ হয়ে যাওয়ার আগে শহরটাকে একবার দেখতে চাই।’

পান্ডা চোখ বড়-বড় করে নেশাতুর দৃষ্টিতে তাকাল জিশানের দিকে : ‘কিল গেম-এ শেষ? তুমি?’ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল পান্ডা। তারপর হাসি থামলে বলল, ‘জিশানের শেষ নেই।’

জিপিসি-র সিকিওরিটি কন্ট্রোল রুমে জিশানকে নিয়ে এল পান্ডা আর মূর্তি।

এরকম আধুনিক ঝকঝকে কন্ট্রোল রুম ফিউচারিস্টিক সিনেমাতেও দেখা যায় না। চারদিকে শুধু কাচ আর স্টেইনলেস স্টিল। এ ছাড়া ওয়াল মাউন্টেড কম্পিউটার আর অসংখ্য টাচ-স্ক্রিন ডিসপ্লে। বাঁ-দিকের বিশাল দেওয়ালের পুরোটাই একটা গ্রাফিক ডিসপ্লে স্ক্রিন। সেখানে জিপিসি-র নানান মনিটরড জোন দেখা যাচ্ছে। ছবির সঙ্গে-সঙ্গে জোনগুলোর নম্বর আর নাম চোখে পড়ছে। পাঁচ কি ছ’সেকেন্ড পরপর ছবিগুলো পালটে যাচ্ছে—ঠিক যেমন কম্পিউটার কার্ড গেমে তাস পালটে যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *