০১.
ওষুধের দোকানের কাছে পৌঁছে পকেটে হাত ঢোকাল জিশান। এবং সঙ্গে-সঙ্গে আঁতকে উঠল। পকেটে টাকা নেই! অথচ একটু আগেই তো ছিল! একটা একশো টাকার নোট, একটা পঞ্চাশ টাকার নোট, একটা কুড়ি টাকার নোট, আর কিছু খুচরো পয়সা। এখন শুধু খুচরো পয়সাগুলো পড়ে আছে।
কী হবে এখন! বহু কষ্টে গতকাল দুশো টাকা রোজগার করেছে। তখনই ঠিক করেছে প্রথমেই শানুর জন্য একটা দুধের কৌটো কিনবে। ছ’মাসের বাচ্চাটা এ পর্যন্ত ছ’সপ্তাহের দুধ পেয়েছে কি না বলা মুশকিল। ওর খিদের কান্না জিশানকে পাগল করে দেয়। আর তার সঙ্গে জুড়ে যায় মিনির কান্না। বাচ্চার কষ্ট কোন মা-ই বা সইতে পারে!
কিন্তু তাই বলে মিনি কখনও জিশানকে দোষ দেয় না। কারণ, সাংঘাতিক অভাব-অনটনের কথা জেনেশুনেই তো ও জিশানকে বিয়ে করেছে। তখন জিশান একটা লোহালক্কড়ের কারখানায় কাজ করত—বিয়ের কয়েকমাস পরেই ওটা লকআউট হয়ে যায়। তারপর…তারপর থেকে জিশান রোজই কাজের খোঁজে বেরোয়। যা কাজ পায় তাই করে—শুধু কোনওরকমে কিছুটা টাকা জোগাড় করতে পারলেই হল।
বারকয়েক পকেট হাতড়ে দোকানের কাছ থেকে সরে এল জিশান। ওর নাকে একটা পোড়া গন্ধ এল। ও চোখ ঘুরিয়ে তাকাল সেদিকে। কয়েকটা লোক রাস্তার পাশে একটা আবর্জনার ভ্যাটের কাছে তার পোড়াচ্ছে। লোকগুলোর পোশাক ছেঁড়া-খোঁড়া নোংরা। তার ওপর মাথার যা অবস্থা! কতদিন স্নান করেনি কে জানে!
লোকগুলো ক্ষুধার্ত দৃষ্টি নিয়ে আগুনের কুণ্ডলী ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তারের প্লাস্টিকটা পুড়ে গেলে ভেতরের তামা কিংবা অ্যালুমিনিয়ামটা ওরা ওজনদরে বেচে দেবে।
প্লাস্টিক পোড়া ধোঁয়া পাক খেয়ে-খেয়ে ওপরদিকে উঠছিল। মাথা তুলে ওপরে তাকাল জিশান। ধোঁয়ায়-ধোঁয়ায় রাতের আকাশের সুন্দর কালো রংটাই আর নেই—কেমন যেন লাল আর হলুদের আভা মেশানো ঘোলাটে হয়ে গেছে।
না, শুধু এই তার পোড়ানো ধোঁয়ার জন্য নয়। এই শহরের নানান জায়গায় শুধু কলকারখানা, গাড়ি আর উনুনের ধোঁয়া। প্রায় ষোলো বছর ধরে জিশান এই ব্যাপারটা দেখছে। এ ছাড়া রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা, খানাখন্দে ভরা, যেখানে-সেখানে নোংরার স্তূপ, বাড়িগুলো জীর্ণ মলিন, রাস্তার বেশিরভাগ আলোই খারাপ—সারানোর কেউ নেই, পুলিশ-প্রশাসন বলেও কিছু নেই। সরু ঘিঞ্জি রাস্তায় যে-গাড়িগুলো চলে তাদের মডেল এত পুরোনো যে, ভিনটেজ কার বলা যায় অনায়াসে। আর তাদের যেরকম দোমড়ানো মোচড়ানো চেহারা তাতে সেগুলো যে এখনও চলছে সেটাই বড় কথা।
এককথায় শহরটা আর বেঁচে নেই। আর বেঁচে আছে বলে যদি ধরে নেওয়া যায় তা হলে বলতে হয় শহরটার যক্ষ্মা, পক্ষাঘাত এবং ক্যান্সার হয়েছে। সবাই এটাকে বলে ‘ওল্ড সিটি’, কিন্তু জিশান বলে ‘ডেড সিটি’। এই শহরটা কেউ চালায় না—নিজে থেকে চলছে।
জিশান বাবার কাছে শুনেছে, নব্বই কি একশো বছর আগেও এই শহরের নাম ছিল কলকাতা। তারপর নতুন একটা শহর তৈরি হল তার পাশে। নাম হল ‘নিউ সিটি’। নিউ সিটির গড়ে ওঠার কাজ চলতে লাগল, আর একইসঙ্গে অনাদরে অবহেলায় ভাঙতে লাগল ওল্ড সিটি।
এখন, প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছরের ভাঙা-গড়ার খেলার পরে, ওল্ড সিটি যখন ধুঁকছে, নিউ সিটি তখন টগবগ করছে—সেখানে সবকিছুই নতুন, ঝাঁ-চকচকে, ব্যাপক।
মাথা তুলে আকাশে তাকাল জিশান। ধোঁয়াশা পেরিয়ে অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেল। গত কুড়ি-বাইশদিন ধরেই দৃশ্যটা সবার চোখে পড়ছে। দুটো প্রকাণ্ড ধূমকেতু পাখনা মেলে ছড়িয়ে রয়েছে আকাশে। একটার রং লালচে, আর অন্যটার আভা নীল। ওদের লেজদুটো ক্রমশ চওড়া হয়ে দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। ওদের পাশে চাঁদের কুমড়োর ফালিটা কেমন ক্ষয়াটে অসুস্থ মনে হচ্ছে।
আনমনাভাবে পথ হাঁটতে শুরু করল জিশান। বাড়িতে ফিরে কী বলবে মিনিকে? এরকম বোকার মতো টাকা হারানোর কোনও মানে হয়! শানুর কথা ভেবে ওর বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল।
আর ঠিক তখনই একটা লোক ছুটে এসে জিশানকে ধাক্কা মারল।
জিশান পড়ে যেতে-যেতে কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। তারই মধ্যে টের পেল, লোকটা ধাক্কা মারার সময় ওর পকেটে হাতটা ঢুকিয়েই আবার বের করে নিয়েছে। এবং একইসঙ্গে প্রাণপণ দৌড় লাগিয়ে ঢুকে গেছে একটা অন্ধকার গলিতে।
পকেটে হাত দিয়ে দেখল জিশান। খুচরো পয়সা খানিকটা কমে গেছে। মনে-মনে ভীষণ রাগ হল ওর। পকেটমারি-চুরি-ছিনতাই এ-শহরে রোজকার ঘটনা। জিশান সবসময় সাবধান থাকে বটে, অথচ একটু আগে একশো সত্তর টাকা উধাও হওয়ার ব্যাপারটা ও একেবারেই টের পায়নি।
.
০২.
মুখে একটা তেতো ভাব, মনে একরাশ বিরক্তি—এই অবস্থায় জিশান এলোমেলো দিশেহারাভাবে হাঁটতে শুরু করল। না:, ওল্ড সিটিতে ওর বিরক্তি ধরে গেছে। এখানে শুধু অভাব আর অভাব। দিনের বেলা সূর্য উঠলেও আসলে চব্বিশ ঘণ্টাই অন্ধকার। ষোলো বছর আগে বাবা যদি হঠাৎ করে গরিব হয়ে না যেত তা হলে জিশানকে কোনওদিন ওল্ড সিটিতে আসতে হত না—নিউ সিটিতেই ওরা সুখে থাকতে পারত।
কিন্তু সেটা হয়নি। নিউ সিটিতে সবাই এত বড়লোক যে, সেখানে জীবন চালানোর খরচ অনেক বেশি। সবকিছুর দাম প্রায় আকাশছোঁয়া। চারিদিকে অঢেল সুখ আর আহ্লাদ। বাবার মুখেই এসব কথা শুনেছে জিশান। তখন ও খুব ছোট।
বাবা আর নেই। চোদ্দো বছর আগে বাবা চলে গেছে।
‘অ্যাই, জিশু!’
কে যেন আচমকা ডাকল জিশানকে।
ফিরে তাকাল জিশান। দেখল, হনহন করে হেঁটে আসছে মালিক।
ওর ছোটবেলার বন্ধু জিশান। একসময় একসঙ্গে খেলাধুলো করেছে। দুটো পয়সা উপায় করার জন্য বাগজোলা খালে মাটিও কেটেছে দুজনে।
মালিকের লম্বা শক্তপোক্ত চেহারা—অনেকটা জিশানের মতোই। তবে জিশানের মতো ফরসা নয়—ঠিক উলটো—কুচকুচে কালো। হাসলে পর অন্ধকার রাতের তারার ঝিকিমিকির মতো দাঁতের সারি ঝলসে ওঠে। এখনও তাই হল।
একটু পা টেনে-টেনে চলে মালিক। কাছে এসে ও জিশানের কাঁধ চাপড়ে দিল : ‘কী রে, মুখখানা এরকম আউল-আউল কেন?’
মালিক সবসময় পাখির নামগুলো ইংরেজিতে বলে। এককালে যে ওয়ার্ডবুক মুখস্থ করেছে সেটা কিছুতেই ভুলতে চায় না।
জিশান ওকে টাকা হারানোর গল্পটা বলল।
মালিক শব্দ করে থুতু ফেলল ঘেন্নায়, বলল, ‘এই নোংরা শহরটায় সালা আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু নিউ সিটিতে যে যাব সে-ক্ষমতাও নেই। এমনই পোড়া কপাল!’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মালিক বলল, ‘তবে আমি হার্ট অ্যান্ড সোল চেষ্টা করছি—দেখি কিছু করতে পারি কি না।’
জিশান জানে, মালিক কী চেষ্টা করছে। নিউ সিটিতে অনেক গেম শো হয়। তাতে প্রচুর টাকার প্রাইজ মানি থাকে। আর প্রতিটি খেলা লাইভ টেলিকাস্ট করা হয়। এই খেলায় একবার দাঁও মারতে পারলেই নবাব। দুনিয়া মুঠঠি মে। কিন্তু খেলাগুলোয় দারুণ ঝুঁকি রয়েছে। এক-একটা খেলা তো একেবারে দম বন্ধ করা ব্যাপার। খেলাগুলোর বেশিরভাগই চালায় ‘সুপারগেমস কর্পোরেশন’।
যেমন, ‘স্নেকস অ্যান্ড জেমস’ নামের একটা খেলায় সাপের চৌবাচ্চায় নেমে জলে হাতড়ে ছড়ানো-ছিটানো হিরের টুকরো কুড়িয়ে নিয়ে আসতে হয়। চৌবাচ্চায় ফুটখানেক ঘোলা জল। তার মধ্যে কিলবিল করছে বিষধর সাপ। আর জলের তলায় ছড়িয়ে আছে ছোট-বড় নানান মাপের হিরে। যে-ক’টা হিরে নিয়ে যে বেঁচে উঠে আসবে সেগুলো তার। যদি সেই প্রতিযোগী হিরেগুলো বিক্রি করতে চায় তা হলে ‘সুপারগেমস কর্পোরেশন’ টাকা দিয়ে সেগুলো কিনে নেয়।
আর-একটা খেলার নাম ‘ম্যানিম্যাল রেস’। ম্যান আর অ্যানিম্যাল—দুটো শব্দ জুড়ে তৈরি হয়েছে ম্যানিম্যাল। এই দৌড়ে অংশ নেয় কয়েকজন মানুষ আর একপাল তাগড়া বুনো কুকুর। এই দৌড়ে শুধু ফার্স্ট হলেই চলবে না, গায়ে কুকুরের আঁচড়-কামড়ের চিহ্ন থাকা চাই। তবেই পাওয়া যাবে পুরস্কার। দু-লক্ষ টাকা।
প্রাইজ মানির অঙ্কটা শুনলেই জিশানের বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। কতবার যে ও স্বপ্নে দেখেছে, ও খেলায় জিতে পুরস্কার নিচ্ছে, আর মিনি শানুকে কোলে নিয়ে তার লাইভ টেলিকাস্ট দেখছে! তারপর থেকে ওদের সংসারে অভাব আর নেই।
নিউ সিটির সুপারগেমস কর্পোরেশন এইসব বিপজ্জনক খেলার প্রতিযোগী খুঁজে পায় ওল্ড সিটি থেকেই। ওল্ড সিটির অনেকেই এই খেলায় জিতে ভাগ্য বদল করতে পেরেছে। তখন ওল্ড সিটি ছেড়ে তারা নিউ সিটির পাকাপাকি বাসিন্দা হয়ে গেছে। সেই কারণেই ওল্ড সিটির বহু বেপরোয়া যুবক এইসব হাই-রিসক গেমসে জেতার স্বপ্ন দ্যাখে।
ওল্ড সিটির সব জায়গাতেই টাঙানো রয়েছে ন্যানোটেকনোলজির প্লেট টিভি। চব্বিশ ঘণ্টা ধরে সেই টিভিতে প্রায় একশো চ্যানেল দেখানো হচ্ছে। তার মধ্যে গোটা চল্লিশ চ্যানেলে শুধু নানারকম গেম শো। কখনও লাইভ টেলিকাস্ট, কখনও পুরোনো বাঁধানো ফটোর মতো দেখতে হালকা এবং চ্যাপটা এই টিভিগুলো নিউ সিটির ‘সিন্ডিকেট’ টাঙিয়ে দিয়েছে ওল্ড সিটির কম করেও এক লক্ষ জায়গায়। চারঘণ্টা সূর্যের আলো পেলেই একটা প্লেট টিভি বিনা ব্যাটারিতে চারশো ঘণ্টা চলতে পারে। গরিব এই শহরে বলতে গেলে এটাই সকলের একনম্বর মনোরঞ্জন।
মালিক প্রায়ই জিশানকে এই খেলার ব্যাপারে ওসকায়। বলে, ‘চল, একটা রিসক নিই।’
জিশান অতটা সাহসী হতে পারে না। ও মালিকের মতো ঝাড়া হাত-পা হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু ওর কিছু হলে তখন মিনি আর শানুর কী হবে? তা ছাড়া মিনি এ ধরনের ফাটকা খেলা পছন্দ করে না।
মালিক বলে, ‘তোর যদি লটঘট কিছু হয়, তা হলে প্রাইজ মানির টুয়েন্টি পার্সেন্ট তোর ফ্যামিলি পাবে। তুই জানিস না, খেলায় নামার আগে ওরা ”নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স” কোম্পানি থেকে স্পেশাল ইনশিয়োরেন্স করিয়ে দেয়!’
হ্যাঁ, জানে জিশান। এবং এও জানে, সেই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির মালিকও বকলমে সুপারগেমস কর্পোরেশন। কিন্তু তাও…।
‘চল, আমাদের ওল্ড সিটির ফাইট গেম দেখবি চল।’ জিশানের হাত ধরে টান মারল মালিক। নিউ সিটির দেখাদেখি ওল্ড সিটিতেও গেম শো-র হিড়িক পড়ে গেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, হাতাহাতি লড়াই—’ফাইট গেম’।
মালিক বলল, ‘লাস্ট উইকে আমি আড়াইশো টাকা জিতেছি।’
শুনে হাসি পেয়ে গেল জিশানের। যে লক্ষ-কোটি টাকার স্বপ্ন দেখছে সে মাত্র আড়াইশো টাকা জিতেছে! আড়াইশোকে কত দিয়ে গুণ করলে একশো কোটি হয়? কারণ, একশো কোটি টাকা হল সুপারগেমস কর্পোরেশনের সবচেয়ে বেশি প্রাইজ মানি। ওদের ‘কিল গেম’ খেলায় জিততে পারলে এই মাথা-ঝিমঝিম-করা টাকার অঙ্ক পুরস্কার পাওয়া যায়। জিততে পারলে মানে বাঁচতে পারলে। কারণ, খেলাটা সত্যি-সত্যিই বাঁচা-মরার খেলা। ওল্ড সিটির কত মানুষ যে এই খেলায় নায়ক হওয়ার স্বপ্ন দ্যাখে! চব্বিশ ঘণ্টার এই খেলায় যে নাম লেখাবে, ওল্ড সিটি আর নিউ সিটির মানুষের কাছে সে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য সুপারহিরো। কারণ, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও একশো কোটি টাকা পুরস্কারের লোভে এই খেলায় নাম লেখানো বড় সহজ কথা নয়! আর খেলাটা চব্বিশ ঘণ্টা ধরে একটানা লাইভ টেলিকাস্ট করা হয় প্লেট টিভিতে। মাঝে-মাঝে থাকে বিজ্ঞাপনের ব্রেক।
জিশানকে হাত ধরে টানতে-টানতে এগোল মালিক। বলল, ‘আজ শনিবার। খেলা ভালো জমবে। চাই কি তুইও দু-একদান লাক ট্রাই করে দেখতে পারিস। কে জানে, ফট করে জিতে গেলে হয়তো বাচ্চার দুধটা কিনে বাড়ি ফিরতে পারবি।’
‘না রে, মিনি এসব জুয়া-ফুয়া পছন্দ করে না। তুই যা, আমি চলি—।’
জিশানের জামা ধরে হ্যাঁচকা টান মারল মালিক : ‘আরে, একটু তো চল—না হয় একটা ফাইট দেখবি, তারপর কেটে পড়বি। তোর কোনও ভয় নেই—ক্রো-বার্ডও টের পাবে না।’
‘কাকপক্ষী টের না পেলে কী হবে—মিনি ঠিক টের পাবে। ও খারাপ কাজের গন্ধ পায়। তা ছাড়া জুয়ায় জিতে সেই পয়সায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়াব! না:, আমায় ছেড়ে দে—আর-একদিন যাব।’
‘আজ আমার কথা শুনতেই হবে তোকে। একটিবার, প্লিজ! তোকে খেলতে হবে না—শুধু আমার খেলা দেখবি। ব্যস, হয়েছে তো!’
সুতরাং নাছোড়বান্দা মালিকের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল জিশান।
মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা ‘শুটার’ উড়ে গেল। নিউ সিটির পুলিশ ফোর্স আকাশে টহল দেওয়ার জন্য এই শুটার হাওয়াযান ব্যবহার করে। যন্ত্রটা নীল আর সাদা রঙের ডোরাকাটা একটা বড়সড় পটল যেন। তার গায়ে পাখনা লাগানো—লেজ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে। রাতের আকাশে সেই আগুন স্পষ্ট চোখে পড়ছে।
শুটারগুলো যখন হর্ন দেয় তখন মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। ওদের হর্নের তীব্র শিসের মতো শব্দ কখনও-কখনও জানলার কাচও ভেঙে দেয়। শিস দিয়ে ওরা ওল্ড সিটির লোকজনকে সাবধান করে দেয়। বিপজ্জনক ভিড় বা জটলা থাকলে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। আর শিসে কাজ না হলে বুলেট চলে—কখনও রবার-বুলেট, কখনও মেটাল-বুলেট।
হাঁটতে-হাঁটতে মানিকতলার খালের কাছে পৌঁছে গেল মালিক আর জিশান। পথে নানান জায়গায় দেখল, মানুষজন ভিড় করে প্লেট টিভিতে গেম শো দেখছে। নানান কোম্পানি নানারকম গেম শো দেখালেও সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেমগুলোই সবার সেরা।
সে-কথাই মালিককে বলছিল জিশান।
মালিক তাতে হেসে বলল, ‘ওল্ড সিটির ফাইট গেমটাও কিছু কম নয়। গেমটা একবার দেখ—নেশা ধরে যাবে।’
কথা বলতে-বলতে হাসি-ঠাট্টা করতে-করতে একটা বিশাল কারখানার সামনে হাজির হল ওরা।
কারখানাটা উঠে গেছে বহুকাল। এককালে স’ মিল ছিল—এখন তার ভাঙাচোরা কঙ্কাল পড়ে আছে। তার ভেতরে আলো-আঁধারিতে ঝুপড়ি বেঁধে আস্তানা গেড়েছে অসংখ্য লোক।
স’ মিলের সামনের রাস্তায় পাইপ ফেটে ফিনকি দিয়ে জল বেরোচ্ছে। বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিয়ে কয়েকজন মহিলা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। চার-পাঁচটা উনুন থেকে কালো ধোঁয়া বেরিয়ে পাক খেয়ে উঠে যাচ্ছে লাল-নীল ধূমকেতুর দিকে।
স’ মিলের অন্ধকার থেকে একটা মোটাসোটা ধেড়ে ইঁদুর বেরিয়ে এল। তারপর বেশ ধীরে-সুস্থে হেলেদুলে রাস্তা পার হয়ে চলে গেল খালের দিকে।
একটা হইহই চিৎকার ওদের কানে আসছিল। আঙুল তুলে স’ মিলের উলটোদিকের খালধারটা দেখাল মালিক, বলল, ‘খালপাড়ে…নীচেটায়…ফাইট হচ্ছে। জলদি চল।’
খালধারে অনেকটা জায়গা জুড়ে ঘন আগাছা—মাঝে-মাঝে বড়-বড় গাছ। কোনও-কোনও গাছের তলায় ফেলে যাওয়া শীতলা ঠাকুর। রোদ-জল-বৃষ্টিতে ঠাকুরের হতমান অবস্থা।
ওরকমই একটা ঠাকুরের পাশে প্রচুর লোহালক্করের ডাঁই। তার মধ্যে গোটাপাঁচেক জং-ধরা ভাঙা গাড়িও আছে। একটা গাড়ির মাথায় আর-একটা গাড়ি চড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তার পাশ দিয়ে এগিয়ে ঢাল বেয়ে খালের দিকে নামতে শুরু করল মালিক। জিশান ওর পিছু নিল।
একটা বড় গাছ পেরোতেই ঢালুভাবে নেমে যাওয়া খালপাড়টা জিশানের চোখে পড়ল। খালপাড়ের ঢালে—বেশ খানিকটা নীচে—একটা এবড়োখেবড়ো সমতল জায়গা। সেখানে আগাছার জঙ্গল সাফ করে ময়দান-এ-জঙ্গ তৈরি হয়েছে। তাকে ঘিরে অসংখ্য কেরোসিন কুপি, হ্যারিকেন আর মশালের আলো। ঠিক যেন মনে হচ্ছে দেওয়ালির রাত। আর সেই আলোর বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে বেশকিছু দর্শক উত্তেজনায় চিৎকার করছে : ‘খতম করো! খতম করো!’
লড়াইয়ের রিং-টা খালপাড়ের ঢালে বেশ খানিকটা নীচে হওয়ায় রাস্তা থেকে চোখে পড়ার উপায় নেই। ফলে এখন ওটা নজরে আসামাত্রই জিশান বুকে একটা ধাক্কা খেল।
রিং-এর ভেতরে তখন লড়াই চলছে।
•
জিশান এই ফাইট গেমের কথা আগে শুনেছে, কিন্তু কখনও দেখেনি। তাই ও অবাক হয়ে দেখছিল।
একটা কদমছাঁট চুল লম্বা ছেলে একজন বেঁটেমতন লোকের সঙ্গে লড়ছিল।
ছেলেটার গায়ের রং ময়লা, এককানে মাকড়ি, গলায় কালো সুতোর মালায় একটা চকচকে লকেট ঝুলছে। ওর পোশাক বলতে একটা বাদামি রঙের হাতকাটা ফতুয়া, আর ছেঁড়া জিনসের প্যান্ট।
বেঁটেমতন লোকটার গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি, আর একটা কালচে হাফপ্যান্ট। মাথায় বড়-বড় চুল। কুতকুতে চোখ।
লড়াই চলছিল আর একটা টুলের ওপরে দাঁড়িয়ে একজন রোগা-সোগা লোক মিহি গলায় ফিরিওয়ালার মতো চেঁচাচ্ছিল : ‘ফাইট দারুণ জমে উঠেছে। দেখা যাক, কে জেতে—কার্তিক, না ছুন্না। একে চার, একে চার…।’
ফিরিওয়ালা লোকটার হাতে অনেকগুলো নোট। মুঠো করে ধরে বাতাসে নাড়ছে। কেউ-কেউ হাত বাড়িয়ে তার হাতে টাকা দিচ্ছে। লোকটা টাকা নিয়ে একটা ছোট স্লিপমতন দিচ্ছে।
টাকাগুলো দেখে জিশানের তেষ্টা পেয়ে গেল, শানুর কথা মনে পড়ল। মনে পড়ে গেল, কিছুক্ষণ আগে ওর পকেটের টাকাগুলো কেউ হাতিয়ে নিয়েছে।
হ্যারিকেন, কুপি, আর মশালের লাল-হলদে শিখা কাঁপছিল। সেই আলো ছিটকে পড়েছে দর্শকদের উল্লাস ভরা মুখে, লড়াকু কার্তিক আর ছুন্নার গায়ে।
আশপাশের লোকজনকে জিগ্যেস করে মালিক জানতে পারল, বেঁটেমতন ফাইটার হচ্ছে কার্তিক, আর জিনস পরা ছেলেটা ছুন্না। কার্তিক আগে অনেক ম্যাচ জিতেছে। সেই তুলনায় ছুন্না একেবারেই নতুন—শুধু আগের ম্যাচটা জিতেছে। সুতরাং ছুন্নার ওপরে যারা বাজি ধরেছে, ছুন্না জিতলে তারা একটাকায় চারটাকা পাবে। আর কার্তিক জিতলে দশটাকায় তিনটাকা।
রিং-এর ভেতরটা সাফসুতরো করা হলেও জমি এবড়োখেবড়ো, কোথাও-কোথাও কাদা রয়েছে। তারই মধ্যে ছুন্না আর কার্তিক জন্তুর মতো লড়ছিল। ছুন্নার পা চলছিল বেশি, আর কার্তিকের হাত। আর দুজনেই মাঝে-মাঝে বিশ্রী ভাষায় একে অপরকে গালিগালাজ করছিল।
ছুন্না মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। সেই অবস্থাতেই কার্তিকের তলপেটে এক লাথি কষিয়ে দিল। ‘ওঁক’ শব্দ করে উঠল কার্তিক, ওর শরীরটা ভাঁজ হয়ে ঝুঁকে পড়ল সামনের দিকে। ছুন্না বেজির ক্ষিপ্রতায় লাফিয়ে উঠে খামচে ধরল কার্তিকের চুল—এক প্রবল হ্যাঁচকা টানে ওকে ছিটকে ফেলে দিল চারহাত দূরে। তারপরই ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর গায়ের ওপর। সঙ্গে-সঙ্গে কার্তিক সপাটে এক ঘুষি কষিয়ে দিল ছুন্নার মুখে।
একটা ভোঁতা শব্দ হল। তারপরই ছুন্না চিৎ হয়ে পড়ে গেল। আর কার্তিক শরীরটাকে গড়িয়ে ওর কাছে নিয়ে গেল। একখাবলা মাটি তুলে নিয়ে ঘুঁটে দেওয়ার মতো ঢঙে সজোরে থাবড়ে দিল ছুন্নার মুখে। এবং পলকে উঠে দাঁড়িয়ে ছুন্নার একটা পা একটানে তুলে নিল। সেটাকে গোড়ালি ধরে মুচড়ে শরীরটাকে বাঁকিয়ে চাপ দিতে লাগল। আর ছুন্না অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করতে লাগল।
বোঝা গেল, লড়াই শেষ।
দর্শক উল্লাসে জিগির তুলতে লাগল : ‘কার—তিক! কার—তিক! কার—তিক!’
মালিক জিশানের কানে ফিসফিস করে বলল, ‘সালা আমার তিরিশটা টাকা গেল।’
জিশান অবাক হয়ে মালিকের দিকে তাকাল। ও কখন ছুন্নার ওপরে বাজি ধরেছে কে জানে!
‘তুই কখন টাকা লাগালি?’
‘এখানে এসেই—।’
‘এভাবে যখন-তখন বাজি ধরা যায়?’
‘যায়। সেটা অ্যালাউ করবে কি না ঠিক করে রেফারি—ওই যে, ওই টিংটিঙে লোকটা—যে নোটের গোছা হাতে চেঁচাচ্ছে।’
রেফারি তখন বাজি জেতা লোকজনকে টাকা দিচ্ছে। কার্তিক আর ছুন্না একবালতি জল থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে রক্ত আর কাদা ধুয়ে নিচ্ছে। দু-তিনটে ছেলে ওদের সাহায্য করছে।
মিনিটপাঁচেক পরেই রেফারি আবার হাঁকতে শুরু করল : ‘এবার পরের ফাইট। সব সরে যাও—এবার শুরু হবে পরের ফাইট। কে লড়বে বলো—কে লড়বে?’
জনতার মধ্যে তখন চাপা উত্তেজনা, জোর আলোচনা চলছে, কথাকাটাকাটিও হচ্ছে। কেউ বলছে, ছুন্নার মুখে কাদা লেপটে না দিলে কার্তিক মোটেই জিততে পারত না। আবার কেউ-বা বলছে, কার্তিকের গায়ে অসম্ভব জোর—আর প্রতিপক্ষের মার সহ্য করার ক্ষমতাও সাংঘাতিক।
রিং-এ কেউ ছিল না। হঠাৎই কার্তিক লাফিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। তারপর বক্সার কিংবা কুস্তিগিরদের ঢঙে নেচে-নেচে ঘুরে বেড়াতে লাগল। আর রেফারি তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, ‘বন্ধুগণ, দোস্তোঁ, মাই ফ্রেন্ডস—কার্তিক আবার লড়তে রাজি আছে। আমাদের ফেবারিট ফাইটার কার্তিক। কে লড়বে ওর সঙ্গে? কে লড়বে? একজনও হিম্মৎদার ব্যাটাছেলে এখানে নেই? একটাও সালা বাপের ব্যাটা নেই?’
রেফারির চেঁচানি চলছিল, আর জনতার গুঞ্জনও চলছিল সমান তালে। মশাল, হ্যারিকেন আর কুপির আলোয় এ ওর দিকে তাকাচ্ছিল—চোখে প্রশ্ন : পয়সার লোভে কে কার্তিকের সঙ্গে লড়ার ঝুঁকি নেবে?
রেফারি তখন বুঝেছে বাজির দর না বাড়ালে কাউকে পাওয়া যাবে না। অথচ আর-একটা লড়াই হলে তার কমিশনটাও বাড়বে। তা ছাড়া এই ছন্নছাড়া গরিব মানুষগুলোর কাছে পয়সা বিরাট ব্যাপার। সুতরাং সে বাজির দর চড়াতে লাগল। বলতে লাগল, নতুন ফাইটার জিতলে একটাকায় ছ’টাকা। আর ফাইটারকে দেওয়া হবে একহাজার টাকা। ফাইটার যদি হেরে যায়, তা হলে পাবে মাত্র পঞ্চাশ টাকা।
জিতলে একহাজার টাকা!
শ্বাস টানল মালিক। চাপা গলায় জিশানকে বলল, ‘একহাজার টাকা মাইরি অনেক। লড়ে গেলে হয়।’
জিশান অবাক হয়ে তাকাল বন্ধুর দিকে। কী বলছে মালিক! কার্তিক পেশাদার ফাইটার—মালিক তার সঙ্গে কী করে পেরে উঠবে? মালিকের প্লাস পয়েন্ট একটাই—ওর জন্য চোখের জল ফেলার কেউ নেই। একমাত্র জিশান ছাড়া।
মালিক দিন-রাত এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়, নানান ফুর্তি-ফার্তা করে, টাকা ওড়ায়। গুছিয়ে বাঁচার ইচ্ছেটা ওর মধ্যে একদম নেই। ওর নীতি হচ্ছে, রঙ্গরৌলি করে জিন্দেগি কাটাও। কিন্তু তাই বলে কার্তিকের সঙ্গে ফাইট!
জিশান বলল, ‘তুই কি খেপেছিস?’
‘কিন্তু জিশু, ভেবে দেখ, একহাজার টাকা! একবার রিসক নিলে হয়…।’
‘ধুৎ, তুই কার্তিকের সঙ্গে পারবি না—।’
‘পারতেও তো পারি!’
আশপাশের কয়েকজন দর্শক ওদের কথাবার্তা শুনছিল। তাদেরই একজন বলে উঠল, ‘লড়ে যাও। তোমার তো দারুণ বডি!’
আর-একজন বলল, ‘শুনলে না, জিততে পারলে হাজার টাকা। ঢুকে পড়ো, রিং-এ ঢুকে পড়ো।’
আচমকা দুজন লোক মালিকের একটা হাত ধরে শূন্যে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এ লড়বে! এ লড়বে!’
ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে তুলকালাম ঘটে গেল।
টুলে দাঁড়ানো রেফারির কাছে পটাপট বাজির টাকা জমা পড়তে লাগল। জনতা নতুন লড়াই দেখার আশায় হইহই করে উঠল।
মালিক একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল—কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। আর জিশান লোকদুটোর হাত থেকে মালিককে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। বারবার বলতে লাগল, ‘ও লড়বে না। ও লড়বে না।’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! কয়েকটা হাত প্রবল ধাক্কায় মালিককে ছিটকে দিল রিং-এর ভেতরে। মালিক চিতপাত হয়ে পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে রেফারি একটা হুইসল বাজিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘স্টার্ট!’ আর হিংস্রভাবে নেচে বেড়ানো কার্তিক চুলের মুঠি ধরে মালিককে একটানে তুলে নিল। কয়েকপলক তাকাল গোল হয়ে ঘিরে থাকা দর্শকদের দিকে। তারপর এক ভয়ঙ্কর চাপড় বসিয়ে দিল মালিকের গালে—কিন্তু ওর চুলের মুঠি ছাড়ল না।
মালিকের মুন্ডুটা প্রবল ঝাঁকুনি খেয়ে গেল। অসহ্য ব্যথায় মনে হল চোয়ালটা বোধহয় এখনই খুলে পড়বে। কয়েক লহমার জন্য অসাড় হয়ে গেল মালিক। ওর চোখ বুজে গেল।
কিন্তু প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলে একটা ব্যাপার আছে। বাঁচার তাগিদ কারও কিছু কম নেই। আত্মরক্ষার তাগিদও। হয়তো সেই তাগিদেই অনেকটা অটোমেটিক পুতুলের মতো কার্তিকের গলা টিপে ধরল মালিক। নদীতে ডুবে যাওয়ার সময় মানুষ যেরকম প্রাণপণে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, অনেকটা সেই ঢঙে মালিক কার্তিকের গলা টিপে ধরেছিল—যেন বাঁধন আলগা করলেই ও জলে ডুবে মারা যাবে।
কিন্তু কার্তিক পেশাদার ফাইটার। এ-লাইনে পুরোনো পাপী। তাই মালিক গলা টিপে ধরতেই ও ডান হাঁটু দিয়ে মালিকের দু-ঊরুর মাঝে এক জোরালো গুঁতো মারল। সঙ্গে-সঙ্গে হেঁচকি তোলার শব্দ করে মালিক মাটিতে খসে পড়ল, শরীরটাকে কেন্নোর মতো গুটিয়ে কাটা ছাগলের মতো ছটফট করতে লাগল।
জিশান চিৎকার করে উঠেছিল, ‘কী হচ্ছে কী? এখনই লড়াই বন্ধ করো। এভাবে যেখানে-সেখানে মারার নিয়ম নেই। বন্ধ করো ফাইট।’
দর্শকরা জিশানের কথা কানেই তুলল না। রক্ত দেখার খিদেয় জন্তুর মতো চিৎকার করতে লাগল। কে একজন বলল, ‘ফাইটের মাঝে আবার নিয়ম দেখাচ্ছ! ব্যাটা বুরবাক!’
জিশান দু-হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে চাইল রেফারির কাছে। ধাক্কাধাক্কিতে একটা মশাল থেকে আগুনের কুচি ছিটকে পড়ল ওর গলার কাছে। পিন ফোটানোর মতো যন্ত্রণা হল। ভিড়ের মধ্যে থেকে কে যেন গালাগাল দিল জিশানকে।
কোনওরকমে টুলে দাঁড়ানো রেফারির কাছে এসে পৌঁছল ও। লোকটা গভীর মনোযোগে মালিক আর কার্তিকের লড়াই দেখছে, একইসঙ্গে ফুকফুক করে বিড়ি টানছে।
জিশান চেঁচিয়ে অনেক কিছু বলছিল, কিন্তু লোকটা সেদিকে কোনও কানই দিচ্ছিল না।
রেফারির গায়ের তেলচিটে নোংরা পোশাকের বোটকা গন্ধ জিশানের নাকে আসছিল। ছুঁতে ঘেন্না করলেও শেষ পর্যন্ত ও মনের জোরে লোকটার প্যান্ট ধরে টান মারল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘এভাবে যেখানে-সেখানে মারার কোনও নিয়ম নেই—।’
লোকটা বিরক্ত হয়ে চোখ নামিয়ে তাকাল জিশানের দিকে। চোখের পলকে কুকুর-তাড়ানোর ভঙ্গিতে একটা লাথি চালাল জিশানের বুকে এবং দাঁত বের করে খিঁচিয়ে উঠল, ‘ফোট, সালা—ফোট! এ-ফাইটে ইল্লিগাল বলে কিছু নেই।’
তারপরই আবার খেলা দেখায় মন দিল।
জিশান কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন দর্শক অশ্রাব্য গালিগালাজ করে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিল সামনে থেকে।
লাথি-খাওয়া কুকুরের মতো সরে এল জিশান। ভিড় ঠেলে উঁকি মারল রিং-এর ভেতরে।
মালিকের অবস্থা তখন ভালো নয়। ওকে উপুড় করে একটা পা মুচড়ে ধরেছে কার্তিক। মালিকের অন্য পা-টা শূন্যে ছটফট করছে। সেই অবস্থায় কার্তিক কনুই দিয়ে মালিকের পিঠে গুঁতো মারছিল।
মালিক অতিকষ্টে পালটি খেল। কোনওরকমে জোড়া পায়ে ঝটকা দিয়ে ঠেলে দিল কার্তিককে। তারপর ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।
জিশান দেখল, মালিকের ঠোঁটের কোণ আর কপাল থেকে রক্ত পড়ছে। ওর গায়ের রং কালো বলে ব্যাপারটা খুব স্পষ্টভাবে চোখে পড়ছে না। তবে জ্বলন্ত মশালের আগুনের আভায় গড়িয়ে পড়া রক্ত চকচক করছে।
জিশান বুঝতে পারছিল মালিকের হয়ে এসেছে। ও চিৎকার করে ডেকে উঠল, ‘মালিক! বেরিয়ে আয়—আর ফাইট করতে হবে না! চলে আয়…! মালিক! চলে আয়—!’
জিশানের গলার আওয়াজ পেয়ে মালিক সেদিক লক্ষ করে তাকাল। আলো-ছায়ার খেলার মাঝে জিশানকে খুঁজে নিতে চাইল।
মালিক একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। সেইজন্যই ছুটে আসা কার্তিককে ও খেয়াল করেনি। যখন করল তখন দেরি হয়ে গেছে।
বুলেটের মতো ছুটে এসে কার্তিক মাথা দিয়ে গুঁতো মারল মালিকের পেটে। বুনো ষাঁড়ের মতো ওর শরীরটাকে ঠেলে নিয়ে চলল রিং-এর ধারে দাঁড়ানো দর্শকদের দিকে।
প্রচণ্ড উত্তেজনার চিৎকার শোনা গেল। হুড়মুড়িয়ে দর্শকরা সরে গেল জায়গা থেকে—যাতে ফাইটারদের সঙ্গে সংঘর্ষ না হয়। আর তখনই রিং-এর বাইরে লোহালক্কড়ের ডাঁইটা নজরে পড়ল জিশানের। এতক্ষণ দর্শকদের ভিড়ে ওগুলো আড়াল হয়ে ছিল।
জিশান আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। ওর চোখ বড়-বড় হয়ে উঠল। আর সেই বিস্ফারিত চোখের সামনেই মালিকের শরীরটা জং-ধরা লোহালক্কড়ের স্তূপে গিয়ে ধাক্কা খেল।
ঠিক কী যে হল ভালো করে বোঝা গেল না। বোঝা গেল একটু পরে—কার্তিক যখন সরে এল মালিকের কাছ থেকে।
মালিকের দেহটা তখনও বলতে গেলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চোখ বোজা। মাথাটা ঝুঁকে পড়ে চিবুকটা প্রায় বুকে ঠেকে গেছে।
কার্তিক তখন রিং-এর মধ্যে নৃশংস উল্লাসে নেচে বেড়াচ্ছে। ওর দেহের দু-চার জায়গা কেটে-ছড়ে গেলেও ও বিন্দুমাত্রও কাহিল হয়ে পড়েনি।
চারপাশে দর্শকদের হইচই চলছে। রিং-এর মধ্যে অনেকে ঢুকে পড়েছে। রেফারি সরু গলায় ‘কার্তিক! কার্তিক!’ বলে চেঁচাচ্ছে। সেই তালে-তালে দর্শকও চেঁচাচ্ছে, ‘কার—তিক! কার—তিক!’
জিশান ছুটে গেল মালিকের কাছে। আর কাছাকাছি এসেই ওর মনে হল, মালিক বোধহয় আর বেঁচে নেই। হঠাৎই ত্রুশবিদ্ধ জিশুর ছবিটা ঝলসে উঠল ওর চোখের সামনে। ও হাত বাড়িয়ে মালিককে জড়িয়ে ধরল, টান মেরে তুলে নিতে চাইল বুকে, কিন্তু ওকে নড়াতে পারছিল না।
জিশান কেঁদে ফেলেছিল। বারবার মালিকের নাম ধরে ডাকছিল। তখন কয়েকজন দর্শক আর রেফারি মিলে জিশানের সঙ্গে হাত লাগাল। পিঠে গেঁথে যাওয়া লোহাগুলো অনেক কষ্টে ছাড়িয়ে মালিককে বের করে নিয়ে এল ওরা। মালিকের শরীরের পিছনদিকটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
জিশান ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। একহাজার টাকার জন্য এভাবে ঝুঁকি নিল মালিক!
কিন্তু মালিক তো ঝুঁকি নিতে চায়নি! উত্তেজনায় পাগল দর্শকের দল ওকে ধাক্কা মেরে ঢুকিয়ে দিয়েছে রিং-এর ভেতরে। প্লেট টিভির গেম শো-গুলোই সবার সর্বনাশ করেছে। রোজ-রোজ নতুন-নতুন গেম চালু হচ্ছে টিভিতে। কী করে পলকে বড়লোক হওয়া যায়—এই চিন্তাটাই ঢুকে গেছে সবার মনের ভেতরে।
নিউ সিটির সুপারগেমস কর্পোরেশনের ওপরে ভীষণ রাগ হল জিশানের। ওদের বিপজ্জনক খেলাগুলোয় সবসময় নাম দেয় ওল্ড সিটির লোকজন—যারা চট করে বড়লোক হতে চায়, যাদের জানের এমনিতে খুব একটা দাম নেই।
আর নিউ সিটির বড়লোকগুলো! এক-একটা সব ভিতুর ডিম! একটা গেম শো-তেও ওরা কেউ নাম দেয় না। ওরা শুধু বাড়িতে নিশ্চিন্তে বসে প্লেট টিভিতে খেলা দ্যাখে আর চিকেন-প্রন পকোড়ার সঙ্গে সুস্বাদু পানীয় খায়।
গেম শো-গুলোকে জনপ্রিয় করার জন্যই ‘সিন্ডিকেট’ অসংখ্য প্লেট টিভি বিনা পয়সায় লাগিয়ে দিয়েছে ওল্ড সিটিতে। টিভির ইন্টারঅ্যাক্টিভ প্রাোগ্রামে স্রেফ বোতাম টিপেই গেম শো-তে নাম দেওয়া যায়।
সেই গেম শো নকল করতে পাগল ওল্ড সিটি। নকল নবিশির জেরে শেষ হয়ে গেল মালিক। এর হিসেব সমান করবে কে? জিশান?
গেম শো নিয়ে ঘৃণা আর টানের ফাঁদে পড়ে গেল জিশান। ওর চোখ ফেটে জল বেরোচ্ছিল।
মালিকের শরীরের ওপরে ঝুঁকে পড়েছিল ও। হঠাৎই টের পেল, মালিকের শ্বাস পড়ছে। চোখের জল মুছে ও ‘মালিক!’ বলে ডেকে উঠল। ওর মুখের ওপরে আরও ঝুঁকে পড়ল।
মালিক ধীরে-ধীরে চোখ খুলে জিশানকে দেখল। অনেকক্ষণ ঘোলাটে নজরে তাকিয়ে থেকে তারপর খুব অস্পষ্টভাবে বিড়বিড় করে বলল, ‘জিশু, ভেবেছিলাম লড়ব যখন ফ্যালকনের মতো লড়ব…কিন্তু সালা স্প্যারোর মতো লড়লাম। তুই ওকে উড়িয়ে দে। ওই কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস!’
মালিকের চোখ বুজে গেল। আর শ্বাস পড়ছে কিনা ঠিক বোঝা গেল না। আশেপাশে ভিড় করে থাকা লোকজন এতক্ষণ ‘হাসপাতাল…ডাক্তার…’ এসব বলছিল। ওরা হঠাৎই চুপ করে গেল। কে একজন চিৎকার করে বলল, ‘সালা টেঁসে গেছে। বডিটা খালাস করে দে।’
সঙ্গে-সঙ্গে দু-তিনজন লোক এসে মালিকের বডিটা টেনে নিয়ে যেতে শুরু করল।
জিশান প্রথমটা আটকাতে গিয়েছিল—কিন্তু কী ভেবে ছেড়ে দিল। কী হবে মালিকের বডি নিয়ে? বডি নিয়ে কোথায় যাবে ও? শ্মশানে ছাড়া?
জিশানের হাতে-জামায় রক্ত। নাকে মালিকের গায়ের গন্ধ টের পাচ্ছিল ও—বন্ধুত্বের গন্ধ।
ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল জিশান। ঠিক তখনই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ওর সামনে বাড়িয়ে ধরল কেউ।
মুখ তুলে তাকাল জিশান। ওর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে রেফারি। মালিকের হেরে যাওয়ার টাকাটা জিশানকে দিচ্ছে।
জিশানের বমি পেয়ে গেল। মুখে একগাদা থুতু উঠে এল পলকে।
টাকাটা জিশান নিতে চায়নি, কিন্তু হঠাৎই ওর মনে হল, ওটা মালিকের স্মৃতি। তা ছাড়া মালিক মারা যাওয়ার আগে ফিসফিস করে যা বলে গেছে সেই কথাগুলো এখন দামামা হয়ে জিশানের কানে বাজছে: ‘…কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস।’
মালিকের পাওনা টাকা আর পাওনা শপথের দায় এখন জিশানের।
জিশান আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল। ও ভালো করেই জানে, ওখানে গড বলে কেউ নেই—সেইজন্যেই আকাশটা দিনের বেলায় ফাঁকা আর রাতের বেলা অন্ধকার—এই নষ্ট শহরটার মতো অন্ধকার।
রঙিন ধূমকেতু দুটোর লাল-নীল আভা জিশানের চোখে পড়ল। ও মালিককে যেন আকাশে দেখতে পেল কোথায়। চোখ মুছে নজর নামাল জিশান। পঞ্চাশ টাকার নোটটা নিল রেফারির কাছ থেকে। লোকটার সারা গা থেকে বিড়ির গন্ধ বেরোচ্ছিল, তার সঙ্গে বোটকা গন্ধ।
জিশান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘আর-একটা ফাইট হয়ে যাক। ওই কার্তিকের সঙ্গে আমি লড়ব।’
সঙ্গে-সঙ্গে রেফারির দু-চোখে ফস করে খুশির আলো জ্বলে উঠল। ডানহাত ওপরে তুলে লোকটা মিহি গলায় চেঁচাতে শুরু করল, ‘কেউ চলে যেয়ো না। শুরু হচ্ছে নয়া ফাইট। কার্তিকের সঙ্গে লড়বে নতুন আনকোরা এক ইয়ং ফাইটার—’ লোকটা চেঁচানো থামিয়ে নিচু গলায় জিশানকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’
‘জিশান।’
‘বন্ধুগণ, নতুন ফাইটার জিশান—আর আমাদের চ্যাম্পিয়ন কার্তিক।’ আবার চেঁচানি শুরু হয়ে গেল : ‘এটাই আজকের লাস্ট ফাইট। আজকের মারাত্মক লাস্ট ফাইট। জিশান ভার্সেস কার্তিক—দেখা যাক সালা কে জেতে—।’
চেঁচাতে-চেঁচাতে লোকটা চলে গেল ওর টুলের কাছে। প্রায় লাফিয়ে টুলের ওপরে উঠে দাঁড়াল। আর সঙ্গে-সঙ্গে দর্শকরা ওর দিকে হামলে পড়ল। নানান প্রশ্ন করতে লাগল।
‘একে বিশ, একে বিশ! জলদি করো! লাস্ট ফাইট—ঢিসুম-ঢিসুম—কাম অন, কাম অন…।’
মালিকের সঙ্গে লড়াই শেষ হওয়ার পর জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনা করছিল অনেকে। অনেকে আবার বাড়ির পথ ধরেছিল। মালিকের মারা যাওয়ার ব্যাপারটা ওদের মনে তেমন দাগ কাটেনি। কারণ, এই ফাইট গেমে মাঝে-মাঝেই দু-একজন মারা-টারা যায়। এই গেমে যে ঝুঁকি আছে সেটা সবাই জানে। আর ঝুঁকি আছে বলেই খেলাটায় এত রোমাঞ্চ, এত উত্তেজনা।
রেফারির চিৎকার শুনে দর্শকদের ভাব-ভঙ্গি পালটে গিয়েছিল। শান্ত হয়ে যাওয়া মানুষগুলো আবার যেন রক্তের খিদেয় পাগল হয়ে গেল। ছত্রখান জনতা চটপট নিজেদের গোল করে সাজিয়ে নিল—মাঝে জল-কাদা মাখা এবড়োখেবড়ো রিং। জনতার অনেকেই ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল রেফারির কাছে—ওকে মাছির মতো ছেঁকে ধরল। রেফারিও চটপট পেশাদারি ঢঙে বাড়িয়ে ধরা হাতগুলো থেকে ছোঁ মেরে টাকা নিয়ে ছোট-ছোট স্লিপ গুঁজে দিতে লাগল।
রিং-এর ভেতরে কার্তিক ততক্ষণে হিংস্র উল্লাসে লাফাতে শুরু করেছে। বড়-বড় লাফ দিয়ে দর্শকদের নাকের ডগা ছুঁয়ে গোল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসছে গালাগালির ফোয়ারা।
জিশান রিং-এর ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। ওর গায়ে গোলাপি-সাদা চেক কাটা হাফশার্ট। তার এখানে-সেখানে রক্ত লেগে রয়েছে—মালিকের রক্ত।
জিশান শার্টটা খুলতে শুরু করতেই মিহি গুঁড়োর মতো বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। শার্টটা খুলতে-খুলতে দর্শকদের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিল ও। আগ্রহে উত্তেজনায় ওরা কার্তিকের নাম ধরে চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে : ‘কার—তিক! কার—তিক! কার—তিক!’
কার্তিক রিং-এ পাক খেতে-খেতে জিশানের গায়ে থুতু ছিটিয়ে গেল। জিশান তাকিয়ে দেখল শুধু—কিছু বলল না।
রেফারি একটা হুইসল বাজাল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘স্টার্ট!’
ব্যস, লড়াই শুরু হয়ে গেল।
জিশান দু-পা ফাঁক করে সামনে ঝুঁকে দাঁড়াল—যেন এখনই শিকার লক্ষ্য করে লাফ দেবে। ওর ফরসা খালি গা, উজ্জ্বল চোখ, মাথার ঢেউ খেলানো চুল, রং-ওঠা জিনসের প্যান্ট, কোমরে কালো বেল্ট—দেখে মনে হয় না, ও ওল্ড সিটিতে থাকে।
আর কার্তিক! ওর ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, নিরীহ ভেড়ার ছানাদের রিং-এ টেনে এনে কুচিকুচি করে জবাই করাটাই ওর পেশা।
ও জিশানকে ঘিরে স্লো-মোশান ছবির মতো পাক খাচ্ছিল, আর তীক্ষ্ণ নজরে প্রতিপক্ষকে মেপে নিচ্ছিল। ও বেঁটে হলে কী হবে, হাফপ্যান্টের নীচেই ওর ঊরুর শক্তিশালী পেশি চোখে পড়ছিল। মিহি বৃষ্টিতে ওর মাথায়, গায়ে, বৃষ্টির কণা চিকচিক করছিল।
আচমকা জিশানের দিকে ছুটে এল কার্তিক। আফ্রিকার আদিবাসী যোদ্ধাদের মতো কানফাটানো এক জিগির তুলে শূন্যে লাফ দিল। ওর পেশিবহুল শক্ত ডান-পাটা টান-টান করে সামনে বাড়ানো। ও তাক করেছে জিশানের গলা। একবার সংঘর্ষ হলেই লড়াই খতম।
জিশান শূন্যে ধেয়ে আসা হিংস্র কার্তিককে দেখল। ওর মনে পড়ল, এ-খেলায় নিয়ম বলে কিছু নেই, বে-আইনি বলে কিছু নেই।
তাই পলকে এক হাঁটু ভাঁজ করে মাটিতে বসে পড়ল জিশান। কার্তিক তখন শূন্যে, ওর মাথার ওপরে।
কার্তিকের ঊরুসন্ধি লক্ষ করে লোহার মুঠি চালিয়ে দিল জিশান। সে-ঘুষির পিছনে ওর সমস্ত শক্তি একজোট করা ছিল।
কার্তিক সটান খসে পড়ল মাটিতে—যেন গুলি খাওয়া চড়ুইপাখি। আর বাজপাখি জিশান ছোঁ মেরে তুলে নিল ওর ছটফটে দেহটা। মাথার ওপরে তুলে এগিয়ে গেল লোহালক্কড়ের ডাঁইয়ের দিকে।
ওকে এগিয়ে আসতে দেখে দর্শকরা ভয়ে সরে গেল দুপাশে। কিন্তু ওরা পাগলের মতো চিৎকার করছিল, ‘জি—শান! জি—শান! জি—শান!’
জিশানের সামনেই জং-ধরা লোহার স্তূপ—খোঁচা-খোঁচা লোহার শিক বেরিয়ে আছে সেখান থেকে।
মালিকের কথা মনে পড়ল জিশানের। অন্ধ রাগে ও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, তারপরই কার্তিকের দেহটা ছুড়ে দিল লোহালক্কড়ের ওপরে।
জনতা উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল।
ব্যস, ফাইট খতম।
কার্তিককে উড়িয়ে দিয়েছে জিশান। মালিকের আত্মা নিশ্চয়ই দেখেছে, কে ফ্যালকন, আর কে স্প্যারো! জিশানের শপথ পূর্ণ হয়েছে। এবার জিশান জল খেতে পারে।
জিশান হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল রিং-এর জল-কাদার মধ্যে। হাঁ করে তাকাল ওপর দিকে।
বৃষ্টির ফোঁটা এখন মাপে একটু বড় হয়েছে। সেগুলো টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে জিশানের হাঁ করা মুখের ভেতরে। আকাশ থেকে ছেটানো শান্তির জল।
পাবলিক তখন রেফারিকে ঘিরে ধরেছে। হইচই চেঁচামেচি হচ্ছে। আপসেট রেজাল্টে বেশিরভাগেরই মুখ ব্যাজার। যারা জিতেছে তাদের মুখে চওড়া হাসি। কেউ-কেউ চেঁচিয়ে গান ধরেছে।
ভেজা গায়ে উঠে দাঁড়াল জিশান। রিং-এর একপাশে পড়ে থাকা দলাপাকানো ভেজা শার্টটা তুলে নিয়ে গায়ে দিল। তারপর বোতাম লাগাতে-লাগাাতে রেফারির কাছে গেল। আড়চোখে লক্ষ করল, কার্তিকের দেহ অথবা মৃতদেহ ঘিরে বেশ বড়সড় জটলা তৈরি হয়ে গেছে।
ভীষণ আপসেট রেজাল্ট—এ-রেজাল্ট কেউ ভাবতেও পারেনি। তাই জিশানের হাতে অনেকগুলো টাকা ধরিয়ে দিল রেফারি। তারপর মিহি গলায় বলল, ‘পরশু রাতে আবার ফাইট আছে। জরুর আসবে—সেদিন তোমার হয়ে মোটা মাল লড়িয়ে দেব…।’
টাকাগুলো নেওয়ার সময় জিশানের ডানহাতটা ব্যথা করছিল। ঘুষিটা কার্তিককে ও এত জোরে মেরেছে যে, এখনও কাঁধ পর্যন্ত টনটন করছে। কিন্তু ওইটুকু ব্যথা নিয়েও অনায়াসে এই রেফারি লোকটাকে একটা থাপ্পড় মারা যায়। কারণ, খানিকক্ষণ আগে এই লোকটাই জিশানকে কুকুরের মতো লাথি মেরেছিল।
যে-এলাকার যা নিয়ম।
জিশান প্রথমে রেফারির মুখে শব্দ করে থুতু দিল। তারপর সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল লোকটার গালে।
পটকা ফাটার মতো শব্দ হল এবং লোকটা চোখ উলটে ভিড়ের গায়ে ঢলে পড়ল।
জিশান আর দাঁড়াল না। দর্শকদের ভিড় ঠেলে খালপাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল। ততক্ষণে বৃষ্টি আরও বেড়ে গেছে। কাদায় ওর পা পিছলে যেতে চাইছিল বারবার।
রাস্তায় উঠে এসে তাড়াতাড়ি পা চালাল জিশান। অনেক দেরি হয়ে গেছে মিনি চিন্তা করবে। কিন্তু একটা কথা ভেবে ওর ভালো লাগছিল—পকেটে এখন অনেকগুলো টাকা। শানুর জন্য একটা কেন, ও এখন চাইলে দশটা দুধ কিনতে পারে।
ওষুধের দোকানের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎই কান্না পেয়ে গেল জিশানের। প্রথমে মালিকের জন্য। ও ভাবতেই পারছিল না, ওকে আর কেউ ‘জিশু’ বলে ডাকবে না। বিশৃঙ্খল এই শহরে উচ্ছৃঙ্খল জীবন কাটানোর জন্য কেউ তাকে আর বারবার করে লোভ দেখাবে না। ভাবতেই পারছিল না, মালিক আর নেই।
কিন্তু জিশানও কি আর আছে! আগের জিশান?
দ্বিতীয়বার কান্না পেয়ে গেল জিশানের। এবারে নিজের জন্য। রাগে দু:খে এ কী করে বসল ও! অভাবের তাড়না ওকে রোজ কোণঠাসা করে তুলছিল ঠিকই, কিন্তু তাই বলে…!
পথ চলতে-চলতে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলল জিশান। শুধু মালিক নয়, জিশানও আজ মারা গেছে। মারা যাওয়া অধ:পাতে যাওয়া এই জিশান এখন জুয়ায় জিতে সেই টাকায় ছেলের জন্য দুধ কিনতে যাচ্ছে।
এ-কথা ভাবার সঙ্গে-সঙ্গে ওর ভেতর থেকে কে যেন প্রতিবাদ করে উঠল : না, জুয়ায় জেতা টাকা নয়—পরিশ্রম দিয়ে উপার্জন করা টাকা। গায়ের শক্তি দিয়ে ও কার্তিককে হারিয়ে তারপর এই টাকা পেয়েছে।
তখনই ওর বুকের ভেতরে হেসে উঠল মালিক, বলল, ‘জিশু, এ আমার প্রাণের দাম। এতে কোনও পাপ নেই। এ-টাকা দিয়ে তুই শানুর জন্যে দুধ কিনে নিয়ে যা…মেয়েদের মতো কাঁদিস না সালা—।’
জিশান যন্ত্রণায় চোখ বুজল। ওর দু-চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
ততক্ষণে ও ওষুধের দোকানে পৌঁছে গেছে।
•
রোজ বিকেলে শানুকে কোলে নিয়ে বেড়াতে বেরোয় জিশান। এক-একদিন মিনিও ওর সঙ্গে থাকে। যেমন আজ।
রাতের অন্ধকারে ওল্ড সিটির চেহারা একরকম—কেমন যেন অপার্থিব, ছমছমে রহস্যে ঢাকা। আর দিনের চড়া আলোয় শহরটা কী কুৎসিত, হতমান!
শহরের বেশিরভাগ গাছপালাই নেড়া, তাতে কোনও ফুল-পাতা নেই। শুধু কঙ্কালটা কোনওরকমে দাঁড়িয়ে আছে। এমনকী বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, সবই ধুঁকছে—সেই সঙ্গে শহরের মানুষগুলোও। তবে মানুষগুলোর মধ্যে এখনও স্বপ্ন আছে। বেশিরভাগেরই স্বপ্ন নিউ সিটিতে যাওয়ার।
কিন্তু জিশান বা মিনির স্বপ্ন পুরোপুরি সেটা নয়। ওরা চায়, এই শহরটা আবার বেঁচে উঠুক—গাছপালা, বাড়ি-ঘর, দোকানপাট, হাটবাজার, আর মানুষগুলোও বেঁচে উঠুক আবার। নানান রঙের ফুল আর পাখিরা ফিরে আসুক।
এখন তো পাখি বলতে শুধু কাক, চড়ুই, শালিখ, চিল আর শকুন—এ ছাড়া কখনও-কখনও ছিটকে চলে আসা দু-একটা পায়রা চোখে পড়ে। মউমাছি বা প্রজাপতি শেষ কবে দেখেছে জিশানের মনে নেই। আর ফুল? জংলা ঝোপ-ঝাড়ে দয়া করে যেটুকু যা ফুটে থাকে। নইলে রোজ বাগান করার শখের পয়সার জোগান দেবে কে!
নোংরা রাস্তার একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ওরা। সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। সেই আলো পড়েছে পুবে দাঁড়ানো নিউ সিটির গায়ে। শহরটা ঝলমল করছে। তার মাথায় অল্পবিস্তর শেষবর্ষার মেঘ। তার কিনারায় বিকেলের রং লেগেছে।
সেদিকে তাকিয়ে মিনি বলে উঠল : ‘কী দারুণ দেখাচ্ছে!’
জিশান বলল, ‘একদিন আমাদের শহরটাও ওরকম হবে।’
‘হবে তো?’ জিশানের দিকে তাকাল মিনি। ওর চোখে স্বপ্ন।
‘নিশ্চয়ই!’ বলে শানুর গালে একটা চুমু খেল জিশান।
শানুর চোখে কাজল, কপালে টিপ। ও জুলজুল করে বাবাকে দেখতে লাগল।
একটা ঝরঝরে গাড়ি ছুটে যাওয়ার সময় বৃষ্টির জল-ভরা খন্দে পড়ে লাফিয়ে উঠল। জিশান চট করে সরে যেতে চেষ্টা করল, কিন্তু পুরোটা এড়াতে পারল না। কাদা-জল ছিটকে এল ওর গায়ে।
মিনি বলল, ‘ইস, ভালো জামাটা নষ্ট হয়ে গেল।’
জিশান কোনও জবাব দিল না। ওর ভালো জামা-প্যান্ট বলতে আজকের পোশাকটাই সম্বল। বাকি আর যা-কিছু আছে সেগুলো দিনের বেলায় না পরাই ভালো।
পোশাকের ব্যাপারে মিনির অবস্থাও একইরকম। তবে রাতে ওকে বেরোতে হয় না কখনও। কারণ, অন্ধকার হয়ে গেলে জিশানই ওকে বেরোতে দেয় না। ভয়ের এই শহরে রাতে মেয়েরা একরকম বেরোয় না বললেই চলে।
জিশানরা আনমনাভাবে হেঁটে যাচ্ছিল। ডানদিকে, খানিকটা দূরে, একটা খাল। খাল না বলে পরিখা বলাই ভালো। কারণ, ওই পরিখা ওল্ড সিটি আর নিউ সিটিকে আলাদা করে রেখেছে। দুটো শহরের মধ্যে যোগাযোগ বলতে একটা ইস্পাতের সেতু—তার নাম ‘মাস্টার ব্রিজ’। ব্রিজের দুপাশে দুটো প্রকাণ্ড লোহার দরজা। দরকার পড়লে ওই দরজা খুলে নিউ সিটি থেকে ‘পিস ফোর্স’ আসে ওল্ড সিটিতে। এই শহরে ওদের অনেকগুলো যোগাযোগ অফিস আছে। আর একটা হেডঅফিস। সেই অফিসের মাধ্যমে ওরা নিউ সিটির জন্য ‘কাজের লোক’ জোগাড় করে। আর ইচ্ছে করলে ওইসব অফিসে যোগাযোগ করেও নানান গেম শো-তে নাম দেওয়া যায়।
মাস্টার ব্রিজের নিরাপত্তার জন্য পিস ফোর্সের লোক তো আছেই, তা ছাড়া আছে নানানরকম অটোমেটিক কন্ট্রোল। মাস্টার ব্রিজের কন্ট্রোল সিস্টেম অকেজো করে কারও পক্ষে ওই জোড়া লোহার দরজা ভেঙে নিউ সিটিতে ঢোকা সম্ভব নয়।
আর যদি কেউ সাঁতরে পরিখা ডিঙিয়ে নিউ সিটিতে যাওয়ার কথা ভাবে!
সেটাই হবে তার জীবনের শেষ ভাবনা।
কারণ, পরিখার দু-পাড়ের খাড়া দেওয়াল কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো। আর জল শুরু হয়েছে পঁচিশ ফুট নীচে।
সেই জলে কিলবিল করছে বিষধর সাপ আর পিরানহা মাছ। ওরা সবসময় জল পাহারা দেয়। ওই জলের উষ্ণতা, নোনাভাব, সবকিছুই সূক্ষ্ম পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
মাস্টার ব্রিজ কিংবা পরিখার নিরাপত্তার কথা ওল্ড সিটির বহু জায়গায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জাহির করা আছে—এই শহরের বাসিন্দাদের সাবধান করার জন্য।
সেইরকম একটা বিজ্ঞাপন পরিখার কিনারায় দেখতে পেল জিশান। বিশাল-বিশাল ফ্লুওরেসেন্ট হরফে রং-বেরঙের বিজ্ঞাপন।
নিউ সিটিতে এত নিরাপত্তা যে, ওল্ড সিটিতে তার ছিটেফোঁটাও নেই। এ-কথা ভেবে তেতো হাসি পেয়ে গেল জিশানের। ও মিনিকে জিগ্যেস করল, ‘নিউ সিটিতে যেতে ইচ্ছে করে?’
মিনি তাকাল জিশানের দিকে। বলল, ‘করে। মাঝে-মাঝে সত্যি যেতে ইচ্ছে করে।’
‘বেড়াতে, না পাকাপাকিভাবে?’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল মিনি। চারপাশটা চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখল। তারপর ইতস্তত করে জিগ্যেস করল, ‘আমাদের এই শহরটার আর কিছু হবে না, না?’
মিনি শহরটাকে নিয়ে সবসময় খুব ভাবে।
জিশান ওর কথায় হেসে ফেলল। শানুকে মিনির কোলে দিল। একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘হওয়া তো দরকার। শহরটা আর বেশিদিন এরকম থাকলে আমরা সবাই খারাপ হয়ে যাব, মিনি।’
শানু মুখে আঙুল ঢুকিয়ে অর্থহীন কয়েকটা শব্দ করে উঠল। জিশানের মনে হল, বাচ্চাটা যেন বলছে, ‘ঠিক বলেছ!’
সত্যিই তো! এই বর্বর শহরটার চাপে পড়ে জিশানরা সবাই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মিনি যদি পাশে না থাকত, এতদিনে জিশান কোথায় তলিয়ে যেত কে জানে! সেদিন যেভাবে কার্তিকের সঙ্গে লড়াইয়ের ব্যাপারটা হুট করে হয়ে গেল…যেভাবে চলে গেল মালিক…জিশানের বুকের ভেতরে তিন-চারদিন ধরে এক অস্থির তোলপাড় চলেছিল। মিনিকে আঁকড়ে ধরে অনেক চোখের জল ফেলেছে ও। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, এক জিশান আর-এক জিশানের জন্য চোখের জল ফেলছে।
মিনি এমনিতে খুব চাপা ধরনের মেয়ে। বুঝতে পারে সবকিছু, কিন্তু সহজে ওর মুখ ফোটে না। সংসারের অভাব নিয়ে জিশানের নানান অভিযোগ আছে, কিন্তু মিনির কোনও অভিযোগ নেই। ওর কথা ভাবলেই মনে কেমন একটা জোর পায় জিশান।
সূর্য যত হেলে পড়ছিল, বাদল মেঘ ততই আকাশের দখল নিচ্ছিল। দুটো শুটার তীব্র শিস দিয়ে মাথার ওপরে উড়ে গেল। মিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল, বলল, ‘এবার বাড়ি চলো। যদি পট করে বৃষ্টি এসে যায় তা হলে শানু ভিজে যাবে।’
জিশানও দেখল আকাশটাকে। এই একই আকাশ নিউ সিটির ওপরে। অথচ দুটো শহরে কত তফাত!
সামনেই একটা জটলা চোখে পড়ল ওদের। জটলাটা নিউ সিটির একটা ছোট ব্রাঞ্চ অফিসের সামনে।
শানুর পিঠ চাপড়াতে-চাপড়াতে মিনি জিগ্যেস করল, ‘কীসের ভিড় ওখানে?’
‘কে জানে! হয়তো নিউ সিটিতে কিছু কাজের লোক নেওয়া হবে—তারই অন-লাইন ফর্ম ফিল-আপ চলছে।’
সত্যি, এই শহরটা যেন শুধু চাকরবাকরদের শহর হয়ে গেছে! ভাবল জিশান।
মিনি বলল, ‘সুপারগেমস কর্পোরেশনের খেলায় নাম দেওয়ার ভিড়ও হতে পারে।’
‘হতে পারে—।’
‘চলো তো, কী খেলা দেখি। দেখি কত টাকা প্রাইজ মানি!’
জিশান ভেতরে-ভেতরে একটু দু:খ পেল। কৌতূহল আর লোভ। এই দুটো ব্যাপারকে উসকে দিয়ে সুপারগেমস কর্পোরেশন দিব্যি ব্যাবসা চালাচ্ছে। এ ছাড়া অভাব বড় সাংঘাতিক জিনিস। ভেতর থেকে মানুষকে ধীরে-ধীরে নরম করে দেয়।
ওরা হাঁটতে-হাঁটতে জটলার কাছে এগিয়ে গেল। আর তখনই ব্যাপারটা বুঝতে পারল।
সুপারগেমস কর্পোরেশন একটা নতুন খেলা লঞ্চ করছে। খেলাটার নাম ‘হাংরি ডলফিন’। প্লেট টিভিতে তারই প্রাোমো দেখানো হচ্ছে। দুজন প্রেজেন্টার খেলাটা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছে।
সমুদ্রের মধ্যে প্রকাণ্ড মাপের একটা খাঁচা ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই খাঁচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একডজন ডলফিন। তার মধ্যে ছ’টা ডলফিন আসলে হাঙর—তাদের বৈজ্ঞানিক কায়দায় ডলফিনের ছদ্মবেশ পরানো হয়েছে। এমন নিঁখুত ছদ্মবেশ যে, বাইরে থেকে দেখে বোঝার কোনও উপায় নেই।
এবারে এই খাঁচার মধ্যে নেমে পড়ছে একজন খেলোয়াড়। তাকে সাঁতার কেটে ঘুরে বেড়াতে হবে সেই খাঁচায়। এবং ছদ্মবেশী হাঙরের আক্রমণ থেকে বাঁচতে হবে। আত্মরক্ষার জন্য তাকে দেওয়া হবে দুটো ছুরি—একটা ছোট, একটা বড়। এ ছাড়া খেলোয়াড়ের কাছে থাকবে একটা ইলেকট্রনিক রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট। সে রিমোট টিপে সংকেত পাঠালেই খাঁচার দরজা খুলে যাবে এবং খেলোয়াড় পালিয়ে বাঁচতে পারবে।
‘হাংরি ডলফিন’ খেলার মোট সময়সীমা কুড়ি মিনিট। যদি কোনও খেলোয়াড় কুড়ি মিনিট ওই খাঁচায় কাঁটিয়ে আহত কিংবা অক্ষত অবস্থায় বেঁচে ফিরে আসতে পারে, তা হলে সে পাবে বিশলাখ টাকা। যদি কেউ তার আগে খাঁচা থেকে বেরিয়ে আসে, তা হলে তার পুরস্কার হল মিনিটপিছু এক লক্ষ টাকা। তবে কমপক্ষে পাঁচমিনিট খাঁচায় তাকে কাটাতেই হবে।
তারপরেই প্রেজেন্টাররা বলছে খেলার নানান শর্ত এবং নিয়মকানুন। বিশ লাখ টাকা প্রাইজ মানি দিয়ে নিউ সিটি থেকে কী-কী সুখ এবং আরাম কেনা যেতে পারে। কোথায়-কোথায় বেড়ানো যেতে পারে। কোন-কোন স্বপ্ন সত্যি হয়ে উঠতে পারে সফল প্রতিযোগীর জীবনে।
জিশান অবাক হয়ে দেখছিল।
সত্যি, সুপারগেমস কর্পোরেশনকে সেলাম জানাতে হয়। মাথা খাটিয়ে কী করে যে ওরা এতসব অদ্ভুত-অদ্ভুত খেলা বের করে কে জানে!
শানুকে কোলে নিয়ে এক্স-এক্স-এল সাইজের প্লেট টিভির দিকে তাকিয়ে ছিল মিনি। ওর চোখের পলক পড়ছিল না। খেলোয়াড়দের লোভ দেখানোর কায়দাটা দারুণ। ডলফিনের ছদ্মবেশে হাঙর। মিনিটপিছু একলক্ষ টাকা। কোনওরকমে পাঁচমিনিট কাটাতে পারলেই পাঁচ লাখ।
মিনি এমনিতে এসব খেলায় নাম দেওয়াটা খুব একটা পছন্দ করে না। কিন্তু বেশ কয়েকবছর ধরে অভাবের সঙ্গে লড়তে-লড়তে মাঝে-মাঝে ওর মনে হয়, এরকম দু-একটা খেলায় জেতার স্বপ্ন দেখলে ক্ষতি কী!
প্রেজেন্টার দুজন তখন ‘বার গ্রাফ’ আর ‘পাই চার্ট’ এঁকে খেলাটার অঙ্ক বোঝাচ্ছিল।
অর্থাৎ, একজন খেলোয়াড়ের প্রথম পাঁচমিনিট বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কত। তার পরের পাঁচমিনিটে সেই সম্ভাবনার মান কত হওয়ার সম্ভাবনা। কিংবা খেলোয়াড়ের আই. কিউ.-র সঙ্গে সারভাইভাল ফ্যাক্টরের সম্পর্ক কী। কী করে হাঙরের আক্রমণ এড়াতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।
এইসব বিজ্ঞানের কচকচির পরই শুরু হল একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান: শার্ক ভার্সাস ডলফিন। একজন হাঙর বিশেষজ্ঞ এবং একজন ডলফিন বিশেষজ্ঞ মুখোমুখি বসে হাঙর এবং ডলফিনের আচার-আচরণ নিয়ে দুজন প্রেজেন্টারের সঙ্গে তুমুল আলোচনায় মেতে উঠলেন।
প্রাোমোর সবশেষে টিভিতে ফুটে উঠল নিয়মাবলী।
তাতে রয়েছে খেলার নানান শর্ত এবং কীভাবে প্রতিযোগীরা খেলাটায় নাম দেবে তার সুলুকসন্ধান।
মিনির আশেপাশে ভিড় করে থাকা লোকজন হাঁ করে প্রাোমো প্রাোগ্রামটা গিলছিল। ওদের অনেকের চোখ দিয়ে লালা ঝরছিল।
নিউ সিটির যে-দুজন এজেন্ট টিভির পাশে চুপটি করে বসে ছিল, তাদের ছেঁকে ধরল কয়েকজন। ‘হাংরি ডলফিন’ গেম নিয়ে প্রশ্নে-প্রশ্নে পাগল করে তুলল।
জিশান জানে, খেলাটায় সারভাইভাল ফ্যাক্টর 0.61। অর্থাৎ, না-বাঁচার সম্ভাবনা শতকরা ঊনচল্লিশ ভাগ। কিন্তু তা সত্বেও এই বিপজ্জনক খেলায় নাম দেবে অনেকে। তার কারণ, ঝুঁকি নিয়ে জুয়া খেলতে চাওয়া লোকের সংখ্যা ওল্ড সিটিতে খুব একটা কম নয়। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণ হল লোভ—টাকা দিয়ে সুখ এবং আরাম কেনার লোভ। এই লোভের টোপ বড় সাংঘাতিক জিনিস।
মিনি জিশানের জামা ধরে টান মারল, বলল, ‘চলো, শানুর ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে আধ দুধ খেতে চাইবে না।’
জিশানের চোখ দেখে মিনির বুকটা কেঁপে উঠল। আশপাশের মানুষগুলোর চোখের সঙ্গে কিছুটা যেন মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। না, আর বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়ানো ঠিক নয়।
মিনি দোটানায় দুলতে-দুলতে হঠাৎই যেন ঘোর কাটিয়ে জেগে উঠল। আর-একবার জিশানের হাত ধরে আলতো টান মারতেই জিশান বিরক্ত হয়ে হাতটা ছাড়িয়ে নিল : ‘আ:! একমিনিট দাঁড়াও না!’
ততক্ষণে প্রাোমোর পরের অংশ শুরু হয়ে গেছে।
ওল্ড সিটির যেসব মানুষ সুপারগেমস কর্পোরেশনের অন্যান্য শো-তে নাম দিয়ে ভাগ্য ফেরাতে পেরেছে তাদের ফটোগ্রাফ দেখানো শুরু হল।
প্রথমে এল বছর পঁয়তিরিশ-ছত্তিরিশের একজন লোক। ঝকমকে পোশাক, চোখে গোল্ডেন ফ্রেমের চশমা, ঠোঁটে সিগারেট, মুখে চওড়া হাসি।
ভদ্রলোকের নাম সেন্টালি মজুমদার। একটা সোফায় আরাম করে বসে আছেন। পায়ের কাছে একটা লোমওয়ালা পুঁচকে কুকুর। সামনের টেবিলে কফির কাপ।
ক্যামেরা ভদ্রলোকের ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখাল। আর সেইসঙ্গে বলতে লাগল, সেন্টালি মজুমদার নিউ সিটির এই ফ্ল্যাটে কী আরামেই না আছেন! এই আরাম সেন্টালি কিনেছেন সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম শো-তে নাম দিয়ে। এবং জিতে।
জিশান এই প্রাোমো দেখতে-দেখতে আরামের গন্ধ পাচ্ছিল। কয়েক লহমার জন্য আনমনা হয়ে গেল ও।
শুধু জিশান কেন, দর্শকদের আরও অনেকেই ওই আরামের সুবাস পাচ্ছিল।
প্রাোমো দেখতে-দেখতে হঠাৎই একটা ধাক্কা খেল জিশান।
কারণ প্রেজেন্টার মেয়েটি তখন বলছে, ‘…কিন্তু গেম শো-তে জেতার আগে কেমন ছিল সেন্টালি মজুমদারের জীবন? এবারে দেখুন, কোথা থেকে কোথায় এসেছেন তিনি!’
সঙ্গে-সঙ্গে ক্যামেরা দেখাতে শুরু করেছে ওল্ড সিটির একটা জঘন্য বস্তি অঞ্চল। নোংরা, অন্ধকার, ক্লেদাক্ত জীবনযাত্রার ভয়াবহ ছবি। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকসমেত প্রায় আধমিনিট ধরে সেগুলো দেখানো হল। তারপর টিভির ফ্রেমে ফিরে এল প্রেজেন্টার। দর্শকদের দিকে আঙুল তুলে বলল, ‘আপনি কি চান না আপনার জীবনটাকে ফেরাতে? জীবন বদলানোর অধিকার সবার আছে—আপনারও। সেই বদলের জন্য নিতে হবে সামান্য ঝুঁকি। কী, পারবেন না একটু ঝুঁকি নিতে? আমাদের গেম শো-র সামান্য ঝুঁকির বিনিময়ে আমূল বদলে যেতে পারে আপনার জীবন।’
এরপর শুরু হল সেন্টালির ইনটারভিউ। গেম শো-তে ঝুঁকি নেওয়ার পক্ষে অনেক ভালো-ভালো কথা বললেন সেন্টালি। শোনালেন ‘মাই লাইফ উইথ আ টাইগার’ গেম-এ তাঁর রোমাঞ্চকর লড়াইয়ের কাহিনি।
একটা বাঘের খাঁচায় তাঁকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল একটা ছোট হান্টিং নাইফ আর চোদ্দো কেজি মাংসের টুকরো। মোক্ষম সময়ে বাঘের মুখে বারবার মাংসের টুকরো ছুড়ে দিয়ে, খাঁচার জাল বেয়ে টিকটিকির মতো পালিয়ে বেড়িয়ে, তাঁকে একঘণ্টা বাঁচতে হয়েছিল। এই লড়াইয়ে কালঘাম ছুটে গিয়েছিল সেন্টালির। মনের ওপরে কী সাংঘাতিক চাপই না পড়েছিল! একঘণ্টা পর যখন খাঁচার দরজা খুলে তাঁকে বের করা হয় তখন তিনি যন্ত্রণা আর টেনশানে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। জ্ঞান ফেরার পর তাঁর মনে হয়েছিল, বাঘের খাঁচার ব্যাপারটা সত্যি নয়—স্বপ্ন। কিন্তু খাঁচার ভেতরে তাকিয়ে দেখেছিলেন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারটা তখন মাংস চিবিয়ে খাচ্ছে। সেটা কিন্তু মোটেই স্বপ্ন ছিল না।
এই খেলায় পঞ্চাশ লক্ষ টাকা জিতেছেন সেন্টালি মজুমদার। তাঁর স্ত্রী আর দু-ছেলের তো আনন্দে পাগল হওয়ার জোগাড়। ওঁদের সবার জীবনটাই সেই মুহূর্ত থেকে বদলে গিয়েছিল।
ক্যামেরা এবার সেন্টালির পায়ের দিকে এগোল। সেন্টালি তাঁর প্যান্টের ডান পা-টা ওপরদিকে গোটাতে শুরু করলেন। ক্যামেরা ডান পায়ের ক্লোজ আপ শট দেখাচ্ছে। তাতে স্পষ্ট দেখা গেল, সেন্টালির ডান পায়ের গোলাপি রং চকচক করছে এবং সেই পায়ে একটাও লোম নেই।
পা-টা ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলেন সেন্টালি। তাঁর ডান পা-টা হাঁটুর কাছ থেকে খুলে চলে এল হাতে।
প্লাস্টিকের নকল পা।
একঘণ্টা ধরে রয়্যাল বেঙ্গলের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে একটা পা খুইয়েছেন সেন্টালি। অবশ্য তার জন্য সুপারগেমস কর্পোরেশনের সিস্টার কোম্পানি নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স সেন্টালিকে তিন লক্ষ টাকা দিয়েছে।
অর্ধেক ডান পায়ের দাম।
জ্ঞান ফিরে আসার পর সেন্টালি দেখেছিলেন, বাঘটা মাংস চিবোচ্ছে। আসলে বাঘটা তখন তাঁর কামড়ে কেটে নেওয়া ডান পা-টা চিবোচ্ছিল।
প্রাোমো দেখতে-দেখতে এতক্ষণ বেশ ভালোই লাগছিল জিশানের। প্রাোমোর সঙ্গে-সঙ্গে জাম্প কাট করে গেম শো-টার ফুটেজ দেখানো হচ্ছিল বারবার। মাঝে-মাঝে আবার স্লো মোশানে দেখানো হচ্ছিল, কী কায়দায় সেন্টালি বাঘের দাঁত-নখ এড়িয়ে বাঘকে ফাঁকি দিচ্ছেন।
টিভিতে সেসব দেখতে-দেখতে উত্তেজনা আর আনন্দে দর্শকরা হইহই করছিল, হাততালি দিচ্ছিল। কিন্তু একেবারে শেষে যখন সেন্টালির খোয়া যাওয়া পা-টা দেখানো হল, দেখানো হল বাঘের পা চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য, তখন পলকে সব হইচই থেমে গেল।
জিশানের হাত ধরে হিংস্রভাবে টান মারল মিনি : ‘এক্ষুনি চলে এসো বলছি!’
জিশানের হঠাৎই গা গুলিয়ে উঠল। ও তাড়াতাড়ি সরে এল টিভির সামনে থেকে। প্রেজেন্টার মেয়েটি তখন বলছে, ‘ভাবুন তো! এ-খেলায় কী মারাত্মক থ্রিল! আর কী মারাত্মক পুরস্কার—প-ন-চা-শ ল-ক্ষ টা-কা! হোয়াও! আর তার সঙ্গে বোনাস ইনশিয়োরেন্সের তিন লক্ষ টাকা! ভাবা যায়!’
সত্যিই ভাবা যায় না! লোভের টোপ ফেলে সুপারগেমস কর্পোরেশন সেন্টালির ডান পায়ের অর্ধেকটা নিয়ে নিয়েছে। কে জানে, একটু এদিক-ওদিক হলে সেন্টালির প্রাণটাই হয়তো খরচের খাতায় জমা পড়ে যেত!
সেন্টালির পরই দেখা গেল আর-একজন সফল প্রতিযোগীকে। সে তার সাফল্যের সাতকাহন শুরু করতেই জিশান সরে এল। কারণ, মিনি ওকে টানতে-টানতে রাস্তা ধরে হাঁটা দিয়েছে। আর ওর ডান কাঁধের ওপরে মাথা রেখে ছোট্ট শানু ঘুমিয়ে পড়েছে।
আকাশের রং এতক্ষণে অনেকটা ছায়া-ছায়া ঘোলাটে হয়ে গেছে। ধূমকেতু দুটো ধীরে-ধীরে রঙিন এবং স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেদিকে তাকিয়ে জিশানের মন খারাপ হয়ে গেল। এইভাবে খেলতে-খেলতেই কি সবার জীবন শেষ হবে?
হাঁটতে-হাঁটতে ও মিনির দিকে তাকাল : ‘মিনি—।’
‘উঁ—।’ আনমনাভাবে শব্দ করল মিনি। ও পথচলা দুটো বাচ্চা ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। বয়েস ওদের আট কি নয়। গায়ে ময়লা পোশাক। আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত বিড়ি। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে-করতে হেঁটে যাচ্ছিল। ওদের কথা যেটুকু শোনা গেল তাতে কানে আঙুল দিতে হয়।
কিন্তু আজকাল খুব একটা কেউ কানে আঙুল দেয় না—অনেকটা যেন গা-সওয়া হয়ে গেছে।
জিশান আক্ষেপের একটা শব্দ করে বলল, ‘হুঁ:, এই আমাদের পরের জেনারেশান!’
মিনি বলল, ‘এর মাঝে আমাদের শানুকে বড় করে তোলা…আমার খুব ভয় করে।’
‘জানো, আমাদের ছোটবেলাটা এরকম ছিল না…মানে, এতটা খারাপ ছিল না।’
মিনি ম্লান হেসে বলল, ‘সব জানি।’ একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তারপর : ‘তখন তো আর সুপারগেমস কর্পোরেশন ছিল না! আর এত প্রাইজ মানিও ছিল না।’
সত্যি, বাজি ধরা, জুয়া খেলা, যেন জীবনের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে! অথচ বাবা বলতেন, ‘শ্রমের মর্যাদা কখনও নষ্ট করবে না।’
হুঁ:! কোথায় শ্রম আর কোথায় মর্যাদা!
হাঁটতে-হাঁটতে নিজের পাড়ায় পৌঁছে গেল জিশান।
ভাঙাচোরা গলিপথের ওপরে দুপাশ থেকে ঝুঁকে রয়েছে জরাজীর্ণ একতলা সব বাড়ির কাঠামো। বাড়িগুলোর সর্বত্র জোড়াতালি দেওয়া। কালচে দেওয়াল। ফাটল ধরা দরজা-জানলা। দেখেই বোঝা যায়, এখানে যে-মহামারী রোগ ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম অভাব।
গলিতে টিমটিম করে কয়েকটা বালব জ্বলছিল। সামনের একটা টিনের চালের আড়ালে প্যাঁচা বাসা বেঁধেছে। মাঝে-মাঝে রাতবিরেতে ওটা ডেকে ওঠে। মিনি বলে, প্যাঁচাটা খুব জাগ্রত—বিপদের গন্ধ পেলেই ডাক ছেড়ে গলির সবাইকে হুঁশিয়ার করে দেয়।
জিশান আর মিনি গলিতে পা রাখামাত্রই প্যাঁচাটা দুবার ডেকে উঠল।
মিনি কেঁপে উঠল। চকিতে তাকাল প্যাঁচাটার আস্তানার দিকে। অন্ধকারের ভেতরে সাদাটে পাখিটার নড়াচড়া অস্পষ্টভাবে দেখতে পেল ও।
জিশান এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না। তাই মিনির মুখের চেহারা দেখে মজা করে হাসল।
ঠিক তখনই জিশান খেয়াল করল, আশেপাশের বাড়ির জানলা-দরজা ফাঁক করে কয়েকটা মুখ জিশানদের কৌতূহলে দেখছে।
কিন্তু কেন? ওরা তো জিশানদের প্রতিবেশী! রোজই দেখতে পায় জিশানদের। তা হলে আজ এত উঁকিঝুঁকি মারা কেন?
সেটা বোঝা গেল বাড়িতে ঢোকার পর।
ঘরে ঢুকতে গিয়ে জিশান দ্যাখে, ওদের ঘরে চারজন লোক এদিক-ওদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে নীল দস্তানা এবং নীল রঙের অটোমেটিক পিস্তল।
•
চারজনের মধ্যে তিনজন কালো রঙের য়ুনিফর্ম পরে রয়েছে। পোশাকে সোনালি বিডের লাইনিং। বুকে লাগানো সোনালি হলোগ্রাম ব্যাজ থেকে আলো ঝলসে বেরোচ্ছে। তার মধ্যে সুন্দর হরফে লেখা ‘পি.এফ.’—পিস ফোর্সের প্রথম দুটো অক্ষর। ওদের মুখগুলো মরা মানুষের মুখের মতো—অভিব্যক্তিহীন।
ওদের তিনজনের চোখই জিশানের দিকে। চোখের পাতা পড়ছে না।
চতুর্থজনের পোশাক ধবধবে সাদা। তাতে ঝকঝকে সোনালি বোতাম আঁটা। বুকপকেটের ওপরে জ্বলজ্বলে নীল হলোগ্রাম।
লোকটা সামান্য হেসে জিশানের দিকে দু-পা এগিয়ে এল। পিস্তলের নলটায় এমনভাবে আঙুল বোলাতে লাগল যেন পোষা কুকুরের গলায় সুড়সুড়ি দিয়ে আদর করছে।
‘গুড ইভনিং, মিস্টার পালচৌধুরী, এভাবে হানা দিয়ে আপনাকে আচমকা চমকে দেওয়ার জন্যে মাপ চাইছি। আর একইসঙ্গে সাফ জানাই, আমরা পিস ফোর্সের কাট-পিস। প্র্যাকটিক্যালি ফোর্স করে আমাদের চার পিসকে এখানে পাঠানো হয়েছে—সিন্ডিকেটের ইন্ডিকেশানে। আমার নাম শ্রীধর পাট্টা। নিউ সিটির পিস ফোর্সের ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল। বোঝেনই তো হালচাল!’
শ্রীধর পাট্টা কথা বলছিলেন চিবিয়ে-চিবিয়ে, আর একইসঙ্গে হাসছিলেন। ওঁর ফরসা মুখে অনেক ভাঁজ। সূচিতীক্ষ্ণ ভুরুর রেখা—দেখে মনে হয় প্লাক করা। ঠোঁটজোড়া টুকটুকে লাল এবং ঝকমক করছে। নিশ্চয়ই ফ্লুওরেসেন্ট লিপস্টিক লাগিয়ে এসেছেন।
শ্রীধর কথা বলছিলেন মেয়েলি টানে সুর করে। ওঁর দাড়ি-গোঁফ কামানো মসৃণ লম্বাটে মুখ আর লম্বা-লম্বা চুল মেয়েলি ভাবটাকে আরও জোরালো করেছে।
‘আমরা আপনাকে রিফর্ম করতে এসেছি, জিশান—তাই আপনাকে একটা ফর্ম ফিল-আপ করতে হবে। ভে-রি সিম্পল…আপনার ওয়াইফের গালে তো হেভি নাইস ডিম্পল! কমপ্লিমেন্টস, ম্যাডাম—’ মিনির দিকে ফিরে বললেন শ্রীধর, ‘তা আপনার ছানাটি তো বেশ!…বেশ ঘুম-ঘুম ছানা। বদন চাঁদপানা। কী নাইস ঘুমিয়ে রয়েছে!’
জিশান আর মিনি হতবাক হয়ে শ্রীধরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। জিশানের মাথার ভেতরে বনবন করে একটা মেরি-গো-রাউন্ড ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল। পিস ফোর্সের লোকজন কেন ওর বাড়িতে এসেছে সেটাই বুঝতে পারছিল না জিশান। তা ছাড়া মার্শাল, শ্রীধর পাট্টা, ঠিক কী যে বলতে চাইছেন তাও মাথায় ঢুকছিল না।
ঘুমন্ত শানুর মাথায় হাত ছোঁয়ালেন শ্রীধর, বললেন, ‘বে-বি! ছুইট বেবি। মিনিদেবী, আপনার পারমিশান নিয়ে আমি কি ওকে কোলে নিতে পারি?’
মিনি শ্বাস টানল শব্দ করে। শ্রীধরের ছোঁয়া থেকে এক ঝটকায় শানুকে সরিয়ে নিতে চাইল।
হেসে ফেললেন শ্রীধর। একঝাঁক কাচের চুড়ি এ ওর গায়ে ঢলে পড়লে যেমন রিনরিনে শব্দ হয়, অনেকটা সেইরকম শোনাল ওঁর হাসিটা। মিনির গালে দস্তানা পরা আঙুলের আলতো টোকা দিয়ে বললেন, ‘ও মা গো! মা ভয় পেয়েছে গো! ও. কে.—দেন য়ু গো, গো। য়ু গো টু নেক্সট রুম! আমরা আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আলাদা কথা বলতে চাই—।’
মিনিকে ইশারা করে পাশের ঘরে যেতে বললেন শ্রীধর। পকেট থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে তা থেকে দু-ফোঁটা তরল হাঁ করে মুখে ঢাললেন। জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে স্বাদ নিয়ে ‘চকাস! চকাস!’ শব্দ করলেন দুবার। তারপর পলকে চাঙ্গা হয়ে উঠলেন।
জিশান আন্দাজ করল, ওই শিশিতে নেশা-ধরানো কোনও জিনিস রয়েছে। নিউ সিটিতে এরকম নতুন-নতুন বহু মাদক পাওয়া যায়।
মিনি জিশানের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘আমি তোমার কাছে থাকব।’
জিশান ইশারায় ওকে শান্ত হতে বলল।
হঠাৎই মাথা ঝাঁকালেন শ্রীধর। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটের কয়েকটা কাগজ বের করলেন।
কাগজগুলো দোমড়ানো মোচড়ানো। পাতা উলটে-উলটে সেগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন তিনি। আর মুখে ‘উঁ-উঁ’ শব্দ করতে লাগলেন।
অবশেষে একসময় শ্রীধর পাট্টা হেসে উঠে বললেন, ‘গট ইট। আইটেম ভেরি হট। পড়ে ফেলি চটপট।’
একটা পৃষ্ঠা মুখের কাছে নিয়ে তিনি পড়তে শুরু করলেন।
‘জিশান পালচৌধুরী। বয়েস আটাশ। ওল্ড সিটি। সিটিজেনশিপ নাম্বার কে বাই এইচ 21034। ওয়াইফ মিনি। একমাত্র ছেলে অর্কনিশান—ডাকনাম শানু। চার্জ : উইলফুল মার্ডার অ্যান্ড ইল্লিগ্যাল গ্যাম্বলিং।’
থামলেন শ্রীধর। কালো য়ুনিফর্ম পরা তিনজনের একজনকে সদর দরজাটা দেখিয়ে চোখের ইশারা করলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে মরা মানুষটা রোবটের মতো এগিয়ে গেল ঘরের দরজার দিকে। রীতিমতো শব্দ করে দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিল।
‘এইবার আমরা স্পষ্টভাবে কথা বলতে পারি। বাইরের কেউ আর আমাদের কথা শুনতে পাবে না—’ শ্রীধর ঘরের চারপাশে চোখ বোলালেন, বললেন, ‘আসুন, শ্রীপালচৌধুরী, বসে পড়া যাক এখানে-ওখানে। এখানে বসেই কাজের কথা হোক। আর শ্রীমতী পালচৌধুরী—’ মিনির দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে বললেন শ্রীধর পাট্টা, ‘আপনি স্বামীর কাছে থাকুন, তবে ছানাটাকে রেখে আসুন। নইলে কখন লোহার সঙ্গে খোকার ঠোকাঠুকি লেগে যায়…’ হাতের পিস্তলটা নাচিয়ে দেখালেন : ‘…কে বলতে পারে!’
ঘরটার অবস্থা নোংরা, ছন্নছাড়া। এলোমেলো দড়িতে উলটোপালটা জামাকাপড় ঝুলছে। দেওয়ালের তাকে পুরোনো বইপত্র, অচল ঘড়ি, গায়ে মাখার সাবান আর প্লাস্টিকের খেলনা।
একটা ভাঙা টুল নিয়ে বসে পড়লেন শ্রীধর—পায়ের ওপরে পা তুলে মডেলদের ভঙ্গিতে বসলেন।
জিশান মেঝেতে বসে পড়ল।
মিনি শানুকে পাশের ঘরে রেখে ফিরে এল—বসল জিশানের পাশে।
প্যাঁচাটা তা হলে এমনি-এমনি ডাকেনি! ভাবল মিনি।
জিশান স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা তিনটে মৃতদেহের দিকে একপলক তাকাল। তারপর শুকনো ঠোঁটের ওপরে জিভ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, স-স-স্যার!’
কম্পিউটার প্রিন্ট-আউটগুলো পকেটে ঢুকিয়ে হাসলেন শ্রীধর, বললেন, ‘কোনও চিন্তা নেই—আমি সুন্দর করে বুঝিয়ে দিচ্ছি। এত সুন্দর যে, আপনার বউয়ের চেয়েও সুন্দর—ঠিক আছে? গত শনিবার রাতে মানিকতলার খালধারে আপনি ইল্লিগ্যাল একটা ফাইট গেমে নাম দিয়ে গ্যাম্বল করেছেন—বে-আইনিভাবে জুয়া খেলেছেন। সেই সময়ে কার্তিক তপাদার নামে ওল্ড সিটির একজন সিটিজেনকে—সিটিজেনশিপ নাম্বার এল বাই ডি-76618—আপনি ইচ্ছে করে খুন করেছেন। উইলফুল মার্ডার।’
‘মিথ্যে কথা! আমি জুয়া খেলিনি!’
‘তাই?’ কপট বিস্ময়ে চোখ বড়-বড় করলেন শ্রীধর পাট্টা, ন্যাকা ঢঙে বললেন, ‘আমার নক্ষী ছোনা চাঁদের কণা! আমার ছোনা কি-চ্ছু করেনি! ন-এ ন্যাকা, আর ব-এ বোকা! শুনুন—’ শ্রীধরের কথা বলার ঢং হঠাৎই বদলে গেল। রঙ্গপ্রিয় মেয়েলি ভাব উধাও হয়ে তিনি পুরোপুরি মার্শাল হয়ে গেলেন: ‘শুনুন, পালচৌধুরী! আমাদের কাছে অনেক উইটনেস আছে। স্যাটেলাইট ডেটাও আছে। সেইসঙ্গে ডিজিটাল ফটোগ্রাফ। জুয়া আপনি খেলেছেন আর খুনও করেছেন—হ্যাঁ, হ্যাঁ, হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আমাদের সিন্ডিকেটকে নিগেট করে কখনও কিছু করা যায় না। আমাদের লক্ষ-লক্ষ চোখ।’
জিশান অবাক হয়ে ভাবছিল।
খালধারের ওই ফাইট গেম ইল্লিগ্যাল! তা হলে সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেমগুলো? সেগুলো সব লিগ্যাল!
‘স্নেকস অ্যান্ড জেমস’, ‘মাই লাইফ উইথ আ টাইগার’, ‘ম্যানিম্যাল রেস’, কিংবা ‘হাংরি ডলফিন’ গেম-এ কেউ যদি মারা যায় তা হলে সেটা উইলফুল মার্ডার নয়?
আর ‘কিল গেম’? সেই খেলায় তো আজ পর্যন্ত বহু মানুষই মারা গেছে—ওল্ড সিটির সব মানুষ। তার বেলা?
মালিকের কথা মনে পড়ল জিশানের। কুচকুচে কালো, ঝকঝকে দাঁত, দিলখোলা হাসি, মিষ্টি মুখ।
ওর মৃত্যুটা তা হলে কী? ওটা উইলফুল মার্ডার নয়?
মিনির কান্নায় ঘোর কাটল জিশানের। মিনি হাতের পিঠ কামড়ে গুঙিয়ে কাঁদছে।
এখন তা হলে কী হবে? দিশেহারা পাগল হয়ে গেল জিশান। ওর ভেতরে একটা জংলি চিতা খেপে উঠল।
তখন শ্রীধর পাট্টা ধীরে-ধীরে বলছেন, ‘এবার তা হলে আমরা পানিশমেন্টের কথায় আসি, মিস্টার পালচৌধুরী—।’
জিশান পাগলের মতো একলাফে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীধরের ওপরে এবং শ্রীধর কাত হয়ে টুল থেকে পড়ে যেতে-যেতে গুলি চালালেন।
প্রচণ্ড শব্দে ছোট্ট ঘর থরথর করে কেঁপে উঠল। গুলিটা গিয়ে লাগল দেওয়ালে ঝোলানো একটা বাঁধানো ছবিতে। ভাঙা কাচের টুকরো ফুলঝুরির মতো চারিদিকে ছিটকে গেল।
জিশান ভয় পেয়ে শ্রীধরকে ছেড়ে একপাশে লাফিয়ে পড়ল।
তিনজন গানম্যান পলকে পিস্তল উঁচিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা জিশানকে টিপ করে ফ্রিজ শট হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। শ্রীধর না বললে ওদের গুলি চালানোর হুকুম নেই।
শ্রীধর পাট্টা মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ডানহাতের পিস্তলটা জিশানের দিকে তাক করে হাসলেন : ‘আপনি কি বাবু বুঝতে পেরেছেন যে, গুলিটা আমার মিস হয়নি—ইচ্ছে করে মিসফায়ার করেছি?’ বাঁ-হাতে পোশাক ঝাড়তে লাগলেন শ্রীধর। তারপর ধীরে-ধীরে চুইংগাম চিবোনোর ঢঙে বললেন, ‘তার কারণ, আপনাকে নিয়ে আমার অন্য প্ল্যান আছে, জিশান—মিস করেছি সেইজন্যে…।’
সঙ্গে-সঙ্গে মিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল। তারপর জিশানকে জাপটে ধরে ভয় পেয়ে কোণঠাসা আহত পশুর মতো হেঁচকি তুলে কাঁদছে।
‘…তা নইলে খুলি আর মাটির ভাঁড় আমার কাছে একই—ওদের জন্মই হয়েছে চৌচির হওয়ার জন্যে।’ হাসলেন শ্রীধর। পিস্তলটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে হাতুড়ি পেটার ঢঙে সবেগে বসিয়ে দিলেন জিশানের পাঁজরে।
জিশান কঁকিয়ে উঠল। যন্ত্রণায় ওর শরীরটা কুঁকড়ে গেল।
মিনি ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীধরের পায়ে। উপুড় হয়ে পায়ে মাথা ঘষতে-ঘষতে বলল, ‘প্লিজ, ওকে ছেড়ে দিন। ও ইচ্ছে করে কাউকে খুন করেনি। ইচ্ছে করে কাউকে খুন করেনি…।’
‘জানি তো, মা-মণি। শুধু-শুধু এমনধারা করছ কেন বলো তো? মরছ কেন মাথা খুঁড়ে আমার পায়ের পাতায়?’ গায়ে জ্বালা ধরানো ন্যাকা মেয়েলি ভঙ্গিতে বললেন শ্রীধর পাট্টা। ঝুঁকে পড়ে মিনিকে ধরে তুললেন মেঝে থেকে। দস্তানা পরা আঙুলের ডগা দিয়ে বেশ সময় নিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।
জিশান শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দেখল দৃশ্যটা। ও ভাঙা গলায় চিৎকার করে উঠল, ‘স্টপ ইট! স্টপ ইট য়ু…।’
‘স্টপ ইট য়ু কী? বাস্টার্ড? নাকি বাংলায় তালব্য শ দিয়ে খুব কমন একটা যে গালাগাল আছে, সেটা দিতে যাচ্ছিলেন?’ কোমরে হাত রেখে তেরছা চোখে তাকালেন শ্রীধর পাট্টা : ‘আমি তো আপনার বউকে ছুঁইনি, বাবু। আপনার বউয়ের চামড়া আর আমার চামড়ার মাঝে দস্তানার কাপড়ের লেয়ার রয়েছে না! ন্যাকাবোকা! কিচ্ছু বোঝে না মাইরি!’
মিনিকে আলতো করে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে শ্রীধর বললেন, ‘জিশান পালচৌধুরী, শোনো। তোমাকে নিয়ে আমার প্ল্যানটা এবারে বলি। তোমার এগেইনস্টে যা চার্জ তাতে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট দেওয়া ছাড়া সিন্ডিকেটের কাছে আর কোনও পথ খোলা নেই। তবে তোমাকে বাঁচার একটা সুযোগ দেওয়া যায়…।’
থামলেন শ্রীধর পাট্টা।
আশায় মিনির চোখ চকচক করে উঠল। জিশানেরও।
‘…তোমাকে ”কিল গেম”-এ নাম দিতে হবে।’
শ্রীধরের শেষ কথাটা যেন বরফের ছুরি হয়ে কেটে বসল জিশানের মগজে।
আর মিনি পাথর হয়ে গেল।
শ্রীধর পাট্টা চুপচাপ চোয়াল শক্ত করে বসে রইলেন। তারপর শব্দ করে থুতু ফেললেন ঘরের মেঝেতে। ভুরু উঁচিয়ে বললেন, ‘ঘরটা যা নোংরা! এখানে ইজিলি থুতু ফেলা যায়, কী বলো?’
শেষ প্রশ্নটা জিশানকে লক্ষ করে। কিন্তু জিশান কোনও জবাব দিতে পারল না। কারণ, ও তখনও ‘কিল গেম’ নিয়ে ভাবছে।
‘কিল গেম’ খেলাটা গড়ে দু-মাসে একবার করে হয়। কারণ, সবসময় খেলোয়াড় পাওয়া যায় না। তা ছাড়া ওই খেলায় শুধু খেলোয়াড় পেলেই হল না, তার শারীরিক এবং মানসিক শক্তি পরীক্ষা করে দেখা হয়। নানারকম ডাক্তারি ও অন্যান্য পরীক্ষার পর যদি সে পরীক্ষায় পাশ করে, তবেই তাকে ‘কিল গেম’-এ নামার সুযোগ দেওয়া হয়।
খেলায় নামার আগে খেলোয়াড়কে বন্ড সই করতে হয়—যেমন করতে হয় অপারেশানের আগে। সেই বন্ডে লেখা থাকে : ‘ ”কিল গেম”-এ মৃত্যু হলে কিংবা অঙ্গহানি হলে সুপারগেমস কর্পোরেশন দায়ী নয়।’
এ ছাড়া খেলোয়াড়কে এক কোটি টাকার ইনশিয়োরেন্স করিয়ে দেয় নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স কোম্পানি। খেলায় ক্যান্ডিডেটের ভালো-মন্দ কিছু হলে তার ফ্যামিলি ওই এক কোটি টাকা পায়।
‘কিল গেম’ খেলাটা হয় নিউ সিটির একটা নকল শহর ‘গেম সিটি’-তে। শহরটার মাপ কুড়ি কিলোমিটার বাই কুড়ি কিলোমিটার। সেই শহরে রাত বলে কিছু নেই—সবসময়েই পড়ন্ত বিকেলের আলো চারশো বর্গকিলোমিটারের গেম সিটি-তে ছড়িয়ে আছে। সেই অদ্ভুত গোধূলি আলোয় গেম সিটি জেগে ওঠে চব্বিশ ঘণ্টার জন্য।
কী নেই সেই গেম সিটি-তে! পাহাড় আছে, ঝরনা আছে, জঙ্গল আছে, নকল নদী আছে, আছে বাড়ি-ঘর, যানবাহন, দোকানপাট। একটা আধুনিক শহরে যা-যা থাকে তার সবই আছে। শুধু নেই কোনও মানুষ।
‘কিল গেম’-এ কোনও খেলোয়াড় ‘স্বেচ্ছায়’ নাম দিলে তখন চব্বিশ ঘণ্টার জন্য শহরটা লোকজনে টগবগ করে। যেমন, জিশান এখন ‘স্বেচ্ছায়’ নাম দিতে বাধ্য হচ্ছে।
‘কিল গেম’ খেলাটার লম্বা প্রাোমো টিভিতে বহুবার দেখেছে জিশান। প্রায় একঘণ্টা ধরে দেখানো হয় সেই প্রাোমো।
যেদিন চব্বিশ ঘণ্টার খেলাটা শুরু হয় তার আগের দিন থেকেই গেম সিটি-কে সাজিয়ে ফেলা হয়। বাড়ি-ঘরগুলো ‘বেড়াতে আসা’ টুরিস্ট ফ্যামিলিতে ভরে যায়। দোকানপাট ভরে যায় লোভনীয় খাবারদাবারে। সেসব দোকানে তদারকি করে একদিনের নকল দোকানদাররা। আর রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায় নানান গাড়ি। বহু গাড়ি এখানে-সেখানে দাঁড় করানো থাকে—যেন মনে হয়, গাড়িগুলো পার্ক করে মালিক বা ড্রাইভাররা এদিক-ওদিক কোথাও গেছে।
সব মিলিয়ে যে-ছবিটা তৈরি হয় সেটা আসল কোনও শহরের মতোই। তবে সমুদ্র নেই এই যা!
‘কিল গেম’ খেলার সময় গেম সিটি-তে যারাই থাকে তারা সবাই ‘টুরিস্ট’ হলেও ‘কিল গেম’-এর পার্টিসিপ্যান্ট। খেলার আগের দিন তারা সবাই এসে খালি হাতে গেম সিটি-তে ঢুকে পড়লেই হল। বাকি সব ব্যবস্থার দায়িত্ব সুপারগেমস কর্পোরেশনের। ফলে পার্টিসিপ্যান্টদের জন্য সব ফ্রি। যেমন খাবারের দোকানে খেতে গেলে পয়সা লাগবে না, তেমনই গাড়ি চড়ে ঘোরা যাবে বিনাপয়সায়। অর্থাৎ, থাকা-খাওয়া-বেড়ানোর কোনও খরচ নেই।
অথচ পুরস্কার পাওয়ার সুযোগ আছে।
আর সবচেয়ে বড় পুরস্কার রয়েছে চারজনের জন্য।
তার মধ্যে আবার সেরা পুরস্কারের দাবিদার হবে জিশান। বাকি তিনজন পাবে সমান অঙ্কের দ্বিতীয় পুরস্কার।
কিন্ত খেলাটা কী?
খুবই সহজ-সরল। খেলার দিন খেলার হিরোকে ভোর ছ’টায় ঢুকিয়ে দেওয়া হবে গেম সিটি-তে। আর তার দু-ঘণ্টা পর হিরোকে ‘শিকার’ করতে তিনজন কিলার বেরিয়ে পড়বে। তারপর চলবে শিকার-শিকারি খেলা। বাইশ ঘণ্টা ধরে হিংস্র লুকোচুরি। যদি নায়ক খেলার শেষে বেঁচে থাকে, তবেই পাবে একশো কোটি টাকা। আর যদি…।
না:, আর ভাবতে চাইল না জিশান। ও ব্যথাতুর চোখে মিনির দিকে তাকাল। মিনির চোখে নজর পড়তেই জিশানের বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। এত মায়া ওই রোগা মেয়েটার দু-চোখে! শেষ দেখার সময় লোকে বোধহয় এভাবেই তাকায়।
শ্রীধর পাট্টা ছোট্ট করে হাততালির শব্দ করলেন, গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘বলো, বাবু, কী করবে? ধারা তিনশো দুই—না কিল গেম? অবশ্য অল দ্য সেম—শুধু ”কিল গেম”-এ বাঁচার সামথিং সম্ভাবনা আছে এই যা।’
জিশান উঠে বসল মেঝে থেকে। ওর মাথা ঝিমঝিম করছিল। সবকিছু কেমন ঝাপসা হয়ে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।
ও সবকিছু ঠিকঠাক দেখতে পাচ্ছে তো? শুনতে পাচ্ছে তো ঠিকঠাক?
ওই তো মিনি! ওর পাতলা ঠোঁট কাঁপছে। চোখের কোলে জলের ফোঁটা।
জিশান এবার উঠে দাঁড়াল। কালো পোশাক পরা তিন প্রহরীর দিকে একবার তাকাল। ওরা পিস্তল নাড়িয়ে জিশানকে সতর্ক করে দিল।
জিশান সেসব ভ্রূক্ষেপ না করে শ্রীধর পাট্টার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় জিগ্যেস করল, ‘এ ছাড়া আর কোনও পথ নেই?’
‘না গো, নেই। এই খেলাটায় কী আর মেলা পাবলিক পাওয়া যায়! কোটিতে গুটি-গুটি। তাই তিনশো দুই, নয় তো ”কিল গেম”।’
‘কখন যেতে হবে আমাকে?’
‘আমরা তোমাকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে এসেছি, জিশান। এখান থেকে শুটারে চড়ে আমরা সোজা চলে যাব সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারে। সেখানে কতকগুলো ফরমালিটি সেরে তারপর সোজা সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেমস বিল্ডিং। তারপর…।’
‘তারপর?’ প্রশ্নটা করে মনে-মনে নিজের ভবিষ্যতের ছবিটা আঁকতে চেষ্টা করল জিশান।
হাসলেন শ্রীধর। পিস্তলটা নাচাতে-নাচাতে বললেন, ‘তারপর শুরু হবে প্রিলিমিনারি গেমস। এই গেমগুলো বলতে গেলে ”কিল গেম”-এর ট্রেনিং। এই ট্রেনিং চলবে দু-মাস। তারপর স্পেশাল ট্রেনিং। এই ট্রেনিং-এর পর তুমি রেডি হলে গেমের ডেট অ্যানাউন্স করা হবে। প্লেট টিভিতে খবর পৌঁছে যাবে সব জায়গায়—ওল্ড সিটিতে, নিউ সিটিতে…।’
মিনি আর থাকতে পারল না। হিংস্রভাবে চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীধরের ওপরে।
শ্রীধর পলকে বাঁ-হাতটা বাড়িয়ে লোহার আঙুলে মিনির টুঁটি টিপে ধরলেন।
‘আঁক’ শব্দ করে মিনির চিৎকার বন্ধ হয়ে গেল মাঝপথে। ওর চোখ দুটো কোটর ছেড়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল। ও হাঁ করে এক আঁজলা বাতাস টানার জন্য আইঢাই করতে লাগল।
জিশান লাফিয়ে পড়ল শ্রীধরের বাঁ-হাতের ওপরে। হাতটা আঁকড়ে ধরে প্রাণপণে ছাড়াতে চাইল। কিন্তু পারল না।
তার কারণ, জিশান হাতটা ধরে টানাটানি শুরু করতেই শ্রীধর ওঁর ডানহাতে ধরা পিস্তলটা প্রচণ্ড জোরে জিশানের কাঁধে বসিয়ে দিয়েছেন। আর জিশান সঙ্গে-সঙ্গে কাঁধ চেপে ধরে বসে পড়েছে মেঝেতে।
এক ধাক্কায় মিনিকে ছিটকে ফেলে দিলেন শ্রীধর। মেয়েটা ঘরের কোণে রাখা একটা ঝুড়ির ওপরে গিয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে শ্রীধর সঙ্গীদের ইশারা করলেন। ওরা তিনজন জিশানকে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে চেপে ধরল। তারপর টানতে-টানতে নিয়ে চলল ঘরের বাইরে।
চলে যাওয়ার আগে শ্রীধর মিনিকে লক্ষ করে বললেন, ‘চলি, শ্রীমতী পালচৌধুরী। ভয় নেই…আপনার সঙ্গে আমাদের রেগুলার যোগাযোগ থাকবে। আমরা আপনাকে একটা ভিডিয়ো-মোবাইল সেট দিয়ে যাব। সেটা আমাদের স্পেশাল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডে কাজ করে। ওটা দিয়ে আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে কনস্ট্যান্ট কানেকশান রাখতে পারবেন।’
মিনি তখন ঘরের কোণে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। ফ্যালফ্যালে চোখে তাকিয়ে আছে শ্রীধরের দিকে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে না, ওঁর কথার একটি বর্ণও মিনির মাথায় ঢুকেছে।
প্রহরী তিনজন চৌকাঠের বাইরে এসে শ্রীধর পাট্টার জন্য দাঁড়িয়ে পড়েছিল। কয়েক লহমা অপেক্ষা করছিল। তখন জিশান ঘুরে তাকাল ঘরের দিকে। দেওয়ালে টাঙানো বাবার ফটোর ওপরে চোখ পড়ল ওর।
বাবা তাকিয়ে আছে জিশানের দিকে। স্থির শান্ত চোখে এক অলৌকিক আত্মবিশ্বাস।
জিশান শ্বাস টানল, মিনির নাম ধরে ডাকল দুবার।
শ্রীধর পাট্টা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। মিনিও ওঁর পিছন-পিছন ছুটে বেরিয়ে এল বাইরে।
মিনির দিকে না তাকিয়েই শ্রীধর মসৃণ নরম গলায় তখনও ওকে বলে চলেছেন, ‘টাকা-পয়সার জন্যে চিন্তা করবেন না, মা-মণি। অন্ন চিন্তাও করবেন না। ওসব ব্যবস্থা আমরা করব—যদি অবশ্য ”কিল গেম”-এ নাম দেয় আপনার হাজব্যান্ড। আন্ডারস্ট্যান্ড? আর যদি শ্রীপালচৌধুরী খেলায় জিতে যান, তা হলে একশো কোটি টাকা আপনাদের। তখন এই নোংরা জঘন্য মস্তিহীন বস্তিতে আপনাদের আর থাকতে হবে না। সুতরাং আপনাদের জন্যে ব্রাইট ফিউচার ওয়েট করছে। যদিও তাতে স্লাইট রিসক আছে।’
ওঁরা বস্তির গলিপথ ধরে হেঁটে রওনা দিলেন।
মলিন আলো-আঁধারি গলিতে দুপাশে ছায়া-ছায়া মুখ দেখতে পাচ্ছিল জিশান। পাড়াপড়শিদের কৌতূহলী ভিড়।
ছ’জনের মিছিলটা ধীরে-ধীরে বেরিয়ে এল গলির বাইরে। পিছনে উৎসাহী জনতার দল।
প্যাঁচর ডাক শুনতে পেল জিশান। শুনতে পেল মিনিও। ভয়ে ওর বুকটা দুরুদুরু করে উঠল।
কিন্তু জিশান প্যাঁচার ডাকটাকে পাত্তা দিল না। বরং ভাবল, যদি এই ডাকটা অশুভ হয়, তা হলে সেটা শ্রীধরের জন্যও হতে পারে।
গলি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকে অনেকটা ঘুরে আর-একটা রাস্তায় এল ওরা। রাস্তার একপাশে আবর্জনার স্তূপ। সেখানে নেড়ি কুকুরের ভিড়।
তারই আড়ালে দাঁড়িয়েছিল তিনটে শুটার। নীল-সাদা ডোরাকাটা লম্বাটে চেহারা। হুড খোলা। সামনে লাগানো টার্বো-প্রপ।
ওরা সবাই শুটারের দিকে এগোল। খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে পাড়াপড়শির ঝাঁকও সঙ্গে-সঙ্গে এগোল।
মিনি জিশানের হাত আঁকড়ে ধরল। কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘আমি আর শানু সবসময় তোমার কথা ভাবব।’
‘আমিও তোমাদের কথা ভাবব। এ ছাড়া এই জীবনে ভাবার মতো আর কী আছে! তুমি বাড়ি যাও…শানু একা রয়েছে…।’ কথা শেষ করতে গিয়ে জিশানের গলা ভেঙেচুরে গেল। ওর ভেতরটাও।
মিনি ঠোঁট টিপে কান্না আটকাতে চাইল। মাথা নাড়তে লাগল বারবার। যেন বলতে চাইল : ‘যেয়ো না! তুমি যেয়ো না…।’
জিশান ভেতরের কষ্ট আর সইতে পারছিল না। এভাবেই তা হলে ‘কিল গেম’-এর খেলোয়াড় জোটায় সুপারগেমস কর্পোরেশন! দু-মাস কি আড়াইমাস আগে ‘কিল গেম’-এর যে-লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছিল তাতে ছেলেটা ষোলো ঘণ্টার পর মারা গিয়েছিল। ওর ফ্যামিলি বলতে কিছু ছিল কি না জিশান জানে না।
কিন্তু জিশানের?
জিশান শুধু ফ্যামিলি নয়, ওর প্রাণটাও রেখে যাচ্ছে এই বস্তিতে। আর ওর দেহটা যাচ্ছে ‘কিল গেম’-এ লড়তে। যদি প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্য ওর দেহটাকে ওই মরণখেলায় লড়তেই হয়, জিশান দেখিয়ে দেবে লড়াই কাকে বলে। চব্বিশ ঘণ্টা নয়, পুরোপুরি তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিটই ও লড়বে। দরকার হলে তেইশ ঘণ্টা ঊনষাট মিনিট ষাট সেকেন্ড। শিকার আর শিকারির খেলায় ও হাড়ে-হাড়ে বুঝিয়ে দেবে কে শিকার, আর কে শিকারি।
জিশানের নজর ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল। চোখ মুছে নিয়ে ও তাকাল মিনির দিকে। ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি বাড়ি যাও—শানু একা রয়েছে—ভয় পাবে।’
জিশানকে ধাক্কা মেরে শুটারে তুলল মার্শালের দলবল।
তারপর তীব্র সিটি দিয়ে তিনটে শুটার ছুটতে শুরু করল। কয়েকটা বাড়ির ময়লা জানলার কাচ ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল। একটু পরেই শুটারগুলো ভেসে উঠল শূন্যে। মিনি আর জটলা করা মানুষজন ছোট হয়ে দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। একইসঙ্গে ওল্ড সিটিও।
আকাশে চোখ রাখল জিশান। কোথাও-কোথাও ছন্নছাড়া মেঘ থাকলেও চাঁদ এবং রঙিন ধূমকেতু দুটো চোখে পড়ছে। আরও নীচে…দূরে…বহু দূরে দেখা যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন আলোর বিন্দু…নেকলেসের মতো চিকচিক করছে। রাতের নিউ সিটি—যেখানে জিশান এখন যাচ্ছে।
মালিকের কথা মনে পড়ল জিশানের : ‘…কার্তিক সালাকে না উড়িয়ে তুই জল খাবি না। গড প্রমিস।’
সুপারগেমস কর্পোরেশনকে কি কার্তিক বলে ভাবা যায়? যদি যায়, তা হলে ওর ঊরুসন্ধিটা কোথায়? জিশান জানে, ‘কিল গেম’ খেলার নিয়ম হচ্ছে, ওই খেলায় কোনও নিয়ম নেই। বাঁচার জন্য তুমি যা খুশি করতে পারো।
ও চোয়াল শক্ত করে সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ষোলো বছর পর ও আবার নিউ সিটিতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। যদি খেলায় ও হেরে যায় তা হলে নিউ সিটিতে আর থাকতে পারবে না। ফিরতে পারবে না ওল্ড সিটিতেও।
ওকে চলে যেতে হবে ওপরে।
পাশে বসা শ্রীধর মুখ ফিরিয়ে তাকালেন জিশানের দিকে, হেসে জিগ্যেস করলেন, ‘কী বাবু, চুপচাপ কেন? ভয় করছে?’
জিশান সরাসরি তাকাল শ্রীধরের দিকে। ঠান্ডা পাথরের মতো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, ভয় করছে—তোমার জন্যে।’
অন্ধকার আকাশ চিরে তিনটে শুটার শিস দিয়ে উড়ে চলল।
জিশানের হঠাৎই মনে হল, ওরা শিস দিয়ে গান গাইছে। মৃত্যুর গান।
•
রাতটা জিশানের কাটল ওল্ড সিটিতেই—পিস ফোর্সের হেড-অফিসের গেস্টহাউসে।
শ্রীধর পাট্টা নিউ সিটিতে যেতে চাইলেও যাওয়া হয়নি।
শুটারের পাইলটকে সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারে উড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন শ্রীধর। কিন্তু পাইলট হঠাৎই সমস্যার কথা জানিয়েছে। একটি শুটারের ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে যাওয়ায় একটা টার্বোপ্রপ কাজ করছে না।
তখন শ্রীধর যে-ভাষায় পাইলটকে গালিগালাজ করলেন সেটা বোধহয় শুধু ওঁকেই মানায়। তারপর মোবাইল ফোন বের করলেন পকেট থেকে, চটপট হেডকোয়ার্টারে যোগাযোগ করলেন।
সাংকেতিক ভাষায় কথাবার্তা চলল কিছুক্ষণ। জিশান তার একবর্ণও বুঝতে পারল না।
অবশেষে ফোন ছেড়ে দিয়ে শ্রীধর তাকালেন জিশানের দিকে, হাসলেন: ‘জিশান, আজকের রাতটা আমাদের পিস ফোর্সের এখানকার গেস্টহাউসে থাকতে হচ্ছে। সেখানেই হবে তোমার রেস্ট। সেটাই বোধহয় বেস্ট। আর কাল থেকে শুরু হবে তোমার টেস্ট।’
টেস্ট! কীসের টেস্ট?
জিশান শুনেছে কিল গেম-এ নামার আগে বড় মাপের ট্রেনিং আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সেগুলো ঠিক কী ধরনের পরীক্ষা জিশান জানে না।
শ্রীধরের অন্ত্যমিল মন্তব্যগুলোর কোনও জবাব দিল না ও।
ততক্ষণে শুটারের নাক ঘুরিয়ে ওরা রওনা হয়ে গেছে ওল্ড সিটির পিস ফোর্সের হেডকোয়ার্টারের দিকে।
হেডকোয়ার্টারে নেমে সোজা গেস্টহাউসের ঘর।
এরকম আরাম জিশান শেষ কবে পেয়েছে মনে পড়ে না।
শোওয়ার জন্য গোটা একটা ঘর—তাও আবার মাপে বিশাল। চারপাশে ধপধপে সাদা দেওয়াল। রাজহাঁসের পালকের মতো বিছানা। শীতাতপের আরাম চারপাশে ভাসছে। খুব নিচু সুরে মনভোলানো বাঁশি বেজে চলেছে। বাতাসে একটা পাগল করা সুবাস।
সব মিলিয়ে মোলায়েম আরামে চোখ বুজে আসছিল জিশানের।
ওর চোখে-মুখে হতবাক ভাব দেখে শ্রীধর বলে উঠলেন, ‘সিন্ডিকেটের গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাসের গেস্টহাউসে তোমার জন্যে থাকার ব্যবস্থা অনেকটা এইরকম। তবে এর চেয়েও ভালো।’
এর চেয়েও ভালো হওয়া সম্ভব! অবাক হয়ে ভাবল জিশান।
রাতে বিছানায় গা ঢেলে দিয়ে স্বপ্নের দেশে তলিয়ে গেল ও। বুঝতে পারল, এইসব বিছানায় স্বপ্ন অনেক সহজে আসে।
স্বপ্নে মিনি আর শানুকে দেখতে পেল। সেই স্বপ্ন ভাঙল ভোরবেলায়—ঘুম ভাঙার সঙ্গে-সঙ্গে।
জিশান দেখল, শ্রীধর পাট্টা ওঁর টিপটপ পোশাক পরে জিশানের বিছানার সামনে হাজির। সঙ্গে কাঠখোদাই তিন প্রহরী।
ওকে নিয়ে ভোরের আকাশে ভেসে পড়ল তিনটে শুটার।
জিশান অবাক চোখে দূরের নিউ সিটির দিকে তাকিয়ে রইল। কতদিন পরে শহরটাকে ও দেখতে পাবে!
নিউ সিটিকে কখনও পাখির চোখে দেখেনি জিশান। শুটার থেকে এই প্রথম দেখল।
উঁচু-উঁচু আকাশছোঁয়া মিনার, আর তার ফাঁকে-ফাঁকে আয়তাকার সবুজ কিংবা নীল।
সবুজগুলো পার্ক, কিংবা চাষের খেত। অথবা পরিকল্পনা করে তৈরি করা বনাঞ্চল। নিউ সিটিতে অবহেলায় পড়ে থাকা কোনও সবুজ মাঠ নেই। সব সবুজকেই এখানে কাজে লাগানো হয়েছে।
আর নীলগুলো জল। কোনওটা সুইমিং পুল, কোনওটা আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের দিঘি।
মাঝে-মাঝে হালকা নীল যে-চৌকোনা রং দেখা যাচ্ছিল সেগুলো খেলার মাঠ। মাঠে সিনথেটিক টার্ফ লাগানো। এইসব মাঠে ছেলেবেলায় খেলেছে জিশান।
এ-কথা মনে পড়তেই ও ছেলেবেলায় ঢুকে পড়ল পলকে।
ফিটফাট হয়ে জিশান স্কুলে যাচ্ছে। এয়ারকন্ডিশনড স্কুল বাস। বাস চলার কোনও শব্দ নেই। ধোঁয়ার দূষণ নেই—কারণ, বাসগুলো সব ব্যাটারি পাওয়ারড ভেহিকল। ছবির মতো পথ ধরে জিশানদের বাস স্কুলের দিকে ছুটে চলেছে।
অ্যাস্ট্রো টার্ফের ওপরে খেলছে জিশান। বন্ধুদের নাম ধরে চিৎকার করছে। রবিন, টুকাই, নোনা, বুকি। ওরা সব এখন কোথায় কে জানে! জিশানের মতো ওল্ড সিটিতে নিশ্চয়ই চলে যায়নি—কিংবা যেতে বাধ্য হয়নি।
না:, ছেলেবেলাটা খারাপ ছিল না। এই ছেলেবেলার গল্প মিনিকে কতবার শুনিয়েছে জিশান। আক্ষেপ করে বলেছে, শানুর ছেলেবেলাটা এরকম সুন্দর করতে পারলে কত ভালো হত।
হঠাৎই আঙুল তুলে নীচের দিকে দেখালেন শ্রীধর পাট্টা। বললেন, ‘ওই যে, জিশানবাবু। ওটাই গেম সিটি। ওখানেই তুমি খেলবে কিটি-কিটি। বেড়াল আর নেংটি। হাইড অ্যান্ড সিক…হাইড অ্যান্ড সিক। পুরো চব্বিশ ঘণ্টা। তোমার লুকোচুরি খেলার লাইভ টেলিকাস্ট হবে…পাবলিক দেখবে। কী থ্রিলিং হবে মাইরি!’
শ্রীধর পাট্টার ন্যাকা সুরের কথা শুনতে-শুনতে জিশানের গা-রিরি করছিল। পাশে বসে থাকা লোকটার উত্তাপ টের পাচ্ছিল ও। লোকটা যে একইসঙ্গে হিংস্র এবং জঘন্য সেটা জিশান ক্রমশ বুঝতে পারছিল।
গেম সিটির দিকে তাকাল জিশান।
কুড়ি কিলোমিটার বাই কুড়ি কিলোমিটার মানুষ মারার কল। যেন এক বিশাল খাঁচায় বেড়ালের ইঁদুর ধরার খেলা। জিশান ইঁদুর। আর অজানা তিনজন শিকারি—তারা হল বেড়াল।
মিনি আর শানুর কথা মনে পড়ল জিশানের। ওরা এখন বাড়িতে একা। জিশান নেই। মিনির নিশ্চয়ই ভীষণ ফাঁকা লাগছে।
জিশান তাকাল শ্রীধরের দিকে।
নির্বিকার মুখে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। চোয়ালের রেখা শক্ত। লাল টুকটুকে ঠোঁটে একবার জিভ বুলিয়ে নিলেন।
‘আমার ওয়াইফের সঙ্গে একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে—।’ ঘষা গলায় আমতা-আমতা করে বলল জিশান।
শ্রীধর ওর দিকে তাকালেন। ঠোঁট ফাঁক না করে হাসলেন : ‘এর মধ্যেই উতলা? হায়, মা শীতলা! ধৈর্য—ধৈর্য। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সব অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যাবে। স্পেশাল ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডের মাইক্রোভিডিয়োফোন পৌঁছে যাবে তোমার ওয়াইফ মিনির—তাই তো নামটা?—কাছে। তোমার কাছে থাকবে আইডেন্টিক্যাল আর-একটা হ্যান্ডসেট। তখন দশমিনিট ধরে যত প্রাণ চায় কথা বোলো—ফ্রি টকটাইম—কিল গেম পর্যন্ত। তারপর তো…’ মুখে ‘ফুস-স’ শব্দ করে আঙুল তুলে আকাশের দিকে দেখালেন শ্রীধর।
এই ইশারার অর্থ বুঝতে জিশানের অসুবিধে হল না। ও চুপ করে গেল। মাইক্রোভিডিয়োফোনটা হাতে পাওয়ার জন্য এখন থেকেই অপেক্ষা করতে শুরু করল।
মাথার ওপরে নীল আকাশ আর সোনালি রোদ। সূর্যের দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ধূমকেতু দুটোর রং এখন বোঝা যাচ্ছে না। সূর্যের আলোয় হারিয়ে গেছে। ঝকঝকে রোদে নীচের নিউ সিটিকে গ্রাফিক আর্ট বলে মনে হচ্ছে। তারই মাঝে ঝিকিয়ে উঠছে বেতার সংযোগের বল অ্যানটেনাগুলো।
শুটার তিনটে স্ক্রুর প্যাঁচের মতো অদ্ভুতভাবে পাক খেয়ে নেমে এল অনেকটা নীচে। সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারটা দেখতে পেল জিশান।
বিশাল মাপের আকাশে-চুমু-খাওয়া বিল্ডিং। বিল্ডিংটার চারদিকেই রুপোর মতো ঝকঝকে পাত লাগানো। জানলা বলে কিছু চোখে পড়ছে না। বিল্ডিং-এর মাথার কাছটায় ধাতুর হরফে বড়-বড় করে লেখা :
The Syndicate HQ
আর লেখাটার নীচে সিন্ডিকেটের লোগো। লোগোটা গ্রাফিক ঢঙে আঁকা একটা ‘S’।
মিনিটখানেক যেতে-না-যেতেই শুটারগুলো শিস দিয়ে নেমে পড়ল সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর মসৃণ ছাদে।
শ্রীধর মোবাইল ফোন বের করে কার সঙ্গে যেন চাপা গলায় কথা বললেন। তারপর জিশানকে বললেন, ‘কাম অন, বয়। আমরা এসে গেছি—।
‘বয়’ সম্বোধনটা জিশানের ভালো লাগল না। ও বিরক্তভাবে শ্রীধরের দিকে তাকাল শুধু।
শ্রীধর ঠোঁট বেঁকিয়ে তেরছা হাসলেন। জিশানের থুতনিতে কড়ে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন, ‘হরিদাসের দেখছি রাগ হয়েছে! এখনই এত রাগ করে না, সোনা। রাগ করার মতো এখনও প্রচুর ব্যাপার বাকি। রাগ করতে-করতে তুমি টায়ার্ড হয়ে যাবে। তখন তোমার সব রাগ ওয়াটার হয়ে যাবে—ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া।’
কথাটা শেষ করেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন শ্রীধর। শুটারের একটা অংশে বাঁ-হাতের ভর দিয়ে অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় শূন্যে লাফ দিয়ে শুটারের বাইরে নেমে পড়লেন।
দাঁতে দাঁত চেপে রইল জিশান। ধীরে-ধীরে নেমে এল শুটার থেকে।
বাকি তিনজন প্রহরীও নেমে পড়েছিল অন্য দুটো শুটার থেকে।
সবাই নেমে পড়তেই শ্রীধর পাইলটদের দিকে তাকিয়ে ইশারা করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে তিনটে শুটার শিস দিয়ে আবার ভেসে পড়ল আকাশে।
জিশান আগেই লক্ষ করেছিল, ছাদের মসৃণ মেঝেতে বড়-বড় মাপের খোপ কাটা—অনেকটা দাবার ছকের মতো। গোটা ছাদটা ছাই রঙের হলেও তার মধ্যে একটা খোপের রং কুচকুচে কালো।
সবাইকে ডেকে নিয়ে সেই খোপটার ওপরে গিয়ে দাঁড়ালেন শ্রীধর। পা দিয়ে মেঝেতে তিন-চারবার শব্দ করলেন। অমনি সেই কালো অংশটা নামতে শুরু করল নীচের দিকে।
জিশান একপলকের জন্য চমকে উঠেছিল।
সেটা লক্ষ করে শ্রীধর মুচকি হেসে বললেন, ‘অটোমেটিক প্লেট এলিভেটর—অডিয়ো অ্যাকটিভেটেড।’
জিশান অবাক হয়ে ভাবছিল, ষোলো বছরে নিউ সিটিতে প্রযুক্তি অনেকটাই এগিয়ে গেছে। আর ওল্ড সিটিতে সেটা দ্বিগুণ গতিতে পিছিয়ে গেছে।
এলিভেটর মসৃণভাবে নীচে নামছিল। এলিভেটর শ্যাফটের চার দেওয়াল থেকে হালকা নরম আলো ছড়িয়ে পড়ছিল জিশানদের ওপরে। একটা দেওয়ালে বসানো অনেকগুলো আলোর বোতাম। এলিভেটরের সঙ্গে-সঙ্গে বোতামগুলোও সমান গতিতে নেমে চলেছে—অনেকটা উৎসবের আলোকসজ্জার চলমান টুনি বাতির মতো।
বোতামগুলোর ওপরে সংখ্যা লেখা রয়েছে।
শ্রীধর ‘23’ লেখা বোতামটি টিপলেন। তারপর যেন আপনমনেই বললেন, ‘টোয়েন্টি থার্ড ফ্লোরে রেজিস্ট্রেশান ডেসক। আমরা সেখান থেকে শুরু করব।’
•
সিন্ডিকেট বিল্ডিং-এর সবকিছুই জিশানকে অবাক করছিল। মনে হচ্ছিল, ও বিশাল কোনও মহাকাশযানের ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
চারপাশে ঠান্ডা নরম আলো। ভাবলেশহীন মুখ নিয়ে ইউনিফর্ম পরা কর্মীরা যাতায়াত করছে। কারও মুখে কোনও কথা নেই—শুধু মসৃণ মেঝেতে জুতোর খটখট শব্দ। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।
গোটা বাড়িটাই যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেটা জিশান শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল। এখন করিডর দিয়ে হাঁটার সময় ওর বেশ শীত-শীত করতে লাগল।
করিডরের দেওয়ালগুলো ধপধপে সাদা, আর মেঝেতে চকচকে বাদামি গ্র্যানাইট পাথর। কোথাও এককণা ময়লা নেই, একবিন্দু অনিয়ম নেই।
চারপাশটা এত ঝকঝকে পরিষ্কার যে, জিশানের নোংরা জামা-প্যান্ট আরও নোংরা দেখাচ্ছিল। সঙ্কোচে জিশান একটু কুঁকড়ে গেল।
করিডরে ওরা এতবার বাঁক নিল যে, জিশানের দিক গুলিয়ে গেল।
একটু পরেই ওরা এসে দাঁড়াল একটা দরজার সামনে। দরজার মাথায় একটা লুমিনাস হেডিং জ্বলছে : রেজিস্ট্রেশান।
পকেট থেকে একটা ম্যাগনেটিক স্মার্ট কার্ড বের করলেন শ্রীধর পাট্টা। সেটা দরজার পাশের একটা স্লটে ঢুকিয়ে টানলেন। সঙ্গে-সঙ্গে কোথা থেকে যেন একটা রেকর্ডেড ভয়েস বলে উঠল : ‘থ্যাংকু য়ু।’ এবং দরজার পাল্লাটা স্লাইড করে সরে গেল একপাশে।
প্রহরীদের হাত নেড়ে চলে যেতে ইশারা করলেন শ্রীধর। ওরা অ্যাবাউট টার্ন করে করিডর ধরে হেঁটে রওনা হল।
জিশানকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীধর রেজিস্ট্রেশান রুমে ঢুকে পড়লেন।
বিশাল ঘর। ঘরের শেষ প্রান্তে গোটা দশ-বারো কাউন্টার। কাউন্টারের মাথায় জ্বলজ্বলে লাল আলোর হরফে নম্বর লেখা। প্রতিটি কাউন্টারে একটি করে ছিপছিপে মেয়ে বসে আছে। ওদের সামনে একটা করে কালো রঙের ল্যাপটপ কম্পিউটার।
কালো পোশাক পরা পাঁচজন সিকিওরিটি গার্ড ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওদের দুজনের চোখে অদ্ভুত ধরনের কালো চশমা। কোমরে চওড়া চামড়ার বেল্ট। বেল্টের একপাশ থেকে ঝুলছে গাঢ় নীল রঙের একটা রড, তবে তার হাতলের দিকটা কালো চামড়ায় মোড়া।
শ্রীধরকে দেখেই গার্ডগুলো টান-টান হয়ে দাঁড়াল। চোখ নামাল মেঝের দিকে।
শ্রীধর একজনের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। তীক্ষ্ণ চোখে তার পোশাকটা খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন। ওপরওয়ালার জরিপ-নজরের সামনে গার্ডটা একেবারে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গার্ডদের কালো পোশাকে সোনালি বিডের লাইনিং লাগানো। বুকে সোনালি ব্যাজ। ব্যাজের মনোগ্রামে সুন্দর ছাঁদে লেখা পি. এফ.।
গার্ডটির বুকের ব্যাজের দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন শ্রীধর পাট্টা। যেন চোখের তীব্র নজরে ব্যাজটাকে ভস্ম করে ফেলবেন। তারপর হাত বাড়িয়ে গার্ডের কোমর থেকে নীল রঙের রডটা তুলে নিলেন।
জিশান লক্ষ করল, রডটার কালো হাতলের কাছে একটা ছোট সুইচ রয়েছে।
সুইচটা অন করে চোখের পলকে রডের ডগাটা গার্ডটির পেটে চেপে ধরলেন শ্রীধর।
লোকটার শরীর স্প্রিং-এর মতো হেঁচকি তুলে ছিটকে লাফিয়ে উঠল। ওর মুখ দিয়ে অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকার বেরিয়ে এল। চোখে লাগানো কালো চশমাটা ঠিকরে পড়ল দূরে।
শ্রীধর রডের ডগাটা ক্ষিপ্রভাবে আবার চেপে ধরলেন গার্ডের পাঁজরে।
থরথর করে কেঁপে উঠল লোকটা। তিনহাত পিছনে ছিটকে পড়ল। মেঝেতে পড়ে ছটফট করতে লাগল।
জিশানের দিকে তাকিয়ে হাসলেন শ্রীধর, বললেন, ‘খেয়াল করেছ, ওর বুকের ব্যাজটা একটু বেঁকাভাবে লাগানো রয়েছে? নিউ সিটিতে প্রতিটি মিসটেকের জন্যে হাই স্টেক। এমনিতে মস্তি, কিন্তু ভুল করলেই শাস্তি…।’
একটি গার্ডকে শাস্তি দেওয়ার কাজ যখন চলছিল, অন্য চারজন গার্ড তখন স্ট্যাচুর মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে। যেন ওদের চোখ কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, ওদের কান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না।
নীল রডের মতো জিনিসটা তখনও শ্রীধরের হাতে শক্ত করে ধরা ছিল। তিনি সেটার সুইচ অফ করে দিলেন।
রডটার দিকে আঙুল দেখিয়ে আমতা-আমতা করে জিশান প্রশ্ন করল, ‘এটা কী?’
‘এটার নাম শকার।’ হেসে বললেন শ্রীধর পাট্টা, ‘শাসনের জন্যে দরকার। আর ওই কালো চশমাটা—ওই যে মেঝেতে পড়ে আছে…’ আঙুল তুলে চশমাটা দেখালেন শ্রীধর : ‘ওটা স্পেশাল এক্স-রে ভিশান স্পেক।’
জিশান তখনও রডটার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। মাঝে-মাঝেই ওর দৃষ্টি ছিটকে যাচ্ছিল মেঝেতে পড়ে থাকা হতভাগ্য লোকটার দিকে। লোকটা এখনও অল্প-অল্প নড়ছে। কাতরাচ্ছে।
‘সুইচ অন করলে এটার মধ্যে ফোর হান্ড্রেড ভোল্টস এসি তৈরি হয়।’ শ্রীধর তখনও বলছিলেন, ‘তারপর কারও গায়ে চেপে ধরলে…ওই যে, নেংটি ইঁদুরটা মেঝেতে পড়ে চিঁ-চিঁ করছে…।’
রডটা সামনে ধরে পড়ে থাকা লোকটার দিকে দেখালেন শ্রীধর পাট্টা।
জিশান যেন একটা ধাক্কা খেল।
ইউনিফর্মের বুকে লাগানো ব্যাজটা সামান্য বেঁকে আছে বলে চারশো ভোল্টের শক! শ্রীধর কি মানুষ?
শকারটা বগলে চেপে ধরে শ্রীধর পকেট থেকে ছোট্ট শিশিটা বের করে নিলেন। শিশির মুখটা খুলে ওপরদিকে তাকিয়ে হাঁ করলেন। শিশি থেকে তিন ফোঁটা তরল মুখে ঢাললেন। জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে চটপটি বাজির মতো ‘চটাস! চটাস!’ শব্দ করলেন কয়েকবার । জোরে-জোরে এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকালেন। ওঁর দু-গালে লাল আভা দেখা গেল। ওঁকে এখন অনেক চাঙ্গা মনে হল জিশানের।
এইবার জিশানকে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন শ্রীধর। সোজা এগিয়ে গেলেন সাতনম্বর কাউন্টারের কাছে।
কাউন্টারের মেয়েগুলো এতক্ষণ ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে শ্রীধরের কীর্তিকলাপ দেখছিল। এখন শ্রীধর আর জিশানকে কাছে এগিয়ে আসতে দেখে সাতনম্বর কাউন্টারের মেয়েটির মধ্যে প্রাণ এল।
‘কিল গেম পার্টিসিপ্যান্ট—’ ঠোঁট প্রায় ফাঁক না করেই কথাগুলো উচ্চারণ করলেন শ্রীধর।
‘কিল গেম’ কথাটা শোনামাত্রই কম্পিউটার কিবোর্ডে খটখাট শুরু করল মেয়েটি। তারপর জিশানের দিকে না তাকিয়েই যান্ত্রিক সুরে প্রশ্নমালা শুরু করল।
‘নাম?’
‘জিশান—জিশান পালচৌধুরী।’
‘বয়েস?’
‘ছাব্বিশ।’
‘হাইট? ওয়েট?’
‘পাঁচ-এগারো। আর ওয়েট চুয়াত্তর কেজি বোধহয়—লাস্ট যখন ওয়েট নিয়েছিলাম।’
‘নো প্রবলেম। এসব ডেটা আমরা আবার ক্রসচেক করে নেব—আমাদের রুটিন মেডিক্যাল চেক-আপ-এর সময়…।’
জিশান প্রশ্নের উত্তর দেওয়ামাত্রই মেয়েটির আঙুল চলছিল কিবোর্ডে। জিশান সম্পর্কে সমস্ত তথ্য ও ঢুকিয়ে দিচ্ছিল কম্পিউটারের মগজে।
জিশান মেয়েটিকে লক্ষ করছিল।
ছিপছিপে ফরসা চেহারা। মুখের মাপের তুলনায় চোখগুলো বড়-বড়। মুখের দুপাশে চুলের ঢল নেমেছে—ফলে মুখটাকে আরও ছোট দেখাচ্ছে।
মেয়েটির প্রসাধন খুবই সাধারণ। অন্তত জিশানের তাই মনে হল।
ওর চোখে কাজলরেখা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। আর পারফিউমের গন্ধ একটা নাকে আসছিল বটে, কিন্তু ওটা এমনই পালিয়ে-বেড়ানো ঢঙের যে, কে মেখেছে জিশান বুঝে উঠতে পারছিল না।
মেয়েটির গায়ে হালকা নীল টপ আর গাঢ় নীল স্কার্ট। অনেকটা ইউনিফর্ম পরা স্কুলের মেয়ের মতো লাগছে।
একঘেয়ে ভঙ্গিতে জিশানকে আরও অনেক প্রশ্ন করল মেয়েটি। যেমন, বাড়ির ঠিকানা, বাবার নাম, মায়ের নাম, বিয়ে করেছে কি না, এরকম আরও অনেক কিছু।
ওর প্রশ্নের উত্তর দিতে-দিতে জিশানের ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল।
‘কোনওরকম নেশা করেন—বা করতেন?’
‘একসময় স্মোক করতাম—চারবছর হল ছেড়ে দিয়েছি।’
‘কেন?’
‘ওল্ড সিটির এয়ার পলিউশান কমানোর জন্যে।’
এই প্রথম জিশানের দিকে চোখ তুলে তাকাল মেয়েটি। চোখে এককণা হাসল।