১৮. স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল

১৮.

না, জিশান, এভাবে মারধোর খেয়ে আমরা কিন্তু ভেঙে পড়িনি। বরং আমার মনে একটা স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছিল। অবশ্য স্বপ্ন না বলে সেটাকে দু:স্বপ্নও বলা যায়।

ঠিক করলাম, আমরা বন্ধুরা মিলে একটা মোটরবাইক গ্যাং তৈরি করব। তার নাম হবে ‘অ্যান্টি-মোটরবাইক গ্যাং’—সংক্ষেপে এ-এম জি। আমাদের গ্যাঙের কাজ তো তার নামেই স্পষ্ট! অর্থাৎ, আমাদের কাজ হবে মোটরবাইক গ্যাঙের গুন্ডাগর্দি রুখে দেওয়া, ওদের টরচার আর ক্রাইমের হাত থেকে ওল্ড সিটির মানুষকে বাঁচানো।

আমরা প্রায় ছ’মাস সময় নিলাম। ওই সময়ে নিজেরা তৈরি হলাম। কিছু অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করলাম। আরও চারজন বন্ধু দলে জুটে গেল। সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করলাম, আমাদের এ-এম-জি দলের লক্ষ্য কী। কী হতে পারে তার ম্যানিফেস্টো।

এ-শহরের নানান জায়গায় আমরা টহল দিয়ে বেড়াব। কোনও মোটবাইক গ্যাংকে ক্রাইম করতে দেখলে আমরা রুখে দাঁড়াব, বাধা দেব। এ-কাজে অতি অবশ্যই আমরা পাবলিকের সাপোর্ট পাব।

প্রথমে আমরা প্রচুর ঘোরাঘুরি করে শহরের মোটরবাইক গ্যাংগুলোকে চিনে নিলাম। মোটরবাইক গ্যাঙের কোনও ক্রাইমের খবর পেলেই সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে তথ্য জোগাড় করতে লাগলাম। এইভাবে ছ’মাস কেটে যাওয়ার পর আমরা তৈরি হয়ে রাস্তায় নামলাম।

না, আমাদের কোনও নেমপ্লেট ছিল না। তবে আমাদের আটজনের পোশাক ছিল একইরকম—সবুজ টি-শার্ট, আর কালো প্যান্ট।

আমরা সপ্তাহে দু-তিনদিন রাস্তায় টহল দিতে বেরোতাম। আমাদের টহলের নির্দিষ্ট কোনও রুট ছিল না, সময়ের নিয়ম ছিল না কোনও। আমরা আটজন যখন একসঙ্গে সময় মেলাতে পারতাম, তখনই আমরা নজরদারিতে বেরোতাম।

মেহেন্দি আমাকে এ-কাজে ভীষণ সাপোর্ট দিয়েছিল। থার্টিনদের সঙ্গে অ্যাকশনের পর যখন বাড়ি ফিরেছিলাম তখন আমার অবস্থা দেখে মাহি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমি সেরে ওঠার পর ও বলেছিল, ‘তুমি প্রাোটেস্ট করে ঠিক করেছ। প্রাোটেস্ট করার লোকজন তো দিন-কে-দিন কমে যাচ্ছে…।’

মাহির কাছ থেকে আর পাড়াপড়শিদের কাছ থেকে ব্যাপারটা নিয়ে এত সাপোর্ট পেলাম যে, আমাদের আটজনের কেউই পেছিয়ে আসার কথা আর ভাবল না। সুতরাং ছ’টা মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর এ-এম-জি মাঠে নামল। আমার ‘প্যাসকো বাইক ওয়ার্কশপ’ যেমন চলতে লাগল, তার পাশাপাশি এটাও। আমরা আটজন সব লোকজনকে জানান দিয়ে সবুজ ‘জার্সি’ পরে অপারেশানে বেরিয়ে পড়তে লাগলাম। কখনও সকালবেলা, কখনও দুপুরে, কিংবা বিকেল, সন্ধে, অথবা রাতে।

এইরকমভাবে ঘুরতে-ঘুরতে প্রায় দু-মাস পর থার্টিনদের সঙ্গে আমাদের দেখা হল।

সময় তখন সকাল সাতটা। ওল্ড সিটি থেকে বাইরে চলে যাওয়ার যে-তিনটে ইন্টারসিটি রাস্তা আছে তার দু-নম্বর সড়কটায় আমরা টহল দিচ্ছিলাম।

এর প্রথম কারণ দু-নম্বর ইন্টারসিটি হাইওয়েটার একটু বেশি বদনাম আছে। এই রাস্তাটায় খুন-জখম-রাহাজানির মাত্রাটা বড্ড বেশি। আর সবক্ষেত্রেই ক্রিমিনাল হচ্ছে কোনও-না-কোনও মোটরবাইক গ্যাং।

দু-নম্বর সড়কটা যে মোটরবাইক গ্যাংদের বেশি পছন্দ, তার কারণ আছে। সেটা হল, সড়কটার একদিকে ঘন জঙ্গল, আর অন্যদিকে নদী। এতে অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়ারও যেমন সুবিধে, তেমনই লাশ লোপাট করতেও ঝামেলা কম। অনেক সময়েই দেখা যায় নীচে, নদীর খাতে, অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া গাড়ি উলটে পড়ে আছে।

দু-নম্বর সড়কটা যে আমরা বেছে নিয়েছিলাম, তার আরও একটা কারণ ছিল। সেটা হল, গত একমাসে এই রাস্তায় মোটরবাইক গ্যাংরা সাত-সাতটা ভয়ংকর ক্রাইম ঘটিয়েছে। তার মধ্যে চারটে হয়েছে ভোরের দিকে—ছ’টা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যে। তা ছাড়া সেদিন সকালে রাস্তার লোকজনের কাছ থেকে আমরা খবর পেয়েছিলাম যে, একটা মোটরবাইক গ্যাং ভোরবেলার দিকে দু-নম্বর ইন্টারসিটির দিকে গেছে।

দু-নম্বর সড়কে ঢুকেই চোখে পড়ল কতকগুলো রং-চটা হোর্ডিং। তাতে সাবধানে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে বেশ কয়েকটি সতর্কতার কথা লেখা রয়েছে। আর জ্ঞানসূচক বাণীমালার একেবারে নীচে বড়-বড় হরফে লেখা : গাড়িকে অবশ্যই মানুষ মারার অস্ত্র ভাববেন। বাক্যটির শেষে নিশ্চয়ই ‘না’ কথাটা লেখা ছিল, কিন্তু রং চটে যাওয়ায় সেই গুরুত্বপূর্ণ শব্দটি অদৃশ্য হয়ে গেছে।

একটা সুদীর্ঘ ময়াল সাপের মতো হাইওয়েটা শুয়ে আছে। তার জায়গায়-জায়গায় ছোট-বড় ক্ষতচিহ্নগুলো ময়াল সাপের গায়ের নকশা।

বাঁ-দিকে তাকালে চোখে পড়ে সূর্য। সেই আলো নদীতে পড়েছে, রাস্তায় এসে পড়েছে। ডানদিকে চোখ ফেরালে ঘন জঙ্গল। মনে হচ্ছে, গাছপালাগুলো হেঁটে এগোতে গিয়ে রাস্তাটাকে সামনে পেয়ে বাধ্য হয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে। নইলে ওরা হেঁটে-হেঁটে নদীর ঠিক পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াত।

হাইওয়ের পাশে কোথাও-কোথাও বিকল ট্রাক দাঁড়িয়ে। আবার কখনও চোখে পড়ছে অ্যাক্সিডেন্টে বেঁকেচুরে তুবড়ে যাওয়া গাড়ি। এ ছাড়া রয়েছে পরিত্যক্ত কয়েকটা টিনের চালাঘর—হয়তো কোনওকালে দোকান-টোকান ছিল।

রাস্তা ধরে বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে যাওয়ার পর দূরে একটা নীল রঙের গাড়ি চোখে পড়ল।

হাইওয়েতে গাড়ি চোখে পড়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু এই গাড়িটা দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার পাশে, মাটির ঢালের ওপরে। যে-ঢালটা জঙ্গলে গিয়ে মিশেছে।

গাড়িটাকে ঘিরে কয়েকটা মোটরবাইক দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর কয়েকটা বাইক গাড়িটাকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আহত শিকারকে ঘিরে চিতাবাঘ যেমন ঘুরপাক খায়।

আমি হাত তুলে সবাইকে থামতে ইশারা করলাম। তারপর আমরা বাইক সাইড করে ঢাল বেয়ে নামিয়ে দিলাম। জঙ্গল ঘেঁষে যন্ত্রগুলো দাঁড় করালাম।

গাছের আড়াল থেকে আমরা ব্যাপারটা লক্ষ করতে লাগলাম। এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলাম নীল গাড়িটাকে ঘিরে কোন কর্মকাণ্ড চলছে।

শুধু তাই নয়। বিরাট লম্বা আর চওড়া একটি লোককে চোখে পড়ল। গাড়ির বেশ কাছে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় কদমছাঁট চুল। গায়ে লাল টি-শার্ট—তার ওপরে এলোমেলো কালচে ছোপ।

লোকটাকে আমি অল্পবিস্তর আঁচ করতে পারছিলাম। আর ঠিক তখনই ‘হেল’ গ্যাঙের সাইনবোর্ডটা আমার চোখে পড়ল।

থার্টিন আর তার দলবল দু-নম্বর ইন্টারসিটি হাইওয়ের ওপরে শিকার ধরেছে।

চাপা গলায় আমার সঙ্গীদের সঙ্গে আলোচনা করে নিলাম।

আমরা আটজন বাইক নিয়ে থার্টিনদের ওপরে ঝোড়ো বাতাসের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ব। ওদের ছত্রভঙ্গ করে দেব। আর বাইক থেকে কিছুতেই যেন আমরা না নামি—বা পড়ে না যাই। কারণ, আমাদের সঙ্গে কোনও অস্ত্রশস্ত্র নেই—গতিই আমাদের একমাত্র অস্ত্র।

আমাদের আটটা বাইক প্রায় একইসঙ্গে স্টার্ট নিল। খ্যাপা ষাঁড়ের মতো গোঁ-গোঁ করতে-করতে উঠে এল হাইওয়ের ওপরে। তারপর ‘অকুস্থল’ লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করল।

হাই এনার্জি সাইক্লোনের মতো আমাদের আটটা বাইক চোখের পলকে থার্টিনের দলের ওপরে আছড়ে পড়ল। ওদের মধ্যে একজন একটা মোটা নলের শটগান বের করে ফায়ার করল। আমার দলের একজন ‘ও:!’ আর্তনাদ করে চলন্ত বাইক থেকে ছিটকে পড়ল রাস্তায়। ওর বাইকটা পাগলের মতো ছুটে গিয়ে নীল গাড়িটার বাঁ-দিকের হেডলাইটের কাছে ধাক্কা খেল। লাফিয়ে দুবার পালটি খেয়ে থার্টিনের দলের একটা বাইকের সঙ্গে সংঘর্ষ ঘটাল। তারপর দুটো বাইক লাট খেয়ে রাস্তার ঢাল বেয়ে পড়ে গেল।

নীল গাড়িটাকে ঘিরে একটা ডামাডোল শুরু হয়ে গেল। বাইকের গোঁ-গোঁ শব্দে সকালবেলার বাতাস অস্থির হয়ে কেঁপে-কেঁপে উঠতে লাগল।

থার্টিন আত্মরক্ষার চেষ্টায় ছুটে ওর বাইকের কাছে গেল। বাইকটা রাস্তায় কাত হয়ে পড়ে ছিল। সেটাকে দাঁড় করিয়ে লাফিয়ে বাইকে উঠে বাইক ছুটিয়ে দিল।

আমি বুকের ভেতরে গনগনে রাগ নিয়ে ওকে তাড়া করলাম। তার আগে একঝলক দেখলাম, থার্টিনের দলের অন্যান্যরা হঠাৎ এই ঝোড়ো আক্রমণের চাপে পড়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাচ্ছে। ওদের একটা সোর্ড আর একটা শটগান রাস্তায় ছিটকে পড়েছে। নীল গাড়িটা সুযোগ বুঝে স্টার্ট নিয়ে চলতে শুরু করেছে। গাড়ির ভেতরে পুরুষ মহিলা মিলিয়ে চার-পাঁচজন বসে আছে।

থার্টিনের বাইকের স্টিয়ারিং-এ বোধহয় কোনও গণ্ডগোল হয়ে থাকবে। কারণ, ওর বাইকটা বারবার টাল খেয়ে মাতালের মতো এঁকেবেঁকে ছুটছিল। আর আমাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ কমছিল।

উলটোদিক থেকে দুটো গাড়ি আসছিল। একটা কালোরঙের প্রাইভেট কার, আর তার খানিক পেছনে বিচ্ছিরিরকম লোড করা একটা ফুল পাঞ্জাব ট্রাক।

রাস্তায় গর্ত আর খানাখন্দ থাকায় ট্রাকটা বিপজ্জনকভাবে ডানদিক বাঁ-দিকে টাল খাচ্ছিল। ট্রাকটার কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে হলে হাইওয়ের একেবারে বাঁ-দিক ঘেঁষে বাইক চালাতে হয়। তো আমি তাই করলাম। যতটা পারলাম বাঁ-দিকে সরে গেলাম। কিন্তু বেশি সরে গেলেই হালকা আগাছার ঝোপ আর ঢাল—নীচে নদীর দিকে গড়িয়ে গেছে।

থার্টিনও আমার মতো সাবধান হয়েছিল। তাই ওর বাইকটা ক্রমশ বাঁ-দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ওর কাছাকাছি এসে যাওয়া ফুল পাঞ্জাব ট্রাকটা হঠাংই খাড়া অবস্থা থেকে দশ-পনেরো ডিগ্রি হেলে গেল।

থার্টিন ভয়ে চিৎকার করে উঠল। ওর বাইক বাঁ-দিকে আগাছার ঝোপের দিকে ছুটে গেল। শুধু ছুটে গেল নয়, তার ফাঁক দিয়ে ঢুকে ঢাল বেয়ে নদীর দিকে এগিয়ে চলল। ও প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাইকের স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে বাইকটাকে সামাল দিতে পারছিল না।

আমিও ঢাল বেয়ে বাইক নামিয়ে দিলাম। গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে আমার মোটরবাইক থার্টিনের মেশিনের দিকে ছুটে চলল। তারপর আমি যা চাইছিলাম তাই হল। দুটো মেশিনে প্রবল সংঘর্ষ হল। ওর বাইকের পেটের কাছাকাছি জায়গায় ধাক্কাটা লাগল।

থার্টিনের বাইক কাত হয়ে গেল। আপন খেয়ালে অদ্ভুত বৃত্তচাপ এঁকে ঢালের ওপরে ছুঁচোবাজির মতো খানিক ছুটল। তারপর লাট খেয়ে ঢাল বেয়ে লাফিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেল নদীর পাথর আর পলিমাটির পাড়ে।

সংঘর্ষের সঙ্গে-সঙ্গেই থার্টিনের দেহটা শূন্যে ছিটকে উঠেছিল। সেখান থেকে জমিতে পড়ে ওর অবস্থাও হল ওর বাইকের মতন। গড়িয়ে-গড়িয়ে পড়ে গেল নীচে।

আমার বাইক কিন্তু তখনও দু-চাকার ওপরে ছিল। আমি কসরত করে ওটাকে ঢালের ওপরে চালাচ্ছিলাম। আঁকাবাঁকা পথে ওটাকে নদীর পাড়ে নামিয়ে নিয়ে গেলাম। সেখানে মোলায়েম মাটি আর ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় নুড়ি পাথর।

থার্টিন যে তেমন চোট পায়নি সেটা বুঝতে পারলাম তখনই। দেখলাম, ও উঠে দাঁড়িয়েছে এবং নদীর পাড় ধরে ছুটছে।

আমি বাইক নিয়ে ওকে তাড়া করলাম।

ও ছুটতে-ছুটতে একবার থামল। ঝুঁকে পড়ে একটা পাথর তুলে নিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারল। তারপর আবার দৌড়তে লাগল।

পাথরটা আমার বেশ কয়েক হাত দূর দিয়ে ছিটকে গেল। আমি বাইক থামালাম না। ছোট-বড় নানান মাপের পাথর কাটিয়ে ডিঙিয়ে কোনওরকমে গাড়িটা চালাতে লাগলাম।

যখন আমি থার্টিনের খুব কাছাকাছি চলে এসেছি তখন ও একটা কাণ্ড করল। চট করে ঘুরে নদীর জল লক্ষ্য করে দৌড়তে শুরু করল।

আমিও স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ওর পিছু নিলাম বটে, কিন্তু বুঝলাম, ওর বুদ্ধির কাছে আমি হেরে গেছি।

যা ভেবেছিলাম তাই হল। থার্টিন নদীর জলে নেমে পড়ল। ছপছপ করে পা ফেলে প্রায় কোমর জলে চলে গেল।

আমার বাইকের চাকা নদীর জল ছুঁয়ে ফেলতেই আমি গাড়ি থামালাম।

দৃশ্যটা আমার খুব অলৌকিক লাগছিল।

আমার গায়ে মাথায় রোদ। নদীর জলের গন্ধ। হালকা বাতাস। দূরের গাছপালার সারি। নাম-না-জানা পাখির ডাক। মাথার ওপরে আকাশের নীল।

এই রোমান্টিক পরিবেশে আমার পাশে মাহি যদি থাকত তা হলে দারুণ লাগত।

কিন্তু তার বদলে আমার সামনে একজন ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর শত্রু। যার সারা গায়ে কাটা-ছেঁড়া দাগ, গালে-কপালে রক্ত লেগে আছে। যে এখন আমাকে তাক করে চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে অশ্রাব্য গালিগালাজ করছে।

আমি অসহায়ভাবে বাইকে বসে রইলাম। থার্টিন তখন মুখ বিকৃত করে বলছে, আমাকে কবজায় পেলে ও কী হাল করে ছাড়বে। আমার নকশা ও বদলে দেবে। আমার ফ্যামিলিকে ও থেঁতলে পিষে লেই বানিয়ে ছাড়বে।

আমি শুধু ওকে বললাম, যেখানেই তোমার গ্যাং-কে আমরা পাব, সেখানেই রুখে দেব। স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল—যেখানেই হোক।

থার্টিনের সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও রিভলভার কিংবা শটগান ছিল না। থাকলে ও অবশ্যই আমাকে খতম করে দিত। তাই ও ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বড়-বড় শ্বাস ফেলে হাঁপাচ্ছে।

আরও কিছুক্ষণ আমরা একইভাবে স্থির রইলাম। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না এখন কী করব। আমার বন্ধুরা যদি আমাকে এখানে দেখতে পেয়ে নেমে আসে তা হলে হয়তো কিছু একটা করার কথা ভাবা যায়।

আমার পকেটে রাখা মোবাইল ফোন বাজছিল। কিন্তু আমার তখন ফোন ধরতে ইচ্ছে করছিল না। আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থার্টিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

হঠাৎই পেছন থেকে বাইকের ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। তার সঙ্গে চিৎকার।

থার্টিন সঙ্গে-সঙ্গে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। নদীর ওপার লক্ষ্য করে সাঁতার কাটতে শুরু করল।

আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কতকগুলো সবুজ টি-শার্ট আর মোটরবাইক। ওপরে হাইওয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে আমাকে লক্ষ্য করে ডাকছে, হাত নাড়ছে।

‘প্যাসকো! প্যাসকো!’

আমি হাত নেড়ে ওদের নেমে আসতে বললাম। একইসঙ্গে থার্টিনের আচমকা জলে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণও বুঝতে পারলাম।

বন্ধুদের কাছে জানতে পারলাম, আজকের অপারেশানে এ-এম-জি জিতেছে। আমাদের দলের দুজন অল্পবিস্তর আহত হয়েছে—তবে সেটা সিরিয়াস কিছু নয়। আর ‘হেল’ গ্যাঙের একজন গুন্ডা ভালোরকম চোট পেয়েছে। তার বডিটা জঙ্গলের মধ্যে গাছের আড়ালে শোয়ানো আছে। আর বাকি গুন্ডাগুলো পালিয়েছে।

থার্টিনের দিকে তাকিয়ে দেখি, ও তখন সাঁতরে অনেক দূরে চলে গেছে।

আমরা বাইক নিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।

হাইওয়েতে উঠে দেখি সেই ফুল লোড ট্রাকটা রাস্তার ওপরে কাত হয়ে পড়ে আছে। তার মালপত্র ছড়িয়ে ছত্রখান হয়ে গেছে : ইস্পাতের তৈরি ছোট-ছোট মেশিনারি পার্টস। সেগুলোর ওপরে রোদ পড়ে ঝকঝক করছে। কাত হয়ে থাকা ট্রাকটার জন্যে ইন্টারসিটি হাইওয়ে জ্যাম হয়ে গেছে।

আমরা সবাই বাড়ি ফিরলাম বটে, কিন্তু থার্টিনের হুমকির কথা আমি ভুলতে পারছিলাম না।

রাতে মেহেন্দিকে আমি সকালের সব ঘটনা খুলে বললাম। ও শুনে আমার গালে একটা চুমু গেল। বলল, ‘ঠিক করেছ। লাইফে পজিটিভ কিছু করা দরকার—।’

কিন্তু থার্টিনের একটা কথা আমার মনে কাঁটা হয়ে খচখচ করছিল: আমার ফ্যামিলিকে ও থেঁতলে পিষে লেই বানিয়ে ছাড়বে।

বিয়ের আগে মেহেন্দির সঙ্গে আমি প্রায় দু-বছর মিশেছি। আমার পছন্দ-অপছন্দ অভ্যাস সবই ওর জানা। সবকিছু জেনেই ও আমার সঙ্গে মিশেছিল। আমার বন্ধুদের সবাইকেই ও চিনত। আমাদের ঘরে কখনও-কখনও চায়ের আসর বসত। সেই আসরে নানান বিষয়ে তর্কাতর্কি হত। যেমন, কোন উলকির নকশা ভালো, আর কোনটা খারাপ। নিউ সিটির হাইফাই রিসকি গেমগুলোর মধ্যে কোনটা সবচেয়ে খতরনাক। নিউ সিটির গেমে নাম লিখিয়ে টাকা জেতার চেষ্টা করা উচিত কি না। মোটরবাইক গ্যাংগুলোর সঙ্গে ঠিক কীভাবে আমাদের ফাইট করা উচিত।

এইসব আলোচনার সময় মেহেন্দিও আমাদের সঙ্গে গলা ফাটাত, মতামত দিত।

সেইসব হুল্লোড় আর তর্কাতর্কির সময় একটা ব্যাপার আমি লক্ষ করেছিলাম : নিউ সিটির গেমে নাম দেওয়ার ব্যাপারে ওর ঘোরতর আপত্তি ছিল। ও বলত, মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে তাকে নিয়ে নানান ডেঞ্জারাস খেলা খেলিয়ে মজা লোটার এই কায়দাটা ভীষণ জঘন্য আর নোংরা। ও কোনওদিনই নিউ সিটির মার্শালকে ক্ষমা করতে পারবে না।

আমার বন্ধুদের কেউ-কেউ ওইসব গেমে নাম দিয়ে ‘জুয়াখেলা’য় জেতার কথা বললে মেহেন্দি তাদের বেধড়ক ঝাড়ত। আমি অনেক সময় ওকে খ্যাপানোর জন্যে নিউ সিটির গেমে নাম দেওয়ার কথা বলতাম, ওর সঙ্গে মজা করতাম। কিন্তু তাতে ও জেনুইনলি হেভি চটে যেত।

তখন জানতাম না, এই আমি সত্যি-সত্যি সুপারগেমস কর্পোরেশনের কোনও গেমে নাম দেব।

আমার জীবনে চরম দুর্ঘটনাটা একদিন ঘটল।

দু-নম্বর ইন্টারসিটি হাইওয়েতে থার্টিনদের সঙ্গে এনকাউন্টার হওয়ার পর প্রায় ছ’মাস কেটে গেছে। আমার জীবনের সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। সপ্তাহের ছ’টা দিন বাইক ওয়ার্কশপের কাজ, আর একটা দিন নিজের জন্যে। আমার আর মাহির জন্যে।

একরমই একটা ছুটির দিনে—দিনটা রবিবার ছিল—আমি আর মাহি মোটরবাইক চেপে ঘুরতে বেরিয়েছিলাম।

আমার আস্তানা থেকে সাত কি আট কিলোমিটার দূরে একটা পার্ক ছিল। নাম হেক্সাগন পার্ক। বুঝতেই পারছ, পার্কের চেহারাটা হেক্সইগনের মতো বলেই ওই নাম।

পার্কটা মাপে প্রকাণ্ড। আর তার ঠিক মধ্যিখানে হেক্সাগন চেহারার একটা লেক ছিল। এ ছাড়া প্রচুর গাছপালা।

কিন্তু পার্ক বলতে যেরকম ছবি মনের ভেতরে ভেসে ওঠে, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম ছিল না। অবহেলা আর অযত্নে পার্কের এককালের সুন্দর বাগান আর সাজানো গাছপালা অনেকটা জঙ্গলের চরিত্রে বদলে গিয়েছিল। লেকের নীল জলে একসময় লাল-নীল সব মাছ খেলা করত। কালে-কালে লেকের জলের রং বদলে শ্যাওলা ধরে ঘোলাটে সবুজ হয়ে গিয়েছিল। একসময়ে পার্কের যে-আলোকসজ্জার আমরা প্রশংসা করতাম, তখন সেই সজ্জার জাঁকজমক মৃত্যুশয্যায়।

তবুও সেখানে লোকজন যেত। বিশেষ করে আমার মতো গরিব। কারণ, হেক্সাগন পার্কে ঢোকার জন্যে কোনও টিকিট কাটতে হত না।

পার্কের ভেতরে লেকের চারদিকের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে আমার খারাপ লাগত না। আর আমার যেটা পছন্দের সেটা মাহিরও পছন্দের ছিল। তা ছাড়া আমাদের গোটা শহরের যেরকম দশ দশা, তাতে ওই হতমান হেক্সাগন পার্কই ছিল আমাদের এলাকার অক্সিজেন সেন্টার। তাই ছুটির দিনে দুপুরে বা বিকেলে মোটামুটি ভিড় হত সেখানে।

পার্কটা হতমান হলেও সেখানে অলসভাবে ঘুরে বেড়াতে আমার আর মেহেন্দির ভালো লাগত। এলোমেলো বেহিসেবি গাছপালা, শান্ত লেকের ঘোলাটে জল, তাতে বুড়বুড়ি কাটা চানাচুনো আর তেলাপিয়া মাছ—তার মধ্যেই আমরা আমাদের অল্প-অল্প ভালো লাগা খুঁজে পেতাম।

 তো অভ্যাসমতো সেই ছুটির দিনটায় আমি আর মেহেন্দি হেক্সাগন পার্কে গিয়েছিলাম।

সন্ধের মুখে আমি আর ও হাসাহাসি করতে-করতে পার্কের বাইরে বেরিয়ে এলাম।

হঠাৎই একটি সতেরো-আঠেরো বছরের ছেলে আমার কাছে এগিয়ে এল। রোগাটে মুখ, চাপদাড়ি, বাঁ-দিকের গালে শ্বেতীর দাগ।

ছেলেটা জিগ্যেস করল, ‘দাদা, ক’টা বাজে?’

আমি বাঁ-হাতের কবজি উলটে ঘড়ি দেখে বললাম, ‘পৌনে ছ’টা—।’

কথাটা বলতে না বলতেই ছেলেটা চকিতে ছোবল মেরে আমার জামার বুকপকেট থেকে মোবাইল ফোনটা তুলে নিল। তারপরই দে ছুট।

আমি আগুপিছু চিন্তা না করেই ছেলেটাকে ধরতে তাড়া করলাম। তখনই লক্ষ করলাম, ছেলেটার ডানহাতের কবজিতে একটা ঘড়ি রয়েছে। সেটা আমি কেন যে আগে খেয়াল করিনি!

আমি ‘চোর! চোর!’ বলে চিৎকার করছিলাম, কিন্তু তাতে আশপাশের লোকজন তেমন গুরুত্ব দিল বলে মনে হল না। কারণ, ওল্ড সিটিতে ‘চোর! চোর!’ চিৎকারটা এত বেশি চেনা যে, বলার কথা নয়।

কিছুক্ষণ ছোটার পরই বুঝলাম, আমার ভারী শরীর নিয়ে ওই রোগা দৌড়বাজ ছেলেটাকে আমার পক্ষে ধরা সম্ভব নয়। তাই আমি থেমে গেলাম। বড়-বড় শ্বাস ফেলতে লাগলাম।

এমন সময় মেহেন্দির চিৎকার শুনতে পেলাম।

ও আমার নাম ধরে ডেকে উঠেছে। এই ডাকটা ভয়ের ডাক। বিপদ থেকে বাঁচতে চাওয়ার ডাক।

আমি ঘুরে মেহেন্দির দিকে তাকালাম। তাকিয়ে যা দেখলাম তাতে একটা বরফের সাপ আমার শিরদাঁড়া পেঁচিয়ে নেমে গেল। মাথাটা টাল খেয়ে গেল পলকে।

তিন-চারটে মোটরবাইক মেহেন্দিকে ঘিরে ফেলেছে। একটা লম্বামতন লোক ওকে টেনেহিঁচড়ে একটা বাইকে তুলছে। আর মেহেন্দি আমার নাম ধরে চিৎকার করে চলেছে।

আমি শয়তানগুলোকে লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করলাম। কিন্তু ততক্ষণে ওকে বাইকে বসিয়ে বাইক গতি নিয়েছে।

বাইকটা চালাচ্ছে একজন। তার পেছনে মাহি। আর মাহিকে প্রাণপণে জাপটে ধরে ওর পেছনে চেপে বসেছে আরও একজন। দুটো পুরুষের মাঝে মাহি স্যান্ডউইচ হয়ে আছে।

লম্বা মতন যে-ছেলেটা বাইক চালাচ্ছে, ছুটতে-ছুটতেই ওর পায়ের দিকে চোখ গেল আমার। ছেলেটার বুট পরা পায়ের গোড়ালির কাছে কী যেন একটা চকচক করছে। ওর জিনস-এর পায়াটা তার ভেতরে গোঁজা।

একটা স্টিলের বালা। ওর ডান পায়ে। থার্টিন। বলেছিল, আমার ফ্যামিলিকে ও থেঁতলে পিষে লেই বানিয়ে ছাড়বে।

থার্টিনকে চিনতে পারামাত্রই আমার মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এসেছিল। কসাইখানায় শুয়োর কাটার সময় যে-ধরনের চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়।

জন্তুর মতো চিৎকার করতে-করতে আমি থার্টিনের মোটরবাইকের দিকে ছুটে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোনও লাভ হল না। ভটভট গর্জন তুলে দুশমনের বাইকটা দূরে মিলিয়ে গেল। সেইসঙ্গে মাহির চিৎকারও।

আমি রাস্তায় বসে পড়লাম। মাটি চাপড়ে কপাল চাপড়ে অসহায়ের মতো অনেক কান্নাকাটি করলাম। রাস্তার লোকজন হাঁ করে আমাকে দেখতে লাগল। হয়তো ভাবল, একটা ভবঘুরে পাগল নিজের সুস্থতা ফিরে পাওয়ার জন্যে হা পিত্যেশ করে কাঁদছে।

একটু পরে কান্নাকাটি থামিয়ে আমি নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম। তারপর আমার বাইকে উঠে থার্টিনদের খোঁজে বেরোলাম।

দিশেহারাভাবে সারাটা রাত ওদের খুঁজে বেড়ালাম আমি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার হাত শূন্য রয়ে গেল। ক্লান্ত শরীরে শূন্য হাতে ভোরবেলা বাড়ি ফিরে এলাম।

তারপর সারাদিন ধরে বন্ধুদের সঙ্গে অনেক পরামর্শ করলাম। ওদের কথায় থানা-পুলিশ নিয়ে প্রচুর দৌড়ঝাঁপ করলাম। কিন্তু মেহেন্দির খোঁজ পেলাম না।

তবুও আমি খুঁজে চললাম। ওল্ড সিটির সম্ভব অসম্ভব সব জায়গায় চষে বেড়ালাম।

না, মেহেন্দি কোথাও নেই।

কয়েকদিন পর আমার কিছু বন্ধু হাল ছেড়ে দিল, কিন্তু আমি জেদ ছাড়িনি। মাত্র তিনজন বন্ধুকে সঙ্গী করে খোঁজ চালাতে লাগলাম।

আরও কিছুদিন পর বন্ধুর সংখ্যা কমে দাঁড়াল মাত্র একজন। কিন্তু তাও আমি খোঁজ চালিয়ে যেতে লাগলাম।

শেষে, আরও পনেরোদিন পর, আমি একা। তখন আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছি। কখন চান করি, কখন খাই, আর কখন ঘুমোই—কিছুই মনে থাকে না। শুধু খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ।

তবুও মাহিকে পেলাম না।

এইভাবে টানা একবছর কাটিয়ে তারপর বুঝলাম, মাহিকে আর কোনওদিনই আমি ফিরে পাব না।

ব্যস, তারপরই আমি কেমন যেন শান্ত পাথর হয়ে গেলাম। একা-একা চুপচাপ সময় কাটাতে লাগলাম। জীবন সম্পর্কেই আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল।

সেরকমই একটা সময়ে ঠিক করলাম, আমি নিউ সিটির কিল গেমে নাম দেব। যদি কিল গেমে জিততে পারি তা হলে সুপারগেমস কর্পোরেশনের সব খেলা আমি খতম করে দেব। ওদের কোম্পানির ঝাঁপ বন্ধ করে চিরকালের জন্যে তালা লাগিয়ে দেব।

কারণ, মেহেন্দি এই খেলাগুলো একটুও পছন্দ করত না।

তো আমি কিল গেমে নাম দিলাম।

প্যাসকোর কাহিনি যখন শেষ হল তখন সুপার হাই-ফাই ক্যান্টিনের বাইরে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে।

জিশান প্যাসকোর দিকে তাকিয়ে ছিল। মানুষটার জীবনের ওঠা-পড়া কল্পনায় দেখতে চাইছিল।

প্যাসকো হঠাৎ বলল, ‘একটা জিনিস দ্যাখো…।’ বলে পকেট থেকে একটা চ্যাপটা ছোট ডকুমেন্ট বক্স বের করল। সেটা খুলে একটা রঙিন ফটোগ্রাফ বের করে নিল। তারপর ফটোটা বাড়িয়ে দিল জিশানের দিকে।

জিশান দেখল।

একটা অল্পবয়েসি রূপসি মেয়ে। চোখে অনেক স্বপ্ন।

প্যাসকো বলল, ‘মেহেন্দি…মাহি…।’

মুখ তুলে তাকাল জিশান।

প্যাসকোর বাঁ-চোখে একফোঁটা জল।

৩১ আগস্ট। শুক্রবার। মাঝে আর একটা দিন—তারপরই রবিবার। কিল গেম।

শ্রীধর পাট্টা জিশানকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। চারজন গার্ড জিশানকে গ্রানাইট পাথরে ঢাকা করিডর ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। জিশান ওদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলার চেষ্টা করছিল, কিন্তু ওরা কেউই সেরকমভাবে কোনও জবাব দিচ্ছিল না। শুধু ছোট্ট করে ‘হু-হাঁ’ করছিল।

জিশান বেশ অবাক হয়ে গেল। ব্যাপারটা কী! নিউ সিটির গার্ডরা তো সবসময়েই জিশানের সঙ্গে কথা বলেছে, গল্প করেছে—এমনকী কেউ-কেউ ওকে হিরোর সম্মান পর্যন্ত দিয়েছে।

অবশেষে আর থাকতে না পেরে জিশান জিগ্যেস করেই ফেলল, ‘কী ব্যাপার বলো তো! তোমরা কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাও না?’

জিশানের ডানপাশে যে-গার্ডটি হেঁটে যাচ্ছিল সে বলল, ‘না, স্যার। আসলে মার্শাল নিয়ম করেছেন, কিল গেমের আগে আটচল্লিশ ঘণ্টা কেউ ক্যান্ডিডেটের সঙ্গে কথা বলতে পারবে না।’

জিশান হেসে বলল, ‘কিল গেমের পরে কেউ কি আর আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে?’

গার্ড মাথা নীচু করল। কোনও কথা বলল না।

ততক্ষণে ওরা একটা বন্ধ দরজার সামনে পৌঁছে গেছে।

একজন গার্ড পকেট থেকে রিমোট বের করল। দরজার দিকে তাক করে বোতাম টিপল।

স্লাইডিং ডোর। দরজার পাল্লা নি:শব্দে পাশে সরে যাচ্ছিল।

গার্ড চারজন প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, ‘গুডবাই, স্যার—।’

তখন থেকে ওরা ‘স্যার-স্যার’ শুরু করেছে কেন? অবাক হয়ে ভাবল জিশান। কারণ, গার্ডদের মধ্যে অন্তত দুজন জিশানের চেয়ে বয়েসে অনেক বড়। তার মধ্যে আবার একজনের গোঁফে পাক ধরেছে।

সামান্য হেসে ‘স্যার-স্যার’ রোগের কারণটা জানতে চাইল জিশান।

একজন গার্ড মুখ নামিয়ে বলল, ‘যে যাই বলুক, স্যার। আমাদের কাছে আপনি ”স্যার”। আপনার মুখের দিকে আমরা সবাই চেয়ে আছি।’

আর-একজন গার্ড পাশ থেকে বলল, ‘আমরা এখানে ভালো নেই, স্যার…।’

ওরা আর দাঁড়াল না। অ্যাবাউট টার্ন করে চটপট হাঁটা দিল।

ঠিক তখনই শ্রীধর পাট্টার অভ্যর্থনা শুনতে পেল জিশান।

‘এসো, এসো, জিশান / এখন বুদ্ধিতে দাও শান।’ একটু হেসে বাঁ-হাতটা শূন্যে তিরিশ ডিগ্রি ঘুরিয়ে : ‘পরশু কিল গেম / কী পাবে, শেম, না ফেম?’

জিশান কোনও উত্তর দিল না। ওর মধ্যে কেমন একটা থম-মেরে-যাওয়া ভাব কাজ করছিল। শ্রীধর পাট্টার ব্যঙ্গের ছুরি ওর গায়ে আঁচড় কাটতে পারছিল না।

শ্রীধর ছোট ঘেরওয়ালা একটা সাদা প্যান্ট পরে ছিলেন। প্যান্টটা এমন যে, পায়ের সঙ্গে চোস্তাই পাজামার মতো লেপটে আছে।

গায়ে প্যান্টের সঙ্গে মানানসই খাপি সাদা কোট। শ্রীধরকে যেন আদর করে জড়িয়ে ধরেছে। কোটের কলারে আর হাতায় কবজির কাছে সোনালি রঙের পটি। বুকে মাঝারি মাপের সোনালি বোতাম।

জিশান ভাবলেশহীন মুখে ঘরে ঢুকল। ওর আবেগ আর অনুভূতির জানলা-দরজা ও বন্ধ করে দিয়েছিল। নিজেকে পুরোপুরি একটা পোজিট্রনিক রোবট বলে ভাবতে শুরু করেছিল।

বিশাল ঘর। ঘরের সাজসজ্জা সবই সাদার কাছাকাছি রঙের। একদিকের দেওয়ালে একটা প্রকাণ্ড কম্পিউটার স্ক্রিন। ওটা খুলে মেঝেতে পেতে দিলে ডাবল বেড বিছানার ইলেকট্রনিক সংস্করণ বলে মনে হতে পারে।

কম্পিউটার স্ক্রিনের বিপরীত দিকের দেওয়ালের কাছে বসে আছেন দুজন সাজুগুজু করা লোক—তাঁদের সামনে দুটো আর্ক কম্পিউটার। আর তাঁদের পাশে সার বেঁধে সাজানো চারটে সাদা সোফা।

ঘরের এসি এমন সেট পয়েন্টে চলছিল যে, জিশানের মনে হল ঋতুটা শীতকাল।

ইশারায় জিশানকে ডেকে নিলেন শ্রীধর। নিজে একটা সোফায় গিয়ে বসলেন। পাশেরটায় জিশানকে বসতে বললেন।

‘জিশান, তোমাকে এখন ডেকেছি গেম সিটির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্যে। তুমি তো জানো, পরশু কিল গেম খেলাটা গেম সিটিতে-ই হবে।’ শ্রীধর ডানপাশে ফিরে ওঁর চাকরবাকর দুজনকে হাতের ইশারা করলেন। সঙ্গে-সঙ্গে কম্পিউটারের মেগা স্ক্রিন জীবন্ত হয়ে উঠল। সেখানে ধীরে-ধীরে গুগল ম্যাপের মতো একটা রঙিন মানচিত্র ফুটে উঠল।

চারদিক পাঁচিল দিয়ে ঘেরা একটা চৌকো এলাকা। তার মধ্যে গাছপালা, নদী, ঘরবাড়ি—এরোপ্লেন থেকে নীচের দিকে তাকালে ঠিক যেমন দেখায়।

শ্রীধর বললেন, ‘এটা আমাদের গেম সিটি—টুয়েন্টি কিলোমিটার বাই টুয়েন্টি কিলোমিটার। চারশো স্কোয়ার কিলোমিটার এলাকা। পরশুদিন ভোর ছ’টা থেকে পরদিন ভোর ছ’টা পর্যন্ত—মানে, চব্বিশ ঘণ্টা—এটা তোমার এলাকা।’ ছোট্ট করে মুচকি হেসে আরও যোগ করলেন : ‘এই এলাকায় ওই চব্বিশ ঘণ্টায় তুমি যা খুশি করতে পারো—আর তোমার যা খুশি হতে পারে…।’

শ্রীধরের কথার নিহিত অর্থ বুঝতে জিশানের এতটুকুও অসুবিধে হল না। ওঁর দিকে তাকিয়ে দেখল, শ্রীধর ঠান্ডা চোখে জিশানের দিকে চেয়ে আছেন, কিন্তু ওঁর ঠোঁটের কোণে হাসি।

কয়েক সেকেন্ড পর শ্রীধর কম্পিউটার অপারেটরদের দিকে তাকিয়ে আঙুলে টুসকি দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে একজন অপারেটর টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। একটা ক্যাবিনেটে-র ভেতর থেকে একটা অপটিক্যাল ট্যাবলেট বের করে নিল। অন করে নানান বোতাম টিপে সেট করে দিল। ট্যাবলেটের স্ক্রিটে গেম সিটির হাই রিজোলিউশন কালার ইমেজ ফুটে উঠল।

লোকটি জিশানের কাছে এল। পাশে বসে ট্যাবলেটটা ওর হাতে দিল। ঠিক যেন ষোলো ইঞ্চি ডায়াগনালের একটা ফ্রেমে বাঁধানো ফটো।

শ্রীধর পাট্টা বললেন, ‘এটা তোমার। তোমার কাছেই থাকবে। সোমবার ভোর ছ’টা পর্যন্ত। এতে গেম সিটির যে-কোনও অংশের ছবি দেখতে পাবে। ছবি তোমার ইচ্ছেমতো জুম করতে পারবে। তা ছাড়া ছবিগুলো সবই থ্রি ডায়মেনশন্যাল ইমেজ। তাই হাই-ফাই ভিডিয়োগেমের মতো তুমি যে-কোনও অবজেক্টের—মানে, ঘরবাড়ি, গাছপালার চারিদিকে ঘুরে-ঘুরে দেখতে পারবে। কোনও বাড়ির জানলা কিংবা দরজা দিয়ে খুশিমতো ভেতরে ঢুকে যেতে পারবে। বাড়ির ভেতরের লোকজন, সিচুয়েশান, সবই দেখতে পাবে। ফলে তোমার কিলাররা যদি কোনও বাড়ির ভেতরে ঢুকে লুকিয়ে থাকে, তুমি ইচ্ছে করলেই তাদের খুঁজে বের করতে পারো…।’

লোকটি তখন জিশানকে ট্যাবলেটের অপারেশন দেখিয়ে দিচ্ছে। জিশান ওর রোববারের ‘এলাকা’-র রঙিন ছবি খুঁটিয়ে দেখছিল। কী স্পষ্ট, নিখুঁত ছবি! হাত দিয়ে ছুঁতে ইচ্ছে করে, এমন বাস্তব!

শ্রীধর খুকখুক করে কাশলেন।

‘তবে, জিশান—মনে রেখো, একইরকম অপটিক্যাল ট্যাবলেট ওই তিনজন কিলারের কাছেও থাকবে। ওরাও তোমাকে সবসময় ওয়াচ করবে, চোখে-চোখে রাখবে। তা না হলে খেলাটা ঠিক জমবে না—সমানে-সমানে হবে না। কী বলো?’ প্রশ্নটা করে হাসলেন। তবে হাসিতে কোনও শব্দ ছিল না।

জিশান কোনও কথা বলল না। রোবটের মতো মুখ করে বসে রইল। আড়চোখে একবার শ্রীধর পাট্টার চোখের দিকে তাকিয়েছিল। তখন শ্রীধরের চোখে ও বিকৃত উল্লাস দেখতে পেয়েছিল।

অপটিক্যাল ট্যাবলেটের ডেমো চলছিল। জিশান ওর সমস্ত মনোযোগ একজোট করে ট্যাবলেটের অপারেশন শিখছিল। ওর মস্তিষ্কের সব নিউরোন সজাগ হয়ে সমস্ত তথ্য স্মৃতিকোষে সঞ্চয় করে নিচ্ছিল।

জিশান সত্যি-সত্যি নিজেকে একটা রোবট বলে ভাবছিল, এবং রোবটের দক্ষতায় ও অপটিক্যাল ট্যাবলেটের অপারেশন নিখুঁতভাবে শিখতে চাইছিল।

ট্যাবলেটের অপারেশন শেখার কাজ মোটামুটিভাবে শেষ হওয়ার পর কম্পিউটার অপারেটর ভদ্রলোক ট্যাবলেটটা অফ করে একটা ছোট ম্যানুয়াল জিশানের হাতে দিলেন। বললেন, ‘এই টার্বো ম্যানুয়ালটা সঙ্গে নিয়ে আপনি যদি ঘণ্টাখানেক এই ট্যাবলেটটা অপারেট করেন তা হলে এর নানান অপারেশান আপনার চটজলদি রপ্ত হয়ে যাবে।’

জিশান শুধু ছোট্ট করে মাথা নাড়ল—কিছু বলল না।

টেবিলে নীল রঙের একটা পলিব্যাগ রাখা ছিল। তার গায়ে সুপারগেমস কর্পোরেশনের লোগো। ট্যাবলেটের ম্যানুয়ালটা সেই পলিব্যাগে ঢোকানোর জন্য অপারেটর ভদ্রলোক জিশানকে ইশারা করলেন।

ম্যানুয়ালটা ব্যাগে ঢোকানোর পর জিশান ট্যাবলেটটাও সেখানে ঢোকাতে যাচ্ছিল, কিন্তু শ্রীধর পাট্টা ওকে থামতে ইশারা করলেন।

‘ট্যাবলেটের কাজ এখনও বাকি আছে, জিশান।’

জিশানের হাত থমকাল। শ্রীধরের মুখের দিকে তাকাল ও।

‘ট্যাবলেটটা উলটে দ্যাখো—তা হলেই বুঝতে পারবে…।’ ঘাড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দ্বিতীয় কম্পিউটার অপারেটরের দিকে তাকালেন শ্রীধর। আঙুল নাচিয়ে তাঁকে জিশানের কাছে আসতে বললেন।

ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। একইসঙ্গে প্রথম অপারেটর জিশানের পাশ থেকে উঠে নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার জন্য রওনা হলেন।

শ্রীধর কোটের পকেট থেকে ছোট্ট একটা শিশি বের করলেন—ওঁর নেশার শিশি। ঘরের সিলিং-এর দিকে মুখ তুলে দু-ফোঁটা তরল মুখে ঢাললেন। জিভ টাকরায় ঠেকিয়ে শব্দ করলেন দুবার। ওঁর গাল আর নাকের ডগা লালচে হয়ে উঠল। চোখে ঝলসে উঠল নতুন দীপ্তি।

জিশান ট্যাবলেটটা উলেটে ফেলেছিল। অবাক হয়ে দেখল, উলটোদিকেও একটা পরদা। তবে সেটা এখন অন্ধকার।

ট্যাবলেটের দু-দিকেই পরদা থাকার ব্যপারটা জিশানকে বেশ চমকে দিয়েছিল। এরকম ‘দু-মুখো কম্পিউটার’ ও আগে কখনও দেখেনি। ওল্ড সিটির মিউজিয়ামে একবার ও একটা জিনিস দেখেছিল। খুব পুরোনো কালের একটা রাইটিং গ্যাজেট—বাচ্চাদের লেখার জন্য। গ্যাজেটটার নাম ‘স্লেট’। তার ওপরে সাদা রঙের একটা রাইটিং স্টিক দিয়ে লেখা যায়। ব্ল্যাক স্লেটের ওপরে হোয়াইট মার্ক পড়ে। সেইসব লেখা আবার ভিজে কাপড় দিয়ে মুছে ফেলা যায়।

এই ট্যাবলেটের ব্যাপারটা ঠিক যেন সেই স্লেটের মতো।

দ্বিতীয় কম্পিউটার অপারেটর ততক্ষণে জিশানের পাশটিতে এসে বসে পড়েছেন। রোগা, বেশ লম্বা, চোখে চশমা, গালে চাপদাড়ি।

‘জিশান, ট্যাবলেটের এই দিকটা হচ্ছে একটা ট্র্যাকার…’ ভদ্রলোক শান্ত মিহি গলায় বললেন, ‘হাই-ফাই ইলেকট্রনিক ট্র্যাকার…।’

‘ট্র্যাকার?’ জিশানের অজান্তেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।

‘হ্যাঁ—ট্র্যাকার।’ ভদ্রলোক ঠোঁটের কোণে হাসলেন : ‘স্টেট অফ দ্য আর্ট টেকনোলজি। কিল গেমের সময় এই ডিভাইসটা আপনাকে দারুণ হেলপ করবে। গেম সিটিতে যখন গেম স্টার্ট হবে তখন থেকেই এটা অ্যাক্টিভ হয়ে যাবে। এর এল.সি.ডি. স্ক্রিনে গেম সিটির টোপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ ফুটে উঠবে। তার ওপরে সুপারইমপোজড থাকবে কো-অর্ডিনেট গ্রিড…।’ কথা বলতে-বলতে জিশানের হাতে ধরা ট্যাবলেটের একটা বোতাম টিপে দিলেন ভদ্রলোক।

একটা ছোট্ট ‘বিপ’ শব্দ করে ট্র্যাকার অন হয়ে গেল। সেখানে ফুটে উঠল গেম সিটির রঙিন ম্যাপ—তার ওপরে সাদা উজ্জ্বল রেখা দিয়ে ছক কাটা গ্রিড ম্যাট্রিক্স। ফলে গেম সিটির ছবিটা দাবার ছকের মতো চৌষট্টিটা চৌকো খোপে ভাগ হয়ে গেল।

ঠিক একই ছবি দেওয়ালের জায়ান্ট স্ক্রিনে ফুটে উঠল। জিশান সেদিকে একপলক তাকিয়ে আবার হাতের ডিভাইসটার দিকে চোখ রাখল।

ভদ্রলোক ছবিটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে শুরু করলেন।

‘এটা টাচ স্ক্রিন অপারেটেড। স্রেফ আঙুলে ছুঁয়ে আপনি এর যে-কোনও একটা স্কোয়ার টাইলকে জুম করে ক্লোজ-আপ ভিউ পেতে পারেন। আবার ইচ্ছেমতো নরমাল সাইজে ফেরাতে পারেন।’ ভদ্রলোক আঙুল ছুঁইয়ে ছবির দুটো স্কোয়ার ব্লককে ক্লোজ-আপ-এ নিয়ে এলেন, আবার নরমাল সাইজে ফিরিয়ে দিলেন।

জিশান খুঁটিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ করছিল। রঙিন ম্যাপের নানান জায়গায় নানান রং। যেখানে গাছপালা জঙ্গল সেখানে সবুজ আর গাঢ় সবুজের বহুরকম শেড দিয়ে গাছপালার ছবি আঁকা আছে। পাহাড়ের জায়গায় ধূসর আর সবুজে আঁকা রয়েছে পাহাড়। এ ছাড়া রয়েছে নদী, বাড়ি-ঘর, রাস্তা, পার্ক, পুকুর, আরও কত কী!

সবমিলিয়ে কুড়ি কিলোমিটার বাই কুড়ি কিলোমিটার একটা মিনি শহর।

জিশানের পাশে বসা ভদ্রলোক প্রায় সবক’টা খোপ জুম করে-করে জিশানকে সব বুঝিয়ে বলছিলেন। জিশান মনোযোগী ছাত্রের মতো শুনছিল। ও খেয়াল করল, গেম সিটির নানান অঞ্চল সুন্দরভাবে ছবি এঁকে বোঝানো থাকলেও বাড়তি সুবিধে হিসেবে নীচে এক কোণে লেজেন্ড টেবল রয়েছে—ম্যাপে যেমন থাকে।

ট্র্যাকারটা দেখতে-দেখতে জিশান শুধু একটা কথাই ভাবছিল : ছবিটা তো গেম সিটির ইলেকট্রনিক ম্যাপ—এর মধ্যে ট্র্যাকিং-এর ব্যাপারটা কোথায়, আর কিল গেমের সময় ডিভাইসটা কীভাবেই বা ওকে হেলপ করবে?

জিশান যেন একটা হেলিকপটার থেকে গেম সিটিকে দেখতে পাচ্ছিল। একইসঙ্গে দেখতে পাচ্ছিল, গেম সিটিতে ও ছুটছে—ছুটে পালাচ্ছে—তিনজন কিলারের কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছে।

ভদ্রলোকের দেওয়া ডেমো শেষ হলে পর জিশান ওঁকে প্রশ্নটা করল।

‘ডিভাইসটার নাম ট্র্যাকার কেন? ওটা কী ট্র্যাক করবে?’

‘তোমাকে ট্র্যাক করবে, জিশান/তুমি হবে তিনজন খুনির প্রাণ।’ কথাগুলো বলতে-বলতে আচমকা উঠে দাঁড়ালেন শ্রীধর পাট্টা। ঠোঁটে বাঁকা হাসি।

আয়েশি পা ফেলে টেবিলের ওপাশে চলে গেলেন। জিশানের ঠিক বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ালেন।

‘রোবট’ জিশান শ্রীধরের দিকে তাকাল। কারণ, শ্রীধরের বলা কথার মধ্যে থেকে কিল গেমের দরকারি তথ্যগুলো ছেঁকে নেওয়া দরকার এবং ঠিকঠাকভাবে সেগুলো মাথায় রাখাটা জরুরি।

শ্রীধর বলতে শুরু করলেন। ঠোঁটের কোণ সামান্য বেঁকে গিয়ে একটা তেরছা হাসির আভাস তৈরি করেছে।

‘আসলে, জিশান, তোমার প্রাণ ওই তিনজন খুনির প্রাণ। মানে, তোমার প্রাণ নিতে পারলে ওরা তিনজনে প্রাণ ফিরে পাবে। ওদের ডেথ সেন্টেন্স মকুব করে দেওয়া হবে। ওদের হাতে বাইশ ঘণ্টা সময় আছে তোমাকে মারার জন্যে। আর তোমার হাতেও সেই বাইশ ঘণ্টা—তবে বাঁচার জন্যে।’ অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাতাসে হাত নাড়লেন শ্রীধর। তারপর : ‘এবার ভালো করে শোনো। কিল গেম শুরু হওয়ামাত্র এই ইলেকট্রনিক ট্র্যাকার অ্যাক্টিভেটেড হয়ে যাবে। তখন গেম সিটির ওই রঙিন ম্যাপের ভেতরে একটা সবুজ আলোর ফুটকি দেখা যাবে। ফুটকিটা কম্পিউটারের কারসরের মতো দপদপ করবে।

‘ওই সবুজ আলোর ফুটকিটা হলে তুমি। তুমি গেম সিটির ঠিক যে-লোকেশানে আছ ফুটকিটা ম্যাপে ঠিক সেই খোপের মধ্যে দপদপ করে জ্বলবে। তুমি চলতে শুরু করলে হুবহু তোমার চলার পথ ধরে ফুটকিটাও চলতে শুরু করবে। মানে, ওই গ্রিন ডটটা তোমার পজিশানকে ট্র্যাক করবে। দারুণ টেকনোলজি, না?’ শব্দ করে হাসলেন মার্শাল। তারপর চুপচাপ টেবিলের দৈর্ঘ্য বরাবর আলতো পায়চারি করে চললেন।

কম্পিউটার অপারেটর ভদ্রলোক ট্যাবলেটের বোতাম টিপে একটা ডেমো প্রাোগ্রাম চালু করে দিলেন। একটা সবুজ আলোর ডট ব্লিংক করতে-করতে ট্র্যাকারের পরদায় ঘুরে বেড়াতে লাগল।

দুবার কাশির শব্দ করে জিশানের মনোযোগ চাইলে শ্রীধর।

জিশান ওঁর দিকে তাকালে আবার বলতে শুরু করলেন।

‘এইরকম ট্র্যাকার তিনজন খুনির হাতে একটা করে থাকবে। ওরা এই ট্র্যাকারে তোমার ডায়ানামিক পজিশান সবসময় জানতে পারবে। তোমার পজিশান জেনে নিয়ে ওরা ট্র্যাকারের উলটোদিকের অপটিক্যাল ট্যাবলেট অপারেট করবে। এবং তখনই ওরা তোমাকে ছবিতে ধরে ফেলবে।

‘ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশান…আমাদের গেম সিটিতে এক লক্ষ চার হাজার তিনশো বত্রিশটা ক্যামেরা ফিট করা আছে, আর সেগুলো স্মার্ট নেটওয়ার্কিং-এ কানেক্টেড। গেম সিটির সেন্ট্রাল কন্ট্রোল রুম থেকে ক্যামোরা নেটওয়ার্কটা অপারেট করা হয়। এসব এতই হাই-টেক ব্যাপার যে, তুমি কখনওই ক্যামেরার চোখ অ্যাভয়েড করতে পারবে না। কোনও না কোনও ক্যামেরা তোমাকে ক্যাচ করবেই।’

জিশানের ভুরুতে ভাঁজ পড়েছিল। সেটা লক্ষ করে শ্রীধর তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বুঝেছ, জিশান। ওই চব্বিশ ঘণ্টা তোমার প্রাইভেসি বলে কিছু থাকবে না। উই ওয়ন্ট য়ু অন ক্যামেরা অ—ল দ্য টাইম। কারণ, সেই সময়টা নিউ সিটির শো-টাইম।’

জিশান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।

শ্রীধর হাতে হাত ঘষে শীত তাড়ানোর ভঙ্গি করলেন। তারপর আড়চোখে নাটকীয় নজরে জিশানকে দেখলেন।

‘তোমাকে এখনও লাল ডটের কথা বলিনি, জিশান। গেম সিটিতে ঢোকার পর থেকেই ওই তিনজন খুনির পজিশানও ধরা পড়বে এই ট্র্যাকারে। তিনটে লাল ডট—দপদপ করে জ্বলবে-নিভবে। তিনজন মার্ডারারের ডায়নামিক পজিশান। তার মানে কী দাঁড়াল?’ দু-হাতের আঙুল ডগায়-ডগায় ঠেকালেন শ্রীধর। কম্পিউটার অপারেটরের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারা করলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে অপারেটর ভদ্রলোক ট্র্যাকারের আর-একটা বোতাম টিপে দিলেন। আর-একটা ডেমো প্রাোগ্রাম অ্যাক্টিভেটেড হয়ে গেল। তিনটে লাল ডট জন্ম নিল পরদায়। এবং সেগুলো ধীরে-ধীরে সবুজ ডটটার দিকে এগোতে লাগল।

‘আমাদের কিল গেম খুব ফেয়ার গেম। তাই তুমিও সবসময় খুনিদের পজিশান জানতে পারবে। অর্থাৎ, মোট চারটে ব্লিংকিং ডট ঘোরাফেরা করবে এই ট্র্যাকারে—তিনটে লাল, আর একটা সবুজ। কী পছন্দ?’ মুচকি হেসে সরাসরি জিশানের দিকে তাকালেন মার্শাল।

ফেয়ার গেমই বটে! যার নকল সারভাইভাল ফ্যাক্টর 0.07 আর আসল সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.0! চমৎকার! তার ওপর আবার একজনকে খুন করার জন্য তিনজন খুনি। একটা ইঁদুর ধরতে তিন-তিনটে বেড়াল!

যা বোঝার জিশান বুঝে গিয়েছিল। তাই মার্শালের উৎসাহে টুসটুসে মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে রইল—কোনও কথা বলল না।

শ্রীধর আবার নিজের আরামের সোফায় ফিরে গেলেন। অপারেটর দুজনকে বললেন, আরও অন্তত আধঘণ্টা ওঁরা যেন জিশানকে অপটিক্যাল ট্যাবলেটের আর ট্র্যাকারের ট্রেনিং দেন।

শ্রীধর সোফার হাতলে বসানো একটা ছোট্ট বোতামে চাপ দিলেন। সঙ্গে-সঙ্গে খুব আলতো ভলিয়ুমে মিউজিক বাজতে শুরু করল। বিলম্বিত লয়ের বিষণ্ণ সুর।

সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন শ্রীধর। কিল গেম আসছে। শরীরের প্রতিটি রোমকূপে তার আগমনী বার্তা টের পাচ্ছেন। প্রতিটি রক্তকণিকায় যেন ফাগুনের আগুন—অথচ ফাগুন এখনও অনেক দূরে।

বড় করে শ্বাস টানলেন। চোখ বুজেও গেম সিটিকে দেখতে পেলেন। যেন খুন-খুন খেলা চলছে চোখের সামনে। আর শুনতে পেলেন উত্তেজিত জনতার উত্তেজনা উল্লাসের চিৎকার।

এবারের কিল গেমে আয়োজনের কোনও ত্রুটি রাখেননি শ্রীধর। প্রচারের জন্য সবরকম মিডিয়াকে চূড়ান্তভাবে ব্যবহার করেছেন। ফলে বিজ্ঞাপনও পেয়েছেন প্রচুর—কম করেও কয়েক লক্ষ কোটি টাকা। তার পাশাপশি দর্শকদের প্রত্যাশাও পৌঁছে গেছে তুঙ্গে। এর আগে কোনও কিল গেমে প্রত্যাশার পারদ এতটা ওপরে চড়েনি। বিজ্ঞাপনের আয়ও হয়েছে এবারের তুলনায় অনেক কম।

শ্রীধরের ধারণা এবারের কিল গেম হতে চলেছে সবার সেরা। এবারের কিল গেম ইতিহাস তৈরি করবে।

তার একটা বড় কারণ অবশ্যই জিশান। জিশান পাল চৌধুরী।

চোখ খুলে জিশানের দিকে তাকালেন। কিল গেমের জনপ্রিয়তার কিস্তিমাতের ঘুঁটি।

কম্পিউটার অপারেটর দুজন সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। জিশানের আধঘণ্টার ট্রেনিং কয়েক মিনিট হল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ওঁরা মার্শালের নির্দেশের অপেক্ষা করছিলেন। মার্শালের চোখ খোলার অপেক্ষা করছিলেন।

শ্রীধর ইশারায় ওদের ছুটি দিলেন। ওঁরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

জিশান অপটিক্যাল ট্যাবলেট আর সব ম্যানুয়াল পলিব্যাগে ঢুকিয়ে নিল।

‘জিশান, তুমি এবার আমার কাছে এসে বোসো—প্লিজ।’ মার্শাল ইশারায় ওকে কাছে ডাকলেন, ‘তোমার সঙ্গে অনেকগুলো জরুরি কথা সেরে নেওয়ার আছে।’

জিশান পলিব্যাগটা সাবধানে টেবিলের ওপরে রাখল। তারপর শ্রীধরের কাছে গিয়ে বসল।

আবার হাতে হাত ঘষলেন শ্রীধর। তারপর ডানহাতের আঙুলের ডগা দিয়ে কপালের পাশে কয়েকবার চাপ দিলেন।

‘তোমার সঙ্গে আজকে আমার শেষ মিটিং, জিশান…’ একটু থামলেন। তারপর : ‘…কিল গেমের আগে। আর…মানে…কিল গেমের পর দেখা হবে কি না সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। তুমি যদি গেম সিটিতে চব্বিশ ঘণ্টা টিকে যাও তা হলে দেখা হবে। এ ছাড়া তুমি যদি তিনজন কিলারকে চব্বিশ ঘণ্টার আগেই খতম করতে পারো তা হলে আরও আগে আমাদের দেখা হতে পারে।’

জিশান চুপ করে রইল।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শ্রীধর পাট্টা আবার বলতে শুরু করলেন।

‘ট্র্যাকারের লাল ডট আর সবুজ ডটের ব্যাপারটা তোমাকে বুঝিয়ে দিয়েছি, কিন্তু এটা বলিনি যে, তোমাদের ডায়নামিক পজিশন ওই ওয়ারলেস ট্র্যাকারে ধরা পড়বে কেমন করে।

‘আসলে ব্যাপারটা খুব সিম্পল। আগামীকাল তোমাদের চারজনের বডিতে একটা করে মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। তারই সিগন্যাল ট্র্যাকারে ধরা পড়বে। তবে চিন্তার কিছু নেই। খুব ছোট্ট অপারেশান। কী, ঠিক আছে?’

জিশান কোনও কথা বলল না। শ্রীধরের ঠান্ডা চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।

পাঁচদিন আগেই ওর কন্ট্রোল ফ্রিডমের ব্যবস্থাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর একইসঙ্গে শুরু হয়েছে কড়া নজরদারি। জিশানকে কিল গেম ফাইনালিস্টের স্পেশাল কোয়ার্টারে শিফট করে দেওয়া হয়েছে। সিকিওরিটি গার্ডরা ওকে রাউন্ড দ্য ক্লক প্রাোটেকশন দিচ্ছে, যাতে কেউ ওর কোনওরকম ক্ষতি করতে না পারে। সকাল-বিকেল ওর অ্যানালগ জিম, ডিজিটাল জিম আর মেডিক্যাল চেক আপ চলছে। ট্রেনাররা ওকে ট্রেইন করছে। ডায়েটিশিয়ানদের পরামর্শ মতো ওর খাওয়ার মেনু ঠিক করা হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায় চলছে সবকিছু।

‘শোনো, জিশান। তোমার ওই ছোট্ট অপারেশানটা করা হবে কাল বিকেল চারটের সময়। অপারেশানটা এমন যে, তুমি কিছু টেরই পাবে না। তাঁর ব্যথা-ট্যাথাও কিছুই হবে না। তারপর আমাদের টেকনিক্যাল টিম আর মেডিক্যাল টিম ট্র্যাকিং-এর ব্যাপারটা চেক করে দেখবে। ব্যস, তারপর তুমি রেডি!’ কথাটা বলে পাতলা ঠোঁটের ওপরে আঙুল বোলাতে লাগলেন শ্রীধর। মনে-মনে বোধহয় তিনি ছুটন্ত জিশানকে গেম সিটিতে দেখতে পাচ্ছিলেন।

‘রোববার ভোর চারটের সময় কিল গেম অপারেশান টিম তোমার কোয়ার্টারে যাবে। তোমাকে ওরা নিয়ে যাবে আরমারি ইউনিটে। সেখানে তুমি তোমার পছন্দসই অস্ত্রশস্ত্র বেছে নেবে—যা তোমার প্রাণ চায়। আর বেছে নেবে তোমার মনের মতো পোশাক।

‘তারপর তুমি গিয়ে হাজির হবে ”লাস্ট স্টপ” চেম্বারে। গেম সিটিতে ঢুকে পড়ার আগে তুমি যাদের সঙ্গে শেষবারের মতো দেখা করতে চাও তারা সেখানে আসবে তোমাকে উইশ করতে। তারপর আবার ফাইনাল মেডিক্যাল চেক আপ। সেটা শেষ হলেই তুমি গেম সিটিতে ঢুকে পড়বে।’ শ্রীধর পাট্টা উঠে দাঁড়ালেন। হাতের একটা ভঙ্গি করে বললেন, ‘তুমি কোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে তোমার দেখা করতে চাওয়ার উইশ লিস্টটা সিকিওরিটি চিফের হাতে দিয়ে দিয়ো। রোববার ভোর পাঁচটার সময়ে তাদের ”লাস্ট স্টপ” চেম্বারে হাজির করানোর জন্যে আমি হার্ট অ্যান্ড সোল চেষ্টা করব। তবে হ্যাঁ—নো ফ্যামিলি।’ হাসলেন শ্রীধর : ‘কারণ, তোমার ওয়াইফ আর ছেলেকে যদি তোমার সঙ্গে দেখা করানোর জন্যে ওল্ড সিটি থেকে নিয়ে আসা হয় তা হলে, আই অ্যাম শিয়োর, তোমার পক্ষে সেটা ডেঞ্জারাসলি হার্মফুল হবে—কারণ, তোমার কনসেনট্রেশান নষ্ট হবে…অ্যান্ড দ্যাট মে কিল য়ু আর্লিয়ার ইন দ্য গেম।’ শ্রীধর হাসলেন।

জিশান উইশ লিস্টটা মনে-মনে তৈরি করা শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু শ্রীধরের শেষ কথাটা শোনামাত্র ও থমকে গেল। লিস্টের গোড়া থেকে মিনি আর শানুর নামটা ও মনে-মনে কেটে দিল।

পরপর অনেক নামই ওর মনে পড়তে লাগল। মনোহর সিং, ফকিরচাঁদ, পান্ডা, মূর্তি, রিমিয়া, গুনাজি, ডক্টর রঙ্গপ্রকাশ বিশ্বাস, প্যাসকো, সুধাসুন্দরী, আর খেলার মাঠে আলাপ হওয়া সেই গার্ড—যার বাড়ি নাহাইতলা গ্রামে।

তবে এদের মধ্যে কেউ আছে, কেউ নেই। মনোহর সিং, ফকিরচাঁদ…আরও কে-কে আছে বা নেই কে জানে!

জিশানের মনে পড়ল, গার্ড বলেছিল, ওর গ্রাম ছবির মতো—সুন্দর, শান্ত, নরম।

ছেলেটা আরও বলেছিল, ভগবানের ভরসায় বসে থাকলে হবে না। যা করার মানুষকেই করতে হবে।

তেইশ-চব্বিশের ছেলেটার মুখটা জিশানের চোখের সামনে ভেসে উঠল। সত্যি, ও যদি শেষবারের মতো দেখা করতে আসে—শেষ সময়ে—তা হলে জিশানের খুব ভালো লাগবে। আর এই ভালো লাগাটা ওকে কিল গেমে লড়াই করার শক্তি জোগাবে।

একইসঙ্গে জেহাদি সিকিওরিটি গার্ড পান্ডার মুখটাও দেখতে পেল জিশান। বড়-বড় নেশাতুর চোখ মেলে ওর দিকে তাকিয়ে পান্ডা বলেছিল, ‘জিশানের শেষ নেই।’

১ সেপ্টেম্বর। শনিবার। আর মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা। তারপরই শুরু হবে জিশানের তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিটের লড়াই। অথবা তেইশ ঘণ্টা ঊনষাট মিনিট ষাট সেকেন্ডের লড়াই।

কিল গেম ফাইনালিস্টের স্পেশাল কোয়ার্টারে চুপচাপ বসে ছিল জিশান। খোলা জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। আকাশটাকে এক মনে উপভোগ করছিল।

আকাশটা কী শান্ত, মসৃণ, নীল! কী সুন্দর!

জিশানের অবাক লাগছিল। আকাশটাকে কখনও ও এত মনোযোগ দিয়ে উপভোগ করেনি। আজ মনে হচ্ছে, আকাশটার দিকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ে থাকলেও ওর দেখা ফুরোবে না। আজ ওর ঘণ্টা, মিনিট গোনা হয়ে গেছে। গোনা হয়ে গেছে নিশ্বাস-প্রশ্বাসও। তাই হয়তো আজ এই মুহূর্তের ভালো লাগাটা অফুরান।

বিছানায় এসে বসল জিশান। এমন আরামের বিছানা, যেন মেঘ দিয়ে তৈরি। আরাম আর বিনোদনের সমস্ত উপকরণ ঘরের মধ্যে হাজির। কী নেই এখানে! মাত্র সাতদিনের অতিথিশালা হলেও এখানে প্রকাণ্ড মাপের প্লেট টিভি রয়েছে। আর তার সঙ্গে কালার প্রিন্টার।

এই কোয়ার্টারে কোনও ইলেকট্রিক্যাল বা ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের কোনও সুইচ নেই। সবই ভয়েস অ্যাক্টিভেটেড। ঠিকঠাক সেন্সরের সামনে গিয়ে ‘অন’ কিংবা ‘অফ’ বললেই কাজ হয়ে যায়।

এই সাতদিন এই স্পেশাল কোয়ার্টারের আরাম, বিলাস বোধহয় শুধু রূপকথাতেই পাওয়া যায়! আর আগামীকালের ভয়ঙ্কর রুক্ষ নিষ্ঠুর লড়াই—সেটাও বোধহয় আর-এক রূপকথা।

স্পেশাল কোয়ার্টারের চারিদিকে, আনাচেকানাচে, চোখ বুলিয়ে নিল জিশান। এই মনোরম মোলায়েম স্বাচ্ছন্দ্য আর আরামের নামই কি সুখ? না, নিশ্চয়ই নয়। তাই যদি হত, তা হলে ওল্ড সিটির গরিব মানুষের বস্তিতে জিশান, মিনি আর শানু যেখানে থাকে, সেখানে সুখ থাকত কেমন করে! ‘থাকত’, কারণ, এখন আর নেই। যেহেতু জিশান মিনি আর শানুর কাছে এখন নেই।

একটা কবিতার কথা মনে পড়ল জিশানের। মাত্র দুটো লাইন :

‘সুখ পড়ে আছে এখানে-ওখানে ঘরের কোণে,

খুঁজে নিতে হয় তাকে জেনো অতি সঙ্গোপনে।’

বস্তির সেই হতদরিদ্র ঘরে ঠিক এইভাবেই সুখ খুঁজে নিত জিশান আর মিনি। কালকের চব্বিশ ঘণ্টার দিনটা পার করে আবার ওল্ড সিটিতে ফিরবে জিশান। তারপর আবার ওরা দুজনে রোজ খুঁজে নেবে সুখের মণিকণা।

গতকাল রাতে মিনির সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেছে জিশান। কথা বলেছে শানুর সঙ্গেও।

মাইক্রোভিডিয়োফোনে অনেক টকটাইম তিল-তিল করে জমিয়ে রেখেছিল। মনে-মনে ভেবে রেখেছিল, কিল গেমের আগে শেষবারের মতো যখন মিনির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পাবে, তখন এই জমানো টকটাইম প্রাণ ভরে খরচ করবে।

গতকাল সকালে শ্রীধর পাট্টা জানিয়ে দিয়েছিলেন, শুক্রবার রাত বারোটার মধ্যে এম-ভি-পি শেষবারের মতো ব্যবহার করতে হবে। আর শনিবারটা হচ্ছে ‘লাল পিরিয়ড’—সাইক্লোনের আগে খানিকটা সময় যেমন গুমোট থাকে, থাকে থমথমে স্তব্ধতা, ঠিক সেইরকম। তারপরই রবিবার, কিল গেমের সাইক্লোন।

শ্রীধর আরও বলেছিলেন, শনিবার দিনটা জিশানের মনোসংযোগের জন্য। মন থেকে সমস্ত আজেবাজে চিন্তা সরিয়ে ওকে শুধুই কিল গেমের কথা ভাবতে হবে।

অথচ এখন, কাল রাতে মিনির সঙ্গে কথা বলার সময়টুকুর ছবি জিশানের মনে ভেসে উঠছিল।

‘মিনি!’

মাইক্রোভিডিয়োফোনের পরদায় মিনিকে দেখতে পাচ্ছিল জিশান। মিনিকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। ওর কোলে বসে আছে শানু। সেই কারণেই হয়তো মিনিকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে।

শানু কত বড় হয়ে গেছে! আধো-আধো কথার টুকরো বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে।

জিশান ছেলের নাম ধরে ডেকে উঠল : ‘শানু! শানু!’

শানু অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বুড়ো আঙুল চুষছিল। জিশানের ডাকে ঘুরে তাকাল।

এম-ভি-পি-র পরদায় বাবা আর ছেলের চোখাচোখি হল। জিশান আবেগে কেঁপে উঠল। ছেলের চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে আদরের অর্থহীন শব্দ করতে লাগল। শানুও বাবার অর্থহীন শব্দের উত্তরে আরও অর্থহীন, আরও দুর্বোধ্য সব শব্দ ফিরিয়ে দিল।

মিনির চোখ ভিজে উঠেছিল। ওড়না দিয়ে চট করে চোখ মুছে নিল ও।

জিশানও চোখ মুছল। বলল, ‘শানু কীসব বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!’

মিনি অল্প হেসে বলল, ‘ও বলছে, কিল গেমে তোমাকে জিততে হবে। তারপর কিল গেমকে চিরকালের মতো খতম করতে হবে…।’

জিশান ধরা গলায় বলল, ‘তুমি মনে-মনে আমার সঙ্গে থাকলে নিশ্চয়ই পারব…।’

‘শানু তোমাকে কাঁদতে বারণ করছে।’

জিশান চোখ মুছল আবার। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করল।

‘না, আর কাঁদব না। শ্রীধর পাট্টা ঠিকই বলেছে : এতে আমার কনসেনট্রেশন নষ্ট হবে। কিল গেমে ভালো করে লড়তে পারব না…।’

আচমকা মিনি বলল, ‘জিশান, আজ আর কথা নয়…তোমার সঙ্গে পরে কথা বলব…।’

জিশান তাড়াতাড়ি বলে উঠল : ‘মিনি, মিনি! কিল গেমের আগে আজই তোমার সঙ্গে শেষ কথা। শ্রীধর আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। কাল তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলতে দেবে না—।’

‘জানি। সুপারগেমস কর্পোরেশন আমাকেও ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়েছে।’ নিজেকে শক্ত করল মিনি : ‘সেইজন্যেই আমি অনেক কথা বাকি রাখতে চাইছি। বাকি কথাগুলো আমি বলতে চাই কিল গেমের পর…।’

জিশান প্রথমটায় ব্যথা পেলেও পরে বুঝতে পারল মিনি আসলে কী বলতে চাইছে।

‘আমি এখন কানেকশন কেটে দিচ্ছি, জিশান। সোমবার যদি তুমি আমার সঙ্গে কথা না বলো তা হলে জীবনে তোমার মুখ দর্শন করব না। কথাটা মনে থাকে যেন!’

তারপর সত্যি-সত্যিই কানেকশন কেটে দিল মিনি।

মিনির না বলা গোপন কথা জিশান বুঝতে পারল। এম-ভি-পি-র শূন্য পরদার দিকে তাকিয়ে জিশানের মনে হল, মিনি শেষ কথাটা যা বলল তার বদলে এ-কথাও বলতে পারত : ‘…সোমবার যদি তুমি আমার সঙ্গে কথা না বলো তা হলে তোমার মরা মুখ দেখব।’

না, জিশান নিজের মরা মুখ মিনিকে দেখাতে চায় না। আর সেইজন্যই দরকার মনোযোগ—সূচিতীক্ষ্ণ মনোযোগ। যে-মনোযোগ থাকলে ওর সারভাইভাল ফ্যাক্টরটা 0.5-এর বেশি হতে পারে।

এখন বসে-বসে সেই কথাই ভাবছিল জিশান।

মিনি। অর্কনিশান। জিশান। কনসেনট্রেশন। কনসেনট্রেশন।

এই পাঁচটা শব্দ জিশানকে মনের ভেতরে সাইক্লিক অর্ডারে ঘুরছিল। আর বারবার ভেবে মরছিল, ওই তিনজন খুনিকে ও কীভাবে বাইশ ঘণ্টা ধোঁকা দেবে।

সকাল ছ’টা থেকে আটটা—এই দু-ঘণ্টা—গেম সিটি থাকবে জিশানের একার দখলে। তারই মধ্যে জিশানের লড়াইয়ের ময়দানটা দেখেশুনে নিতে হবে।

শ্রীধর পাট্টা বলেছেন, গেম সিটির নানান জায়গায় দাঁড় করানো থাকবে অনেক গাড়ি আর মোটরবাইক। সেগুলোর ফুয়েল ট্যাঙ্ক ভরতি থাকবে। ট্যাঙ্কের ঢাকনা সিল করা থাকবে। ইগনিশনে লাগানো থাকবে গাড়ির চাবি—সে-চাবি এমনই যে, কি-হোল থেকে কখনও বের করা যাবে না। সোজা কথায়, তেল না ফুরোনো পর্যন্ত ওই গাড়ি আর বাইকগুলো ওরা চারজন ব্যবহার করতে পারবে। চারজন মানে জিশান, আর তিনজন কিলার।

গেম সিটিতে যেসব মানুষ চব্বিশ ঘণ্টার ‘সিটিজেন’ হয়ে আসবে তারা থাকবে যার-যার নির্দিষ্ট বাড়িতে বা দোকানে। তাদের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো বারণ। যদি কেউ সে-নিয়ম না মানে তা হলে তার ভালোমন্দ কিছু হয়ে গেলে সে-দায়িত্ব মোটেই সুপারগেমস কর্পোরেশনের নয়। তবে যদি কখনও কোনও বাড়ি বা দোকানের ভেতরে জিশান এবং তার শত্রুদের কোনও মোকাবিলা হয় তা হলে সেটা হবে পুরোপুরি অস্ত্রহীন মোকাবিলা। এ-নিয়ম না মানলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও মারাত্মক।

শ্রীধর এইসব নিয়মের কথা বারবার করে চারজনকে বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার সঙ্গে এও বলেছেন, ‘মনে রাখবে, লক্ষ ক্যামেরা প্রতিটি মুহূর্তে তোমাদের লক্ষ করছে। সেইসঙ্গে রয়েছে দেশবিদেশের কোটি-কোটি দর্শক।’

জিশান অপটিক্যাল ট্যাবলেটটা হাতে নিল। ওটা ‘অন’ করে গেম সিটির আনাচকানাচ ভীষণ মনোযোগে দেখতে লাগল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেখেই চলল। পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করার মতো গেম সিটির ভূগোল মুখস্থ করে চলল। কারণ, লড়াইয়ের সময় বারবার ট্যাবলেট দেখে ও দামি সময় নষ্ট করতে চায় না। তাই গেম সিটিকে ও মনের মধ্যে গেঁথে নিতে চায়।

গতকাল শ্রীধরকে জিগ্যেস করেছিল, ‘ওই চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে জল আর খাবার কি সঙ্গে নিতে হবে?’

শ্রীধর হেসে বলেছেন, ‘না। আমি কোয়ালিটি টাইম নষ্ট করতে চাই না। তোমাদের চারজনের জন্যে জল আর খাবারের ব্যবস্থা করেছি ভারী অভিনব কায়দায়, বুঝলে বাবু জিশান! একেবারে হাই-ফাই সুপার-ডুপার টেকনোলজি…।’

‘তার মানে?’ জিশান ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল। মনে-মনে ভাবল, এই পাগল স্যাডিস্ট লোকটা হয়তো গেমের ফান আর এক্সাইটমেন্ট ফ্যাক্টর বাড়ানোর জন্য জল আর খাবারের কোনও ব্যবস্থাই রাখেনি। গেম সিটির জঙ্গলের গাছের ফল, পাতা আর কচি ডালপালা হচ্ছে খাবার, আর জল খাওয়ার জন্য রয়েছে নদীর অগাধ জল।

কিন্তু জিশানকে ভুল প্রমাণ করে শ্রীধর পাট্টা অন্যরকম উত্তর দিলেন। অপটিক্যাল ট্যাবলেটের একটা লালরঙের চৌকো বোতাম দেখিয়ে বললেন, ‘জিশান, এই বোতামটা হচ্ছে ফুড বাটন। এটা টিপলেই তুমি দেখতে পাবে ফুড ম্যাপ। গেম সিটির কোন-কোন পয়েন্টে তোমার ফুড আর ড্রিঙ্কের প্যাক রাখা আছে সেগুলো লাল ব্লিঙ্কিং ডট হিসেবে স্ক্রিনে ফুটে উঠবে। তুমি ইচ্ছে করলেই পিকচার জুম করে পয়েন্টগুলোর ডিটেইলড লোকেশান দেখে নিতে পারবে…।’

‘কিন্তু কিলাররাও তো এই ম্যাপ দেখতে পাবে। তখন ওরা…।’

হাত তুলে জিশানকে থামতে ইশারা করলেন মার্শাল। হেসে বললেন, ‘আমাকে তুমি বোকা ভাব কেন, জিশান? আমি থ্রিলিং ফাইট দেখতে চাই—খাবার চুরির কায়দা-কানুন দেখতে চাই না—’ জিভটা ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে কয়েকবার বের করলেন, ঢোকালেন। সাপের মতো। তারপর : ‘তোমার ফুড ম্যাপ কিলাররা কেউ দেখতে পাবে না। আর ওদের ফুড ম্যাপ ওরা তিনজন দেখতে পেলেও তুমি দেখতে পাবে না—অলরাইট?’

জিশান স্তম্ভিত হয়ে শ্রীধর পাট্টার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা একইসঙ্গে শয়তান এবং জিনিয়াস।

ফুড ম্যাপের ব্যাপারটা জিশানকে জলের মতো বুঝিয়ে দেওয়ার পর শয়তান এবং জিনিয়াসটা ওকে একটা ফাইল দেখিয়েছিল। সেটা আরমারি ইউনিটের হরেকরকম অস্ত্রশস্ত্রের চেক লিস্ট।

এক-একটা অস্ত্রের এক-একরকম কোড নম্বর। নম্বরের পাশে রয়েছে অস্ত্রের রঙিন ছবি আর বিবরণ। তাতে লেখা আছে কোন অস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, তার মাপ কত, ওজন কত, আর মারণ ক্ষমতাই বা কত।

সেই লিস্টের মধ্যে আরও রয়েছে নানান যন্ত্রপাতির খোঁজখবর। যেমন, অটোফোকাস ডায়মন্ড লেন্স, হাই পাওয়ার টেলিস্কোপ, সাউন্ড রিকগনিশন অডিয়োগ্রাফি সিস্টেম, বহু রকমের নাইট-ভিশন ইন্সট্রুমেন্ট, আরও কত কী!

এগুলোর সঙ্গে আগেই জিশানের পরিচয় ছিল। ওর ট্রেনিং-এর সময় যখন ওকে নানান ধরনের লড়াইয়ের কায়দাকানুন শেখানো হচ্ছিল তখন একটু-একটু করে আরমারি ইউনিটের যন্ত্রপাতি আর অস্ত্রশস্ত্রের সঙ্গে ওকে আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন ওকে খুব হিসেব করে যন্ত্র আর অস্ত্র বেছে নিতে হবে। কারণ, এগুলোর সংখ্যা যত বাড়বে, ওজন তত বাড়বে। আর ওজন যত বাড়বে, জিশানের ছোটাছুটি করতে ততই অসুবিধে হবে।

শ্রীধরের কথা মতো আরমারি ইউনিটের চেক লিস্টটার সফট কপি ট্যাবলেটের মেমোরিতে সেভ করে নিয়ে এসেছিল জিশান। আজ রাতে ও আরমারির চেক লিস্টে ‘টিক’ মারতে বসবে। তারপর সেই ‘টিক’ মারা লিস্টটা শ্রীধর পাট্টার কম্পিউটার সিস্টেমে পাঠিয়ে দেবে। তা হলে কাল ভোরে আরমারি ইউনিটে ওর অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি বেছে নিতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। ইউনিটের অফিসাররা আগে থেকেই সব বাছাই করে রাখবেন।

শ্রীধরের চেম্বার থেকে চলে আসার সময় মার্শাল ওকে পিছু ডেকেছেন, ‘জিশান—!’

জিশান পিছন ফিরে তাকিয়েছে ওঁর দিকে।

‘তোমার স্যাটেলাইট ফোন কিন্তু তোমার সঙ্গে থাকবে—আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্যে। শুধু আমি তোমাকে ফোন করতে পারব, আর তুমি আমাকে—আর কেউ নয়। ওকে?’ হাসলেন : ‘আসলে কিল গেমের প্রতিটি মোমেন্টে তোমার আর আমার যোগাযোগ থাকা দরকার—তাই না?’

উত্তরে জিশান শুধু মাথা নেড়েছে। কোনও কথা না বলে চলে এসেছে।

সন্ধে ছ’টার সময় একটা মেডিকেল টিম জিশানের কোয়ার্টারে এল।

মোট চারজন লোক। প্রত্যেকের গায়ে সাদা ইউনিফর্ম। তার ওপরে বড়-বড় হরফে ‘মেডিক’ কথাটা লেখা।

ওদের প্রত্যেকের হাতে পোর্টেবল যন্ত্রপাতি। তার কয়েকটার মধ্যে মনিটর লাগানো রয়েছে।

ওদের একজন জিশানকে সামান্য তোতলা স্বরে বলল, ‘গু-গুড ইভনিং, মিস্টার পাল চৌধুরী। মা-মার্শাল স্যারের ইনস্ট্রাকশনে আ-আমরা একটা ছো-ছোট্ট অপারেশান করতে এসেছি। আ-আপনার বডিতে একটা মা-মা—…।

‘মাইক্রোইলেকট্রনিক ট্রান্সমিটার?’ জিশান হেসে খেই ধরিয়ে দিল।

‘হ-হ্যাঁ। ছো-ছোট্ট অপারেশান। কিল গেমের জন্যে এ-এ-এসেনশিয়াল।’

জিশান জিগ্যেস করল, ‘আমাকে কী করতে হবে?’

‘আ-আপনি কাইন্ডলি বিছানায় শু-শুয়ে পড়ুন—।’

জিশান বিছানার কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

তারপর ওরা চারজন মিলে ওর বাঁ-হাতের ওপরদিকটায় কী যে করল জিশান তার কিছুই টের পেল না, শুধু প্রথমে একটা আলতো পিন ফোটানোর ব্যাপার টের পেয়েছিল।

ঘড়ি ধরে ঠিক কুড়ি মিনিট। তারপরই প্রথম লোকটি জিশানকে বলল, ‘অ-অ-পারেশান কমপ্লিট, মিস্টার পাল চৌধুরী। এবারে আপনি সোজা হয়ে বসতে পা-পারেন।’

জিশান বিছানায় উঠে বসল। অপারেশনের জায়গাটায় হাত দিয়ে দেখল। না:, কোনও ব্যথা-ট্যাথা নেই। তবে টিপলে একটু শক্ত লাগছে।

সেটা লক্ষ করে লোকটি বলল, ‘স্টেট অফ দ্য আ-আর্ট টে-টেকনোলজি। কোনও ব্যথা পাবেন না।’

যন্ত্রপাতি গুছিয়ে নিতে-নিতে লোকটি নীচু গলায় বলল, ‘আ-আমাদের ক্ষ-ক্ষমা করবেন। মার্শাল স্যারের অর্ডার। আমাদের কিছু করার নেই—।’

জিশান শুধু বলল, ‘থ্যাংক য়ু—।’

ওরা চলে যেতেই জিশান আবার ‘পড়াশোনা’ শুরু করল। এখনও ওর পড়া শেষ হয়নি। হাতে আর সময় বেশি নেই। সময় ক্রমশ কমছে।

অনেক রাতে জিশানের ‘পরীক্ষার পড়া’ শেষ হল।

ঘড়ির দিকে তাকাল জিশান : ঘড়ির অর্ধবৃত্তাকার কালো অংশে ছোট কাঁটাটা একের দাগে। রাত একটা বাজে।

জিশানের হাই উঠল। উইশ লিস্টের কথা মনে পড়ল ওর।

কাল রাতে সিকিওরিটি চিফের হাতে ও উইশ লিস্টটা তুলে দিয়েছে। ‘লাস্ট স্টপ’ চেম্বারে লিস্টের ‘বন্ধুদের’ দেখা পেলে ওর খুব ভালো লাগবে। কিল গেমে আরও, আরও, বেশি করে জিততে ইচ্ছে করবে।

জিশান আবার হাই তুলল। পায়ে-পায়ে খোলা জানলার কাছে গেল।

ওই তো আকাশে চাঁদ—দ্বাদশী অথবা ত্রয়োদশীর। কী অপরূপ লাগছে দেখতে! সকালের নীল আকাশের মতো চাঁদকে উপভোগ করতে লাগল জিশান। একইসঙ্গে মনে হল, নিশ্বাস-প্রশ্বাসও যখন গোনা হয়ে গেছে তখন সেটাকেও তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করা যাক।

জিশান বেশ ধীরে-ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে লাগল। শ্বাস টানা কিংবা ছাড়ার প্রক্রিয়ার দিকে তীক্ষ্ণ মনোযোগ দিল। একইসঙ্গে ভাবতে লাগল, ওর শ্বাস-প্রশ্বাসের কোটা যদি নির্দিষ্ট হয়ে গিয়ে থাকে তা হলে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে ওর আয়ু একধাপ-একধাপ করে কমছে।

জিশান মনে-মনে বেশ অবাক হল। শ্বাস টানা কিংবা ছাড়ার ব্যাপারটা নিয়ে ও আগে কখনও এমন করে ভাবেনি। কিন্তু ভাববেই বা কেন? ওর জীবনে আগে তো কখনও কিল গেম আসেনি।

জিশান বেশ বুঝতে পারছিল, বাকি যে-তিন ঘণ্টা সময় হাতে রয়েছে, সে-সময়টা ওর ঘুমোনো দরকার। কারণ, ভোর চারটে থেকে কিল গেমের তোড়জোড় শুরু। বলির পাঁঠাকে তখন তৈরি করে হাড়িকাঠের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে এই হাড়িকাঠটা হাড়িকাঠের মতো দেখতে নয়, আর এটার মাপ চারশো বর্গ কিলোমিটার। তফাত শুধু এইটুকুই।

কিন্তু ঘুম আসবে কি না তা নিয়ে জিশানের বেশ সংশয় ছিল। বাবার কাছে শুনেছিল, মৃত্যুদণ্ডের আসামি শাস্তি পাওয়ার আগের রাতটায় কখনও ঘুমোতে পারে না। ওর বেলাতেও ব্যাপারটা অনেকটা তাই।

সে-কথা ভাবতে-ভাবতে আরও একবার হাই তুলল জিশান।

আরমারি ইউনিটে এসে মনের মতো পোশাক বেছে নিল জিশান। তারপর নিজের পোশাক ছেড়ে নতুন পোশাক পরে নিল। পায়ে পরে নিল কালো রঙের স্নিকার।

পোশাকটা অদ্ভুত ধরনের। ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর প্যান্ট—কোমরে কাপড়ের বেল্ট। চকচকে কালো রঙের সিনথেটিক মেটিরিয়ালের তৈরি। খুব চাপা নয়, খুব ঢোলাও নয়। প্যান্টটায় ছ’টা নানান মাপের পকেট। আর টি-শার্টের চারটে—দুটো বুক পকেট, দুটো সাইড পকেট।

পোশাক পরে নেওয়ার পর বাছাই করা অস্ত্রশস্ত্র একটা বড়সড় রুকস্যাকে ভরে নিল। জামা-প্যান্টের পকেটও বাদ গেল না। অস্ত্রগুলো মারাত্মক হলেও ওজনে বেশ হালকা।

জামার বাঁ-পকেটে জিশান রাখল মিনি আর শানুর রঙিন ফটো। এই ছবিটা ও এম-ভি-পি-র মেমোরি থেকে নিয়ে ওর স্পেশাল কোয়ার্টারের কালার প্রিন্টারে প্রিন্ট করে নিয়েছিল। তাই মিনি আর শানু এখন থাকবে ওর হৃদয়ের কাছাকাছি।

অপটিক্যাল ট্যাবলেট কাম ট্র্যাকারটা জিশান হাতেই রাখল। গেম সিটিতে ঢোকামাত্রই ওটা কাজে লাগবে।

আরমারি ইউনিটের একজন কর্মী একটা বড় মাপের কালো রিস্টওয়াচ জিশানের বাঁ-হাতের কবজিতে স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে দিল। কাউন্টডাউন রিস্টওয়াচ। ও গেম সিটিতে ঢোকামাত্রই ওকে ঘড়ির একটা নীল বোতাম টিপতে হবে। তা হলেই চব্বিশঘণ্টা থেকে কাউন্টডাউন শুরু হবে। আর তার পাশাপাশি স্বাভাবিক ঘড়িও চলতে থাকবে। এই কাউন্টডাউন দেখে জিশান বুঝতে পারবে কিল গেম শেষ হতে আর কতক্ষণ বাকি।

তৈরি হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখল জিশান। নিজেকে চিনতে পারল না। তবে ওর মনে হচ্ছিল, হ্যাঁ, এই লোকটার ওপরে বাজি ধরা যায়। কিল গেমে এই লোকটা সহজে হারবে না।

ও তৈরি হয়ে যখন ‘লাস্ট স্টপ’ চেম্বারে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছে, তখন আরমারি ইউনিটের সাতজন কর্মী আর অফিসার ওকে উইশ করল। জিশান হেসে বলল, ‘থ্যাংক য়ু—।’

পিস ফোর্সের চারজন গার্ড ওকে রোবটের ভঙ্গিতে নিয়ে গেল ‘লাস্ট স্টপ’ চেম্বারে। ওদের মুখে কোনও কথা নেই। কালো কাচের মেঝেতে পা ফেলে ওরা এগিয়ে যাচ্ছিল।

জিশান ব্যাপারটা বুঝতে পারল—তাই ওদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল না।

চুপচাপ হেঁটে ওরা একটা বিশাল দরজার সামনে এসে দাঁড়াল।

ঘষা কাচের তৈরি দরজার পাল্লায় সোনালি হাতল বসানো। একটা চওড়া এল-সি-ডি ডিসপ্লে প্যানেলে ইংরেজি হরফে লেখা : লাস্ট স্টপ।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল জিশান। পিছনে তাকিয়ে দেখল, চারজন গার্ড নীরবে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে। ওরা জিশানকে বিদায় জানাচ্ছে, নাকি শোকপ্রস্তাব জানিয়ে একমিনিট নীরবতা পালন করছে?

একা-একা কয়েক পা হাঁটতেই একটা কাচের ঘরে পৌঁছে গেল জিশান। ফ্লুওরেসেন্ট আলোয় ঘরটা ঝকঝক করছে। সেখানে টিপটপ ড্রেস পরে দুজন অফিসার দাঁড়িয়ে।

ওকে দেখে একজন অফিসার বলল, ‘আপনার সঙ্গে অনেকে দেখা করতে এসেছেন। ওঁরা একজন-একজন করে ওই কিউবিকলে আসবেন। আপনি ওঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। তবে প্রত্যেকের সঙ্গে আপনার কথা বলার টাইম লিমিট হচ্ছে একমিনিট…।’

কিউবিকলটার দিকে তাকিয়ে দেখল জিশান।

ওর কাচের ঘরের লাগোয়া আর-একটা ছোট কাচের ঘর। দু-ঘরের মাঝের দেওয়ালে একটা ছোট জানলা—বড়জোর আট ইঞ্চি বাই আট ইঞ্চি।

এসেছে? সবাই এসেছে? সিকিওরিটি চিফের হাতে যে-উইশ লিস্টটা ও গত পরশু তুলে দিয়েছে তারা সবাই এসেছে?

ঘড়ির দিকে তাকাল জিশান। সাড়ে পাঁচটা বাজে।

ঘরের ডানদিকের দেওয়ালে একটা টাচ স্ক্রিন প্যানেল ছিল। বেঁটে মতন আর-একজন অফিসার প্যানেলের একটা বোতামে আঙুল ছোঁয়ালেন। সঙ্গে-সঙ্গে একটা মিষ্টি ইলেকট্রনিক সুর বেজে উঠল। আর তার কয়েক সেকেন্ড পরেই ছোট কাচের ঘরটায় এসে দাঁড়াল প্যাসকো। ওর চোখে ঘুম লেগে আছে।

জিশানের চোখে তাকিয়ে প্যাসকো একগাল হাসল : ‘হাই, জিশান!’

‘হাই!’

তারপর প্যাসকো অনেকক্ষণ জিশানের দিকে চেয়ে রইল। দুজনেই চুপচাপ।

একসময় ছোট জানলার ভেতর দিয়ে হাত বাড়াল প্যাসকো। জিশান ওর হাত ধরল। চাপ দিল। উষ্ণতার আদানপ্রদান হল।

প্যাসকো বলল, ‘শালারা ঢোকার সময় এক্স-রে আর মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে হেভি ছানবিন করেছে। যাকগে, শোনো ব্রাদার, ছোট্ট একটা টিপস। কিল গেমের আসল অস্ত্র হচ্ছে মোটরবাইক। এটা ভুলো না। সবসময় ভাববে, বাইকটা কোনও ভেহিকল নয়—ওটা তোমার বডির একটা পার্ট —হাত-পায়ের মতো…।’

জিশান সায় দিয়ে ঘাড় নাড়ল।

‘গেম সিটিতে ঢুকেই আগে একটা বাইক হাতিয়ে নেবে। তারপর ওই চারশো স্কোয়ার কিলোমিটার তোমার—একা তোমার…।’

জিশান আবার ঘাড় নাড়ল।

একজন অফিসার টাচ স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়ালেন। মিষ্টি সুর বেজে উঠল আবার।

‘টাইম শেষ।’ অন্য অফিসার বলে উঠলেন।

প্যাসকো বলল, ‘গুড লাক।’ তারপর ‘থামস আপ’-এর ভঙ্গিতে ডানহাতের বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে দেখাল।

জিশান ‘বাই—’ বলল বটে, তবে ওর ঠোঁট নড়ল শুধু—কোনও শব্দ শোনা গেল না।

প্যাসকো চলে যাওয়ার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঢুকল সুধাসুন্দরী। জিশানের চোখে তাকিয়ে চুপ করে রইল।

জিশান লক্ষ করল, ও ঠোঁট চেপে আছে। হয়তো কান্না চাপতে চেষ্টা করছে।

সুধা খোপ দিয়ে হাত বাড়ল। জিশানও। প্রায় পাঁচ-সাত সেকেন্ড ওরা একে অপরের হাত ধরে রইল। তারপর সুধা মাথাটা ওপর-নীচে নাড়াল শুধু। জিশানের হাতটা ছেড়ে দিয়ে ও আবার জিশানের দিকে অপলকে তাকিয়ে রইল। একসময় আচমকা মুখটা এক ঝটকায় ঘুরিয়ে নিয়ে কিউবিকল থেকে চট করে চলে গেল।

জিশান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘরে ঢুকল গুনাজি।

ছেলেটা জিশানের হাত চেপে ধরে শুধু ‘দাদা! দাদা!’ বলে কাঁদতে লাগল।

গুনাজির পর পান্ডা এল কিউবিকলে। ওর চোখ লাল। শরীরটা অল্প-অল্প টলছে।

ও জিশানের দিকে তাকিয়ে একটু জড়ানো গলায় বলল, ‘জয় হো!’

তারপর একটা সেলাম ঠুকল।

পান্ডার পর মূর্তির পালা। মূর্তি মাথা নীচু করে কাঁদছিল। কোনও কথা বলতে পারল না। কিছুক্ষণ পর, চলে যাওয়ার সময়, জিশানকে বুক চিতিয়ে ভেজা চোখে স্যালুট করল।

মূর্তির পর ‘লাস্ট স্টপ’ চেম্বারে ঢুকল সেই নাম-না-জানা গার্ড—যার বাড়ি নাহাইতলা গ্রামে।

গার্ড ছোট খোপের ভেতর দিয়ে ওর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিল।

জিশান হ্যান্ডশেক করতে গিয়ে দেখল, গার্ডের হাতে একটা লাল টুকটুকে আপেল।

গার্ড বলল, ‘নাও, তোমার জন্যে এনেছি—।’

জিশান আপেলটা নিল। তারপর ওপর হাতে হাত মেলাল।

গার্ড বলল, ‘ভগবানের ভরসায় থেকো না। মনে রেখো, ভাই, তোমাকে ছেলের কাছে ফিরে যেতে হবে…।’

জিশান ওপর-নীচে মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, ওর মনে থাকবে—গার্ডের দুটো কথাই।

জিশানের দিকে তাকিয়ে গার্ড চেষ্টা করে হাসল। বলল, ‘যদি তুমি সুযোগ দাও তা হলে তোমাকে আমার দেশের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যাব—।’

‘যাব।’ জিশান বলল।

একটু পরেই ইলেকট্রনিক ঘণ্টা বেজে উঠল। গার্ড কিউবিকল থেকে চলে গেল।

একজন অফিসার বললেন, ‘আর কোনও ভিজিটর নেই। চলুন, এবার ফাইনাল মেডিকেল চেক আপ…।’

অফিসারের দেখানো করিডর ধরে জিশান এগিয়ে চলল।

একটা ছোট ঘরে ওর মেডিকেল চেক আপ হল। মাত্র সাত মিনিটেই হাই-টেক চেক আপ শেষ। তারপর ওকে নিয়ে যাওয়া হল একটা দরজার সামনে। দরজাটা স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি। দেখেই বোঝা যায়, যথেষ্ট শক্তপোক্ত এবং ভারী।

একজন অফিসার একমনে নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলেন।

হঠাৎই দরজার ওপরে লাগানো একটা প্লেট টিভি চালু হয়ে গেল। টিভি-টা যে ওখানে বসানো আছে সেটা জিশান আগে খেয়ালই করেনি।

টিভি থেকে শ্রীধর পাট্টা জিশানের দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন। তবে ওঁর চোয়ালের রেখাগুলো নিষ্ঠুর।

শ্রীধর বললেন, ‘বেস্ট অফ লাক, জিশান…।’

সঙ্গে-সঙ্গে কোথায় যেন একটা সুরেলা ঘণ্টি বেজে উঠল। আর স্টেইনলেস স্টিলের ভারী দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যেতে লাগল।

সকাল থেকে এই প্রথম প্রকৃতির আলো দেখতে পেল জিশান।

শ্রীধর পাট্টা টিভি থেকে আবার বললেন, ‘দ্য গেম সিটি ইজ ইয়োরস—।’

খোলা দরজা পেরিয়ে জিশান গেম সিটিতে ঢুকে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে কাউন্টডাউন রিস্টওয়াচের নীল বোতাম টিপে দিল।

মাথার ওপরে ভোরের নরম আকাশ। আর সামনে মসৃণ পিচের রাস্তা। সেই রাস্তায় ছড়িয়ে রয়েছে নীলচে মোলায়েম ভোরের আলো। কারণ সূর্য এখনও ওঠেনি।

রাস্তার ডানদিকে, বেশ খানিকটা দূরে, দেখা যাচ্ছে কয়েকটা সুন্দর-সুন্দর বাড়ি : কোনওটা গোলাপি, কোনওটা হালকা বাদামি, কোনওটা হালকা নীল অথবা চোখ-ধাঁধানো রুপোলি।

আর বাঁ-দিকে বড়-বড় গাছের বাগান। সেই বাগান যতই ছড়িয়েছে ততই ঘন চেহারা নিয়েছে।

চোখের সামনে এই দৃশ্যটা দেখে জিশানের মনে হচ্ছিল যেন ফ্রেমে বাঁধানো একটা সুন্দর ছবি। যেন কোনও অলীকনগরীতে পা দিয়েছে ও। অথচ এখানেই মৃত্যু লেখা আছে।

জিশানের হাতে গার্ডের দেওয়া আপেলটা ছিল। একহাতে আপেল, অন্য হাতে অপটিক্যাল ট্যাবলেট। চারপাশের সুন্দরকে দেখতে-দেখতে ও আপেলটায় কামড় বসাল।

কী মিষ্টি!

একইসঙ্গে ওর মনে হল,লড়াইয়ের জন্য জরুরি এক জীবনীশক্তি ওর শরীর আর মনে ঢুকে পড়ল। আপেলটা খেতে-খেতে ও রাস্তা ধরে পা চালিয়ে হাঁটতে লাগল। ওর দু-চোখ একটা মোটরবাইক খুঁজছিল—কিন্তু সেটা দেখা যাচ্ছিল না।

আপেলটা খাওয়া শেষ হতেই জিশান ছুটতে শুরু করল। তখনই ঠিকঠাক টের পেল স্নিকারটা কত আরামে ওর পা-কে জড়িয়ে রেখেছে।

ছুটতে-ছুটতেই বাড়িগুলোর কাছাকাছি চলে এল জিশান। তখনও ও মোটরবাইকের খোঁজে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল, তাই বাড়িগুলোর দিকে ততটা মনোযোগ দেয়নি।

একটা হইচই চিৎকার কানে যেতেই ও ওপরদিকে মুখ তুলল। কয়েকটা বাড়ির বারান্দা আর ছাদে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে—জিশানের নাম ধরে চেঁচাচ্ছে, হাত নাড়ছে। ওরা জানে, ভোর ছ’টাতেই কিল গেম শুরু হয়ে গেছে।

ছুটতে-ছুটতে পালটা হাত নাড়ল জিশান। তারপর একটা বাড়ির কাছে এগিয়ে গেল। ট্যাবলেটটা বগলে চেপে মুখের কাছে দু-হাতের তালুর চোঙা তৈরি করে চেঁচিয়ে বলল, ‘মোটরবাইক! মোটরবাইক!’

সঙ্গে-সঙ্গে কয়েকটা হাত একটা দিক দেখাল। চিৎকার করে বলল, ‘ওইদিকে—ওইদিকে!’

জিশান হাত নেড়ে ধন্যবাদ জানাল। এবং ছুটতে শুরু করল।

দশ-বারো সেকেন্ড পেরোতে না পেরোতেই ও মোটরাবইকগুলো দেখতে পেল। রাস্তার ধার ঘেঁষে সাত-আটটা রঙিন বাইক দাঁড় করানো রয়েছে। যেন সাত-আটটা রঙিন চিতাবাঘ। তারপাশে ছ’টা প্রাইভেট কার। মাপে ছোট, তবে নিশ্চয়ই হাই-টেক।

দৌড়ে গিয়ে একটা কালো চিতাবাঘের পিঠে চড়ে বসল জিশান, অপটিক্যাল ট্যাবলেটটা কেরিয়ারে রাখল। তারপর চিতাবাঘ গর্জন করে উঠল। ছুটতে শুরু করল।

এর মধ্যেই কখন যেন সূর্য উঠে গেছে। বাড়ির মাথায়, গাছের মাথায় রোদের ছোঁয়া লেগেছে।

জিশান পিচের রাস্তা ধরে বাইক চালাতে লাগল। দেখা যাক এই রাস্তাটা কোথায় গেছে!

বাড়িগুলোর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বারান্দা কিংবা ছাদের দিকে তাকিয়ে উৎসাহী লোকজনকে দেখতে পাচ্ছিল। তারা হাত নাড়ছে। জিশানকে দেখার আশায় ভোর ছ’টা থেকেই অপেক্ষা করছে। টিভিতে লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হয়ে গেলেও খালি চোখে সরাসরি দেখতে পাওয়ার আনন্দই আলাদা।

বাড়ির সারির ফাঁকে-ফাঁকে বেশ কয়েকটা টিভি ক্যামেরা জিশানের চোখে পড়ল। বাঁ-দিকে তাকিয়ে একইরকম দৃশ্য দেখতে পেল জিশান। গাছে-গাছে লাগানো টিভি ক্যামেরার চোখ। না:, শ্রীধর পাট্টার প্ল্যানিং-এ কোনও গণ্ডগোল নেই!

প্রায় পনেরো মিনিট বাইক চালানোর পর গেম সিটির একটা বাউন্ডারি ওয়ালের কাছে পৌঁছে গেল। কালো পাথরে তৈরি শক্তিশালী পাঁচিল। দেখামাত্রই জেলখানার কথা মনে পড়ে।

রাস্তাটা বাঁ-দিকে ঘুরে গেছে। জিশানও রাস্তা ধরে বাইক ঘোরাল। একপলক হাতঘড়ির দিকে তাকাল। ছ’টা পঁচিশ। জলতেষ্টা পাচ্ছে—তার সঙ্গে খিদেও।

একটু পরে রাস্তার ধারে বাইক দাঁড় করাল। কেরিয়ার থেকে অপটিক্যাল ট্যাবলেট বের করে লাল রঙের চৌকো বোতামটা টিপল। পরদায় কতকগুলো লাল ব্লিংকিং ডট ফুটে উঠল। জিশানের ফুড ম্যাপ। পটাপট বোতাম টিপে সবচেয়ে কাছাকাছি ফুড পয়েন্টটা কোথায় দেখে নিল জিশান। তারপর ট্যাবলেট কেরিয়ারে ঢুকিয়ে আবার বাইকে চড়ে দৌড়।

ট্যাবলেটের নিশানা বারবার চেক করে রাস্তা ছেড়ে গাছপালার মধ্যে ঢুকতে হল জিশানকে। আলোছায়ার কাটাকুটির মধ্যে সাপের মতো এঁকেবেঁকে বাইক চলছিল। চারিদিকে সবুজ আর বাদামি পাতার ছড়াছড়ি। বাইকের আওয়াজ পেয়ে গাছের পাখিরা ডেকে উঠল। এ-গাছ থেকে ও-গাছে ওড়াউড়ি করতে লাগল।

একটা ফুড পয়েন্টের কাছে পৌঁছে বাইক থামাল। নেমে পড়ল বাইক থেকে।

চারপাশে বড়-বড় গাছ। তাদের ঘিরে ছোট-বড় আগাছা। চোখে পড়ল, প্রজাপতি আর ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে।

ট্যাবলেটটা হাতে নিয়ে ফুড পয়েন্টটার ব্লিংকিং ডটে আঙুল ছোঁয়াল জিশান। সঙ্গে-সঙ্গে খুব কাছাকাছি কোনও লুকোনো জায়গা থেকে পিপ-পিপ শব্দ শোনা গেল। চারপাশে তাকাল। কোথা থেকে আসছে শব্দটা?

ট্যাবলেট হাতে নিয়ে শব্দের উৎসের খোঁজ করতে লাগল। এবং একমিনিটের কম সময়েই খোঁজ পেয়ে গেল।

একটা বিশাল গাছের গোড়ার কাছ থেকে শব্দটা আসছে। পিপ-পিপ, পিপ-পিপ।

দৌড়ে সেখানে গেল জিশান। হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। পড়ে থাকা কয়েকটা পাতা সরাতেই চোখে পড়ল ঝুরো মাটি।

পকেট থেকে একটা অস্ত্র বের করল : হান্টিং নাইফ। টেম্পারড স্টিলের সাত ইঞ্চি লম্বা ব্লেড। একদিক ধারালো, অন্যদিকে কুমিরের পিঠের মতো খাঁজকাটা। ছুরিটা বাগিয়ে ধরল। তারপর মাটি খুঁড়তে শুরু করল।

একটু পরেই দেখা গেল একটা স্টিলের বড় বাক্স। তার গায়ে অদ্ভুত ধরনের সব ভাঁজ। সেটা টেনে বের করল। ঝুরো মাটি ঝেড়েঝুরে বাক্স খুলল।

ওর খাবার দেখতে পেল জিশান।

ছ’টা চিকেন স্যান্ডউইচ। চারটে ডিমের ওমলেট। আর দু-লিটার জলের একটা বোতল।

মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়ল। চটপট খাওয়া শুরু করল।

খেতে-খেতেই জিশানের মাথায় একটা আইডিয়া এল। আচ্ছা, ফুড পয়েন্টগুলোকে আর্মস পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করলে কেমন হয়!

কথাটা মাথায় আসামাত্রই জিশান দুরন্ত স্পিডে খাওয়া শেষ করল। বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খেল। ছিপি টাইট করে এঁটে বোতলটা আবার রেখে দিল বাক্সের ভিতরে।

জিশান চারটে স্যান্ডউইচ খেয়েছিল। দুটো বাক্সে রেখে দিয়েছিল। কারণ, ওর মনে হয়েছিল, বাক্সের খাবার শেষ করে দিলে ফুড ম্যাপে এই নির্দিষ্ট ফুড পয়েন্টটা ব্লিংকিং ডট হিসেবে আর নাও দেখা যেতে পারে। শ্রীধর পাট্টার দুষ্টু বুদ্ধিকে বিশ্বাস নেই।

কিন্তু এই ব্লিংকিং ডটগুলো জিশানের কাছে এখন ভীষণ জরুরি। কারণ, ও ঠিক করেছে এই পয়েন্টগুলোতে ও রুকস্যাকে ভরা নানান আর্মস লুকিয়ে রাখবে। তা হলে ফুড ম্যাপের বোতাম টিপলেই ও একইসঙ্গে ফুড পয়েন্ট আর আর্মস পয়েন্ট দেখতে পাবে। অথচ ওর শত্রুরা এই লোকেশনগুলোর একটাও দেখতে পাবে না।

সুতরাং কাজ শুরু করল জিশান।

রুকস্যাক থেকে বের করে নিল লেজার পয়েন্টার লাগানো হাই-রেঞ্জ টুয়েন্টি শুটার অটোমেটিক পিস্তল। সেটাকে মাটির নীচে ফুড বক্সের পাশে শুইয়ে দিল। তারপর মাটি চাপা দিয়ে তার ওপরে শুকনো পাতা আর ডালপালা কুড়িয়ে আগের মতোই ছড়িয়ে দিল।

জিশানের হঠাৎই মনে পড়ল টিভি ক্যামেরার কথা। ক্যামেরার চোখগুলো নিশ্চয়ই ওর ওপরে সর্বক্ষণ নজর রাখছে। তা হলে কোটি-কোটি মানুষের কাছে জিশানের এই কাণ্ডকারখানা লাইভ টেলিকাস্টের মাধ্যমে এই মুহূর্তে পৌঁছে যাচ্ছে!

সে যায় যাক! তা না হলে ইঁদুর আর বেড়ালের লুকোচুরি খেলা জমবে কেমন করে! তা ছাড়া ওর তিন শত্রু কখনওই জিশানের এই কৌশলের কথা জানতে পারবে না। কারণ, ওরা কোনওভাবেই টিভির লাইভ টেলিকাস্ট দেখতে পাবে না। জিশানের হিসেব অন্তত তাই বলছে।

গেম সিটির ‘নাগরিকরা’ তখন কিল গেমের লাইভ টেলিকাস্ট দেখছিল। চলমান ছবির পাশাপাশি চলছিল উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠার মশলা ঠাসা ধারাভাষ্য। ধারাভাষ্য যিনি দিচ্ছিলেন তিনি আবেগ মাখানো জোরালো গলায় জিশানের বুদ্ধির তারিফ করছিলেন। বলছিলেন, কিল গেম শুধু শারীরিক শক্তি আর দক্ষতার মোকাবিলা নয়, বুদ্ধির উদ্ভাবনী ক্ষমতা আর ধারেরও লড়াই।

কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াল জিশান। চারপাশে তাকাল। গাছপালা, আলোছায়া। শোনা যাচ্ছে দু-তিনরকমের পাখির ডাক।

হঠাৎই অদ্ভুত একটা শব্দ জিশানের কানে এল। কেউ যেন মিহি গলায় কাশছে। অথবা হাসছে।

একটা গাছের গুঁড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে সতর্কভাবে এদিক-ওদিক তাকাল। কই, কেউ তো কোথাও নেই!

শব্দটা আবার শোনার জন্য জিশান দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল।

হঠাৎই বাঁ-দিকের একটা নড়াচড়া ওর চোখের কোণে ধরা পড়ল। চকিতে চোখ ফেরাল জিশান। সঙ্গে-সঙ্গে আশঙ্কার ঠান্ডা ছোবল টের পেল বুকের ভেতরে।

একটু দূরে দুটো মোটা-মোটা গাছের গুঁড়ির আড়াল থেকে তিনটে হায়েনা ওর দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে আছে।

বাদামির ওপরে কালো ছোপ-ছোপ দাগ। কুকুরের চেয়েও বড়সড় চেহারা। কানগুলো ভোঁতা। গলার বেশ কিছুটা জায়গায় কালচে রং।

এমনিতে হায়েনা যে মানুষকে আক্রমণ করে না সেটা জিশান জানে। কিন্তু এই তিনটে লোভাতুর প্রাণীকে দেখে ও তেমন একটা ভরসা পাচ্ছিল না।

গত কয়েক মাসে জিশান বহুবার গেম সিটি নিয়ে শ্রীধর পাট্টার সঙ্গে আলোচনা করেছে। কিন্তু শ্রীধর একটিবারের জন্যও ওকে বলেননি যে, গেম সিটির জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী রয়েছে।

তা হলে কি হায়েনার চেয়ে বড়সড় প্রাণীও থাকতে পারে এই জঙ্গলে?

তা ছাড়া এই হায়েনাগুলো স্বাভাবিক হায়েনা কি না কে জানে! হয়তো শ্রীধরের পোষা বিজ্ঞানীরা এদের শরীরে নানান কেমিক্যাল ইনজেক্ট করে এদের আরও হিংস্র, আরও বেপরোয়া করে তুলেছে।

জিশান আড়চোখে দেখল, বাইকটা ওর যথেষ্ট কাছাকাছি রয়েছে। সুতরাং আর দেরি না করে ও দু-লাফে বাইকের কাছে পৌঁছে গেল। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই বাইকে বসে স্টার্ট দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে দিল।

আশ্চর্য! হায়েনা তিনটে লাফ মেরে বেরিয়ে এল গাছের আড়াল থেকে। এবং রাস্তার নেড়ি কুকুরের মতো জিশানের বাইকটাকে তাড়া করতে শুরু করল। যদিও জিশানের বাইকের হাই মোটিভ পাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হায়েনাগুলোকে পিছনে ফেলে দিল।

জিশান ঠিক করল দু-ঘণ্টার মধ্যে যেটুকু সময় হাতে আর বাকি আছে তার মধ্যে ও যতগুলো ফুড পয়েন্ট পারবে কভার করবে।

গেম সিটির মধ্যে জিশানের বাইক ছুটে বেড়াতে লাগল। কখনও জঙ্গলে, কখনও রাস্তায়, কখনও বা নদীর ওপরে ফ্লাইওভারে। আবার কখনও পাহাড়ে।

যতই ঘুরে বেড়াচ্ছিল ততই অবাক হচ্ছিল জিশান। চারশো বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে কীভাবে একটা বিচিত্র শহর তৈরি করেছেন শ্রীধর! এখানে বাড়ি-ঘর আছে, নদী আছে, জঙ্গল আছে, পাহাড় আছে—এমনকী বন্যপ্রাণীও ঘুরে বেড়াচ্ছে গাছের আড়ালে! এরকম নকল শহর সিনেমার শুটিং-এর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। কিংবা অবসর বিনোদনের রিসর্ট হিসেবে। কিন্তু শ্রীধর পাট্টা এই শহরটা তৈরি করেছেন বধ্যভূমি হিসেবে। লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি টাকা রোজগারের জন্য বিনা ঝুঁকির বিনিয়োগ।

রাস্তা ধরে বাইক চালিয়ে যাচ্ছিল জিশান। পথ ঘেঁষে অনেকগুলো বাড়ি আর দোকান। একটু দূরেই সার বেঁধে দাঁড় করানো রয়েছে অনেকগুলো গাড়ি আর মোটরবাইক।

কয়েকটা বাড়ির দরজায় লোকের ভিড় চোখে পড়ল। ওরা বোধহয় টিভির লাইভ টেলিকাস্টে দেখতে পেয়েছে জিশান এই পথ দিয়েই আসছে।

জিশানকে দেখামত্রই ওরা সবাই হইচই করে উঠল, হাত নাড়তে লাগল। হঠাৎই ভিড় থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একটা বাচ্চা ছেলে আর একটা ছোট মেয়ে। ছেলেটার বয়েস বোধহয় ছয় কি সাত, আর মেয়েটার ন’দশ। ওদের বাবা-মা আর অন্যান্য মানুষজন দরজার কাছটায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে ওদের ডাকছিল, ‘রাস্তায় যাস না! চলে আয়! শিগগির ফিরে আয়!’

কিন্তু কে শোনে কার কথা! ছেলেটা আর মেয়েটা একেবারে জিশানের বাইকের পথ আটকে দাঁড়াল। ‘জিশান! জিশান!’ বলে চিৎকার করতে লাগল।

জিশান ঘড়ি দেখল। আটটা বাজতে এখনও কুড়ি মিনিট বাকি। এই কুড়ি মিনিট গেম সিটির পথঘাট নিরাপদ—কারণ, কিলাররা এখনও মাঠে নামেনি।

জিশান ইচ্ছে করলে ওদের পাশ কাটিয়ে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যেতে পারত, কিন্তু সেটা করল না। ও বাইক থামাল। কী বলতে চাইছে বাচ্চা দুটো? ছেলেটার মুখের সঙ্গে ছেলে শানুর মুখের মিল খুঁজে পেল। জামার বাঁ-পকেটের ওপরে হাত ছোঁয়াল। মিনি আর শানুর ফটো অনুভব করল।

জিশান বাইক থেকে নামল। বাচ্চা দুটো তিরবেগে ছুটে চলে এল ওর কাছে। একসঙ্গে বলে উঠল, ‘অটোগ্রাফ দাও, জিশানকাকু—অটোগ্রাফ।’

তখনই খেয়াল করল, দুজনের হাতেই একটা করে পাতলা খাতা, আর পেন।

জিশান ফুটফুটে বাচ্চা দুটোর মুখের দিকে তাকাল। তারপর পেন নিয়ে খাতা দুটোর পাতায় পরপর সই করল। তারপর বড় করে লিখে দিল, ‘ভালোবাসা নাও—।’

বাড়িগুলোর দরজার কাছে আর দোকানের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন চিৎকার করতে লাগল, ‘জি—শান! জি—শান!’

জিশান সেদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। তারপর বাচ্চা দুটোকে নাম জিগ্যেস করল।

মেয়েটার নাম টুকটুকি, আর ছেলেটার নাম কাঞ্চন।

কাঞ্চন বলল, ‘জিশানকাকু, আমরা তোমার সঙ্গে ফটো তুলব—।’

এ কী আবদার! সময় যে বড় কম! আর-একটু পরেই কিলাররা গেম সিটিতে ঢুকে পড়বে!

টুকটুকি জিশানের হাত ধরে টানতে শুরু করল : ‘এসো না! এসো! ওইখানটায় দ্যাখো—টিভিতে তোমাকে দেখাচ্ছে। চলো, দেখবে চলো…।’

জিশান দোটানায় পড়ল। ওর মনে হল, শানু টুকটুকির মতো বড় হয়ে গেছে। ওর হাত ধরে টানছে।

জিশান যেন কোন এক জাদুমন্ত্রে অবশ হয়ে গেল। নাকি বলা ভালো, বশ হয়ে গেল। টুকটুকির ওপরে নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে ছেড়ে দিল। পায়ে-পায়ে এগোতে শুরু করল রাস্তার ধারের একটা ফাস্ট ফুডের দোকানের দিকে।

আশপাশের ভিড় করা জনতা হইহই করে উঠল। ‘জিশান! জিশান!’ বলে চিৎকার করতে লাগল। টুকটুকি আর কাঞ্চন জিশানের দু-হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। ক্যামেরার আলোর ঝলক দেখা গেল বারবার। ওদের ফটো উঠতে লাগল।

দোকানের কাছে যেতেই জিশানকে ঘিরে ভিড় জমে গেল। ওকে একবার ছোঁয়ার জন্য লোকজন পাগলামি শুরু করে দিল। টুকটুকি দোকান থেকে একটা কেক নিয়ে জিশানকে দিল : ‘কাকু, এটা খেয়ে নাও—প্লিজ!’

জিশান ছোট মেয়েটার চোখের দিকে তাকাল। ওর চোখে মায়ের মমতা।

জিশান ‘না’ বলতে পারল না। কেকটা খেতে লাগল। তখনই কে একজন একটা জলের বোতল বাড়িয়ে ধরল ওর দিকে।

জিশান জল খেল। তখনই ওর প্লেট টিভির দিকে চোখ গেল। দোকানের একটা দেওয়ালে প্রকাণ্ড মাপের প্লেট টিভি। সেখানে জিশানকে দেখা যাচ্ছে। চারপাশে মানুষজনের ভিড়।

টিভির কমেন্টেটর তখন বলছেন, ‘…আপনারা দেখুন, একটা ছোট্ট মেয়ে ওর ”জিশানকাকু”-কে একটা কেক খাওয়াল। আমরা এই মেয়েটিকে তিরিশ হাজার টাকা রিওয়ার্ড দেব। যারাই আমাদের সুপারহিরো জিশানকে সাপোর্ট দেবে, হেলপ করবে, তাদের জন্যে রয়েছে নানা অ্যামাউন্টের প্রাইজ মানি। ওয়েল ফোকস, আর-একটু পরেই শুরু হবে কিল গেমের অ্যাকশন…।’

নিজেকে টিভির পরদায় লাইভ টেলিকাস্টে দেখতে পেয়ে জিশানের বেশ মজা লাগছিল। ও ঝুঁকে পড়ে এক হ্যাঁচকায় কাঞ্চনকে কোলে তুলে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে টিভির পরদায় সেই ছবি চলে এল। ছবির পাশাপাশি ধারাবিবরণী।

‘দেখুন—আপনারা জিশানকে দেখুন! কী পারফেক্ট! কী সাংঘাতিক কুল!’ এবার কমেন্টেটরকে দেখা গেল। চশমা চোখে পোড়খাওয়া একজন মোটাসোটা ভদ্রলোক। কপালে ভাঁজ, মাথায় টাক। গলায় একটা সোনার চেন। তাঁর পাশেই বসে আছে অল্প পোশাকের একজন তরুণী। মুখে চড়া মেক-আপ।

কমেন্টেটর তখন বলছিলেন, ‘আমার পাশেই বসে রয়েছেন কিল গেম আরকাইভের সিইও শবনম। ঠিক-ঠিক সময়ে শবনম আপনাদের পুরোনো কিল গেমের নানান ক্লিপিংস দেখাবেন, যাতে পুরোনো কিল গেমের সিচুয়েশানের সঙ্গে আপনারা নতুন কিল গেম—মানে, জিশানের কিল গেম কমপেয়ার করতে পারেন…।

‘এখন তাকিয়ে দেখুন, জিশানের মুখে কী সুন্দর স্নেহ আর মমতা মাখানো। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, ওর বছর দেড়েকের একটা ছেলে রয়েছে—ভালো নাম অর্কনিশান। আর ডাকনাম শানু। দেখুন, দেখুন, কোলে তুলে নেওয়া বাচ্চা ছেলেটিকে জিশান কীভাবে আদর করছে। অথচ….অথচ এই জিশান—জিশান পাল চৌধুরী—একটু পরেই হয়ে উঠবে নির্মম, নিষ্ঠুর। ঠান্ডা মাথায় ও তখন কিল গেমের তিন-তিনজন কিলারের সঙ্গে সশস্ত্র মোকাবিলা করবে।

‘আটটা বাজতে এখন পাঁচমিনিট। আর পাঁচমিনিট পরেই খুনিরা পা রাখবে গেম সিটিতে। শুরু হবে ইঁদুর আর বেড়ালের লড়াইয়ের খেলা। কিন্তু কে ইঁদুর আর কে বেড়াল সেটাই প্রশ্ন। এখন নিচ্ছি একটা বিজ্ঞাপনের বিরতি। চারমিনিট পরেই আবার ফিরে আসছি। টিভির সামনে থেকে কোথাও যাবেন না, প্লিজ…।’

শুরু হয়ে গেল বিজ্ঞাপন।

জিশান ঘড়ির দিকে তাকাল। আটটা বাজতে চার মিনিট।

না, আর দেরি করা যাবে না। কাঞ্চনকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। আকাশের দিকে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। তবে তার পশ্চিমদিকে হালকা মেঘের চাদর। বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া। জিশানের শ্বাস নিতে ভালো লাগছিল।

ও চারপাশের ভিড়ের দিকে তাকাল। মানুষগুলোকে দেখেও ওর ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ও জীবনের অনেক কাছাকাছি রয়েছে।

কিন্তু না। এখনই ওকে মোটরবাইকে চড়ে ছুট লাগতে হবে। আর এই মানুষগুলোও দৌড়ে চলে যাবে ওদের বাড়ি কিংবা দোকানের ভেতরে—ওদের নিরাপদ আশ্রয়ে।

ঝুঁকে পড়ে কাঞ্চন আর টুকটুকির মাথায় চুমু গেল জিশান। আর তারপরই দৌড়ল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ওর বাইকের দিকে।

ভিড় থেকে দু-তিনজন চিৎকার করে বলল, ‘জিশান, আমরা তোমার পাশে আছি। আমরা তোমার ফ্যান!’

ততক্ষণে জিশানের বাইক ছুটতে শুরু করেছে।

কিন্তু কিছুটা পথ গিয়েই একটা ফাঁকা মাঠে পৌঁছে গেল। ধু-ধু প্রান্তর। ঢেউখেলানো উঁচু-নীচু মাঠ। আর কোথাও সবুজ ঘাস, কোথাও ধুলো আর মাটি। এ ছাড়া কয়েকটা বড়-বড় গাছ—এদিক-ওদিক ছড়িয়ে।

ঘড়ির কাঁটায় আটটা বেজে এক মিনিট।

বাইক থামাল জিশান। বাইকের আওয়াজ থেমে যাওয়ামাত্রই চারপাশে স্তব্ধতা নেমে এল। শুধু বহুদূর থেকে ভেসে আসা কয়েকটা পাখির ডাক।

বাইকের কেরিয়ার থেকে অপটিক্যাল ট্যাবলেট বের করল জিশান। তারপর ট্র্যাকার অন করল।

ওই তো দেখা যাচ্ছে তিনটে লাল ডট! যে-দরজা দিয়ে জিশান গেম সিটিতে ঢুকেছিল সেই দরজা দিয়েই তিনজন কিলার গেম সিটিতে ঢুকেছে। তবে তিনটে ডট এখনও খুব কাছাকাছি। তার মানে, ওরা হয়তো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে গেম প্ল্যান তৈরি করছে।

জিশান টাচ স্ক্রিনে আঙুল ছোঁয়াল। লাল ডট তিনটে যে-স্কোয়ার টাইলের মধ্যে ছিল সেটা বড় হয়ে ক্লোজ আপ ভিউ দেখাল।

জিশান ঠিকই ভেবেছে। গেম সিটিতে ঢুকে ওরা এখন পিচের রাস্তায় রয়েছে। ট্র্যাকারে জিশানের সবুজ ডটটা ওরা দেখতে পাচ্ছে। হয়তো ভাবছে, রাস্তায় পার্ক করা গাড়ি আর বাইকগুলোর মধ্যে কোনটা নেবে এবং ক’টা নেবে।

ইস, জিশানের সঙ্গে একটা প্লেট টিভি থাকলে ভালো হত! ও সরাসরি কিলারদের দেখতে পেত। ওরা কোন অস্ত্র ব্যবহার করতে চলেছে সেটাও জানতে পারত।

আপনমনেই মাথা নাড়ল জিশান। না:, একটা প্লেট টিভি দরকার। কিন্তু কীভাবে সেটা পাওয়া যায়?

আচ্ছা, একটু আগেই যেসব মানুষজনের সঙ্গে ওর দেখা হল তাদের কাছে চাওয়া যায় না? একটা ছোট টিভি চাইলে জিশানকে ওরা দেবে না? নিশ্চয়ই দেবে।

জিশান বাইক ঘোরাল। এখন শুধু দরকার স্পিড…স্পিড।

ধু-ধু ফ্লাইওভারের ঠিক মাঝখানটিতে পৌঁছে মোটরবাইক থামাল জিশান।

বেলা বেড়েছে। রোদ অনেক চড়া হয়েছে। বাতাস বইছে। জিশানের লম্বা চুল উড়ছে।

ফ্লাইওভারের রেলিঙের ফাঁক দিয়ে নীচের দিকে তাকাল। অনেক নীচে ঠান্ডা জলের নদী। কুলকুল করে বয়ে চলেছে। দেখলেই মনে হয়, এ জগতে সবকিছু শান্তি-কল্যাণ হয়ে আছে।

ফ্লাইওভার বরাবর দু-দিকে তাকাল। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ফ্লাইওভারের মাঝখানটা কচ্ছপের পিঠের মতো উঁচু হওয়ায় নজর চালানোর সুবিধে হয়েছে। বাইক নিয়ে গেম সিটির সর্বত্র দুরন্ত ছুটোছুটি না করে কোথাও-কোথাও বাইক দাঁড় করিয়ে চুপচাপ বিশ্রাম নেওয়াটা অনেক বেশি কাজের। তাতে হাঁপিয়ে যাওয়া শরীরে নতুন শক্তি ফিরে আসে। আর একইসঙ্গে কিল গেমের সময়টাকে ধীরে-ধীরে পার করে দেওয়া যায়। তবে মাঝে-মাঝেই ট্র্যাকারের দিকে লক্ষ রাখতে হচ্ছে—কিলারদের কাছ থেকে জিশানের দূরত্ব খুব বেশি কমে না যায়।

নদীর দৈর্ঘ্য বরাবর চোখ মেলে দিল জিশান। কী নাম এই মিষ্টি নদীটার? কে জানে! যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু গাছপালা। তারই মাঝে হঠাৎ করে মাথাচাড়া দিয়েছে দুটো পাথুরে পাহাড়। আবার ডানদিকে চোখ সরালেই চোখে পড়ছে ঘর-বাড়ি—যে-ঘর-বাড়িগুলো শুধু আজকের জন্য মানুষে-মানুষে জমজমাট। কাল সকালের পর আবার সব ফাঁকা! তখন এই গেম সিটিটা খাঁ-খাঁ করবে।

আকাশে কয়েকটা চিল উড়ছিল। ওরা বাঁশি বাজনোর শব্দ করে ডাকছিল। সেদিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল জিশান। হাতের পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল। তারপর বাইকের কেরিয়ার থেকে ট্র্যাকারটা বের করে নিল।

ওই তো তিনটে লাল ডট! একে অপরের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।

জিশান বুঝতে পারল, তিনজন কিলার কী করতে চাইছে। ওরা তিনদিক থেকে সবুজ ডটটাকে ঘিরে ফেলতে চাইছে। যাতে সবুজ ডটটা সবসময় তিনটে লাল ডট দিয়ে তৈরি ত্রিভুজের মধ্যে থাকে। তারপর তিনটে লাল ডট ক্রমশ ত্রিভুজটাকে মাপে ছোট করতে থাকবে। একসময় লাল ডটগুলো হিংস্রভাবে সবুজের ঘাড়ে এসে পড়বে।

ফ্লাইওভারের যা কো-অর্ডিনেট তাতে লাল ডটগুলো এদিকটায় সরে আসতে বেশ সময় নেবে। আর যদি আচমকা ওরা এসেও পড়ে তা হলে জিশান ফ্লাইওভারের উত্তর দিকের রাস্তা ধরে নেমে আসবে। ফ্লাইওভার শেষ হওয়ার পাঁচ-ছ’ হাত পরেই একটা কাঁচা রাস্তা ঢালু হয়ে নেমে গেছে বাঁ-দিকে। তারপর সোজা ঢুকে পড়েছে জঙ্গলে। জিশান সেই কাঁচা রাস্তা দিয়ে ঢুকে পড়বে জঙ্গলে—গাছপালার আড়ালে গা-ঢাকা দেবে।

এবার টিভিটা একবার সুইচ অন করে দেখা যাক।

যে-প্লেট টিভিটা গেম সিটির ‘সিটিজেন’রা জিশানকে হইহই করে গিফট করেছে সেটার মাপ মাত্র আট ইঞ্চি। জিশান ইচ্ছে করেই সবচেয়ে ছোট মাপের টিভিটা চেয়েছে। ওটা দেখারও সুবিধে, ক্যারি করাও সুবিধে।

বাইকের কেরিয়ার থেকে আবার প্লেট টিভিটা বের করে নিল জিশান। তারপর সুইচ অন করল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রঙিন ছবি ফুটে উঠল টিভিতে। আর সেই ছবি দেখামাত্রই জিশান হতবাক হয়ে গেল।

কারণ, টিভির পরদায় তখন অপাশি কানোরিয়াকে দেখা যাচ্ছে। নিষ্পাপ, গোলগাল ফরসা মুখ। গাল আর থুতনিতে হালকা দাড়ি। এই খুনিকে জিশান টিভির পরদাতে আগেও দেখেছে। কিল গেমের তিনজন কিলারের পরিচয় নিয়ে যখন কম্পিটিশন চলছিল তখন।

সেই প্রতিযোগিতার শেষে দুজন কিলারের পরিচয় দর্শকদের জানানো হয়েছিল। আর তিন নম্বর কিলারের পরিচয় গোপন রাখা হয়েছিল—শ্রীধর পাট্টার নির্দেশে। ফলে প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়নি, আর পুরস্কারও মুলতবি রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, কিল গেমের সময়েই তিন নম্বর কিলারকে প্রথম দেখা যাবে, আর তখনই প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিজেতাদের নাম টিভিতে ঘোষণা করা হবে। সারপ্রাইজ।

না, এসব ব্যাপারের জন্য জিশান অবাক হয়নি। কারণ, এসব তথ্য ওর আগে থেকেই জানা।

ও অবাক হয়েছে, কিলার অপাশি কানোরিয়ার হাতে একটা স্যাটেলাইট ফোন দেখে। যে-ফোনে অপাশি এখন কথা বলছে আর-একজন কিলার সুখারাম নস্করের সঙ্গে।

তিনজন খুনি যে নিজেদের মধ্যে স্যাটেলাইট ফোন ব্যবহার করবে এ-কথা শ্রীধর পাট্টা জিশানকে জানাননি। কারণ, সারপ্রাইজ!

জিশান বুঝতে পারল, স্যাটেলাইট ফোনের একটানা সাহায্য নিয়ে তিনটে লাল ডট অত্যন্ত সাবলীলভাবে সবুজ ডটের নিখুঁত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবে। আর জিশানের স্যাটেলাইট ফোনটা শুধুমাত্র শ্রীধর পাট্টার সঙ্গে কথা বলার জন্য। অনেকটা যেন শ্রীধর আর ওর মধ্যে ইন্টারকম ফোন।

কিলার অপাশি গাড়ি চালাচ্ছিল। গাড়ি চালাতে-চালাতেই ফোনে কথা বলছিল।

আর কিলার সুখারাম একটা চলন্ত বাইকের পিঠে বসে আছে। লাল আর কালো রঙের বাইক। বাঁ-হাতে একটা হাতল ধরে রয়েছে। ডানহাতে ফোন।

টিভিতে ধারাবিবরণী চলছিল।

পোড়খাওয়া মোটাসোটা কমেন্টেটর তখন বলছেন, ‘কিলারদের কথাবার্তা আমরা ভালো করে শুনতে পাচ্ছি না, তবে ওদের প্ল্যানটা মোটামুটি গেস করা যাচ্ছে। ওরা জিশানকে ট্রায়াঙ্গুলার ট্র্যাপে ফেলতে চায়। তাড়াহুড়োর কোনও ব্যাপার নেই…ওদের হাতে এখনও অনেক সময় আছে…।’

এবার টিভির ক্যামেরা অপাশি কানোরিয়ার সিটের ওপরে ফোকাস করল।

কানোরিয়ার পাশেই সিটের ওপরে রাখা আছে কয়েকটা অস্ত্র। তার মধ্যে একটা অদ্ভুত ধরনের বন্দুক। রিভলভারের চেয়ে মাপে একটু বড়, তবে নলটা একটু বেশি মোটা আর লম্বা। ধারাভাষ্যকার অস্ত্রটার পরিচয় দিল : মিসাইল গান। এ থেকে যে-বড় মাপের বুলেট বা শেল বেরোয় সেটা ইনফ্রারেড রশ্মির উৎস লক্ষ্য করে ছুটে যায়। জীবন্ত মানুষের শরীর হল তাপের উৎস। সেই উৎস থেকে অবলোহিত রশ্মি বেরোয়। ফলে আঁকাবাঁকা পথে ছুটে পালানো একজন মানুষকে এই মিসাইল গানের বুলেট আঁকাবাঁকা পথে তাড়া করে হিট করতে পারে।

মিসাইল গানের পাশেই রয়েছে নানান মাপের তিনটে চপার। কানোরিয়ার ‘বাউন্ডারি’ মারার ‘ব্যাট’। কিন্তু আজ ওর সামনে বাউন্ডারি মারার সুযোগ নেই। আজ শুধু জিশান—মানে, একটা ‘শর্ট রান’। কিন্তু এই শর্ট রান নিতে গেলে শত্রুর কাছে পৌঁছতে হবে। দুশমনটাকে পেতে হবে চপারের নাগালে।

কানোরিয়া সম্পর্কে টিভিতে অনেক কথাই শুনেছে জিশান। জেনেছেও অনেক কথা। কিন্তু সেইসব ভয়ংকর তথ্য জানার পরেও ওর কোনও হেলদোল হয়নি। কারণ, ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা জিশানের মধ্যে থেকে কয়েক মাস আগেই উধাও হয়ে গেছে।

কিলার অপাশির সঙ্গে কিলার সুখারামের ফোনে কথাবার্তা চলছিল। টিভি ক্যামেরা পালা করে একবার একে আর-একবার ওকে দেখাচ্ছিল—ঠিক সিনেমার মতন।

ছোটমাপের এই প্লেট টিভিটা হাতে না পেলে জিশান খুনিদের স্যাটেলাইট ফোনের ব্যাপারটা জানতেই পারত না। ভাগ্যিস একটা টিভি জোগাড় করার কথা ওর মনে হয়েছিল!

টিভির খোঁজ করতে কাঞ্চন আর টুকটুকিদের বাড়ির কাছেই আবার ফিরে গিয়েছিল জিশান। ওকে ফিরে আসতে দেখে জনতা হইহই করে উঠেছিল। ওর মোটরবাইক ঘিরে ধরেছিল চোখের পলকে।

দু-হাত তুলে ওদের হুল্লোড় আর উৎসাহ থামিয়ে একটা ছোট টিভির জন্য আবেদন করেছিল জিশান। ব্যস, তাতেই কাজ হল। এক মিনিটের মধ্যেই নানান মাপের ছ’-ছ’টা প্লেট টিভি এসে হাজির হল ওর সামনে। তার মধ্যে থেকে আট ইঞ্চি ডায়াগনালের ছোট প্লেট টিভিটা জিশান বেছে নিয়েছিল।

জিশান আর দেরি করল না। ট্র্যাকার আর টিভি গুছিয়ে রেখে বাইকে স্টার্ট দিল। ফ্লাইওভার পেরিয়ে বাঁ-দিকের ঢালু রাস্তা ধরে নেমে গেল।

একটু পরেই জঙ্গল শুরু হয়ে গেল। গাছগাছালির মধ্যে দিয়ে প্যাঁচালো সুঁড়িপথ। তার ওপর পথটা আবার ডাল, পাতা আর আগাছায় ঢাকা। তারই ওপর দিয়ে জিশানের বাইক কোনওরকমে এগিয়ে চলল।

বাইকের গর্জনে গাছে বসে থাকা পাখিরা চঞ্চল হয়ে ডাকতে লাগল, ডানা ঝাপটে এ-গাছ থেকে ও-গাছে ওড়াউড়ি করতে লাগল। ছোট চেহারার গোলাপি বানরের দল চিঁ-চিঁ শব্দ করে ডালে-ডালে ছোটাছুটি করতে লাগল। ছাইরঙের দুটো খরগোশ চমকে উঠে ছুটে পালাল।

জিশান বেশ বুঝতে পারছিল, বাইকের শব্দটা ওর শত্রু। এই নির্জন শহরে বহু দূর থেকে ওর বাইকের আওয়াজ শোনা যাবে। তা ছাড়া বাইকটা কোথাও রেখে ও যে কোনও একটা গোপন আস্তানায় লুকিয়ে পড়বে তারও উপায় নেই। ট্র্যাকারের সবুজ ডট ওর নিখুঁত কো-অর্ডিনেট শত্রুদের জানিয়ে তো দেবেই, উপরন্তু ওর ছেড়ে যাওয়া বাইকটা নি:শব্দ চিৎকারে জানিয়ে দেবে যে, ও কাছাকাছিই কোথাও লুকিয়ে আছে।

তা হলে শত্রুদের চোখে ধুলো দেওয়ার উপায় কী?

এসব কথা ভাবতে-ভাবতে জিশান বোধহয় একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। হঠাৎই ও দূরে গাছের আড়ালে দুটো হরিণ দেখতে পেল। হরিণ দুটোর গায়ের রং সোনালি-বাদামি আর সাদা। পেটের কাছ বরাবর লম্বা গাঢ় বাদামি দাগ। মোটরবাইকের আওয়াজে ওরা চমকে তাকিয়েছে জিশানের দিকে। তারপরই জঙ্গলের মধ্যে ছুট লাগিয়েছে।

জিশান বাইক থামাল। আর কতক্ষণ ও এই বাইকটা নিয়ে ছুটবে? কারণ, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই হয়তো এই মেশিনটার তেল ফুরিয়ে যাবে। তখন?

জিশানের বিভ্রান্ত লাগল। নানান চিন্তা ওর মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল।

একটু পরেই ট্র্যাকারটা বের করে দেখল ও। একটা লাল ডট ওর সবুজ ডটের বেশ কাছে এসে গেছে। সেটা কে? অপাশি কানোরিয়া? না সুখারাম নস্কর? নাকি তিন নম্বর কিলার?

আর ভাবার দরকার নেই। ট্র্যাকার উলটে অপটিক্যাল ট্যাবলেট দেখল। ওর মনে হল, ঘর-বাড়ির এলাকায় গেলেই ওর লড়াইয়ের কাজটা সহজ হবে। সুতরাং ও সেদিকে বাইক ছুটিয়ে দিল।

কিছুটা পথ চলার পরই জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা দেখতে পেল। জায়গাটা গাছের পাতায় ঢাকা। টাটকা আর শুকনো গাছের পাতা কেউ যেন সেখানে ঝেঁটিয়ে এনে জড়ো করেছে।

জিশান বাইক চালাতে-চালাতেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিল। আর ঠিক সেই সময়েই দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল।

ওর বাইক চলে এসেছিল গাছের পাতায় ঢাকা জায়গাটার ওপরে। আর সঙ্গে-সঙ্গে গাছের পাতাগুলো চোরাবালির মতো বাইকসমেত জিশানকে গিলে ফেলল।

জিশান নীচের দিকে পড়তে লাগল। গাছের পাতাগুলো বৃষ্টির মতো ওর শরীরের ওপরে ঝরে পড়ছিল। একটু পরেই নরম মাটিতে ও বাইকসমেত আছড়ে পড়ল। এবং বাইক থেকে ছিটকে গেল।

কয়েকটা মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কোমরে ব্যথা। ডানহাতের কনুইয়েও সামান্য লেগেছে। গা থেকে কয়েকটা শুকনো পাতা ঝেড়ে ফেলল ও। বাইকটাকে সোজা করে দাঁড় করানোর আর চেষ্টা করল না। কারণ, বাইক নিয়ে এই গর্ত থেকে বেরোনোর কোনও গল্প নেই।

গর্তটা অনেকটা গন্ডার বা হাতি শিকারের ফাঁদের মতো। শুধু গর্তের নীচে শূলের মতো কাঠের গজাল পোঁতা নেই এই যা! কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে এরকম ফাঁদের ব্যবস্থা কেন?

ঠিক সেই মুহূর্তে জিশানের স্যাটেলাইট ফোন বেজে উঠল।

ফোন ধরল জিশান। শ্রীধর পাট্টা।

‘এই গর্তটা সারপ্রাইজ, জিশান। গেম সিটিতে এরকম আরও অনেক সারপ্রাইজ তোমার জন্যে ওয়েট করছে…।’

জিশান বিরক্তভাবে ‘থ্যাংক য়ু ভেরি মাচ’ বলে ফোন কেটে দিল। এখন এই সাইকোপ্যাথটার সঙ্গে বাজে বকার সময় নেই। আগে এই গর্তটা থেকে বেরোনো দরকার। কে জানে, হয়তো কোনও কিলার এই মুহূর্তে ওকে খতম করতে গর্তটার দিকেই এগিয়ে আসছে। প্লেট টিভিটা একবার দেখা যাক। সেই সঙ্গে ট্র্যাকারটাও।

পড়ে থাকা বাইকের কেরিয়ারের দিকে হাত বাড়াল। যন্ত্র দুটো এখনও ঠিকঠাক আছে তো!

ট্র্যাকারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল জিশান। একটা লাল ডট সবুজ ডটের মারাত্মক কাছাকাছি। সঙ্গে-সঙ্গে ট্র্যাকার রেখে প্লেট টিভি অন করল।

পরদায় অপাশি কানোরিয়ার মুখ। কী যেন একটা করছে ও।

একটু পরেই দেখা গেল ও কী করছে। একটা বড়সড় জেরিক্যান থেকে জলের মতো কী যেন ঢালছে জঙ্গলের ঘাস-পাতার ওপরে। একটু দূরে একটা মোটরবাইক দাঁড় করানো রয়েছে।

কমেন্টেটর তখন বলছেন, ‘ফোকস, শিকার আর শিকারি এখন অনেক কাছাকাছি এসে গেছে। পরিভাষায় যাকে বলে স্ট্রাইকিং ডিসট্যান্স। জিশানকে জঙ্গলের মধ্যে ট্র্যাক করার জন্যে কিলার অপাশি কানোরিয়া একটু আগেই গাড়ি ছেড়ে দিয়ে মোটরবাইক নিয়েছে। এখন ও বাইক থেকে নেমে অভিনব অপারেশান শুরু করেছে। জেরিক্যান থেকে অপাশি কী একটা লিকুইড যেন ঢালছে…।’

তখনই পেট্রলের গন্ধ পেল জিশান। শুকনো গাছের পাতা ভেজাতে-ভেজাতে তরল জ্বালানি নেমে আসছে গর্তের ভেতরে। জিশানের মরণকূপে। এরপর শুধু দরকার একটা দেশলাই-কাঠি।

অপাশি তা হলে অস্ত্র হিসেবে পেট্রল ভরতি কয়েকটা জেরিক্যানও নিয়েছিল!

জিশান ক্ষিপ্রগতিতে ট্র্যাকার আর টিভি ঢুকিয়ে দিল ওর রুকস্যাকে। তারপর হাঁচড়পাঁচড় করে গর্ত বেয়ে উঠে আসতে চাইল। কিন্তু বারবার হাত-পা স্লিপ করতে লাগল। তবে চারবারের চেষ্টায় খানিকটা উঠতে পারল। আর তখনই পেট্রলের ভেজা পথ ধরে আগুনের লকলকে শিখা ছুটে এল গর্তের দিকে।

জিশান একটা গাছের শিকড় ধরে এক হ্যাঁচকায় শরীরটাকে টেনে তুলল ওপরে। তখনই দাউদাউ শিখা ডিঙিয়ে অপাশি কানোরিয়াকে দেখতে পেল। নির্বিকার শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতে লম্বা একটা চপার। তার চকচকে ফলা থেকে কমলা রঙের আগুনের ছায়া ঠিকরে বেরোচ্ছে। অপাশির বেশ কিছুটা পিছনে দাঁড় করানো রয়েছে একটা মোটরবাইক।

আগুনের তাপ আর শিখায় ভয় পেয়ে গেল গাছের পাখিরা। ওরা গাছের আশ্রয় ছেড়ে ছিটকে গেল আকাশে। একটা খরগোশ আর একটা বনবেড়াল কোন আড়াল থেকে বেরিয়ে দিগভ্রান্তের মতো ছুট লাগাল।

জিশানও ঘাবড়ে গিয়ে ছুটতে শুরু করল। বিদ্যুৎঝলকের মতো ওর মনে পড়ল, অপাশি কানোরিয়ার ফেরোসিটি কোশেন্ট 9.4।

‘জিশা—ন!’ বলে মিহি গলায় ডেকে উঠল অপাশি। আর একইসঙ্গে আদিবাসী যোদ্ধাদের ক্ষিপ্রতায় ওর হাতের চপারটা জিশানকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল। ইস্পাতের অস্ত্রটা শূন্যে লাট খেয়ে তিরবেগে ছুটে এল জিশানের দিকে।

ছুটতে-ছুটতেই জিশান আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে। চপারটা ওর শরীরের ইঞ্চিছয়েক ওপর দিয়ে বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল। গেঁথে গেল একটা গাছের গুঁড়িতে। থরথর করে কাঁপতে লাগল।

আবার উঠল জিশান। আবার ছুট। গাছপালার আড়ালে-আড়ালে, এঁকেবেঁকে। নাকে আসছে গাছ-পাতা পোড়ার গন্ধ। সেইসঙ্গে শরীরে টের পাচ্ছে গরম বাতাসের ছোঁয়া।

ছুটতে-ছুটতেই পকেটে হাত ঢোকাল। টেনে বের করে নিল মিসাইল গান। থমকে ঘুরে দাঁড়িয়ে অপাশিকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপল। এক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অপাশি সরে গেল একটা গাছের গুঁড়ির আড়ালে। ও যে শুধু সেজন্য বেঁচে গেল তা নয়। এখানে-সেখানে আগুন তখনও জ্বলছিল। ফলে মিসাইলের ইনফ্রারেড ট্র্যাকিং সিস্টেম বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। মিসাইলটা জলন্ত গাছ-পাতার আগুনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

এ-অঞ্চলের বাড়ি-ঘরগুলো কোনদিকে আছে জিশানের সেটা ভালোই আন্দাজ ছিল। ও মোটামুটি সেদিক লক্ষ্য করেই দৌড়তে লাগল। এক্ষুনি আর-একটা মোটরবাইক ওর দরকার। এক্ষুনি।

পিছন থেকে অপাশির মোটরবাইক স্টার্ট করার শব্দ কানে এল। সঙ্গে-সঙ্গে জিশান দৌড়ের গতি আরও বাড়িয়ে দিল। ও এটুকু বুঝেছিল, গাছপালার গোলকধাঁধার মধ্যে অপাশি কখনই খুব জোরে বাইক ছোটাতে পারবে না।

একটু পরেই জিশান বেরিয়ে পড়ল ফাঁকা রাস্তায়।

বেলা প্রায় দশটা। কংক্রিটের রাস্তা রোদে ঝকঝক করছে। রাস্তার দুপাশে ফুলের বাগান। তাতে ছবির মতো ফুল। সেই ফুলের টানে বেশ কয়েকটা প্রজাপতি ওড়াউড়ি করছে।

রাস্তা ধরে একটু এগোতেই বেশ কিছু দোকানপাট আর অনেকগুলো বাড়ির ব্লক। বাড়িগুলোর সামনে সার বেঁধে গাড়ি আর বাইক পার্ক করা রয়েছে।

জিশান ছুটতে-ছুটতে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কংক্রিটের রাস্তা ধরে অপাশির বাইক ছুটে আসছে।

শ্রীধরের কথা জিশানের মনে পড়ল : কোনও বাড়ি কিংবা দোকানের ভেতরে যদি জিশান আর কিলারদের কোনও মোকাবিলা হয় তো সেটা হবে পুরোপুরি অস্ত্রহীন মোকাবিলা। অপাশির যা চেহারা জিশান দেখেছে তাতে খালি হাতের লড়াইয়ে ও জিশানের কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। সেটাই এবার পরখ করে দেখা দরকার।

জিশান ঢুকে পড়ামাত্রই বাড়িটায় হইচই হাঙ্গামা শুরু হয়ে গেল। এ-ঘর সে-ঘর থেকে ‘জিশান! জিশান!’ রব উঠল। কেউ-কেউ আনন্দে সিটি বাজাল।

কিন্তু জিশানের কোনওদিকে নজর ছিল না। ও লোকজনকে ঠেলে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, ‘অপাশি কানোরিয়া আমার পেছনে তাড়া করে আসছে। আমি ছাদে যাচ্ছি—।’

‘চারতলায়! ছাদ চারতলায়!’ ওপরদিকে আঙুল দেখিয়ে চেঁচিয়ে উঠল দুজন ‘সিটিজেন’।

গেম সিটিতে যেসব ‘সিটিজেন’রা আজ হাজির রয়েছে তারা প্রত্যেকেই হাজিরা দেওয়ার জন্য পুরস্কার পাবে। এ ছাড়াও নানান অ্যাক্টিভিটির জন্য রয়েছে ‘সারপ্রাইজ প্রাইজ মানি’। তাই এই মানুষজনের উৎসাহ-উদ্দীপনার অন্ত নেই।

জিশান তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। একবার ছাদে পৌঁছতে পারলে ও অনেকটা নিশ্চিন্ত। সেখানে ও অনেকটা খোলা জায়গা পাবে। তা ছাড়া মার্শালের নিয়ম অনুযায়ী সেখানে সশস্ত্র লড়াই করা যাবে না। সুতরাং ছাদে শেষ পর্যন্ত যেটা হবে সেটা অপাশির সঙ্গে ওর হাতাহাতি লড়াই। সে-লড়াইয়ে অপাশি নস্যি।

ছাদে এসে পৌঁছল জিশান। বিশাল বড় খোলা ছাদ। আকাশের দিকে মুখ করে বুক চিতিয়ে পড়ে আছে। মাথার ওপরে সূর্য ঠিক-ঠিকভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছে। আলো আর উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে চারিদিকে।

জিশান ছুটে গেল বাঁ-দিকের পাঁচিলের কাছে। ঝুঁকে পড়ে নীচের রাস্তার দিকে তাকাল। অপাশি এখন কোথায়?

প্রশ্নের উত্তর দিল মিসাইল গান। অপাশি মিসাইল গান হাতে তোলার সঙ্গে-সঙ্গেই বসে পড়েছিল জিশান। তাই ছাদের পাঁচিল বর্ম হয়ে ওকে বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু বিকট শব্দ হল। পাঁচিলের একটা অংশ ভেঙে চৌচির হয়ে খসে পড়ল। জিশান ছুটে সরে এল ছাদের ঠিক মাঝখানে। এখান থেকে ছাদের দরজার দূরত্ব অনেকটাই। ফলে অপাশি ছাদে এলে ও তৈরি হওয়ার জন্য অনেকটা সময় পাবে।

তারপর হাতাহাতি লড়াই।

রুকস্যাকটা পিঠ থেকে নামাল জিশান। চটপট ট্র্যাকার আর টিভি বের করে দেখল।

ট্র্যাকারে একটা লাল ডট সবুজ ডটের খুব কাছাকাছি। ওটা বোধহয় অপাশি কানোরিয়া। বাকি দুটো ডট তার তুলনায় মোটামুটি দূরে।

এবার টিভি অন করল জিশান। অপাশি একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে—সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। কিন্তু ওর হাতে ওগুলো কী?

শ্রীধর পাট্টা তো নিয়ম করেছেন বাড়ির ভেতরে অস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না! কারণ, তাতে গেম সিটির ‘সিটিজেন’দের বিপদ হবে। তা হলে অপাশির দু-হাতে দুটো অস্ত্র কেন? বাঁ-হাতে একটা ধারালো চপার, আর ডানহাতে টুয়েন্টি এমএম টেন শটার নিউক্লিয়ার পিস্তল।

টিভি আর ট্র্যাকার চটপট রুকস্যাকে ঢুকিয়ে নিল জিশান। পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করল। স্পিড ডায়াল মোডে শ্রীধর পাট্টাকে ফোন করল।

ও-প্রান্তে একবার রিং বাজতেই শ্রীধর ফোন ধরলেন।

‘বলো, জিশান—হাউ আর য়ু?’

‘এসব কী হচ্ছে! বাড়ির মধ্যে আর্মস নিয়ে ঢুকেছে অপাশি। গেমের রুলে তো এটা বারণ ছিল!’

‘সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ!’ ও-প্রান্তে চিবিয়ে হাসলেন শ্রীধর : ‘তা ছাড়া কানোরিয়া বিল্ডিং-এ শুধু আর্মস নিয়ে ঢুকেছে—ইউজ তো করেনি। তাই অফিশিয়ালি ও এখনও ক্লিন। আর সেকেন্ড পয়েন্টটা হল, তোমাদের মোকাবিলা যদি হয় তো সেটা হবে ছাদে। সেটাও অফিশিয়ালি ”বাড়ির ভেতরে” হল না।’ শ্রীধর ছোট করে দুবার কাশলেন : ‘সুতরাৎ এসব ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে লড়াই করো, জিশান। ফাইট। সারভাইভ।’ আচমকা ফোন কেটে দিলেন শ্রীধর।

আর তখনই জিশান টিভিতে দেখতে পেল, অপাশি ছাদের দরজা ডিঙিয়ে ছাদে পা দিচ্ছে। টিভি থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকিয়েও দেখতে পেল একই দৃশ্য।

সঙ্গে-সঙ্গে রুকস্যাকের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল জিশান। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে একটা মিনি গ্রেনেড বের করে নিল। তারপর শোওয়া অবস্থাতেই সেটার পিন দাঁতে টেনে অপাশিকে লক্ষ্য করে ছুড়ে দিল।

জিশানকে অবাক করে ওই মোটা শরীর নিয়েও অপাশি আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় বাঁ-দিকে লাফিয়ে পড়ল। নিউক্লিয়ার পিস্তল ফায়ার করল জিশানকে তাক করে।

আপেক্ষিক গতিবেগের জটিলতায় স্বাভাবিক কারণেই অপাশির নিশানা তাকছুট হয়ে গেল। আর জিশানের মিনি গ্রেনেডও অপাশির গায়ে লাগেনি। তবে বিকট শব্দ, আগুন আর ধোঁয়া বাড়ির সবাইকে বিস্ফোরণের খবর পাঠিয়ে দিল।

অপাশি তখনও ছাদের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর জিশান সবে হাঁটুগেড়ে উঠে বসেছে। হঠাৎই ছাদের দরজা দিয়ে পাঁচ-ছ’জন ‘সিটিজেন’ ঢুকে পড়ল খোলা ছাদে। ওরা ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে অপাশির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওকে এলোপাতাড়ি কিল-চড়-ঘুসি মারতে লাগল।

ওদেরই মধ্যে দুজন চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘জিশান, পালাও! পালাও!’

জিশান রুকস্যাকটা তুলে নিয়ে ছুট লাগাল ছাদের দরজার দিকে।

সিঁড়ি নামতে-নামতে জিশান সদ্য-হওয়া অভিজ্ঞতাটার কথা ভাবছিল। এই আবেগমাখানো সমীকরণটার কথা নিশ্চয়ই শ্রীধর পাট্টা ভাবতে পারেননি। জিশানের পাবলিক ইমেজ আসল জিশানের চেয়ে বোধহয় অনেক বড়। নইলে এইরকম নিয়ম-ভাঙা ঘটনা কখনও ঘটে!

শ্রীধরকে ফোন করে জিশানের বলতে ইচ্ছে করল, ‘সারপ্রাইজ! সারপ্রাইজ!’

দোতলা থেকে একতলার দিকে নামতে-নামতে টিভির ধারাবিরণী কানে এল ওর : ‘আশ্চর্য! অবাক কাণ্ড! চমকে দেওয়া ঘটনা। গেম সিটির ছ’জন ”সিটিজেন” কিলার অপাশির ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে প্রবল পেটাচ্ছে। জিশানকে ওরা নিউক্লিয়ার পিস্তলের মুখ থেকে কান ঘেঁষে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আপনারা তো জানেন, বন্ধুগণ, কিল গেমের দিন গেম সিটিতে যেসব মক ”সিটিজেন” হাজির থাকে তারা প্রত্যেকেই পুরস্কার হিসেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা পায়। কিন্তু এই মুহূর্তে জিশানকে বাঁচানোর জন্যে ওরা প্রত্যেকে কুড়ি হাজার টাকা করে বোনাস পুরস্কার পাবে। কিল গেম জমে উঠেছে, বন্ধুগণ—দারুণ জমে উঠেছে…।’

বাড়িটা থেকে বেড়িয়ে এসেই আবার ছুট, ছুট, ছুট। একটা মোটরবাইক চাই। এক্ষুনি। ওই তো, দেখা যাচ্ছে!

রাস্তা পেরিয়ে জিশান ছুটে গিয়ে চড়ে বসল একটা মোটরবাইকে। পুশবাটন স্টার্ট দিতেই বাইকটা গর্জন করে উঠল। সাইলেন্সার পাইপ দিয়ে অল্প ধোঁয়া বেরোল। তারপর ‘হুউশ’ করে ছুটে গেল সামনের দিকে।

নিউক্লিয়ার পিস্তল আর চপারের ভয় দেখিয়ে অপাশি ‘সিটিজেন’দের জটলা থেকে কোনওরকমে বেরিয়ে এল।

রাগে ওর ভিতরটা গরগর করছিল। তিনতলার একটা ঘরের ভিতর থেকে টিভির আওয়াজ ছুটে আসছিল : ‘অপাশি কানোরিয়া ব্যর্থ হয়েছে। দ্য সুপার কিলার হ্যাজ ফেইলড। এখন অপাশি সিঁড়ি দিয়ে নামছে…তাড়া করছে জিশানকে। কিন্তু মনে হয় না এ-দফায় ও কিছু করতে পারবে। কারণ, জিশান এখন বাইক নিয়ে ছুটছে…।’

কানোরিয়া ঢুকে পড়ল ঘরটার ভেতরে। সেখানে দুজন বয়স্ক পুরুষ প্লেট টিভির দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। হাতে ফ্লাফি কুকিজের প্যাকেট। ওদের হাত আর মুখ চলছিল।

একটা নোংরা গালাগাল দিল অপাশি। তারপর এক ঝটকায় টিভির কাছে গিয়ে যন্ত্রটার ওপরে চপারের কোপ বসিয়ে দিল। আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছিটকে বেরোল টিভি থেকে। শর্ট সার্কিটের ‘ফটফট’ শব্দ হল। টিভির পরদা দপ করে আঁধার হয়ে গেল।

‘সিটিজেন’ দুজন ভয়ে চিৎকার করে উঠল। অপাশি সেটাকে আমল না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল বাইরে। ওর পক্ষে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব তত তাড়াতাড়ি সিঁড়ি নামতে শুরু করল। জিশান—জিশানকে এখন ওর চাই। জিশানের রক্ত চাই।

জিশান বাইক ছুটিয়ে দিয়েছিল নদীর দিকে। সেখানে ফ্লাইওভার পেরিয়ে ও চলে যেতে চায় গেম সিটির পশ্চিমদিকে। সেখানে একটা বিশাল এলাকা জুড়ে ঘন জঙ্গল রয়েছে। দিনেরবেলাটা ও জঙ্গলে লুকিয়ে থেকে সময়টা কাটিয়ে দিতে চায়। তারপর সন্ধে হলে, অন্ধকার নামলে, ওর লুকিয়ে থাকার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

পথে বাইক দাঁড় করিয়ে ও একবার ট্র্যাকার দেখে নিয়েছে। তিনটে লাল ডটের অবস্থান এখন খানিকটা এলোমেলো। কারণ, জিশানের গতিবিধি ওদের হিসেবকে গুলিয়ে দিয়েছে। তাই ওরা চক্রবূহ্যের মতো সবুজ ডটটাকে ঘিরে ধরতে পারেনি।

আরও কিছুক্ষণ বাইক ছোটানোর পর জিশানের টিভি দেখতে ইচ্ছে করল। তিনজন কিলার এখন কী করছে?

কৌতূহল মেটাতে বাইক দাঁড় করাল জিশান। টিভি বের করে অন করল।

পরদায় ভেসে উঠল একটু অদ্ভুত মুখ। মুখ না বলে মুখোশ বলাটাই বোধহয় বেশি ভালো। মাথায় চুলের ধাঁচে তৈরি একটা চকচকে কালো টুপি। মাথায় এমনভাবে এঁটে বসেছে যে, সেটা আদতে টুপি নাও হতে পারে—হয়তো চুলের একটা অদ্ভুত স্টাইল। তবে দেখে মনে হচ্ছে, চুলটা প্লাস্টিক অথবা মেটালের তৈরি। কিংবা প্লাস্টিক আর মেটালের প্লাজমা মিক্সচার ব্যবহার করা হয়েছে।

চোখে কালো চশমা। চশমার কাচ অথবা পলিমার যেন ছোট-ছোট দুটো আয়তক্ষেত্র—চোখ দুটোকে রোদ কিংবা অন্যান্য ক্ষতিকারক রশ্মির হাত থেকে বাঁচাচ্ছে। দু-কানে মেটালের মোটা রিং। ভাঙা চোয়াল। ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট—ঠিক যেন মসৃণ চামড়াকে ব্লেড দিয়ে চিরে মুখের রেখা তৈরি করা হয়েছে।

লোকটির গায়ে পলিমারের তৈরি আঁটোসাঁটো চকচকে ফুলহাতা পোশাক—যেন দ্বিতীয় চামড়া, অনেকটা স্কুবা ডাইভারদের মতন। দু-হাতে কালো দস্তানা। পায়ে কালো স্নিকার। আর পিঠে একটা কালো রুকস্যাক।

ক্যামেরা একটু দূরে সরে যেতেই লোকটার পুরো চেহারাটা দেখা গেল: ছিপছিপে, লম্বা—চাবুকের মতো।

টিভির ভাষ্যকার তখন বলছে, ‘বন্ধুগণ, আসুন—কিলার প্রাোটনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই। প্রাোটনের রক্ত ঠান্ডা, বরফের মতো। চোখের নজর দিনে শকুনের মতো, রাতে প্যাঁচার মতো, কারণ, ওর আই গিয়ারে নাইটভিশান ইন্সন্ট্রুমেন্ট ফিট করা আছে। ওর হাতের নখ চোখা এবং শক্ত। বাঘ এবং সাপের সঙ্গে এই নখের মিল রয়েছে, কারণ, ওই জোরালো এবং ধারালো নখের ডগায় বিষ মাখানো আছে। ওই নখের এক আঁচড়ে একটা জোয়ান মানুষ পলকে ছটফটিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে।

‘কিলার প্রাোটন এতক্ষণ ধরে জিশানের স্ট্র্যাটেজি ওয়াচ করছিল, আর নিজের স্ট্র্যাটেজি ক্যালকুলেট করছিল, তৈরি হচ্ছিল মনে-মনে। এবার কিলার প্রাোটন অ্যাকশানে নেমেছে। সো কনটিনিউ ওয়াচিং দ্য কিল গেম, ফোকস। খেলা ক্রমশ আরও এক্সাইটিং হয়ে উঠছে…।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *