১৭. এবড়োখেবড়ো রাস্তা

১৭.

কয়েক মিনিটের মধ্যে খালধারের রাস্তায় এসে পড়ল। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় বাইক লাফাতে-লাফাতে ছুটছে। ওই তো দেখা যাচ্ছে, আকাশ জুড়ে টাওয়ার কোম্পানির পোড়া গোডাউনের কালো ছায়া। তার পাশে অনেক উঁচুতে টাওয়ার কোম্পানির লাল-নীল রঙের নিওন সাইন। এখনও সেটা জ্যান্ত—জ্বলছে-নিভছে। বোধহয় পোড়া গোডাউনের ডেডবডিটাকে পাহারা দিচ্ছে।

মোটরবাইকের হেডলাইটের আলোয় বদনোয়াকে দেখতে পেল। খালধারের ভাঙাচোরা রাস্তার একদিকে টাওয়ার কোম্পানির গোডাউন, আর অন্যদিকে মা-বোনের মহাঘাতক। বাইকের পাশে দাঁড়িয়ে আছে—হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।

বাইকের গতি কমাতে লাগল সুখারাম। লক্ষ করল, বাইকটাকে দেখে বদনোয়া হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিল। তারপর ডানহাতটা পকেটে ঢোকাল।

সুখারাম জানত বদনোয়া ঝামসার বাইকটা আগে চিনতে পারবে, তারপর—কয়েক সেকেন্ড পর—বুঝতে পারবে বাইকের ওপরে যে বসে আছে সে একা। এবং সে ঝামসা নয়—অন্য কেউ।

কিন্তু ওই কয়েক সেকেন্ডই যথেষ্ট। যে-কাজের জন্য ওই কয়েক সেকেন্ড যথেষ্ট সেই কাজটাই এখন শুরু করল সুখারাম।

আচমকা বাইকের গতি বাড়িয়ে দিল। এক ঝটকায় বাইকটা গর্জন তুলে চিতাবাঘের গতি নিল। বদনোয়াকে লক্ষ্য করে পাগলের মতো ছুটে চলল।

বদনোয়া পকেট থেকে ওর রিভলভারটা বের করতে যাচ্ছিল, কিন্তু পুরোপুরি বের করে ওঠার আগেই সুখারামের বাইক সরাসরি এসে ওর পেটে ধাক্কা মারল।

আত্মরক্ষার জন্য বদনোয়া বাঁ-হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সংঘর্ষের অভিঘাতে ওর গোটা দেহটা সামনে ঝুঁকে পড়ল। সুখারামের মাথার সঙ্গে ওর মাথা ঠুকে গেল। যন্ত্রণার শব্দ বেরিয়ে এল দুজনের মুখ থেকেই। কিন্তু শব্দগুলো এমন জড়িয়ে গেল যে, আলাদা করে চেনা গেল না।

সংঘর্ষের সময় স্থিতিজাড্য বদনোয়ার ওপরে কাজ করেছিল। তাই ডানহাতটা ও আর পকেটে ঢোকাতে পারেনি—রিভলভারটা পকেটেই থেকে গেছে। আর ওর ভারী শরীরটা শূন্যে তুলে নিয়েছে সুখারামের বাইক। প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় বদনোয়া বাইকের হাতল আঁকড়ে ধরেছিল। ওই অবস্থাতেই সুখার বাইক ওকে ‘কোলে’ করে ছুটে চলল।

মাথায়-মাথায় ঠুকে গিয়ে সুখারামের অসহ্য ব্যথা করছিল। মাথার ভেতরে পাগল করা দপদপানি। কিন্তু ওর হাত এক অমানুষিক জেদে অ্যাকসিলারেটর আঁকড়ে ধরে ছিল। গোঁ-গোঁ করতে-করতে বাইকটা ছুটে চলল খালের দিকে।

ইট-পাথরে ঠোকর খেয়ে বাইকটা লাফাচ্ছিল। সেই অবস্থাতেই দু-চাকাওলা গাড়িটা খালপাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল।

নামতে-নামতে নিয়ন্ত্রণহীন বাইকটা একটা তেঁতুল গাছের গুঁড়িতে ধাক্কা খেল। সঙ্গে-সঙ্গে ঝড়ের পাখির মতো শূন্যে ছিটকে গেল বদনোয়া আর সুখারাম। বাতাসে বৃত্তচাপ এঁকে ওদের শরীর দুটো খালের জলে গিয়ে পড়ল। কয়েক লহমার তফাতে দুটো ‘ঝপাং শব্দ হল। খালের তেলচিটে কালো জল ওদের অজগর সাপের মতো গিলে ফেলল।

তেঁতুল গাছের গুঁড়ি আর একটা পাথরের ফাঁকে বাইকটা আটকে গিয়েছিল। বাইকের ইঞ্জিনের শব্দ ক্রমশ ক্ষয়ে আসছিল। হেডলাইটের আলোটাও মলিন হয়ে যাচ্ছিল। এদিক-ওদিক থেকে ছিটকে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলো খালের জলে পড়ে চিকচিক করছিল। দুটো শরীর খালের জলে আলোড়ন তোলায় চিকচিক করা আলোর বিন্দুগুলো এপাশ-ওপাশ দুলছিল।

একটু পরে সুখারামের কালো মাথাটা খালের জলের ওপরে ভেসে উঠল। ওর চোখ-মুখ-নাক জ্বালা করছে, নাকে আসছে কটু দুর্গন্ধ। চারপাশে নোংরা আবর্জনা আর পচা কচুরিপানা। জলের মধ্যে মিশে আছে থকথকে পোড়া মোবিল আর কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ। সুখারামরা ঠাট্টা করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত যে, এই খালের জলে কেউ ডুবে মারা যাবে না, মারা যাবে বিষাক্ত দূষণে। ব্যাপারটা যে আসলে ঠিক কী সেটা সুখা এখন আন্দাজ করতে পারল।

খালটা তেমন গভীর নয়। জলের নীচে সুখার পা পাঁকের মধ্যে বসে যাচ্ছিল। ও হাত দিয়ে চোখ-মুখের ওপর থেকে কালো চটচটে জল সরাল। তারপর এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে বদনোয়ার খোঁজ করতে লাগল।

প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বদনোয়ার মাথা দেখা গেল জলের ওপরে।

প্রাণপণে মাথা ঝাঁকাচ্ছে, বাতাস টানার জন্য হাঁকপাঁক করছে।

সুখারাম ওর মাথা নামিয়ে নিল, প্রায় নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে দিল জলে। তারপর খালের ধার ঘেঁষে ছেয়ে থাকা কচুরিপানার ঝাঁকের দিকে সরে যেতে লাগল।

দুর্গন্ধে সুখারামের দম আটকে আসছিল। কিন্তু প্রতিশোধের আক্রোশ ওকে সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা জোগাচ্ছিল।

আকাশে মেঘ অনেক গাঢ় হয়েছিল। হঠাৎই ছোট-ছোট বিদ্যুতের টুকরো ঝলসে উঠল সেখানে। তার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই চাপা গুড়গুড় আওয়াজ।

তখনই সুখারাম খেয়াল করল, বদনোয়ার ডানহাত উঁচিয়ে রয়েছে শূন্যে। সেই হাতের মুঠোয় ওর প্রিয় রিভলভার। ও এদিক-ওদিক নজর মেলে সুখারাম নস্করকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে।

জলে ভিজে যাওয়ার পর রিভলভার ঠিকঠাক কাজ করে কি না সুখা জানে না। তবে অনেক সিনেমায় ও নায়ককে জলের তলা থেকে গুলি ছুড়তে দেখেছে। তাই সাবধান থাকাটা দরকার।

কচুরিপানার ঝাঁককে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করল সুখারাম। একইসঙ্গে গা গুলিয়ে ওঠা ভাবটাকে দমিয়ে রাখতে দাঁতে দাঁত চাপল। হালকাভাবে হাত চালিয়ে খালের পাড়ে পৌঁছল।

খালের পাড়ে প্রচুর পরিত্যক্ত জিনিস আর আবর্জনা। তারই মধ্যে একটা লম্বা গাছের ডাল খুঁজে পেয়ে গেল। ফুট পাঁচেক লম্বা, সামান্য আঁকাবাঁকা, শক্তপোক্ত আর ভারী।

অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে ওটা আঁকড়ে ধরল। সঙ্গে-সঙ্গে বুকের ভেতরে একধরনের আত্মবিশ্বাস আর শক্তি তৈরি হয়ে গেল। ডালটা ও নি:শব্দে জলের মধ্যে টেনে নিল। জলের ওপরে বিছিয়ে থাকা কচুরিপানার জালের তলায় ঢুকে পড়ল। মাথা সামান্য উঁচিয়ে কচুরিপানার ফাঁকফোকর দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাসের কাজ চালাতে লাগল।

বদনোয়া সতর্কভাবে পাঁকের ভেতরে পা ফেলছিল আর এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছিল। কোথায় গেল হারামি কা অওলাদ?

সুখাকে খুঁজতে-খুঁজতে খালের কিনারার দিকে এগোচ্ছিল বদনোয়া। হঠাৎই কচুরিপানার জাল ঠেলে একটা ভূত মাথা তুলল। তার হাতে ধরা একটা আঁকাবাঁকা লাঠি। বদনোয়া রিভলভার চালানোর আগেই লাঠিটা নিষ্ঠুরভাবে ওর ব্রহ্মতালুতে এসে পড়ল। একবার—দুবার।

তারপরই আর-একটা আঘাত এসে আছড়ে পড়ল ডান চোয়ালে। এবং আবার।

কালো ভূতটা একের পর এক নিষ্ঠুর আঘাতে বদনোয়ার মুখ আর মাথা গুঁড়ো করতে লাগল। একইসঙ্গে খ্যাপা জানোয়ারের মতো অর্থহীন চিৎকার করতে লাগল।

একটু পরেই বদনোয়া খালের জলে তলিয়ে গেল। কালো গাঢ় জলে বুড়বুড়ি উঠল কিছুক্ষণ। তারপর সব শেষ।

লাঠিটা ফেলে দিয়ে খাল থেকে টলতে-টলতে উঠে এল সুখারাম। আবেগে ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। সারা গায়ে কালো তেলচিটে আঠালো তরল আর কয়েকটা কচুরিপানা।

এলোমেলো পা ফেলে খালপাড়ের চড়াই বেয়ে ও কোনওরকমে উঠে এল রাস্তায়। মা, চোলি, তোরা দ্যাখ—আমার কাজ শেষ। খতমের খাতায় সবক’টা জানোয়ারের নাম তুলে দিয়েছি আমি।

রাস্তার ধারে টলে পড়ে গেল সুখারাম। সেই অবস্থাতেই মা আর চোলির সঙ্গে আপনমনে বিড়বিড় করে কথা বলতে লাগল।

আকাশের দিকে তাকাল সুখারাম। গায়ের জ্বালা-পোড়া কমাতে ও ভগবানের কাছে বৃষ্টি চাইল। একইসঙ্গে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পুলিশের সাইরেন বাজানো টহলদারী জিপের জন্যও প্রার্থনা করল।

ভগবান ওর নীরব প্রার্থনায় সাড়া দিল।

প্রথমে বৃষ্টি এল।

তার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশ।

নিউ সিটিতে সাজ-সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। কারণ, সিন্ডিকেট কিল গেমের তারিখ ঘোষণা করেছে। সেপ্টেম্বরের দু-তারিখ, রবিবার।

সারা শহর জুড়ে জিশানের পাবলিসিটির হোর্ডিং। কোনও জায়গায় আবার জিশানের স্টিল ফটোগ্রাফের বদলে রঙিন ভিডিয়ো। সেইসব ভিডিওয়োতে জিশানের ট্রেনিং অথবা নানান গেমের রোমাঞ্চকর দৃশ্য : স্নেক লেকের দৌড়, কমব্যাট পার্কে কোমোডোর সঙ্গে লুকোচুরি, কিংবা জাব্বার সঙ্গে পিট ফাইট।

কিন্তু জিশানের সঙ্গে কিল গেমে লড়বে কারা? কোন তিনজন খুনিকে বেছে নেওয়া হবে জিশানের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে?

না, সেটা এখনও জানায়নি সুপারগেমস কর্পোরেশন। তার বদলে ওরা টিভির দর্শকদের নিয়ে একটা কনটেস্ট শুরু করে দিয়েছে। সেন্ট্রাল জেলের বারোজন খুনের আসামিকে ওরা বেছে নিয়েছে। তাদের প্রত্যেকের ফেরোসিটি কোশেন্ট আটের ওপরে। টিভিতে সেই বারোজনের ক্রিমিনাল রেকর্ডস দেখানো হচ্ছে। দেখানো হচ্ছে তাদের সাইকোলজিক্যাল প্রাোফাইল, ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, আর অন্যান্য রেকর্ড।

এইসব দেখে বিচার করে দর্শকদের বলতে হবে, কিল গেমের জন্য এদের কোন তিনজনকে বেছে নেবে সুপারগেমস কর্পোরেশন। যদি কোনও দর্শক তিন জনের নাম ঠিকঠাক বলে দিতে পারে তা হলে সে পাবে সেরা পুরস্কার—পঁচিশ লক্ষ টাকা। তার নীচেই রয়েছে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পুরস্কার। পনেরো এবং দশ লক্ষ টাকা। বরাবরের নিয়ম অনুযায়ী বিজয়ীর সংখ্যা বেশি হলে পুরস্কারের টাকা তাদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দেওয়া হবে।

দর্শকরা এই কনটেস্টে ফোন করে অথবা ইন্টারঅ্যাকটিভ প্লেট টিভির মাধ্যমে অংশ নিতে পারে।

এই প্রাোগ্রাম চলার সময় দেখানো হচ্ছে প্রচুর বিজ্ঞাপন। তার মধ্যে কোনও-কোনও বিজ্ঞাপন জিশানকে নিয়ে। ফলে সেপ্টেম্বরের দু-তারিখকে নিয়ে দর্শকদের উত্তেজনা উৎসাহ ক্রমশ বাড়ছে। আর দিন-কে-দিন দর্শকের সংখ্যা হাইপারবোলিক ফাংশানের ঢঙে বেড়ে চলেছে।

নিউ সিটির বড়-বড় রাস্তায় বিশাল মাপের অসংখ্য ডিজাইনার হোর্ডিং। তাতে শুধু লেখা : ‘সেপ্টেম্বর দুই। কে জিতবে?’

শহরের নানান জায়গায় কিল গেমের গিফট আইটেমের স্টল বসেছে। সেখান থেকে সুপারগেমস কর্পোরেশনের এজেন্টরা গেম সিটির মডেল বিক্রি করছে, বিভিন্ন কম্পিটিশনে জিশান যেসব পোশাক পরেছে সেগুলো বিক্রি হচ্ছে, জিশানের লড়াইয়ের নানা ভঙ্গির মডেল বিক্রি হচ্ছে, কম্পিটিশনের বিভিন্ন মুহূর্তের ফটোগ্রাফ বিক্রি হচ্ছে, জিশান আর জাব্বার পিট ফাইটের ফাইবার পলিমারের মডেল বিক্রি হচ্ছে।

সারা শহর জুড়ে এককথায় টগবগে হইচই।

এসব দেখে ওল্ড সিটির সুপ্রাচীন জমকালো সময়ের দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে যায়। সেই পুজোর পাঁচদিনের আনন্দকে একদিনে জড়ো করেও এই উল্লাসের তীব্রতা বোঝানো যাবে না।

জিশান গুনাজির সঙ্গে শহরের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল আর শহরের প্রাণস্পন্দনটাকে অনুভব করতে চেষ্টা করছিল। ও বুঝতে পারছিল, নিউ সিটিতে জন্মের উৎসবের চেয়ে মৃত্যুর উৎসব অনেক বড়।

কিল গেমের দিন যত কাছে আসছে জিশানের ফিজিক্যাল ট্রেনিং-এর তীব্রতা তত বাড়ছিল। এখন ওর একার জন্য সম্পূর্ণ আলাদা দুটো জিম : অ্যানালগ জিম আর ডিজিটাল জিম। এই জিমে জিশান একা-একা প্র্যাকটিস করে। নানা ধরনের লড়াইয়ের অনেক কলাকৌশল এখন ওর আয়ত্তে। তার সঙ্গে রয়েছে মডার্ন আর্মামেন্ট ট্রেনিং-এর সাপোর্ট।

ঘাম-ঝরা শরীর নিয়ে জিমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল জিশান। গায়ের রং আরও তামাটে হয়েছে। শরীরের সমস্ত পেশি উৎকটভাবে মাথাচাড়া দিয়ে আছে। সবমিলিয়ে ওকে দেখাচ্ছে দুর্গাপুজোর অসুরের মতো—পেশিসর্বস্ব একটা দানব।

অ্যানালগ জিমে জিশান ভ্যারিয়েবল ফোর্স নিয়ে ওয়ার্কআউট করে। আর ডিজিটাল জিমে ওর শরীরচর্চা ইমপ্যাক্ট ফোর্স নিয়ে। সেখানে আচমকা ঘুসি ছুড়ে দেওয়ার জন্য রয়েছে বক্সিং মেশিন। এই মেশিন থেকে দস্তানা পরা ধাতুর হাত আচমকা ছুটে আসে। শরীরের সঙ্গে এই যান্ত্রিক ঘুসির সংঘর্ষ হলেই সংঘর্ষের তীব্রতা এবং স্থায়িত্ব ডিজিটাল স্ক্রিনে ফুটে ওঠে। তা ছাড়া চট করে কীভাবে ঘুসি এড়ানো যায় সেই কৌশলও শেখা যায় এই যন্ত্র থেকে।

জিশানের জিম দুটোর দেওয়াল মানেই আয়না। আর ঘরে সাজানো রয়েছে আধুনিক সব মেশিন। সবক’টা মেশনিই মিটারে-মিটারে ছয়লাপ।

জিশান রোজ এই দুটো জিমে যন্ত্রের সঙ্গে ‘লড়াই’ করে নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতার মান বিচার করে। একসময় ও শ্রান্ত-ক্লান্ত হয়ে জিম থেকে বেরোয়। তারপর স্নান, খাওয়া আর বিশ্রাম।

রোজ বিকেলে গুনাজির গাড়ি করে বেরোয় জিশান। তারপর ইচ্ছেমতো সময় কাটিয়ে ঠিক রাত ন’টায় ও ফ্রিডম কন্ট্রোল ল্যাবে সুধাসুন্দরীর কাছে ফিরে আসে। ওর কন্ট্রোলড ফ্রিডম রিচার্জ করার জন্য। তখন ওর দেখা হয়ে যায় রোগা, লম্বা, ফরসা মেয়েটার সঙ্গে। যে-মেয়েটা উদ্ধত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। এবং শুধু বিজ্ঞানের চাকর—আর কারও নয়।

আজ ফ্রিডম কন্ট্রোল ল্যাবের দিকে হেঁটে যাওয়ার সময় জিশানের মনে হল, সুধাসুন্দরীকে যে-প্রশ্নটা ও প্রথম দিন ম্যাজিক শট নেওয়ার সময় করেছিল সে-প্রশ্নের উত্তর এখনও জানা হয়নি। সুধাকে যখনই ও প্রশ্নটা করেছে তখনই ও কোনও-না-কোনওভাবে পাশ কাটিয়ে গেছে। আজ জিশানের মনে হল, অপেক্ষা অনেক হয়েছে—আর নয়। আজ জিশান জেদ ধরবে, বাচ্চা ছেলের মতো বায়না করবে।

ল্যাবে কাজকর্ম ঠিকমতোই এগোল। সুধা জিশানের শরীরের ভেতরে ঢোকানো সিলভার ক্যাপসুলটাকে রিমোট অপারেশানে রিচার্জ করে দিল। তারপর, যখন ল্যাব থেকে বেরিয়ে আসার পালা, তখন জিশান ওকে আলতো গলায় বলল, ‘সুধা, প্রথম দিন আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। তুমি বলেছিলে ”কাল বলব।” কাল-কাল করে তো দু-সপ্তাহ কেটে গেল। সত্যি করে আমাকে বলো দেখি, তুমি কি উত্তরটা বলতে চাও—নাকি চাও না?’

ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সুধা। তারপর বলল, ‘হ্যাঁ—বলতে চাই…।’

‘তা হলে বলো। সেকেন্ড সেপ্টেম্বর আসতে আর মাত্র চব্বিশ দিন বাকি। আর…তার পর যদি বলতে চাও তা হলে…তা হলে আমার হয়তো…হয়তো আর শোনা হবে না।’

সুধাসুন্দরী অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল জিশানের দিকে। ওর বড়-বড় চোখের দিকে তাকিয়ে জিশানের মনে হল, জিশান যেন একটা খোলা বই—আর মেয়েটা সেই খোলা বইটা অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে।

কয়েকসেকেন্ডের জন্য চোখ বুজল সুধা। তারপর ধীরে-ধীরে চোখ খুলল। নীচু গলায় বলল, ‘জিশান, তুমি কাল বিকেলে একবার আমার ল্যাবে আসতে পারবে? এই ধরো পাঁচটা নাগাদ?’

জিশান ঘাড় নাড়ল : ‘হ্যাঁ, পারব—’

‘তা হলে মনে করে এসো। পাঁচটা। তখন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। সেকেন্ড সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তোমাকে আমি অপেক্ষা করাতে চাই না।’ শেষ দিকে সুধাসুন্দরীর গলা ধরে এল। ও মুখ নামিয়ে নিল। আঙুলের ডগা দিয়ে চোখের কোণ মুছে দিল।

‘আমি কি তোমাকে হার্ট করলাম?’ জিশান ইতস্তত করে জানতে চাইল।

‘না, না—।’ মাথা নেড়ে মেয়ে বলল, ‘কাল এসো। পাঁচটা—। ও, ভালো কথা, তুমি আমার ফোন নাম্বারটা রেখে দাও। রিমোট অপারেশানস ল্যাবের কাছে এসে আমাকে ফোন কোরো—আমি একমিনিটের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে আসব…।’

কথা শেষ করে ফোন-নম্বর বলল সুধা।

জিশান পকেট থেকে স্যাটেলাইট ফোন বের করল। ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে সুধার নম্বরটা উচ্চারণ করল। নম্বর মেমোরিতে ট্রান্সফার হয়ে গেল।

সুধাসুন্দরীর ল্যাব থেকে বেরিয়ে এল জিশান।

কফির কাপে চুমুক দিতে-দিতে চারপাশে তাকাচ্ছিল জিশান। ঘরে বাড়তি কোনও আসবাব নেই, সাজসজ্জার বাড়তি কোনও উপকরণ নেই। এই ড্রয়িংরুমটার সঙ্গে ‘ছিমছাম’ শব্দটা বেশ মানানসই হয়। ঘরের মধ্যে রুম ফ্রেশনারের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল।

জিশানের মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসেছিল সুধা। ওর হাতেও কফির কাপ। মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট চুমুক দিচ্ছে।

‘এই বাড়িটায় আমি থাকি। আমার যা-কিছু প্রয়োজন সবই এখানে আছে। যদি নতুন কোনও কিছুর দরকার হয় মার্শাল স্যারকে একবার ফোন করে জানালেই হল—দ্য রিকোয়েস্ট উইল বি অনারড উইদিন আ হুইফ।

‘এই ঘরটা ড্রয়িংরুম। এর পাশেই আছে আমার লাইব্রেরি কাম স্টাডি। এ ছাড়া ভেতরদিকে একটা বড় ঘর আছে—সেটা বেডরুম। কফিটা শেষ করে নাও—পরে তোমাকে গোটা বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি…।’

জিশান ওর কথা শুনছিল আর মনে-মনে একটু অবাক হচ্ছিল।

একটা ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিল জিশান। তার জন্য ওকে নিজের ফ্ল্যাট দেখাতে নিয়ে এল কেন সুধা?

অবাক হলেও চুপ করে রইল জিশান। ওর মনে হল, সুধা ওকে যা-যা বলতে চায় বলুক। আজ জিশান শুধু শুনবে—কিছু বলবে না।

গুনাজির গাড়ি করে ঠিক পাঁচটার সময় রিমোট অপারেশানস ল্যাবে পৌঁছেছিল জিশান। তারপর সুধাসুন্দরীকে ফোন করে সেটা জানান দিতেই একমিনিটের মধ্যে ও এসে হাজির।

‘তোমার গাড়ি ছেড়ে দাও। তুমি আমার গাড়িতে যাবে।’

সুধা কথাটা এমনভাবে বলল যে, সেটা অনুরোধের বদলে দাবির মতো শোনাল।

জিশান একটু ইতস্তত করছিল। তাই দেখে সুধা বলল, ‘আমি তোমাকে ঠিক রাত ন’টার সময়ে আমার ল্যাবে নিয়ে আসব—তোমার ক্যাপসুল রিচার্জের জন্যে। তারপর তুমি তোমার গাড়িতে যেয়ো…।’

গুনাজিকে সেরকমভাবেই বলে দিল জিশান। রিমোট অপারেশানস ল্যাবের পার্কিং লটে গাড়ি রেখে গুনাজি জিশানের জন্য অপেক্ষা করবে।

তারপর সুধা ওর গাড়িতে গিয়ে বসল। জিশান ওর পাশে।

গাড়ি চলতে শুরু করার পর জিশান শুধু একবার জিগ্যেস করেছিল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘তোমার প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে—।’ জিশানের দিকে তাকিয়ে হেসেছে সুধা।

পনেরো কি কুড়ি মিনিট চলার পর গাড়ি এসে থেমেছে একটা একতলা বাড়ির সামনে।

জিশান নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। চারপাশে তাকিয়ে দেখল। চওড়া রাস্তার দুপাশে সার বেঁধে সাদা রঙের একতলা বাড়ি। প্রতিটি বাড়ির মাথায় ডিশ অ্যানটেনা। বাড়িগুলোর স্টাইল খুব আধুনিক। বাড়ির সামনে আর পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগান। বাগান বলতে সবুজ লন, আর লনের কিনারায় ফুলগাছের সারি।

সুধা জানাল, এটা সায়েন্টিস্টদের ক্লাস্টার। নিউ সিটির সব সায়েন্টিস্ট এই এলাকাতেই থাকেন। নিউ সিটিতে কোনও সায়েন্টিস্টের নিজস্ব বাড়ি থাকলেও তাঁর এখানে থাকাটা জরুরি। এটাই নিয়ম।

জিশানের বাবার কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল, নিজেদের বাড়ির কথা।

সুধা বলল, ‘আমার সেসব প্রবলেম নেই, কারণ, আমার এই একটাই থাকার জায়গা—।’

বাড়ির ভেতরে ঢুকে প্রথমেই ড্রয়িংরুম—যেখানে বসে এখন ওরা কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।

জিশান সুধাসুন্দরীকে দেখছিল।

কালো রঙের একটা সালোয়ার। তার সঙ্গে নীল, কালো আর সাদার নকশাকাটা একটা কামিজ। ফরসা বলে ওকে বেশ মানিয়েছে। তবে সবচেয়ে সুন্দর ওর বড় মাপের চোখ। ওগুলো এমন গভীর আর বুদ্ধিদীপ্ত যে, মনে হচ্ছে চোখ থেকে এক অদ্ভুত আলো ঠিকরে ছড়িয়ে পড়ছে।

শর্মি নামের একটি মেয়েকে ডাকল সুধা। মেয়েটির বয়েস আঠেরো কি কুড়ি। শ্যামলা রং। রোগা, স্মার্ট।

ওকে কফি করতে বলল।

‘শর্মি আমার কম্বাইন্ড হ্যান্ড। খুব চটপটে—অনেক কাজ করে। তার মধ্যে একটা হল রান্নাবান্না।’

কফি খাওয়া শেষ হলে সুধা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, ‘এইবার তোমার প্রশ্নের উত্তর দেব। আমার মতো সুপার লেভেলের একজন সায়েন্টিস্ট এই পোড়া নিউ সিটিতে কেন পড়ে আছে। তুমি শোনার জন্যে রেডি তো?’

জিশান কফির কাপ নামিয়ে রাখল সামনের টেবিলে। সুধার চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, রেডি…।’

‘আমি ইউ. এস. এ.-তে ছিলাম। নর্থ ক্যারোলাইনাতে। সেখানে স্টেট বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারে চাকরি করতাম। ”এমিনেন্ট সায়েন্টিস্ট” পোস্টে। আমি বেসিক্যালি একজন ডক্টর এবং পরে বায়োকেমিস্ট্রিতে পিএইচ. ডি. করেছি। তোমাকে আমার তেতাল্লিশটা পেটেন্টের কথা আগে বলেছি। সে ছাড়া আমার বাইশ-তেইশটা রিসার্চ পাবলিকেশান আছে—সবই ইন্টারন্যাশনাল জার্নালে। আমার রিসার্চের এরিয়া হল, প্রাোটিন, আর-এন-এ, ডি-এন-এ আর পলিফসফেট—এদের সিনথিসিস, স্ট্রাকচার এসব স্টাডি করা আমার কাজ।

‘মা ছাড়া আমার ফ্যামিলিতে আর কেউ নেই। তাই নর্থ ক্যারোলাইনাতে আমি মা-কে নিয়েই থাকতাম। কিন্তু হঠাৎ করে ট্রাবল শুরু হল আমার একটা ডিসকাভারি নিয়ে। আমি চারবছর ধরে একটা কেমিক্যাল কম্পাউন্ডের ওপরে গবেষণা করছিলাম। ব্যাপারটা জেরান্টোলজি ওরিয়েন্টেড…।’

‘জেরান্টোলজি মানে?’ জানতে চাইল জিশান।

‘জেরান্টোলজি মানে জরাবিজ্ঞান। মানে, আমাদের যে বয়েস বাড়ে সেই ব্যাপার রিলেটেড সায়েন্স।…যাই হোক, জেরান্টোলজি বরাবরই আমার রিসার্চের সেকেন্ডারি ফোকাস। তো রিসার্চ করতে-করতে আমি এমন একটা কম্পাউন্ড আবিষ্কার করলাম যেটা কয়েকটা অ্যানিম্যালের এজিং প্রসেস স্লো করে দেয়। অর্থাৎ, তাদের বয়েস ধীরে-ধীরে বাড়বে।

‘ব্যাপারটা খুব এক্সাইটিং বুঝতেই পারছ। তা ছাড়া, যদি সত্যি-সত্যি এরকম একটা কেমিক্যালের সন্ধান পাওয়া যায়, তা হলে সেটার ফরমুলা আর তৈরি করার সায়েন্টিফিক প্রসেস হাতে পাওয়ার জন্যে সারা পৃথিবী ছটফট করবে। ইন্টারন্যাশনাল কেয়স তৈরি হবে। কেজিবি, সিআইএ, র’—সমস্তরকম ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি মাঠে নেমে পড়বে।

‘সেইজন্যে রিসার্চের ভাইটাল ব্যাপারগুলো আমি কাউকে জানাইনি। নিজের কাছেই গোপন রেখেছিলাম। তবে ল্যাবের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টদের নিয়ে আমার নানান টেস্টিং আর এক্সপেরিমেন্টের কাজ চলছিল। কিন্তু এসব টেস্টের ঠিক কোন-কোন রেজাল্ট আমার কাছে জরুরি সেটা আমি কাউকে জানাইনি। জেরান্টোলজি রিলেটেড অবজারভেশানের কাজগুলো আমি একা-একাই করতাম।

‘আমি ল্যাবে ইঁদুর, গিনিপিগ, বেড়াল আর কুকুরের ওপরে কেমিক্যালটা টেস্ট করেছি। তাতে অল্পবিস্তর পজিটিভ রেজাল্টও পেয়েছি। কেমিক্যালটা মানুষের ওপরে অ্যাপ্লাই করা তখনও বাকি। তা ছাড়া এজিং প্রসেস স্লো হওয়ার রেটটা ছিল বড্ড কম। আমি রিসার্চ করে সেই রেটটা বাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, আর কীভাবে কেমিক্যালটা নিয়ে হিউম্যান এক্সপেরিমেন্টেশানে যাওয়া যায় সে-কথা ভাবছিলাম…।’

‘এরকম একটা সময়ে কীভাবে যেন রিসার্চ সেন্টারের কয়েকজন আমার রিসার্চের আসল ব্যাপারটা জেনে গেল। কয়েকজন আমাকে অভিনন্দন জানানোয় আমি বলেছি যে, এখনও অভিনন্দন জানানোর মতো কিছু আমি করে উঠতে পারিনি। প্রাণিদের এজিং প্রসেসের মিস্ট্রি নিয়ে আমি এখনও এক্সপ্লোর করে চলেছি এবং এখনও আমি অন্ধকারে। কিন্তু তাদের সবাই যে আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি সেটা তাদের মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম।

‘এর মাসখানেক পর আমার কাছে একটা ফোন আসে। যে-লোকটা ফোন করেছিল তার গলাটা একটু ফ্যাঁসফেসে, জড়ানো। আমি ফোন ধরতেই শুনলাম…’

‘ডক্টর সুধাসুন্দরী স্পিকিং?’ ইংরিজিতে কথাটা উচ্চারণ করতে গিয়ে ‘সুধাসুন্দরী’ শব্দটা লোকটাকে কয়েকটা হোঁচট খাইয়ে দিল।

‘ইয়েস—।’ সুধা জবাব দিল।

‘কনগ্র্যাচুলেশানস। তোমার চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারের কথা আমরা জানতে পেরেছি। এতে সন্দেহ নেই, মানবজাতির অনেক কল্যাণ হবে—।’

সুধা অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘আপনি কে বলছেন? কোথা থেকে বলছেন?’

‘এগুলো অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন, ম্যাডাম। আমি একটা সংগঠনের পক্ষ থেকে বলছি। তোমার আবিষ্কারের জন্যে সারা পৃথিবী তোমাকে অভিনন্দন জানাবে, আশীর্বাদ করবে।’

‘সেরকম কোনও আবিষ্কার তো আমি করিনি! আমি তো ছোট-ছোট কয়েকটা রুটিনমাফিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি…।’

‘আমরা সব জানি। তুমি আমাকে ভুল বোঝাতে পারবে না, ম্যাডাম। আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর আছে…।’

‘আপনি আমাকে ফোন করেছেন কেন? কী দরকারে?’

টেলিফোনের ও-প্রান্তে হাসল লোকটা : ‘এখনও বুঝতে পারোনি? তোমার আবিষ্কারের সব কাগজপত্রের ফাইলটা আমাদের চাই। কারণ, আমরা মনে করি, এই আবিষ্কারটার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকা দরকার। পৃথিবীর পক্ষে এই আবিষ্কারটা নিশ্চয়ই খুব উপকারী—তবে আমাদের মনে হয়, এই মুহূর্তে এই আবিষ্কারটার কথা জানাজানি হলে বিপদ হবে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো এটা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে। সেই লড়াই থেকে ব্যাপারটা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগোবে। আর সেই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ—যেটা পরমাণু-যুদ্ধ হবে বলেই আমাদের ধারণা—যদি হয় তা হলে মানবজাতির সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ একটু থামল লোকটা। তারপর : ‘সুতরাং, ম্যাডাম, বুঝতেই পারছ, তোমার এই আবিষ্কারটা অত্যন্ত নিরাপদ হেফাজতে থাকা দরকার…।’

সুধাসুন্দরীর বুকের ভেতরে ধকধক শব্দ হচ্ছিল। ভয়ডর ওর বরাবরই কম—কিন্তু, তা সত্বেও ওর একটু-একটু ভয় করছিল।

এই যে লোকটা ওকে ফোন করেছে, সে সুধার আবিষ্কারের ঠিক কতটুকু জানে? লোকটা আন্দাজে ব্লাফ দিচ্ছে না তো!

লোকটাকে বাজিয়ে দেখতে সুধা বলল, ‘আপনি আমার কোন আবিষ্কারের কথা বলছেন বলুন তো? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না—।’

লোকটা হাসল—সবজান্তার ব্যঙ্গের হাসি। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল, ‘মানুষকে দীর্ঘায়ু করার আবিষ্কার। আমাদের শরীরে বার্ধক্য যে-গতিতে প্রভাব ফেলে, সেই গতি কমিয়ে দেওয়ার আবিষ্কার। তুমি আমাদের হোমওয়ার্কে কোনও ফাঁক পাবে না, ম্যাডাম।’

সুধাসুন্দরীর গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। ও পাগলের মতো এই সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু পাচ্ছিল না।

লোকটা ধীরে-ধীরে বলল, ‘আমি পরশুদিন তোমাকে আবার ফোন করব, ম্যাডাম। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই।’

সুধা হঠাৎই সাহস জুগিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি যা-ই আবিষ্কার করে থাকি না কেন, সেটা যাকে-তাকে দেওয়ার জন্যে নয়।’

‘একদম ঠিক বলেছ, ম্যাডাম। কিন্তু তোমার সামনে মাত্র দুটো পথ খোলা আছে : হয় তুমি ওটা নিজে থেকে আমাদের হাতে তুলে দেবে, নয় তো ওটা আমরা তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেব। আর সেই কাড়াকাড়ির সময় অল্পবিস্তর কোল্যাটারাল ড্যামেজ হতে পারে—।’

‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ মানে?’

‘তোমার মায়ের কথা ভুলে গেলে, ম্যাডাম?’ হাসল লোকটা।

সুধাসুন্দরী পাথর হয়ে গেল। ওর মাথা আর কাজ করছিল না।

‘উই উইল বি ওয়াচিং য়ু, ম্যাডাম। ওয়ান রং মুভ অ্যান্ড য়ু আর ডান অ্যালং উইথ ইয়োর মাম।’

লোকটা ফোন ছেড়ে দিল।

শরীরের ভেতরে বয়ে চলা একটা ঠান্ডা স্রোত টের পাচ্ছিল সুধা। আর তার সঙ্গে অদ্ভুত এক চিনচিন যন্ত্রণা।

মা! মায়ের কথা বলল লোকটা! আজকের বিখ্যাত বিজ্ঞানী সুধাসুন্দরী যা কিছু, তার সবটাই ওর মায়ের জন্য। ওকে ভালো করে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করে তোলার জন্য ওর মায়ের চেষ্টা আর পরিশ্রম এক কথায় উদাহরণ। সেই মায়ের ক্ষতি করবে ওরা! কোল্যাটারাল ড্যামেজ!

সুধা উদভ্রান্তের মতো হয়ে গেল। এই হুমকিটা ফাঁকা আওয়াজ, না কি সত্যি? লোকটার কথা বলার ঠান্ডা সুর সুধার মনে প্রতিধ্বনি তুলছিল। ওর মন বলছিল, কথাকে কাজে পালটে দিতে এই ধরনের লোকের কোনও সময় লাগে না।

 ফোনটা এসেছিল রাত আটটা নাগাদ। তার পর থেকে সুধাসুন্দরীর মনের স্বস্তি উধাও হয়ে গেল। ওর উসখুস অস্থির ভাব দেখে মা বেশ কয়েকবার জিগ্যেস করলেন, ‘কী হয়েছে? তখন থেকে ওরকম ছটফট করছিস কেন?’

উত্তরে সুধা বলেছে, ‘না, কিচ্ছু হয়নি—।’

রোজ ল্যাব থেকে বাড়ি ফিরে বেশিরভাগ সময়টাই সুধা পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আজ ও পড়াশোনাতেও মন বসাতে পারছিল না। একটা কাঁটা কোথায় যেন খচখচ করছিল।

ভয়ে-ভয়ে দিন কাটতে লাগল সুধার। মা-কে ও একা বেরোতে বারণ করে দিল। বলে দিল, সুধার ফোন ছাড়া অন্য কারও ফোন যেন মা কখনও না ধরে, সুধা ছাড়া আর কাউকে যেন কক্ষনো দরজা না খোলে।

এসব কথায় মা ভয় পেয়ে গেলেন। বারবার জিগ্যেস করলেন, এত সাবধান হওয়া কীসের জন্য।

উত্তরে সুধা শুধু বলল, ‘আমাদের হয়তো এ-দেশ ছাড়তে হবে, মা।’

ও মনে-মনে বুঝতে পারছিল, শত্রু যারাই হোক, তার হুট করে কিছু করবে না। সুধার কাগজপত্রগুলো ওরা হাতে পাবে, নাকি পাবে না—সে-ব্যাপারে সুনিশ্চিত না হয়ে ওরা চরম ব্যবস্থা নেবে না।

ল্যাবে সুধা একটা অদ্ভুত কাজ করল। ওর জেরান্টোলজি রিসার্চের যত কাগজপত্র ছিল সেগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে তার প্রতিটি পৃষ্ঠায় কেমিস্ট্রির একটা করে ভুল সমীকরণ লিখল। তাও আবার পৃষ্ঠার নানান জায়গায়। তারপর সেই পাতাগুলো ওর অন্যান্য রাফ কাগজের পৃষ্ঠার সঙ্গে মিশিয়ে দিল। ঠিক যেন তাস শাফল করে মেশাচ্ছে।

সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠার এক ‘পাহাড়’ তৈরি হল। এর মধ্যে থেকে আসল কাগজগুলো একমাত্র সুধাসুন্দরীই খুঁজে বের করতে পারবে। ওই ভুল সমীকরণই ওর ‘সংকেত’।

কাগজের স্তূপটাকে কয়েকটা ভাগে ভাগ করে ল্যাবের মধ্যে নানান জায়গায় রেখে দিল।

মনে-মনে বেশ শান্তি পেল সুধা। এই ল্যাবে হানা দিয়ে কারও পক্ষে ‘আসল’ কাগজগুলো খুঁজে পাওয়া বোধহয় আর সম্ভব নয়।

এর চারদিন পরেই একটা ঘটনা ঘটল।

দিনটা ছিল রবিবার। সেদিন বিকেলবেলা কয়েকটা টুকিটাকি জিনিস কিনতে পায়ে হেঁটেই ও রাস্তায় বেরিয়েছিল।

রাস্তায় লোকজন বেশি ছিল না। বয়স্ক দু-চারজন মহিলা কি পুরুষ চোখে পড়ছিল। দুজন মানুষকে চোখে পড়ল পোষা কুকুর সঙ্গে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন।

রাস্তাটা ফাঁকা হলেও এখান দিয়ে ভালোরকমই গাড়ি যাতায়াত করে। থেকে-থেকে ছুটন্ত গাড়ি সুধাসুন্দরীর নজরে পড়ছিল।

সামনে একটা বাঁক ঘুরতেই ও দেখতে পেল রাস্তার পাশ ঘেঁষে একটা মেয়ে পড়ে আছে। গায়ে লাল আর কালো রঙের সুন্দর ছাঁদের পোশাক।

সুধাকে দেখেই মেয়েটা ‘হেলপ! হেলপ!’ বলে চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল।

সুধা রাস্তার যেদিক ধরে হেঁটে যাচ্ছিল, মেয়েটা পড়ে আছে তার উলটোদিকে। তাই সাবধানে রাস্তা পার হয়ে ওপারে পৌঁছল। তারপর অসহায়ভাবে পড়ে থাকা মেয়েটির দিকে এগোল।

সুধা কাছে যেতেই মেয়েটি যন্ত্রণা মেশানো গলায় বলল যে, একটা গাড়ি ওকে ধাক্কা মেরে পালিয়েছে। ওর হাঁটু আর গোড়ালিতে অসহ্য যন্ত্রণা। নিজে-নিজে উঠে দাঁড়াতে পারছে না। সুধা যদি, প্লিজ, ওকে একটু হেলপ করে তা হলে ভালো হয়।

সুধা আর দেরি করল না। ঝুঁকে পড়ে মেয়েটিকে তোলার চেষ্টা করতে লাগল।

ঠিক তখনই কোথা থেকে দুজন তরুণ এসে হাজির হল। সুধাকে এবং পড়ে থাকা মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘হোয়াটস দ্য ম্যাটার? হোয়াট হ্যাপেনড?’

সুধা সংক্ষেপে ব্যাপারটা বলল। মেয়েটিও ‘উ: ! আ:’ করতে-করতে সাহায্য চাইল।

তক্ষুনি ছেলে দুটো কাজে নেমে পড়ল। আহত মেয়েটিকে তুলে নিয়ে রাস্তার পাশের ঘাসজমিতে শুইয়ে দিল। তারপর সুধাকে বলল, ‘মিস, তুমি তোমার কাজে যাও—আমরা ওর মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের বন্দোবস্ত করছি—।’

আহত মেয়েটি সুধাকে দুবার ‘থ্যাংকস’ জানাল। সুধা সৌজন্যের দু-একটা কথা বলে রাস্তা পার হতে লাগল।

ঠিক তখনই একটা ছাই রঙের পিক-আপ ট্রাক কোথা থেকে যেন দৈত্যের মতো ছুটে এল সুধার দিকে। ট্রাকটাকে ঘাড়ের ওপরে এসে পড়তে দেখে সুধা হকচকিয়ে গেল। পেটের ভেতরটা কেমন ফাঁকা মনে হল। ঠান্ডা ঘামের ফোঁটা আচমকা ওর কপাল, মুখ গলা ভিজিয়ে দিল। ও পাগলের মতো লাফ দিল একপাশে। ওর হাত থেকে মোবাইল ফোন ছিটকে পড়ল রাস্তায়।

ট্রাকটা ওকে চাপা দেওয়ার জন্য ছুটে গেল। তারপর চাপা দিতে-দিতে একেবারে শেষ মুহূর্তে বাঁক নিয়ে ওর পড়ে থাকা শরীরটার গা ঘেঁষে ছুটে পালাল। চাকার মোচড়ের মিহি শব্দ ছিটকে উঠল বাতাসে। আর সুধাসুন্দরী রাস্তায় পড়ে দরদর করে ঘামতে লাগল। ওর আচ্ছন্ন চোখের সামনে রাস্তা, ঘর-বাড়ি, গাছপালা সব বনবন করে ঘুরপাক খাচ্ছিল।

সেই অবস্থাতেই শরীরটাকে গড়িয়ে-গড়িয়ে রাস্তার কিনারায় নিয়ে এল। কোনওরকমে উঠে বসল। হাতে, কনুইয়ে আর হাঁটুতে ব্যথা। দু-জায়গায় ছড়ে গেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ও বাড়ি ফিরতে পারবে তো? মোবাইল ফোনটা কোথায় গেল? এই রাস্তাটা যে এত দুর্ঘটনাপ্রবণ সেটা সুধা জানত না।

এমন সময় ওর চোখ পড়ল সেই দুটি ছেলে আর আহত মেয়েটির দিকে। ওদের দিকে তাকিয়ে ও তাজ্জব হয়ে গেল।

ওরা তিনজনেই সুধার দিকে তাকিয়ে হাসছে, বিদায়ের ইশারা করে হাত নাড়ছে।

সুধা হতবাক ভাবটা কাটিয়ে ওঠার আগেই একটা সাদা রঙের স্পোর্টস কার ওদের পাশে এসে ব্রেক কষল। ওরা তিনজনে চটপট গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়িটা সাঁ করে উধাও হয়ে গেল।

টলতে-টলতে উঠে দাঁড়াল। ততক্ষণে তিনজন পথচারী ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ওর মোবাইল ফোনটা ওর দিকে বাড়িয়ে ধরল : ‘তোমার মোবাইল ফোন, মিস। রাস্তার ওইখানটায় পড়ে ছিল…।’

সুধা চেতনাহীন রোবটের ঢঙে মোবাইল ফোনটা নিল। তারপর প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমাকে একটু বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন?’

বাড়ি ফেরার পর প্রায় ঘণ্টাখানেক সুধাসুন্দরীর নার্ভাস ভাবটা গেল না। আজ যদি ওর ভালোমন্দ কিছু একটা হয়ে যেত তা হলে ওর মায়ের কী হত!

রাতে ওর মোবাইলে যে-ফোনটা এল তাতে ঠিক এই প্রশ্নটাই করল লোকটা। এই লোকটাই প্রথম ওকে ফোন করে জেরান্টোলজির বিষয় নিয়ে ওকে শাসিয়েছিল।

‘যদি আজ তোমার কিছু একটা হয়ে যেত, ম্যাডাম, তা হলে তোমার মায়ের কী হত সেটা ভেবে দেখেছ। বয়স্ক মানুষ। এ-পৃথিবীতে একা-একা কী করে থাকতেন? হয়তো…হয়তো রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরে শেষ পর্যন্ত…।’ কথা আর শেষ করেনি লোকটা।

সুধা ভয় পেলেও মনে-মনে সাহস তৈরি করছিল। ও বেশ বুঝতে পারছিল, ওকে মেরে এই লোকগুলোর কোনও লাভ নেই। তাতে ওরা যা চায় সেটা কোনওদিনও ওরা আর হাতে পাবে না। ওরা শুধু সুধাসুন্দরীকে নিয়মিত ভয় দেখাবে। ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে রিসার্চের কাগজপত্রগুলো আদায় করবে।

ও ঠান্ডা জেদি গলায় বলল, ‘আমি ভয় পাইনি। আপনারা যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন।’

লোকটা হাসল : ‘ভয় পাবে না মানে! ভয় তো তোমাকে পেতেই হবে। কেন, ম্যাডাম, কোল্যাটারাল ড্যামেজের কথা ভুলে গেলে? ওই পিক আপ ট্রাকটা আজ ইচ্ছে করলে তোমাকে পিষে দিতে পারত—কিন্তু দেয়নি। কারণ, এটা আমাদের একটা ওয়ার্নিং।

‘এবার মনে করো, তোমার বদলে তোমার মা আমাদের টার্গেট হয়ে গেলেন। তারপর টার্গেট থেকে ভিকটিম। ভিকটিম থেকে মর্গ। তারপর মর্গ থেকে পোস্টমর্টেম….।’ খুকখুক হাসি দিয়ে লোকটা কথা শেষ করল।

কেন জানি না, সুধাসুন্দরীর হঠাৎ কান্না পেয়ে গেল। ও কেঁদে ফেলল। মা-কে ছেড়ে থাকার কথা ও কখনও ভেবে দেখেনি। কারণ, এটা ও কখনও ভাবতেই পারবে না।

ওর ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কান্না শুনতে পেল লোকটা। অন্যায় করে ধরা পড়ে যাওয়া বাচ্চা ছেলের মতো অপরাধী গলায় বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করো, ম্যাডাম। আমি তোমার চোখে জল এনেছি। আসলে একটা কথা তোমাকে আমি স্পষ্ট করে বোঝাতে চাই। তুমি, প্লিজ, এটা বোঝার চেষ্টা করো। তোমার জেরান্টোলজির রিসার্চ যতই ভ্যালুয়েবল হোক, তোমার মায়ের চেয়ে নিশ্চয়ই ভ্যালুয়েবল নয়। এই সিম্পল ট্রুথটা তুমি, ম্যাডাম, বোঝার চেষ্টা করো। গুড নাইট—।’

সুধা চুপ করে থেকেছিল। কোনও জবাব দিতে পারেনি। ওর চোখে তখনও জল। লোকটার শেষ কথাটা ওর কানে বাজছিল। লোকটা খুব সত্যি কথা বলেছে। সুধার জেরান্টোলজির গবেষণা ওর মায়ের চেয়ে অবশ্যই ভ্যালুয়েবল নয়।

এই কথাটা ওকে ভাবিয়ে তুলল বটে, কিন্তু গবেষণার জরুরি কাগজপত্রগুলো সরাসরি ওই লোকগুলোর হাতে তুলে দিতে ওর মন চাইল না।

সুধা ওর গবেষণা চালিয়ে যেতে লাগল। আর একইসঙ্গে অন্তরের ঝড় তোলা টানাপোড়েনে প্রতিটি মুহূর্তে কষ্ট পেতে লাগল।

ও বেশ বুঝতে পারছিল, ল্যাবে যে-মনোযোগে ও সাধারণত কাজ করে, সেই মনোযোগে চিড় ধরছিল।

টেলিফোনের লোকটা কিন্তু ধৈর্য হারায়নি। সে পাঁচ-ছ’-দিন পরপরই সুধাকে ফোন করে। ঠান্ডা মাথায়, ঠান্ডা গলায়, সুধাসুন্দরীকে বশ করার চেষ্টা করে। সুধার কোনও কথাতেই সে রাগ করে না, উত্তেজিত হয় না। শুধু রোজ কথা শেষ করার আগে সুধাকে কোল্যাটারাল ড্যামেজের কথা মনে করিয়ে দেয়।

এইভাবে কাজ করতে সুধার ভালো লাগছিল না। ও বেশ বুঝতে পারছিল, ইনস্টিটিউট-এ ডেডিকেটেড রিসার্চার হিসেবে ওর যে আকাশ-চুমু-খাওয়া খ্যাতি, সেই খ্যাতিতে একটু-আধটু চিড় ধরছিল।

টেলিফোনে ভদ্র ভাষায় হুমকি দেওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ও থানা-পুলিশ করতে পারেনি। কারণ, তার সঙ্গে ওর জেরান্টোলজির গবেষণার ব্যাপারটা জড়িয়ে আছে। এই গবেষণা নিয়ে ও এখনই ঢাক পেটাতে চায় না।

রিসার্চ সেন্টারে ওর যারা কাছের লোক তারা শুধু লক্ষ করল যে, সুধাসুন্দরী আগের তুলনায় অনেক চুপচাপ হয়ে গেছে। যে-মেয়েটা কথা বলতে ভালোবাসত সে আর কথা বলতে তেমন ভালোবাসে না।

আসলে একটা দমচাপা উৎকণ্ঠা আর অস্বস্তি সুধার সবসময়ের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তা ছাড়া, ও এখানকার পাট গুটিয়ে ইন্ডিয়ায় ফিরে যাবে কি না, সেই চিন্তাটাও মাঝে-মধ্যেই ওর মাথায় খোঁচা মারছিল। সেইজন্য কখনও-কখনও ল্যাবের ওর কাজে ভুল হয়ে যেত, অনেক কথা ঠিক-ঠিক সময়ে মনে পড়ত না।

একদিন সন্ধেবেলা রিসার্চ সেন্টার থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সুধা একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঢুকল।

‘ফোর স্কোয়ার’ নামের এই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরটা ওর খুব চেনা। এখানে ও নিয়মিত আসে। খাওয়াদাওয়ার নানান জিনিসপত্র থেকে শুরু করে তেল, মশলা, শ্যাম্পু, সাবান—সবই ও এখান থেকে কেনে।

আজ যখন ও ট্রলি ঠেলে নিয়ে বিভিন্ন লেনের র‌্যাক থেকে দরকারি জিনিসগুলো বেছে-বেছে ট্রলির বাস্কেটে তুলছে তখনই ওর ফোন বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। ছোট্ট আশঙ্কা নিয়ে ‘অ্যাকসেপ্ট’ বোতাম টিপে ফোন কানে দিল।

‘হ্যালো—।’

ও-প্রান্ত থেকে একটা লোক কথা বলল। তার গলাটা সুধার ভীষণ চেনা।

‘ম্যাডাম, আমাদের ব্যাপারটা কতদূর এগোল? তুমি কী ডিসাইড করলে?’

‘কী ব্যাপার?’ না বোঝার ভান করে জানতে চাইল সুধা।

লোকটা ছোট-ছোট শব্দ করে হাসল : ‘জেরান্টোলজি, ম্যাডাম।’

সুধার খুব রাগ হচ্ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টায় সেটাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে ও বলল, ‘জেরান্টোলজি? জেরান্টোলজির ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। ও নিয়ে আমি কোনও রিসার্চ করছি না।’

‘কী দু:খের ব্যাপার, ম্যাডাম!’ আক্ষেপ করে বলল লোকটা, ‘তুমি পৃথিবীর সব মানুষের আয়ু বাড়াতে চেষ্টা করছ, অথচ তোমার আর তোমার মায়ের আয়ু কমাতে চেষ্টা করছ! ভেরি স্যাড। কিন্তু এটাই কী তোমার শেষ কথা?’

‘আমার কাছে কোনও অপশান নেই।’ চোয়াল শক্ত করে বলল সুধা, ‘আমি বিজ্ঞান ছাড়া আর কারও চাকর নই…।’

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল লোকটা। সুধা যখন ভাবছে যে, লোকটা ফোন ছেড়ে দিয়েছে, তখনই লোকটা কথা বলল।

‘গুড। গুড। সো উই অ্যাকসেপ্ট দ্য কোল্যাটারাল ড্যামেজ…।’

ফোন ছেড়ে দিল লোকটা।

নিজের টেনশন কাটাতে সুধা চুপচাপ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল।

কিছুক্ষণ পর আবার ওর কেনাকাটা শুরু হল। কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ও প্রাণপণে ছন্দে ফিরতে চাইছে।

প্রায় আধঘণ্টা পর সুধাসুন্দরীর কেনাকাটার পাট শেষ হল। ও জিনিস ভরতি ট্রলি নিয়ে একটা ক্যাশ কাউন্টারে লাইন দিল। চারপাশের লোকজনকে ও দেখছিল বটে কিন্তু তাদের ‘ছবিগুলো’ ওর মাথায় ঢুকছিল না। ওর বারবার লোকটার শেষ মন্তব্যটা মনে পড়ছিল, আর মায়ের কথা মনে পড়ছিল। মা-কে ভীষণ দেখতেও ইচ্ছে করছিল। ওর মনের মধ্যে বাড়ি ফেরার তাড়া উথলে উঠল।

হঠাৎই বছর পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্নর একজন প্রৌঢ় সুধার ট্রলির কাছে এসে দাঁড়াল। ট্রলি থেকে একটা দুধের প্যাকেট তুলে নিয়ে ওকে জিগ্যেস করল, ‘এই দুধটা কি স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো, মিস?’

সুধা একটু অবাক হয়ে লোকটার দিকে তাকাল।

গোলগাল বেঁটে চেহারা। লালচে সাদা গায়ের রং। মাথাজোড়া টাক। মুখটা ফোলা-ফোলা, গায়ে একটা স্ট্রাইপড কোট, পায়ে ময়লা সাদা প্যান্ট।

সুধা আজ তিনটে দুধের প্যাকেট কিনেছে—মায়ের জন্য। রোজ সকালে মা-কে একগ্লাস দুধ খেতে বাধ্য করে সুধা। মায়ের শরীর যা রোগা আর দুর্বল তাতে রোজ সকালে এই দুধটুকু দরকার। চারমাস আগে মা-কে হসপিটালে ভরতি করিয়ে সবরকম টেস্ট করিয়েছিল। সেইসব টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে মেডিসিনের নামি একজন ডক্টরকে দেখিয়েছিল। তাতে মা-কে অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে রোজ হাফ লিটার করে দুধ খেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ডক্টর। সেই পরামর্শটা মা-কে মানতে বাধ্য করেছে সুধা। মা-কে বলেছে, ‘তুমি মাঝে-মাঝে ভুলে যাও কেন যে, আমিও একজন পাশ করা ডাক্তার!’

তারপর থেকে রোজ দুধ খাওয়ার নিয়মটা দাঁড়িয়ে গেছে।

সুধা নিজের চিন্তায় আনমনা হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎই ও খেয়াল করল, টাক মাথা ভদ্রলোক তখনও ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এবং আবার জিগ্যেস করছেন, ‘মিস, এই ব্র্যান্ডের মিলক কি হেলদি? গুড ফর পেশেন্টস?’

সুধা ঘোর কাটিয়ে বলে উঠল, ‘অ্যাঁ—হ্যাঁ। ইয়েস, ইয়েস—গুড ফর হেলথ।’

‘থ্যাংকস—’ ভদ্রলোক বললেন, ‘আসলে আমার ওয়াইফ খুব সিকলি। ডক্টর রোজ ওকে দুধ খেতে বলেছেন। কিন্তু এখানে এসে এতরকম ব্র্যান্ডের সুইট মিলক প্যাক দেখে আমি বেশ কনফিউজড। তখনই তোমাকে খেয়াল করলাম। ভাবলাম, তোমার কাছ থেকে সাজেশান নিলে হয়। তাই তোমাকে বদার করলাম। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড…।’

‘না, না—মনে করার কী আছে!’

ভদ্রলোক একটু অতি-বিনয়ের সঙ্গেই সুধাকে বেশ কয়েকবার ধন্যবাদ জানালেন। দুধের প্যাকেটটা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। তারপর ওটা সুধার ট্রলিতে রেখে দিয়ে আরও একবার ‘থ্যাংকস’ বলে চলে গেলেন।

ঘটনাটা ও বলতে গেলে ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু পরে ওর মনে হয়েছিল, ঘটনাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ভুলে যাওয়াটা ওর মস্ত বড় ভুল ছিল।

বিপদটা হল চারদিন পরেই।

তখন দুপুর সওয়া দুটো। লাঞ্চব্রেক থেকে ল্যাবে ফিরে সবে কাজের ভেতরে আবার মাথা গলিয়েছে সুধা। এমন সময় ফোনটা এল।

মোবাইল কানে দিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই চেনা গলা শুনতে পেল।

‘আমরা খুবই দু:খিত, ম্যাডাম। তোমার কাছে আমরা ক্ষমা চাইছি।’

‘ক্ষমা চাইছি মানে? কীসের ক্ষমা? কী হয়েছে?’

লোকটা সুধার একটা প্রশ্নেরও জবাব না দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি হলে ল্যাব থেকে এখুনি বাড়ি চলে যেতাম…।’

লোকটা কীসের ইশারা করছে? বাড়ি যেতে হবে মানে?

সুধাসুন্দরীর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। মা! মায়ের কিছু হল না কি? নাকি এটা নিছকই ওকে ভয় দেখানোর জন্য ফাঁকা আওয়াজ?

‘কী বলতে চান সোজাসুজি বলুন!’ অধৈর্য গলায় বলল সুধা।

লোকটা খুক-খুক করে হাসল : ‘ম্যাডাম, আর বাচ্চা মেয়ে সেজে থাকার ভান কোরো না। তুমি বুঝতে পারছ না কী বলতে চাইছি?’ একটু চুপ করে থেকে লোকটা প্রায় ফিসফিসে গলায় বলল, ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ। তোমাকে প্রথম থেকেই আমরা সাবধান করেছিলাম। শুধু তোমার বোকা-বোকা জেদের জন্যেই এরকম একটা বাজে ব্যাপার ঘটে গেল….।’

লোকটা তো অসহ্য! ভাবল সুধা। ওর গলা উঁচু পরদায় উঠে গেল: ‘কী হয়েছে বলুন, প্লিজ!’

‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ—ডান বাই য়ু। তুমি এখন জলদি বাড়ি যাও—।’

আর দেরি করেনি সুধাসুন্দরী। ল্যাবের কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে ছুটেছে বাড়ির দিকে।

ফ্ল্যাটের দরজা খোলার আগে থেকেই সুধা ‘মা! মা!’ বলে চিৎকার শুরু করেছিল, কিন্তু কোনও সাড়া পায়নি। দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢোকার পর সাড়া না পাওয়ার কারণটা বুঝতে পারল।

ড্রয়িং-ডাইনিং স্পেসে একটা সোফায় মায়ের দেহটা এলিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো বোজা। ডান হাতে টিভির রিমোট। টিভি চলছে।

মেঝেতে দুধের গ্লাসটা ভেঙে চৌচির। দুধ ছড়িয়ে পড়ে কার্পেটের অনেকটা জায়গা ভিজে গেছে।

‘মা!’

সুধাসুন্দরীর মুখ থেকে যে-চিৎকারটা বেরোল সেটা আর্ত হাহাকারের মতো শোনাল। তারপরই কান্নার ঢেউ ওর বুক ঠেলে উথলে উঠল। কোল্যাটারাল ড্যামেজ!

হাতের ব্যাগ ছুড়ে ফেলে ও ছুটে গেল মায়ের কাছে। মায়ের দেহটা জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নিল। না, মায়ের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকুনি ও টের পাচ্ছে না। তখন শঙ্কা আর আশঙ্কা নিয়ে হাত বাড়াল মায়ের কবজির দিকে। পালস বিট দেখতে চাইল।

আছে! আছে!

আনন্দে খুশিতে সুধাসুন্দরীর ভেতরটা গলে গেল। ও যেন নতুন করে বুঝতে পারল, মা থাকা আর না থাকার মধ্যে কতটা তফাত। মা-কে জড়িয়ে ধরে ও আনন্দে কাঁদতে লাগল।

একটু পরেই ও নিজেকে সামলে নিল। মায়ের এখন চিকিৎসা দরকার। কী করে এমন হল, সেটাও জানা দরকার।

চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। মায়ের অচেতন দেহটা ঠিকঠাক করে শুইয়ে দিল সোফায়। রিমোটটা অসাড় হাতের মুঠো থেকে খুলে নিয়ে বোতাম টিপে টিভি অফ করে দিল। রিমোট রেখে দিল টেবিলে।

ঘরটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল সুধা। সবকিছু জায়গামতোই রয়েছে। কোথাও কোনও হানাদারের ছাপ নেই।

আর দেরি না করে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে ফোন করে দিল। পেশেন্টের কথা বলল। বাড়ির ঠিকানা আর লোকেশান বলল।

এবার অপেক্ষা।

সুধার বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ শব্দ হচ্ছিল। মনের ভেতরে খারাপ-খারাপ স্মৃতির ছবিগুলো পাগলের মতো ছুটোছুটি করছিল। মাথার দুপাশে দপদপানি। এসি অন থাকা সত্বেও ঠোঁটের ওপরে ঘামের ফোঁটা।

ঝুঁকে পড়ে মা-কে পরীক্ষা করল—যন্ত্রপাতি ছাড়া যতটা করা যায়। ব্লাড প্রেশারটা মাপতে পারলে ভালো হত।

কী করে মায়ের এমন হল? হার্ট অ্যাটাক? না সেরিব্রাল অ্যাটাক? ঠিকমতো কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

এমন সময় সধাসুন্দরীর মোবাইল ফোন বেজে উঠল।

‘ম্যাডাম, কেমন আছ?’ মোলায়েম স্বরে প্রশ্নটা ভেসে এল।

উত্তরে একসঙ্গে অনেক কিছু বলতে চাইল সুধা। কিন্তু কথাগুলো ওর গলার ভেতরে আটকে গেল। ঠোঁট কাঁপতে লাগল।

একটু পরে ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘মা…! মা…!’

‘হ্যাঁ, তোমার মা—’ একবার কাশল লোকটা : ‘তোমার মা বেঁচে আছে, ম্যাডাম। আমরা বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছি, তাই।’

‘কী হয়েছে মায়ের? মা-কে কী করেছেন আপনারা?’ উৎকন্ঠায় কেঁপে ওঠা গলায় জানতে চাইল।

‘তোমার মায়ের হার্ট অ্যাটাক বা সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়নি। তোমার মা দুধ খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে…।’

‘দুধ!’

‘হ্যাঁ—দুধ।’ হাসল সে : ‘তোমার মনে পড়ে, ম্যাডাম, কয়েকদিন আগে ”ফোর স্কোয়ার” ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে তুমি তিন প্যাকেট দুধ কিনেছিলে?’

‘হ্যাঁ—।’

‘তখন একজন টাকমাথা লোক তোমার সঙ্গে আলাপ করে কথা বলেছিল। তোমার ট্রলি থেকে একটা দুধের প্যাকেট তুলে নিয়ে সেটার ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্ন করেছিল। প্যাকেটটা অনেকক্ষণ তার হাতে ছিল। মনে আছে?’

‘হ্যাঁ—হ্যাঁ—।’ সুধার বুকের ভেতরের শব্দটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল।

‘ওই ভদ্রলোক অ্যাকচুয়ালি আমাদের লোক।’ খুক-খুক করে হাসল : ‘তোমার ওই দুধের প্যাকেটে একটা হাই পোটেনশিয়াল টক্সিন ইনজেক্ট করে দেওয়া হয়েছিল। ওই টাকমাথা লোকটার কাছে একটা আলট্রা-থিন নিডলওয়ালা ইনজেকশান সিরিঞ্জ ছিল। খুব ছোট সিরিঞ্জ। তার মধ্যে ছিল ওই টক্সিন। তোমার দুধের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে-করতে তোমার চোখের আড়ালে ওই টক্সিনটা প্যাকেটের মধ্যে পুশ করে দেওয়া হয়েছিল…।’

সুধাসুন্দরী কোনও কথা বলতে পারছিল না। মোবাইল ফোনটা আর-একটু হলেই ওর হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল।

অনেক চেষ্টায় ওর মুখ থেকে কয়েকটা অর্থহীন টুকরো শব্দ বেরোল শুধু।

লোকটা হেসে বলল, ‘ইচ্ছে করলেই আমরা ওই প্যাকেটে স্ট্রং ডোজের পয়জন ইনজেক্ট করতে পারতাম, কিন্তু করিনি। করলে তোমার মা ওপারে চলে যেত। সো কনসিডার ইয়োরসেলফ লাকি, ম্যাডাম। আসলে আমরা খুব দয়ালু…।’

সুধা চুপ করে রইল।

‘বাট নেক্সট টাইম উই মে নট বি সো কাইন্ড। য়ু মে নট বি সো লাকি। এখন ছাড়াছি। পরে আবার ফোন করব। বাট ডোন্ট ফরগেট, উই উইল বি ওয়াচিং য়ু…।’

ফোন ছেড়ে দিল লোকটা।

মায়ের চিকিৎসা নিয়ে টানা দু-সপ্তাহ ব্যস্ত রইল সুধা। মা-কে সুস্থ করে তোলার জন্য হাসপাতালের ডাক্তার এবং নার্সরা প্রাণপাত পরিশ্রম করতে লাগল।

হাই পোটেনশিয়াল টক্সিনটা মা-কে ভালোমতোই জখম করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডাক্তার-নার্সরা জিতে গেল। ওদের সাহায্যে মা-কে শারীরিকভাবে সুস্থ করে তুলে বাড়িতে নিয়ে এল সুধা। তারপর থেকেই ভয় আর উৎকণ্ঠা ওর মনের ভেতরে বাসা বাঁধল। নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে পাট গোটানোর জন্য ও পাগলের মতো হয়ে উঠল। ওর বারবারই মনে হতে লাগল, আগে মা, পরে জেরান্টোলজি।

কয়েকদিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সুধাসুন্দরী। ইন্টারনেটে নানান জায়গায় রিসার্চ সায়েন্টিস্ট পোস্টে অ্যাপ্লাই করতে লাগল। আর সকলের চোখের আড়ালে জেরান্টোলজির রির্সাচের কাগজপত্রগুলো সালফিউরিক অ্যাসিডে পোড়াতে লাগল।

প্রায় দিনদশেক ধরে নিজের প্রাণের জিনিসগুলো ধীরে-ধীরে পুড়িয়ে শেষ করল সুধা। পোড়ানোর সময়ে ওর চোখে জল এসেছিল। কিন্তু মায়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে ও মন শক্ত করেছে, চোখের জল মুছে নিয়েছে।

ওর গবেষণার কেরিয়ারের জোরে পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকেই চাকরির অফার পেল। অফার এল নিজের দেশ থেকেও। মা বারবার দেশে ফিরতে চাইছিল। বলছিল, ওল্ড সিটিতে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ওল্ড সিটির যা অবস্থা সেখানে না আছে সুধাসুন্দরীর মতো বিজ্ঞানীর জন্য কোনও চাকরি, না আছে মহিলাদের কোনও নিরাপত্তা!

তাই ওই ছন্নছাড়া বিপজ্জনক হতশ্রী শহরটায় না ফিরে সুধা ফিরে এল তার খুব কাছাকাছি—নিউ সিটিতে। চাকরির অফারটা নেওয়ার ফাইনাল স্টেজে ও কথা বলল সরাসরি শ্রীধর পাট্টার সঙ্গে। স্পষ্ট বলল, স্বাধীনভাবে গবেষণা করার জন্য ওর কী-কী চাই। কোন-কোন ধরনের ল্যাব ওর দরকার, ক’টা ‘ক্লিন’ রুম দরকার, কী ধরনের ম্যানপাওয়ার ওর চাই।

শ্রীধর পাট্টা প্রতিভা চিনতে কখনও ভুল করেন না। তা ছাড়া সুধাসুন্দরীর সম্পর্কে খুঁটিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর তিনি ওর কেরিয়ার দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। তাই ওর সব কথায় রাজি হয়ে গেলেন। তিনি জানতেন, সুধাসুন্দরী নিউ সিটিতে রিসার্চ কেরিয়ার নতুন করে শুরু করছে মানে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানের ম্যাপে নিউ সিটি জায়গা করে নেবে। তাই সুধাকে অসম্ভব গুরুত্ব আর স্বাধীনতা উপহার দিলেন।

মা-কে নিয়ে দেশে ফিরে এল সুধা। শ্রীধর পাট্টার শহরে ও নতুন করে বিজ্ঞানী-জীবন শুরু করল। ওর তত্বাবধানে বেশ কয়েকটা ল্যাবরেটরি গড়ে উঠল। সারা পৃথিবীর বায়োকেমিস্ট্রি ফিল্ডের বিজ্ঞানীরা এবার নিউ সিটির দিকে চোখ ফেরাতে লাগল।

কয়েক বছরের মধ্যেই সুধাসুন্দরী নিউ সিটির অংশ হয়ে গেল।

ওর কাহিনি শেষ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল সুধা। জিশানের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। ওর বড়-বড় চোখে প্রত্যাশার ছায়া। যেন বলতে চাইছে, এবার জিশান কিছু বলুক।

জিশান চটপটে তেজি বিজ্ঞানী মেয়েটাকে দেখছিল। ওর ভয়ংকর দিনগুলো ভাবতে চেষ্টা করছিল : জেরান্টোলজির গবেষণা, ওই ভয়-দেখানো টেলিফোন, মায়ের ওপরে ওইরকম নৃশংস অ্যাটেম্পট…। সত্যি, অনেক সইতে হয়েছে সুধাকে! যেমন, জিশান এখন সইছে।

জিশান হেসে বলল, ‘তুমি একজন রিয়েল ফাইটার।’

‘তোমার মতো নয়। তুমি এখন একজন আইকন—নিউ সিটি আর ওল্ড সিটির সবার কাছে…।

‘তোমার মা এখন কেমন আছেন?’

দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াল সুধাসুন্দরী। কী একটা বলতে গিয়েও বলল না। টেবিলের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল। তারপর মুখ তুলে জিশানের দিকে তাকাল : ‘চলো, মায়ের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। মা বেডরুমেই থাকে—খুব একটা বেরোতে পারে না…।’

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সুধা। জিশানও।

সুধা ছোট্ট করে বলল, ‘এসো…।’

সুধাসুন্দরীর পিছন-পিছন এগিয়ে চলল জিশান। সম্পর্কের টান আর তাকে জড়িয়ে থাকা ভালোবাসার কথা মনে পড়ছিল। মনে পড়ছিল মিনি আর শানুর কথা। মিনি দোসরা সেপ্টেম্বর তারিখটার কথা প্লেট টিভির দৌলতে জেনেছে। জিশান যখন ওকে এম-ভি-পি-তে কিল গেমের তারিখটার কথা বলে তখন মিনি ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিল, ‘জানি—।’

 সেদিন মিনি বড্ড চুপচাপ ছিল। শুধু শানুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল। হয়তো ভাবছিল, জিশান চলে গেলে ছোট্ট শানুকে ও একা-একা মানুষ করতে পারবে তো!

জিশান ওকে বলেছিল, ‘দু-তারিখের ব্যাপারটা মিটে গেলে তিন তারিখ সকালে তোমাকে ফোন করব…।’

মিনির চোখের দিকে তাকিয়ে জিশানের মনে হয়নি যে, মিনি ওর কথা বিশ্বাস করেছে।

সুধাসুন্দরীর বেডরুমের দরজায় দাঁড়াতেই ওষুধের মতো একটা গন্ধ জিশানের নাকে এল। সুধা তখন কাউকে লক্ষ্য করে একটু জোরালো গলায় ডেকে উঠেছে, ‘মা!’

ঘরে ঢুকেই সুধার মা-কে দেখতে পেল জিশান।

ধপধপে সাদা বিছানায় বসে আছেন একজন ধপধপে সাদা মহিলা। পরনে ধপধপে সাদা শাড়ি।

সাদা বিছানার পটভূমিতে মহিলাকে প্রায় দেখাই যেত না, যদি না ওঁর মাথার চুলগুলো কালো হত।

রোগা ক্ষীণজীবী চেহারা। সামনে টিভি চলছে, কিন্তু সেদিকে ওঁর মন নেই। বিছানার চাদরের ওপরে আঙুল দিয়ে অদৃশ্য দাগ টেনে কাটাকুটি খেলছেন। ওঁর গায়ের চামড়ায় এত ভাঁজ যে, জিশান অবাক হল। আগে কখনও কারও চামড়ায় এত ভাঁজ দেখেনি ও।

বিছানার কাছেই একটা সবুজ রঙের হেক্সাগনাল ব্লকের ওপরে শর্মি বসে ছিল। জিশানকে শোওয়ার ঘরে দেখে ও কেমন যেন একটু জড়োসড়ো হয়ে গেল। চট করে উঠে দাঁড়াল।

‘মা! এই দ্যাখো, জিশান তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে। এই যে—তাকাও এদিকে…।’

সুধা গিয়ে মায়ের পাশে বসল। মায়ের একটা হাত জড়িয়ে ধরল। শর্মিকে ইশারা করতেই ও একটা নীল রঙের হেক্সাগনাল ব্লক বিছানার কাছে নিয়ে এসে রাখল।

‘জিশান, এসো—বোসো—।’ ব্লকটা জিশানকে ইশারা করে দেখাল সুধা।

জিশান বসল। সুধাসুন্দরীর মায়ের খুব কাছে—মুখোমুখি।

কাছ থেকে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে জিশান অবাক হয়ে গেল।

লোলচর্ম এই বৃদ্ধার দু-চোখের মণির ওপরে সাদা পরদার আস্তরণ। মনে হচ্ছে, ওঁর চোখের ওপরে কুয়াশা জমেছে।

‘মা, এই যে, জিশান—’ মায়ের হাতটা নিয়ে জিশানের হাত ছুঁইয়ে দিল সুধা : ‘জিশান এখন নিউ সিটির সুপারহিরো। সেপ্টেম্বরের দু-তারিখে গেম সিটিতে ওর লড়াই—কিল গেম—সকাল থেকে রাত পর্যন্ত…।’

বৃদ্ধার সাদা কুয়াশা ঢাকা চোখ জিশানের দিকে তাকাল। ভাঁজ পড়া গাল কাঁপল। জিশানের হাতের ওপরে আলতো করে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘সুধার খুব বিপদ। ওকে টেলিফোন করে সবাই ভয় দেখায়…।’

জিশান সুধার দিকে তাকাল। চোখে আবছা প্রশ্ন।

সুধা ওকে হাতের ইশারায় চুপ করে থাকতে বলল।

‘তোমাকে কেউ ভয় দেখায় না তো, জিশান?’ কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন।

‘না, কাকিমা—কেউ ভয় দেখায় না। কারণ, আমি ভয় পাই না…।’

‘খুব ভালো, খুব ভালো—’ জিশানের হাতে হাত বোলাতে-বোলাতে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না। আর শোনো, রাস্তাঘাট দেখে পার হবে—কোনও গাড়ি যেন তোমাকে ধাক্কা না মারে…।’

জিশান উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছিল না।

সুধা ওর মায়ের পাশ থেকে উঠে জিশানের পাশটিতে এসে দাঁড়াল। জিশানের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ‘মা যা বলে চুপচাপ শুনে যাও আর মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাও। পরে তোমাকে সব বলছি…।’

সুধা আবার ওর মায়ের পাশে গিয়ে বসল।

বৃদ্ধা তখনও শূন্য চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলছেন, ‘দেখে-শুনে রাস্তা পার হবে, বুঝলে। নইলে কোথা থেকে গাড়ি-টাড়ি ছুটে আসবে—হুট করে ধাক্কা মেরে দেবে…।’

বৃদ্ধার হাতে চাপ দিল জিশান। বলল, ‘আজ আসি, কাকিমা। আশীর্বাদ করুন যেন কিল গেমে জিততে পারি…।’

‘তুমি জিতবে…জিতবে…।’

বৃদ্ধার হাতটা আলতো করে ফিরিয়ে দিল জিশান। তারপর উঠে দাঁড়াল।

সুধার দিকে চোখ গেল ওর। চোখের কোণ চিকচিক করছে। মুখে কাতর ছায়া।

জিশান একটু সরে আসতেই সুধাসুন্দরী উঠে দাঁড়াল। জিশানের খুব কাছে এসে চাপা গলায় বলল, ‘ওই মিসহ্যাপটার পর মায়ের ব্রেন খানিকটা ড্যামেজ হয়ে গেছে। বিশেষ করে অপটিক আর ভেগাস ক্রেনিয়াল নার্ভগুলো। এ ছাড়া আর-একটা পিকিউলিয়ার ব্যাপার হয়েছে। মায়ের এজিং প্রসেসে একটা ডিজর্ডার দেখা দিয়েছে—মা খুব তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাচ্ছে। মা-কে আর কতদিন ধরে রাখতে পারব জানি না…।’ সুধার গলা ধরে এল।

ওর দিকে তাকিয়ে জিশান স্পষ্ট বুঝতে পারল ও প্রাণপণে কান্না চাপতে চেষ্টা করছে।

সুধা হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। গলা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে ওর মা-কে লক্ষ্য করে নীচু গলায় বলল, ‘মা, আসছি…।’

ইশারা করে শর্মিকে মায়ের কাছে এসে বসতে বলল সুধা। তারপর জিশানকে সঙ্গে নিয়ে বেডরুমের দরজার দিকে এগোল।

হঠাৎই পিছন থেকে কাঁপা গলায় ডেকে উঠলেন বৃদ্ধা, ‘জিশান…।’

জিশান ঘুরে দাঁড়াল : ‘বলুন, কাকিমা—।’

‘তুমি কখনও দুধ খেয়ো না, জিশান…।’

গুনাজির কাছে নিয়মিত গাড়ি চালানো শিখছিল জিশান। এবং গাড়ির মধ্যে যেসব আধুনিক অটোমেটিক ব্যবস্থা রয়েছে তাতে গাড়ি চালানো শিখতে ওর সময় বেশি লাগল না। তারপর গুনাজি ওকে চালানোর নানান কায়দা, কসরত আর কেরামতি শেখাতে লাগল।

ঢাল বেয়ে নামার সময় কীভাবে গাড়ি চালাতে হয়। সাপের মতো আঁকাবাঁকা পথে কীভাবে স্টিয়ারিং আর ব্রেককে কন্ট্রোল করতে হয়। যদি দেখা যায় যে, অ্যাক্সিডেন্ট হচ্ছেই—কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না—তখন কী-কী স্টেপ নিলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো যেতে পারে। হঠাৎ করে গাড়ির ব্রেক ফেল হয়ে গেলে জিশান কীভাবে নিজেকে বাঁচাবে। ব্যাক গিয়ার দিয়ে কীভাবে গাড়ি পিছনদিকে জোরে ছোটাতে হয়।

এইরকম আরও কত কী!

জিশান বাধ্য ছাত্রের মতো সব শিখে নিচ্ছিল আর মনে-মনে ভাবছিল, এতসব কায়দাকানুন ওর শেখার দরকারটা কী?

একদিন ও গুনাজিকে প্রশ্নটা করেই বসল।

‘গুনাজি, তুমি আমাকে ড্রাইভিং-এর এতরকম মারপ্যাঁচ শেখাচ্ছ কেন বলো তো? আমি কি কার রেসিং-এ নাম লেখাতে যাচ্ছি নাকি?’

জিশানের দিকে তাকিয়ে হাসল গুনাজি : ‘দাদা, আপনাকে কার ড্রাইভিং-এর সঙ্গে-সঙ্গে এসবও শেখাতে হবে। কারণ, মার্শাল স্যার আমাকে সেরকমই অর্ডার দিয়েছেন…।’

গুনাজিকে ভালো করে লক্ষ করল জিশান।

মাথার চুলে জেল। চুলের সোনালি রং রোদে চকচক করছে। মুখে প্রবল উৎসাহ আর উদ্দীপনা। গা থেকে পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে।

‘কেন, এরকম অর্ডার দিয়েছেন কেন?’

একটু চুপচাপ থাকার পর গুনাজি বলল, ‘কিল গেমে যারা যায় তাদের এগুলো শিখে নেওয়া জরুরি, তাই। গেম সিটিতে দরকার পড়লে গাড়ি চালাতে হয়। আর সেটাও চালাতে হয় বেশ ডেঞ্জারাসভাবে…।’

জিশান গুনাজির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর মনে হচ্ছিল, গুনাজি জিশান নয়, অন্য কারও কথা বলছে। কিল গেমের অন্য একজন প্লেয়ারকে গুনাজি গাড়ি চালানো শেখাচ্ছে, গাড়ি নিয়ে নানান কসরত রপ্ত করাচ্ছে—তারই কথা বলছে গুনাজি। আর জিশান শুনছে।

ইস, এমনটা যদি সত্যি হত!

গাড়িটা একপাশে পার্ক করে কথা বলছিল গুনাজি। জিশান গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল।

বিশাল এলাকা জুড়ে নিউ সিটির এই ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার। নাম ‘ফ্লাই বাই’। সুপারগেমস কর্পোরেশনের পার্টিসিপ্যান্টরাই একমাত্র এই ট্রেনিং সেন্টারে গাড়ি এবং মোটরবাইক চালানো শিখতে পারে। তাও আবার কর্পোরেশনের অর্ডার পেলে তবেই।

এখানে এক-এক ধরনের ট্রেনিং-এর জন্য রয়েছে এক-একরকম ট্র্যাক। প্রতিটি ট্র্যাকের এলাকায় রঙিন এল-সি-ডি প্যানেলে নানান নির্দেশ লেখা। তার পাশে ছবি এঁকেও বোঝানো রয়েছে, এই এলাকাটা কোন ধরনের ট্রেনিং-এর জন্য ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া প্রতিটি এলাকার জন্য রয়েছে বিশেষ ধরনের লোগো। সেই লোগোটা এলাকার নানান জায়গায় বেশ পরিকল্পনা করে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে কারও পক্ষে ভুল করে এক এলাকার বদলে অন্য এলাকায় ঢুকে পড়া মুশকিল।

কিন্তু তা সত্বেও যদি কেউ ঢুকে পড়ে তার জন্য রয়েছে বিপার এবং সিকিওরিটি গার্ড।

একটা গাড়ি যখন ‘ফ্লাই বাই’-এর কোনও জোনে ঢুকতে চায় তখন সেই গাড়ির ড্রাইভারকে সেই জোনের একটা বড় মাপের লোগো কার্ড দেওয়া হয় : স্পেশালি কোডেড ম্যাগনেটিক কার্ড। সেটা উইন্ডশিল্ডে লাগিয়ে নিতে হয়। এই লোগো কার্ড লাগানো অবস্থায় অন্য কোনও জোনে গাড়ি ঢুকলেই বিপার বেজে ওঠে আর লোগো কার্ডটা ফ্ল্যাশ করতে থাকে। তখন সিকিওরিটি গার্ডরা গাড়িটা থামিয়ে তার কন্ট্রোল হাতে নেয়।

‘ফ্লাই বাই’-এর গার্ডদের পোশাকের রং নীল, তবে জোন অনুযায়ী তাদের পোশাকে নানান লোগো লাগানো রয়েছে।

গুনাজির কাছেই জিশান জেনেছে, এই ট্রেনিং সেন্টারের রাস্তাগুলো একটা স্পেশাল টাইপের সিনথেটিক অ্যাসফাল্ট দিয়ে তৈরি। এর ওপর দিয়ে যত জোরেই গাড়ি ছুটুক না কেন, তাতে রাস্তার ক্ষয় প্রায় হয় না বললেই চলে। অথচ গাড়ির টায়ারের গ্রিপের কোনও সমস্যা হয় না।

রাস্তা ছাড়াও ট্রেনিং-এর জন্য রয়েছে ধু-ধু মাঠ। এবড়োখেবড়ো, পাথুরে, আগাছায় ভরা। এ ছাড়া রয়েছে প্রকাণ্ড ঢিবি আর গর্ত। সবমিলিয়ে রাফ অ্যান্ড টাফ হোস্টাইল টেরেন। গাড়ি চালানো শিখতে হবে সবরকম রাস্তা আর জমিতে।

‘ফ্লাই বাই’-এর চারপাশটা দেখে জিশান স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। এত সুন্দর এবং আধুনিক ট্রেনিং সেন্টার বুঝি স্বপ্নেই দেখা যায়! নাকি তাও দেখা যায় না?

কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে গড়ে তোলা এই ট্রেনিং সেন্টার জীবন-মরণ নিয়ে জুয়া খেলার আধুনিক আয়োজন করে তা থেকে নিয়মিত কোটি-কোটি টাকা আয়ের কী চমৎকার স্থায়ী বন্দোবস্ত করেছেন শ্রীধর পাট্টা!

গুনাজির কাছে তিনদিন ট্রেনিং নেওয়ার পর জিশানের দায়িত্ব নিল অন্য একজন ট্রেনার—যদিও গুনাজি অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে সঙ্গে রইল।

এই ট্রেনিং-এর ধাপে জিশান যেটা শিখছিল সেটা হল, নিজেকে অক্ষত রেখে কী করে বেপরোয়াভাবে গাড়ি ড্রাইভ করতে হয়—তা সেটা সামনের দিকেই হোক বা পিছনের দিকেই হোক। তার সঙ্গে শেখানো হতে লাগল গাড়ি ছুটিয়ে ‘র‌্যাম্প’ বেয়ে উঠে সেখান থেকে ঝাঁপ দেওয়া। ছুটন্ত গাড়ি জলের মধ্যে পড়ে গেলে ডুবে যাওয়া সেই গাড়ি থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসতে হয়। চলন্ত গাড়িতে আগুন ধরে গেলে কী করে নিজেকে বাঁচাতে হয়।

সোজা কথায়, গাড়ি নিয়ে যতরকম বিপজ্জনক পরিস্থিতি হতে পারে তার মোকাবিলা করার ট্রেনিং চলতে লাগল।

জিশান বুঝতে পারছিল, ও একটা পেশিবহুল যন্ত্র থেকে ধীরে-ধীরে আরও নিখুঁত একটা পেশিবহুল যন্ত্রে পালটে যাচ্ছিল।

গাড়ি চালানোর ঘামঝরানো বেপরোয়া ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর জিশানের কিন্তু ছুটি হল না। শ্রীধর পাট্টার নির্দেশে ওকে তুলে দেওয়া হল প্যাসকো নামের এক মোটরবাইক ওস্তাদের হাতে।

জিশানের সামনে অ্যাসফাল্টের ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল ‘বুলডোজার—ব্লু লাইন’ মডেলের চার হাজার সি.সি.-র একটা বাইক। তার পাশে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে ছিল প্যাসকো।

কালো রঙের বাইকটাকে মনে হচ্ছিল একটা বুনো মোষ। আর তার বাঁকানো দুটো হাতল যেন মোষের শিং।

জিশানের মনে হল, প্যাসকোর মোটাসোটা ভারী চেহারাটাও বুনো মোষের চেহারার খুব কাছাকাছি।

গায়ে কালো চামড়ার স্লিভলেস জ্যাকেট। জ্যাকেটের গলার কাছটায় কয়েক খাবলা লোম উঁকি মারছে। গায়ের রং গাঢ় তামাটে। মোটা-মোটা হাত দুটো যেন ইস্পাতের থাম। হাতের সব জায়গায় লাল-কালো-সবুজ রঙের উলকি। মাথার ঝাঁকড়া চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমে এসেছে। মুখটা লাউয়ের মতো ভারী। বাঁ-কানে একটা সোনার মাকড়ি। থুতনিতে যে-দাড়িটুকু রয়েছে সেটা ফ্রেঞ্চকাট আর ছাগলদাড়ির মাঝামাঝি। তাতে আবার চকচকে রুপোলি রং মাখানো।

প্যাসকো কী যেন একটা চিবোচ্ছিল—কারণ, ওর চোয়াল নড়ছিল।

প্যাসকোকে দেখেই জিশানের মনে হল, প্যাসকো কিল গেমের একজন পার্টিসিপ্যান্ট। ওর চোখ দুটো ছোট-ছোট—ডুমো-ডুমো গালের কোলে ঢোকানো। দুটো চোখের মণি যেন বরফের টুকরো। ঠান্ডা, মরা মাছের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে জিশানের দিকে।

প্রথম দিন সকাল ন’টার সময় জিশানকে মোটরবাইক ট্রেনিং জোনে পৌঁছে দিয়ে গুনাজি ‘ভিজিটরস ওয়েটিং জোন’-এ চলে গিয়েছিল। সেখানে ও জিশানের জন্য বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।

গাড়ি চালানোর কসরত শেখানোর সময় গুনাজি বলেছিল, ‘দাদা, শুধু কার ড্রাইভিং নয়, আপনাকে মোটরবাইক চালানোও শিখতে হবে…।’

উত্তরে জিশান বলেছে, ‘আমি মোটরবাইক চালাতে জানি, গুনাজি…।’

গুনাজি হেসে বলেছে, ‘ওই শেখা দিয়ে কাজ হবে না, দাদা। গেম সিটিতে মোটরবাইক চালানো খুব সহজ নয়। অথচ সেখানে শত্রুকে প্রাণে মারার জন্যে…কিংবা নিজে প্রাণে বাঁচার জন্যে…মোটরবাইক চালানোয় ওস্তাদ হওয়া দরকার…।’

কথা বলতে-বলতে গুনাজি হঠাৎ কেঁদে ফেলল। কোনওরকমে চোখ মুছে নিয়ে ভাঙা গলায় বলল, ‘সেটা আপনি দু-তারিখেই বুঝতে পারবেন। গেম সিটির মধ্যে এবড়োখেবড়ো পাথুরে জমি, পাহাড়, নদী, জঙ্গল—সব আছে। আমাদের মার্শাল বলেন, এসব না থাকলে লুকোচুরি খেলা জমবে কী করে! টিভিতে কিল গেমের প্রাোমোতে প্রায়ই এসব নিয়ে আলোচনা হয়, ছবি দেখায়। আমি দেখেছি…।’

কাঁধে হাত বুলিয়ে গুনাজিকে আশ্বাস দিল জিশান : ‘তুমি আমার ওপরে ভরসা রাখতে পারছ না, গুনাজি?’

‘না, না—তা নয়…।’ গুনাজি ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে বলল।

‘তুমি চিন্তা কোরো না, গুনাজি। আমি খুব মন দিয়ে মোটরবাইক চালানো শিখব। খুব মন দিয়ে লড়ব…।’

গুনাজি কোনও কথা বলল না। শুধু চোখের জল মুছে চোয়াল চেপে ওপর-নীচে মাথা নাড়ল। তারপর গাড়িতে উঠে ‘ভিজিটরস ওয়েটিং জোন’-এর দিকে রওনা হয়েছিল।

ওর গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে জিশানের মনে হল, সত্যি কিল গেমের আর বেশি দিন বাকি নেই : মাত্র চোদ্দো দিন।

প্যাসকোর কাছাকাছি পৌঁছতেই ও হাত বাড়িয়ে দিল জিশানের দিকে। ওর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার সময় জিশান টের পেল, ওর শক্তিও বুনো মোষের যথেষ্ট কাছাকাছি।

‘ওয়েলকাম, জিশান, ওয়েলকাম—।’ হেসে বলল প্যাসকো, ‘তোমার কাণ্ডকারখানা টিভিতে রোজ দেখছি। তোমার জবাব নেই।’

জিশানের মনে হল, প্যাসকোর হাসিটা খুব সরল এবং আন্তরিক। তা ছাড়া, ওর মুখে হাসি ফুটে ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে চোখের ঠান্ডা মরা মাছের দৃষ্টিটা কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।

ওর হাসির উত্তরে জিশান অজান্তেই হেসে ফেলল।

‘সুপারগেমস কর্পোরেশন তোমার ডোসিয়ার আমাকে পাঠিয়েছে। সামনের মাসের দু-তারিখে তোমার কিল গেম। আমাদের এই ”ফ্লাই বাই”-এ ছ’-জন মোটরবাইক ট্রেনার আছে। তবে আমি শুধু কিল গেমের ক্যান্ডিডেটদের ট্রেনিং দিই। সুতরাং তুমি আমাকে মোটরবাইক ট্রেনিং-এর সুপার ট্রেনার বলতে পারো।…আচ্ছা, তুমি কি বাইক চালাতে জানো?’

প্রশ্নটা এমনভাবে হল যে, জিশান ঠিক তৈরি ছিল না। একটু থতমত খেয়ে ও বলল, ‘হ্যাঁ—জানি।’

‘তা হলে আমাদের ট্রেনিং-এ অনেকটা সুবিধে পাওয়া যাবে—।’

‘তোমার কাছে সুপার ট্রেনিং নিতে আমার ক’দিন লাগবে?’

জিশানের কথায় মজা পেয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘হা-হা’ করে হেসে উঠল প্যাসকো : ‘ভালো বলেছ! সুপার ট্রেনিং!…এই যে এই বাইকটা দেখছ…,’ বলে কালো বাইকটার গায়ে হাত বোলাল প্যাসকো। তারপর রেসে জেতা ঘোড়ার পিঠে অহঙ্কারের চাপড় মারার ঢঙে বাইকটার সিটে চাপড় মারল : ‘বুলডোজার—ব্লু লাইন বাইক। চারহাজার সিসি। ঘণ্টায় পাঁচশো মাইল স্পিডে ছুটতে পারে। এককথায় সুপারবাইক…।’

‘তা হলে আর ভুল কী বলেছি, প্যাসকো! সুপার ট্রেনার আর সুপার বাইক—সুপার ট্রেনিং তো হবেই হবে।’

প্যাসকো বাইকে উঠে বসল। পিছনে উঠে বসার জন্য জিশানকে ইশারা করল।

জিশান চটপটে পা ফেলে বাইকটার কাছে এগিয়ে গেল। অভ্যস্ত ভঙ্গিতে প্যাসকোর পিছনে চড়ে বসল। তারপর আবার জিগ্যেস করল, ‘আমার ট্রেনিং ক’দিন চলবে?’

প্যাসকো ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, ‘দ্যাখো, আমার সিটের দুপাশে গ্রিপার আছে। ও-দুটো শক্ত করে চেপে ধরো। হ্যাঁ, তোমার ট্রেনিং। আমার কাছে তোমার ট্রেনিং চলবে চারদিন। সকাল ন’টা থেকে পাঁচটা। ঝোড়ো ট্রেনিং। ক্র্যাশ কোর্স—।’

জিশান কোনও কথা বলল না। একটু নজর করতেই ও কালো ফাইবারের গ্রিপার দুটো দেখতে পেল। শক্ত করে সে-দুটো চেপে ধরল। তখনই খেয়াল করল, একটু দূরে দাঁড়িয়ে একজন সিকিওরিটি গার্ড ওকে লক্ষ্য করে হাসছে।

ট্রেনিং-এ আসছে বলে জিশান টুপি বা কালো চশমা পরে আসেনি। তাই গার্ডটা ওকে চিনতে পেরেছে।

গার্ডটা হাত তুলে ওকে সেলাম জানাল।

জিশানও পালটা সেলাম ফিরিয়ে দিল।

তখন গার্ডটা দু-হাত শূন্যে তুলে দুটো ‘ভি’ অক্ষর দেখাল।

জিশান প্রথমটা ভাবল, গার্ডটা ওকে ডবল ভিকট্রি সাইন দেখাচ্ছে। কিন্তু তার পরেই মনে হল, না, তা নয়। গার্ডের দেখানো প্রথম ‘ভি’-টা আসলে দুই—সেপ্টেম্বরের দু-তারিখ। আর দ্বিতীয় ‘ভি’-টা ভিকট্রি।

বুলডোজার ছুটতে শুরু করেছিল। স্টার্ট দেওয়ার পর মাত্র দু-তিন সেকেন্ডের মধ্যেই বাইকটা হাই ভেলোসিটিতে পৌঁছে গিয়েছিল। জিশানের চুল বাতাসে উড়ছিল। বাইকের মসৃণ চলায় জিশান প্যাসকোর দক্ষতা টের পাচ্ছিল। ও ভেবেছিল, চারহাজার সিসি-র বাইক চলার সময় কানফাটানো আওয়াজ হবে, কিন্তু সেটা হচ্ছিল না। বাইকের দুপাশে প্রকাণ্ড মাপের দুটো সাইলেন্সার লাগানো রয়েছে। স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি সাইলেন্সার দুটোয় বড়-বড় খাঁজ কাটা, আর তাদের চেহারাও বিচিত্র। ওরাই বেশিরভাগ শব্দকে গিলে নিচ্ছিল।

পাঁচ-সাত সেকেন্ডের মধ্যেই ওরা ট্রেনিং জোনে এসে পড়ল। ট্রেনিং জোন, তবে সেটা প্রকৃতির তৈরি একটা বিশাল এলাকা। গাছপালা, উঁচু টিলা, উঁচু-নীচু রুক্ষ জমি, খানা-খন্দ-ডোবা—সবই আছে সেখানে।

জোনের একপাশে প্যাভিলিয়ন। সেখানে সবার জন্য ড্রেসিংরুম, বাথরুম আর ক্যান্টিন রয়েছে।

জিশান জামাকাপড় পালটে তৈরি হয়ে নিল। তখন দেখল, সেখানে আরও কয়েকজন ট্রেনার আর ট্রেনি রয়েছে। এই ট্রেনিরা নিশ্চয়ই অন্যান্য গেমের পার্টিসিপ্যান্ট।

ওরা সবাই জিশানকে দেখতে লাগল, নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় আলোচনা করতে লাগল।

জিশান লক্ষ করল, ট্রেনি কিংবা ট্রেনার, সবার চেহারাই সমীহ করার মতো। এদের মধ্যে যে-কেউই কিল গেমের পার্টিসিপ্যান্ট হতে পারে। কিন্তু চেহারাই যে সব নয় সেটা জিশান এর মধ্যেই বেশ ভালো করে জেনেছে। তাই ও মনে-মনে হাসল। ও এখন জানে, কিল গেমের ফাইনালে উঠতে হলে ভালো চেহারা ছাড়াও আর কী-কী লাগে।

শক্তি, সাহস, ক্ষিপ্রতা, উপস্থিতবুদ্ধি, প্রতিপক্ষের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা, চুলচেরা বিচারের সূক্ষ্ম নজর, এক লহমায় পরিস্থিতি আঁচ করে নেওয়ার দক্ষতা, আর…।

আর পিছুটান। মিনি আর শানুর মতো জোরালো সুন্দর পিছুটান।

জিশান আগে ভাবত, যাদের কোনও পিছুটান নেই তারাই বোধহয় সবচেয়ে বেপরোয়া লড়তে পারে। এখন ও জানে, সেটা ঠিক নয়। বেপরোয়ার বেপরোয়া লড়তে পারে পিছুটানওয়ালা মানুষ। তার ভালোবাসার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য।

সারাদিনের ট্রেনিং যখন শেষ হল তখন জিশান সত্যিই কাহিল হয়ে পড়েছে। ও প্যাসকোর সঙ্গে ক্যান্টিনে গিয়ে বসল। আরামের গদিতে শরীরটাকে ছেড়ে দিল। তারপর গ্র্যানিউলার গ্রেভি স্যান্ডউইচ আর কনসেনট্রেটেড এনার্জি ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল।

ট্রেনিং-এর মাঝে ব্রেকের সময় একবার ওরা ক্যান্টিনে এসেছিল বটে কিন্তু তখন আয়েস করার সময় ছিল না। সেকেন্ড হাফের ট্রেনিং শুরু করার চাপ ছিল।

কিন্তু এখন সে-টেনশান নেই।

প্যাসকোর ট্রেনিং-এর কথা জিশানের মনে পড়ছিল। ওর মোটরবাইক চালানো দেখে মনে হচ্ছিল বুলডোজার বাইকটা ওর শরীরেরই অংশ। বাইক নিয়ে যে এরকম বিপজ্জনকভাবে এত কিছু করা যায় তা জিশান আগে কখনও কল্পনা করেনি। ও মোটরবাইক চালাতে জানে বলে প্যাসকোর ট্রেনিং খুব দ্রুত এগোচ্ছিল।

আজ ট্রেনিং-এর প্রথম ধাপে জিশান প্যাসকোর পিছনে বসেছে।

দ্বিতীয় ধাপে প্যাসকো বসেছে জিশানের পিছনে।

আর তৃতীয় ধাপে জিশান একাই বুলডোজার চালিয়েছে। তখন জিশানের কানে ছিল ইয়ারফোন। বহুদূরে দাঁড়ানো প্যাসকোর ইনস্ট্রাকশন ওয়্যারলেসের মাধ্যমে জিশানের কানে এসেছে।

আজ ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর জিশানের মনে হচ্ছিল, ও যেন কতদিন ধরে ‘ফ্লাই বাই’-এ মোটরবাইক চালানোর ট্রেনিং নিচ্ছে।

ট্রেনিং শেষ হওয়ার পর জিশান যে শুধু ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তা নয়, ওর ভীষণ খিদেও পাচ্ছিল। ক্যান্টিনে এসে ওর খিদেটা কেউটের ফণার মতো ঝটকা দিয়ে লাফিয়ে উঠল।

ক্যান্টিনটা নামেই ক্যান্টিন, কিন্তু চরিত্রে সুপার হাই-ফাই রেস্তরাঁ। নরম রঙিন আলোয় ভাসিয়ে দেওয়া ঠান্ডা মনোরম পরিবেশ। গোটা রেস্তরাঁর ইন্টিরিয়ার ডেকরেশানে ব্যবহার করা হয়েছে শুধু রংহীন কাচ আর স্টেইনলেস স্টিল। রেস্তরাঁর সামনে সুন্দর করে সাজানো সবুজ মাঠ, আর তাকে ঘিরে রঙিন ফুলের বাগান।

রেস্তরাঁর কোথাও কোনও মেয়ের চিহ্ন নেই—চারিদিকে পুরুষ আর পুরুষ। তাদের বেশিরভাগই গেমস পার্টিসিপ্যান্ট এবং তারা ওল্ড সিটির পাবলিক।

প্যাসকো হালকা গল্প করছিল। ওর চেহারা দেখে মনে হয় না ও কখনও কারও সঙ্গে এরকম ভেসে যাওয়া মুডে গল্প করতে পারে।

খেতে-খেতে ও হঠাৎই মুখ তুলে তাকাল জিশানের দিকে। আচমকা বলে বসল, ‘জানো তো, আমি কিল গেমের পার্টিসিপ্যান্ট ছিলাম। চার বছর আগে। তোমার মতো ফাইনালেও উঠেছিলাম…।’

জিশান চমকে উঠল। ওর খাওয়া থমকে গেল।

অবাক হয়ে বলল, ‘সত্যি?’

‘হ্যাঁ, সত্যি…।’ প্যাসকো বলল।

‘তারপর? তারপর কী হল? তুমি কিল গেমে জিতলে?’

‘না:…,’ মাথা নাড়ল প্যাসকো। ‘ফোঁস’ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বলল, ‘জিতিনি…।’

জিশান অবাক হয়ে গেল। না জিতলে প্যাসকো ওর সামনে বসে আছে কী করে? বেঁচে আছে কী করে?

তিন চামচ গ্র্যানিউলার গ্রেভি স্যান্ডউইচ মুখে পুরে দিল প্যাসকো। সেটা চিবোতে-চিবোতে চুমুক দিয়ে কয়েক ঢোঁক এনার্জি ড্রিংক তাতে মিশিয়ে নিল। তারপর বলল, ‘আমার পিকিউলিয়ার একটা মিসহ্যাপ হয়েছিল…’ একটু থেমে ‘হুঁ:’ করে বিরক্তির একটা শব্দ করল। মাথা ঝাঁকাল কয়েকবার : ‘কিল গেমের ঠিক দুদিন আগে আমি হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেলাম। আমাকে নিউ সিটির সেন্ট্রাল নার্সিং ইউনিটে ভরতি করে দেওয়া হয়েছিল। পরদিন জ্ঞান ফেরার পর নার্সদের মুখে শুনলাম, হাইপারটেনশান আর হাই প্রেশার আমাকে আচমকা ধাক্কা দিয়েছে। কিল গেমের দিন যত এগিয়ে আসছিল আমার টেনশান নাকি ততই বাড়ছিল। তারপর আমি আর চাপ নিতে পারিনি…।’

‘কিল গেমের কী হল?’

‘কী আবার হল! শ্রীধর পাট্টা আমার বদলে অন্য একজন পার্টিসিপ্যান্টকে মাঠে নামিয়ে দিলেন। ছেলেটা দুপুর পেরিয়ে বিকেল হওয়ার আগেই বডি হয়ে গেল। গেমস-এর অনেকগুলো রাউন্ডে ও জিতেছিল…কিন্তু সেরকম টাফ ছিল না।’

জিশান এনার্জি ড্রিংক শেষ করে হাতের পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছল। হ্যাঁ, কিল গেমে চব্বিশ ঘণ্টা লড়তে গেলে টাফ হওয়া দরকার। প্যাসকোর গা থেকে টাফনেসের গন্ধ বেরোচ্ছিল। সেই সঙ্গে ঘামের গন্ধও।

একটু দূরে একটা টেবিল ঘিরে পাঁচজন ট্রেনির একটা দল বসে ছিল। নিজেদের মধ্যে ওরা গল্পগুজব করছিল, খাওয়াদাওয়া করছিল। আর থেকে-থেকেই ঘাড় ঘুরিয়ে জিশানকে দেখছিল।

জিশানকে ওরা চিনতে পারবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ওরা এতবার তাকাচ্ছিল যে, জিশানের একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। ও বুঝতে পারছিল, শুধু তাকানো নয়, ওকে নিয়ে কিছু একটা আলোচনাও চলছে। তা ছাড়া মাঝে-মাঝেই ওরা জিশান আর প্যাসকোর দিকে আঙুল দেখিয়ে চাপা গলায় কীসব বলাবলি করছে।

জিশান ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টায় প্যাসকোর দিকে তাকাল। যে-প্রশ্নটা কিছুক্ষণ ধরে ওর মনে খোঁচা মারছিল সেটাই করল ওকে।

‘কিন্তু এই চাকরিতে তুমি ঢুকলে কেমন করে? আর এইরকম ব্যাপক বাইক চালাতেই বা শিখলে কী করে? মার্শাল তো আর এমনি-এমনি তোমাকে সুপার ট্রেনারের চেয়ারে বসাবেন না…।’

হাসল প্যাসকো। বলল, ‘ঠিকই বলেছ। সে অনেক গল্প। তোমার ট্রেনিং তো এখন চলবে। কাল শুনো…।’

‘ঠিক আছে—তাই হবে।’

ক্যান্টিন থেকে বেরোনোর সময় প্যাসকো জিশানের পিঠে চাপড় মেরে বলল, ‘তোমার মোটরবাইকের হাত ভালো—শিখছও তাড়াতাড়ি। একটা কথা মনে রেখো, জিশান। গেম সিটিতে মোটরবাইক হচ্ছে একটা বড় ওয়েপন। খুব পাওয়ারফুল ওয়েপন। এটাকে ঠিকঠাক ইউজ করতে পারলে তুমি জিতবে—।’

জিশান প্যাসকোর চোখের দিকে তাকাল। একটা দিনের পরিচয়েই লোকটাকে ওর বন্ধু বলে মনে হল।

পরদিন সুপার হাই-ফাই ক্যান্টিনেই ঘটনাটা ঘটল।

বিকেল পাঁচটা নাগাদ ট্রেনিং শেষ হওয়ার পরে প্যাসকো আর জিশান ক্যান্টিনে বসে রিল্যাক্স করছিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ওরা কনসেনট্রেটেড এনার্জি ড্রিঙ্কে চুমুক দিচ্ছিল। তখনই জিশান গতকালের ট্রেনির ঝাঁকটাকে লক্ষ করল।

আজ ওরা বসেছে জিশানদের টেবিলের একটা টেবিল পরেই—ফলে গতকালের তুলনায় অনেক কাছাকাছি। সুতরাং ওদের কথার্বাতার টুকরো জিশান আর প্যাসকোর কানে আসছিল। সেই টুকরোগুলোর মধ্যে ওদের নামও শোনা যাচ্ছিল। এ ছাড়া, গতকালের মতোই, ছেলেগুলো বারবার মুখ ফিরিয়ে জিশানদের দিকে দেখছিল। নিজেদের মধ্যে চাপা গলায় আলোচনা করছিল।

জিশান উশখুশ করছিল। প্যাসকোও জিশানের সঙ্গে মন দিয়ে গল্প করতে পারছিল না—ওর তাল কেটে যাচ্ছিল।

জিশান ভাবছিল যে, উঠে গিয়ে ওদের জিগ্যেস করবে, ব্যাপারটা কী? ঠিক তখনই ওদের দল থেকে লম্বা মতন একটা ছেলে উঠে এল, জিশানদের টেবিলের কাছাকাছি এসে দাঁড়াল।

জিশান বসেই রইল। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ছেলেটা কোন গেমের পাটিসিপ্যান্ট কে জানে! তবে পেটানো চেহারা। রং ময়লা। মুখের পেশি শক্ত। ঠোঁটের ওপরে সরু গোঁফ। গোঁফের দুপাশে ক্যালিপার্স-রেখা। আবছা ভেলভেট দাড়ি। চোখ দুটো টানা-টানা হলেও তাতে অভিসন্ধির ছাপ আছে।

‘তুমি তো জিশান—’ ছেলেটা প্যান্টের পকেটের কাছটায় হাত ঘষতে-ঘষতে বলল।

জিশান কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘হ্যাঁ, কেন?’

ছেলেটা হাসল : ‘আমরা তোমাকে আর ওকে নিয়ে কাল থেকে ডিসকাস করছিলাম…।’ প্যাসকোর দিকে আঙুলের ইশারা করল ছেলেটা।

জিশান কোনও কথা বলল না। চুপ করে অপেক্ষা করতে লাগল। প্যাসকো কুতকুতে চোখে ঠান্ডা দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটার দিকে শুধু তাকিয়ে রইল।

জিশানদের টেবিল ঘিরে দুটো খালি চেয়ার ছিল। কিন্তু জিশানরা ছেলেটাকে বসতে বলেনি।

তা সত্বেও ছেলেটা হঠাৎ ‘বসছি—’ বলে একটা খালি চেয়ারে বসে পড়ল।

প্যাসকোর ধৈর্য বোধহয় জিশানের চেয়ে কম। ও মাথা ঝাঁকিয়ে ছেলেটাকে জিগ্যেস করল, ‘তোমার কী দরকার তাড়াতাড়ি বলো। আমরা নিজেদের মধ্যে প্রাইভেট কথা বলছি…।’

ছেলেটা আবারও হাসল। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বন্ধুদের দিকে। ওরা বেশ আগ্রহ নিয়ে জিশানদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে।

ছেলেটা জিশানের দিকে চোখ ফেরাল। হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, যা বলছিলাম। কাল থেকে আমরা তোমাদের নিয়ে ডিসকাস করছি…’ সরু গোঁফের ওপরে আঙুল বোলাল : ‘আমাদের পয়েন্টটা হচ্ছে, তোমাদের দুজনের মধ্যে ফাইট হলে কে জিতবে…।’

জিশান অবাক হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড ও কোনও কথা বলতে পারল না। প্যাসকোর অবস্থাও তাই।

আরও দুজন ট্রেনি ততক্ষণে নিজেদের জায়গা ছেড়ে উঠে পড়েছে। জিশানদের টেবিলের কাছে এগিয়ে আসছে।

প্যাসকো ছেলেটির দিকে জরিপ নজরে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে চেষ্টা করছিল, ছেলেটি কোনও নোংরা রসিকতা করতে চাইছে কি না।

জিশান ঠান্ডা গলায় ছেলেটাকে জিগ্যেস করল, ‘তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ বলো তো?’

ছেলেটার মুখে তখনও হাসিটা লেগে রয়েছে। ও বলল, ‘আমরা তোমাদের একটা ফ্রি স্টাইল ফাইট দেখতে চাইছি। আমরা পাঁচজন সে নিয়ে বাজিও ধরতে রাজি। সুপারগেমস কার্পোরেশনের নানান গেমে আমরা বেশ কয়েকটা রাউন্ডে কোয়ালিফাই করেছি। তাতে অনেক টাকাও পেয়েছি। তাই…।’

প্যাসকো সামনে ঝুঁকে পড়ে ওর ডানহাতটা ছেলেটার দিকে বাড়াতে যাচ্ছিল, জিশান সাপের ছোবলের ক্ষিপ্রতায় প্যাসকোর হাত চেপে ধরল। হাতের ওপরে আলতো করে চার আঙুলের চাপড় মেরে ওকে শান্ত হতে ইশারা করল।

বাকি দুজন ট্রেনি এখন ওদের বন্ধুর দুপাশে দাঁড়িয়ে। মুখে কৌতূহল, উত্তেজনা।

প্রথম ছেলেটা দু-বন্ধুর দিকে একে-একে তাকিয়ে ইশারায় বোঝাতে চাইল যে, ব্যাপারটা সে জিশানকে বলেছে।

জিশান বলল, ‘যদি ঠিক বুঝে থাকি তা হলে তোমরা চাইছ, আমি আর প্যাসকো ফ্রি স্টাইল ফাইটে মোকাবিলা করি—।’

উত্তরে তিনজনেই বলল, ‘ইয়েস! ইয়েস!’

প্রথম ছেলেটা বলল, ‘আমরা পাঁচজনে মিলে তোমাদের ভালো টাকার প্রাইজ মানি দেব, জিশান—।’

প্যাসকো চট করে উঠে দাঁড়াল।

জিশানও উঠে দাঁড়াল : ‘প্যাসকো, প্লিজ…।’ প্যাসকোকে শান্ত হতে ইশারা করল।

জিশান ছেলেটাকে বলল, ‘তোমরা একটা ছোট্ট ভুল করছ। আমরা বন্ধু। আর জানোই তো, ফ্রেন্ডস ডোন্ট ফাইট।’

এ-কথায় ছেলেটার মুখে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তবে ও উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, ‘জিশান, তুমি কিল গেমে কোয়ালিফাই করেছ বটে, বাট য়ু ডোন্ট লুক সো টাফ। তোমার এই যে বন্ধু—প্যাসকো না কী নাম বললে—ও তোমার চেয়ে অনেক বেশি টাফ…।’

ওদের দলের বাকি দুজনও কখন যেন জিশানদের টেবিলের কাছে ভিড় করে এসে দাঁড়িয়েছে।

ওদের আর-একজন বলল, ‘জিশান, লড়ে যাও! প্যাসকোকে দেখিয়ে দাও তোমাদের মধ্যে কে বেশি টাফ। কিল গেমে তুমি যখন কোয়ালিফাই করেছ তখন নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে একটা কিলার রয়েছে—।’

বন্ধুর কথার খেই ধরে নিয়ে প্রথম ছেলেটা বলল, ‘কাম অন, কিলার, শো আস হু ইজ দ্য বস। কাম অন…।’

ছেলেটা কথাগুলো ইংরেজিতে বললেও তার মধ্যে যে লড়াইয়ের ওসকানি রয়েছে সেটা জিশান ভালোই বুঝতে পারছিল। তা সত্বেও ও ঠান্ডা গলায় বলল, ‘বললাম তো, বন্ধুরা কখনও ক্ষমতা দেখানোর জন্যে লড়াই করে না। অনেক কষ্ট করে একজন ভালো বন্ধু পাওয়া যায়…।’

ওদের মধ্যে একটা ছেলে বেশ মোটাসোটা, পালোয়ান গোছের। তার ঘাড়ে লাল-কালোয় মেশানো উলকি আঁকা। সেই ছেলেটা তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে কয়েন টস করার ভঙ্গি করে বলল, ‘আরে ভাই, ঠিক আছে—আমরা পাঁচজন মিলে ফিফটি থাউজ্যান্ড দেব। ছোট করে একটা ফাইট হয়ে যাক…।’

‘রেস্টুরেন্টের বাইরে ওই খোলা জায়গাটায় ফাইটটা হতে পারে—’ ওদের মধ্যে উৎসাহী একজন রেস্তোরাঁর বাইরের মাঠটা আঙুল তুলে দেখাল।

প্রথম ছেলেটা জিশান আর প্যাসকোকে হাতের ইশারা করে ডাকল : ‘চলো, জিশান—ফাইট গেম শুরু করে দেওয়া যাক।’

যেটা জিশানকে অবাক করছিল সেটা হল, ছেলেগুলো শুধু নিজেদের কথা বলেই যাচ্ছিল—জিশানের কথাকে একফোঁটাও পাত্তা দিচ্ছিল না। ওরা হয়তো ওল্ড সিটি থেকে এসেছে—পুরস্কার জেতার লোভে। কিন্তু এর মধ্যেই নিউ সিটির রীতিনীতির সঙ্গে দিব্যি খাপ খাইয়ে নিয়েছে। সেইজন্যই বন্ধুত্বকে টাকা দিয়ে টেক্কা দিতে চাইছে।

‘কাম অন, প্যাসকো! কাম অন, জিশান! লেটস গো—।’ প্রথম ছেলেটা অধৈর্যভাবে প্যাসকো আর জিশানকে তাড়া লাগাল।

প্যাসকো অনেকক্ষণ ধরেই ভেতরে-ভেতরে ফুঁসছিল। ওর ভেতরে একটা ভূমিকম্প তৈরি হয়ে সেটা রিখটার স্কেলে ক্রমশ বাড়ছিল।

এবার বিস্ফোরণ ঘটে গেল।

চোখের পলকে ছেলেটার মাথার চুল বাঁ-হাতে খাবলে ধরল প্যাসকো। এবং ডানহাতে সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল গালে।

পাইপগানের গুলি চালানোর মতো তীক্ষ্ম শব্দ হল। আর শব্দের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে ছেলেটার গালের ক্ষতি হল।

ওর ডান গালটা আড়াই ইঞ্চি লম্বা হয়ে ফেটে গেছে। লালচে গালের ওপরে রক্ত ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে-ধীরে।

ওর চারজন সঙ্গী নানারকম চিৎকার করে উঠল। ওদের মধ্যে একজন প্যাসকোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেল, কিন্তু জিশান কী এক কায়দায় যেন লাথি চালাল। ছেলেটা রেস্তরাঁর মেঝেতে ছিটকে পড়ল।

বাকি তিনজন বুদ্ধিমান। ওরা প্যাসকো আর জিশানের কাছ থেকে পায়ে-পায়ে পিছিয়ে গেল।

প্যাসকো কিন্তু প্রথম ছেলেটার চুলের মুঠি ছাড়েনি—এখনও খামচে ধরে রেখেছে। ছেলেটার মুখ যন্ত্রণায় বেঁকে গেছে। হাউমাউ করে চিৎকার করছে। অসহায়ভাবে শূন্যে দু-হাত নাড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে, বাতাসে সাঁতার কাটছে।

রেস্তরাঁয় আর যারা ছিল, তারা গোলমাল দেখে চারপাশে এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। রেস্তরাঁর ম্যানেজার এবং কর্মীরা একপাশে এসে জড়ো হয়ে গেছে।

জোকারের মতো তিড়িংবিড়িং করা ছেলেটার গালে কয়েকটা আলতো চাপড় মারল প্যাসকো। মুখে ‘চুক-চুক’ শব্দ করে বলল, ‘যা:, পালা। আমাদের দোস্তি বিক্রি নেই। আবার এরকম দুষ্টুমি করলে একেবারে ফারফোর করে দেব…।’

কথা শেষ করে হতভাগা ছেলেটাকে পিছনে ঠেলে দিল প্যাসকো। ছেলেটা উলটো ডিগবাজি খেয়ে ছ’-সাত হাত দূরে পৌঁছে গেল। ওর সঙ্গীসাথীরা ওকে তাড়াতাড়ি আগলে ধরল। সোজা করে দাঁড় করাল। কাটা গালে রুমাল চেপে ওকে মেরামত করতে চেষ্টা করল। তারপর ক্যান্টিনের বাইরে পা বাড়াল। যাওয়ার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে জিশান আর প্যাসকোকে বারবার দেখছিল ওরা।

এত হইচই হুজ্জুতির মধ্যেও রেস্তরাঁর ডেকরেশান বা ফার্নিচারের কোনও ক্ষতি হয়নি। প্যাসকো হাত-পা নেড়ে ম্যানেজারকে ঘটনাটা সবিস্তারে বলছিল।

জিশান রওনা হওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল। ম্যানেজারের সঙ্গে প্যাসকোর কথা শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল।

ক্যান্টিনের কাচের দেওয়ালের বাইরে সন্ধ্যা নেমে আসছে। খুব হালকাভাবে মোটরবাইকের ইঞ্জিনের আওয়াজ ভেসে আসছে। দূরে আধোআঁধারির মধ্যে হেডলাইটের ছুটে যাওয়া আলো দেখা যাচ্ছে।

ম্যানেজার চলে যেতেই প্যাসকো জিশানকে বসতে ইশারা করল : ‘আর একটু বসে মেজাজ ঠান্ডা করে তারপর যাব। তোমার সঙ্গে কথা আছে—।’

জিশান বসল। প্যাসকো ওর মুখোমুখি বসে পড়ল আবার। দু-হাতের চেটো চামড়ার জ্যাকেটে কয়েকবার ঘষে নিয়ে বলল, ‘নিউ সিটিটা একদম গেছে! খুব কম সময়ে একটা মানুষকে নষ্ট করে দেয়। পলিউশান।’

বেয়ারাকে ইন্ডিকেটর ল্যাম্প জ্বেলে কাছে ডাকল জিশান। দুটো এনার্জি ড্রিঙ্কের অর্ডার দিল।

প্যাসকো ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, ‘জিশান, আমি চাই তুমি কিল গেমে জিতে যাও। তা হলে যদি সুপারগেমস কর্পোরেশনকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যায়।’ সামনে ঝুঁকে এল প্যাসকো। নীচু গলায় বলল, ‘কিল গেমের সব পার্টিসিপ্যান্টকেই আমি খুব খেটে মন দিয়ে মোটরবাইক চালাতে শেখাই। এই আশায় যে, ওরা কিল গেমে জিতে যাবে…’ আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল : ‘কিন্তু সেটা হল কই? আমি আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু টিভিতে তোমার অ্যাকশান দেখে একেবারে হাঁ হয়ে গেলাম। মনে হল তুমিই পারবে। তুমিই শালা পারবে—।’

বেয়ারা এনার্জি ড্রিঙ্ক সামনে রেখে গেল।

জিশান প্যাসকোর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘থ্যাংক য়ু—।’

প্যাসকো মাথা ঝুঁকিয়ে ধন্যবাদটা নিল। তারপর বলল, ‘তোমাকে তো আগেই বলেছি, গেম সিটিতে মোটরবাইক হচ্ছে একটা বড় ওয়েপন। খুব পাওয়াফুল ওয়েপন। তোমাকে আমি জান দিয়ে শেখাব, জিশান।’

জিশান এনার্জি ড্রিঙ্কে চুমুক দিল। প্যাসকোও।

জিশান হেসে বলল, ‘সে তো শেখাবে। তার আগে বলো দেখি, তুমি এরকম সুপার বাইক চালাতে শিখলে কোত্থেকে?’

প্যাসকো ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল। বলল, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি মোটরবাইকের পোকা। কেন জানি না, শালা বাইক ব্যাপারটাই আমাকে টানত। কিন্তু বাইক কেনার পয়সা ছিল না—কোত্থেকে থাকবে! বাপটা চাকরি করত বাড়ির কাছেই—নালাগড় কটন মিলে। আর আমরা চার-চারটে ভাই-বোন। ভাত-রুটি আর আলুসেদ্ধ—এই ছিল বলতে গেলে ডেইলি মেনু।

‘আমার মোটরবাইক কেনার পয়সা না থাকলে কী হবে, সুযোগ পেলেই পাড়ার দাদাদের বাইকের পেছনে চড়ে বসতাম। ওদের বাইকগুলো ধোয়া-মোছা করতাম। ওরা আমাকে হাত খরচের পয়সা দিত। তাই দিয়ে সিগারেট-বিড়ি ফুঁকতাম, নেশা করতাম।’ একটা বড় শ্বাস ছাড়ল প্যাসকো। ওর চোখে শূন্য দৃষ্টি। ও এখন ফিরে গেছে জীবনখাতার অতীতের পাতায়।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্যাসকো বলল, ‘জানো, জিশান—আমি গরিব ছিলাম—তবে বেশ ছিলাম। বিনাপয়সায় মোটরবাইক চড়তাম, গলা ছেড়ে গান গাইতাম, আর সকালবেলায় কটনমিলের মাঠে বন্ধুরা মিলে লোহালক্কড় নিয়ে ব্যায়াম করতাম।

‘বাইকের দেখভাল করতে-করতে আমি বাইক চালানো শিখে গিয়েছিলাম। নিজের খেয়ালেই বাইক নিয়ে নানান কসরত ট্রাই করতাম। তখন আমার কত আর বয়েস? বড়জোর ষোলো-টোলো হবে। পাড়ার দাদারা আমার বাইক চালানোর তারিফ করত, আর আমি ভেতরে-ভেতরে ফুলে যেতাম।

‘ওরা আমাকে একটা বাইক ধরিয়ে দিয়ে নানান ফরমাশ করত : এখান থেকে ওখানে কোনও চিঠি বা প্যাকেট পাঠানো, কাউকে বাস স্ট্যান্ডে কিংবা স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া, মালের বোতল কিনে আনা—আরও কত কী! আমি বাইক চালানোর সুযোগ পেয়ে মনের আনন্দে কাজগুলো করতাম।

‘তবে একটা ব্যাপার, জিশান—যতই অভাব থাক, আমি কখনও চুরি করিনি—না বাইকের পার্টস, না বাইকের তেল। শুধু এক বার বাইক চালানোর সুযোগের জন্যে মনটা ছটফট করত।’

‘কিন্তু তুমি নিজের মোটরবাইক কিনলে কেমন করে?’ জিশান জিগ্যেস করল।

হাসল প্যাসকো : ‘সেটা একটা থ্রিলিং ব্যাপার। শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে…।’

‘কীরকম?’ কৌতূহলে প্রশ্ন করল জিশান।

‘আমাদের এলাকায় অনেক দাদা ছিল। তাদের বেশ কয়েকজনের বাইক ছিল।’ টেবিলের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট করে হাসল প্যাসকো। পুরোনো কথা মনে করে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল : ‘আর…কী বলব তোমায়…বাইকওয়ালা দাদা হলেই আমি যেন তার কেনা গোলাম হয়ে যেতাম। ওই বাইক চালানোর মওকার লোভে আর কী!

‘তবে দাদাগুলো সবই দু-নম্বরি লাইনের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। বন্ধ কারখানার স্ক্র্যাপ যখন নিলামে উঠত তখন দাদারা সেখানে ডাক চড়াত। সেখান থেকে ভালো নোট আমদানি হত। আমদানির রাতগুলোতে ফুর্তি-ফার্তা হত। ওরা সব বোতলবাজি করত, সঙ্গে কষা মাংস, পরোটা। মদে আমার কোনও টান ছিল না। মদের গন্ধে আমার উলটি আসত। এর আসল কারণ কী জানো?’ প্রশ্নটা করে মুখে বিরক্তির ‘হুঁ:’ শব্দ করল প্যাসকো। তারপর বলল, ‘ছোটবেলা থেকে দেখছি আমার বাপটা মাল-টাল টেনে প্রায়ই আমার মা-কে পেটাত। আমার বেচারি মা!…ওই কাণ্ড দেখে ছোটবেলা থেকেই মদের ওপরে আমার ঘেন্না ধরে গিয়েছিল। তো দাদারা ওসব খেত, নিজেদের মধ্যে হইচই করত…আর আমি এককোণে বসে কষে কষা মাংস আর পরোটা খেতাম। বাড়িতে তো এসব খাবার কখনও জুটবে না!

‘শুধু স্ক্র্যাপের ডাক নয়, আমাদের পাড়ার বেশিরভাগ দাদাই আর-পাঁচটা কর্ডলাইনে লেনদেন করত। যেমন, ছুরি-বাটলি চালাচালি, ফোর শটার, সাদা গুঁড়ো, চরস, গাঁজা—আরও কতরকম জিনিসের কারবার! এ নিয়ে অন্য এলাকার দাদাদের সঙ্গে দুশমনি ছিল। দু-চারজন মার্ডারও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বুরা লাইনে এসব ঝগড়া কাজিয়া তো থাকবেই!

‘বুরা লাইনে লেনদেনের কাঁচা পয়সা আমাকে টানেনি। কেন জানো? আমার বাবাটা মাল খেত, মা-কে পেটাত, কিন্তু বহুত সৎ ছিল, খাঁটি মাল ছিল। হেভি বড়-বড় স্বপ্ন দেখত। কিন্তু একটা স্বপ্নও সত্যি হয়নি। লাইফে ফেল মেরে গিয়েছিল। তাই হয়তো নিজের ওপরে খেপে থাকত। সেই খ্যাপা রাগটা আমার বেচারি মায়ের ওপরে ঝাড়ত।

‘যাই হোক, আমার অনেক দাদার মধ্যে একজন ছিল রিয়েল দাদা। তার নাম ছিল লালানি। আমরা সবাই লানিদা বলতাম। বড়রা বলত, লানি। লানিদা খুব ডেয়ারডেভিল ছিল। দারুণ মোটরবাইক চালাত। ওকে আমি বাইক চালানোয় আমার গুরু বলে মানতাম।

‘লানিদা যেটায় বেশি ইনভলভ ছিল সেটা হল আর্মসের বিজনেস। অনেক সময় সেই বিজনেসের কাজে কারও সঙ্গে ভেট করতে গেলে মোটরবাইকের পেছনে আমাকে বসিয়ে নিত।

‘লানিদার অনেক দুশমন ছিল। তাই সবসময় কোমরের পেছনদিকে মেশিন গুঁজে রাখত। ঢোলা জামা পরত—বাইরে ঝুলিয়ে।

‘লানিদা আমায় খুব ভালোবাসত। কখনও চাইত না, আমি ওদের মতো খারাপ লাইনে নামি। তাই সবসময় বলত, ”তুই কখনও আমাদের এসব বাজে লাইনে আসবি না। তুই ঠিকঠাক একটা বিজনেস করবি, নয়তো কোনও দোকান বসাবি। আমি তোকে কিছু টাকা দেব—।”

‘আমি লানিদাকে বলতাম, আমি মোটরবাইক সারানোর গ্যারেজ করব। এ-কথায় লানিদা হেসে বলত, ”একদম ঠিক বলেছিস। বাইক সারানোর গ্যারেজ। নাম হবে ‘প্যাসকো বাইক ওয়ার্কশপ’। কী বলিস?”

‘আমি হাসতাম। বলতাম, ”তোমার বাইক আমার গ্যারেজে সারাতে দেবে তো লানিদা?”

”দেব না মানে!” তারপরই লানিদার একগাল হাসি।

‘একদিন সন্ধের পর লানিদার সঙ্গে বাইকে বসে বেরোলাম। লানিদা খুব সিগারেট খেত। কিন্তু কখনও সিগারেটের প্যাকেট কিনত না। দুটো করে সিগারেট কিনত। তার মধ্যে একটা ধরাত, আর অন্যটা জামার বুকপকেটে রেখে দিত।

‘লানিদার এই হ্যাবিটের কথা সবাই জানত। এটা নিয়ে সিনিয়ার কি জুনিয়ার ইয়ারদোস্তরা লানিদাকে মাঝে-মাঝে চাটত। তো বাইক নিয়ে বেরোলে লানিদার সিগারেট এনে দিতাম আমি। মাঝরাস্তায় কোথাও সিগারেটের তেষ্টা পেলে লানিদা প্রথমে জামার পকেটের ওপরে হাত চাপা দিত। তারপর সিগারেট নেই বুঝলে বাইক থামাত। আমার হাতে পয়সা দিয়ে বলত, ”প্যাসকো, দুটো উইলস ফিলটার।”

‘লানিদা কোন সিগারেট খায় আমি ভালো করেই জানতাম। কিন্তু দাদার ওই অভ্যেস—সবসময় ব্র্যান্ডের নামটা বলত।

‘সেদিন পাড়া থেকে অনেক দূরের একটা বাস-স্ট্যান্ডের কাছে লানিদা একজন লোকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। লানিদা যখন ফোনে লোকটার সঙ্গে কথা বলছিল তখন কিছু টুকরো কথাবার্তা আমার কানে আসছিল। তাতে বুঝতে পারছিলাম যে, তিরিশটা ফোর শটার কেনাবেচার ব্যাপারে কথা হচ্ছে।

‘বাস-স্ট্যান্ডটা আমি তখন চিনতাম না। পরে জেনেছি ওটা ছিল নাগরা বাস-ট্যান্ড। ওখান থেকে সব দূরপাল্লার বাস ছাড়ে।

‘তো বিজনেসের কথাবার্তা বলতে লানিদা বাস-স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে একটা গলিতে একটা পুরোনো বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। আমাকে বাইরে বাইকের কাছে রেখে গেল।

‘ঘণ্টাখানেক পর দাদা ফিরে এল। দেখলাম খুব বিরক্ত আর রাগ-রাগ ভাব। বাইকে বসে লানিদা আপনমনেই গজগজ করছিল। তার কিছু-কিছু কথা আমি শুনতে পাচ্ছিলাম।

”আমার সঙ্গে ছকবাজি করলে আমিও ছাড়ব না। আমার ফোর শটারের বিজনেসে যে পা বাড়াবে তার টেংরি আমি কেটে নেব।…আমাকে বুরবাক পেয়েছে!”

‘আমি পেছনের সিট থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম, ”কী হয়েছে, লানিদা? এত খেপে গেছ কেন?”

”’ও কিছু না। ছাড়…।” বলে বাইকে স্টার্ট দিল।

‘বাইক ছুটছিল। আমি চুপচাপ বসেছিলাম। হাওয়ায় চুল উড়ছে। চারপাশে রাত। বাতাসে কারখানার ধোঁয়ার গন্ধ। ছুটে যাওয়া গাড়ির হর্ন। ঝরঝরে রাস্তায় চাকার শব্দ।

‘একটা কালো রঙের বাইক আর একটা সাদা প্রাইভেট মাঝে-মাঝেই আমাদের ওভারটেক করে এগিয়ে যাচ্ছিল, আবার পিছিয়ে পড়ছিল। বাইকে বসা লোক দুটোর মাথায় হেলমেট।

‘বারতিনেক এমনি হওয়ার পর আমার একটু খটকা লেগেছিল। কিন্তু লানিদার মেজাজের অবস্থা দেখে কিছু বলিনি।

‘হঠাৎই লানিদা বুক পকেটের ওপরে হাত বোলাল। তারপরই বাইকের স্পিড কমিয়ে রাস্তায় ধারের একটা সিগারেট আর কোল্ড ড্রিংকের দোকানের কাছে বাইক সাইড করল। প্যান্টের পকেট থেকে টাকা বের করে আমাকে দিয়ে বলল, ”দুটো উইলস ফিল্টার নে—।”

‘আমি বাইক থেকে নেমে সিগারেট কিনতে গেলাম। আর ঠিক তখনই কয়েকটা পটকা ফাটার শব্দ কানে এল।

‘আমি চমকে উঠে শব্দ লক্ষ্য করে ফিরে তাকালাম। দেখি লানিদা রাস্তায় ছিটকে পড়েছে। বাইকটা কাত হয়ে পড়ে গেছে রাস্তায়। ওটার ইঞ্জিন গরগর করছে। আর কালো বাইক আর সাদা গাড়িটা ছুটে চলে যাচ্ছে দূরে।

‘আমি ”লানিদা” বলে চিৎকার করে উঠলাম। গোল্লায় যাক উইলস ফিল্টার। ছুটে চলে এলাম লানিদার কাছে।

‘লানিদার গায়ে অন্তত তিনটে গুলি লেগেছে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই লানিদা উঠে বসেছে। ডানহাত পেছনদিকে বাড়িয়ে কোমরে গোঁজা রিভলভারটা বের করার চেষ্টা করছে।

‘আমি আর দেরি করলাম না। প্রথমে লানিদাকে টেনে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলাম। ”লানিদা! লানিদা!” বলে বারবার ডাকতে লাগলাম। কেন জানি না, আমি লানিদার জন্যে কাঁদতে শুরু করেছিলাম।

‘দু-বগলের তলায় হাত ঢুকিয়ে কয়েকবার টানাহ্যাঁচড়া করতেই লানিদা অতিকষ্টে ”উ:! আ:!” করতে-করতে কোনওরকমে সোজা হয়ে দাঁড়াল। দেখলাম, ওর কোমরে আর পাঁজরে রক্ত।

‘তাড়াতাড়ি মোটরবাইকটার কাছে গেলাম। ওটাকে খাড়া করে চেপে বসলাম। লানিদাকে বললাম, পেছনের সিটে চড়ে বসতে। বললাম, শক্ত করে আমাকে জাপটে ধরতে।

‘ব্যস, বাইক স্টার্ট দিলাম। তখনই দেখলাম, কালো মোটরবাইক আর সাদা গাড়িটা ইউ-টার্ন নিয়ে আমাদের দিকে আবার ফিরে আসছে। তিনটে হেডলাইট চোখ ধাঁধিয়ে জ্বলছে।

‘আমার মাথার ভেতরে কে যেন বলে উঠল, ”লানিদাকে বাঁচাতেই হবে।” আর একইসঙ্গে মোটরবাইক দেবতা আমার মাথার ওপরে সওয়ার হয়ে বসল। আমি বাইক ছুটিয়ে দিলাম। আমার দিকে তেড়ে আসা গাড়ি আর বাইকের দিকে। কারণ, ওটাই আমাদের এলাকায় ফেরার পথ। তা ছাড়া তখন ইউ-টার্ন নিতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। ওই অবস্থায় এক সেকেন্ড বাড়তি সময়ও আমার কাছে মারাত্মক জরুরি।

‘যে-আঁকাবাঁকা রেখায় আমার বাইক ছুটাছিল তাতে সাপের চলার ঢঙও লজ্জা পেয়ে যাবে।

‘রাস্তার পাশের পাথর, গর্ত, ঢিবি এসবের ওপর দিয়ে আমি বাইক চালাচ্ছিলাম। কারণ, মনে হচ্ছিল, এতে আমার বাইক এলোমেলোভাবে লাফাবে, ডানদিকে বাঁ-দিকে ছিটকে যাবে। তাতে ওদের ফায়ারিং-এর নিশানা ফসকে যাবে।

‘ঠিক তাই হল। আমাদের লক্ষ্য করে ওরা গুলি চালাতে লাগল। বাইকে বসা লোকদুটো ফায়ার করতে লাগল। আর গাড়ির ভেতরে বসা দুজন জানলা দিয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে মেশিনের ঘোড়া টিপতে লাগল।

‘গুলির ঘন-ঘন আওয়াজে চারপাশটা কেঁপে উঠল বারবার। আমি সবকিছু ভুলে বডিটাকে বাইকের হাতলের গায়ে প্রায় সেঁটে দিয়ে পাগলের মতো বাইক ছোটাতে লাগলাম। হঠাৎই মনে হল আমার ডান পায়ে একটা গরম ছ্যাঁকা লাগল। জায়গাটা জ্বলতে লাগল। কিন্তু তখন আর পরীক্ষা করে দেখার মতো পরিস্থিতি নেই। শুধু জানি, আমাকে বাইক ছুটিয়ে উধাও হয়ে যেতে হবে।

‘আধঘণ্টা কি চল্লিশ মিনিট পর আমাদের এলাকায় বাইক ঢোকাতে পেরেছিলাম। অন্য দাদারা আমাদের দেখতে পেয়েই ছুটে এসে ঘিরে ধরল। তখনই জানা গেল, লানিদা অজ্ঞান হয়ে গেছে।’

জিশান মন্ত্রমুগ্ধের মতো প্যাসকোর কাহিনি শুনছিল। আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সেদিনের সেই সতেরো বছরের কিশোরকে খুঁজছিল।

প্যাসকো যে শক্তিশালী সেটা ওকে দেখে বোঝা যায়। কিন্তু ওর মধ্যে যে সততা আর অন্য গুণগুলো রয়েছে সেগুলোও জিশান এখন দেখতে পাচ্ছিল।

ও যেন নেশার ঘোরে জিগ্যেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপরই তো আসল ব্যাপার—’ হাসল প্যাসকো। জ্যাকেটে হাত ঘষল কয়েকবার। একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, ‘প্রায় একমাস ধরে হাসপাতাল নার্সিংহোম করে লানিদা সেরে উঠল। ওর বডিতে তিনটে গুলি লেগেছিল। আর আমার পায়ে একটা। আমার সেরকম কোনও চোট লাগেনি—শুধু চামড়া আর মাংস ছিঁড়ে গিয়েছিল। সাত-দশ দিনের মধ্যেই আমার পা ঠিক হয়ে গেল। শুধু একটা দাগ থেকে গেল।

‘হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম। লানিদা সেরে ওঠার পর ওর বাইকটা আমাকে গিফট করে দিল। আমি আমার জীবনে প্রথমে মোটরবাইকের মালিক হলাম। সব দাদাদের সামনে লানিদা বলেছিল, ”প্যাসকো সেদিন আমার জন্যে যা করেছে সে শালা শোধ হওয়ার নয়। ওকে দেখলেই সবসময় আমার মনে পড়বে, আমি ওর জন্যে বেঁচে আছি।”

‘জিশান, এই হল আমার মোটরবাইক কেনার কাহিনি। লানিদা আমার একটা স্বপ্নকে সত্যি করে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, লানিদা আমাকে চল্লিশ হাজার টাকাও দিয়েছিল—মোটরবাইকের গ্যারেজ খোলার জন্যে। আমি পাড়ার মধ্যেই একটা জায়গা খুঁজে বের করে ভাড়া নিয়েছিলাম। তারপর সেখানে সত্যি-সত্যি একটা মোটরবাইক সারাইয়ের গ্যারেজ খুলেছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ”প্যাসকো বাইক ওয়ার্কশপ”।

‘কিন্তু সবচেয়ে ভালো ব্যাপার কী হয়েছিল জানো? যেটা আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল?’

‘কী?’

‘ওই অ্যাকশানের পর লানিদা খারাপ লাইন ছেড়ে দিয়েছিল। থানকাপড়ের ব্যাবসা স্টার্ট করেছিল। ব্যাবসা ওপেনিং-এর দিন লানিদা সবাইকে কবজি ডুবিয়ে খাইয়েছিল।’

জিশান প্যাসকোর দিকে তাকিয়ে দেখছিল। মনে-মনে ভাবছিল, মোটরবাইক সারানোর গ্যারেজ খুলে একটা ইয়াং ছেলে দিব্যি করে খাচ্ছিল। দশ-বারো বছর পর সে হঠাৎ কিল গেমে নাম লেখাতে গেল কেন?

জিশানের স্যাটেলাইট ফোন ফ্ল্যাশ করে উঠল। গুনাজি ফোন করছে। দেরি হচ্ছে বলে ও চিন্তায় পড়ে গেছে।

জিশান ফোন ধরে ওকে বলল যে, আর দশ মিনিট—তার মধ্যেই ও ‘ভিজিটরস ওয়েটিং জোন’-এ গুনাজির কাছে পৌঁছে যাবে।

ক্যান্টিনের বাইরেটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। ক্যান্টিনের লোকজনও প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে।

প্যাসকো উঠে দাঁড়াল : ‘চলো, জিশান—লেটস গো…।’

জিশানও উঠে দাঁড়াল। ক্যান্টিন থেকে বেরোতে-বেরোতে বলল, ‘ ”প্যাসকো বাইক ওয়ার্কশপ” তো ঠিকঠাকই চলছিল। তা হলে তার মালিক দশ-বারো বছর পর হঠাৎ কিল গেমে নাম লেখাতে গেল কেন?’

বেশ জোরে হেসে উঠল প্যাসকো। কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বলল ‘জিশান, ওই ওয়ার্কশপের মালিকটা ছাব্বিশ বছর বয়েসে একটা মেয়েকে বিয়ে করে বসল—সংসারী হল—তোমার মতো…।’

‘তারপর?’

‘হুঁ:।’ আক্ষেপের একটা শব্দ করল প্যাসকো। অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাল। সেখানে তখন কয়েকটা তারা ফুটছে। ওই তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে ও কী খুঁজল কে জানে! তারপর আলতো গলায় ধীরে-ধীরে বলল, ‘তারপর…তারপর…বিয়ে করার বছরখানেক পর…ওই লোকটার জীবনে একটা সর্বনাশ ঘটে গেল। সব…কেমন যেন…পালটে গেল।’

জিশান কোনও কথা বলল না। চুপ করে রইল।

প্যাসকো পায়ে চলা পথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কাল তোমাকে সব বলব। আজ, এখন, বলতে গেলে ভীষণ কষ্ট হবে—বিশ্বাস করো…।’

কোনও কথা না বলে জিশান প্যাসকোর হাত ধরল। আলতো করে চাপ দিয়ে বোঝাল, ও বিশ্বাস করেছে।

আমার প্যাসকো ওয়ার্কশপ ভালোই চলছিল। আর কাজে-অকাজে বাইক চালানোর সুযোগও মিলছিল প্রচুর। কাজ নিয়ে আমি বেশ খুশি ছিলাম। পাশাপাশি ব্যায়াম-ট্যায়ামও চলছিল।

আমরা বন্ধুরা মিলে প্লেট টিভিতে নিউ সিটির মারকাটারি খেলাগুলোর লাইভ টেলিকাস্ট দেখতাম। অনেক সময় নিজেদের মধ্যে বাজিও ধরতাম।

এইভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর আমাকে ট্যাটুর নেশা পেয়ে বসল। সেই শখে হাতে-গায়ে নানান রঙের উল্কি আঁকলাম। দু-হাতে উল্কি আঁকা অবস্থায় যখন স্লিভলেস জ্যাকেট পরে বাইক চালাতাম তখন নিজেকে বেশ একজন কেউকেটা বলে মনে হত।

আমার বন্ধুদের আরও অনেকে হাতে-পায়ে-বুকে-পিঠে উল্কি আঁকিয়েছিল। তাদের কেউ-কেউ আবার মোটরবাইকও চালাত। আমরা বন্ধুরা যখন চার-পাঁচজন মিলে বাইক নিয়ে বেরোতাম তখন ওল্ড সিটির লোকরা আমাদের দেখে ভয় পেত। ভাবত আমরা ‘মোটরবাইক গ্যাং’।

কিন্তু কেন সেটা ভাবত আমি জানি না। কারণ, মোটরবাইক গ্যাংগুলোর দু-একটা বাইকে একটা করে প্ল্যাকার্ড থাকত। সেই প্ল্যাকার্ডে গ্যাং-এর নাম কিংবা লোগো আঁকা থাকত—কিংবা দুটোই। আমার মনে হয়, তুমিও এটা দেখেছ। তো আমাদের দলের কারও বাইকে সেরকম কোনও লোগো আঁকা প্ল্যাকার্ড ছিল না। কিন্তু তা সত্বেও অনেকে ভুল বুঝত।

তুমি তো জানো, জিশান, ওল্ড সিটির নানা জায়গায় এরকম মোটরবাইক গ্যাং ঘুরে বেড়ায়। তারা পারে না এমন কোনও খারাপ কাজ নেই। লুঠপাট, ডাকাতি, ছিনতাই, রেপ, মার্ডার—এদের কাছে এসব নেহাতই মামুলি ব্যাপার। ওরা সাংঘাতিক বেপরোয়া, কাউকে ভয় পায় না। খোলা রাস্তায় দিনদুপুরেও ওদের নৃশংস তাণ্ডব চলে।

এই ধরনের খতরনাক গ্যাং-কে সবাই এড়িয়ে চলে। তাই আমরাও এড়িয়ে চলতাম।

আমার বিয়ের প্রায় মাস ছয়েক পর একবার আমরা চারজন দোস্ত একটা মোটরবাইক গ্যাং-এর মুখোমুখি পড়ে যাই। রাস্তার একটা বাঁক ঘুরেই ওদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে যায়। সোজা রাস্তায় থাকলে আমাদের এই প্রবলেমটা হত না। দূর থেকে ওদের দেখামাত্রই আমরা চারজন বাইক ঘুরিয়ে সরে পড়তে পারতাম। কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা হল না। আমরা মুখোমুখি পড়ে গেলাম।

গ্যাংটাতে প্রায় আট-দশজন ছিল। তাদের নানারকম বাইক, নানারকম চেহারা। তার মধ্যে তিনটে বাইকের সামনে প্ল্যাকার্ড লাগানো ছিল। প্রায় দেড়ফুট লম্বা স্টিলের রডের মাথায় একটা ছ’ইঞ্চি বাই ছ’ইঞ্চি চৌকো মেটাল প্লেট। তার ওপরে লাল রঙের একটা মড়ার খুলি আঁকা। তার নীচে ইংরেজিতে লেখা ‘HELL’।

আমাদের চারজনকে দেখেই দলটা বাইক থামাল—কিন্তু ইঞ্জিন থামাল না। ওদের ইঞ্জিনগুলো গোঁ-গোঁ শব্দ করতে লাগল। যেন অনেকগুলো বাঘ গজরাচ্ছে।

আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বুকের ভেতরে একটা ঠান্ডা স্রোত টের পেলাম।

ওদের দলের যে-লোকটা সবার সামনে বাইক এগিয়ে দাঁড়িয়েছিল তার চেহারা চোখে পড়ার মতন।

লোকটা যে লম্বা সেটা বোঝা যায় ওর পা দেখে। বাইকের ওপরে বসেও ও অনায়াসে দুটো পা পৌঁছে দিয়েছে মাটিতে—যেন খাটো টুল কিংবা মোড়ায় বসে আছে।

লোকটার মাথায় কদমছাঁট চুল। ধবধবে ফরসা মুখে এককণাও গোঁফ-দাড়ি কিংবা ভুরু নেই। সারা মুখটা মসৃণ, তেলতেলে, সাদা—বেগুনের পোকার মতো। ঠোঁটের জায়গায় একটা চেরা দাগ। গায়ে লাল টি-শার্ট—তাতে এলোমেলো কালচে ছোপ। তারই মাঝে ইংরেজিতে ‘১৩’ লেখা। পায়ে শতচ্ছিন্ন ব্লু জিনস আর কালো স্নিকার। ডান পায়ের জুতোর ওপরে মলের মতো একটা স্টেইনলেস স্টিলের বালা।

লোকটির গলায় কালো সুতোয় গাঁথা নখ আর হাড়ের টুকরোর মালা। অন্তত দেখে তাই মনে হচ্ছিল। আদতে সেগুলো নকল, প্লাস্টিকের তৈরি হলেও হতে পারে। দুটো মালার মধ্যে একটা মালায় লকেট লাগানো—স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি একটা মড়ার মাথা।

লোকটার হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল ও-ই হচ্ছে ‘হেল’ গ্যাঙের লিডার।

লিডারের বাইক ঘা খাওয়া জন্তুর মতো গোঁ-গোঁ করছিল। আর থেকে-থেকেই ও বাইকের সামনের চাকাটা শূন্যে তুলে দিচ্ছিল—ছটফটে তেজি ঘোড়া যেমন মাঝে-মাঝে সামনের পা দুটো শূন্যে ছুড়ে দেয়।

‘হেল’ গ্যাঙের অন্য বাইকগুলোও গোঁ-গোঁ করছিল। ওদের সবক’টা বাইকের একঘেয়ে আওয়াজে আমার বিরক্ত লাগছিল। মনে-মনে চাইছিলাম, আমাদের মতো ওরাও নিজেদের বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে দিক। তারপর আমাদের কিছু বলার থাকলে বলুক। এবং বলার কাজ শেষ হয়ে গেলে সবাই যার-যার পথে চলে যাক।

ওদের একজন বোধহয় লিডারকে লক্ষ্য করেই বলল, ‘থার্টিন, এখন কী করব?’

বুঝলাম, লিডারটার নাম ‘থার্টিন’। সেইজন্যেই ওর ময়লা ছোপ লাগা টি-শার্টে ’13’ লেখা।

থার্টিন ছোট করে ডানদিক-বাঁ-দিক মাথা নাড়ল। আমি ভাবলাম বোধহয় মাথা নেড়ে ‘না’ বলছে কাউকে—কিংবা হয়তো আমাকেই। কিন্তু একটু পরে বুঝলাম, না, এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়াটা ওর মুদ্রাদোষ।

আমার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল থার্টিন। ওর ছোট-ছোট চোখ অনেকটা সাপের চোখের মতো লাগছিল।

তারপর থেমে-থেমে জিগ্যেস করল, ‘তোমরা কোন গ্যাং?’

আমি বাইকের ইঞ্জিনের আওয়াজ ছাপিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘আমরা কোনও গ্যাং নই। আমরা চারজন বন্ধু। আমরা এমনি বাইক নিয়ে বেরোই…।’

বিকট শব্দ করে রাস্তায় থুতু ফেলল থার্টিন। বাইকের ইঞ্জিন অফ করে বাইক থেকে নেমে পড়ল। ওটাকে স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল।

এবার ঠিকঠাক বোঝা গেল ও কতটা লম্বা এবং চওড়া।

নিজের বুকে হাত ঘষল থার্টিন। ওর ডান হাতের আঙুলে তিনটে মেটালের আংটি চোখে পড়ল।

কয়েকটা পা ফেলে ও আমার বাইকের কাছে এগিয়ে এল।

আমি বাইকে বসেই ছিলাম—বাইক ছেড়ে নামিনি।

ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থার্টিন বলল, ‘গ্যাং তৈরি করেছ, কোনও নেমপ্লেট লাগাওনি।’

আমি কোনও ঝগড়াঝাঁটি কিংবা মারপিট চাইছিলাম না। আর সেরকম কিছু হলে আমরা পেরেও উঠতাম না। কারণ, আমরা চারজন আর ওরা ন’জন। তা ছাড়া, এই মোটরবাইক গ্যাংগুলোর সঙ্গে নানারকম অস্ত্রশস্ত্র থাকে। তাই ওদের বাইকের কেরিয়ার কখনও খালি থাকে না। উলটোদিকে আমরা নেহাতই নিরস্ত্র নিরীহ পাবলিক। হিসেবমতো হেল গ্যাং-কে আমাদের ভয় পাওয়ার কথা।

কিন্তু আমি মোটেই ভয় পাইনি। আমার বাকি তিন বন্ধুও তাই। আমরা বাইক চালানোর আনন্দে, পথে ঘুরে বেড়ানোর খুশিতে, ঘুরে বেড়াই। এটাই আমাদের স্বাধীন পাগলামো।

যে-মেয়েটির সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল ওর নাম ছিল মেহেন্দি। আমি ওকে ‘মাহি’ বলে ডাকতাম। ওকে যখন বিয়ে করি তখন কথা দিয়েছিলাম, ওর সঙ্গে কখনও আড়ি করব না। আর ও যদি কখনও কোনও কারণে আমার সঙ্গে আড়ি করে, তা হলে আমি জোর করে ভাব করে নেব।

আমার বাইকের নেশার কথা মাহি ভালো করেই জানত। তাই বিয়ের পরেও আমার এই স্বাধীন পাগলামোয় কখনও ও বাধা দেয়নি। তবে সবসময় বলত, রাস্তাঘাটে ঝামেলা মারপিট এড়িয়ে চলতে। তা না হলে ও আমার সঙ্গে আড়ি করে দেবে।

হেল গ্যাঙের লিডারের সঙ্গে কথা বলার সময় মাহির কথা আমার মনে ছিল। তাই খুব শান্তভাবে জবাব দিলাম, ‘বললাম যে, আমরা কোনও গ্যাং নই। তাই আমাদের কোনও নাম নেই। কোনও নেমপ্লেট নেই…।’

আমার কথা শুনে থার্টিনের ঠোঁটের চেরা দাগটা একটু চওড়া হল। নাকের দুপাশে দুটো ভাঁজ পড়ল। তার মানে থার্টিন হাসছে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর ও বলল, ‘স-সালা ডরপোক!’

ওর গলার আওয়াজটা কেমন যেন চাপা ফ্যাঁসফেসে।

উত্তরে আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। একটা কথা যদি সত্যি হয় তা হলে যে সেটা অনেকবার বলতে হবে, এমনটা আমার জানা ছিল না। তাই চুপ করে প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। আমার তিন বন্ধুও চুপ করে রইল।

সময়টা বিকেল। রাস্তায় লোকজন চলাফেরা করছে। গাড়ি, সাইকেল, বাস, সাইকেল ভ্যান ব্যস্তভাবে ছুটে যাচ্ছে। যদিও রাস্তার করুণ অবস্থার জন্য ‘ছুটে’ যাওয়াটা অনেকটা ‘হেঁটে’ যাওয়ার মতো দেখাচ্ছে। কোনও গাড়ি জোরে ছোটার চেষ্টা করলে তাকে শূন্যে লাফিয়ে উঠে মাশুল গুনতে হচ্ছে।

রাস্তায় এতগুলো বাইক জড়ো হয়ে যাওয়ায় বেশ ভিড় জমে গেছে। কিন্তু ভিড়ের লোকজন মোটরবাইক গ্যাংদের ভালো করে চেনে। তাই ওরা একটা ভয়-পাওয়া দূরত্ব বজায় রেখেছে।

জায়গাটা যানজটের চেহারা নিয়েছিল। বেশ কয়েকটা গাড়ি আর বাস অধৈর্য হয়ে হর্ন বাজাচ্ছিল। কোনও-কোনও গাড়ি ফাঁকফোকর দিয়ে পথ তৈরি করে জটলাটা পেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।

আমাদের চারপাশে জমায়েত হওয়া লোকজনের বেশিরভাগই ভিখিরি কিংবা ঝুপড়িবাসী। অন্তত তাদের পোশাকআশাক দেখে তাই মনে হল। তুমি তো জানো, জিশান, শতচ্ছিন্ন শহরটায় এরকম বাসিন্দাই বেশি। হয়তো আমিও তার মধ্যেই পড়ি।

জটলার বৃত্তে একটা ইয়াং মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ফরসা, ছিপছিপে। পরনে হলদে আর বাদামি রঙের নকশা কাটা চুড়িদার। সঙ্গে একজন ছেলে-বন্ধু।

ছেলেটার চুল জেল মাখিয়ে এমনভাবে সেট করা যে, প্লাস্টিকের নকল চুল বলে মনে হচ্ছে। গায়ে একটা কালো টি-শার্ট আর ব্লু জিনস।

হেল গ্যাঙের সবচেয়ে পেছনে থাকা লোকটা হঠাৎই ওর বাইকটা নিয়ে মেয়েটাকে তাক করে তেড়ে গেল।

মেয়েটা চমকে লাফিয়ে সরে যেতে চাইল। সরে ও গেল বটে, কিন্তু তাড়াহুড়ো করে সরতে গিয়ে রাস্তায় পড়েও গেল।

মেয়েটার করুণ অবস্থা দেখে হেল গ্যাঙের চার-পাঁচজন হো-হো করে হেসে উঠল। হাসতেই লাগল। ইঞ্জিনের গরগর ছাপিয়ে ওদের হাসির হররা চলতে লাগল।

আমি ওদের কদাকার বিচিত্র চেহারাগুলো দেখছিলাম। কারও মাথা ন্যাড়া, কারও মাথায় খাবলা-খাবলা চুল। ভুরুতে, কানে, চোখের নীচে সোনার আংটা লাগানো। ঘাড়ে, গলায়, হাতে নানান উলকি আঁকা। তার মধ্যে একজনের গলায় আবার একটা খয়েরি রঙের সরু সাপ জড়ানো।

যে-লোকটা বাইক নিয়ে অসভ্যতা করেছিল সে বাইকের ওপরে প্রায় শুয়ে পড়ে ঝুঁকে ওর লোমশ হাত বাড়াল মেয়েটার দিকে। হাসতে-হাসতে বলল, ‘এসো, হাত ধরো, সোনামণি…।’

মেয়েটার ছেলে-বন্ধু কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেনি। মেয়েটাকে তোলার জন্যে ও উদ্যোগ নিয়েছিল। বাইক গ্যাঙের নোংরা লোকটাকে ওর বান্ধবীর দিকে হাত বাড়াতে দেখে ও খেপে গেল। একটা গালাগাল দিয়ে লোমশ হাতটাকে ও এক ঝটকায় ঠেলে সরিয়ে দিল।

সঙ্গে-সঙ্গে বাকি ঘটনাগুলো ঘটে গেল।

লোমশ হাতের মালিক এক ছোবলে ছেলেটার চুলের মুঠি চেপে ধরল। তারপর বাইক চালিয়ে দিল।

বাইকের গর্জন, ছেলেটার চিৎকার সবার কানে তালা ধরিয়ে দিল। মেয়েটাও কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করছিল। কিন্তু আমাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের মধ্যে কোনও হেলদোল ছিল না। ওরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু দেখছিল।

একটা বাইক-গুন্ডা বাইক নিয়ে মেয়েটার দিকে তেড়ে গেল। মেয়েটা ভয়ে চিৎকার করে তাড়াতাড়ি ভিড়ের মধ্যে ঢুকে গেল। বোধহয় পালিয়ে বাঁচতে চাইল।

এদিকে ছেলেটার বডি রাস্তায় ছেঁচড়ে-ছেঁচড়ে যাচ্ছিল। কখনও-কখনও গরম সাইলেন্সার পাইপ ওর গায়ে ঠেকে যাচ্ছিল। তাই ওর যন্ত্রণার চিৎকার কিছুতেই থামছিল না।

এতসব ঘটনা ঘটে গিয়েছিল খুব তাড়াতাড়ি। কিন্তু একটা জিনিস আমাকে অবাক করল। পেছন থেকে এত চিৎকার, চেঁচামেচি, হইচই শোনা গেলেও থার্টিন একবারও পেছন ফিরে তাকায়নি—ও ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকেই।

আমার গোটা শরীরটা জ্বালা করছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম। গায়ের চামড়া যতটা মোটা হলে এসব নোংরা ঘটনা চোখের সামনে দেখেও দিব্যি নির্বিকার থাকা যায়, আমার চামড়া ততটা মোটা নয়।

আচ্ছা, মেহেন্দি যদি এখানে হাজির থাকত তা হলে কী হত?

কী হত আমি জানি। কোনও বিপদ-আপদ কিংবা ভয়ের তোয়াক্কা না করে ও মেয়েটাকে বাঁচাতে দস্যুগুলোর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ত।

থার্টিনের সাদাটে মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মাথার ভেতরে একটা সুইচ হঠাৎই অন হয়ে গেল। আর সঙ্গে-সঙ্গে আমার শরীরটা শর্ট সার্কিট হয়ে গেল।

আমি বাইকে স্টার্ট দিয়ে ক্লাচ-গিয়ার দিকে যন্ত্রটাকে ছুটিয়ে দিলাম।

এত আচমকা ব্যাপারটা ঘটল যে, থার্টিন থতমত খেয়ে গেল। আমার এই বোকা-বোকা সাহস আর আস্পর্ধার জন্যে ও মোটেই তৈরি ছিল না।

আমার বাইক ছুটে গিয়ে যে ওর তলপেটে আঘাত করল শুধু তাই নয়, বাইকের গতি আর সংঘাত ওর লম্বা শরীরটাকে উঠিয়ে দিল আমার বাইকের হাতলের ওপরে।

সেই অবস্থাতেই আমি জোরে বাইক চালিয়ে দিলাম। থার্টিনের মুখ দিয়ে এককণা শব্দও বেরোল না। নিজেকে বাঁচাতে ও একহাতে বাইকের হাতল আঁকড়ে ধরল, আর-এক হাতে আমার শরীর আর পোশাক খামচে ধরতে চাইল।

জনতার মুখ থেকে তুমুল হইচই শোনা গেল। থার্টিনের দলের অন্য বাইক-গুন্ডাগুলো চুপচাপ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল—কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। যে-বাইক-গুন্ডাটা নিরীহ ছেলেটাকে চুলের মুঠি ধরে ঘোরাচ্ছিল, সে সর্দারের এই অবস্থা দেখে বাইক থামিয়ে ফেলেছে এবং ছেলেটাকেও ছেড়ে দিয়েছে।

কিন্তু আমি ছাড়িনি। থার্টিনকে বাইকে চাগিয়ে পাগলের মতো ছুটে চলেছি। ওদের সবার চোখের সামনে—রাস্তার এদিক থেকে সেদিকে।

প্রায় কয়েক মিনিট এরকম চলার পর আমি বন্ধুদের বাইকের কাছে এসে আচমকা ব্রেক কষলাম। থার্টিনের বডিটা সাত হাত দূরে ছিটকে পড়ল।

তখনই আমার প্রথম মনে হল, এ আমি কী করলাম। আবেগের মাথায় সাহস দেখাতে গিয়ে আমি বোধহয় নিজের মৃত্যু পরোয়ানায় সই করে বসে আছি।

একটু পরে বুঝলাম, মৃত্যু পরোয়ানা নয়, অর্ধ-মৃত্যু পরোয়ানা।

থার্টিন আর তার আট সঙ্গী মিলে আমাদের চারজনকে প্রচণ্ড মারধোর করল। ওদের সঙ্গে লোহার রড আর স্টিলের পাঞ্চ ছিল। সেই অস্ত্রগুলো ওরা আমাদের ওপরে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করল। নেহাতই দয়া করে ছুরি-টুরি কিংবা রিভলভার ব্যবহার করেনি।

আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, আমার এক বন্ধু জনার্দনও সেন্সলেন্স হয়ে গিয়েছিল।

আমাদের ফেলে রেখে হেল গ্যাঙের গুন্ডাগুলো চলে যাওয়ার পর পাবলিক আমাদের হেলপ করার জন্যে হাত বাড়ায়। চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করে ওরা আমাদের পাড়ায় পৌঁছে দেয়।

থার্টিনদের রোষে পড়ে আমাদের বাইকগুলোও অল্পবিস্তর ড্যামেজ হয়েছিল। সেগুলো সাইকেল ভ্যানে চাপিয়ে পাড়ায় নিয়ে আসতে হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *