০৩. একটা স্ট্যাটুইটারি ওয়ার্নিং

০৩.

তারপর মেয়েটি বলল, ‘মিস্টার পালচৌধুরী, আপনাকে এবার একটা স্ট্যাটুইটারি ওয়ার্নিং শোনাচ্ছি : কিল গেম-এর সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর মাত্র 0.07। অর্থাৎ, পার্টিসিপ্যান্টদের শতকরা তিরানব্বই জনই মারা যায়। আপনি ইচ্ছে করলে এখনও নাম উইথড্র করতে পারেন।’

জিশান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল শ্রীধরের দিকে। শ্রীধরের মুখে সাপের মতো ঠান্ডা অভিব্যক্তি।

জিশানের মনে পড়ল : ‘…তিনশো দুই, নয়তো কিল গেম।’

তা ছাড়া মিনি আর শানুর ওপরে পিস ফোর্সের নজরদারি রয়েছে। ওদের ক্ষতি করার ভয় দেখিয়ে জিশানকে দিয়ে শ্রীধররা অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারেন। জিশানের কিছু করার নেই। অন্তত এখন।

জিশান মেয়েটিকে বলল, ‘থ্যাংক য়ু ফর দ্য অ্যাডভাইস। আমি স্বেচ্ছায় নাম দিচ্ছি।’

‘ও. কে.। তা হলে আমি আপনাকে রেজিস্ট্রেশান কিট দিচ্ছি। তার মধ্যে আপনি কিল গেম-এর রুলস অ্যান্ড রেগুলেশানস পাবেন। ফ্যাক এবং তার উত্তর পাবেন। মানে, ফ্রিকোয়েন্টলি আস্কড কোয়েশ্চেনস এবং তার আনসার। আপনার আগামী একমাসের ট্রেনিং শিডিউল পাবেন। গেম পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাস—আমরা শর্টে বলি জিপিসি—সেখানে গেস্টহাউসে আপনার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। ওখানে কিল গেম ছাড়াও অন্যান্য খেলার অনেক পার্টিসিপ্যান্ট রয়েছে। রেজিস্ট্রেশান কিটে সব ডিটেইলস দেওয়া আছে।’

মেয়েটি একটা মোটা পলিথিনের প্যাকেট জিশানের দিকে বাড়িয়ে দিল। জিশান হাতে নিয়ে বুঝল প্যাকেটটা বেশ ভারী।

মেয়েটি এবারে একটা ফর্ম এগিয়ে দিল কাউন্টারের ওপরে। সঙ্গে একটা পেন।

জিশান ফর্মটা দেখল। ওর এইমাত্র দেওয়া তথ্যগুলো ফর্মে ছাপানো রয়েছে।

‘এটায় আপনি সাইন করে দিন—দু-জায়গায়—এই যে, টিক দেওয়া আছে।’

জিশান পেনটা তুলে নিয়ে খসখস করে সই করে দিল।

ফর্মটা ফেরত নিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আপনার রেজিস্ট্রেশান কমপ্লিট, মিস্টার পালচৌধুরী। ফর ইয়োর ইনফরমেশান, জিপিসি গেস্টহাউস থেকে অন-লাইন নেটওয়ার্কে আপনি আমাদের টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স হেলপলাইনে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনার যে-কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্যে আমাদের হেলপলাইন সবসময় অ্যাকটিভ থাকে।’

একটু থামল মেয়েটি। ওর কথাগুলো ঠিক মুখস্থ করা পরীক্ষার পড়ার মতো শোনাচ্ছিল। জিশানের ভয় হচ্ছিল, হঠাৎ করে মাঝপথে ওর মুখস্থ করা লাইনগুলো না গুলিয়ে যায়।

এইবার শ্রীধর পাট্টার দিকে কয়েকপলক তাকিয়ে মেয়েটি জিশানকে বলল, ‘এরপর আপনার একটা বন্ড দেওয়ার ব্যাপার আছে—ইনডেমনিটি বন্ড। আর একটা রিসক ইনশিয়োরেন্স ফর্ম সাইন করতে হবে। নিউলাইফ ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির অথরাইজড এজেন্ট সময়মতো আপনাকে দিয়ে ফর্ম ফিল-আপ করিয়ে নেবে। সমস্ত ইনফরমেশান আপনি ঘরে বসে অন-লাইনে পেয়ে যাবেন।’

জিশান ভাবল মেয়েটির কথা শেষ হয়ে গেছে। তাই ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। মেয়েটির ডাক শুনে ও থামল।

‘মিস্টার পালচৌধুরী—।’

জিশান আবার ঘুরে দাঁড়াল কাউন্টারের দিকে।

মেয়েটি একটা বোতাম টিপল। সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল ইলেকট্রনিক ম্যাজিক। পাশে রাখা একটা লাল-সাদা বাক্স থেকে একটা ছোট কার্ড লাফিয়ে বেরিয়ে এল—অনেকটা পপ-আপ টোস্টারের মতো।

কার্ডটা জিশানের দিকে এগিয়ে দিল মেয়েটি। বলল, ‘এটা রাখুন—এটা আপনার পার্সোনাল স্মার্ট কার্ড। জিপিসিতে থাকার সময় প্রতিটি স্টেপে এই কার্ডটা আপনার কাজে লাগবে। কার্ডটা হারাবেন না যেন…।’

জিশান কার্ডটা দেখল। ওর ফটো লাগানো ল্যামিনেট করা একটা সুদৃশ্য কার্ড। হঠাৎ দেখলে ক্রেডিট কার্ড বলে ভুল হতে পারে। কার্ডটায় একটা নম্বর লেখা আছে—জিশানের আই-ডি নম্বর। পি-2713444।

কিন্তু ওর ফটোটা ওরা পেল কোথায়?

তখনই জিশানের খেয়াল হল, এখন যে-জামাটা ও পরে রয়েছে, ফটোতে সেই জামারই ছবি। তার মানে, এই কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় কোনও লুকোনো ক্যামেরা ওর ফটো তুলে নিয়েছে।

জিশান মেয়েটিকে জিগ্যেস করল, ‘আমি কি এবার যেতে পারি?’

‘অফ কোর্স। অল দ্য বেস্ট, মিস্টার পালচৌধুরী…।’

অল দ্য বেস্ট।

তার মানে কী?

যে-মেয়েটি জানাচ্ছে, কিল গেম-এ সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07, সে-ই আবার বলছে, ‘অল দ্য বেস্ট।’ মেয়েটি কি জানে না, এই মরণখেলায় ‘অল দ্য বেস্ট’ হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা মাত্র সাত ভাগ!

নাকি এটাও স্ট্যাটুইটারি উইশ—ওই স্ট্যাটুইটারি ওয়ার্নিং-এর মতো?

জিশানের জিভ বিস্বাদ হয়ে গেল। একটা তেতো ভাব টের পেল ও। ওর রেজিস্ট্রেশান শেষ, স্মার্ট কার্ড পকেটে…অতএব এখন আর ফেরার কোনও পথ নেই।

শ্রীধর ইশারায় ওকে ডাকলেন।

চারজন গার্ড একইরকমভাবে দাঁড়িয়ে। আর মাটিতে যে পড়ে ছিল সে পড়েই আছে।

জিশানকে নিয়ে বেরোনোর সময় শ্রীধর শকারটা ছুড়ে দিলেন পড়ে থাকা লোকটার গায়ে। এবং একইসঙ্গে ডানপায়ে সপাটে এক লাথি কষিয়ে দিলেন লোকটাকে। চাপা গলায় বললেন, ‘আরাম হারাম হ্যায়—।’

তারপর জিশানকে বললেন, ‘চলো, বাবু, তোমাকে জিপিসিতে পৌঁছে দিই। তারপর আমার ছুটি। তুমি প্যাকেটের বইপত্তরগুলো ভালো করে স্টাডি করে নিয়ো। কাল থেকে শুরু হবে অ্যাকশান। তুমি তৈরি থেকো, বাবু…।’

শ্রীধরের দিকে তাকিয়ে গলায় থুতুর দলা উঠে এল জিশানের। মনে হল, জঘন্য কাজ করার জন্য কিছু-কিছু জঘন্য লোকের জন্ম হয়।

জিমের নাম ‘ডিজিটাল’।

কেন যে এরকম নাম জিশান প্রথমে বুঝতে পারেনি। সেটা ওকে বুঝিয়ে দিল মনোহর।

মনোহর সিং জিপিসিতে জিশানের সাতদিন আগে এসেছে। তাই ও এখানকার খোঁজখবর জিশানের চেয়ে বেশি জানে।

‘ডিজিটাল’ নাম লেখা জিমনাশিয়াম বিল্ডিংটা প্রায় তিনতলা উঁচু। গোটা জিমটা ঠান্ডা—এয়ারকন্ডিশনড। এই জিমে ব্যায়াম-ট্যায়াম কিছু হয় না। শুধু হয় কমপিটিশান।

পার্টিসিপ্যান্টদের নিয়ে নানান রকমের কমপিটিশানের ব্যবস্থা আছে এখানে। কমপিটিশান না বলে সহজ কথায় লড়াই বলাই ভালো। আর সে-লড়াইয়ের উত্তর সবসময়েই ডিজিটাল—অর্থাৎ, বাইনারি ওয়ান আর জিরোর মতো—হয় জেতো, নয় হারো—মাঝামাঝি কিছু নেই। তবে এখানকার কর্মীরা এই লড়াইগুলোকে কখনও ‘ফাইট’ বলে না। বলে ‘কমপিটিশান’ বা ‘গেম’। এইসব গেম-এ প্রায়ই পার্টিসিপ্যান্টরা আহত হয়, বিকলাঙ্গ হয়, এমনকী মারাও যায়—কিন্তু তবুও এর নাম ‘গেম’।

জিমে ঢুকে চারদিকে তাকালে একেবারে চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই নানান যন্ত্রপাতি। তার সঙ্গে আধুনিক কন্ট্রোল প্যানেল। প্যানেলে কম্পিউটার মনিটর, রঙিন পুশবাটন আর ইন্ডিকেটিং ল্যাম্প।

জিশান আর মনোহরকে নিয়ে মোট দশজন ঢুকেছে ডিজিটাল জিমে। ঢোকার সময় যে-যার পার্সোনাল স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করেছে। গেম শেষ হলে পর এখান থেকে নিজের পায়ে হেঁটে বেরোবে তিনজন। বাকি সাতজন বাতিল। কিল গেম-এর জন্য তাদের বলা হবে ‘আনফিট’।

মনোহরের কাছে ব্যাপারটা শোনার পর জিশানের মনে আশা জেগেছিল। মানে, প্রাথমিক পরীক্ষায় হেরে গেলে পর আসল পরীক্ষায়—অর্থাৎ, কিল গেম-এ—আর বসতে হবে না।

এ-কথা মনোহরকে বলতেই ওর কী হাসি! পেট চেপে ধরে হাসছে তো হাসছেই।

হাসি থামলে পর মনোহর বলল, ‘জিশান ভাইয়া, দুনিয়া এত সহজ নয়। তা হলে জিপিসিতে গেস্টহাউসে কিল গেম-এর আমরা যারা রয়েছি তারা সবাই একে-একে হেরে যাওয়ার চেষ্টা করবে আর সাতদিনেই খাঁচা খালি হয়ে যাবে। যখন কমপিটিশান চলে তখন সুপারগেমস কর্পোরেশনের কয়েকজন অবজার্ভার থাকে। ওরা গেমস কমিটিকে রিপোর্ট দেয়। যদি সেই রিপোর্টে কারও নামে এমন লেখা থাকে যে, সেই পাবলিক জেনুইন লড়েনি, তখন তাকে…।’ কথা থামিয়ে মনোহর আচমকা জিশানকে প্রশ্ন করল, ‘বলো দেখি, তাকে নিয়ে কী করে? বাতাও, কেয়া…?’

জিশান কিছু ভেবে উঠতে পারছিল না। ও ঠোঁট উলটে মাথা নাড়ল, বলল, ‘জানি না। কী করে তাকে নিয়ে?’

হাসল মনোহর, বলল, ‘তাকে ধরে হাংরি ডলফিন, ম্যানিম্যাল রেস—বা ওরকম কোনও ডেঞ্জারাস গেম-এ জোর করে নামিয়ে দেয়। ফারাক সিরফ দুটো ব্যাপারে : এই গেম-এ কোনও প্রাইজ মানি থাকে না, আর এই খেলার কোনও লাইভ টেলিকাস্ট হয় না। আভি সমঝে আপ?’

জিশান বুঝতে পারল—বেশ ভালো করেই বুঝতে পারল। ও মনোহরের ক্লেদহীন সরল মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

গোলগাল মুখ। ভুরু দুটো খুব ঘন। মাথায় কদমছাঁট চুল। নাকটা অতিরিক্ত ছড়ানো। আর সামনের দাঁতে কালচে ছোপ।

হাসলে মনোহরকে একেবারে বাচ্চা ছেলের মতো দেখায়।

রেজিস্ট্রেশান কিটের ম্যানুয়াল আর বইপত্রগুলো এর মধ্যেই জিশান অনেকটা করে পড়ে ফেলেছে। সবরকমের পার্টিসিপ্যান্টের কথা মাথায় রেখে ম্যানুয়ালগুলো বাইলিঙ্গুয়াল—বাংলা আর ইংরেজিতে ছাপা। সেগুলো পড়ে অনেক নিয়মকানুনের কথা জেনেছে জিশান। তবে সেখানে মনোহরের কাছে শোনা এই বিচিত্র ‘শাস্তি’-র কথা লেখা নেই। তার কারণ, ম্যানুয়ালগুলো আগাপাস্তলা অফিশিয়াল এবং আইনমাফিক লেখা।

ডিজিটাল জিমে ঢুকে জিশান আর মনোহররা একপাশে লাইন করে দাঁড়িয়ে পড়ল।

বিশাল মাপের জিমের নানান জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে ইউনিফর্ম পরা সিকিওরিটি গার্ড, কোমরের বেল্টে ঝুলছে শকার।

জিশানদের সঙ্গে রয়েছেন একজন ইনস্ট্রাকটর। তাঁর গায়ে লাল ইউনিফর্ম। কোমরে স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা ল্যাপটপ কম্পিউটার, আর হাতে রিমোট কন্ট্রোল ইউনিটের মতো একটা ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্র।

খেলাটা জিশানদের বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য ইনস্ট্রাকটর বললেন, ‘সবাই ওই স্ক্রিনটার দিকে তাকান। যে-গেমটা আমাদের খেলতে হবে তার সিমুলেশান ওই পরদায় আমি দেখাচ্ছি। আমার ল্যাপটপ থেকে পাওয়ার পয়েন্ট দিয়ে ওখানে প্রাোজেক্ট করছি। আপনারা দয়া করে টোটাল অ্যাটেনশান দেবেন। রেডি, ওয়ান, টু, থ্রি—স্টার্ট!’

জিমের একপাশে দাঁড় করানো একটা বড় সাদা পরদায় গেমটার সিমুলেশান শুরু হল।

রঙিন ছবিতে দেখা গেল একটা বিশাল জিম। জিমটার নাম ‘ডিজিটাল’।

ক্যামেরা প্যান করে জিমের ভেতরে ঢুকল। সেখানে দশজন খেলোয়াড় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের সকলের চেহারা একইরকম—ভিডিয়োগেমের ছবি যেমন হয়। আর তাদের প্রত্যেকের গায়ে একইরকম পোশাক—জিশানরা এখন যেমন পরে রয়েছে।

হলদে রঙের স্পোর্টস টি-শার্ট। বুকের ওপরে সুপারগেমস কর্পোরেশনের লোগো ছাপা। আর তার ঠিক নীচেই একটা বার কোড। এই কোড লেজার স্ক্যানার দিয়ে স্ক্যান করলেই প্রতিযোগীর নানান প্রয়োজনীয় তথ্য ফুটে উঠবে স্ক্যানারে লাগানো কম্পিউটারে।

জিশানদের গায়ে হলদে টি-শার্টের সঙ্গে রয়েছে কালো রঙের বারমুডা প্যান্ট। প্যান্টের একপাশে সুপারগেমস কর্পোরেশনের লোগো। তার নীচে আবার সেই বার কোড।

এ ছাড়া প্রত্যেকেরই পায়ে স্পোর্টস শু। আর জুতোর সোলের একপাশে লাগানো রয়েছে বার কোডের স্টিকার।

ওরা দশজন পরদার সিমুলেশানটা হাঁ করে গিলছিল। সিনেমা শেষ হলেই ওদের সত্যি-সত্যি সেরকম করতে হবে।

জিশানের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পড়ছিল। ও মনে-প্রাণে চাইছিল, ওকে যেন মনোহরের মুখোমুখি না পড়তে হয়। জিপিসিতে এসে দু-দিন কাটিয়েই মনোহরকে ওর পছন্দ হয়ে গেছে।

মনোহর সংসারে একা। তিনকুলে ওর কেউ নেই। সেই কোন ছোটবেলায় ওর বাবা-মা ওকে রাস্তায় ফেলে পিঠটান দিয়েছে। তার পর থেকে ও রাস্তায়-রাস্তায় মানুষ। একটা সময়ে ঠেলাগাড়ি আর সাইকেল ভ্যান চালাত। তারপর ট্রেনের টিকিট ব্ল্যাক করত। এইভাবে বহুবার পেশা বদলে শেষ পর্যন্ত ফুটপাতে রেডিমেড জামাকাপড়ের ব্যাবসা করছিল। তখনই ও পিস ফোর্সের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে।

একদিন রাতে বৃষ্টির মধ্যে ও যখন চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ দিয়ে হেঁটে আসছিল, তখন হঠাৎই দ্যাখে গিরিশ পার্কের কাছে রাস্তার ধার ঘেঁষে একটা শুটার দাঁড় করানো। আর পিস ফোর্সের দুটো গার্ড একটা মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করছে।

খানাখন্দ ভরতি বৃষ্টি-ভেজা রাস্তায় লোকজন যে একেবারেই ছিল না এমন নয়। কিন্তু যারা ছিল তারা কোনও ঝামেলায় নাক গলাতে চায়নি। ওল্ড সিটিতে এটাই সাধারণ স্টাইল। নিজের ঠিকঠাক বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

কিন্তু মনোহর ছোটবেলা থেকেই বেপরোয়া। এমনভাবে ও জীবন কাটিয়েছে যে, ওর পক্ষে ওল্ড সিটির সিটিজেনদের নির্লিপ্ত ঢঙের সঙ্গে লাগসই হয়ে যাওয়াটা মুশকিল।

তাই মনোহর গিয়ে পিস ফোর্সের দুই মস্তানের মুখোমুখি হয়েছে। এবং কোনও কথা না বলেই এক ঘুষিতে একটাকে রাস্তায় পেড়ে ফেলেছে। সেই ফাঁকে দ্বিতীয় গার্ডটা অটোমেটিক পিস্তলের বাঁট বসিয়ে দিয়েছে মনোহর সিং-এর মাথায়।

অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে মনোহর ঝাপসাভাবে দেখতে পেয়েছিল মেয়েটা ছুটে পালাচ্ছে।

অদ্ভুত এক তৃপ্তিতে মনোহরের মন ভরে গিয়েছিল এবং ও অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল।

তারপরই ওকে নিয়ে আসা হয়েছে সিন্ডিকেটের হেডকোয়ার্টারে।

মনোহর মাঝে-মাঝেই এক-দু-কলি গান গেয়ে ওঠে আর জিশানকে বলে নিজের লক্ষ্যহীন জীবনের কথা।

‘জিশান ভাইয়া, না কোই আগে, না কোই পিছে / উপর আসমা, ধরতী নীচে। তাই লাইফে আমার কোনও পিছুটান নেই। ব্যস, গুজরনা হ্যায়। এখানে এসে আমার ভালোই লাগছে…আগে জো হোগা ও রাম জানে!’

দম বন্ধ করে খেলাটা দেখছিল জিশান।

জিমের ঠিক মাঝখানে অনেক উঁচুতে একটা লম্বা লোহার রড—জিমের একপ্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্তে চলে গেছে। সেই রড থেকে সার বেঁধে ঝুলছে একজোড়া করে লোহার শিকল। একজোড়া শিকল থেকে পরের জোড়া শিকলের দূরত্ব পনেরো কি ষোলো ফুট।

শিকলগুলো নেমে এসেছে অনেক নীচে, তবে জিমের ফ্লোর থেকে ফুটদশেক ওপরে শেষ হয়ে গেছে। প্রতিটি শিকলে দশফুট দূরত্বে একটা করে লোহার চাকা লাগানো—অনেকটা গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলের মতো। ফলে শিকল ধরে এই চাকায় দু-পায়ের ভর দিয়ে দাঁড়ানো যায়।

খেলার শুরুতে একজোড়া শিকলের দুটো প্রান্তকে একটা অদ্ভুত যন্ত্র দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হল বিপরীত দিকে—একেবারে জিমের সিলিং-এর উচ্চতায়। তারপর একটা অটো-এলিভেটর দুই প্রতিযোগীকে তুলে দিল বিপরীত দিকের দুটো প্ল্যাটফর্মে—শিকলের প্রান্তের একেবারে কাছে। তারা শিকলের প্রান্ত ধরে বসে রইল সেখানে।

এইরকমভাবে পাঁচজোড়া শিকল নিয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে তৈরি হল পাঁচজোড়া খিলাড়ি।

তারপর জিমের উত্তরদিকের দেওয়ালে লটকানো প্রকাণ্ড মাপের একটা এলইডি ডট ম্যাট্রিক্স স্ক্রিনে শুরু হল কাউন্ট ডাউন : টেন, নাইন, এইট,…থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো।

কাউন্ট ডাউন শেষ হতে-না-হতেই খেলা শুরু।

মুখোমুখি প্ল্যাটফর্মে বসা প্রতিযোগী দুজন ঝাঁপিয়ে পড়ল প্ল্যাটফর্ম থেকে। টারজানের মতো শূন্যে দোল খেয়ে তারা উল্কার মতো ধেয়ে এল পরস্পরের দিকে। জিমের মাঝামাঝি জায়গায় এসে ওদের মারাত্মক সংঘর্ষ হল।

তারপর চলতে লাগল দাঁত-নখ লড়াই।

আচমকা পরদায় প্রাোজেকশান বন্ধ করে দিলেন ইনস্ট্রাকটর। বললেন, ‘সবাই নিশ্চয়ই খেলাটা বুঝতে পেরেছেন?’

জিশান লক্ষ করল, ইনস্ট্রাকটরের জামায় বোতামের কাছে মউমাছির মতো ছোট্ট ক্লিপ-অন মাইক্রোফোন লাগানো। লুকোনো কোনও সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে জিশানরা ওঁর কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছিল।

‘তাড়াতাড়ি বলুন, খেলাটা আপনারা সবাই বুঝতে পেরেছেন কি না—।’

জিশানরা সকলেই হাতের ইশারায় জানাল, হ্যাঁ, ওরা বুঝতে পেরেছে।

‘…খেলাটায় নিয়ম বলে কিছু নেই। শিকল ধরে প্ল্যাটফর্ম থেকে ঝাঁপ দেওয়ার পর আপনারা যে যেমনভাবে খুশি লড়াই করতে পারেন। যদি কেউ শিকল শক্ত করে ধরে রাখতে না পেরে নীচে পড়ে যান তা হলে ডিসকোয়ালিফায়েড হওয়ার কোনও ভয় নেই। অটো-এলিভেটরের হেলপ নিয়ে আপনারা আবার শিকল ধরে প্ল্যাটফর্মে গিয়ে বসবেন—ঝাঁপ দেবেন।’ ইনস্ট্রাকটর ওদের দশজনকে একে-একে দেখলেন। তারপর হেসে বললেন, ‘এই খেলাটায় সুবিধে হচ্ছে, এর কোনও টাইম লিমিট নেই। টেক ইয়োর ওন টাইম টু ফিক্স ইয়োর অপোনেন্ট।’

দু:খে হাসি পেয়ে গেল জিশানের। কোনও টাইম লিমিট নেই! শিকলে ঝুলতে-ঝুলতে পশুর মতো লড়ে যাও প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। শিকলে বাড়ি খাও, মাথা ফাটাও—নিজের অথবা অন্যের। শিকল থেকে পড়ে গেলেও কোনও অসুবিধে নেই। তখন আবার প্ল্যাটফর্মে চড়ে বসতে হবে। নতুন করে শুরু করতে হবে লড়াই। যদি অবশ্য জিমের মেঝেতে পড়ে গিয়ে শরীরটা আস্ত থাকে!

মোদ্দা কথা হল, ডিজিটাল রেজাল্ট চাই : এক অথবা শূন্য, জয় অথবা পরাজয়। আর এত সত্বেও এর নাম খেলা—গেম!

‘ও.কে.। টেক ইয়োর পজিশন। যার-যার জায়গামতো দাঁড়িয়ে যান আপনারা। এদিকে পাঁচজন, আর ওদিকে পাঁচজন। কুইক—উঠে পড়ুন অটো-এলিভেটরে।’

জিমের যন্ত্রগুলো যন্ত্রের মতোই কাজ করতে লাগল। জিশান অনেক হিসেব কষে এমনভাবে একদিকে গিয়ে দাঁড়াল যাতে ওকে মনোহর সিং-এর মুখোমুখি না পড়তে হয়।

ও খেয়াল করল, মনোহরও বোধহয় একই চিন্তা করে জিশানের সঙ্গে একইদিকের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

জিশানের সঙ্গে মনোহরের চোখাচোখি হল। মনোহর হেসে চোখ মারল জিশানকে। তারপর ‘দেখি, নসিবে কী আছে!’ গোছের ভাব করে হাত আর ঠোঁট ওলটাল।

অটো-এলিভেটর জিশানদের তুলে দিল প্রায় চল্লিশ ফুট ওপরের প্ল্যাটফর্মে। তারপর অদ্ভুত একটা যন্ত্র শিকলের প্রান্তগুলো ওপরে তুলে পৌঁছে দিল জিশানদের হাতের কাছে।

ইনস্ট্রাকটরের সিগনালের সঙ্গে-সঙ্গে ডিজিটাল কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেল।

জিশান তাকাল বিপরীতদিকের মাচায় বসা ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে।

ছেলেটার নাম শিবপদ। শিকলের প্রান্তটা ধরে লাফ দেওয়ার জন্য ওত পেতে বসে আছে। দূরত্বটা অনেক বেশি হওয়ার জন্য স্পষ্ট করে ওকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আগে শিবপদকে লক্ষ করেছে জিশান। বেশ লম্বা, ফরসা, গাল ফোলা, কবজি দুটো শিরা-ওঠা—চওড়া, ঘন-ঘন চোখের পাতা ফ্যালে। আর গলায় একটা রুপোর চেন।

জিপিসিতে এসে থেকে জিশানরা রোজ নিয়মমাফিক ব্যায়াম করে। রোজকার সেই ওয়ার্কআউটের সময় জিশান লক্ষ করেছে, শিবপদ সবসময় চুপচাপ থাকে।

ওর সঙ্গে একবার আলাপ করতেও চেষ্টা করেছিল জিশান। ব্যায়াম করার ফাঁকে ওর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে বলেছিল, ‘আমার নাম জিশান…।’

ছেলেটা তখন পাওয়ার বিল্ডারে কাজ করছিল। যন্ত্রটায় হ্যাঁচকা মারা থামিয়ে ও চোখ পিটপিট করে তাকিয়েছিল জিশানের দিকে। তারপর থতিয়ে বলেছিল, ‘আমি শিবপদ…আলাপ করে কী লাভ! বরং ঝামেলা বাড়বে।’

‘ঝামেলা! কীসের ঝামেলা?’ জিশান ওর কথাটা বুঝতে না পেরে জিগ্যেস করেছিল।

তোয়ালে দিয়ে গায়ের ঘাম মুছে শিবপদ বলেছিল, ‘আজ নয় কাল তো মুখোমুখি লড়াইয়ে নামতে হবে। বেশি আলাপ হয়ে গেলে তখন লড়তে প্রবলেম হবে।’

স্পষ্ট বিদায়ের ইঙ্গিত।

কিন্তু তা সত্বেও হাল ছাড়েনি জিশান। শিবপদর চোখদুটোকে বড় করুণ বলে মনে হয়েছিল ওর। তাই আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘তুমি এখানে কেমন করে এলে?’

‘বলব না।’ সরাসরি আপত্তি করেছিল শিবপদ, ‘দয়া করে নিজের জায়গায় যাও…মন দিয়ে ওয়ার্কআউট করো…শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করো।’

কথা শেষ করে শিবপদ আবার ব্যায়ামে মন দিয়েছিল। পাওয়ার বিল্ডারের রড ধরে দ্রুত ছন্দে হাপর টানার কাজ শুরু করে দিয়েছিল।

জিশানের যে কী জেদ চেপে গিয়েছিল!

ও নাছোড়বান্দার মতো জানতে চেয়েছিল, ‘বাড়িতে কে-কে আছে তোমার?’

‘বলব না!’

তারপর জিশানের প্রশ্নবাণের হাত থেকে বাঁচার জন্য চেঁচিয়ে একজন ইনস্ট্রাকটরকে ডেকেছিল, ‘স্যার, আমাকে একটু দেখিয়ে দেবেন…।’

জিশান আর দাঁড়ায়নি। সরে এসেছিল শিবপদর কাছ থেকে।

এখন শিবপদকে দেখে জিশানের মনে হল, ও ঠিকই বলেছিল : বেশি আলাপ হয়ে গেলে লড়তে প্রবলেম হবে।

ডিজিটাল কাউন্ট ডাউন খুব তাড়াতাড়ি শূন্যের দিকে ছুটছিল।

জিমের টঙে বসে জিশান দেখল, মাথায় কালো টুপি আর সাদা ট্র্যাক-সুট পরা তিনজন লোক ঢুকে পড়েছে জিমে। ওদের ভুঁড়ির কাছে ঝোলানো ল্যাপটপ কম্পিউটার। আর ট্র্যাক সুটের বুকের কাছটায় লাল হরফে লেখা ‘Observer’।

কাউন্ট ডাউন শূন্যে পৌঁছল এবং জিশান শূন্যে ঝাঁপ দিল।

সত্যিই ব্যাপারটা গাছের শিকড় ধরে টারজানের লাফ দেওয়ার মতো।

শোঁ-শোঁ করে বাতাস কেটে দীর্ঘ ব্যাসার্ধের বৃত্তচাপ এঁকে ভেসে চলল জিশান। যতই ও নীচে নামছিল ততই ওর গতি বাড়ছিল।

এ যেন ঠিক রূপকথার গল্পের মতো। জাদুকার্পেট কিংবা রূপকথার ঢেঁকিতে চড়ে আকাশে ভেসে বেড়ানো। অথবা পরিদের মতো পিঠে ডানা গজিয়ে যাওয়া।

নিজেকে রূপকথার গল্পের নায়ক ভাবছিল জিশান। আরামে ওর চোখ বুজে আসতে চাইছিল।

হঠাৎই ও দেখল, আয়নার প্রতিবিম্বের মতো বিপরীত দিক থেকে আর-একটা জিশান সমান গতিতে, সমান তালে, ছুটে আসছে ওর দিকে।

প্রতিবিম্বটা খুব কাছে আসতেই জিশান বুঝতে পারল ছায়াটা শিবপদর মতো দেখতে।

এই উপলব্ধির প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই সংঘর্ষটা হল।

জিমের ভেতরে পৃথিবীর অভিকর্ষের কোনও রকমফের নেই। তাই আরও চারজোড়া প্রতিযোগী একইরকম বেগে নেমে এসে একই মুহূর্তে সংঘর্ষ ঘটিয়েছে।

লোহার সঙ্গে লোহার টক্করে আগুনের ফুলকি ঠিকরে বেরোল। ঝনঝন শব্দ প্রতিধ্বনি তুলল জিমের ভেতরে। সংঘর্ষের শব্দে জিশানের কানে তালা লেগে গেল।

সংঘর্ষ শুধু লোহায়-লোহায় হয়নি, শরীরের সঙ্গে শরীরেরও হয়েছে। তবে সেই ভোঁতা শব্দগুলো লোহার সংঘর্ষের তীব্র শব্দে চাপা পড়ে গেছে।

শব্দের অনুভূতির পরই জিশান টের পেল ব্যথার অনুভূতি। ওর বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠল অসংখ্য হলদে ফুল।

কারণ, শিবপদর কাঁধের সঙ্গে ওর মাথার সংঘর্ষ হয়েছে।

ধাক্কা লাগার পরই জিশান আর শিবপদর শরীরটা লাট্টুর মতো পাক খেতে শুরু করেছে। সেই অবস্থায় দুলতে-দুলতে ওরা ছিটকে সরে গেছে দূরে—কিন্তু আবার ছুটে আসছে কাছে। কারণ, অভিকর্ষের নিয়মের হাত থেকে কারও রেহাই নেই।

জিশানের মাথা ঘুরছিল। ঝিমঝিম করছিল। মনে হচ্ছিল, মাথাটা প্রকাণ্ড এক উলের বল। এক্ষুনি বোধহয় হাওয়ায় ভেসে উড়ে যাবে ওপরে।

সেই অবস্থাতেই জিশান চেন ধরে খানিকটা ওপরে উঠে যেতে চাইল, যাতে ওপর থেকে শিবপদকে লাথি মারার সুযোগটা পায়।

শিবপদর শরীরটা তখনও লাট খাচ্ছিল। ওই লাট খাওয়া অবস্থাতেই শিবপদ ভেসে আসছিল জিশানের দিকে।

পায়ের নাগালে ওর শরীরটা আসতেই জিশান জোড়া পা চালাল।

জিশানের স্পোর্টস শু-র ডানপাটিটা ধাক্কা খেল শিবপদর কোমরে। আর বাঁ-পা-টা গিয়ে লাগল শিকলের লোহায়।

বাঁ-পায়ের গোড়ালি থেকে মাথা পর্যন্ত ঝনঝন করে উঠল। নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী জিশান ছিঁটকে গেল দূরে। যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেলল।

তখনই মিনিকে দেখতে পেল জিশান। একরাশ হলদে ফুলের মধ্যে মিনির মুখটা টলটল করছে।

আরও ভালো করে দেখার চেষ্টায় ও চোখ ছোট করে সামনে ঝুঁকে পড়ল।

তখন দেখতে পেল মিনির কোলে ছোট্ট শানু হাত-পা ছুড়ছে।

জিশান একগাল হেসে শানুকে কোলে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াল।

ঠিক সেই মুহূর্তে একটা প্রচণ্ড ঘুষি এসে আছড়ে পড়ল জিশানের চোয়ালে।

যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল জিশান। মনে হল ওর চোয়ালটা বেঁকে গেছে।

অনেক চেষ্টা করে চোখ খুলতে পারল ও। দৃষ্টি ঝাপসা। শুধু কানে আসছে লোহার ঠনঠন শব্দ আর টুকরো-টুকরো চিৎকার।

আশেপাশে ঝুলন্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের তীব্র লড়াই চলছে।

জিশান হাঁপাতে লাগল। যে-করে-হোক মিনি আর শানুর কাছে ওকে ফিরতে হবে—ফিরতেই হবে।

জিশান টের পেল, ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।

নাকের ফুটো থেকে বেরিয়ে গোঁফের ওপর, তারপর ঠোঁটে, তারপর থুতনির দিকে।

জিভ বের করে ঠোঁট চাটল। এতদিনের শোনা কথাটা সত্যি প্রমাণ হল: রক্তের স্বাদ নোনা।

চোখের পলকে কী একটা হয়ে গেল জিশানের ভেতরে। শিবপদ হঠাৎই যেন কার্তিক হয়ে গেল।

ডানহাত ওপরে তুলে শিকলটা শক্ত মুঠোয় আঁকড়ে ধরেছিল জিশান। তার ঠিক ওপরেই ছিল গাড়ির স্টিয়ারিং-এর মতো একটা লোহার চাকতি। শিবপদর মাথাটা যে চাকতি বরাবর সেটা জিশান খেয়াল করল। সঙ্গে-সঙ্গে বাঁ-হাতে শিবপদর গেঞ্জি খামচে ধরল জিশান। আর প্রবল শক্তিতে ডানহাত চালিয়ে লোহার চাকাটা ভয়ংকরভাবে ঠুকে দিল শিবপদর মাথায়।

কিছু একটা ফেটে যাওয়ার শব্দ হল। শিবপদর মাথার একপাশটা হাঁ হয়ে গেল। ঠিক যেন স্টেজের কালো পরদা সরে গিয়ে ভেতরের কুশীলবদের দেখা গেল। ওরা সবাই লাল পোশাক পরে রয়েছে।

শিবপদর চোখ উলটে গেল। শিকল থেকে ওর হাতের মুঠো আলগা হয়ে গেল। ওর লম্বা দেহটা চিত হয়ে নীচে পড়তে লাগল।

জিশানের মনে হল, ও স্লো মোশানে কোনও সিনেমা দেখছে।

অবলম্বনহীন শিবপদ শূন্যে হাত-পা ছড়িয়ে নীচে পড়ছে-তো-পড়ছেই।

যেখানে ওদের লড়াই চলছিল সেখান থেকে মেঝেটা প্রায় বিশ ফুট নীচে। অভিকর্ষের টানে সেই দূরত্ব পেরোতে শিবপদর যেন একশো বছর লাগল। তারপর ওর ভারী দেহটা আছড়ে পড়ল জিমের মেঝেতে। পড়ে খানিকটা লাফিয়ে উঠল। আবার পড়ল। মাথাটা এপাশ-ওপাশ খানিকটা নড়ল। তারপর সব শেষ।

জিশানের মুখ থেকে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল। তবে শুনে মনে হল, চিৎকারটা ওর মুখ থেকে বেরোয়নি—বেরিয়েছে কোনও জন্তুর মুখ থেকে।

জিশান ভেবে অবাক হল যে, আওয়াজটার কোনও সঠিক চরিত্র নেই। ওটা দু:খের, হতাশার, নাকি জয়ের জিগির—জিশান কিছুই বুঝতে পারল না।

ও ঘামছিল, হাঁপাচ্ছিল। তাকিয়ে ছিল নীচে পড়ে থাকা শিবপদর শরীরটার দিকে।

ওর হলদে গেঞ্জিতে লালের ছোপগুলোকে বাটিকের প্রিন্ট বলে মনে হচ্ছে। ছেলেটার দু-চোখ বন্ধ—মনে হচ্ছে যেন অদ্ভুতভাবে হাত-পা ছড়িয়ে হঠাৎই ঘুমিয়ে পড়েছে।

জিশান কেঁদে ফেলল। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ল ওর। কিল গেম-এর দিকে ও একধাপ এগিয়ে গেছে। একইসঙ্গে মানুষ থেকে পশুর দিকেও।

এইভাবে ধাপে-ধাপে ও কিল গেম-এর জন্য তৈরি হবে, আর ধাপে-ধাপে হিংস্র পশু হয়ে উঠবে। হায় ভগবান!

জিশান কাঁদতে-কাঁদতেই শিকল বেয়ে নীচে নামতে শুরু করল। আশেপাশে তখনও ঝনঝনাৎ শব্দ উঠছে, শোনা যাচ্ছে হিংস্র চিৎকার। লড়াই চলছে পুরোদমে।

শিকলের শেষ প্রান্তে এসে লাফ দিল জিশান। এসে পড়ল শিবপদর পাশে।

এমনসময় ভারী অথচ ভোঁতা একটা শব্দ জিশানের কানে এল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।

দূরের একটা শিকল থেকে খসে পড়েছে একজন প্রতিযোগী। তার প্রতিদ্বন্দ্বী তখন শিকল ধরে ঝুলছে। বিজয়ের উল্লাসে চিৎকার করে এক হাত ছুড়ে দিচ্ছে শূন্যে।

আরও একজনের ভাগ্যরেখা গন্তব্যে পৌঁছে গেল। বিষণ্ণভাবে ভাবল জিশান। তারপর শিবপদর দেহের ওপরে ঝুঁকে পড়ল। ওর মুখের কাছে মুখ নিয়ে ডাকল, ‘শিবপদ! শিবপদ!’

কোনও সাড়া নেই।

‘শিবপদ!’ কান্না-ভাঙা গলায় আবার ডাকল জিশান।

তখনই শিবপদর গলা থেকে একটা অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এল। ওর মাথাটা নড়ে উঠল।

জিশান আরও ঝুঁকে পড়ল শিবপদর ওপরে। দু-হাত দু-গালে চেপে ওর রক্তাক্ত মুখটাকে সোজা করে ধরল। শিবপদকে কি এখন মালিকের মতো দেখাচ্ছে?

নিয়তির এ কী অদ্ভুত মায়া! একই মানুষ—কখনও সে কার্তিক, কখনও মালিক।

জিশানের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। ও মমতা ভরা গলায় ডাকল, ‘শিবপদ! শুনছ?’

শিবপদর বোজা চোখ সামান্য ফাঁক হল। ধ্যানমগ্ন শিবের মতো দেখাচ্ছিল ওকে।

জিশান আবার ডাকল।

শিবপদ এবার বিড়বিড় করে কথা বলল।

‘আমার বাড়ি বরানগরে…একচালা ঘরে…থাকতাম।’ হাঁ করে কয়েকবার দম নিল শিবপদ। ওর বুকটা ওঠা-নামা করল। তারপর জিশানকে খামচে ধরল।

জিশান দেখল, ওর চোখ আরও খুলে গেছে, কিন্তু চোখের উজ্জ্বল ভাব কমে গিয়ে ঘোলাটে হয়ে গেছে। শিবপদ ঠিক যে কোনদিকে তাকিয়ে আছে সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

‘জি-জিশান…আমার ছোট বোন আছে…ভাই আছে…মা আছে… আর…আর হাঁ-করা অভাব আছে। দু-বেলা খাবার জুটত না আমাদের…।’

কথা বলতে-বলতে শিবপদ যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠছিল। কে জানে, ওপর থেকে পড়ে গিয়ে ওর হাড়গোড় কতটা ভেঙেছে!

জিশান ওর কপালে হাত বোলাতে চেষ্টা করল। কিন্তু কপালের একপাশটা রক্তে মাখামাখি—ভালো করে হাত বোলানো যাচ্ছে না। কান্নার দমক উথলে উঠল জিশানের বুকের ভেতর থেকে। এই রক্তাক্ত কপাল জিশানের দান। নিজের প্রতি ঘেন্নায় বমির ওয়াক উঠতে চাইল। দেখল, শিবপদকে ঘিরে কয়েকটা মাছি উড়ছে, রক্তের ওপরে বসছে—আবার উড়ে এসে বসছে জিশানের গায়ে।

শিবপদ ঘোলাটে চোখে জিশানকে ফোকাস করতে চাইল। বলল, ‘কেঁদো না…এ তো হতই…হয় তুমি…নয় আমি…।’ আবার দম নেওয়ার জন্য থামল শিবপদ। বড়-বড় শ্বাস টেনে বলল, ‘একদিন…একদিন দেখি…স্টেশানে…আমার ভাই আর বোন ভিক্ষে করছে। আমাকে দেখেই…দে ছুট…।’

‘আর কথা বোলো না। চুপ করো। আমি ওদের ডাক্তার ডাকতে বলছি—।’

‘না! ডাক্তার ডাকতে হবে না। ডাক এসে গেছে—।’ হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল শিবপদ। খামচে ধরল জিশানের কোমর।

জিশানের ব্যথা করছিল। ও মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল, একটু দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন সিকিওরিটি গার্ড।

জিশান চেঁচিয়ে বলল, ‘এই যে, শুনছেন! একজন ডাক্তার ডাকুন—একে হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন!’

পিস ফোর্সের গার্ডটি জিশানের দিকে একবার দেখল। তারপর আবার ঘাড় ঘুরিয়ে রোবটের ঢঙে দাঁড়িয়ে রইল।

শিবপদ আবার কথা বলল।

‘সেইদিন…সেইদিন ঠিক করলাম…কিছু একটা আমাকে…আমাকে…করতে হবে। তাই…তাই…কিল গেম…একশো কোটি টাকা…।’ এইবার কেঁদে ফেলল শিবপদ। কয়েকবার হেঁচকি তুলল। তারপর অত্যন্ত নিচু পরদায় বলল, ‘আমার…আমার গলার… চেনটা…মাকে দিয়ো। ওদের…ওদের আর কেউ রইল না…রইল না।’

জিশান বলতে পারল না, ‘আমি তো আছি!’ কারণ, ও জানে না শেষ পর্যন্ত ও থাকবে কি না। ও হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর চেষ্টা করল।

শিবপদ কথা বলার ক্লান্তিতে হাঁপাচ্ছিল। হঠাৎই ও মরণ খিঁচুনিতে জিশানকে আঁকড়ে ধরল।

জিশান আকুল হয়ে ওর নাম ধরে বারবার ডাকতে লাগল।

কিন্তু কোনও সাড়া নেই। ঘোলাটে চোখ তাকিয়ে আছে জিমের সিলিং-এর দিকে।

জিশান শিবপদকে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিল। লক্ষ করল, শিবপদর চোখের পাতা পড়ছে না। আর ঠিক তখনই একটা মাছি গিয়ে বসল শিবপদর খোলা চোখের ওপরে।

এবারেও শিবপদর চোখের পাতা পড়ল না।

বাচ্চা ছেলের মতো কেঁদে ফেলল জিশান। শিবপদর ওপরে ঝুঁকে পড়ে ওর গলার চেনটা খুলে নিল। জিশান ওর বাড়ি চেনে না। তা হলে কী করে ওর মাকে গিয়ে চেনটা দেবে? কিন্তু তবুও এটা থাক ওর কাছে। স্মৃতি হিসেবে।

শিবপদকে ছেড়ে ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল ও। ঝাপসা চোখে দেখল, শূন্য শিকলগুলো ঝুলছে। তার মধ্যে কয়েকটা তখনও পেন্ডুলামের মতো অলসভাবে দুলছে। তিনজন প্রতিযোগী জিমের মেঝেতে পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আর বাকি পাঁচজন জিমের একপাশে ইনস্ট্রাকটরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে। তাদের মধ্যে মনোহরও রয়েছে। জিশানের দিকে তাকিয়ে হাত তুলে ও বোঝাতে চাইল, ও জিতেছে।

অবজার্ভার তিনজন এখন একজায়গায় জড়ো হয়ে নিজেদের ল্যাপটপের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করছিল। এ-ওর কম্পিউটারের পরদায় উঁকি মারছিল।

জিশান হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছল, প্যান্টে হাত ঘষে হাতের রক্ত মুছল। তারপর চেনটা পকেটে গুঁজে শ্রান্ত পা ফেলে এগোল মনোহরদের দিকে।

যেতে-যেতে শিবপদর মৃতদেহের দিকে একবার ফিরে তাকাল জিশান। শিবপদর ছোট বোন আর ছোট ভাইটার কথা একঝলক মনে পড়ল। বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। শিবপদ ঠিকই বলেছিল, জিপিসিতে এসে আলাপ করলেই ঝামেলা বাড়বে। কারও সঙ্গে পরিচয় হওয়াটাই পাপ।

এমনসময় স্পিকারে ইনস্ট্রাকটরের গলা শোনা গেল।

কারা-কারা এই ডিজিটাল কমপিটিশানে কোয়ালিফাই করেছে তাদের নাম শোনা গেল।

প্রথমেই জিশান পালচৌধুরী, তারপর মনোহর সিং—আর সবশেষে রণজিৎ পাত্র।

নাম ঘোষণার পর ওদের তিনজনকে একপাশে লাইন করে দাঁড়াতে বলা হল। তখন জিশান রণজিৎকে ভালো করে দেখল।

কালো দশাসই চেহারা। মোটা গোঁফ। সবকিছুতেই গলা ফাটিয়ে হা-হা করে হাসে। মাথায় চুল কম। মাঝখানটায় তো রীতিমতো টাক পড়ে গেছে।

ব্যায়াম করার সময় জিশানের সঙ্গে সামান্য আলাপ হয়েছে। ওর মুখে সবসময় একটা তাচ্ছিল্যের ভাব। তা ছাড়া ব্যায়ামের যন্ত্রের একটু-আধটু দখল নিয়ে এর-তার সঙ্গে ঝগড়া আর খিচখিচ করছিল।

ছেলেটাকে দেখে জিশানের কেন জানি না ভালো লাগেনি। তাই আলাপ বেশি দূর গড়ায়নি ও।

ওরা তিনজন একপাশে লাইন করে দাঁড়াতেই বাকি তিনজন ঈর্ষার চোখে ওদের দেখতে লাগল।

স্পিকারে ইনস্ট্রাকটরের নির্দেশ শোনা গেল।

‘গার্ডস, যারা উন্ডেড কিংবা ফিনিশড তাদের বডি সরিয়ে ফ্যালো—কুইক।’

সঙ্গে-সঙ্গে রোবট গার্ডগুলো নড়েচড়ে উঠল। যান্ত্রিক দক্ষতায় কাজ শুরু করল।

জিমের শেষ প্রান্তের দেওয়ালে সার বেঁধে অনেকগুলো ফর্ক লিফট দাঁড়িয়ে ছিল। একজন গার্ড পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে ফোন করতেই চারটে ফর্ক লিফট গড়গড় করে এগিয়ে এল। ওদের সামনের চাকার ঠিক ওপরে দুটো লম্বা স্টিলের পাত চামচের মতো সামনে বাড়ানো। চারজন ফর্ক লিফট অপারেটর দারুণ দক্ষতার সঙ্গে মেঝেতে পড়ে থাকা দেহগুলো চটপট তুলে নিল স্টিলের পাতের ওপরে। তারপর চারটে যন্ত্র সার বেঁধে বেরিয়ে গেল জিম থেকে। দুজন গার্ড তার পিছন-পিছন দৌড়ল।

একমিনিটেরও কম সময়ে দেহ এবং মৃতদেহ—সবই সরিয়ে ফেলল ওরা।

তার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই একটা ছোট হুড খোলা সাদা গাড়ি ঢুকে পড়ল জিমে। গাড়িটার গায়ে বড় হরফে একটা লাল রঙের যোগচিহ্ন আঁকা। তার নীচে ছোট করে লেখা ‘মেডিকেল ইউনিট’।

সাদা গাড়ি থেকে নেমে এল দুজন পুরুষ ও দুজন মহিলা। ওদের হাতে ডাক্তারি বাক্স। ওরা চটপট জিশান, মনোহর আর রণজিতের প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করল।

পাঁচ কি সাতমিনিট—তার মধ্যেই ওদের কাজ শেষ। তারপর ওরা নির্বিকার ভঙ্গিতে গাড়িতে উঠে পড়ল। গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে গেল জিম থেকে।

জিশানের হঠাৎই খেয়াল হল, মেডিকেল ইউনিটের কেউই কারও সঙ্গে একটি কথাও বলেনি।

ইনস্ট্রাকটর এবার একটা কম্পিউটার প্রিন্টআউট দেখে বললেন, ‘কনগ্র্যাচুলেশানস, জিশান। কনগ্র্যাচুলেশানস, মনোহর। কনগ্র্যাচুলেশানস, রণজিৎ। আপনারা কিল গেম-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডের প্রথম খেলায় কোয়ালিফাই করলেন। এই প্রিলি রাউন্ডের প্রথমটায় কোয়ালিফাই করার জন্যে আপনাদের প্রত্যেককে সুপারগেমস কর্পোরেশন দেবে তিরিশ হাজার টাকা। আপনারা এখন গেস্টহাউসে ফিরে যাবেন। আপনাদের যা ডেইলি রুটিন সেটাই কনটিনিউ করবেন। সেকেন্ড রাউন্ডের গেম যখন শিডিউলড হবে তখন আপনাদের সব ডিটেইলস অন-লাইনে জানিয়ে দেওয়া হবে। এনি কোয়েশ্চেনস?’

কথা শেষ করে প্রশ্ন করলেন ইনস্ট্রাকটর।

জিশানরা সবাই এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল : না, ওদের কোনও প্রশ্ন নেই।

‘ও.কে., থ্যাংক য়ু ফর ইয়োর পার্টিসিপেশান। উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট!’

আবার উইশ! এটাকে উইশ না বলে ডেথউইশ বলাই ভালো। ভাবল জিশান।

জিশানের মাইক্রোভিডিয়োফোনের ছোট রঙিন পরদায় মিনির ছবি ভেসে উঠতেই বিছানায় ধড়মড় করে উঠে বসল ও।

মিনি ‘হ্যালো’ বলতেই জিশানের বুকের ভেতরে খুশির বাজনা বেজে উঠল। ও ফোনটা পরম আদরে গালে চেপে ধরল। তারপর ধরা গলায় জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছ?’

মিনি বলল, ‘একটুও ভালো নেই। কিচ্ছু ভালো লাগছে না—।’

জিশান মোবাইল ফোনটা চোখের সামনে ধরল।

পরদায় মিনি কাঁদছে, ওর চোখ থেকে মুক্তো গড়িয়ে পড়ছে।

জিশান জিগ্যেস করল, ‘শানু কেমন আছে?’

‘ও ভালো আছে। ও এখন ছোট…কিছু বোঝে না…তাই ভালো আছে।’ কান্না চেপে মিনি বলল। তারপর ওর ফোনের ক্যামেরাটা শানুর দিকে তাক করে ধরল।

ছবিতে ছেলেকে দেখতে পেল জিশান। ডানহাতের বুড়ো আঙুলটা মুখে গুঁজে দিয়ে ঘুমোচ্ছে।

জিশানের বুক ঠেলে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। কবে আবার ওকে কোলে নিতে পারবে কে জানে!

‘ওরা কখন ফোন দিয়ে গেল তোমাকে?’

‘এই তো, আজ সকালে—।’

শ্রীধর পাট্টা তা হলে কথা রেখেছেন! জিশান চলে আসার দু-দিন পরে হলেও ফোনটা দিয়েছেন!

সিন্ডিকেট হেডকোয়ার্টার থেকে জিপিসিতে আসার পর শ্রীধর জিশানকে এই এমভিপি সেটটা দিয়েছেন। তখন থেকেই জিশান মিনিকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে—কিন্তু পাচ্ছে না। এখন বুঝতে পারল কানেকশান না পাওয়ার কারণ।

তারপর মিনিকে অনেক কথা বলল জিশান। ওর দিন-রাতের জীবনের খবর নিল খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে।

মিনিও অনেক কথা বলল জিশানকে। তারপর কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘কিল গেম-এ তোমাকে জিততে হবে। আমি এখন টিভিতে সবসময় কমপিটিশানগুলো দেখছি। ওরা মাইক্রোভিডিয়োফোনের সঙ্গে-সঙ্গে একটা প্লেট টিভিও দিয়ে গেছে বাড়িতে।’

জিশান রোজ কী করছে সে-কথা জানতে চাইল মিনি। জিশান সময় নিল। ধীরে-ধীরে সব বলল মিনিকে।

জিশানের মনে পড়ে গেল ডিজিটাল জিমের ইনস্ট্রাকটরের কথা : গেস্টহাউসে ফিরে এসে ডেইলি রুটিন কনটিনিউ করতে বলেছেন তিনি।

এখানে আসার পর থেকে এদের ডেইলি রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে জিশান।

ভোর ঠিক ছ’টায় একটি সুরেলা মেয়েলি গলা জিশানকে নাম ধরে ডাকে—ওর ঘুম না ভাঙা পর্যন্ত ডেকেই চলে।

বিছানায় উঠে বসামাত্রই চোখ পড়ে দেওয়ালে লাগানো প্লেট টিভির রঙিন পরদায়। সেই পরদায় একজন সুন্দরী মেয়ের মুখ—ঠোঁটে ওর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের হাসি। এই মেয়েটিই জিশানকে ডাকছিল।

জিশানের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলেছে, ‘গুড মর্নিং, জিশান। তাড়াতাড়ি হাত-মুখ ধুয়ে রেডি হয়ে নাও। শার্প ছ’টা পনেরোয় ওয়ার্কআউট—প্রথম অ্যানালগ জিমে, তারপর আউটডোরে। আজ ঠিক সওয়া ন’টায় তোমার ওয়ার্কআউট শেষ হবে। তারপর…।’

জিশান অবাক হয়ে মেয়েটিকে দ্যাখে। এমনভাবে ও কথা বলছে যেন ওর ঘরেই সশরীরে হাজির রয়েছে। আসলে এই ঘরে কোথাও একটা লুকোনো ক্যামেরা রয়েছে। সেই ক্যামেরার চোখ প্রতিটি মুহূর্তে লক্ষ রাখছে জিশানের ওপরে। এবং ওর ছবি নির্ঘাত পৌঁছে যাচ্ছে জিপিসির কন্ট্রোল রুমে। সেখানেই হয়তো বসে আছে এই সুন্দরী মেয়েটি। সব খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখছে।

এখানে গেস্টহাউসে যে-ক’জন প্রতিযোগী আছে তাদের সকলের জন্যই একইরকম নজরদারির ব্যবস্থা। সেটা জিশান অন্যদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছে।

ঘরের প্লেট টিভিটার সঙ্গে লাগানো রয়েছে ব্ল্যাক কিবোর্ড। অর্থাৎ, দরকারে ওই টিভি পরদাই হয়ে যেতে পারে কম্পিউটারের মনিটর। এবং জিশান ওর যত রাজ্যের প্রশ্নের চটজলদি উত্তর পেয়ে যেতে পারে চব্বিশ ঘণ্টার হেলপলাইনে।

যে-জিমে শুধু ব্যায়াম-ট্যায়াম করা হয় তাকে বলা হয় অ্যানালগ জিম। অ্যানালগ জিমেই শিবপদর সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল জিশানের।

অ্যানালগ জিমে একঘণ্টা ব্যায়ামের পর আধঘণ্টা বিশ্রাম। তখন ওদের ফলের রস, কাজুবাদাম, গ্লুকোজ, ওট মিল এসব খেতে দেওয়া হয়। সেসময় চার-পাঁচজন ছেলে ওদের পরিচর্যা করে। তোয়ালে দিয়ে গা মুছে দেয়, হাত-পা টিপে দেয়। তাদের নাম ‘জিম বয়’।

অ্যানালগ জিমে জিম বয় ছাড়াও আছে ‘জিম গার্ল’। ওরা প্রতিযোগীদের খাওয়া-দাওয়ার দিকটা দ্যাখে আর টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে।

বিশ্রাম শেষ হলে আউটডোর ওয়ার্কআউট।

কতরকম অভিনব ব্যবস্থা সেখানে! মাঠের ওপরে দৌড় প্র্যাকটিস, তারপর বালির ওপরে দৌড়, আর সবার শেষে জলের ওপরে দৌড়।

জলের ওপরে দৌড় বলতে একটা বিশাল মাপের চৌবাচ্চা। তার একপ্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্তের মানুষকে এত ছোট দেখায় যে, ভালো করে চেনা যায় না। চৌবাচ্চায় দেড় ফুট মতন জল আছে। প্রতিযোগীদের সেই জল ভেঙে দৌড়তে হয়। কিছুক্ষণ দৌড়নোর পর বিশ্রাম—তারপর আবার দৌড়।

ব্যায়ামের পর্ব শেষ হলে গেস্টহাউসের ঘরে ফিরে আসে জিশান। শীতাতপ ঘরগুলোর ব্যবস্থা এমনই যে, ফাইভ স্টার হোটেলকেও হার মানায়। সেই ঘরের আরামে কাটে ঘণ্টাখানেক। তারপর টিভিতে পাওয়া নির্দেশ অনুসারে যেতে হয় লেকচার হলে। সেখানে রোজই একজন করে অভিজ্ঞ বক্তা আসেন—ভিডিয়ো ফিল্ম দেখিয়ে আর্মড কমব্যাট আর আনআর্মড কমব্যাট শেখান। তারই মধ্যে শেখানো হয় কতরকমের আর্মস আর অ্যাম্যুনিশানস আছে—কীভাবে কোন-কোন পরিস্থিতিতে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়। আরও শেখানো হয় গেরিলা যুদ্ধ।

সবচেয়ে জিশানের যেটা অবাক লাগে সেটা হল, কখনও কোথাও কিল গেম-এর নাম করতে চায় না কেউ। এমনকী ইনশিয়োরেন্সের ফর্ম ফিল-আপ করার সময়েও কিল গেম না লিখে নির্দেশমতো লিখতে হয়েছিল হাই রিসক গেম। শুধুমাত্র বন্ড সই করার সময় কিল গেম নামটা ফর্মে দেখতে পেয়েছিল জিশান।

লেকচার হলে ক্লাস শেষ হলে জিশানরা ফিরে আসে গেস্টহাউসে। খাওয়া-দাওয়া করে বিশ্রাম নেয়। তারপর বিকেলে যায় মাঠে খেলতে। সেখানে ভলিবল কিংবা ফুটবল খেলা হয়—নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ারকি চলে। তবে না চাইলেও কারও-কারও সঙ্গে একটু-আধটু আলাপ জমে যায়।

কথা বলে জিশান জেনেছে, পার্টিসিপ্যান্টদের সকলের রেজিস্ট্রেশান কিল গেম-এ নয়। অন্যান্য গেম-এও অনেকের রেজিস্ট্রেশান রয়েছে। তবে যেহেতু সব খেলাতেই বডি স্কিল দরকার সেহেতু অ্যানালগ জিম, আউটডোর ওয়ার্কআউট, খেলাধুলো—এগুলো সকলের জন্য।

সন্ধেবেলা জিশানদের শিডিউল হল ফিল্ম শো। জিপিসির এ.সি. অডিটোরিয়ামে সন্ধেবেলা যত রাজ্যের অ্যাকশান ফিল্ম দেখানো হয়। পুরোনো আমলের অ্যাকশান ফিল্মও নিয়ে আসা হয় ফিল্ম আর্কাইভ থেকে।

এই ফিল্মগুলো দেখার সময় একটা অদ্ভুত ব্যাপার জিশান লক্ষ করেছে। যে-কোনও অ্যাকশান সিকোয়েন্স দেখানো হয়ে যাওয়ার পরই সেটাকে আবার স্লো-মোশানে দেখানো হয়। যাতে অ্যাকশান দৃশ্যের খুঁটিনাটি সব দর্শক ভালো করে বুঝতে পারে।

সিনেমা দেখার পালা শেষ হলে কিল গেম পার্টিসিপ্যান্টদের জন্য দিনের শেষ প্রাোগ্রাম আর্মস একজিবিশান অ্যান্ড ট্রেনিং। আর্মস একজিবিশানে নানান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র দেখানো হয়। সেগুলো কেমন করে কাজ করে সেটাও দেখিয়ে দেয় একজন ডেমনস্ট্রেটার। তার পাশেই থাকে একান্ন ইঞ্চি পরদার প্লেট টিভি। ডেমনস্ট্রেটারের ডেমো শেষ হলে টিভির পরদায় অডিয়োভিশুয়াল ডেমো শুরু হয়। তাতে দরকার মতো ক্লোজ-আপ ছবি থাকে। কারও বুঝতে অসুবিধে হলে অসুবিধের জায়গাটা রিপ্লের ব্যবস্থা আছে।

লাইভ ডেমো আর টিভি ডেমো শেষ হলে শুরু হয় হ্যান্ডস-অন ট্রেনিং। জিশানদের নিয়ে যাওয়া হয় শুটিং রেঞ্জে। সেখানে একটি ঘণ্টা ঘাম-ঝরানো ট্রেনিং-এর পর ওদের ছুটি। তখন জিশানরা গেস্টহাউসের ঘরে বিছানায় শুয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম নেয়। প্লেট টিভিতে নানারকম হালকা এবং মজার প্রাোগ্রাম দ্যাখে। তারপর রাতের খাওয়া এবং ঘুম।

জিশানদের একটা দিন শেষ।

সব শোনার পর মিনি বলল, ‘জিশান, ভাবতে কী অবাক লাগে, না? মানুষকে কীভাবে মারতে হয় সেটা শেখানোর জন্যে এত চেষ্টা, এত খরচ!’

‘মিনি, এখানে বাঁচা শিখতে হলে মারতে শিখতে হয়। ফিরে গিয়ে তোমাকে আমি শিবপদর কথা শোনাব।’

‘কে শিবপদ?’

‘একজন কিল গেম পার্টিসিপ্যান্ট…ও মারা গেছে…আজ সকালে… আমার হাতে…।’ জিশানের গলা ভেঙে গেল।

‘কী বলছ তুমি! তোমার হাতে মারা গেছে! তুমি খুনি হয়ে গেছ!’

‘হ্যাঁ, মিনি, হ্যাঁ। ওকে না মারলে ও আমাকে মেরে ফেলত। তুমি আমার সঙ্গে এমভিপিতে আর কথা বলতে পারতে না…।’ জিশান শত চেষ্টা করেও কান্না চাপতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পর ও নরম গলায় জিগ্যেস করল, ‘মিনি, তুমি চাও না আমি তোমার কাছে ফিরে যাই? তুমি চাও না, ছোট্ট শানু দু-হাত সামনে বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুক আমার কোলে?’

‘হ্যাঁ—চাই, চাই, চাই!’ উত্তেজিতভাবে কথা বলতে গিয়ে মিনির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল।

মাথা নিচু করে জিশান বলল, ‘যদি তাই চাও, তা হলে আমাকে খুনি হতে হবে। বেশ কয়েকজনকে খতম করতে হবে। তুমি জানো না, কিল গেম-এ সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর মাত্র 0.07। খুব উঁচুদরের খুনি না হলে এ-খেলা থেকে বেঁচে ফেরা ইমপসিবল। তোমার আর শানুর জন্যে আমাকে হার্ট অ্যান্ড সোল চেষ্টা করতে হবে…।’

‘তাই করো…’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল মিনি, ‘…পরের খেলাগুলোয় জেতার চেষ্টা করো। তোমার আজকের খেলাটা টিভি পাইনি বলে দেখতে পারিনি। পরেরগুলোর লাইভ টেলিকাস্ট দেখব। তুমি মনে রাখবে, আমি তোমার গেম শো দেখছি। মনে রাখবে তো? তোমাকে জিততেই হবে, জিশান…।’ কেঁদে ফেলল মিনি। হাতের পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। নিজেকে সামলে নিতে সময় নিল কিছুক্ষণ। তারপর গোটা-গোটা চোখ মেলে তাকাল জিশানের দিকে। ইতস্তত করে বলল, ‘এই জঘন্য ব্যাপারটা একেবারে বন্ধ করা যায় না?’

‘কে জানে! হয়তো যায়। কিন্তু অভাব আর লোভ বড় অদ্ভুত কম্বিনেশান। ওল্ড সিটির মানুষরা এত অভাবের মধ্যে আছে…তার ওপর দিন-রাত প্লেট টিভিতে ওদের লোভ দেখানো হচ্ছে। দিনকেদিন আমাদের অবস্থাটা খুব কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছে…।’

‘কিছু একটা করা যায় না?’ ফিসফিস করে জিগ্যেস করল মিনি।

জিশানের মনে হল, প্রশ্নটা মিনি ওকে করেনি—বরং ছুড়ে দিয়েছে সকলের দিকে।

ও বলল, ‘দশমিনিট হয়ে গেছে, মিনি। রাখছি। নইলে ওরা মাঝপথে কানেকশান অফ করে দেবে। ভালো থেকো…।’

মিনি কিছু বলার আগেই কানেকশানটা সত্যি-সত্যি অফ হয়ে গেল।

জিপিসিতে প্রত্যেক প্রতিযোগীর জন্য এমভিপিতে কথা বলার রোজকার বরাদ্দ সময় মোট দশমিনিট। কেউ যদি একমিনিট করে কথা বলে, তা হলে দিনে সে দশবার বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারবে। তবে জিশানের পছন্দ একসঙ্গে দশমিনিট খরচ করা। তাতে ও মিনির কাছাকাছি আসার তৃপ্তি পায়।

 ফোনটা কেটে যেতেই সারা দিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল জিশানের ওপরে। একইসঙ্গে ও যেন জিপিসির বাস্তবে ফিরে এল।

আরাম দিয়ে ঘেরা হারাম বাস্তব।

বিকেলে খেলাধুলোর সময় জিশান চুপচাপ মাঠের একপাশে বসে ছিল।

বিশাল মাঠকে ঘিরে বিমূর্ত জ্যামিতিক ধাঁচের অনেকগুলো লম্বা-লম্বা বাড়ি। তার মধ্যে একটা জিশানদের গেস্টহাউস।

কাচ বা আয়নায় ঢাকা সুন্দর ছাঁদের বাড়ি ছাড়াও রয়েছে সাজানো বাগান আর দিঘি। ওপরের নীল আকাশে কখনও-কখনও চোখে পড়ছে শিস দিয়ে উড়ে যাওয়া শুটার।

সবমিলিয়ে জায়গাটা এত সুন্দর যে, ওল্ড সিটির কোনও বাসিন্দার কাছে এসব নেহাতই স্বপ্ন। তবে সেই স্বপ্নের আড়ালে রয়েছে মৃত্যুর গন্ধ।

জিশান জানে, যতই সাজানো-গোছানো হোক, ব্যাপারটা আসলে আধুনিক জেলখানা ছাড়া আর কিছুই নয়।

গত দু-দিন ধরে জিশান কিল গেম-এর পার্টিসিপ্যান্টদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছিল। বুঝতে চাইছিল, আর ক’জন প্রতিযোগী এখনও কিল গেম-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডে রয়েছে। আর্মস একজিবিশান অ্যান্ড ট্রেনিং প্রাোগ্রামে আরও জনাদশেক ছেলেকে ও দেখেছে—কিন্তু ওরাই কি সব? ওদের মধ্যে রণজিৎ পাত্র আর মনোহর সিং-কে ও চেনে। বাকিদের নাম-ধাম পরিচয় কিছুই জানে না।

মাঠের ধারে বসে খেলোয়াড়দের মুখগুলো লক্ষ করছিল ও। সকলের মুখেই স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। যেন খেলাটাই ওদের জীবন।

মনোহর আর রণজিৎ ফুটবল খেলছিল। খেলতে-খেলতে মনোহর বারবার তাকাচ্ছিল জিশানের দিকে—হাতছানি দিয়ে ওকে ডাকছিল। আর জিশান হাত নেড়ে ইশারা করে বোঝাছিল যে, না, ওর খেলতে ভালো লাগছে না।

জিশানের কাছাকাছি একজন গার্ড পাথরের মতো মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আবার একইসঙ্গে খুব নিচু গলায় গুনগুন করে গানের কলি ভাঁজছিল।

ব্যাপারটা জিশানকে অবাক করেছিল, কারণ এ ক’দিনে পিস ফোর্সের গার্ডগুলোকে ও রোবট বলে ভাবতে শিখেছে। ওরা তা হলে মানুষ! শখ করে গান গায়!

জিশান গার্ডটাকে ভালো করে দেখল।

মেদহীন টান-টান শরীর। ফরসা। বয়েস তেইশ কি চব্বিশ। গাল দুটো সামান্য বসা। কালো আর সোনালি ইউনিফর্মে দারুণ স্মার্ট দেখাচ্ছে। কোমরে ঝোলানো নীল রঙের শকার বিকেলের আলোয় ঝকঝক করছে।

গার্ডটা সামনের দিকে তাকিয়ে ছিল। মুখ একটুও না ঘুরিয়ে ও আড়চোখে জিশানের দিকে তাকাল। গুনগুন থামিয়ে নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী? শরীর খারাপ?’

জিশান বলল, ‘না—।’

‘তা হলে? খেলছ না?’

‘খেলতে ভালো লাগছে না।’

‘কী করে ভালো লাগবে? সামনে বিপদ…।’

জিশান অবাক চোখে গার্ডটার দিকে তাকিয়ে রইল। পিস ফোর্সের একজন গার্ড জিশানদের বিপদ নিয়ে ভাবে!

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর গার্ডটা বলল, ‘তোমার আসল খেলার ডেট কবে?’

‘এখনও জানি না।’

‘কোন খেলায় নাম দিয়েছ?’

‘কিল গেম।’ একটু থেমে জিশান আবার যোগ করল, ‘আমি নাম দিতে চাইনি। ওরা জোর করে নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে…।’

‘জানি।’ গার্ডটা একচিলতে বিষণ্ণ হাসল : ‘ওরা এইরকমই করে—সবাইকেই। তোমার বাড়িতে কে-কে আছে?’

জিশান বলল।

শুনে গার্ডটা জিশানের দিকে একবার তাকাল, তারপরই মুখ ফিরিয়ে নিল সামনের দিকে।

ঠিক তখনই মনোহরদের ফুটবলটা লাফাতে-লাফাতে চলে এল জিশানের কাছাকাছি। জিশান উঠে গিয়ে বলটা ধরে ফেলল।

একটা ছেলে ছুটতে-ছুটতে এল জিশানের কাছে। বলটার জন্য হাত বাড়াল। জিশান বলটা ওকে ছুড়ে দিল।

হাঁপাতে-হাঁপাতে ‘থ্যাঙ্কস’ বলল ছেলেটা। তারপর বলটা হাতে নিয়ে ছুটে চলে গেল ‘থ্রো-ইন’ করতে।

গার্ডটা আড়চোখে একবার দেখল জিশানের দিকে। জিশান এখন ওর অনেক কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। তাকিয়ে আছে ওর দিকেই।

গার্ডটা বলল, ‘কেয়ারফুল। এখানে নানান জায়গায় লুকোনো ক্যামেরা লাগানো আছে। ওদের নজরকে ফাঁকি দেওয়ার জো নেই।’

এ-কথায় জিশান অন্যদিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াল, কিন্তু গার্ডটার সঙ্গে দূরত্ব কমাল না। হয়তো কথায়-কথায় ওর কাছ থেকে কিছু নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। তাতে লাভ কতটুকু হবে জিশান জানে না—তবে কৌতূহল খানিকটা মিটবে।

গার্ডটা চাপা গলায় বলল, ‘তুমি যদি শেষ পর্যন্ত ছেলের কাছে ফিরে যেতে পারো তা হলে সেটা ফ্যানট্যাসটিক ব্যাপার হবে, তাই না?’

‘হ্যাঁ—।’ একটু থেমে তারপর : ‘কেউ কি ফিরে যেতে পেরেছে আজ পর্যন্ত?’

‘আমি তো কাউকে দেখিনি। আমার চাকরি প্রায় পাঁচবছর হয়ে গেল…।’

‘ওরা যে বলছে, কিল গেম-এ সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর 0.07—মানে, একশোজনের মধ্যে সাতজন বেঁচে যায়…।’

গার্ড হেসে ফেলল : ‘ওদের সবকথা তুমি বিশ্বাস করো নাকি! আইনের মারপ্যাঁচ বুঝে-শুনে তারপর ওদের অফিশিয়াল গেমস প্রাোগ্রাম তৈরি করা হয়। শ্রীধর পাট্টা—আমাদের পিস ফোর্সের মার্শাল—লোকটা একটা কসাই। তার ওপরে মহা ধুরন্ধর। ওই সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টরটা যদি আসলে 0.0 হয় তা হলেও আমি অবাক হব না।’

গার্ড বলে কী!

জিশানের খুব ইচ্ছে করল, গার্ডটার দিকে ঘুরে তাকায়, এ নিয়ে আরও প্রশ্ন করে। কিন্তু লুকোনো ক্যামেরার কথা ভেবে পারল না। রাগে ওর চোয়াল শক্ত হল শুধু।

গার্ড আবার বলল, ‘তুমি মন খারাপ কোরো না। আমি ফস করে সত্যিটা বলে ফেললাম। কিল গেম-এ কেউই খুব একটা আশা নিয়ে আসে না। তবে সিন্ডিকেট চায় লড়াইটা খুব জমে উঠুক। তা হলে লড়াই চলবে অন্তত পনেরো কি কুড়ি ঘণ্টা। তাতে পাবলিকের যেমন বেশিক্ষণ ধরে এনটারটেইনমেন্ট হবে, তেমনই বিজ্ঞাপনের ইনকাম অনেক বেড়ে যাবে।’ গার্ড নাক দিয়ে ফোঁস করে একটা শব্দ করল : ‘বুঝলে, এরা সবকিছু পয়সা দিয়ে মাপে। এমনকী দোকানে মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনতে গেলে বলে না ”এক লিটার কি দু-লিটারের বোতল দাও।” বলে, ”ষাট টাকার জল দাও।” নয়তো ”একশো টাকার জল দাও।” স্কুল-কলেজেও সেইরকমই শেখায়। অসহ্য!’

‘অসহ্য লাগছে তাও এখানে চাকরি করছ?’

‘হ্যাঁ, করছি। দু-বেলা খেতে হবে তো! নিউ সিটিতে সিন্ডিকেটই শেষ কথা। আমাকে ওরা চাকরি দিয়েছে। মাসে-মাসে মাইনে পাচ্ছি, খেতে-পরতে পাচ্ছি—ব্যস। চাকরিটা না করলে হয়তো আমাকে ওল্ড সিটিতে গিয়ে দু-বেলা অভাবের মধ্যে কাটাতে হত।’

জিশান বলল, ‘ওল্ড সিটিতে অভাব আছে—কিন্তু স্বাধীনতাও আছে।’

‘হুঁ:!’ ব্যঙ্গে ঠোঁট বেঁকাল গার্ড : ‘স্বাধীনতা! সেটা আবার কী—গায়ে মাখে, না মাথায় দেয়? এখানে চাকরি করতে-করতে তোমার মতো অনেক স্বাধীন নাগরিককেই তো দেখলাম! একটার-পর-একটা চোখের সামনে খরচ হয়ে যাচ্ছে। যেগুলো বেঁচে ফিরছে, সেগুলো কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা জিতে নিউ সিটিতে থেকে যাচ্ছে—সিন্ডিকেটের পোষা কুকুর হয়ে যাচ্ছে।’

‘এর কি কোনও শেষ নেই?’ বিভ্রান্তের মতো প্রশ্ন করল জিশান।

‘কী করে শেষ হবে! সবাই তো ভগবানের ভরসায় বসে আছে। ভগবান ওখানে আছে কি না আমি জানি না—’ ছোট্ট ইশারা করে আকাশের দিকে আঙুল তুলল গার্ড, বলল, ‘তবে সোজাসাপটা যা বুঝি, যা করার মানুষকেই করতে হবে…।’

গার্ডটাকে ভারি অদ্ভুত লাগছিল জিশানের। ঠিক এই কথাগুলোই ও একা-একা কতবার ভেবেছে। কিছু একটা করা দরকার। ওল্ড সিটির মুষড়ে পরা গুঁড়িয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কথা মনে পড়ল জিশানের। পচে যাওয়া মানুষের শরীরে যেসব জঘন্য পোকামাকড় বাসা বাঁধে তাদের মতো নোংরা ক্লেদাক্ত জীবন নিয়ে বেঁচে আছে জিশানরা। অসহ্য এই জীবন।

জিশান ঠিকই বলেছিল মিনিকে : লোভ আর অভাব বড় অদ্ভুত কম্বিনেশান। এই কম্বিনেশানের বিরুদ্ধে লড়াই করা সহজ নয়। তা সত্বেও মিনির কথাটা বারবার মনে পড়ছিল জিশানের : ‘কিছু একটা করা যায় না?’

গার্ড ঠিকই বলেছে। যা করার মানুষকেই করতে হবে।

জিশান ওকে বলল, ‘ঠিকই বলেছ। আমরা কিছু করছি না, তাই আমাদের কপাল ফিরছে না। কিন্তু তুমি কি এখানে খুব সুখে আছ?’

জিশানের দিকে আড়চোখে চাইল গার্ড, বলল, ‘শোনো ভাই, এখানে এমনিতে সুখে থাকলেও মনে শান্তি নেই। আমি তো ঠিক করেছি, আর পাঁচবছর চাকরি করব এখানে। তারপর চাকরি ছেড়ে জমানো টাকা সঙ্গে নিয়ে সোজা কেটে পড়ব দেশের বাড়িতে।’

‘কোথায় তোমার দেশ?’

‘নাহাইতলা গ্রামে—মেদিনীপুর স্টেশানে নেমে আরও বাইশ কিলোমিটার উত্তরে যেতে হয়।’

‘তোমার দেশ কেমন? ভালো?’

‘ভালো মানে! একেবারে ছবির মতো গ্রাম। কী সুন্দর! শান্ত, নরম।’

কোনও গ্রাম যে ‘নরম’ হতে পারে সেটা জিশানের জানা ছিল না। কিন্তু তবুও ওর মনে হল, গার্ড কী বলতে চাইছে সেটা ও বুঝতে পেরেছে।

গার্ডের সঙ্গে কথা বলে জিশানের ভালো লাগছিল। মানসিক চাপটা কিছুটা কমে গেছে বলেও মনে হল। কিল গেম-এর চ্যালেঞ্জটাকে নতুনভাবে দেখতে চাইছিল জিশান। ভাবল, রাতে ও মিনির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবে।

‘তোমার কি সারা দিন ডিউটি?’ গার্ডকে জিগ্যেস করল জিশান।

‘না, শিফট ডিউটি। এখন দুটো-দশটার ডিউটিতে আছি। নেক্সট উইক থেকে ছ’টা-দুটো।’

‘তোমার সঙ্গে কাল দেখা হবে?’

‘কেন হবে না? এখানেই ডিউটিতে থাকব আমি। পরের সপ্তাহ থেকে অ্যানালগ জিমে ডিউটি। ওই দ্যাখো—খেলা শেষ।’

জিশান দেখল, খেলা শেষ করে মনোহর-রণজিৎরা ফিরে আসছে।

জিশান গার্ডকে বলল, ‘আজ আসি—।’

গার্ড পাথরের মতো মুখ করে সামনের দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কাল দেখা হবে।’

জিশান নাহাইতলা গ্রামের ছেলেটার দিকে একপলক তাকিয়ে মনোহরের দিকে এগিয়ে গেল।

ও মনোহরের কাছাকাছি পৌঁছে যেতেই হাত বাড়িয়ে দিল মনোহর। জিশানও হাত বাড়িয়ে দিল।

মনোহর জোরালো মুঠোয় জিশানের হাতটা আঁকড়ে ধরে বলল, ‘জিতে গেছি, জিশান ভাইয়া।’

জিশান তখনও বোধহয় একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। ও ভাবল, সিন্ডিকেটের সঙ্গে লড়াইয়ে মনোহর জিতে গেছে। তাই বিড়বিড় করে বলল, ‘আর তা হলে আমাদের কোনও ভয় নেই। এবার থেকে আর অন্যের ফুর্তির জন্যে মানুষ মরবে না।’

জিশানের কথার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারল না মনোহর সিং। ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল জিশানের দিকে।

কিছুক্ষণ পর মনোহর বলল, ‘কী সব আনসান বকছ, জিশান ভাইয়া। আমরা ফুটবল খেলায় জিতে গেছি। তিন-দুই গোলে। অব সমঝে আপ?’

জিশান ঘোর কাটিয়ে মাটিতে নেমে এল। একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘সরি, মনোহর। আমি অন্য কথা ভাবছিলাম। কনগ্র্যাচুলেশানস।’

ওরা পাশাপাশি হেঁটে চলল গেস্টহাউসের দিকে। জিশান পিছন ফিরে গার্ড ছেলেটিকে একবার দেখল। তারপর মনোহরকে বলল, ‘তোমাকে একটা খবর দেব…।’

‘কী খবর?’ বাচ্চা ছেলের কৌতূহল নিয়ে জিশানের মুখের দিকে তাকাল মনোহর।

‘কিল গেম-এর সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টরটা 0.07 নয়। এটা হয়তো সিন্ডিকেটের বানানো। আসল সারভাইভ্যাল ফ্যাক্টর জিরোও হতে পারে—।’

মনোহর সিং-এর মুখটা পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ও চাপা গলায় জানতে চাইল, ‘কী করে জানলে?’

জিশান বলল।

শুনে শব্দ করে মাটিতে থুতু ফেলল মনোহর, বলল, ‘ইয়ে লোগ বহত কামিনা হ্যায়।’

জিশান কোনও কথা বলল না। ওরা পায়ে-পায়ে চলে এল গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর ভেতরে।

ভেতরটা যথারীতি এয়ারকন্ডিশানড। একেবারে সুপারস্টার হোটেলের মতো সাজানো। সব জায়গাতেই ঝকঝকে মার্বেল—সেখান থেকে প্রতিফলিত আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। জিপিসির এই বিশাল বিল্ডিং-এর আটাশ, উনতিরিশ আর তিরিশ—এই তিনটে ফ্লোর নিয়ে পার্টিসিপ্যান্টদের গেস্টহাউস। বাকি ফ্লোরগুলোয় নানান কন্ট্রোল রুম আর অফিশিয়াল গেস্টদের জন্য সুপারকমফোর্ট পেন্টহাউস। নিরাপত্তার কারণে সুপারগেমস কর্পোরেশনের এমপ্লয়ি আর গেস্টদের ঢোকার-বেরোনোর পথ জিশানদের থেকে আলাদা। গেমস পার্টিসিপ্যান্টদের স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করলে যেসব দরজা খুলে যায় সেগুলো দিয়ে অবাধে তারা যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু নিষিদ্ধ এলাকার কোনও দরজাই তাদের স্মার্ট কার্ড টেনে খোলা যায় না।

এইরকম ঝিকিমিকি ফ্যাশানদুরস্ত লবিতে জিশানদের হলদে গেঞ্জি আর কালো বারমুডা প্যান্ট বেশ বেমানান লাগছিল। তার ওপর পোশাকের এখানে-সেখানে কাদা-মাখানো ফুটবলের রাবার স্ট্যাম্প। কিন্তু যেহেতু এই গেস্টহাউসে সব গেমস পার্টিসিপ্যান্টরাই রয়েছে, সেহেতু জিশানদের অস্বস্তি হওয়ার কোনও কারণ নেই।

পিস ফোর্সের গার্ডরা তাদের জায়গামতো কাঠের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়ে।

জিশানরা কয়েকজন অটো-এলিভেটরে উঠল। আটাশ নম্বর বোতাম টিপল।

আগাপাস্তলা স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি বিশাল মাপের এলিভেটর। তবে এটা অডিয়ো অ্যাকটিভেটেড নয়। এর ভেতরে অন্তত বিশজন এঁটে যায় অনায়াসে। কিন্তু একটা মেটাল প্লেটে সবচেয়ে বেশি আঠেরোজন যাত্রীর কথা লেখা আছে।

জিশান দেখল, পিস ফোর্সের একজন গার্ড ভেতরে মোতায়েন হয়ে দাঁড়িয়ে। জিশানরা গার্ডের কাছ থেকে দূরত্ব রেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

অটো-এলিভেটরে করে ওপরে ওঠার সময় জিশান লক্ষ করল, রণজিৎ পাত্রও ওদের সঙ্গে উঠেছে। বারবার অন্যদের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় আঁচ করতে চাইছে, এরপর ওকে কার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।

ওকে দেখতে পেয়েই জিশান মুখে কুলুপ আঁটল। রণজিতের সঙ্গে কথা বলতে ওর একটুও ইচ্ছে করে না। তা ছাড়া রণজিতের স্বভাবই হচ্ছে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধানো। ঝগড়া বেধে যাওয়ার পর ও হাত চালাতে ভালোবাসে।

মনোহর সিং রণজিৎকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তাই ওর সঙ্গে মনোহরের তেমন মাখামাখিও নেই, আবার ঝগড়াও নেই। রণজিৎ যে একইসঙ্গে এলিভেটরে উঠেছে সেটাও বোধহয় ভালো করে খেয়াল করেনি মনোহর।

ও জিশানকে লক্ষ করে বলল, ‘ঘরের কী খবর? বিবি, বাচ্চা সব ঠিক আছে তো?’

জিশান হেসে ঘাড় নাড়ল—মুখে কিছু বলল না।

মনোহর বলল, ‘আমি পিস ফোর্সের একজন ডেপুটিকে বলেছিলাম, আমার তো ঘরে কথা বলার কেউ নেই—তো আমার কোটার দশমিনিট জিশান পালচৌধুরীর কোটায় লাগিয়ে দিন—ও ফ্যামিলি ম্যান আছে—টাইমটা ওর কাজে লাগবে। তো সালা বলল যে, নামুমকিন—নহি হো সকতা…।’

মনোহরের কথায় মজা পেলেও হাসতে পারল না জিশান। কারণ, অটো-এলিভেটরে ওদের সঙ্গে পিস ফোর্সের গার্ড রয়েছে। ও সতর্ক চোখে গার্ডটার দিকে তাকাল।

না, মনোহরের ‘শালা’ শব্দটা গার্ডটাকে বিশেষ বিচলিত করেনি।

কিন্তু রণজিৎ বোধহয় বিচলিত হয়েছিল। কারণ, ও হা-হা করে হাসিতে ফেটে পড়ল।

অটো-এলিভেটরের সবাই অবাক হয়ে রণজিতের দিকে তাকাল।

জিশান আগেই লক্ষ করেছিল, এলিভেটরে পিস ফোর্সের গার্ড ছাড়া আর ছ’জন পার্টিসিপ্যান্ট রয়েছে। জিশান, মনোহর আর রণজিৎকে বাদ দিলে বাকি যে-তিনজন, তার মধ্যে একজন, খোকন, মনের দিক থেকে মনোহরের কাছাকাছি, আর বাকি দুজন রণজিতের। জিপিসিতে যে একটা চাপা দলবাজির ব্যাপার আছে সেটা দ্বিতীয় দিন থেকেই টের পেয়েছে জিশান—অনেকটা জেলখানার দলবাজির মতো। এখন সেটা আরও স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল।

রণজিতের হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওর বাকি দুজন জিগরিও দাঁত বের করেছিল। সেটা দেখে জিশানের গা জ্বলে যাচ্ছিল। যদিও ওরা কেন হাসছে সেটা জিশান বা মনোহর কেউই বুঝতে পারছিল না।

শেষ পর্যন্ত রণজিৎ অতিকষ্টে অট্টহাসি থামিয়ে বলল, ‘ফ্যামিলি ম্যান আবার কিল গেম কী লড়বে! কী রে, হাসান! কী রে, পাপুয়া! বল…।’

হাসান আর পাপুয়া জিশানের দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছিল। পাপুয়া হাসির ফাঁকে-ফাঁকে বলল, ‘ওস্তাদ, এ মালটা আবার ফাস্ট রাউন্ডে পাশ হয়ে গেছে।’

মনোহর মারমুখী হয়ে রণজিতের দিকে একটা পা বাড়িয়েছিল, জিশান ওর হাত ধরল—চাপ দিল—ওকে থামতে ইশারা করল।

রণজিৎ ব্যাপারটা লক্ষ করেছিল। ও হঠাৎ মনোহরের সামনে এসে জোড়হাত করে আচমকা হাঁটুগেড়ে বসে পড়ল। ভিক্ষে চাওয়ার সুরে ইনিয়েবিনিয়ে বলল, ‘ক্ষমা, স্যার, ক্ষমা। প্লিজ, মারবেন না। আমার ভয় করছে। আর কোনওদিন এরকম করে হাসব না, স্যার—।’

ব্যাপারটা দেখে জিশান আর মনোহর হতভম্ব হয়ে গেল। কেমন যেন বিব্রত হয়ে পড়ল।

রণজিৎ যে আসলে মনোহরকে ব্যঙ্গ করে ভয় পাওয়ার অভিনয় করছে এটা বুঝতে জিশান বা মনোহরের পাঁচ-দশ সেকেন্ড সময় লেগে গেল।

ব্যাপারটা যে আসলে কী সেটা ওরা বুঝতে পারল হাসান আর পাপুয়ার লবঙ্গলতিকা হাসি দেখে। ওরা দুই সখীর মতো হাসতে-হাসতে এ-ওর গায়ে ঢলে পড়ছে। সেইসঙ্গে বলছে, ‘আবে, আমাদের বস রেগে গেছে। চল, গিয়ে ক্ষমা চাই…।’

গার্ডটাকে পাত্তা না দিয়েই হাসান আর পাপুয়া প্রায় ছুটে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মনোহরের পায়ের কাছে—রণজিতের দুপাশে।

কাঁদুনে সুরে হাসান বলল, ‘আর করব না, স্যার। ভুল হয়ে গেছে। আমাদের মারবেন না—প্লিজ।’

জিশান আর মনোহর কিছুটা পিছিয়ে গেল। খোকন ওদের পাঁচজনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল। আর পিস ফোর্সের গার্ড তার শকারটা কোমর থেকে খুলে হাতে নিল। তারপর সুইচটা অন করে অটো-এলিভটরের একপ্রান্তে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল। এবার সে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মজা দেখবে। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তা হলে শকার ব্যবহার করবে। আর তাতেও যদি হালে পানি না পাওয়া যায় তা হলে এলিভেটরের ইমার্জেন্সি হেলপ বোতাম টিপবে।

হঠাৎই সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রণজিৎ।

ওঠার সময় ও ঝুঁকে পড়েছিল মনোহরের দিকে। হিসেবটা এমন ছিল যাতে ওর মাথাটা মনোহরের থুতনির ঠিক নীচে ধাক্কা খায়।

রণজিতের হিসেবে ভুল ছিল না। ওর মাথার সঙ্গে মনোহরের থুতনির সংঘর্ষ হল। আর একইসঙ্গে ও পিছিয়ে এসে প্রচণ্ড শক্তিতে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিল মনোহরের গালে।

মনোহর এসবের বিন্দুবিসর্গ আঁচ করতে পারেনি। তাই দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে মার খেল। ওর শরীরটা হেলে পড়ল এলিভেটরের দেওয়ালে। আর থাপ্পড়ের চোটে মাথাটা এক ঝটকায় ঘুরে গেল একপাশে। ওর ঠোঁটের কোণ দিয়ে রক্তের রেখা গড়িয়ে নামতে লাগল চোয়ালের দিকে।

এখানেই শেষ নয়।

রণজিতের দুই দোস্ত তখনও এলিভেটরের মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে ছিল। ওরা দুজন পশুর মতো চিৎকার করে মনোহরের দু-পায়ের গোড়ালি চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল সামনের দিকে।

মনোহরের খাড়া শরীরটা পলকে চিত হয়ে পড়ল মেঝেতে। আর সঙ্গে-সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা রণজিৎ স্পোর্টস শু দিয়ে জব্বর লাথি বসিয়ে দিল মনোহরের পেটে।

এতক্ষণ পরে যন্ত্রণায় একটা ‘আঁক’ শব্দ বেরিয়ে এল মনোহরের মুখ থেকে। ওর চোখ দুটো কেমন যেন ঘষা কাচের মতো হয়ে গেছে। গাড়ি চাপা পড়া কুকুরের মতো দেহটা নেতিয়ে পড়ে আছে।

জিশান স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। যেন হলে বসে কোনও অ্যাকশান ফিল্ম দেখছে।

খোকনও তাই। নির্বাক দর্শক।

আর গার্ডের মুখে মুচকি হাসি। হাতের নীল শকার অল্প-অল্প দুলছে।

রণজিতের দুই শাগরেদ ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। শব্দ করে তালি দিয়ে হাত ঝাড়ছে আর হাসছে।

জিশান ওদের পাশ কাটিয়ে গার্ডটার কাছে গেল। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমার বন্ধুকে এরকমভাবে মারল…কিছু বললে না?’

জিশানের দিকে রূঢ়ভাবে তাকাল গার্ডটা, বলল, ‘অর্ডার নেই।’

গার্ডটার কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, চোখের পলকে ওর হাত থেকে শকারটা ছিনিয়ে নিল জিশান। এবং ওটা নিষ্ঠুরভাবে চেপে ধরল গার্ডের গায়ে।

সঙ্গে-সঙ্গে এক প্রবল ঝটকা মেরে গার্ডটার দেহ খসে পড়ে গেল মেঝেতে।

সেই মুহূর্তে নিজেকে শ্রীধর পাট্টা বলে মনে হল জিশানের। এখন ও হিংস্রভাবে যা খুশি করতে পারে।

ঠিক তাই করল জিশান।

হাসান বোধহয় মাথায় একটু মাটো। অথবা শকারের ক্ষমতা সম্পর্কে উদাসীন। কারণ, জিশানের হাতে শকার দেখেও ও এতটুকু ভয় পেল না। বরং জিশানের ঊরুসন্ধি লক্ষ করে প্রচণ্ড শক্তিতে পা চালাল।

হাসানের চাপদাড়ি, কালো চোয়াড়ে মুখ, গালের কাটা দাগ, দড়ি পাকানো কঠিন চেহারা বলে দিচ্ছিল যে, হাসান এসব মারপিটের কাজে অভ্যস্ত। হয়তো ও টাকার লোভে পড়েই কিল গেম বা অন্য কোনও গেম-এ নাম দিয়েছে। এবং জিতবে বলে হয়তো আশাও রাখে।

কিন্তু এখানে এসে থেকে জিশান যা করছে তা আসলে জিশানের কাজ নয়—ভেতর থেকে অন্য কেউ ওকে দিয়ে করিয়ে নিচ্ছে। যেমন এখন।

চকিতে একপাশে সরে গিয়ে ঠান্ডা মাথায় হাতের শকারটা হাসানের চাপদাড়িতে চেপে ধরল। লোম আর চামড়া পুড়ে যাওয়ার গন্ধ বেরোল। তারপর রডটাকে ও জোরে-জোরে ঘষে দিল কয়েকবার। ততক্ষণে হাসানের লাথিটা ওর কোমরের কাছে এসে লেগেছে।

ঘুষি মারতে একটা হাত শূন্যে তুলেছিল হাসান। কিন্তু শকারের হাই ভোল্টেজ শক খাওয়ার পর ওর হাত তোলা অবস্থাটা অনেকটা ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ ভঙ্গির মতো দেখাল। ওর শরীরের ভারকেন্দ্রটা সেই মুহূর্তে একটু পিছনদিকে থেকে যাওয়ায় হাসান পিছনদিকেই উলটে পড়ল।

জিশান কোমরে ব্যথা পেয়েছিল, তবে তেমন জোরালো নয়।

রণজিৎ পড়ে-যাওয়া হাসানকে সামাল দেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছিল, কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারেনি।

সেই সময়ে জিশান অনায়াসেই রণজিৎকে শকার দিয়ে কাবু করতে পারত, কিন্তু করল না। ও রণজিতের দিকে তাকিয়ে রইল। আড়চোখে লক্ষ করল, পাপুয়ার মুখে আতঙ্কের ভাঁজ পড়েছে। ওর মুখ থেকে লাফাঙ্গা-হাসি মিলিয়ে গেছে। শকার থেকে যতটা সম্ভব সরে গিয়ে ও লিফটের দেওয়ালে নিজেকে পোস্টারের মতো সাঁটিয়ে রেখেছে।

হাসানকে ধরতে গিয়ে রণজিৎ অনেকটা হেলে পড়েছিল। সেই অবস্থায় জিশানের দিকে চোখ পড়তেই ও স্ট্যাচু হয়ে গেল। তারপর জিশানের দিকে নজর স্থির রেখে খুব ধীরে-ধীরে শরীরটাকে সোজা করে দাঁড় করাল।

কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। শুধু অটো-এলিভেটর ওপরে ওঠার মৃদু গুনগুন শব্দ।

জিশান পায়ে-পায়ে সরে এল এলিভেটরের বোতামের কাছে। রণজিতের দিকে সতর্ক চোখ রেখে বাঁ-হাতে বোতাম টিপে এলিভেটর থামাল। তারপর এক নম্বর বোতামটা টিপে দিল। এবং এলিভেটর নামতে শুরু করল।

এতে অনেকটা সময় পাওয়া যাবে। ভাবল জিশান। এলিভেটর ওঠা-নামা করিয়ে সময় তৈরি করে এই মোকাবিলাটা খতম করতে হবে।

রণজিৎ ধূর্ত চোখে শকারটার দিকে তাকিয়ে ছিল। এককণা সুযোগ খুঁজছিল ও। সেটুকু সুযোগ পেলেই ও শুয়োরের বাচ্চাটাকে তুলোধোনা করতে পারবে।

জিশান রণজিতের মতিগতির কিছুটা বোধহয় আঁচ করতে পারছিল। ও শকারটা রণজিতের মুখের সামনে ধীরে-ধীরে দোলাল। যেন কোনও জাদুকর তার জাদু-দণ্ড দুলিয়ে কাউকে ঘুম পাড়াতে চাইছে।

জিশান জিগ্যেস করল, ‘ভয় করছে? ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে?’

রণজিৎ চোখ বড়-বড় করে তাকিয়ে ছিল জিশানের দিকে। বুঝতে চাইছিল, ঠিক কী ধরনের উত্তর এই পাগল ছেলেটাকে খুশি করতে পারে।

‘আমি মারব বলে ভয় করছে না তো?’ ঠান্ডা গলায় আবার জানতে চাইল জিশান।

তারপর রণজিতকে অবাক করে দিয়ে শকারের সুইচটা অফ করে দিল।

জিশানের পায়ের কাছে মনোহর সিং তখন নড়তে শুরু করেছে। সঙ্গে যন্ত্রণার ‘উ:! আ:!’ কাতরানি। খোকন মারমুখী ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে পাপুয়ার দিকে। হাসান জলে-ডোবা মৃতদেহের মতো অসাড়, অসহায়। চোখদুটো বন্ধ—যেন ঘুমিয়ে আছে।

খোঁচা দেওয়ার ভঙ্গিতে জিশান জিগ্যেস করল, ‘আমি মারব বলে ভয় করছে না কি?’

রণজিৎ ওর গোদা-গোদা দাঁত বের করে হাসল। কারণ, জিশান যে শকারের সুইচটা অফ করে দিয়েছে সেটা ও স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে।

তবে ওটা যে জিশানের টোপ সেটা বুঝতে পারেনি।

সুতরাং রণজিৎ হাত চালাল।

আর জিশানও চোস্ত খেলোয়াড়ের মতো শকারটাকে সামনে বাড়িয়ে জোরালো গুঁতো মারল রণজিতের পেটে।

সুইচ অফ করা অবস্থায় অস্ত্র হিসেবে শকারের গুণমান কাঠের রুলের চেয়ে একটু বেশি, লোহার রডের চেয়ে একটু কম। ফলে শকারের গুঁতোয় বেশ ভালোই কাজ হল।

রণজিতের দেহটা ভাঁজ হয়ে গেল সামনে। মাথাটা নিচু হয়ে যাওয়ায় চাঁদির তেলতেলে টাকটা এসে পড়ল জিশানের কাছাকাছি। জিশান নিজের মাথাটা ঝাঁকিয়ে মুগুরের মতো বাড়ি মারল রণজিতের টাকে। তারপর বাঁ-হাতের মুঠোয় সাপের মতো পোঁচিয়ে ধরল রণজিতের ডানহাতের মধ্যমা।

যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল রণজিৎ। হেঁড়ে গলায় চাপা গর্জন করে চলল—সঙ্গে তীব্র ফোঁসফোঁসানি।

জিশান রণজিতের আঙুলে হিংস্র মোচড় দিল। রণজিতের গলা থেকে যন্ত্রণার সা-রে-গা-মা বেরিয়ে এল। এবার শকারটা জিশান সপাটে বসিয়ে দিল রণজিতের পিঠে।

রণজিৎ পড়ে গেল বটে, কিন্তু কাবু হল না।

ও যে কিল গেম লড়তে এসেছে, সেকথা ভুললে চলবে না। ওর শরীরের রস-কষকে খাটো করে দেখলে চলবে না। মনে-মনে ভাবল জিশান।

রণজিৎ আবার উঠতে যাচ্ছিল, জিশান ব্যঙ্গের ঝাঁজালো গলায় চেঁচিয়ে উঠল, ‘ক্ষমা, স্যার, ক্ষমা—।’ এবং পলকে সুইচ অন করে শকারটা চেপে ধরল রণজিতের পাঁজরের কাছে।

গেঞ্জির কাপড় পুড়ে যাওয়ার গন্ধ বেরোল। আর কোনও গন্ধ নাকে ভালো করে ঠাহর করার আগেই এলিভেটরের মেঝেতে পড়ে গেল রণজিৎ।

জিশান ঘুরে তাকাল পাপুয়ার দিকে। শকারটা হাতে খোলা তরোয়ালের মতো ধরা।

পাপুয়া সটান জিশানের পায়ে বডি ফেলে দিল : ‘মাপ করো, বস, মাপ করো! আর এরকম হবে না। ক্ষমা, বস, ক্ষমা…।’

জিশান শকারটার সুইচ অফ করে পাপুয়ার পিঠে ঠেকাল। সঙ্গে-সঙ্গে পাপুয়া আতঙ্কে হাঁউমাঁউ করে উঠল।

জিশান হেসে বলল, ‘সালা, ডরপোক—ইঁদুরের বাচ্চা।’ জিশান ওর কোমরে একটা হালকা লাথি কষাল।

এলিভেটর তখন চারনম্বর ফ্লোর পার হচ্ছিল। এলিভেটরের প্যানেলের কাছে গিয়ে জিশান বোতাম টিপে যন্ত্রটাকে থামাল। তারপর আটাশ নম্বর বোতাম টিপে দিল।

জিশান, মনোহর, খোকনরা গেস্টহাউসের আটাশ নম্বর ফ্লোরে থাকে। আর রণজিৎরা থাকে উনতিরিশে।

ওপরে উঠতে এলিভেটরের বেশ সময় লাগবে। সেই ফাঁকে জিশান এলিভেটরের ভেতরটা গোছাতে লাগল। খোকন ওর সঙ্গে হাত লাগাল।

প্রথমেই শকারটা গার্ডের শিথিল শরীরের পাশে রেখে দিল জিশান। তারপর ও আর খোকন মিলে মনোহরকে দাঁড় করাল। ওর গালে আলতো চাপড় মেরে সাড় ফেরাতে চাইল।

পাপুয়া তখন ঝুঁকে পড়ে হাসান আর রণজিতের সেবা করছে।

এলিভেটর যখন আটাশ নম্বর ফ্লোরে এসে থামল তখন মনোহর জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। ও ফ্যালফ্যালে চোখে জিশানের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করল, ‘কেয়া হুয়া, জিশান ভাইয়া?’

জিশান ছোট্ট করে বলল, ‘লাফড়া।’

তারপর খোকনের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘এর মাথাটা গেছে। চলো, ভালো করে জল-টল না ছেটালে এর কিচ্ছু মনে পড়বে না…।’

খোকন বলল, ‘ঠিক বলেছ!’

জিশান ভাবল, এই যে শকার নিয়ে ও লড়াই করল—এটা কি কিল গেম-এর আর-একটা প্রিলিমিনারি রাউন্ড? ও কি তা হলে আর-একটা রাউন্ডে কোয়ালিফাই করল? আর সেইসঙ্গে মানুষ থেকে পশুর দিকে এগিয়ে গেল আর-একটা ধাপ?

হঠাৎই জিশানের মনে হল, এলিভেটরে ওদের এই দাঙ্গাহাঙ্গামা কেউ দেখে ফেলেনি তো? দেখলেই সর্বনাশ! তখন কী শাস্তি পেতে হবে কে জানে!

এলিভেটরের সিলিং-এর দিকে তাকাল জিশান।

দুটো ছোট্ট টিভি ক্যামেরা ওর নজরে পড়ল।

জিশান কতক্ষণ ঘুমোতে পেরেছিল ঠিক মনে নেই। হঠাৎই কেমন একটা অস্বস্তি টের পেল ও। মিনি আর শানুকে নিয়ে যে-স্বপ্নটা দেখছিল সেটা জলের নীচে ডুবে থাকা ছবির মতো ভাসতে-ভাসতে তলিয়ে গেল। একটা মেয়েলি গলা ওকে যেন বারবার ডাকছিল : ‘জিশান! জিশান!’

প্রথমে গলাটা মিনির মতো ঠেকল। তারপর বদলে গেল সেই মেয়েটার গলায় যে রোজ ভোরবেলা ছ’টা বাজলেই ওকে প্লেট টিভির ভেতর থেকে ডাকে—মিষ্টি সুরেলা গলায় ডেকে-ডেকে ওর ঘুম ভাঙায়।

চোখ কচলে বিছানায় উঠে বসল জিশান। অবাক হয়ে দেখল, ওর ঘরের আলোগুলো জ্বলছে।

ও কি তা হলে আলো জ্বেলেই শুয়ে পড়েছিল?

না তো! স্পষ্ট মনে আছে, ও সবক’টা আলোর সুইচই অফ করেছে।

তা হলে আলোগুলো অন করল কে?

হঠাৎই হাসি পেয়ে গেল জিশানের। এই জিপিসি-র গেস্টহাউসে প্রায় সবকিছুই অটোমেটিক। এবং তার সমস্ত মাস্টার কন্ট্রোল সিন্ডিকেটের হাতে। সুতরাং, খুশিমতো ওরা জিশানের ঘরের আলো জ্বালতেই পারে।

ঘরের দেওয়ালে ইনসেট করা ডিজিটাল ঘড়ির দিকে চোখ গেল জিশানের। সময় দুটো। পাশে বাঁকা চাঁদের ছবি—মানে রাত। প্রতিদিন সূর্য যখন ওঠে ঠিক তখন চাঁদের ছবিটা পালটে সূর্য হয়ে যায়। আর সূর্য ডুবলেই সূর্যের ছবি মুছে গিয়ে ফুটে ওঠে চাঁদের ছবি।

এখন যে রাত দুটো সেটা নিশ্চিতভাবে বোঝার জন্য পুবদিকের কাচের জানলাটার দিকে তাকাল জিশান।

সেখানে এখন রাতের অন্ধকার। অন্ধকারে তারা চোখে পড়ছে। আর তার সঙ্গে লাল-নীল জোড়া ধূমকেতুর লেজের কিছুটা করে অংশ।

এবার প্লেট টিভির চেনা সুন্দরীর দিকে তাকাল। মেয়েটি তখন বলছে, ‘ঘুম ভাঙাতে হল বলে দু:খিত, জিশান। কিন্তু তোমাকে এখুনি তৈরি হয়ে নিতে হবে। একটা ইমার্জেন্সি কলে পিস ফোর্সের গার্ডরা তোমাকে নিতে আসবে। ক্রিমিনাল রিফর্ম ডিপার্টমেন্টের মার্শাল শ্রীধর পাট্টা তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। তৈরি হওয়ার জন্যে তোমার হাতে মাত্র পাঁচমিনিট সময় আছে, জিশান। তোমার সময় শুরু হচ্ছে এখন…। ও. কে.। গুড বাই অ্যান্ড থ্যাংক য়ু—।’

 প্লেট টিভির পরদা থেকে মেয়েটি পলকে উধাও হয়ে গেল। টিভিটাও বোধহয় রিমোট কন্ট্রোল টেকনিকে আবার অফ হয়ে গেল।

জিশানের বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল।

শ্রীধর পাট্টা! দেখা করতে চেয়েছেন। কিন্তু কেন?

ধড়মড় করে বিছানা থেকে নেমে পড়ল জিশান। ওয়ার্ডরোবের কাছে গিয়ে চটপট পোশাক বদলাতে শুরু করল। হাতে মাত্র পাঁচমিনিট—কিংবা তার কম—সময় আছে।

জিপিসি-র গেস্টহাউসে পার্টিসিপ্যান্টদের জামাকাপড়ের কোনও অভাব নেই। জিশানকে দেওয়া ম্যানুয়ালে স্পষ্ট করে লেখা আছে ট্রেনিং, কমপিটিশান বা গেমের সময় কী ধরনের পোশাক পরতে হবে। এ ছাড়া বাকি সময় ক্যাজুয়াল ড্রেস।

এখন ক্যাজুয়াল ড্রেসই পরবে ঠিক করল জিশান। কারণ, মাঝরাতে শ্রীধর পাট্টা হঠাৎ ডেকে পাঠালে কী পোশাক পরে যেতে হবে সে-কথা ম্যানুয়ালে লেখা নেই। তা ছাড়া ওর ভেতরে কেমন যেন একটা বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিচ্ছিল।

জিশানের বারবার হাই উঠছিল। হাই তুলতে-তুলতেই একটা বাদামি রঙের কর্ডের প্যান্ট আর একটা নেভি ব্লু হাফশার্ট পরে নিল ও। শার্টটা প্যান্টের ভেতরে গুঁজে নিয়ে কোমরে বেল্ট পরে নিল। তারপর হাই তাড়াতে টয়লেটে গিয়ে চোখে-মুখে জলের ছিটে দিল। এখানে জল নিছক জল নয়—তার সঙ্গে একটা মিষ্টি গন্ধ মেশানো।

ঠিক তখনই দরজায় পাখি-ডাকা সুরে বেল বেজে উঠল।

তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলল জিশান। পিস ফোর্সের দুজন গার্ড দরজায় দাঁড়িয়ে।

জিশান ভালো করেই জানে, গার্ডরা যখন-তখন যে-কোনও গেমস পার্টিসিপ্যান্টের ঘরে দরজা খুলে ঢুকে পড়তে পারে। সে-চাবিকাঠি ওদের কাছে আছে। তা সত্বেও ওরা যে এখন বেল বাজাল সেটা নিছকই ভদ্রতা।

জিশান বাইরে বেরিয়ে এল। লক্ষ করল, দুজন গার্ডের শকারের সুইচ অন করা। মানে, শ্রীধর পাট্টা কোনওরকম ঝুঁকি নিতে রাজি নন।

দরজা টেনে বন্ধ করল জিশান। তারপর দুই পাথরের মূর্তির সঙ্গে মসৃণ করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল। ওর মন বলছিল, এলিভেটরের টিভি ক্যামেরা দুটোর জন্যই যত সর্বনাশ।

খানিকটা হেঁটে গিয়ে ওরা তিনজন একটা অদ্ভুত এলিভেটরের সামনে এসে দাঁড়াল। এলিভেটরটা কালো কাচের তৈরি। তার মাথার কাছটায় সবুজ আলোর ফুটকি দিয়ে লেখা : H-Elevator। মানে, হরাইজন্টাল এলিভেটর।

এ ক’দিনের অভিজ্ঞতায় জিশান জেনেছে, এই স্পেশাল এলিভেটর শুধু অনুভূমিক তল বরাবর যাতায়াত করতে পারে। অর্থাৎ, এর ওপরে-নীচে ওঠা-নামার কোনও ক্ষমতা নেই…অথচ এর নাম ‘এলিভেটর’।

এইচ-এলিভেটরে ঢুকেই হাসি পেয়ে গেল জিশানের। হরাইজন্টাল, তবু এলিভেটর। একেই বোধহয় বলে নাম মাহাত্ম্য! হঠাৎই ও খেয়াল করল, ওর ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে গার্ড দুজন অবাক হয়ে ওকে দেখছে।

এলিভেটরের ভেতরে ঢুকেই একজন গার্ড কন্ট্রোল প্যানেলের টাচ স্ক্রিন বোতাম টিপে দিল। সঙ্গে-সঙ্গে কালো কাচ ঢাকা একটা ছোট্ট জানলায় এলিভেটরের স্থানাঙ্ক পালটাতে লাগল। অর্থাৎ, এলিভেটর চলছে। কিন্তু চলার কোনও শব্দ নেই। শুধু খুব মনোযোগে কান পাতলে ভোমরার মিহি গুনগুন শোনা যাচ্ছে।

একটা স্থানাঙ্কে পৌঁছে এইচ-এলিভেটর থামল। তার দরজা নিজে থেকেই খুলে গেল। ঠান্ডা কাচের বাক্স ছেড়ে বেরিয়ে ওরা একটা করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল।

এখানেও করিডরে আয়নার মতো চকচকে বাদামি গ্র্যানাইট আর দেওয়াল খরগোশের মতো ধপধপে সাদা।

পনেরো-ষোলো পা এগিয়ে গার্ডরা ডানদিকে ঘুরল।

সামনে ঘষা কাচের একটা বিশাল দু-পাল্লার দরজা। তাতে লম্বা পাইপের মতো দুটো পিতলের হাতল—সোনার মতো ঝকঝক করছে।

একজন গার্ড একটা স্মার্ট কার্ড বের করল পকেট থেকে। দরজার পাশে লাগানো একটা স্লটে মসৃণভাবে সেটা টানল। তারপর দুজনে দুটো হাতল টেনে ধরে দরজা ফাঁক করল। ওদের অন্য হাত দুটো জিশানকে ঠেলে দিল ভেতরে। এবং হাতল দুটো ছেড়ে দিল। স্প্রিং দেওয়া দরজা সঙ্গে-সঙ্গে নি:শব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

ভেতরে যে-ঘরটা জিশানকে প্রায় গিলে নিল সেটা ঘর না ইনডোর ফুটবল মাঠ জিশান বুঝতে পারল না। ওটার চেহারা অনেকটা জিশানের দেখা ডিজিটাল জিমের মতো। তবে ঘরের উচ্চতা তার তুলনায় অনেক কম।

ঘরের একপাশে অন্তত পঞ্চাশটা সোফা সাজানো। সোফাগুলোর উঁচু হাতল লাল রঙের গদি মোড়া। তার ওপরে সোনালি জরির কাজ। যেন মহারাজাদের বিশ্রামের জন্য তৈরি।

সোফাগুলোর বিপরীতদিকে একটা ফুটখানেক উঁচু প্ল্যাটফর্ম—অনেকটা ডান্স ফ্লোরের মতো। সেখানে একটা প্রকাণ্ড কাচের বল একটা ধাতব ফ্রেমে দাঁড় করানো।

জিশান অনুমানে বুঝল, বলটার ব্যাস প্রায় দশ-বারো ফুট হবে। কিন্তু জিনিসটা কী কাজে লাগে সেটা ওর মাথায় ঢুকল না।

হঠাৎই কে যেন বলে উঠল, ‘এক্ষুনি বুঝতে পারবে, জিশান, কী এই বলের টান—।’

অন্ত্যমিল সংলাপ, মেয়েলি ঢঙের সঙ্গে রঙ্গব্যঙ্গের মিশেল…জিশান সঙ্গে-সঙ্গেই বুঝতে পারল, কথাগুলো বলছেন শ্রীধর পাট্টা—সিআরডি-র মার্শাল।

শব্দ লক্ষ করে চমকে মুখ ফেরাল জিশান।

মাঝের সারির একটা সোফায় শরীর ডুবিয়ে বসে আছেন শ্রীধর। সোফার হাতলের ওপর দিয়ে ওঁর মাথার খানিকটা, কপাল, আর ছোট-ছোট চোখ দেখা যাচ্ছে। সরু-সরু দুটো পা টান-টান করে সামনের সোফার পিঠের ওপরে রাখা।

পা নামিয়ে শরীরটাকে পলকে সামনে ঝুঁকিয়ে এক মসৃণ মোচড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন শ্রীধর। ফ্লুওরেসেন্ট লিপস্টিকে রাঙানো টুকটুকে ঠোঁটে বাঁকা হাসি। মুখের ভাঁজগুলো সাইডলাইটে আরও স্পষ্ট হয়ে গেছে।

‘ওয়েলকাম, বয়। তোমার মতো ফাইটার কেউ নয়। য়ু ওয়্যার শিয়োরলি ব্রাইটার, ইনসাইড দ্য এলিভেটর।’

ও, জিশানের অনুমানই তা হলে ঠিক। এলিভেটর ফাইটের ভিডিয়ো রেকর্ডিং শ্রীধর দেখেছেন। কিন্তু তার জন্য কী মিলবে? পুরস্কার, না তিরস্কার?

মনে-মনে হঠাৎই হেসে ফেলল জিশান। অন্ত্যমিল রেখে সংলাপ বলাটা কি ছোঁয়াচে রোগ? পুরস্কার, তিরস্কার। ওর ওপরে কি শ্রীধর ভর করেছেন?

শ্রীধর পাট্টার পরনে সেই একইরকম সাদা পোশাক। তাতে সোনালি বোতাম আর নীল হলোগ্রাম।

জিশানের দিকে পায়ে-পায়ে এগিয়ে এলেন শ্রীধর। পকেট থেকে ছোট্ট মাপের একটা যন্ত্র বের করে বোতাম টিপলেন।

সঙ্গে-সঙ্গে ঘটে গেল অলৌকিক কাণ্ড।

একটা দেওয়ালের খানিকটা অংশ নি:শব্দে সরে গিয়ে আটজন মানুষ ঢুকে পড়ল ঘরে। তাদের মধ্যে যে ছ’জন গার্ড সেটা তাদের পোশাক দেখে বুঝতে পারল জিশান। বাকি দুজনের পরনে সাদা ফুলশার্ট, সাদা প্যান্ট—আর শার্টের ওপরে কমলা রঙের হাতকাটা জ্যাকেট। জ্যাকেটের ওপরে রুপোলি হরফে লেখা : MEDIC। মানে, ওরা ডাক্তার। ওদের প্রত্যেকের হাতে একটা করে ব্রিফকেস ঝুলছে।

ছ’জন গার্ড যান্ত্রিক পায়ে হেঁটে কাচের বলটার কাছে গেল। বলটাকে ঘিরে পজিশন নিল। জিশান লক্ষ করল, ওদের সকলের কোমরে ঝুলছে শকার।

মেডিক দুজনকে ইশারা করলেন শ্রীধর। ব্যালে ডান্সারের ভঙ্গিতে বাঁ-হাতটা শূন্যে তুলে জিশানকে নির্দেশ করে বললেন : ‘ব্লাড প্রেশার এবং ব্লাড শুগার, চেক করুন ইচ দুবার।’

শ্রীধরের ছন্দ-বাণীতে মেডিক দুজন মোটেই অবাক হল না। বোঝা গেল, ওরা শ্রীধরকে চেনে।

হতভম্ব জিশানের দুপাশে এসে দাঁড়াল দুজন ডাক্তার। ব্রিফকেস খুলে অচেনা চেহারার দুটো ইলেকট্রনিক গ্যাজেট বের করল। গ্যাজেটগুলোর দুপাশে স্ট্র্যাপ বেরিয়ে আছে। দুটো যন্ত্রই ওরা স্ট্র্যাপ দিয়ে বেঁধে দিল জিশানের কবজিতে। তারপর একইসঙ্গে দুজনে দুটো বোতাম টিপে দিল।

ব্লাড শুগার পরীক্ষার জন্য শরীরে পিন ফুটতে পারে ভেবে জিশান ভুরু কুঁচকে চোখ ছোট করে যন্ত্রণার মোকাবিলার জন্য তৈরি হল। তখন সেই যন্ত্রের দায়িত্বে থাকা মেডিক বলল, ‘নরমাল হোন। এ-পিন ফুটলে টের পাবেন না। ন্যানো প্রাোব…ন্যানোটেকনোলজিতে তৈরি…রোমকূপের ভেতর দিয়ে সড়সড় করে ঢুকে যাবে…মাইনিউট ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে নেবে। স্মুদ অ্যান্ড এফিশিয়েন্ট।’

তাই হল। দুটো যন্ত্রেরই ডিসপ্লে প্যানেলে জিশানের ব্লাড প্রেশার আর ব্লাড শুগার লাল আর সবুজ আলোয়ফুটে উঠল।

শ্রীধর কাছে এগিয়ে এসেছিলেন। গলা বাড়িয়ে প্রেশার এবং শুগারের মান দেখলেন। নিচু গলায় বললেন, ‘গুড…গুড…।’

মেডিকরা দ্বিতীয়বার বোতাম টিপল। আবার ফুটে উঠল ব্লাড প্রেশার আর ব্লাড শুগারের মান। সেগুলো দেখে দ্বিতীয়বার সন্তুষ্ট হলেন শ্রীধর। হাতে হাত ঘষে বললেন, ‘চমৎকার। কোনও প্রবলেম নেই। এবার বাবু জিশানকে রোলারবলে ঢুকিয়ে দাও…প্লাস্টিকের আড়ালে লুকিয়ে দাও…।’

‘রোলারবল’ শব্দটা শোনামাত্রই অদ্ভুত বলটার দিকে চোখ গেল জিশানের।

ও, বলটা তা হলে প্লাস্টিকের?

মেডিক দুজন ওর হাত থেকে যন্ত্রের স্ট্র্যাপ খুলে নিল। যন্ত্রগুলো ব্রিফকেসে রেখে ব্রিফকেস দুটো মেঝেতে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর জিশানকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল বলটার দিকে।

জিশান এবার ভয় পেল। একমুহূর্তের জন্য ওর মনে হল বিদ্রোহ করবে। তাই শরীর শক্ত করল। কিন্তু পরের মুহূর্তেই বুঝল ব্যাপারটা হঠকারিতা হয়ে যাবে। সঙ্গে-সঙ্গে ওর শরীর শিথিল হয়ে গেল।

পিছন থেকে শ্রীধর পাট্টার বক্তৃতা শোনা যাচ্ছিল : ‘এলিভেটরের মধ্যে এনার্জি নষ্ট, এতে আমাদের বড় কষ্ট। তোমরা এমন লড়বে, সবাই হাঁ করে দেখবে। তোমাদের জয়-বিজয়, সবাই করবে এনজয়। অযথা এনার্জি ক্ষয়, তার কোনও মানে হয়! তাই নাও কোমল শাস্তি, এ ছাড়া উপায় নাস্তি….।’

বলের নীচে এসে পড়ল জিশান। একজন গার্ড একটা রিমোট কন্ট্রোল ইউনিট বের করে বোতাম টিপল। সঙ্গে-সঙ্গে মিহি শব্দ করে বলের নীচের দিকের খানিকটা অংশ খুলে গেল। দুজন মেডিক আর দুজন গার্ড জিশানকে তুলে ধরল ওপরে। একজন আদেশের সুরে বলল, ‘বলের ভেতরে ঢুকে পড়ুন। কুইক!’

জিশান কথা শুনল। ও ভেতরে ঢোকার পরই আবার রিমোটের বোতামে চাপ। খোলা অংশটা আবার বন্ধ হয়ে গেল। জিশান বন্দি হয়ে গেল প্লাস্টিকের বলের ভেতরে।

শ্রীধর পাট্টা খিলখিল করে হেসে উঠলেন। পকেট থেকে নেশার ছোট্ট শিশিটা বের করে মুখ হাঁ করে ওপরদিকে তাকালেন। খুব সাবধানে তিন ফোঁটা তরল মুখে ঢাললেন। জিভে তৃপ্তির শব্দ করে জোরে-জোরে কয়েকবার শ্বাস টানলেন। তারপর ঠোঁট চওড়া করে হাসলেন।

হঠাৎই মিলিটারি আদেশের সুরে হাত শূন্যে ছুড়ে শ্রীধর তীব্র স্বরে চিৎকার করে উঠলেন, ‘স্টার্ট অপারেশান। স্টেপ ওয়ান : ড্রপ দ্য স্টিল বলস—।’

বলের ভেতরে ঢুকে পড়ার পর জিশান পরীক্ষা করে বুঝল, বলটা নতুন ধরনের কোনও শক্ত প্লাস্টিকের তৈরি। ও গোলকের ভেতরের তলে হাত বুলিয়ে দেখছিল। তলটা মসৃণ নয়—সাবুদানার মতো ছোট-ছোট বুটি রয়েছে। অনেকটা পদ্মকাঁটার মতো। কিন্তু তা সত্বেও গোলকের ভেতর থেকে বাইরেটা দেখতে ওর কোনওরকম অসুবিধে হচ্ছিল না।

স্বচ্ছ গোলকের ভেতর থেকে শ্রীধর পাট্টাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল জিশান—তবে ওঁর কোনও কথা শুনতে পাচ্ছিল না। ওর মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ওর শ্বাসকষ্ট শুরু হবে, এবং সেটাই বোধহয় শ্রীধরের ‘কোমল’ শাস্তি।

ঠিক তখনই শ্রীধর হাত ছুড়ে কী যেন বললেন আর সঙ্গে-সঙ্গে গোলকের ওপরদিকের একটা ছোট্ট জানলা খুলে দশটা স্টেইনলেস স্টিলের বল টপাটপ করে খসে পড়ল ভেতরে। কানে তালা লাগার মতো খটাখট শব্দ হল।

ঝকঝকে বলগুলোর মাপ টেনিসবলের মতো। গোলকের দেওয়ালে ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়ল জিশান। একটা বল হাতে তুলে নিল। টেনিসবলের মাপের স্টিলের বল যতটা ভারী হওয়া উচিত ঠিক ততটাই ভারী।

কিন্তু এই বলগুলো দিয়ে কী করতে চান শ্রীধর?

উত্তর পাওয়া গেল প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই। কারণ, শ্রীধর পাট্টা চিৎকার করে দ্বিতীয় আদেশ দিলেন : ‘স্টেপ টু : স্টার্ট রোলিং দ্য বল। আর. পি. এম. টুয়েন্টি—।’

রিমোট ইউনিটের বোতাম টিপল একজন গার্ড। সঙ্গে-সঙ্গে প্লাস্টিকের বিশাল বলটা ঘুরতে শুরু করল।

ক্রমশ বলটার গতি বাড়তে লাগল। এবং শ্রীধরের নির্দেশ মতো ওটার গতি মিনিটে কুড়ি পাকে পৌঁছে গেল।

শ্রীধর পাট্টা একটা সোফার কাছে গিয়ে বসে পড়লেন। পায়ের ওপরে পা তুলে আধশোয়া ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে দাঁত খুঁটতে-খুঁটতে ঘুরন্ত বলটাকে দেখতে লাগলেন। সেইসঙ্গে স্বচ্ছ বলের ভেতরে জিশানের হেনস্থাও তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন।

বলটা ঘুরপাক শুরু করতেই জিশানের দুনিয়াটা বদলে গেল। ওর শরীরটা বলের সঙ্গে ঘুরতে শুরু করেছিল, কিন্তু বলের গতি বাড়তেই স্থিতিজাড্যের প্রভাবটা স্পষ্ট হল। বলের তুলনায় অনেক কম গতিতে ঘুরপাক খেতে লাগল জিশান। ফলে বলের প্লাস্টিকের তলে সাবুদানার মতো বুটিগুলো কেন রয়েছে তার কারণ স্পষ্টভাবে বোঝা গেল। এ ছাড়া স্টিলের বলগুলোও তাদের কাজ করছিল। প্লাস্টিকের বলের ভেতরে ছুটোছুটি করছিল। এলোমেলো ঠোক্কর খাচ্ছিল গোলকের প্লাস্টিকের তলে আর জিশানের গায়ে। চটপটি বাজির মতো ঠকাঠক শব্দ হচ্ছিল।

সাবুদানার ঘষায় জিশানের শার্ট ছিঁড়ে ফালা-ফালা হয়ে গেল। শরীর জ্বলতে লাগল। ও লাট খেয়ে পড়ে গেল বলের নীচের দিকে। ওর মাথা ঘুরতে লাগল।

শ্রীধর পাট্টা হাতঘড়ির দিকে তাকালেন। তারপর মিলিটারি হুকুম ছুড়ে দিলেন বাতাসে : ‘স্টেপ থ্রি : চেঞ্জ দ্য অ্যাক্সিস অফ রোটেশান কনটিনিউয়াসলি।’

সঙ্গে-সঙ্গে বলের ঘূর্ণনের অক্ষ বদলাতে শুরু করল। জিশানের শরীরটা যে বলের নীচের দিকে চলে গিয়ে অস্থির যন্ত্রণা থেকে খানিকটা রেহাই পেয়েছিল সেটা উলটে গেল পলকে। এবং ওর শরীরটা নিয়ে বলটা বলতে গেলে ছিনিমিনি খেলতে লাগল।

আবার হাতঘড়ি দেখলেন শ্রীধর। চিৎকার করে বললেন, ‘লাস্ট স্টেপ: ভ্যারি দ্য অ্যাঙ্গুলার ভেলোসিটি ইর‌্যাটিক্যালি—ফ্রম হান্ড্রেড আর. পি. এম. টু টুয়েন্টি আর. পি. এম.—।’

এবার সর্বনাশের আর কিছু বাকি রইল না।

ঘুরপাক খাওয়া বলের গতিবেগ মিনিটে একশো পাক থেকে কুড়ি পাকের মধ্যে যাচ্ছেতাইভাবে পালটাতে লাগল। সেইসঙ্গে ঘূর্ণনের অক্ষও বদলে যাচ্ছিল বেহিসেবিভাবে। আর ইস্পাতের বলগুলো পাগলা বুলেটের মতো জিশানের শরীরে আঘাত করছিল। কোনওটা ঠোঁটে এসে লাগছে, কোনওটা চোখে। যন্ত্রণায় বারবার সিঁটিয়ে যাচ্ছিল ও। আর শরীর থেকে যে রক্ত বেরোচ্ছে সেটা ও বুঝতে পারছিল প্লাস্টিকের বলের গায়ে লেপটে যাওয়া তাজা রক্তের দাগ দেখে।

এরকম শাস্তির কথা জীবনে কখনও কল্পনা করেনি জিশান। ওর শরীর থেঁতো হচ্ছিল। মনটাও ক্রমশ আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল। যন্ত্রণা আর কষ্ট ভুলে থাকার জন্য ও প্রাণপণে মিনি আর শানুর কথা ভাবতে চেষ্টা করল। কিন্তু ওদের মুখগুলো বারবার ঝাপসা হয়ে যেতে চাইছিল।

শেষ পর্যন্ত অসাড় প্রাণহীন একদলা কাদার মতো পড়ে রইল জিশান। বলটা ঘুরছে-তো-ঘুরছেই। ও কখন যে অজ্ঞান হয়ে গেছে সেটা ওর আর খেয়াল নেই।

শ্রীধর পাট্টা হাতঘড়ি দেখে নির্দেশ দিলেন, ‘স্টপ অপারেশান।’

সঙ্গে-সঙ্গে সবকিছু থেমে গেল। ঘরটা ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেল।

শ্রীধর খিলখিল করে হেসে উঠলেন। হাঁটুতে চাপড় মেরে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আ গ্রেট জব! আ গ্রেট জব! এতে জিশান পালচৌধুরীর শাস্তি হল, আবার খানিকটা ফিজিক্যাল ট্রেনিংও হল। ওর বডিটা নিয়ে যাও। ছাদে রেখে এসো। জ্ঞান ফিরলে ও নিজে থেকেই ঘরে ফিরে যেতে পারবে। আর কাল গেমস পার্টিসিপ্যান্টদের জিশানের শাস্তির ভিডিয়ো রেকর্ডিংটা দেখাবে। অ্যানালগ জিমে যখন সবাই ব্যাচ ধরে ট্রেনিং করবে তখন দেখিয়ো। নাও, বডিটা এবার বের করো—দেখা যাক, কতটা ছাতু হয়েছে।’

বিকেলের খেলাধুলো শেষ হলে মনোহর সিং আর খোকন জিশানের ঘরে এল। জিশান তখন ওর ফ্ল্যাটের লাগোয়া বারান্দায় বসে পশ্চিমের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সূর্যের আকাশ রাঙানোর লীলা দেখছে। আর হয়তো আধঘণ্টার মধ্যেই সন্ধে পরিপাটিভাবে নেমে আসবে।

মনোহরদের নিয়ে ঘরে ঢুকে এল জিশান। খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটতে গিয়ে গায়ের ব্যথাগুলো আর-একবার চাগিয়ে উঠল।

ভোরবেলা ক্লান্তির ঘুম ভাঙার পর কোনওরকমে ও ঘরে ফিরে এসেছে। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। মাথাটা যেন লোহার তৈরি—বয়ে বেড়াতে কষ্ট হচ্ছে। গতকাল রাতের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না ও। শাস্তি দেওয়ার ওই যন্ত্র—মানে, রোলারবলের আইডিয়াটা যদি শ্রীধর পাট্টার মাথা থেকে বেরিয়ে থাকে তা হলে বলতেই হবে শয়তানটার এলেম আছে। সত্যি, মাত্র দশমিনিটের মধ্যে একটা সা-জোয়ানকে তুলোধোনা করে তুলতুলে করার ব্যাপারে রোলারবলের জুড়ি নেই।

রাতে জিশানের যখন জ্ঞান ফিরেছিল তখন ওর মনে হচ্ছিল ও কোনও আকাশযানে চড়ে শূন্যে ভেসে চলেছে। ওর মাথার ওপরে ঘোর কালো আকাশ, তারই মাঝে চাঁদ-তারার হলদে আলো, আর একজোড়া ধূমকেতুর লাল আর নীল লেজের ছটা।

জিশানের মনে হচ্ছিল, ও আর বেঁচে নেই। কোন এক অলৌকিক উপায়ে ওর মৃতদেহ চোখ মেলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইহলোক ছেড়ে ভেসে চলেছে অন্য কোনও ‘লোক’-এর দিকে।

মনোহর সিং আর খোকনকে দেখে খুশি হল জিশান। ওর শাস্তির খবর মনোহররা সকালবেলাতেই পেয়েছে। শ্রীধর পাট্টার শয়তানির কথা ভেবে রাগে ওদের গা চড়চড় করছিল, কিন্তু বাইরে সেটা প্রকাশ করেনি। কারণ, জিপিসি-তে সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে লুকোনো ক্যামেরার চোখ।

এখনও জিশানের ঘরে কথা বলতে এসে প্রথমেই ক্যামেরার কাচের চোখগুলো খুঁজে বের করতে চাইল মনোহর। সিলিং-এর আনাচেকানাচে তাকাল।

সেখানে দুটো ক্যামেরা খুঁজে পেল ও। জিশান ইশারায় বোঝাল, দুটো নয়, আরও অনেক ক্যামেরা লুকোনো আছে। পরে সুযোগ পেলে বলবে।

জিপিসি-র গেস্টহাউসে ফ্ল্যাটগুলো একই ছাঁদের হলেও ক্যামেরাগুলো একই নিয়মে বসানো নয়। এটা জিশান যেমন জানে, মনোহরও তেমনই জানে।

ঘরে ঢুকে জিশান বিছানায় বসল।

মনোহর আর খোকন দুটো সোফায় বসল।

জিশান বালিশের পাশে রাখা রিমোট ইউনিট নিয়ে বোতাম টিপল। দশ সেকেন্ডের মধ্যেই একজন অ্যাটেনড্যান্ট এসে হাজির হল। জিশান তাকে তিনকাপ কফির অর্ডার দিল। সঙ্গে ফিঙ্গার চিপস। জিশান জানে, এই গেস্টহাউসের সার্ভিসের গতি অবাক করে দেওয়ার মতো।

মনোহর জিগ্যেস করল, ‘কেমন আছ, জিশান ভাইয়া?’

জিশান হেসে বলল, ‘যেমনই থাকি, দু-তিনদিনের মধ্যে ফিট হয়ে উঠতে হবে। তার জন্যে এরাও কম চেষ্টা করছে না….।’

‘তার মানে?’ ভুরু কপালে তুলল মনোহর।

‘সকালে দু-দুবার মেডিকরা আমাকে দেখে গেছে। ইনজেকশান দিয়ে গেছে। ”গেট ওয়েল সুন” লেখা রঙিন কার্ড পাঠিয়েছে—সঙ্গে ফুলের তোড়া…।’ ইশারায় বালিশের পাশে রাখা কার্ড আর ফুলের তোড়া দেখাল জিশান। একগুচ্ছ গোলাপ। এখনও সতেজ। ওদের রঙের রোশনাই দেখিয়ে জিশানকে যেন বলছে, ‘ভালো হয়ে ওঠো।’

‘এসবের মতলব?’ মনোহরের ভুরু এখন কুঁচকে গেছে।

‘মতলব আর কী! সিন্ডিকেট মনে করছে আমি কিল গেম-এর একজন পোটেনশিয়াল ক্যান্ডিডেট। আমি থাকলে ফাইট জমবে…।’

খোকন বলল, ‘পোটেনশিয়াল মানে?’

জিশান খোকনের দিকে তাকাল। সত্যি, পোটেনশিয়াল শব্দটার মানে ওর জানার কথা নয়। ও এসেছে চিৎপুরের খালধারের বস্তি থেকে। হাংরি ডলফিন গেম-এ ও নাম দিয়েছে। মনে অনেক আশা যে, ও জিতে যাবে।

খোকনের চোখ টানা-টানা। কেমন যেন একটা কবি-কবি ভাব। নাক টিকলো। গাল একটু ভাঙা। হঠাৎ করে ওর দিকে তাকালে মনে হয়, ওর চোখ দুটো দূরের কোনও স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে আছে।

খোকন যখন হাংরি ডলফিন গেম-এ নাম দিয়ে ওল্ড সিটি ছেড়ে চলে আসে তখন ওর মা-বাবা-ভাই-বোন সবাই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। ওরা খোকনকে পিছু ডাকছিল বারবার। কিন্তু খোকন ওদের চোখের জলে বা ডাকে ফিরে তাকায়নি।

দিন-দশেক আগে এক বৃষ্টির রাতে খোকনের বাবা রাস্তায় গুণ্ডার দলের পাল্লায় পড়েছিল। মুশকো চেহারার মোটরবাইক গুন্ডার দল তাড়া করেছিল ওর বাবাকে। প্রাণভয়ে ছুটতে-ছুটতে সে শেষ পর্যন্ত টাল সামলাতে পারেনি। খানা-খন্দ আর বৃষ্টির কাদা-জলে ভরতি নোংরা রাস্তায় ছিটকে পড়ে গিয়েছিল। তাড়া করে আসা প্রথম মোটরবাইকটা খোকনের বাবাকে চাকার তলায় চেপে ধরে। লোকটার বাইকের ইঞ্জিন গোঁ-গোঁ করছিল আর চাকার নীচে চাপা পড়া ঊরুর ভেতরে থেকে-থেকেই বিদুৎঝলকের মতো শকওয়েভ ঠিকরে উঠছিল। খোকনের বাবার কাতর চিৎকারে আকাশ-বাতাস কাঁপছিল, কিন্তু তাকে সাহায্যের জন্য কেউ ছুটে আসেনি—না ঘুষ খাওয়া, নেশা করা, ধুঁকে-ধুঁকে বেঁচে থাকা পুলিশের কেউ, না আমজনতার কেউ।

মাতাল গুন্ডার দল গলা ফাটিয়ে হাসছিল। বাতাসে ভেসে উঠছিল মদের গন্ধ। ওদের উল্লাস দেখে মনে হচ্ছিল মোটরবাইকের নীচে কোনও মানুষ চাপা পড়েনি—চাপা পড়েছে একটা দুর্গন্ধওয়ালা ছুঁচো।

খোকনের বাবার পকেটে একশো দশ টাকা মতো ছিল—আর কিছু খুচরো পয়সা। গুণ্ডার দল খুচরো পয়সা সমেত সব টাকা কেড়ে নিয়েছিল। এমনকী পরনের জামা-প্যান্টটাও খুলে নিয়েছিল মজা করার জন্য।

হেনস্থা আর অপমান সহ্য করে মাঝবয়েসি মানুষটা জল-কাদা মাখা অবস্থায় খোঁড়াতে-খোঁড়াতে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিল। পরনে শুধু জাঙ্গিয়া আর গেঞ্জি। খোকনের বেশ মনে আছে, জানলার ভাঙা পাল্লার ফাঁক দিয়ে খুব চাপা গলায় মায়ের নাম ধরে ডেকেছিল বাবা। খোকন সে-ডাক শুনতে পেয়েছিল। মা ছুটে গিয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মেরে স্বামীর ওই দুর্দশা দেখে চাপা চিৎকার করে উঠেছিল। আলনা থেকে একটা শাড়ি টেনে নিয়ে চুপিচুপি চলে গিয়েছিল বাইরে।

সেই শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে বাবা বাড়িতে ঢুকেছিল। তখন খোকন, ওর ভাই, আর ছোটবোন বাবাকে ওই অদ্ভুত পোশাকে দেখেছিল। ওদের দিকে চোখ পড়তেই বাবা হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল। মায়ের নাম ধরে ডেকে উঠে কান্না-ভাঙা গলায় বলেছিল, ‘জানো, শান্তা, এ শহরে আর কোনও মানুষ নেই—সব জানোয়ার। তার সঙ্গে রয়েছে আমাদের মতো কিছু ইঁদুর, ছুঁচো, আর পোকামাকড়। আমি এত চিৎকার করলাম…একটা লোকও আমাকে বাঁচাতে ছুটে এল না! একটা লোকও না! শান্তা, এ-শহরের মানুষগুলো সব মরে গেছে। আমরা কেউই আর বেঁচে নেই, বুঝলে? অনেকদিন আগেই আমরা মরে গেছি।’

 খোকনের মনে আছে, সেদিন সারারাত ও ঘুমোতে পারেনি। আরও মনে আছে, পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা বাবার ফুঁপিয়ে ওঠা কান্না সারারাত ধরে ওর বুকের ভেতরে আগুন জ্বালিয়ে রেখেছিল। বারবার ওর কানে বাজছিল বাবার কান্না মেশানো কথাগুলো : ‘…এ-শহরের মানুষগুলো সব মরে গেছে…।’

প্লেট টিভিতে দেখানো নানান ধরনের খেলা খোকনকে বরাবর নেশার মতো টানত। সেইসঙ্গে টাকার অভাবটা ওকে চব্বিশ ঘণ্টা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাক করে দিত। সেই রাতের পর ও মনে-মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, যে করে হোক, বাবার চোখের জল ও মুছবেই।

সাঁতারে খোকন ছোটবেলা থেকেই ওস্তাদ। ওয়াটার পোলো ও ভালোই খেলে। তাই ওর মনে হল, হাংরি ডলফিন খেলাটাই ওর পক্ষে সবচেয়ে ভালো।

হাংরি ডলফিন গেম-এ নাম দিয়ে যখন ও ওল্ড সিটি ছেড়ে চলে আসে তখন ওর খুব কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু ও মুখ ফুটে বাবাকে বা মা-কে বলতে পারেনি, ‘তোমাদের চোখের জল মোছার জন্যেই আমি নিউ সিটিতে যাচ্ছি—।’ ওর খুব সাধ, বিশলাখ টাকা প্রাইজ জিতে মা-বাবাকে ও প্রাইজ দেবে। দেখিয়ে দেবে, খোকন ফ্যামিলির জন্য কিছু করতে পারে।

ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে এসব কথা ভাবছিল জিশান। খোকনই ওকে সব বলেছে। বলেছে, দু:খের কথা, বলেছে স্বপ্নের কথাও।

কাল বিকেলের পর থেকে জিশান খোকনের কাছে ‘জিশানদা’ হয়ে গেছে। এলিভেটর ফাইটটা জিশানকে খোকনের কাছে হিরো করে দিয়েছে।

খোকন আবার জিগ্যেস করল, ‘জিশানদা, পোটেনশিয়াল মানে?’

জিশান হেসে বলল, ‘পোটেনশিয়াল মানে যে হেভি লড়বে—সহজে হারবে না।’

খোকন মনোহরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সিন্ডিকেট তা হলে ঠিকই ভেবেছে। কী বলো, মনোহরদা?’

মনোহর বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল : ‘হুঁ—।’

এমন সময় ঘরের দরজা খুলে অ্যাটেনড্যান্ট ঢুকল। হাতের ক্রিস্ট্যাল ট্রে-তে সাজানো তিনকাপ কফি আর ফিঙ্গার চিপস।

সোফার সামনে রাখা টেবিলে কফি আর ফিঙ্গার চিপস সাজিয়ে দিয়ে অ্যাটেনড্যান্ট চলে গেল।

ফিঙ্গার চিপস তুলে নিয়ে তাতে কামড় বসাল মনোহর। চোখ বুজে চিবোতে-চিবোতে বলল, ‘এরা রান্নাগুলো দারুণ করে, জিশান ভাইয়া।’

জিশান ছোট্ট করে ‘হুঁ’ বলল। কিন্তু মনে-মনে বাবার কাছে শোনা একটা ঘটনার কথা ভাবছিল। বহু যুগ আগে দেবতাদের সামনে পশুবলি দেওয়ার প্রথা চালু ছিল। তখন বলির ঠিক আগে পশুটিকে প্রাণভরে তার প্রিয় খাদ্য খাওয়ানো হত।

সে-কথা ভাবতে-ভাবতে মনোহরের দিকে দেখছিল জিশান। বাচ্চা ছেলের মতো তৃপ্তিতে ফিঙ্গার চিপস খাচ্ছে আর ধোঁয়া ওঠা কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে।

জিশানেরও একই দশা, কিন্তু ও মনোহরের মতো নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে কই?

জিশান আবারও মনে-প্রাণে চাইল, ওকে যেন মনোহরের সঙ্গে মরণপণ মোকাবিলায় না নামতে হয়।

খোকন চুপচাপ কফি খাচ্ছিল। হঠাৎই বলল, ‘মনোহরদা, জিশানদাকে পুনিয়ার কথা বলো…।’

জিশানের ভুরু কুঁচকে গেল। পুনিয়া? কে পুনিয়া?

ও সে-কথাই জিগ্যেস করল মনোহরকে।

মনোহর বলল, ‘পুনিয়া আমাদের গ্রুপের না—অন্য গ্রুপের। ওর পুরো নাম পুনিয়া সরকার—খিদিরপুরে থাকত…।’

‘থাকত মানে?’

‘কাল রাতে লাস্ট রাউন্ডে মারা গেছে।’

জিশান বুঝতে পারল। পুনিয়া কিল গেম-এর কোয়ালিফাইং রাউন্ডগুলোর লাস্ট রাউন্ডে মারা গেছে।

কিল গেম পার্টিসিপ্যান্টদের নিয়ে নানান কোয়ালিফাইং রাউন্ডে যে এতরকম বিপজ্জনক ‘খেলা’ আছে সেটা জিশান জানত না। কারণ, সুপারগেমস কর্পোরেশন কোনওদিনই টিভিতে এসব নিয়ে প্রচার করেনি। এগুলো হয়তো সিন্ডিকেটের ট্রেড সিক্রেট।

কফি খেতে-খেতে মনোহরের মুখে পুনিয়ার কথা শুনল জিশান।

পুনিয়া জিশান-মনোহর-খোকনদের গ্রুপে নয়—অন্য গ্রুপে। ও জিশানদের অনেক আগেই জিপিসি-তে এসেছিল। পেটানো স্বাস্থ্য, লড়াকু ছেলে। ছোটবেলা থেকে খতরনাক পাড়ায় মানুষ। মারপিট করতে-করতেই বড় হয়েছে।

কিল গেম-এর অন্য সব রাউন্ডগুলোয় পুনিয়া অনায়াসেই জিতেছে। কিন্তু কাল রাতে ছিল ওর ‘পিট ফাইট’। একটা বিশাল গর্তের মধ্যে দুজন ফাইটারের লড়াই। অনেকেই সেই লড়াই দেখতে যায়। মনোহর আর খোকনও গিয়েছিল।

জিশান পিট ফাইট নিয়ে আগে কিছু শোনেনি। তাই ওই ফাইট দেখার কোনও উৎসাহ ওর ছিল না। তবে এখন খোকনের কাছে শুনল, পিট ফাইট শুধু গায়ের জোরের লড়াই নয়—মনের জোরেরও লড়াই।

গতকাল রাতে পুনিয়া অন্য আর একটা গ্রুপের চ্যাম্পিয়ান জাব্বা নামে এক ফাইটারের হাতে মারা গেছে। এ নিয়ে জাব্বার হাতে মোট দুজন পার্টিসিপ্যান্ট খতম হল। মনোহর আর জিশান যদি পরের দুটো রাউন্ডে কোয়ালিফাই করে তা হলে ওরা লাস্ট রাউন্ডে যাবে। তখন ওরা পিট ফাইটে কার মুখোমুখি হবে কে জানে!

এখানে কোনও পার্টিসিপ্যান্ট শুধু নানান রাউন্ডে জিতলেই কিল গেম-এ তাকে নেওয়া হবে না। ওদের ট্রেনিং শিডিউল-এর নানান ধাপে নম্বর দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। যেমন, ফিজিক্যাল ট্রেনিং স্কিল, আর্মস স্কিল, রিঅ্যাকশন টাইম—এসবের ওপরে নম্বর দেওয়া হয়। সেইসব নম্বর যোগ করে তারপরই বেছে নেওয়া হবে একজনকে—কিল গেম-এর জন্য।

জাব্বাকে দেখে মনোহর আর খোকন বেশ ভয় পেয়ে গেছে।

মনোহর ভয় পেয়েছে নিজের আর জিশানের জন্য, আর খোকন ভয় পেয়েছে মনোহরের জন্য—আর কিছুটা জিশানের জন্যও।

মনোহর বলল, ‘জিশান ভাইয়া, জাব্বার চোখ দুটো খুনির মতো। সবাই বলাবলি করছে, লোকটা নাকি তিন-চারবার জেল খেটেছে। আর জাব্বা বলছে, কিল গেম-এ ও চান্স পাবেই—আর তারপর ওই তিনটে খতরনাক কিলারকে ধরে ও মটমট করে ঘাড় মটকে দেবে—পাটকাঠির মতো। তারপর লুটে নেবে একশো কোটি টাকা।’

জিশান কোনও কথা বলল না। জানলা দিয়ে বাইরের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাশের আলো কমে গিয়ে অন্ধকার নামছে। হঠাৎই ওর মনে হল ওর জীবনটা আকাশেরই মতো।

খোকন অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল, ও ভেতরে-ভেতরে কী একটা হিসেব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

হঠাৎই ও বলে উঠল, ‘আচ্ছা জিশানদা, পরের দুটো রাউন্ডে তুমি আর মনোহরদা হেরে গেলে কেমন হয়? তা হলে তোমাদের আর জাব্বার মুখোমুখি পড়তে হয় না…।’

খোকন এই কথা বলামাত্রই জিশান কাশতে শুরু করল। কাশতে-কাশতে মাথা নিচু করে মুখে হাত চাপা দিল ও।

মনোহর আর খোকন একটু অবাক হয়েই জিশানকে দেখতে লাগল।

জিশান অনেক কষ্টে কাশি থামিয়ে খোকনের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘হারার কথা বোলো না, খোকন। আমি আর মনোহর ডরপোক না। জাব্বাকে হাতে পেলে আমরা গুঁড়ো করে দেব…।’

খোকন তা সত্বেও বিড়বিড় করে বলল, ‘জাব্বাকে তুমি তো দ্যাখোনি, তাই এ-কথা বলছ। মনোহরদা দেখেছে—।’

জিশান নেমে পড়ল বিছানা থেকে। আবার কাশতে শুরু করল। বাথরুমের দিকে পা বাড়িয়ে কোনওরকমে খোকনকে বলল, ‘খোকন, শিগগির বাথরুমে চলো। আমার—আমার মাথা চাপড়ে একটু জল ঢেলে দেবে। ও:, গলায় কী যেন একটা আটকে গেছে—।’

প্রায় হাঁপাতে-হাঁপাতে বাথরুমে ঢুকে পড়ল জিশান। ওর পিছন-পিছন ঢুকল খোকন। আর উদ্বেগ নিয়ে চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল মনোহর।

বাথরুমে কোনও টিভি ক্যামেরা নেই। জিশান সেটা ভালো করেই জানে। তাই বাথরুমে ঢুকেই ওর কাশি আর হাঁপানি থেমে গেল। ব্যাপারটা যে অভিনয় ছিল সেটা খোকন এখন বুঝতে পারল।

জিশান চাপা গলায় বলল, ‘তোমার মতো হদ্দ বোকা আর দেখিনি। তুমি জানো না, এখানে কোয়ালিফাইং রাউন্ডগুলোয় ইচ্ছে করে হেরে যাওয়ার চেষ্টা করলে কী হয়? সিন্ডিকেটের লোকরা প্রত্যেকটা গেমের ভিডিয়ো রেকর্ডিং দ্যাখে—স্লো মোশানে। তখন স্পষ্ট বোঝা যায়, কে ইচ্ছে করে কোন গেম হারছে। তখন কপালে জুটবে রোলারবল, শক ট্রিটমেন্ট, হাংরি ডলফিন বা ম্যানিম্যাল রেস—উইদাউট প্রাইজ মানি—অথবা সবচেয়ে খারাপ শাস্তি—ডগ স্কোয়াড। তোমার কথাগুলো টিভি ট্রান্সমিশানে চলে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের কাছে। সেইজন্যেই আমি কাশির অ্যাকটিং করে তোমাকে থামাতে চেয়েছি…।’

‘সরি, জিশানদা—আমার খেয়াল ছিল না…।’

খোকনের অপরাধী-অপরাধী মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল জিশান, আর শাস্তিগুলোর কথা ভাবছিল।

রোলারবল তো ও নিজেই চেখে দেখেছে। বাকি শাস্তিগুলোর কথা ও অন্য কম্পিটিটারদের মুখে শুনেছে। শুনেছে, এই সব শাস্তিতে নাকি বেশ কয়েকজন আগে মারা গেছে।

যেমন, শক ট্রিটমেন্টে ষোলোটা ইলেকট্রোড শরীরে লাগিয়ে বিভিন্ন তীব্রতার ভোল্টেজ শক দেওয়া হয়। আর ডগ স্কোয়াড শাস্তির বেলা থাকে আটটা ক্ষুধার্ত অ্যালসেশিয়ান কুকুর। তারা অপরাধীকে মরজি মতন ছিন্নভিন্ন করে।

জিশান খোকনকে তাড়া মেরে বলল, ‘এখন শিগগির আমার মাথায় জল ঢালো। মনে রেখো, তোমার হাতও ভিজে থাকতে হবে—কারণ, আমাদের দুজনের অ্যাকটিংই ঠিকঠাক হওয়া জরুরি। সিন্ডিকেটের গোপন চোখ সবকিছু খুঁটিয়ে নজর করে…।’

ভেজা মাথা নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল জিশান। আপাতত অ্যাকটিং করে ও সিন্ডিকেটের টিভি ক্যামেরাকে বোকা বানাল বটে, কিন্তু জাব্বার চিন্তাটা ওর মাথার ভেতরে বাসা বেঁধে রইল।

দেখতে-দেখতে পরের কোয়ালিফাইং রাউন্ডের দিন এসে গেল। সাতদিন বিশ্রাম পেয়ে জিশান এখন পুরোপুরি সুস্থ, শরীরে আগের মতন জোর ফিরে পেয়েছে। স্টেয়ার ফ্লেয়ার ব্যায়ামটা ও অনায়াসেই ষাটবার করে ফেলতে পারছে। পায়ের কাফ মাসল বা লিগামেন্টে কোনও স্ট্রেইন টের পাচ্ছে না।

 স্টেয়ার ফ্লেয়ার ব্যায়ামটা একটু অদ্ভুত ধরনের। মেঝের ওপরে কংক্রিটের তৈরি ছ’ধাপ সিঁড়ি তৈরি করা আছে। ব্যায়াম যে করবে তাকে ছ’ধাপ সিঁড়ি উঠে আবার পিছনদিকে নেমে আসতে হবে। ব্যায়াম করতে-করতে তাকে ক্রমশ এই ওঠা-নামার গতি বাড়াতে হবে।

ব্যায়ামের দ্বিতীয় ধাপটা বেশ কঠিন। ওপর থেকে ছ’ধাপ নীচে নেমে আবার পিছনদিকে ছ’ধাপ উঠতে হবে। এবং আগের মতোই ওঠা-নামার গতি ধীরে-ধীরে বাড়াতে হবে।

শেষ ধাপে এসে ব্যায়ামটা অদ্ভুত বাঁক নিয়েছে।

এবারে সিঁড়ি ওঠা-নামার কাজ করতে হবে পাশ থেকে। তবে একবার সিঁড়ির দিকে মুখ করে, আর-একবার পিছন ফিরে।

জিশান এই শেষ ধাপটাই অনায়াসে ষাটবার করে ফেলতে পারছিল। তাতে ও আত্মবিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, এই রাউন্ডটা ও সহজেই পার হয়ে যাবে।

দুপুর আড়াইটের সময় ওরা গেম পয়েন্টের দিকে রওনা হল। ওদের পরনে সেই একই পোশাক : হলদে টি-শার্ট আর কালো বারমুডা প্যান্ট।

জিশান গুনে দেখল : মাত্র এগারোজন পার্টিসিপ্যান্ট। নির্লিপ্ত মুখে সবাই হেঁটে চলেছে গেম পয়েন্টের দিকে। ওদের সামনে-পিছনে রয়েছে পিস ফোর্সের চারজন গার্ড। তাদের প্রত্যেকের কোমরে ঝুলছে শকার। এ ছাড়া সামনে হেঁটে চলেছে লাল ইউনিফর্ম পরা দুজন ইনস্ট্রাকটর। কোমরে ল্যাপটপ, হাতে রিমোট ইউনিট।

গেম পয়েন্টটা বেশি দূরে নয়, তাই ওরা সবাই সার বেঁধে হেঁটে চলেছে। দূরে হলে ওরা গেমস মোবাইলে চড়ে রওনা হত। গেমস মোবাইল সাপের মতো লম্বা মোটরগাড়ি। একটা গাড়িতে পাইলট-কেবিনের সঙ্গে আরও ন’টা সিট একজনের পিছনে আর-একজন করে সাপের মতো জোড়া আছে। গাড়িটা এমন অদ্ভুতভাবে তৈরি যে, বাঁক নেওয়ার সময় গাড়ির পিছনের অংশটা অপকেন্দ্র বলে ছিটকে গিয়ে দুর্ঘটনা বাধায় না। জিশানকে একজন ইনস্ট্রাকটর বলেছে, গাড়ির প্রত্যেকটা ক্যারেজে ভেলোসিটি আর কার্ভেচার সেন্সর লাগানো আছে। তা দিয়ে ভেলোসিটি আর রেডিয়াস অফ কার্ভেচার সেন্স করে ক্যারেজের দশটা অটো ব্রেকিং মেকানিজম কাজ করে।

মসৃণ রাস্তা ধরে জিশানরা হেঁটে যাচ্ছিল। মনোহর সিং রয়েছে লাইনের সামনের দিকে, আর জিশান পিছনের দিকে। মনোহর মাঝে-মাঝে জিশানের দিকে পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল।

হাঁটতে-হাঁটতে জিশান চারপাশটা দেখছিল। চারদিকে সব ছবি সাজানো। যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই কোন অলৌকিক রূপকার বিমূর্ত জ্যামিতিক ছাঁদে ছবির মতো করে সবকিছু তৈরি করেছে।

এই চোখজুড়োনো পরিবেশে এত হিংস্রতা, এত নৃশংসতা!

মাথার ওপরে চোখ তুলে তাকাল জিশান। নীল আকাশে গনগনে সূর্য। এদিক-ওদিক উড়ে যাচ্ছে শুটার। ওদের ধাতুর শরীরে রোদ পড়ে ঝিকিয়ে উঠছে।

জিশান চোখ নামাল। ওর মনে হল, ‘আমরা যাচ্ছি এগারোজন—কিন্তু কমপিটিশানের পরে এই পথ ধরে ফিরে আসব ক’জন?’

জিশানের আরও মনে হল, যারা আর ফেরে না, তাদের নিয়ে কী করে সুপারগেমস কর্পোরেশন?

এমন সময় হঠাৎই ওর খেয়াল হল, সুরেলা মিষ্টি গলায় কে যেন বলছে, ‘টা-টা…টা-টা…।’

এখানেও প্লেট টিভির যন্ত্রণা! জিশান চোখ ফেরাল না—সামনের প্রতিযোগীর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল।

কিন্তু পরের মুহূর্তেই ওর মনে হল, ওদের চলার পথের দুপাশে মিহি ঘাসে ছাওয়া সবুজ লন। লন ছাড়িয়ে সুন্দর-সুন্দর বাড়ি। ওগুলো জিপিসি-র নানান কর্মীদের কোয়ার্টার। এখানে আলটপকা প্লেট টিভি আসবে কোথা থেকে!

অতএব চোখ ফিরিয়ে তাকাল জিশান। এবং ওর চোখ আটকে গেল।

বাঁ-দিকের একটা বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে। গায়ে লেসের কাজ করা উজ্জ্বল গোলাপি ফ্রক। মাথায় দুটো ছোট-ছোট বিনুনি, তার প্রান্তে গোলাপি ফিতের ফুল।

বছর ছয়েকের এই ফুটফুটে দেবশিশু জিশানদের দিকে তাকিয়ে হাসছে, হাত নাড়ছে, আর ‘টা-টা’ বলছে।

সঙ্গে-সঙ্গে শানুর কথা মনে পড়ে গেল। চোখে জল এসে গেল জিশানের। এই বাচ্চা মেয়েটা কি গুনতে জানে? তা হলে ওদের ফেরার সময় দেখবে এগারোজন আর নেই। এমন তো হতেই পারে, সেই হারিয়ে যাওয়া কয়েকজনের মধ্যে জিশান পালচৌধুরী থাকবে! মেয়েটির সঙ্গে জিশানের আর কোনওদিনই দেখা হবে না! শানুর সঙ্গেও আর দেখা হবে না কোনওদিন!

জিশানের অন্তর ফুঁপিয়ে উঠল।

কিন্তু তারপরই ওর বুকের ভেতরে কীরকম একটা উথালপাথাল হয়ে গেল।

না, জিশান ফিরবেই! এই পথ দিয়েই ও ফিরবে। এই মেয়েটিকে আবার ও দেখতে পাবে। শানুকেও দেখবে আবার। মিনিকেও।

সামনে যতই কঠিন খেলা থাকুক, জিশান তার চেয়েও কঠিনভাবে লড়বে।

জিশান হাত তুলে বাচ্চাটির ‘টা-টা’ ফিরিয়ে দিল। দেখল, ওদের মধ্যে আরও কেউ-কেউ বাচ্চাটাকে ‘টা-টা’ করছে।

বাচ্চাটার মিষ্টি হাসির উত্তরে হাসল জিশান। ওর মনে হচ্ছিল, ও যেন শানুর সঙ্গে ইশারায় খেলা করছে।

ওরা এগিয়ে যেতে লাগল। একটু দূরে ছোটখাটো গাছপালার ভিড় চোখে পড়ল। তার পাশে একটা একতলা বাড়ির মতন। সেখানে পৌঁছে সবাই থামল।

জিশান দেখল, গাছপালাগুলো যেখানে শুরু হয়েছে সেখানে একটা বিশাল লোহার গেট। গেটের ওপরে সাইনবোর্ডে লেখা : ‘KOMBAT PARK’।

জিশানের অল্পবিস্তর পড়াশোনা থাকলেও প্রথম শব্দটার মানে ও বুঝতে পারল না।

একজন ইনস্ট্রাকটর চেঁচিয়ে ওদের থামতে বললেন।

‘সবাই থামুন। আমরা কমব্যাট পার্কে পৌঁছে গেছি। আমাদের এই রাউন্ডটা এখানেই হবে। এটা হচ্ছে সারপ্রাইজ রাউন্ড…।’

সারপ্রাইজ রাউন্ড? জিশানের অবাক লাগল। ও পার্কটাকে দেখছিল। নিউ সিটির অন্য সবুজের মতো অতটা সাজানো-গোছানো নয়। বরং ভেতরের গাছপালাগুলো বেশ এলোমেলো। তবে অনেক উঁচু লোহার জাল দিয়ে ঘেরা। এর ভেতরে কী আছে কে জানে!

সেটা জানা গেল একটু পরেই।

ওদের নির্দেশ দিলেন ইনস্ট্রাকটর : ‘পাশের হলঘরটায় সবাই ঢুকে পড়ুন—।’

ওরা একে-একে ঢুকে পড়ল সেই একতলা বাড়িটার হলঘরে।

হলঘরের দরজায় লেখা : ‘Kombat Park Control Room’। ঘরের ভেতরটা ঠান্ডা, চুপচাপ। একদিকে সারি-সারি গোটা চল্লিশ সবুজ রঙের চেয়ার। আর তার বিপরীতে সাদা পরদা—অনেকটা সিনেমাহলের মতন।

ইনস্ট্রাকটরের কথামতো ওরা সিটে বসে পড়ল। একটু পরেই ঘর অন্ধকার করে পরদায় সিনেমা শুরু হল। সঙ্গে বাংলা ধারাবিবরণী। তবে একজন ইনস্ট্রাকটর চেঁচিয়ে বললেন যে, প্রত্যেক সিটের সঙ্গে ট্রানস্লেটর হেডফোন আছে। সেটা ব্যবহার করলেই পছন্দসই ভাষায় ধারাবিবরণী শোনা যাবে।

সিনেমার প্রথমে কমব্যাট পার্কের নানান তথ্য জানানো হল। সঙ্গে হেলিকপ্টার কিংবা শুটার থেকে তোলা পার্কের ছবি।

পার্কের বেশ কিছু জায়গায় ছোট-ছোট ডোবা রয়েছে। এ ছাড়া আছে গাছপালা আর উঁচু-নিচু ঢিবি।

পার্কের বন্যপ্রাণী মাত্র চাররকম। আর, পাখি আছে সতেরোরকম।

বন্যপ্রাণীদের প্রথম তিনটি হল হরিণ, বুনো শুয়োর এবং ছাগল।

আর চতুর্থটি হল কোমোডো ড্রাগন।

এ-কথা বলার সঙ্গে-সঙ্গেই ক্যামেরা জুম করে চলে এল নীচে—একেবারে পার্কের মাটিতে। দেখা গেল, প্রায় দশফুট লম্বা একটা কোমোডো ড্রাগন ধারালো দাঁতে একটা চিতল হরিণের পেট খাবলে খাচ্ছে।

প্রাণীটার ভয়ঙ্কর চেহারা জিশানকে কাঁপিয়ে দিল। ছবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা ধারাবিবরণী ঠিকমতো ওর কানে ঢুকছিল না।

‘…জায়ান্ট মনিটর বা কোমোডো ড্রাগন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাপের লিজার্ড স্পিসিজ। একসময়ে এই ড্রাগন প্রায় লুপ্ত হতে বসেছিল, কিন্তু পরিবেশবিদ আর প্রাণিবিজ্ঞানীদের চেষ্টায় আবার এরা সংখ্যায় বেড়ে উঠেছে। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় দশ-বারো ফুট পর্যন্ত হয়, আর ওজন একশো কুড়ি থেকে একশো পঞ্চাশ কেজি মতন। এরা জোরে ছুটতে পারে—টিকটিকির মতো। আর ওদেরই মতো চটপট গাছ বেয়ে উঠতে পারে।

‘একসময় এই ড্রাগন শুধুমাত্র ইন্দোনেশিয়ায় কোমোডো, রিনটজা, পাডার আর ফ্লোরেস দ্বীপে পাওয়া যেত। কোমোডো দ্বীপ থেকেই এদের নাম কোমোডো ড্রাগন হয়েছে। আর ইংরেজি ‘‘Komodo’’ এবং ‘‘Combat’’ শব্দ জুড়ে আমরা Kombat শব্দ তৈরি করেছি। যার মানে হল, কোমোডোর সঙ্গে লড়াই…।’

এটাই তা হলে সারপ্রাইজ রাউন্ড!

জিশান ভয়ের চোখে প্রাণীটাকে দেখছিল।

গোসাপের মতো দেখতে কিন্তু গোসাপের চেয়ে মাপে অনেক বড়। খসখসে ধূসর চামড়া—তাতে পদ্মকাঁটার মতো বুটি। শক্ত চোয়াল, বড় মাপের ধারালো দাঁত। তেমনই ধারালো পায়ের নখ।

জিশান দেখছিল, জমিতে লাঙল দেওয়ার মতোই প্রাণীটার দাঁত কত সহজে ঢুকে যাচ্ছে হরিণের পেটে। তারপর মাথার এক ঝাঁকুনিতে টেনে বের করে নিচ্ছে মাংস আর নাড়িভুঁড়ি। ওটার দাঁতের ফাঁকে মাংসের টুকরো আটকে রয়েছে, ঝুলছে নাড়িভুঁড়ির অংশ।

জিশানের গা ঘিনঘিন করছিল।

সিনেমার ভাষ্যকার তখন বলছে, ‘…কোমোডো ড্রাগন কখনও তেড়ে গিয়ে মানুষকে আক্রমণ করেছে এমন শোনা না গেলেও কমব্যাট পার্কে বহুবার এই ঘটনা দেখা গেছে। কারণ, কোমোডোগুলো ক্ষুধার্ত। সবাই বলে হিংস্রতায় কোমোডো কুমিরের চেয়ে কম—কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, খুব একটা কম নয়…।’

এরপর ক্যামেরা পার্কের নানান অঞ্চল দেখাতে লাগল। গাছপালা, পাখি, হরিণ, ছাগল, দাঁতালো শুয়োর—আর অসংখ্য ছোট-বড় কোমোডো। জলায়, ডাঙায়, গাছে।

দেখতে-দেখতে জিশান ভাবছিল, এই পার্কে ঢুকে ওদের ঠিক কী করতে হবে? কীভাবে লড়াই করতে হবে কোমোডো ড্রাগনের সঙ্গে? হলের সাউন্ড সিস্টেমে তখন শোনা যাচ্ছে : ‘…কোমোডোর চোখের নজর খুব সাংঘাতিক—প্রায় তিনশো মিটার দূর থেকেও ওরা দেখতে পায়। তবে ওদের রেটিনায় রড না থাকায় ওরা অল্প আলোয় ভালো করে দেখতে পায় না। এ ছাড়া ওদের শোনার ক্ষমতা মানুষের তুলনায় বেশ কম। মানুষ যেখানে 20 থেকে 20,000 হার্ৎজ কম্পাঙ্কের শব্দ শুনতে পায় সেখানে কোমোডো ড্রাগনের শব্দ শোনার কম্পাঙ্ক-সীমা হল 400 থেকে মাত্র 2000 হার্ৎজ।

‘ওদের হলদে রঙের চেরা জিভ একটি আশ্চর্য যন্ত্র…।’

ক্যামেরা একটি কোমোডোর ক্লোজ-আপ দেখাল। প্রাণীটা বারবার সাপের মতো চেরা জিভ বের করছে আর মুখের ভেতরে ঢুকিয়ে নিচ্ছে। এদিক-ওদিক মাথা ঘোরাচ্ছে।

‘এই জিভ দিয়ে ওরা বাতাস থেকে ঘ্রাণ নেয়—ঠিক সাপের মতো। তারপর জিভ ভেতরে ঢুকিয়ে ওরা টাকরায় ঠেকায়। সেখানে আছে জ্যাকবসনস অরগ্যান। এই অঙ্গটি বাতাস থেকে পাওয়া ঘ্রাণরেণুর রাসায়নিক চরিত্র বিচার করে কোমোডোর কাছে সংকেত পৌঁছে দেয় যে, কাছাকাছি কোনও শিকার কাছে কিনা…।’

হঠাৎই জিশানের কানের কাছে ফিসফিস করে কে বলে উঠল, ‘বেফায়দা এই বকবকানির কী মানে আছে, জিশান ভাইয়া? তার চেয়ে জলদি বলে ফ্যালো পার্কমে হামকো কেয়া করনা হ্যায়…।’

জিশান পিছনদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মনোহরকে চিনতে পারল। ও কখন যেন জিশানের ঠিক পিছনের সিটটাতে এসে বসেছে।

জিশান অন্ধকারেই হাসল, বলল, ‘সিরফ জিন্দা রহেনা হ্যায়, মনোহর। স্রেফ বেঁচে থাকতে হবে। সে কোমোডো ড্রাগনই হোক কি ডাইনোসর—।’

পরদায় এবার কোমোডোর চোয়াল আর দাঁতের ক্লোজ-আপ দেখাল। দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মাংসের টুকরোও দেখা গেল। সেইসঙ্গে শোনা গেল ভাষ্যকারের গলা : ‘…কোমোডোর কামড় খেয়েও যদি কোনও হরিণ বা ছাগল পালিয়ে বেঁচে যায় তা হলে এটা নিশ্চিত যে, সে আর বেশিদিন বাঁচবে না। কারণ, কোমোডোর দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা মাংসের টুকরো পচে গিয়ে সেখানে নানান ব্যাকটিরিয়া তৈরি হয়। সেইসব ব্যাকটিরিয়ার ইনফেকশানে কোমোডোর কামড় খেয়েও বেঁচে যাওয়া শিকার কিছুদিন পর মারা যায়। তবে কোমোডোর নিজের শরীরে প্রাকৃতিকভাবেই এইসব ব্যাকটিরিয়ার প্রতিষেধক আছে। কারণ, কোমোডোরা যখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করে কামড় খায়, আহত হয়, বা ক্ষতবিক্ষত হয়, তখন তাদের কোনওরকম ইনফেকশানই হয় না—দিব্যি বেঁচে থাকে।

কোমোডো ড্রাগনরা…।’

আরও মিনিট-পনেরো কোমোডো-কাহিনি চলল। তারপর জিশানরা সিমুলেশান দেখতে পেল। অর্থাৎ, কোমোডোর সঙ্গে কিল গেম-এর পার্টিসিপ্যান্টরা কীভাবে লড়বে তার ভিডিয়ো গেম।

কমব্যাট পার্কের লোহার গেট খুলে গেল। তার একপাশে দাঁড় করানো একটা বাক্সের গায়ে হলদে গেঞ্জি পরা কতকগুলো মানুষ-পুতুল তাদের স্মার্ট কার্ড টানল। তারপর ঢুকে পড়ল পার্কে।

চারটে শুটার পার্কের আকাশে উড়তে লাগল। পুতুলগুলোর ওপরে নজর রাখতে লাগল।

ভিডিয়ো সিমুলেশানে প্রতিযোগীদের নানান অ্যাঙ্গেল থেকে দেখানো হল। ওরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ছুটছে—উঁচু-নিচু ঢিবি পেরিয়ে, জলাভূমি পেরিয়ে, লতা-পাতার আড়াল সরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। আর ওদের তাড়া করে চলেছে অসংখ্য ক্ষুধার্ত কোমোডো।

একজন ইনস্ট্রাকটর তখন বলছেন, ‘আজকের এই কমপিটিশানের জন্যে পার্কের কোমোডোগুলোকে গত দশদিন ধরে ছাগল, হরিণ বা শুয়োর সাপ্লাই করা হয়নি। ওরা একটা শিকার ধরে তাকে নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি করেছে। তাতে যে-ক’টা কোমোডো মারা গেছে সেগুলোকে বাকিরা দিব্যি ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। এখন খিদের জ্বালায় ওদের সাংঘাতিক অবস্থা। আপনারা সবাই প্রাণপণে ছুটবেন, দরকার হলে গাছ বেয়ে উঠবেন—কি জলে ঝাঁপ দেবেন। কারণ, আপনাদের সকলের উদ্দেশ্য একটাই : কমব্যাট পার্ক থেকে বেঁচে বেরোতে হবে—যদিও বেরোনোর ব্যাপারটা একটু ঝামেলার।

সিমুলেশানের দিকে আপনারা লক্ষ রাখুন…।’ জিশানরা লক্ষ রাখছিল।

মানুষ-পুতুলগুলো ছুটে পালাচ্ছিল, লাফাচ্ছিল, কখনও-বা গাছ বেয়ে উঠে পড়ছিল। আর ওদের পাগলের মতো ধাওয়া করছিল কোমোডোর দল। সিমুলেশানে দেখা গেল, পার্ক থেকে বেরোনোর গেট একটাই। তবে সেই গেটটা একটা ঢিবির ঢালের চূড়ায় বসানো—আর সেখানে পৌঁছনোর পথটা সরু এবং শ্যাওলায় ঢাকা।

প্রতিযোগীরা যখনই সেই পথ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে, বাঁচার চেষ্টা করছে, তখনই হয় তারা শ্যাওলায় পা পিছলে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে, অথবা অন্য প্রতিযোগীরা তাদের পা ধরে টেনে নীচে ফেলে দিয়ে নিজেরা গেটের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করছে।

সিমুলেশান দেখতে-দেখতে জিশান ঠোঁট কামড়াচ্ছিল।

বাঁচার লড়াইটা এতই জঘন্য যে, হয়তো মনোহরকে পা টেনে ফেলে দিয়ে জিশানকেই গেটের কাছে পৌঁছতে হবে। অথবা এর উলটোটা। আর মিনি এই নিষ্ঠুরতার লাইভ টেলিকাস্ট বাড়িতে বসে-বসে দেখবে। ছি:!

না, জিশান বরং মনোহরকে সঙ্গে টেনে নিয়ে বেরোতে চেষ্টা করবে। এটা ঠিকই, মনোহরের তিনকুলে কেউ নেই। কিন্তু একজন বন্ধু কি তিনকুলের মধ্যে পড়ে না? নিশ্চয়ই পড়ে! জিশান সিমুলেশান দেখতে-দেখতে মনকে তৈরি করছিল।

ঠিক পাঁচমিনিট পরেই জিশানরা সিমুলেশানটা সিমুলেট করতে লাগল। কমব্যাট পার্কের মধ্যে ওরা পাগলের মতো ছুটোছুটি করতে লাগল। আর ওদের তাড়া করে বেড়াতে লাগল জায়ান্ট মনিটরের দল। মাথার ওপরে উড়তে লাগল আধডজন শুটার।

.

০৪.

ছুটতে-ছুটতে তেতো হাসি পেল জিশানের। সিমুলেশানের নকল ছবি দেখে এবার ওরা আসল কাজটা করছে। নকলের সিমুলেশান!

জিশান লাফিয়ে একটা গাছে উঠল। ওর পা থেকে ঠিক দু-ফুট দূরে চোয়ালে-চোয়াল ঠোকার শব্দ হল। একটা কোমোডো অল্পের জন্য জিশানের পায়ের নাগাল পায়নি।

জিশান হাঁপাচ্ছিল। গাছের গোড়ায় এসে পৌঁছনো কোমোডোটার দিকে নজর রাখছিল। ওটা বারবার ওর চেরা জিভ বাইরে বের করছে আর ঢোকাচ্ছে। ওটা কি এখন গাছ বেয়ে উঠতে চেষ্টা করবে?

জিশানের সারা গায়ে মাথায় কাদা-মাখা। মিনি এই অবস্থায় ওকে দেখলে নিশ্চয়ই হেসে গড়িয়ে পড়ত। আর শানুও নির্ঘাত ভয়ে ওর কোলে আসতে চাইত না।

মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। গোটা পার্কে কড়া রোদের আলো-ছায়া। একটু দূরেই একটা জলার ঘোলাটে জল চিকচিক করছে। জলার ধারে তিনটে কোমোডো মাথা ঝুঁকিয়ে জল খাচ্ছে।

হঠাৎই পাখির শিস শুনতে পেল জিশান। কিন্তু এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে পাখিটাকে কোথাও দেখতে পেল না। গাছের গোড়ায় ওত পেতে থাকা কোমোডোটার কথা খেয়াল হতেই আবার তাকাল নীচের দিকে। জন্তুটা সবে ওর সামনের দুটো পা গাছের গুঁড়িতে তুলেছে।

কী করা যায় এখন? জিশানের মাথার ভেতরে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল। অনেক ভেবেও মাথা থেকে কিছু বের করতে পারছিল না। কেমন যেন পাগল-পাগল লাগছিল ওর।

কোমোডোটা ধীরে-ধীরে উঠে আসছে ওপরে।

জিশানের গায়ে কাঁটা দিল। এরপর কী হবে?

গাছের ওপরের দিকে তাকাল জিশান। দু-তিনফুট ওপর থেকেই শুরু হয়ে গেছে সরু ডাল। ওগুলো জিশানের ভার সামলাতে পারবে না। তা ছাড়া এই কমব্যাট পার্কে সব গাছই ছোট মাপের—কোনওটাকেই মহীরুহ বলা যায় না। এরকমটা যেন ইচ্ছে করেই করেছে সিন্ডিকেট। এটা কমপিটিশানের ডিজাইনের একটা অংশ। মানুষ মারার নকশা।

তা হলে এখন বাঁচার জন্য কী করবে জিশান?

নিরস্ত্র জিশান মরিয়া হয়ে একটাই পথ দেখতে পেল। ডালপালা ধরে কোনওরকমে উঠে দাঁড়াল ও। তারপর প্যান্টের জিপ খুলে কোমোডোটার মুখে পেচ্ছাপ করতে লাগল।

চকিতে অচেনা গন্ধের ঢেউ কোমোডোটাকে ভাসিয়ে দিল। হিংস্র প্রাণীটার নখের বাঁধন আলগা হয়ে গেল। ওটা খসে পড়ল মাটিতে। নিজেকে সামলে নিয়ে প্রবলভাবে এপাশ-ওপাশ মাথা ঝাঁকাতে লাগল।

জিশান আর দেরি করল না। প্যান্টের চেন লাগিয়ে নিয়ে কী ভেবে গাছের একটা মাঝারি মাপের ডাল সজোরে আঁকড়ে ধরল। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল মাটিতে।

ও যা ভেবেছিল তাই হল। পাঁচ-ছ’ফুট লম্বা ডালটা সটান মটকে গিয়ে চলে এল জিশানের হাতে। ডালটাকে কয়েকটা জোরালো মোচড় দিল ও। ডালটা গাছের গা থেকে খুলে এল—হয়ে গেল হাতের লাঠি। আপাতত এটাই অস্ত্র হোক। ক্ষুধার্ত সরীসৃপগুলোর সঙ্গে লড়াই করার জন্য এই আঁকাবাঁকা লাঠিটা কম কী!

বিভ্রান্ত কোমোডোটাকে পিছনে ফেলে জিশান ছুটতে শুরু করল।

প্রতিযোগীদের সুবিধের জন্য কমব্যাট পার্কের নানান জায়গায় বেরোনোর পথের নিশানা দেওয়া আছে। সেইসব সাইনবোর্ড দেখে-দেখে জিশান উদভ্রান্তের মতো ছুটতে লাগল। শরীরের বহু জায়গায় ছড়ে গেছে, নুনছাল উঠে রক্ত বেরোচ্ছে, জ্বালা করছে—কিন্তু থামার কোনও উপায় নেই।

ছুটতে-ছুটতে ও শুনতে পেল অন্য কোনও খেলোয়াড়ের আর্তচিৎকার। শব্দ লক্ষ করে কয়েকটা গাছের আড়াল পেরিয়ে খানিকটা এগোতেই জিশান দৃশ্যটা দেখতে পেল।

একজন হাট্টাকাট্টা জোয়ান অসহায়ভাবে পড়ে আছে পার্কের মাটিতে। ছোট-বড় মাপের প্রায় সাত-আটটা কোমোডো লোকটাকে ছেঁকে ধরেছে। লোকটা চিৎকার করছে, হাত-পা ছুড়ছে। আর প্রাণীগুলো ধারালো দাঁত-নখে তাকে ছিন্নভিন্ন করছে। একইসঙ্গে নিজেদের মধ্যেও খেয়োখেয়ি করছে।

জিশান ছুটতে লাগল। একটা জলা জায়গা পেরোতেই দুটো কোমোডো দুপাশ থেকে ওর দিকে ছুটে এল। পাগলের মতো গাছের ডাল চালাল ও। একবার, দুবার, বারবার। ভোঁতা সংঘর্ষের শব্দ হতে লাগল। সংঘর্ষের তীব্রতায় ওর কবজি আর কনুই ঝনঝন করে উঠল।

ছুটতে-ছুটতে ও পৌঁছে গেল বেরোনোর গেটের কাছে। সেখানে একলহমা থমকে দাঁড়াল।

সিমুলেশানে যেমন দেখানো হয়েছিল বেরোনোর পথটা একটা ঢালের ওপরে। সেখানে বেয়ে ওঠার সরু শ্যাওলা-মাখা পথে দুজন খেলোয়াড় তখন হাঁকপাঁক করে ওপরে উঠতে চাইছে। পা পিছলে গেলে পথের দুপাশের আগাছার ঝুঁটি ধরে সামলে নিচ্ছে।

বেয়ে ওঠার পথের নীচেই অপেক্ষা করছে ছোট মাপের তিনটে কোমোডো। ওরা তাকিয়ে আছে ওপরদিকে—কখন প্রতিযোগী দুজন পা পিছলে পড়ে।

জিশানের চোখ মনোহরকে খুঁজছিল—কিন্তু খুঁজে পেল না। মনোহর কি আগে বেরিয়ে গেল, নাকি পিছনে পড়ে আছে?

আর ভাবার সময় পেল না জিশান। একটা কোমোডো ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। চেরা জিভ মুখের বাইরে বেরোচ্ছে আর ঢুকে পড়ছে।

জিশান আর দেরি করল না। পিছনদিকে ছুট লাগল। অনেকটা গিয়ে তারপর থামল। এবং ঘুরে দাঁড়াল।

হাতের লাঠিটা উঁচিয়ে ধরে এবার গেট লক্ষ করে ছুটতে শুরু করল। ওর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ও পোলভল্ট প্রতিযোগিতায় নাম দিয়েছে।

জিশান সত্যিই তাই করল। ছুটতে-ছুটতে ঢালের কাছাকাছি এসে পড়ল। তারপর গাছের ডালটাকে লাঠির মতো ব্যবহার করে মাটিতে ভর দিয়ে শূন্যে লাফ দিল।

সময় মতো লাঠিটা ছেড়ে দিল জিশান। আকাশে একটা বৃত্তচাপ তৈরি করে ও একেবারে গেটের মুখে এসে আছড়ে পড়ল। মাটিতে কয়েকবার পাক খাওয়ার পর ওর শরীরটা থামল।

সামনেই খোলা গেট। মুক্তি। এবারের মতো চ্যালেঞ্জ রাউন্ড শেষ। লাইভ টেলিকাস্ট শেষ।

জিশান উঠে দাঁড়াল। প্রায় টলতে-টলতে এগিয়ে গেল খোলা গেটের দিকে। এতক্ষণ ও যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। এখন ঘোর কাটতেই দুনিয়ার ক্লান্তি ওকে জড়িয়ে ধরল। একইসঙ্গে ক্ষতবিক্ষত শরীরের জ্বালা-পোড়া তীব্রভাবে টের পেল।

ও: ভগবান! চরম পরীক্ষার আগে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে ওকে!

গেটের বাইরে মেডিক্যাল ইউনিটের লোকজন অপেক্ষা করছিল। তারা জিশানকে দেখামাত্রই ছুটে এল। অ্যালুমিনিয়াম আর পলিমারের তৈরি স্ট্রেচারে ওকে চটপট শুইয়ে দিল। তারপর ওকে নিয়ে ঢুকে পড়ল একটা ছোট দোতলা বাড়িতে।

বাড়িটার নাম ‘পোস্টগেম কেয়ার’। জিশান বুঝল, ব্যাপারটা অনেকটা নার্সিংহোম টাইপের। চ্যালেঞ্জ রাউন্ড শেষ হওয়ার পর প্রতিযোগীদের শুশ্রূষা এবং চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছে এরা।

স্ট্রেচারে চিত হয়ে শুয়ে এগিয়ে চলার সময় জিশান নার্সিংহোমের সাদা ধপধপে সিলিং আর দেওয়াল দেখতে লাগল। একইসঙ্গে ও মনোহরের কথা ভাবতে লাগল। মনোহর এখন কোথায়? কমব্যাট পার্কে, নাকি এই পোস্টগেম কেয়ার বিল্ডিং-এ?

জিশানকে একটা বড় এসি রুমে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ঘরটার সবক’টা দেওয়ালই কাচের। ধপধপে সাদা আলোয় ঝকঝক করছে। ঘরে প্রায় কুড়ি-বাইশটা বেড। তার কয়েকটায় পেশেন্ট শুয়ে আছে। মেডিকরা তাদের তদারকি করছে।

জিশানকে একটা বেডে শুইয়ে দেওয়া হল। সঙ্গে-সঙ্গে দুজন ডাক্তার আর একজন সিস্টার ওকে ঘিরে ধরল। ওর যত্ন নিতে লাগল।

জিশানের তেমন মারাত্মক কোনও চোট ছিল না। তবে একজন ডাক্তার ওকে বলল যে, কোমোডোর কামড় খাওয়ার পর ইনফেকশানের হাত থেকে রেহাই পেতে একটা অ্যান্টিডোট সব কমপিটিটরকেই ইনজেক্ট করা হয়। ইনজেকশানটা নেওয়ার সময় একটু ব্যথা লাগবে। জিশান যেন কিছু মনে না করে।

হাসি পেয়ে গেল জিশানের।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ও একের-পর-এক মরণখেলা খেলে চলেছে। এইমাত্র ও ভয়ঙ্কর কোমোডো ড্রাগনের ধারালো দাঁতের আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়ে প্রাণে বেঁচে ফিরে এসেছে। আর ইনজেকশানটা দেওয়ার সময় একটু ব্যথা লাগবে বলে আগেভাগেই ডাক্তার বিনীতভাবে ক্ষমা চাইছে! আশ্চর্য!

মিনিট-কুড়ি পরেই বেডে উঠে বসল জিশান। শরীরটা এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে, তবে একটু ঘুম-ঘুম ভাব লেগে রয়েছে। হয়তো ডাক্তারদের দেওয়া ওষুধপত্রের জন্য, কিংবা ওই অ্যান্টিডোট ইনজেকশানের জন্য।

জিশান দেখল, ওকে নিয়ে ঘরে মোট পাঁচজন পেশেন্ট। তার মানে এই রাউন্ডটায় এই পাঁচজন কোয়ালিফাই করেছে। এরপর আর-একটা রাউন্ড। আর তারপরই পিট ফাইট।

হঠাৎই ঘরে ঢুকল দুজন ইনস্ট্রাকটর। জিশান তটস্থ হয়ে তাদের দিকে তাকাল। একজন ইনস্ট্রাকটর ল্যাপটপের বোতাম টিপে এলসিডি স্ক্রিনে ফুটে ওঠা লেখা দেখে বলতে লাগল, ‘এই রাউন্ডে কোয়ালিফাই করেছে পাঁচজন পার্টিসিপ্যান্ট। তাদের প্রত্যেকের জন্যে পুরস্কার পঞ্চাশহাজার টাকা। কনগ্র্যাচুলেশানস…। আর ফর ইয়োর ইনফরমেশান, বাকি ছ’জনের কয়েকজন মারা গেছে—আর কয়েকজন ইনডিসপোজড… মানে, অকেজো হয়ে গেছে।’

জিশান একটা ধাক্কা খেল। খবর পড়ার মতো নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে কী সহজেই না আহত-নিহতদের পরিসংখ্যানটা জানিয়ে দিল লোকটা! বাচ্চা মেয়েটার কথা মনে পড়ল। জিশানরা ফেরার সময় পাঁচের বেশি ওকে গুনতে হবে না।

ইনস্ট্রাকটর তখন বিজয়ী পাঁচজনের নাম বলছিল। তারপর বলল, ‘থ্যাংক য়ু ফর ইয়োর পার্টিসিপেশান। উইশ য়ু অল দ্য বেস্ট। ঠিক আধঘণ্টা পর আমরা জিপিসি-র গেস্টহাউসের দিকে রওনা হব। য়ু প্লিজ গেট রেডি বাই দেন…।’ ইনস্ট্রাকটর দুজন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

জিশান ইনস্ট্রাকটরের শেষদিকের কথাগুলো আর শুনছিল না। ও বেডে শুয়ে থাকা অন্য চারজন পেশেন্টের দিকে দেখছিল। কোথায় মনোহর? কারণ, ইনস্ট্রাকটরের বলা পাঁচজনের নামের মধ্যে মনোহর সিং-এর নাম আছে।

হঠাৎই একটা বেডে একজন পেশেন্ট সোজা হয়ে বসল। জিশানকে লক্ষ করে ডেকে উঠল, ‘এ জিশান ভাইয়া!’

জিশান চমকে সেদিকে ফিরে তাকাল।

মনোহর সিং। মুখে একগাল হাসি। কালচে ছোপধরা দাঁত দেখা যাচ্ছে। একপায়ে হাঁটুর নীচে ব্যান্ডেজ।

জিশান বেড থেকে নেমে ওর কাছে এগিয়ে গেল। পায়ের ব্যান্ডেজের দিকে আঙুল দেখাতেই মনোহর উঠে বসল। কোমরের নীচে ইনজেকশানের জায়গাটা হাত দিয়ে ঘষতে-ঘষতে বলল, ‘একটা গিরগিটি আমার পায়ে কামড়ে দিয়েছে—।’

জিশান মনোহরকে দেখে খুব খুশি হয়েছিল। হেসে বলল, ‘গিরগিটি নয়—কোমোডো।’

‘ওই একই হল। সালা আমিও একটা গিরগিটিকে কামড়ে দিয়েছি…।’

জিশান আঁতকে উঠল। মনোহর বলে কী! একটা কোমোডো ড্রাগনকে ও কামড়ে দিয়েছে!

সে-কথা জিগ্যেস করতে মনোহর বলল, ‘হাঁ, জিশান ভাইয়া। আমার পায়ে কামড় দিয়ে জানোয়ারটা ছাড়ছিল না। তখন আমি লড়তে-লড়তে ওটার লেজে কামড় দিয়েছি। ও:, কী বাজে টেস্ট!’ নাক কুঁচকে ঘেন্নায় মাথা ঝাঁকাল মনোহর।

জিশান আবার হেসে ফেলল। তবে সেই হাসির মধ্যে কিছুটা দু:খ মেশানো ছিল। সুপারগেমস কর্পোরেশন কী চমৎকারভাবেই না মানুষকে ধীরে-ধীরে পালটে দিচ্ছে পশুতে! একটা মানুষ পশুর গায়ে কামড় বসিয়ে লড়াই করছে—পশুর মতো!

অন্যান্য বেডের বাকি তিনজন তখন বিছানায় উঠে বসেছে। নিজেদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছে। পঞ্চাশহাজার টাকার প্রাইজ মানি কে কীভাবে খরচ করবে তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে।

 সেদিকে একবার তাকিয়ে মনোহর সিং বলল, ‘জিশান ভাইয়া, তোমার তো মোট প্রাইজ মানি হল আশিহাজার টাকা। তুমি এই টাকাটা নিয়ে কী করবে ঠিক করেছ?’

জিশান বলল, আজ রাতে অন-লাইন নেটওয়ার্কে বোতাম টিপে বলে দেব টাকাটা আমার ওয়াইফের কাছে পাঠিয়ে দিতে। মিনি ঠিক করবে এই টাকা দিয়ে ও কী করবে। আমার তো এখান থেকে ফিরে যাওয়ার কোনও ঠিক নেই…বুঝতেই পারছ…।’

‘ফিরতে তোমাকে হবেই, জিশান ভাইয়া। তোমার বিবি-বাচ্চার সঙ্গে মিলতে হবে। ওরা ওয়েট করছে…।’

জিশানের মনটা পলকে উড়ে গেল ওল্ড সিটিতে। মিনি আর শানুর কাছে। ওদের কাছে যদি ও আর কখনও ফিরতে পারে তখন কি আর ও মানুষ থাকবে? ফিরে গিয়ে ওদের সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্তটার কথা ভেবে ভয় পেল জিশান।

মনোহর তখন হাসিমুখে বলছে, ‘আমার টাকাটা নিয়ে কী করব সেটা আমিও ভেবে ফেলেছি।’

‘কী করবে?’

‘তিরিশহাজার আমি রাখব, আর বাকিটা আমার ভাতিজাকে দেব—।’

‘ভাতিজা?’ অবাক হয়ে বলল জিশান, ‘এই যে বলো, তোমার আগে-পিছে কেউ নেই!’

‘আগে ছিল না—এখন আছে।’ মুচকি হেসে বলল মনোহর, ‘একজন দাদা আছে, একজন ভাবী আছে, আর একজন ভাতিজা আছে।’

‘মানে?’

মনোহর ঝুঁকে পড়ে জিশানের হাত চেপে ধরল : ‘জিশান ভাইয়া, তুমি আমার দাদা আছ। আর শানু মেরা ভাতিজা। আমার আগে তো রিশতেদার কেউ ছিল না—এখন আছে। ওই পঞ্চাশহাজার টাকা আমি ভাতিজা শানুর জন্যে রাখব। তোমার কোনও ”না” শুনব না। তুমি আজ আমার ঘরের কম্পিউটার থেকে টাকাটা ট্রান্সফারের বেওস্থা করে দেবে। ওয়াদা?’

জিশানের চোখে জল এসে গিয়েছিল। ও চাপা গলায় বলল, ‘পাক্কা ওয়াদা।’

ও মনে-মনে চাইছিল, পিট ফাইটে কিছুতেই যেন ওকে মনোহরের মুখোমুখি না পড়তে হয়। যদি পড়ে, তা হলে জিশান লড়বে না—কিছুতেই না। তার জন্য শ্রীধর পাট্টা যে-শাস্তিই দিক জিশান মেনে নেবে। হোক সে রোলারবল, কিংবা প্রাইজ মানি আর লাইভ টেলিকাস্ট ছাড়া হাংরি ডলফিন কি ম্যানিম্যাল রেস—অথবা ডগ স্কোয়াড।

মনোহরের হাতে চাপ দিয়ে জিশান ধরা গলায় বলল, ‘আশ্চর্য, মনোহর, আমরা এখনও ইনসান আছি—পুরোপুরি জানবর হয়ে যাইনি।’

আর পাঁচ-দশমিনিটের মধ্যেই ইনস্ট্রাকটর দুজন ঘরে ঢুকে পড়ল। চেঁচিয়ে বলল, ‘ও. কে. গাইজ—লেটস গো।’

ওরা পাঁচজন চটপট লাইন দিয়ে দাঁড়াল। তারপর ঘর থেকে রওনা হল।

মনোহর জিশানের ঠিক সামনেই ছিল। সামান্য খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটছিল। ও জিশানের দিকে মুখ ফিরিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘বহত ভুখ লাগছে, জিশান ভাইয়া—।’

‘আমারও—। তবে চিন্তা নেই, গেস্টহাউসে গিয়েই মহাভোজ পেয়ে যাবে।’

‘এর পরের রাউন্ডের আগে আমাদের রেস্ট দেবে তো? আমার পায়ের যা অবস্থা…।’

‘নিশ্চয়ই দেবে। কিন্তু পরের রাউন্ডে কী গেম রেখেছে কে জানে!’

‘আমি শুনেছি, জিশান ভাইয়া। পরের রাউন্ডের গেমটার নাম ”স্নেক লেক”। তার পরে লাস্ট রাউন্ডের ”পিট ফাইট”…।’

‘স্নেক লেক?’

‘হ্যাঁ। জহরিলা সাপে কিলবিল করছে এমন একটা লেকের মধ্যে দিয়ে আমাদের ছুটতে হবে…।’

‘লেকের মধ্যে দিয়ে ছুটতে হবে মানে?’ জিশান অবাক হয়ে জানতে চাইল। লক্ষ করল, লাইনের বাকি তিনজন গলা বাড়িয়ে ওদের চাপা কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করছে।

‘লেকে বেশি জল নেই। আধহাঁটু জল। আমি ফকিরচাঁদের কাছে শুনেছি। ওর ভাই আমিরচাঁদ স্নেক লেকে ছুটতে গিয়ে সাপের কামড়ে মারা গেছে…।’

জিশান আর কোনও কথা বলল না। আজকের কমব্যাট পার্ক রাউন্ডেও হয়তো দু-চারজন মারা গেছে। এই মৃতদেহগুলো কোথায় যায়? সিন্ডিকেট কি এই ডেডবডিগুলো সৎকার করার চেষ্টা করে?

হঠাৎই জিশানের মনে হল, এটা খুবই মামুলি প্রশ্ন। যারা নিয়মিত মনুষ্যত্বের সৎকার করে চলেছে তাদের কাছে ডেডবডির নিয়মিত বন্দোবস্ত করাটা কোনও ব্যাপারই নয়।

আজ রাতে মিনির সঙ্গে কথা বলবে জিশান। প্রাণভরে দশমিনিট ধরে কথা বলবে। বলবে, কীভাবে ও আজ জিতেছে। কীভাবে মানুষ থেকে জানোয়ারের দিকে আরও একধাপ এগিয়েছে। বলবে মনোহর সিং-এর কথাও।

পড়ন্ত বেলায় জিশানরা যখন লাইন করে হেঁটে ফিরছে তখন দেখল পশ্চিম দিগন্তে সূর্য ডুবে যাচ্ছে।

জিশানের বুক থেকে একটা লম্বা নিশ্বাস বেরিয়ে এল। সূর্য ডুবে যাওয়ার ব্যাপারটা ওর ভালো লাগল না।

মাইক্রোভিডিয়োফোনে মিনির ছবি ভেসে উঠতেই জিশান কেমন যেন হয়ে গেল। ওর মনের ভেতর থেকে নিউ সিটির ছবি মিলিয়ে গেল পলকে। ও ভুলে গেল নিউ সিটির ‘সিটিজেন’-দের অফুরন্ত ভোগ আর আহ্লাদের কথা, সুপারগেমস কর্পোরেশনের বিপজ্জনক এবং হিংস্র খেলাগুলোর কথা, শ্রীধর পাট্টার কথা, এমনকী কিল গেম-এর কথাও।

ওর মন সিনেমার জাম্প কাটের মতো একলাফে পৌঁছে গেল ওল্ড সিটিতে—ওর সস্তা, ভাঙাচোরা, নোংরা ঘরে। ও মিনির গায়ের গন্ধ পেল। একইসঙ্গে নাকে এল ছোট্ট শানুর হিসি করে ভিজিয়ে দেওয়া প্যান্টের গন্ধও।

‘কেমন আছ, মিনি?’ ধরা গলায় জানতে চাইল জিশান।

‘যেমন থাকা যায়—তোমাকে ছেড়ে।’ মিনির চোখে জল এসে গেল।

‘শানু কেমন আছে? ওকে একবার দেখাও—।’

‘ও তো বাচ্চা, তাই আমার চেয়ে ভালো আছে। একমিনিট ওয়েট করো—ওকে নিয়ে আসছি—।’

একটু পরেই এমভিপিতে শানুকে দেখতে পেল জিশান। ছোট-ছোট জীবন্ত চকচকে চোখ, মুখে হিজিবিজি শব্দের টুকরো, বারবার এমভিপির স্ক্রিনের দিকে থাবা বাড়াচ্ছে।

জিশানের মুখে খুশির ছোঁয়া লাগল। ও অর্থহীন ভাষায় ছেলের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল।

শানুকে রেখে এল মিনি। চোখ নামিয়ে মাথা নেড়ে বলল, ‘আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না…।’

জিশান বলল, ‘মন খারাপ কোরো না। আমি তো এখানে লড়াই করছি…তোমাকেও ওখানে লড়াই করতে হবে।’ কথা বলতে-বলতে চোখ মুছল জিশান: ‘আজ আমাদের কমব্যাট পার্কে সারপ্রাইজ রাউন্ড ছিল। আমরা পাঁচজন জিতেছি—পঞ্চাশহাজার টাকা করে…।’

‘হ্যাঁ—প্লেট টিভিতে দেখেছি। জন্তুগুলো যা বীভৎস দেখতে—উফ, ভাবা যায় না।’ মিনি শিউরে উঠল।

‘মনোহরভাইয়াও জিতেছে। ও ওর প্রাইজ মানি শানুকে গিফট করবে। আমার কোনও বারণ শুনছে না।’ বলে মনোহরের সঙ্গে আজ পোস্টগেম কেয়ার বিল্ডিং-এ যা-যা কথা হয়েছে সব জানাল।

জিশানের কাছে মনোহর সিং-এর কথা আগে শুনেছে মিনি। এখন এইসব কথা শোনার পর ওর ঠোঁটে একচিলতে হাসির রেখা ফুটল। ও নরম গলায় বলল, ‘জিশান, সিন্ডিকেট দেখছি এখনও তোমাদের পুরোপুরি অমানুষ করতে পারেনি! যার তিনকুলে কেউ নেই—মনোহরদা—তার মধ্যেও দ্যাখো, এখনও কেমন স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা রয়েছে।’

বরাদ্দ দশমিনিট সময় ক্রমশ কমে যাচ্ছিল। জিশান আজকের সারাদিনের গল্প শোনাতে লাগল মিনিকে। শোনাল ছোট্ট মেয়েটার কথা—যে জিশানদের হাসিমুখে ‘টা-টা’ করছিল। জিশান বলল, এর পরের রাউন্ডে স্নেক লেক। আর তারপর পিট ফাইট। ও ইচ্ছে করেই জাব্বার কথা চেপে গেল। এখন ওসব শঙ্কা-আশঙ্কার কথা মিনিকে বলে ওর দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। যখন মিনি ওসব গেম-এর লাইভ টেলিকাস্ট দেখবে তখন যা দেখার দেখবে।

বাড়ির খবর নেওয়া ছাড়াও পাড়াপড়শিদের খবর নিল জিশান। তারপর দশমিনিটের কোটা শেষ হয়ে আসছে দেখে তাড়াতাড়ি কথা শেষ করতে চাইল।

মিনির চোখে জলের ফোঁটা। সেই অবস্থাতেই পুরোনো কথাটা আবার বলল।

‘জিততে তোমাকে হবেই। এখানে আমরা সবাই খুব আশা করে আছি। তবে শুধু জেতা নয়—তুমি জিতলে এই জঘন্য ব্যাপারটা একেবারে বন্ধ করার ব্যবস্থাও করতে হবে তোমাকে। তোমাকেই।’

‘পারব কি না জানি না—তবে চেষ্টা তো একবার করবই।’ দাঁতে দাঁত চেপে বলল জিশান। ওর মালিকের কথা মনে পড়ল। মনে পড়ল শিবপদর কথা। কষ্ট করে ঢোঁক গিলল দুবার। তারপর নিচু গলায় মিনিকে বলল, ‘এবার আসি। কাল কথা বলব আবার। লাভ য়ু…।’

মিনির সঙ্গে কথা শেষ হলে চুপচাপ বিছানায় বসে রইল জিশান। ও চোখ বুজে ভাবতে চাইল যে, ও ওল্ড সিটিতে নিজের ঘরে মিনি আর শানুর কাছে বসে আছে। কিন্তু কয়েকসেকেন্ড পরেই কল্পনার ছবিটা নড়েচড়ে ঘেঁটে গেল। ওর মাথার মধ্যে পরের রাউন্ডের বিপজ্জনক গেমগুলোর কথা ঘুরতে লাগল। সঙ্গে-সঙ্গে মুখে একটা বিরক্তির শব্দ করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল জিশান। সামনের ছোট টেবিলে পড়ে থাকা গোল বলের মতো চেহারার রিমোট ইউনিটটা তুলে নিল। বোতাম টিপে ঘরের সব আলো নিভিয়ে দিল। এখন ওর অন্ধকারে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করছে।

ডিজিটাল ঘড়ির দিকে চোখ গেল জিশানের। রাত বারোটা দশ। অন্ধকার ঘড়িতে শুধু ডিজিটাল অক্ষরগুলো জ্বলজ্বল করছে—পাশে উজ্জ্বল নকল চাঁদের ছবি।

জিশানের আসল চাঁদ দেখতে ইচ্ছে করল। ও উঠে চলে বারান্দায়। রেলিং-এ হাত রেখে আকাশের দিকে তাকাল। প্রাণপণে অস্থির মনটাকে শান্ত করতে চাইল।

কালো আকাশময় ছোট-ছোট তারার ছিটে। মিটমিট করে জ্বলছে। সেই পটভূমিতে তুলির টান দিয়েছে লাল এবং নীল ধূমকেতুর আলো।

হঠাৎই একটা শুটারের আলো চোখে পড়ল জিশানের। ওটার হেডলাইটের তীব্র সাদা বর্শা সামনের অন্ধকারকে চিরে দিয়ে ছুটে চলেছে। আবছা শিসের শব্দ জিশানের কানে আসছে। এ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

একই আকাশ ছেয়ে আছে ওল্ড সিটিকে। অথচ আকাশের নীচের ছবিটা কী বিশ্রীভাবে দুরকম। ওল্ড সিটিতে অভাবের অভাব নেই, আর নিউ সিটিতে অভাব খুঁজে পাওয়াই মুশকিল।

কিন্তু অভাব নেই বলেই কি নিউ সিটির স্বভাব বিগড়ে গেছে? অবাক হয়ে ভাবল জিশান। ওর মনে হল, সব মানুষের জীবনেই কিছুটা অভাব জড়িয়ে থাকা ভালো। তা হলে স্বভাবটা বোধহয় আর ততটা খারাপ হবে না।

হঠাৎই একটা চাপা কান্নার শব্দ কানে এল জিশানের।

বহুদূর থেকে ভেসে আসা শব্দটা শুনে মানুষের কান্না বলেই মনে হল। কিন্তু কে কাঁদছে এত রাতে?

বারান্দার রেলিং-এর ওপর ঝুঁকে নীচের দিকে তাকাল জিশান। জিপিসি-র গেস্টহাউসের চারপাশটা আলোয় আলো। কিন্তু উনতিরিশ তলার উচ্চতা থেকে নীচের চাতালে কাউকে নজর করাটা সহজ নয়। তবুও কালো ফুটকির মতো একটা মানুষের মাথা দেখতে পেল। কান্নাটা বোধহয় সেদিক থেকেই আসছে।

জিশানের মনে হল, অস্থির মনটাকে শান্ত করতে কোনও একটা কাজ নিয়ে মেতে ওঠা দরকার। কারণ, এখন ওর মনের যা অবস্থা তাতে বিছানায় গিয়ে শুলেও ঘুম আসবে না। তাই কান্নার শব্দটা তলিয়ে দেখাটাকেই ও ‘কাজ’ হিসেবে বেছে নিল।

ঘরে এসে পোশাক পালটে নিল জিশান। একটা বাদামি রঙের টি-শার্ট আর নীল জিনসের প্যান্ট পরে নিল। মাথার চুলে দুবার চিরুনি চালাল। তারপর সোজা ঘরের বাইরে এসে পা বাড়াল অটো-এলিভেটরের দিকে।

শুনশান করিডর। সামনে-পিছনে তাকালে কাউকে চোখে পড়ে না। শুধু পিস ফোর্সের দুজন গার্ড করিডরের দুটো বাঁকের মুখে বসে আছে। হঠাৎ করে দেখলে ওদের পাথরের মূর্তি বলে ভুল হতে পারে।

জিশানকে দেখে ওরা একচুলও নড়ল না। তাতে জিশান অবাক হল না। কারণ, ওর রেজিস্ট্রেশান কিটের ভেতরে জিপিসি-র ‘রুলস অ্যান্ড রেগুলেশানস’-এর একটা বই ছিল। তাতে ইংরেজি, হিন্দি এবং বাংলায় গেমস পার্টিসিপ্যান্টস ক্যাম্পাসের সবরকম নিয়মকানুন লেখা ছিল। জিশান সেগুলো পড়ে দেখেছে। তাতে বলা আছে, ডেইলি রুটিনের মধ্যে যে-সময়টা প্রতিযোগীর নিজের—মানে, যখন তার অবসর সময়—তখন সে ক্যাম্পাসের মধ্যে যখন খুশি যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবে জিপিসি-র কোনও নিয়ম ভাঙা যাবে না।

হাসি পেয়ে গেল জিশানের। খাঁচার মধ্যে স্বাধীনতা!

সত্যি, সুপারগেমস কর্পোরেশনের কাজকর্ম এত নিখুঁত যে, যেসব প্রতিযোগী লেখাপড়া জানে না, তাদের জন্য ওরা মাইনে করা লোক রেখেছে। তারা নিয়মিত রুলস অ্যান্ড রেগুলেশানস-এর ক্লাস নেয়। জিপিসি-র নিয়মকানুনের প্রতিটি ধারা বুঝিয়ে দেয়। প্রতিযোগীরা ইচ্ছে করলে সেই ক্লাস করতে পারে। ফলে কোনও প্রতিযোগীই কোনও ‘বেআইনি’ কাজ করে বলতে পারবে না যে, সে নিয়ম জানত না। শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

অটো-এলিভেটরে ঢুকে পড়ল জিশান। সেখানেও পিস ফোর্সের একজন গার্ড বসে আছে—হাতে নীল রঙের শকার।

গার্ডটা ঝিমোচ্ছিল। জিশান ঢুকতেই নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। ঠোঁটের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়া লালা মুছে নিল। শকারের হাতলে হাত রেখে জিশানের দিকে সতর্ক নজরে তাকিয়ে রইল—কিন্তু কোনও কথা বলল না।

জিশান বোতাম টিপতেই এলিভেটর নীচে নামতে শুরু করল।

একটু পরেই গেস্টহাউসের সদর দরজায় পৌঁছে গেল ও। কাঠের ফ্রেমে লোহার গ্রিল আর বুলেটপ্রুফ কাচ দিয়ে তৈরি বিশাল শৌখিন দরজা। পকেট থেকে স্মার্ট কার্ড বের করে দরজার ফ্রেমের পাশে বসানো যন্ত্রে সোয়াইপ করল জিশান। ‘বিপ’ শব্দ হল। একটা সবুজ এল. ই. ডি. বাতি জ্বলে উঠল। তারপর হাতের চাপ দিতেই দরজার পাল্লা খুলে গেল। এবং কান্নার শব্দটা জোরালোভাবে শোনা গেল।

শীতাতপের এলাকা ছেড়ে বাইরে বেরোতেই প্রকৃতির উষ্ণ বাতাস জিশানকে জড়িয়ে ধরল। বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ পেল জিশান। বোধহয় রাত-ফুলের গন্ধ।

বিল্ডিং-এর বাইরে সাদা মার্বেল বাঁধানো চাতাল। ভেপার ল্যাম্পের আলোয় ঝকঝক করছে। চাতালের দুপাশে সুন্দর বাগান আর ঘাসে ছাওয়া লন। আর মাঝখানে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু এক বিমূর্ত ভাস্কর্য। তাকে ঘিরে লাল-নীল-হলদে-সবুজ রঙিন জলের ফোয়ারা।

ফোয়ারার রঙিন জলের ধারা এসে পড়ছে পাদদেশের জলাশয়ে। সেখানে সব রং মিলেমিশে তৈরি হয়েছে এক বিচিত্র গাঢ় রঙের জল।

জলাশয়ের চারদিকে প্রায় দু-ফুট উঁচু মার্বেল পাথরের পাঁচিল। পাঁচিলের গায়ে নানান কারুকাজ করা, আর তাকে ঘিরে ছোট-ছোট মার্বেল পাথরের টবে সুন্দর-সুন্দর গাছ।

কিন্তু জিশান এসব ভালো করে দেখছিল না। ও তাকিয়ে ছিল জলাশয়ের পাঁচিলের ওপরে ভিজে ন্যাকড়ার মতো শিথিলভাবে শুয়ে থাকা লোকটার দিকে।

লোকটা উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। গায়ে নীল হাফশার্ট আর ছাই রঙের প্যান্ট। পায়ের চটি খসে পড়ে আছে মার্বেল পাথরের মেঝেতে। ওর একটা হাত জলাশয়ের জলের ভেতরে ডোবানো, অন্য হাতটা পাঁচিলের এপাশে ঝুলছে। দেখে হঠাৎ করে মনে হতে পারে ও আর বেঁচে নেই। কিন্তু কান্নার আওয়াজটা জানিয়ে দিচ্ছে ও বেঁচে আছে—অন্তত এখনও।

এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে পিস ফোর্সের দুজন গার্ডকে দেখতে পেল জিশান। ওরা টান-টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরে শকার ঝুলছে। ওদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল না যে, সামনে পড়ে থাকা মানুষটার অস্তিত্ব ওরা টের পাচ্ছে।

জিশান গার্ড দুটোর দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে ফোয়ারার কাছে এগিয়ে গেল। দুটো টবের মাঝে দাঁড়িয়ে লোকটার শরীরটাকে টেনে তুলতে চেষ্টা করল।

জিশানের হাতের ছোঁয়া পেয়েই লোকটা কান্না থামিয়ে চট করে উঠে বসল। ঘুরে তাকাল জিশানের দিকে—চোখেমুখে লড়াকু ছাপ। কিন্তু জিশানকে দেখেই ওর ভাবভঙ্গি নরম হল। ‘ও—’ বলে জলাশয়ের পাড়ে মাথা ঝুঁকিয়ে অবসন্নভাবে বসে রইল। ওর গলা দিয়ে কান্নার মিহি গোঙানি বেরিয়ে আসতে লাগল। শরীরটা ফুলে-ফুলে উঠতে লাগল।

লোকটাকে ভালো করে দেখল জিশান।

লম্বাটে মুখ। পোড়খাওয়া তামাটে রং। গালে খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। ছোট কিন্তু চওড়া ভুরু। চোখ দুটো নরম—ভালোবাসার কবিতার মতো। সেই চোখে জল।

লোকটার মুখে আলোছায়ার খেলা। চোখের দৃষ্টি বিভ্রান্ত।

‘তুমি কাঁদছ কেন?’ লোকটার পিঠে হাত রেখে জিশান জিগ্যেস করল।

লোকটা কোনও উত্তর দিল না। এমনকী জিশানের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।

জিশান আবার জিগ্যেস করল, ‘কী হয়েছে?’

লোকটা এবার কান্না থামাল। দু-হাতে চোখ মুছে জিশানের দিকে তাকাল। ওর চোখে লালচে আভা, চোখের কোল ফোলা। ভাঙা গলায় পালটা প্রশ্ন করল, ‘তোমাকে বলে কী ফায়দা?’

জিশান ওর পাশে বসে পড়ল। বলল, ‘তেমন লাভ কিছু হবে কি না জানি না, তবে তোমার দু:খ একটু কমতেও পারে…।’

‘হুঁ:!’ বলে তাচ্ছিল্যের একটা শব্দ করল লোকটা : ‘দু:খ কমলেও আমার ভাই তো আর ফিরবে না…।’

‘তোমার ভাইয়ের কী হয়েছে?’

‘ও মারা গেছে। ”স্নেক লেক” গেমটায় নাম দিয়েছিল। সাপের কামড়ে মারা গেছে—।’

‘কবে?’

‘আটদিন আগে। দুটো সাপ পায়ে কামড়েছিল।’ আবার ফুঁপিয়ে উঠল লোকটা। হাতের পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিল : ‘…আসলে ও রেসটা শেষ করেছিল। সেকেন্ড হয়েছিল। তখনও বুঝতে পারেনি ওকে সাপে কেটেছে। কয়েকমিনিট পর ছটফট করতে-করতে পড়ে গেল। এদের ডাক্তার নার্স আসতে-আসতেই সব শেষ। ভাইয়া চলে গেল…আমাকে ছেড়ে চলে গেল….।’

জিশান একটু অবাক হল। আটদিন আগে যে-ভাই মারা গেছে তার জন্য লোকটা আজ হাপুস নয়নে কাঁদছে! সবাই জানে, সুপারগেমস কর্পোরেশনের গেম শো-তে নাম দিলে সাধারণত প্রাণের ঝুঁকি থাকে। ফলে প্রিয়জন হারানোর শোকটা কখনও আচমকা আসে না—তার একটা মানসিক প্রস্তুতি থাকে। তার ওপর দু:খের ঘটনাটা ঘটেছে আটদিন আগে। তাই কোথায় যেন একটা খটকা লাগছিল জিশানের।

ও লোকটাকে বলল, ‘চলো ভাই, আমরা মেন গেটের কাছে যাই। ওখানে ঘাসের ওপরে বসে একটু গল্প করি। আমিও এখানকার গেম-এ নাম দিয়েছি। টেনশানে ঘুম আসছিল না। তোমার কান্না শুনে নীচে নেমে এলাম। চলো…দু:খ তো লাইফে থাকবেই…।’ কথা বলতে-বলতে জিশান উঠে দাঁড়াল।

লোকটা জিশানের দিকে তাকিয়ে কী বুঝল কে জানে। দু-হাতে ঘষে-ঘষে চোখ মুছল। ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়াল।

ওরা পাশাপাশি পা ফেলে মেন গেটের দিকে এগিয়ে চলল। জিশান লোকটাকে নিজের কথা বলতে লাগল। বলল, কীভাবে ও নিউ সিটিতে এসে পৌঁছেছে। কীভাবে ব্ল্যাকমেল করে ওকে কিল গেম-এ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নিজের কাহিনি শেষ করে জিশান জিগ্যেস করল, ‘তোমার নাম কী?’

লোকটা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘ফকিরচাঁদ।’

জিশানের মনে পড়ল মনোহরের কথা। আজ বিকেলে ‘কমব্যাট পার্ক’ থেকে ফেরার সময় মনোহর তা হলে এর কথাই বলছিল!

মেন গেটের দুপাশে সবুজ লন। একটু দূরে সুন্দর জ্যামিতিক কায়দায় সাজানো ঝাউগাছ আর পামগাছ।

এদিকটায় আলো কম। তাই অনেকটা যেন খোলামেলা পার্কের কোমল আবহাওয়া। সবুজ ঘাসের মোলায়েম আসনে বসে জিশানের মনেই হল না ও আর ফকিরচাঁদ আসলে নিউ সিটির ‘বন্দি’।

ওরা দুজনে কথা বলতে লাগল।

জিশান লক্ষ করল, মেন গেটের বাইরে দুজন গার্ড পাহারা দিচ্ছে। ওরা জিশানদের দিকে একপলক তাকিয়েই নজর সরিয়ে নিল। মেন গেটের বাইরে না আসা পর্যন্ত ওদের কাছে জিশানদের কোনও গুরুত্ব নেই।

বুক ভরে বাতাসের গন্ধ নিচ্ছিল জিশান। রাতের প্রকৃতিকে দু-চোখ ভরে দেখছিল।

ফকিরচাঁদ ওর ভাই আমিরচাঁদের কথা বলছিল।

অভাবের তাড়নায় খারাপ পথে চলে গিয়েছিল আমির। বুড়ো মা-বাপ আর ছোটবোন জেবার কষ্ট সইতে না পেরে ও নিয়মিত চুরি-ছিনতাই করতে শুরু করেছিল। তারপর একদিন দু-চারজন বন্ধুর পাল্লায় পড়ে ‘স্নেক লেক’-এ নাম দেয়।

ছোটভাইকে দারুণ ভালোবাসত ফকির। তাই ভাইয়ের দেখাদেখি ও-ও নাম দেয় ‘হাংরি ডলফিন’ গেম-এ। ওরা দু-ভাই একসঙ্গে এই নিউ সিটিতে আসে। কম্পিটিশানের দুটো রাউন্ডে পরপর জিতেও যায় দুজনে। তারপর…তারপর আসে আমিরচাঁদের গেম-এর পালা : স্নেক লেক।

বাঁ-হাতে ঘাসের ওপরে হাত বোলাচ্ছিল ফকিরচাঁদ। কথা বলতে-বলতে কখন যেন ওর গলা ভারি হয়ে গিয়েছিল।

এতক্ষণ ধরে না-করা প্রশ্নটা এইবার উচ্চারণ করল জিশান : ‘…আটদিন আগে ভাই মারা গেছে…সেজন্যে আজও তুমি কাঁদছ?’

জিশানের দিকে মুখ ফেরাল ফকিরচাঁদ। কয়েকসেকেন্ড অপলকে তাকিয়ে রইল। তারপর ডানহাতে মাথার চুলে আঙুল চালাল। থেমে-থেমে বলল, ‘আমি কাঁদছি আমিরের ডেডবডির জন্যে, জিশানভাইয়া…।’

‘ডেডবডির জন্যে?’ অবাক হয়ে গেল জিশান।

‘হ্যাঁ, জিশানভাইয়া। অনেক চেষ্টা করে দুজন সিকিওরিটি গার্ডকে প্রাইজ মানির টাকা থেকে ঘুষ দিয়ে ভাইকে দেখার একটা বন্দোবস্ত করেছিলাম…।’ ওরা চোখে পটি বেঁধে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সেখানে…ভাইয়ের কাছে…।’

‘তার মানে? তোমার ভাই তো মারা গেছে—।’

‘হ্যাঁ—মারা গেছে। কিন্তু মারা যাওয়ার পর তো ভাইকে আর আমি দেখিনি—।’

আঙুল দিয়ে চোখের কোণ মুছল ফকিরচাঁদ : ‘তাই মরা ভাইকে ফুল দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু…কিন্তু সেই…সেই কবরস্তানে গিয়ে…যা দেখলাম তাতে মনটা ভেঙে গেল। আমিরচাঁদ যে এত বদনসিব ছিল বুঝতে পারিনি। সে-কথা মনে পড়লেই আমার কান্না পায়।’

হঠাৎই কোথা থেকে দুজন গার্ড এসে হাজির হল জিশানদের সামনে। একজন লম্বা, একজন বেঁটে। লম্বা গার্ডটা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘অর্ডার এসেছে। তোমরা যার-যার রুমে চলে যাও। এখুনি।’

জিশান হকচকিয়ে গেল। তা হলে কি পার্টিসিপ্যান্টদের অসময়ে কথাবার্তা বলার সময় বাঁধা আছে? নাকি ওরা কোনও ওপরওয়ালার নজরে পড়ে যাওয়ায় এই দুজন গার্ডের কাছে ‘অর্ডার’ এসেছে?

জিশান আর ফকিরচাঁদ উঠে দাঁড়াল। জিশান দেখল গার্ড দুজনের দিকে। ভাবলেশহীন পাথরের মুখ। দেখে মনে হয় যন্ত্রেরও অধম। কিন্তু খেলার মাঠে আলাপ হওয়া নাহাইতলার সেই গার্ড বলেছিল, ‘…এরা সবকিছু পয়সা দিয়ে মাপে।’ তা হলে জিশান কি একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে? ওর হাতে আছে প্রাইজ মানির আশিহাজার টাকা। এ ছাড়া মনোহরের কবুল করা গিফট পঞ্চাশহাজার টাকা।

টাকা খরচ হয় হোক, জিশান ওই কবরস্থানটা একবার দেখতে চায়। আজই না জিশান ভাবছিল, কম্পিটিশানে ‘খরচ’ হয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে নিয়ে সিন্ডিকেট কী করে? সেটা নিজের চোখে একবার দেখা যায় না?

লম্বা গার্ডটা ফকিরচাঁদকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। ভাঙাচোরা মানুষটা চাপা গলায় কাঁদতে-কাঁদতে চলে গেল।

জিশান আর দেরি করল না। বেঁটে মতন গার্ডটাকে বলল, ‘ভাই, কবরস্থানটা আমাকে একবার দেখাতে পারো? আমার কাছে প্রাইজ মানির অনেক টাকা আছে। কাল তোমাকে তার থেকে দশ হাজার টাকা দেব…।’

গার্ডটা জিশানের কবজি ধরতে যাচ্ছিল—থমকে গেল। নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘কী বললে? দশহাজার?’

জিশান ওর চোখে লোভের ঝিলিক দেখতে পেল। একইসঙ্গে ওর মুখ থেকে মদের গন্ধ পেল। তাই ঝুঁকি নিয়ে ওর দু-হাত চেপে ধরল। অনুনয় করে বলল, ‘ভাই, একটিবারের জন্যে কবরস্থানটা আমাকে দেখাও। দশহাজার দেব। কাউকে বলব না। প্লিজ…।’

গার্ডটা এদিক-ওদিক তাকাল। ওর মুখ দেখে বোঝা গেল ওর ভেতরে লোভের সঙ্গে ভয়ের লড়াই চলছে। শ্রীধর পাট্টাকে সবাই যমের চেয়েও বেশি ভয় পায়।

কয়েকবার ঢোঁক গিলল গার্ডটা। তারপর বলল, ‘না, না—উইদাউট পারমিশানে ওখানে যাওয়াটা খুব রিসকি। তার চেয়ে আমি একটা সাজেশান দিই। তুমি যদি ওই দশহাজার টাকাটা দাও তা হলে পারমিশান করিয়ে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে জান লড়িয়ে দেব…।’

চোখে প্রশ্ন নিয়ে জিশানের দিকে চেয়ে রইল প্রহরী। জিশান এই প্রস্তাবে রাজি হলে তবেই ও পরের ধাপে এগোবে।

দু-চারসেকেন্ডের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল জিশান। বলল, ‘তাই হবে। আজ রাতে যদি কবরস্থানটা আমাকে দেখাও তা হলে কাল ক্যাশ দশহাজার টাকা তুলে তোমাকে দিয়ে দেব—।’

তখনই জিশান দেখল, ফকিরচাঁদকে পৌঁছে দিয়ে দ্বিতীয় গার্ডটা ফিরে আসছে।

প্রথম গার্ড সঙ্গে-সঙ্গে চলে গেল সঙ্গীর কাছে। দুজনে মিলে কিছুক্ষণ কীসব আলোচনা করল। তারপর প্রথমজন জিশানের কাছে এসে বলল, ‘তোমার পার্টিসিপ্যান্ট আই-ডি নাম্বারটা বলো—।’

জিশান বলল।

পকেট থেকে ছোট ওয়্যারলেস সেট মতন কী একটা যন্ত্র বের করে নম্বরটা স্টোর করে নিল গার্ড। তারপর হাতের ইশারা করে বলল, ‘তুমি এখানে ওয়েট করো। আমরা পারমিশানের ব্যাপারটা ট্রাই করতে যাচ্ছি। আমাদের ইন-চার্জকে এ-কথা বলব যে, তোমার এক বন্ধুর কবরে তুমি ফুল দিতে যাবে। যদি পারমিশান পেয়ে যাই তা হলে আমরা জেনারেল স্টোর থেকে সাদা ফুল নিয়ে আসব। চিন্তা কোরো না…আমরা কুড়িমিনিট কি বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যে আসছি। তুমি ওয়েট করো। অন্য কোনও গার্ড কিছু জিগ্যেস করলে বলবে, তোমার এখানে ওয়েট করার অর্ডার আছে। ও.কে.?’

জিশান সায় দিয়ে মাথা নাড়ল।

সঙ্গে-সঙ্গে গার্ডটা চলে গেল তার সঙ্গীর কাছে। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে-বলতে ঢুকে পড়ল গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর ভেতরে।

জিশান চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওদের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। ওর মনে হল, ফকিরচাঁদকেও সঙ্গে নিলে হত—যদি অবশ্য অনুমতি পাওয়া যায়।

মিনিটকুড়ি কি পঁচিশ পর গার্ড দুজন ফিরে এল। ওদের ঠোঁটের হাসি দেখেই জিশান বুঝল, অনুমতি মিলেছে। সেই ধারণাটা নিশ্চিত হল একজনের হাতে একটা সাদা ফুলের তোড়া দেখে।

প্রথমজন নিচু গলায় জিশানকে বলল, ‘পারমিশান পাওয়া গেছে। মেন গেট খোলার অথরাইজড স্মার্ট কার্ড দিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া একটা কিউ-মোবাইল-এরও ব্যবস্থা করা গেছে। আমাদের সময় দিয়েছে একঘণ্টা।’ হাতঘড়ি দেখল : ‘আর কিছুক্ষণের মধ্যেই মেন গেটে একটা কিউ-মোবাইল এসে দাঁড়িয়ে যাবে—।’

দ্বিতীয় গার্ড ফুলের তোড়াটা জিশানের হাতে দিয়ে বলল, ‘দশহাজার টাকাটা কাল মনে করে দিয়ো কিন্তু। চাইতে যেন না হয়।’

জিশান বলল, ‘দেব। চাইতে হবে না। তবে একটা রিকোয়েস্ট আছে…।’

‘আবার কী রিকোয়েস্ট?’ রুক্ষভাবে জানতে চাইল দ্বিতীয়।

‘ফকিরচাঁদকে নিয়ে এসো। ওকে আমার সঙ্গে নেব। ও ওর মরা ভাইকে যদি দেখতে চায়…।’

গার্ড দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর ওরা ফকিরচাঁদকে সঙ্গে নেওয়া অনেক ঝামেলার বলে জিশানের সঙ্গে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল। কিন্তু জিশান গোঁ ধরে রইল। এ-কথাও শুনিয়ে দিল যে, দশহাজার টাকা নেহাত কম নয়।

প্রায় পাঁচমিনিট তর্ক-বিতর্কে খরচ হওয়ার পর ওরা নিমরাজি হল। একজন গার্ড জিশানের কাছে দাঁড়িয়ে রইল, আর-একজন গেল ফকিরচাঁদকে নিয়ে আসতে।

ফকিরচাঁদ এলে ওরা চারজন মেন গেটের দিকে হাঁটা দিল। ফকিরচাঁদকে দেখে ক্লান্ত অবসন্ন মনে হল। ওর হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল ও নেশা করেছে। ও ক্লান্ত গলায় বিড়বিড় করে বলছিল, ‘আমিরের ওই ডেডবডি আমি আর দেখতে চাই না…দেখতে চাই না…।’

কেন এই ডেডবডি দেখার আতঙ্ক জিশান বুঝতে পারল না। তা ছাড়া, এতদিন পরও ডেডবডি দেখবে কেমন করে?

মেন গেটে পৌঁছে একজন গার্ড স্লটে স্মার্ট কার্ড সোয়াইপ করল। যন্ত্রে ‘বিপ’ শব্দ হল। সবুজ বাতি জ্বলে উঠল। হাতের চাপ দিতেই কম্পাউন্ডের গেট খুলে গেল। জিশানরা বেরিয়ে এল গেস্টহাউস বিল্ডিং-এর বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *