সূক্ষ্ম গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে। ঠিক বর্ষাকালের মতন। কিন্তু এটা নকল বর্ষা। শীতের শেষে কোনো কোনো বছর দু-একদিন এ-রকম বৃষ্টি হয়ে যায়। তারপরই দু-তিন মাস একটানা খরা। সেই সময়টায় একেবারে অসহ্য অবস্থা হয়।
দ্বারিকের মাথাটা ভীষণ ভারী হয়ে আছে। খুব সম্ভবত তার জ্বর আসছে। যে-করেই হোক জ্বরটা আটকাতেই হবে। এ সময় বিছানায় পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। বাড়ির কারোকেই সে এখন কিছু জানাতে চায় না।
সকাল বেলা চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই দ্বারিক ঠিকমতন স্বাদ পায়নি। তখনই বুঝেছিল, একটা কিছু গোলমাল হচ্ছে। বৃষ্টি না পড়লে, দ্বারিক খোলা হাওয়ায় খানিকটা ঘুরে আসত। আজ থেকে তার স্কুলে যাওয়ারও কথা ছিল! সে জানলার ধারে বসে বৃষ্টি দেখতে লাগল।
একটু আসব?
দ্বারিক মুখ ফিরিয়ে বীথিকে বলল, এসো! বোসো!
দু-দিনের বৃষ্টিতে পুকুরটায় খানিকটা জল হয়েছে। কাদাগোলা ভাবটা অবশ্য যায়নি। তবু দ্বারিক একটু আগে দেখেছে, বীথি পুকুর থেকে স্নান করে আসছে। পুকুরপাড় থেকে এতটা ভিজে কাপড়ে হেঁটে আসতে হয় বলে সে সকাল সকাল স্নান সেরে নেয়। বীথির স্নান নিয়ে সত্যিই একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সরকারবাড়ির কুয়োর কাছে সে আর একদম যায় না। জল নিয়ে প্রত্যেকদিন ঝগড়াঝাঁটি হচ্ছিল। আর কয়েকদিন পর তো পুকুরে একদমই জল থাকবে না। তখন বীথি কোথায় স্নান করবে? বাড়িতে একটা টিউবওয়েল না বসালেই নয়। টাকা জোগাড় করতে হবে।
বীথি চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে বলল, আমি ভাবছি…
দ্বারিক চেয়ে রইল বীথির দিকে।
আমি ভাবছি কাল-পরশু বহরমপুর চলে যাব। -র কাছ থেকে অনেকদিন চিঠি পাইনি। বেশ তো, ঘুরে এসো ক-দিন, আমি তোমায় পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।
পৌঁছে দিতে হবে না, আমাকে মল্লিকপুরে বাসে তুলে দিলেই…।
সে তুমি যেতে পারবে জানি, কিন্তু আমারও তো ইচ্ছে করতে পারে তোমার মায়ের হাতের রান্না খেয়ে আসতে।
বীথি কিছু বলল না, হাসল শুধু একটু।
আমার মাকে বলেছ?
এখনও বলিনি।
বেশ তো ঘুরে এসো না। আমি মাকে বলে দেব এখন।
ঘুরে…আসব?
তুমি…ওখানেই থেকে যেতে চাইছ?
ওখানে হয়তো চেষ্টা করলে কোনো স্কুলে কাজ-টাজ পাওয়া যায়…এখানে তো বিশেষ কোনো সুযোগ নেই।
দ্বারিক দু-এক মুহূর্ত নিশ্বাস বন্ধ করে রইল। সে যেন মনে মনে বেশ কিছুদিন ধরেই কথাটার প্রতীক্ষা করছিল। একদিন-না-একদিন বীথি একথা বলবেই। সে লেখাপড়া শিখেছে, ছোট্টবেলা থেকে শহরে জীবন কাটিয়েছে, সে এইরকম একটা এঁদো পাড়াগাঁর নিস্তরঙ্গজীবনে নিছক একটা ঘরের বউ হয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দেবে কেন? ভুতো এখানে থাকলে না হয় তবু অন্য কথা ছিল। ভুতো থাকলে অবশ্য নানারকম ব্যাপারে মাতিয়ে রাখত সবাইকে। ওরা শহরে গিয়ে আলাদা বাড়ি ভাড়া করেও থাকতে পারত।
তবু বীথি যখন সত্যিই চলে যাওয়ার কথা বলল, তখন দ্বারিক যেন বুকের মধ্যে পরাজয়ের শূন্যতা বোধ করল। বীথি জানে, তাকে কেন্দ্র করে নানারকম কোন্দল হচ্ছে। গ্রামে। বীথি কি চলে যাচ্ছে দ্বারিককে নিষ্কৃতি দিয়ে যাওয়ার জন্য?
বহরমপুরে অনেকে আমাকে চেনে…আমি যে স্কুলে পড়েছিলাম হয়তো সেখানে চেষ্টা করলেই একটা কাজ পাব…আপনি কী বলেন?
দ্বারিক কি না বলবে? সে কি তার ছোটোভাইয়ের স্ত্রীকে অনুরোধ করতে পারে, তুমি চলে যেয়ো না, তুমি থাকো!
সেটাই তো উচিত মনে হয়, এখানে শুধু শুধু পড়ে থেকে…
ওখানে একটা কাজ পেলে এখান থেকে বাবা-মাকে মাঝে মাঝে নিয়ে গিয়ে আমার কাছে রাখতে পারি।
দ্বারিক ফ্যাকাশেভাবে বলল, হ্যাঁ..ওরা বহুদিন কোথাও বেড়াতে যাননি…মা বোধ হয় বছর দশেক আগে একবার বর্ধমান গিয়েছিলেন, দিদির বিয়ের পর।
দিদিকে তো আমি দেখলামই না।
এমনকী হতে পারে যে শুধু স্নানের কষ্টের জন্যই বীথি হঠাৎ চলে যাওয়া ঠিক করল। অনেক ছোটোখাটো ব্যাপারও জীবনে এক-এক সময় খুব বড়ো হয়ে ওঠে। প্রায়ই নিরামিষ খাওয়া বীথি সহ্য করেছিল, কিন্তু জলের কষ্ট বোধ হয় আর সহ্য করতে পারছে না। প্রত্যেকদিন ভালোভাবে স্নান করা যার অভ্যেস, সে দিনের পর দিন স্নান না করে কিংবা নোংরা জলে কোনো কারণে মাথা ডুবিয়ে হয়তো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না।
দ্বারিক কি বলবে, তুমি থাকো বীথি, আমি যে করেই হোক বাড়িতে শিগগিরই একটা টিউবওয়েল বসাব?
না। সে-কথাটা এখন বলা যায় না। স্যালো টিউবওয়েল বসিয়ে এদিকে সহজে জল পাওয়া যায় না। জল উঠলেও এক-দেড় বছরের মধ্যে শুকিয়ে যায়। গভীর করে কুয়ো খুঁড়লে কাজ হয়, কিন্তু তাতে অনেক খরচ।
তোমার এখানে খুবই অসুবিধে হচ্ছিল।
আমি আমার অসুবিধের জন্য চলে যাচ্ছি না। আমার কিছু একটা কাজ-টাজ করা উচিত, এই কথা ভেবেই।
তা ঠিক!
বীথির সঙ্গে খোলাখুলি অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু এই ক-মাস এক বাড়িতে থেকেও সে কিছুতেই বীথির সঙ্গে সহজ হতে পারল না। ভুতো তার থেকে মাত্র তিন বছরের ছছাটো। ভুতোর স্ত্রীর সঙ্গে তার ঠাট্টা-ইয়ার্কির সম্পর্ক হতে পারত। কিন্তু দ্বারিক আড়ষ্টতা কাটাতে পারল না!
কালকেই যাবে ঠিক করেছ?
যদি বৃষ্টিটা ছেড়ে যায়!
এ বৃষ্টি বেশিক্ষণ চলবে না, আজই থেমে যাবে।
মা দু-বার বীথির নাম ধরে ডাকতেই বীথি উঠে পড়ল। দ্বারিক বলল, ঠিক আছে, মাকে আমি বুঝিয়ে বলব।
নুটুও পরামর্শ দিয়েছিল বীথিকে তার মায়ের কাছে রেখে আসতে কিছুদিনের জন্য। জাতের প্রশ্ন নিয়ে গ্রামের লোকজন যে দ্বারিকদের প্রায় একঘরে করবার ব্যবস্থা করছে, সেটা কাটিয়ে দেওয়া তাহলে খুবই সহজ হয়।
কিন্তু সেটা কী হার স্বীকার নয়? ব্রাহ্মণের বাড়িতে শূদ্রের মেয়ে বউ হয়ে এলে গ্রামের লোক খেপে যাবে, আর সেটাই মেনে নিতে হবে? তাড়িয়ে দিতে হবে সেই মেয়েটিকে!
বিটু ফিরে আসায় দ্বারিক একটা কুৎসিত অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়েছে। কিন্তু বিটু যদি ফিরে না আসত? অন্ডাল স্টেশন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল ছেলেটা, খিদের জ্বালায় দোকান থেকে। খাবার চুরি করে ছুটে পালাতে গিয়েছিল। সেখানে ট্রেনে কাটা পড়তে পারত। তাহলে কোনো খবরই এসে পৌঁছোত না এখানে। কিংবা যদি আরও দূরে চলে যেত কোথাও! সব নিরুদ্দিষ্ট ছেলেরা তো ফেরে না। তাহলে সমস্ত দায়টা চাপত দ্বারিকের ঘাড়ে। গ্রামের লোক যে নরবলির গুজবটা বিশ্বাস করেছিল, এটা ভেবেই দ্বারিকের সর্বাঙ্গ জ্বলে যায়।
প্রথম রাউণ্ডে গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের হার হয়েছে। সেজন্য দ্বারিক দুঃখিত। ওঁর নাতিটি বাঁচেনি। আহা, হয়তো ছেলেটাকে বাঁচনো যেত, দ্বারিক কেন আর একটু জোর করল না!
হেরে গিয়ে গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই আরও উগ্র হয়ে উঠেছেন। জাতের প্রশ্ন তুলে বেশি করে খ্যাপাচ্ছেন লোকজনকে। আশ্চর্যের ব্যাপার, এ গ্রামে কয়েক ঘর মাত্র বামুন। যারা বামুন নয়, তারাও মনে করে বামুনের ঘরে শূদ্র বউ এলে সমাজের দারুণ অমঙ্গল হয়। এ-বছর যদি ভালো বৃষ্টি না হয়, হয়তো সেই দায়ও চাপানো হবে দ্বারিকদের ঘাড়ে। তাদের পাপেই ভগবান রুষ্ট হয়েছেন। এই দেশ!
সুতরাং গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউণ্ডের লড়াইটা বাকি আছে। খুব সম্ভবত তিনি এবার দ্বারিকের স্কুলের চাকরিটা খাবার চেষ্টা করছেন।
এইসময় বীথি চলে গেলে দ্বারিকের সুবিধে হয়ে যায় খুবই। এমনকী দ্বারিকের মা-ও নিশ্চয়ই মনে মনে খুশি হবেন এতে। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে! বীথি দ্বারিককে মুক্তি দেওয়ার জন্য চলে যাচ্ছে? দ্বারিকের মনটা খুব দমে গেল।
শরীরে মাঝে মাঝে কাঁপুনি লাগছে। জ্বরটা এসেই গেল বোধ হয়। দুর ছাই, ভালো লাগে। একটা চাদর টেনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল দ্বারিক।
বাড়িতে কারা আগুন লাগাতে এসেছিল, তা জানা যায়নি। এখনও সেই মীমাংসাটা বাকি আছে। ও কাজটা বোধ হয় গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের নয়। উনি অত নীচে নামবেন না মনে হয়। মহাদেব সাহার মতিগতি এখনও বোঝা যাচ্ছে না। দ্বারিকের বিরুদ্ধে মহাদেব সাহা এখনও প্রকাশ্যে নামেনি। আড়ালে কলকাঠি নাড়তে পারে অবশ্য। দ্বারিক ওকেও ছাড়বে না। ডিপটিউবওয়েলের জল ভাগাভাগি করার সময় কিংবা ফসল কাটার সময় গোলমাল হবেই–
তখন মালোপাড়ার খেতমজুরদের সংঘবদ্ধ করে দ্বারিক মহাদেব সাহাকে এবার একটা সাংঘাতিক শিক্ষা দেবেই!
দ্বারিক নরবলি দেয়নি শুনে নাকি মালোপাড়ার লোকজনরা একটু নিরাশ হয়েছে। দ্বারিককেই তারা পরিত্রাতা ভেবেছিল!
জ্বরের কাঁপুনির মধ্যেও দ্বারিকের হাসি পেল।
বৃষ্টি ছেড়ে গেল দুপুরের দিকে। বিকেলের দিকে পরিষ্কার আকাশ আর পাতলা ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে সুন্দর হয়ে উঠল দিনটা। দ্বারিক তখনও ঘুমিয়েই রইল। মাঝখানে শুধু একবার উঠে কোনোরকমে খানিকটা ভাত খেয়ে নিয়েই আবার শুয়ে পড়েছিল। তাকে যেন অনন্ত ঘুমে পেয়েছে।
শেষ বিকেলের দিকে বীথি বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। অনেক দিন পর। পথে যে দু চারজন লোক পড়লো, তারা চকিতে সরে গেল বীথিকে দেখে। যেন বীথির স্পর্শের হাওয়াতে দোষ আছে। সামনে থেকে নয়, পেছেন থেকে তারা বীথির শরীরে দৃষ্টি বিঁধিয়ে দিতে অবশ্য ছাড়ল না।
কিন্তু কিছুই গ্রাহ্য করল না বীথি। সে যেন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। গ্রাম ছাড়িয়ে এসে পড়ল মাঠে। তারপর আরও হাঁটতে হাঁটতে চলে এলো সেই মরা নদীর খাতে।
এই কয়েকদিনের সামান্য বৃষ্টি এখানকার মাটি চোঁ চোঁ করে শুষে নিলেও খানিকটা জল জমেছে বীথির নিজের তৈরি করা ছোট্ট পুকুরে।
হাত দিয়ে কাদা মাটি লেপে লেপে পুকুরের চার দিক সমান করে দিল বীথি। বনতুলসীর গাছগুলোতে ফুল এসেছে। তার ইচ্ছে ছিল, রোজ এসে আরও খানিকটা খুঁড়ে খুঁড়ে এটাকে আর একটু বড়ো করে ফেলবে। তারপর মাছ ছাড়বে এখানে। তেলাপিয়া মাছ যে-কোনো জায়গায় বাঁচে। শুধু বর্ষার কয়েক মাস সবাই এ-রকম ছোটো ছোটো পুকুর খুঁড়ে সেখানে তেলাপিয়া মাছ ছাড়লেও তো খানিকটা মাছের সমস্যা মেটে।
কিন্তু বীথি এখানে আর আসবে না। কাল সে চলে যাবে। কয়েকদিন পরই বুজে যাবে এই পুকুরটা। কেউ কোনোদিন জানবেও না। বীথি এখানে কিছু একটা তৈরি করবার চেষ্টা করেছিল।
যদি তার মেয়েটা বাঁচত, তাহলে, সে একটু হাঁটতে শিখলেই বীথি তার হাত ধরে হাঁটি হাঁটি পা পা করে নিয়ে আসত এখানে। ওকে তার এই পুকুরের মধ্যে বসিয়ে খেলতে দিতো।
বীথি তার কয়েক ফোঁটা কান্না মেশালে তার নিজের গড়া পুকুরের জলে।
লালবাগে তিনজন পুলিস সেদিন বীথিকে উলঙ্গ করে তার তলপেটে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়েছিল, সেদিনই বীথি ভেবেছিল তার গর্ভের সন্তান বাঁচবে না। মনের মধ্যে আবার দুটো মন থাকে। একটা মন ওই কথা ভেবেছিল, আবার আর একটা মন দারুণভাবে আশা করছিল, না, মরবে না, বেঁচে থাকবে, স্বদেশ হালদারের একজন উত্তরাধিকারীকে সে এনে দেবে পৃথিবীতে।
পেঁজা তুলো তুলো মেঘের মধ্যে লুকোচুরি খেলা চলছে চাঁদের। বীথি খেয়ালই করে নি, কখন সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত এসে গেছে। তবু তার ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। আর তো কখনো আসা হবে না এখানে।
সে বহরমপুরে ফিরে গিয়ে চাকরি করবে, কোনোদিন কি সেখানে তার সময় হবে কোনো মাঠের মধ্যে একলা গিয়ে বসার। ওখানে তো এত নিরালা নেই। বহরমপুরে কাজ না পেলে চলে যাবে কলকাতায়। তার পিসতুতো দিদি মমতা একটা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস, সে বলেছিল, বীথিকে একটা কাজ দিতে পারে।
সকাল বেলা একঘেয়ে বৃষ্টির সময় কল্পনাই করা যায় নি যে আজ রাতে এ-রকম জ্যোৎস্না উঠবে। জোৎস্নায় ধপধপে দেখাচ্ছে মাঠটা। দূরে দূরে দু-চারটে খেজুর গাছ, তাও কত সুন্দর দেখাচ্ছে এখন। কী শান্ত কোমল এই রাত। এই সময় এই সব গ্রাম্য জায়গাকেও কত মোহময় মনে হয়। বোঝাই যায় না যে এখানে ক্ষুধা আছে, দারিদ্র্য আছে, আর আছে মানুষের মনে অন্ধত্ব। যে অন্ধত্ব কোনো সৌন্দর্য দেখতেও জানে না।
ডিপটিউবওয়েলের জলের নালি কাটা হয়নি এই মাঠের দিকে। কোনদিকে, কার জমির পাশ দিয়ে নালি কাটা হবে, তা নিয়ে এরমধ্যেই খেয়োখেয়ি শুরু হয়ে গেছে। বীথি সব জানে। আরও কত বছর, কত শতাব্দী এই মাঠটা এ-রকম পতিত, অনাবাদি হয়ে থাকবে কে জানে?
একটা কাঠি দিয়ে বীথি মাটির ওপর নিজের নামটা লেখার চেষ্টা করল। কাল-পরশুর মধ্যেই মুছে যাবে এই নামটা, যাক। এ জায়গাটা তার প্রিয় ছিল, সে-কথা বীথি শুধু এই জায়গাটাকেই জানিয়ে যেতে চায়।
লোক তিনটি নিঃশব্দেই আসবে ভেবেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বীথি তাদের পায়ের আওয়াজ টের পেয়ে যায়।
কে?
লোক তিনটি হুড়মুড় করে ছুটে এল বীথির দিকে।
মানুষ দেখে বীথি আর সহজে ভয় পায় না। এইটুকু জীবনে সে অনেক ভয়ের মুহূর্ত পেরিয়ে এসেছে।
সে প্রথমেই ভাবল, এরা কেন এসেছে? এরা কি তার ওপর বলাৎকার করবে, না তাকে ধরে নিয়ে যাবে?
পরের মুহূর্তেই সে ভাবল, এরা পারবে না। এরা কিছুতেই পারবে না। সে বীথি হালদার, সে স্বদেশ হালদারের স্ত্রী।
সে উঠেই দৌড়োলো সামনের দিকে।
লোকগুলোর কাছে কোনো অস্ত্র নেই। একটা মেয়েকে ধরবার জন্য তিনজনের খালি হাতই যথেষ্ট ভেবেছে। ওরা ঠিক লোক নয়। বীথিরই প্রায় সমবয়েসি তিন যুবক। পা-জামা আর গেঞ্জি পরা।
ওরা গ্রামের দিক থেকে এসেছিল বলে বীথিকে ছুটতে হল উলটো দিকে। এদিকে অনেকখানি ছুটলে রণকালীপুর গ্রামে পৌঁছোনো যায়। ওই অবস্থাতেই বীথির মনে পড়ল, দ্বারিককে সে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোতে দেখে এসেছিল। বীথির ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে দ্বারিক কি তাকে খুঁজতে আসতে পারত না আজ? এই লোকগুলোই কি আগুন লাগাতে এসেছিল তাদের বাড়িতে?
একজন লোক এসে প্রায় ধরে ফেলল বীথিকে। বীথি এঁকে-বেঁকে দৌড়োতে লাগল। পারবে না, এরা কিছুতেই পারবে না, সে বলতে লাগল মনে মনে।
তিনজন ঘিরে আসছে তিনদিক থেকে। তার মধ্যে একজন হঠাৎ বীথির একটা হাত ধরে ফেলতেই বেগ সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল দু-জনেই। বীথি সঙ্গে সঙ্গে উঠে বসে লোকটির হাত কামড়ে দিল। লোকটি অন্য হাতে একটা চড় মারল বীথির গালে। কিন্তু বীথি ততক্ষণে নিজেকে মুক্ত করে ফেলেছে। বাকি দু-জন এসে পড়ার আগেই বীথি দৌড়োতে শুরু করল আবার।
এবার মোরামডাঙা গ্রামের দিকে। লোক তিনটেও ছুটে আসছে। সব ব্যাপারটা ঘটে যাচ্ছে নিঃশব্দে। বীথিও চিৎকার করছে না। এখান থেকে চিৎকার করলেও তাদের বাড়ির কেউ শুনতে পাবে না। গ্রামের অন্য কেউ শুনতে পেলেও তাকে সাহায্য করতে আসবে কিনা সন্দেহ। এই গ্রামের লোকদের সম্পর্কে বীথির মনে একটা তীব্র ঘৃণা জন্মে গেছে। এরা তাকে মানুষ বলে মনে করেনি। শূদ্র মনে করেছে। এ গ্রামে আসবার আগে বীথি জানতও না যে শূদ্র হওয়া অপরাধ। তার বাবাকে বহরমপুরের কত লোক শ্রদ্ধা করেছে।
পারবে না, এরা কিছুতেই ধরতে পারবে না, বীথি মনে মনে বারবার এই কথা বলতে লাগল। কলেজ স্পোর্টসে প্রত্যেকবার কাপ পেয়েছে বীথি, তাকে এরা দৌড়ে হারাতে পারবে না। একবার বাড়ি পৌঁছে গেলেই আর কোনো চিন্তা নেই। এখনও দ্বারিকের মুখোমুখি দাঁড়াবার সাহস নেই কারোর। আর বেশি দূর নয়, দূরে দেখা যাচ্ছে আলো…।
তবু ওরা বীথিকে ধরে ফেলল। গ্রামের এইসব লোকেরা স্পোর্টসে নাম দেয় না। কিন্তু দৌড়োতে পারে। দুটো লোক দু-দিক থেকে চেপে ধরল বীথিকে। বীথি বনবিড়ালির মতন ওদের আঁচড়ে-কামড়ে মুক্তি পেতে চাইল। একটুক্ষণের জন্য আর একবার নিজেকে ছাড়িয়ে নিল বীথি, আবার খানিকটা দূর গেল, আবার ধরা পড়ল। এবার দু-জন লোক বীথির দু হাতে মুচড়ে ধরে রইল, অন্যজন দুমদাম করে মারতে লাগল বীথির মুখে।
ওরা এখানে বলাৎকার করার জন্য আসেনি। ওরা বীথিকে ধরে নিয়ে গভীরতর মাঠের দিকে নিয়ে যেতে চায়। বীথি চিৎকার করতে লাগল, না, না, আমি যাব না, আমায় খুন করে ফেলো, আমি কিছুতেই যাব না, আমাকে মেরে না ফেললে আমি যাব না–
দড়ি আনেনি ওরা, বীথিকে অজ্ঞান করে না ফেললে বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। বীথিকে মেরে মেরে ওরা অজ্ঞান করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু বীথি জীবনে কম মার খায়নি, সে সহজে অজ্ঞান হবে না। সে পাগলের মতন হাত-পা ছুড়ে ওদের আটকাতে চাইছে।
এবার ব্যাপারটা অন্য একটি দিকে নাটকীয় মোড় নিল। একটি টর্চের আলো দেখা গেল দূরে, গোলমাল শুনে আলোটা বেশ দ্রুত এগিয়ে আসতে লাগল এদিকে।
লাল রঙের ধুতি ও উড়নি পরা একজন দীর্ঘকায় মানুষ, এক হাতে টর্চ, অন্য হাতে একটা লাঠি। সঙ্গে আর একটি বেঁটে মতন হৃষ্টপুষ্ট লোক।
কে রে? কে রে? কোন হারামজাদা!
লোক তিনটে পালাবার আগেই গোষ্ঠ ভট্টাচার্য সেখানে এসে পড়লেন। ওরা ততক্ষণে বীথির হাত-পা ধরে প্রায় কাঁধে তুলে ফেলেছিল। কারোকে ডাকবার জন্য নয়, বীথি তখন নিজস্ব রাগেই চিৎকার করছিল। সাংঘাতিক মুষ্টিতে সে ধরে আছে একজনের মাথার চুল।
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য হাতের লাঠি তুলে একজনের পিঠে মারলেন দড়াম করে। লোক তিনটি গোষ্ঠ ভট্টাচার্যকে দেখল, আর এক মুহূর্তও দেরি না করে, বীথিকে ফেলে দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
দেখ তো, সুবল, ওরা কোন বাড়ির মেয়ের এমন সর্বনাশ করছিল?
এত মার খেয়েও বীথি জ্ঞান হারায়নি। তার হাতের মুঠোয় একজনের মাথার অনেকগুলো চুল। টর্চের আলোয় সে উঠে বসে বিস্রস্ত বসন ঠিক করল।
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য জিজ্ঞেস করল, এ ভুবন হালদারের ছোটো ছেলের বউ-না?
তাঁর সঙ্গীটি বলল, হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে।
জানোয়ারের দল, মেরে ওদের মাথা ভেঙে দিতে হয়। তোমার কি বেশি চোট লেগেছে। মা? উঠতে পারবে? এই সুবল, দেখ না!
বীথি উঠে দাঁড়াল।
যাও মা, বাড়ি যাও। রাত-বিরেতে কি মাঠে-ঘাটে একলা আসতে হয়। তোমরা শহরের মেয়ে, গাঁ দেশের রীত প্রকৃত জান না।
বীথির সর্বাঙ্গ জ্বলছে। দু-চোখ দিয়ে বিচ্ছুরিত হচ্ছে ঘৃণা, প্রতি রোমকূপে ঝাঁ-ঝাঁ করছে রাগ। এই লোকটি এসে পড়ে তাকে অসম্মান থেকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু এই উপকারের সে রেয়াত করে না। এই লোকটির জন্যই তাকে চলে যেতে হচ্ছে গ্রাম ছেড়ে।
সে বলল, ওই লোকগুলোকে আপনি চেনেন?
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য বললেন, চিনি, প্রত্যেকটাকে চিনি। আশপাশের আট-দশখানা গ্রামের এমন কোনো লোক নেই, যাকে আমি চিনি না! ওই তিনটে তো নাম করা হারামজাদা! তোমরা যদি ওদের নামে মামলা করতে চাও আমি নিজে তোমাদের হয়ে সাক্ষী দেব! কিন্তু তাতে তো কোনো লাভ নেই। তাতে তোমার কলঙ্ক বাড়বে বই কমবে না! স্ত্রীলোকের নামে কলঙ্ক একবার রটলে তা আর ঘোচে না।
তবু ওদের শাস্তি পেতেই হবে!
শাস্তি ওদের আমিই দেব…তবে, তোমারও রাতবিরেতে এদিকে আসা উচিত হয়নি…এতে দুশ্চরিত্রদের লোভ দেখানো হয়…একটা কথা বলি, তোমাদের শহরে যা চলে, গ্রামে তো চলে না…এখানে তোমার স্বামী নেই, বাড়িতে জোয়ান ভাসুর, সে এখনও বিয়ে করেনি, লোকের মনে নানা কথা আসবেই…শহরে তোমরা ধর্ম, সমাজ সব উচ্ছন্নে দিয়েছ…ব্যভিচার, স্বেচ্ছাচার সেখানে মর্যাদা পেয়েছে…কিন্তু গ্রামে আমরা প্রাচীন ধারাগুলো বজায় রাখবার চেষ্টা করছি, সেখানে তোমরা মাথা না গলালেও তো পার!
প্রাচীন ধারার মানে বুঝি শুধু কুসংস্কার? আপনারা চান গ্রামকে অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখতে। তাতে আপনাদের মতন লোকদের সুবিধে হয়। জাতের ব্যাপার নিয়ে যারা মাথা ঘামায়, তারা মানুষের শত্রু।
এখন তক্ক করার সময় নয়। বাড়ি যাও, মা। স্ত্রীলোকদের সঙ্গে আমি তক্ক করতেও চাই না। সুবলকে আমি টর্চ দিচ্ছি, সে তোমায় রাস্তা দেখিয়ে দেবে।
আমি নিজেই যেতে পারব।
বীথি খানিকটা গিয়েও আবার ফিরে এল। এসে দাঁড়াল গোষ্ঠ ভট্টাচার্যের একেবারে সামনে। স্পর্শ এড়াবার জন্য গোষ্ঠ ভট্টাচার্য একটু পিছিয়ে গেলেন।
বীথি বলল, একটা কথা আপনাকে বলে যাচ্ছি, শুনে রাখুন। এই সমাজ একদিন বদলাবেই। এই পচা-গলা সমাজ বেশিদিন টিকতে পারে না! শিগগিরই গড়ে উঠবে নতুন সমাজ। সেদিন সেই সমাজের লোকরা আপনার মতন মানুষদের আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলে দেবে!
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য উদারভাবে হাসলেন। তারপর বললেন, তাহলে তোমাকেও একটা কথা বলি, শুনে রাখো। হয়তো এই সমাজ বদলাবে। তোমাদের কথামতন এক ধর্মহীন ও নীতিহীন সমাজ গড়ে উঠবে। সেখানে তোমরা জোরজুলুম করে সব লোককে শুধু খেতে পরতে দিয়ে ঠাণ্ডা রাখবে, তাও মানলুম। কিন্তু এই বুড়ো বামুন বলে যাচ্ছে, সেই সমাজে তোমরা সুখ পাবে না, শান্তি পাবে না!
বীথি বলল, সুখ! এখনকার মানুষ বুঝি খুব সুখে আছে?
বাড়ি যাও। এই সুবল আলোটা দেখা—
বীথি প্রথমে কিছুটা হেঁটে, তারপর প্রায় দৌড়োতে শুরু করল। তার ঠোঁটের কোণ কেটে রক্ত পড়ছে, শরীরে আর কোনো জায়গায় ক্ষত হয়নি। বীথি আঁচল দিয়ে রক্ত মুছতে লাগল, তবু রক্ত বন্ধ হল না চট করে। বীথির শাড়িটার রং গাঢ় নীল, রক্ত লেগে থাকলেও চট করে বোঝা যাবে না। তবু, তার সারাগায়ে ধুলো, চুল অবিন্যস্ত। এতক্ষণ বীথি ভয় পায়নি, কিন্তু গ্রামের মধ্যে ঢুকে ভয় ভয় করতে লাগল। কেউ তাকে এই অবস্থায় দেখলে অন্যরকম ভাববে।
সোজা বাড়ি না ফিরে বীথি চলে এল পুকুরধারে। খানিকক্ষণ বসে রইল চুপ করে। তার বুকের মধ্যে দুমদুম শব্দ থামতে বেশ সময় লাগল। লোকগুলো সত্যিই যদি তাকে ধরে নিয়ে যেত? লোকগুলো তাকে কোথায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিল; বীথি সারারাত না ফিরলে দ্বারিক নিশ্চয়ই ছোটাছুটি করত চারদিকে। এমনিতেই দ্বারিকের সমস্যার অন্ত নেই।
গোষ্ঠ ভট্টাচার্য নিশ্চয়ই ঘটনাটা বলে বেড়াবেন সবাইকে। তিনি এত বড়ো একটা বীরত্বের কাজ করেছেন, সে-কথা লোককে না জানিয়ে ছাড়বেন কেন? তিনি কতখানি রং চড়াবেন, তাই বা কে জানে! এরপর এ গ্রামে থাকা বীথির পক্ষে আরও শক্ত। কাল ভোরেই সে চলে যাবে। ভাগ্যিস কথাটা সে আজ সকালেই দ্বারিককে বলেছিল, দ্বারিক অন্তত বুঝতে পারবে যে শুধু এই ধরনের একটা বাইরের ঘটনার জন্যই বীথি চলে যাচ্ছে না।
যাওয়ার আগে এই ঘটনাটা কি বীথির নিজের মুখে জানানো উচিত, না উচিত নয়! বীথি কিছুতেই তা ঠিক করতে পারল না।
বীথি তার চুলের মধ্যে আঙুলগুলো চিরুনির মতন চালিয়ে জট ছাড়াল, তারপর চুল বাঁধল। শাড়িটা খুলে নিয়ে ধুলো ঝেড়ে নিল ভালো করে। ঠোঁটের কোণে রক্তটা জমে গেছে এখন, পুকুরের জলে ভালো করে ধুয়ে নিলে মুখ। সন্ধ্যের পর সাধারণত এখানে কেউ আসে না। কিন্তু এখন পুকুরপাড়ের সব কটি গাছকেই মনে হচ্ছে অবিশ্বাসী। প্রত্যেকটি গাছই যেন একজন করে শয়তানকে লুকিয়ে থাকবার আড়াল দিয়েছে। তারা বীথির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্য ওঁত পেতে আছে।
বারান্দায় পা দু-খানি ছড়িয়ে বসেছিলেন মা। বীথির দেরি করে ফেরা বিষয়ে কোনো কথা বললেন না।
বউমা, তুমি কাল চলে যাচ্ছ? সত্যি চলে যাচ্ছ?
কোনো দ্বিধা না করে বেশ স্পষ্টভাবে বীথি বলল, হ্যাঁ মা!
আর একটিও কথা হল না। প্রথমে নিঃশব্দে কেঁপে কেঁপে, তারপর শব্দ করে তিনি কাঁদতে লাগলেন।
বীথি বুঝতে পারল, এই কান্না তার চলে যাওয়ার কারণে নয়, এই কান্না ওঁর ফিরে না আসা ছেলের জন্য। এখানে বীথির কোনো সান্ত্বনার ভাষা নেই। সে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর চলে গেল ভেতরে।
নিজের ঘরে ঢোকবার আগে সে উঁকি মেরে দেখল, দ্বারিক এখন জেগে আছে। হ্যারিকেনের আলোয় পড়ছে একটা বই।
খাওয়ার সময়ও দ্বারিক বিশেষ কোনো কথা বলল না। মা কান্না থামিয়ে ফেলেছেন। নিজেই প্রসঙ্গটা তুলে বললেন, বউমা কাল কখন যাবে? একা একা এতটা পথ যেতে পারবে?
আসবার সময় যে বীথি একাই এসেছিল সে-কথা মা ভুলে গেছেন।
দ্বারিক বলল, আমি ট্রেনে তুলে দিয়ে আসব। বেশি বেলা হয়ে গেলে মল্লিকপুরের বাসে বসবার জায়গা পাওয়া যায় না। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়াই ভালো, সাতটার মধ্যে…।
সারাদিন ঘুমিয়েছে বলে দ্বারিকের সহজে ঘুম আসবে না। আজও বীথি তার খাওয়ার জল রেখে গেছে। কাল থেকে আর রাখবে না। জলের গেলাসটা রেখে বীথি একটুক্ষণ যেন দাঁড়িয়েছিল। সে কি কিছু বলতে চেয়েছিল? কিন্তু কিছু বলেনি। দ্বারিকও বলতে পারেনি কিছু। একটুক্ষণ চেয়েছিল তার দিকে। তারপর বীথি চলে গেল।
অথচ অনেক কথা বলার ছিল।
সারাদিন ঘুমিয়ে বেশ উপকার হয়েছে দ্বারিকের। জ্বর জ্বর ভাবটা ছেড়ে গেছে। দু-বার পড়া একটা প্রবন্ধের বই সে তৃতীয়বার পড়তে লাগল শুয়ে শুয়ে। পড়ায় মন না বসলেও সে জোর করে চোখ আটকে রাখছে বইয়ের পাতায়।
একসময় হ্যারিকেনের শিখা দপদপ করে উঠল। তেল ফুরিয়ে এসেছে। দ্বারিক ঘড়িতে দেখল, রাত সোওয়া একটা।
বীথির ঘরে আলো জ্বলছে এখনও। বীথি তো সারাদুপুর ঘুমোয়নি, তবু এত রাত জেগে বই পড়ছে সে? কাল ভোরে জাগতে হবে। কোনো বই যদি তার শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে সেটা তো অনায়াসেই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারে।
দ্বারিক খাট থেকে নামল।
বীথি বই পড়ছে না। হ্যারিকেনটা জ্বালাই রয়েছে—পাশের টুলের ওপর, বীথি দু-হাতে মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ঘুমিয়েই পড়েছে বোধ হয়।
আলোটা নিভিয়ে দেওয়া দরকার। দ্বারিক পা টিপে টিপে ঢুকল বীথির ঘরে। হ্যারিকেনটা তুলে নিতেই বীথি মুখ ফিরিয়ে তাকে দেখল।
তোমার সঙ্গে আমার দু-একটা কথা আছে, বীথি। হয়তো পরে আর সময় পাওয়া যাবে না।
বীথি উঠে বসল। দ্বারিক ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, প্রায় শব্দ না করে সদর দরজাটা খুলে চলে এল সামনের চত্বরে। বীথিও পেছন পেছন এসেছে।
ভুতোর তৈরি কাঠের গুঁড়ির বেঞ্চিটা দেখিয়ে বীথিকে সে বলল, বোসসা! তোমার ঘুম ভাঙালাম, না তুমি জেগেই ছিলে?
ঘুম আসছিল না।
দ্বারিক কোনখান দিয়ে কথা শুরু করবে, ভেবে পাচ্ছে না। অথচ তাকে কিছু কথা বলতেই হবে। স্কুল ফাইনালের প্রথম পরীক্ষার দিনে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় শরীরটা যেমন অদ্ভুত হালকা লাগছিল, আজও যেন ঠিক সেইরকম অনুভূতি হচ্ছে দ্বারিকের।
নিজের কাছে আর অস্বীকার করার উপায় নেই দ্বারিকের, যে বীথির চলে যাওয়াটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। জাগ্রত অবস্থায় শুধু এই কথাটাই তার মাথায় ঘুরছে। এর কারণ কী? কয়েক মুহূর্ত আগে বীথির ঘরে ঢোকার সময় সে কারণটা স্পষ্ট টের পেয়েছে। বীথির সঙ্গে তার বেশি কথাবার্তা না হলেও, দ্বারিক জানত, বীথি তাকে বোঝে। বীথি দূর থেকে তাকে লক্ষ করে। তার অস্থিরতা, হতাশা, সংশয়ের কথা বীথি ঠিক টের পায়। প্রত্যেকদিন রাত্রে জলের গেলাস দিতে এসে বীথি যে দুটো-একটা কথা বলত, তাতেই বোঝা যেত যে, বীথি তার যন্ত্রণার ভাগ নিচ্ছে। এ গ্রামে আর একজনও কেউ নেই, যার সঙ্গে দ্বারিক মন খুলে কথা বলতে পারে। কাল বীথি চলে যাবে, কাল থেকে দ্বারিক সত্যি সত্যি সম্পূর্ণ একা।
অথচ বীথির যাওয়াই তো উচিত। সে কেন এখানে পড়ে থেকে তার জীবনটা নষ্ট করবে? শুধু শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে সে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা! বীথিকে আটকাবার চেষ্টা করা, দ্বারিকের পক্ষে স্বার্থপরতা।
তুমি একদিন বলেছিলে, ভুতো..মানে স্বদেশ তোমাকে এই গ্রামে এসে অপেক্ষা করতে বলেছে…সে ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি থাকবে…তখন আমি কিছু বলিনি, কিন্তু আজ বলা দরকার, ভুতো আর কখনো ফিরবে না।
বীথি চুপ করে দ্বারিকের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
দ্বারিক চোখ নত করে বলল, কাল তুমি চলে যাচ্ছ, এবার তোমাকে খোলাখুলি বলা উচিত, তুমি নিশ্চয়ই খুব আঘাত পাবে…কিন্তু এই গোপনীয়তার বোঝা আর আমি বইতে পারছি না…ভুতো বেঁচে নেই!
বীথি একটুও চমকাল না। মৃদু গলায় বলল, আমি জানতাম।
দ্বারিকই চমকে উঠল সাংঘাতিকভাবে। এতদিন একথাটা সে মনে মনেও উচ্চারণ করতে ভয় পেয়েছে, পাছে বীথি জেনে যায়। অথচ বীথি তা আগে থেকেই জেনে বসে আছে!
তুমি কী করে জানলে? তুমি কবে জানলে?
এখানে আসবার আগেই…পুলিশ ওকে ধরতে পারেনি…ওর ডেডবডি পাওয়া গিয়েছিল জঙ্গিপুরে…পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল না অন্য পার্টির ছেলেরা মেরেছিল, তা জানা যায়নি শেষ পর্যন্ত…ওর বন্ধুরা ওর বডি পুড়িয়ে ফেলে।
আমিও তাই শুনেছি..বিমল, কৌশিক, ভৃগু আর মন্টু—ওরা এই চারজন বন্ধু ওকে নিয়ে গিয়েছিল শ্মশানে.কৌশিক পরে ধরা পড়ে..জেলের মধ্যে গোপনে আমাকে এই খবর দেয়।
আশিসেরই ডাক নাম ভৃগু, যে আশিস এখানে এসেছিল।
আমাকে একথা তোমরা আগে বলোনি? অথচ আমি দিনের পর দিন…প্রথমে ভেবেছিলাম, মার কাছে খবরটা আস্তে আস্তে ভাঙব, মা সইতে পারবেন না…তারপর তুমি এসে পড়লে।
আমরা ভেবেছিলাম, আপনি জানেন না…আপনি হঠাৎ বেশি আঘাত পাবেন ভেবে…ওর বন্ধুরা সবাই জানে, আপনি আপনার ভাইকে দারুণ ভালোবাসতেন…
ভুতো চলে গিয়ে আমার প্রাণশক্তি অর্ধেক নিয়ে গেছে।
ও ধানবাদে লুকিয়েছিল, সেখানে থাকলে ধরা পড়ত না…কিন্তু ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছিল।
তোমাদের বিয়ে হয়েছিল…একদিন পুলিশ তোমাদের বাড়ি সার্চ করতে আসে, ভুতো আর উপায়ন্তর না দেখে, তোমাদের বিছানায় এক কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়ে…সেই জন্যই তোমার বাবা।
না তো! সেরকম কিছু তো হয়নি। ও বিয়ে করতে চায়নি, আমিই জোর করেছিলাম…ও সেই সময়টা প্রায় পাগলের মতন হয়ে গিয়েছিল…আমি ভেবেছিলাম আমি ওকে বাঁধতে পারব…কিছুটা স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা পেলে…কিন্তু ভুল, কিছুতেই ওকে আটকানো গেল …এমারজেন্সি উঠে যাওয়ার পর আমি বলেছিলাম ওকে ধরা দিতে, ও শুনল না, আমার কথা না, কারোর কথা না…
ভীষণ জেদি ছেলে।
এখন কি মাকে বলবেন?
তুমি চলে গেলে…তারপর আস্তে আস্তে বলতেই হবে।
আমি কি আরও কিছুদিন থেকে যাব এখানে?
না, না, না, তুমি থাকবে কেন? তোমার আর থাকার কোনো মানেই হয় না…এতদিন কষ্ট করে থেকেছ, সেটাই আমি অবাক হয়ে ভাবছি এখন।
কষ্ট? আপনিও তো কত কষ্ট করে আছেন।
এটা আমার বাড়ি, আমার জায়গা…আমার তো এখানে কোনো কষ্ট হয় না।
আপনি বসুন।
না, দাঁড়িয়ে থাকতেই আমার ভালো লাগছে…তুমি যদি আগে বলতে যে তুমি জান, তাহলে গোপনীয়তা আমরা দুজনে ভাগ করে নিতাম…কিংবা হয়তো ভালোই হয়েছে, মা-র কাছে ধরা পড়ে যেতাম আগেই…তুমি চমৎকার অভিনয় করেছ, আমি পর্যন্ত বুঝতে পারিনি।
আমিও বুঝতে পারিনি যে আপনি জানেন। স্বদেশ আমাকে বলেছিল, একবার ওর মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, সেইজন্যই আমি এসেছিলাম। ভেবেছিলাম, দু-এক সপ্তাহ পরেই ফিরে যাব…এসে দেখলাম, আপনি একা, সব কিছু সামলাতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছেন…তাই ভাবলাম যদি কিছু সাহায্য করতে পারি আমি…আপনাদের দুই ভাইয়ের মুখের আদল একদম একা।
তুমি অনেক সাহায্য করেছ!
ছাই সাহায্য করেছি!
তুমি জান না, বীথি, তুমি ছিলে বলেই আমি অনেক জোর পেয়েছি।
আমি কি আরও কিছুদিন থাকব? থাকতে পারি, কোনো তাড়া তো নেই।
না, না, না! এখানে থেকে তোমার সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
আমার জন্যই আপনাকে অনেক বিপদে পড়তে হয়েছে। হয়তো আরও হবে।
তোমার জন্য নয়। গ্রামের লোক আমাকে ভয় পায়…ওরা ভাবে আমি বুঝি আবার ছোটো ছোটো ছেলেদের খ্যাপাব…তাদের বিপজ্জনক পথে নিয়ে যাব..সেইজন্যই যেকোনো ছুতোয় ওরা আমাকে তাড়াতে চায়।
আমি যখন প্রথম আসি, তখন তো গ্রামের লোক কোনো আপত্তি করেনি, আমি কুয়ো থেকে জল এনেছি, তাও কেউ কিছু বলেনি…হঠাৎ এতদিন বাদে কেন সবাই আমার জাত নিয়ে…
সে-কথাটা আমিও ভেবেছি…এটাও গ্রাম্য সংস্কার..তুমি যতদিন..মানে যতদিন তোমার গর্ভে সন্তান ছিল, কেউ তোমার সঙ্গে শত্রুতা করতে সাহস করেনি…ভাবি-জননীর কোনো ক্ষতি করলে নিজেদের সংসারে অমঙ্গল হয়…এ-রকম একটা ধারণা আছে…এখন তো তুমি জননী নও।
একটা কথা বলব?
কী?
আমি চলে যাচ্ছি…আপনি এখানে একা থেকে কী করবেন? একা একা সবার সঙ্গে লড়াই করবেন কী করে? আপনিও চলুন…বড়ো কোনো জায়গায় আপনি কাজ করার অনেক সুযোগ পাবেন…ইচ্ছে করলে, বহরমপুরেও
দ্বারিক একটুক্ষণ চুপ করে রইল। সে অভাববোধ করল একটা সিগারেটের। কিন্তু সিগারেট আনবার জন্য আবার বাড়ির মধ্যে যেতে হবে। কোনোরকম শব্দ পেলে মা জেগে উঠতে পারেন। সিগারেট টানলে আবার কাশিও হবে। তার শরীরটা একটু একটু কাঁপছে।
তা হয় না!
বীথি নেমে পড়ল বেঞ্চটা থেকে। দ্বারিকের কাছে একটু এগিয়ে এসে বলল, আপনি মা বাবার কথা ভাবছেন? বহরমপুরেও স্কুল আছে…কিংবা অন্য কোনো যা তোক একটা কাজ আপনি ঠিকই পেয়ে যাবেন…মা-বাবাকে টাকা পাঠাতে পারবেন…পরে ইচ্ছে করলে মা বাবাকেও ওখানে কাছে নিয়ে রাখতে পারবেন, ওখানে গেলে পার্টির ছেলেদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগও হবে।
দ্বারিক খানিকটা কঠোরভাবে বলল, সে আমি যাব কিনা, পরে ভেবে দেখব। তুমি যাচ্ছ, এখনই আমার যাওয়া চলে না।
তুমি ঘরে যাও বীথি, শুয়ে পড়ো। কাল ভোরে উঠতে হবে।
আপনি যাবেন না?
আমি একটু পরে যাচ্ছি…আমার এখন ঘুম আসবে না, খানিকক্ষণ খোলা হাওয়ায় থাকলে আপনার জন্য আমার ভয় করে।
কেন?
আপনার শরীর ভালো নেই…আপনার মনের ওপর সাংঘাতিক চাপ…এখানে আপনার কোনো বন্ধু নেই…আমি দূরে চলে গেলেও আপনার জন্য…স্বদেশ আর ফিরবে না। কিন্তু আপনি..আপনার জন্যই আমি এতদিন এখানে ছিলাম।
দ্বারিক অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার জন্য তোমার চিন্তা করার কোনো দরকার নেই…আমি ঠিক থাকব…তুমি শুতে যাও, অনেক রাত হল।
বীথি দ্বিধা করতে লাগল। আজ সন্ধ্যের ঘটনাটা কি সে দ্বারিককে জানাবে? দ্বারিক পরে শুনতে পাবেই। সেই শয়তানগুলো ভাববে, বীথি ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছে। ওই কথাটা মনে আসতেই বীথির রাগ হয়ে যাচ্ছে।
আমি যদি না যাই, যদি ঠিক করি এখানেই থাকব, তাও কি আপনি আমাকে চলে যেতে বলবেন জোর করে?
দ্বারিক অসহায়ভাবে বলল, তুমি অবুঝ হোয়য়া না বীথি…আমি মাকে…অন্যদের বলেছি তোমার চলে যাওয়ার কথা, তোমার এখন আর থাকা চলে না…তোমার চলে যাওয়াই ভালো, আমি বলছি, সেটাই তোমার পক্ষে সবদিক থেকে ঠিক…
বীথি ধীরপায়ে হেঁটে গেল বাড়ির দিকে। ভেতরে ঢুকে ভেজিয়ে রাখল সদর দরজাটা। কিন্তু নিজের ঘরের হ্যারিকেনটা নেভাল না। তার লালচে আলোর শিখা পড়ে রইল উঠোনে।
দ্বারিক পায়চারি করতে করতে সেই আলোটার দিকে তাকাতে লাগল বার বার। বীথি আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তারপর সে বাড়িতে ঢুকবে।
পায়চারি করতে করতে এক-একবার চলে যেতে লাগল আমবাগান পর্যন্ত, আবার ফিরে এল। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত না হয়ে পড়লে ঘুম আসবে না। সেইসময় একটা ঝড় বইছে, কিন্তু দ্বারিক এখন কিছুই ভাবতে চায় না? চিন্তার সব কটা জানলা বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব হলে সে তা-ই দিত। ভুতোর কথা বলে ফেলে শরীরটা অনেকখানি স্বচ্ছন্দ লাগছে।
দ্বারিক খুব মায়ার সঙ্গেই নিজের শরীরে হাত বুলোতে লাগল। স্বাস্থ্যটা এবার ভালো করে নিতেই হবে। সামনেই আসছে কঠোর গ্রীষ্ম, শরীর ভালো না থাকলে সে যুঝতে পারবে না। জলের ভাগবাটোয়ারা কিংবা ধান কাটার সময় ঝামেলা বাধবেই। দ্বারিকের সামনে এখন অনেক কাজ।
এই তার গ্রাম, এখানে সে জন্মেছে, জেল থেকে সে এখানেই ফিরে এসেছে। এখানে যদি সে হেরে যায় এখান থেকে যদি তাকে পালিয়ে যেতে হয়, তাহলে অন্য কোনো জায়গায়, অন্য কোনো বৃহত্তর জয়েরও কোনো মূল্য থাকবে না।
বীথি কাল চলে যাবে। কিন্তু দ্বারিককে থাকতে হবে এখানেই।