০৬. পাছ পুকুরের জল

পাছ পুকুরের জল এত নোংরা যে ওখানে স্নান করতে প্রবৃত্তি হয় না। রান্নাঘরের পেছনে চারখানা টিন দিয়ে ঘিরে একটা ছাদখোলা বাথরুম বানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বীথি স্নান করে সেখানে।

জল আনতে হয় সরকার বাড়ির কুয়ো থেকে। দ্বারিকদের পানীয় জল বরাবর ওইখান থেকেই আসে, কিন্তু স্নানের জল কেউ কখনো ওখান থেকে আনেনি। বর্ষার সময়টা ওই পুকুরের জলেই চালিয়ে দিতে হয়। এদিকে জলের বড়ো কষ্ট। প্রত্যেকদিন স্নান করা এখানে বিলাসিতা। কিন্তু বীথি রোজ অতদূরের কুয়ো থেকে জল টেনে টেনে আনে, বড়ো বড়ো বালতির তিন-চার বালতি।

সে-দৃশ্য দেখে দ্বারিকের খুবই অস্বস্তি হয়। বীথি শহরের কলেজে-পড়া মেয়ে। কুয়ো থেকে জল তোলার অভ্যেস তার নেই, তার ওপর রোদুরের মধ্যে এতটা পথ ওই ভারী বালতি বয়ে আনা। যার গর্ভে একটি সন্তান নষ্ট হয়েছে, তার পক্ষে কি এত পরিশ্রম করা উচিত? পেটে ব্যথার জন্য একসময় বীথি অজ্ঞান হয়ে যেত, এখনও সব সেরেছে কিনা কে জানে!

অথচ অন্য কোনো উপায়ও নেই। জল আনার জন্য আর তো কোনো লোক নেই বাড়িতে। এক দ্বারিক নিজে এনে দিতে পারত। কিন্তু গ্রামে এ-রকম শিভাল্যরি চলে না। সে ভাসুর হয়ে রোজ ছোটোভাইয়ের স্ত্রীর স্নানের জল এনে দিচ্ছে, এটা হতেই পারে না। কেন পারে না? গ্রামের লোক এই নিয়ে পাঁচরকম কথা বলবে, এজন্য দ্বারিক ভয় পায়? গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই সেদিন এ-রকম একটা কুৎসিত ইঙ্গিত করেছিলেন। গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের মতামতটা গ্রামে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে যায়। বলুক-না যার যা খুশি! আবার একথাও ঠিক, বীথি নিজেই রাজি হত না। দ্বারিক রোজ পরিশ্রম করে জল এনে দেবে, আর বীথি স্নান করবে, এ-রকম বিলাসী মেয়েও বীথি নয়। ব্যাপারটা সরল নয় মোটেই।

স্নান সেরে আসার পর বীথি মাঝখানের বড়ো ঘরটার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিঁদুর পরে। মাস দু-এক ধরে বীথির স্বাস্থ্যটা ভালো হয়েছে। তার স্নানসিক্ত নির্মল মুখখানি দেখলে আর মনে হয় না যে, সে পরিশ্রমের জন্য ক্লান্ত। স্নানটা সে সত্যিই খুব উপভোগ করে।

প্রত্যেকদিন যা দেখা অভ্যেস, তার কোনো অনিয়ম হলে প্রথম দু-তিনদিন ঠিক খেয়াল হয় না, তারপর একটা খটকা লাগে।

খেয়ে-দেয়ে স্কুলে যাওয়ার পথে, রোদের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দ্বারিকের একটু খটকা লাগল। রোজ সে খেয়ে ওঠার পর মিনিট পনেরো জিরিয়ে নেয়। সেইসময় সে খোলা দরজা দিয়ে মাঝের ঘরে আয়নার সামনে বীথির সিঁদুর পরার দৃশ্য দেখে। ওই দিকে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। এটা প্রতিদিনের ঘটনা। কিন্তু আজ, গতকাল বা পরশু সে বীথিকে সিঁদুর পরতে দেখেনি।

গ্রামের মেয়েদের মতন মোটা করে সিঁদুর পরার চল আজকাল শহরে নেই। বেশি সিঁদুর ব্যবহার করা উচিতও না। গ্রামে যেগুলো কিনতে পাওয়া যায় সেই মেটে সিঁদুরের মধ্যে লেড মেশানো থাকে, ওপর থেকে লেড পয়জনিং হওয়ার সম্ভাবনা। ওই জন্য গ্রামের অনেক সতীসাবিত্রী রমণীরই মাথার সামনের দিকে চুল উঠে যেতে শুরু করে তাড়াতাড়ি। অনেকের সিঁথি বিশ্রীভাবে চওড়া হয়ে যায়, নানারকম পেটের গোলমালও শুরু হয়।

কিন্তু দ্বারিক তো বীথিকে সিঁদুর পরতে বারনও করতে পারে না।

বীথি অত সিঁদুর পরত নিশ্চয়ই মাকে খুশি করার জন্য। হঠাৎ কি বীথি সেই অভ্যেস পালটালো? দ্বারিক ভালো করে বীথির মুখচ্ছবিটা মনশ্চক্ষে আনবার চেষ্টা করল, না, বীথির সিথিতে তো সে এখনও সিঁদুর দেখতে পাচ্ছে। দেখেছে আজও বেরোবার আগে। তা হলে কি বীথি আয়না কিনে নিজের ঘরে সিঁদুর পরে। আয়না কিনল কবে? বীথির সত্যিই একটা নিজস্ব আয়না কেনা দরকার। একথা দ্বারিকের বোঝা উচিত ছিল।

সারাদিন এই কথাটা ঘুরে-ফিরে অনেকবার মনে আসছিল দ্বারিকের। কিন্তু সন্ধ্যের পর বাড়ি ফিরে আবার সে ভুলে গেল। ফের মনে পড়ল পরদিন সকালে। না, বীথির ঘরে কোনো আয়না নেই।

সকাল থেকে বীথির কতগুলো ধরাবাঁধা কাজ আছে।

ভুবন চা খেতে ভালোবাসেন, তাই সকাল বেলা দু-বার চা হয়। এটাই এ বাড়ির একমাত্র বিলাসিতা। এ গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতেই চায়ের পাট নেই। চা তৈরির ভার বীথির। দ্বিতীয়বার চায়ের সঙ্গে বীথি প্রত্যেককে এক বাটি করে মুড়ি ও কাঁচা পেঁয়াজ দেয়। কোনো কোনো দিন পেঁয়াজকলি ভাজা। হালদার বাড়ির সারাদিনের খাদ্যে পেঁয়াজের খুব প্রাবল্য। বাড়ির পেছন দিকের কাঠাসাতেক জমি এতদিন আগাছায় ভরে থাকত। দ্বারিক সে-জায়গাটা সাফসুতরো করে পেঁয়াজ চাষ দিয়েছিল, বেশ ভালো ফলন হয়েছে। নতুন করে আবার লাগানো হয়েছে। বীথিই এখন পেঁয়াজ খেতের চর্চা করে। সে জল দেয়, মাটি নিড়োয়, আগাছা বাছে।

ভুবন হালদারের বাবা যা জমিজায়গা রেখে গিয়েছিলেন, ভুবন হালদার বিক্রি করতে করতে তা প্রায় ফতুর করে এনেছেন। অবশ্য নেশা-ভাং করেননি বা বেলেল্লাপনাও ছিল না, মানুষটি প্রকৃতিতেই অলস এবং বিষয়বুদ্ধিহীন। কিছু জমি গেছে মেয়ের বিয়েতে, আর কিছু গেছে দুই ছেলেকে লেখাপড়া শেখাবার জন্য। মোরামডাঙার মতন গ্রামের ক-টা লোক শহরের হোস্টেলে ছেলেদের রেখে লেখাপড়া শেখায়?

দ্বারিকের দিদির বিয়ে হয়েছিল বর্ধমানে। কিন্তু জামাইবাবু এখন জিয়োলজিক্যাল সার্ভেতে চাকরি নিয়ে সপরিবারে থাকেন দেরাদুনে। বছর সাতেকের মধ্যে দিদি এ গ্রামে আসেনি। অ্যাবসকণ্ড করে থাকার সময় দ্বারিক জামাইবাবুর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। উনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তাই দ্বারিক আর দিদি-জামাইবাবুকে চিঠিও লেখে না।

এখন জমি আছে মাত্র এগারো বিঘে। ভাগচাষ দেওয়া আছে। জলের অভাবে এদিকে ধানের ফলন খুব কম। আই আর এইট-এর মতন বহুমুখী ধানের চারার কথা এদিককার চাষিরা জানে না, বছরে দু-তিনবার ফসল ওঠবার কথা স্বপ্নেও ভাবে না। বিঘেপ্রতি সাত-আট মন ধান হয় মাত্র, তাও যদি খরা না লাগে। বছরে সাত-আট মাসের মতন খোরাকির চাল ওই জমি থেকেই আসে। আর কোনো আয় নেই।

দ্বারিক পেঁয়াজের চাষ করে উৎসাহিত হয়ে কিছুদিন ধরে ভাবছে এবার সে বেগুন, আলু ইত্যাদি তরকারির চাষেও লাগবে। এ কাজে সে বীথিকেও নিযুক্ত রাখতে চায়। কারণ, সারাদিনে তার তত প্রায় কিছুই করার নেই। বীথি যথেষ্ট লেখাপড়া শিখেছে, অথচ তা কোনো কাজেই লাগবে না, এটা দ্বারিকের মনে হয় বিশ্রী অপচয়। স্কুলে পড়ানোর কাজ বীথিও করতে পারত দ্বারিকের মতন, কিন্তু আশেপাশে কোনো মেয়েদের স্কুল নেই। বাড়িসংলগ্ন জমিতে তরকারি চাষ করলে তবু কিছুটা সাশ্রয় হয়।

রান্নার কাজটা মা নিজের হাতেই রেখেছেন। বীথি নিতে চেয়েছিল, মা দেননি। রান্নাটাও ছেড়ে দিলে মা নিজেই বা সারাদিন করবেন কী? তা ছাড়া শুধু লাউয়ের খোসা আর আলুর খোসা মিলিয়ে যে সুস্বাদু হেঁচকি রাঁধা যায়, তা কি বীথি পারবে? বীথি চাল, ডাল ধুয়ে তরকারি কুটে মাকে খানিকটা সাহায্য করে, তারপর সরকার বাড়ির কুয়ো থেকে বালতি ভরে জল আনতে যায়। তার স্নানের জল। খাবার জলটা অবশ্য মা নিজেই আনেন পেতলের কলসিতে।

বীথি, তোমার কি জ্বর-টর হয়েছে?

দ্বারিকের রোদে শুকনো শার্ট আর গেঞ্জি রাখতে এসেছিল বীথি। ঘুরে তাকিয়ে বলল, কই না তো!

বীথি সত্যি কথা বলছে কিনা অথবা তার শরীরে জ্বর আছে কিনা এটা দেখার জন্য বীথির কপালে হাত দিয়ে দেখা দরকার। এ দায়িত্বটা দ্বারিক তার মাকেই দিতে চায়। কিন্তু একটা মুশকিল এই, মা কোনো অসুখবিসুখের নাম শুনলেই চোখ কপালে তুলে ফেলেন। প্রত্যেক অসুখের পাশেই যেন মা দেখতে পান মৃত্যুদূত।

মাকে এ-রকম ব্যতিব্যস্ত করা বীথি নিশ্চয়ই পছন্দ করবে না।

তোমার যদি শরীর-টরীর খারাপ হয় আমাকে বলবে। শুধু শুধু চেপে রাখলে পরে বেশি কষ্ট পেতে হবে তোমাকেই!

আমার শরীর একটুও খারাপ হয়নি। এখন খুব ভালো আছি। আমায় কিছু খারাপ

দেখছেন?

তিন-চারদিন ধরে তোমায় জল আনতে দেখিনি। তুমি স্নান করছ না?

এখন থেকে ভাবছি, পুকুরের জলেই স্নান করব।

কেন?

বীথি চাপাভাবে হাসল। যেন এ প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। শুধু হাসিটাই যথেষ্ট।

শীতের শেষে পুকুরে জল বলতে প্রায় কিছুই নেই। এক হাঁটু জলের পরেই থকথকে কাদা। তাও শ্যাওলা সরিয়ে সরিয়ে নামতে হয়। বাসনপত্র ধুতে হয় ওই জলেই।

দ্বারিক আবার জিজ্ঞেস করল, কেন?

আপনারা ওখানে চান করতে পারেন, আমিই বা পারব না কেন? বিকেলের দিকে জলটা অনেকটা পরিষ্কার থাকে।

বীথি আবার হাসল। সঙ্গে সঙ্গে একটা ঝিলিক খেলে গেল দ্বারিকের মাথায়। এবার সে বুঝতে পেরেছে বীথির হাসির মর্ম। মেয়েদের অকারণ হাসির মানে একটাই হয়, বীথি দ্বারিকের মন অন্য দিকে ফেরাতে চায়।

আমি একটু ঘুরে আসছি।

এখন কোথায় যাবেন? আপনি খেতে বসবেন না। আপনার স্কুলে যাওয়ার দেরি হয়ে যাবে।

দ্বারিক দেওয়ালের পেরেকে ঝোলানো জামাটা নিয়ে গায়ে পরতে পরতে বলল, সরকারবাড়ির কুয়ো থেকে তোমায় জল আনতে কেউ বারন করেছে?

না তো!

বীথি সচরাচর মিথ্যেকথা বলে না। আজ মিথ্যেকথা বলছে বলেই সেটা চাপা দেওয়ার জন্য হাসছে বারে বারে।

এখন শুধু শুধু কেন বেরোচ্ছেন?

আমাকে যেতেই হবে।

বীথি কোনোদিন যা করেনি, আজ তাই করল। এগিয়ে এসে দ্বারিকের হাত চেপে ধরে বলল, না, যাবেন না, আমি অনুরোধ করছি।

দ্বারিক কড়া গলায় বলল, আমার হাত ছাড়ো, বীথি।

ছোটোবাড়ি, এঘর থেকে ওঘরের কথা শোনা যায়। মা রান্নাঘরে, শুনতে পাননি কিছু, কিন্তু ভুবন এসে দাঁড়িয়েছেন দরজার সামনে। তিনি দেখলেন তাঁর ছোটো-বউমা তাঁর বড়ছেলের হাত চেপে ধরেছে। ভুবন কোনো কথা বললেন না, দাঁড়িয়েই রইলেন।

বীথি হাত ছেড়ে দিয়ে একটু সরে দাঁড়াল। হঠাৎ ভুবন এসে না পড়লে সে হয়তো দ্বারিককে আরও কিছু বলত।

দ্বারিক পায়ে চটি গলিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঘর থেকে। বাইরে যেতে যেতে শুনল, ভুবন জিজ্ঞেস করছেন, অ বউমা, কোথায় গেল বড়োখোকা? রাগ করে গেল? তুমি তাকে কিছু বলেছ? অ বউমা…

বীথি অসহায়। সে তো আর ভুবনকে বলতে পারবে না, যান, আপনার ছেলেকে এক্ষুনি ফেরান, সে সত্যিই রাগ করে যাচ্ছে।

দ্বারিক হন হন করে এগিয়ে গেল সরকারদের কুয়োর কাছে।

সরকারদের বাড়িতে এখন বারো শরিক। তাদের মধ্যে নিত্য তিরিশ দিন ঝগড়া। এ পরিবারে সবচেয়ে সার্থক পুরুষ বিশ্বেশ্বর সরকার কিছু সম্পত্তি দেবত্র করে গিয়েছিলেন, শরিকি বিবাদে সেটা এখনও নষ্ট হয়নি। একটা শিবমন্দির, ছোটো একটি বাগান ও কয়েক বিঘে ধানজমি। আর এই কুয়ো। অনেকখানিক উঁচু করে গোল পাড়বাঁধানো, অনেকে এটিকে ইদারাও বলে। শীতকালেও জল থাকে। একটা পাথরের ট্যাবলেটে অনেক কথা লেখা ছিল, জলে ধুয়ে ধুয়ে মুছে গেছে, এখন আর প্রায় কিছুই পড়া যায় না।

এ গ্রামের মেয়েরা পুকুর পাড়ে গিয়ে বিশ্রম্ভালাপ করে না। মেয়েলি জটলার জায়গা এই কুয়োতলা। আশেপাশের অন্তত পঁচিশ-তিরিশখানা বাড়ির জল যায় এই বাড়ি থেকে।

জনা পাঁচেক মহিলা আজও উপস্থিত রয়েছেন সেখানে। সবাই দ্বারিকের চেনা। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কলরবে মত্ত ছিলেন, দ্বারিককে দেখে হঠাৎ চুপ করে গেলেন। এঁরা অনেকেই দ্বারিককে ছেলেবেলা থেকে দেখেছেন, সুতরাং তাঁকে ভাসুরঠাকুরের মতন সমীহ করার কোনো কারণ নেই। অস্বস্তিকর নীরবতা।

সরকারবাড়ির ছেলে বিষ্ণু কাঁধে গামছা ফেলে একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁতন করছে। শুধু ওবাড়ির পুরুষরাই এখানে স্নান সারতে আসে।

গল্প ভেঙে গেছে, রমণীরা একে একে বাড়ির পথ ধরলেন।

দ্বারিক একজনকে বলল, মণিপিসিমা, একটু জল খাব। একটু জল ঢেলে দেবেন?

মহিলা দ্বারিকের দিকে তাকালেনও না। আড়ষ্ট গলায় বললেন, বালতিতে আছে, ঢেলে নাও।

তারপর নিজের ঘড়াটা কাঁখে তুলে নিয়ে দ্রুত চলে গেলেন।

জল খেতে চাইলে কেউ এ-রকম ব্যবহার করে না গ্রামে। সকলেই নিজের ঘড়া থেকে জল ঢেলে দেয়। মণিপিসিমা বরাবর তাকে তুই বলতেন। দ্বারিক বুঝল গুরুতর কিছু গোলমাল হয়েছে।

দ্বারিক বালতি থেকে জল ঢেলে নিতে যেতেই বিষ্ণু বলল, আমি কিন্তু এখন চান করব!

দ্বারিক বলল, তুমি চান করবে…আমি একটু জল খেলে কি ক্ষতি আছে।

বিষ্ণু বলল, সে-কথা বলিনি। বলছি, তুমি যদি এখন চান করতে চাও, তাহলে একটু দাঁড়াতে হবে, আমি আগে সেরে নেব।

দ্বারিককে দেখেই বোঝা যায়, সে স্নান করতে আসেনি। বিষ্ণু ইচ্ছে করে তাকে খোঁচা মারছে।

বালতি থেকে পরিষ্কার ঠাণ্ডা জলটুকু ঢেলে দ্বারিক মুখটা ধুয়ে নিল ভালো করে, কিছুটা খেয়েও নিল। তারপর হালকাভাবে বলল, তুমি বোসো, বিষ্ণুদা, আমি জল তুলে তোমার মাথায় ঢেলে দিচ্ছি।

কেন, তুমি আমার জল তুলে দিতে যাবে কেন?

এমনিই। বোসসা না।

না। নিজের জল আমি নিজেই তুলে নিতে পারি।

আরে বোসসা না। একদিন না হয় তুলেই দিলাম।

না।

দ্বারিক বালতিটা নীচে নামিয়ে দিল। অনেক দূরে জলের ওপর শব্দ হল ধপাস করে। দ্বারিক আবার বালতিটা টেনে তুলল।

বিষ্ণু এসে সেই বালতির জলটা ঢেলে ফেলল মাটিতে। এবার নিজে সে বালতি ফেলল। তার মুখখানা থমথমে।

বিষ্ণুদা, শোনো।

বিষ্ণু দ্বারিকের দিকে মুখ না ফিরিয়ে ঘাড় গোঁজ করে রইল।

আমাদের, ইয়ে মানে, ভুতোর স্ত্রী এখান থেকে জল নিতে আসত রোজ, তাকে কেউ জল নিতে বারন করেছে?

আমি কী জানি!

আর একজন মধ্যবয়সি মহিলা জল নিতে এসেছেন, পেতলের কলশিটা মাটিতে নামিয়ে রাখতে একটা শব্দ হল।

বিষ্ণু সেইদিকে ফিরে বলল, ওই তো হেমীপিসিমা এসেছেন, ওনাকে জিজ্ঞেস করো, উনি কিছু জানেন কিনা।

দ্বারিক জিজ্ঞেস করল, হেমীপিসি, আমাদের ভুতোর বউকে কেউ জল নিতে বারন করেছে এখান থেকে?

হেমীপিসির জিভের ধার বিখ্যাত। ঠিক এইসময় উনি এসে পড়ায় বিষ্ণু বেশ খুশিই হয়েছে। মনে হল।

হেমীপিসিমা বললেন, না বাবা, তাকে নিষেধ করবে এমন বুকের পাটা কার আছে?

দ্বারিক বক্রোক্তিটা গ্রাহ্য করল না। হাসিমুখে বলল, গত ছ-মাস, আট মাস ধরে সে এখান থেকে জল নিচ্ছে, কেউ কিছু বলেনি, হঠাৎ কী এমন হল? চার-পাঁচ দিন ধরে সে এখানে জল নিতে আসে না, কেউ কিছু তাকে বলেছে নিশ্চয়। আপনি কিছু শোনেননি।

না, আমি কিছু শুনিওনি, বলিওনি তাকে। আমি শুধু বলেছি, ও মেয়েটি জল নিলে আমাদের আর এখান থেকে জল নেওয়া হবে না। আমরা কষ্ট করে ভট্টাচার্য বাড়িতেই যাব। দূর হলে আর কী করা যাবে?

ও জল নিলে আপনারা নেবেন না? কেন? এতদিন নিয়েছেন—

বিষ্ণু এবার বলল, এতদিন তো লোকে জানেনি যে তোমরা শুদুরের ঘর থেকে বউ। এনেছ, তোমরা গোপন রেখেছিলে।

এটা গোপন রাখবার কী আছে?

গোপন রাখবার কিছু থাক-বা না থাক, খুলেও বলনি। ভুতোর সঙ্গে তার কেমন ধারা বিয়ে হল, তাও আমরা জানি না। ওসব কলকাতায় চলে, গাঁয়ে চলে না।

হেমীপিসিমা বললেন, নিজেরা যা করছ, তা করছ, কেউ তো বাগড়া দিতে যায়নি, তা

অন্যের জাতধৰ্ম্ম নিয়ে টানাটানি করা কেন আর?

দ্বারিক ঠাণ্ডাভাবে বলল, ভুতোর সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে গভর্নমেন্টের লোকের সামনে, রীতিমতন সাক্ষী রেখে। সে-কাগজপত্রও আছে, যার খুশি হয়, দেখে আসতে পারে। হেমীপিসিমা, ওই মেয়েটি বি. এ. পাস, ওর বাবা ছিলেন একজন উকিল, তবু সে আপনাদের সঙ্গে এক কুয়ো থেকে জল নিতে পারবে না?

লেখাপড়া শিখলেই কি ছোটোজাত অমনি বড়ো জাত হয়ে যায়? কত ছছাটো জাতও তো আজকাল লেখাপড়া শিখছে…

বিষ্ণু এখনও স্নান শুরু করেনি, দাঁতনটা ঘষে যাচ্ছে একমনে। লোকটি এক নম্বরের মামলাবাজ। তা ছাড়া অন্য চরিত্রদোষও আছে।

দ্বারিক তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, শোনো বিষ্ণুদা, বিশ্বেশ্বর সরকার এই কুয়োটা তৈরি করেছিলেন সর্বসাধারণের জন্য। ওই পাথরের গায়ে সেকথা লেখা ছিল এক সময়, আমরা দেখেছি। সে-লেখা এখন মুছে গেলেও তোমার ঠাকুরদার কথাটা তো মিথ্যে হয়ে যাবে না!

বিষ্ণু বলল, আমার ঠাকুরদার আমলে কোনো বামুনের ঘরে মেয়েকে বউ করে আনা হলে তাদের ভিটেমাটি ছাড়া করে গাঁ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হত!

এখনও তোমাদের সেরকম ইচ্ছে আছে নাকি?

দ্বারিক, তুই আমার ওপর চোখ রাঙাচ্ছিস কেন? আমি তোর খাই না পরি?

আমি বলে গেলাম, ভুতোর বউ আবার এখান থেকে জল নিতে আসবে, দেখি, কে তাকে আটকায়!

আর কেউ জল নিতে আসবে না, সে একা নেবে?

যার খুশি নেবে, যার খুশি নেবে না। কারুকে বাধা দেওয়া চলবে না, এই বলে রাখলাম।

ওসব চোখরাঙানি আমাকে দেখাতে আসিসনি। আগেকার দিন আর নেই যে যখন-তখন যার-তার হাতে মাথা কাটবি।

হেমীপিসিমা বললেন, ও বাবা দ্বারিক, আমার ওপর রাগ করিস না, আমার ঘরে ছোটো ছেলেপুলে আছে, আমরা পুরোনো সেকেলে-মেকেলে লোক, আমরা আর জাত খোওয়াতে পারব না… ভুতোর বউকে আমি মুখ ফুটে কিছু বলিনি..আমি বরং অন্য জায়গা থেকে জল নিতে যাব… বড়ো ভটচাজ বলেছিলেন…

বড়ো ভটচাজ অর্থাৎ গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই। সেদিন গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের কথাগুলোতে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে দ্বারিক ভুল করেছে। উনি ইচ্ছে করলে দারুণ শত্রুতা করতে পারেন।

রাগে দ্বারিকের শরীর জ্বলছে। এখন সে বুঝতে পারছে অনেক কিছু। গত তিন-চারদিন ধরে গ্রামের লোকেরা এড়িয়ে যাচ্ছে তাকে। কীরকম যেন আড়চোখে তাকাচ্ছে। সেই দৃষ্টির মধ্যে খানিকটা ভয়। লোকে নরবলির সঙ্গে তার নামটা জড়িয়েছে। এই কুৎসার উৎস ওই গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই।

বাড়ি না ফিরে দ্বারিক এগিয়ে গেল সরকারবাড়ির দিকে। লীলাবউদির সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। এক্ষুনি।

বিটু নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দ্বারিক একবারও লীলাবউদির কাছে যায়নি। মাকে পাঠিয়েছিল দু-একবার। দ্বারিক কান্না সহ্য করতে পারে না, কান্না শুনলে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করে। লোকে এটা বুঝবে না। বেশিরভাগ লোকই কান্না উপভোগ করে। একজন কাঁদে আর বহুলোক তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে গোল হয়ে। তারা দয়ালু, আর যে সেখানে যায় না, সে নিষ্ঠুর।

বিশ্বেশ্বর সরকারের দু-মহলা বাড়ি এখন যোলো টুকরো। খুব ছেলেবেলায় দ্বারিক এই বাড়ি গমগম করতে দেখেছে। আজ ভূতুড়ে বাড়ি মনে হয়। চতুর্দিকে ভাঙা ইটের স্থূপ। দেওয়ালের গায়ে বট-অশ্বথের মোটা শিকড়।

সদর দরজার কাঠের পাল্লা দুটোয় নানারকম কারুকার্য করা। বিশ্বেশ্বর সরকার নাকি শখ করে গুজরাট থেকে এই পাল্লা দুটো আনিয়েছিলেন। অযত্নে অবহেলায় সেই শিল্পকীর্তি এখন বিবর্ণ, ক্ষতবিক্ষত। এ দরজা কখনো বন্ধ হয় কিনা কে জানে।

ভেতরে একটা চৌকো উঠোন, তার তিনদিকে রক বাঁধানো। সেই রকে বসেছিল সুরেন। দ্বারিককে দেখে সে বিস্ময় লুকোবার চেষ্টাও করল না। স্পষ্টত হাঁ হয়ে গেল মুখখানা। তাড়াতাড়ি দরজার দিকে চেয়ে দেখল, দ্বারিকের সঙ্গে দলবল রয়েছে কিনা। আর কেউ নেই দেখে সে যেন আরও বেশি অবাক।

দ্বারিক সুরেনের সঙ্গে কথা বলার কোনো প্রয়োজন বোধ করল না। সবাই জানে, সে একটি অপদার্থ। এখানকার ভিলেজ ইডিয়েট-এর পদটা তাকে দেওয়া যায় অনায়াসে।

কোথায় যাচ্ছিস, দ্বারিক?

দ্বারিক কোনো উত্তর না দিয়ে রকের ওপর উঠে দুটো ঘরের মাঝখানের সরু জায়গাটা দিয়ে চলে এল দ্বিতীয় উঠোনটার দিকে। এই উঠোনেও তিন দিকে উঁচু রক, তার ওপর সার সার ঘর। দক্ষিণ দিকের কোণের একটিমাত্র ঘর লীলাবউদির।

ধীরেনদা মারা যাওয়ার পর লীলাবউদিকে এ বাড়ি থেকে তাড়াবার অনেক চেষ্টা হয়েছে। উনি বিদায় হলেই ধীরেনদার ভাগের ঘর আর জায়গাজমি অন্যদের দখলে আসতে পারে। বিষ্ণু তো মামলা বাধিয়ে জমিগুলো হাতাবার ব্যবস্থা প্রায় পাকা করে ফেলেছে। এ ব্যাপারে ওই হাবলা সুরেনটার উৎসাহও কম নয়।

লীলাবউদি।

দু-তিনবার ডেকেও দ্বারিক কোনো সাড়া পেল না। তারপর পুব দিকের একটি ঘর থেকে সাড়া এল, কে?

সে-ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন লতু কাকিমা। দ্বারিককে দেখে তিনি একটিও বাক্য ব্যয় না করে সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ফিরে গিয়ে বেশ শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

দ্বারিক জেল থেকে ফেরবার পর এই লতু কাকিমা একদিন তাকে নেমন্তন্ন করে খাইয়েছিলেন। ওঁর এক ভাই পুলিশে চাকরি করে। বীরভূমে পোস্টেড। গত কয়েক বছরের হাঙ্গামায় সেই ভাইটি যে খুন হয়নি সেই কৃতজ্ঞতাতেই বুঝি তিনি নেমন্তন্ন করেছিলেন দ্বারিককে। আজ একটি কথাও বললেন না।

দ্বারিক রকের ওপর উঠে লীলাবউদির ঘরের দরজা দিয়ে মুখ বাড়ালো, খাটের ওপর দেওয়ালের দিকে ফিরে শুয়ে আছেন লীলাবউদি।

মায়ের কাছে দ্বারিক শুনেছিল যে বিটু নিরুদ্দেশ হওয়ার পর প্রথম দু-তিন দিন লীলাবউদি ঘন ঘন অজ্ঞান হয়ে পড়ছিলেন। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া সম্পর্কে কোনো হুশ ছিল না। উনি নিজে তো কিছু খেতেনই না, ওঁর ছোটোমেয়েটার খাওয়ার ব্যবস্থার কথাও ওবাড়ির কেউ ভাবেনি। দ্বারিকের মা-ই সেদিন জোর করে উনুন ধরিয়ে ওদের জন্য রান্না চাপিয়েছিলেন।

দ্বারিক আজও দেখল, ঘরের দরজার পাশে একটা না-ধরানো উনুন পড়ে আছে।

দ্বারিক আবার জোরে লীলাবউদির নাম ধরে ডাকল!

লীলাবউদি পাশ ফিরে দ্বারিককে দেখে, যেন দারুণ ভয় পেয়ে, হুড়মুড় করে উঠে বসলেন।

দ্বারিকের বুক কাঁপছে। জীবনে কখনো সে এতটা অসহায় বোধ করেনি। সে কীভাবে কথা শুরু করবে? যে লীলাবউদি বাল্যকাল থেকে কত স্নেহ করেছেন দ্বারিককে, তিনি আজ তাকে দেখে ভয় পাচ্ছেন? যদি হঠাৎ চেঁচিয়ে ওঠেন? দ্বারিক কী করে ওঁকে বোঝাবে?

লীলাবউদি, আমি দ্বারিক।

লীলাবউদির বয়েস বছর পঁয়তিরিশ-ছত্রিশের বেশি না, কিন্তু যৌবনের কোনো চিহ্নই আর ওঁর শরীরে নেই। ভাগ্য-বিড়ম্বনায়, দুঃখে, দুশ্চিন্তায় এই রূপহীনা নারীর মুখখানা আরও অসুন্দর হয়ে গেছে।

উনি কাঁদলেন না বা চেঁচিয়ে উঠলেন না। দ্বারিকের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে খুব শান্ত গলায় বললেন, ও দ্বারিক, তুমি এসেছ? আমি ভাবলাম বুঝি কে না কে! বোসসা, এই খাটের ওপরেই বোসসা।

মিনু কোথায়?

কী জানি কোথায় গেছে! কোথায় কোথায় টোটো করে ঘোরে, কিন্তু আমি ওর জন্য চিন্তা করি না। মেয়েসন্তান তো, ওকে যমেও নেবে না।

লীলাবউদি, আমি…

তুমি বোসো দ্বারিক, ভালো হয়ে বোসো। তুমি এসেছ, তোমার সঙ্গে দুটো প্রাণখুলে কথা বলি। সেরকম মানুষ তো আর কেউ নেই এখানে!

ঘরটা বড়ো অন্ধকার হয়ে আছে, জানলা দুটো বন্ধ..খুলে দিই!

না ও জানলা খুললেই বড়দিদির রান্নাঘরের ধোঁয়া এসে ঢোকে।

আপনি এই অসময়ে শুয়ে আছেন…রান্নাবান্না করবেন না? এ-রকমভাবে চললে যে শরীর একেবারে ভেঙে পড়বে!

শোনো দ্বারিক, কত লোক কত কথা বলে গেল, আমি বিশ্বাস করিনি। আমি জানি, তুমি এই গরিব বিধবার ছেলেকে মারবে না।

লীলাবউদি, আমি আপনার পা ছুঁয়ে বলছি।

থাক থাক, পা ছুঁতে হবে না। আমি জানি। তুমি বামুনের ছেলে, আমার পা ছুঁলে যে পরকালেও আমার গতি হবে না। তুমি তোমার মায়ের সন্তান, তুমি আর একজন মায়ের সন্তানকে কক্ষনো কেড়ে নিতে পার না। তোমরা লেখাপড়া জানা ছেলে, দেশের কাজ করতে গিয়েছিলে, তোমরা তো নিরীহ মানুষের ক্ষতি করতে চাওনি কখনো। তা ছাড়া, নরবলি দিলে মাটি থেকে জল বেরোবে, এটা একটা বাজে কথা নয়? বলো?

নিশ্চয়ই!

সেদিন ওরা আমাকে একটা কাটা মুণ্ডু দেখিয়েছিল, আমি জানি, ও আমার বিটু নয়..কিছুই নেই, নাক নেই, চোখ নেই, তবু আমি ঠিক বুঝেছি…নিজের সন্তান…দেখলে ঠিক চেনা যায়!

দূর থেকে লীলাবউদির কান্না আর বার বার অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার কথা শুনে দ্বারিক ভয়ে আসেনি। কিন্তু আজ সে দারুণ অবাক হয়ে গেল। লীলাবউদি সাধারণ স্ত্রীলোক নন, শোকের মধ্যেও তাঁর বিচারবুদ্ধি লোপ হয়ে যায়নি।

হয়তো বিটু বেঁচে নেই।

লীলাবউদি, আমি নিজে ওর খোঁজ করব…যে করে পারি…আজই আমি সদর থানায় যাব। মরেই গেছে বোধ হয়…অকালে কি ছেলে-মেয়েরা মরে না? পৃথিবীতে কি আমিই প্রথম মা এ-রকম পুত্রশোক কি আর কেউ পায়নি? এতদিনেও যখন কোনো খবর দিল না…আমাদের ছেড়ে নিজের ইচ্ছেয় চলে যাবে, সে তো এত স্বার্থপর ছেলে নয়। দ্বারিক, তুমি তাকে ফেল করিয়ে দিয়েছিলে?

আমি? আমি তো শুধু অঙ্কখাতা দেখেছি…অঙ্ক ছাড়া তো আর কিছু পড়াই না আমি।

বিটু অঙ্কেও ফেল করেছে।

খাতায় প্রায় কিছু লেখেইনি..কয়েকটা অঙ্ক কষার চেষ্টা করলেও তার ওপর তবু কিছু নম্বর দেওয়া যায়…কিন্তু খালি খাতায়…অবশ্য অঙ্কে ফেল করেও অনেকে প্রোমোশন পেয়েছে এবার।

পড়াশুনোয় ওর মাথা নেই…পাস করবে কী করে…কে দেখাবে অঙ্ক, কে ইংরেজি পড়াবে…আমার যেটুকু বিদ্যে ছিল, ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়িয়েছিলাম, আর পারি না..আশা করেছিলাম ওই ছেলে লেখাপড়া শিখে দাঁড়াবে, তারপর আমরা এবাড়ি ছেড়ে চলে যাব..কিন্তু কিছুই হল না, আমাদের ফেলে রেখে ও চলে গেল।

ও কেন চলে গেল, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না…এত শান্তশিষ্ট ছেলে—

বড়ো অভিমানী…যাদের অভিমান বেশি থাকে, তারা বেশিদিন বাঁচে না! এবাড়ির লোকেরা যখন আমাদের গালমন্দ করত, যা নয় তাই বলত…বিষ্ণু একদিন আমায় বলেছিল, এ মাগিটার রাক্ষুসির মতন চেহারা…বাড়িতে থাকলেই অমঙ্গল..তখন আমার ছেলে দৌড়ে এসে আমার কান চাপা দিয়ে বলত, মা তুমি ওসব কথা শুনো না…আর খুব কাঁদত। রাত্তিরে আমার পাশে শুয়ে বলত, মা, আমি একটু বড়ো হই, তারপর আমি চাকরি করব তোমাকে আর মিনুকে এখান থেকে নিয়ে যাব, অনেকদূরে এ গাঁয়ে আর আমরা কক্ষনো ফিরব না মা, তখন আর তোমার কোনো দুঃখ থাকবে না…

লীলাবউদির মুখে একটা হিক্কার শব্দ উঠল। এইবার বোধ হয় কান্না শুরু হবে। দ্বারিক সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। ঘরটায় একটা ভ্যাপসা গন্ধ। জানলা দুটো বোধ হয় কোনো সময়ই ভোলা হয় না। একটা কেমন দমচাপা ভাব।

কিন্তু লীলাবউদি কাঁদলেন না। চোখ বুজে রইলেন খানিকক্ষণ। সেই অবস্থায় থেকেই বললেন, সবাইকে নিয়তি মেনে নিতেই হয়, জানি, তবু মন মানে না…যখনই মুখখানা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

দ্বারিক খাট থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, আমার যতদূর সাধ্য, আমি যেকোনো উপায়ে বিটুর একটা খোঁজ বার করবই…একটা চোদ্দো বছরের ছেলে তো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না…

লীলাবউদি চোখ খুললেন না।

আমি এখন যাই! আপনি উঠুন, রান্নাবান্নার কিছু ব্যবস্থা করুন। ঘরে চাল আছে? দ্বারিক, তোমার মা এসে সেদিন আমার বললেন, বউ, ভেবে দেখ তো সেইসব দিনের কথা, যখন আমার দুটো ছেলেই নিরুদ্দেশ…পুলিশ এসে যখন-তখন বাড়ি তছনছ করছে…আমি তাও তো সহ্য করে বেঁচে থেকেছি…তোমার মা সত্যি অনেক কষ্ট পেয়েছেন…কিন্তু তাঁর এক ছেলে ফিরে এসেছে, আর এক ছেলেও ফিরবে…কিন্তু আমার বিটু আর ফিরবে না।

চোখ খুলে লীলাবউদি আবার বললেন, আমি জানি, বিটু আর ফিরবে না!

নিশ্চয়ই ফিরবে, একথা দ্বারিক যতজোর দিয়ে বলতে চেয়েছিল, ততখানি জোর গলায় ফুটল না। মায়ের কাছে তার সন্তান সম্পর্কে মিথ্যে স্তোকবাক্য উচ্চারণ করা সহজ নয়। দ্বারিকের পিঠের ওপরে যেন একটা পাষাণ ভার।

সে নিজের পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দেখছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *