০৮. ডিপটিউব-ওয়েল থেকে সত্যি জল বেরিয়েছে

ডিপটিউব-ওয়েল থেকে সত্যি জল বেরিয়েছে। এখন নালি কাটার কাজ চলছে। সরু সরু নালিগুলো যাবে প্রত্যেকের জমির পাশ দিয়ে, প্রয়োজনের সময় এখান দিয়ে জল যাবে।

দ্বারিক গিয়েছিল জায়গাটা দেখতে। গ্রামের কিছু লোক এখানে সবসময়ই ভিড় করে। থাকে। এটাও ঠিক, এই ডিপটিউবওয়েল বসানো এই গ্রামের পক্ষে একটি বৃহৎ ঘটনা।

যদিও দ্বারিক জানে, এতে লাভ হবে বড়ো বড়ো চাষি আর মহাজনদেরই। জল কিনতে হবে পয়সা দিয়ে। পাম্প চলবে ডিজেল বা পেট্রোলে, একজন লোক রাখতে হবে পাম্প চালাবার জন্য। সরকারের খরচ আছে। সরকার বিনা পয়সায় জল দেবে না। ভাগচাষিদের খরচ বাড়বে। সে পয়সা আগে তুলে নেবে জমির মালিক।

তবু ফসলের পরিমাণ বাড়বে। অনেকেই বলাবলি করছে যে, এ তল্লাটের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এবার। এই হারে যদি উন্নতি হয়, তাহলে মালোপাড়ার লোকগুলোর সারাবছর প্রত্যেকদিন দু-বেলা পেট ভরে খাওয়ার মতন অবস্থা আসতে নিশ্চয়ই লেগে যাবে আরও এক-শো বছর।

দ্বারিক কারুকে ডেকে কথা বলতে পারছে না। চোখাচোখি হলেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অন্যরা। অথবা দূরে যাচ্ছে। কোনো একটা জায়গায় গেলেই বোঝা যায়, সেখানকার লোকরা তাকে পছন্দ করছে কী করছে না। কয়েকদিন থেকে এ-রকম শুরু হয়েছে। অথচ, জেল থেকে ফেরার পর অনেকেই সাগ্রহে তার কাছে গল্প শুনতে আসত। এখন তারা দ্বারিককে ভয় পাচ্ছে? নাকি, বেশি ভয় পেত তখনই।

এক জায়গায় দ্বারিক থমকে গেল। একটা তীব্র বিরক্তি পাক খেয়ে গেল তার শরীরে। খানিকটা জায়গা ছোটো ছোটো পাথরের নুড়ি দিয়ে গোল করে ঘেরা। মাঝখানে একটা বড়োপাথর। তার গায়ে আলকাতরা দিয়ে লেখা, কাজলচন্দ্র সরকারের স্মৃতিতে।

দ্বারিক জানে, লীলাবউদির ছেলে বিটুর ভালো নাম কাজল।

সে মুখ তুলে দেখল, খানিকটা দূরে দশ-বারো জন লাইন করে দাঁড়িয়ে চেয়ে আছে তার দিকে।

দ্বারিক খানিকটা ক্রুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করল, এটা কী?

কেউ কোনো উত্তর দিল না।

দ্বারিকের ইচ্ছে করল, লাথি মেরে সব জিনিসটা ভেঙে দেয়। পরীক্ষায় ফেল করে একটা ছেলে পালিয়ে গেছে, তার সম্পর্কে ভালো করে খোঁজখবর নেওয়া হল না। তার আগেই গ্রামের লোক ছেলেটাকে শহিদ বানিয়ে দিচ্ছে। ওর মা জানতে পারলে কতখানি আঘাত পাবেন! এদের এইসব ব্যাপারে কোনো বোধই নেই। একটু হুজুগ পেলেই হল!

পেছন ফিরে দ্বারিক জোরে জোরে হাঁটতে লাগল আর অমনি হো-ও-ও-করে একটা ব্যঙ্গের হাসির আওয়াজ ভেসে এল লোকগুলোর দিক থেকে। একজন চেঁচিয়ে বলল, এঃ আবার খিটকেলমি দেখো না। জিজ্ঞেস করছে, এটা কী? জানে না যেন।

দ্বারিক ফিরে দাঁড়াল। সে ওদের কাছে যাবে? ঝগড়া করবে? তার খুব রাগ এসে যাচ্ছে। এখন সে বুঝিয়ে কথা বলতে পারবে না।

সে চেঁচিয়ে বলল, এই ব্ৰজেন। এই সুখরঞ্জন, আমি কী খিটকেলমি করলাম?

তোমার সঙ্গে কে কথা বলেছে? আমরা তো তোমাকে কিছু বলিনি!

ঠিক যেন ছেলেমানুষের ঝগড়া। যে লোকটা রিগ চালায়, সে একটা ইটের পাঁজার ওপর বসে বিড়ি টানতে টানতে মজা দেখছে। দ্বারিক বুঝল, এখানে এখন কথা বলার কোনো মানে হয় না।

সে আবার হাঁটতে শুরু করতেই আর একটি মন্তব্য ভেসে এল, ন্যাকাচৈতন! আমরা বাপের জন্মে এতখানি ন্যাকা সাজতে শিখিনি!

দ্বারিক মনে মনে বলল, মাথা গরম করলে চলবে না। বোকাদের ওপর রাগ করে লাভ নেই। পরে ধীরেসুস্থে ওদের বোঝাতে হবে।

গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই প্রচার কাজটা ভালোভাবেই চালাতে পেরেছেন তা হলে। ওঁর কেন এত রাগ আমার ওপর, দ্বারিক ভাবল? এটা বুঝে ওঠা খুব শক্ত। দ্বারিক গোষ্ঠজ্যাঠামশাইকে কখনো অসম্মান দেখায়নি, তবু তিনি দ্বারিককে গ্রাম ছাড়া করতে চান। দ্বারিক বরং ধরেই নিয়েছিল যে মহাদেব সাহা কোনো-না-কোনোভাবে তার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করবে। মহাদেব সাহার কাকা খুন হয়েছিল। সে ব্যাপারে দ্বারিকের কোনো হাতই ছিল না। সে তখন দমদম সেন্ট্রাল জেলে। কিন্তু এটা যেহেতু তাদের পার্টিরই কাজ, সেইজন্যই সে পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে এখন দ্বারিককে ওরা শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

মহাদেব সাহা কিন্তু প্রকাশ্যে সেরকম কোনো ভাবই দেখায় না। দ্বারিকের সঙ্গে দেখা হলেই একগাল হেসে খুব খাতির করে কথাবার্তা বলে। গতকালও দেখা হয়েছিল, অন্যদের মতন মহাদেব সাহা মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, বরং বলেছিল, আমাদের বাড়িতে একবার এসো না? দ্বারিক যায়নি অবশ্য। বাইরে হাসিমুখে থাকলেও মহাদেব সাহা হয়তো ছুরি শানাচ্ছে ভেতরে ভেতরে। এইসব লোককে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না দ্বারিক, অন্য মানুষদের শোষণ করাই যাদের জীবিকা, অথচ তাদের মুখে সবসময় একটা উদার, দয়ালু দয়ালু ভাব মাখানো থাকে। কাকার হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মহাদেব সাহা যে ঠিক কোন দিক দিয়ে আক্রমণ করবে, তা দ্বারিক এখনও বুঝতে পারে না।

অথবা, এমনও হতে পারে, ওর কাকার মৃত্যুতে মহাদেব সাহা খুশিই হয়েছে। পরোক্ষভাবে মহাদেব সাহাকে সাহায্য করেছে দ্বারিকের দল। কাকার সম্পত্তি মহাদেব সাহাই আত্মসাৎ করে নিয়েছে। সেইজন্যই সে দ্বারিককে দেখে হাসে? মহাদেব সাহাকে বাঁচতে দেওয়াটাই ভুল হয়েছিল।

মহাদেব আর গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের স্বার্থ এক নয়। অন্যের জমিজায়গা দখল করার দিকে ঝোঁক নেই গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের। তিনি চান নৈতিক প্রভুত্ব। তাঁর কাছে পাপ-পুণ্যের নিরিখ শুধু ধর্মীয় সংস্কার। উনি চান সে-ব্যাপারে সবাই ওঁর নির্দেশ মেনে চলবে।

গ্রামের মানুষরা যে দ্বারিককে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে এর একটা প্রতিবিধান শিগগিরই করতে হবে তাকে। এটা আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। এ গ্রামে সে একা পড়ে গেছে। কিন্তু সকলকে আবার বোঝানো দরকার যে সে একা নয়, মল্লিকপুরের ছেলেদের নিয়ে আবার দল গড়তে হবে।

স্কুলে গিয়েও দ্বারিককে একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হল। ছেলেরা তার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে। অন্য মাস্টারমশাইরা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে তাকে দেখে।

হেডমাস্টার নিশীথ কর্মকার দ্বারিককে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে। ইনি বহু পুরোনো লোক, দ্বারিকও একসময় এঁর কাছে পড়েছে।

সেসময় স্কুলবাড়িটা ছিল কাঁচা, মাটির ভিত আর দরমার বেড়া। পেনসিল দিয়ে বড়ো ফুটো করা ছিল দ্বারিকের প্রিয় দুষ্টুমি। এই পাঁচ-ছ বছর আগে পাকাবাড়ি হয়েছে, কিন্তু এরই মধ্যে নানা ধরে গেছে দেওয়ালে। বৃষ্টির সময় ছাদ চুইয়ে জল পড়ে। হেডমাস্টারমশাইয়ের পেছনের দেওয়ালটায় জমা জলের ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া দাগ। অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয় দুটো ভালুক লড়াই করছে।

তোমার সম্পর্কে তো একটা বিচ্ছিরি গুজব উঠেছে হে দ্বারিক? তুমি শুনেছ?

এইকথা শুনে উঁচু গলায় হেসে ওঠাই উচিত, কিন্তু দ্বারিক হাসতে পারছে না, তার রাগ এসে যাচ্ছে। শরীরটা দুর্বল বলেই কি তার দ্রুত রাগ বাড়ছে আজকাল?

হ্যাঁ শুনেছি। আমি নরবলি দিয়েছি। আমাদের পাড়ারই একটি ছেলেকে চুরি করে আট দশদিন লুকিয়ে রাখার পর রাতের অন্ধকারে তার মুন্ডু কেটে রক্ত ঢেলে দিয়েছি মাটিতে। যাতে সরকারি কুয়োয় জল আসে!

লোকেরও বলিহারি! কিছু একটা কথা শুনল আর অমনি তাই নিয়ে…মানে, চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে ছোটো চিলের পেছনে! হেঃ! তবে ছেলে চুরির ব্যাপারটা… কয়েকটা ছেলে সত্যিই চুরি হয়েছে শুনলাম।

স্যার, সেটাও গুজব।

সেটা জোর দিয়ে বলা যায় না। তুমি জান না দ্বারিক, কলকাতা শহরে একটা বড়ো গ্যাং আছে, তারা গ্রাম থেকে ছেলে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের হাত-পা কেটে কিংবা চোখ অন্ধ করে তারপর ভিখিরি বানিয়ে দেয়।

কিন্তু থানাতে একটাও ডায়েরি হয়নি। কোনো বাড়ি থেকে কেউ গিয়ে বলেনি যে তাদের বাড়ির ছেলে হারিয়েছে। শুধু লোকের মুখে মুখে ছড়াচ্ছে কথাটা।

লোকে থানায় যায় না, কারণ পুলিশের ওপর কারুর বিশ্বাস নেই! লোকের ধারণা পুলিশও গেরস্তবাড়ির ছেলেদের জোর করে ধরে নিয়ে যায়, কোনো হারানো ছেলেকে ফেরত আনার জন্য পুলিশের মাথাব্যথা নেই। পুলিশ সম্পর্কে তোমারও তো ভালো অভিজ্ঞতা আছে, তুমি একথা মান না?

দ্বারিক বিরক্তভাবে চুপ করে রইল।

কোনো ছেলে চুরি যায়নি বলছ? তোমাদের পাড়ারই তো ছেলেটি, কী নাম যেন, কাজল, হ্যাঁ কাজল সরকার।

ওই একজনকেই শুধু পাওয়া যাচ্ছে না।

কিন্তু একটা নরমুন্ড পাওয়া গেছে।

তার মানে, স্যার আপনিও বলির ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন?

না, না, সে আগেকার দিনে হত, রিলিজিয়াস ফ্যানাটিজম (যা বললেন) ছিল…তোমরা তো ধর্মই মান না।

নিশীথ কর্মকারের দু-হাতে তিনটি আংটি, সোনা, রুপো ও তামার, তিনরকম পাথর বসানো। টেবিলের কাচের নীচে কালীঠাকুরের ছবি।

আমি বলছিলাম কী, দ্বারিক, তুমি বরং বাড়িতে কিছুদিন বিশ্রাম নাও।

কীসের জন্য বিশ্রাম?

মানে, ব্যাপারটা একটু ধামাচাপা পড়ক, লোকে কিছুদিন বাদেই ভুলে যাবে। পাবলিক মেমোরি, জান তো, প্রোভাবালি (যা বললেন) শর্ট।

স্যার, আপনি আমাকে স্কুলে আসতে বারন করছেন?

কিছুদিনের জন্য…দু-এক হপ্তা…তার মধ্যে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।

লোকের কথার ভয়ে আমি বাড়িতে বসে থাকলে…সেটা আমার পক্ষে…তার মানে কি লোকের কথাই মেনে নেওয়া হবে না?

দেখো। স্কুলের অ্যাটেন্সে এ দু-দিনে দারুণ কমে গেছে, ক-জন গার্জিয়ান এসে বলছেন, ছেলেরা ভয় পাচ্ছে।

তা বলে একটা বাজে গুজবকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে?

আমাকে তো সব দিক সামলে চলতে হয়…ছেলেরা যদি দলে দলে ক্লাস কামাই করতে শুরু করে?

দ্বারিক হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে গিয়ে বারান্দা থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল মাঠে। তারপর ছুটতে লাগল।

হেডমাস্টারমশাই নেমে গিয়ে দু-তিনবার চেঁচিয়ে ডাকলেন, দ্বারিক, দ্বারিক।

কিন্তু দ্বারিক আর দাঁড়াল না।

দু-তিন ঘণ্টা মাঠের মধ্যে একটা শিমুল গাছতলায় বসে রইল সে। আর একটুক্ষণ হেডমাস্টার মশাইয়ের সামনে বসে থাকলে সে বোধ হয় একটা কিছু ছুড়ে ওঁকে মেরে বসত। কিন্তু তার মাথা ঠাণ্ডা রাখা দরকার।

মানুষ কী বিচিত্র! কী অদ্ভুত যুক্তিবোধ! এরা বিশ্বাস করছে যে নরবলি দিলে মাটি থেকে জল ওঠে। সেই জলে চাষের উপকার হবে। ধরে নেওয়া যাক, দ্বারিক ওদের উপকারের জন্য একজন মানুষ বলি দিয়েছে। তা সত্ত্বেও ওরা তাকেই ভয় পাচ্ছে কিংবা ঘেন্না করছে?

ওরা কি দ্বারিককে পাগল করে দিতে চায়?

আরও একঘণ্টা সেখানেই ঘুমোলো দ্বারিক। তারপর সন্ধ্যের মুখোমুখি জেগে উঠে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে। তার যদি বাড়ি না থাকত, যদি বাবা-মা কেউ না থাকত, তাহলে দ্বারিক আজই ভেগে পড়ত অন্য দিকে। কিন্তু শুধু বাবা-মা নয়, বীথিও আছে। বীথিকে কী মুখ ফুটে বলা যায়, তুমি চলে যাও!

ফেরার পথে রওনাক আলিপুরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কবরখানাটা তার চোখে পড়ল। কবরখানার চারপাশে পাতলা ইটের দেওয়াল ছিল একসময়। এখন অনেক জায়গাতেই ভেঙে গেছে। ভেতরে আগাছার ঝোপ। কাছাকাছি মনুষ্য বসতি নেই। এখানে শেয়ালের বাসা থাকা খুবই স্বাভাবিক। এখানকার কবর খুঁড়ে শেয়ালেরা একটা মুণ্ডু কেন মোরামডাঙায় নিয়ে যাবে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। দ্বারিক শেয়ালের মনস্তত্ত্ব বিষয়ে কিছুই জানে না।

লীলাবউদি বলেছিলেন, সেই মুন্ডুটা তাঁর ছেলের নয়। কিন্তু সে-কথায় কেউ কোনো গুরুত্ব দেয়নি। যুক্তির তো কোনো প্রশ্ন নেই সেখানে। লোকে একটা গুজবের আমেজ নিয়ে মেতে থাকতে চায়।

কবরখানাটার মধ্যে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল দ্বারিক। কোথাও গর্ত দেখলে নীচু হয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। নিষ্ফল তদন্ত।

একটু পরেই দ্বারিকের খেয়াল হল, কবরখানার মধ্যে তাকে যদি অন্য কেউ এখন দেখে ফেলে, তাহলে হয়তো আবার অন্য কোনো গুজবের জন্ম হবে। অন্ধকারের মধ্যে একা একা কবরখানার মধ্যে ঘুরেবেড়ানো সত্যিই তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। নরবলি সংক্রান্ত ব্যাপারে মুসলমানরা চুপচাপ আছে, এবার যদি তারাও খেপে ওঠে…।

খুব সন্তর্পণে এদিক-ওদিক তাকিয়ে, প্রায় চোরের মতন ভঙ্গিতে দ্বারিক বেরিয়ে এল কবরখানা থেকে।

সেই রাত্তিরেই দ্বারিকদের বাড়িতে আগুন লাগল।

দ্বারিকের বাবা ভুবনই প্রথম চেঁচিয়ে উঠেছিল, কে? কে?

ভুবনের যখন-তখন ঘুম ভেঙে যায়। তাই সে শুনতে পেয়েছিল ফিসফাস কথা। টিনের ক্যানেস্তারার মটাং মটাং শব্দ! ভুবনের চিৎকারে সবাই জেগে ওঠায় ধ্বংস হল না।

দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বাইরে থেকে। দ্বারিক দড়াম দড়াম করে লাথি মেরে দরজা ভাঙার চেষ্টা করছিল, এরমধ্যেই বীথি আবিষ্কার করে ফেলল যে রান্নাঘরের দিকের দরজাটা ওরা বন্ধ করতে ভুলে গেছে। বীথিই প্রথম দৌড়ে বাইরে এসে দেখতে পায় চার-পাঁচজন লোক আমবাগানের ভেতর দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে।

আগুন লাগিয়েছিল বীথির ঘরের দিকে। টিনে করে এনেছিল কেরোসিন। তবে, কাঁচা হাতের কাজ, জানে না কী করে ইটের বাড়িতে আগুন লাগাতে হয়। অথবা ওরা হঠাৎ জেগে ওঠায় সময় পায়নি। দলে চার-পাঁচজন লোক ছিল, তবু ওরা পালিয়ে গেল কেন? দ্বারিকদের সবাইকে বেঁধে আগুনের মধ্যে ফেলে গেলেই তো পারত। ওদেরও তাহলে ভয় আছে। খুব সম্ভবত ওদের ধারণা, দ্বারিকের কাছে এক-আধটা বন্দুক-পিস্তল লুকোনো আছে ঠিকই। দ্বারিকের সামনে আসবার সাহস পায় না।

বীথি আর দ্বারিক মজা পুকুরের নোংরা কাদাভরতি জল-ই বালতি বালতি এনে ঢালতে লাগল বার বার। বীথির ঘরের জানলাটাতেই আগুন ধরে গেছে বেশি। মায়ের চেঁচামেচি শুনে সরকার বাড়ি থেকে ছুটে এসেছে বিষ্ণু, সুরেনরা তিন-চারজন। তাদের চোখে-মুখে সদ্য ঘুমভাঙা চিহ্ন। পুরোনো সংস্কার অনুযায়ী এ সময় অবশ্য তারা কোনো শত্রুতা মনে রাখল না, আগুন নেভাবার জন্য সাহায্য করল যথাসাধ্য।

তবু দ্বারিক বার বার তীক্ষ্ণ চোখে ওদের দিকে চাইছিল। ওরা অভিনয় করছে না তো? ওরাই কি একটু আগে এসে আগুন লাগিয়ে গেছে? তা যদি না হয়, তাহলে যারা ছুটে পালাল, তারা কার লোক, মহাদেব সাহা, না গোষ্ঠ জ্যাঠামশাই-এর? অথবা তৃতীয় কোনো শক্তি তৈরি হয়েছে? দুটো টিন ভরে কেরোসিন এনেছে, এজন্য পয়সা খরচ করতে হয়েছে। কেরোসিন এদিকে সবসময় পাওয়াই যায় না, রীতিমতন দামি জিনিস!

আগুনের তেজ বেশি ছিল না। নিবিয়ে ফেলা গেল কোনোরকমে। বাইরে লোকজন যত জুটেছিল, ফিরে গেল একটু বাদে। বীথির ঘরখানা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বাকি রাতটা তাকে বড়োঘরে মায়ের সঙ্গে শুতে হবে। কিন্তু মায়ের হা-হুতাশ আর কিছুতেই থামছে না। কী সর্বনাশ হল, কারা এই সর্বনাশ করল, এক সুরে এই কথাই বলে যাচ্ছেন বার বার।

দ্বারিক গুম মেরেছিল। একসময় তিক্তভাবে বলল, আঃ, মা চুপ করো! শুধু শুধু মড়াকান্না কেঁদে কী হবে।

এই আগুনের ব্যাপারে দ্বারিকের দু-টি উপলব্ধি হল। আজ তাদের বাড়িতে আগুন না লেগে যদি অন্য কারুর বাড়িতে আগুন লাগত, ধরা যাক, মহাদেব সাহা কিংবা গোষ্ঠ জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে, তাহলে, চেঁচামেচি শুনে দ্বারিকের কি সেখানে যাওয়া উচিত হত? সে আগুন নেভাবার কাজে সাহায্য করতে গেলেও কেউ-না-কেউ বলে উঠতে পারত, দ্বারিকই আগুন লাগিয়েছে। হয়তো তখনই একটা লিনচিং শুরু হয়ে যেতে পারত।

আর শুতে যাওয়ার আগে দ্বারিক দু-একবার ভেবেছিল, বীথিকে বলবে, কয়েকদিনের জন্য বহরমপুর ঘুরে আসতে। কিন্তু আগুন লাগবার ফল হল এই, দ্বারিক সে-কথা আর কিছুতেই বলবে না। বীথি যাবে না, এখানেই থাকবে।

দ্বারিক কিছুতেই হার মানবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *